অচেনা
শেষ পর্ব,
বড় ভাবীকে ঘিরে পরবর্তী চার থেকে পাঁচ ঘন্টা ,বাড়ির সদস্য এবং পাড়া প্রতিবেশীর বুকভাঙা আহাজারি চলতে থাকলো… তারপর হঠাৎ সবাই কেমন ক্লান্ত হয়ে গেল।
দুঃখ কষ্টের তীব্রতা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। আস্তে আস্তে ভোঁতা হয়ে আসে । সহনশীল হয়ে আসে। তখন সেই যন্ত্রণা প্রকাশ করার চেয়ে বুকের মধ্যে পুষে রাখতেই আরাম লাগে।
পাড়া-প্রতিবেশীরা একজন আরেকজনের সাথে হাজারো রকমের তর্ক বিতর্ক, পরামর্শ, উপদেশ, ঘটনার কারণ এবং তাঁর সম্ভাব্য ভয়াবহ সব ফলাফল আলোচনা ও বিশ্লেষণ করে করে ক্ষান্ত হয়ে গেল । কেউ কেউ এরমধ্যেই বিদায় নিয়েছে, কেউ কেউ যাচ্ছি, যাই করছে।
আব্বার এই বয়সে ,এর চেয়ে বেশি সময় ধরে বিলাপ করার মতো শারীরিক শক্তি নেই।
ভাবী ডাইনিং টেবিলে সেই ঠায় বসে আছে। কেউ কেউ ভাবীকে কাঁদানোর চেষ্টা করেছে,, কিন্তু লাভ হয়নি। যেন এ বাড়িতে কি ঘটছে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ভাবী।
আমার ভীষণ ইচ্ছা করছিল, ভাবীকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদি, ,, কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমার মনের ইচ্ছা মনেই থেকে যায়।
কেউ একজন ফোনে ছোট ভাইয়াকে খবরটা দিয়েছে, ছোট ভাইয়া আর ভাবী এসেছিলেন।বড় ভাইয়া লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে,তার নতুন বউয়ের জন্য খাবার নিতে রুম থেকে বের হয়েছিলেন…ছোট ভাইয়া আর ভাবীকে দেখতে পেয়ে,,বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে তাদের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করলেন।
“ও তোদের খুব অসুবিধা হয়ে গেল তাই না, আকবর? বসে বসে আমার সব সম্পদ পাবি বলে স্বপ্ন দেখেছিলি…. আমার ছেলে হলে তো তোদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি… আমার ভালো কবে চাইসিলি তোরা? খুব জ্বলে তাই না? আমার ছেলে হবে শুনে? কে খবর দিলো তোদের এখানে মাতব্বরি করার জন্য?। তোদের ফন্দি আমি বুঝি, ..বড় ভাবীর জন্য তোদের কত দরদ আমার সব জানা আছে।আসল কথা তো অন্যখানে… এক কনা সম্পত্তি পাবি না আমার, মনে রাখিস….ইত্যাদি ইত্যাদি ।”
“তোদের” শব্দটা দিয়ে,বড় ভাইয়া আমাকে সহ বোঝালো কিনা জানিনা…
আর এতো লাভ ক্ষতি বোঝেন বড় ভাইয়া!! চারটা পরীর মতো মেয়ের কোন অস্তিত্ব নেই ভাইয়ার কাছে? এতো অন্ধকার এই মানুষটার মনে?
ছোট ভাইয়া এইসব শুনে তৎক্ষণাৎ বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। ছোট ভাবী অবশ্য আরো কিছুক্ষণ রয়ে গেল।
আব্বার শরীর বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল… সম্ভবত আব্বা এটা বিশ্বাস করতে পারছেন না,যে তার নয়নের মনি আলমগীর — এমন একটা কাজ করতে পারে।ছোট ভাবী আব্বাকে বেশ জোর করে একটু খাইয়েছে…,
তারপর ঘুমাতে যাওয়ার জন্য অনেক জোর করলো , কিন্তু আব্বার এক কথা… আলমগীর আর রুকুর সাথে কথা না বলে ,আব্বা বিছানায় যাবেন না।
ছোট ভাবীকে আমার খারাপ লাগে না। যদিও বেশিদিন এই বাড়িতে থাকা হয়নি তার, তবু বড় ভাবীর প্রতি তার ভালোবাসা আন্দাজ করতে পারি। ভালোবাসা আর ঘৃনা দুটোরই একটা গন্ধ আছে। কোনো রকম কথাবার্তা না হলেও ,কে আপনাকে ভালোবাসে আর কে আপনাকে ঘৃনা করে ,সেটা কেমন যেন টের পাওয়া যায়।
ছোট ভাবী আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে.. এ বাড়ির চার মেয়েকে নিজের সাথে নিয়ে যাবার কথা বললো।
আমি ছোট ভাবীর সিদ্ধান্তে সায় দিলাম মাথা নেড়ে।
সত্যি এটা খুব ভালো হবে।
এদিকে ছোট ভাইয়া রাগ করে,বাড়ির বাইরে গাড়িতে বসে ভাবীর জন্য অপেক্ষা করছিল। ওদের গাড়িতে সবার জায়গা হবে না।তাই বাড়ির আরেকটা গাড়ি নিয়ে আমিও গেলাম সবাইকে নামিয়ে দিতে। ড্রাইভারকে দিয়েই পাঠিয়ে দিতে পারতাম কিন্তু বড় ভাবীর স্হির মুখটা দেখে আর বাড়িভর্তি লোকজনের মন্তব্যে আমার কেমন দম বন্ধ লাগছিলো।
সবাইকে নামিয়ে দিয়ে যখন ফিরছি তখন ড্রাইভার , সিরাজের মুখে অনেক গল্প জানতে পারলাম।
সিরাজ এই বাড়িতে এসেছে মাত্র কয়েকমাস হলো। আগে তার চাচা মতি মিয়া,আমাদের অনেক বছরের পুরনো এবং বিশ্বস্ত ড্রাইভার ছিল। উনার অনেক বয়স হয়েছে বলে তারই অনুরোধে ,ভাতিজা সিরাজকে রাখা হয়েছে। সিরাজের বয়স একদম কম, কথা বললেই বোঝা যায় সে বেশ চটপটে এবং বুদ্ধিমান ছেলে।বড় ভাবীকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে সিরাজ। সত্যি বলতে এ বাড়িতে যত লোক কাজ করে, আশ্রয় পায় সবাই বড় ভাবীকে অনেক ভালোবাসে এবং সম্মান করে।বড় ভাবীর প্রতি আনুগত্য থেকেই সিরাজ গত কয়েক ঘন্টার মধ্যে ভাইয়ার ঢাকার কর্মচারীদের সাথে যোগাযোগ করে ,নতুন বউ সম্পর্কিত সব খবর বের করে ফেলেছে। নতুন বউ এর নাম জেরিন।সে ভাইয়ার ম্যানেজার এর বোন।এই বয়সে এসে,,সুন্দরী এই মেয়েকে বিয়ে করতে ভাইয়া বিশ লক্ষ টাকার গয়না দিয়েছে, সাথে পঁচিশ লক্ষ টাকার কাবিন পরিশোধ করেছে, এবং আরো কিছু সম্পত্তি বা ব্যবসার শেয়ার লিখে দেয়ার কথা রয়েছে। হানিমুন করতে দুজন মিলে থাইল্যান্ডেও গিয়েছিল।
এই মেয়েটির সাথে কয়েক বছর ধরে ভাইয়ার সম্পর্ক । ঢাকার বাড়িটি এই মেয়ের নামে কেনা হয়েছে।
এইসব শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। নিজেকে দারুন নির্বোধ মনে হচ্ছিল। চোখের সামনে এতো কিছু ঘটে গেলো আর আমি একটুও টের পেলাম না।
জন্মের পরপরই মা’কে হারিয়েছি তো, তাই আমি ভালোবাসা আর স্নেহের কাঙাল। টাকা পয়সা, বিষয় সম্পদ আমাকে এতটুকু আকৃষ্ট করে না।তাই এগুলো নিয়ে মাথাই ঘামাই না আমি।নইলে আট নয় মাস আগে, বড় ভাইয়া যখন ভাবীর ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে পঞ্চাশ লাখ টাকা নিয়েছিল তখন একটু খোঁজ নিতে পারতাম।
বড় ভাইয়া ইচ্ছে করেই ভাবীর একাউন্ট খালি করেছেন, যেন ভাবী টাকার জোরে কোথাও যেতে না পারেন ।মন থেকে মানুক আর না মানুক,এ বাড়িতে থেকেই যেন বড় ভাবী সবার সেবা যত্ন করেন এটাই ভাইয়ার প্ল্যান।
বড় ভাবীর বাবা মা কেউ বেঁচে নেই। দুই ভাইয়ের কেউই সচ্ছল নন,। চার মেয়েকে নিয়ে বড় ভাবীর শেষ জীবন তাহলে এই অপমানের মধ্যে কাটবে?
বাড়িতে ফিরে বাকি লোকজনদের বুঝিয়ে বিদায় করলাম।
তারপর বড় ভাবীর সামনে এসে দাঁড়ালাম…
ভাবী আমার দিকে তাকালেন না,,,একবারও না।
মনে হলো ভাবীর কিছুক্ষণ একা থাকা প্রয়োজন।
আমি নিজের ঘরে ঢুকে গেলাম।হঠাৎ দেখি বড় ভাইয়া পিছনে…
শেষ কবে বড় ভাইয়া আমার ঘরে এসেছিলেন.. আমার সাথে কথা বলতে.. মনে পড়ে না।
আমি বললাম,”আব্বা আপনার সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছে অনেকক্ষন যাবৎ, আপনি একটু আব্বার ঘরে যান।”
বড় ভাইয়া খুব একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
“জাহাঙ্গীর, রুকু কে একটু ম্যানেজ কর তুই।বোকা মানুষ তো,,, কি থেকে কি করে ফেলে…ওর খাওয়া পড়ার কোন সমস্যা তো হবে না… যেমন ছিল তেমনই থাকবে… বাড়িতে একজন সদস্য বাড়লো আর কি…তোর নতুন ভাবীর এখন একটু যত্ন দরকার। রুকু একটু ভালো মন্দ রান্না করে খাওয়াবে এই তো… একটু প্র্যাকটিক্যালি চিন্তা করে দেখ… আমি তো…”
প্রচন্ড রাগে আমার মনে হচ্ছিল , ঘুষি মেরে বড় ভাইয়ার নাক মুখ ফাটিয়ে দিই।
তার চোখে মুখে কোন অপরাধবোধ নেই, নেই বড় ভাবীর প্রতি এতটুকু শ্রদ্ধা। মনে হয় যেন খাওয়া পড়াটাই বড় ভাবীর একমাত্র প্রাপ্য, এরজন্যই বড় ভাবী এই পরিবারটা কে এইভাবে আগলে রেখেছিল।
ভাইয়ার পিশাচের মতো মুখের দিকে তাকিয়ে,,আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম কি করবো।
পাঁচ বছর পর…..
সন্তানের অধিকার খাটিয়ে বড় ভাবীকে সেদিন আমার সঙ্গে আসতে রাজি করিয়েছিলাম। সাথে আব্বা। মেয়েরাও কেউ থাকতে চায় নি বাবার সাথে। সেদিন ওই বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের হয়ে এসেছিল আমার বড় ভাবী, ভাইয়ার দেয়া যেকোনো জিনিস নিতে ঘৃনা হচ্ছিল তাঁর । বড় ভাইয়া কাউকে আটকানোর চেষ্টা করে নি ভালোবেসে,,ক্ষমা চেয়ে… বরং ভাবীর গায়ে হাত তুলেছিল,এক মনিবের মতোন।
উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সামান্য যা কিছু আমার ছিল, তাই দিয়ে পার্টনারশিপে আমি আর বড়ভাবী একটা ছোট ব্যবসা শুরু করেছি। আমার মূলধন আর বড়ভাবীর শ্রম।
পরিশ্রমী ভাবীর ব্যবসা দাড় করাতে সময় লাগেনি। আমিও ছিলাম পাশে, বড় ভাবীর কাছে যে আমার অনেক ঋন।
বড় মেয়ের তো পড়া শেষের পথে ছিলই । ছোট ভাইয়ার সামান্য সাহায্যে সেটা পুরোপুরি শেষ হয়েছিল।ভাবী নিজের রোজগার করা টাকায় সেই ঋন শোধ করতে পেরেছেন।
মেজো মেয়ে নিজ যোগ্যতায় সরকারি মেডিকেলে চান্স পেয়েছে।
পরের দুইজনও আশা করছি এবছর ভালো জায়গায় চান্স পাবে।
আমিও বিয়ে করে সংসারী হয়েছি। আমাদের সবার মাঝে বাবাও ভালো থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সত্যি বলতে, আমরা সবাই ভালো থাকার চেষ্টা করে যাচছি। সবকিছু এতো সহজ নয় তো॥
আর বড় ভাইয়া?
বড় ভাইয়ার সুন্দরী বউ, তার কাছ থেকে টাকা পয়সা যতটুকু সম্ভব নিয়ে ..উধাও হয়ে গিয়েছে ম্যানেজারের সাথে।যাকে ভাই বানিয়ে বড় ভাইয়াকে বিয়ে করেছিল। যতটুকু শুনেছি ঐ বাচ্চাটা ম্যানেজারের, ভাইয়ার নয়। সারা জীবন এতো হিসেবে দক্ষ ভাই, শেষ সময়ে গড়মিল করে ফেললেন।
সেই শোকে, ..যন্ত্রণায় ,ভাইয়া শয্যাশায়ী।
সাথে অযত্ন,,,,হায়..! জলপাই তেল দিয়ে খাবার বানিয়ে দেয়ার কেউ তো নেই আর।
যার দুই দুইটা মেয়ে ডাক্তার, সে এখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে,একা ঘরে নিজের সাথেই নিজের জীবনের হিসাব করে। আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে, ওদের নিয়ে বড় ভাইয়াকে একটু দেখে আসি কিন্তু ভাবীর মুখের দিকে তাকিয়ে সেই ইচ্ছা দমন করে রাখি।
বড় ভাবী কখনো ভাইয়ার প্রসংগে একটা কথাও বলে না। বাড়িতে বড় ভাইয়া কে নিয়ে কথা হলে, সেখান থেকে সরে যান ভাবী। এতোটা নিয়ন্ত্রণ নিজের উপর কারো থাকতে পারে, চোখের সামনে দেখেও বিশ্বাস হয়না।
বড় ভাবী সব দিক থেকেই জয়ী,
তবু ভাবীর মুখে মাঝে মাঝেই, ভীষণ ভাবে প্রতারিত হবার কেমন একটা বিষন্নতা ছুঁয়ে থাকে। অবশ্য সেদিনের পর,,,তার চোখে আজও একফোঁটা অশ্রু দেখিনি আমি।
শক্ত খোলসে মোড়ানো,এই ভাবী যেন আমার বড্ড অচেনা।
অচেনা,
রুচিরা
Ruchira Sultana
(সমাপ্ত)