মেমসাহেব পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
57

🔴মেমসাহেব (পর্ব :২০, শেষ পর্ব )🔴
-নিমাই ভট্টাচার্য

তুমি লিখেছিলে লাডাকে এখন মাইনাস ১০-১২ ডিগ্রী টেম্পারেচার। কলকাতার বাঙালী হয়ে আমাদের কল্পনাতীত। আমার তো ভাবতেও ভয় লাগছে। উলের আণ্ডারউয়ার, গ্লোভস, ক্যাপ ইত্যাদি নিতে ভুলে না। তুমি বার্লিন থেকে যে ওভারকোটটা এনেছ, সেটা অতি অবশ্য নেবে। আমি জানি তুমি ভাল থাকবে কিন্তু তবুও চিন্তা তো হবেই। তাই যদি পার লেতে পৌঁছবার পর একটা টেলিগ্ৰাম করে।

শেয়ে লিখেছিল, ৮ই মার্চ তোমার সঙ্গে দিল্লী যাবার পর খুব বেশী বেড়াবার সময় থাকবে কি? তুমি তো প্ৰায় সবকিছুই গুছিয়ে রেখেছ কিন্তু তবুও নতুন সংসার করার কিছু ঝামেলা তো থাকবেই। তাছাড়া তোমার ক’দিন বিশ্রাম চাই তা! এইত কংগ্রেস কভার করে। ফিরলে। এখন যাচ্ছে লাডাক। ফিরে এসেই পার্লামেণ্ট। তারপর কলকাতায় আসা-যাওয়া বিয়ে-থার জন্য তোমার কি কম পরিশ্রম হবে? সেজন্য দিল্লী গিয়ে আবার কোথাও যাবার আমার ইচ্ছে নেই।

তোমাকে আর এর মধ্যে দেখতে পাব না। সেই ২০শে ফাল্গুন রাত্রে একেবারে শুভমুহুর্তে তোমাকে দেখব! ভাবতেও তারী মজা व्लांटछ। cऊांभांद्र डांदेड डांक्ल व्लांशदछ ना? Í মেমসাহেবের চিঠি পাবার পরদিনই ভোরবেলায় পালামের এয়ার ফোর্স স্টেশন থেকে এয়ার ফোর্সের এক স্পেশ্যাল প্লেনে আমরা চলে গেলাম জম্মু। সেখান থেকে মোটরে উধমপুর। এক রাত্রি উধমপুরে কাটিয়ে পরদিন তোরবেলায়। জম্মু এয়ারপোর্টে এসে শুনলাম লেতে ভীষণ খারাপ আবহাওয়া। প্রভিং ফ্রাইটে একটা প্লেন গিয়েছে। যদি ঐ প্লেনটা ল্যাণ্ড করতে পারে, তাহলে সেই মেসেজ পাবার পর আমাদের প্লেন ছাড়বে। বেলা আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে আবহাওয়ার উন্নতি না হলে আজ আর যাওয়া হবে না।

সাড়ে আটটা পৰ্যন্ত কোন মেসেজ এলো না। প্রভিং ফ্লাইটে যেপ্লেনটি গিয়েছিল, সেটি ফেরত এলো নটা নাগাদ। কোর হেড কোয়াটার্স থেকে আমি হেড কোয়ার্টার্সে মেসেজ চলে গেল, ব্যান্ড ওয়েদার এ্যারাউণ্ড লে স্টপ প্রভিং ফ্লাইট ফেলড স্টপ প্রেস পার্টি হেলন্ড-আপ। আমিও আমার হেড কোয়াটার্সে একটা টেলিগ্রাম করলাম, লে। আণ্ডার ব্যান্ড ওয়েদার, স্টপ নো ফ্লাইট টু-ডে স্টপ।

উধমপুরে একটা অতিরিক্ত রাত্রিবাস ভালই কেটেছিল। দুপুরে একটা চমৎকার লাঞ্চ ছাড়াও সন্ধ্যায় আমাদের সম্মানে একটা ককটেল দিলেন কোর কমাণ্ডার নিজে। পরের দিন ভোরে রওনা হবার আগে আমরা ওয়েদার রিপোর্ট চেক-আপ করে জানলাম, লের আবহাওয়া ভালই। সুতরাং ফাস্ট সর্টির ফাস্ট এয়ারক্রাফটেই আমরা রওনা হয়ে জম্মু থেকে লে এলাম।

লে’তে পৌঁছবার পর একটু বিশ্রাম করে শহরে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে মেমসাহেবকে একটা আর্জেণ্ট টেলিগ্ৰাম করলাম, রিচড সেফলি।

লাডাকে আসার পর কলকাতার আর কোন খবর পেলাম না। সময়ও হতো না, সুযোগও হতো না। কলকাতার স্টেশন অত্যন্ত উইক। তাছাড়া এত ঠাণ্ডায় ব্যাটারীও ঠিক কাজ করে না। সুতরাং রেডিওতেও কলকাতার কোন খবর পেলাম না।

লেতে একদিন কাটাবার পর আমরা ফরোয়ার্ড এরিয়া দেখতে রওনা হলাম। কোথাও জীপ, কোথাও হেলিকপ্টার। সারাদিন ঘুরে বেড়াতাম চোদ-পনের হাজার ফুট উপরে হিমালয়ের মরু অঞ্চলে। বিকেল থেকে মধ্যরাত্ৰি পৰ্যন্ত কাটাতাম আমাদের বা অফিসারদের কোন-না-কোন মঙ্গোলিয়ান টেন্টে বোখারীর পাশে।

ফরোয়ার্ড এরিয়া ঘুরে লোতে ফেরার পর জানলাম, গত পাঁচদিন ধরে কোন প্লেন ল্যাণ্ড করে নি। ব্যান্ড ওয়েদার। আবহাওয়া কবে ভাল হবে, সে-কথা কেউ জানেন না। পরের দিনও ভাল হতে পারে, আবার আট দশদিনের মধ্যেও না হতে পারে। শীতকালে লাডাকের আবহাওয়া এমনিই হয়। চিন্তিত না হয়ে পারলাম না, কিন্তু চিন্তা করেও কোন উপায় ছিল না।

শহরে গিয়ে পোস্টাফিস থেকে মেমসাহেবকে একটা টেলিগ্ৰাম করে দিলাম, রিটাৰ্ণাড ফ্রম ফরোয়ার্ড এরিয়াস স্টপ ব্যাড ওয়েদার প্রোগ্রাম আনসার্টেন।

শেষপৰ্যন্ত এক সপ্তাহের পরিবর্তে, বারো দিন পর আবার পালামের মাটি স্পর্শ করলাম।

এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এলাম ওয়েস্টার্ন কোট। রিসেপশন কাউন্টারে আমার ঘরের চাবি চাইতেই বললো, ইওর সিস্টার-ইন-ল…ইজ দেয়ার।

সিস্টার-ইন-ল ?

অবাক হয়ে গেলাম। দিদি? মেজদি? কিন্তু ওঁরা এখন আসবেন কেন? বেড়াতে? একটা খবর তো পাওয়া উচিত ছিল। জরুরী কোন কাজে? লিফট্‌-এ উঠতে উঠতে অনেক কিছু ভাবছিলাম। আবার ভাবলাম বিয়ে নিয়ে কোন গণ্ডগোল হলো নাকি? না, না, তা কেমন করে সম্ভব।

ঘরে ঢুকতে গিয়েই মেজদিকে দেখে থমকে গেলাম। হঠাৎ মেজদিকে অমন বিশ্ৰীভাবে দেখে মনে হলো বোধহয় মেজদিরই চরম সর্বনাশ হয়ে গেছে। মনটা ব্যথায় ভরে গেল। এইত কমাস আগে বিয়ে হলো। এরই মধ্যে…

মেজদি আমাকে দেখেই হাউ-হাউ করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ওর অপ্ৰত্যাশিত আগমন এবং ততোধিক অপ্ৰত্যাশিত কান্নায় আমি এমন ঘাবড়ে গেলাম যে আমার গলা দিয়ে একটি শব্দও বেরুতে চাইল না। মেজদি আমাকে ঐ ভাবে জড়িয়ে ধরে কতক্ষণ কেঁদেছিলেন তা আমার মনে নেই। তবে মনে আছে বেশ কিছুক্ষণ বাদে মেজদি হঠাৎ বলে উঠলেন, তুমি কিভাবে একলা একলা বাঁচবে ভাই?

একলা? একলা? আমি?

আমি এবার মেজদির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিজেই ওরা দু’টো হাত চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করলাম, মেমসাহেব কেমন আছে?

মেমসাহেবের নাম শুনে মেজদি আর থাকতে পারলেন না। আবার আমাকে দু’হাত দিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে হাউ-হাউ করে কাঁদতে লাগলেন।

আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। বেশ কড়া করে দাবড় দিয়ে বললাম, কি হয়েছে মেমসাহেবের?

অস্পষ্ট স্বরে মেজদি জবাব দিলেন, সে আর নেই ভাই। মুহুর্তের মধ্যে মনে হলো সারা পৃথিবীটা অন্ধকারে ভরে গেল। কারা যেন অকল্যাণ হাতের ছোয়ায় পৃথিবী থেকে সবার প্রাণশক্তি হারিয়ে গেল। মনে হলো পায়ের নীচের মাটি সরে যাচ্ছে। আর আমি পাতালের অতল গহবরে ডুবে যাচ্ছি।

দোলাবৌদি, আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না। পাড় মাতালের মত টলে পড়ে গেলাম সোফার পর। অত বড় একটা মহা সর্বনাশের খবর শোনার পর আমার কিছু হলো না। মহা আরামে ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙল তখন দোখ রাত হয়ে গেছে আর আমার চারপাশে অনেকে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। প্ৰথমে আমি কাউকে চিনতে পারছিলাম না। খানিকক্ষণ পরে চিনতে পারলাম। ডাঃ সেন আমার পাশে বসে আছেন।

আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডাঃ সেন জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছেন?

ঘুম ভাঙার পর ডাঃ সেনকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ভাবলাম বোধহয় বেড়াতে এসেছেন। তাই আমি পালটা প্রশ্ন করলাম, আপনি কেমন আছেন?

আমি ভাল আছি। আপনি ভাল তো?

বড্ড ঘুম পাচ্ছে। কাল আসবেন। আবার আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন অনেক বেলায় আমার ঘুম ভাঙিল। গজানন চা নিয়ে এলো, ফিরিয়ে দিলাম। স্নান করতে বললো, করলাম না। গজানন আবার কিছুক্ষণ পরে এসে অনুরোধ করল, আবার ওকে ফিরিয়ে দিলাম। আমি চুপচাপ বসে রইলাম।

এর পর মেজদি এসে অনুরোধ করলেন, নাও ভাই স্নান করে একটু কিছু মুখে দাও।

আমি কোন জবাবই দিলাম না। আরো কিছুক্ষণ এমনি করে বসে থাকার পর মনে হলো গ্ৰীনাপার্কে মেমসাহেবের সংসারটা দেখে আসি। গজাননকে ডাক দিয়ে বললাম, গাড়ি তৈয়ার করে।

কাঁহা, যানা ছোটোসাব? খুব মিহি গলায় গজানন জানতে চাইল।

গ্ৰীন পার্ক।

কিছুক্ষণ বাদে গজানন এসে খবর দিল, গাড়ি তৈয়ার হায় ছোটোসাব।

আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লাম। গজানন বললো, এই নোংরা জামাকাপড় পরে বেরুবেন? তবে কি সিল্কের পাঞ্জাবী চাপিয়ে বেরুব? একটা চটি পায় দিয়ে হন হন করে বেরিয়ে গেলাম। গজানন দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে পিছনের সীটে বসে পড়ল। মেজদিও নিঃশব্দে আমার পাশে এসে বসল।

সেদিন গাড়ি চালিয়েছিলাম বিদ্যুৎ বেগে। কোন স্টপ সিগন্যাল পর্যন্ত মানিনি। গজানন বললো, এতনা তেজ মাত চালাইয়ে। আমি ওর কথার কোন জবাবই দিলাম না। মেজদি বললেন, একটু আস্তে চালাও ভাই, বড় ভয় করে।

কিছু ভয় নেই মেজদি। আমরা মরব না।

সেদিন শ্ৰীনাপার্কের বাসায় গিয়ে প্ৰথমে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। চোখে জল এসেছিল। মুছে নিলাম। সমস্ত বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম, খুব ভাল করে দেখলাম। তারপর ড্রইংরুমে এসে বুক সেলফ-এর পর থেকে মেমসাহেবের পোট্রেটটা তুলে নিলাম।

ব্যস? আর আমি নিজেকে সংযত রাখতে পারিনি। হাউ হাউ করে, চীৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। এত ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছিলাম যে চোখের জল ফেলতে পারিনি। পরবর্তীকালে জীবনে অনেক দুঃখ, অনেক আঘাত পেয়েছি কিন্তু তখনও চোখের জল ফেলার অবকাশ পাই নি। তাইতো সেদিন গ্ৰীনাপার্কের বাসায় আমার জমিয়ে রাখা সমস্ত চোখের জল বেরিয়ে এলো বিনা বাধায়।

মেমসাহেব আমার কাছে ছিল না, কিন্তু আমি স্থির জানি সে আমার কান্না না শুনে থাকতে পারে নি। আমার সমস্ত জীবনের চোখের জলের সব সঞ্চয় সেদিন ঐ পোড়ামুখীর জন্য ঢেলে দিয়েছিলাম, ভবিষ্যতের জন্য একটা ফোটাও লুকিয়ে রাখিনি।

মেজদি চুপটি করে পাশের সোফায় বসে কেঁদেছিলেন। গজানন দরজার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেঁদেছিল।

চোখের জল থামলে মেজদিকে জিজ্ঞাসা করলাম, মেমসাহেবের কি হয়েছিল। মেজদি?

আর কি হবে? সেই কলকাতার চিরন্তন ঝামেলা আর খোকনের বিপ্লব।

পাঁচই ফেব্রুয়ারী। সওয়া-তিনটায় ক্লাস শেষ হবার পর মেমসাহেবের কলেজ থেকে বেরুতে বেরুতে প্ৰায় পৌনে চারটে হলো। হাওড়ায় এসে পাচ নম্বর বাস ধরল। বাড়ি যাবার জন্য। আগের কয়েকদিনের মত সেদিনও বাস ডালহৌসী হয়ে গেল না। যাই হোক বাসায় পৌঁছবার পরই খোকনের এক ক্লাস ফ্রেণ্ড বলাই হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিল, ছোড়দি, খোকনের বুকে গুলী লেগেছে।

মেমসাহেব শুধু চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করেছিল, কোথায়?

এসপ্ল্যানেড ইস্ট এ। একমুহুর্ত নষ্ট করে নি মেমসাহেব। ট্যাক্সি নিয়ে ছুটেছিল এসপ্ল্যানেড। গ্র্যাণ্ড হোটেলের সামনে ট্যাক্সি থামল। পুলিস আর এগুতে দিল না। মেমসাহেব ঐখান থেকে দৌড়ে গিয়েছিল। এসপ্ল্যানেড ইস্টে। তখন সেখানে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলছে। মেমসাহেবও দৌড়ে দৌড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। খোকনকে পাবার জন্য। খোকনকে কি পাওয়া যায়? সে তো তখন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। মেমসাহেব খোকনকে না পেয়ে পাগল হয়ে উঠেছিল, কিন্তু বেশীক্ষণ তার পাগলামি করতে হয় নি। ঐ চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে, টিয়ারগ্যাসের ধোয়ার অন্ধকারের মধ্যে ছোট একটা রাইফেলের বুলেট এসে লেগেছিল বুকের মধ্যে।

আর খোকন? তার বুকে বুলেট লাগে নি, পায় লেগেছিল। ছোড়দিন মৃত্যু সংবাদে সেও উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। মেডিক্যাল কলেজের সমস্ত রোগীর আর্তনাদ ছাপিয়ে খোকনের কান্না শোনা গিয়েছিল।

দুদিন পরে কলকাতার কাগজগুলো মেমসাহেবের মৃত্যু নিয়ে চমৎকার হিউম্যুন স্টোরি লিখেছিল। একটা কাগজে মেমসাহেব, আর খোকনের ছবি পাশাপাশি ছেপেছিল। রিপোর্টটা পড়ে সবার মন খারাপ হয়েছিল। স্কুল-কলেজ, অফিসে, রেস্তোরাঁয়, ট্রামেবাসে, লোক্যাল ট্রেনে সবাই এই স্টোরিটা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। পুলিসের লোক’জনও পড়েছিল। সবাই দুঃখিত, মৰ্মাহত হয়েছিলেন।

মনে পড়ল। অনেকদিন আগে আমি যখন কলকাতায় রিপোর্টারী করতাম, তখন আমিও এমনি কত হিউম্যান স্টোরি লিখেছি, পড়েছি কিন্তু যেদিন আমার মেমসাহেবকে নিয়ে কলকাতার সব কাগজে এত বড় আর এত সুন্দর রিপোর্টটা ছাপা হলো, সেদিন অনেক চেষ্টা করেও আমি সে রিপোর্ট পড়তে পারলাম না।

বুকের মধ্যে খবরের কাগজগুলো চেপে জড়িয়ে ধরে শুধু নীরবে চোখের জল ফেলেছিলাম🥲

তারপরের ইতিহাস আর কি বলব? আমার জীবন-মধ্যাহোঁই এমন অপ্রত্যাশিতভাবে আমার জীবন-সূৰ্য চিরকালের জন্য ঘন কালে মেঘে ঢাকা পড়বে, কোনদিন কল্পনা করতে পারিনি। কিন্তু কি করব? ভগবান বোধহয় আমার জীবনটাকে নিয়ে লটারী খেলবার জন্যই আমাকে এই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। জীবনে যা কোনদিন কল্পনা করিনি, যা আমার মত অতি সাধারণ ছেলের জীবনে হওয়া উচিত ছিল না, আমার জীবনে সেইসব অসম্ভবই সম্ভব হয়েছে। যা বহুজনের জীবনে সম্ভব হয়েছে ও হবে, যা আমার জীবনেও ঘটতে পারত, ঠিক তাই হলো না।

কেন, কেন আমার এমন হলো বলতে পার? কে চেয়েছিল জীবনে এই প্ৰতিষ্ঠা? অর্থ-যশ-প্ৰতিপত্তি? কে চেয়েছিল স্ট্যাণ্ডার্ড হেরান্ড? বছর বছর বিদেশ ভ্ৰমণ? আমি তো এসব কিছুই চাইনি। তিন-চারশ’ টাকা মাইনের সাধারণ রিপোর্টার হয়ে মীর্জাপুর বা বৈঠকখানাতেই তো আমি বেশ সুখে থাকতে পারতাম। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি অন্যান্য অনেকের মত আমিও তো পেতে পারতাম। আমার আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন-সাধনার মানসীকে। আমার প্ৰেয়সীকে, আমার জীবন-দেবতাকে, আমার সেই এক অদ্বিতীয়া অনন্যাকে। ঐ পোড়ামুখী হতভাগী মেয়েটা আমার জীবনে এলে কি পৃথিবীর চলা থেমে যেত? চন্দ্ৰ-সূৰ্য ওঠা বন্ধ হতো?

মাঝে মাঝে মনে হয়, কালাপাহাড়ের মত ভগবানের সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দিই। মনে হয় মন্দির-মসজিদ-গীর্জাগুলো ভেঙে চুরমার করে দিই। আমাদের মত অসহায় মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার ভগবানকে কে দিল? মায়ের কোল থেকে একমাত্র সন্তানকে কেড়ে নেবার অধিকার কে দিয়েছে ভগবানকে? লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষের পাকা ধানে মই দেবার সাহস ভগবানের এলো কোথা থেকে?

বিশে ফাল্গুন, ৬ই মার্চ বিয়ের দিন আমি মেমসাহেবের দেওয়া ধুতি-পাঞ্জাবি পরে গ্রীন পার্কের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ওর ঐ পোট্রেটটা কোলে নিয়ে এইসব আজে-বাজে কথা ভাবতে ভাবতে চোখের জল ফেলেছিলাম সারারাত। চোখের জল মুছতে মুছতে ঐ ফটোয় মালা পরিয়েছিলাম, সিন্দুর দিয়েছিলাম। আর? আদর করেছিলাম, বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আদর করেছিলাম।

শুধু সেই শুভদিনে নয়, তারপর থেকে রোজই আমি গ্রীন পার্কে যাই। কাজকর্ম শেষ করে রোজ সন্ধ্যার পর ওখানে গিয়ে মেমসাহেবের সংসারের তদারকি করি, মেমসাহেবকে আদর করি, সুখ-দুঃখের কথা বলি। রোজ অন্তত একবার মেমসাহেবের কাছে না গিয়ে থাকতে পারি না। কোন কোনদিন কাজকর্ম শেষ করতে করতে অনেক রাত হয়, ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে চোখদু’টো ঘুমে ভরে আসে। মনে হয় ওয়েস্টার্ন কোটেই চলে যাই, শুয়ে পড়ি। কিন্তু কি আশ্চর্য! গাড়ির স্টিয়ারিংটা ঠিক হেষ্টিংস-তুগলক রোডের দিক ঘুরে সফদারজং এয়ারপোর্টের পাশ দিয়ে মেহেরালী রোড ধরে শেষপর্যন্ত গ্রীন পার্কে এসে হাজির হই।

লাদাক থেকে ফিরে এসে মেজদির কাছে যখন আমার চরম সর্বনাশের খবর শুনেছিলাম, তখন মনে হয়েছিল। আর বাঁচিব না। প্রিয়জনের বিয়োগ-ব্যথায় সব মানুষের মনেই এই প্ৰতিক্রিয়া হয়। আমারও হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমারও পরিবর্তন হয়েছে। মেমসাহেব নেই, কিন্তু আমি আছি। আমি মরিনি, মরতে পারিনি। আমি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতই বেঁচে আছি। আমাকে দেখে বাইরের কেউ জানতে পারবে না, বুঝতে পারবে না। যে আমার বুকের মধ্যে ব্যথা-বেদনা দুঃখ-আক্ষেপের হিমালয় লুকিয়ে আছে। আমার হাসি-ঠাট্টা হৈ-হুল্লোেড় দেখে কেউ অনুমান পৰ্যন্ত করতে পারেন না। এতবড় একটা বিয়োগান্ত নাটকের আমি হিরো। আমার মুখে হাসি আছে, কিন্তু মনের বিদ্যুৎ, প্ৰাণের উচ্ছ্বাস, চোখের স্বপ্ন চলে গেছে, চিরকালের জন্য, চিরদিনের জন্য চলে গেছে।

জান দোলাবৌদি, যতক্ষণ কাজকর্ম নিয়ে থাকি, ততক্ষণ বেশ থাকি। বুকের ভিতরের যন্ত্রণা ঠিক অনুভব করার অবকাশ পাই না। কিন্তু রাত্ৰিবেলা? যখন আমি সমস্ত দুনিয়ার মানুষের থেকে বহুদূরে চলে আসি, যখন আমি শুধু আমার স্মৃতির মুখোমুখি হই, তখন আর স্থির থাকতে পারি না। নিজেকে হারিয়ে ফেলি। সমস্ত শাসন অমান্য করে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। মেমসাহেবের ফটোটাকে নিয়ে আদর করি, ভালবাসি, কথা বলি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলি। কত রাত হয়ে যায়, তবু ঘুম আসে না। আর ঘুম এলেও কি শান্তি আছে? ঐ হতচ্ছাড়ী পোড়ামুখী আমাকে একলা একলা ঘুমুতে দেখলে বোধহয় হিংসায় জ্বলোপুড়ে মরে। আমার ঘুম না ভাঙিয়ে ওর যেন শান্তি হয় না।

ফারাক গোরখপুরীর একটা শের মনে পড়ছে–
নিদ আয়ে, তো খোয়াব আয়ে
খোয়াব আয়ে, তো তুমি আয়ে
পর তুমহারি ইয়াদ মে
ন নিদ আয়ে, ন খোয়াব আয়ে।

চমৎকার। তাই না? ঘুম এলেই স্বপ্ন আসে, স্বপ্ন এলেই তুমি আস কিন্তু যেই তুমি আস তখন না আসে ঘুম, না আসে স্বপ্ন।

ফীরাক গোরখপুরীর জীবনেও বোধহয় আমারই মত কোন বিপৰ্যয় এসেছিল। তা না হলে এত করুণ, এত সত্য কথা, এত মিষ্টি করে লিখলেন কেমন করে? ফীরাক যা লিখেছেন তা বর্ণে বর্ণে সত্য। যেই চোখের পাতাদু’টো ভারী হয়ে বুজে আসে, সঙ্গে সঙ্গে ও পা টিপে টিপে আমার ঘরে ঢুকবে। আমি বুঝতে পেরেও পাশ ফিরে শুয়ে থাকি। ও আমার কাছে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়বে, কিন্তু তবুও আমি ওর দিকে ফিরে তাকাই না। হতচ্ছাড়ী আমাকে আদর করে ভালবেসে ঠোঁট দু’টোকে শেষ করে দেয়। তারপর কিছুক্ষণ আমার বুকের পর মাথা রেখে শোবে, হয়ত বা আমার মুখটাকে নিজের বুকের মধ্যে রেখে আমাকে জড়িয়ে শোবে। আর চুপ করে থাকতে পারে না। ডাক দেবে, শুনছ?

আমি শুনতে পাই কিন্তু জবাব দিই না। আবার ডাকে, ওগো, শুনছ?

আমি হয়ত ছোট্ট জবাব দিই, উঃ।

হাত দিয়ে আমাকে টানতে টানতে বলবে, এদিক ফিরবে না? আস্ফুটস্বরে একটা বিচিত্র আওয়াজ করে আমি এবার চিৎ হয়ে শুই।। ও এক টানে আমাকে ওর দিকে ঘুরিয়ে নেয়। আমি আর চুপ করে থাকতে পারি না। ওকে জড়িয়ে ধরি। আর যেই দু’চোখ ভরে ওকে দেখতে চাই, সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘুম ভেঙে যায়।

দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে মেমসাহেব রোজ রাত্রে আমার কাছে এসে ঘুমটা কেড়ে নিচ্ছে। আগে আমার কি বিশ্ৰী ঘুম ছিল। বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড ওলট-পালট হয়ে গেলেও আমার ঘুম ভাঙত না। ঘুমের জন্য মেমসাহেব নিজেই কি আমাকে কম বকাবিকি করেছে? আর আজকাল? ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিছানায় গড়াগড়ি করি, কিন্তু ঘুম আসে না। একেবারে শেষরাত্রের দিকে ও ভোরবেলায় মাত্র দুতিন ঘণ্টার জন্য ঘুমাই।

জীবনটা যেন কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সবকিছু থেকেও আমার কিছু নেই। ঘর-সংসার থেকেও সংসারী হতে পারলাম না। তাছাড়া সংসারের জন্য কম করলাম না। সুন্দর সুখী পরিবাবের জন্য যা কিছু দরকার, তা সবই আমার গ্ৰীন পার্কের বাড়িতে আছে। যখন যেখানে গেছি, সেখান থেকেই মেমসাহেবের জন্য কিছু না কিছু এনে গ্ৰীন পার্কের বাড়িতে জমা করেছি। সোফা-কাৰ্পেট-ফ্রিজ থেকে শুরু করে রেডিও-ট্রোনজিস্টার-টেপরেকর্ডার পর্যন্ত আছে। মেমসাহেবের তো খুব চুল ছিল, তাই একবার ওকে বলেছিলাম, তোমাকে একটা হেয়ার-ড্রায়ার দেব। বেডরুমের ওয়াড়বের নীচের তাকে দেখবে আমি ওর জন্য হেয়ার-ড্রায়ারও এনেছি। ওর খুব ইচ্ছে ছিল ও অর্গান বাজিয়ে গান গাইবে। বছর-দুই আগে জার্মান এম্বাসীর ফাস্ট সেক্রেটারী দিল্লী থেকে বদলী হবার সময় ওদের অর্গানটা আমি কিনে নিই।–ড্রইংরুমের ডানদিকে কোনায় অর্গানটা রেখেছি। অর্গানের এক পাশে মেমসাহেবের একটা ছবি আর গীতবিতান। ডানদিকে চেক কাট-গ্লাসের একটা ফ্লাওয়ার-ভাস-এ ফুল রেখে দিই।

মেমসাহেবের স্বপ্ন দেখার কোন সীমা ছিল না।…ওগো, তুমি আমাকে একটা রকিং চেয়ার কিনে দেবে। শীতকালের দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়া করে বারান্দায় রোদরের মধ্যে রকিং চেয়ারে বসে বসে দুলতে দুলতে আমি তোমার লেখা বই পড়ব।,…কবে। আমি বই লিখব আর কবে ও আমার বই পড়বে, তা জানি না। তবে গ্ৰীন পার্কের বাড়ির সামনের বারান্দায় রকিং চেয়ার রেখেছি। শীতকালের দুপুরবেলা গ্ৰীন পার্ক গেলে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই, মেমসাহেব ওর লম্বা লম্বা চুলগুলো খুলে দিয়ে রকিং চেয়ারে দুলে দুলে আমার লেখা বই পড়ছে। ড্রইংরুমে ঢুকলে মনে হয় অর্গান বাজিয়ে মেমসাহেব গান গাইছে, জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে।

আর কি লিখব দোলাবৌদি? আমি আর পারছি না। এসব কথা লিখতে আমার হাতটা পৰ্যন্ত অবশ হয়ে আসে। আমি ভাবতে পারি না মেমসাহেব নেই। রাস্তাঘাটে চলতে-ফিরতে গিয়ে দূর থেকে একটু ময়লা, একটু টানা-টানা চোখের বিরাট খোঁপাওয়ালা মেয়ে দেখলেই মনে হয়, ঐ বুঝি মেমসাহেব। প্রায় ছুটে যাই তার পাশে। কোথায় পাব মেমসাহেবকে? ও এমন আড়াল দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে যে সারাজীবন আমি চোর হয়ে ওকে খুজে বেড়াব। কিন্তু পাব না। আমি খালি অবাক হয়ে ভাবি আমাকে এত কষ্ট দিয়ে ওর কি লাভ? ওর কি একটু দুঃখ হয় না? আমাকে একটু দেখা দিলে কি আমি ওকে গিলে খেতাম? আজি আর আমি কিছুই চাই না। শুধু মাঝে মাঝে ওকে একটু দেখতে চাই, দেখতে চাই ওর সেই ঘন কালো টান টানা গভীর দু’টো চোখ, ঐ বিরাট খোপাটা, ঐ একটু হাসি। আর? আর কি চাইব? চাইলেই কি পাব? পাব কি আমার কপালে ওর একটু হাতের ছোয়া? আমি ভাবতে পারি না। ওকে আর কোনদিন দেখতেও পার না।

একসঙ্গে বেশীদিন আমি দিল্লীতে টিকতে পারি না। বছরে আটবার-দশবার ছুটে যাই কলকাতায়। ওর-আমার স্মৃতি-জড়ান রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই। সকালবেলায় রাসবিহারীর মোড়ে লেডিজ ট্রামিটার জন্য আর বিকেলবেলা এ্যাসেমব্লী হাউসের কোণে বা হাইকোর্টের ঐ ধারের রেস্টরেন্টে ঘুরে ঘুরে বেড়াই। ওকে দেখতে পাই না কিন্তু ওর ছায়া দেখতে পাই।

আরো কত কি করি! যেখানে যেখানে মেমসাহেবের স্মৃতি লুকিয়ে আছে, আমি সময় পেলেই সেখানে ছুটে যাই। ডায়মণ্ডহারবার-কাকদ্বীপ থেকে শুরু করে দাৰ্জিলিং-এর পাহাড়ে, পুরীর সমুদ্রপাড়ে, জয়পুরের রাস্তায়, সিলিসেরের লেকের ধারে ছুটে যাই। বিনিময়ে? বিনিময়ে শুধু চোখের জল আর পাজার-কঁপানো দীর্ঘনিঃশ্বাস। ব্যস, আবার কি?

মাঝে মাঝে মনে হয় আমি ভুল, আমি মিথ্যা, আমি ছায়া, আমি অব্যয়। মনে হয় এমন করে নিজেকে বঞ্চনা করে কি লাভ? মেমসাহেব যদি আমাকে ঠকিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারে, তবে আমিই বা তাকে মনে রাখব কেন? হতচ্ছাড়ীকে ভুলব বলে হোয়াইট, হর্স বা ভ্যাট-সিক্সটনাইনের বোতল নিয়ে বসে ঢক-চক করে গিলেছি। গিলতে গিলতে বুক-পেট জ্বলে উঠেছেও আমি স্বাভাবিক থাকতে পারিনি, কিন্তু তবুও ওর হাসি, ওর ঐ দু’টো চোখ আমার সামনে থেকে সরে যায় নি। আবার মাঝে মাঝে মনে হয়েছে আমি লম্পট, বদমাইস, দুশ্চরিত্র হবো; যখন যেখানে যে-মেয়ে পাব, তখন তাকে নিয়েই ফুর্তি করব, মজা করব, আনন্দ উপভোগ করব। মনে করেছি। রক্তমাংসের এই দেহটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলিব। পারিনি দোলাবৌদি, পারিনি। সুযোগ-সুবিধা পেলেও পারিনি। সফিসটিকেটেড সোসাইটির কত মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। কতজনের সঙ্গে আমি ঘুরে বেড়াই, সিনেমায় যাই, হোটেলে যাই, ক্লোর শোতে যাই। কখনো কখনো বাইরেও বেড়াতে যাই। রক্ত-মাংসের একটু-আধটু ছোঁয়াছুইতে ওদের অনেকেরই জাত যায় না, তা আমি জানি। কিন্তু পারি না। মনে হয়। মেমসাহেব পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

মেমসাহেবকে ভুলি কি করে? ওকে ভুলতে হলে নিজেকেও ভুলতে হয়, ভুলতে হয় আমার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। কিন্তু সে কি সম্ভব? আমি যদি উন্মাদ না হই, তাহলে তা কি করে হবে? আমার জীবনের অমাবস্যার অন্ধকারে ওর দেখা পেয়েছিলাম। কৃষ্ণপক্ষের দীর্ঘ পথযাত্রায় ও আমার একমাত্র সঙ্গিনী ছিল। কিন্তু পূর্ণিমার আলোয় ওকে পাবার আগেই ও পালিয়ে গেল। ও আমাকে সবকিছু দিয়েছে। কর্মজীবনে সাফল্য, সমাজজীবনে প্ৰতিষ্ঠা, প্ৰাণভর ভালবাসা-সবকিছু দিয়েছে। নিজে কিছুই তোগ করল না, কিছুরই ভাগ নিল না। সবকিছু রেখে গেল, নিয়ে গেছে শুধু আমার হৃৎপিণ্ডটা।

এই বিরাট দুনিয়ায় কত বিচিত্র আকর্ষণ ছড়িয়ে রয়েছে। মানুষের মনকে প্ৰলুব্ধ করার জন্য সম্পদ-সম্ভোগের বন্যা বয়ে যাচ্ছে দেশে দেশে। কত নারী, কত পুরুষ তা উপভোগ করছে। আমার জীবনেও সে সুযোগ এসেছে বার বার, বহুবার। স্বদেশে, বিদেশে সর্বত্র। কিন্তু পারিনি। মনের মধ্যে এমন জমাট-বাধা কান্না জমে আছে যে, আনন্দে-বাসরের কাছে গেলে আমি আঁতকে উঠি। দিল্লী, বোম্বে, কলকাতায় কত রসের মেলা বসে রোজ সন্ধ্যাবেলায়। কত বন্ধু-বান্ধব ও বান্ধবী সাদর আমন্ত্রণ জানান সে-উৎসবে, সে-রসের মেলায় অংশ নিতে। হয়ত সেসব উৎসবে উপস্থিত থাকি, হয়ত ঠোঁটের কোনায় একটু শুকনো হাসির রেখা ফুটিয়ে কাকলী রায় বা অনিমা মৈত্ৰকে আর এক গেলাস শ্যাম্পেন বা হুইস্কি এগিয়ে দিই কিন্তু মেতে উঠতে পারি না। ওদের মত। শুধু এখানে কেন? লণ্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্কে? ওখানে তো সন্ধ্যার পর মানুষ মাটিতে থেকেও অমরাবতী-অলকানন্দায় বিচরণ করে। পরিচিত-পরিচিতার দল আমাকে হোটেল থেকে টেনে নিয়ে যায়, একলা থাকতে দেয় না। কিন্তু পারি কি ওদের মত আমরামতী-অলকানন্দায় উড়ে যেতে? পারি কি নিজেকে ভুলে যেতে? পারি না দোলাবৌদি, পারি না। সব সময় মনে হয় মেমসাহেব থাকলে কত মজা হতো।

ওরা কত ইচ্ছা ছিল আমার সঙ্গে দেশ-বিদেশে ঘুরবে। যখন ও আমার কাছে ছিল, তখন ওকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবার সামৰ্থ্য আমার ছিল না। অকৰ্মণ্য বেকার সাংবাদিক হয়ে ওকে নিয়ে কলকাতার রাস্তায় বেরুতেও ভয় পেতাম, লোকলজ্জায় পিছিয়ে যেতাম। আজ? আজ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আজ ঐ চিরপরিচিত কলকাতার রাজপথে আমি যে-কোন মেয়েকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারি। আমি জানি কেউ আমার সমালোচনা করবে না বা করলেও সে বিশ্ব-নিন্দুকদের আমি ভয় করি না। কিন্তু আজ কোথায় পাব আমার মেমসাহেবকে? যে কলকাতার রাজপথ দিয়ে হঁটিতে হাঁটতে দুজনে স্বপ্ন দেখেছি। ভবিষ্যৎ জীবনের, আজ আমি সেই পথ দিয়েই এক এক ঘুরে বেড়াই। সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পৰ্যন্ত ঘুরে বেড়াই। . ক্লান্ত হলে এক কাপ চা বা এক পেগ হুইস্কি নিয়ে বসে পড়ি, কিন্তু মেমসাহেবের স্মৃতিবিজড়িত পথের আকর্ষণ কাটিয়ে ঘরে ফিরতে পারি না। ভাবি, নিঃসঙ্গভাবে পথ চলতে গিয়েই একদিন মেমসাহেবের দেখা পেয়েছিলাম ভিড়ের মধ্যে ওকে হারিয়ে ফেলেছি। হয়ত পথে পথে ঘুরতে ঘুরতেই আবার ওর দেখা পাব। আমি জানি এই পৃথিবীতে আর একটা মেমসাহেব পাওয়া অসম্ভব। যদিও বা সবকিছুর মিল খুঁজে পাই, ওর ঐ অপারেশনের চিহ্ন তো পাব না।

মেমসাহেবকে পেয়ে বোধহয় মনে মনে বড় বেশি অহংকার হয়েছিল। বোধহয় সেই তরুণ প্ৰেমিকের মত ভেবেছিলাম–
জিস্ত পর ইনকিলাব আনে দে
কমসিনী পর শরাব আনে দে
এ খুদা, তেরী খুদাই পলটু দুঙ্গা
জরা লব তক শরাব আনে দে।
মরনে আর জিনে কা ফয়সালা হোগা।
জরা উনোক জবাব আনে দে।

হয়ত সেই তরুণ প্রেমিকের মত ভেবেছিলাম, আমার হৃদয়ে বিপ্লব আসুক, আমার ঐ প্রাক-যুবতীর যৌবন আসুক, ওর ঠোঁটে ভালবাসা আসুক, তারপর ভগবানের ভগবানত্ব ঘুচিয়ে দেব। ওর দেহে এই বিবর্তন আসার পর একবার বাঁচা-মরার ফয়সালা করে ছাড়ব।

আমিও বোধহয় এমনি স্বপ্ন দেখেছিলাম যে, মেমসাহেবকে পাবার পর সারা দুনিয়াটাকে একবার মজা দেখাব। আজ আমার পাশে মেমসাহেব থাকলে দুজনে মিলে হয়ত সত্যি অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করতাম। ভগবান নিজের মাতকবরী বজায় রাখবার জন্য আমাদের সে-সুযোগ দিলেন না। হিংসুটে ভগবান কেড়ে নিলেন। মেমসাহেবকে। হতচ্ছাড়া ভগবান যদি আমাদের মত রক্ত-মাংসের তৈরী হতেন, তাহলে অনুভব করতেন আমাদের জ্বালা-যন্ত্রণা। কিন্তু নিম্প্রাণ পাথরের ঐ মূর্তিগুলো কি করে অনুভব করবে। আমাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, জ্বালা-যন্ত্রণার কথা। মানুষের মনের কথা বুঝবে না বলেই তো ও পাথরের মূর্তি হয়ে আমাদের উপহাস করছে, বিদ্রেরূপ করছে।

কাজকর্ম, দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে একটু মুক্তি পেয়ে একটু একলা হলেই এইসব আজেবাজে চিন্তা করি। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, হয়ত মেমসাহেবকে নিয়ে অত আনন্দ করা আমার উচিত হয় নি। ভগবানের ব্যাঙ্কে আমার অদৃষ্ট যৌ-পরিমাণ আনন্দ জমা ছিল, আমি বোধহয় তার চাইতে অনেক, অনেক বেশি আনন্দের চেক কেটেছিলাম। তাই বোধহয় এখন সারাজীবন ধরে চোখের জলের ইনসটলমেণ্ট দিয়ে সে দেন শোধ করতে হবে। আবার কখনও কখনও মনে মনে সন্দেহ হয় যে, শ্যামবাজারের মোড়ে যেমন ফিরপো বা গ্র্যাণ্ড-গ্ৰেটইস্টার্ন হোটেল মানায় না, এসপ্ল্যানেডের মোড়ে যেমন ছানার দোকান বেমানান হয়, তেমনি আমার পাশেও বোধহয় মেমসাহেবকে মানাত না। আই এফ এস বা আই এ এস। বা টপ মাৰ্কেণ্টাইল একসিকিউটিভের পাশে ওকে যেমন মানাত, তেমনি কি আমার পাশে সম্ভব হতো? কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে ভগবান আমার জীবনে ওকে আনলেন কেন? কি প্ৰয়োজন ছিল এই রসিকতার?

এসব কথা ভাবতে গেলে আমি আর নিজেকে সামলাতে পারি না। মাথাটা ঝিমঝিম করে, বুকের মধ্যে অসহ্য ব্যথা করে, হাত-পা অবশ হয়ে আসে। মাঝে মাঝে ভাবি ও হতচ্ছাড়ী পোড়ামুখীর কথা আর ভাবব না, আর কোনদিন মনে করব না। ওর স্মৃতি। ওর স্মৃতিকে ভুলবার জন্যই হয়ত দুটি-একটি বান্ধবীর সঙ্গে একটু বেশী মেলামেশা, একটু বেশী মাতামাতি করেছি। কখনও কখনও। কিন্তু এক পা এগিয়ে তিন পা পিছিয়ে এসেছি। অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা মেমসাহেব সহ্য করতে পারত না। বলত, ওগো, তুমি অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে বিশেষ মেলামেশা করো না।

আমি জিজ্ঞাস করতাম, কেন? আমি কি হারিয়ে যাচ্ছি?

তা জানি না, তবে আমার বড় কষ্ট হয়।

সেই স্মৃতি, সেই কথা, মেমসাহেবের সেই মুখখানকেই, মনে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে আমি পালিয়ে আসি ঐ সখী বান্ধবীর কাছ থেকে। তাছাড়া ও যদি অন্য ছেলেদের সঙ্গে একটু হাসি-ঠাট্টা বা গল্প-গুজব করত, তাহলে আমিও তো সহ্য করতে পারতাম না! সেবার দাৰ্জিলিং-এ গিয়ে ও যখন আধঘণ্টার কথা বলে ঘন্টা-দুই ধরে ইউনিভার্সিটির পুরান বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে হোটেলে ফিরে এলো, তখন ওকে আমি কি ভীষণ বকেছিলাম। সুতরাং আজ আমায় কি অধিকার আছে বনানী, চন্দ্রাবলী বা অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে যত্রতত্র বিচরণ করবার? আমি যে অধিকার ওকে দিতে পারিনি, সে অধিকার আমি উপভোগ করি কোন মুখে?

তাইতো ওদের সবার কাছ থেকে পালিয়ে আসি। পালিয়ে আসি গ্ৰীণ পার্ক। মেমসাহেবের সংসারে। ওর নিজে হাতে লাগান কাঠচাঁপা গাছে একটু জল দিই, বারান্দায় ডেকচেয়ারটাকে ঠিক করে রাখি। ড্রইংরুমে গিয়ে অর্গানটাকে একটু পরিষ্কার করি, মেমসাহেবের পোর্ট্রেটটা একটু বাঁকা করে ঘুরিয়ে রেখে ওর মুখোমুখি বসে থাকি।

আগে ভাবতাম কাজকর্ম শেষ করে বাড়িতে ফিরে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান শুনব। ভাবতাম, দু’টো-একটা গান শোনাবার পর ও বলবে, সারাদিন বাদে বাড়ি ফিরলে। আগে স্নান করে খাওয়া-দাওয়া সেরে নাও। তারপর আবার গান শোনাব।

আগে তুমি গান শোনাও। পরে স্নান করব।

লক্ষ্মীটি, আগে খাওয়া-দাওয়া সোরে নাও, পরে গান শুনে। খাওয়া-দাওয়ায় এত অনিয়ম করো না।

মেমসাহেবের কণ্ঠস্বর চিরদিনের মত শুদ্ধ হয়ে গেছে। আজ আমি যত অনিয়মই করি না, কেউ নেই; আমাকে শাসন করবার। কেউ নেই আমাকে বাধা দেবার। আর গান? চিরকালের জন্য আমার জীবন থেকে সুর আর ছন্দ বিদায় নিয়েছে।

টেপ-রেকর্ডারে কত বড় বড় শিল্পীর কত অসংখ্য গান তুলে রেখেছি। কোন কোনদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ড্রইংরুমে বসে ঐসব গান শুনি । গান শুনতে শুনতে হারিয়ে ফেলি নিজেকে। কোনদিন ৩য়ত ঘুমিয়ে পড়ি। গজাননন এসে ডাক দেয়, ছোটোসাব, অনেক রাত হয়ে গেছে, ফিরে যাও, খাওয়া-দাওয়া করবে তো?

আমি একটু মুচকি হেসে বলি, গজানন, খাওয়া-দাওয়া করে যদি শান্তিতেই ঘুমাব, তাহলে তোমার বিবিজীকে হারাব কেন?

গজানন লুকিয়ে কাপড়ের কোণা চোখে দিয়ে চোখের জল মুছে নেয়। বলে, ছোটোসাব, তুমি এমন করে নিজেকে কষ্ট দিলে বিবিজীরও কষ্ট হবে।

গজাননের কথায় আমি পাগল উঠি। হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠি। যা-তা বলে গজাননকে গালাগালি দিই, ফালতু বাত্‌ মাত্‌ কহো। ননসেন্স, ইডিয়েট, রাসকেল। বিবিজীর কষ্ট হবে? তোমার বিবিজীর ছাই হবে। আমাকে জ্বলিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দিল যে-মেয়ে, তার আবার কষ্ট হবে?

কি আশ্চর্য! গজানন আমার কথায় রাগে না, কঁদে!

এই হতচ্ছাড়া গজাননটা হয়েছে আমার আর এক জ্বালা৷৷ ও হতভাগার কোন চুলোয় যাবার জায়গা নেই। বেটাকে তো বহুকাল আগেই খেয়ে বসে আছে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে বহুকাল। রিটায়ার করার পর সেই যে আমার ঘাড়ে চেপেছে আর নামছে না। কত বকি, কত গালাগালি দিই। কতবার বলি, দূর হয়ে যা। কিন্তু হতভাগা নড়বে না। জগদল পাথরের মত আমার ঘাড়ে চেপে বসে আছে। বেশী কিছু বললে হাউমাউ করে এমন কান্নাকাটি লাগবে যে আমি আর কিছু বলতে পারি না। মাঝে মাঝে মন-মেজাজ ভাল থাকলে জিজ্ঞাসা করি, গজানন, মাইনে নেবে না?

গজানন অবাক হয়ে বলে, মাইনে? আমি টাকা নিয়ে কি করব ছোটসাব? তুমি খেতে পরতে দিচ্ছ, আমার আবার কি চাই?

একটু পরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে, তাছাড়া তোমার সঙ্গে আমি কি হিসাব-নিকাশ করব? যার সঙ্গে হিসাব নিকাশ করব ভেবেছিলাম, সেই তো সব হিসাব-নিকাশ মিটিয়ে চলে গেল।

ওর এই কথা বলার পর কি আর কিছু বলা যায়? আমি চুপ করে যাই।

এতবড় বাড়িতে একলা থাকে বলে গজাননকে মাঝে মাঝে নানা রকমের ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়। অনেকেই অনেক রকম প্রশ্ন করে। ও কাউকে বলে, বিবিজী বিলেতে পড়তে গেছে, ক’বছর পর ফিরবে। গ্রীন পার্কের অধিকাংশ লোকই জানে মেমসাহেব বিলেতে পড়তে গেছে। কাউকে কাউকে বলে, বিবিজীর বাচ্চা হবে বলে কলকাতা গেছে।

আমি কখনও কখনও জিজ্ঞাসা করি, হ্যাঁরে, এইসব আজে-বাজে কথা বলে। লাভ কি?

ও বলে, আমাদের ঘরের কথায় ওদের কি দরকার? আমরা কি ওদের ঘরের খবর জানতে চাই?

গজাননকে দেখে মাঝে মাঝে আমি সত্যি নিজের কষ্ট ভুলে যাই। গ্ৰীন পার্কের বাড়িটাকে ও এত সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে যে কি বলব! ড্রইংরুম, বেডরুম, কিচেন, বাথরুম সব ঝকঝাক তকতক করছে। লনে পর্যন্ত একটু নোংরা পাওয়া যাবে না। দেখে কেউ ভাবতে পারবে না যে মেমসাহেব নেই, মেমসাহেব। আর কোনদিন আসবে না। মাঝে মাঝে আমিও ভারতে পারি না। মনে হয় গাড়িটা নিয়ে মেমসাহেব একটু কেনা-কাটার জন্য কনট্রপ্লেসে গেছে, এক্ষুনি এসে পড়বে।

যাঁরা মেমসাহেবের কথা জানেন, তাদের অনেকেই আমাকে বিয়ে করবার পরামর্শ দেন। বলেন, পাগলামি করো না ভাই, বিয়ে কর। যে গেছে সে আর কখনও ফিরবে না। নিজের জীবনটাকে নিয়ে কেন ছিনিমিনি খেলছ? বিয়ে করার কথা সবাই বলেন, বলে না। শুধু গজানন। বিয়ের কথা শুনলে ও রেগে আগুন হয়ে যায়। বলে, ‘ওরা কি ভালবাসতে জানে? ওদের মাথায় শুধু স্মৃর্তি করার মতলব। আমার হাতদুটো চেপে ধরে বলে, “না, না, ছোটোসাব, তুমি বিয়ে করলে স্বৰ্গে গিয়েও বিবিজী শান্তিতে থাকতে পারবে না।”

আমি কোন জবাব দিই না। চুপ করে বসে থাকি। গজাননও একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “ছোটোসাব, যদি তুমি বিয়ে কর, তাহলে আমাকে একটু আগের থেকে খবর দিও। আমি থাকতে অন্য মেয়েকে এই সংসারে আনতে পারবে না।

দোলাবৌদি, শুনলে আমার সেই কালো মেমসাহেবের কাহিনী? কেমন লাগল? যাকে নিয়ে তোমরা এতদিন লুকিয়ে-চুরিয়ে ফিসফিস করেছ, যাকে নিয়ে অনেকে আমার আড়ালে সমালোচনা করেছ, এই হলো সেই মেমসাহেবের ইতিহাস।

আমার তুমি আমার বিয়ে দিতে চাও, ভাল কথা। কিন্তু ঐ হতচ্ছাড়ী পোড়ামুখীর শূন্য আসন পূর্ণ করার মত কাউকে পাবে কি? আমার ঐ গ্ৰীন পার্কের সংসারে এসে সুখী হবে এমন মেয়ে কোথায় আছে বলতে পার? ঐ রকিং চেয়ারে বসে বই পড়বে, ঐ অর্গ্যানে গান গাইবে, ঐ ড্রইংরুমে বসে গল্প করবে, ঐ বেডরুমে শুয়ে আমাকে আদর করবে, এমন সাহস কোন মেয়ের হবে?

টেনিসনের দুটো লাইন মনে পড়ছে

“Time marches on but
memories stays.
Torturing silenty the rest
of our days.”

সেই স্মৃতির জ্বালা বুকে নিয়েই বোধহয় আমার বাকী দিনগুলো কাটবে। তাই না?

তোমাদের বাচ্চু।
সমাপ্তি 📌

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে