#অচেনা_মানুষের_মাঝে
#শুভ্রতা_শুভ্রা
#সূচনা_পর্ব
পনেরো বছর বয়সে আজ বাড়ি ছাড়া সামান্তা। সে ভাবতেও পারছে না তার খালা আপন খালা তার সঙ্গে এমনটা করলো। সবাই তো বলতো খালা নাকি মায়ের মতো আগলে রাখবে। কিন্তু আজ সে আর তার দুইবছরের ভাই রেদোয়ান রাস্তায়। দুনিয়াটা আসলেই স্বার্থপর।
সামান্ত বসে আছে তার ভাইকে কোলে নিয়ে পার্কের মাঠে। দৃষ্টি তার মাটিতে থাকা ঘাসের উপর। কি করবে সে মাথা কাজ করছে না তার। ছোট ভাইটাকে নিয়ে কোথায় যাবে সে। কার দুয়ারে গিয়ে উঠবে যেখানে খালা বাসা থেকে বের করে দেওয়ার সময় জন্মদাতা বাবাও টু শব্দ করেনি। তার ঘাড়ে যে এখন এই ছোট ভাইটাকে মানুষ করার দায়িত্ব। সামান্তা এগুলোই ভাবছিল আর চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় নোনা জল গড়িয়ে পরছে তার। বাধ যেন ভাঙছেনা চোখের জলের।
সামান্তার কান্না করার মাঝেই রেদোয়ান হঠাৎ করে কেঁদে উঠলো। সামান্তার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে রেদোয়ানের ক্ষুধা লেগেছে। সামান্তা চোখ মুছে উঠে দাড়ালো। ওড়নার প্যাঁচ থাকা টাকাটা বের করলো। ভালো যে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মনে করে টাকাটা নিয়ে এসেছিল।
সামান্তা এগিয়ে গেল সামনে চায়ের দোকানের দিকে। একটা রুটি আর দুধ কিনে নিলো। চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে রেদোয়ানকে সে খাওয়াতে লাগলো। সামান্তা সামনে চোখ বুলিয়ে দেখলো চায়ের দোকানে থাকা লোকগুলো কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তাদের দৃষ্টিতে ইতস্তত বোধ করলো সামান্তা। তাড়াতাড়ি রেদোয়ানকে খাইয়ে বেরিয়ে আসে চায়ের দোকান থেকে।
পার্কে এসে পুনরায় বসে সামান্তা। ক্ষুধা তো তারও লেগেছে। কিন্তু যখনই তার জন্য কিছু কিনতে চাচ্ছে। তখনই ভাবনায় আসছে সে যদি কিছু কিনে খায়। তাহলে টাকা শেষ হয়ে যাবে। আর শেষ হয়ে গেলে রেদোয়ানের ক্ষুধা লাগলে তখন কি করবে সে। আস্তে আস্তে অন্ধকারও হয়ে আসছে। রাতে পার্কে কিভাবে থাকবে। এগুলোই ভাবছিল সামান্তা। সময় যাচ্ছে পেটে ক্ষুধাটাও বেড়ে চলছে তার। পার্কটাও নির্জন হয়ে যাচ্ছে। মানুষের সঙ্গে পাখিরাও নিজেদের আশ্রয় কেন্দ্র চলে যাচ্ছে। কিন্তু সামান্তা কোথায় যাবে। তার যে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে। আজ যদি তার মা থাকতো তাহলে কখনোই তাদের এই পরিস্থিতিতে পরতে হতো না। হঠাৎ করে তার মা যে তাদের ছেড়ে চলে যাবে তা কল্পনাও করেনি সামান্তা।
সন্ধ্যা বাড়ছে সামান্তার ভয়টাও বাড়ছে। এমনিতে অন্ধকার তার উপর আবার পার্কটা নিরব হয়ে আসছে। হঠাৎ সামনে কারো উপস্থিতি পেয়ে ভয়টা আরো একধাপ বেড়ে গেল সামান্তার। কালো ছায়া মুর্তিটা যত সামান্তার কাছে আসছে সামান্তার হৃদস্পদন একধাপ করে বেড়ে যাচ্ছে। অচেনা এক ভয় গ্রাস করছে তাকে। এইদিকে রেদোয়ান ও সামান্তার কোলেই ঘুমিয়ে পরেছে। সামান্তা কি করবে বুঝতে পারছেনা।
ছায়া মুর্তিটা আরো একটু কাছে আসতে নিবে তার আগেই সামান্তা রেদোয়ানকে কোলে নিয়েই দৌড় লাগাল। সামান্তা বুঝতে পারলো তার পিছু নিয়েছে লোকটা। সামান্তা প্রাণপনে ছুটে সামনে থাকা টিনশেডের বাসায় লুকিয়ে পরে। সামান্তা ভয়ে রিতিমত কাপছে থরথর করে। সে চোখ বন্ধ করে পরপর কয়েকটা জোরে জোরে নিশ্বাস ছেড়ে পিটপিট করে চোখ খুললো। সামনে একটা মধ্যবয়স্ক মহিলা কোমরে হাত দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সামান্তা ভয়ে আরো গুটিয়ে গেল।
মহিলাটা গম্ভীর সুরে বললে উঠলো, “কে তুমি? এখানে এমন করে আসলে কেন?”
সামান্তা মিনমিন করে বলল, “আজকের রাতটা কি আমি আপনার বাসায় একটু আশ্রয় নিতে পারি?”
মধ্যবয়স্ক মহিলাটা সামান্তা পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে নেয় একবার। কোলে থাকা রেদোয়ানের দিকে একবার তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“তোমার নাম কি? আর তুমি কে? তোমাকে তো আগে কখনো দেখিনি। আর তুমি এতো হাঁপিয়ে আর ভয় নিয়ে আছো কেন?”
সামান্তা কোনো মতে ইনিবিনিয়ে মানিয়ে নেয় মধ্যময়স্ক মহিলাটাকে। মহিলাটা বলল, “সে মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করে। সামান্তাকেও কাজ দিবে বলে।” সামান্তা কিছুটা সস্থির হয় মহিলাটির কথায়। সামান্তা চলে গেল মহিলাটির দেখানো রুমে দিকে।
টিন ছেদ করে চাঁদের আলো প্রবেশ করছে রুমে। জির্নসির্ন রুমে একটা চৌকি ছাড়া আর কিছুই নেই। রেদোয়ানকে চৌকিতে শুয়ে দিয়ে। সে রেদোয়ানের পাশেই শুয়ে পরলো। ক্লান্ত লাগছে কিন্তু চোখে ঘুম নেয়। পরেরদিনগুলো কেমন যাবে কি করবে কিছুই মাথায় আসছে না তার। ছোট ভাইটাকে নিয়ে কোথায় যাবে সে। একা থাকলে এতোটা ভাবতো না সে। কিন্তু ছোট ভাইটাকে তো তাকেই দেখে রাখিতে হবে। খুব কান্না পাচ্ছে তার খুব। রেদওয়ানকে বুকের মাঝে আকড়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠে সে।
কাদতে কদতে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছে সে নিজেই বুঝতে পারেনি। রেদওয়ানের কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল সামান্তার। সে ধড়ফড় করে উঠে বসলো। তাড়াহুড়ো করে রেদওয়ানকে কোলে তুলে নিলো সামান্তা। সে গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে তখনই একটা ফিসফিস করা আওয়াজ ভেসে এলো তার কানে।
সামান্তার কপালে এক দীর্ঘ ভাঁজ পরলো। এটা যে ওই মধ্যবয়স্ক মহিলার গলা তাতে কোনো সন্দেহ নেই সামান্তার। সামান্তা খেয়াল করলো রেদওয়ান কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পরেছে তার কোলে। সামান্তা একটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে কান খাড়া করলো। কিন্তু সে যা শুনলো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে।
সেই মহিলা তাকে আর তার ভাইকে অন্য কোথাও টাকা দিয়ে বেঁচে দেওয়া প্লান করছে মহিলাটা।
মহিলাটার এসব কথা শুনে ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো সামান্তার। হাত পা যেন নাড়াতে ভুলে গেছে। কি করবে কিছু বুঝতে পারছেনা। মাথাটা ঝিম ধরে আছে। সে আর কিছু ভাবতে পারছে না। রুমে থাকা ছোট্ট জানালা দিয়ে দেখতে পেল ভোরের আলো ফুটতে আরো দেড়ি আছে। কিন্তু তাকে এখনই বেড়িয়ে যেতে হবে। সামান্তা আর কিছু না ভেবে দৌড় লাগালো বাহিরের দিকে।
এক ছুটে অনেকটা দূরে চলে এলো সামান্তা। অনেকটা হাপিয়ে গিয়েছে সে। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। হঠাৎ করে মেঘ ডেকে উঠলো।
সামান্তা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো আকাশের দিকে। চোখ বেয়ে নোনা জল গরিয়ে পরলো তার। ওই যে বলে না বিপদ একা আসে না সব আত্মীয়স্বজন নিয়েই আসে। মেঘ আরো ডাকতে লাগলো। ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে সামান্তা। তার যে এমন অবস্থা হবে সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। ইতিমধ্যে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। নিস্তব্ধ রাস্তায় আশেপাশে কোনো আশ্রমকেন্দ্র ও চোখে পরছে না সামান্তার। চোখ ভেঙে পানি পরছে। রেদওয়ানকে নিজের বুকের সঙ্গে আরো শক্ত করে আকড়ে ধরে চিৎকার করে কান্না করতে লাগলো। বৃষ্টি শব্দের সঙ্গে তার কান্নার আওয়াজ যেন এক অন্য রকম আওয়াজ সৃষ্টি করছে। সামান্তা চিৎকার করে বলতে লাগলো
“সৃষ্টিকর্তা তুমি এতো কঠিন কিভাবে হলে। একটু রহম করো। আমি যে আর পারছিনা। কেন তুমি আম্মুকে কেড়ে নিলো কেন কেন!”
বলেই আরো জোরে জোরে কান্না লাগলো। তার কান্না শোনার জন্য হলেও আজ তার পাশে কেউ নেই। কেউ যে তার মাথায় হাত রেখে বলবে কান্না করো না আমি আছি তো তোমার পাশে। কেউ নেই যে ভরসার ছায়া দিবে। তার কান্না শুধু বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিলিয়ে পিচ ঢালা রাস্তার সঙ্গে মিশে চলে যাচ্ছে এক অচেনা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। কেউ যে নেই স্নেহের আলতো স্পর্শে চোখের পানিটুকু মুছিয়ে দিবে। আজ কেউ নেই তার পাশে। কেউ না। স্বার্থপর দুনিয়ায় সবাই সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত।
হঠাৎ……
#চলবে