অঙ্গারের নেশা পর্ব-১০

0
573

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~১০

সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সকাল সাতটায় রওনা হলো সুফিয়ান ও প্রানেশা। ঘুরতে যাওয়ার আগের দিন রাতে কখনোই প্রানেশার ঘুম আসে না। দুইটার দিকে সুফিয়ান বকে ঘুম পাড়িয়েছে৷ সাতটায় সুফিয়ানের সঙ্গে রওনা দিলো প্রানেশা উদ্দেশ্য ‘বালি’

সিঙ্গাপুর ট্রানজিটে চার ঘন্টার ফ্লাইট শেষ করে কুয়ালালামপুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছালো
টানা দশ ঘন্টার ট্রানজিট শেষে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা ওড়ার পর দুজন বালি পৌঁছে গেলো।

প্রানেশার মাঝে তেমন ক্লান্তি নেই বললেই চলে। সবকিছু তার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। গায়ে একটা লং টপস আর জিন্স, গলায় স্কার্ফ, চুল পনিটেইল করে বাঁধা। সব মিলিয়ে বয়স কম মনে হচ্ছে। সতেরো, আঠারোর মেয়ে মনে হয় দেখতে। সুফিয়ান হাসলো নিজমনেই। সুফিয়ানের গায়ে কোর্ট প্যান্ট। কিছুটা সামনে একজন লোক দাঁড়ানো হোটেলে নেয়ার জন্য। তাই দুই তিন মিনিট হেঁটে যেতে হবে। প্রানেশা হাঁটতে হাঁটতে বেখেয়ালি ভাবে সুফিয়ানের হাত জরিয়ে ধরে উৎসাহিত হয়ে বললো-
‘ বালি সম্পর্কে কিছু বলুন না! ‘

সুফিয়ান হেসে বললো –
‘এতক্ষণ যে ধৈর্য ধরে চুপ আছো এতে অবাক আমি’

প্রানেশা সরু চোখে তাকিয়ে বললো-
‘আপনি কী আমায় বাঁচাল বলতে চাইছেন?’

সুফিয়ান হাসি আঁটকে বললো-
‘কী বলো প্রাণ! তুমি আর বাঁচাল! দুটো দুই প্রান্তের বস্তু ‘

প্রানেশা বুঝতে পারলো সুফিয়ান তার সাথে মজা নিচ্ছে। সুফিয়ানের হাত ছেড়ে দূরে গিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। গাল ফুলিয়ে বিরবির করে বললো –
‘বদ লোক! কাল থেকে বারবার জিজ্ঞেস করছি বলে ভাব বেড়েছে, আর জিজ্ঞেসই করবো না ‘

সুফিয়ান হেসে প্রানেশার বাহু এক হাতে জড়িয়ে গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে বললো-

‘সরি, শোনো। বালি ইন্দোনেশিয়ার একটি দ্বীপ এলাকা ও প্রদেশ। জাভা শহর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে ইন্দোনেশিয়ার ৩৩তম প্রদেশ। আর আগেই বলেছিলাম যে, বালিকে পৃথিবীর ‘অন্তিম স্বর্গদ্বান’ বা ‘লাস্ট প্যারাডাইস অন আর্থ’ও বলা হয়। ‘

‘অন্তিম স্বর্গদ্বান কেনো বলা হয়? পৃথিবীতে তো আরও বহু সুন্দর জায়গা আছে! ‘

‘সেখানের মানুষদের দেয়া নাম এটি, জনসংখ্যায় হিন্দুদের বাস বেশী। হিন্দু -৮৩.৫%,মুসলিম -১৩.৪%, খ্রিস্টান -২.৫%, বৌদ্ধ -০.৫% ‘

প্রানেশা আরও প্রশ্ন করতে নিয়েছিলো কিন্তু গাড়ির কাছে এসে পড়ায় আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না।
গাড়ির কাছাকাছি আসার পর পেছনে আরেকটা গাড়ি থেকে দুই তিনজন কালো পোশাকধারী ব্যাক্তি নেমে এলো। প্রানেশা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো –

‘এরা কারা?’

সুফিয়ান ট্রলিগুলো তাদের এগিয়ে দিতে দিতে বললো-
‘আমাদের বডিগার্ডস’

‘মানে! আমাদের আবার বডিগার্ড কেনো লাগবে?’

‘এতো কথা না বলে ওঠো’

অবাক ভাব কাটিয়ে ওঠার আগেই সুফিয়ান প্রানেশাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিলো ৷ প্রানেশা চুপচাপ বসে গাড়িতে মাথা এলিয়ে দিলো। গাড়ি চলতে শুরু করলেই প্রানেশা বাহিরের পরিবেশ উপভোগ করতে থাকলো৷ সুফিয়ান প্রানেশার এক হাত মুঠিবদ্ধ করে নিজেও চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পরই হোটেলের সামনে গাড়ি থামলো। এত বড় হোটেল দেখে একই সাথে অবাক আর পুলকিত হয়ে উঠলো প্রানেশা। দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে বাহিরে বেরিয়ে আসলো। সুফিয়ান সানগ্লাস পড়ে গাড়ির বাহিরে আসতেই প্রানেশা লাফ দিয়ে সুফিয়ানকে জড়িয়ে ধরলো,উৎকন্ঠার সঙ্গে বললো- ‘থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ সো মাচ!’

সুফিয়ান মৃদু হেসে প্রানেশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই প্রানেশা ছেড়ে দিলো। প্রানেশার হাত ধরে সামনে এগোতেই হুরমুড়িয়ে একজন ব্যাক্তি এসে দাঁড়িয়ে গেলো।নাক মুখে একরাশ ভয়ের রেখা। সুফিয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে লোকটার যে হাঁটু কাপছে তা ভালোই বুঝলো প্রানেশা। সুফিয়ানকে হালকা হাতে ধাক্কা দিয়ে বললো-‘এই লোকের কী হাঁটু কাঁপার রোগ আছে? ‘
সুফিয়ান হেসে বললো –
‘হ্যা প্রাণ, তবে সবসময় না। ব্যাক্তিভেদে এই রোগের দেখা মিলে। ‘

প্রানেশা ভ্রু কুচকে বললো-
‘বড়ই অদ্ভুত রোগ!’

লোকটি ভীষণ ভীতু তা বোঝাই যায়। টিস্যু দিয়ে কপালের ঘাম মুছে হাত পেছনে রেখে কাঁপতে কাঁপতে বললো-
‘গুড মর্নিং স্যার, গুড মর্নিং ম্যাম’

সুফিয়ান ঠোঁট চেপে হেসে বললো –
‘ মিস্টার তনিম, আপনার এই ভীরু স্বভাব বদলান। আপনাকে মেরে তো ফেলছি না ‘

তনিম জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মনে মনে বললো-
‘ সেটাও বা অসম্ভব কী!আপনাকে দেখে তো সিংহেরও মুত্রত্যাগ হয়ে যাবে’ কিন্তু মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বললো –
‘কী যে বলেন স্যার, সব কিছু রেডি আছে। আপনার আর ম্যামের জন্য হোটেলের সবচেয়ে বড় রুমটা বুক করা হয়েছে। আসুন স্যার ‘

সুফিয়ান প্রানেশার হাত এখনো ধরেই আছে। প্রানেশা সবার এহেন কান্ডে বেশ হকচকিয়ে গেছে। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন মোটাতাজা বডিগার্ডরাও এই ঠান্ডায় ঘেমে ভিজে উঠছে। এরকম হওয়ার কারণ কিছুতেই বের করতে পারলো না সে। কিন্তু সন্দেহ রয়েই গেলো। সুফিয়ান তিন তলার রুমটায় ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলো। প্রানেশা নরম তুলতুলে বেড দেখে বিছানায় গড়িয়ে পড়লো। সুফিয়ান গায়ের কোর্ট খুলে পাশে হ্যাংগারে রেখে বললো –
‘প্রাণ, যাও আগে একটা হট বাথ নাও। অনেক বড় জার্নি হয়েছে ‘

প্রানেশার আরামে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। এখন আর উঠতে ইচ্ছে করছেনা। মুখের উপর নরম বালিশ লাগিয়ে ঘুমঘুম গলায় বললো –
‘উমহুম! পরে’

সুফিয়ান গায়ের শার্ট খুলে প্রানেশার হাত ধরে ওঠানোর চেষ্টা করলো। হালকা শক্তি দেয়ায় প্রানেশা দোল খাচ্ছে , হেসে বললো –
‘বৃথা চেষ্টা, আমি ঘুমাবো’

সুফিয়ান বুঝতে পারলো এভাবে কাজ হবেনা। মুখে বালিশ থাকায় প্রানেশা এখনো সুফিয়ানকে খালি গায়ে দেখেনি। সুফিয়ান বালিশ সরিয়ে প্রানেশাকে কাছে টানতেই প্রানেশা চোখ মেললো। উদাম গা দেখেই মুখ কুঁচকে ভেংচি কেটে বললো-
‘নির্লজ্জ কোথাকার! ‘

সুফিয়ানের জ্বালায় শেষমেষ না পেরে উঠে বসলো। সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বকতে বকতে ওয়াশরুমের কাচের গ্লাসটা ঠাস করে বাড়ি দিয়ে লাগিয়ে দিলো। সুফিয়ান প্রানেশার মেকি রাগে হেঁসে ফেললো।

টেবিলের উপর থেকে সবচেয়ে দামী ওয়াইনের বোতল নিয়ে গ্লাসে ঢেলে দুটো আইস ঢেলে ব্যালকনির ফাঁক গলিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে পান করতে থাকলো নীল চোখের সুপুরুষটি। গায়ে তার ছেলেদের লং নাইটি। বোঝা যাচ্ছে, মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে সে। সকালে উঠে দুই গ্লাস কড়া মদ্যপান না করলে তার পুরো দিনটাই পানশে হয়ে ওঠে। ব্যালকনির বাম দিকে নিজের সুবিশাল আভিজাত্যপূর্ণ কক্ষের দিকের বড় একটা ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে পূর্ণ নজরে কিছুক্ষণ তাকালো সে। খোচালো শজারুর কাঁটার ন্যায় লম্বা চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে, নারীচিত্রের ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘আপনাকে আমি এখনো ভুলিনি স্রোতস্বিনী , আপনি যে আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে নিজের বিচরণ চালান! আপনার রূপের স্রোতের ধ্বংসাত্মক তান্ডব আমার দু চোখের পাতা এক হতে দেয়না। খুব শীঘ্রই আমার হবেন আপনি ‘

সোনায় মোড়ানো ফ্রেমের ভেতরের হাত বাড়ানো হাস্যজ্জল নারীটির ওষ্ঠে হাতের আঙুল ছোঁয়লো সে। ফ্রেমের আরও ঘনিষ্ঠে এসে নারীটির গভীর ডাগর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো –

আঁধারে শ্রাবণ রাতে সে এসেছিলো বলে,
জোৎস্নারা হেঁসেছিলো ঘরময় জুড়ে।
প্রজাপতি এসেছিলো দলবল নিয়ে ,
আজ সে নেই বলে তারা যাবে চলে।
সেও কী গভীর রাতে মোর নাম জপে?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে