মেমসাহেব পর্ব-১৭+১৮+১৯

0
24

🔴মেমসাহেব (পর্ব :১৭, ১৮, ১৯)🔴
-নিমাই ভট্টাচার্য

সেদিন দমদমে অরেঞ্জ পাড়ের একটা তাঁতের শাড়ি আর অরেঞ্জ রং-এর একটা ব্লাউজ পরে, রোদপুরের মধ্যে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ‘মেমসাহেব রেলিং এর ধারে দাঁড়িয়েছিল আমার আগমন প্ৰত্যাশায়। . আমার দুহাতে ব্রিফকেশ, টাইপরাইটার, কেবিনব্যাগ আর ওভারকোট থাকায় হাত নাড়তে পারলাম না। শুধু একটু মুখের হাসি দিয়ে ওকে জানিয়ে দিলাম, ফিরে এসেছি।

কাস্টমস ইমিগ্রেশন কাউন্টার পার হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেই ও আমার হাত থেকে টাইপরাইটার আর কেবিনব্যাগটা নিয়ে নিল। টার্মিনাল বিল্ডিং থেকে বেরুবার সময় জিজ্ঞাসা করল, ভাল আছ তো?

মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, তুমি?

ভাল আছি।

তারপর ট্যাক্সিতে উঠে মেমসাহেব আমাকে প্ৰণাম করল।

আমি ওর মাথায় হাত দিয়ে বললাম, সুখে থাক, মেমসাহেব।

নিশ্চয়ই সুখে থাকব। তারপর আমি বলেছিলাম, জান, এই শাড়িটা আর ব্লাউজ পরে তোমাকে ভারী ভাল লাগছে।

খুব খুশি হয়ে হাসিমুখে ও বললো, সত্যি বলছ?

সত্যি বলছি। তোমাকে বড় শান্ত, স্নিগ্ধ, মিষ্টি লাগছে।

একটু পরে আবার বলেছিলাম, ইচ্ছা করছে তোমাকে জড়িয়ে ধরে একটু আদর করি।

মেমসাহেব দু’হাত জোড় করে বলেছিল, দোহাই তোমার, এই ট্যাক্সির মধ্যে আদর করো না।

দোলাবৌদি, এমনি করে এগিয়ে চলেছিলাম। আমি আর মেমসাহেব। আমি দিল্লীতে থাকতাম, ও কলকাতায় থাকত। কখনও লুকিয়ে-চুরিয়ে মেজদিকে হাত করে ও দিল্লী আসত, কখনও বা আমি কলকাতা যেতাম। মাঝে মাঝেই আমাদের দেখা হতো। বেশীদিন দেখা না হলে আমরাও শান্তি পেতাম না।

ইতিমধ্যে এক’জন ন্যাভাল অফিসারের সঙ্গে মেমসাহেবের মেজদির বিয়ে হলো। বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আমি কলকাতা গিয়েছিলাম। একটা ভাল প্রেজেনটেশনও দিয়েছিলাম।

মেজদির বিয়েতে গিয়ে ভালই করেছিলাম। এই উপলক্ষ্যে আমার সঙ্গে ওদের পরিবারের অনেকের আলাপ-পরিচয় হলো। তাছাড়া ঐ বিয়ে বাড়িতেই মেজদি আমাদের ব্যাপারটা পাকাপাকি করে দিয়েছিলেন। আমার হাত ধরে টানতে টানতে মেজদি ওর মার সামনে হাজির করে বলেছিলেন, হ্যাঁ মা, এই রিপোর্টারের সঙ্গে তোমার ঐ ছোটমেয়ের বিয়ে দিলে কেমন হয়? f

এমন অপ্ৰত্যাশিত ঘটনার জন্য আমি মোটেও প্ৰস্তুত ছিলাম না। লজ্জায় আমার চোখ-মুখ-কান লাল হয়ে উঠেছিল। তবুও আমি অনেক কষ্টে ভণিত করে বললাম, আঃ মেজদি! কি যা তা বলছেন? মেজদি আমাকে এক দাবিড় দিয়ে বললেন, আর ঢং করবেন। না। চুপ করুন।

তারপর মেজদি আবার বললেন, কি মা? তোমার পছন্দ হয়? এত সহজে ঐ কালো-কুচ্ছিত হতচ্ছাড়ী মেয়েটাকে যে আমার মত সুপাত্রের হাতে সমৰ্পণ করতে পারবেন, মেমসাহেবের মা তা স্বপ্নেও ভাবেন নি। তাই বললেন, তোদের যদি পছন্দ হয় তাহলে আর আমার কি আপত্তি থাকবে বল?

বিয়ে বাড়ি। ঘরে আরো অনেক লোকজনে ভর্তি ছিল। ওদের সবার সামনেই মেজদি আমার ঘাড়ে একটা ধাক্কা দিয়ে বললেন, নিন, মাকে প্ৰণাম করুন।

লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল। কিন্তু কি করব? প্ৰণাম করলাম। এবার মেজদি আমার মাথাটা চেপে ধরে বললেন, নিন, এবার আমাকে প্ৰণাম করুন।

আমি প্রতিবাদ করলাম, আপনাকে কেন প্ৰণাম করব?

মেজদি চোখ রাঙিয়ে বললেন, আঃ। যা বলছি তাই করুন। তা নিয়ত সবকিছু ফাস করে দেব।

আশেপাশের সবাই গিলে গিলে মেজদির কথা শুনছিলেন। আর হাঁ করে আমাকে দেখছিলেন।

আমি এদিক-ওদিক বাঁচিয়ে অনেক কষ্টে মেজদিকে চোখ টিপে ইশারা করলাম।

ন্যাভাল অফিসারকে পেয়ে মেজদির প্রাণে তখন আনন্দের বন্যা। আমার ইশারাকে সে তখন গাহ্য করবে কেন? তাই সবার সামনেই বলে ফেললেন, ওসব ইশারা-টিসারা ছাডুন। আগে প্ৰণাম করুন—তা নয়ত…

দোলাবৌদি, তুমি আমার অবস্থাটা একবার অনুমান কর। বিয়ে বাড়ি। চারদিকে লোক’জন গিজগিজ করছে। তারপর ঐ রণমূৰ্তিধারী বধুবেশী মেজদি! বীরত্ব দেখিয়ে বেশী তর্ক করলে না। জানি হাটের মধ্যে হাঁড়ি ভেঙে মেজদি কি সর্বনাশই করত। টিপ করে একটা প্ৰণাম করেই পালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মেজদি আবার টেনে ধরে বললেন, আহা-হা! একটু দাঁড়ান।

হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ঐ যে দিদি দাঁড়িয়ে আছে। দিদিকে প্ৰণাম করুন।

আমি একটু ইতস্তত করতেই মেজদি আবার ভয় দেখালেন, খবরদার রিপোর্টার। অবাধ্য হলেই…

দিদিকেও প্ৰণাম করলাম।

দিল্লী আসার দিন মেমসাহেব স্টেশনে এসে বলেছিল, জান, তোমাকে সবার খুব পছন্দ হয়েছে।

স্টেশনে প্ল্যাটফর্মের সবার সামনেই ও আমাকে প্ৰণাম করল, আমি ওকে আশীৰ্বাদ করলাম। দিল্লী মেল ছেড়ে দিল।

মেজদি যে এত তাড়াতাড়ি আমাদের এত বড় উপকার করবেন, তা কোনদিন ভাবিনি। শুধু ভাবিনি নয়, কল্পনাও করিনি। মেমসাহেব আমাকে ভালবাসত, আমি মেমসাহেবকে ভালবাসতাম। সে ভালবাসায় কোন ফাকি, কোন ভেজাল ছিল না। আমরা নিশ্চিত জানতাম আমরা মিলবই। শত বাধা-বিপত্তি অগ্ৰাহ করেও আমরা মিলতাম।

কিন্তু তবুও মেজদির ঐ সাহায্য ও উপকারটুকুর একান্ত প্রয়োজন ছিল এবং মেজদির প্রতি আমরা দুজনেই কৃতজ্ঞ ছিলাম।

আসলে মেজদি বরাবরই আমাকে ভালবাসতেন, স্নেহ করতেন। আমারও মেজদিকে বড় ভাল লাগত। প্ৰথম দিন থেকেই মেজদিরও আমাকে ভাল লেগেছিল। কিছুদিনের মধ্যেই মেজদি আমাদের দুজনের ভালবাসার গভীরতা উপলব্ধি করেছিলেন। তাই মনে মনে ছোট বোনকে তুলে দিয়েছিলেন আমার হাতে।আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার

এবার তো সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দিলেন, মেমসাহেব আমার, আমি মেমসাহেবের। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তির হস্তান্তরের সবকিছু পাকাপাকি হয়ে গেল। শুধু এক সাবরেজিস্ট্রারের সই। আর সীলমোহর লাগান বাকি রইল। এই কাজটুকুর জন্য আমি বিশেষ চিন্তিত ছিলাম না।

মেমসাহেব অনেকদিন আগে বললেও আমি এতদিন বাড়ি ভাড়া নেবার কথা খুব সিরিয়াসলি ভাবিনি। সেবার কলকাতা থেকে ফিরে সত্যি সত্যিই গ্ৰীনপার্ক ঘোরাঘুরি শুরু করলাম, দু চারজন বন্ধু-বান্ধবকেও বললাম।

দু’চারটে বাড়ি দেখলাম। কিন্তু ঠিক পছন্দ হলো না। আরো কিছুদিন অপেক্ষা করলাম। আরো কিছু বাড়ি দেখলাম। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আরো কিছু পরামর্শ করলাম। কয়েকটা বাড়ির জন্য দরদস্তুরও করলাম।

এমনি করে আরো মাস দুই কেটে যাবার পর সত্যি সত্যিই তিনখানা ঘরের একটা ছোট কটেজ পেলাম তিনশ টাকায়। বাড়িটা আমার বেশ পুছন্দ হলো। মেহরালী রোড থেকে বড় জোর দুশো গজ হবে। গ্ৰীনপার্ক মার্কেট বেশ কাছে, মিনিট তিন-চারের রাস্তা। বাজার দূরে হলে মেমসাহেবের পক্ষে কষ্টকর হতো। তাছাড়া বাড়িটাই বেশ ভাল। কর্নার প্লাটু। সামনে আর পাশে মাঝারি সাইজের লন। গেটের ভিতর দিয়ে বুড়ির ভিতরে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা। ড্রইং-ডাইনিং রুমটা তো বেশ বড়। কুড়ি বাই পনের। একটা বেডরুম বড়, একটা ছোট। দু’টো বেডরুমেই লফটু আর ওয়ারড্রব। বড় বেডরুম আর ড্রইং-ডাইনিং রুমের মাঝে একটা ওয়েস্টার্ন স্টাইলের বাথরুম। বাড়ির ভিতরে একটা ইণ্ডিয়ান স্টাইলের প্ৰিভি। সামনের বারান্দাটা অনেকটা লম্বা থাকলেও বিশেষ চওড়া ছিল না। ভিতরের বারান্দাটা স্কোয়ার সাইজের বেশ। বড় ছিল। রান্নাঘর? দিল্লীর নতুন বাড়িতে যেমন হয়, তেমনিই ছিল। আলমারী-মিটসেফ-সিঙ্ক-কাপবোর্ড সবই ছিল। লেফট্ৰ, আলমারী ওয়ারড্রব থাকার জন্য আলাদা কোন স্টোর ছিল না। কিন্তু ছাদে একটা দরজা-বিহীন ঘর ছিল।

লন। দু’টো বেশ ভাল ছিল সত্যি। কিন্তু দিল্লীর অন্যান্য বাড়ির মত এই বাড়িটায় কোন ফুলগাছ ছিল না। আগে যিনি ভাড়া ছিলেন, তার নিশ্চয়ই ফুলের শখ ছিল না। তবে সামনের বারান্দার এক পাশ দিয়ে একটা বিরাট মাধবীলতা উঠেছিল।

মোটকথা সব মিলিয়ে বাড়িটা আমার বেশ ভাল লেগেছিল। তাছাড়া আমার মত ডাকাতের হাতে পড়ে মেমসাহেব ফ্যামিলি প্ল্যানিং এসোসিয়েশনের সভানেত্রী হলেও এ বাড়িতে থাকতে অসুবিধা হবে না বলে বাড়িটা আরো ভাল লেগেছিল।

বাড়িটা নেবার পর মেমসাহেবকে কিছু জানালাম না। ঠিক। করলাম ও দিল্লী আসার আগেই বেশ কিছুটা সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে চমকে দেব। আবার ভাবলাম, ওয়েস্টার্ন কোর্ট ছেড়ে এই বাড়িতেই। চলে আসি। পরে ভাবলাম, না, না, তা হয় না। একলা একলা। থাকব এই বাড়িতে? অসম্ভব। ঠিক করলাম। ওকে নিয়েই এই বাড়িতে ঢুকব।

গজাননকে আমার এই নতুন বাড়িতে থাকতে দিলাম। আমি ওকে বললাম গজানন, তুমি আমার বাড়িটার দেখাশুনা কর। আমি এর জন্য তোমাকে মাসে মাসে কিছু দেব।

গজানন সাফ জবাব দিয়েছিল, নেই নেই, ছোটোসাব, তুমি আমার হিসেবা-টিসেব করতে পারবে না। আমি বিবিজির কাছ থেকে যা নেবার তাই নেব।

গজানন বাসে যাতায়াত করত। ডিউটি শেষ হবার পর এক মিনিটও অপেক্ষা করত না। সোজা চলে যেত গ্রীনপার্ক।

আমি আমার বাড়তি আড়াইশ টাকা দিয়ে কেনাকাটা শুরু করে দিলাম। একটা সোফা সেট কিনলাম, একটা ডবল বেডের খাট কিনলাম। ওয়েস্টার্ন কোট থেকে আমার বইপত্তর ঐ বাড়িতে নিয়ে গেলাম। বিদেশ থেকে কিনে আনা ডেকরেশন পিসগুলোও সাজালাম।

তারপর এক মাসে সমস্ত ঘরের জন্য পর্দা করলাম। তাছাড়া যখন যেরকম বাতিক আর সামর্থ্য হয়েছে, তখন কটেজ ইণ্ডাষ্ট্রিজ এম্পোরিয়াম বা অন্য কোন স্টেট এম্পোরিয়াম থেকে কিছু কিছু জিনিসপত্র কিনে ঘরদের সাজাচ্ছিলাম।

গজানন বড় দরদ নিয়ে বাড়িটার দেখাশুনা করছিল। দীর্ঘদিন ওয়েস্টার্ন কোর্টে কাজ করার ফলে ওর বেশ একটা রুচিবোধ হয়েছিল। মানি প্যাণ্ট, ক্যাকটাস্‌, ফার্ন দিয়ে বাড়িটা চমৎকার সাজাল।

আমি যখনই দিল্লীর বাইরে গেছি, গজানন তখনই ফরমায়েশ করে ছোটখাট সুন্দর সুন্দর জিনিস আনিয়েছে। হায়দ্রাবাদ থেকে দশ-পনের টাকা দামের ছোট ছোট সুন্দর সুন্দর উড, কাতিং এনেছি, বেনারস থেকে পাথরের জিনিস। এনেছি, কলকাতা থেকে বঁকুড়ার টেরেকোটা ঘোড়া আর কৃষ্ণনগরের ডলস এনেছি। উড়িষ্যা থেকে স্যাগুস্টোনের কোনারক মূর্তি, কালীঘাট আর কাঁটকি পটিও এনেছিলাম। আমাদের ড্রইংরুমের জন্য।

বুক-সেলফ’এর উপর দু’কোনায় দু’টো ফটো রেখেছিলাম। একটা প্ৰাইম মিনিস্টারের সঙ্গে আমার ছবি আর একটা মেমসাহেবের প্রোর্ট্রেট।

এদিকে যে এতকাণ্ড করছিলাম, সেসব কিছুই মেমসাহেবকে জানালাম না। ইচ্ছা করেই জানালাম না। ইতিমধ্যে বোম্বে থেকে মেজদির কাছ থেকে চিঠি পেলাম—

ভাই রিপোর্টার,
যুদ্ধ না করেও যারা যোদ্ধা, ইণ্ডিয়ান নেভীর তেমনি এক অফিসারকে বিয়ে করে কি বিপদেই পড়েছি। সংসার করতে গিয়ে রোজ আমার সঙ্গে যুদ্ধ করছে, রোজ হেরে যাচ্ছে। রোজ বন্দী করছি, রোজ মুক্তি দিচ্ছি। তবে বার বার তো যুদ্ধ-বন্দীর প্রতি এত উদার ব্যবহার করা যায় না। এবার তাই শাস্তি দিয়েছি, দিল্লী ঘুরিয়ে আনতে হবে। তবে ভাই একথা স্বীকার করব বন্দী এক কথায়, বিনা প্ৰতিবাদে, শাস্তি হাসিমুখে মেনে নিয়েছে।

আর কিছুদিনের মধ্যেই তুমিও বন্দী হতে চলেছি। শাস্তি তোমাকেও পেতে হবে। তবে তুমি তোমার মেমসাহেবের কাছ থেকে শাস্তি পাবার আগেই আমরা দুজনে তোমাকে শাস্তি দেবার জন্য দিল্লী আসছি।

প্রেসিডেন্টের খুব ইচ্ছা কে আমরা রাষ্ট্রপতি ভবনে ওর অতিথি হুই। কিন্তু ভাই, তোমাকে ছেড়ে কি রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকা ভাল দেখায়? তোমার মনে কষ্ট দিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকতে আমি পারব না। আমাকে ক্ষমা করো।

আগামী বুধবার ফ্রন্টিয়ার মেল অ্যাটেণ্ড করতে ভুলে যেও না। তুমি স্টেশনে না এলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হয়েই আবার সেই রাষ্ট্রপতি ভবনে যেতে হবে।

তোমার মেজদি।

বুধবার আমি ফ্রন্টিয়ার মেল অ্যাটেণ্ড করেছিলাম। মেজদিদের নিয়ে এসেছিলাম আমার গ্রীনাপার্কের নতুন আস্তানায়। সারা জীবন কলকাতায় ঐ চারখানা ঘরের তিনতলার ফ্ল্যাটে কাটিয়ে আমার গ্রীনাপার্কের বাড়ি মেজদির ভীষণ পছন্দ হয়েছিল।

যুদ্ধ না করেও যিনি যোদ্ধা, মেজদির সেই ভাগ্যবান বন্দী ঘরবাড়ি দেখে মন্তব্য করেছিলেন, দেখেশুনে মনে হচ্ছে ম্যাডাম সপিং করতে গিয়েছেন। এক্ষুনি এসে ড্রইংরুমে বসে এককাপ কফি খেয়েই বেডরুমে লুটিয়ে পড়বেন।

তারপর জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ম্যাডামএর জন্য এত আয়োজন করার পর এ বাড়িতে আপনার একলা থাকতে কষ্ট হয় না?

আমি বলেছিলাম, আমি তো এখানে থাকি না। আমি ওয়েস্টার্ন কোটেই থাকি।

আমার কথায় ওরা দুজনেই অবাক হয়েছিল। বোধহয় খুশিও হয়েছিলেন। খুশি হয়েছিলেন এই কথা ভেবে যে একলা ভোগ করার জন্য আমি এত উদ্যোগ আয়োজন করিনি।

মেজদিরা তিনদিন ছিলেন। কখনো ওরা দুজনে, কখনও বা আমরা তিনজনে ঘুরে বেড়িয়েছি। ওদের দিল্লী ত্যাগের আগের দিন সন্ধ্যায় গ্রীন পার্কের বাড়ির ড্রইংরুমে বসে অনেক রাত্ৰি পৰ্যন্ত আমরা আড্ডা দিয়েছিলাম।

কথায় কথায় মেজদি একবার বললেন, সংসার করার প্রায় সবকিছুই তো আপনি যোগাড় করে ফেলেছেন। বিয়েতে আপনাদের কি দেব বলুন তো?

আমি উত্তর দেবার আগেই বন্দী উত্তর দিলেন, আজেবাজে কিছু না দিয়ে একটা ফোমড় রাবারের গদি দিও। শুয়ে আরাম পাবে আর প্রতিদিন তোমাকে ধন্যবাদ জানাবে।

এইসব আজেবাজে। আলতু-ফালতু কথাবার্তা বলতে বলতে অনেক রাত হয়েছিল। মেজদি বললেন, আজ আর ওয়েস্টার্ন কোট, যাবেন না, এইখানেই থেকে যান।

আমি হেসে বলেছিলাম, না, না, তা হয় না।

কেন হয় না?

ওখানে নিশ্চয়ই জরুরী চিঠিপত্র এসেছে…

মেজদি মাঝপথে বাধা দিয়ে বললেন, এত রাত্তিরে আর চিঠিপত্তর দেখে কি করবেন। কাল সকালে দেখবেন।

আবার বললাম, না, না, মেজদি, আমি এখন এ-বাড়িতে থাকব না।

এবার মেজদি হাসলেন। বললেন, কেন? প্ৰতিজ্ঞা করেছেন বুঝি যে, একলা একলা এই বাড়িতে থাকবেন না?

আমি কোন উত্তর না দিয়ে শুধু একটু হাসলাম। একটু পরে বিদায় নিয়ে চলে এলাম ওয়েস্টার্ন কোর্ট।

পরের দিন স্টেশনে বিদায় জানাতে গেলে মেজদি আমাকে একটু আড়ালে ডেকে নিলেন। বললেন, আপনার মেমসাহেব বোম্বে দেখেনি। তাই সামনের ছুটিতে আমাদের কাছে আসবে। কদিনের জন্য দিল্লী পাঠিয়ে দেব, কেমন?

আমি হাসতে হাসতে বললাম, আপকা মেহেরবানি। মেজদি বললেন, মেহেরবানির আবার কি আছে? বিয়ের আগে একবার সবকিছু দেখেশুনে যাক।

আমি এ-কথারও কোন জবাব দিলাম না। মাথা নীচু করে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ট্রেন ছাড়ার মুখে মেজদি বললেন, ফাল্গুনে বিয়ে হলে আপনার কোন আপত্তি নেই তো?

আমি মাথা নীচু করেই বললাম, সে-সময় যে পার্লামেন্টের বাজেট সেসন চলবে।

তা চলুক গে। বেশী দেরী আর ভাল লাগছে না। শেষে মেজদি বলেছিলেন, সাবধানে থাকবেন তাই। চিঠি দেবেন।

মেজদি চলে যাবার পর মনটা সত্যি বড় খারাপ লাগল। পরমাত্মীয়ের বিদায়-ব্যথা অনুভব করলাম মনে মনে।

কদিন পর মেমসাহেবের চিঠি পেলাম।

… তুমি কি কোন তুক-তাক বা কবচ-মাদুলী দিয়ে মেজদিকে বশ করেছ? ও মা-র কাছে ছ পাতা আর আমার কাছে চার পাতা চিঠি লিখেছে। সারা চিঠি ভর্তি শুধু তোমার কথা, তোমার প্রশংসা। তোমার মত ছেলে নাকি আজকাল পাওয়া মুশকিল। তুমি নাকি ওদের খুব যত্ন করেছ? ওরা নাকি খুব আরামে ছিল?

তারপর মা-র চিঠিতে ফাল্গুন মাসে বিয়ে দেবার কথা লিখেছে। তোমারও নাকি তাই মত? মা-র কোন আপত্তি নেই। আজ মেজদির চিঠিটা মা দিদির কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

আর ক’দিন পরেই আমাদের কলেজ বন্ধ হবে। ছুটিতে মেজদির কাছে যাব। যদি মেজদিকে ম্যানেজ করতে পারি। তবে ওদের কাছে দু সপ্তাহ থেকে এক সপ্তাহের জন্য তোমার কাছে যাব।

আমাদের এখানকার আর সব খবর মোটামুটি ভাল। তবে ইদানীং খোকনকে নিয়ে একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছি। আমার মনে হচ্ছে ও রাজনীতিতে মেতে উঠেছে। পড়াশুনা এখনও অবশ্য ঠিকই করছে কিন্তু ভয় হয় একবার যদি রাজনীতি নিয়ে বেশী মেতে ওঠে, তবে পড়াশুনার ক্ষতি হতে বাধ্য। খোকন যদি কোন কারণে খারাপ হয়ে যায়, তাহলে তার জন্য আমারও কিছুটা দায়ী হতে হবে। সর্বোপরি বৃদ্ধ বিপত্নীক কাকাবাবু বড় আঘাত পাবেন।…

আমি মেমসাহেবকে লিখলাম, মেজদি যা লিখেছে তা বর্ণে বর্ণে সত্য। ফাল্গুন মাসে পার্লামেন্টের সেসন চলবে। কিন্তু তা চলুক গে। চুলোর দুয়োরে যাক পার্লামেণ্ট। ফান্ধন মাসে আমি বিয়ে করবই। আমার আর দেরী সহ হচ্ছে না। তুমি যে আমার চাইতেও বেশী অধৈৰ্য হয়েছ, তা আমি জানি।

আরো অনেক কিছু লিখেছিলাম। শেষের দিকে খোকনের সম্পর্কে লিখেছিলাম, তুমি ওকে নিয়ে অত চিন্তা করবে না। বাঙালীর ছেলেরা যৌবনে হয় রাজনীতি, না হয় কাব্য-সাহিত্য চৰ্চা করবেই। শরৎ-হেমন্ত-শীত-বসন্ত ঋতুর মত এসব চিরস্থায়ী নয়। দু’চারদিন ইনকিলাব বা বন্দেমাতরম চিৎকার করে ডালহৌসী স্কোয়ারের স্ট্রম রোলারের তলায় পড়লে সব পাল্টে যাবে। খোকনও পাল্টে যাবে।

এ-কথাও লিখলাম, তুমি খোকনের জন্য অত ভাববে না। হাজার হোক আজ সে বেশ বড় হয়েছে, কলেজে পড়ছে। তাছাড়া তার বাবা তো আছেন। ছেলেমেয়েদের এই বয়সে তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে গেলে অনেক সময়েই হিতে বিপরীত হয়। তোমারও হতে পারে। সুতরাং একটু খেয়াল করে চলবে। শেষে লিখলাম, খোকন যখন ছোট ছিল, যখন তাকে মাতৃস্নেহ দিয়ে, দিদির ভালবাসা দিয়ে অতাবিত বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার প্রয়োজন ছিল, তুমি ও মেজদি তা করেছ। তোমাদের স্নেহচ্ছায়ায় যে একটা মাতৃহারা শিশু আজ যৌবনে পদার্পণ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, সেইটুকুই তোমাদের যথেষ্ট পুরস্কার। এর চাইতে বেশী আশা করলে হয়ত দুঃখ পেতে পার।আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার

জান দোলাবৌদি, খোকন সম্পর্কে এত কথা আমি লিখতাম না। কিন্তু ইদানীংকালে মেমসাহেব খোকনকে নিয়ে এত বেশী মাতামাতি, এত বেশী চিন্তা করা শুরু করেছিল যে-এসব না লিখে পারলাম না। আজকাল ওর প্রত্যেকটা চিঠিতে খোকনের কথা থাকত। লিখত, খোকনের এই হয়েছে, ঐ হয়েছে। খোকনের কি হলো, কি হবে? খোকন কি মানুষ হবে না? ইত্যাদি ইত্যাদি হাজার কথা লিখত। তুমি তো জান আজকালকার দিনে নিজেদের খোকনকেই মানুষ করতে মানুষ পাগল হয়ে উঠছে। তাছাড়া স্নেহ-ভালবাসা দেওয়া সহজ। কিন্তু বিনিময়ে তার মর্যাদা পাওয়া দুর্লভ।

খোকনের প্রতি ওর এত স্নেহ-ভালবাসার জন্য সত্যি আমার ভয় করত। তয় হতো। যদি কোনদিন খোকন ওর এই স্নেহভালবাসার মূল্য না নেয়, মৰ্যাদা না দেয়, তখন সে-দুঃখ, সে-আঘাত সহস্থ করা অত্যন্ত কষ্টকর হবে। তাই না?

এই চিঠির উত্তরে মেমসাহেব কি লিখল জান? লিখল, তুমি যত সহজে খোকন সম্পর্কে যেসব উপদেশ পরামর্শ দিয়েছ, আমার পক্ষে অত সহজে সেসব গ্রহণ করা বা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তার কারণ খুব সহজ। মাতৃহারা ছবছরের শিশু খোকনকে নিয়ে কাকাবাবু আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। সে অনেক দিনের কথা। মাতৃস্নেহ দেবার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। কিন্তু দিদি, মেজদি আর আমি ওকে বড় করেছি। ওকে খাইয়েছি, পরিয়েছি, সুর করে ছড়া বলতে বলতে কোলের মধ্যে নিয়ে ঘুমিয়েছি। একদিন নয়, দুদিন নয়, বছরের পর বছর খোকনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে শুয়েছি আমরা তিন বোনে।

কয়েক বছর পর দিদির বিয়ে হয়ে গেলে আমি আর মেজদি ওকে দেখেছি। ওর অসুখ হলে মেজদি ছুটি নিয়েছে, আমি কলেজ কামাই করেছি, মা মানত করেছেন। মেজদিরও বিয়ে হয়ে গেল। আজ খোকনকে দেখবার জন্য শুধু আমি পড়ে রয়েছি। তুমিও কলকাতা ছেড়ে চলে গেলে। মা-বাবার কথা বাদ দিলে খোকন ছাড়া এখানে আমার আর কি আকর্ষণ আছে বল? হাতেও প্রচুর সময়। তাইতো খোকনের কথা না তেবে উপায় কি?

এই চিঠির উত্তরে আমি আর খোকন সম্পর্কে বিশেষ কিছু লিখলাম না। ভাবলাম মেমসাহেবের ছুটিতে দিল্লী এলেই কথাবার্তা বলব।

ছুটিতে মেমসাহেব বোম্বে গিয়েছিল। একবার ভেবেছিলাম দু’তিনদিনের জন্য বোম্বে ঘুরে আসি। খুব মজা হতো। কিন্তু শেষপর্যন্ত গেলাম না। মেজদির ওখানে সতের-আঠারো দিন কাটিয়ে মেমসাহেব কলকাতায় যাবার পথে দিল্লী এসেছিল। কলকাতায় সবাই জানত ও বোম্বেতেই আছে। মেমসাহেব আমার কাছে মাত্র চার-পাঁচদিন ছিল।

মেমসাহেবকে গ্রীনাপার্কের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওর খুব পছন্দ হয়েছিল। বলেছিল, লাভলি।

তারপর বলেছিল, তুমি যে এর মত্যেই এত সুন্দর করে সাজিয়েগুছিয়ে নেবে, তা ভাবতে পারিনি।

আমি বলেছিলাম, তোমাকে বিয়ে করে তো যেখানে-সেখানে তুলতে পারি না।

ঐ লম্বা সরু। কালে ভ্রূ দু’টো টান করে উপড়ে তুলে ও বলেছিল, ইজ ইট?

তবে কি? মেমসাহেব গজাননকে অশেষ ধন্যবাদ জানাল অতি সুন্দর করে।

বাগান করবার জন্য। জিজ্ঞাসা করল, গজানন, তোমার কি চাই বল?

গজানন বলেছিল, বিবিজি, আভি নেই। আগে তুমি এসো, সবকিছু বুঝে-টুঝে নাও, তারপর হিসাব-টসাব করা যাবে।

বিকেল হয়ে এসেছিল? গজাননকে কিছু খাবার-দাবার আর কফি আনতে মার্কেটে পাঠিয়ে দিলাম। মেমসাহেব ও-পাশের সোফাটা ছেড়ে আমার পাশে এসে বসল। আমার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে মাথা নীচু করে কি যেন দেখছিল, কি যেন ভাবছিল। আমি কিছু বললাম না, চুপ করেই বসে। রইলাম। কয়েক মিনিট ঐভাবেই কেটে গেল। তারপর ঐ মাথা নীচু করেই নরম গলায় ও বললো, সত্যি, তুমি আমাকে সুখী করার জন্য কত কি করছ।

কেন? আমি বুঝি সুখী হবে না?

নিশ্চয়ই হবে। তবুও এত বড় বাড়ি এত সব আয়োজন তো আমার জন্যই করেছ।

আমি ঠাট্টা করে বললাম, সেজন্য কিছু পুরস্কার দাও না। মেমসাহেব হেসে ফেললো। বললো, তোমার মাথায় শুধু ঐ এক চিন্তা।

তোমার মাথায় বুঝি সে চিন্তা আসে না?

ও চিৎকার করে বললো, নো, নো, নো!

এক মুহুর্তের জন্য আমিও চুপ করে গেলাম। একটু পরে বললাম, এদিকে তো গলাবাজি করে খুব নো, নো বলছি, আর ওদিকে বিয়ের আগেই ছেলেমেয়ের ঘর ঠিক করছ।

মেমসাহেব এইভাবে ফাস্ট ওভারের ফাস্ট বলে বোলন্ড হবে, ভাবতে পারে নি। আমার কথার কোন জবাব ছিল না। ওর কাছে। শুধু বললে, তোমার মত ডাকাতের সঙ্গে ঘর করতে হলে একটু ভূত-ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে উপায় আছে?

গ্ৰীনপার্ক থেকে ওয়েস্টার্ন কোটে ফিরে আসার পর মেমসাহেব বললো, জান, মেজদি বলছিল বিয়েতে তোমার কি চাই তা জেনে।

আমি ভ্রূ কুঁচকে বেশ অবাক হয়ে বললাম, সে কি? মেজদি জানে না?

তুমি বলেছ নাকি?

একবার? হাজারবার বলেছি।

আমার রাগ দেখে ও যেন একটু ঘাবড়ে গেল। বললো, হয়ত কোন কারণে…

এর মধ্যে কারণ-টারণ কিছু নেই।

মেমসাহেবের মুখটা চিন্তায় কালো হয়ে গেল। মুখ নীচু করে বললো, মেজদি হয়ত ভেবেছে তুমি ফ্রাঙ্কলি আমাকে সবকিছু খুলে বলতে পার…

তোমাকে যা বলব, মেজদিও তা জানে।

মেমসাহেব নিশ্চল পাথরের মত মাথা নীচু করে বসে রইল। আমি চুরি করে ওর দিকে চাইছিলাম। আর হাসছিলাম।

একটু পরে ও আমার কাছে এসে হাতদু’টো ধরে বললো, ওগো, বল না, বিয়েতে তোমার কি চাই।

আমি প্ৰায় চিৎকার করে বললাম, তোমার মেজদি জানেন না যে আমি তোমাকে চাই?

একটা বিরাট দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে হাসতে হাসতে ও বললো, বাপরে বাপ! কি অসভ্য ছেলেরে বাবা।

আমি অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বললাম, এতে অসভ্যতার কি করলাম?

মেমসাহেব আমাকে এক দাবড় দিয়ে বললো, বাজে বকো না। ছি, ছি, অমন করে কেউ ভাবিয়ে তোলে?

পরে ও আবার আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, বল না, বিয়েতে তুমি কি চাও?

আমি বললাম, তোমার এসব কথা জিজ্ঞাসা করতে লাজ করছে না? তুমি কি ভেবেছ আমি সেই ভদ্রবেশী অসভ্য ছোটলোকগুলোর দলে যে লুকিয়ে লুকিয়ে নগদ টাকা নিয়ে পরে চালিয়াতি করব?

পরে মেজদিকে একটা চিঠি লিখে জানিয়েছিলাম, আপনারা আমাকে ঠিক চিনতে পারেন নি। বিয়েতে যৌতুক বা উপঢৌকন তো দূরের কথা, অন্য কোন মানুষের দয়া বা কৃপা নিয়ে আমি জীবনে দাঁড়াতে চাই না। সে মনোবৃত্তি থাকলে বেহালায় সরকারী জমিতে সরকারী অর্থে একটা বাড়ি বা কলকাতার শহরে বেনামীতে। দু’টো-একটা ট্যাকসি অনেক আগেই করতাম। আর শ্বশুরের পয়সায়, শ্বশুরের কৃপায় সমাজ-সংসারে প্রতিষ্ঠা? ছিঃ, ছিঃ! মেরুদণ্ডহীন হীনবীৰ্য পুরুষ ছাড়া এ কাজ কেউ পারবে না। খিড়কির দরজা দিয়ে আয় করে, সম্পত্তি করে চালিয়াতি করতে আমি শিখিনি। নিজের কর্মক্ষমতা ও কলমের জোরে যেটুকু পাব, তাতেই আমি সুখী ও সন্তুষ্ট থাকব।

এই চিঠির উত্তরে মেজদি লিখেছিলেন, ভাইরিপোর্টার, তোমার চিঠি পড়ে মনে হলো তুমি আমাদের ভুল বুঝেছি। তোমার সঙ্গে আমাদের সবচাইতে ছোট বোনের বিয়ে হচ্ছে। তাইতো তোমরা দুজনে আমাদের কত প্রিয়, কত আদরের; তোমাদের বিয়েতে আমরা কিছু দেব না, তাই কি হয়? তোমাদের কিছু না দিলে কি বাবা-মা শান্তি পাবেন?

আমি আবার লিখলাম, সেন্টিমেন্টের লড়াই লড়বার ক্ষমতা আমার নেই। তবে আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি, আমার কিছু চাই না। যদি নিতান্তই কিছু দিতে চান, তাহলে কনটেমপোরারি হিষ্ট্রর কিছু বই দেবেন। দয়া করে আর কিছু দিয়ে আমাকে বিব্রত করবেন না।অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন

যাকগে ওসব কথা। মেমসাহেব কলকাতা যাবার আগের দিন দু’জনে বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে শেষে বুদ্ধ-জয়ন্তী পার্কে বসেছিলাম অনেকক্ষণ। কথায় কথায় মেমসাহেব খোৰুনের কথা বলেছিল, তুমি কলকাতা ছেড়ে চলে আসার পর বুঝলাম তোমাকে কত ভালবাসি। এমন একটা অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা আমাকে ঘিরে ধরল যে তোমাকে কি বলব। কোনমতে সেই লেডিজ ট্রামে চেপে কলেজ যেতাম। আর আসতাম। আর কোথাও যেতাম না। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সিনেমা টিনেমা কিছু ভাল লাগত না।

আমি বললাম, ঠিক সেইজন্যই তো খোকনকে বেশী আঁকড়ে ধরেছ, তা আমি বুঝি।

তইতো সন্ধ্যার পর খোকনকে পড়াতে বসতাম। পড়াশুনা হয়ে গেলে খাওয়া-দাওয়ার পর ছাদে গিয়ে দুজনে বসে বসে গল্প করে কাটাতাম। কোন কোনদিন মা আসতেন। গান গাইতে বলতেন। কিন্তু আমি গাইতে পারতাম না। গান গাইবার মত মন আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম।

একটু পরে আবার বললো, গরমকালে কলকাতার সন্ধ্যাবেলা যে কি সুন্দর তা তো তুমি জান। তোমার সঙ্গে কত ঘুরে বেড়িয়েছি। ঐ সন্ধ্যাবেলায় কিন্তু তুমি চলে আসার পর আমি কলেজ থেকে ফিরে চুপচাপ শুয়ে থাকতাম আমার খাটে।

তাই বুঝি? সত্যি বলছি, জানিলা দিয়ে পাশের শিউলি গাছটা দেখতাম আর এক টুকরো আকাশ দেখতে পেতাম। শুয়ে শুয়ে ভাবতাম শুধু তোমার কথা।

আমি ওর হাতটা আমার হাতের মধ্যে টেনে নিলাম। বললাম, তুমি যে আমাকে ছেড়ে শান্তিতে থাকতে পার না, তা আমি জানি মেমসাহেব।

ওর চোখদু’টো কেমন যেন ছলছল করছিল। গলার স্বরটাও স্বাভাবিক ছিল না। তেজা তেজা গলায় বললো, এখন শুধু খোকন ছাড়া কলকাতায় আমার কোন আকর্ষণ নেই। কিন্তু ছেলেটা আজকাল যে কি লাগিয়েছে তা ওই জানে।

কি আবার লাগল?

মনে হচ্ছে খুব জোর পলিটিকস করছে।

তার জন্য ভয় পাবার বা চিন্তা করবার কি আছে?

তুমি কলকাতায় রিপোর্টারী করেছ, অনেক রাজনৈতিক, আন্দোলন দেখছি। সুতরাং তুলি দেখলে বুঝতে পারতে কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারি না ও কি করছে। সেইজন্যই বেশী ভয় হয়।

চুরি-জোচ্চারি তো করছে না, সুতরাং তুমি এত ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন?

মেমসাহেব দৃষ্টিটা একটু ঘুরিয়ে নিয়ে কেমন যেন অসহায়ার। মত আমার দিকে তাকাল। বললো, জান, এই ত কিছুদিন আগে হাতে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে ফিরল। প্ৰথমে কিছুই বলছিল না। বার বার জিজ্ঞাসা করার পর বললো, পুলিসের লাঠি লেগেছে। এবার মেমসাহেব আমার হাতদু’টো চেপে ধরে বললো, আচ্ছা! বলতে, ঐ লাঠিটাই যদি মাথায় লাগত, তাহলে কি সর্বনাশ হতো?

আমি বেশ বুঝতে পারলাম খোকন রাজনীতিতে খুব বেশী মেতে উঠেছে। সভা-সমিতি মিছিল-বিক্ষোত করছে সে এবং আজ হাতে লাঠি পড়েছে, কাল মাথায় পড়বে, পরশু হয়ত গুলীর আঘাতে আহত হয়ে মেডিক্যাল কলেজের অপারেশন থিয়েটারে যাবে। চিন্তার নিশ্চয়ই কারণ আছে কিন্তু এ-কথাও জানি ছেলেরা একবার মেতে উঠলে ফিরিয়ে আনা খুব সহজ নয়। খবরের কাগজের রিপোটারী করতে গিয়ে কলকাতার রাজপথে বহুজনকে পুলিশের লাঠিতে আহত, গুলীতে নিহত হতে দেখেছি। সব রিপোর্টারই এসব দেখে থাকেন, নিশ্চল নিশ্চপ পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেন। চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমিও সবকিছু দেখেছি, একফোটাও চোখের জল ফেলিনি।

আজ মেমসাহেব খোকনের কথা বলায় হঠাৎ মুহুর্তের জন্য এইসব দৃশ্যের ঝড় বয়ে গেল মনের পর্দায়ে। কেন, তা বুঝতে পারলাম না। মনে মনে বেশ একটু চিন্তিতও হলাম। ওকে সেসব কিছু বুঝতে দিলাম না। সান্ধনা জানিয়ে বললাম, হাতে একটু লাঠি লেগেছে বলে অত ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন? কলকাতায় বাস করে যে পুলিসের এক ঘা লাঠি খায়নি, সে খাটি বাঙালীই না।

দু। ফোটা চোখের জল ইতিমধ্যেই গড়িয়ে পড়েছিল মেমসাহেবের গালের পর। আমার কাছ থেকে লুকোবার জন্য তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে সারা মুখটা মুছে নিয়ে বললো, হয়ত তোমার কথাই ঠিক কিন্তু যদি কোনদিন কিছু হয়।…

মেমসাহেব। আর বলতে পারল না। দুই হাঁটুর পর মাথাটা রাখল। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, আত ভয় পাচ্ছি কেন মেমসাহেব? আবার বললাম, অতি চিন্তা করলে কি বাঁচা যায়?

মেমসাহেব রাজনীতি করত না কিন্তু কলকাতাতে জন্মেছে, স্কুল-কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে। সুতরাং ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, অনেক কিছু দেখেছে। হয়ত গুলিতে মরতে দেখে নি কিন্তু লাঠি বা টিয়ার-গ্যাস বা ইট-পাটকেলের লড়াই নিশ্চয়ই অনেকবার দেখেছে। তাছাড়া খবরের কাগজও পড়ে, ছবি দেখে। সেই সামান্য অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই খোকন সম্পর্কে মেমসাহেব একটু অস্তির না হয়ে পারে নি।

ওয়েস্টার্ন কোটে ফিরে আসার পর আমি মেমসাহেবকে বলেছিলাম, তুমি বরং খোকনকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। এখানে পড়াশুনা করবে। আর আমাকেও একটু-আধটু সাহায্য করবে।

আমার প্রস্তাবে ও আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিল। বলেছিল, সত্যি ওকে পাঠিয়ে দেব?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, দাও।

কিন্তু…

কিন্তু কি?

ক’মাস পরেই তো ওর ফাইন্যাল।

আমি বললাম, ঠিক আছে। পরীক্ষা দেবার পরই পাঠিয়ে দিও, এখানে বি-এ পড়বে। w

মেমসাহেব একটু হাসল, আমাকে একটু জড়িয়ে ধরল। বললে, ততদিনে আমিও তো তোমার কাছে এসে যাব, তাই না?

আমি ওর মাথায় একটু ঝাকুনি দিয়ে একটু আদর করে বললাম, তখন খুব মজা হবে, তাই না?

ও আমার বুকের ’পর মাথা রেখে বললো, সত্যি খুব-মজা হবে।

পর্ব ১৭ শেষ 📌

মেমসাহেব – নিমাই ভট্টাচার্য

🔴পর্ব :১৮🔴

ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দুনিয়ায় আস্তে আস্তে বেশ জল ঘোলা হতে শুরু করল। সীমান্ত নিয়ে মাঝে মাঝেই অস্বস্তিকর খবর ছাপা হতে লাগল পত্র-পত্রিকায়। সঙ্গে সঙ্গে পার্লামেন্টে ঝড় বয়ে যেত–সর্ট নোটিশ, কলিং অ্যাটেনশান, অ্যাডজর্নমেণ্ট মোশান। সরকার আর বিরোধী পক্ষের লড়াই নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। শুধু তাই নয়। কংগ্রেস পার্টির মধ্যেও সরকারী নীতির সমালোচনা শুরু হল গোপনে গোপনে। সরকারী নীতির গোপন সমালোচনার এসব খবর কংগ্রেসীরাই নেমন্তন্ন করে আমাদের পরিবেশন করতেন। তবে সবাইকে নয়, অনেককে। যমুনার জল আরো গড়িয়ে গেল। কংগ্রেস পার্লামেণ্টারী পার্টির সাধারণ সভায় সরকারী নীতির সমালোচনার গুঞ্জন শোনা যেতে লাগল। মাঝে মাঝে। তবে নিয়মিত নয়। সমষ্টিগতভাবেও নয়। পাঁচশ-সাড়ে পাঁচশ জন কংগ্রেসী এম-পির মধ্যে মাত্র দু-চারজন সরকারী নীতির প্রশংসা করতে করতে শেষের দিকে ভুল করে সরকারের সমালোচনা করছিলেন।

রাজনৈতিক দুনিয়ার জল আরো ঘোলা হল। যমুনার জল আরো গড়িয়ে গেল। কংগ্রেস পার্লামেণ্টারী পার্টিতে সরকারী নীতির সমালোচকদের সংখ্যা বাড়ল, সমালোচনা তীক্ষ্ম থেকে তীক্ষ্ণতর হল। মাঝে মাঝে নয়, প্ৰতি মিটিংয়েই সমালোচনা শুরু হল। এখন আর গোপনে নয়, প্ৰকাশ্যে সর্বজনসমক্ষে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে কংগ্রেস পার্লামেণ্টারী পার্টির সেক্রেটারীরা এই সব সমালোচনার খবর দিতেন করসপনডেন্টদের। ভারতবর্ষের প্রতিটি সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় মোটা মোটা বড় বড় হরফে এসব খবর ছাপা হত।

ওদিকে উত্তর সীমান্তের নানা দিক থেকে নানা খবর আসছিল। মাঝে মাঝেই। কখনো নেফার জঙ্গল থেকে, কখনো লাডাকের পাৰ্বত্য মরুভূমি থেকে, কখনো ওয়ালঙ থেকে, কখনো দৌলত-বেগওলডি বা চুণ্ডল, মাগার, ডেমচক থেকে গুলীর আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। ঐসব গুলীর আওয়াজ নিউজ এজেন্সীর টেলিপ্রিন্টার মারফত দিল্লী পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গেই মিস্টার স্পীকার, স্যার-এর টেবিলে জমা হত। কলিং অ্যাটেনশন-অ্যাডজর্নমেণ্ট মোশানের নোটিশ। এয়ার-কণ্ডিসনড লোকসভা চেম্বার রাজনৈতিক উত্তেজনায় দাউ দাউ করে জ্বলত সারা দিন।

ডিফেন্স মিনিস্ট্রি-এক্সটারন্যাল অ্যাফেয়ার্স মিনিষ্টিতেও চাঞ্চল্য বেড়ে গেল অনেক। মিটিং-কনফারেন্স প্রেসনোট-প্রটেস্ট নোটের ঠেলায় আমাদের কাজের চাপ সহস্ৰ গুণ বেড়ে গেল।

তারতবর্ষের ইতিহাসের সে এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। তখন ভারতবর্ষের ইতিহাস আর একবার মোড় ঘুরছিল। আমরা দিল্লীপ্রবাসী, করসপনডেন্টের দল প্ৰতিদিন সেই ইতিহাসের টুকরো টুকরো সংগ্রহ করে পরিবেশন করছিলাম অসংখ্য পাঠক-পাঠিকার জন্য।

এই বাজারে দিল্লীর গুরুত্ব আরো বেশী বেড়ে গেল। এক দল ফরেন করসপনডেন্ট আগেও ছিলেন। কিন্তু এই বাজারে আরো অনেকে এলেন সানফ্রান্সিসকো-নিউইয়র্ক-ওয়াশিংটন-অটোয়া-লগুনপ্যারিস–ব্রাসেলস–মস্কো–প্ৰাগ-কায়রো–করাচী–সিডনি-টোকিও থেকে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকেও আরো অনেক করসপনডেন্ট এলেন দিল্লী। ইউনাইটেড নেশনস-লণ্ডন-প্যারিসমস্কো-কায়রো-টোকিওর সঙ্গে সঙ্গে দিল্লীও পৃথিবীর অন্যতম প্ৰধান নিউজ সেণ্টার হল।

আমার কাগজের ডাইরেক্টর ও সম্পাদক এবার উপলব্ধি করলেন আমাকে শুধু মাইনে দিলেই চলবে না, দিল্লী থেকে গরম গরম খবর পাবার জন্য আরো কিছু করতে হবে। সাধারণত দিল্লীর বিষয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য এতদিন আমাকেই কতাঁরা ডেকে পাঠাতেন। এবার সম্পাদক স্বয়ং দিল্লী এলেন আমার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা করার অছিলায় সম্পাদক সাহেব আরো কয়েকটি অফিস ঘুরে ফিরে তাদের কাজকর্ম ও অফিসের বিধিব্যবস্থা দেখে নিলেন। তারপর আর আমাকে বলতে হল না, নিজেই উপলব্ধি করলেন আমার কাছ থেকে আরো বেশী ও ভাল কাজ পেতে হলে আমাকে অনেক সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।

এডিটর সাহেব নিজেই বললেন, বাচ্চু, সব চাইতে আগে তোমার একটা গাড়ি চাই। গাড়ি ছাড়া এখানে কাজ করা রিয়েলি মুশকিল।

আমি বললাম, এখন প্ৰায় সব করসপনডেন্টদেরই গাড়ি আছে। গাড়ি না হলে ঠিক স্বাধীনভাবে ইচ্ছামত ঘোরাঘুরি করা অসম্ভব।

এডিটর সাহেব বললেন, তাছাড়া আমাদের একটা অফিস দরকার।

শেষে বললেন, তুমি এবার ওয়েস্টার্ন কোর্ট ছেড়ে গ্ৰীন পার্কে চলে যাও। বাড়িতে একটা টেলিফোন নাও। গাড়ি আর টেলিফোন থাকলে বিশেষ কোন অসুবিধা হবে না।

আমি মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললাম, তা ঠিক। তবে ভাবছিলাম। ফাল্গুন মাসের পরেই গ্রীন পার্ক যাব।

কেন তুমি কি ফাল্গুনে বিয়ে করর?

আমি মাথা নীচু করে বললাম, তাইতো ঠিক হয়েছে। দু’টো এসট্যাবলিসমেন্ট মেনটেন করতে অযথা তোমার কিছু খরচ হচ্ছে। যাই হোক এই ক? মাস তাহলে এখানেই থেকে যাও। কিন্তু গেট এ টেলিফোন ইমিডিয়েটলি।

একটু পরে বললেন, আমাদের নিউজ পেপার সোসাইটি বিল্ডিংএ হয়ত একটা ঘর পাব। কিছুকালের মধ্যেই। যতদিন না পাওয়া যায়। ততদিন তুমি একটা পার্ট-টাইম স্টেনো রেখে দাও।

একটা মাস ঘুরতে না ঘুরতেই সত্যি সত্যিই অফিসের পয়সায় আমি একটা গাড়ি কিনলাম। স্ট্যাণ্ডার্ড হেরল্ড! টু-ডোর। টেলিফোনও হল। একশ টাকা দিয়ে এক’জন পার্ট-টাইম মাদ্রাজী স্টেনোও রাখলাম।

ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক চরম সঙ্কটের দিনে আমার ভাগ্যাকাশে এমনভাবে সৌভাগ্যের সুৰ্যোদয়, কোনদিন কল্পনাও করতে পারিনি। দিল্লীর যদি এতটা গুরুত্ব না বাড়ত, যদি কাগজে কাগজে প্ৰতিযোগিতা এত তীব্র না হত, তাহলে আমার ইতিহাসও অন্যরকম হত। কিন্তু বিধাতাপুরুষের নির্দেশ কি ব্যর্থ হতে পারে?

তিলে তিলে বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে অজস্র দিনের পরিশ্রম দিয়ে, অসংখ্য দিনের অনাহার। আর অনিদ্রার বিনিময়ে সেদিন যখন আমি কর্মজীবনে এতবড় স্বীকৃতি, এতবড় মৰ্যাদা, এতবড় সাফল্য অর্জন করলাম, তখন আমি নিজেই চমকে গিয়েছিলাম। কলকাতায় যে আমি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস একবেলা এক আনার ছোলার ছাতু আর দু পয়সায় ভেলী গুড় খেয়ে কাটিয়েছি, যে আমি শুধু এক মুষ্টি অন্ন আর ভদ্রভাবে বাঁচার দাবী নিয়ে কলকাতার পথে পথে ভিখারীর মত অসংখ্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি, সেই আমি গাড়ি চড়ব? বিধাতাপুরুষের কি বিচিত্র খামখেয়ালি! আগে বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু অসংখ্যা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চায়ের পর আজ বিশ্বাস করি এই দুনিয়ায় সবকিছু সম্ভব। ভগবানের আশীৰ্বাদ পেলে পঙ্গু সত্যি সত্যিই গিরি-পৰ্বত–লঙ্ঘন করতে পারে।

দোলাবৌদি, আজ বুঝেছি ভগবান বড় বিচিত্র। কখনো নির্মম, কখনো করুণাময়। তিনি সবাইকে কিছুতেই সবকিছু দেন না। যে কর্মজীবনে সাফল্য অর্জন করবে, বৃহত্তর সমাজে প্ৰতিষ্ঠা পাবে, অগণিত মানুষের হৃদয়ে যার আসন, সে ব্যক্তিগত জীবনে কিছুতেই সুখী হতে পারে না। নিজের জীবনের চরম অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি এই সত্য উপলব্ধি করেছি।

আমার এই মেমসাহেবের কাহিনীর শেষ হতে আর বেশী বাকী নেই। তুমি আর একটু পরেই বুঝবে আমার এই সাফল্য সার্থকতার মধ্যেও বেদনা কোথায়। বুঝবে কেন আমি এত কিছু পেয়েও আজি লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জল ফেলি। বুঝবে এত মানুষের সংস্পর্শে থেকেও কেন আমি নিঃসঙ্গ। আর একটু জানলেই বুঝবে কেন আমি ক্লান্ত।

যাই হোক ভারতবর্ষের বিচিত্র রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আমার সম্পাদকের দয়ায় আমার এই অভাবনীয় সাফল্যের পর মেমসাহেবকে লিখলাম, তুমি কি কোনদিন তন্ত্রসাধনা করেছিলে? তুমি যদি জ্যোতিষী হতে তাহলে আমার সাহায্য ও সহযোগিতা। ছাড়া তোমার পক্ষে আমার ভূত-ভবিষ্যৎ জানা সম্ভব ছিল না। একমাত্র তন্ত্রসাধনা করলেই কিছু না জেনেও অপরের ভবিষ্যৎ বলা যায়। আমার সম্পর্কে তুমি যা যা বলেছিলে, যা যা আশা করেছিলে তার প্রায় সবই তো সত্য হয়ে গেল। তাই আজ আমার মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে, তুমি হয়ত তন্ত্রসাধনা করেছ।

গজানন রোজ গাড়িটাকে দু-দুবার করে পরিষ্কার করে। ড্রাইভারের গাড়ি চালান ওর একটুও পছন্দ ছিল না। বলত, না, না, ছোটোসাব, ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে দেবেন না। ওরা যা তা করে গাড়ি চালায়। আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর রাখতে হবে, কোনদিন ভাবিনি। তাই গাড়ি চালান আগে শিখিনি। তোমাকে নিয়ে এই গাড়িতে ঘুরে বেড়াবার আগে নিশ্চয়ই ড্রাইভিং শিখতাম, না। কিন্তু গজানন রাজী হল না। বাধ্য হয়েই আমি গাড়ি চালাচ্ছি। কিন্তু তবুও পিছনে বসে বসে গজানন আমাকে বলে, ছোটোসাব, আস্তে আস্তে গিয়ার দাও।

পরশু দিন সন্ধ্যাবেলায় গ্রীন পার্কে তোমার বাড়িতে গিয়েছিলাম। কথায় কথায় গজানন হতচ্ছাড়া কি বলল জান? বলল, বিবিজির কিসমৎ খুব ভাল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেন রে? ও বলল, বিবিজির কিসমৎ-এর জন্যই তো আপনার সবকিছু হচ্ছে। আমি ওকে দাবড় দিয়ে বললাম, বাজে বকিস না। হতচ্ছাড়া বলল, ছোটোসাব, বিবিজি না থাকলে তোমার কিছুই হত না। ওর কথাটা আমার ভালই লেগেছিল। কিন্তু মুখে বললাম, তুই তোর বিবিজির কাছে যা, আমার কাছে থাকতে হবে না।

ভাল কথা, সেদিন তোমার কলেজে ট্রাঙ্ককল করলে তুমি ঐ রকম চমকে উঠলে কেন? তুমি যত অস্বস্তি বোধ করছিলে আমার তত মজা লাগছিল। ঠিক করেছি। প্ৰতি সপ্তাহেই তোমাকে ট্রাঙ্ককল করব।

শেষে কি লিখেছিলাম জান দোলাবৌদি? লিখেছিলাম, ফাঙ্কন মাস তো প্ৰায় এসে গেল। এবার বল বিয়েতে তোমার কি চাই? লজ্জা কর না। তোমার যা ইচ্ছা, আমাকে লিখো। আমি নিশ্চয়ই তোমার আশা পূর্ণ করব।

মেমসাহেব লিখল, তোমার প্রত্যেকটা চিঠির মত এই চিঠিটাও অনেকবার পড়লাম। পড়তে ভারী মজা লাগল। তোমার এডিটর যে এমন অপ্ৰত্যাশিতভাবে আমাদের স্বপ্ন বাস্তব করে তুলবেন, আমি সত্যি ভাবতে পারিনি। ভগবানকে শত-কোটি প্ৰণাম না। জানিয়ে পারছি না। তারই ইচ্ছায় সবকিছু হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। ইঙ্গিত দেখে মনে হয়। ভগবান নিশ্চয়ই আমাদের সুখী করবেন।

তুমি আমার গাড়ি নিয়ে খুব মজা করে ঘুরে বেড়াচ্ছ। ভাবতেও আমার হিংসা হচ্ছে। আমার ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছে, তুমি গাড়ি চালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। তুমি যখন গাড়ি চালাও তখন তোমাকে দেখতে নিশ্চয়ই খুব ভাল লাগে। খুব স্মার্ট? খুব স্থাপ্তিসাম?–খুব সাবধানে গাড়ি চালাবে। তোমাদের দিল্লীতে বড় বেশী অ্যাকসিডেন্ট হয়। তুমি গাড়ি চালােচ্ছ জানার পর আর একটা নতুন চিন্তা বাড়ল। সব সময় মনে রেখে আজ আর তুমি একলা নও। মনে রেখে তোমার জীবনের সঙ্গে আমার জীবনও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। সুতরাং তোমার ক্ষতি হওয়া মানে আমারও সর্বনাশ! ভুলে যেও না যেন, কেমন?

আচ্ছা সেদিন তুমি হঠাৎ ট্রাঙ্ককল করলে কেন বলত? কলেজের অফিসে তখন লোকজনে ভর্তি ছিল। প্ৰথমে প্রিন্সিপ্যালই টেলিফোন ধরেন। তারপর যেই শুনলেন দিল্লী থেকে আমার ট্রাঙ্ককল এসেছে তখন তার আর বুঝতে বাকি রইল না যে তুমিই ট্রাঙ্ককাল করছি। কারণ তোমার সঙ্গে যে আমার বিয়ে হবে, একথা কলেজের সবাই জানেন। প্রিন্সিপ্যালও শুনেছেন। তাছাড়া বেরুটি থেকে কেনা জার্মান ফোলডিং ছাতাটা দু-একদিন ব্যবহার করায় উনি একথাও জানতে পেরেছেন যে তুমিই এনে দিয়েছ। তাই তো প্রিন্সিপ্যাল লাইনটা অফিসে দিয়েছিলেন এই ভেবে যে, আমি ওঁর সামনে তোমার সঙ্গে ঠিকমত কথা বলতে পারব না। কিন্তু কলেজের অফিস কি ফাঁকা থাকে? আমি তোমার কোন কথারই জবাব দিতে পারছিলাম না। তাছাড়া ওসব কি যা তা প্রশ্ন করছিলে? কলেজের অফিসে বসে বসে ঐসব প্রশ্নের জবাব দেওয়া যায়? তাছাড়া আমার এই সব একান্ত ব্যক্তিগত ও গোপনীয় খবর জানার যদি এতই গরজ হয়, তাহলে একবার চলে এসে। আসবে দু-এক দিনের জন্য? এলে খুব খুশি হব।

বিয়ের সময় তুমি আমাকে কিছু উপহার দিতে চেয়েছ। শাড়িগহনার কথা বলছ? ওসব কিছু আমার চাই না। আজ আমার শুধু একটাই কামনা–সে কামনা তোমাকে পাওয়ার। মন-প্ৰাণ দিয়ে তোমাকে আমি পেতে চাই। তাহলেই আমি খুশি। স্ত্রী হয়ে আর কি কামনা, আর কি প্ৰত্যাশা থাকতে পারে? সত্যি বলছি তুমি আমাকে কিছু উপহার দিও না। আমি শুধু তোমাকেই উপহার চাই। দেবে তো?

মেজদি থাকতে ওকে ম্যানেজ করে নানা রকম ধোকা দিয়ে তোমার কাছে গেছি কবার। এখন আর তা সম্ভব নয়। তাই বলছিলাম তুমি যদি আসতে। তবে ভাল হত। তোমাকে না দেখে আমি থাকতে পারি না। তুমি কি আমার সে কষ্ট উপলব্ধি করতে পার? যদি পাের। তবে দয়া করে অন্তত একটি দিনের জন্য দেখা দিয়ে যেও।

ভাল কথা, মেজদির বাচ্চা হবে। এইত কমাস আগে বিয়ে হলো! এরই মধ্যেই বাচ্চা? না জানি আমার অদৃষ্ট কি আছে?

মেমসাহেবের এই চিঠির উত্তর তো পোস্টকার্ডে দেওয়া যায় না। কর্মব্যস্ততার জন্য তাই কদিন চিঠি দিতে পারিনি। তাছাড়া কদিনের জন্য সৌরাষ্ট্র গিয়েছিলাম। এমনি করে উত্তর দিতে বেশ দেরী হয়ে গেল। ইতিমধ্যে মেমসাহেবের আবার একটা চিঠি পেলাম। জানলাম, ইতিমধ্যে একদিন ভোর পাঁচটার সময় পুলিস এসে খোকনদের ফ্ল্যাট সার্চ করে গেছে। খোকনকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিল। বিকেলবেলা ছেড়ে দিয়েছিল।

কলকাতার কাগজগুলো পড়ে বেশ বুঝতে পারছিলাম। বাংলা দেশের রাজনৈতিক আকাশের ঈশান কোণে ঘন কালো মেঘা জমতে শুরু করেছে। দামামা আবার বেজে উঠবে। সভা-সমিতির পালা এবার শেষ হবে, শুরু হবে মিছিল, বিক্ষোভ, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ। তারপর লাঠি, কাঁদুনে গ্যাস, গুলী। আবার বিক্ষোত, আবার মিছিল হবে। আবার চলবে লাঠি, গুলী। কিছু মানুষ হারাবে তাদের প্ৰিয়জনকে। তার কাঁদবে, সারা জীবন ধরে কাঁদবে।

খোকন যে বেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে, সেকথা বুঝতে আমার কষ্ট হল না। এ নেশার ঘোর ওর এখন কাটবে না। কিছু খেসারৎ না দিলে এ নেশা। কাটে না। অনেকের কোন কালেই কাটে না। খোকনেরও কাটবে। কিনা ঠিক নেই।

মেমসাহেব অবশ্য ভাবছিল আমি কলকাতা গিয়ে খোকনকে বুঝিয়ে-সুবিয়ে একটা কিছু করি। কিন্তু কি করব? কি বোঝাব ‘ খোকনকে? বোঝাতে চাইলেই কি সে বুঝবে? আমারও মেমসাহেবকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছিল। ভেবেছিলাম দু-তিন দিনের জন্য ঘুরে আসব। কিন্তু মেমসাহেবের পরের চিঠিতে খোকনের খবর পাবার পর ঠিক করলাম, না যাব না। মেমসাহেবকে লিখে দিলাম, সত্যি ভাষণ ব্যস্ত। এখন কোনমতেই যেতে পারছি না। যদি এর মধ্যে সময় পাই তাহলে নিশ্চয়ই তোমাকে দেখে আসব। শেষে লিখলাম রাজনীতি অনেকেই করে, খোকনও করছে। তার জন্য অত চিন্তা বা ঘাবড়াবার কি কারণ আছে? তাছাড়া খোকন তো আর শিশু নয়। সুতরাং তুমি অত ভাববে না।

খোকন সম্পর্কে আমার এই ধরনের মন্তব্য মেমসাহেব ঠিক পছন্দ করত না, তা আমি জানতাম। কিন্তু কি করব? আমি স্থির জানতাম খোকন আমার কথা শুনবে না। মেমসাহেবের কথাও তার পক্ষে শোনা তখন সম্ভব ছিল না। সুতরাং আমি আর কি লিখব?

আমার চিঠি পাবার সঙ্গে সঙ্গেই মেমসাহেব উত্তর দিল, যে কোন কারণেই হোক তুমি খোকন সম্পর্কে বেশ উদাসীন। হয়ত ওকে ঠিক পছন্দ করো না। জানি না কি ব্যাপার। তোমার সঙ্গে এ বিষয়ে তর্ক করব না। তবে জেনে রাখা খোকন সম্পর্কে আমার ও আমাদের পরিবারের ভীষণ দুর্বলতা।

আমি সত্যি কোন তর্ক করিনি। তর্ক করব কেন? মানুষের স্নেহ-ভালবাসা নিয়ে কি তর্ক করা উচিত? কখনই নয়। তাছাড়া যুক্তি-তর্ক ন্যায়-অন্যায় বাচ-বিচার করে কি মানুষ তালবাসতে পারে? না। তা আমি জানি। সুতরাং এই বিষয়ে মেমসাহেবকে কিছু না লিখে এবার খোকনকেই একটা চিঠি দিলাম। লিখলাম, তোমার মত ভাগ্যবান ছেলে এই পৃথিবীতে খুব কম পাওয়া যাবে। তার কারণ এই পৃথিবীটা বড় নিষ্ঠুর, বড় কৃপণ। আপনজনের কাছ থেকেই ভালবাসা পাওয়া এই পৃথিবীতে একটা দুর্লভ ব্যাপার। সুতরাং অন্যের কাছ থেকে স্নেহভালবাসা সত্যি সৌভাগ্যের কথা। তুমি সেই অনন্য ভাগ্যশালীদের অন্যতম। অনেক সুখ, অনেক আনন্দ ত্যাগ করে, অনেক কষ্ট, অনেক দুঃখ সহ্য করে, অনেক আত্মত্যাগ স্বীকার করে তোমার বড়মা ও দিদিরা তোমাকে মানুষ। করেছেন। তোমাকে নিয়ে ওঁদের অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন। তোমার গায় একটু আঁচড় লাগলে ওদের পাজরার একটা হাড় ভেঙে যায়। হয়ত এতটা স্নেহ-ভালবাসার কোন অর্থ হয় না। কিন্তু তুমি তো জান ভাই এই স্নেহ-ভালবাসা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। তোমার বড়মা ও দিদিদেরও তাই অন্ধ করে দিয়েছে। তুমি ওদের এই অমূল্য স্নেহ-ভালবাসার অমর্যাদা কোনদিন করবে না, তা আমি জানি। কিন্তু তোমার জন্য আজকাল ওঁরা বড় চিন্তিত, বড় উদ্বিগ্ন। তুমি কি এর থেকে ওঁদের মুক্তি দিতে পার না? আমার মনে হয় তুমি ইচ্ছা করলেই পার। যাঁরা তোমার জন্য দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর রাত্রি জেগে কাটিয়েছেন, যাঁরা তোমার কল্যাণে ব্ৰত-উপবাস করেছেন, কালীঘাটে পূজা দিয়েছেন, তারকেশ্বরে ছুটে গিয়েছেন, তুমি কি তাদের উৎকণ্ঠ দূর করতে পার না? পার না। ওঁদের চোখের জল বন্ধ করতে? একটু স্থির হয়ে ভেবে দেখা।

আমি এক’জন সাংবাদিক হয়ে তোমাকে রাজনীতি করতে মানা করব না। তবে আগে লেখাপড়াটা শেষ করলে ভাল হয় না? লেখাপড়া শিখে সমাজের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে দশজনের এক’জন হয়ে রাজনীতি করা ভাল না? রাজনীতি নিশ্চয়ই করবে, একশবার করবে। স্বাধীন দেশের নাগরিকরা নিশ্চয়ই রাজনীতি করবে। কিন্তু তার আগে নিজে প্ৰস্তুত হও, তৈরী হও, উপযুক্ত হও।

তোমার ফাইন্যাল পরীক্ষা এসে গেছে। তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। একটু মন দিয়ে লেখাপড়া করলেই চমৎকার রেজাল্ট করবে। তুমি তো জান তোমার বড়মার শরীর ভাল না, ছোড়দিও বড় একলা। ওঁদের একটু দেখো। আর ভুলে যেও না তোমার বাবার কথা যিনি শুধু তোমারই মুখ চেয়ে উদয়-অস্ত পরিশ্রম করছেন। একটু তাড়াতাড়ি মানুষ হয়ে ঐ বৃদ্ধ মানুষটাকে একটু শান্তি দেবার চেষ্টা করো।

শেষে জানালাম, এ চিঠির উত্তর না দিলেও চলবে। তোমার বক্তব্য তোমার ছোড়দিকে জানিও। সেই আমাকে সবকিছু জানাবে। আর হ্যাঁ, তুমি যদি চাও তাহলে দিল্লী আসতে পাের। যেদিন ইচ্ছা সেদিনই এসে। এবং এখানে এলে তোমার পড়াশুনা ভালই হবে। তাছাড়া আমিও তোমার সাহচৰ্য পেতাম।

এই চিঠি লেখার পরই আমি আবার বাইরে গেলাম। উত্তরপ্রদেশ কংগ্রেসের ঘরোয় কোন্দল প্ৰায় চরমে উঠেছিল। প্ৰদেশ কংগ্রেস কমিটির নির্বাচন নিয়ে দুই দলে প্ৰায় কুরুক্ষেত্রের লড়াই শুরু করেছিলেন। এডিটরের নির্দেশে সেই কুরুক্ষেত্রের লড়াই কভার করতে আমি লক্ষ্মেী চলে গেলাম। যাবার আগে মেমসাহেবকে জানাতে পারিনি। লক্ষ্মেী পৌঁছেও প্ৰথম দুদিন সময় পাইনি। তার পরদিন ওকে জানালাম যে, আমি দিল্লীতে নেই, লক্ষ্মৌ এসেছি।

এক সপ্তাহ লক্ষ্মৌ থাকায় পর লক্ষ্মেীবাসী এক সাংবাদিক বন্ধু ও এক’জন এম-পির পাল্লায় পড়ে দিল্লী আসার পরিবর্তে চলে গেলাম নৈনীতাল। ঠিক ছিল দুদিন থাকব। কিন্তু ওদের পাল্লায় দিল্লী ফিরলাম এক সপ্তাহ পরে।

দিল্লী ফিরে অনেকগুলো চিঠি পেলাম। মেজদির চিঠিতে জানলাম ন্যাতাল অফিসার কোচিনে বদলী হয়েছেন। ওখানে এখন কোয়ার্টার পাওয়া যাবে না। তাই মেজদি কলকাতা যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে কোয়ার্টার পেলেও কোচিন যাবেন না, একেবারে আমাদের বিয়ে দেখে তবে ফিরবেন। মনে মনে ভাবলাম চমৎকার। আমি মেজদিকে লিখলাম, ছি, ছি, আত তাড়াতাড়ি কেউ কো-চিন যায়? আরো এই আকশাই চীনের বাজারে? একেবারে খোকনকে পেরাম্বুলেটারে চড়িয়ে বঙ্গোপসাগরের ধার দিয়ে বেড়াতে বেড়াতে ভুবনেশ্বরে চা খেয়ে, কোনারকে কফি খেয়ে, ওয়ালটেয়ারএ কাজু খেয়ে, মাদ্রাজে দোস খেয়ে, কন্যাকুমারিকায় ভারত মহাসাগরের জলে সাঁতার কেটে, ত্ৰিবান্দ্ৰমে নারকেল খেয়ে কো-চিন যাবেন। কেমন? দরকার হয় আমিই পেরাস্কুলেটার দেব। কারণ পরে ওটা তো আমাদেরও কাজে লাগবে, তাই না?

খোকনকে চিঠি লেখার জন্য মেমসাহেব খুব খুশি হয়েছিল। এ-কথাও জানিয়েছিল যে খোকনের একটু পরিবর্তন দেখা দিয়েছে।

এবার ঠিক করলাম দুতিন দিনের জন্য কলকাতা যাব। এডিটরকে চিঠি লিখে এক সপ্তাহের ছুটি নিলাম। কলকাতা যাবার কথা মেমসাহেবকে কিছু লিখলাম না। মেজদিকে লিখলাম, কতকাল আপনাকে দেখিনি। মনে হচ্ছে যেন কত যুগে আগে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমি আপনাকে না দেখে আর থাকতে পারছি না। কাজকর্মে মন বসছে না। রিপোর্ট লিখতে গিয়ে বার বার ভুল করছি। মুখে কিছু ভাল লাগছে না। এমন কি মধুবালা-সোফিয়া লরেনের ফিল্ম দেখতেও ইচ্ছা করছে না। আমাকে মাপ করবেন, তাই আমি আগামী সোমবার সকালে দিল্লী মেলে কলকাতা যাচ্ছি। আপনাকে দেখার জন্য।

পর্ব ১৮ শেষ 📌

🔴পর্ব :১৯🔴

সেবারের কলকাতা যাওয়া আমি জীবনে কোনদিন ভুলতে পারব না। না, না, কোনদিন ভুলব না। সেবারের কলকাতার স্মৃতি আমার জীবনের সব চাইতে মূল্যবান স্মৃতি। আজ আমার পার্থিব সম্পদ অনেক ভবিষ্যতে হয়ত আরো হবে। লক্ষ লক্ষ মানুষের সঙ্গে আজ আমার পরিচয়। কত ভি-আই-পি-র সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি দেশ-দেশান্তর। তাদের কত মিষ্টি, ক’ত সুন্দর, কত চমকপ্ৰদ স্মৃতি আমার মনের সেফ ডিপোজিট ভলটে জমা আছে। কিন্তু সেবারের কলকাতা যাওয়ার স্মৃতির সঙ্গে অন্য কোন স্মৃতির তুলনাই হয় না। একদিন হয়ত আমার সবকিছু হারিয়ে যাবে, হয়ত আমি অতীত দিনের মত একমুষ্টি অন্নের জন্য, একটা লেখা ছাপিয়ে দশটা টাকা পাবার জন্য আবার কলকাতার রাজপথে ঘুরে বেড়াব। হারাবে না শুধু আমার স্মৃতি, মেমসাহেবের স্মৃতি, সেবারের কলকাতার স্মৃতি।

হাওড়া স্টেশনে মেজদি এসেছিলেন। মেমসাহেবকে না দেখে আমি একটু অবাক হলাম। মেজদিকে কিছু বললাম না। শুধু এদিকে-ওদিকে চাইছিলাম। ভাবছিলাম বোধহয় লুকিয়ে আছে। একটু মুচকি হেসে মেজদি বললেন, এদিক-ওদিক দেখে লাভ নেই। ও আসে নি।

আমি একটু জোরে হেসে বললাম, আরে না, না। ওকে কে খুঁজছে? আমার এক বন্ধুর আসার কথা ছিল। তাই দেখছি এসেছে কিনা।

মেজদি একটু দুষ্ট হাসি হেসে বললে, ও আই সী।

প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্যাকসি-স্ট্যাণ্ডে যাবার পথে মেজদি বললেন, আজ রাত্তিরে আপনি আমাদের ওখানে খাবেন।

আমি থমকে দাঁড়িয়ে বললাম, সে কি?

মা’র হুকুম।

রিয়েলি?

তবে কি আমি আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করছি?

মেমসাহেব সেদিন সত্যি স্টেশনে আসে নি; চীফ অফ প্ৰোটোকল হয়ে মেজদি এসেছিলেন আমাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। মেমসাহেবকে না দেখে মনে মনে একটু হতাশাবোধ করলেও আমার সামাজিক মৰ্যাদায় বেশ গর্ববোধ করেছিলাম।

রাত্রে নেমন্তান্ন খেতে গিয়েছিলাম। মেমসাহেবের দেওয়া ধুতি পাঞ্জাবী পরে সত্যি প্ৰায় জামাই সেজে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম। মেমসাহেব আমারই অপেক্ষায় বসেছিল ড্রইংরুমে। কিন্তু যেই আমি বাজার বাজালাম, ও সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বললো, মেজদি। দেখত, কে এসেছে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ওর কথা শুনতে পেলাম। এমন একটা ভাব দেখােল যেন ওর কোন গরজ নেই। আসল কথা লজ্জা করছিল।

মেজদি দরজা খুলেই চিৎকার করলেন, মা! তোমার ছোট জামাই এসেছেন।

ভিতর থেকে মেমসাহেবের মার গলা শুনতে পেলাম, আঃ চিৎকার কারিস না।

মেজদি ঘর ছেড়ে ভিতরে যাবার সময় হুকুম করে গেলেন, চুপটি করে বসুন। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলার প্রয়োজন নেই, এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

মেজদির বিদায়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মেমসাহেব এলো। একটু এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আমি ওর হাত ধরে পাশ থেকে সামনে নিয়ে এলাম। তারপর দু’হাত দিয়ে ওর কোমরটা জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে আলতো করে মাথাটা রাখলাম।

ও আমায় মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, আঃ ছেড়ে দাও। কেউ এসে পড়বে।

আমি ওর কথার কোন জবাব দিলাম না। আমনি করেই ওকে জড়িয়ে ধরে রইলাম।

ও আস্তে আস্তে আমার হাতদু’টো ছাড়িয়ে দিতে দিতে বললো, লক্ষ্মীটি ছেড়ে দাও, কেউ দেখে ফেলবে।

আমি এবার ওর হাতদু’টো ধরে মুখের দিকে চাইলাম। বললাম দেখুক না। কি হয়েছে?

ও একটা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমার মুখে, কপালে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, কেমন আছ?

ভাল।

একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কেমন আছ?

ভাল না।

কেন।

কেন আবার? আমার আর একলা একলা থাকতে একটুও ভাল লাগছে না।

আমি ওর ফোলা ফোলা গালদু’টো একটু টিপে ধরে বললাম, এইত এসে গেছে। আর তো দুমাসও বাকি নেই।

সেদিন রাত্রে মেমসাহেবের মা সত্যি জামাই-আদর করে খাওয়ালেন। ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে অত আদর-যত্ন পাওয়া কোনদিন অত্যাস নেই। অত ভালমন্দ খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাসও কোনদিন ছিল না। আমি কোনটা খেলাম, কোনটা খেলাম না।

খাওয়া-দাওয়ার শেষে ডুইংরুমে বসে বসে মেজদি আর মেমসাহেবের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। শেষে মেমসাহেবের মাকে প্ৰণাম করে বিদায় নেবার সময় উনি আমার হাতে একটা পাথর সেটকরা আংটি পরিয়ে দিলেন। আমি বললাম, একি করছেন?

বিয়ের আগে তো আর তুমি আসছ না। আশীৰ্বাদ তো বিয়ের আসরেই হবে। তাই এটা থাক।

আমি আবার আপত্তি করলাম। উনি বললেন, মায়ের আশীৰ্বাদ না করতে নেই।

আমি আপত্তি করলাম না।

পরের দিন মেমসাহেব আর আমি দক্ষিণেশ্বর গিয়েছিলাম। সন্ধ্যার পর আরতি দেখে নৌকায় চড়ে গিয়েছিলাম বেলুড়। পৌষ মাসের সন্ধ্যায় মিষ্টি ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিল গঙ্গার পর দিয়ে। মেমসাহেব আমার পাশ-ঘেষে বসে আমার কাঁধে মাথা রাখল।

সেদিন সন্ধ্যায় বিশেষ কথাবার্তা হয় নি আমাদের। আনন্দতৃপ্তিতে দুজনেরই মনটা পূর্ণ হয়েছিল। বেশী কথাবার্তা বলতে কারুরই মন চায় নি।

মেমসাহেব জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি আর এর মধ্যে কলকাতা আসবে না?

না।

একেবারে সেই বিয়ের সময়?

হ্যাঁ।

একটু পরে আবার বলেছিল, বিয়ের পর তুমি কিন্তু আমাকে তোমার মনের মতন করে গড়ে নিও। আমি যেন তোমার সব প্ৰয়োজন মেটাতে পারি।

আমার সব প্রয়োজনের কথাই তো তুমি জান। তাছাড়া তুমিই তো আমাকে গড়ে তুলেছি। সুতরাং আমি আর তোমাকে কি গড়ে তুলিব?

আমি তো নিমিত্ত মাত্ৰ। তোমার নিজের মধ্যে গুণ ছিল বলেই তুমি জীবনে দাঁড়াতে পেরেছ। গুণ না থাকলে কি কেউ কাউকে কিছু করতে পারে?

আমি বললাম, পারে বৈকি মেমসাহেব। শুধু ইট-কাঠ-সিমেন্ট হলেই তো একটা সুন্দর বাড়ি হয় না। আর্কিটেকট চাই, ইঞ্জিনীয়ার চাই, মিস্ত্রী চাই। সোনার তালের দাম থাকতে পারে। কিন্তু তার সৌন্দৰ্য নেই। স্বর্ণকারের হাতে সেই সোনা পড়লে কত সুন্দর সুন্দর গহনা হয়।

ওর মুখের পর মুখ রেখে বললাম, মেমসাহেব, তুমি আমার সেই আর্কিটেকট, ইঞ্জিনীয়ার, শিল্পী।

ও আমার এসব কথার জবাব না দিয়ে বললো, তুমি আমাকে বড্ড বেশী ভালবাস। তাইতো তুমি আমাকে অকৃপণভাবে মৰ্যাদা দিতে চাও। মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে বললো, তাই না?

তোমার মত আমি তো ইউনিভার্সিটিতে পড়িনি। মনুষ্যচরিত্রের অতশত বিশ্লেষণ করতে আমি শিখিনি।

মেমসাহেব এবার যেন একটু অভিমান করে বললো, ওসব আজেবাজে কথা বলবে না তো! হাজার হোক তুমি আমার স্বামী। আর তাছাড়া এম-এ পড়লেই কি সবাই পণ্ডিত হয়ে যায়? ও নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দিল, মোটেই না। তোমার জ্ঞান, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতার কাছে আমি কি দাঁড়াতে পারি?

দোলাবৌদি, মেমসাহেব শুধু আমাকে ভালবাসত না, শ্রদ্ধা করত, ভক্তি করত। সোনায় যেমন একটু পান মিশিয়ে না নিলে গহনা মজবুত হয় না, সেইরকম ভালবাসার সঙ্গে একটু শ্ৰদ্ধা, ভক্তি না মিশলে সে ভালবাসাও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। মেমসাহেব আজ অনেক-অনেক দূরে চলে গেছে। কিন্তু যত দূরেই যাক, যেখানেই থাকুক, আমি নিশ্চিত জানি সে আজও আমাকে ভুলতে পারে নি। আমি জানি, সে আজও আমাকে ভালবাসে। প্রতিটি দিনের প্রতিটি মুহুর্তের স্মৃতি আজও তার মনে আছে।

কলকাতায় আরো কদিন ছিলাম। এবার সবাইকে বলে দিলাম, আসছে ফাঙ্কনে মেমসাহেবের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে। কেউ অবাক হলো, কেউ কেউ আবার বললো, আমরা আগেই জানতাম। আমি কারুর কোন মন্তব্য গ্ৰাহ্য করলাম না। গ্ৰাহ করব। কেন? তোমরা কি কেউ আমাকে ভালবেসেছ? কেউ কি আমার বিপদের দিনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছ? কেউ তো একটা পয়সা দিয়ে বা এক কাপ চা খাইয়ে উপকার কর নি। সুতরাং তোমাদের আমি থোড়াই কেয়ার করি। যখন যেখানে যার সঙ্গে দেখা হয়েছে তাকেই বলেছি, আমার বিয়ে। মেমসাহেবের সঙ্গে। কবে? এইত এই ফাল্গুনেই। বহুজনকে নেমস্তন্নও করেছিলাম, আসতে হবে কিন্তু। বন্ধুবান্ধবদের বললাম, এবার যদি তোরা দিল্লী না আসিস তবে ফাটাফাটি হয়ে যাবে।

বিয়ের আগে আর কলকাতা আসা হবে না ভেবে বিয়ের কিছু কাজও করলাম। কলকাতায়। দিল্লীতে ভাল পাঞ্জাবী তৈরী হয় না; ভবানীপুরের একটা দোকান থেকে তিন গজ ভাল সিল্কের কাপড় কিনে শ্যামবাজারে মণ্টুবাবুর দোকানেপাঞ্জাবী তৈরী করতে দিলাম। দিল্লীতে ভাল বাংলা কার্ড পাওয়া যায় না; সুতরাং কয়েকশ কার্ড কিনলাম। আর? আর কিনেছিলাম সিন্ধ হাউস দোকান থেকে মেমসাহেবের জন্য দু’টো বেনারসী শাড়ি। দিল্লীতে বেনারসী পাওয়া যায় কিন্তু বড্ড বেশী দাম। তাছাড়া ঠিক রুচিসম্মত পাওয়া প্ৰায় অসম্ভব। শাড়ি দু’টো কেনার সময় মেমসাহেবকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম পছন্দ করবার জন্য। স্কাই কলারের বেনারসীটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল, ওরও খুব ভাল লেগেছিল। কিন্তু বার বার বলেছিল, কেন এত দামী শাড়ি কিনছ?

আমি বলেছিলাম, এর চাইতে কম দামের শাড়িতে তোমাকে মানাবে না।

ও ভ্রূ কুঁচকে একটু হাসতে হাসতে বলেছিল, তাই নাকি?

তবে কি?

শাড়ি কিনে দোকান থেকে বেরুবার সময় মেমসাহেব বললো, তুমি আমার দেওয়া ধুতি-পাঞ্জাবী পরে বিয়ে করতে আসবে।

সেকি? আমি তো কাপড় কিনে পাঞ্জাবী তৈরী করতে দিয়ে দিয়েছি।

তা হোক। তুমি আমার দেওয়া ধুতি-পাঞ্জাবী পরে বিয়ে করবে।

সেন্টাল এভিন্যুর খাদি গ্রামোদ্যোগ থেকে মেমসাহেব আমার পাঞ্জাবীর কাপড় কিনে বললো, চল এবার ধুতিটা কিনতে যাই।

ধুতি কিনতে গিয়ে আমি ওর কানে কানে ফিসফিস করে বললাম, প্লেন পাড় দেবে, না, জরি পাড় দেবে?

আগে কতবার জরি পাড় ধুতি চেয়েছি পাই নি। এবার পেলাম। একটা নয়, একজোড়া।

আমি জানতে চাইলাম, একজোড়া ধুতি পরে বিয়ে করতে যাব?

অসভ্যতা করে না। একটু থেমে বললো, তোমার তো মোটে দু’টো ধুতি। তাই একজোড়াই থাক।

ধুতি কিনে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি তো আমার বিয়ের কাপড় দিলে, ফুলশয্যার জন্য তো কিছু দিলে না?

ও আমার কথার জবাব না দিয়ে বললো, সেদিন যে তুমি কি করবে, তা ভাবতেই আমার গায় জ্বর আসছে।

তাই নাকি? একটু থেমে আবার বললাম, বেশ, তাহলে শুধু বিয়েই হোক, ফুলশয্যার আর দরকার নেই।

ও একটু বাঁকা চোখে হাসি হাসি মুখে বললো, ভূতের মুখে রাম नांभ?

কলকাতায় এমনি করে। কটা দিন বেশ কেটে গেল। আমার কলকাতা বাসের মেয়াদ শেষ হলো। দেহটাকে আবার চাপিয়ে দিলাম দিল্লী মেলের কামরায়। মন? সে পড়ে রইল। কলকাতায়। মেমসাহেবের কাছে।

দিল্লীতে ফিরে এসে আবার বেশ কাজকর্মের চাপ পড়ল। দশ-বারে দিন প্ৰায় নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ পেলাম না। সমাগত কংগ্রেস অধিবেশনের জন্য কংগ্রেস পাটিতে দলাদলি চরম পর্যায়ে পৌঁছল। কংগ্রেসের ঘরোয় বিবাদ যত তীব্র থেকে তীব্রতর হলো, আমাদের কাজের চাপও তত বেশী বাড়ল।

এদিকে কলকাতার কাগজ পড়ে বেশ বুঝতে পারছিলাম অবস্থা সুবিধার নয়। গণ্ডগোল শুরু হলো বলে।

মাদ্রাজে কংগ্রেস অধিবেশন কভার করতে গিয়েই খবর পেলাম, কলকাতায় গুলী চলেছে। দুজন মারা গেছে। বাংলাদেশে, বিশেষ করে কলকাতা শহরে এই ধরনের রাজনৈতিক নাটক প্রায়ই অভিনীত হয়।

দিল্লী ফিরে এসে খবর পেলাম ডুয়ার্সে, কৃষ্ণনগরে, দুর্গাপুরে, আর বসিরহাটেও গুলী চলেছে। কিছু আহত কিছু নিহত হয়েছে। বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। না জানি খোকন আবার কি করে। গতবার কলকাতায় গিয়ে তো কত বুঝিয়ে এলাম। কিন্তু সন্দেহ হলো ওসব কিছুই হয়ত ওর কানে ঢোকে নি। উপদেশ আর পরামর্শ দিয়ে যদি কাজ হতো তাহলে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে বিদ্যাসাগরবিবেকানন্দ-নেতাজীকে পাওয়া যেত।

ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের শান্ত হিমালয় সীমান্ত আরো অশান্ত হয়ে উঠেছিল। সীমান্ত নিয়ে অনেক আজগুবী কাহিনী ছাপা হচ্ছিল নানা পত্র-পত্রিকায়। স্বাভাবিক ভাবেই সরকার উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন এসব খবরে। তাছাড়া পার্লামেন্টের বাজেট অধিবেশন এসে গিয়েছিল। . এই সময় এই ধরনের খবর নিয়মিত ছাপা হলে পার্লামেণ্টে অযথা ঝড় বয়ে যাবে। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর সরকার একদল জার্নালিস্টকে লাডাকে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমি হেড কোয়ার্টার্সের ঠিক মত ছিল না; কারণ, এই তীব্র ঠাণ্ডায় জার্নালিস্টদের লাডাকে নিতে হলে অনেক ঝঞ্চাট। কিন্তু শেষপৰ্যন্ত তাঁরাও রাজী হলেন। দশজন দেশী-বিদেশী সাংবাদিক দলে আমিও স্থান পেলাম।

এক সপ্তাহের প্রোগ্রাম। মেমসাহেবকে জানালাম, এক সপ্তাহের জন্য লাডাক যাচ্ছি। আমরা হওনা হবে ২রা ফেব্রুয়ারী। এখান থেকে জম্মু যাব। সেখান থেকে উধমপুর, কোর কমাণ্ডারের হেড কোয়ার্টার্স। একদিন উধমপুর থেকে যাব লোতে। সেখানে একদিন থেকে যাব অপারেশন্যাল এরিয়া তিজিট করতে। ফিরে এসে আবার একদিন লোতে থেকে ফিরব দিল্লী।

১৪ই ফেব্রুয়ারী বাজেট অধিবেশন শুরু হবে। ২৮শে ফেব্রুয়ারী বাজেট পেশ করা হবে। আমি ৪ঠা মার্চ কলকাতা রওনা হবো। বাবা বেনারস থেকে ২রা কি ৩রা কলকাতা পৌঁছবেন। ৬ই মার্চ বিয়ে হবার পর ৮ই মার্চ ডি-লুকস একসপ্রেসে তোমাকে নিয়ে আবার দিল্লী ফিরব। ১৪ই মার্চ আমার ছুটি শেষ হবে। সুতরাং যদি কোথাও বাইরে বেড়াতে যেতে চাও, তাহলে ঐ কদিনের মধ্যেই ঘুরে আসতে হবে। পার্লামেণ্ট শেষ হলে তোমাকে নিয়ে নিশ্চয়ই কোথাও বেড়াতে যাব। কেমন? মত আছে তো?

মেমসাহেব লিখল, তোমার চিঠিতে জানলাম, তুমি লাডাক যাচ্ছি। তুমি যখন সাংবাদিক, তখন তোমাকে তো সর্বত্রই যেতে হবে। অনেক সময় বিপদের মুখোমুখি হতে হবে তোমাকে। আমার মুখ চেয়ে নিশ্চয়ই তুমি সব সময় সাবধানে থাকবে। তবে আমি জানি, তোমাকে কোন বিপদ স্পৰ্শ করতে পারবে না।

তুমি লিখেছি লাডাকে এখন মাইনাস ১০-১২ ডিগ্রী টেম্পারেচার। কলকাতার বাঙালী হয়ে আমাদের কল্পনাতীত। আমার তো ভাবতেও ভয় লাগছে। উলের আণ্ডারউয়ার, গ্লোভস, ক্যাপ ইত্যাদি নিতে ভুলে না। তুমি বার্লিন থেকে যে ওভারকোটটা এনেছ, সেটা অতি অবশ্য নেবে। আমি জানি তুমি ভাল থাকবে কিন্তু তবুও চিন্তা তো হবেই। তাই যদি পার লেতে পৌঁছবার পর একটা টেলিগ্ৰাম করে।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে