নৈশব্দে নিরুপমা পর্ব-১৪

0
47

#নৈশব্দে_নিরুপমা
[১৪]
-তামান্না

রিহান:সালাম দিয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একজন অপরিচিত মানুষের গলার শব্দ শুনতে পায়।কিছু একটা শুনে হাত থেকে ঠাস করে ফোন টা নিচে পড়ে যায়।
নিরু মাত্রই রুমে এসেছে।ফোন পড়ে যেতে দেখে মোবাইল টা হাতে নেয়।নিয়ে দেখে অচেনা নাম্বার। কয়েকবার হ্যালো বলার পর কেউ একজন বলে নীলা আর রিফাত এক্সিডেন্ট করেছে,, দুজনেরই অবস্থা খুবই গুরুতর।বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুব কম।আর যে ফোন করেছে সে হলো রিফাতের কাজিন নয়ন।

–নিরু ফোন টা টেবিলের উপর রাখতেই স্যান্সলেস হয়ে পড়ে যেতে নিলে রিহান ধরে ফেলে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজে ও বসে পড়ে নিচে।

–সবচেয়ে কাছের মানুষের মধ্যে একজন হলো রিফাত।তার এমন বাজে পরিণতি শুনে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।কেমন যেন ফাঁকা লাগছে।ফাঁকা বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিরুকে।

–বাসা থেকে মানবে না মানবে না করে কতো যুদ্ধ পেড়িয়ে গত সপ্তাহে ওদের বিয়ের কাবিন হলো। দুটি ভালোবাসার পরিণত হলেও একসাথে বাঁচা হলো না একজীবন।আফসোস ভালোবাসা এবং খাঁটি ভালোবাসা গুলো অকালেই ঝড়ে গেলো।অথচ চারপাশে এতো বিশ্বস্ত এবং খাঁটি মানুষ আজকাল পাওয়া যায় না।

–হঠাৎ করেই বুকটা কেঁপে ওঠে নিরুকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা ও করে না রিহান।মাথা সোজা করে দেখে সেন্স নেই,, তাড়াতাড়ি করে বিছানায় শুয়ায় পানি এনে চোখে মুখে দেয়।
নিরুর জ্ঞান ফিরতেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রিহান। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,,তুমি যাবে হসপিটাল?তোমার বেশি খারাপ লাগছে?
–নিরু:প্রিয় মানুষ গুলো এমন কেন?খুব সহজেই ছেড়ে চলে যায়।ওদের ছাড়া আমাদের যে কষ্ট হয় বুঝে না কেন?আচ্ছা! ওরা কি নিজ ইচ্ছায় আমাদের ছেড়ে চলে যায়?

–রিহান:জীবনের আয়ু ফুরিয়ে গেলে কিভাবে থাকবে বলো?ওদের কিছু হবে না চলো তোমাকে সাথে নিয়ে যাবো।তারপর দুজনে এভাবেই বেড়িয়ে যেতে নিলে রিহান এসে নামাজ পড়ার হিজাব টা দিয়ে বলে এটা পড়ে নাও।
.
.
–এক ঘন্টা পর হসপিটালে এসে পৌঁছায় রিহানরা এসে দেখতে পায় ওদের আত্মীয় স্বজনরা চলে এসেছে।সবাই কান্না কাটি করছে। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে দুজনেই মা-রা গেছে।

–তারপর এখান থেকে সবাই রিফাতদের বাসায় চলে যায়।ওখানে দাফন দিতে দিতে পরদিন বিকেল হয়ে যায়।নিরুর বাড়ির মানুষ রিহানদের বাসার মানুষ সবাই এসেছে।
–রিহান:নিরু!এবার বাসায় চলো?ফ্রেশ হতে হবে তো!
–নিরু:নীলা রিফাত ভাইয়া অনেক আরামে আছে বলেন? পৃথিবীর সাথে আর যুদ্ধ করতে হবে না।
–রিহান:এগিয়ে এসে নিরুর মাথা ওর পেটে চেপে ধরে। নিরু বসে থাকায় আর রিহান দাঁড়িয়ে থাকায় এভাবেই ধরতে হয়েছে।নিশা আর রিফা ও এগিয়ে এসে অনেক কষ্টে ওকে নিয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে আসে।

সারা রাস্তা নিরবে শুধু চোখের পানি ফেলেছে আর একটু পরপর হেঁচকি দিয়েছে।যতই সবাই বুঝাক মন কি আর মানে।প্রিয় মানুষ গুলোর শূন্যতা যে ভীষণ কঠিন।

*********-
–ফ্রেশ হয়ে চুপচাপ আনমনা হয়ে বেলকনিতে বসে আছে নিরু।কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। নিশা আর রিফা রুমে আসে।এগিয়ে এসে নিরুর পাশে বসে।
–রিফা:কিছু করার নেই আপু।জীবনে সবচেয়ে চরম সত্যি মৃত্যু সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে। প্লিজ তুমি একটু স্বাভাবিক হও।
–নিশা:বোনকে জড়িয়ে ধরে বলে,,কষ্ট পেও না।
–নিরু:চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।জোর পূর্বক হেসে বলে,একদিন আমি ও হারিয়ে যাবো।আচ্ছা!যদি এমন অকালে হারিয়ে যাই কেমন হবে?
–রিহান :ভালোই হবে।নীলা আর রিফাতের মতো তোমার আর আমার জানাজা এক সাথে সবাই মিলে পড়ে যেতে পারবে।রিফা আর নিশা উঠে চলে যায়।

–নিরু এবার শব্দ করে কান্না করতে থাকে।রিহান এগিয়ে এসে পাশে বসে বলে,,মৃত্যু চিরন্তন সত্যি। তবে হয়তো অকালে ঝড়ে গেছে দুটি প্রাণ কিন্তু ভালো কিন্তু একটা হলেও উপর ওয়ালা করেছে।

“নিরু:যেমন?
–রিহান :ভেবে দেখো রিফাত আর নীলা যথেষ্ট কষ্ট করে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে।ওদের ভালোবাসা মনে গেঁথে যাওয়ার মতো।আজকে যদি একজন মা-রা যেতো তাহলে?তাহলে অন্য জন বেঁচে থাকলে ও জীবনের কোনো স্বাদ পেতো না।ভালোবাসা হারিয়ে গেলে বেঁচে থাকা সহজ না।এর থেকে ভালো দুজনের ভালোবাসার সমাপ্তি একসাথে থেকেই হয়েছে।হয়তো কষ্ট অনেক তবে মেনে তো নিতেই হবে বলো?
–নিরু:আমি যদি হঠাৎ করে মা-রা যাই?আমার জন্য তো কারো জীবনের স্বাদ চলে যাবে না?
–রিহান :নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে উঠে দাঁড়ায়। রুমে গিয়ে পাশে থাকা ফুলদানি টা ছুড়ে মারে ফ্লোরে।সাথে সাথে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

–নিরু চোখে পানি নিয়ে ও জোর পূর্বক হাসে।এর মধ্যে রুমে আসে মিরা।
–মিরা:আসার পর তো তোর বউয়ের সাথে কথায় হলো না রিহান।জানি তোদের ভীষণ মন খারাপ নিরুপমা কই?
–রিহান :সাবধানে পা কেটে যাবে।প্লিজ মিরা আমি মারতে পারছি না তুই একটু আমার হয়ে ফাজিল মেয়ের গালে দুটো থাপ্পড় দিয়ে দিছ তো।
–মিরা:চারপাশে তাকিয়ে বলে এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে?
–নিরু:বেলকনি থেকে এগিয়ে এসে সালাম দেয়। মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করে ভালো আছে কি না!

–মিরা:বাহ্ খুব মিষ্টি বউ পেয়েছিস তো।আসো আমার পাশে বসো।এগিয়ে গিয়ে মিরার পাশে বসে নিরু।সুন্দর করে ওড়না দিয়ে শরীর ঢেকে নম্র ভদ্র একটা মিষ্টি মেয়ে মাথা নুয়ে বসে আছে। আড় চোখে কয়েকবার দেখে নেয় রিহান।মনে মনে বলে মনে হচ্ছে ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না।অথচ আমাকেই ভেজে ফেলে।

–মিরা:হাসতে হাসতে বলে ভাই!তোর বউ তুই সারাজীবন দেখতে পাবি চুরি করে নিয়ে যাবো না।
এবার রিহান লজ্জা পেয়ে যায়।এরমধ্যে কাজ করে যে আন্টি রুম পরিষ্কার করে দিয়ে যায়।

–মিরা:এতো সহজ সুন্দর বউ পেয়ে ও রাগ হয় কেমনে?একটু তো কন্ট্রোল করতে শিখ নিজেকে!
–রিহান:সহজ?তুই নিরুপমা কে সহজ বলছিস? তুই জানিস তোকে আর আমাকে ও সন্দেহ করতে ছাড়ে নি এই পাকা মেয়ে।

–নিরু এবার চোখ বড় বড় করে রিহানের দিকে তাকায়।মিরা হাসতে হাসতে বলে,,সত্যি নিরুপমা?
–নিরু:দ্রুত মাথা নেড়ে বলে না না।
–রিহান :আচ্ছা!তবে মনে মনে স্বস্তি নাও মিরা বিবাহিত মহিলা!তারপর হাসতে থাকে।
–মিরা:বিয়ে হয়েছে বলেই মহিলা হয়ে গেলাম?
–নিরু:দেখলা আপু কেমন সে?
–রিহান :তো!
–নিরু:মহিলা বলা হয় আম্মু চাচিদের বয়সী লোকদের।
.
.
কয়েকদিন পর,,
–রিফা:তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো ভাইয়া!
–রিহান :হুম!বলে ফেল,আমার সাথে কথা বলতে আবার কবে অনুমতি নিয়েছিস?
–নিরু ও খানিকটা চমকে যায়।যে মেয়ে সব সময় বকবক করে ভাইয়ের সাথে সে কিনা আজকে অনুমতি নিতে আসছে?
–রিফা:জানি তুমি রেগে যাবে।কিন্তু আমার কিছু করার নেই।আমি অনেক ভেবে দেখেছি।
–রিহান :ল্যাপটপ টা বন্ধ করে বোনের দিকে তাকিয়ে বলে কি?
–রিফা:চোখ বন্ধ করে বলে আমি একজনকে ভালোবাসি ভাইয়া।
–নিরু:সাথে সাথে মুখ টা মলিন করে বলে,, কে সে?
–রিফা:আমি ওকেই বিয়ে করতে চাই।রিহান একবার নিরুর দিকে তাকায় আবার বোনের দিকে তাকিয়ে বলে,,আচ্ছা!পরিচয় করিয়ে দিস দেখি ভালো হলে সমস্যা নেই।

–রিফা:তুমি তাকে ভালো ভাবেই চেনো।কিন্তু বিশ্বাস করো ভাইয়া সে পাল্টে গেছে।আমাকে বলেছে কখনো বাজে কাজ,, ব্যবহার করবে না।

–রিহান :ভ্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে কে সে?
–রিফা:চোখ বন্ধ করে বলে নিরব ভাইয়া।সাথে সাথে মনে হলো একটা কম্পনের সৃষ্টি হয়েছে।চোখ খুলে দেখে চেয়ার টা ছিটকে পড়ে আছে সাথে জিনিস পত্র ও।
–নিরু:প্লিজ!শান্ত হও তোমরা।রিফাকে দু’হাতে আগলে ধরে বলে মজা করে বলেছে হয়তো।
–রিহান:চিৎকার করে বলে,ওর সাহস হয় কি করে?রিহানের চিৎকারের শব্দ শুনে ওর আব্বু আম্মু ও চলে আসে।

–তারপর ছোট খাটো একটা ঝড় বয়ে যায় পুরো বাড়িতে।রিফা কান্না করতে করতে যে রুমে গিয়ে দরজা আটকে রেখেছে।নিরু সেই কখন থেকে ডেকে যাচ্ছে খুলছে না।

********************************************–রিফার কান্ড দেখে দেখা করতে বাধ্য হলো রিহান।নয়তো হিতে বিপরীত হতে পারে।মুখোমুখি বসে আছে নিরব রিহান আর এক বন্ধু।

–রিহান :ঠান্ডা মাথায় বলে ,, তোর সাথে আমাদের শত্রুতা তুই এরমধ্যে রিফা কে কেন জড়াচ্ছিস?
–নিরব:কেন?ভুল হয়ে গেছে বুঝি?প্রিয় মানুষ গুলোতে হাত বাড়ালে কেমন লাগে?খুব কষ্ট হয় বুঝি?

–রিহান :দাঁতে দাঁত চেপে বলে সন্ধান পেলি কোথায়? তোর সাথে তো রিফার যোগাযোগ হওয়ার মতো সুযোগ সুবিধা নেই?

–নিরব:হাসতে হাসতে বলে,,নরম খেলোয়াড় ভেবেছিস?একেবারে পিষে দেবো।

একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে হাতাহাতি হয়ে যায়।চারপাশের কয়েকজন এগিয়ে এসে থামায়।কিন্তু লাস্ট কথার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না রিহান।দুকদম পিছিয়ে পড়ে যেতে নিলে ধরে ফেলে ওর বন্ধু।
কোনো রকম তর্কে না জড়িয়ে চুপচাপ চলে আসে বাসায়।

–নিরু:কি হয়েছে?এমন অস্বাভাবিক লাগছে কেন তোমায়?নিরব ভাইয়া কি বলেছে?দেখা হয়েছে?আরও কিছু বলতে নিলে এর আগেই ঠাস করে থাপ্পড় মা’রে রিহান।ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের করে দরজা আটকে ফেলে ভিতর থেকে।
–রিফা:এগিয়ে এসে কাঁপা কাঁপা হাতে নিরুকে আগলে ধরে।নিরু এখনো স্তব্ধ হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে।বুঝতে পারছে না ঠিক কি হয়েছে?বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তো এমন ছিলো না?চোখ দিয়ে আপনা আপনি কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।এমন দিন কেন বারবার ফিরে আসে? যা হজম করার ক্ষমতা উপর ওয়ালা দেয় নি এমন দিন কেন দেয়?কেন এমন পরিস্থিতি তে ফেলে।মনে মনে এই কথা গুলোই চিন্তা করে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে