অঙ্গীকার (১০ম পর্ব)

2
2067
অঙ্গীকার (১০ম পর্ব) লেখা- শারমিন মিশু জাওয়াদ সাহেব,,শাফী,,ক্বাফী আর ওর বাবা সহ বসে আছে ডাক্তার ইশরাক চৌধুরীর চেম্বারে উনার মুখোমুখি হয়ে। জাওয়াদ সাহেব এয়ারপোর্টে নেমে মেয়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে ওখান থেকে সরাসরি হসপিটালে চলে এসেছেন। ডাক্তার চেম্বারের বাহিরে বাড়ীর অন্য সব সদস্যরা চিন্তিত মুখে বসে আছে। ডাক্তার ইশরাককে চিন্তিত মুখে বসে থাকতে দেখে শাফী ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,,, স্যার আপনি কিছু বলছেন না কেন?? খারাপ কিছু হয়নি তো ওর? -ডাক্তার ইশরাক বললো,,,, দেখুন আমার বলতে খুব খারাপ লাগছে তারপরও বলতে হবে। উনার কন্ডিশন আর সবগুলো রিপোর্ট দেখার পর আমি পুরোপুরি নিশ্চিত যে উনার… ফুসফুসের ক্যান্সার । -ডাক্তার!!! বলে শাফী থেমে গেলো। ওর মুখ দিয়ে কোন কথা আসছেনা। -ক্বাফী বললো,,, স্যার,,, এখন আমাদের কি করতে হবে? -দেখুন যতটুকু বোঝা যাচ্ছে উনার এখন লাস্ট স্টেজ চলছে। এই মুহুর্তে অন্য কোন চিকিৎসা আমাদের কাছে নেই মেডিসিনের মাধ্যমে যতটা ভালো রাখা যায়। -স্যার বাহিরের কোনো দেশে নিয়ে গেলে..
-দেখুন বাহিরে নিয়ে গেলে যদি উনি ভালো হতো তাহলে আমি না করতাম না। মেডিকেল শাস্ত্রের রুল অনুযায়ী এরকম একজন রুগীকে যদি আমরা বাঁচাতে পারতাম তাহলে সেটা আমাদের ডাক্তাদেরই সফলতা হতো। কিন্তু এখন আমি নিরুপায়। সরি আমাদের কিছু করার নেই। খুব বেশি দেড়মাস কি দুইমাস উনি বেঁচে আছে। -ডাক্তার আপনারা কি হাসপাতালে চিকিৎসা দিবেন নাকি বাড়ি নিয়ে যাবো? -দেখুন হাসপাতালে রাখার চেয়ে যে কয়দিন আছে সবার মাঝে উনাকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করাটাই বেটার হবে। বাকীটা আপনাদের ইচ্ছা। সবাই একে একে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসলো। সবার বিষন্ন মুখের দিকে তাকয়ে বাহিরের সবার আর বুঝতে বাকী রইলোনা কি হয়েছে। মুনিরা ওখানেই বসে পড়লো। ক্বাফীর মুখ থেকে সব শুনার পর সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো। রাদিয়া কাঁদতে কাঁদতে বললো,,, আমি সেদিনই ওকে বলেছি আপু তুই ডাক্তার দেখা ও শুনেনি আমার কথা। -জাওয়াদ সাহেব রাদিয়ার কথা শুনে বললো,,, কোনদিনের কথা বলছিস? -আমি কয়দিন আগে আপুর বাসায় যায়। আর ওর সাথে কথা বলার সময় আমি ওর নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে দেখে বললাম আপু এটা কি? তোর তো ডাক্তার দেখানো দরকার? কিন্তু ও আমার কথা পুরো অগ্রাহ্য করে বললো,,, আরে এটা তেমন কোন সমস্যা না এরকম মাঝেমাঝেই হয় আমার। কিন্তু ওর কথা শুনে আমিও তখন চুপ করে যায়। মুনিরা বললো,,, তুই আমায় কেন বলিস নি? মেয়েটা আমার এতো চাপা স্বভাবের ভিতরে নিজে দুমড়ে মুচড়ে যাবে কিন্তু কাউকে বুঝতে দিবেনা। আর ওর এই চাপা স্বভাবের জন্য আজ ও মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে। কি করে হবো আমি ওর মুখোমুখি?? -মা আমি তো তখন এতটা হয়ে যাবে ভাবিই নি। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো কোনভাবে এটা আফিয়াকে বুঝতে দেয়া যাবেনা। কিন্তু কে বুঝাবে কার মনকে? কেউ তো নিজেকে সামলাতে পারছেনা ওকে কি করে বুঝ দিবে? শাফী সেই থেকে চুুপ হয়ে আছে। অনুভূতিহীন হয়ে গেছে ও। না কোন কথা বলছে না চোখ দিয়ে পানি ঝরাচ্ছে যেন পাথর হয়ে জমাট বেঁধে আছে। জাওয়াদ সাহেব মেয়ের কেবিনের দিকে গেলেন ধীর পায়ে। এই তিনটা মেয়েকে উনি বড্ড যত্নে মানুষ করেছেন। কখনো এতোটা কষ্টে পেতে দেননি। এদের জন্য বছরের পর বছর উনি ভিনদেশে পড়ে ছিলেন। আর আজ নিজের চোখের সামনে মেয়েটাকে ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখবেন এটা কি করে হয়। পৃথিবীর নিয়মগুলো এতো নির্মম না হলে কি হয়না? এতোটা স্বার্থপর কেনো পৃথিবী? জাওয়াদ সাহেব মেয়ের পাশে চুপচাপ করে বসলেন। মেয়ের সামনে কাঁদবেন না বলেও কিন্তু কোনভাবে কান্না আটকাতে পারছেন না। আফিয়া বাবার উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে তাকালো। ওকে চোখ খুলতে দেখে জাওয়াদ সাহেব তড়িগড়ি করে চোখ মুছে নিলেন। আফিয়া সেটা দেখে ও না দেখার ভান করে সালাম দিয়ে বললো,,, আব্বু কেমন আছো তুমি? কখন আসছো? -মেয়ে যখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করে কেমন আছো বাবার কি উত্তর দেয়া উচিত বলতো মা?? -আফিয়া হেসে দিলো। -হাসবিনা! আমি দেশে আসবো আমার মেয়েদের সাথে সময় কাটাবো তা না মেয়ে আমার হাসপাতালে শুয়ে বাবাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। -আফিয়া বললো,, আমি বাড়ী ফিরে যায় তারপর তোমার সাথে জমিয়ে গল্প করবো বাবা। অনেকদিন তোমায় কাছে পাইনি। কতদিন পর তোমার সাথে দেখা হলো বলো তো? তোমার সাথে বলার জন্য কত কথা জমে আছে আমার বলে অন্যদিকে তাকিয়ে নিজের চোখে আসা পানিটা আড়াল করার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর পরিবেশটা স্বাভাবিক করার জন্য বললো,,, বাবা তুমি কিন্তু অনেকটা বুড়ো হয়ে গেছো। -হুম বয়স তো আর কম হয়নি শশুর হয়েছি নাতনির নানা হয়েছি আর কতো? এ বলে বাবা মেয়ে হেসে দেয়। ততক্ষণে বাকী সবাই রুমে চলে আসে। সবার সাথে কথা বলা অবস্থায় আফিয়া বারবার শাফীকে খোঁজার চেষ্টা করলো। সবাই এখানে থাকলেও শাফী এখানে নেই। সবাই বেশ স্বাভাবিক ভাবেই ওর সাথে কথা বললো। ওইদিকে ক্বাফীকে সালেহা বেগম বাসায় পাঠিয়ে দিলো নতুন বউ বাসায় রেখে সবাই চলে এসেছে। রিসিপশান পার্টিটা কয়দিন পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। এই মুহুর্তে বাড়ীতে কোন আনন্দ অনুষ্ঠান করার ইচ্ছে কারো নেই। আফিয়াকে তিনদিন হসপিটালে রাখা হয়েছে। এই তিনদিন শাফী অনেকটা আফিয়াকে আড়াল করে থেকেছে। ওর বড্ড ভয় হয় আফিয়ার সামনা সামনি হলে ও নিজেকে সামলাতে পারবে তো? যতই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুক না কেন ওর ভিতরে কি চলছে সেটা ও জানে। যার সাথে সারজীবনে কাটানোর অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছে সেই মানুষটা যে এভাবে ওকে পর করে চলা যাবার টিকেট কাটবে এটাতো কল্পনার বাহিরে ছিলো। যদি নিয়ে যাবে উপরওয়ালা তাহলে মানুষের মাঝে এতো ভালোবাসা কেন দিয়েছে? তিনদিন পর আফিয়াকে বাসায় আনা হলো। রাদিয়া ওর সাথে এসেছে। ক্বাফীর নতুন বউ ইফতি আফিয়াকে দেখতে ওর রুমে এলো। এসেই সালাম দিলো। আফিয়া খাটের সাথে হেলান দিয়ে শুয়ে ছিলো। ইফতির সালামের আওয়াজ পেয়ে জবাব দিয়ে নিজেও সালাম দিলো। ইফতি একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। আফিয়া বললো,,, ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন বোন? এখানে এসে বসো। ইফতি এসে বসতেই আফিয়া বললো,, কেমন আছো? -জ্বী ভাবি আলহামদুলিল্লাহ। আপনার কি অবস্থা? শরীর এখন ঠিক আছেতো? -হুম আলহামদুলিল্লাহ এখন আল্লাহর রহমতে অনেকটা ভালো আছি। কিছুক্ষন চুপ থেকে আফিয়া বললো,,, আমার জন্য তোমার পুরো বিয়ের আনন্দটাই মাটি হয়ে গেলো বোন। রিসেপশান পার্টিটা ও হলোনা আমার উপর কোন রাগ নিওনা। আমি এসেছি এবার সব হবে। -ইফতি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,,, ভাবি এসব কি বলছেন? বিপদ আর কাউকে বলে কয়ে আসে। আগে আপনি সুস্থ হয়ে নিন। -আফিয়া একটা মলিন হাসি দিলো। সবাই ওকে না বললেও ও জানে ওর কঠিন কোনো রোগ হয়েছে। ইফতি উঠে চলে গেলো। আফিয়া আবার চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো। শাফী আজ কয়দিন থেকে ওর সাথে ঠিক করে কথা বলেনা,, দেখা করেনা কেমন যেনো এড়িয়ে চলে। অথচ হসপিটাল থেকে মা যখন ওকে ও বাড়ীতে নিয়ে যেতে চাইলো ও ইচ্ছে করেই নিষেধ করে দিয়েছে। যে কয়দিন বেঁচে আছে এ মানুষটার বাহুডোরেই ও থাকতে চায়। আর মানুষটা!!! কেমন এড়িয়ে যাচ্ছে। আফিয়ার চোখের কোণ পেয়ে পানির স্রোত নামছে। বুশরা কে অনেকক্ষণ থেকে দেখতে পাচ্ছেনা। কোথায় আছে মেয়েটা। আফিয়া আস্তে করে খাট থেকে নেমে দরজার বাহিরে আসতেই দেখলো রাদিয়া বুশরাকে নিয়ে এদিকেই আসছে। রাদিয়ার কোল থেকে বুশরাকে নিয়ে বললো,,, রাদি কোথায় গিয়েছিলি ওকে নিয়ে? -একটু ছাদে গেছি। -রাদি আমার মাথায় একটু পানি দিয়ে দিবি কেমন জ্বালা করছে। -হুম তুই বুশরাকে রেখে শুয়ে পড় আমি পানি নিয়ে আসছি। আফিয়া শুয়ে আছে রাদিয়া আস্তে আস্তে মাথায় পানি ঢালছে। রাদিয়ার চোখগুলো বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে। যতবার ভাবে ওর সামনে নিজেদের কষ্ট গুলো প্রকাশ করবেনা ততবারই চোখের পানি যেনো আরো বাঁধ ভেঙে নামছে। এই বোনটাই ওকে সঠিক পথে এনেছে বিপদে আপদে মায়ের পরে ওই আগলে রেখেছে। আর আজ সেই মানুষটা ওদেরকে একা করে চলে যাবে এটা ভাবতেই ওর বুক ফেটে যাচ্ছে। আফিয়া চোখ বন্ধ করে বললো,,,রাদি তুই কাঁদছিস? -রাদিয়া তাড়াতাড়ি করে চোখ মুছে বললো,,,, না না কাঁদবো কেন? -মিথ্যা বলছিস কেন? –
-আচ্ছা তুই আমাকে বলতো আমার কি হয়েছে? -কি..কি..কি হবে? কি.. কিচ্ছু হয়নি তোর? -লুকোচ্ছিস কেন? তোরা না বললে ও আমি জানি আমি আর বেশিদিন বাঁচবোনা? -আল্লাহ না করুক। এমন কথা একদম বলবিনা। তোর কিচ্ছু হবেনা। আমরা তোর কিচ্ছু হতে দিবোনা। প্রয়োজনে দেশের বাহিরে নিয়ে যাবো? -কেনো মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছিস রে রাদি? আমি তো ছোট বাচ্ছা নয় যে আমাকে যা বুঝ দিবি আমি তা শুনবো। আমি মরে যাবো এ কথাটা আমাকে বলতে তোরা এতো সংকোচ করছিস কেনো? সবাই কেন আমার সামনে এতো লুকোচুরি খেলছিস? কিসের এতো ভয় তোদের? এই কথাতে রাদিয়া ওকে ঝড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। আরে পাগলী কাঁদছিস কেন? দেখ আমি কিন্তু একটু ও ঘাবড়ায়নি তাহলে তোরা কেন এমন ভেঙে পড়ছিস। মৃত্যু আজ না হয় কাল হবে,,, সেটা স্বাভাবিক ভাবে হোক বা রোগে ভুগে। এটার জন্য এতো বিচলিত কেন হবো? -আপু তোকে ছাড়া কি করে থাকবো আমরা? -দূর পাগলী৷ আমি তো আছিই কি হবে? শুধু চিন্তা হচ্ছে আমার বুশরাটাকে নিয়ে৷ সবাই তো সব পাবে কিন্তু আমার মেয়েটা তো মা পাবেনা। এইটুকু বয়সে ওকে মা হারা হতে হবে। ব্যাপারটা অনেক কষ্টের নারে? মেয়েটার এই একটা কষ্ট জীবনভর থাকবে। – তুই বুশরাকে নিয়ে একদম চিন্তা করবিনা। বুশরার জন্য তো আমরা আছি। কথা না বলে তুই চুপচাপ একটু ঘুমাতো। -আর ঘুম!!! এতো ঘুমিয়ে কি হবে বলতো? কয়দিন পরেতো একবারের জন্য ঘুমিয়ে যাবো। -আপুউউউ কিচ্ছু আটকায়না মুখে তোর? আফিয়া টলতে টলতে উঠতে নিলেই রাদিয়া থামিয়ে দিয়ে বললো,,, কি করতে হবে আমায় বল আমি করে দিচ্ছি। -আলমারি খুলে একটা প্যাকেট দেখতে পাবি ওটা নিয়ে আয় তো? -রাদিয়া আলমারি খুলে একটা প্যাকেট দেখিয়ে বললো,,, এটা? -হুম নিয়ে আয়। -রাদিয়া প্যাকেটটা এনে বোনের হাতে দিলো। আফিয়ার বললো,,, এটা তুই রাখ রাদি। তোর বিয়ের গিফট আমি দিলাম। তখন তো হয়তো আমি থাকবোনা। আর কখনো দিতেও পারবোনা। -রাদিয়া ছলছল চোখে আফিয়ার দিকে তাকালো। তারপর প্যাকেটটা খুলে দেখলো একটা সুন্দর লাল শাড়ী। আপু গিফট দিয়ে আমি কি করবো? যেখানে তুই থাকবিনা!!! -রাদি তুই কিন্তু তোর বিয়ের দিন এ শাড়ীটাই পরবি কেমন? কথাটা বলতে আফিয়ার গলা কেঁপে উঠলো। একটু থেমে আফিয়া বললো,,, জানিস রাদি,,, এ শাড়ীটা খুব স্পেশাল,,, উনার দেয়া গিফট। আমার প্রিয়। তোর কাছে থাকলে ভালো লাগবে। রাদিয়া কান্না আটকাতে না পেরে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। রাদিয়া চলে যেতেই আফিয়াও হু হু করে কেঁদে উঠলো। রাদি তোরা ভাবছিস আমি এতো শক্ত কি করে? কিন্তু আমার ভেতরটাও যে ফেটে যাচ্ছে রে!!! তোদের সবাইকে ভালো রাখার জন্য এই মিথ্যে অভিনয় আমায় করতে হচ্ছে। এতো এতো প্রিয় মানুষগুলোকে ছেড়ে যেতে হবে এই যন্ত্রনা আমি নিতে পারিনা রে!!! আমার যে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। আমিও আর পারছিনা রে,, একদম পারছিনা…… চলবে………….

2 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে