মধ্যবিত্তের একাল সেকাল

0
903

সাধ আর সাধ্য শব্দ দুটোর মধ্যে শুধুই একটা ‘য’ ফলার পার্থক্য। কিন্তু মধ্যবিত্তের জীবন অংকে এই একটা য ফলা শব্দ দুটোর মধ্যে বানিয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব।

আমি দেখে দেখে খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতাম সেই ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু স্কুলের বেতন দিতেই যেখানে বাবার কষ্ট হয়ে যেতো সেখানে আঁকাআঁকি শিখতে চাওয়া ছিল নিতান্তই বিলাসিতার অন্য নাম। ফি বছর আগের ক্লাসের ভালো ফলাফলের সুবাদে হাফ বেতনে পড়ার সুযোগ মিলতো। কমদামী ভেঙে যাওয়া পেন্সিল ব্লেড দিয়ে কোনরকমে সাইজ করে দিতেন মা।সেটা দিয়েই দিব্যি নীচু ক্লাসের লেখালেখির কাজ চলে যেতো। পুরোনো বই বা খাতার শেষ পাতায় হয়তো নিজের শখের বশে করতাম আঁকাআঁকি। এক সেট ভালো রং পেন্সিলের খুব শখ ছিল। আমারই সহপাঠী জিনিয়ার মামা ওর জন্য বিদেশ থেকে একসেট দারুন রং পেন্সিল পাঠিয়েছিল। একবারই শুধু ধরার সুযোগ মিলেছে, ফেবার ক্যাসেল নাম ছিল। বইয়ের এক কোণে লিখে রেখেছিলাম নামটা। বড় হয়ে কখনো পয়সা হলে এক সেট কেনার স্বপ্ন দেখতাম যে।

জিনিয়ার সুবাদেই আমার ভাগ্যে প্রথমবারের মতো বিদেশী চকোলেট খাওয়ার সুযোগ মেলে। ও দুইটা চকোলেট এনেছিল স্কুলে। আমাকে হাভাতের মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে অর্ধেক না দিয়ে পারেনি বোধহয়। দশ পয়সা দামের হজমী আর চারআনার লজেন্স খাওয়া এই আমি জীবনে বুঝি প্রথমবার অমৃতের স্বাদ পেয়েছিলাম। খাতায় নামটা লিখে রেখেছিলাম, ফেরেরো রচার। যেদিন অনেক টাকা হবে আমার নিশ্চয়ই বাক্স বাক্স কিনে খাবো। আমার ধারনা হয়েছিল সব ভালো আর দামী জিনিসের দাম বুঝি ‘ফ’ দিয়েই হতে হয়।

আরো একটু বড় হতে দেখলাম জিনিয়া, রিয়া, তৃনা ওদের বাসায় জন্মদিন পালন করা হয়, বড় কেক কেটে মোমবাতি জ্বালিয়ে। আমিও দাওয়াত পেয়েছিলাম কয়েকবার। সবাই সুন্দর কাপড় পরে দারুন সব উপহার নিয়ে যায়। যেন বা ঈদের মতো আনন্দ। কি যে স্বাদ সেই কেকের তা বুঝি কোনভাবেই ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। পরদিন স্কুলে হয়তো যার জন্মদিন থাকতো সে এক টুকরো কেক টিফিন হিসেবে নিয়ে যেতো। মনে হতো আহা কি ভাগ্য ওদের। কোন দোকান থেকে সেই কেক কেনা হয় জানতে পারিনি। আমি বড় হওয়াতক দোকানটা থাকলেই হয়। রোজ কেক কিনে খাব নিশ্চিত। শখের খাতায় পেস্ট্রি কেকের নামও উঠে যায়।

মা কে বলেছিলাম, আমার জন্মদিন করতে। ভেবেছিলাম বন্ধুদের আসতে বলবো। বাবার সীমিত আয়ের সংসারে কেক কেনা হয়ে ওঠেনি। মা পায়েস রেঁধেছিল, খুব মজাও হয়েছিল। কিন্তু পায়েস দিয়ে কি আর জন্মদিন হয়? তাই বন্ধুদের আর আসতে বলা হয়নি কখনোই। মধ্যবিত্তের জীবন বোধহয় আসলে আলোবিহীন পানসেই হয়।

আরেকটু বড় হলাম। বান্ধবীরা তখন নানা পদের সাজগোজের জিনিসের গল্প করে। কি দাঁতভাঙ্গা সেসব নাম। কারো মামা, কারো চাচা বা কারো খালা হয়তো পাঠাতো সেসব বিদেশ থেকে। আর আমি সেসময় লেইসফিতা নয়তো মোড়ের স্টেশনারী দোকানের ফেয়ার এন্ড লাভলী ক্রিম, তিব্বত পমেড আর নাম পরিচয়হীন লিপস্টিক দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতাম। বন্ধুদের বলতাম, আমার আসলে সাজতে ভালো লাগেনা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে দুটো টিউশনি জুটিয়ে ফেললাম। বাবার কাছ থেকে রোজ হাতখরচ নিতে ভালো লাগতোনা। এক আধটা জামা বানানো, আসা যাওয়ার খরচ, কদাচিৎ বন্ধুদের সাথে বাইরে কোথাও খাওয়া; এই করতেই যে পুরো টাকা শেষ হয়ে যেতো। আর সাধের লিস্টে জমতে থাকতো অারো কিছু অপ্রাপ্তির নাম। অনেক বন্ধু গাড়িতে করে ভার্সিটিতে আসতো। সমীহের চোখে দেখতো তাদের অনেকেই। বাস, টেম্পু চেপে আসা এই আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে এড়িয়ে যেতাম তাদের আর ভাবতাম আমারো একদিন নিজের একটা গাড়ি হবে নিশ্চয়ই। এক বান্ধবী একবার তার গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দিল। কারো সাথে ধাক্কাধাক্কি নেই, সিটের জন্য চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকা নেই; আহা কি শান্তি। বাড়ির কাছাকাছি এসে অবশ্য মরমে মরে যাওয়ার অবস্থা; আমাদের তস্যগলি দিয়ে যে আর গাড়ি ঢুকবেনা। চাইলেও বন্ধুকে কি এক সংকোচে বাড়ি পর্যন্ত আসতে বলতে পারিনি সেদিন।

পড়াশোনার পাট চুকিয়ে বিয়ে হলো সেই এক মধ্যবিত্ত পরিবারেই। ভেবেছিলাম প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে নিজের ছোট ছোট শখগুলো পূরণ করবো। কিন্তু প্রিয় মানুষদের প্রাধান্য দিতে যেয়ে সেই সাধও আর পূর্ণ হলোনা। দুজনেই চাকুরী করাতে তাও খানিকটা ভালোভাবে চলা গেলেও সাধের পাল্লার সাথে সাধ্য কুলোয়না এই বেলা এসেও; দুজনকেই যে দুই পরিবারে খরচ দিতে হয়। বয়স আর বেতন বাড়ার সাথে সাথে নিত্য চাওয়ার পরিমানও বেড়ে যায় বলেই বোধহয় সাধ আর সাধ্য চাইলেও পাশাপাশি হাঁটতে পারেনা এক জীবনে।

…………………

মেয়েদের একবার আমার ছোটবেলার না পাওয়ার গল্প করেছিলাম আনমনেই। নিজেদের অপ্রাপ্তিগুলো ওরা যেন পায় সে বিষয়ে সচেষ্ট থেকেছি সবসময়।

গতকাল আমার চল্লিশতম জন্মদিন ছিল। জন্মদিনের কেকের সাথে বড় একটা বাক্স উপহার পেয়েছি মেয়ে আর তাদের বাবার কাছ থেকে। উপহার হিসেবে বাক্সের ভেতর পেয়েছি দুই সেট ফেবার ক্যাসেলের রংপেন্সিল, একবক্স ফেরেরো রচার, আর ম্যাকের এক সেট সাজগোজের জিনিস।
সবগুলো জিনিসে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে দিয়েছি দুই মেয়েকে। ওরাতো অবাক; আমার এতো শখের জিনিস দিয়ে দিচ্ছি ওদের। কিভাবে ওদের বোঝাই সময়, বয়স, অবস্থান বা পারিপার্শিকতার সাথে সাধও যে বদলায়। ওদের প্রাপ্তিমাখা হাসিমুখই যে এখন সবচেয়ে বেশী কাম্য।

ডা. জান্নাতুল

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে