#অচেনা_মানুষের_মাঝে
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৭
আয়ানের কথায় সবাই চলে গেল। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও তিথি চলে গেল রাশেদের সঙ্গে।
আয়ান পরপর কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সামান্তার মুখটা নিজের বুক থেকে তুলে চোখের পানি মুছিয়ে দিলো। দুধ আর সুপটা যত্ন সহকারে নিজের হাতে খাইয়ে দিলো। সামান্তা টু শব্দ টুকুও করলো না। বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নিলো।
আয়ান খাওয়ানো শেষে সামান্তাকে কোলে নিয়ে রওনা হলো সামান্তার রুমের দিকে। সামান্তাকে বেডে বসিয়ে দিয়ে নিজেও ওর পাশে বসলো। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল “কে করেছে তোর এই অবস্থা!”
সামান্তার চোখ স্থির জানালার বাহিরে “আমি মুক্তি চাই। আমাকে মুক্তি এনে দেবেন।”
সামান্তার কথায় কপালে ভাঁজ পড়লো আয়ানের। সামান্তা বলল
“ফারাবির আসলে পরিচয় কি জানেন?”
আয়ান চোখ ছোট ছোট করে বলল “আসল পরিচয় মানে!”
সামান্তা পরপর কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল “লামিয়া বেগম অর্থাৎ আমার খালা বর্তমানে আমার সৎ মা তার প্রথম পক্ষের ছেলে।”
আয়ান অবাকের চরম পর্যায় গিয়ে বলল “কিহ!”
সামান্তা চোখ বন্ধ করে বালিশে হেলান দিয়ে বলা শুরু করলো
” আমার মায়ের অনেকটা সম্পত্তি ছিল। বড় ও বাবার বাধ্য মেয়ে থাকায় লামিয়া বেগমের থেকে আমার মায়ের সম্পত্তির ভাগ বেশি ছিল। আর আমার মায়ের মৃত্যুর পর সেই সব সম্পত্তি আমার নামে চলে আসে। আমার সম্পত্তি নিজের করার জন্য লামিয়া বেগম নানা পরিকল্পনা করতে থাকে। তখন তার প্রথম পক্ষের ছেলে ফারাবির কথা মনে পড়ে। ফারাবিকে সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে আমাকে বিয়ে করার জন্য রাজি করায়। কিন্তু ফারাবির বিয়ে করা বউ ছিল। ফারাবিদের আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকায় সেই বউকে গ্রামে রেখে এসে আমাকে বিয়ে করে। আমি ও কি বোকা মনে করেছিলাম হয় তো খালা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর আর কিছু করবেনা। কিন্তু সে আমার জীবনটাই শেষ করে দিলো। আমি সবকিছু জানতে পারি বিয়ের একমাসের মাথায়। তখনই আমি সেখান থেকে চলে আসতে চাই। কিন্তু তারা আমায় আসতে দেয়নি। এই বাড়ি থেকে ফোন গেলে ফারাবির শেখানো কথা আমাকে বলতে হতো। তাছাড়া সাতদিন খাওয়া বন্ধ করে দিতো। এরপর ফারাবি কথায় কথায় আমাকে নানাভাবে মারতে লাগল। আর প্রতিদিন সম্পত্তির পেপার নিয়ে আসতো সাইন করানোর জন্য। কিন্তু ওইটুকুই আমার মায়ের শেষ চিহ্ন ছিলো। আমি যখনই সাইন করতে চাইতাম না তখনই মারতো। এই বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল সব সাজানো লোক নিয়ে। আমার জন্মদাতা পিতা গত হয়েছে আরো তিনবছর আগে। এমনকি লামিয়া বেগম আমার মাকেও খুন করেছে।”
বলতে গিয়েই কথা গলায় আটকে গেল সামান্তার। সামান্তার বুকটা নিজের বুকে আকড়ে ধরলো আয়ান। সামান্তা আয়ানের বুকে মাথা রেখেই বলল “জানেন আপনাকে বিদেশ পাঠানোও তাদেরই পরিকল্পনা ছিল। আপনি থাকলে হয় তো এমনটা হতো না। আজ আর একটু হলে আমি মরেই যেতাম। কোনো রকম ভাবে পালিয়ে এসেছি। আমি আর পারছিনা জানেন।”
আয়ান আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সামান্তাকে। সামান্তাও মুখ গুজে রইলো আয়ানের বুকে। আয়ান সামান্তার মাথায় হাত বোলাতে লাগল আলতো হাতে। আর ভাবতে লাগল মানুষ এতোটা খারাপ কি করে হতে পারে। কি হতো যদি একটু শান্তি দিলে এই মেয়েটাকে। তখনই তার মনে খটকা লাগল। সে সেইবার বিদেশ গিয়েছিল তার মা আয়েশা বেগমের কথায়। তার কথা মতে তার ভাই অসুস্থ ছিল বলে আয়ান যেন তাকে একটু দেখতে যায়। আয়ানও না ভেবে চলে যায়। কিন্তু যখন সে তার মামার কাছে পৌছায় তেমন কিছুই ছিল না। তার মামা অসুস্থ ছিলোই না। পরে এই বিষয়ে জিঙ্গাসা করলে তাকে বলা হয় যে আয়ান অনেকদিন তাদের সঙ্গে দেখা করেনি বলে তাকে এই কথা বলে পাঠানো হয়। কিন্তু পরে যখন সে দেশে ফিরে আসে তখন শোনে সামান্তার বিয়ে হয়ে গেছে। এটা নিয়ে সে খুব ঝামেলা ও রাগারাগীও করে। কিন্তু সবাই খুশি ও ভালো আছে ভেবে আর কিছু বলেনি।
আয়ান আর ভাবতে পারছে না। মাথা ব্যথা করছে তার। আয়ান খেয়াল করলো সামান্তা ঘুমিয়ে পড়েছে। অবশ্য ঘুমানোরই কথা। ঘুমের ঔষধ দিয়েছে যে আয়ান। এখন মেয়েটার একটু রেস্টের প্রয়োজন। আয়ান সামান্তাকে শুয়ে দিয়ে কম্বল টেনে দেয় ওর গায়ে। রক্ত মাখা জামা চেন্স করিয়ে গেছে একজন সার্ভেন্ট। আয়ান আলতো করে ঠোঁটে ছোঁয়ায় সামান্তার কপালে। সামান্তা ঘুমের মধ্যেই কেঁপে উঠে। আয়ান মুচকি হাসে আর বিরবির করে বলে “আর কষ্ট পেতে দিবো না তোমায়। জীবন দিয়ে হলেও তোমার ঠোঁটে হাসি ফোটাবো সবসময়।”
বলেই আয়ান রওনা হয় নিজের রুমের দিকে। চারপাশে ফজরের আযান দিচ্ছে। আয়ান ঝটপট একটা শাওয়ার নিয়ে নেয়। মনটাকে যে শান্ত করা যে প্রয়োজন হয়ে দাড়িয়েছে। শাওয়ার শেষে নামাজ পড়ে নেয় সে। মনের অস্থিরতা এখন অনেকটাই কমেছে। নিজেই এক মগ কফি বানিয়ে হাতে নিয়ে দাড়ায় তার রুমের সঙ্গে লাগানো বারান্দাটায়। কফির মগ থেকে কফি খাচ্ছে আর সকাল হওয়া দেখছে আয়ান।
—————-
সকালে নাস্তার টেবিলে সবাই আছে সামান্তা, রেদওয়ান, আর আরাফ ছাড়া। আরাফ আর রেদওয়ান স্কুলে চলে গেছে আরও সকালে। আয়ান খাওয়ার মাঝেই বলে উঠলো “সামান্তা ফারাবিকে ডিভোর্স দিবে। আমি আজকের মধ্যেই ব্যবস্থা করবো। আমার বন্ধু আছে উকিল। সমস্যা হবেনা কোনো কথা হয়ে ওর সঙ্গে।”
আয়ানের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়েশা বেগম উত্তেজিত হয়ে বলল “এই সামন্য কারণে ডিভোর্স এটা কেমন কথা।”
আয়ান এবার খাওয়া বাদ দিয়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো আয়েশা বেগমের দিকে। আয়ান কিছু বলতে নিবে তখনই তিথি বলে উঠলো “সামান্য বিষয় হয় কিভাবে ভাবি! কাল মেয়েটা কি অবস্থায় বাসায় এসেছে তুমি দেখেও কিভাবে বলছো যে সামান্য বিষয়।”
রাশেদ কথার মাঝে বলে উঠলো ” তিথি তুমি চুপ করো আর ভাবি আমার মেয়েকে আমি বোঝা মনে করিনা। আয়ান তোর সিদ্ধান্তে আমি রাজি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবস্থা কর।”
আজিজ সাহেব চুপ করেই আছেন। খাওয়া শেষে সবাই উঠে পড়লো। আয়ান তিথিকে বলল “ছোট আম্মু সামান্তা ঘুম থেকে উঠলে ওকে খাইয়ে দিও। আর ঔষধ আছে আমি লিখে দিয়েছি ওগুলো খাইয়ে দিও।”
বলেই চলে গেল আয়ান নিজের রুমের দিকে। রেডি হয়ে নিলো আয়ান এখন সে যাবে তার উকিল বন্ধু রাজুর কাছে আজকে রাতের মধ্যেই সে ডিভোর্স পেপার পাঠাবে ফারাবিকে যে করেই হোক। আয়ান আজ গাড়ি নিবেনা তাই নিজের বাইকের চাবিটা নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে রুম থেকে বের হলো। নিচেই যাচ্ছিল তখন কিছু কথা শুনে আটকে গেল আয়ান। কথাগুলো শুনে বাঁকা হাসলো সে। আয়ান তার মতো চলে গেল।
————————-
আয়ান বসে আছে একটা কফিশপে সঙ্গে রাজুও বসে আছে। আয়ানের কথামতো খুব দ্রুত ডিভোর্স পেপার বানিয়ে দিয়েছে রাজু। আয়ান মুচকি হেসে ডিভোর্স পেপার হাতে নিয়ে বলল “তোর চেনা পুলিশ অফিসারকে আমার কথা মতো সব বলেছিস।”
রাজু ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল “হুম বলেছি।”
আয়ান সেখান থেকে বেড়িয়ে পড়লো। আগে ডিভোর্স পেপারটা ফারাবিকে পাঠিয়ে দিলো। এখন সে যাবে লামিয়া বেগমের অফিসে। শার্টটা ঝাড়া দিয়ে চোখের সানগ্লাসটা ঠিক করে উঠে পড়লো বাইকে। প্রায় পনেরো মিনিট পর আয়ান পৌঁছে গেল লামিয়া বেগমের অফিসে।
———-
অন্যদিকে সামান্তার ঘুম ভাঙতেই সে তার হাতের অসহ্য ব্যথায় আহ করে উঠলো। তিথি এগিয়ে এলো সামান্তার কাছে। তিথি সামান্তার রুমের বারান্দায় অপেক্ষা করছিল সামান্তার ঘুম ভাঙার জন্য। তিথি অস্থির হয়ে বলল “কি হয়েছে!”
#চলবে
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)