সবিতা পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0
70

সবিতা
শেষ পর্ব
মুমতাহিনা জান্নাত মৌ

নবআলো নারী শিক্ষা কেন্দ্র এখন স্থানীয় পর্যায়ে একটা পরিচিত নাম হয়ে উঠেছে।
এটা আর শুধু একটামাত্র স্কুল না, এটি একটি আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রতিটি মেয়ের মধ্যে স্বাধীনতা ও আত্মবিশ্বাসের আলো জ্বলে উঠছে।
তবে এই সফলতার পথে নানা প্রতিবন্ধকতা অপেক্ষা করছে।

একদিন দুপুরের দিকে সবিতা স্কুলে পৌঁছানোর আগেই একজন পুরুষ শিক্ষার্থী এসে তাকে জানায়,

— “আপু, একদল লোক এসেছিল স্কুলের সামনে, তারা কিছু বলতে চাইছিল।”

সবিতার মন খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু কিছু বলার আগেই তাওহীদ আসে।

— “সব ঠিক আছে।তবে তারা শুধু জানিয়ে গিয়েছে যে আমরা অগ্রহণযোগ্য।”

এটা ছিল তাদের জন্য প্রথম বড় প্রতিবাদ।
স্থানীয় কয়েকজন সমাজকর্মী এবং আত্মীয়স্বজন এই স্কুলের বিরোধিতা শুরু করেছে।
তারা বলতে শুরু করেছে, “এই স্কুল মেয়েদেরকে খারাপ পথে পরিচালিত করছে, এখান থেকে মেয়েরা স্বাধীন হয়ে যাবে, তাদের চরিত্র নষ্ট হবে।”

এই অভিযোগগুলো সবিতার মনের ভিতরে গুরতর ভাবে আঘাত হানে।
কিন্তু সে জানত, এসব বাধা শুধু তার পথকে শক্ত করবে।
যেহেতু সে নিজেই নিজের সংগ্রাম, নিজের সাহস, আর নিজের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জেনেছে—অন্ধকারে একটু আলোই পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করতে পারে।

রুমাইসা স্কুলে প্রথম এসেছিল শঙ্কিত মন নিয়ে, কিন্তু এখন সে পুরোপুরি বদলে গেছে।
প্রতিদিন নতুন কিছু শিখে, নিজের সাহস বাড়িয়ে, আজ সে নবআলোর সেরা শিক্ষার্থী।

একদিন সবিতা তাকে বসিয়ে বলল,

— “রুমাইসা, আজকে তোর যা অর্জন, সেটা আমি শুধু চেহারায় দেখলাম না, তোর চোখেও দেখলাম।
তুই এখন সাহসী, তুই এখন নিজের ভালোবাসার জন্য লড়াই করতে জানিস।”

রুমাইসা মাথা নিচু করে বলে,

— “আপু, আমি জানতাম না, আমাকে শিক্ষার আলো দিবে এমন কেউ কখনও আসবে। আজ আমি জানি—আমার কাছে আর কোনো বাধা নেই।”

এটা সবিতার চোখে অশ্রু এনে দেয়।
এটা সেই মুহূর্ত ছিল, যখন সে বুঝেছিল, তার সংগ্রাম একমাত্র নিজের জন্য নয়, বরং এই মেয়েদের জন্য।

একদিন স্কুলের শিক্ষিকা রুনা আপু এসে সবিতার কাছে জানান,

— “কিছু স্থানীয় নেতারা বলেছে, তারা নবআলোকে বন্ধ করতে চায়।
তাদের দাবি, এই স্কুলে পড়া মেয়েরা অনেক কিছু শিখছে যা সমাজের জন্য ক্ষতিকর।”

সবিতা অবাক হয়ে যায়,

— “এটা তো কখনোই ভাবিনি। কিন্তু আমি তাদের বলব—এখানে আমরা শুধু মেয়েদের শিক্ষা নয়, মানবিকতা ও স্বাধীনতা শেখাই।”

তাওহীদ আসে, এবং তাকে সমর্থন দেয়।

— “তুমি একা না সবিতা। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। এই সংগ্রাম আমরা একসঙ্গে করব।”

সবিতার মনে শান্তি ফিরে আসে।
এটা তার সংগ্রামের দ্বিতীয় বড় পর্ব।
কিন্তু সে জানে, এবার কোনোরকম ভয় বা সন্ত্রাস তাকে থামাতে পারবে না।

একদিন রাতে সবিতা বসে থাকে একা, নতুন কিছু পরিকল্পনা নিয়ে।
— “আমি আর থামব না। এখানে কিছু পাথর ফেলা হলে, আমি সেই পাথরগুলো নিয়ে নতুন রাস্তা তৈরি করব।
আমার মেয়েরা সব ধরণের বাধা টপকাতে পারবে।”

সে ঠিক করে, এই প্রতিবাদকেই শক্তি হিসেবে নিতে হবে।
যে সমাজ তাকে বাধা দিতে চায়, সেই সমাজকে দেখিয়ে দিতে হবে—মেয়েরা শুধু দাসত্বের জন্য জন্ম নেয় না,
তারা স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার রাখে।

তাওহীদ এসে দাঁড়িয়ে বলল,

— “তুমি একদিন পুরো সমাজের চোখ খুলে দিবে সবিতা, তোমার স্বপ্নগুলো রূপান্তরিত হবে বাস্তবে।
তোমার সংগ্রাম শুরুর দিকে ছিল একক, কিন্তু এখন সেটা সবার। আর আমরা সবাই তোমার পাশে আছি।”

নবআলো নারী শিক্ষা কেন্দ্রের পথ চলা ক্রমশ আরও জটিল হয়ে উঠছে। সবিতা জানে, এই যাত্রা সহজ হবে না। সমাজের পুরনো ধ্যানধারণা আর বদ্ধমূল বিশ্বাসগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে আরও শক্ত হতে হবে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা কেবল সমাজের মানুষই নয়, কিছু রাজনৈতিক শক্তিও। এখন এই পথটাই সবিতার জন্য সত্যিকারের পরীক্ষা।

একদিন দুপুরের পরে সবিতা স্কুলে পৌঁছানোর আগে, স্থানীয় এক নেতা এসে জানায়,

— “তোমার স্কুলের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উঠেছে। যদি এসব বন্ধ না হয়, আমরা তোমাকে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করব।”

সবিতা একটু থমকে দাঁড়িয়ে যায়।

— “অভিযোগ কি ধরনের?”

— “মেয়েদের মনে স্বাধীনতার ভাবনা, অশিক্ষার পরিবেশ। এমনকি, অনেকের মতে, এখানে এসে মেয়েরা সমাজের নৈতিকতার বিরুদ্ধে কাজ করছে।”

এই কথাগুলো সবিতার মনকে একেবারে শূন্য করে দেয়, তবে সে জানে, হাল ছাড়লে তো চলবে না। সে দৃঢ়তার সাথে জানায়,

— “আমরা শুধু মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করছি। আর এই শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের জন্য ভালো কিছু হতে পারে, এটাই আমার বিশ্বাস।”

নেতা কিছু না বলে চলে যায়, কিন্তু তার কথাগুলো সবিতার মাথায় ঘুরতে থাকে।
তার মনের ভিতরে একটা ঝড় চলছে, তবে সে জানে—কোনো ভয়েই তাকে থামানো যাবে না।

একদিকে সবিতা লড়াই করছে বাইরে, অন্যদিকে তার শিক্ষার্থীরা তাদের জীবনে নতুন সুযোগ ও পরিবর্তন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
রুমাইসা, যাকে একসময় অন্ধকারের পথে চলতে দেখেছিল, এখন অন্য মেয়েদের কাছে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা শেয়ার করে।
একদিন, সে সবিতার কাছে এসে বলে,

— “আপু, আমি জানি, আমি যদি এখানে না আসতাম, তাহলে হয়তো আমি আজও সেই পুরনো জীবনেই থাকতাম। এই স্কুলে এসে আমি শুধু পড়াশোনা শিখিনি, আমি শিখেছি কীভাবে নিজেকে সম্মান করতে হয়।”

সবিতা গর্বিত হয়ে বলে,
— “তুমি যেভাবে নিজেকে গড়ে তুলেছো, সেটা খুবই প্রশংসনীয়। তবে মনে রেখো, এখনও অনেক পথ চলা বাকি।”

আয়ন, রুমাইসার বন্ধু, এবার স্কুলে যোগ দিয়েছে। সে আসে, তার মুখে আত্মবিশ্বাস এবং চোখে নতুন স্বপ্নের আভা।
একদিন সবিতা আয়শাকে বলে,
— “তুমি কি জানো, তুমি যদি সাহসী না হতে, তাহলে এখানে আসা হতো না।”

আয়শা মাথা নিচু করে বলে,
— “আপু, আমার কাছে এই স্কুল শুধু শিক্ষা নয়, এটা আমার বেঁচে থাকার পথ।”

________

একদিন, সবিতা এক বিশেষ সভার আয়োজন করে, যেখানে তার শিক্ষার্থীরা নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করবে।
সভায় উপস্থিত হয় স্থানীয় অনেক গুণী মানুষ এবং সাংবাদিকও।
রুমাইসা, আয়শা, সিমলা—এরা সবাই নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে, কিভাবে তারা নবআলোতে এসে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে।

তারপর সবিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

— “আজ আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে জানাচ্ছি—আমরা শুধু মেয়ে শিক্ষার জন্য কাজ করছি না, আমরা তাদের জীবনের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করছি।
এই স্কুল শুধু শিক্ষার জায়গা নয়, এটা একটি আন্দোলন, যেখানে প্রতিটি মেয়ে তাদের সঠিক জায়গা খুঁজে পাবে।”

সকলের চোখে চোখে আবেগ দেখা যায়, কেউ বা কেঁদে ফেলে, কেউ আবার হাসে।
এই দিনটা সবিতার জীবনের সবচেয়ে বড় মুহূর্ত।
সে বুঝতে পারে, তার সংগ্রাম শুধু নিজের জন্য নয়, বরং পুরো সমাজের জন্য।

অল্প সময়ের মধ্যে নবআলো নারী শিক্ষা কেন্দ্র ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু জনপ্রিয়তার সঙ্গে বেড়ে ওঠে সমস্যাও।
একদিন সবিতা হঠাৎই খবর পায়, যে রাজনৈতিক দলের নেতারা আরেকবার তাদের স্কুলের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে চাইছে।
এবার তারা জানিয়েছে, “এই স্কুলের কর্মকাণ্ডের জন্য সমাজের স্বাভাবিক নিয়ম ভেঙে পড়ছে। যদি না বন্ধ করা হয়, তাহলে আরো বড় বিপদ আসবে।”

সবিতা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। সে জানে, এবার পরিস্থিতি আরো কঠিন হতে যাচ্ছে।
তবে তার মন দৃঢ়। সে জানে, সত্যের পথে চলতে থাকলে, একসময় আলোর দেখা পাওয়া যাবে।
সে সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

— “আমরা আমাদের সংগ্রামে অবিচল। যখন মানুষ একসঙ্গে হয়, তখন তারা কোনকিছুই হারাতে পারে না।”

নবআলো নারী শিক্ষা কেন্দ্রের কক্ষগুলোতে এখন আর কেবল বইয়ের পাতা উল্টানোর শব্দ নয়, বরং প্রতিদিনই নতুন স্বপ্নের জন্ম হয় এখানে। মেয়েরা যে সমাজ তাদের ‘বোঝা’ ভেবে অবহেলা করেছে, সেই সমাজেই তারা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধ শুরু করেছে। কিন্তু ঠিক তখনই শুরু হলো আরেকটি ঝড়।

এক দুপুরে স্কুলে ঢোকে এক অফিসার, সঙ্গে হাতে কাগজ।
— “আপনার নামে অভিযোগ এসেছে ম্যাডাম। আপনি নাকি মেয়েদের উসকে দিচ্ছেন, পরিবার আর সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছেন। আপনার স্কুল বন্ধের নির্দেশ এসেছে।”

সবিতা অবাক হলেও ভেঙে পড়েনি। সে চুপচাপ কাগজটা পড়ে, তারপর মাথা উঁচু করে বলে,

— “যে সমাজ অন্যায় মেনে নেয়, সেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হলে কেউ একজন তো দাঁড়াবেই। আমি পিছিয়ে যাবো না। আমার মেয়েরা জানে কীভাবে লড়তে হয়।”

অফিসার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
— “আপনার কথা ঠিক। কিন্তু প্রভাবশালীরা চায় না এই জায়গা টিকে থাকুক। সাবধান থাকবেন।”

সবিতা জানে, ঝড় এসে গেছে। এখন লড়াইটা শুধু একটা স্কুল টিকিয়ে রাখার নয়—এটা একটি আদর্শ বাঁচিয়ে রাখার লড়াই।

সেদিন সন্ধ্যায় সবিতা মেয়েদের ডেকে বলে,

— “আমাদের স্কুল হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। তোমাদের যদি ভয় হয়, তাহলে চলে যেতে পারো। আমি কাউকে দোষ দেবো না।”

কিন্তু সিমলা বলে ওঠে,
— “আপু, যদি আপনি লড়েন, আমরা কেন পালাবো? আপনি আমাদের দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। এবার আমরাও দাঁড়াবো আপনার পাশে।”

আয়শা বলে,
— “এই স্কুলটা আমার আত্মার মতো। কেউ যদি এটা কেড়ে নিতে চায়, তাকে আমার বুকের রক্তের ওপর দিয়ে যেতে হবে।”

সবার চোখে দৃঢ়তা।
সবিতা অনুভব করে, সে আর একা নেই।

আন্দোলনের শুরু,

মেয়েরা নিজেরাই একটি প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করে।
স্থানীয় গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে—”একদল মেয়ে, তাদের শিক্ষিকার নেতৃত্বে, নারী শিক্ষার অধিকার বাঁচাতে পথে নেমেছে।”

সমাবেশে এক বুড়ি মা এসে বলেন,
— “আমার ছেলেও চায় না আমি স্কুলে পড়ি। কিন্তু সবিতা আপুর স্কুলে এসে আমি শিখছি কীভাবে নাম লিখতে হয়। আমার জীবনটা নতুনভাবে শুরু হচ্ছে।”

এই ধরনের বক্তব্যে চারপাশ নড়ে ওঠে।
যারা সবিতার বিরুদ্ধে ছিল, তারাও এবার একটু থেমে যায়,সবাই বুঝতে পারে সবিতাকে আর আটকানো যাবে না,সে তার আলো সকল অবহেলিত আর নির্যাতিত মেয়ের মধ্যে ছড়িয়ে দিবে।

শেষ দৃশ্য

সবিতা রাতে নবআলো’র ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশে চাঁদ, চারপাশে নীরবতা।
তার পাশে এসে এক এক করে সকল মেয়েরা দাঁড়ায়।
সিমলা বলে,
— “আপু, ভয় লাগছে?”

সবিতা হালকা হাসে,

— “ভয় লাগে, কিন্তু ভয় পেয়ে থেমে থাকলে তো আলো জ্বলবে না।”

সবিতা বুঝে যায়—এই মেয়েগুলোই তার শক্তি। এটাই তার সত্যিকারের পরিবার।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে