#অচেনা_মানুষের_মাঝে
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৯(শেষ_পর্ব)
সামান্তা আনমনেই বলে উঠলো
“জানেন এই বৃষ্টি যখনই এসেছে তখনই আর জীবনের উঠাপড়া নিয়েই এসেছে। কেন যেন যতবার বৃষ্টিকে ভালো বলতে চাই আমার চোখের পানি রূপে সে আমার সামনে আসে।”
আয়ান তাকালো সামান্তার দিকে পরপর কয়েকটি তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল “হয় তো তোমার জীবনকে নতুন ও সতেজ করতে বৃষ্টি আসে। হয় তো জীবনটাকে আবার নতুন করে শুরু করার জন্য বৃষ্টিটা আসে। যাই বলো আর তাই বলো এই বৃষ্টির কারণে আমি আমার ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছিলাম। স্নিগ্ধ মুখের এক কিশোরীর গভীর মায়ায় আমি পড়েছিলাম। পড়েছিলাম তার চঞ্চল গভীর চোখ দুটোর প্রেমে। গোলাপের পাঁপড়ির ন্যায় ঠোঁট দুটোর কাঁপাকাঁপি প্রেমে পড়েছিলাম। ঘন কালো কেশের প্রেমে পড়েছিলাম। বৃষ্টিমুখর পরিবেশে সে যেন ছিল এক ফুটন্ত গোলাপ। যার সৌন্দর্য অপূর্ব। কিন্তু আর যে ছিল গোলাপের ন্যায় কাটা। কারণ আমি যে তাকে দেখার পর থেকে অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। সে যে আমার ঘুমহীন রাতে একমাএ কারণ। হ্যাঁ আমি তাকে ভালোবাসি। পারিনি আমি তার মায়া ত্যাগ করতে। প্রতিনিয়ত তার মায়াবী মুখ আমায় এক অসম্ভব অস্থিরতা অনুভব করায়। আমার এই হৃদয় যে অপূর্ণ সেই বৃষ্টি মাখা কিশোরী ছাড়া। আমি চাই তাকে নিজের বুকে আকড়ে বাঁচতে। আমি চাই তার সঙ্গে বৃষ্টির স্নিগ্ধতা উপভোগ করতে। আমি খুব খুব করে চাই তাকে। আমি চাই সে বৃষ্টি হয়ে আসুক আমার জীবনে। আমি তার স্নিগ্ধতার অতল গভীরে হারিয়ে যেতে চাই বহুদূর।”
আয়ানের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সামান্তা। সামান্তা আর কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পাড়লো না বলেই ফেলল “আপনি কি আপনার মনের কথা বলেছেন তাকে!”
আয়ান হাসলো। আয়ানের হাসিটা কেমন যেন অদ্ভুত ছিল। আয়ান মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকালো সামান্তার দিকে। সামান্তা আজ এক অন্যরকম মায়া খুজেঁ পেল আয়ানের চোখে। আয়ান বলল “হুম বলেছি”
সামান্তা এবার গালে হাত রেখে অবাক চোখে আয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল “সে কি বলল!”
আয়ান আবারও শান্ত কন্ঠে বলল “কিছু বলেনি।”
সামান্তা ভাবুক হয়ে বলল “কেন বলেনি কিছু। আর কে সে? আমাকে দেখাবেন?”
আয়ান চোখ বন্ধ করে নিলো। কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল “যদি বলি সেই মানুষ আর কেউ না তুমি।”
আয়ানের এমন উত্তর শুনে হতভম্ব হয়ে গেছে সামান্তা। বাকশক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে। ইতিমধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। সামান্তা উঠে দৌড়ে চলে যেতে নিবে তখনই আয়ান শক্ত হাতে ধরে ফেলে সামান্তাকে।
আয়ান বসা থেকে দাড়িয়ে পড়লো। সামান্তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। আলতো হাতে সামান্তার গালে হাত রাখলো আয়ান। নেশালো কন্ঠে বলল “আমি আর পারছিনা। প্রেমের দহনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি দিনদিন। আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো। কেন এতো দ্বিধা বলো তো।”
সামান্তা ফুপিয়ে উঠলো আর বলল “কিন্তু আমি তো ডিভোর্সী। সমাজে আমি কলঙ্কনী নারী।”
আয়ান সামান্তার ঠোঁটে হাত রেখে চুপ করিয়ে দিলো। আর বলল “সারাজীবন সংসার আমি করবো সমাজ করবেনা। একবেলার খাবার যখন সমাজ দেয়না তখন কোনো কথা বলার অধিকারও সমাজের নেই। তুমি আজও আমার নিকট আগের ন্যায় স্নিগ্ধ আর পবিত্র। সদ্য ফোঁটা গোলাপের মতো বুঝলে পাগলী।”
আয়ানের কথায় কেঁদে দিলো সামান্তা। আয়ান তার উষ্ণ ঠোঁটে ছোয়ালো সামান্তার কপালে। এই অবস্থায় ওর যে কতক্ষণ ছিল না। ওদের এই অপূর্ব মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে আছে স্নিগ্ধ বাতাস আর বৃষ্টি।
হঠাৎ সামান্তার হাচি পড়ায় হুশ ফিরলো ওদের। দুইজনই ভিজে গেছে। আয়ান আর কিছু না ভেবে সামান্তাকে কোলে নিয়ে হাঁটা দিলো। সামান্তা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আয়ানের দিকে। বৃষ্টিতে ভিজলে যে ছেলেদের এতটা সুন্দর লাগে তা জানা ছিল না সামান্তা। আয়ানের এলোমেলো চুলগুলো পড়ে আছে কপালে যা থেকে টুপ টুপ করে পানি বেয়ে পড়ছে। সামান্তা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে।
আয়ান বাঁকা হেসে বলল “কি মেডাম! এমন করে তাকিয়ে আছেন কেন আমার বুঝি অসস্থি হয় না।”
আয়ানের কথায় লজ্জা পেল সামান্তা। লজ্জায় মুখ গুজলো আয়ানের বুকে।
————-
কেটে গেছে তিনটা দিন। আয়ানের মা বাবা চলে এসেছে গ্রাম থেকে। আয়ান আর সামান্তার সম্পর্কও ভালো চলছে। কেউ সামান্তাকে নিয়ে খারাপ কথা বলতে নিলে তিথি রাশেদ কিংবা আয়ান থামিয়ে দেয়। আয়ান সকাল সকাল রেডি হয়ে চলে গেছে রাজুর সেই পুলিশ বন্ধু ফাহিমের সঙ্গে দেখা করতে। সামনের একটা কফিশপে বসে আছে দুইজন। আয়ান বলল “কিছু কি খবর পেলেন লামিয়া বেগমের ব্যপারে।”
ফাহিম হেসে বলল “হুম পেয়েছি। আর আপনি বলো না তুমিই বলো।”
আয়ান হেসে বলল “আচ্ছা ঠিক আছে। এখন বলো কি তথ্য পেলে!”
ফাহিম ধোয়া উঠা কফিটা খেতে খেতে বলল “মহিলা অনেক খারাপ। বিদেশে তার বিভিন্ন নেশাদ্রবের ব্যবসা আছে। আর সে দেখানোর এখানে আলতাফ হোসেন অর্থাৎ সামান্তার বাবার বিজনেস চালাচ্ছেন। সন্দেহ মিলে গিয়েছে সামান্তার মা রাইমা বেগমকে লামিয়া বেগম মেরেছেন এটার প্রমাণ পেয়েছি। আর নারী ও শিশু নির্যাতনে মামলা তো আছেই।”
আয়ান মুচকি হাসলো। কফি খেতে খেতে বলল “তা শাস্তি কি মৃত্যুদণ্ড হবে?”
ফাহিম বলল “হুম উনি খুন করেছেন।”
আয়ান এক অদ্ভুত হাসি দিয়ে বলল “তা তাকে ধরছেন কবে?”
ফাহিম দাড়িয়ে পড়লো। আর বলল “যাচ্ছি এখন। তোমাকে জানানো দরকার ছিল তাই জানালাম।”
আয়ান দাড়িয়ে হাত মেলালো।
সামান্তা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে। টিভিতে লামিয়া বেগমকে জেলে নিয়ে যাচ্ছে। সেটাই দেখাচ্ছে। সামান্তা অবাক হয়ে দেখছে। তখনই আয়ান এলো। আয়ান ঝট করে সামান্তার হাত ধরে বাহিরে নিয়ে যেতে লাগলো। তিথি বলে উঠলো “কিরে ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”
আয়ান যেতে যেতে বলে উঠলো “কাজী অফিস,বিয়ে করতে।”
আয়ানের কথায় তিথি চোখ কপালে তুলে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওদের যাওয়ার দিকে। পরক্ষণেই মুচকি হাসলো।
সামান্তাও হা হয়ে আছে আয়ানের কথায়। আয়ান নিজের গাড়িতে সামান্তা উঠিয়ে নিজেও উঠলো। সামান্তা এখনো হা করেই আছে দেখে আয়ান বলল “মুখে মশা যাবে কিন্তু ”
আয়ানে কথায় সামান্তা মুখ বন্ধ করলো কিন্তু অবাক চোখে তাকিয়ে কিছু বলতে নিবে তখনই আয়ান বলে উঠলো “কোনো কথা না শুধু দেখে যাও আর গাড়ির পিছনের সিটে তোমার ডায়েরি আছে। আজকের কথাও না হয় লিখবে। ভালোবাসার পরিণতিটা লিখবে।”
সামান্তা পিছনে তাকিয়ে লজ্জা পেয়ে গেল। কারণ সেই ডায়েরিতে সে আয়ানকে নিয়ে তার মনে ভিতরের অনুভূতি প্রকাশ করেছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তার কাজী অফিসে পৌঁছে গেল। আজ সামান্তা সাদা রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পড়েছিল। আয়ানও সাদা শার্ট আর কালো জিন্স পড়েছে। আয়ান নিজের মুখটা একটু নিচে নামিয়ে সামান্তার কানের কাছে এসে বলল “সবাই তো লাল রঙ দিয়ে দিনটা কাটায়। আমরা না স্নিগ্ধ আর শান্তিপূর্ণ সাদা রঙ দিয়েই শুরু করি। আয়ানের কথা মুচকি হাসলো সামান্তা। যাতে ছিল একরাশ প্রশান্তি। আয়ান মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইলো সামান্তার দিকে।
বিয়ের সকল কাজ সম্পূর্ণ করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সামান্তাকে গাড়িতে বসিয়ে কিছু দরকারি কাজ আছে বলে আয়ান একটু দূরে গেল। কল করলো আয়েশা বেগমকে। আয়েশা বেগম কল রিসিভ করতে আয়ান বলল “আম্মু আমি সামান্তাকে বিয়ে করে নিয়েছি।”
ছেলের মুখে এমন কথা শুনে থমকে গেল আয়েশা বেগম। আয়ান আবার বলল “আম্মু আমি জানি তুমি ওকে পছন্দ করোনা। তাই তো তুমি আমাকে মামার কাছে পাঠিয়ে সামান্তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য লামিয়া বেগমের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলে। আমি চাই না এটা আর কেউ জানুক। আম্মু ও আমার প্রাণ। আমি ওকে অনেক ভালোবাসি। তুমি যদি ওকে মেনে নিতে না পারো তাহলে বলে দেও আমি ওকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো।” ছেলের কথায় ফুপিয়ে উঠলেন আয়েশা বেগম আর বললেন “না বাবা তুই আমার কাছে ফিরে আয়। আমি মেনে নিবো সব।” আয়ান মুচকি হেসে কল কেটে দিলো। পাশের দোকান থেকে গোলাপ ফুলের গুচ্ছ আর বেলিফুল আর বকুল ফুলের মালা নিয়ে গাড়ির কাছে গেল।
গোলাপ ফুলটা সামান্তা হাতে দিলো। আলতো হাতে বেলিফুলের মালাটা পড়িয়ে দিলো ওর হাতে। আর খোপায় পড়িয়ে দিলো বকুল ফুলের মালা। মুচকি হেসে সামান্তার হাত ধরে বলল
“অচেনা থেকে আজ তুমি আমার প্রিয় মানুষ। যাকে ছাড়া আমি অচল।” বলেই ঠোঁট স্পর্শ করলো সামান্তার কপালে। সামান্তা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আয়ানকে। আয়ানও জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।
ভালো থাকুক ভালোবাসা।❤
#সমাপ্ত