অঙ্গারের নেশা পর্ব-২৪+২৫

0
564

‘অঙ্গারের নেশা ‘
পর্ব-২৪

‘রেয়ান, তুমি বলেছিলে তোমার বড় ভাই আছে। মা বাবার ছবি দেখালেও ভাইয়ের ছবি তো দেখালে না! ‘

তখন সম্পর্কের বয়স চার বছর। এর মধ্যে প্রানেশার মনে নানারকম সন্দেহের উৎপাত হয়েছে। প্রানেশার শুধু মনে হতো রেয়ান কিছু লুকাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলেই রেয়ান নানা অযুহাত দিয়ে দিতো৷ আর পাঁচ দশটা স্বাভাবিক কাপলদের মতো প্রানেশা হতে পারে না। কেনো তার জানা নেই। আজ গাড়িতে বসে রেয়ানকে জিজ্ঞেস করে ফেললো সে৷ রেয়ান ড্রাইভিং করছিলো। প্রানেশার প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো। আমতা
আমতা করে বললো –
‘ বলেছিলাম না, আমার ভাই এখানে থাকে না। হি ইজ আউট অফ কান্ট্রি ‘

‘কিন্তু, তাই বলে তার কোনো ছবিই নেই! ‘

রেয়ান রাগী মুখে বললো-

‘ তুমি কী সন্দেহ করো প্রানেশা! ‘

প্রানেশার উৎসুক মুখ মিইয়ে গেলো। চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে উইন্ডোর দিকে তাকিয়ে রইলো। চাইলেও হিসাব যে মিলে না। রেয়ান মুখ অন্য দিকে করে মুখ হাসলো, যাক প্রানেশার প্রশ্নের জাল থেকে এবার বাঁচা যাবে। প্রানেশার মলিন মুখ দেখে প্রানেশার হাত এক হাত রাখলো। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো –
‘সরি, আমি রেগে গেছিলাম। তুমি বারবার এত প্রশ্ন করবে না ‘

প্রানেশা চমকে হাত সরিয়ে ফেললো৷ রেয়ানের ছোঁয়ায় প্রানেশা এখনো কম্ফোর্ট হতে পারেনি। রেয়ান আর কিছু বললো না।
রেয়ান চেহারা বদলানোর পর থেকে আগের ভার্সিটিতে পড়ে না। ওখানে থাকলে যে তাকে নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাই, অন্য ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। সবাই শুধু এতটুকু জানে যে সুফিয়ান বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে আর রেয়ান অন্য ভার্সিটিতে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। যেদিন মিসেস অদিতি আর রাহাত সাহেব এই ব্যাপারটা জানতে পারেন সেদিন তাকে খুব মেরেছে। প্রানেশাকে নিয়ে সংগঠিত ঘটনা জানেনা বলেই রহস্য ভেদ করতে পারেনি। কিন্তু রেয়ানের ভেতরের রাগ আরও বেড়েছে। চেহারার জন্য নতুন ভার্সিটিতে বেশ ভালো নাম হয়ে গেছে তার। মনে মনে সে এটা ভেবেই খুশি হয় যে তাকে কেউ আর অবজ্ঞা করতে পারে না। ব্যস এটুকুই তো চেয়েছে সে ৷

———
পাঁচ বছর পর,

ডান্স ক্লাবের ড্রিংক জোনে একটার পর একটা গ্লাস খালি করছে সুফিয়ান। আট পেগ শেষ করার পর পাশের সোফায় গিয়ে বসলো। ইভানান সামনে একটা শর্ট ড্রেস পড়া মেয়ের সঙ্গে ডান্স করছে। হাতে মদের একটা ডিজাইনিং গ্লাস। সুফিয়ানকে বসতে দেখে এগিয়ে এসে পাশে লাফিয়ে বসলো। পুরো সোফা দুলে উঠতেই সুফিয়ান একবার আড়চোখে তাকালো। ইভানান ঠোঁট বাকিয়ে হেঁসে বললো –
‘সুফি, প্রতিদিন কম মেয়েকে তো পাঠাচ্ছি না তোর কাছে। তবুও এমন দেবদাস! ‘

সুফিয়ান দুই হাতের তালু দিয়ে মুখমন্ডল ঘষলো। হাতের কব্জি উল্টিয়ে দেখলো রাত ১১.৩০। উঠে দাঁড়িয়ে গাড়ির চাবি বের করলো। তারপর হাঁটা ধরলো। ইভানান হাতের গ্লাসটা দ্রুত ভঙ্গিতে রেখে পেছনে পেছনে এলো। গাড়ির দরজা খুলে নির্লিপ্ততা নিয়ে বসলো সুফিয়ান, তার পাশের সিটে ইভানান বসলো। ইভানান চিন্তিত হওয়ার মতো করে বললো –

‘তুই আজ বেশি খেয়েছিস। আমি ড্রাইভ করি, তুই ওঠ’

সুফিয়ান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললো-

‘আই এম কমপ্লিটলি ফাইন। ইউ ডোন্ট নিড টু ওয়ারি ‘

‘ইফ আই ডোন্ট থিঙ্ক, হু ইলস উইল? ‘

সুফিয়ান শক্ত কন্ঠে বললো-

‘ আই ডোন্ট নিড এনিওয়ান’

সুফিয়ানের দৃষ্টি আবদ্ধ অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরার অন্ধকার জনমানবহীন রাস্তায়। কিন্তু মন একবিন্দুও এখানে নেই। পাঁচ পাঁচটে বছর হয়ে গেছে, অথচ এখনও সুফিয়ান ভুলতে পারেনি তার প্রাণের কথা। কী করে ভুলবে! নিজের সবটা দিয়ে যে ভালোবেসেছিলো।
অতিরিক্ত ভালোবাসায় একবার ডুবলে বাঁচার উপায় নেই। হয় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যেতে হবে, না হয় কেউ টেনে তুলবে এই আশায় হাত পা ছুড়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।আদৌ যে কেউ বাঁচাবে, এই নিশ্চয়তা নেই।
কিন্তু ওই যে ভালোবাসা!
তাহার চেয়ে সু্ন্দর আর একইসাথে কুৎসিত অনুভূতি পৃথিবীতে একটিও নেই!

ইভানান মাথা হেলে জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে। গাছগুলো যেনো পেছনে চলে যাচ্ছে একের পর এক। মনে মনে সে নিজের ব্যাথিত অতীত মনে করছে।

তখন সে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছে ৷ প্লে থেকে এই পর্যন্ত সুফিয়ানের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে জান দিয়ে ভালোবেসে বন্ধুত্বের সকল দায়িত্ব পালন করেছে। সব সময়ই সুফিয়ানকে নিজের ভাই মেনেছে।
নিজের সকল কিছু ভাগ করে নিতো সুফিয়ানের সঙ্গে।
কিন্তু সুফিয়ান কি করলো তার সাথে! তার আদরের ছোট বোনটাকে শেষ করে দিলো। মেরে ফেললো!

মনে হয় এই তো সেইদিন ছোট বোনের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করলো, কেক নিয়ে মুখে লাগিয়ে দিলো, বোনের বিনুনি ধরে টেনে দৌড়ে ভেগে গেলো। এখন সব স্মৃতি! অথচ এখনও জীবন্ত। হাতড়াতে শুরু করলে গোলকধাঁধার মতো সব চোখে মুখে বাড়ি খায়।
ছোট বোন ইনায়া, মা, বাবা। কত সুন্দর একটা পরিবার ছিলো তার৷ খুব বেশি একটা গ্যাপ ছিলো না ইনায়া আর ইভানানের মাঝে। তাই সম্পর্কটা ছিলো বন্ধুত্বপূর্ণ। ইনায়া তখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। ইভানান বোনের রুমে ঢুকতেই দেখলো জানালার পাশে বিষন্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ইভানান মাথায় হাত দিয়ে হালকা করে বাড়ি দিলো। ইনায়া একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। ইভানান দেখলো ইনায়ার মুখটা লাল হয়ে আছে, চোখের কোণে জল। ইভানান জিজ্ঞেস করলো ‘ কী হয়েছে? ‘

ইনায়া ভাইয়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করলো। ইভানান অবাক হয়ে গেলো। ইনায়া কখনো এভাবে তো কাঁদেনা! আজ কী হলো তাহলে?
মাথায় হাত রেখে অস্থির ভাবে বললো –
‘ ইনু, কী হয়েছে তোর? কেউ কিছু বলেছে তোকে!একবার নাম বল, কেটে রেখে দেবো ‘

ইনায়া ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললো-
‘ সুফিয়ান ভাই আমাকে বোঝে না কেনো ইভ ভাইয়া? ‘

ইভানান বুঝতে পারলো না। তাই অবাক হয়ে বললো-
‘সুফি! ‘

‘হ্যা সুফিয়ান ভাই। আমি তাকে ভালোবাসি ইভ ভাইয়া’

ইভানান অবাক হয়ে তাকালো ৷ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শান্ত স্বরে বললো-

‘ কবে থেকে? ‘

ইনায়া নিজেকে সামলিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। লজ্জিত হওয়ার মতো করে বললো –

‘ ক্লাস নাইন থেকেই ভালো লাগতো। বিশ্বাস করো ইভ ভাই, আমি সুফিয়ান ভাইকে সত্যিই খুব ভালোবাসি। ‘

একটু থেমে ইভানানকে অনুরোধ স্বরে বললো –
‘ ভাইয়া, সুফিয়ানকে ভাইকে আমি অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে কিছুতেই বোঝে না। তুমি একটু বোঝাও না তাকে’

ইভানান মৃদু হেসে বললো –
‘মনের কথা জানিয়েছিস ওকে?’

ইনায়া চকিত নজরে তাকিয়ে বললো –
‘সুফিয়ান ভাই কী আমাকে গ্রহণ করবে? ‘

ইভানান মজা করে বললো-
‘মনে মনে যাকে নিয়ে সংসার সাজিয়ে ফেললি, আর তাকেই বললি না! পাগলী ‘

ইনায়া ভয়ার্ত চেহারায় বললো-
‘ সুফিয়ান ভাই যদি না মানে, আমি মরে যাবো ভাইয়া’

ইভানান রাগী মুখে বললো-
‘ এক থাপ্পড় মারবো না! বেশী বুঝিস। অত বেশি ভয় না পেয়ে বলে দে ‘

‘আচ্ছা, তাহলে কালই বলি’

ইভানান বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বাহিরে চলে গেলো। তার কোনো আপত্তি নেই, থাকবে কী করে! সুফিয়ানের শিরা উপশিরা চিনে সে। মেয়েলি দোষ নেই, চরিত্র ভালো, সৎ। ব্যস এটুকুই যথেষ্ট। তার বিশ্বাস তার বোন সুফিয়ানের সঙ্গে ভালো থাকবে।

পরের দিনই শাড়ি পড়ে, পিঠ পর্যন্ত চুল খুলে রেখে একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে সুফিয়ানকে মনের কথা জানায় ইনায়া। সুফিয়ান প্রথমে অবাক হয়েছিলো। কারণ, ইনায়াকে সে নিজের বোন ব্যতিত কিছু ভাবেনি কখনো। তাই , ভালো করে বুঝিয়ে বলে দিলো৷ কিন্তু ইনায়া কেঁদে উঠলো। সুফিয়ান শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে বললো-
‘ সুফি ভাই, আমার মতো করে কেউ আপনাকে ভালোবাসবে না। একটা সুযোগ দিন আমাকে। ‘

সুফিয়ান ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। রাগী স্বরে বললো –

‘ ইউ হ্যাভ লস্ট ইওর মাইন্ড ইনায়া। ইউ নিড ট্রিটমেন্ট’

‘ তো দিন না, ট্রিটমেন্ট দিন আমাকে। আপনিই একমাত্র ঔষধ আমার ‘

‘জাস্ট স্টপ ইট। চলে যাও ইনায়া, আমাকে রাগীও না’

ইনায়া নিচে বসে পড়লো, সুফিয়ানকে আরও অবাক করে দিয়ে সুফিয়ানের পা ধরে আকুতিভরা টলটলে স্বরে বললো –

‘ সুফি ভাই, কৈশোরের প্রথম প্রেম আপনি। কী করে ভুলি আমি? ‘

সুফিয়ান টেনে উঠিয়ে ইনায়ার গালে পরপর দুটি থাপ্পড় মেরে দিলো। রাগে হতবুদ্ধ হয়ে গেছে সে। কী করে এত বেহায়া হয় ইনায়া ভাবতেই রাগের পারদ বাড়তে থাকলো। কিন্তু সে তখনও জানতোই না, ভালোবাসা মানুষকে দিয়ে সব করাতে পারে।
ইনায়া হৃদয়ভগ্ন হয়ে দৃষ্টি স্থির করে দাঁড়িয়ে আছে। সুফিয়ান রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে জায়গা ত্যাগ করলো। এতক্ষণ তারা ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলো। ইভানান কল করে আসতে বললো তাই এসেছিলো। কিন্তু ইনায়া যে এমন করবে সে জানতো না। চুপচাপ নিচে নেমে গেলো। আর ছাদে অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ইনায়া। অস্ফুটস্বরে বললো –
‘ আমার মতো আপনিও একদিন ভালোবাসার শিখায় পুড়বেন সুফি ভাই ‘

দীর্ঘক্ষণ পর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গোলাপ গুলো যত্নশীল হাতে উঠিয়ে নিলো। নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো৷ একটা কাগজে লিখলো –

‘ইভ ভাইয়া, তোমার এই বোনটাকে ক্ষমা করে দিও।
ঐ নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন মানুষটাকে ছাড়া জীবনটা কী যে বিষন্নময়! তাকে বিহীন এক একটা রাত কী যে দুর্বিষহ! আফসোস, জমা কথাগুলো কিছুই তাকে বলা হলো না। তার আগেই আমি পাড়ি জমাবো, না ফেরার দেশে ‘

পরের দিন সকালে যখন ইনায়া দরজা খুলছিলো না তখন অজানা আশঙ্কায় শরীর কেঁপে উঠলো ইভানানের। দরজা ভেঙে ভেতর যেতেই দেখলো ইনায়ার লাশটা ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আছে। বোনের লাশ জড়িয়ে পাগলের মতোন চিৎকার করে কেঁদেছিলো। বিশ্বাসই হয়নি তখনও যে বোনটা বেঁচে নেই। সুখ শান্তি সব যেনো চলে গিয়েছিলো পরিবারের। সুফিয়ানকে যখন বললো ইনায়ার কথা তখন সুফিয়ানেরও অপরাধবোধ হয়েছিলো কিন্তু সেই কষ্টটা ইভানানের সামনে খুলে প্রকাশ করতে পারেনি। ইভানান সুফিয়ানের নির্লিপ্ততা সহ্য করতে পারছিলোনা। যার জন্য নিজের জীবন শেষ করলো তার বোন, সে এতটা স্বাভাবিক এটা ভাবতেই সুফিয়ানের প্রতি ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসছিলো তার। তারপর শুরু হলো তার প্রতিশোধ নেয়ার নেশা। সুফিয়ানকে তিলে তিলে শেষ করার জন্যই এসবকিছু৷

গাড়ির হর্ণ বাজতেই ধ্যান ভাঙলো ইভানানের। সুফিয়ান গাড়ি পার্ক করে ফেলেছে ইতিমধ্যেই। ইভানানকে নামতে বলেছে৷ ইভানান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নেমে পড়লো। সুফিয়ান এপার্টমেন্টের ভেতরে ঢুকে গেছে। ইভানান খেয়াল করলো বহুদিন পর চোখের কোণা ভিজে উঠেছে তার। রাতের তারায় ঢাকা ঝলমলে আকাশ দেখতে দেখতে অভিমানী সুরে বললো –

ভালো আছো তো না ফেরার দেশে?
মনে করো তো সেখানে আমাকে?
নাকি লেলিহান দাবানলে এখনো পুড়ো?

পৃথিবীর বুক ছেড়ে গেলে অজানায়,
ভালোবাসার কী এতোই শক্তি,
যে করে দিলো নিঃস্ব তোমায়!

চলবে….

“অঙ্গারের নেশা”
পর্ব-২৫

অন্যান্য দিনের চেয়ে সেই সকালটা ছিলো অন্যরকম।
আকাশ তখন হলদে রঙে সেজেগুজে হাজির হয়েছে। নারীর দেহে অলংকারের ন্যায় আকাশেরও হলদে রঙ বেশ শোভা ছড়াচ্ছে। না আছে রোদ আর না আছে কোনো মেঘলা ভাব। চমৎকার একটা পরিবেশ। এরকম একটা সময়ে ভালোবাসার মানুষের হাতটা যদি নিজের মুঠোয় থাকে তাহলে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকতে বেশি কিছু লাগে না।
হসপিটালের ৩০৯ নাম্বার কেবিনে আড়াআড়ি ভাবে লম্বা জানালাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুফিয়ান। জানালার বাহিরের সৌন্দর্যে মোড়ানো এক টুকরো অপার্থিব দৃশ্য উপভোগ করছিলো। একাকিত্বের এই মূহুর্তগুলোতে প্রানেশার স্মৃতিগুলো খুব কঠোর ভাবে ঝাপিয়ে পড়ে। বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে অতৃপ্ত শ্বাস।
পাশের ঝুলানো ক্যালেন্ডারে লাল কালির দাগ জ্বলজ্বল করছে৷ সুফিয়ানের মনে পড়লো, আজ নিজের মাতৃভূমি থেকে দূরে চলে এসেছে ৫ বছর ৩ মাস। এর আগে চারটা ক্যালেন্ডারেও সে এভাবেই লাল কালির একটা দাগ কেটে দিতো৷ কোনো লাভ নেই, কিন্তু কোথায় কিছু একটা ভালো লাগে তার৷ গায়ে সাদা রঙের একটা শার্ট ইন করা। পাশের ডেস্কে সার্জিক্যাল স্যুট, গ্লাভস, মাস্ক পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আজ তার পাঁচ নাম্বার অপারেশন ছিলো।
নতুন ডাক্তার হওয়ায় খুব বেশি অপারেশন করে না সে৷ সার্জারির জন্য বেশি প্রেশার পড়লে তবেই করে।
এখন, মেডিসিনের উপর ২ বছরের একটা কোর্স করবে ঠিক করলো। নাহলে, শুধু সার্জারী করে আত্মতুষ্টি পাওয়া যায় না বলে মনে করে সুফিয়ান। ঠিক করলো, মেডিসিন কোর্স শেষ হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত সে বাংলাদেশেই ফিরবে না। এতগুলো দিনে একবারো বাংলাদেশের কারো সাথে যোগাযোগ করেনি। ইচ্ছে যে হয়নি তা না, বরং মাকে, রেয়ুকে খুব মনে পড়েছে কিন্তু বললেই যে বাংলাদেশে চলে যেতে মন চাইবে।
জাস্টিন বেইবারের ‘বেবি ‘ গানের রিংটোন বেজে উঠতেই হাল্কা চমকপ্রদ হলো সুফিয়ান। ডেস্কের কাছে এসে মোবাইলটা হাতে নিয়ে মুচকি হাসলো। ‘ইভ’ নামটা উঠে আছে৷ সুফিয়ানের চোখে তার জীবনের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মানুষ। যে তার বিপদে আপদে মনে রাখে, ঠিক এমনটাই তো মনে করে সুফিয়ান!
কল রিসিভ করে কানে তুলতেই শোনা গেলো সুর টেনে ইভানান বলছে-
‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ ‘

সুফিয়ান অবাক হয়ে গেলেও পরে মনে করলো আজ তার জন্মদিন। এত ব্যস্ততায় সে ভুলে বসেছিলো। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো-
‘তুইও না! বুড়ো হয়ে বাচ্চাদের মতো বার্থডে উইশ করিস ‘

ইভানান হাসতে হাসতে বললো-
‘আমি কী আর তো মতো বুড়ো নাকি! আই এম ফিট এন্ড ফাইন। ত্রিশ পেরোলেই না তার আগেই তুই বুড়োর মতো গম্ভীর হয়ে থাকিস বুড়োদের মতো আচরণ করিস’

‘মনের রঙ ঘুচে গেলে তখন আর নিজেকে জুয়ান মনে হয় না, শরীর তরতাজা থাকলেও মনটা মরা মাছের মতোন ‘

‘হয়েছে, এবার তোর জ্ঞান শুরু করে দিস না। ‘

সুফিয়ান হেসে বললো –

‘আচ্ছা তা না হয়, না দিলাম। তোর খবর কী বল, দুই বছর ধরে আলাদা থাকছিস’

‘এখানে থেকে আমি একটু শান্তি অনুভব করি। প্রকৃতির রূপে ডুবে থাকি, আমি তো চাকরি- বাকরি
করবো না। তাই, আঁকাআকি করে এক্সিবিশন গুলোতে যা পাই তা দিয়েই চলি ‘

‘হাহাঃ আমি দুইটা সার্জারী করেও যা পাইনা তার ডাবল তুই একটা এক্সিবিশনেই পেয়ে যাস। ‘

প্রতুত্তরে হাসলো ইভানান। সত্যি বলতে প্রচুর টাকার মালিক ইভানান। প্রকাশ না করলেও তা সুফিয়ান ভালোই জানে। বেশ ভালো একটা হোটেলে থাকছে এখন সে, প্রতি ছয় মাস পরপর নানান হোটেল বুক করে ঘুরাফেরা করে। ইভানান গম্ভীর গলায় বললো –

‘ওহ শোন, তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে ‘

‘সারপ্রাইজ! ‘

‘হ্যা, তোর জীবনের সেরা উপহার হবে এটা সুফি’

সুফিয়ান হেঁসে বললো –
‘ঠিক আছে, টাইম ইজ স্টার্ট নাও ‘

কল কেটে দিতেই সুফিয়ান নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ৷ দুই মিনিট পর ডোরে কেউ নক করায় ভ্রু কুচকে সুফিয়ান বললো-
‘ কাম ইন ‘

বিদেশি কালোমতো একটা ছেলে ভেতরে এসে গুড মর্নিং বললো৷ এখন বাজে সাড়ে এগারোটা, তাই গুড মর্নিং শুনে একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুফিয়ান তাকালো। ছেলেটার হাঁটু কাপছে। সুফিয়ান গম্ভীর স্বরে বললো-

‘সে ইট কুইকলি ‘

ছেলেটা কেঁপে কেঁপেই বললো-

‘এ ম্যান হ্যাজ কাম টু সি ইউ, স্যার’
(আপনার সঙ্গে একজন লোক দেখা করতে এসেছে স্যার)

সুফিয়ান হাতের বইটা সাইডে রেখে বললো –
‘নেম? ‘

‘তনিম ‘

সুফিয়ান চকিতে তাকালো। তনিম! এখানে তার সাথে দেখা করতে কেনো এসেছে! তনিমকে তো সে প্রানেশার খোঁজ নিতে পাঁচ বছর আগে পাঠিয়েছিলো।
মাথা তুলে বললো-

‘সেন্ড হিম ‘

ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। কয়েক সেকেন্ড পরই ভেতরে স্যুট প্যান্ট পড়া ভদ্রলোক আসলো৷ সুফিয়ান বেশ খানিকটা অবাক হলো৷ তনিম যে এতটা বদলাবে ভাবেনি। উঠে দাঁড়াতেই তনিম তার স্বভাবমতোন সুফিয়ানের কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো। সুফিয়ান পিঠ চাপড়ে বললো-
‘কী ব্যাপার তনিম? কেমন আছো?’

তনিমকে অনেক উত্তেজিত দেখালো৷ যেনো কিছু বলার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে আছে সে৷ সুফিয়ানের প্রশ্নে বললো –

‘জি আলহামদুলিল্লাহ ভাই, ভালো আছি ‘

কিছুটা থেমে আবার বললো-
‘ভাই, আপনাকে কিছু কথা বলা অনেক জরুরি। ‘

‘ঠিক আছে, বসো আগে ‘

তনিম সামনের চেয়ারে বসে পড়লো। হাতের তালু কচলে আমতাআমতা করতে করতে বললো –

‘ভাই, একটা ভুল হয়ে গেছে ‘

সুফিয়ান ভ্রু বাকিয়ে বললো-
‘কী ভুল তনিম?

তনিম আচমকা ঠোঁট চেপে কেঁদে ফেললো৷ সুফিয়ান থতমত খেয়ে বললো-
‘আরে! কাঁদছো কেনো? কী হয়েছে বলবে তো?’

‘অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে ভাই। পাপ করেছি আমি, আজ শাস্তি ভোগ করছি, পাঁচ বছর আগের করা ভুলের মাশুল গুনছি আমি ‘

এতটুকু বলেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়লো তনিম। সুফিয়ান তনিমের কাঁধে হাত রেখে বললো –

‘কী করেছো খুলে বলো ‘

তনিম দুই হাতে চোখ মুছে নিলো৷ লম্বা শ্বাসে বললো-

‘আপনি তো জানেনই ভাই, আমি গরীব ঘরের ছেলে। এলাকায় বড় ভাই টাইয়ের সাথে ঘুরতাম তাই মানুষ চিনতো৷ বাবা যখন মারা গেলো, তার কয়েক দিন পরই আবার মায়ের একটা কিডনি নষ্ট হলো৷ আমি আকূলপাথারে পড়লাম৷ তখন আপনার এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি সাহায্যের জন্য সবার আগে আপনার কাছে গেলাম, কিন্তু আপনি তো হসপিটালের বেডে তখন৷ তবুও, আপনাকে দেখার জন্য একবার হসপিটালের ভিতর ঢুকলাম। দেখে চলে আসছিলাম, ঠিক তখন পেছন থেকে আমাকে কেউ ডাকলো। ফিরে দেখি ইভানান ভাই। আমি তাকে দেখে সালাম দিলাম, সে আগে থেকেই বোধ হয় আমার মায়ের ব্যাপারটা জানতো৷ সে নিজে থেকেই আমাকে দশ লাখ টাকা দিলো৷ আমি মানা করলে জোর করে টাকা দিলো৷ আমি ভেবেই নিলাম, আপনার বন্ধুও আপনার মতোন বড় মনের মানুষ। আমার মায়ের অপারেশনের পর, আমি যখন বাড়ি ফিরলাম। সে বললো আমাকে তার হয়ে একটা কাজ করতে হবে। তা নাহলে, পাঁচ দিনের মাঝেই টাকা ফেরত দিতে হবে। আমার ঘাম ছুটে গেলো৷ পাঁচ দিনের মাঝে টাকা দেয়া কোনো ভাবেই আমার পক্ষে সম্ভব না তা ইভানান ভাইও জানে।
আমি বুঝলাম, বড় কোনো কাজ করাতেই সে আমাকে ব্যবহার করতে চায়। কোনো উপায় না পেয়ে আমি সায় দিলাম। সে বললো ফোনে কাজ বুঝিয়ে দিবে। তার কয়েক দিন পরই আমাকে সকালে ফোন দিয়ে বললো আমি যেনো বলি প্রানেশা ভাবির আরেক জায়গায় সম্পর্ক আছে, আমার মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। আমি তার হাত পায়ে ধরে অনুরোধ করে বলেছি এসব করতে পারবো না। কিন্তু, টাকার হুমকি দেয়ায় কাজটা করতে বাধ্য হলাম৷ যখন আপনাকে বললাম ভাবীর অন্য কারো সাথে সম্পর্ক আছে তখন সে বললো, মায়ামতী ঝিলের কথাটা বলতে ৷ বলার পরে যে আপনি এভাবে অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসবেন আমি ভাবিনি ‘
কিছুটা থেমে তনিম আবারও রেয়ানের চেহারা সহ সবকিছু খুলে বললো৷

সুফিয়ান স্থির হয়ে সবকিছু শুনছে৷ এখনও বিশ্বাস করে ওঠতে পারছে না। যাকে এতোটা বিশ্বাস করলো সে কিভাবে এমন করবে! সুফিয়ান থমকে যাওয়া চোখে বললো-
‘ইভানান! ‘

তনিম সুফিয়ানের মুখপানে চেয়ে বুঝতে পারলো ধোঁকায় সুফিয়ান কতটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে।
তনিমের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললো-
‘তুমি এখন যাও তনিম ‘

তনিম নিঃশব্দে হেঁটে বাহিরে চলে গেলো৷ সুফিয়ান চোখ বন্ধ করে দুই মিনিট ধাতস্থ হলো, চোখ খুলতেই বাম চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে টুপ করে নিচে পড়লো। এই তাহলে মূল্য দিলো ইভানান তার বন্ধুত্বের। বাহ! চমৎকার। তনিম সবকিছু বললেও ইভানান কেনো এসব করেছে তা বলেনি৷ সুফিয়ানের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে । উঠে দাড়িয়ে রওনা হলো ইভানানের হোটেলের উদ্দেশ্যে।
ফুল স্পিডে গাড়ি চালিয়ে আধা ঘণ্টায় রাস্তা পাড় করে ফেললো৷ রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। ইভানান যদি সত্যিই এসব করে তাহলে জান নিয়ে ছাড়বে ওর।
উপরে উঠতেই বিশাল রুমের আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো৷ হাসতে হাসতে কেউ একজন বললো-

‘সারপ্রাইজ কেমন লাগলো বন্ধু? ‘

সুফিয়ান রেগে ভেতরে ঢুকে পড়লো। ইভানান হাত
ভাজ করে খাটের উপর বসে আছে। সুফিয়ান ঠাস করে গালের উপর চড় বসিয়ে দিলো। ইভানানের ঠোঁটের হাসি মুছেনি৷ সে তার হাসি আরও বিস্তৃত করলো। সুফিয়ান মারতে মারতে হাঁপিয়ে উঠলো৷ দূরে সরে এসে বললো-

‘তোর এখনো লজ্জা করছে না? ‘

ইভানান হেসে বললো –
‘নাহ, কারণ এসব তো আমিই সাজিয়েছি। আমি না চাইলে তনিম এই পর্যন্ত পৌঁছাতে পারতো না৷ আজ মা মরেছে বলে জানপ্রাণ নিয়ে ছুটে এলো ‘

‘এসব কেনো করলি তুই?’

‘এখনও বুঝিসনি? ‘

সুফিয়ান চিৎকার করার স্বরে বললো –
‘না বুঝিনি, এসব কেনো করলি?’

ইভানান গম্ভীর গলায় বললো –
‘কারণ আমি চাই, তুইও বুঝিস যে আপন মানুষ থেকে দূরে থাকা ঠিক কতটা কঠিন সঙ্গে যখন নিজের বন্ধুর কারণেই হয় ‘

সুফিয়ান অবাক হয়ে বললো-
‘ কেনো? ‘

‘কেনোনা তুই পাঁচ বছর আগে আমার সঙ্গেও এটাই করেছিলি, আমার ইনু শুধু মাত্র তোর কারণে মারা গেছে। তুই যদি আমার বোনকে কষ্ট না দিতি আত্মহত্যা কখনো করতো না ‘

‘ইনায়াকে আমি আত্মহত্যা করতে বলিনি ইভ!’

‘বলিসনি কিন্তু বাধ্য করেছিস, আমার সহজসরল বোনটাকে শেষ করেছিস। আর তাই তোর কাছে থেকে বদলাস্বরূপ আমি তোর ভালোবাসাকে সরিয়ে দিলাম তোর কাছে থেকে দূরে ‘

সুফিয়ান বুঝতে পারলো একে বলে কিছু লাভ নেই।
ইভানান যে বোনের শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই ইভানানকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো-
‘যাই করিস, এবার প্রানেশাকে আমি আমার কাছে আনবোই ‘

সুফিয়ান বের হওয়ার পর ইভানান উচ্চস্বরে বললো –
‘কী করে হয় আমি দেখবো সুফি ‘

সুফিয়ান সেদিকে কান না দিয়ে চলে গেলো। দুইদিন পরই বাংলাদেশে চলে গেলো৷ মা আর বাবাকে ইভানান, রেয়ানের কাজের কথা বললো। মিসেস অদিতি আর রাহাত সাহেব অবাক হয়ে গেলেন৷ কারণ, রেয়ান চেহারা পাল্টে যে এই ভয়ংকর খেলায় মেতেছে। সুফিয়ান মিসেস অদিতিকে বললো প্রানেশার বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাতে ৷ আর বিয়েতে যেনো সমস্যা না হয় তাই রেয়ানকে সিঙ্গাপুর পাঠালেন রাহাত সাহেব। তার আট দিন পরে হুলুস্থুল করে প্রানেশাকে বিয়ে করে নিলো।

বর্তমান –
সুফিয়ান ফুঁপানোর শব্দে পাশে ঘুরলো৷ প্রানেশা ঠোঁট চেপে কাঁদছে। সুফিয়ান অস্থির ভাব উঠলো। প্রানেশাকে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলো। প্রানেশা সুফিয়ানের গলা জড়িয়ে কাঁধের একটু নিচে মাথা রেখে আদুরীর মতো বললো-

‘ভালোবাসি অঙ্গার’

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে