#অচেনা_মানুষের_মাঝে
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৬
সামান্তা তিথির চুল বেঁধে দেওয়ার পর তিথিও সামান্তার চুল বেঁধে দিলো।
পরেরদিন,
সকালবেলার নাস্তা করে আয়ান আর সামান্তা বেড়িয়ে সামান্তাকে নতুন স্কুলে ভর্তি করার উদ্দেশ্যে। আয়ান সাদা শার্ট আর কালো জিন্স পড়েছে। আর তিথি একটা আকাশি রঙের টপস আর সাদা রঙের জিন্স পড়েছে। তিথি তার ঘন কালো চুলগুলোকে দুই বেণী করে দিয়েছে। গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে। আয়ান নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করছে। সামান্তা তার পাশের সিটেই বসে আছে। তার দৃষ্টি বাহিরের দিকে। আয়ান ড্রাইভিং করতে করতেই বলল
“তোমাকে তো আরো পিচ্চি পিচ্চি লাগছে।”
আয়ানের কথায় কপালে ভাঁজ ফেলে সামান্তা তাকালো আয়ানের দিকে। আয়ানের দৃষ্টি সামনের দিকে। আয়ান বাঁকা হাসলো। আর বলল “তুমি এতো চুপচাপ কেন!”
আয়ানের কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি ফুঁটে উঠলো সামান্তার ঠোঁটে। যা আয়ানের চোখ এড়ানো গেল না। আয়ান বুঝতে পারল যে সামান্তা এখন কথা বলতে চাচ্ছে না। তাই সেও আর কথা বাড়ালো না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেল স্কুলে। গাড়ি থেকে নামতেই আয়ান রওনা হলো হেড টিচারের রুমের দিকে। আর পিছু পিছু যেতে লাগল সামান্তা। সামান্তাকে ভর্তি করতে কোনো সমস্যা হলো না। কারণ হেড টিচারকে অনেক আগে থেকেই চিনে আয়ান। আয়ান ভর্তির সব কাজ শেষ করে সামান্তাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে চলে গেল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
সামান্তা ফুস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভিতরের দিকে রওনা হলো। কলিংবেল বাজাতেই একজন সার্ভেন্ট এসে দরজা খুলে দিলো। সামান্তাও চুপচাপ মাথা নিচু করে রুমের দিকে যাচ্ছিল। তখনি কিছু কথা শুনে তার পা আটকে গেল।
আয়ানের মা আর পাশের বাসার এক মহিলা বসে গল্প করছিল সোফার রুমে। সামান্তা সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সেই মহিলা বলে উঠলেন “ভাবি এমন মেয়ে খুব চালাক হয়। চেহারায় মায়া দেখিয়ে ভালভালাই করে সব নিজের হাতে নেয়। একটু দেখে শুনে থাইকেন কিন্তু ভাবি। বলা তো যায় দিনকাল তেমন ভালো না।”
আয়েশা বেগম মুখে পান গুজে বললেন “তা কিছু ভুল বলেননি ভাবি।”
সামান্তার চোখ বেয়ে দু ফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পরল। তখন কিছু নাস্তা সোফার টেবিলে রেখে তিথি বলল
“যার মনমানসিকতা ভালো সে ভালো চিন্তা করে আর যার খারাপ, সে যাইহোক নাস্তাটা খেয়ে যাবে ভাবি। আর আমার মেয়ে কেমন আমি বুঝে নিবো। আপনাকে এতো কষ্ট করে ভাবতে হবে না।”
কথাগুলো বলে হনহন পায়ে সামান্তাকে নিয়ে চলে গেল তিথি। সামান্তাকে ওর ঘরে এনে বেডে বসিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে তিথি বলল “কুকুরের ঘেউঘেউ কে পাত্তা দিসনা। এখন বল তো স্কুল কেমন লাগল।”
সামান্তা কিছু বলতে নিবে তার আগেই একজন সার্ভেন্ট এসে নতুন বউ রেখে গেল সামান্তার রুমে। নতুন বই দেখে চোখ মুখ চিকচিক করে উঠলো সামান্তার। সে তিথির দিকে তাকালো। তিথি মুচকি হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। সামান্তাও মুচকি হাসলো আর বলল
” অনেক সুন্দর স্কুলটা। আমার অনেক ভালো লেগেছে।”
তিথি বলল “ভালো হলেই ভালো। এখন যাহ ফ্রেশ হয়ে আয়। রেদওয়ান তোকে খুঁজছিল।”
সামান্তা বলল “ও কোথায়?”
তিথি হেসে বলল “ও আর কোথায় আরাফের রুমে। দুইজনের বেশ জমেছে।”
সামান্তা হাসলো।
————————–
কেটে গেছে পাঁচবছর। সামান্তা এখন অনার্স পড়ে। রেদওয়ানও বড় হয়েছে। সবকিছুর পরিবর্তন হয়েছে। তবে আয়ানের মা আর সামান্তার সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন হয়নি। আয়েশা বেগম এখনো দেখতে পারেনা সামান্তাকে। এতে সামান্তা তেমন একটা পাত্তা দেয়না। আরাফ আর রেদওয়ান একই স্কুলে পড়াশোনা করে। শুধু ক্লাস আলাদা। ভালোই চলছিল ওদের দিনগুলো। সামান্তা সবার আসল পরিচয় ও জানে। আয়ানের সঙ্গেও সামান্তার ভাব হয়েছে। আয়ান বর্তমানে গিয়েছে দেশে বাহিরে কিছু কাজে।
আজ সামান্তার বিয়ে। বিয়েটা হচ্ছে ফারাবির সঙ্গে। ফারাবি আজিজ সাহেবের বন্ধুর ছেলে। সবাই খুশি থাকায় সামান্তাও রাজি হয়ে যায়।
কিন্তু এই বিয়েটাই যে সামান্তার জীবনের অন্যতম ভুল হয়ে দাড়াবে তা কে জানতো।
————————
রাত বাজে দুইটা। কলিংবেল বাজতেই ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলে দিলো একজন সার্ভেন্ট। সামনে তাকিয়ে সে চিৎকার করে ডাকতে লাগল বাড়ির সবাই। সার্ভেন্ট এর চিৎকার শুনে সবাই নিচে দরজার সামনে এলো। আয়েশা বেগম তো রেগে চিৎকার করে কিছু বলতে নিবে কিন্তু তার আগেই দরজার দিকে তাকিয়ে থেমে যায়। তিথি দৌড়ে যায় দরজার কাছে। সামান্তা একদম এলোমেলো হয়ে দাড়িয়ে আছে দরজার সামনে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। পরনের শাড়িটা মাটিতে পড়ে আছে। ঠোঁটে কেটে রক্ত বের হচ্ছে। বাম হাত দিয়ে ব্লাউজ ভেদ করে রক্ত চুয়ে চুয়ে পড়ছে। কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। চোখ মুখ শুকিয়ে আছে।
প্রায় একবছর পর মেয়েকে এমন অবস্থায় দেখে তিথির হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে গিয়েছে। সামান্তা পড়ে যেতে নিবে তখনই একটা শক্ত হাত তাকে আকড়ে ধরে। সামান্তা পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলো আয়ান। চোখ বুজে নিলো সামান্তা। আয়ান ঝট করে কোলে তুলে নিলো সামান্তাকে।
রাশেদ তিথি আর আজিজ সাহেব অস্থির হয়ে আছে। আয়ানের মুখে চিন্তার ছাপ পরিষ্কার। আয়ান আলতো হাতে শুয়ে দিলো সামান্তাকে সোফার উপর। সার্ভেন্ট গিয়ে পানি এনে দিলো। আয়ান আলতো হাতে পানি ছিটাতে লাগল। আর এক সার্ভেন্টকে উদ্দেশ্য করে বলল
“তাড়াতাড়ি এক গ্লাস দুধ আর সুপ বানিয়ে নিয়ে আসো।”
আয়ান দেখলো সামান্তার গায়ে মারের কাল সিটে দাগ। আয়ান দৌড়ে তার রুমে গেল। আর দৌড়ে ফিরে এলো। আলতো হাতে সামান্তার রক্ত মুছিয়ে দিতে লাগল। হাতে ছুড়ি দিতে আঘাতের দাগ। তিথি তো হুহু করে কেঁদে উঠলো। রাশেদ আকড়ে ধরলো তিথিকে আর হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো সামান্তার দিকে।
আয়ান যত্ন সহকারে ক্ষত স্থানে ব্যান্ডেজ করে দিতে লাগল। ব্যথা নাশক একটা ইনজেশন দিয়ে দিলো। আলতো হাতে সামান্তার গালে হাত রেখে ডাকতে লাগল সামান্তাকে। সামান্তা পিটপিট করে চোখ খুলতেই আয়ানের চিন্তিত মুখটা ভেসে উঠলো। সামান্তা হুট করে আয়ানকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো।
আয়ান হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে হাত বোলাতে লাগল সামান্তার মাথায়। এতক্ষণে সামান্তার কান্নার বেগ কমে এলেও থামেনি। আয়ান শান্ত কন্ঠে সামান্তাকে জিঙ্গাসা করলো
“কি হয়েছে!”
আয়ানের কথা সামান্তা আরো মুখ গুজে দিলো আয়ানের বুকে। সামান্তার এমন অবস্থা দেখে আয়ানের বুকে চিনচিন ব্যথা করছে। আয়ান সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল “তোমরা সবাই নিজের ঘরে যাও। আমি দেখছি।”
আজিজ সাহেব বললেন “ফারাবিকে জানানো দরকার।”
আজিজ সাহেবের কথায় সামান্তা খামচে ধরলো আয়ানের শার্ট। আয়ান বুঝতে পেয়ে বলল “না এর কোনো দরকার নেই। আমি বুঝে নিবো। তোমরা যাও।”
তিথি করুণ চোখে তাকাল আয়ানের দিকে। আয়ান শান্ত সুরে বলল “ছোট আম্মু আমি আছি তো।”
#চলবে