অঙ্গারের নেশা পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0
589

“অঙ্গারের নেশা ”
পর্ব -৩০ (শেষ পর্ব)
(প্রথম অংশ)

গমগমিয়ে বৃষ্টির আওয়াজ রোজকার মতো আজ আর স্নিগ্ধ মোহময় হয়ে ধ্বনিত হচ্ছে না। বৃষ্টির ফোঁটা গুলো শোনাচ্ছে কোনো এক কিশোরীর আর্তনাদের ন্যায়। এমনটাই অনুভূত হচ্ছে কাঁচের তৈরি আবদ্ধ কক্ষে।
মাথায় ভারী জিনিস রাখা এমন লাগছে প্রানেশার।
ঘ্রাণ শক্তি লোপ পেয়েছে। নাকি, এখানে ঘ্রাণের কোনো উৎসই অবশিষ্ট নেই! বুঝতে পারছে না প্রানেশার অবচেতন মন৷
চেতনা ফিরেনি এখনো তার। ঘুমঘুম দেহে নরম শরীরটা উঠিয়ে বসালো প্রানেশা। চোখ কচলে নিলো।
চারপাশে হালকা ঝাড়বাতির আলো ৷ চোখ মেলতেই চারপাশের পরিবেশ অচেনা মনে হলো। পুরো রুমের নকশাই আলাদা৷ রুম বললে বোধ হয় ভুল হবে৷ এত বড় রুম হয়! কেমন গা ছমছমে।
ঘুমের ঘোর কাটতেই মনে পড়লো সে তো পরীক্ষার হলের বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলো। ইভানান হঠাৎ তার মুখে রুমাল চেপে ধরলো। তারপরই সব অন্ধকার। অর্থাৎ,তাকে ইভানান কিডনেপ করে ফেলেছে।
সুফিয়ান নিশ্চয়ই খুঁজছে তাকে! সুফিয়ান কী জানে ইভানানের এই জঘন্য অপরাধের কথা? মনে একের পর প্রশ্ন দলা পাকিয়ে বেরিয়ে এলো। বিছানা থেকে নামতে নিতেই চমকে উঠলো। একি! তার পা অবশ হয়ে আছে। পা পাথরের মতোন লাগছে। অদ্ভুত! কোনো অনুভূতি হচ্ছে না। এটা কী করে হলো!

খট করে দরজা খুলে কেউ ভেতরে ঢুকে পড়লো। হালকা আওয়াজে দরজাও আঁটকে নিলো। প্রানেশা চোখ তুলে চাইতেই সামনের দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠলো ইভানানের চেহারা। আবছা আলোয় কী ভয়ংকর দেখাচ্ছে নীল চোখদ্বয়! প্রানেশা পেটের কাছটা খামচে ধরে রেখেছে। চিনচিনে ব্যথা উঠছে। ছয় মাসের পর থেকেই এমন ব্যথা করে। আজ পরিমাণ বেশী। শরীর নাড়াতে না পেরে ব্যথাটা বেড়ে যাচ্ছে। ইভানান বেডের মাঝ বরাবর টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো। প্রানেশার হাত মৃদু কাঁপছে। ইভানান যদি খারাপ কিছু তার সাথে করার চেষ্টা করে, এই রকম শরীর নিয়ে প্রানেশা হয়তো কুলিয়ে উঠতে পারবেনা। এ ভেবেই অন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো। ইভানান অদ্ভুত স্বরে বললো –

‘স্রোতস্বিনী! ‘

প্রানেশা ভাবনার দুয়ার থেকে বেরিয়ে গেলো। অস্থির ভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। তারপরও নিজেকে সামলে সাবধানতার সঙ্গে কঠোর গলায় বললো –

‘সমস্যা কী আপনার! সুফিয়ানের কম ক্ষতি তো করেননি আপনি। তারপরও কী চান? ‘

ইভানান হাসলো ৷ ভয়ংকর হাসি। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়ার ন্যায় হাসি। প্রানেশার কাছে এসে কিছুটা ঝুঁকে গালের উপরে পড়ে থাকা চুলগুলো পিছনে সরিয়ে দিলো। হাসিমুখেই প্রানেশার নরম কোলে মাথা রেখে হাত ভাজ করে শুয়ে পড়লো। প্রানেশার গা অস্বস্তিতে গুলিয়ে আসতে শুরু হলো৷ দুই হাতে ধাক্কা দিয়ে মাথাটা নিচে নামিয়ে দিলো। ইভানানের ঘুমন্ত রাগ ডগমগিয়ে উঠলো। তেড়ে এসে প্রানেশার গাল চেপে ধরলো। সাপের মতো ফেনা তুলার ভঙ্গিতে বললো-

‘একদম চুপ! আমাকে রাগান্বিত করবেন না স্রোতস্বিনী
এর ফল ভালো হবে না ‘

কিছুটা সময় পর ছেড়ে দিয়ে পাশে বসলো সে। প্রানেশা ভয়ে অস্ফুটস্বরে গোঙাচ্ছে। শ্বাস প্রশ্বাস ঘন ঘন। ইভানান সেদিকে এক পলক তাকিয়ে হাস্যজ্জ্বল কন্ঠে বললো –

‘স্রোতস্বিনী, আপনি জানেন আমরা এখন কোথায় আছি? ‘
থেমে নিজে নিজেই বললো –
‘নীলগিরি ‘

উচ্ছ্বাসের সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত পদে হেঁটে লম্বা কাঁচে ঘেরা জানালাটা খুলে দিলো। বৃষ্টির বেগ হালকা হয়ে এসেছে। সামনেই ছোট নদীর স্বচ্ছ পানির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আজকের দিনটা ইভানানের অদ্ভুত সুন্দর মনে হচ্ছে। হবেই না বা কেনো! তার স্রোতস্বিনী যে তার কাছে। কত সাধনাই না করেছে সে এই দিনের অপেক্ষায়। প্রানেশার দিকে এগিয়ে আসলো। প্রানেশা ভয়ে কাতর হয়ে গুটিয়ে বসে আছে। ইভানান গম্ভীর গলায় বললো –

‘সুফিয়ানের ক্ষতি আমি কেনো চাই জানতে চান আপনি?’

প্রানেশা স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো। সত্যটা তো সে জানে। তারপরও ইভানানের মুখে শুনতে মুখিয়ে আছে। ইভানান প্রানেশার কাঁধের চুল পেছনে দিয়ে বললো-

‘আমি জানি, সুফিয়ান আপনাকে ইনায়ার কথা বলেছে। ‘

থেমে আবার বললো- ‘কিন্তু, এরপরও কেনো এসব করছি জানেন? ‘

প্রানেশার কোমল গালে দুই হাত রেখে বললো –

‘শুধু মাত্র আপনার জন্য স্রোতস্বিনী!কারণটা আপনি’

প্রানেশা অবাক চোখে বললো-

‘আমি! ‘

‘হ্যা, সেই প্রথম দিন আপনাকে যখন দেখলাম জানিনা কী হয়েছিলো আমার। দুনিয়াটাই উলোট পালোট করে দিয়েছিলো। রাতের নিদ্রাহীন প্রহরের সৃষ্টি করেছিলেন। ইনায়ার মৃত্যুর প্রতিশোধ আমি অন্য ভাবে নিতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম রেয়ান আর ছোট চাচিকে চিরদিনের জন্য ওর থেকে কোনোভাবে দূরে সরিয়ে দিবো। রেয়ানটা তো বোকা ৷ ওকে নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে আসবো। কিন্তু, সুফিয়ান আরও একবার আমার আপনজন কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করলো। আমার স্রোতস্বিনীকে নিজের করার চেষ্টায় উঠেপড়ে লেগেছিলো। অসহ্য লাগতে শুরু করলো আমার। দিনরাত নিজের ভালোবাসার মানুষের কথা অন্য কারো মুখে শুনতে শুনতে হৃদয়ে বিষাক্ততা ছড়িয়ে পড়ছিলো। তারপর হঠাৎ একদিন সুফিয়ানের মুখে শুনলাম আপনিও ওকে ভালোবাসেন। সহ্য করতে পারিনি আর। মনে মনে ভেবে নিলাম, আপনাকেও বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ওকে একেবারে নিঃশেষ করে দেবো। রেয়ানকে ধীরে ধীরে বোঝালাম সুফিয়ান ওর ভালো চায় না। রেয়ান প্রথমে বিশ্বাস না করলেও আমি বারবার এক কথা স্মরণ করানোতে বাধ্য হয়ে বিশ্বাস করলো। সবই মস্তিষ্কের খেলা। ততদিনে রেয়ান আমার বশে। ফুলপ্রুভ প্ল্যান সাজিয়ে নিলাম। যেদিন সুফিয়ানের কনসার্ট। সেদিন কনসার্টের চেয়ে বেশি আপনার সাথে দেখা করার জন্য উৎফুল্ল ছিলো৷ আমিই ওর এক্সিডেন্ট করিয়ে দিলাম।
আরেকটু সহজ হলো আমার জন্য, ওর গলায় সমস্যা
হয়ে গেলো। আমার উদ্দেশ্য ছিলো ওকে আপনার কাছে পৌঁছাতে আটকানো। যেভাবেই হোক ৷ কিন্তু গলায় আঘাত পাওয়াটা সম্পূর্ণ প্ল্যানের বাহিরে। রেয়ান যে গাইতে পারে এটা আমার প্লাস পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ালো৷ আমি ওকেই গানের দুনিয়ায় মগ্ন করে তুললাম। ক্যারিয়ার থেকে ওর নিজের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেলো।
ততদিনে ওকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিলাম। আমি গেলে আপনি হয়তো আমাকে মেনে নিতেন না। কারণ কোনোকিছুই আমার সঙ্গে মিলতো না। কিন্ত, আপন ভাই হওয়ায় রেয়ানের সঙ্গে মিলে যায়। রেয়ান আমার কথায় উঠবে আর বসবে বলেই আমি ওকে আপনার কাছে পাঠালাম। রিলেশনে আপনার সাথে থাকলেও আমরা কথামতো চলতো৷ সুফিয়ানকে ইমোশনাল করে ওর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমালাম। লোকজন লাগিয়ে রাখলাম টাকা দিয়ে যাতে সুফিয়ান বাংলাদেশের কোনো খবর না পায়।
আমার উদ্দেশ্য ছিলো ওকে একটা ধাক্কা খাওয়ানো। যেদিন ওর জন্মদিন সেদিনই তনিমকে মুক্ত করে দিলাম। বোকাটা বোঝেইনি, যে সবই আমার প্ল্যান।
সুফিয়ান কীভাবে যেনো সব ঠিকঠাক করে আপনাকে বিয়ে করে নিলো৷ সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো বটে। ‘

প্রানেশা বিস্ময়ে বিভোর হয়ে গেছে। একজন মানুষ কতটা নিচুস্তরের হতে পারে! ঘৃণায় মুখ কুঁচকে রইলো।
ইভানান অস্থির কন্ঠে বললো-

‘আমার কিচ্ছু চাইনা স্রোতস্বিনী। আপনি আমার হয়ে যান৷ খুব ভালোবাসবো আপনাকে। আর কারো ক্ষতি করবো না ‘

প্রানেশা ধাক্কা দিয়ে গালে রাখা হাতটা সরিয়ে দিলো।
চিৎকার করে বললো –

‘পাগল আপনি। একে ভালোবাসা বলেনা। পাগলামো বলে। যে নিজের আপন বন্ধুর সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করে সে আমাকে কী করে ভালোবাসে! ‘

ইভানান হিংস্র রুপে বললো-

‘হ্যা, পাগল হয়ে গেছি আমি! এই পাগলেরই হতে হবে আপনার। ‘

পরমুহূর্তেই আদুরে কন্ঠে বললো –

‘আপনার সন্তানকেও আমি নিজের সন্তানের চোখে দেখবো। কোনো অবহেলা হবে না। তারপরও বিয়ে করুন, আপনি আমায় ভালোবাসুন ‘

প্রানেশা কোনো কথা না শুনে নামার চেষ্টা করলো৷ কিন্তু পা দুটো নাড়াচাড়া করা যাচ্ছেই না। কী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। ইভানান হেঁসে বললো –

‘আপনাকে ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। আগামী এক ঘন্টায় আপনার পায়ের অবশ ভাব সরবেনা। বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই ‘

প্রানেশা চিল্লাতে চিল্লাতে বললো-

‘কেনো করলেন এমন? ‘

‘এমন না করলে যে আপনি বারবার চলে যাওয়ার চেষ্টা করবেন! আপনাকে বেঁধে রাখতে হবে। কষ্ট হবে আপনার, আর তা আমি কী করে সহ্য করবো বলুন তো!’

প্রানেশা বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লো সে। এখন যে পা নাড়াতে না পেরে আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে। এমনিতেই ছয় মাস হওয়ার পর থেকে এক জায়গায় বেশি সময় বসলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আর এখন তো ইয়াত্তাই নেই। সেই কখন থেকে পা অবশ। নাহ, এই পাগলকে অন্য কায়দায় বোঝাতে হবে। প্রানেশা বুক ফুলিয়ে শ্বাস টেনে বললো-

‘দেখুন, আপনি যা করছেন তা সবার জন্যই ক্ষতিকর। আমি বিবাহিত, কয়েক দিন পর এক বাচ্চার মা হবো৷ আমাকে বিয়ে করে কী লাভ! আমি সুফিয়ানকে ভালোবাসি। ‘

ইভানানের চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো। তেড়েমেড়ে এসে প্রানেশার গলা চেপে ধরলো। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এলো প্রানেশার। মুহূর্তেই চোখ উল্টে আসতে শুরু করলো৷
আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে মৃত্যু অতি সন্নিকট হবে। ইভানান রাগের মাথায় প্রানেশাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলো ফ্লোরে । প্রাণ সঞ্জিবনী ফুরিয়ে আসলো বোধ হয়। তলপেটের দিকটা ছিড়ে যাওয়ার মতো ব্যাথা অনুভব হচ্ছে।
হঠাৎ সম্বিত ফিরলো ইভানানের। নিচে নেমে উঠাতে যাবে এমন সময় কে যেনো লাথি মেরে দরজা খুলে ফেললো৷ চমকে তাকালো সেদিকে৷ সুফিয়ানের মতো মনে হলেও ধরে ফেললো এটা রেয়ান।
অনেকক্ষণ ধরেই বাহিরে দাঁড়ানো ছিলো সে৷ ইভানানের প্রতিটি কথাই শুনেছে সে৷ মস্তিষ্ক রাগে টগবগ করছে। বিশ্বাসই করতে পারছেনা যে, ভালো মানুষীর মুখোশ পড়ে কত বিচ্ছিরি এক খেলা খেলছিলো। অস্ট্রেলিয়ায় ইভানানের বাড়িতেই ছিলো। ইভানান এক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে ফিরেছে। রেয়ানের অফিসের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় সেও ফিরে এলো৷ ইভানানের বান্দরবনে আসার কথা বাড়ির কেয়ার টেকারের থেকে শুনলো। নীলগিরিতে কী করছে ভেবে পেলো না সে। কারণ পেইন্টিং এর কাজ এখন সিলেট ছিলো৷ ইভানান হয়তো জানতো না টেক কেয়ার ওর নীলগিরিতে থাকার কথা বলে দেবে। রেয়ান যে সব সত্যি জেনে গেছে এটা বুঝতে পারলো।

রেয়ান দ্রুত পদে এগিয়ে আসলো৷ ইভানানের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না। তুমি এমন জঘন্য মানুষ,ছি! ‘

থেমে উত্তেজিত কন্ঠে বললো-

‘আমি সুফি ভাইকে সব বলবো। এখনই ডেকে আনছি’

প্রানেশার আর্তনাদের পরিমাণ বাড়ছে। প্রানেশার দিকে তাকিয়ে মায়া হলো তার। অজান্তেই সবার অপরাধী হয়ে গেছে সে। নিজেকেই একবার ধিক্কার দিয়ে উঠলো মনে মনে রেয়ান ।

পরমুহূর্তেই দৌড়ে বেড়িয়ে সুফিয়ানকে খবর দিতে নিলেই পেছন থেকে ইভানান পাশের ফুলদানি দিয়ে মাথায় আঘাত করলো৷ দুনিয়া ঘুরে উঠলো রেয়ানের।
ঘাড় বেয়ে নামতে লাগলো লহুর সরু লাইন। ফ্লোরে পড়ে থেকে রেয়ানের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রানেশা। কিছুই যেনো করার নেই৷ সুফিয়ান না আসা পর্যন্ত কিছু করা সম্ভব হবে না। রেয়ান লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে,হালকা জ্ঞান আছে । ইভানান পাগলের মতোন হাসতে হাসতে প্রানেশার দিকে ঝুঁকে বললো-

‘এত দিনের স্বপ্ন কী করে ধুলোয় মিশে যেতে দেই বলুন স্রোতস্বিনী! আপনি যে আমার বহু আকাঙ্খিত নারী। কত কিছু করেছি আমি আপনার জন্য। আপনি বাঁচলে শুধু আপনার নীল পুরুষের জন্য বাঁচবেন। যে আমার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে তাকে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দেবো আমি। ‘

প্রানেশার ব্যাথার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। মুখ নীলচে রঙ ধারণ করছে। সহ্য করতে না পেরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ইভানান বললো-

‘আপনার কষ্ট হচ্ছে স্রোতস্বিনী?আরেকটু কষ্ট সহ্য করুন আমি ডাক্তার ডাকছি৷ ‘

প্রানেশাকে কোলে তুলে নিয়ে বেডে শুইয়ে দিলো। এক ঘন্টার মতো হয়ে এসেছে প্রায়। প্রানেশা পা দাপিয়ে চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে। ইভানান মোবাইল নিয়ে কল করে পেছনে ফিরতেই কিছু পড়ার আওয়াজ আসলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সুফিয়ান ভেতরে ঢুকে পড়লো। ইভানান চমকে উঠলো। এত কড়া নিরাপত্তা ভেঙে কী করে প্রবেশ করলো বুঝতে পারছে না সে ৷ সুফিয়ানের শরীর ঘামে ভিজে একাকার। সেই সকাল থেকে প্রানেশাকে না পেয়ে কলিজা শুকিয়ে গেছে । কোথায় যেতে পারে ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছিলো না। ফোনটাও রাস্তায় একটা দোকানের সামনে পেলো৷ অনেক খোঁজ খবরের পর নীলগিরিতে আসার খবর পেলো শেষমেষ।

প্রানেশাকে চিৎকার করে কাঁদতে আর রেয়ানকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে সমস্ত রাগ দাউদাউ করে জ্বলজ্বল করে উঠলো৷ বন্ধুত্বের মর্যাদা রেখে এতদিনের সকল অপরাধ ক্ষমা করেছিলো। অথচ, ইভানান এখনো শুধরায়নি। এবার আর কোনো ক্ষমা নেই। সোজা ইভানানের গালে চড় বসিয়ে দিলো। কলার টেনে দুটো ঘুষি মেরে বললো-

‘তোকে এবার আর ক্ষমা করবো না৷ তুই না মরা পর্যন্ত শান্তি হবেনা আমার৷ সব সীমা লঙ্ঘন করে ফেললি ‘

ইভানানের নাক দিয়ে রক্ত ঝড়ছে৷ তারপরও মুখে হাসি। হাসতে হাসতেই বললো-

‘মার, আমিও দেখি ‘

সুফিয়ান একের পর এক ঘুষি মেরে লাথি মারতেই ইভানান পাল্টা আক্রমণ করলো৷ সুফিয়ান দুই কদম পিছিয়ে গেলো। প্রানেশার দিকে তাকাতেই দেখলো প্রায় বেহুশ হয়ে যাচ্ছে। ইভানানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পাশে থাকা পানির গ্লাস নিয়ে রেয়ানের মুখে ছেটালো। রেয়ানের হুঁশ ফিরতেই উঠে বসলো। সুফিয়ান বললো-
‘প্রানেশাকে এখানে থেকে নিয়ে যা। ‘

রেয়ান মাথা নেড়ে প্রানেশাকে ধরে দাঁড় করালো। প্রানেশা হেলে দাঁড়িয়ে আছে। রেয়ান কয়েক কদম আগালো৷ সুফিয়ান আর ইভানানের মাঝে তখনও মারপিট চলছে। ইভানান প্রানেশার যাওয়ার পথের দিকে একবার তাকিয়ে চিৎকার স্বরে বললো-

‘ স্রোতস্বিনী, যদি আপনি আমারই না হন তাহলে আপনার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই! ‘

বলেই সুফিয়ানের প্যান্টের পকেটে গুঁজে রাখা পিস্তলটা ছিনিয়ে প্রানেশার মাথা বরাবর শুট করে দিলো। চারিদিকে আত্মচিৎকারে ভরে উঠলো। সুফিয়ানের চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে টুপ করে পড়লো, অস্ফুটস্বরে বললো -‘আমার প্রাণ ‘

(চলবে..)

‘অঙ্গারের নেশা ‘
(দ্বিতীয় ও সর্বশেষ অংশ)

আকাশের রঙ আজ পরিষ্কার। গাছে গাছে নতুন ফুল ফুটেছে ৷ ফুটবেই তো আজ যে বসন্ত! বসন্তকাল জুড়েই তো নানা রঙের ফুল ফলালির ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে ওঠা। রাস্তায় লাল ফুল বিছিয়ে পড়ে আছে। প্রকৃতি নতুন রঙে সেজেগুজে নবাবী ভঙ্গিতে হাসলো যেনো। আহা! এই সুন্দর রূপে ডুবিয়েই ছাড়বে সবাইকে।

লাল রঙে সুসজ্জিত রূপের গাছটি দেখে মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে তাকিয়ে আছে একটি ছোট মেয়ে। বয়স চার বছর। তার গায়েও যে লাল রঙের ফ্রক৷ মনে মনে সে কিছু একটা ভাবলো। ঠোঁট উল্টে গাছটিকে কিছু একটা শুধালো। নির্বোধ গাছটি কোনরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। কয়েক কদম দূরে একটি গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা৷ মেয়েটি দৌড়ে গাড়ির সামনে দাঁড়ানো মানুষটির কাছে গিয়ে নিজের ছোট ছোট হাত দিয়ে আঁকড়োমুঠোয় হাঁটু জড়িয়ে ধরলো। ব্যাক্তিটি তার হাঁটুতে স্পর্শ পেয়ে নিচের দিকে তাকালো ৷ মৃদু হেসে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিলো ৷ নরম গাল দুটো হালকা টানতেই মেয়েটি ফুলে ফেঁপে থাকা গাল আরেকটু ফুলিয়ে আদো আদো কন্ঠে বললো-

‘বাব্বা! ‘

ব্যাক্তিটি মেয়েটির মতোন গাল ফুলিয়ে একই ভঙ্গিতে বললো –

‘কী হয়েছে বাব্বা? ‘

মেয়েটি সামনের গাছ করে বললো –

‘বাব্বা! ওতা কী গাচ?’

ব্যাক্তিটি আঙুল বরাবর তাকালো। লাল ও কমলা রঙের ফুলে ফেঁপে থাকা গাছটি দেখে বললো-

‘ওটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ‘

ছোট মেয়েটা আপনমনে উচ্চারণ করার চেষ্টা করলো –

‘ওওও আত্তা, কিত্নচূলা গাচ’

ব্যাক্তিটি হো হো করে হাসলো৷ মেয়ের মন রক্ষার্থে বললো-

‘হ্যা, সায়েশা মা ঠিক বলেছো ‘

মেয়েটি উৎফুল্ল হয়ে হাসলো। কিছুটা সময় থেমে বললো-

‘বাব্বা, আমলা পাপাল কাচে কখন যাবো? ‘

‘এই তো সায়েশা, আমার কলে কথা বলা শেষ। চলো এখনই যাবো এয়ারপোর্টে । ‘

‘আত্তা চলো ‘

ব্যাক্তিটি মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসিয়ে দিলো। নিজেও ড্রাইভিং সিট বসে পড়লো। আধা ঘণ্টা পর এয়ারপোর্টের সামনে গাড়ি থামলো। নেমে আসলো ব্যাক্তিটি। পড়নে কোর্ট, চোখে কালো ফ্রেমের বেশ স্টাইলিং একটা চশমা। সায়েশা টুকুর টুকুর করে নামলো। দূর থেকে দেখলে বিদেশি কোনো পুতুল মনে হবে। ব্যাক্তিটি মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢুকলো। কিছুক্ষণ বাদেই আরেকজন ব্যাক্তি তাদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ালো। চিৎকার করে বললো –

‘আমি এসে গেছি সুফি! ‘

সুফিয়ান চকিতে সেদিকে তাকাতেই মুখে ছড়িয়ে পড়লো মুক্তোর মতো হাসি৷ বহু দিন পর বহু আকাঙ্খিত মানুষ। হ্যা, এটা সুফিয়ান। কেটে গেছে আজ চার বছর। কেটেছে সময়। পুরনো মানুষ অথচ নতুন রূপ। বহু মানুষ কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। আবার নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি হয়েছে। আজ সে একজন বাবা। সুফিয়ান হেসে সেদিকে দ্রুত পদে এগিয়ে গেলো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির সাথে কোলাকুলি করলো। সুফিয়ান আবেগি গলায় বললো –

‘ভালো আছিস ইভ? ‘

ইভানান মুখ নিচু করে হাসলো৷ সুফিয়ানের পাশে দাঁড়ানো ছোট পুতুলের মতো মেয়েটাকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে সারামুখে চুমু খেলো। সায়েশাও গলা জড়িয়ে ইভানানের কাঁধে মুখ গুজলো। আদো আদো কন্ঠে অস্পষ্টতা নিয়ে বললো-

‘পাপা, তুমি দেলি কললে কেনো?’

ইভানানের চোখের পাপড়ি ভিজে উঠলো৷ বাম হাতে চোখ মুছে নিয়ে হাসি ফুটিয়ে বললো –

‘আর দেরি করবো না। এবার থেকে আমার সায়ু মা কে ছেড়ে কোথাও যাবো না ‘

সায়েশাও ইভানানের গালে আদর করে হাত বুলিয়ে কানের কাছে বললো-

‘আমাল গুড পাপা ‘

ইভানান সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘এতদিন ভালো ছিলাম নারে। এখন ভালো আছি, খুব ভালো আছি ‘

সুফিয়ান হেসে বললো –

‘এখন থেকে এভাবেই ভালো থাকবি। চল বাড়িতে চল। মা অপেক্ষা করছে। ‘

ইভানান সায়েশাকে নিয়ে পেছনের সিটে বসলো। সুফিয়ান গাড়ি স্টার্ট দিতেই ইভানান বললো-

‘সাইরানকে নিয়ে আসলি না কেনো? ‘

‘সাইরান, তার ছোট বাবাকে পেয়েছে না! আজ আর সে কোথাও নড়বে না। তার ছোট বাবার আজ ছুটি। ‘

‘ওহহ’
ইভানান মলিন মুখে জিজ্ঞেস করলো –

‘সুফি, সে আমায় ক্ষমা করেছে তো? ‘

সুফিয়ান গম্ভীর গলায় বললো –

‘নিজেই জিজ্ঞেস করে নিস।’

ব্যস, এরপর সায়েশা আর ইভানানের কথা গাড়ির আনাচে কানাচে ভরে উঠলো ৷ সুফিয়ান গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো ৷ পথ অতিক্রম করতে এক ঘন্টা সময় লাগলো৷ বাড়িতে পৌঁছাতেই ইভানান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো৷ পা থমকে গেলো। সুফিয়ান হেসে বললো ‘এত সংকোচ কিসের বলতো! ‘

ইভানান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। মিসেস অদিতি এসে দাঁড়াতেই ইভানান সালাম করলো৷ মিসেস অদিতি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন –

‘বেঁচে থাক বাবা। ভালো আছিস তো? ‘

ইভানান হেসে বললো –

‘ তোমাদের দেখে অনেক ভালো আছি। ‘

মিসেস অদিতি মৃদু হেসে সবাইকে ভেতরে নিয়ে আসলেন। রাহাত সাহেবও বেরিয়ে আসলেন। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে সোফায় বসলেন। সবাই নানান রকম কথায় মেতে উঠলো৷ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো এক সুশ্রী রূপের রমনী। হাতে পায়েস আর সন্দেশের ট্রে। পাক্কা গৃহিণী যেনো। সুফিয়ান সহ সবাই সেদিকে তাকালো। রমনীটি ট্রে টি-টেবিলে রেখে ইভানানকে বললো-
‘ সময় হলো তাহলে আপনার আসার! ‘

ইভানান অপরাধীর মতো মুখ কাচুমাচু করে হাসলো। নত মুখেই বললো-
‘কী করবো বলো! ওখানের কম্পানিতে আমি না থাকলেই কর্মচারীরা ঝামেলা পাকিয়ে ফেলে। ‘

রমনী আলতো হেসে সবাইকে পায়েসের বাটি তুলে দিলো। সুফিয়ান সেই রমনীকে মুগ্ধ চোখে দেখলো। এই কী সেই অবুঝ বউটা! যে অল্প কিছুতেই কেঁদে ভাসাতো। একটু ব্যাথাতেই কাতর হয়ে পড়তো। বিশ্বাসই হয়না এটা সেই প্রানেশা। তার প্রাণ। চার বছর আগের স্মৃতি হাতরালো সুফিয়ান। সেই দিনটি যেদিন প্রানেশাকে আরেকটু হলেই হারিয়ে ফেলতো সে।
বুক ধকধক করে ওঠে সেসব কিছু মনে করলে।

চার বছর আগে –

ইভানান প্রানেশার দিকে শুট করতেই সেটা লেগে যায় রেয়ানের বাহুতে। মূলত রেয়ান ইচ্ছে করেই প্রানেশাকে সরিয়ে দিয়েছে ৷ রেয়ানের চোখ মুখ ব্যাথায় লাল হয়ে উঠলো। সুফিয়ান দৌড়ে রেয়ানকে ধরলো। প্রানেশা ভয় পেয়ে চিৎকারে করে উঠলো। রেয়ানের রক্তাক্ত বাহুর দিকে তাকিয়ে নিচে বসে পড়লো। লেবার পেইন উঠেছে কিছু ক্ষণ আগে থেকেই। সারা শরীর ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে আছে। রেয়ান ব্যাথাকে পাত্তা না দিয়ে সুফিয়ানকে বললো-

‘সুফি ভাই, প্রানেশাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও। আমার জন্য কম ক্ষতি হয়নি। এবার ভালো কিছু হোক। ‘

সুফিয়ান নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে রেয়ানের হাতে বেঁধে দিলো,প্রানেশার নিভু নিভু শরীরটা কোলে তুলে নিয়ে, বললো-

‘তুইও চল। তোরও ব্যান্ডেজ করা লাগবে। ‘

বাহিরের দিকে পা বাড়াতে নিয়েও ইভানানের দিকে ফিরলো। ইভানান কোনো কারণে মাথা চেপে ধরে আছে। মাথার রগ ফোলা ফোলা। সুফিয়ান অতকিছু খেয়াল না করে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো –

‘এবার তো তুই খুশি তাই না! এখন নিশ্চয়ই তোর খুব ভালো লাগছে। তোর বোনের মৃত্যুর পেছনে আমার কোনো হাত ছিলো না। কিন্তু আমার প্রাণের কিছু হলে দায়ী থাকবি তুই। তুই একটা খুনি হয়ে বাঁচবি সারাজীবন। কথায় কথায় বলিস, প্রাণকে ভালোবাসিস। অথচ, নিজের হাতেই শেষ করে দিলি। ‘

বলেই সুফিয়ান রেয়ান আর প্রানেশাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো৷ কেউ দেখলো না সেদিকে ইভানান মাথা চেপে নিচে বসে পড়লো। হাঁপাতে হাঁপাতে শ্বাস কষ্ট উঠে গেলো৷ পাশের মানিব্যাগ থেকে ঔষধ বের করে কোনমতে গিলে বিরবির করতে করতে নিজেও হাসপাতালের দিকে পা চালালো৷

সুফিয়ান দাঁড়িয়ে আছে অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে। হাত পা অনবরত কাপছে। বুকের অস্থিরতা ক্রমশই বেড়ে উঠছে। চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছে। প্রানেশার যদি কিছু হয় তাহলে এই জীবন আর রাখবে না সে। প্রাণ চলে গেলে দেহ পঁচতে বেশি সময় নেয় না। নিচ তলা থেকে দুর্বল পায়ে রেয়ান আসলো৷ সুফিয়ান দাঁড়াতে না পেরে সামনের একটা সিটে বসে পড়েছিলো। রেয়ান আচমকা সুফিয়ানের পা জড়িয়ে নিচে বসে পড়লো। হুহু করে কেঁদে উঠলো। সুফিয়ান তাকাতেই বললো-

‘আমাকে মেরে ফেলো সুফি ভাই। আমাকে মেরে ফেলো। আমি সত্যিই অধম। সত্যিই খুব খুব বোকা।
তুমি তো তুমিই। তোমার ভেতরের আত্মা আলোয় পরিপূর্ণ। আর আমার অন্ধকারে। সেই অপমান, তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহ্য করতে না পেরে ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম আর সেখানে থেকে যখন ইভ ভাই একটা হাত বাড়িয়ে দিলো। আমার খুব আপন মনে হলো। বাবা বাড়িতে আসার পর মা সারাদিন চুপচাপ। তুমি তোমার লাইফে ব্যস্ত। আর আমিও ইন্ট্রোভার্ট। কাউকে নিজের মনের কথা জানাতেও পারিনি। নিজেকে তুলে ধরতে পারিনি। ইভ ভাই, আমাকে নিজের কাছে পুরো অন্যরকম করে তুলে ধরলো৷ আমি স্বার্থপর হয়ে উঠলাম। একবার যদি ভাবতাম, তুমি কখনো আমার খারাপ চাবেনা। তাহলে, এইসব হতো না। ‘

সুফিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে রেয়ানকে তুলে নিলো সামনে। রেয়ান ভাবলো হয়তো সুফিয়ান মারবে তাকে। কিন্তু তাকে স্তব্ধ করে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। সুফিয়ানও বোধ হয় কাঁদলো৷ গাল বেয়ে দুজনেরই অশ্রু ঝরলো৷ সুফিয়ান রেয়ানকে চাপকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ালো৷ চোখ মুছে বললো-

‘তোর একার দোষ ছিলো না রে। দোষটা আমাদের সবার। আমি নিজেকে নিয়ে এতো ডুবে ছিলাম যে আমার ছোট ভাইটাকে সময়ই দেইনি। তোকে একা ছেড়ে দিয়েছিলাম৷ ভেবেছি তুই এভাবেই কম্ফোর্ট ফিল করিস। ‘

থেমে দীর্ঘ শ্বাসে বললো-
‘এসব বাদ। এবার কোনো কথা বলতে হলে সবার আগে আমার কাছে আসবি। ছোটরা তো ভুল করবেই শোধরানোর দায়িত্ব বড়দের। ‘

ইভানান বিমোহিত চোখে তাকিয়ে বললো-
‘সত্যিই সুফি ভাই, তোমার সাথে কাউকে মেলানো সম্ভব না। আমরা সবাই নিজেদের স্বার্থ খুঁজে বেরাই। আর তুমি সবার স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দাও। ‘

সুফিয়ান কিছু বলার আগেই অপারেশন থিয়েটারের ভেতর থেকে নার্স বেরিয়ে আসলো। সুফিয়ানের মুখ আবারও শুকিয়ে যাচ্ছে। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো –

‘সিস্টার, আমার প্রাণ ঠিক আছে তো? ‘

নার্স দ্রুত ভঙ্গিতে বললো –

‘আপনারা ‘O’ পজেটিভ ব্লাড খুঁজে আনুন। ব্লাড ব্যাংকে এই গ্রুপের রক্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্যাশেন্টের রক্তের প্রয়োজন ‘

সুফিয়ান চিন্তিত হয়ে ঘেমে জবজবে হয়ে গেলো। তার B+ রক্ত। কাউকে কল করতে ফোন করলো। রেয়ান থামিয়ে দিয়ে বললো-

‘ থামো ভাই, আমার O+ ভুলে গেছো? ‘

সুফিয়ান হাসতে নিয়েও থেমে গিয়ে বললো-

‘কিন্তু তোর কিছুক্ষণ আগেই গুলি লেগেছে। তুই কীভাবে! ‘

রেয়ান অনুরোধ গলায় বললো –

‘প্লিজ সুফি ভাই, আমি সেই পুরনো ক্ষত আবার আগের করতে পারবো না। কিন্তু, মলম তো দিতে পারি। রক্ত দিয়ে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। বাঁধা দিওনা ‘

সুফিয়ান চিন্তিত স্বরে বললো –

‘চেক আপ করে যদি দুর্বল আসে তাহলে আমি তোকে দিতে দিবো না ‘

রেয়ান সম্মতি দিয়ে নার্সের সঙ্গে রক্তের জন্য চেক- আপের জন্য। ডাক্তার বলেছিলো রেয়ানের শরীর অত্যন্ত দুর্বল কিন্তু রেয়ান ডাক্তারের হাত পায়ে ধরে সুফিয়ানকে এই কথা বলতে মানা করে জোর করে রক্ত দিলো। রক্ত দিয়ে বেরিয়ে এসে সুফিয়ানের পাশে বসলো। দুই ভাই পুরনো স্মৃতি চারণ করছিলো। এরই মাঝে ইভানান তাদের পাশে এসে দাঁড়ালো। সুফিয়ান ক্ষিপ্ত হয়ে ইভানানের গালে পরপর তিনটে চড় বসিয়ে দিলো। ইভানান নিচের তাকিয়ে কী যেনো অনবরত বলে যাচ্ছে। সে যেনো বোধ শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ইভানানকে চতুর্থ থাপ্পড়টি মারতে নিলেই একজন লোক সুফিয়ানকে বাঁধা দিলো। সুফিয়ানকে সরিয়ে দিলো। সুফিয়ান রেগেমেগে বললো-

‘কে আপনি! ‘

লোকটি অর্ধবয়স্ক। চুল হালকা পাক ধরানো। ইভানানের দিকে তাকিয়ে বললো-

‘একজন প্যাশেন্টের সঙ্গে হাসপাতালে আপনি মারামারি করছেন কেনো?’

সুফিয়ান অবাক হয়ে বললো-

‘প্যাশেন্ট! ও প্যাশেন্ট নয় অপরাধী ও ‘

লোকটি কিছু বোঝার মতো করে বললো –

‘বুঝতে পেরেছি, আপনারা আমার সঙ্গে কেবিনে আসুন। আমি একজন কাউন্সিলর । ‘

সুফিয়ান আর রেয়ান কিছু বুঝতে পারলো না। লোকটার পেছনে কেবিনে গেলো। লোকটি পাশের আলমারি থেকে কিছু কাগজ ঘেটে নিজের চেয়ারে বসে পড়লো। সুফিয়ানের দিকে পেপার বাড়িয়ে দিয়ে বললো-

‘পেপারটা পড়ুন ‘

সুফিয়ান দ্রুত পেপারটা নিলো। তেমন কিছু না বুঝলেও প্যাশেন্টের জায়গায় যে ইভানানের নামটি দেখলো। সুফিয়ান কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই লোকটি থামিয়ে বললো –
‘ হ্যা , সে একজন মানসিক রোগী। তার মানসিক অসুস্থতা রয়েছে। অনেক আগে, একদিন আমার শরণাপন্ন হয়েছেন তিনি। তার মানসিক অবস্থা তখন খুব খারাপ। শুনেছিলাম, তার বোন মারা যাওয়ার পর থেকে সে রাতের বেলা ঘুমাতে পারে না। সব জায়গায় তার বোনকে দেখতে পায়। এটা এক ধরনের ডিসওর্ডার। প্রথম একমাস সে আমার কাছে চিকিৎসা করায়। কিন্তু সুস্থ হতে পারেননি। এটা ঠিক হতে অনেক সময় লাগে। বেশিরভাগ প্যাশেন্টরা একসময় সাইকো হয়ে ওঠে। তার আচরণে অন্য আট দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক হলেও সে মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। ‘

সুফিয়ান আর রেয়ান বড় একটা ধাক্কা খেলো। কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছেনা। সুফিয়ান হঠাৎ মনে করার মতো করে বললো –

‘এইজন্যই, অস্ট্রেলিয়ায় ওর সাথে থাকার সময় ও রাতের বেলা কী যেনো বিরবির করতো। জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলতো না! ‘

‘হ্যা, এই ধরনের রোগীরা নিজেকে সবার আড়ালে রাখে। হঠাৎ হঠাৎ রেগে যায়, মাঝে মাঝে কী করে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনা। এরা ঠিক না হলে আশেপাশের মানুষের জন্য ক্ষতিকর। ‘

সুফিয়ান মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। এ কেমন নিয়তি! কাউকেই যেনো দোষ দেয়া যায় না। সুফিয়ান কাউন্সিলরকে জিজ্ঞেস করলো –
‘এই রোগ ঠিক হতে কতদিন লাগবে?’

‘যদি নিয়মিত চিকিৎসা করানো হয়, আর প্রপার কেয়ার করা হয়। তাহলে, এক বছরের মধ্যে মোটামুটি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু মূল চিকিৎসা চালিয়ে যেতে দুই তিন বছরের মতো লাগবে। ‘

সুফিয়ান তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে গেলো। রেয়ান পিছুপিছু আসলো। দুজন অপারেশন থিয়েটারের সামনে আসতেই চেঁচামেচি শুনতে পেলো।
সুফিয়ান আর রেয়ান এগুতেই দেখলো নার্স ইভানানকে বকাঝকা করছে৷ ইভানানের হাতে ছোট সদ্য জন্মানো বাচ্চা মেয়েটা । ইভানান চেয়ারের পাশে হেলে বসে আছে। বাচ্চাটার হাত ধরে কিছু একটা বলছে অস্পষ্টতা নিয়ে। সুফিয়ান নার্সকে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই বললো-

‘দেখুন তো,বাচ্চাকে নিয়ে জোড় করে বসে আছে। ‘

সুফিয়ান সেদিকে একবার তাকালো। ইভানান যে কোনো ক্ষতি করবেনা, তা জানে সুফিয়ান। নার্সের কোলে আরেকটা বাচ্চা দেখতেই বললো –

‘এই বাচ্চাটা! ‘

নার্স এগিয়ে তোয়ালে পেচানো বাচ্চাটা সুফিয়ানের হাতে দিয়ে বললো –

‘এটাও আপনার বাচ্চা। আপনার ওয়াইফের টুইন হয়েছে। একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে। ‘

সুফিয়ান খুশিতে কেঁদে ফেললো৷ ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে চুমু খেয়ে সারা মুখে হাত দিয়ে আদর করলো। আবার কী মনে করে যেনো রেয়ানের হাতে বাচ্চাটা দিয়ে নার্সকে বললো –

‘আমার ওয়াইফ? ‘

নার্স মুচকি হেসে বললো –

‘তিনি সুস্থ আছেন। ভেতরেই শুয়ে আছেন। ‘

সুফিয়ান হেসে ভেতরে ঢুকে পড়লো। প্রানেশাকে নিয়ে এক সপ্তাহ পর বাড়ি ফিরলো। প্রানেশাকে ইভানানের রোগের কথা জানাতেই সেও বললো বাড়িতে রেখেই ইভানানকে চিকিৎসা করাতে। কারণ, ইভানান বাচ্চা মেয়েটাকে নিজের কোল ছাড়া করতে চায়না৷ কিছুটা ঠিক হতেই সে নিজে থেকে নিজের চিকিৎসার জন্য অন্য দেশে চলে যায়। বাংলাদেশে থাকলে রোগ ঠিক হতে বেশি সময় লাগবে। নিজের মেয়ের মতোন ভালোবাসে সে বাচ্চাটাকে। নিজেই নাম রাখলো সায়েশা। সুফিয়ান আর প্রানেশাও ক্ষমা করে দিলো ইভানানকে। কারণ, একজন মানসিক রোগীর বোধ শক্তি কতটুকু তারা জানে। ক্ষমা করেনি শুধু রেয়ান। সে শুধু বলে -‘সে এতো মহান হতে পারবেনা। ইভানানের শাস্তি পাওয়া উচিত। ‘
কেউ তাকে কিছু বলেনি এই নিয়ে। বাচ্চা ছেলের নাম রাখা হয় সাইরান। সায়েশা সাইরানকে নিয়েই তাদের সুখী পরিবার।”

কারও ধাক্কায় অতীত থেকে বেরিয়ে আসলো সুফিয়ান। চারপাশে তাকাতেই দেখলো সব স্বাভাবিক।
হ্যা, আজ এই স্বাভাবিক জীবনে ফিরিতে সবাইকেই অনেক বাঁধা পেরোতে হয়েছে। ধাক্কাটা সাইরান দিয়েছে। হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো-

‘বাবা! ছোট বাবা সেই কখন থেকে ফোনে কথা বলছে’

সুফিয়ান মৃদু হেসে সাইরানকে কোলে উঠিয়ে বসালো।

‘বলবেই তো বাবা, তুমি মন খারাপ করোনা। সব সময় তো তোমার সাথেই থাকে৷ এখন ছোট মাকে একটু সময় দেক ‘

‘ছোট মা কে বাবা? ‘

‘যার সাথে কয়েক দিন আগে তোমার ছোট বাবার বিয়ে ঠিক হলো। ‘

‘ওও, তালহা আন্তি! ‘

‘হ্যা, তালহা আন্টি ‘

সাইরান নিজের বয়স অনুযায়ী অনেক ম্যাচুয়ার্ড। সায়েশা যেমন তার ঠিক বিপরীত। জমজ ভাই-বোন হলেও চেহারা ছাড়া কোনো কিছুতেই মিল নেই। রেয়ানও আসলো। সবাই আড্ডায় মশগুলো। সুফিয়ান সুযোগ পেয়েই উঠে পড়লো। সবাই ব্যস্ত , তাই তার দিকে কোনো মনোযোগ নেই। প্রানেশা বাচ্চাদের খাবারের জিনিসপত্র ঠিক করছিলো। সুফিয়ান সেদিকে পানি খাওয়ার বাহানাতে প্রানেশার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো –

‘প্রাণ, উপরে এসো তো। ‘

প্রানেশা একবার তাকিয়ে নিজের কাজ করতে করতে বললো –

‘বুড়ো বয়সেও রঙঢঙের শেষ নেই। দুই বাচ্চার বাবা হয়েছেন আপনি! ‘

সুফিয়ান অভিমানী সুরে বললো –

‘সবার দিকেই খেয়াল থাকে তোমার। আমাকেই চোখে পড়ে না। আসতে হবে না তোমাকে হুহ! ‘

বলেই আওয়াজ করে গ্লাসটা রেখে হুড়মুড় করে উপরে উঠে গেলো৷ প্রানেশা মুচকি হেসে সেদিকে পা বাড়ালো। সে জানে লোকটা ঠিক তার জন্য অপেক্ষা করছে। উপরে চলে যেতেই, দুটো তৃষ্ণার্থ চোখ ভিজে উঠলো। ইভানানের বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো ভারী শ্বাস। একাকীত্ব যে কত ভয়ংকর! সজ্ঞানে পাপ না করলেও শাস্তি তো সে ঠিকই পাচ্ছে। সে যে এখনো ভালোবাসে তার স্রোতস্বিনীকে। বাকীটা জীবন সে তার স্রোতস্বিনীকেই ভালোবেসে যাবে। এভাবেই পুড়তে পুড়তে অঙ্গারে পরিণত হবে। কিন্তু নেশা কখনো তার হবে না।

সুফিয়ান দোলনায় বসে দোল খাচ্ছিলো। বসন্তের ঐশ্বরিক মাতাল হাওয়ায় মনের ভেতর বইছে শীতল শিহরণ। চোখ বন্ধ অবস্থাই বুঝতে পারলো তার প্রাণের আগমণ ঘটেছে। বুঝবে নাই বা কেনো! তার অর্ধাঙ্গিনীর শরীরের স্নিগ্ধ ঘ্রাণে সে ডুবেছে বহুবার। চেনা পরিচিত হয়ে উঠেছে কোমল ঘ্রাণের সঙ্গে। চোখ বুজেই প্রানেশাকে টেনে নিলো কাছে। দোলনা নড়ে উঠলো প্রানেশা সুফিয়ানের বুকে মাথা রেখে বললো –

‘ভালোবাসি খুব! ‘

সুফিয়ান হাসলো কিন্তু কিছু বললো না। প্রানেশার রাগ হলো। মানুষটা কখনোই বলে না,আমিও তোমাকে ভালোবাসি। তার বুঝি মানে লাগে না! প্রানেশা অভিমানী সুরে বললো –

‘ঠিকই তো আছে, আমি কে হই আপনার! ‘

সুফিয়ান প্রানেশার দিকে মাতাল চাহনি নিক্ষেপ করে মাদকীয় গলায় বললো –

প্রথম ভালোলাগা তুমি,
প্রথম ভালোবাসা তুমি,
শ্রাবণের প্রথম বৃষ্টি তুমি,
হারানো প্রেম তুমি, ফিরে পাওয়া সেই তুমি।

আমার গল্পের প্রথমাংশ তুমি,
শেষাংশের অধিকারিণী তুমি,
ভালোবাসায় পরাজিত সেনা আমি,
আর এই অঙ্গারের নেশা তুমি।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে