আপনি বাংলাদেশী? কি নাম?
– জ্বি। তানিয়া, আপা। বাসায় তৃনা বলে ডাকে।
নতুন জয়েন করেছেন বুঝি? আগে দেখিনি।
– জ্বি আপা। তিন সপ্তাহ হলো।
আপনার চোখে পানি। মন খারাপ দেশের জন্য?
– হুম না মানে আমার শাশুড়ীর শরীরটা বেশ খারাপ। বেচারী একা একা কিভাবে সামলাচ্ছে জানিনা। ডাক্তাররা পরিস্কার করে কিছু বলছেও না।
বাহ, দারুন তো। এই বয়সীদের কোন আলোচনায় বসলে তো শুধু শাশুড়ীদের বদনাম শুনি। আপনার গলায় ভিন্ন সুর।
– আমার মা নেই আপা। বিয়ের পর যতদিন ওনার কাছে ছিলাম উনিই আমাকে মায়ের আদরে রেখেছিলেন। আমাকে তুমি করে বলেন আপা।
তাহলে ফেলে চলে এলে কেন?
– উনিই চেয়েছেন ওনার ছেলে দেশের বাইরে সংসার পাতুক।
ঘুরে এসো না হয় দেশ থেকে।
– আপা এসেছি মাত্র পাঁচমাস হলো। বোঝেনই তো টাকাপয়সার টানাটানি সাথে দুজনেরই নতুন কাজ। দোয়া করেন আপা ওনার জন্য।
দোয়া রইলো। ভালো থেকো। এটা আমার ফোন নাম্বার কোন দরকার হলে জানিও।
…………..
তৃনা নামের মেয়েটার মাঝে যেন আমি আমাকেই দেখতে পেলাম। সেই বয়সের আমি।
ডিগ্রী পরীক্ষা দিয়ে যেদিন বাড়ি এলাম, সেদিন বিকেলেই আশরাফের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। সামনের সপ্তাহে ওর অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার ফ্লাইট। ওখানকার কোন ভার্সিটিতে যেন সে পিএইচডি করতে যাচ্ছে। বিয়ের জন্য কবুল বলার আগ পর্যন্ত শুধু এই দুটো কথাই আমি জানতে পেরেছি ওর সম্পর্কে। সেদিন রাতেই আমাকে শ্বশুরবাড়ি তুলে নেয়া হয়।
নিজেদেরকে জানবার বা বুঝবার আগেই আশরাফ চলে যায় বিদেশে। ওরা ছিল তিন ভাই। ওর বাবা ছিল না। বাড়িতে আমার শাশুড়ী আর দু দেবর নিয়ে শুরু হয় আমার নতুন জীবন। ওনার নিজের মেয়ে না থাকাতে উনি যেন আমায় পেয়ে ওনার মেয়ে পেলেন। সারাদিন এক মূহুর্তের জন্য চোখের আড়াল করতেন না। এমনকি রাতে আমি ঘুমাতামও ওনার সাথে। সত্যি বলতে আমার যেদিন অস্ট্রেলিয়া যাবার কাগজ হাতে এলো, সেদিন সারারাত আমি আমার শাশুড়ীকে ধরে কেঁদেছি। বাড়ির আর কেউ কি ভেবেছে আমি জানিনা শুধু আমরা দুজন জানতাম আমরা একে অপরের জন্য কাঁদছি। অথচ স্বামীর কাছে সংসার করতে যেতে কে না চায়! এতোটাই ভালবাসায় উনি আমায় বেঁধে রেখেছিলেন প্রায় একটা বছর যে আমি নিজের বাবার বাড়িতে গেলেও উনি আমার সাথে পারলে চলে যেতেন।
তারুণ্যের স্বভাবই হচ্ছে নতুন কিছুতে সহজে মানিয়ে নেয়া। আর সেই সূত্র মেনে এই বিদেশ বিভূয়ে আমি আশরাফের সাথে দারুনভাবে মানিয়ে নিলাম। ও সারাদিন ক্লাস শেষ করে বাড়ি এলে শুরু হতো আমাদের খুঁনসুটি। প্রতি ছুটির দিনে দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া, দুজনে হাত পুড়িয়ে রান্না করা, যখন যা ইচ্ছে সামর্থ্যের মধ্যে সেটা পূরণ করা। যেন এক ইচ্ছেপুরীতে সৃষ্টিকর্তা আমায় ছেড়ে দিয়েছেন। আমার আনন্দকে পরিপূর্ণ করতে বছর না ঘুরতেই জানতে পারি আমি মা হতে চলেছি। সে কি খুশী আশরাফের। এই কিনে ঐ কিনে ঘর পারলে প্রায় ভর্তি করে ফেলে।
কথায় বলে পৃথিবীতে কোন সুখই চিরস্থায়ী নয়। আমার সুখতো সে হিসেবে একটু বেশীই হয়ে গিয়েছিল। আমার তিন মাসের সময় যখন হাসপাতাল চেকআপে যাই, সব সেরে বের হবার মুখে হঠাৎ করেই আমার চোখের সামনে আশরাফ মাটিতে লুটিয়ে পরে। দৌড়াদৌড়ি করে তাকে হাসপাতালের ভেতরে নেয়া হয়। ওটি টেবিলেই সে মারা যায়। আমার জীবনের হাসিমাখা একটা দুপুর এক নিমিষেই বিবর্ন হয়ে যায় নিউরোসার্জনের সরি নামক শব্দে।
হাসপাতালের হিমঘরে আশরাফকে রেখে একাকী ঘরে ফিরে আসি। আমার পুরো পৃথিবী যেন এক নিমিষে শূন্য হয়ে যায় আশরাফের অনুপস্থিতিতে। ঘরে ফিরে দেখি আশেপাশের বাঙ্গালী পরিচিতরা খবর পেয়ে বাসায় চলে এসেছে। আমার একাকীত্ব আর অসহায়ত্বের ভার বাড়িয়ে দিতে এক আপা এগিয়ে আসে আমার নাকফুল খুলে নিতে। একবুক কান্নার দলা বুকে জমিয়ে আমি শুধু ভাবি, এসব সংস্কার পালন করা কি এতোই জরুরী? আমাকে বৈধব্যের সাজে সাজালেই বুঝি তাদের বা আশরাফের অনেক পূণ্য হয়ে যাবে? চব্বিশ বছরের এই আমি কোন কিছুই বলতে পারিনা তাদের। আশরাফের শরীরটাকে দেশে ফিরিয়ে নিতে যে ওদের সাহায্য আমার লাগবে।
প্রিয়জনের মৃতদেহ সাথে নিয়ে ভ্রমন করা কতটা কষ্টের তা বুঝি শুধু ভুক্তভোগীই জানে। যে মানুষটার সাথে জীবনের কিছু সোনালী সময় জড়ানো আজ সে নিথর হয়ে বাক্সবন্দী হয়ে আছে এই হাওয়াই জাহাজের এককোণে। কি যে হাহাকার করা এক কষ্ট! এই মানুষটার পাশে বসে কত স্বপ্ন বুনেছি সামনের বড়দিনের ছুটিতে দেশে যাব আমাদের বাবুটাকে নিয়ে। কি কি করবো সব মনে মনে প্ল্যান করে রেখেছিলাম। হায় নিয়তি, বড়দিনের ছুটিটা আমার জন্য এক বছর আগেই চলে এলো।
নিজের একটা হালকা রংয়ের শাড়ি আর আশরাফেরই দেয়া একটা নাকফুল আবার পরে নিয়ে আমি এয়ারপোর্ট থেকে শ্বশুরবাড়ী যাই। কি বিদেশ, কি দেশ সান্ত্বনা বা পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে আমার বেশভূষা পাল্টে দিতেই যেন ও বাড়িতেও একদল লোক অপেক্ষায় ছিল। এক আত্মীয়ের আমার হাতে তুলে দেয়া সাদা শাড়ীটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলাম বুঝি অনেকটা সময়। পিঠের ওপর নেমে আসা পরিচিত হাতের স্পর্শে চমক ভাঙ্গে। আমার শাশুড়ী মা। আমার হাত থেকে শাড়ীটা নিয়ে রেখে দেন খাটের এক পাশে। কাউকে আমার হাতের চুড়ি বা নাকফুলেও হাত দিতে দেননি।
আশরাফের সৎকারের সব কিছু শেষ হলে পরে নিজের একাউন্ট থেকে টাকা তুলে তিনি আমার হাতে তুলে দেন অস্ট্রেলিয়া ফেরত যেতে। আমি ওনার কাছে থেকে যেতে চেয়েছিলাম। উনি শুধু বলেছিলেন, ‘আমি তোকে আমার মেয়ে মনে করি। তুই ওখানে থাকলেই ভালো থাকবি। নিজের জীবন তোর মতো করে গড়ে নে।’
আশরাফের বেতনে আমরা দুজন হাত পা ছড়িয়ে বেশ খরচ করে চলতে পারতাম। কিন্তু ফেরার পর বুঝতে পারি জীবন আসলে কতটা কঠিন। বাইরে কখনো কাজ না করা এই আমি, সাথে প্রেগন্যান্সী দুটো মিলে কি যে এক বিভীষিকা দিন গেছে। নিজের অতীতে ফিরে তাকালে মনে হয় কিভাবে পেরেছিলাম? আমার ছেলেটার একমাস বয়সের সময় একরাতে হুট করে অসুস্থ হয়ে তিনদিনের মধ্যে আমার শাশুড়ী মারা যান। আমি ওনার মৃত্যুর সময় ওনার পাশে থাকতে পারিনি, এই দুঃখ আমি আজীবন বয়ে চলেছি নিজের মাঝে। কি করবো আমার ব্যাগে যে তখন ছিল মোটে বিশ ডলার। এই টাকা দিয়ে যে দেশের টিকেট করা যায়না।
………..
হঠাৎ করেই মনে হয় অর্থাভাবে একদিন আমি যা পারিনি তা আমার মতো কেউ একজন অন্তত পারুক। ডেস্ক থেকে উঠে খুঁজে বের করি তৃনাকে।
ওর হাত ধরে বলতে পারি, ‘প্রিয় মানুষের শেষ মূহুর্তে তার পাশে না থাকতে পারার আকুতি একটা জীবন পোড়ায়। তোমার টিকেটটা আমি করে দিচ্ছি। তোমার যখন সুযোগ হয় তখন না হয় শোধ দিয়ে দিও।’
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস