মাঘের সাঁঝে বসন্তের সুর পর্ব-০২

0
21

#মাঘের_সাঁঝে_বসন্তের_সুর
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি

২.
মৃত্তিকা মৃন্ময়ীর সামনে এল সকালে। গতকাল এসে হতে সে অভুক্ত। রাতে মৃদুলা তাকে খেতে ডেকেছিল। কিন্তু তার খাওয়ার ইচ্ছা ছিল না বলে খায়নি। সকালে ঘুম ভাঙতেই পেটের মধ্যে ক্ষুধার জ্বালাতন শুরু হয়ে গেছে। এখন আর কিছু না খেয়ে থাকা সম্ভব নয়। এতটা সময় না খেয়ে থাকার অভ্যাস নেই তার। হাত-মুখ ধুয়েই সে রান্নাঘরে হাজির হলো। সাজেদা বেগম তখন সবে নাশতা বানানো শেষ করেছেন। মৃত্তিকাকে দেখে তিনি গম্ভীর মুখে বললেন,
“রুটি-ভাজি করেছি। নিয়ে খা।”
মৃত্তিকা প্রত্যুত্তর না করে চুপচাপ প্লেটে রুটি-ভাজি নিয়ে চলে এল। টেবিলের কাছে এসে দেখল মৃন্ময়ী বসে রুটি খাচ্ছে। রান্নাঘরে যাওয়ার সময় সে মৃন্ময়ীকে খেয়াল করেনি। মৃন্ময়ী স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে খেতে বসেছে। মৃত্তিকা আসতেই সে বলল,
“বোস, কাল রাত থেকে না কি কিছু খাসনি? তোর শরীর ভালো?”
মৃত্তিকা চেয়ার টেনে বসে বলল,
“ভালো।”

শরীর ভালো থাকলেও যে মন ভালো নেই, সেটা তার মলিন মুখটাই বলে দিচ্ছে। মৃন্ময়ী বুঝতে পারছে বোনের মনের অবস্থা ভালো না। এই মুহূর্তে সে কীভাবে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। মৃত্তিকা রাগ, বিরক্তি তাদের দুবোনের চেয়ে বেশি। কারো কথা পছন্দ না হলে সে খুব বিরক্ত হয়। আচ্ছা, কোন কথা দিয়ে শুরু করলে আজ মৃত্তিকা বিরক্ত হবে না? এটা তো তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মৃন্ময়ীকে চুপ দেখে মৃত্তিকা নিজেই বলল,
“আপা কি খুব শক খেয়েছিস?”
মৃন্ময়ী কথাটার কারণ বুঝেও জানতে চাইল,
“শক খাব কেন?”
“এই যে তোদের জ্বালাতে চলে এলাম।”
মৃত্তিকার ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি। তাচ্ছিল্যটা আসছে তার কপালের প্রতি। মৃন্ময়ীর কেন জানি খারাপ লাগল। মৃত্তিকাকে আরও একটু সময় দিতে ইচ্ছা করল। কাঁচা ক্ষত খুঁচিয়ে র’ক্তাক্ত করতে তার দ্বিধা হচ্ছে। যদিও সকালে মা তাকে বারবার করে বলে দিয়েছে মৃত্তিকার পেট থেকে কথা বের করতে। সে সত্যিই আর ফিরবে কি না জানতে। মৃত্তিকা খেতে-খেতে বলল,
“কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে করতে পারিস, সমস্যা নেই। তোর ঘাড়ে যখন আবার ফিরে এসেছি, সবকিছু জানার অধিকার তো তোর আছেই।”
মৃন্ময়ী বলল,
“তোর যখন মন ভালো হবে তখন তুই বলিস।”
“এখন আর মন নিয়ে ভেবে লাভ নেই। এসে যখন পড়েছি, তোদের কাছে সবটা পরিষ্কার থাকাই ভালো।”
এই পর্যায়ে মৃন্ময়ী নড়েচড়ে বসে প্রশ্ন করল,
“তুই কি একেবারেই চলে এসেছিস? না কি প্রতিবারের মতো রাগ কমলে চলে যাবি?”
“যাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই।”
“কেন? এবার কী সমস্যা হয়েছে তোদের?”
“সমস্যা তো একটার পর একটা চলছিলই। পুরো পরিবার জোট বেঁধে নেমেছিল আমাকে সংসার থেকে ছাঁটাই করার জন্য। স্বামীর জন্য তবু সবার সাথে যুদ্ধ করে টিকে ছিলাম। শেষমেশ সেই মানুষ নিজেই আমাকে সংসার থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো।”
“অনেকদিন ধরে তোদের ঝগড়াবিবাদ চলছিল, তা তো জানি। এবার এমন কি হলো যে তোকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো, আর তুইও চলে এলি?”
“ওরা যে কিছু একটা ঘটাবে তা আমার কয়েকদিন ধরেই সন্দেহ হচ্ছিল। কয়েকদিন ধরে আমার ডাইনি শাশুড়িটা সবসময় ছেলের সাথে ফুসুরফুসুর করছিল। আমাকে দেখলেই তারা চুপ। আর আমার সঙ্গে-ও খারাপ ব্যবহার আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমার জামাই আমার সাথে দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছিল। আমার পাশে ঘুমাত না, ঠিকমতো কথা বলত না। কিছু জিজ্ঞেস করলেই ধমকে উঠত। দুদিন আগে তারা সবাই মিলে আমার নানা শ্বশুরকে দেখতে গিয়েছিল, তার অবস্থা না কি খুব খারাপ ছিল। আমাকে একা বাড়িতে রেখে গিয়েছিল। তখন তো আর বুঝিনি তারা আমার সংসার ভাঙার হাতিয়ার আনতে গেছে।”
মৃন্ময়ী কপাল কুঁচকে বলল,
“হাতিয়ার মানে?”
“সতিন, সতিন। তারা গতকাল সকালে নতুন ছেলের বউ নিয়ে বাড়িতে উঠেছে। আমার জামাইকে এত করে জিজ্ঞেস করলাম সে আমার সাথে এমন কেন করেছে, সে এমন ভাব করল যেন আমি তার কেউ না। তারা সবাই ব্যস্ত নতুন বউ নিয়ে। আমি যেন কীটপতঙ্গ, কেউ চোখেই দেখে না। রাগ করে আমি যখন চেঁচামেচি শুরু করেছি, তখন তারা সুযোগ বুঝে বলে দিয়েছে তারা তাদের পছন্দমতো ছেলের বউ এনেছে। সহ্য না হলে আমি যেন আমার বাপের বাড়ি চলে আসি। আমার জামাই তো বলেই দিয়েছে সে আমাকে তালাক দিয়ে দিবে। আমি ওখানে থাকলে সে আর আমাকে স্ত্রীর জায়গা দিবে না। এই আর-কী। কথায়-কথায় গায়ে হাত-ও তুলল। তারপর দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিলো। তাই আমিও চলে এলাম। যার জন্য ওই বাড়িতে পড়ে ছিলাম, তার কাছেই যদি জায়গা না পাই, থেকে আর কী হবে? থাকুক তারা তাদের নতুন বউ নিয়ে। আমি তো শান্তি দিইনি। নতুন বউ যদি তাদের শান্তি দেয়।”

মৃন্ময়ী হতভম্ব হয়ে গেল। ঘরে বউ রেখে আবার নতুন বউ এনেছে? তা-ও প্রথম বউয়ের অজান্তে? আশ্চর্য! মানুষ এমন বিশ্রী কাজ কীভাবে করতে পারে? সে অবাক কন্ঠে বলল,
“সংসারে ঝগড়া-বিবাদ তবু মানা যায়। কিন্তু ও তোর সাথে এমন একটা কাজ কীভাবে করতে পারল? ও তো নিজের পছন্দেই তোকে বিয়ে করেছিল।”
“তখন পছন্দের ছিলাম তাই বিয়ে করেছিল। এখন অপছন্দের হয়ে গেছি, তাই ছেড়ে দিয়েছে। আমার কপালে আসলে এটাই হওয়ার ছিল। মা বলেছিল না আমার এই আবেগী বিয়ে বেশিদিন টিকবে না? শেষপর্যন্ত মায়ের কথাই সত্যি হলো।”
“তা তো মা তোর ওপর রাগ করে বলত। কোনো মা কি চায় মেয়ের সংসার ভেঙে যাক? তখন এ কথা বলত, এখন দেখ তুই চলে এসেছিস বলে মা কত দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে।”
মৃত্তিকা আবারও হেসে বলল,
“মা দুশ্চিন্তায় পড়েছে তোকে নিয়ে রে আপা। তোর ঘাড়ে বসে আবারও লাফালাফি শুরু করি কি না, সেই ভয় পাচ্ছে।”
মৃন্ময়ী মাথা নেড়ে বলল,
“মা তোর-আমার সবার চিন্তাই করে রে। শুধু মুখে প্রকাশ করে না বলে আমরা তার খিটখিটে মেজাজটাই সত্যি ভেবে নিই।”
মৃত্তিকা ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“যাক, এখন এসব কথা রাখ। তোর স্কুলে যেতে দেরী হয়ে যাবে। ওঠ-ওঠ।”
মৃন্ময়ী দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সত্যিই তার দেরী হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত হাত ধুয়ে এক গ্লাস পানি পান করল সে। এঁটো প্লেট ধরতেই মৃত্তিকা বলল,
“আমি ধুয়ে রাখব নে। তুই যা।”
অবাক করার মতো কথা। মৃত্তিকার মুখে এমন কথা কোনোদিন শুনেছে বলে মৃন্ময়ীর মনে পড়ে না। সে খাবার খেয়ে নিজের এঁটো প্লেট-ও ফেলে রেখে উঠে যাওয়া মেয়ে। কিন্তু মৃন্ময়ীর এখন অবাক হওয়ার সময়-ও হাতে নেই।‌ উঁচু গলায় মাকে বলেই সে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেল।


বেতন হাতে পেয়ে আজ মৃন্ময়ী কোচিং থেকে বেরিয়ে সোজা মার্কেটে চলে এসেছে। অনেকদিন ধরে সে লক্ষ্য করছে মৃদুলার হাতের পার্সটা পুরোনো হয়ে গেছে। মেয়েটা নতুন পার্স না কিনে সেটা নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছে। মৃন্ময়ী বোনের জন্য একটা পার্স কিনল। নতুন এক ডিজাইনের কানের দুল মৃন্ময়ীর খুব পছন্দ হলো। তার থেকে সে দুই জোড়া কানের দুল কিনে নিল। মায়ের জন্য ঔষধ কিনতে যাওয়ার সময় হঠাৎ মৃন্ময়ীর চোখ আটকে গেল পাশের জুয়েলারি দোকানে। মৃত্তিকার বর দোকানে ঢুকছে, অর্থাৎ প্রাক্তন বর। সঙ্গের মেয়েটা নিশ্চয়ই তার নতুন বউ? নিমেষেই মৃন্ময়ীর মেজাজ বিগড়ে গেল। ইচ্ছা করল ছুটে গিয়ে বাটপারটার কলার ধরে কানের নিচে কষে কয়েকটা থাপ্পড় মা’রতে। এক বউয়ের সঙ্গে বাটপারি করে এখন আরেকজন নিয়ে ঘুরে-ঘুরে জুয়েলারি কেনা হচ্ছে? মনের তীব্র ইচ্ছাটা মনে চেপে মৃন্ময়ী ফার্মেসি থেকে ঔষধ কিনে দ্রুত বাড়ির পথে হাঁটা দিলো। প্রভাত তার পেছনেই ছিল। হঠাৎ করে মৃন্ময়ীকে তাড়াহুড়া করে হাঁটতে দেখে সে দৌড়ে তার কাছাকাছি চলে গেল। মৃন্ময়ীকে ডেকে বলল,
“ম্যাডাম, হঠাৎ গতি বেড়ে গেল যে? আজ আবার কিসের তাড়া?”
মৃন্ময়ী দ্রুত পায়ে হাঁটতে-হাঁটতে গম্ভীর মুখে বলল,
“আমার পিছু নিয়ো না প্রভাত। চলে যাও।”
প্রভাত সে কথা গায়ে না মেখে বলল,
“তা তো তুমি রোজই বলো। নতুন কী?”
“রোজ বললেও তুমি শোনো না, আজ একবার শোনো প্লিজ। আমার পেছনে এসো না।”
মৃন্ময়ীর অন্যরকম কন্ঠস্বর লক্ষ্য করে প্রভাত প্রশ্ন করল,
“তুমি কি রেগে আছো?”
“না।”
“তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি রেগে আছো। একটু আগেও না তোমায় স্বাভাবিক দেখলাম? হঠাৎ কী হলো?”
“কিছু হয়নি। তুমি চুপ করো।”
প্রভাত মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু, কিছু তো একটা হয়েছে। আমাকে বলো না কী হয়েছে।”
মৃন্ময়ী হঠাৎ থেমে গিয়ে রেগেমেগে বলে উঠল,
“বলছি তো কিছু হয়নি? তারপরও এত নাক গলাচ্ছ কেন তুমি? আমি একটু একা হাঁটতে চাইছি। সেই স্পেসটুকু-ও কি তুমি আমায় দিবে না?”
“তোমাকে একা ছাড়ার মতো স্পেস আমি দিতে চাই না।”
মৃন্ময়ী গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“তোমার সাথে আমি কথা বাড়াতে চাই না। দয়া করে এখানেই থেমে যাও, আর এসো না। কারোর সঙ্গ আমার ভালো লাগছে না। চলে যাও।”
তবু প্রভাত ত্যাড়া সুরে বলল,
“যদি না যাই?”
মৃন্ময়ী এবার উত্তর না দিয়ে রাগত চোখে চেয়ে রইল। প্রভাত বলল,
“আচ্ছা, আমি বুঝতে পারছি না কদিন ধরে তোমার কী হয়েছে। কদিন ধরেই খেয়াল করছি তোমার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। বাসায় কি কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“আমার সমস্যা জানার বিশেষ কোনো প্রয়োজনীয়তা তোমার নেই। আমি যাচ্ছি, আমার পিছু নিবে না।”
প্রভাত মন খারাপ করে বলল,
“এমন করছো কেন? আমি চুপচাপ চলি না, কথা বলে তোমাকে বিরক্ত করব না।”
“হাসিয়ো না। তুমি যেদিন চুপচাপ থাকতে পারবে, সেদিন আমি এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করব।”
“তাহলে আমি তোমাকে হাসাতেই চাই।”
“প্রভাত, তুমি কেন বুঝতে চাইছো না আমার একটু স্পেস দরকার? তুমি না আমার সহপাঠী?”
“আচ্ছা দাঁড়াও, রিকশা নিয়ে দিই।”
“আমি রিকশায় যাব না, হেঁটে যাব।”
“তুমিও তো এখন জেদ করছো। রাত বাড়ছে দেখেছ? রাস্তাঘাটে যদি একা ভয় পাও?”
“তুমি পিছু নেওয়ার বহু আগে থেকে আমি একা চলাফেরা করছি। আমাকে নিয়ে অযথা ভেবো না। নিজের কাজে যাও।”
প্রভাত আবারও ত্যাড়া সুরে বলল,
“তোমাকে নিয়ে অবশ্যই আমি ভাবব। একা যেতে চাইলে রিকশায় ওঠো, নয়তো আমার সাথেই চলো।”

মৃন্ময়ী মুখে চ-সূচক শব্দ তুলে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে রইল। প্রভাত একটা রিকশা ডেকে তাকে উঠতে বলল। উপায়ান্তর না দেখে মৃন্ময়ী রিকশায় উঠে বসল। প্রভাত তার কথা না শুনে গাড়ি ভাড়াটা-ও দিয়ে দিলো। রিকশা চোখের আড়ালে চলে গেল। প্রভাত কিছুক্ষণ চুপ মে’রে দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। পকেট থেকে ফোন বের করে বন্ধু সাঈদকে ফোন করে শুধাল,
“কোথায় আছিস রে?”
“বাড়িতে।”
“বাজারে আয়, চা খাই।”
সাঈদ সহাস্যে কৌতুক করে বলল,
“কীরে মামা? এই সময় তো বারবার ফোন দিলেও তোমার পাত্তা মিলে না। আজকে কি ম্যাডামের দেখা পাওনি?”
“পাব না কেন?”
“তাহলে? যাসনি তার পেছনে?”
“না।”
“ম্যাডাম কি আজ ঝাড়ু নিয়ে দৌড়ানি মা’রছে?”
“ফালতু কথা রাখ। বাজারে আয় তাড়াতাড়ি।”
“আচ্ছা আসছি। অপেক্ষা কর।”
ফোন রেখে প্রভাত উলটো পথে হাঁটা ধরল। আপনমনে বিড়বিড় করে বলল,
“রোজই তো এগিয়ে দিয়ে ফিরে আসি। আজ গেলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে চা, নাশতা খেতে চাইতাম না ম্যাডাম।”

মৃন্ময়ীকে ভালোবাসাটা প্রভাতের জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনার একটি। সেই স্কুলজীবন থেকেই সে মৃন্ময়ীকে চেনে। কিন্তু কখনও ভাবেনি সে একদিন ওই ভদ্র-সভ্য মেয়েটাকে ভালোবাসবে। ছাত্রজীবনে প্রভাত বেশ কয়েকবার কয়েকটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। কিন্তু কাউকেই ঠিক ভালোবাসা হয়ে ওঠেনি। প্রেমে তো মানুষ অসংখ্যবার পড়ে। সব প্রেমেই কি আর ভালোবাসা হয়? প্রভাত-ও প্রেমে পড়েছিল। কলেজে ভর্তির পর পরপর দুটো মেয়ের সঙ্গেই অল্প কিছুদিনের সম্পর্ক-ও হয়েছিল তার। দুটোই আবেগে ভেসে গিয়েছিল। না মেয়েগুলো তাকে ভালোবেসেছিল, না সে তাদের ভালোবেসেছিল। প্রেম করার ইচ্ছা জেগেছিল তাই প্রেম করেছিল। অনেক মেয়েরা তো তাকেই পাত্তাই দেয়নি। এই কাজটা করেছিল সব ভালো মেয়েগুলো। ভালো মেয়েরা তার মতো বেপরোয়া স্বভাবের ছেলেকে পাত্তা দিবে না, এটা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। অনার্সে ওঠার পর-ও সে এক মেয়েকে পটানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই মেয়ে কয়েকদিন পরেই বিয়ে করে জামাইয়ের বাইকের পেছনে বসে কলেজে উপস্থিত হয়েছিল। প্রভাত টের পেয়েছিল তার লাভ লাইফ পুরোটাই লসে পরিপূর্ণ। তাই প্রেম থেকে সে একপ্রকার সরেই দাঁড়িয়েছিল। মনে-মনে ঠিক করে নিয়েছিল সে আর কোনো মেয়েকে পটানোর চেষ্টা করবে না। ঠিক সেই সময় আচমকা একদিন সে মৃন্ময়ীর প্রেমে পড়ে গেল। একদম মেঘশূন্য হঠাৎ বৃষ্টির মতোই তার হৃদয়ে ঝমঝমিয়ে প্রেমের বৃষ্টি নেমে এসেছিল। তখন ছিল মাঘ মাসের ভরপুর শীতকাল। সেদিন ঠান্ডাটা একটু বেশিই পড়েছিল। সাঁঝের বেলায় প্রভাত বন্ধুদের আড্ডা থেকে বিদায় নিয়েছিল বাড়ি গিয়ে কম্বলের নিচে আশ্রয় নেওয়ার আশায়। একা পথ চলতে-চলতে হঠাৎ করেই সে বাচ্চাদের কোচিং সেন্টারের সামনে এক মেয়েকে দেখতে পেয়েছিল। কনকনে শীতের মধ্যে মেয়েটা সোয়েটার হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে বসে ছিল। প্রভাত কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে গিয়ে মৃন্ময়ীকে দেখতে পেয়েছিল। মৃন্ময়ীর চোখ ভর্তি জল ছিল, মুখে ছিল তীব্র বিষাদের ছায়া। কেঁদেকেটে চোখ লাল করে ফেলেছিল মেয়েটা। প্রভাতকে দেখেই সে দ্রুত চোখ মুছে নিয়েছিল। প্রভাত তার পাশে গিয়ে বসেছিল। তাকে জিজ্ঞেস করেছিল তার কিসের কষ্ট, সে কেন একা বসে কাঁদছে। মৃন্ময়ী তাকে বলতে চায়নি। কিন্তু প্রভাত জেদ ধরে বসেছিল। মৃন্ময়ীর কান্নার কারণ না জেনে সে কিছুতেই তাকে ছাড়বে না। সে খুব করে জিজ্ঞেস করায় মৃন্ময়ী-ও সেদিন নিজের মন হালকা করার প্রয়োজন বোধ করেছিল। তাই সে প্রভাতের সঙ্গে অনেক কথা বলেছিল। প্রভাতকে শুনিয়েছিল তার দায়িত্বের গল্প। সংসার নামক এক যুদ্ধক্ষেত্রের গল্প। যেখানে সে প্রতিনিয়ত অভাব-অনটন, শোক-অসুখ আর সীমাহীন দায়িত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছে। তবু তার এ দায়িত্ব শেষ হবার নয়। বরং দিনেদিনে বেড়েই চলেছে। বাবা তার কাঁধে নিজের সংসারের ভার চাপিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন যে। প্রভাত শুধু অবাক হয়ে মৃন্ময়ীর অশ্রুভেজা মুখের দিকে চেয়ে ছিল। এত সুন্দর, কোমল মেয়েটা যে মনে এত দুঃখ চেপে রেখেছিল, তা হয়তো কেউই জানত না। প্রভাতের যত কষ্ট ছিল তার মনমতো একটা পরিবারের অভাবে। কিন্তু টাকা-পয়সার অভাব তার কোনোকালেই ছিল না। বাবার কাছ থেকে সে ঠিকই প্রয়োজনীয় সবকিছু আদায় করে নিত। অথচ মৃন্ময়ীর সুন্দর একটা পরিবার থাকা সত্ত্বেও তার কষ্ট ছিল প্রভাতের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। একটা সংসারের দায়িত্ব কীভাবে সামলায় মেয়েটা? তার ওপর ওই মুহূর্তে মৃন্ময়ীর মায়ের ডায়বেটিস খুব বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ছোটো বোনের স্কুলের বকেয়া পরিশোধ করে তার হাতে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। সব শুনে সেদিন প্রভাত জোর করে তার হাতে টাকা গুঁজে দিয়েছিল। মৃন্ময়ী নিতে না চাইলে সে বলেছিল ধার হিসেবে নিতে। মৃন্ময়ী ধার হিসেবেই নিয়েছিল। এক সপ্তাহের মাথায় আবার পরিশোধ-ও করে দিয়েছিল। প্রভাতের হঠাৎ করেই মনে হয়েছিল মৃন্ময়ী তার পাওনা টাকা ফেরত দিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু তারচেয়েও খুব বড়ো কিছু চুরি করে নিয়েছে। ব্যস, নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রভাত আরও একবার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। সেই সাথে সে এ-ও বুঝতে পারছিল যে, এবারের প্রেম মোটেও বাকিগুলোর মতো হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ মৃন্ময়ী-ও ভালো মেয়েদের কাতারেই। প্রেম বিনিময় করলে নির্ঘাত প্রত্যাখ্যান করে দিবে। প্রভাত প্রেম বিনিময় করেনি। সেই থেকে সে মৃন্ময়ীকে আড়াল থেকেই দেখে গিয়েছিল। সুযোগ পেলেই মৃন্ময়ীর বন্ধু হয়ে ওঠার চেষ্টা করত। মৃন্ময়ী-ও ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিল। তার সাথে বন্ধুর মতোই আচরণ করেছিল। সময় যত গড়াচ্ছিল, প্রভাত তত বুঝতে পারছিল এটাই তার প্রথম দীর্ঘস্থায়ী প্রেম। মৃন্ময়ী-ই প্রথম মেয়ে যার প্রতি তার বিরক্তি আসে না, বিতৃষ্ণা আসে না, অধৈর্য আসে না; বরং দিনেদিনে প্রেম বাড়ে। একেক দিন সে নতুন করে মৃন্ময়ীর প্রেমে পড়ে, মুগ্ধ হয়। কিন্তু সে কোনোভাবেই নিজের মনের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছিল না। প্রভাত তরফদার, যে কি না একের পর এক মেয়েকে পটানোর চেষ্টা করেছিল, সে একদিন মৃন্ময়ীর সামনে সাহস হারিয়ে বসেছিল। ব্যাপারটা নিয়ে তার বন্ধুরা খুব মজা করত, সবসময় হাসিঠাট্টা করত। কিন্তু প্রভাত সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিল। সে বুঝতে পেরেছিল মৃন্ময়ীকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। এই ভালোবাসা সে কোনোভাবেই হারাতে চায় না। মৃন্ময়ীর মুখে হাসি ফোটানোর, তাকে একটা সুন্দর জীবন দেওয়ার, একটা সুখী সংসার উপহার দেওয়ার স্বপ্ন তার দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। টানা দেড় বছর প্রভাত আড়াল থেকে মৃন্ময়ীকে ভালোবেসেছিল। তারপর যখন দেখেছিল মৃন্ময়ীর এই জীবন পরিবর্তন হবার নয়, তখন সে ভাবনা বদল করেছিল। মৃন্ময়ীর সংসার-ই তার সবকিছু, দায়িত্ব পালন-ই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। নিজস্ব জীবন নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। সেই মাথাব্যথাটাই প্রভাত তার মাথায় ঢুকানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যাকে সে এতটা সময় ধরে ভালোবেসে এসেছে, সে যদি নিজের সংসার জীবন নিয়েই না ভাবে, তাহলে প্রভাতের এত স্বপ্ন কী করে পূরণ হবে? সে তো মৃন্ময়ীর সঙ্গে সংসার বাঁধার স্বপ্ন নিয়েই তার পেছনে পড়ে ছিল। মৃন্ময়ীর পর যে আর কোনো মেয়ের প্রেমে পড়া হয়ে ওঠেনি তার। ভেবেচিন্তে তখন প্রভাত মৃন্ময়ীকে মনের কথা জানিয়ে দিয়েছিল। নিজের মনের সম্পূর্ণ সত্য অনুভূতি সে মৃন্ময়ীকে শুনিয়েছিল। মৃন্ময়ী সেদিন খুব শক খেয়েছিল। হয়তো সে কখনও কল্পনা-ও করেনি যে প্রভাত তাকে ভালোবাসবে। স্বাভাবিকভাবেই মৃন্ময়ী তার সাথে সম্পর্কে জড়াতে নারাজ ছিল। প্রভাত অবশ্য এর বেশি কিছু আশা-ও করেনি। সে জানত মৃন্ময়ী রাজি হবে না। তাই বলে তো আর সে সরে যেতে পারে না। তাকে লেগে থাকতে হবে। মৃন্ময়ীর মন সে জয় করেই ছাড়বে। সেই থেকে প্রভাত মৃন্ময়ীর পেছনে পড়েছিল। পড়েছিল তো পড়েছিল, আজও মৃন্ময়ী তার হাত ধরে তুলে নেয়নি। সংসার জীবনে পা বাড়ানোর দুঃসাহস মৃন্ময়ীর নেই। কারণটা যে একমাত্র তার পরিবারের প্রতি দায়িত্ব, এটা প্রভাত খুব ভালোভাবেই জানে। তবু সে আশা ছাড়ার পাত্র নয়। সে অপেক্ষায় আছে, একদিন মৃন্ময়ী নিজের দায়িত্বের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে তার কাছে আসবে। দুহাত ভরে তার ভালোবাসা গ্রহণ করে নিবে। সেদিন যত দূরেই হোক, প্রভাত অপেক্ষা করবে।

চলবে, ইন শা আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে