অচেনা (প্রথম পর্ব)
রুচিরা
মাস ছয়েক ধরে লক্ষ্য করছি,বড় ভাইয়া যেদিন রাতে বাড়ি ফিরে সেদিন ভাবি লিপস্টিক , কাজল ,পাউডার দিয়ে সেজেগুজে টেবিলে খাবার সাজিয়ে, ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করে । ভাইয়ার জন্য সেজেছে বলে ভাবীর মুখে একরাশ লজ্জা ঘিরে থাকে ।লজ্জায় ভাবি তার মাথার ঘোমটা কারনে অকারণে বারবার টানতে থাকে,, ঘোমটার টানে ভাবির চুল অনেক বেশি এলোমেলো হয়ে যায় ।ভাবিকে খুব অচেনা দেখায় তখন।
ব্যাপারটা এমন নয় যে ,বড় ভাইয়া ছয়মাস কিংবা এক বছর পর পর বাড়ি আসে ।বড় ভাইয়া প্রতি সপ্তাহে একদিন বাড়ি আসে ।তাছাড়া ভাইয়া যে খুব দূরে থাকে তাও না, যে বাড়িটাতে এখন আমরা থাকি সেটা নারায়ণগঞ্জে…এটা ছাড়াও আমাদের আরো বাড়ি আছে এই শহরেই।ভাইয়া আগে এখানে থেকেই সব ব্যবসা করত ।এখন ভাইয়ার ব্যবসা অনেক অনেক বড় হয়েছে,, সেজন্যই ঢাকায় থাকতে হয় । নিজের ব্যবসার সবকিছুই ভাইয়া নিজে দেখাশোনা করে। আমাকে বা ছোট ভাইয়াকে ব্যবসা থেকে বেশ দূরেই রাখে। ব্যবসা দেখাশোনার সুবিধার্থে ঢাকায় একটা বাড়িও কিনেছে ইতিমধ্যে থাকার জন্য।বিদেশেও যাচ্ছে আজকাল দেখছি।
যাই হোক, বড় ভাবীর প্রসঙ্গে আসি।সকাল থেকে ভাইয়া আর বাড়ির বাকি সবার জন্য রান্না করে করে ভাবী ক্লান্ত হয়ে যায়। ভাইয়া আর বাকি সবাইকে এক না করার কারণ হলো এই বাড়িতে দুই রকমের রান্না হয়। বাড়ির সব সদস্যদের জন্য একরকম আর ভাইয়ার জন্য আরেকরকম।বাসায় সবাই যতই ভাবীকে বলে, কাজের লোক তো আছে কয়েকটা…তারাও তো রান্না করতে পারে …. কিন্তু ভাবি খুব বেশ একটা রাগ আর লজ্জা মিশিয়ে বলতে থাকে,,, “জানোই তো তোমাদের ভাই আমার রান্না ছাড়া খেতেই পারে না… আর বাবার কতো বয়স হয়েছে, তার কি এখন কাজের লোকের রান্না মুখে রুচে? বাচ্চারাও তো আমার হাতের রান্না খেতে চায়,, এখন কি করা? কষ্ট করে করি “… মনে হবে যেন রান্নার জন্য ভাবীর খুব কষ্ট হয় …কিন্তু সত্যি এটাই যে ভাবি নিজের খুশিতেই এইসব রান্নাবান্না করে।
শুধু তাই নয়,,আমার এই মহান ভাবী প্রতিদিন ভাইয়ার জন্য নারায়ণগঞ্জ থেকে রান্না করে ঢাকায় পাঠান।ড্রাইভারকে দিয়ে দুপুর বারোটার আগে ভাইয়ার জন্য সব রান্না করে পাঠানো হয়।
এর পেছনে ভাবীর একনিষ্ঠ ভালোবাসা ছাড়া আরও একটা কারণ আছে। সেটা হল কয়েক বছর আগে ভাইয়ার হঠাৎ করে খুব শরীর খারাপ হয় ।বড় ভাইয়ার বয়স পঞ্চান্ন, অসুখ বিসুখে ভোগার মোক্ষম বয়স এটা। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানা যায় হার্টে ব্লক আছে । শুনে ভাবি একেবারে অস্থির হয়ে পড়ে। আল্লাহর রহমতে বড় ভাইয়া ভাবীর চার মেয়ে। একজনেরও বিয়ে হয়নি, বড় মেয়ে প্রাইভেট মেডিকেলে পড়ছে,, এরপরের জন এইচএসসি দিবে আর তারপর দুটো জমজ মেয়ে ক্লাস এইটে পড়ে।এই অবস্থায় ভাইয়ার ভালো মন্দ কিছু হলে মেয়েদের নিয়ে ভাবী কোথায় যাবে? অনেক ডাক্তার, ওষুধ চলার পর শেষ পর্যন্ত ,,ভাবী ভাইয়ের জন্য কিটো ডায়েট নামে এক ডায়েট শুরু করেছে ।সেই রান্নার যোগান করতে করতে ভাবির দিন পার হয়ে যায় ।
তবে বলা যায় …ভাইয়া এখন আগের চেয়ে অনেক সুস্থ ।বেশ ফিট লাগে ভাইয়াকে আজকাল ।কিছুদিন আগেই থাইল্যান্ডে গিয়ে সমস্ত চেক আপ করে এসেছে। সব রিপোর্ট ভালো, আর রিপোর্ট ভালো এসেছে শুনে মহা আনন্দে ভাবী এই ডায়েট আরো কড়া ভাবে চালু রেখেছে।
আমার ভাবী শুধু যে আগ্রহ নিয়ে রান্না করে তাই না,,, বাড়ির সমস্ত সাংসারিক কাজে ভাবী ভীষণ দক্ষ। এই বাড়িতে ভাবী আসার কিছুদিন পর আমার জন্ম হয়। সন্তান জন্মের জন্য আম্মার বয়সটা উপযুক্ত ছিল না। আমার জন্মের চারদিন পর আম্মা মারা যান। কয়েকদিনের এই ছোট্ট আমাকে নিয়ে সবার দুশ্চিন্তার সীমা ছিল না। আত্মীয়-স্বজন সবাই আব্বাকে আবার বিয়ে করার জন্য নানাভাবে চাপ দিয়েছিল। কিন্তু আব্বার অগাধ আস্থা ছিল বড় ভাবীর উপর। ভাবী
কে ডেকে নিয়ে আব্বা বলেছিল,” রুকু মা,তুই আমার একমাত্র ভরসা মা ..আমার ছোট্ট জাহাঙ্গীরকে তুই দেখবি তো?”
আম্মা শখ করে মোগল সম্রাটদের নামে আমাদের তিন ভাইয়ের নাম রেখেছিলেন। আলমগীর,আকবর আর আমি জাহাঙ্গীর।আর ভাবীর নাম রোকেয়া, আদর করে আব্বা রুকু ডাকেন।
আব্বার কথায় সেই যে ভাবী আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল,, এরপর আর কখনো আমাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। আমি একটু বড় হওয়ার আগ পর্যন্ত ভাবী নিজের সন্তান নেওয়ার কথা চিন্তা করেননি। আমাকে কোলে পিঠে করে বড় করেছেন ঠিক আমার মায়ের মতো করে।বড় ভাইয়া কোন এক অজানা কারণে আমাকে পছন্দ করেননা, খুব একটা কথাও বলেন না….হয়তো আমাকে আম্মার মৃত্যুর জন্য দায়ী করেন।আর ছোট ভাইয়া ঝগড়া করে ব্যবসা বুঝে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছেন বহু আগে।তাই নিজের সংসারের পাশাপাশি বৃদ্ধ শশুর আর মা হারা দেবরকে ভাবীই আগলে রাখেন। এজন্যই ভাবীর জন্য আমার অগাধ মায়া ,,ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা।সব করতে পারি আমি, এই মানুষটার জন্য।
আজও বড় ভাইয়া বাড়ি আসবে বলে সেজেগুজে অপেক্ষা করছিল ভাবী। সংসারের বাকি সব কাজ যতটা দক্ষতার সাথে করে, নিজের সাজের বিষয়ে ততটাই কাঁচা আমার ভাবী। নিজের প্রতি সবসময় বড্ড উদাসীন।তা না হলে লিপস্টিক সবসময় ভাবীর দাঁতে লেগে যায়, কাজলটাও ঠিক ঠাক দিতে পারে না। পাউডার কেমন ভেসে ভেসে থাকে।আর চুলের কথাতো বলেছি…বারবার ঘোমটার টানে চুলটা একদম অগোছালো হয়ে যায়। মিষ্টি মুখের ভাবীকে বড় অচেনা লাগে। একবার দুবার নয়, যতবার সাজে এমনই হয়।
আমার খুব ইচ্ছা করে বলতে যে “ভাবী তুমি সাজটা ধূয়ে ফেলো” কিন্তু ভাবী হয়তো কষ্ট পাবে ,আরো বেশি লজ্জা পাবে… এই ভেবে আর বলিনা ।
কলিং বেলের শব্দে ভাবী দৌড়ে দরজা খুলে দিল।
বড় ভাইয়ার সাথে একটা মেয়ে, দেখতে বেশ সুন্দরী, চেহারার মধ্যে কেমন একটা তাচ্ছিল্যের ভাব।
বড় ভাইয়া মেয়েটাকে হাত ধরে ভিতরে এনে বসিয়ে দিলো।
ভাইয়ার সাথে মেহমান দেখে ভাবী আরো ব্যস্ত হয়ে গেলো।
___মেহমান নিয়ে আসবেন, আগে ফোন করে একটু জানাবেন না ? এখন তো ঘরের রান্না দিয়েই মেহমান খাওয়াতে হবে। আপনার কবে একটু বুদ্ধি হবে, বলেন তো?
__ভাবী লিপস্টিক লাগানো দাঁত বের করে হেসে হেসে ভাইয়াকে অভিযোগ করছে।
__ভাইয়া কিছু না বলে আব্বার ঘরে ঢুকে গেল, আর এরপর যা শুনলাম তাতে আমি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললাম।
বড় ভাইয়ার হাবভাব আর মেয়েটার সাথে ভাইয়ার আচরণ দেখে আমার প্রথমেই একটু খটকা লাগছিল কিন্তু আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে নিজের বড় মেয়ের কাছাকাছি বয়সী কোন মেয়েকে এই বয়সে বিয়ে করে বাড়িতে এনে তুলতে পারে।
বড় ভাইয়ার ভাষ্যমতে,ভাবীর উপর তার কোন অভিযোগ নেই, তবে চার চারজন মেয়ের বাবা হয়ে ভাইয়া থাকতে চায় না। এতো বড় ব্যবসা ভাইয়ার, ছেলে না হলে এই সম্পদ ভাইদের কাছে যাবে।এতো কষ্টের সম্পদ রক্ষা করার জন্যই ভাইয়া বিয়ে করেছেন। তার নতুন বউটি এখন সন্তান সম্ভবা এবং ডাক্তার বলেছে ছেলে সন্তান আছে ভাইয়ার নতুন বউএর গর্ভে। এখন তার সেবা যত্ন দরকার।তাই বাড়িতে নিয়ে এসেছেন যেন বড় ভাবী ঠিক মতো যত্ন করে খাওয়াতে পারে।
বাড়ির সব মানুষ আচমকা এই ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে গেল। জানিনা কি এক অদৃশ্য মাধ্যমে আধা ঘন্টার মধ্যে গোটা পাড়ায় খবরটা জানাজানি হয়ে গেলো। আমাদের সাজানো সুখের বাড়িটা মরা বাড়ির মতো হাহাকার করতে শুরু করলো।
____সারাজীবন এই সংসারে দাসীর মত খেটে ভাবীর কপালে এই জুটলো শেষমেশ !এই আহাজারি সব পাড়া প্রতিবেশীর মুখে।
পাড়া প্রতিবেশীর কাছে ভাবীর যথেষ্ট সুনাম। তাদের তোপের মুখে ভাইয়ার সুন্দরী, সন্তান সম্ভবা নতুন বউ অসুস্থ বোধ করছিল, তাই ভাইয়া কোলে করে নতুন বউ কে নিয়ে বেডরুমে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ হার্টের সমস্যা আছে বলে, পাঁচ কেজির ব্যাগ উঠাতেও দেয় না ভাবী, ভাইয়া কে।
এইসব দেখে…
এই বৃদ্ধ বয়সে, শিশুর মতো কাঁদছেন আব্বা, তার চার নাতনি কে জড়িয়ে ধরে।
বাড়ির কাজের লোকগুলো পর্যন্ত বিলাপ করছে…
শুধু একজন এবাড়িতে কাঁদছে না, বড় ভাবী…
ভাবীর মুখের দিকে তাকিয়ে ভীষণ ভয় হলো আমার।এক টেবিল ভর্তি খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে। ভাবীর মুখে কেমন একটা অদ্ভুত হাসি যেন,, চোখদুটো বড্ড স্হির , অশ্রুহীন।
কারো এরকম চেহারা , আমি কখনো দেখিনি আগে…
চলবে…..