অঙ্গীকার (২য় পর্ব)

0
2568
অঙ্গীকার (২য় পর্ব) লেখা- শারমিন মিশু পরদিন এগারোটার দিকে রাদিয়া নিতুর বিয়েতে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। নিতু রাদিয়ার বেস্টফ্রেন্ড। সেই স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ পর্যন্ত নিতুর সাথে ওর বন্ধুত্ব। রাদিয়া চুলগুলো কে উপরে তুলে ফুলিয়ে বাঁধার জন্য ঠিক করছিলো তখনি পিছন থেকে আফিয়া বলে উঠলো,, কিরে রাদি কোথাও যাবি নাকি? -হুম আপু নিতুর আজ বিয়ে তো তাই সেখানে যাবো। যাবোনা ভেবেছি কিন্তু ও ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে অনেক রিকুয়েস্ট করছিলো তাই যাচ্ছি। -হুম অবশ্যই যাবি। ফ্রেন্ডের বিয়ে যাবিনা কেনো? কিন্তু তুই কি এভাবেই যাবি? -এভাবে মানে? কি বলছো? -মানে এভাবে বোরখা ছাড়া চুল ছেড়েই কি যাবি? -রাদিয়া আনন্দের সাথে বললো,, হুম আপু।
-এই মেয়ে দিন দিন কি ছোট হয়ে যাচ্ছিস নাকি বড় হচ্ছিস? এভাবে বেপর্দা হয়ে বিয়ে বাড়িতে যাবি কত অপরিচিত পুরুষ মহিলা থাকবে ওখানে আর তুই এতো নির্লজ্জ হয়ে যাবি? -উফ আপু!!! এটা এখনকার ফ্যাশন সবাই এভাবে যায়। আর বিয়ে বাড়িতে একটু সেজেগুজে না গেলে হয় নাকি? -ফ্যাশন!!!! কোনটাকে ফ্যাশন বলছিস নিজেকে পুরুষদের চোখে লোভনীয় করে তুলাটা তোদের ফ্যাশন। পশ্চিমা কালচার গুলো তো ভালোই ধারণ করেছিস। মহিলাদের যতগুলা চুল গায়রে মাহরাম পুরুষ দেখবে কাল কেয়ামতের ময়দানে ততগুলা সাপ তার চুলে জড়াবে ভুলে যাসনা। -আপু তোমার এই ওল্ড কথাবার্তা গুলো ছাড়োতো। তুমি সেকেলে রয়ে গেছো আজো। -আমি সেকেলে?? ইংলিশে অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করেও আমি কোন চাকরী না করেও দিব্যি ঘর সংসার সামলাচ্ছি। এতগুলো বছর বিজাতীদের মধ্যে থেকেও আমি তাদের কালচার নিজের মধ্যে ধারন করিনি সেই জন্য কি আমি সেকেলে?? যদি তাই হয় তবে আমি সেকেলে। আমি ওখানে থাকাকালে মা যখন তোর কথা বলতো আমি ভাবতাম হয়তো এটা বয়সের দোষ বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তুই এখন যথেষ্ট এডাল্ট এভাবে বেপর্দা হয়ে চলাফেরা কি এখন ঠিক হচ্ছে? -আপু আমি তো যথেষ্ট শালীন হয়ে চলাফেরা করছি। -এই তোর শালীনতা?? এই ওটা কি দিচ্ছিস গায়ে? -আপু এটা বডি স্প্রে। -সেটাতো আমিও দেখতে পাচ্ছি কিন্তু তুই এটা দিয়ে বাহিরে যাবি? -হ্যা কেন কি সমস্যা আবার এটাতে? -বল কি সমস্যা নেই। হাদীসে মেয়েদের সুগন্ধি জাতীয় জিনিস গুলো ব্যবহার করে বাহিরে বের হতে নিষেধ করেছে কেননা এতে করে পুরুষেরা নারীদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। মেয়েরা ব্যবহার করবে এমন জিনিস যার রং আছে কিন্তু সুবাস নেই। -আপু থামবি!! সব কথায় তুই কেন জ্ঞান দিচ্ছিস? -এটা আমার কথা নয় স্বয়ং রাসূল (সাঃ) বলে গেছেন। -তোর কথা শেষ হলে আমি বেরুবো?? -এই দাঁড়া!! বোরখা না পরে ঘরের বাহিরে এক পা ও দিবিনা। -মুনিরা এসে দাঁড়াতেই রাদিয়া বললো,, মা তুমি আপুকে বলবে? -আমি কি বলবো? ও ভুল কিছু বললে আমি বলতাম কিন্তু এখন আমি কিছু বলবোনা। আমার কথা তো শুনিসনা এখন কি করবি? -আপু প্লিজ যেতে দে আমায়। দেখ সবাই সেজেগুজে আসবে আর আমি এভাবে বোরখা পরে গেলে সবাই আমাকে নিয়ে হাসি তামাশা করবে। -সবার ভয়ে তুই এভাবে যাবি? যাকে ভয় পাওয়ার তাকে ভয় না পেয়ে ওদের ভয় পেয়ে নিজেকে ধ্বংস করবি? আজ যদি তুই ওদের বলা কথাকে উপেক্ষা করে তুই চলতে পারিস তাহলে কাল কেয়ামতের দিনে কিন্তু জয়ের হাসিটা তুই হাসবি এটা মনে রাখ। -আপু… -রাদি আমি কি কথাগুলো তোকে বুঝাতে পারছিনা নাকি তুই বুঝতে চাইছিস না? -আপু আমি বুঝতে পারছি। আমি কাল থেকে বোরখা পরে চলাফেরা করবো প্লিজ আজ যেতে দে আপু প্লিজ। -রাদি তুইতো অনেক বড় বেয়াদব হয়ে গেছিস দেখছি। তুই আমার কথাও মান্য করবিনা? একটা কথা ভালো করে শুন,, যদি বোরখা পরে পর্দায় আবৃত হয়ে যেতে চাস তাহলে যাবি না হলে বাসায় বসে থাকবি। আজকের পর থেকে তোর এভাবে হুটহাট করে বেপর্দায় বাহিরে বের হওয়া যাবেনা এটা আমার শেষ কথা। রাদিয়া জানে আজ আর কোন রিকুয়েস্টে কাজ হবেনা। কিছুক্ষণ দম মেরে বসে থেকে অগত্যা আফিয়ার আনা নেভি ব্লু কালারের বোরখাটা পরে একেবারে চোখমুখ ডেকে ও বেরুলো। রাদিয়া বেরিয়ে যেতেই আফিয়া ওর মাকে বললো,,, মা তুৃমি ওকে এভাবে চলার জন্য কিছু বলোনা? -মুনিরা রান্না করতে করতে বললো,, তোর বোন এখন বড় হয়ে গেছে আমার কথা শুনার মত বয়স ওর আর এখন নেই। সে এখন নিজে নিজে সব সিদ্ধান্ত নিতে পারে। -তাই বলে এতোটা বেড়ে যাবে? -তুই এসেছিস তুই ওকে বুঝিয়ে বিয়ের জন্য রাজি করা আমি আর পারছিনা। -বিয়ে? কি বলছো ও সবে মাত্র ইন্টার দিলো এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে? ওর পড়াশুনা এখনো অনেক বাকী। -দেখ পড়াশুনা বিয়ের পর ও করা যায়। তুই তো বিয়ের পরে মাস্টার্স করেছিস তাহলে ও কেন পারবেনা -মা আমি আর ও এক না। -হুম কথা তো সেটাই তুই আর রাদি এক না। ও যদি তোর মতো হতো তাহলে আমার কোন চিন্তা ছিলোনা। জানিস ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরই আমার ওকে নিয়ে টেনশন শুরু করতে হয়। আমি আর পারবোনা। -মা ও কি রাজি হবে? -ওকে বুঝানোর দায়িত্ব তোর। মানার মধ্যে এখন তোকে যা একটু আধটু মানে। তোর বাবা ও দেশে থাকেনা দুই দুইটা অবিবাহিত মেয়ে নিয়ে ঘরে আমি একা একা থাকি বলা তো যায়না কখন কি হয়। বিপদের তো আর হাত পা নাই। -হুম আমি দেখি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আফিয়া বললো,,, ও মা!! তোমাদের জামাই নাকি আজ বিকালেই চলে যাবে। -কি বলছিস কি? এটা হবেনা। এতদিন পর এসেছে ছেলেটা আর দুটা দিন না থেকে চলে যাবে। -মা আমার শশুরের হার্টে রিং বসাতে হবে সেটা নিয়ে নাকি হাসপাতালে কথা বলতে হবে ডাক্তারদের সাথে। -হুম বুঝছি কিন্তু আজ কোনভাবে যাওয়া হবেনা যেতে হলে কাল সকালে তুই ওকে বলে দিস। আচ্ছা বলে আফিয়া দু’কাপ চা নিয়ে রুমের দিকে গেলো। শাফী বিছানায় শুয়ে মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীমের সূরা ফাতিহার তাফসীরের বইটা পড়ছিলো। শুধুমাত্র সূরা ফাতিহার তাফসীরে যে মহামূল্যবান ব্যাখ্যাগুলো আছে শুধুমাত্র এই সূরার মর্মার্থ গুলো মানুষ অনুধাবন করতে পারলেই মানবজীবন পুরোটাই সার্থক হইতো। এই একটি সূরা পুরো কোরআনের ব্যাখ্যাটা অনুধাবন করাতে পারবে। শাফী বইটির অনেক গভীরে ঢুকে গেছে আফিয়া কখন এসে পাশে বসেছে ও টের পায়নি। আফিয়া আস্তে করে বইটা সরিয়ে নিলো। শাফীর মনোযোগ এবার আফিয়ার দিকে গেলো,, তুৃমি কখন আসলে? -সেই অনেকক্ষন হলো। আপনি তো বই পড়ার মধ্যে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন। -শাফী বললো,,আরে চা এনেছো? দাওতো!! -আফিয়া শাফীর হাতে কাপ দিয়ে বললো,, জানেন আমার না মাঝে মাঝে খুব হিংসে হয়। – শাফী চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,,,হিংসে হয়?? কেন বলতো?? আর কার উপর? -আপনার বইয়ের উপর। -বই কি দোষ করলো? -বই পড়তে বসলে আপনার অন্য কোন দিকে খেয়াল থাকেনা। এমনকি আপনার যে একটা বউ আছে তা আপনি ভুলে যান। এই বইকে মাঝে মাঝে আমার সতীন মনে হয়। -শাফী গগনবিধারী এক হাসি দেয়। -আফিয়া খানিক রাগতস্বরে বললো,,, হাসবেন না। সতীন থাকলেও হয়তো এত কষ্ট লাগেনা। -আরে বউটা আমার রাগ করেছে দেখছি। রাগ ভাঙাতে কি করতে হবে শুনি? -আমি মোটেও রাগ করিনি। -ও আচ্ছা রাগ করোমি তাহলে তো আমি বেঁচে গেলাম। আফিয়ার কাছ থেকে জবাব না পেয়ে শাফী ওর দিকে তাকালো। আফিয়াকে চিন্তিত মুখে বসে থাকতে দেখে শাফী বললো,,, কি হয়েছে,,,এত চিন্তিত কেনো?? -না তেমন কিছুনা। -যেমন কিছুই হোক আমাকে বলো। তোমাকে চিন্তিত দেখলে আমার আরো বেশি চিন্তা হয়। -না আসলে ব্যাপারটা রাদিয়াকে নিয়ে। -কেনো ও আবার কি করেছে? -কিছু করেনি তবে ওর চলাফেরা গুলো কেমন যেনো হয়ে গেছে। কিছুটা উশৃঙ্খলতা ওর মধ্যে আছে আগে এতটা ছিলোনা। -হুম। তো এখন কি করবে!! -মা চাইছে ওকে বিয়ে দিয়ে দিতে। মার ধারনা বিয়ে হলে কিছুটা হলে ও লাইনে আসবে। -তোমার কি মত? -ও মাত্র ইন্টার দিলো এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে? আর ও কি রাজি হবে? -দেখো মার কথা কিছুটা হলে ও যৌক্তিক। এখনো ও হাতের মধ্যে আছে। আজকাল ভার্সিটি গুলোর যা অবস্থা এখন যতটা লাইনে আছে হয়তো এটা ও থাকবেনা। তাই সময় থাকতে সৎপাত্রে ওকে বিয়ে দেয়াটা তোমাদের নৈতিক দায়িত্ব আমার মনে হয়। -এটা আপনি ও বলছেন? -হুম বলছি। আর তুমি এসব বিষয় নিয়ে কেন এতো চিন্তা করছো আমার বুঝে আসেনা। মনে নেই ডাক্তার তোমাকে টেনশন নিতে না করেছে। এমনিতে সবসময় প্রেশার হাই হয়ে থাকে। -আরে বাদ দেনতো!! সব কাজে ডাক্তারি ফলাবেন না। বিরক্ত লাগে। আপনার অতিরিক্ত টেক কেয়ার দেখে মনে হয় দুনিয়াতে আর কারো বাচ্ছা হয়না আমিই প্রথম। -আফিয়া আমি অতিরিক্ত টেক কেয়ার করছি তোমার মনে হয়? -আরে অতোটা সিরিয়াস নিচ্ছেন কেনো? আমি তো দুষ্টুমি করে বলেছি। -এটা দুষ্টুমির কোন কথা নয়। অন্য সবার মতো যদি তোমার স্বাভাবিক ভাবে হতো তাহলে আমার এতো চিন্তা ছিলোনা। ডাক্তার তোমাকে ফুল বেড রেস্টে থাকতে বলেছে। কিন্তু দেশে আসার পর থেকে কি করছো তুমি? একমিনিট ঠিক করে বসে থেকেছো। আসার পর থেকে টইটই শুরু করে দিয়েছো। -আপনি এটা একটা কথা বললেন?? -শাফী এক হাতে আফিয়াকে কাছে টেনে,, ওরে বাবা আমার পাগলীটা রাগ করেছে? তুমি দুষ্টুমি করতে পারবে আর আমি একটু করলেই তুমি মন খারাপ করবে? আফিয়ার মুখটা তুলে ধরে,,, দেখিতো আমার বাবুর আম্মুর কি হয়েছে? -উফ!! আপনি না!! -এইতো হেসেছে। আচ্ছা শুনো,,, আমি কিন্তু বিকালে চলে যাবো মাকে বলেছো তো? -হুম কিন্তু মা আপনাকে আজ যেতে দেবেনা। -আরে কি বলছো আমাকে যেতেই হবে। কাফী যদি দেশে থাকতো আমার এতো চিন্তা করতে হতোনা বাবাকে নিয়ে। -কেন ভাইয়া আবার কোথায় গেলো? -ওর অফিসের একটা ট্যুরে আজ সকালে ইন্ডিয়া যেতে হয়েছে। -ওহ আচ্ছা। কিন্তু মা এতো করে বলছে। -সম্ভব না গো। -আফিয়া মন খারাপ করে,, একটা রাতেরই তো ব্যাপার এমন করছেন কেনো। -থাকলে তুমি খুশি হবে? -সেটাও কি বলে দিতে হবে? -না বুঝে গেছি। -থাকবেন তো? -শাফী মুচকি হেসে বললো,,,জী আপনি এত করে বলছেন না থেকে কি করবো। সন্ধ্যা সাতটা বাজে রাদিয়া এখনো বাসায় ফিরেনি। আফিয়া ড্রয়িংরুমে বসে আছে। এই মেয়ের এত সাহস কি করে হয়? সন্ধ্যার পরে বাড়ির বাহিরে এভাবে কাটানোর সাহস কোত্থেকে আসে আজ জিজ্ঞেস করতেই হবে। আফিয়া মনে মনে ভাবে আজ কিছু কথা বলতেই হবে এই মেয়েকে। সাড়ে সাতটার দিকে দরজার বেলটা বেজে উঠলো। আফিয়া সামিহাকে ডেকে বলতেই ও গিয়ে দরজা খুলে দিলো। রাদিয়া ভীরু পায়ে ঘরের ভিতর ডুকলো। বড় বোন বাসায় না থাকলে এত চিন্তা হতোনা। রাদিয়া আসার আগে শাফী উঠে রুমে চলে গেলো। আফিয়া ভয়ংকর রাগী দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রাদিয়া ওখানেই জমে গেলো। রাদিয়া ভালো করে জানে আফিয়া অতিরিক্ত রেগে আছে এখন৷ ও যখন খুব বেশি রেগে যায় তখন ওর চোখমুখ লাল হয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। রাদিয়া বুঝতে পারছে আজ কিছু একটা তো হবেই ঘূর্নিঝড় বলো আর সাইক্লোন বা ভূমিকম্প। এ যেন ঝড়ের পূর্বাবাস…..
চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে