#মধুবালা [০৭]
#ফারজানা_আক্তার
পুরো রাস্তা র’ক্তে মাখামাখি। কাক ডেকে চলেছে আপন মনে যেনো এক নিঃশ্বাসে। চারপাশে লোকজনের সমাগম। ট্রাকের চাপে শুভ্রর গাড়ি পুরো তেঁ’ত’লা হয়ে গিয়েছে। ট্রাকও উল্টে পরে রয়েছে। শুভ্রকে আর ট্রাক চালককে আলাদা আলাদা এম্বুলেন্সে তোলা হলো। এম্বুলেন্স চলছে খুব দ্রুত গতিতে। শুভ্র আর ট্রাক চালক দু’জনের অবস্থায়ই ভীষণ খারাপ।
হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে দু’জনকে একসাথে ICU তে ঢুকানো হলো। ততক্ষণে বেলাল মির্জা নাজমা বেগম মান্নান মির্জা হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছে। নাজমা বেগম তো হাসপাতালে এসে ছেলের এহেন অবস্থা দেখে দু’বার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। চিকিৎসা চলতেছে শুভ্র আর ট্রাক চালকের।
*************
আরে মহা মুসকিল তো। আপনি আমাদের পিঁছু নিতে নিতে এখান অব্ধি চলে এসেছেন। বলতে হবে খুব সাংঘাতিক লোক আপনি কিন্তু আমিও ছোঁয়া মির্জা আমার সাথে লাগলে হার নিশ্চিত। এখনই পরিক্ষা শুরু হবে, যান বলছি এখান থেকে। স্যার এসে পরবে।”
ছোঁয়া খুব ভাব নিয়ে কথাগুলো বলছে। আলিফের মুখে মুচকি হাসি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে আর তা দেখে ছোঁয়ার গা জ্ব’লে যাচ্ছে। লিলি ছোঁয়ার হাত একটু চেপে ধরে চোখ রাঙ্গায়, ছোঁয়া পাত্তা না দিয়ে সেদিকে জিহ্ব দিয়ে ভেং’চি কেটে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। লিলি মুখে লজ্জা এনে আলিফের দিকে তাকিয়ে খুব মিষ্টি কণ্ঠে বলে “ছোঁয়ার পক্ষ থেকে আমি সরি বলছি ভাইয়া। প্লিজ কিছু মনে করবেননা। আসলে সকালে আমারই ভুল ছিলো, আমি যদি একটু সাবধানে চলাফেরা করতাম তবে ওভাবে ধা’ক্কা লেগে পরে যেতাম না আর ছোঁয়াও আপনাকে দো’ষা’রো’প করতে পারতোনা। যাইহোক আমার বোনের পক্ষ থেকে আমিই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।”
আলিফ এখনো তার মায়াবীনির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লিলি লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। লিলির যে সাহস হচ্ছে না আর আলিফের দিকে তাকিয়ে থাকার। প্রথম দেখাই লিলির আলিফকে ভালো লাগতে শুরু করে। আর আলিফও তার মায়াবীনির মায়ায় আঁটকে পরেছে।
ছোঁয়া একহাতে লিলির বাহু চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে
“তোর এতো আদিখ্যেতা দেখে সত্যিই গা জ্ব’লে যাচ্ছে আমার। দোষ এই মিস্টারের ছিলো তুই কেনো সরি বলবি? এই বোবা তো সরি বলা দূরের কথা একটা কথাও বের করেনি মুখ থেকে এখনো পর্যন্ত। চল আমরা নিজের জায়গায় গিয়ে বসি স্যার এখনই চলে আসবেন।”
ছোঁয়া কথাটা বলে নিজের সিটে যাওয়ার জন্য পেঁছন ঘুরে পা বাড়াতেই একজন পিওন এসে আলিফকে বলে “আলিফ স্যার নিন আপনার কক্ষের সব আসবাবপত্র। ”
এই কথা বলেই সব টেবিলের উপর রেখে চলে যান পিওন। আলিফের দিকে ফিরে ছোঁয়া আর লিলি ভয়ে একটা ঢুক গিলে। আলিফ ওদের অবস্থা বুঝতে পেরে চাপা হেঁসে কঠিন স্বরে বলে “সবাই নিজের সিটে গিয়ে বসো। সময় হয়ে এসেছে, শুরু হবে এখন পরিক্ষা।”
ছোঁয়া ভ্যাঁবাছ্যাঁকা খেয়ে যায়। বোকার মতো গিয়ে নিজের সিটে বসে যায় ছোঁয়া। হঠাৎ ছোঁয়ার মনে কেমন জানি অদ্ভুত রকমের অনুভূতি শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে বারংবার শুভ্র ভালো নেই কিন্তু পরিক্ষার প্রশ্ন হাতে নিয়েই সব ভাবনা ঝে’ড়ে ফেলে দেয় ছোঁয়া।
************
বিকালে বাড়ি ফিরতেই ছোঁয়ার কর্ণকুহর হয় শুভ্রর এ’ক্সি’ডে’ন্টে’র কথা। ছোঁয়ার মনে হচ্ছে ও যেনো কানে ভুল শুনেছে তাই সানিয়ার দুই বাহু ধরে ওকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বারংবার জিজ্ঞেস করে কিন্তু সানিয়া বারবার একই কথা বলাই ছোঁয়া শব্দ করে কেঁদে ফেলে সানিয়াকে জড়িয়ে ধরে। সানিয়া ছোঁয়ার বোন সোহার সাথে একই ক্লাসে পড়ে। দশম শ্রেণিতে সাইন্স নিয়ে পড়ছে দুজন। সানিয়া বেশ বুদ্ধিমতি একটা মেয়ে, সে অনেক কৌশলে ছোঁয়াকে বুঝানোর চেষ্টা করতেছে কিন্তু তবুও সে ব্যার্থ হলো। সোহা এসে ছোঁয়াকে এভাবে কাঁদতে দেখে সেও জড়িয়ে ধরলো ছোঁয়াকে। সানিয়া কিছুটা মুখ ভার করে চলে গেলো সেখান থেকে। তারও বুকটা খাঁ খাঁ করছে বেশ শুভ্রর এহেন অবস্থার জন্য। সানিয়ার টিনএজার বয়সের একমাত্র ক্রাশ শুভ্র কিন্তু এটা সানিয়া আর সানিয়ার অন্তর ছাড়া আর কেউই জানেনা কারণ সানিয়া খুব গম্ভীর একটা মেয়ে। সে কখনো মনের গোপনীয় কথা কারো সাথে শেয়ার করেনা।
সোহা নিজেকে সামলিয়ে ছোঁয়াকে খাটে বসিয়ে বললো “আপু তুই একটু শান্ত হ প্লীজ। শুভ্র ভাইয়ের কিছুই হবেনা দেখিস। চিকিৎসা তো চলছে, তুই বরং কান্না না করে দোয়া কর ভাইয়ার জন্য। ”
এইটুকু কথা বলেই সোহা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাতে থাকে। ছোঁয়া চোখের জল মুছে ওয়াশরুমে চলে যায়। উদ্দেশ্য ওজু করে নামাজ পড়বে। ছোঁয়া মোটেও দূর্বল নয়, সে যথেষ্ট স্ট্রং মেয়ে শুধু পরিবারের অন্যায়গুলো মুখ বুঝে সহ্য করে নেয় যার অর্থ সে নিজেই বুঝেনা। হয়তো পরিবারকে একটু বেশি ভালোবাসে বলে প্রতিবাদ করতে পারেনা। সোহা একটা ঢুক গিলে নিজের রুমে চলে যায়।
ছোঁয়া নামাজে বসে মলিন মুখে মাগরিবের নামাজ শেষ করে আবার ৮ রাকাআত নফল নামায পড়ে নেয় শুভ্রর সুস্থতার জন্য।
“হে আল্লাহ আমি জানিনা আমার কেনো এতো খারাপ লাগছে শুভ্র ভাইয়ার জন্য, তবে আমার মনে হচ্ছে যেনো আমার নিঃশ্বাস গুলো আঁটকে আঁটকে যাচ্ছে। বুকটা শূন্য শূন্য লাগছে হুট করে। হৃদপিণ্ড টা ছা’র’খা’র হয়ে যাচ্ছে। হে আল্লাহ তুমি আমার এই অশান্ত মনটাকে শান্ত করে দাও, সুস্থ করে দাও আমার শুভ্র ভাইয়াকে। আমি পারছিনা আর, আল্লাহ রহম করো।”
মোনাজাতে কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতে শব্দ করে কেঁদে ফেলে ছোঁয়া।
************
আলিফ আহমেদ নিজের রুমে বসে আছে। চোখজোড়া জানালা বেদ করে কাঁচা রাস্তার দিকে। এই রাস্তা দিয়ে কতশত মানুষের চলাফেরা। এতো মানুষের মধ্যেও আলিফের দৃষ্টি খোঁজে চলেছে তার মায়াবীনিকে। কিছুই যেনো আর ভালো লাগছেনা তার।
মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আলিফ। তাদের একটা তিন রুমের ঘর আছে, আর ছোঁয়া লিলির বাসা রাজপ্রাসাদের থেকে কম যায়না। এটা মনে হতেই সব ভাবনা মাথা থেকে ঝে’ড়ে ফেলে সে। ওদের দুজন’কে দেখার পর থেকে আলিফের খুব বেশি ভালো লেগে যায় তার মায়াবীনিকে আর তাই সে মুহুর্তেই সব খোঁজ খবর নিয়ে ফেলে তার একটা বন্ধুকে দিয়ে। আলিফের পরিবারে ওর মা আর এক বোন ছাড়া আর কেউ নেই। আলিফের ছোট বোনের জন্মের দশ বছর পরেই ওদের বাবা মারা যায় আর তারপর থেকেই আলিফ পড়ালেখার সাথে সাথে এই সংসারটাকেও আগলে রেখেছে খুব যত্নে। আলিফের বোন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট। আলিফের কাঁধে এখনো অনেক দায়িত্ব এটা মনে পরতেই সে তার হৃদ স্পন্দনের ধুকপুক বন্ধ করার জন্য ছটপট করতে থাকে।
“কেনো মায়াবীনি এভাবে তুমি সামনে আসলে আমার? কেনো করে দিলে সবটা এলোমেলো? আমি যে নিস্ব হবো তুমিহীনা। কেনো এতোটা মায়া তোমার মুখশ্রী জুড়ে? মনটা যে বড্ড অবাধ্য।”
**********
লিলি ভাইয়ের দূর্ঘটনার কথা শোনার পর পরই দ্রুত হাসাপাতালে চলে যায়। বড্ড বেশি ভালোবাসে কিনা ভাইকে। আপাতত অন্য সব কিছু লিলির ভাবনার বাইরে। বেলাল মির্জা নাজমা বেগম আর লিলি ICU এর বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। সবার মনটাই অশান্ত হয়ে আছে ভীষণ। মান্নান মির্জা একটু দূরে দাঁড়িয়ে নিরবে চোখের জল বি’স’র্জন দিচ্ছে। উনার যে সাহস হচ্ছে না ভাই ভাবি আর ভাতিজীকে সান্তনা দেওয়ার। উনি নিজেই ভেতর থেকে ভে’ঙে পড়েছেন খুব।
ছোঁয়া আর নিজেকে ঘরে বন্দি করে রাখতে পারছেনা। এলোমেলো চুলে সে তার মায়ের কাছে ছুটে যায়। আনজুমা খাতুনের রুমের সামনে দিয়ে যেতেই ছোঁয়া খেয়াল করে তার দাদি শব্দ করে কাঁদছেন আর আল্লাহকে ডাকছেন। ছোঁয়ার বুকটা যেনো মোচড় দিয়ে উঠে।
সেলিনা পারভীন আর জায়েদা বেগম হলরুমে বসে ছিলেন সোফায়। ছোঁয়া দৌড়ে গিয়ে ওর মায়ের কোলে ঢলে পরে বলেন “আম্মু আমি হাসপাতালে যাবো প্লিজ আমাকে না করো না তোমরা। আমি আর স্থির হয়ে এখানে বসে থাকতে পারছিনা। বড় আব্বু যা বলে মুখ বুঁজে সইয়ে নিবো, কিছুই বলবোনা তবুও একটু শুভ্র ভাইকে দেখার তৃষ্ণা টা মিটাতে চাই আমি। আম্মু একটু বুঝার চেষ্টা করো প্লিজ। আমি মানছি শুভ্র ভাই আর আমার সম্পর্ক টা একটু অন্যরকম কিন্তু বিশ্বাস করো আমি কখনোই শুভ্র ভাইয়ার কোনো ক্ষতি চাইনি।”
মেয়ের এমন আহাজারিতে জায়েদা বেগম আর সেলিনা পারভীন হু হু করে কেঁদে দিলেন। তারপর সেলিনা পারভীন অনেক কষ্টে ছোঁয়াকে বুঝিয়ে লিলিকে কল দেয় কথা বলার জন্য।
লিলি কল রিসিভ করেই চাপা কান্নায় ভে’ঙে পরেন। লিলি কাঁদছে এটা বুঝতে পেরেই ছোয়ার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। ছোঁয়া কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে “শুভ্র ভাই কেমন.. কেমন আছে লিলি?”
“ভালো নেই আমার ভাইটা ছোঁয়া। তুই জানিস
ডাক্তার কি বলেছে? ডাক্তার বলেছে ভাইয়ার অবস্থা খুব সিরিয়াস। অন্য হাসপাতাল থেকে বড় ডাক্তার আনা হয়েছে। ট্রাক চালকের অবস্থা মোটামুটি বলেছেন কিন্তু ভাইয়ার অবস্থা খুবই খারাপ। ডাক্তার আরো বলেছেন ভাইয়া আর ট্রাক চালক যে কোনো একজনের মৃত্যু নিশ্চিত কারণ তারা নাকি নেশা জাতীয় দ্রব্য পান করে ড্রাইভ করছিলো।
ছোঁয়া এই ছোঁয়া আমার ভাই টা বাঁচবে তো?”
#চলবে_ইনশাআল্লাহ
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।
#মধুবালা [০৮]
#ফারজানা_আক্তার
অতিরিক্ত নে’শা পান করার কারণে ট্রাক চালকের ক্ষতি বেশি হয়েছে তাই শুভ্র কোনোমতে বেঁচে গেলেও ট্রাক চালককে বাঁচাতে পারেননি ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেও। পরিক্ষা করে জানা গেছে ট্রাক চালক প্রায়ই অনেক বছর ধরে নেশা করতে করতে ভেতরে ক্যান্চার হওয়ার ভাব চলে আসছিলো। ট্রাক চালকের বউ আর পাঁচ বছরের বাচ্চাটার কান্নায় লিলিও কেঁদে ফেলে তবুও কিছুটা স্বার্থপর হয়ে চলে গেলো সেই ক্যাবিনে যেখানে শুভ্র কে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শুভ্রর মা তো এখনো কেঁদেই যাচ্ছে। লিলি বাসায় কল করে বলে শুভ্রর অপারেশন সাকসেস, শুভ্রকে ক্যাবিনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খবরটা শোনা মাত্রই ছোঁয়া আবারো নামাজে দাঁড়িয়ে যায়, এবারের কান্নাটা সুখের। রাত এখন ১০টা ছুঁই ছুঁই। ছোঁয়া বসে আছে নামাজ শেষ করে। মনটা বেশি ভালো না হলেও মোটামুটি ভালো হয়েছে এই মুহুর্তে। ছোঁয়ার ভীষণ ইচ্ছে করছে শুভ্রকে দু-চোখ ভরে একবার দেখতে কিন্তু তা তো সম্ভব না। ছোঁয়ার যে হাসপাতালে যাওয়ার অধিকার নেই। বেলাল মির্জা না চাইলে ছোঁয়া কখনোই হাসপাতালে যাওয়ার সাহস পাবেনা। কিন্তু শুভ্রকে দেখার যে তৃষ্ণা খুব। তবে কি ছোঁয়া ভালোবেসে ফেলেছি শুভ্রকে? নিজের মনের কাছে নিজেই বারংবার প্রশ্ন করে বসে ছোঁয়া কিন্তু উত্তর পায়না কখনো। এক বুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ছোঁয়া বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
************
শুভ্রর জ্ঞান ফিরতেই সে দেখতে পেলো নাজমা বেগম বেলাল মির্জা সোফায় বসে আছে আর লিলি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্র চোখ বুলিয়ে পুরো রুম একবার পর্যবেক্ষণ করে নিলো কিন্তু যাকে খুঁজলো তাকে পেলোনা দৃষ্টির সীমানায়। বুকটা ভার হয়ে আসলো শুভ্রর। ইচ্ছে করছে চোখ দুটো আবারও বুঁজে নিতে, তাও চিরকালের জন্য। ভালোবাসার মানুষের পাশে যে অন্যকাউকে সহ্য করা ভীষণ য’ন্ত্র’ণা’র। খুব নীরবেই শুভ্রর চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পরে। শরীরটা যেনো হালকা কাঁপছে। শুভ্রর মাথায় বেশি আঘাত পেয়েছে, হাত পায়েও বেশ লেগেছে। সুস্থ হতে একমাস কিংবা তার বেশিও সময় লাগতে পারে বলে ডাক্তার জানিয়েছেন।
লিলি শুভ্রর দিকে তাকাতেই ওর জ্ঞান ফিরেছে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে দেয় এক চিৎকার। বেলাল মির্জা আর নাজমা বেগমও ছুটে আসেন শুভ্রর কাছে।
এমন মুহুর্তেও নাজমা বেগমের কষ্টসব ন্যাকামি মনে হচ্ছে শুভ্রর। খুব ধীরে একটু সময় নিয়ে শুভ্র লিলিকে বলে মা যেনো এখনই চলে যায় এখান থেকে নয়তো সে নিজেকে কষ্ট দিবে আরো। যেনো অসহায় হয়ে যায় এসব শুনে নাজমা বেগম। তবুও ছেলের ভালোর জন্য নীরবে বেরিয়ে যান ক্যাবিন থেকে। বেলাল মির্জা মান্নান মির্জাকে কল দেয়, উনি একটু কাজে নিচে গিয়েছিলেন। মান্নান মির্জা এসে শুভ্র কে একটুখানি দেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় নাজমা বেগমকে সাথে নিয়ে।
গাড়ি চলছে ধীরগতিতে। চোখের জল যেনো বাঁধা মানছেননা নাজমা বেগমের।
“ভাবি আর কত কাঁদবেন? অসুস্থ হয়ে যাবেন যে। আমাদের শুভ্র সম্পূর্ণ সুস্থ আছে এখন। চিন্তার কোনো কারণ নেই আর।”
“মান্নান ভাই আমার ছেলেটা কি কখনোই স্বাভাবিক হবেনা আর আমার সাথে? ওর সাথে কি খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছিলাম আমি? আমি তো ওর ভালোই চেয়েছিলাম কিন্তু ওর ভালো চাওয়া টা যে এতোটা ভ’য়ং’ক’র হয়ে উঠবে তা তো জানা ছিলোনা আমার।”
কথাগুলো বলেই আরো বেশিই কান্না করতে থাকেন নাজমা বেগম। মান্নান মির্জা চুপ হয়ে আছে মলিন মুখ করে। নাজমা বেগমকে সান্তনা দেওয়ার যে ভাষা উনার কাছে নেই। মায়ের মন খুবই দূর্বল যে।
**********
পরেরদিন সেলিনা পারভীন হাসপাতালে এসে লিলিকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। আগামীকাল আবার পরিক্ষা আছে লিলির তাই। বড় মাকে দেখে শুভ্র যেনো স্বস্তি পেলো কিছুটা। যদি সেলিনা পারভীন না এসে নাজমা বেগম আসতেন তবে দম বন্ধ হয়ে আসতো শুভ্রর।
লিলি বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ছোঁয়ার কাছে যায়। ছোঁয়া পড়ার টেবিলে বসে আছে মনমরা হয়ে। কিছুই পড়তে পারছেনা ছোঁয়া। মনটা বারবার বলছে এক নজর শুভ্রকে দেখবো। মনের সাথে যুদ্ধ করে ছোঁয়া চোখ-মুখ খিঁচে বসে আছে বই সামনে নিয়ে। ভালোবাসার মানুষকে দেখার তৃষ্ণাটাই অন্যরকম হয় যা হয়তো ছোঁয়া বুঝতে পারছেনা এখনো।
পেঁছন থেকে লিলি এসে জড়িয়ে ধরতেই হঠাৎ ভরকে যায় ছোঁয়া। লিলিকে দেখেই সব লজ্জা-শরম ভুলে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে শুভ্রর কথা।
লিলি কিছুটা মুচকি হেঁসে বলে “নিজেই দেখে নাও নিজের প্রিয়তমকে।”
কথাটা বলতে বলতেই লিলি ওর ফোনটা এগিয়ে দেয় ছোঁয়ার দিকে।
শুভ্রর অনেক গুলো ছবি+ভিডিও করেছে লিলি। কিছুতে শুভ্র ঘুমন্ত আর কিছুতে জাগ্রত।
ছোঁয়া ছবি ভিডিও গুলো দেখে দেখে অশ্রু চোখেই মৃদু হাসছে। লিলি মুগ্ধ নয়নে দেখছে ছোঁয়াকে। খানিকপর হালকা কেঁশে লিলি বললো “তবুও কি বলবি তুই আমার ভাইকে ভালোবাসিস না?”
কথাটা ছোঁয়ার কর্ণকুহর হতেই ছোঁয়া লিলিকে ফোনটা দিয়ে চলে যায় সেখান থেকে। লিলি মুচকি হাসে।
*********
দেখতে দেখতেই কেটে গেলো দুই সপ্তাহ। শুভ্র আজ হাসাপাতাল থেকে ফিরছে। শুভ্রকে আবারো নতুন গাড়ি করে বাসায় আনা হচ্ছে। বেলাল মির্জা ছেলের জন্য আবারো নতুন গাড়ি কিনেছে একটা। কথায় বলে টাকা থাকলে খরচ করতে গায়ে লাগেনা এমনই বেলাল মির্জা।
শুভ্র চুপচাপ বসে প্রকৃতি দেখছে। মনটা ভীষণ চটপট করছে ছোঁয়াকে একটা নজর দেখার জন্য। হাসপাতালে সবাই গেছে শুভ্রকে দেখতে শুধুমাত্র ছোঁয়া ছাড়া। যদিও ছোঁয়াকে লিলি ভিডিও কলে দেখিয়েছে শুভ্রকে কয়েকবার কিন্তু শুভ্রর কাছে সব অজানা। লিলি বলতে চাইলেও ছোঁয়া প্রমিজ নিয়েছে লিলির থেকে এই কথা যেনো কেউ না জানে। শুভ্রর হবু স্ত্রী টিয়াও গেছে কয়েকবার। পরিক্ষা শেষ হতেই টিয়ারা সবাই চলে এসেছে চট্টগ্রাম। আজকেও টিয়া আনতে গিয়েছে শুভ্রকে। ছোঁয়ার উপড় বেশ রাগ আর অভিমান জমে গিয়েছে শুভ্রর। টিয়া ঢাকা থেকে আসতে পারলে ছোঁয়া কেনো যেতে পারেনি এই একটাই প্রশ্ন শুভ্রর হৃদয়ে আঁ’চ’ড় কাঁটছে। এই মুহুর্তে টিয়া ওর পাশের সিটে বসে থাকলেও ভাবনাতে শুধু ছোঁয়ার আসা-যাওয়া।
গাড়ি এসে থামলো মির্জা বাড়ির সামনে। গেট দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করতেই সবাই এসে ঘরের সদর দরজায় ভীড় করে ফেলেছে। টিয়া গাড়ি থেকে নেমে শুভ্রর হাত ধরে ওকে গাড়ি থেকে নামায়। সবার মুখে চিকচিক করছে খুশি। শুভ্র সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কারণ সবাই উপস্থিত থাকলেও ছোঁয়া যে নেই উপস্থিত।
অথচ শুভ্র জানেইনা যে ছোঁয়া ছাঁদ থেকে দেখছে ওকে।
******
এভাবে কেটে গেলো আরো কয়েকটা দিন। শুভ্র কিছু কিছু সুস্থ হয়েছে এখন। তবে এখনো একটু একটু কুঁড়িয়ে হাটে।
এতোদিন হয়ে গেলেও ছোঁয়া এখনো শুভ্রর রুমে আসেনি। শুভ্র আর থাকতে পারলোনা এবার।
ছোঁয়া গোসল করছে। এই ফাঁকে শুভ্র ছোঁয়ার রুমে এসে ওর বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। শুভ্রর কানে পানির শব্দ ভেসে আসছে। এতেই যেনো কেমন শান্তি শান্তি লাগছে শুভ্রর।
টিয়া মাঝে মাঝে খুব ঘনিষ্ঠ হতে চাই শুভ্রর সাথে কিন্তু শুভ্র বারবার এড়িয়ে যায় এতে টিয়ার বেশ রাগ হয় তবুও টিয়া নিজেকে কন্ট্রোল করে রেখেছে সুন্দরভাবে বিয়েটা হয়ে যাওয়ার জন্য। কথা হয়েছে শুভ্র সম্পূর্ণ সুস্থ হলেই টিয়া আর শুভ্রর বিয়ের কথাবার্তা হবে কিন্তু এতোদিন অপেক্ষা করতে পারছেনা টিয়া। টিয়া ঢাকা শহরের মেয়ে। খুব টাইটপিট জামা পরিধান করে টিয়া যা শুভ্রর ভীষণ অপছন্দ। টিয়া চট্টগ্রাম আসার পর থেকে টপস জিন্স পরা বাদ দিলেও সেলোয়ার-কামিজের সাথে ওড়না রাখেনা গায়ে এতেই শুভ্রর রাগ হয় কিন্তু সে কিছুই প্রকাশ করেনা শুধু কয়েকবার বলেছে যেনো ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নেয় বাসায় বড় রা আছে। টিয়া কখনোই শুভ্রর এই কথায় পাত্তা দেয়নি তাই শুভ্রও নিজের মতোই থাকে, টিয়াকে নিজের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেয়না তেমন।
ছোঁয়া গোসল সেরে একটা কালো টি-শার্ট আর প্লাজু পরে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আয়নার সামনে গিয়ে চুল মুছাই ব্যাস্ত। শুভ্রকে খেয়াল করেনি ছোঁয়া। গুন গুন করে গানও ধরেছে চুল মুছতে মুছতে।
“তোমায় ছোঁয়ার ইচ্ছে
আমায় ভীষণ পীঁড়া দিচ্ছে
বলো কবে ছুঁতে দিবে…..”
“এখন এই মুহুর্তে”
ছোঁয়াকে আর কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে না দিয়ে শুভ্র ছোঁয়ার পেঁছনে এসে বলে কথাটি। ছোঁয়া চমকে যায় হঠাৎ শুভ্রর কন্ঠ শোনে। দ্রুত চুল মোছার টাওয়াল টা দিয়ে নিজেকে ঢেকে নেয় ছোয়া কোনোমতে। এই কয়দিনে দুজন একবারও মুখোমুখি হয়নি। শুভ্রও তেমন রুম থেকে বের হয়নি। আয়নায় নিজের পেঁছনে শুভ্রকে দেখে চোখজোড়া জলে ভিজে উঠেছে ছোঁয়ার। কান্নাটা গলায় আঁটকে দিয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করে ছোঁয়া বলে উঠে “শুভ্র ভাই আপনি এখানে?”
“কেউ তো আর আমায় দেখতে যাবেনা তাই আমিই আসলাম। আমার তো আর কারো মতো এতো জেদ নেই।”
“জেদ না থাকলে এ’ক্সি’ডে’ন্ট টা কেনো হলো?”
“তা তো হওয়ার ছিলো তাই হয়েছে।”
“জানা আছে আমার।
আচ্ছা এবার নিজের রুমে যান। আমি চেঞ্জ করবো।”
“তো কর। আমি কি জড়িয়ে ধরে রেখেছি তোকে?”
“টিয়া আপু তুমি?”
ছোঁয়া কথাটা বলতেই পিঁছু ফিরে তাকায় শুভ্র। শুভ্র দেখে ওর পেঁছনে কেউ নেই। ছোঁয়া যে ওকে বোকা বানিয়েছে এটা বুঝতে পেরে বেশ রেগে যায় শুভ্র। রাগি চক্ষুতে ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে যায় শুভ্র। একটা শুকনো ঢুক গিলে ছোঁয়া বলে “নিজের পায়ে নিজেই কু’ড়া’ল মারলি তুই ছোঁয়া।”
#চলবে_ইনশাআল্লাহ
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।