অঙ্গীকার (১৯তম পর্ব)

0
1996
অঙ্গীকার (১৯তম পর্ব) লেখা – শারমিন মিশু রাদিয়া দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে পানি ছেড়ে তার মধ্যে হাত পা ধরে বসে ছিলো। দুই পায়ের অনেকটা জায়গার চামড়া উঠে গেছে। দুই হাতের অনেক জায়গায়ও ফোসকা পড়ে গেছে। উত্তপ্ত গরম পানি!! আল্লাহ সহাই ছিলো বলে হাত পা ছাড়া শরীরের অন্য কোন জায়গায় ফোসকা পড়েনি। যন্ত্রনা কমছেনা। ব্যাথায় যন্ত্রনায় চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে দিলো। কিছুতেই যন্ত্রনা কমছেনা। রুমে এসে তন্নতন্ন করে স্যাভলন ক্রিম বা বার্না জাতীয় কোন ক্রিম আছে কিনা খুঁজলো। কিছু পায়নি। ওদিকে বুশরা কোলে উঠার জন্য চিৎকার করে কাঁদতেছে। রাদিয়ার দিশেহারা অবস্থা। বুশরাকে সামলাবে না নিজের যন্ত্রনায় কাঁদবে বুঝতে পারছেনা। কোনরকমে আবারো বাথরুমে গিয়ে টুথপেস্ট নিয়ে রুমে আসলো। বুশরাকে পাশে বসিয়ে পুরো টুথপেস্ট হাতে পায়ে লাগিয়ে দিলো। না কোনভাবে যন্ত্রনা কমছেনা। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে যন্ত্রনায়। ছিনছিন করে জ্বলা শুরু হয়েছে। বুশরা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। রাদিয়াও ওর সাথে শুয়ে পড়লো। শরীর গরম হয়ে আসছে। মনে হয় জ্বর আসবে।
শাফী সেই থেকে কলিংবেল বাজিয়ে যাচ্ছে রাদিয়ার কোন খবর নেই। বাধ্য হয়ে রাদিয়ার নাম্বারে ফোন দিলো। কানের কাছে ফোনের আওয়াজ পেয়ে রাদিয়া চোখ বন্ধ করে তা হাতে নিলো। চোখ খুলতে পারছেনা। কোনরকমে রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে শাফী বলে উঠলো,, কি ব্যাপার কি করছো তুমি? সেই কখন থেকে কলিংবেল দিচ্ছি খুলছো না কেন? – খুলতেছি বলেই রাদিয়া ফোন কেটে উঠে পড়লো। হুট করে ফ্লোরে পা নামাতেই আল্লাহ গো বলে ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠলো। পা অনেকখানি ফুলে গেছে এই কয়েক ঘন্টায়। হাতে পড়া কয়েকটা ফোস্কা ফেটে গেছে বিছানার ঘষা লেগে। রাদিয়া মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত আটটা বাজে। কি ব্যাপার আমি এতক্ষন ঘুমে ছিলাম? আশ্চর্য্য!! বুশরাও তো দেখি এখনো ঘুমিয়ে আছে! রাদিয়া ভালো করে ওড়না দিয়ে নিজেকে ডেকে নিলো। উনাকেই কিছুতেই দেখানো যাবেনা! উনি দেখলেই এক গাদা বকাঝকা ফ্রীতে দিয়ে দিবে। রাদিয়া দরজা খুলে দিতে শাফী সালাম দিয়ে ভিতরে ঢুকলো। রাদিয়ার চেহারার দিকে তাকিয়ে বললো,, কি ব্যাপার অসুস্থ নাকি? চোখমুখ ফুলে লাল হয়ে আছে যে? -না এমনি অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম তো তাই হয়তো। -ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে আজ দুপুরে কিছুই খাওয়া হয়নি কাজের চাপে। তাড়াতাড়ি খাবার রেডী করো আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি বলে শাফী রুমের দিকে চলে গেলো। শাফী চলে যেতে রাদিয়া একটা টিস্যু দিয়ে হাতের রক্তটা মুছে নিয়েছে। দরজা খুলতে গিয়ে ছিটকিনিতে হাতের মধ্যে গুতো খেয়ে রক্ত ছুটেছে। কথায় আছে,, ভাঙা পা গর্তে পড়ে বেশি না জানি কি একটা!!!! এখন কিছুতেই মনে আসছেনা রাদিয়ার অবস্থাও এখন তাই। পা দুটোর পোড়া জায়গা মনে হচ্ছে ব্যথা বেড়েই চলেছে। এদিকে জ্বরের প্রকোপে সোজা হয়ে দাঁড়ানো মুশকিল হয়ে গেছে। রাদিয়া চেয়ারে বসে নিজেকে কিছুটা শান্ত করার চেষ্টা করলো। তারপর উঠে কিচেন থেকে খাবার আনতে গেলো। ভাগ্যিস দুপুরের রান্না করা খাবারগুলো ছিলো। নাহলে এখন আবার রান্না করা অসম্ভব হয়ে দাড়াতো। শাফী বাথরুম থেকে বেরিয়ে তোয়ালে নিতে গিয়ে চোখ পড়লো মেঝেতে। তাজা কয়েক ফোটা রক্ত পড়ে আছে ওখানে। শাফীর বুকের ভিতর অজানা আশঙ্কায় ধ্বক করে উঠলো। এই রক্ত সেদিন আফিয়ার চলে যাওয়ার দুঃসংবাদটা দিয়েছে। কিন্তু আজ আবার রক্ত! কিসের রক্ত? বুশরা???? শাফী খাটে উঠে বুশরার হাত পা গুলো ভালো করে দেখলো। না বুশরার তো কিছু হয়নি। তাহলে?? রাদিয়া??? রাদিয়ার কিছু হয়নিতো? আরেকটু সামনে চোখ পড়তে দেখলো টুথপেস্টের খালি খোসাটা পড়ে আছে। লাল বিছানার চাদরের এখানে সেখানে সাদা টুথপেস্ট লেগে আছে। রাদিয়ার কান্নার আওয়াজ পেয়ে শাফী দৌড়ে বেরিয়ে এলো। রাদিয়া পা চেপে ধরে বসে আছে। টেবিলে খাবার রাখতে গিয়ে চেয়ারের সাথেপা খেলো ধাক্কা। তার সাথেই ছুটেছে রক্তের স্রোত। চেষ্টা করেও কান্নাটা আটকাতে পারেনি। শাফী দৌড়ে এসে রাদিয়ার পাশে বসে পড়লো। কি হয়েছে পায়ে? রাদিয়া কিছু বলার আগেই খেয়াল করলো হাতে পায়ে পোড়ার চিহ্ন? -হাত পা এভাবে পুড়লো কিভাবে? -রাদিয়া কান্না চেপে ভয়ে ভয়ে বললো,,, হাত ফসকে গরম পানির পাতিল পড়ে। -মানে? গরম পানি?? গরম পানি কিভাবে পড়ে? মন কোথায় থাকে তোমার? কাজ যখন করতে পারোনা তখন কাজ করতে বলে কে? শাফীর চোখেমুখে ভয়ে আতঙ্কিত হওয়ার ভাব। -আপনি কি এভাবে বকবেন? আমি ব্যথায় শেষ হয়ে যাচ্ছি আর আপনি বকাবকি করেই চলেছেন!!! -শাফী আর কিছু না বলে রাদিয়াকে ধরে কোনরকমে রুমে নিয়ে গেলো। -তারপর বললো,, সাথে সাথে বরফ বা ঠান্ডা পানি দাওনি? -সব দিয়েছি কিন্তু কিছুই হয়নি। পানি খুব বেশি গরম ছিলোতে! -আমার এখন ইচ্ছে করছে আরেক পাতিল গরম পানি এনে তোমার গায়ে ঢালতে! -নিষেধ তো কেউ করেনি ঢালুন না! -একটা থাপ্পড় দিবো বেয়াদব মেয়ে! মুখে মুখে আবার কথা। ঠিক করে কাজ করতে পারেনা আবার বড় বড় কথা। শরীরও তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। পায়ে মলম দাওনি? -আপনার সারা ঘর খুঁজা শেষ। একটা মলম বা প্যারাসিটামল জাতীয় কোন ঔষধই খু্ঁজে পাইনি। -আমাকে ফোন দিতে পারোনি তখন? বলে শাফী সেদিনের আনা মলমটা খুঁজতে লাগলো। সেদিনই তো একটা মলম আনলাম কোথায় গেলো? -রাদিয়া বললো,,, তখন আমি নিজের হাত পায়ের ব্যথায় মরে যাচ্ছিলাম আপনাকে ফোন করার কথা মনে থাকে কি করে? শাফী কোন কথা না বলে বেরিয়ে গেলো। মায়ের ঘরে গিয়ে খু্ঁজতে খু্জতে অবশেষে মলম টা পেলো। শাফী রুমে এসে ঠান্ডা পানি নিয়ে একটা পরিস্কার ন্যাকড়া দিয়ে পোড়া জায়গাগুলো পরিস্কার করার জন্য পা মুছতে নিলেই রাদিয়া বাধা দিয়ে বললো,, আরে আরে কি করছেন? পায়ে হাত দিবেন না। -শাফী মেজাজ গরম করে বললো,,পায়ে হাত দিলে কি আরো ফোস্কা পড়ে যাবে তোমার? -রাদিয়া ভয়ে ভয়ে বললো,, আপনি আমার পায়ে হাত দিবেন না। এটা ভালোনা! -শাফী দাঁতে দাঁত চেপে বললো,, কি হবে?? তোমার অমঙ্গল হবে! কোথায় পাও এসব কুসংস্কারপূর্ন কথা! আমি বুঝিনা তোমরা এ যুগের মেয়ে হয়েও কি করে এগুলো বিশ্বাস করো। যত্তসব!! -আপনি কথায় কথায় এমন রেগে যান কেন বলেন তো? -তুমি যেসব কথা বলো রেগে না গিয়ে কোন উপায় নেই। দেখি হাত সরাও আমাকে আমার কাজ করতে দাও। পোড়া জায়গাগুলো পরিস্কার করে তাতে মলম লাগিয়ে দিলো। জিজ্ঞেস করলো,, কিছু খেয়েছো? -উঁহু কিছুই খাওয়া হয়নি। দুপুরে তো জ্বরের ঘোরে বেহাল হয়ে পড়ে ছিলাম। খাবো কি করে? ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে এখন! -শাফী রাদিয়ার কথা শুনে হাসতে গিয়েও তা চেপে গেলো। আফিয়ার কাছে সবসময় শুনতো,, রাদিয়া ক্ষুধা সহ্য করতে পারেনা। অভ্যাসটা দেখি এখনো রয়ে গেছে। সেই ক্ষিধের যন্ত্রনা সহ্য না করতে পারা মেয়েটি আজ সারাদিন উপোস ভাবা যায়? কিছুটা দম নিয়ে বললো,, কি খাবে এখন? তরল জাতীয় কোন খাবার? -আপনার মাথা খারাপ নাকি? আপনি দেখি আমাকে একেবারে রুগী বানিয়ে ফেলেছেন। আমি কি মুমূর্ষু রুগী নাকি যে আপনি আমাকে তরল খাবার খাওয়াবেন? ক্ষিধেয় আমার পেটের মধ্যে ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে। এতক্ষণ ঘুমে ছিলাম বলে টের পাইনি। উনি আসছে আমাকে তরল খাবার খাওয়াতে! সরুন আমি এখন ভাত খাবো বলে নামতে গিয়ে আহ!! বলে শব্দ করে উঠলো। -শাফী বললো,, অতি চালাকের গলায় দড়ি বুঝতে পেরেছো তো। চালাকি দেখিয়ে নামতে গেছো এখন বুঝো ঠেলা! আমাকে বললেই তো আমি এনে দিতাম!
-আমার জন্য আপনাকে কষ্ট করতে হবেনা -তোমার জন্য আমি কষ্ট কেন করবো? আমি আমার জন্য কষ্ট করছি। -মানে?? -মানে হলো তুমি অসুস্থ হয়ে যতদিন পড়ে থাকবে আমাদের বাবা মেয়ের ততদিন খাওয়ার কষ্ট হবে। কারণ তুমি রান্না করতে পারবেনা অসুস্থ অবস্থায়। আমাদের কাপড় চোপড় গুলো অপরিস্কার হয়ে থাকবে। আরো অনেক কারণ আছে! তাই আমাদের জন্য হলেও তোমার সুস্থ থাকা জরুরী। -রাদিয়া রাগীস্বরে বললো,, স্বার্থপর!! -হুম আমি এরকমই নিজেকে ছাড়া কারো জন্য ভাবিনা বলে উঠে গেলো। সব খাবার শাফী রুমে নিয়ে আসলো। প্লেটে খাবার বেড়ে রাদিয়াকে খাওয়াতে গেলে রাদিয়া ওর হাত থেকে প্লেট টেনে নিয়ে বললো,, আমার খাবার আমিই খাবো। আপনাকে কষ্ট দিবোনা এখনো এতটা অচল হয়ে যায়নি। বলে পাশে থাকা চামচটা হাতে নিয়ে খেতে লাগলো। কষ্ট হচ্ছে খেতে তারপরও থাক মানুষকে কষ্ট দেয়ার কি দরকার? শাফী ওর সামনে বসে নিরবে তা দেখতে লাগলো। খাওয়ার নিয়ে আর ওর সাথে জোর করেনি। রাদিয়া খাবার শেষে ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়লো। এতক্ষণ মুখের জোরে কথা বলেছে। না হলে শরীরের যেঅবস্থা উঠে বসার মত শক্তি ছিলোনা। রাদিয়া ঘুমিয়ে পড়লো। শাফী ওর দিকে তাকিয়ে বসে ছিলো। বড্ড অভিমানী মেয়েটা!!! শাফী উঠে চলে যাচ্ছিলো,, তখনি বুশরা কান্না করে উঠলো। ওকে কোলে নিয়ে রুমের মধ্যে কতক্ষণ হাটাহাটি করলো। গরম পানি করা ছিল ফ্লাক্সে ওখান থেকে পানি নিয়ে বুশরাকে পিটার বানিয়ে খাইয়ে দিলো। রাদিয়ার মত ওর পেটের ভিতরও ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। ক্ষুধা সেই কখন লেগেছে রাদিয়ার এরকম অবস্থা দেখে খাওয়ার কথা মনেই ছিলোনা। বুশরাকে পাশে বসিয়ে প্লেটে ভাত বেড়ে নিজেও খেলো মাঝে মাঝে বুশরাকে ও একটু একটু করে খাওয়ালো। বুশরা ঘুমিয়ে পড়তেই শাফী বারান্দায় রাখা চেয়ারটায় গিয়ে বসলো। শাফী আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাদিয়াকে তার মনের কথাটা জানিয়ে দিবে। কিন্তু কি হলো? আশায় গুড়েবালি পড়লো!!! আবারো সেই অপেক্ষা!! অপেক্ষা জিনিসটা বড্ড কষ্টের!! আজ আবার ভেতর বাহির জুড়ে শূন্যতা,, না জানি কবে পাবে না বলা মনের কথাগুলো পূর্ণতা!!!! চলবে……….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে