অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~১১
উত্তাল বাতাসের ধাক্কায় জামা কাপড় তাল মিলিয়ে উড়ছে। চুলগুলো মুখ ঢেকে দিচ্ছে বারংবার, তিন চার সরিয়ে দিয়েছিলো প্রানেশা। এখন আর বলছেনা, নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে টানটান হয়ে তাকিয়ে আছে সে। সকাল বাজে আটটা। দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ায় চোখের পাতা থেকে নিদ্রা বিদায় নিয়েছে। হাত মুখটা ধুয়ে এক ড্রেসেই জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। জানালায় কোনো গ্রিল নেই, তাই হাওয়ার বেগ বেশী। বাহিরে কিছু বিদেশি মানুষের আনাগোনা দেখা যায়। এসব দেখতে দেখতে পেছনে থেকে দুটো হাত জড়িয়ে ধরলো তাকে৷ চমকে পেছনে তাকাতেই দেখলো সুফিয়ান ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে আছে। অধরে নিষ্পাপ হাসি, চুলগুলো এলোমেলো। পায়ে একটা ট্রাউজার, গায়ে কিছু পড়েনি। প্রতিদিনই সুফিয়ান জামা খুলে ঘুমায়। কিন্তু প্রানেশা এটায় এখনো অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। খালি গায়ে দেখেই প্রানেশা লজ্জায় চোখ ফেরায়। সামনে ফিরতেই সুফিয়ান প্রানেশার কোমরে হাত রেখে আলতো করে টেনে নিয়ে কপালে কপাল ঠেকালো। প্রানেশা তাকাতেই সুফিয়ান নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রানেশার নাকের ডগায় চুমু খেলো। প্রানেশা ভ্রু বাঁকিয়ে বললো- ‘ নাকে কেউ চুমু খায়!
সুফিয়ান বাদামি রঙয়ের পুরুষালি ঠোঁট চেপে নেশা নেশা কন্ঠে বললো- ‘আমি খাই। আমার সবচেয়ে ভালো লাগে তোমার নাক, ইয়োর নোজ’
প্রানেশা মুখ কুঁচকে বললো -‘ ইহ! নাক! সিরিয়াসলি?’
সুফিয়ানের এমন মুখ কুঁচকানোটা ঠিক পছন্দ হলো না। আমাদের প্রিয় কোনো জিনিসকে যখন কেউ বলে’ছিইই,ওটাতো নোংরা জিনিস! ‘ তখন যেমন ওই মানুষটার কথায় আমরা বিরক্ত হই তেমনই কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো সুফিয়ান। প্রানেশার হালকা নাকটা টেনে দিয়ে বললো- ‘ তোমার এই টার্কিশ নায়িকাদের মতোন নাকটাই তো আমি প্রথম দেখে প্রেমে পড়েছি প্রাণ, এই নাকটাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মতো স্পর্ধা করবে না ‘
প্রানেশার চোখে মুখে খেলে গেলো প্রশ্নের বাহার। তার নাকের প্রেমে পড়েছিলো সুফিয়ান। কিন্তু কবে? সুফিয়ানের কাঁধে এক হাত রেখে মুখ তুলে প্রশ্ন করলো -‘ আপনি প্রথম কবে দেখেছিলেন সুফিয়ান?’
সুফিয়ান উপর দিকে তাকিয়ে ঘনঘন শ্বাস নিলো। এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মনে মনে কিছু আওরালো । ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু একটা ভাবলো, তারপর প্রানেশার কোমড় চেপে জানালার উপর বসালো। প্রানেশা ভয় পেয়ে সুফিয়ানের গলা আঁকড়ে ধরলো, ভয়ে মুখ লাল হয়ে গেছে। বেশি ফর্সা হলে যা হয় আর কি! সুফিয়ান কোমর শক্ত করে ধরে বললো-
‘পড়বে না, আমি আছি তো’
প্রানেশা ভয় ভয় চোখে তাকালো৷ সুফিয়ান হেসে বললো -‘বিশ্বাস নেই আমার উপর? ‘
প্রানেশা বড় শ্বাস নিয়ে বললো-‘আছে ‘
সুফিয়ান প্রানেশার হালকা মেজেন্ডা চুলগুলো নিয়ে খেলতে শুরু করলো। প্রানেশা টের পেলো না, যে সুফিয়ান তাকে প্রসঙ্গ ভুলিয়ে দিয়েছে। সুফিয়ান অদ্ভুত ভাবে হেসে বললো –
‘আমার যেমন তোমার নোজ পছন্দ তেমন তোমার কী পছন্দ আমার?’
প্রানেশা খানিক পর্যবেক্ষণ করলো সুফিয়ানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত। চেহারার দিকে তাকাতেই মনে পড়লো ‘রেয়ান’ নামক অধ্যায়ের। চোখ তুলে সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে একধ্যানে লক্ষ্য করলো, সুফিয়ান আর রেয়ান দুজন আলাদা ব্যাক্তি একদমই আলাদা৷ এই যে সুফিয়ানের ঠোঁটটা, ভ্যানিলা আইসক্রিমের মাঝে চকলেট চিপস মিশে যে রঙ হয় এমন রঙটা রেয়ানের নেই। সুফিয়ানের চোখের মতোন এত গাঢ় কালো বড় মণির ন্যায় লম্বা পাপড়িতে ঘেড়া অক্ষিযুগোলের অধিকারী রেয়ান নয়। কন্ঠ, চলাফেরায় রাজকীয় গাম্ভীর্যে লেপ্টানো ব্যাক্তিত্ব রেয়ানের মাঝে পরিলক্ষিত হয়না।প্রানেশা খেয়াল করলো, এতো মনোযোগ দিয়ে সে রেয়ানকে কখনো লক্ষ্য করেনি।সুফিয়ানের সবকিছুতেই প্রানেশা মুগ্ধ হলো, কিন্ত তুখোড় দৃষ্টি গিয়ে আটকালো সুফিয়ানের গলার এডামস এপেলের খানিক নিচে লাল কালোর সংমিশ্রণে তৈরী মাঝারী তিলে৷ ছেলেদেরও বুঝি এমন আকর্ষনীয় তিল হয়! প্রানেশা বড় ঢোক গিলে নিলো, তার মনে হচ্ছে সে এক ক্ষুদার্ত বাঘ। আর সামনে রাখা তরতাজা মাংসের বড় এক খন্ড। উপলব্ধি করলো সব কিছুর উর্ধে তার ওই তিলটাই সবথেকে ভালো লাগলো। ভীষণ লোভনীয় মনে হলো প্রানেশার, গলা শুকিয়ে চৌচির হয়ে এলো। ছুয়ে দিতে ইচ্ছে হলো নিগুঢ় হাতে। নাহ,এমন নির্লজ্জের মতোন কাজ সে কখনোই করবেনা। ভেতরের হাসফাস, অস্থিরতা সুফিয়ান ধরে ফেললো। মুচকি হেসে বললো- ‘বললে না যে! ‘
প্রানেশা চোখ মুখ খিচে এক লাফে নিচে নেমে গেলো। বাচ্চাদের মতোন দুই হাতে জামাকাপড় ঝেড়ে বোকা হাসলো। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো-
‘আপনি না বলেছিলেন , আমরা নুসা লেম্বগান আইসল্যান্ড যাবো! ‘
সুফিয়ান হাত ভাজ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বললো-
‘হুম, যাবো তো। রেডি হও, এক ঘন্টার মাঝেই বের হবো’
প্রানেশা দ্রুত পায়ে জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো। ভুলক্রমে হাতের একটা জামা নিচে পড়ে রইলো। সুফিয়ান প্রানেশার অস্থিরতায় হাসলো। জামাটা উঠিয়ে দিতে দিতে বললো-
‘এমন দ্রুত করছো কেনো?’
প্রানেশা হাতে থেকে জামাটা টেনে নিয়ে যেতে যেতে বিরবির করে বললো-
‘ ছেলেদের জন্যও বোরকার মতোন কিছু থাকার ব্যবস্থা করা উচিত। ছেলেদেরও মাঝে মাঝে মাথা ঘুড়িয়ে দেয়ার রূপ থাকে। যা আমার মতোন দূর্বল হার্টের মেয়েদের জন্য ভয়ংকর, অতি ভয়ংকর, তীব্র ভয়ংকর! ‘
সুফিয়ান বোকার মতোন সেদিকে তাকিয়ে হা করে বললো -‘ আমার রূপ ভয়ংকর! ‘
অস্ট্রেলিয়া-
রংতুলির ছোঁয়ায় সাদা কাগজ যেনো প্রাণ পেয়ে জীবন্ত হয়ে উঠছে। হাতে নীল রঙে রাঙিয়ে আছে। পেইন্টিং স্ট্যান্ডটায় বসানো বড় কাগজটায় দেখা যাচ্ছে, সমুদ্রের জলে ভেসে আসছে এক কিশোরী মেয়ের শরীর। সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে দুই উচ্ছল যুবক।
দুইজনের দৃষ্টি সেদিকেই নিবদ্ধ। নীল টিশার্ট পরিহিত যুবকটির হাতে একটা পেন্সিল। দ্বিতীয়জনের গলায় ঝুলানো বাদামী একটা গিটার। মেয়েটার দেহ এদিকেই ভেসে আসছে। শেষের দিকটায় মাটির রঙ দেয়ার আগেই পুরুষটি পেছনে তাকালো। দরজার বাহির থেকে ভেসে আসছে হালকা চেচামেচির আওয়াজ।
হাতের রঙের প্লেটটা সাইডে রেখে টিস্যু নিয়ে হাতটা মুছে ‘ইউজ মি’ তে ছুড়ে ফেলে দরজা খুলে দিলো।
খুলতেই দেখলো হাঁটুর সমান একটা ড্রেস পড়ে হাই হিলের ফর্সা টলটলে শরীরের একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে,তার তথাকথিত গার্লফ্রেন্ড। আর আড়ালে পঞ্চম । নীলচোখের পুরুষটি ভ্রু কুচকে বললো-
‘কী হচ্ছে এসব?’
ঘরের মেইড বললো-
‘স্যার, ম্যাম বারবার আপনার রুমে যেতে চাচ্ছিলেন। আপনি তো কাউকে ভেতরে যেতে মানা করেছেন তাই ম্যামকে মানা করছিলাম’
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রাউন কাঁধ পর্যন্ত স্ট্রেইট চুলের মেয়েটা এগিয়ে এসে পুরুষটির গায়ের সাথে লেপ্টে গেলো৷ ন্যাকা কান্না করে বললো-
‘ডু ইউ নো? হাও মাচ আই মিস ইউ, ইভ?’
পুরুষটি মেইডের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘গো টু ইওর ওয়ার্ক’
বলেই মেয়েটিকে ঘরে ঢুকিয়ে দিলো, দরজা লাগিয়ে বললো-‘হ্যাজেল! হোয়াট কাইন্ড অফ বিহেভিয়ার ইজ দিস?’
হ্যাজেল নাক টেনে বললো-
‘ইইভ! আই লাভ ইউ ‘
পুরুষটি শুধরে দেওয়ার মতো করে বললো-
‘ কত বার বলেছি! আই এম ইভানান তেহজিব নট ইভ’
হ্যাজেল অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে হওয়ায় আগে বাংলা বুঝতে পারতো না। কিন্তু ইভানানের সংস্পর্শে এসে বাংলা বলতে না পারলেও বুঝতে ঠিকই পারে। ইভানানের কাছে এসে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো-‘হোয়াট এভার! নাও আই ওয়ান্ট ইউ ভেরি ক্লোজ ‘
চলবে…
অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব,১২
এক হাতে প্রানেশাকে জড়িয়ে আরেক হাত পকেটে গুঁজে হাঁটছে সুফিয়ান। প্রানেশা বেজায় খুশি। এক্সাইটমেন্টে তার হাত পা কাপছে। অনলাইন, ম্যাগাজিন, টিভি নিউজে বিভিন্ন জায়গায় নুসা লেম্বগান আইসল্যান্ডের সৌন্দর্যের বিস্তারিত শুনেছে। বিশ্বাসই হচ্ছেনা তার, যে আজ সেও এই জায়গা ঘুরবে, হাত দিয়ে ছুয়ে দেবে। প্রানেশার মনে পড়লো দুই বছর আগে একদিন রেয়ানকে বলেছিলো, বালিতে তাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার। ভেতরের দীর্ঘ শ্বাসকে ভেতরে রেখেই মুখে হাসি টেনে নিলো। সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে রেয়ানকে মনমস্তিষ্ক থেকে দূরে রাখতে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় বাঁধাই হলো মুখ অবয়ব। দুই জনের চেহারা এক হওয়ায় কিছুক্ষণ বাদে বাদেই মনে পড়ে যায়। তবে, এখানে এসে প্রানেশা আবিস্কার করছে নতুন সুফিয়ানকে। ভালোবাসা, কেয়ার, আবদার, পজেসিভনেজ সবকিছুতেই নতুন ভাবে প্রেমে পড়ছে প্রানেশা। তবে, ওভার পজেসিভনেসে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হচ্ছে প্রানেশা। এই যেমন হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় প্রানেশা জিন্স শার্ট পড়েছিলো। জিন্স শার্ট যদি ও অনেক বড় আর ঢোলা ছিলো৷ তারপরও সুফিয়ান ভীষণ রেগে বলেছিলো –
‘এসব কী পড়েছো?’
প্রানেশা অবাক হয়ে বললো-
‘কী পড়েছি মানে!সবসময় যা পড়ি। ‘
সুফিয়ান কিছু না বলে একটা প্যাকেট থেকে লম্বা গাউন ও একটা গার্লস ট্রাউজার বের করে দিলো। প্রানেশা না করেনি। চুপচাপ পড়ে নিয়েছিলো৷ এমন নয়,যে প্রানেশা উশৃংখল, আলট্রা মডার্ণ। ছোটবেলা থেকেই যা পড়েছে সেভাবেই ড্রেস কোড ফলো করে। ক্ষমতাবান বাবার মেয়ে হওয়ায় পাওয়ার তো ছিলোই সাথে আবার কাজিনদের সবার ছোট। বংশে দুই মেয়ের বড়জন। তাছাড়া সবাই ভাই । সব ভাই বড় আদরে মানুষ করেছে। তাই, হ্যারেসের মতো ছোটখাটো জিনিসেরও শিকার হওয়ার সুযোগ পায়নি।
কিন্তু তাই বলে সে অবাধ্য নয়। গাউন পড়ে এসে সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে প্রানেশা জিজ্ঞেস করলো –
‘ আমি তো ওগুলো পড়েই যেতে পারতাম, তাহলে এসব কেনো?’
সুফিয়ান জানে প্রানেশার ধর্মীয় আচারের তেমন কোনো জ্ঞান নেই। তাই কোনো প্রকার রাগারাগী না করে মৃদু হেসে বললো –
‘প্রাণ, একটা বইকে তো কভার ছাড়াই বিক্রি করা যায়। কিন্তু তারপরও কভার লাগিয়ে প্যাকিং করে কেনো বিক্রি করে? ‘
‘নরমাল, কারণ কভার লাগানোতে বইয়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি তো হয়ই। সঙ্গে ছিড়ে যাওয়ার ভয় থাকে না, মূলত সেফ থাকে ‘
‘কারেক্ট, তুমি যদি ওগুলো পড়ে যেতে তেমন কিছু হতো না। কিন্তু এই যে, তুমি এগুলো পড়াতে সৌন্দর্য বৃদ্ধি হলো। নিজেকে ঢেকে হেফাযতে রাখা সুন্নত। এতে তোমার সম্মান, পবিত্রতা বাড়বে। তুমি খারাপ নজর থেকে সুরক্ষিত থাকবে । ‘
প্রানেশা পুরোটা শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকালো। সুফিয়ানের মতো করে তাকে কেউ বোঝায়নি। সে যা পড়েছে তাতেই সমর্থন দেয়ায় ভুল আর সঠিকের পার্থক্য বোঝেনি। এভাবেই যদি কেউ বোঝাতো তাহলে ঠিকই বুঝতে পারতো৷ স্বামীদের দায়িত্ব স্ত্রীকে হেফাজতে রাখা। ভূল পথ থেকে সড়িয়ে আনা। স্ত্রীরা ভুল করবেই,কারণ আপন মানুষ ছেড়ে নতুন জায়গায় মানিয়ে নেয়া খুব কষ্টের ব্যাপার। ভুল ত্রুটিগুলো সুধরে নেয়া তাদের দায়িত্ব। এখন যদি সুফিয়ান প্রানেশাকে না বুঝিয়েই সম্পূর্ণটা চাপিয়ে দিতো তাহলে হয়তো প্রানেশা বুঝতো তো পারতোইনা সঙ্গে আঘাত পেতো৷ প্রানেশার মনে সুফিয়ানের জন্য সম্মানের জায়গা তৈরি হলো। তারপর সুফিয়ানের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লো। বের হওয়ার পর দেখলো বাহিরে তিনজন গার্ড সহ একজন নতুন ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে। প্রানেশা এই পজেসিভনেস দেখে বিরক্ত হয়েছিলো। ঘুরতে যাওয়ার সময় যদি এভাবে রোবটের মতোন পেছনে পেছনে ঘুরে তাহলে তো বিরক্ত হবেই। সুফিয়ানের মুখের দিকে অসহায় মুখ করে তাকিয়ে বলেছিলো –
‘শুনুন?’
সুফিয়ান ভাবলো হয়তো প্রানেশার খারাপ লাগছে তাই অস্থির ভাবে বললো –
‘খারাপ লাগছে প্রাণ? ‘
‘উমহু,এই পেছনে আর সামনের বডিগার্ডদের যেতে বলুন না! ‘
সুফিয়ান গম্ভীর মুখভঙ্গিতে বললো-
‘না প্রাণ, সম্ভব নয়। এরা সাথেই থাকবে’
প্রানেশা মুখ লটকে হাঁটতে লাগলো। সুফিয়ান প্রানেশাকে আরও ভালো করে জড়িয়ে হাঁটা শুরু করলো। প্রানেশার পাঁচের মতোন মুখটা দেখে মনে মনে বললো -‘তোমার জন্যই তো এসব প্রাণ, তুমি জানোনা তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে কত হায়নারা ওত পেতে আছে। কষ্ট হলেও এতে অভ্যস্ত হতে হবে তোমায় ‘
গাড়িতে করে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দশটা বাজলো। গিলি গেটওয়ে নামক জায়গা থেকে নুসা লেম্বগান আইসল্যান্ড যেতে হয়। গিলি গেটওয়েতে এসে প্রানেশা দেখলো সমুদ্রের মাঝে অনেকগুলো স্পিডবোটের মতোন কিছু। কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করলো -‘ ওটা কী স্পিডবোট? ‘
সুফিয়ান সেদিকেই তাকিয়ে ছিলো। প্রানেশা জিজ্ঞেস করতেই বললো-
-‘না, ওটা রুকি। নুসা লেম্বগান যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটা ট্রান্সপোর্ট আছে। তারমধ্যে রুকি সবচেয়ে ভালো। সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রান্সপোর্ট এটি স্পিডবোর্টের মতোন দেখতে হলেও আকারে আরও বড়। আমরা এটাতেই যাবো। ‘
-‘ ওয়াও! ‘
সুফিয়ান বাঁকা হেসে বললো –
-‘এখন ওয়াও ওয়াও করছো। ওঠার পর ওয়াও ছুটে যাবে ‘
প্রানেশা শুকনো ঢোক গিলে বড় বড় চোখ করে বললো-
-‘মানে! ওইযে সামনে কত মানুষ চড়ছে। তারা তো চুপ করে বসে আছে।আপনি ভয় দেখাচ্ছেন আমায় হুহ! ‘
-‘প্রাণ,তারা এখানে নিয়মিত আসা যাওয়া করে। বাসে যেমন অভ্যাস হয়ে যায় তেমনই তাদেরও অভ্যাস হয়ে গেছে ‘
প্রানেশা মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে। সুফিয়ান ঠোঁট চেপে হাসছে৷ প্রানেশা যে কী পরিমাণ ভীতু! এটা তার থেকে ভালো কে জানে?
রুকিতে উঠে কাচুমাচু মুখ ধুয়ে বসলো প্রানেশা। সিট খামচে ধরে বসে আছে সে। সুফিয়ান সামনে বরাবর বসে আছে, আর প্রানেশার মুখ দেখে মিটমিট করে হাসছে। পেছনের রুকিতে বডিগার্ডরা বসেছে। প্রানেশা
উপর দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলছে-
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ। আল্লাহ এই যাত্রায় বাঁচিয়ে দাও। একদম ভালো হয়ে যাবো, কখনো মিথ্যা বলবো না, হুজুরনী হয়ে যাবো, বেশী কথা বলবো না, তছবী হাতে ঘুরবো ‘
সুফিয়ানের পেট ফেটে হাসি আসতে চাইছে। এত বাচ্চামো কেউ করতে পারে! আবার বলছে বেশি কথা বলবে না অথচ ননস্টপ বকবক করছেই। এমনিতে যথেষ্ট বুঝদার। ভয় পেলে সব বুঝাবুঝি শেষ। রুকি স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করতেই প্রানেশা ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে চিৎকার করে বললো-
‘আল্লাহ গোওওও!আমি নেমে যাবোওও। আমাকে নামিয়ে দাওওও৷ নাতি পুতির মুখ দেখা আমার আর হলোনা বুঝিইই ‘
চলবে…..