রোমান্টিক_ডাক্তার পার্ট: ৩

0
4500
রোমান্টিক_ডাক্তার

পার্ট: ৩

লেখিকা: সুলতানা তমা

নিজের বাবা মা’কে তো খেয়েছে অনেক আগেই এখন এসে আমার গাড়ে চেপে বসেছে। আর উনি মরার সময় আমার হাত ধরে বলে গেছেন “আমার ভাগ্নিটাকে দেখো” যত্তোসব জ্বালা আমার। নেহাত ওর নামে বাপ মায়ের দেওয়া কিছু সম্পত্তি আছে তাই এতো জ্বালা সহ্য করছি নাহলে তো কবেই….
আমি: নাহলে কবেই কি মামি, মেরে ফেলতে আমাকে…?
মামি: আপনি এসেছেন সময় হলো আপনার আসার
আমি: মতলবটা কি মামি বলবা
মামি: মানে
আমি: আমাকে সহ্যই তো করতে পারো না তাহলে আমি চোখের সামনে নেই বলে এতো তাড়া দিয়ে নিয়ে আসলে কেন
মামি: ও তুই বুঝবি না।
রুমে চলে আসলাম, কি যে চলছে এই মহিলার মাথায় আল্লাহ্‌ জানেন।

জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বিকেলের আকাশ দেখছি। মন যেন কাউকে খুব মিস করছে, কাকে মিস করছে…? কাব্য…? কিন্তু ও কে আমার ওর জন্য এতো মন খারাপ হচ্ছে কেন। আচ্ছা আমি যে কাব্য’কে এতো মিস করছি ও কি আমায় মিস করছে নাকি চোখের আড়াল হতেই ভুলে গিয়েছে আমাকে…?
হঠাৎ তিশা আর মামির চেঁচামেচি শুনে তাড়াতাড়ি বের হলাম।
তিশা: আপনার মতো খারাপ মহিলা আর একটাও দেখিনি
আমি: কি হইছেরে তিশা
মামি: কি আর হবে প্রতিদিনই তো তোর বান্ধবী আমাকে যাতা বলে
আমি: তোমার স্বভাবে শুনো
তিশা: আসছিলাম তোকে ডাকতে সেই সকাল বেলায় অল্প কিছু খেয়ে বের হইছিলাম বিকেল হয়ে গেছে এই বাসায় তো খাবার খাওয়ার কোনো টাইম নেই তাই তোকে নিতে আসছিলাম আর এই মহিলা তুই যাবি না বলে আমার সাথে ঝগড়া শুরু করে দিছে
আমি: ওহ বাদদে এসব আমার খিদে নেই একেবারে রাতে খাবো
তিশা: কি হইছে তোর চোখমুখ এমন লাগছে কেন
আমি: কিছুনা
তিশা: হুম বুঝেছি।
রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। কাব্য’র কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

তিশা: তমা উঠ রাত হয়ে গেছে (তিশার ডাকে তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। আশ্চর্য রাত হয়ে গেলো অথচ মামি আমাকে রান্না করার জন্য বকাবকি করলো না)
তিশা: কি ভাবছিস
আমি: মামি হঠাৎ পাল্টে গেলো কেন, আগে তো কাজের জন্য বকাবকি করতো। অন্যকিছু করবো দূরে থাক কাজের জন্য ঠিকমতো নামাজও পড়তে পারতাম না। আর আজ সেই বিকেল বেলা থেকে রাত অব্ধি ঘুমালাম বকাবকি করলো না।
তিশা: আমি সিউর এই মহিলা তোকে নিয়ে খারাপ কোনো মতলবে আছে
আমি: আর খারাপ কিবা করবে যা খারাপ আচরণ করে
তিশা: চল আম্মু আব্বু অপেক্ষা করছেন তোর জন্য
আমি: ঘুমের কারণে তো নামাজ পড়া হয়নি তুই যা নামাজ পড়ে আসছি
তিশা: ঠিক আছে।

নামাজ পড়ে তিশাদের বাসায় যাওয়ার জন্য বের হতেই মামি ডাক দিলেন।
আমি: কিছু বলবে
মামি: হ্যাঁ তোর সাথে কথা আছে
আমি: বলো
মামি: তোর জন্য ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে ভাবছি তোকে বিয়ে দিয়ে আমার দায়িত্ব শেষ করবো
আমি: বাহ্ যে মামির চোখে আমি বিষ সে নাকি আমাকে ভালো জায়গায় বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে
মামি: শুন আমি এতোটাও খারাপ না
আমি: হ্যাঁ তুমি কতোটা ভালো আমি জানি তো
মামি: চলে যাচ্ছিস যে কিছু তো বলে যা।
মামির কথার উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে আসলাম। বিয়ে দিবে যত্তোসব।

সবাই একসাথে খেতে বসেছি তখন আঙ্কেল মানে তিশার আব্বু আবার বিয়ের কথা বললেন।
তিশা: আব্বু আমি ভাবছিলাম তোমাকে বলবো কিন্তু এখন মত পাল্টে নিয়েছি
আঙ্কেল: কেন তমাকে বিয়ে দিতে হবে না নাকি। তুই কি চাস ওর মামি হুট করে যার তার সাথে ওকে বিয়ে দিয়ে দিক।
তিশা: না আব্বু আমি তোমাকে পরে সব বলবো আপাতত বিয়ে নিয়ে কিছু ভেবো না
আন্টি: আমি আরো ভাবছিলাম আমার দুই মেয়ের বিয়ে একদিনে দিয়ে দিবো
আমি: সবাই বিয়ে বিয়ে করছ আমি তোমাদের ছেড়ে গেলে তো
তিশা: রাজকুমার এসে তুলে নিয়ে যাবে
আঙ্কেল: হাহাহা আছে নাকি কোনো রাজকুমার
তিশা: হ্যাঁ আব্বু আছে এজন্যই তো বললাম আপাতত বিয়ে নিয়ে কিছু ভেবো না
আমি: তিশা চুপ করবি
তিশা: হুম করলাম। শুন ওই মহিলার আচরণ আমার ভালো লাগছে না এখন থেকে রাতে তুই আমার সাথেই থাকবি।
আমি: হুম ঠিক আছে।

তিশার সাথে বসে গল্প করছি হঠাৎ মামি এসে ডাকতে শুরু করলো।
আমি: কি হইছে
মামি: বাসায় চল
তিশা: তমা এখন থেকে রাতে আমার কাছেই ঘুমাবে
মামি: কেন আমার বাসায় বুঝি জায়গার অভাব আছে
তিশা: না তবে ভালোবাসার যথেষ্ট অভাব আছে
মামি: দেখ তমা আমার কথা শুনে চলে আয়
আমি: পারবো না
মামি: কাল তোকে দেখতে আসবে, ওরা যদি এসে শুনে তুই রাতে অন্য বাসায় ঘুমাস তাহলে তো আমার মান সম্মান কিছুই থাকবে না
আমি: তোমার আবার মান সম্মান। আর তুমি আমাকে জিজ্ঞেস না করে আসতে বললে কেন।
মামি: তো কি হইছে
আমি: নিজেই দেখা করো আমি যাবো না ওদের সামনে
মামি: লক্ষী মা এমন করে না আমি আর তোর সাথে খারাপ আচরণ করবো না তুই শুধু ওদের সামনে যাস
আমি: ঠিক আছে তবে কাল না দুদিন পর আসতে বলো
মামি: ঠিক আছে
আমি: এখন যাও আমি তিশার কাছেই থাকবো। (মামি চলে যেতেই তিশা আমার হাত জোরে চেপে ধরলো, ওর চোখ দুটু রাগে লাল হয়ে আছে)
আমি: কি হইছে
তিশা: তুই ছেলে পক্ষকে আসতে বলে দিলি তারমানে তুই তোর মামির পছন্দে বিয়ে করবি
আমি: বিয়ে করবো বলেছি নাকি, মামির কথা না শুনলে আরো বেশি খারাপ আচরণ করবে তাই রাজি হয়েছি।
তিশা: কাব্য শুনলে খুব কষ্ট পাবেরে
আমি: মানে কি এখানে কাব্য আসলো কোথা থেকে আর ও জানবেই বা কিভাবে।
তিশা: জানবে জানবে
আমি: জানলেই বা কি, শুন এসব এক দেখায় ভালোবাসা হয়না শুধুমাত্র একটুখানি ভালোলাগা জন্মায় মনের মধ্যে, এইটা ক্ষণিকের জন্য মোহ ছাড়া আর কিছুই না। চোখের আড়াল হলে দুদিন যেতেই এই মোহ কেটে যায় বুঝেছিস।
তিশা: কাব্য তোর এই ধারণা পাল্টে দিবে দেখিস
আমি: তুই এতো জোর দিয়ে বলছিস কিভাবে…? এই কাব্য’র সাথে তোর যোগাযোগ নেই তো…?
তিশা: অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়।
তিশা চুপচাপ শুয়ে পড়লো কিন্তু আমার কথার উত্তর তো দিলো না। তারমানে কি তিশা কাব্য’র সাথে কথা বলে, যোগাযোগ আছে ওদের মধ্যে…? কি জানি থাকলে থাকুক ওদের মধ্যে যোগাযোগ তাতে আমার কি। ভাববো না আর কাব্য’র কথা। চুপচাপ শুয়ে পড়লাম।

সকালে তিশার ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো তাড়াতাড়ি উঠে নামাজ পড়ে নিলাম। তিশা নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো কিন্তু আমার তো আর ঘুম আসবে না একা একা কি করবো, বাসায় থাকলে তো এখন রান্না করতাম। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, চারপাশে ভোরের আলো ফুঁটতে শুরু করেছে। হঠাৎ বাগানের দিকে চোখ পড়লো, তিশা খুব যত্ন করে এই বাগান তৈরি করেছে। বাগানে অনেক ফুল ফুটেছে দেখে যেতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু এই ভোরবেলা একা একা বাগানে যাওয়া কি ঠিক হবে ভেবে পাচ্ছি না। দুর যাই কিছু হবে না, রুম থেকে মোবাইলটা এনে বাগানের দিকে পা বাড়ালাম।

খালি পায়ে বাগানের মধ্যে হাটছি। ভোরবেলা শিশিরে ভেজা ঘাসের উপর খালি পায়ে হাটার মজাই আলাদা, এতে মন শরীর দুটুই ভালো থাকে। আর ফজরের নামাজ পড়ে এসে একটু হাটাহাটি করলে তো মনে শান্তি বিরাজ করে, সাথে ভোরের আলো ফোটার সুন্দর দৃশ্য, পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ আর সূর্য উঠার অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। ছোটবেলায় একদিন আব্বু বলেছিলেন “নামাজে যে শান্তি আছে সে শান্তি আর কোথাও খুঁজে পাবে না। তোমার মন খারাপ নামাজ পড়ো মন ভালো হয়ে যাবে, তোমার নিজেকে একা লাগছে তাহলে নামাজ পড়ো আর নিজেকে একা মনে হবে না কারণ নামাজে আল্লহকে কাছে পাওয়া যায়, তুমি কোনো বিপদে পড়েছ কি করবে ভেবে পাচ্ছ না তাহলে নামাজ পড়ো আল্লাহ্‌ তোমাকে সাহায্য করবেন, তুমি সবসময় আল্লাহর এবাদত করো আল্লাহ্‌ তোমাকে সবসময় সাহায্য করবেন” আব্বুর কথা গুলো সেদিন মুখস্থ করে ফেলেছিলাম সাথে সেদিন থেকে নামাজ পড়া শুরু করেছিলাম আজো পড়ছি। মধ্যে আব্বু আম্মুর হঠাৎ মৃত্যুতে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম নামাজও ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহ্‌ আমাকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য আমার জীবনে তিশাকে পাঠালেন। তিশা সবসময় বুঝিয়েছে কখনো হতাশ হতে নেই সবসময় আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হয়। আব্বু আম্মুর মৃত্যুতে এতোটাই কষ্ট পেয়েছিলাম যে ভুলেই গিয়েছিলাম এই পৃথিবীতে কেউ চিরস্থায়ী নয়, সবাইকে একদিন মৃত্যুবরণ করতে হবে তাই আপনজনদের মৃত্যুতে আল্লাহকে ভুলে যেতে নেই।

আব্বু আম্মুর কথা মনে পড়াতে কখন যে দুচোখ দিয়ে পানি পড়ে গাল দুটু ভিজে গেছে বুঝতেই পারিনি। কয়টা বাজে দেখার জন্য মোবাইলে চাপ দিলাম কিন্তু মোবাইল তো অফ করা। তারমানে সারারাত মোবাইল অফ ছিল। মোবাইল অন করার সাথে সাথে ফোন আসলো, একটা অচেনা নাম্বার। এতো সকালে কে ফোন দিতে পারে তাও মোবাইল অন করার সাথে সাথে ভেবে পাচ্ছি না। সাধারণত অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসলে আমি রিসিভ করিনা কিন্তু এই ফোনটা রিসিভ করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার মন এই ফোনের জন্যই অপেক্ষা করছিল কিন্তু… রিসিভ করতেই একটা চেনা কন্ঠ ভেসে আসলো।
কাব্য: তিলো ও তিলো ফোন অফ করে রেখেছিলে কেন
আমি: (নিশ্চুপ হয়ে ওর কান্না শুনছি পাগলের মতো কাঁদছে)
কাব্য: কাল সন্ধ্যা থেকে ফোন দিচ্ছি সারারাত ফোন দিয়েই গেছি কিন্তু তোমার ফোন অফ আর এই তিশা গাদিটা তো ফোন রিসিভই করছে ন…. (কাব্য আটকে গেলো অর্ধেক কথা বলে, তারমানে তিশা আর কাব্য’র যোগাযোগ আছে আমার ধারনাই ঠিক। কিন্তু ওরা আমার থেকে লুকাচ্ছে কেন)
কাব্য: জানো আমি কতোটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তোমার ফোন অফ দেখে, আমার তো ইচ্ছে হচ্ছিল রাতেই ঢাকা চলে যাই তোমার কাছে। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না তাই সারারাত ট্রাই করেছি তোমার ফোন সারারাত অফ ছিল। (নিশ্চুপ হয়ে শুধু ওর কথা শুনছি কারণ কিছু বলার নেই আমার)
কাব্য: সারারাত আমাকে টেনশন দিয়ে আমার ঘুম নষ্ট করে এখন চুপ হয়ে আছ (একটা মানুষ কাউকে প্রথম দেখায় এতোটা ভালোবাসতে পারে জানতাম না। আগে তিশাকে অনেক কথা শুনিয়েছি কিন্তু এখন কাব্য’র কান্না শুনে মনে হচ্ছে সত্যি ও আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু এইটাও কি সম্ভব, কেন এতো ভালোবাসে ও আমাকে…? কেন এতো কাঁদে আমার জন্য…?)
কাব্য: আমিও দেখবো তুমি কতোক্ষণ চুপ হয়ে থাকতে পারো (ও কাঁদছে আমি শুনছি কিন্তু দেখতে পারছি না তাও মনে হচ্ছে ওর চোখ থেকে টুপটুপ করে পড়া পানিগুলো আমার হৃদয় ভিজিয়ে দিচ্ছে। নিজের অজান্তেই আমার চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গাল বেয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো)
কাব্য: এই পাগলী একদম কাঁদবে না বলে দিচ্ছি। আমি কাঁদছি বলেই তো কাঁদছ আমি আর কাঁদবো না এইযে চোখের পানি মুছে নিলাম, প্লিজ তুমি কেঁদো না আমার কষ্ট হয়।
আমি নিশ্চুপ হয়ে আছি দেখে কাব্যও নিশ্চুপ হয়ে গেলো। ফোনের দুপ্রান্তে দুজন নিশ্চুপ হয়ে আছি আর একজন আরেকজনের নিঃশ্বাস শুনছি….

চলবে?

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে