নৈশব্দে নিরুপমা পর্ব-০৪

0
26

#নৈশব্দে_নিরুপমা
[৪]
-তামান্না

–তারপর মিথ্যে হিংসা প্রতিশোধ সব ভুলে যায় রিহান।বাবা মায়ের মুখে ও শুনতো নিরুর প্রশংসা।সবাই উৎসাহ দেখালে ও নিরবের ভালো লাগতো না।
একের পর এক দোষ তুলে ধরে নিরুর।প্রতি নিয়ত এটা ওটা বলতে শুরু করে।নিরুপমার সাথে পাড়ার দুই তিন জনের সাথে প্রেম এটা ওটা অনেক কিছু।আস্তে আস্তে প্রতিশোধের নেশা বাড়িয়ে দেয়।তবে ক্ষতি করার মতো সাহস পেতে গোটা এক মাস সময় লাগে।বন্ধুরা সবাই বারণ করলে ও নিরবের কথায় এগিয়ে যায় রিহান।কথায় বলে সৎ সঙ্গে স্বর্গ বাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।আর এই অসৎ সঙ্গী একজন হলেই হয়ে যায়।

–সেদিন নিরব লাস্ট কলে এটাই বলেছিল হাতে নাতে নিরুকে এক ছেলের সাথে ধরা হয়েছে আর সেই প্রমাণ ওর কাছে আছে।ব্যস রিহান ঘৃণায় রাগে অঘটন টা ঘটানোর প্ল্যান করে।
প্রথমে এগিয়ে যায় নিরুপমার কাছে আর পিছনে আমান ভিডিও করে।যদিও নিরুপমা নিজের সম্মান রক্ষার্থে রিহান কে কাছে ঘেঁষতে দেয় নি। রিহানের সাথে ধস্তাধস্তি করে এক পর্যায়ে বের হয়ে যায়।
তবে ভিডিও তো পিছন দিক থেকে করা তাই এতো কিছু বোঝা যায় নি।নিরুপমা চলে যেতেই আমানের থেকে ফোন টা নিয়ে নতুন নাম্বার দিয়ে নিজের বাবার ফোনে রিহান নিজেই ভিডিও টা সেন্ড করে।ঠিক এক ঘন্টার মধ্যে সবার কাছে পৌঁছে দেয় এবং যায়।তারপর সিস্টেম করে অফিসের মিনি প্রজেক্টরে সেট করে দেয়। যার ফলে সবাই দাঁড়িয়ে দেখতে পারে।
তারপর কি হলো তা তো প্রথমেই দেখতে পেলেন।

–নিরুপমা সব কিছু গুছানো শেষ হলে নিশা কে নিয়ে বের হয়।মুখে মাস্ক পড়ে নিয়েছে।আজকেই শেষ নিজের শহর ঘুরবে তারপর আসা হবে কি না জানা নেই।চলে যাওয়ার আগে হলেও এ শহরের ধূলো তে পা রাখতে চায়,,ব্যস্ত রাস্তা এবং পরিবেশ ভালো করে ধারণ করে নিয়ে যেতে চায়।যেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে থাকে।স্মৃতি গুলো প্রখর হলেই তো বেশিদিন মনে থাকবে।
–নিরু:হ্যালো!তুই কি অবসর আছিস নীলা?কলেজে আসতে পারবি?
–নীলা :এই অবেলায় কলেজে কেন?
–নিরু:আয় না একটু।আমি আর নিশা এসেছি,, কালকেই চলে যাচ্ছি ভোরে।
–নীলা :দশ মিনিট অপেক্ষা কর আসছি আর আমি কোচিংয়েই আছি।স্যার কে বলে আসছি। বিকেল বেলা কলেজটা একদম নিরব থাকে।তবে কেন জানি নিরুপমার কলেজের এই নিরবতা ভালো লাগে না।
ছাত্র ছাত্রীদের হৈ হুল্লোড় খেলাধুলা আড্ডা মানুষ এসবেই যেন প্রাণবন্ত লাগে কলেজ।

–আচমকাই বৃষ্টি আসার আভাস পাওয়া যায়।চারপাশে অন্ধকার হালকা বাতাস এবং মেঘের গর্জন শুরু হয়।কলেজটা ও ফাঁকা।যেসব স্যাররা কোচিং করান মাঠের শেষ প্রান্তের ছোট ভবন টাতেই করায়।তাই নিরুপমাদের দিকটাই মানুষ নেই।
–নিশা:চল বারান্দায় দাঁড়ায়,, বৃষ্টি শুরু হচ্ছে।
–নিরু:হাতে থাকা পার্স আর মোবাইল টা নিশার হাতে দিয়ে বলে,, শেষ দিন এই শহরের বৃষ্টি ও বোধহয় আমায় ছুঁতে চাচ্ছে।ভীষণ মিস করবো কলেজ আর স্কুল থেকে বৃষ্টি তে ভিজে বাড়ি ফেরা দিন গুলো।তাই আজকে এতো সুন্দর সুযোগ হাত ছাড়া করতে চাই না।তারপর দৌড়ে মাঠে চলে যায়। পড়নে কালো বোরখা আর গোল্ডেন কালার হিজাব।ভিজলে ও বোরখা পড়ায় বেশি খারাপ দেখাবে না।

–নীলা কোচিং থেকে স্যারকে বলে বের হয়।বৃষ্টি আসবে বলে দৌড়ে মাঠের এই দিক টাই চলে আসে।মাঠের ঐ পাশটায় দেখতে পায় রিফাত নিরব আমান রিহানরা বসে আছে।নীলা কে ছুটে আসতে দেখে নিরব বলে,, কোনো ছেলের পিছনে ছুটছো নাকি?
–নীলা থেমে যায়।অলরেডি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। তারপর সোজা বারান্দায় উঠে নিরবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,,আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কুৎসিত মনটা পড়বেন।আর বাইরে মেয়ে কে টিজ করার আগে অবশ্যই নিজের মা আর বোনের চেহারা টা মনে করবেন।দেখবেন আপনা আপনি আপনার লাগামহীন মুখ কন্ট্রোল হয়ে গেছে ।

–নীলার কথায় আমান আর রিফাত মুখ টিপে হাসে।আর রিহান ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।

–নিরব:উঠে দাঁড়িয়ে আঙুল উঁচু করে বলে বেশি বাড় বাড়লে বান্ধবীর মতো মুখ থুবড়ে পড়বে।
–নীলা :আপনি আমার কচু করবেন বলে বৃষ্টির মধ্যেই দেয় এক দৌড়।

–রিফাত:ভালো কথা মনে হলো।নিরব তোর তো নিরুর সাথে ধরা পড়া ছেলের ছবি দেখানোর কথা।কই দেখালি না তো?
–নিরব:ভয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলে,, সে দেখে কি করবি?ঝামেলা হওয়ায় ফোন থেকে কেটে ফেলেছি।
–রিহান :ভয় পাচ্ছিস নাকি?আমি কিন্তু তোর কথায় কোনো সত্যতা এখন অব্ধি পায় নি।
–নিরব:বাদ দে ইয়ার।এসব দেখে আর কি করবি,, সব তো শেষ হয়েই গেছে।

–আমান:শুধু কি শেষ হয়েছে?সাথে অনেক কিছুই হয়েছে।

–রিফাত :চল ফুটবল খেলা যাক।তারপর সবাই মিলে একমত হয়ে হৃদয় কে বসিয়ে ফোন গুলো দিয়ে মাঠে নেমে পড়ে।

–এদিকে নিরুপমা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে মাথা নুয়ে বসে আছে।দূর থেকে নীলা নিরুকে দেখে ব্যাগ আর ফোন নিশার হাতে দিয়ে চলে আসে। নিশা বসে বসে গেইম খেলতে থাকে।

–নীলা :নিরু?
–নিরু:উঠে এসে হাত দিয়ে মুখের পানি মুছে বলে চলে যাবো।তাই শেষ মূহুর্তে বৃষ্টির লোভটা সামলাতে পারি নি।
–নীলা:চল বলে হাতে ধরে সামনে এগিয়ে বলে,, তোর আর আমার শেষ কলেজ ঘুরা এক সাথেই হোক।এরপর আমিও আর কলেজ বৃষ্টি অবসর আড্ডা এসবে থাকবো না।পরীক্ষা দেওয়া শেষ হলেই চলে যাবো।তোর শূন্যতায় আমি ও ভালো থাকবো না।
–নিরু:এবার নিরু দাঁড়িয়ে কান্না করতে থাকে। তবে বৃষ্টির পানির সাথে সব ধুয়ে যাচ্ছে।
–নীলা :মন খারাপ করিস না।দেখবি ভালো সময় আসবে। মাঝে মধ্যে বেড়াতে আসিস।
–নিরু:এটা বোধহয় আর হবে না রে।তারপর নিরব আর ওর আব্বুর কাহিনি বাড়ি ছেড়ে যাওয়া সব কিছু খুলে বলে।

–রিহানরা খেলার জন্য এই পাশে চলে আসে। দূর থেকে নীলা আর নিরুকে দেখতে পায়।
–রিফাত:এই অবেলায় এরা বৃষ্টি তে ভিজে কেন? আর নিরু ও এ সময়?
–নিরব:দেখ গিয়ে বোধহয় কোনো কু*কর্ম করতে এসেছে এই সময়।
–রিহান:মাঝে মধ্যে একটু বেশিই বলিস।আর মাইন্ড একটু নোংরা মুক্ত রাখার চেষ্টা করবি।নিরব দাঁতে দাঁত চেপে কোনো রকম সয্য করে।
–রিফাত:বাদ দে।খেলতে এসেছি খেলতে চল।

–নীলা :রিহান কলেজেই আছে।
–নিরু:বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে বলে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে নীলা।প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকা যুদ্ধ মনে হচ্ছে।আমি এভাবে একলা হতে চাই নি।এর থেকে খারাপ আমি কখনো থাকি নি।আমার বাঁচতে কষ্ট হচ্ছে স্মৃতি কন্ঠ চেহারা প্রতিনিয়ত ধাওয়া করছে।কথা গুলো বলতে বলতে হেঁচকি উঠে।
–নীলা:একদম ভেঙে পড়বি না।ওদের উপর সঠিক বিচার উপরওয়ালা ঠিক করে নিবেন।
–নিরু:এটা আমি কখনো চাই না।আমি চাই সে ভালো থাকুক।আমি তার কখনো ক্ষতি চাই না মৃত্যু চাই না।দূরে থেকে তার বেঁচে থাকার গন্ধ শুনতে চাই নিশ্বাস শুনতে চাই।সে আমার হোক সেটা ও চাই না তবে চাই সে বেঁচে থাকুক।তারপর আবার আমাদের দেখা হোক সেদিন তার চোখে অনুতাপ অনুশোচনা আমি নিজের চোখে দেখতে চাই।
–নীলা:চল।জ্বর চলে আসবে।নিরু সামনে তাকাতেই রিহানদের দেখতে পায় তাই চুপচাপ চলে যায় এখান থেকে।

–নিরু:তুই বস নিশা আমি আর নীলা ঐদিক টাতে যাই।বৃষ্টি থামলেই বাড়ি ফিরবো।
–নিশা:আম্মু বকা দিবে কিন্তু।এখানে দাঁড়াও আমার সাথে। নিরু ধমক দিয়ে চলে যায়।

–নিরুদের চলে যেতেই রিহান নিশার কাছে আসে।
–রিহান :কি অবস্থা নিশা?আজকাল তো তোমার দেখায় যায় না?
–নিশা:আপনি এমনটা করতে পারলেন রিহান ভাই?আমার বোন কিন্তু ভীষণ কষ্ট পেয়েছে।এরপর আমাদের যাওয়ার আশা করেন?
–রিহান :অন্য দিকে তাকিয়ে বড় করে নিশ্বাস নিয়ে বলে,, বাদ দাও এখানে কেন?একা এসেছো?
–নিশা:আপু এসেছে।কালকে চলে যাচ্ছি আমরা।আর আসা হবে কি না জানা নেই।
–রিহান:কোথায় যাচ্ছো?আর বাড়ি ছেড়ে কেনই বা যাচ্ছো?

–নীলা :চলে আয় নিশা।নিরু চলে যাচ্ছে।
–নিশা:আমি যাচ্ছি রিহান ভাই ভালো থাকবেন আর দেখা হবে কি না জানা নাই।

***********
–ভোর ছয় টায় রওয়ানা দেয় নিরুরা।ট্রেনে করে যাচ্ছে।শখের জিনিস বা শখ গুলো এমন আচমকা পূরণ হয় তখন আর শখ মনে হয় না মনে হয় পরিস্থিতি।কতো দিনের শখ ছিলো ট্রেন জার্নি করবে এবং জানালার পাশটায় বসে উপভোগ করবে সবটা।
আজকে তা হচ্ছে ও কিন্তু উপভোগ করার মতো আর শখ কিংবা সুখময় অনুভূতি আর নেই।
–ভীষণ কান্না পাচ্ছে,, বুক ফেটে যাচ্ছে।যতই সামনে এগোচ্ছে ততই বুকের ব্যাথাটা দীর্ঘ হচ্ছে।
আসল জীবন সোনালী সময় ছেলেবেলা সব কিছু ত্যাগ করে যাচ্ছে।
–নিশা:মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,,আব্বু একা হয়ে গেলো আম্মু।আর কেউ রোজ করে কথা বলার জন্য কবরের পাশটায় দাঁড়াবে না।
–নিরু:এতো ভাবছো কেন?আব্বু আসল জায়গায় আছে যেখানে জীবন বাস্তবতা পরিস্থিতি কিছুই নেই।বিশ্বাসঘাতক ও নেই। আম্মু দুজনকেই জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেয়ে বলে তোমরাই আমার জীবন।তোমাদের সফলতা দেখতে পারলেই আমার জীবন সার্থক।

–আব্বু :সব কিছু ওকে কালকে রাত তিনটের ফ্লাইট।
–রিহান:আচ্ছা!
–আম্মু :কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,, আগের থেকে অনেক টা শুকিয়ে গেছো।তোমায় ছেড়ে থাকতে হবে ভাবি নি।
–রিহান:আমরা যা ভাবি সব সময় কি তা হয়?
–আব্বু :নিরুরা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।আর বাড়ি ওর চাচারা দখল করে নিয়েছে।জীবন কতো কঠিন কখনো কি ভেবেছে রহিম তার মেয়েরা বাড়ি ছাড়া হবে।
–আম্মু :নিরবের বাবারা শেষ পর্যন্ত সফলই হলো।তবে এতে সর্বোচ্চ দোষ তোমার ছেলের। রিহান চুপচাপ উঠে চলে যায়।

–রিফাত :আসল কাহিনি শোনা হয়েছে রিহান?
–রিহান:কি কাহিনি? কি হয়েছে?
–রিফাত :নিরব তার প্ল্যান সম্পর্কে সব কিছু শেয়ার করেছে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রিমনের সাথে।সে ইচ্ছে করেই সবটা করেছে।তার সাথে পারিবারিক সমস্যা ছিলো নিরুদের।তারপর সব কাহিনি খুলে বলে।
রিহান চোখ বন্ধ করে চুপচাপ সব কথা শুনে।দুই দিন যাবত এটাই আন্দাজ করছিল।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে