মন ফড়িং
পর্ব – ১১
আপনাদের একটা বিয়ের ছবি আমাকে দেয়া যাবে? – নিদ্র নিজের অজান্তেই বলে ফেললো। অচেনা কারো কাছ থেকে বিয়ের ছবি চাওয়াটা মনে হয় ঠিক হয়নি।
মিস্টার ব্রন্ড কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন
– অবশ্যই, কেনো নয়?
চেয়ার ছেড়ে উঠে ভেতরের দিকে চলে গেলেন। নিদ্র একটু স্বস্তি বোধ করলো।
কিছুক্ষণ পর মিস্টার ব্রন্ড ছোট্ট একটা ছবি এনে নিদ্রের হাতে দিয়ে বললেন
– এটাতে হবে?
নিদ্র ছবিটা দেখে বললো
– অবশ্যই!
মিস্টার ব্রন্ড মুচকি হেসে বললেন
– নিশ্চয়ই স্পেশাল কাউকে ছবিটি দেখাতে চাচ্ছো?
– হ্যাঁ, যদি সুযোগ হয়।
– অবশ্যই সুযোগ হবে।
নিদ্র বিড়বিড় করে বললো
– প্রিয় মানুষের দেখা সবাই পেলেও, স্পর্শ করার ক্ষমতা সবার মাঝে থাকেনা!
অদ্রির সামনে লিলি বেশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অদ্রি তাকে কী বলার জন্য ডেকেছে সেটা বুঝতে পারছেনা লিলি। অদ্রি আপা কি জেনে গেছে, তার নদীর পাড়ে বসে থাকার কথা? অদ্রি আপা তো এই বাড়ির উঠানে পর্যন্ত নামেন না। তার কাছে অন্য এলাকার মানুষ তো দূরে থাক এই এলাকার মানুষই আসেনা। কে বলবে? রীতা বলেছে নাকি? না, সে নিজেও তো বাসার বাইরে বের হননা।
অদ্রি চায়ের শূন্য কাপ বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলে রেখে ভারি কণ্ঠে বললো
– কোথাও যাওয়া হয় আজকাল?
লিলি স্বাভাবিক ভাবেই বললো
– আপনার মতো বাসায় বসে থাকতে আমার ভালো লাগেনা!
অদ্রি এরকম উত্তর পাবে আশা করেনি। একটু অবাকই হলো।
– তাহলে কী ভালো লাগে? বেহায়াপনা করতে ভালো লাগে?
– ঘুরে বেড়নো কি বেহায়াপনা?
– গায়ের জামাকাপড় কিছু ঠিক থাকে নাকি তোমার? মুখে মুখে কথা তো বলতে খুব ভালো জানো
অদ্রি রেগে বললো
– তোমাকে কীভাবে সোজা করতে হয় আমার জানা আছে। ফের যদি দেখি বাসার বাইরে বের হয়েছো তাহলে আমার অন্যদিকের ব্যবহার দেখতে পারবে! খুব ভালো ব্যবহার করেছি। যাও এখান থেকে।
লিলি রাগে ফুসছিলো। অদ্রির কঠোর ব্যবহার তার আত্মসম্মানে আঘাত করেছে। লিলি তার রুমের দিকে পা বাড়ালো। অদ্রির কোনো কথাই সে শুনবেনা।
রশীদ সাহেব চিঠিটা পোস্টঅফিসে পোস্ট করে বাসায় ফিরছিলেন। নাজমুল কে দাওয়াত দেয়া কি ঠিক হবে? ও আসবেনা এটা সে শিওর। না আসলেও নিদ্রকে পাঠিয়ে দিবে। তাতেও লাভ আছে রশীদ সাহেবের। মেয়ের বিয়ের কথা শুনে কিছু টাকা বা গিফট পাঠাবে। টাকাপয়সার অভাবে আতিথ্য করতে তার যে কী পরিমাণ কষ্ট হবে, তা বোঝার ক্ষমতা একমাত্র তার মতো বাবারাই জানে। অদ্রি তাকে একটা টেনশন থেকে মুক্তি দিয়েছে। সে কি এর বিনিময়ে কিছু করতে পারবে?
অদ্রির টাকাপয়সার অভাব নেই। যা যা দরকার সবই তার আছে। না, কিছুই দেয়ার ক্ষমতা তার নেই। নামাজে বসে মোনাজাতে প্রাণভরে দোয়া করতে পারবে – আর কিছুই করার ক্ষমতা তার নেই।
অদ্রি রিতাকে বললো
– আচ্ছা ২০ জনের মতো মানুষকে ৭/১০ দিন তিন বেলা খাওয়াতে কী পরিমাণ খরচ হতে পারে?
রিতা পান মুখে দিয়ে বললো
– চাল, ডালের হিসাব বলতে পারবো কিন্তু টাকার পরিমাণ টা আমি ঠিক বলতে পারবো না।
– রশীদ চাচার ছোটো মেয়ের বিয়ে এই বাড়িতে হবে। আমি চাচ্ছিলাম খাওয়া খরচ, বর যাত্রীর আপ্যায়ন সব আমি দিবো।
– তাহলে তো বেশ খরচের বিষয় অদ্রি। আমি একা এতো জনের রান্না করতে পারবো না। যদি একজন মানুষ সহকারী হয় তবে সহজ হবে।
– রশীদ চাচাকে আমি দুইজন লোক আনতে বলবো। আর বাড়িটাও রঙ করতে হবে।
– অদ্রি তুমিও বিয়েটা করে ফেলো। আমি ঘটকালি করবো।
অদ্রি মুচকি হেসে বললো
– আমি বিধবা।
রিতা আজকেই প্রথম জানলেন, অদ্রি বিধবা! তার কেনো যেন বিশ্বাস হচ্ছেনা। এতো অল্পবয়সী মেয়ে বিধবা? মেয়েটার এতো ছন্নছড়া থাকার কি এটাই কারণ?
অদ্রি বললো
– রশীদ চাচা কখন বের হয়েছেন?
– ১ ঘণ্টার মতো!
– লিলি কি করছে?
– সে দরজা আটকে তার ঘরে আছে।
– মেয়েটার যে কি হয়েছে বুঝতে পারছিনা। আগে সারাদিন আমার পিছু পিছু আর এখন তাকে খুঁজে পাওয়া যায়না।
– নয়া যৌবন এসেছে বুঝতে হবে!
– ঠিক বুঝলাম না।
– নতুন যৌবনে পা দিলে প্রত্যেক ছেলে – মেয়ের মধ্যে কিছু পরিবর্তন আসে। এইসময় তাদের চোখে চোখে রাখতে হয়।
– আমি আগামীকাল থেকে চোখে চোখে রাখবো। আজকে নিচে নামতে ভালো লাগছেনা। আগে বাগানে বেশ সময় কাটাতাম এখন কিছুই ভালো লাগেনা।
– ছাদে যেতে না?
– না!
– চলো আজকে ছাদে যাই। ভালো লাগবে। এতো সুন্দর বাড়িটাকে সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হলে আরো ভালো লাগবে। বিশেষ করে তোমার রুমটা। দেখে কে বলবে বলোতো এটা অল্পবয়সী মেয়ের রুম?
– অল্পবয়সী বিধবা! কি অদ্ভুত উপাধি তাই না?
– চিঠিটা কাকে পাঠানোর জন্য দিলে?
– নিদ্র, আমাকে বেশ সাহায্য করেছিলো ব্যক্তিগত বিষয়ে। আমার হাতের হাবিজাবি রান্না খেয়ে ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। বেচারা চা খেতে পছন্দ করতেন কিন্তু আমার হাতের চা খেয়ে তার এখানে থাকার সখ হাওয়া হয়ে গেছে। আপনি আসার পরে আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলাম। কিন্তু কোনো প্রতিউত্তর পাইনি তাই এবার লাস্ট চেষ্টা করলাম।
– রশীদ সাহেবের জন্য এতো কিছু কেনো করতে চাচ্ছেন?
– সে আমার জন্য যা করেছে তার কোনো বিকল্প আমি কখনো দিতে পারবো না। বিধবা হবার পরে যখন এখানে চলে আসলাম কেবলমাত্র রশীদ চাচাই আমাকে সাহায্য করেছে। এতো বড় বাড়িতে আমি আর লিলি ছিলাম কেউ জ্বালাতন করার সাহস পায়নি। একমাত্র ওনার কারণে। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে আমি বাধ্য।
– রাতে কী খাবেন? দুপুরের খাবার গরম করে এনে দিবো নাকি থাই স্যুপ করে খাওয়াবো?
– আপনি পারেন?
– আমি অনেক ধরনের রান্না জানি।শুধু তুমি বলবে।
– আপনার ইচ্ছা হলে করবেন। আজকে থাক, দুপুরের খাবারেই হবে। কাল স্যুপ করে খাওয়াবেন।
রিতা খাবার গরম করার জন্য রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে নিচে নেমে আসলেন।
বিয়েটা রশীদ চাচার ছোটো মেয়েটার বদলে তারও হতে পারতো। এই বাড়ির গণ্ডি পেরিয়ে গেলে হতে পারে কেউ জুটে যাবে কিন্তু নিদ্রকে তো পাওয়া যাবেনা।
তার মতো একজন বিধবাকে কেনইবা নিদ্র ভালোবাসবে?
তার এই শরীরে আজ অবদি নিদ্র ছাড়া কারও স্পর্শ পড়েনি। বিয়ে তার ঠিকই হয়েছিল তবে সেটা নামেমাত্র বিয়ে!
একজন মানুষ তাকে ভুলের মধ্যে রেখেছিলো। তার মা – বাবাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে সেই মানুষ টা।
ভাবতেও ঘৃণা লাগে এরপর নিচু মানসিকতার কারো সাথে তার বিয়ে হয়েছিলো!
চলবে…..!
© Maria Kabir