ফাগুণের নবধারা পর্ব-১৩

0
1913
ফাগুণের নবধারা পর্ব-১৩
ফাগুণের নবধারা পর্ব-১৩

ফাগুণের নবধারা

পর্ব-১৩

শাহাজাদী হুমাশা।

ভ্যাপ্সা গরম পরেছে খুব।ফাগুণের মাস শেষের দিকে প্রায়। কতগুলো ফাগুণ যে এভাবেই পার হয়েছে জানা নেই সুমুর।গরমে কুপুকাত অবস্থা।শুধু ভাবে যদি এসি না থাকতো তাহলে নাহিয়ান তো গরমে সেদ্ধ হয়ে যেতো।নবাবের ব্যাটা গরম সহ্য করতে পারেনা।বকাটা বিড়বিড় করে দিয়েই জীভ কাটলো সুমু।

আজ ছুটির দিন তাই সুমুও আজ রান্না ঘরে দিন কাটাবে।আর দিনতো সব শাশুড়ি করেন শুধু ছুটির দিন গুলোতেই সুমু রান্না করে।আজ নাহিয়ানের পছন্দের সব রান্না করবে সুমু।
রান্না ঘরে রান্না করতে করতেই গরমে সিদ্ধ হবার যোগার সুমুর।ভাবছে সবার জীবন এখন আনন্দময় কাটছে।বেশ ভালো লাগে সুমুর সবাইকে সুখী দেখে।তার ছোট্ট বোন নিধি কি সুন্দর আবিরের সাথে সংসার করছে।ইলমাটা তো এত কিছুর পর ইশরাকের সাথে ভালো আছে।বেচারীর উপর কি ঝড়টাই না গিয়েছে।আর রুকু আপা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটা। আবিদ ভাই সব সুখ তাকে দিয়ে পরিপূর্ণ করেছে তাকে।শুধু খারাপ লাগে নিঝুমটার জন্য। ভাইবোন সব হারিয়েছে সে।বাবা মাও পারতপক্ষে তেমন যোগাযোগ রাখেন না।আর নিঝুমের স্ত্রী! ওর সাথে নাকি ত্বালাকের কথা হচ্ছে।কে জানে কি চায় ছেলেটা।রিদিমাও করেকবার ক্ষমা চেয়েছিলো রুকু আপার কাছে কিন্তু আপাতো মানলেনই না।মাঝে মাঝে খারাপ লাগে নিঝুমের জন্য।

কলিংবেলটা বেজেই চলেছে।কেউ দরজা খুলছেনা কেনো??
দরজাটা খুলতে একজন লোক হাতে এতগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো নাহিয়ান।
– আআসসালামু আলাইকুম।আমি কি ভিতরে আসতে পারি??
লোকটার তাকে সালাম দেয়ায় নাহিয়ানের বেশ ভালো লাগলো লোকটাকে।সে সালামের উত্তর দিয়ে তাকে ভিতরে আসার সুযোগ করে দিলো।এর আগেও সে এই লোকটাকে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে।
– আপনি কাকে চাচ্ছেন?? প্রশ্ন করলো নাহিয়ান। লোকটা নাহিয়ান কে দেখে মুচকি হেসে বললো তোমার দাদা দাদু বাসায় আছেন??

পাশের ঘর থেকে আমিনা বেগম এবং তার স্বামী বেড়িয়ে এলেন।
তাদের দেখে লোকটা সালাম দিলো।
নিজের পরিচয় দিলেন।
– আমি রিয়াদ। আমি একজন বিজনেস ম্যান। আপনাদের বিজনেস এ শেয়ার হোল্ডারদের মধ্যে একজন।সুমু ম্যা’ম চেনেন আমাকে।
নাহিয়ান তার মা কে ডাকতে চলে গেলো।
– তা এখানে কি মনে করে?? প্রশ্ন নাভিদের মায়ের।তিনি ছেলেটাকে দেখেই চিনে নিয়েছেন এটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাই।

সুমু কিচেন থেকে লিভিং স্পেসে আসতেই তার হাত পা জমে গেলো।এই বজ্জাত লোকটা বাসা অব্দি চলে এসেছে।রাগে কাপঁছে সুমু।

কিছুদিন আগেই পরিচয় হয়েছিলো রিয়াদের সাথে।এবং রিয়াদ সুমুর সবকিছু জেনেই ভালোবেসেছিলো তাকে।কিন্তু সুমুর আপত্তির জন্য ব্যাপারটা এগুচ্ছেনা।তাই রিয়াদ পণ করেছে সে সুমুকে পাবেই।বহুদিনের প্রতীক্ষার পরও যখন কিছু করতে পারলো না তখন সুমুর শশুড় শাশুড়িই তার শেষ ভরসা।

সুমু আসার চা নিয়ে আসতে বললো তাদের বাসার কাজের লোককে।সুমু আসার আগেই রিয়াদ সুমুর শুশুড় শাশুড়ি কে বিয়ের ব্যাপারে বলে দিয়েছে।

– রিয়াদ সাহেব যে।ভালো আছেন?? তা এখানে কি মনে করে??
– আসলে আমি, না মানে এইতো নাহিয়ানেত জন্য খেলনা কিনেছিলাম সেগুলোই দিতে এসেছি।
– ঠিকাছে খেলনা দিয়েছেন নিশ্চই। চা আনতে বলেছি চা খেয়ে যাবেন।আমার অনেক কাজ আছে আমি উঠছি।

শাড়ি পরিহিতা সুমুকে এই প্রথম দেখলো রিয়াদ।কোমড়ে আচঁল গুজতে গুজতে রান্না ঘরের দিকে যাচ্ছে সুমু।এই রূপ আগে কখনোই দেখেনি রিয়াদ। অফিসেতো সবসময় সালওয়ার স্যুট পরেই যায় কিনা।আজ আরো একবার প্রেমে পড়লো রিয়াদ সুমুর।বহু কষ্টে নিজের দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করে রিয়াদ বিদায় নিয়ে চলে গেলো।সুমুর এই কাটা কাটা স্বভাবে বেশ কষ্ট পেয়েছে রিয়াদ।

– তুই কেনো এমন ব্যবহার করলি ছেলেটার সাথে??ও তো ভালো বুঝেই এসেছিলো।তুই দিনদিন এমন পাথর কেনো হয়ে যাচ্ছিস সুমু??

– আহ মা ছাড়োতো।আমি ভাবেই ঠিক আছি।
তোমরা কেনো আমাকে পর করে দিতে চাও? আমি আর আমার ছেলে কি বোঝা তোমাদের জন্য??

– এ আবার কেমন কথা সুমু?? তুমি বাড়াবাড়ির মাত্রা অতিক্রম করছো।

– মা এ বিষয়ে আর একটা কথাও না।রান্না হয়ে এসেছে প্রায়। আমি গোসলে যাচ্ছি।বাকিটা তুমি দেখো।

আমিনা বেগম সুমুর চলে যাওয়ার পথে একদৃষ্টি তে চেয়ে আছেন।

সকাল গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে।বেলাশেষের সময়টা সুমুর সবচেয়ে প্রিয় সময় স্মৃতি রোমন্থনের জন্য এর চেয়ে ভালো সময় হতেই পারেনা।গোধুলী লগ্নের প্রায় কাছাকাছি। আকাশ সাঁঝ করেছে।মেঘ গুড়্গুড় করে আহ্বান জানাচ্ছে বৃষ্টিকে ধরাকে স্বস্তি দিতে। সব জরা কে ধুয়ে মুছে নিয়ে যেতে।
বারান্দাটা থেকে নিচে দেখা যাচ্ছে। একজন যুবক গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুমু এই যুবক টাকে চিনে।কিন্তু সে তার সিদ্ধান্তে বদ্ধ পরিকর।কিন্তু সে ভুলে বসেছে প্রকৃত এবং পবিত্র ভালোবাসা সকল সিদ্ধান্তের ভীটকে নড়িয়ে দিতে জানে।সুমু বারান্দায় দাঁড়িয়ে রিয়াদের দিকে চেয়ে আছে।এমন না যে সে পছন্দ করেনা।কিন্তু শুধু মাত্র নাহিয়ানের কথা ভেবেই সে আর এগুচ্ছেনা।কি প্রভাব পড়বে তার বাচ্চাটার উপর।এ কয় দিনে রিয়াদ একটু একটু করে সুমুর মনে যায়গা করে নিয়েছে।তবে নাভিদের সম পরিমাণ তা কখনোই না।দিনশেষে সেও তো মানুষ,নারী। তারও ভালো লাগে কারও এক্সট্রা কেয়ার পেতে।কিন্তু তার মাতৃস্বত্তার কাছে বারবার হেরে যায় তার নারী স্বত্তা।

রাত ন’টা বাজে বাহিরে ভেঙে চূড়ে ঝড় নেমেছে।বারান্দার দরজা সহ ঘরের সব জানালা বন্ধ।সুমুর ভয় হয় ফাগুণের নবধারা যদি আবার বারান্দা হয়ে চলে আসে তার ঘরে।সে ভয় পায় সবকিছু আবার হারানোর ভয়। নাহিয়ান তার দাদা দাদুর সাথে গল্পে মসগুল।সুমু রাতের খাবারের আয়োজনে ব্যাস্ত।

রাত ১১ টা বেজে ৫৫ মিনিট।
ঝড় জেনো থামছেই না। নাহিয়ান ঘুমিয়ে পড়েছে।সুমুর চোখে ঘুম নেই।জানালা দিয়ে সে বাহিরের পথে চেয়ে আছে।যুবকটি এখনো দাঁড়ানো। শীতে কাঁপছে সে।কিন্তু একবারের জন্যও গাড়িতে গিয়ে বসছেনা।উফফ মেজাজ টা খিচড়ে যাচ্ছে সুমুর।কি দরকার আছে অমন প্রেমিক পুরুষ সাজার গাঁ জ্বলে যাচ্ছে রাগে।জানালার কাঁচ টা একটু সরিয়ে বাহিরে তাকাতেই লোকটা উপরের দিকে তাকালো।শীতের প্রকপে কাঁপা কাঁপা হাসি দিচ্ছে বোকা লোকটা।সুমুর ইচ্ছে করছে এক চড় দিতে।কিন্তু পারছে কই??
আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে লোকটার মারাত্মক কিছু হয়ে যাবে।কান্না পাচ্ছে সুমুর।কিন্তু তার কান্নার কোনো মানেই হয়না।
চোখের পানি গুলো জেনো বাঁধ ভেঙ্গেছে আজ।নাহিয়ান উঠে এসে কখন সুমুর পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি সুমু।আঁচলে টান পড়তেই খেয়াল হলো সুমুর। ইংরেজ সাহেব দের মতো কথা বলা ছেলেটা তার বাংলা ভাষা কমই বুঝে সবদোষ তার দাদার। নাতিকে ইংলিশ স্কুলে পড়ানোর ফল।খুব আফসোস হয় সুমুর ছেলেটার বাংলা শুনে।তার বাচ্চাটা।

– ডু নট ক্রায় মম।ইউ আর নট আ ক্রায় বেবি। বিগ গার্ল গ্রো আপ।
– সুমু হাঁসছে নাহিয়ানের কথা শুনে।
– কেঁদো না আম্মু।তুমি রিয়াদকে বাসায় নিয়ে এসো।আজ সারাদিন সে কিচ্ছু খায়নি।পানিও না।আমি যখনই বারান্দা থেকে বাহিরে দেখেছি সে এদিকেই তাকিয়ে ছিলো।তুমি তাকে বাসায় নিয়ে এসো।
– থাকুক।ভিজুক বৃষ্টিতে। মাথা ঠিক হয়ে যাবে।
– আমি সব জানি আম্মু।আমার খুব ভালো লেগেছে রিয়াদকে।আমার তাকে পাপা ডাকতে আপত্তি নেই।আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। তুমি তাকে নিয়ে আসবে আমি এখন ঘুমোতে যাচ্ছি।তুমি যাও।
– ছেলের মুখের কথা শুনে সুমুর জেনো খুশি ধরছেনা।তার ছেলেটা এত বড় হয়ে গিয়েছে। এইটুকু বাচ্চা তার বাবার মত করে কথা বলছে।
– আম্মু তুমি যাবে নাকি আমি যাবো??
সুমু নাহিয়ানের কথা শুনে হকচকিয়ে গেলো দ্রুত বলে উঠলো আ’ম গোয়িং হানি।আমি যাচ্ছি।
দ্রুত দরজা খুলে লিভিং রুম থেকে বাহিরের দরজার দিকে ছুটলো সুমু।নাহিয়ান পেছন থেকে ডেকে বললো –
হেই আম্মু ইউ ফরগোট দিস থিংস।
সুমু আবার দৌড়ে নাহিয়ানের কাছে গেলো।
একটা ছাতা আর একটা তাওয়াল ধরিয়ে দিলো নাহিয়ান তার মায়ের হাতে।সুমু নাহিয়ানের গালে চুমু খেতেই নাহিয়ান কপট রাগ দেখিয়ে ইয়াক বলে উঠলো।
সুমু কান্না মিশ্রিত হাসি দিয়ে ছুটলো নিচে যাবার জন্য।
নাহিয়ান তার মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো যতক্ষণ না সে দরজার বাহিরে গিয়ে লিফটে উঠলো।সুমু যেতেই নাহিয়ান নভিদের ছবির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।আর বললো আই প্রমিজ আমি আম্মুকে কখনো কষ্ট পেতে দিবোনা।

লিফট থেকে নেমেই সুমু ছাতা খুলে দৌড়ে গেলো রিয়াদের কাছে।ঠকঠক করে কাঁপছে রিয়াদ।সুমুর চোখ ভর্তি পানি টলটল করছে।রিয়াদ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো-

আপনি নিচে কেনো এসেছেন?? ঠান্ডা লেগে যাবে আপনার।

সুমু ভেঙচি দিয়ে রিয়াদের মিমিক করলো- ঠান্ডা লেগে যাবে আপনার।
অসভ্য,বেহায়া লোক এই অবস্থায় কে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে আপনাকে? বাসায় আসলে কি আপনাকে কেউ ঢুকতে দিতো না?? কেনো দাঁড়িয়ে ছিলেন এভাবে?? কাঁদছে সুমু।

রিয়াদ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে সুমুর দিকে।নাফ্রোদিতির মত সুন্দর দেখতে দেবীটা তার জন্য কাঁদছে,অথচ কি সুন্দর লাগছে তাকে ক্রন্দনরত অবস্থা।ঠোঁট গুলো কান্নার তরে কেঁপে উঠছে।চোখ বেয়ে অশ্রু গুলো গাল বেয়ে গড়িয়ে চিবুক ছুঁয়ে দিচ্ছে। রিয়াদের খুব করে সুমুর চিবুকে ঠোঁট ছোঁয়াতে ইচ্ছে হচ্ছে।সুমু তাকে তাওয়ালে জড়িয়ে তার হাতে ছাতাটা ধরিয়ে দিয়েছে রিয়াদ একদৃষ্টি তে সুমুকে দেখছে। আচমকা সুমু রিয়াদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তাকে শক্ত করে দুহাতে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে সুমু।রিয়াদ একহাতে সুমুকে জড়িয়ে ধরে ভাবছে এক বাচ্চার মা হলেও সুমুর ভিতরের কিশোরী স্বত্তাটা প্রবল। সে ততক্ষণাৎ একটা পণ করলো – সারাজীবন সে নাফ্রোদিতির মত দেখতে এই সুন্দরীকে খুনশুটি করে কাঁদাবে এবং তাকে আদরে আদরে কাণাকাণায় পরিপূর্ণ করবে, এ কান্না দেখেও সুখ।

এক পশলা ফাগুণের নবধারা আবার সুমুকে ভিজিয়ে দিলো কিন্তু এবার তার পাশে রিয়াদ রয়েছে তার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখার জন্য।জীবন বড্ড বৈচিত্র্যময়।??

সমাপ্ত।