অটবী সুখ পর্ব-০২

0
652

অটবী সুখ
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

২.
কাল সারারাত জেগে থাকায় ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছে অটবীর। চিনচিন মাথা ব্যথার পাশাপাশি প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। তাকিয়ে থাকা দায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু এখন মোটেও ঘুমানো যাবে না। তাড়াতাড়ি বাসায় পৌঁছাতে হবে। ঘর পুরো এলোমেলো হয়ে আছে। অনেক কাজ বাকি। রেবা বেগমকে ঔষধ খাওয়াতে হবে, দুপুরের রান্নাবান্না সাড়তে হবে, কলেজে যেতে হবে, বিকালে দুটো টিউশনও করাতে হবে— হাহ! মনে মনে ভীষণ উদাসীন হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো অটবী। ইদানিং সবার জন্য সবটা করতে গিয়ে মনে হয়, সে নিজেই হারিয়ে যাচ্ছে। নিজের জন্য অল্প একটু অবসর পাওয়ারও অবকাশ নেই। বাবা থাকতে যদিও এতসব দায়িত্ব পালন করতে হতো না ওর। দিনগুলো রঙিনই ছিল। তারপর তিনবছর আগে বাবা মারা গেলেন। মা অসুস্থ হয়ে পরলেন। এইতো, জীবনের রঙ ফ্যাকাশে হতে হতে ম’রে যাচ্ছে।
জঙ্গলের রাস্তার কাছাকাছি আসতেই রহিম উচ্চস্বরে অটবীকে ডেকে উঠলো, “কি খুকি? এত তাড়াহুড়োয় কোথায় যাচ্ছো? দুই সুন্দরীকে ইস্কুলে দিয়ে আসছো বুঝি?”

প্রশ্ন শুনে অটবী মা’রাত্বক বিরক্ত হলো। নলী আর পৃথাকে দিয়ে আসার সময় রহিম তাদেরকে দেখেছিল। টাকা গুণতে ব্যস্ত থাকায় কিছু বলেনি। এখন এসেছে খোঁচাতে! বিরক্তিভাব চোখেমুখে ফুটিয়ে অটবী বললো, “কেন? আপনি জাননে না?”
রহিমা হলুদ দাঁতগুলো বের করে হাসতে হাসতে বললো, “জানি তো অনেক কিছুই। তা চাচির কি অবস্থা? ত্রিস্তান ভাই যে এত কষ্ট করে ঔষধপাতি কিন্না দিলো, ধন্যবাদ বলছিলা উনারে? তুমি তো আবার আমাদেরকে পছন্দ-টছন্দ করো না। দেখছো আমরা মানুষরে কত উপকার করি?”

না চাইতেও চেহারা বিকৃত করে ফেললো অটবী। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রহিমের অকাজের কথাবার্তা শুনতে বিন্দু মাত্র ইচ্ছা নেই তার। বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নয়তো কথা না বললে পিছু পিছু আসতেও দ্বিধাবোধ করবে না এই ব’খা’টের দল।
অটবী সব প্রশ্নের উত্তর দিলো না। কাঠকাঠ গলায় তাড়া দিয়ে বললো, “মা এখন আগের চেয়ে ভালো আছে, রহিম ভাই। আমার দেড়ি হচ্ছে। আপনার আর কিছু বলার আছে?”
—“ধন্যবাদ যে দিলা না? আচ্ছা থাক, দিতে হবে না। দেড়ি যখন হচ্ছে, যাওগা।”

অটবী দাঁড়ালো না। দ্রুত পা চালিয়ে সামনে এগোতে এগোতে আড়চোখে একবার ওদের সবাইকে দেখে নিলো। সরোজ ওর বয়সী কিছু ছেলে নিয়ে চাদরে বসে তাস খেলছে। কি আনন্দ ছেলেটার চোখেমুখে! পড়া নেই, লেখা নেই সারাদিন বাবার কষ্টের টাকায় ফুর্তি! বাবার হাতে এত মা’র খেয়েছে, তবুও শিক্ষা হয়নি। আচ্ছা, এই ত্রিস্তান ছেলেটা কেমন? সরোজের মতোই? পরিবার ভালো হলেও সঙ্গ দোষে অধঃপতন হয়নি তো? কি জানি! সারাদিন তো এদের সাথেই থাকে। সকালে সিগারেট টানছিল, এখন বাইকে আরাম করে শুয়ে আছে। অটবীর দিকে একবারও তাকায়নি। শূণ্য দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল আকাশপানে। চারিদিকের কোনো ধ্যান, আগ্রহ ছিল না। কি এমন দেখছিল কে জানে! আকাশে দেখার মতো কি আছে? সাদা-নীল রঙ ছাড়া? সাদা শুভ্রতার হলেও, নীল তো বি’ষাদের। বিষা’দই তো বেশি আকাশে। তাকালেই যেন দুনিয়ার চিন্তা, মন খারাপ জেঁকে বসে। এই যেমন ত্রিস্তানের দেখাদেখি অটবী আকাশের দিকে ভুলে তাকিয়ে ছিল। মন ভার হয়ে গেছে। ফিসফিসিয়ে আ’র্তনাদ করছে, “আমি ভালো নেই। আমার একটা ভালো থাকা চাই।”

_____

অটবীর কলেজ সকাল দশটায় শুরু হয়। ঘড়িতে এখন দশটা পঞ্চান্ন মিনিট। প্রায় একঘণ্টা দেড়ি করে ফেলেছে সে। এমনিতেও নানা কাজে কলেজে আসা হয়না। তারওপর যে দুইটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসের জন্য এসেছিল, তার একটা মিস হয়ে গেছে। অটবীর মন খারাপ হলো খুব। টাকার অভাবে সে কোথাও কোচিং করে না। রেগুলার না বলে বন্ধুবান্ধবও নেই। কার থেকে নোট নেবে এখন?
ক্লাসের একদম শেষের ফাঁকা বেঞ্চটায় গিয়ে বসলো অটবী। দ্বিতীয় ক্লাসের স্যার এখনো আসেনি। টেবিলের ওপর দুহাত রেখে, সেখানে থুতনি ঠেকিয়ে সবাইকে দেখতে লাগলো সে। প্রতিবার ভালো নম্বর পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীগুলো প্রথম সারির তিন বেঞ্চ নিয়ে গল্প করছে। সুন্দরী মেয়েদের একটা দল ওয়াইট বোর্ডের সামনে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কি নিয়ে যেন খুব হাসাহাসি করছে। অটবী ওদেরই দেখতে লাগলো। দেখতে দেখতে আঁখিপল্লব কেমন ভারি হয়ে উঠলো হঠাৎই। সারাদিনের ক্লান্তি, হতাশায় জেগে থাকতে সায় দিলো না আরামপ্রিয় শরীর। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পরলো।

অটবীর ঘুম ভেঙ্গেছে তীব্র হাসাহাসির শব্দে। অটবী প্রথমে বুঝতে পারেনি। পরে যখন দেখলো, স্যারসহ ক্লাসের বাকি সবাই তার দিকে তাকিয়েই হাসছে, তখন বুঝতে পারলো ওদের সবার হাসির উৎস সে-ই। অটবী লজ্জা পেল। মাথা নিচু করে ফেলতেই স্যার রসিকতার সুরে বললেন, “কি মেয়ে? রাতে কি না ঘুমিয়ে চুরি-টুরি করো নাকি? ক্লাসেও তো রেগুলার না মনেহয়। এতই যখন ঘুমাতে ইচ্ছে করে তাহলে কলেজ আসো কেন?”

বাবার মৃ’ত্যু’র পর অটবীকে কেউ কথায় কথায় কাঁদতে দেখেনি। সে সামান্য কথায় কাঁদে না। কিন্তু সবার এই তাচ্ছিল্য দৃষ্টি, অবজ্ঞা ভেতর থেকে মিইয়ে দিলো অটবীকে। অশ্রুতে টলমল করে উঠলো মায়াবী চোখ। পুরোটা ক্লাস অটবী মাথা নিচু করে রাখলো। কোনোমতে ক্লাসটা করেই বেরিয়ে পরলো কলেজ থেকে। বাসে উঠেও তার মন খারাপ বাড়লো বৈ কমলো না। একটা সীটও খালি নেই। উপরন্তু ভীড়ের মাঝে কে যেন বাজে স্পর্শ করেছে তাকে। ভীষণ বাজে স্পর্শ। অটবী নিজেকে খুব কষ্টে আটকে রেখেছিল। এলাকায় ঢুকতেই হু হু শব্দে কেঁদে ফেললো। সেই কান্না শোনার কেউ নেই, দেখার কেউ নেই। নির্জন রাস্তায় শুধু সে এবং একমাত্র সে-ই।

—“এভাবে কাঁদছো কেন?”
আচমকা ভরাট কণ্ঠে কেউ বলে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে কান্না থামিয়ে চমকে উঠলো অটবী। সামনে ত্রিস্তান দাঁড়িয়ে আছে। হাতে সামনের হোটেল থেকে আনা নাস্তার প্যাকেট। সে আবার বললো, “কি হয়েছে?”
অটবী উত্তর দিলো না। চোখ বড় বড় করে চেয়েই রইলো ত্রিস্তানের দিকে। বিমূঢ় গলায় শুধালো, “আপনার নাক থেকে রক্ত পরছে।”
—“হু?”

অস্ফুট শব্দ করে পরপরই অটবীর দিকে পিঠ দেখিয়ে দাঁড়ালো ত্রিস্তান। ঝটপট নাকে হাত দিয়ে দেখলো, বাম নাক থেকে রক্ত ঝরছে। সে রক্তটা হাত দিয়েই মুছে ফেললো।
অটবী ততক্ষণে কাছে এগিয়ে এসেছে, “আপনার নাক থেকে রক্ত পরছে কেন? আপনি ঠিক আছেন?”
—“আছি।”
—“আপনার ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।”
—“তেমন সিরিয়াস কিছু না। যেতে হবে না।”

এখন কি বলা উচিত? কোনো কথা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অটবী কয়েক সেকেন্ড ত্রিস্তানের দিকে তাকিয়ে চলে যেতে চাইলো। তার পূর্বেই ত্রিস্তান জিজ্ঞেস করলো, “আমার নাম জানো?”
থতমত খেয়ে অটবীর উত্তর, “হ্যাঁ।”
—“আমার নামের অর্থ জানো?”

অটবী এবার মাথা নাড়ালো। জানে না। ত্রিস্তান হাসলো মৃদু। গাঢ়, দৃঢ় কণ্ঠস্বরে বললো, “দুঃখ। ত্রিস্তান অর্থ দুঃখ।”

অটবী নির্লিপ্ত। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেললো মাত্র। সে এই নামের অর্থ জানে না ঠিক। অন্য কেউ হলে হয়তো অবাক হতো। কিন্তু তার মনে প্রশ্ন জাগছে। নামের এমন অদ্ভুত অর্থ জেনেও এই নাম কেন রেখেছে? ত্রিস্তানই-বা হঠাৎ একথা দিয়ে কি বোঝাতে চাইছে? অটবী বোঝেনি। জিজ্ঞাসু নয়নে চেয়েই আছে। ত্রিস্তান আবারও হাসলো। প্রশস্ত হাসি। ছেলেটাকে হাসলে আরও সুন্দর লাগে। চলে যেতে যেতে বললো, “এভাবে কাঁদবে না কখনো। অরণ্য কাঁদে না, নিজ গভীরতায় হাজারটা রহস্য পৃথিবী থেকে লুকিয়ে রাখে।”

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে