অঙ্গীকার (১৮তম পর্ব)

0
1830
অঙ্গীকার (১৮তম পর্ব) লেখা – শারমিন মিশু ভোরের আযানের শব্দে রাদিয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। কাল রাতে অবশ্য বেশ ভালো ঘুম হয়েছে। অবশ্য কেন? তার কারণ অজানা। একটা ভালো লাগা মনের ভিতর থেকে ছুঁয়ে গেলো। শাফী যেভাবে ওপাশ ফিরে শুয়ে ছিলো এখনো সেইভাবেই আছো। রাদিয়া উঠে অযু করে আসলো। নামাজ পড়ার পরও দেখলো শাফী এখনো উঠেনি। ডাকবে কি ডাকবেনা চিন্তা করে অবশেষে আস্তে করে দুবার ডাকতেই শাফী উঠে গেলো। রাদিয়া বললো,, নামাজের সময় চলে যাচ্ছে তো তাই ডাকলাম। -শাফী শরীরের আড়মোড়া ভেঙ্গে বললো,,, না ঠিকআছে। আসলে কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি একটু আগেই চোখটা লেগে এসেছিলো তো তাই টের পাইনি। পরক্ষনে শাফী জ্বিভ কেটে মনে মনে বলে,, আশ্চর্য্য আমি ওকে এত কৈফিয়ত দিচ্ছি কেন? চোখ খুলে সামনের দিকে তাকাতেই দেখলো রাদিয়া চলে গেছে এখান থেকে। আজব!! মাত্রই না দেখলাম এখানে এখন আবার কই গেলো? শাফী উঠে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো। শাফী নামাজ পড়ে জায়নামাজ রাখছিলো। রাদিয়া বারান্দা থেকে এসে কোরআন শরীফ তাকে রেখে বললো,, আমি কি আপনার বইয়ের তাক থেকে একটা বই নিতে পারি? -হুম কেন নয়! যেটা খুশি নিয়ে পড়ো। রাদিয়া পুরো তাক ঘেটে মু. নাঈম সিদ্দিকীর (কবরের জীবন) বইটা নিয়ে আবারো বারান্দার দিকে চলে গেলো। শাফী নিজেও তাফসীরুল কুরআন নিয়ে খাটে পা মেলে বসলো। কুরআন তাফসীরসহ ভালো করে জেনে বুঝে না পড়লে আবার ওর শান্তি লাগেনা। মনে হয় যেন লবনবিহীন তরকারী। কুরআন মুখস্থ করার চেয়ে ভালো করে জেনেবুঝে অর্থসহ পড়লে সওয়াব বেশি হয় তাই শাফী সেভাবেই পড়ছে। প্রতিদিন অন্তত দশ আয়াত করে হলেও পড়ার চেষ্টা করে। নাহলে মনের তৃপ্তি পাওয়া যায়না। রাদিয়া বেরিয়ে কিচেনে চলে গেলো। ইফতি এখনো বেরোয়নি। রাদিয়া রুটির জন্য আটা করে সবজি কেটে নেয়। ইতিমধ্যে ইফতি চলে এসেছে। দুজনে মিলে সকালের নাস্তা বানালো। কথায় কথায় ইফতি বলে,, রাদিয়া কাল ভাইয়া রাগারাগি করে নাই তো? -রাদিয়া মুচকি হেসে বললো,,, আরে না রাগারাগি করবে কি? সেই সুযোগই তো পায়নি। আন্টি কাল কথা দিয়ে এমনভাবে মুখ বন্ধ করেছে যে আর কথা বলারই সাহস হয়নি। একেবারে ভেজা বিড়ালের মত চুপসে.. এটুকু বলতেই দরজার দিকে চোখ পড়লো। শাফী ডাইনিং থেকে রাদিয়ার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। এইরে সেরেছে!! -ইফতি রুটি সেঁকছিলো বললো,, কি হলো কি সেরেছে? -ইফতি আজ আমার কপালে শনি আছে। -কেন? -তোমার ভাইয়া সব শুনে ফেলেছে। -রাদিয়া আজ আবার তোমার খবর করবে সাবধান।
Tl রাদিয়ার ফোন বাজছে। রাদিয়া রুমে ঢুকে ফোনটা কানে দিয়ে বারান্দার দিকে চলে গেলো। কথা বলা শেষ করে ফোন রেখে বেরুতে নিলে শাফী পিছন থেকে বলে উঠলো,, এক রাতেই দেখি সাহস অনেক বেড়ে গেছে। শাশুড়ির সাপোর্ট পেয়ে দেখে উড়াউড়ি শুরু হয়ে গেছে। -রাদিয়া জিভে কামড় দিয়ে মনে মনে বললো,, রাদি আজ তোর খবর আছে। -কি হলো কথা নেই কেন? আমি ভেজা বিড়াল? ভিজা বিড়ালের মত কাল চুপসে গেছি? – না মানে!! -কি না মানে? আর কখনো যদি আমার সমালোচনা শুনি তো খবর করে ছাড়বো। আমি ভেজা বিড়াল নাকি রাগি সিংহ তখন দেখিয়ে দিবো। -রাদিয়া কিছু না বলে চুপটি করে বেরিয়ে গেলো। মনে মনে বলে রাদি,, সাবধান! এভাবে আর কখনো কথা বলবিনা। আজ তো ছেড়ে দিয়েছি পরের বার তোর নিস্তার নেই। বেশ কিছুদিন পরের কথা। শাফীর কি যেন একটা কাজ পড়ায় ও বাথরুমে ভেজা কাপড়গুলো রেখেই বেরিয়ে পড়লো। রাদিয়া বুশরার কাপড় ধুতে গিয়ে বালতিতে ভেজানো কাপড় দেখে ধুয়ে দিলো। শুকানোর পরে সেগুলো আয়রন করে ওয়ারড্রোবে রেখে দিলো। পরেরদিন শাফী বেরুতে গিয়ে মনে পড়লো কালকের জামাকাপড় গুলোর কথা। কাল অনেক রাতে বাড়ি ফেরায় সেগুলো ধোয়ার কথা মনে ছিলোনা। আর এখন যে বেরুবে একটা শার্টও আয়রন করা নেই। কি পরে বেরুবে। শাফী আলমারী পুরো খু্জলো একটা আয়রণ করা শার্ট পাওয়া যায় কিনা। রাদিয়া পিছন থেকে বললো,,, কি খুঁজছেন? -শাফী গম্ভীরস্বরে বললো,, কিছুনা। -আপনি আমাকে বললে,, আমিও খু্জে দিতে পারবো হয়তো। -কোন দরকার নেই তুমি নিজের কাজে যাও। আমার যেটার দরকার আমি নিজেই খুঁজে নিবো। -রাদিয়া ওয়ারড্রোব খুলে কালকের জামাকাপড় গুলো নিয়ে খাটের উপর রেখে চুপচাপ বেরিয়ে এলো। -শাফী খু্ঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে শেষে কালকের পরা শার্টটা পরতে নিলেই দেখলো খাটের উপর সুন্দর করে আয়রন করে কালকের জামাকাপড় গুলো রাখা। কিছু বলতে নিয়েও চুপ করে গেলো। মনে মবে কিছুটা খুশিই হলো। মেয়েটা এভাবে আমার সংসার সামলাচ্ছে। আজকের কাপড়গুলো ও ধুয়ে না রাখলে তো অপরিস্কার শাট পরেই বেরুতে হতো। অন্তত কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মেয়েটাকে একটা গিফট তো দিতেই হয়। রাতে শাফী ফিরলো নয়টার দিকে। রাদিয়া তখন বুশরাকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও একটু শুয়েছিলো। ইফতি আজ বাবার বাড়ী গিয়েছে তাই রাদিয়ার উপর কাজের চাপ একটু বেশি ছিলো। এদিকে বুশরাটা ও ইদানিং অনেক জ্বালাচ্ছে। সারাদিনে একটু বিশ্রাম নিতে পারেনি। শাফী রুমে ঢুকেই রাদিয়ার দিকে চোখ গেলো। এই প্রথম শাফী রাদিয়ার দিকে ঠিক করে তাকিয়েছে। কি নিষ্পাপ একটা মুখ! দেখলেই মায়া লেগে যায়। রাদিয়া যে এতোটা মায়াবতী শাফী এর আগে খেয়াল করেনি। ডানগালে একটা ছোট্ট তিল মুখটাকে আরো মায়াবী করে তুলেছে। শাফী রাদিয়ার দিকে এগিয়ে গেলো। মুখের উপরে আসা চুলগুলোকে সরাতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। কি করছি আমি? এ তো অনেক বড় অন্যায়!! তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে ওখান থেকেমসরে এলো। রুমে এটা সেটা রাখার টুংটাং শব্দ পেয়ে রাদিয়ার ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ মেলে শাফীকে দেখতে পেয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। মাথার পাশে ওড়নাটা নিয়ে মাথায় কোনো মতে মাথায় পেঁচিয়ে নিলো। আপনি কখন আসলেন? -এইতো কিছুক্ষণ হলো। অসময়ে ঘুমাচ্ছো কেন? -এমনি একটু মাথাব্যথা করছিলো তো তাই। -ওহ। ঔষধ খেয়েছে? -না। -কেন? রাদিয়া কে কিছু না বলার সুযোগ দিয়ে একটা প্যাকেট রাদিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,, এখানে একটা জামা আছে দেখতো পছন্দ হয় কিনা? নাহলে কাল পাল্টে আনবো। -রাদিয়ে কন্ঠে উচ্ছ্বাস নিয়ে বললো,, খুব পছন্দ হয়েছে। -তুমি তো জামাটা দেখলেই না কি করে পছন্দ হলো? -নিজের বোকামির জন্য রাদিয়া নিজের মাথায় মৃদু চাপড় দিলো। – টেবিলে খাবার দাও বলে শাফী ওয়াশরুমের দিকে গেলো। রাদিয়া জামার প্যাকেটটাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে দিলো। এতটা আনন্দ এর আগে কখনো হয়নি ওর। এটা ঠিক যে প্রিয় মানুষের কাছ থেকে পাওয়া ছোটখাটো জিনিসগুলো ও অনেক স্পেশাল হয়। এটার অনুভূতি আলাদা। একই রুমে থাকতে থাকতে কখন যে শাফীকে পছন্দ করে ফেলেছে সেটা ও নিজেও জানেনা। ব্যাপারটা এমন যে কারণে অকারণে শাফীর সামনে ঘুরঘুর করতে অনেক ভালো লাগে। শাফী খেতে বসলে এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। শাফী যখন কম্পিউটারের কিবোর্ডে আঙ্গুল দিয়ে খটখট করে আওয়াজ তুলে সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। ও যখন একদৃষ্টে বইয়ে মুখ ডুবিয়ে থাকে তখন তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। এটা কি ভালোবাসা নাকি ভালোলাগা বুঝতে পারেনা রাদিয়া। শাফী ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বললো,, আজ কি ভাত খাবোনা নাকি? সেই কখন বলে গেছি খাবার রেডি করতে এখনো বসে আছো? -রাদিয়া কোনমতে হাতে থাকা প্যাকেটটা রেখে বেরিয়ে গেলো। কি লজ্জা!! উনার সামনে উনার আনা গিফটা আমি নিয়ে বসেছিলাম। কি ভাববে উনি? মনে করবে আমি কখনো ?? ছি!! কি নির্লজ্জ আমি! রাদিয়া টেবিলে খাবার দিচ্ছিলো শাফী এসে চেয়ার টেনে বসলো। অর্ধেকটা খাওয়ার পরে ওর মনে পড়লো রাদিয়া খেয়েছে তো? খাওয়া থামিয়ে বললো,, তুমি খেয়েছো? -রাদিয়া মাথা নেড়ে বললো,, আপনি খেয়ে নিন আমি পরে খাবো। -পরে কেন? বসো একসাথে খাই। -বসো একসাথে খাই কথাটা বলার সাথে সাথে রাদিয়ার ভেতর বাহিরে এক আনন্দলহরী দোলা দিয়ে গেলো। শাফী বলার সাথে সাথে ও বসে পড়লো যেনো এই বলার অপেক্ষাটাই ছিলো এতক্ষণ। শাফী একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মন দিলো। রাদিয়া টেবিল গুছিয়ে রুমে আসতেই শাফী বললো,, যদি কষ্ট না হয় তো এক কাপ চা করে দিতে পারবে? -রাদিয়া বললো কেন পারবোনা,,আমি এক্ষুনি দিচ্ছি বলেই তড়িৎ গতিতে বেরিয়ে গেলো। আজ হচ্ছেটা কি আমার সাথে? উনি এতো ভালো ব্যবহার করছে কেন আসার পর থেকে? আমার জন্য গিফট আনলো,, আমাকে খেতে বললো উনার সাথে! তাহলে কি উনিও আমার মত? চা এনে টেবিলে রেখেই রাদিয়া দাঁড়িয়ে রইলো। শাফী কিছুক্ষণ রাদিয়াকে পর্যবেক্ষণ করে গম্ভীরস্বরে বললো,, আজ মনে আনন্দ বেশি মনে হচ্ছে? -মা,, মা,, মানে? -মানে আবার কি? এভাবে দাড়িয়ে আছো কেন,, কিছু বলবে কি? -উঁহু। -তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? -আপনার কিছু লাগবে কিনা তাই। -আমার কিছু লাগলে আমি নিয়ে নিতে পারবো। তুমি যাও ঘুমিয়ে পড়ো। -রাদিয়া শাফীর অদেখায় একটা ভেংচি কেটে খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লো। উফ!! লোকটা এমন কেন? কিছুক্ষণ শান্ত স্বভাবের মনে হয় উনার চেয়ে ভালো আর কেউ নেই। আবার কিছুক্ষণ পরেই বদমেজাজি হয়ে যায়। একে বুঝা মুশকিল!! কেউ কি বলেছে আমার জন্য উনাকে জামা আনতে,, আবার ভদ্রতা দেখিয়ে আমাকে খেতে বলে। আর আমিও একেবারে উনার একটুখানি সুন্দর কথায় ধেই ধেই করে নাচা শুরু করছি। যত্তসব!! এইরকম কঠিন মানুষের মনে কারো জন্য ভালোবাসা থাকতেই পারেনা! আপুটা যে কি করে ছিলো উনার সাথে এতগুলো বছর! আমার ভাবতেই অবাক লাগছে! শাফী রাদিয়ার অবস্থা বুঝতে পেরেই নিজে নিজে হাসতে লাগলো। মেয়েটা এখনো প্রচন্ড ছেলেমানুষী স্বভাবের। তবে অল্প বয়সের আবেগটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখনো। সামান্য একটা গিফট পেয়ে এতো খুশি হয় কেউ? না মেয়েটাকে তার অধিকার থেকে এভাবে বঞ্চিত করা একদম ঠিক হচ্ছেনা। এভাবে ওকে ঠকানো হচ্ছে। আর ঠকাবোনা ওকে ওর প্রাপ্য অধিকার দিবো আমি। একটুখানি ভালো তো বাসতেই পারি!! আফিয়া ঠিকই বলেছে ওর জায়গা না দিয়েও কাউকে ভালোবাসা যায়। ও হয়তো বুঝতে পেরেছে রাদিয়াই পারবে আমাকে ওর স্মৃতির কোটর থেকে বের করে আনতে। একাকী জীবনটাকে আনন্দে ভরিয়ে দিতে তাইতো রাদিকেই ও বেছে নিয়েছে আমার জন্য। পরদিন সকালে সালেহা বেগম শাফীর বাবাকে নিয়ে গেছে উনার বোনের বাড়ী বলেছে দুদিন থাকবে ওখানে।শাফীও সেই সকালে বেরিয়েছে বলেছে ফিরতে রাত হবে। রাদিয়া বুশরাকে কোলে নিয়ে নিয়ে দুপুরের রান্নাটা সেরে নিয়েছে। আজকের সারাটা দিনই রাদিয়ার বেশ ভালো কেটেছে। কেমন যেন ঈদ ঈদ মনে হচ্ছে ওর কাছে। এতো খুশি লাগছে কেন? মনের মধ্যে বসন্তের হাওয়া বইছে উতাল পাতাল করে। বুশরাকে রুমে রেখে রাদিয়া ওর গোসলের জন্য করা গরম পানিটা নিতে কিচেনে আসলো। আনমনে চুলা থেকে পাতিলটা উঠাতে গিয়ে হাত ফসকে পানি শুদ্ধ পাতিলটা পড়ে গেলো রাদিয়া প্রচন্ড জোরে চিৎকার দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো…….
চলবে…………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে