নবপূর্ণিমা পর্ব-২+৩

0
35

#নবপূর্ণিমা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ২ + ৩

ভোরের আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে। রিমঝিমের ঘুম ভাঙলো কারো ধাক্কাধাক্কিতে। সে তড়িঘড়ি করে চোখ খুলতেই হঠাৎই চারপাশটা চিনে উঠতে একটু সময় লাগে। নিজেকে আবিষ্কার করে ব্যালকনিতে।

রাতে গ্রিলের সঙ্গে মাথা রেখে হয়ত কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল সে খেয়াল নেই। ভেজা চোখ, ক্লান্ত শরীর আর গুমোট অভিমান হয়ত ঘুমের দিকে টেনে নিয়েছিল।

গ্রিলের কাছে মাথা রেখে ঘুমানোর ফলে কান ধরে ওঠা ব্যথা যেন মাথার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, তবু সে সেই ব্যথাকে পাত্তা না দিয়ে পাশে তাকায়।
সালমান দাঁড়িয়ে আছে, চোখেমুখে বিরক্তি ফুটে আছে স্পষ্ট।
রিমঝিমকে উদ্দেশ্যে করে ঠাণ্ডা গলায় বলে ওঠে,
“আমার অফিস টাইমও তো দেখি ভুলতে বসেছো। বলেছি না, আজ মিটিং আছে? খালি পেটে যেতে হবে দেখছি!”

রিমঝিম হকচকিয়ে ওঠে। তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায়, মুখে কথার আগা-গোড়া গুছিয়ে বলার আগেই বলে ওঠে,
“আসলে রাতে…”

কিন্তু সালমান তার কথা থামিয়ে দিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে,
“উফফ, তোমার সেই রাতের ড্রামা শুনতে ইচ্ছে করছে না এখন। আপাতত আমার খাবার চাই।”

এই কথাটা রিমঝিমের বুকে যেন কাঁটা হয়ে বিঁধে যায়। সে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। তবু মুখে কিছু না বলে নিজেকে সামলে নিয়ে নিচু স্বরে বলে,
“তুমি একটু অপেক্ষা করো… আমি কিছু বানিয়ে নিয়ে আসছি।”

তার গলার কম্পন সালমান হয়ত শুনতেই পায়নি! সে কাপড় নিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমের দিকে ,আর রিমঝিম হৃদয়ে জমে থাকা অগণিত অপমানের ভার নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।
আজ সকালটাও বুঝিয়ে দিল -এই সংসারে ভালোবাসার জায়গা তার জন্য বরাদ্দ নেই। তবু তার নিয়ম করে প্রতিদিনের ন্যায় খাবারের হাঁড়িতে পানি ঢালতে হবে,কারণ – এখানে কান্নার চেয়ে পেট ভরানোটা অনেক বেশি জরুরি।

রিমঝিম চুপচাপ রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
শরীর ক্লান্ত, মন ভাঙা, কিন্তু হাত থামলে সংসার থেমে যাবে –
এই ভয়টা এতদিন ধরে পেয়ে এসেছে।

কিন্তু রান্নাঘরের চৌকাঠ মাড়াতেই হালিমা বেগমের কণ্ঠ যেন বজ্রাঘাতের মতো আঘাত হানলো তার কানে,
“মহারানীর অবশেষে ঘুম ভাঙলো বুঝি! আমার ছেলেটার অফিস আছে আর সে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। এখন রান্না করবে কখন? আমার ছেলেটা ক্ষুধার্ত পেটে অফিসে যাবে, এই তো অবস্থা!”

শাশুড়ির কথায় এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস আটকে গেল রিমঝিমের। কথাগুলো মাথার মধ্যে গুঁড়ি মেরে থাকা আবেগগুলোকে জাগিয়ে তুললো।
আজ আর সে নীরব থাকলো না। চোখেমুখে জমে থাকা অভিমান, অপমান আর ক্লান্তির ছাপ নিয়ে স্পষ্ট কণ্ঠে কড়াভাষায় বলে উঠল,

“আপনার ছেলের দায়িত্ব কি শুধু তার বউয়ের? আপনি তো তার মা! শুনেছি, বউয়ের চেয়ে মায়ের দায়িত্ব আগে। আমি না এলে আপনি করে দিতে পারতেন না?”

মুহূর্তে ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। হালিমা বেগম যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না নিজের কানে। একটু থমকে দাঁড়িয়ে রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বোঝায় যাচ্ছে, রিমঝিমের মতো নরম মেয়ের কাছ থেকে এমন হুট্ করে জবাব আশা করেননি উনি।

দীর্ঘক্ষন পরে হুঁশ ফিরতেই হালিমা বেগম মুখ ভেংচিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন বিলাপের সুরে,
“এই মেয়ে এখন আমার মুখে মুখে তর্ক করে! বাড়ির বউয়ের আওয়াজ থাকার কথা ঘরের ভেতরে, সে এখন রেঁধে খেতে শেখার বদলে আমাকে শেখায়!”

রিমঝিম শীতল গলায় জবাব দিল,
“আমার আওয়াজ বাইরে যায়নি আম্মা। আপনার আওয়াজই তো পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে।”

হালিমা বেগম থেমে গেলেন। নরম মেয়ে হুট্ করে এমন শক্ত হয়ে উঠাটা তিনি মেনে নিতে পারলেন না।

রিমঝিম আর কোনো কথা বাড়াল না। চুপচাপ পা টেনে রান্নাঘরে চলে গেল। কিন্তু আজ তার ভেতরের নীরবতা আর আগের মতো নিষ্ক্রিয় না, বরং যেন তাতে জমাট অভিমান আর একটা দৃঢ় সিদ্ধান্ত জন্ম নিয়েছে।
এইভাবে আর নয়। যে ক’দিন আছে, নিজেকেই ভালোবাসবে। নিজেকেই গুরুত্ব দেবে।

রিমঝিম হাতে তুলে নিল সবজিগুলো। দুয়েকটা মেনু নয়, বরং সে আজ কয়েক পদ রান্না করলো।
নিজের পছন্দের মতন, যত্ন করে, সময় নিয়ে।
সে জানে, এই ঘরে তার কথা কেউ ভাবে না।
তাই এবার সে নিজেকে নিয়েই ভাববে।

রান্না শেষ করে, সালমানের জন্য খাবার সাজিয়ে দিল।
সালমান গম্ভীর মুখে এসে বসলো।vঅফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে আর কাউকে ডাকলো না সে। এমন কি হালিমা বেগমকেও না।
চুপচাপ তাড়াহুড়োয় সে খেতে লাগলো।
না কোনো অভিযোগ, না কৃতজ্ঞতা।
শুধু নিজেরটা বুঝে নেয়া,এটাই যেন তার অভ্যাস।

রিমঝিম একটুও পাত্তা দিল না এই নীরব প্রতিক্রিয়াগুলোকে। সালমান খেয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যেতেই রিমঝিম চুপচাপ নিজের প্লেট নিয়ে টেবিলে বসে পড়লো।
ধীরে ধীরে আয়েশী ভঙ্গিতে খেতে খেতে একসময় হালকা একটা ঢেকুর তুললো। শরীর একটু শান্তি পেলেও, মন ততটা না।bতবু একটা গভীর প্রশান্তি তার চোখে মুখে – নিজের হাতে রান্না করে, নিজের জন্য খাওয়া – সেই অধিকারটুকু আজ সে ছিনিয়ে নিয়েছে।

ঠিক তখনই হালিমা বেগম ধীরে ধীরে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। চোখে তীব্র কৌতূহল আর অভিমান।
দীর্ঘ সময় কেউ না ডাকায় তিনি নিজেই আজ আগবাড়িয়ে বের হলেন।
আর বেরিয়ে দেখলেন- রিমঝিম টেবিলে একা বসে খাচ্ছে।
আর নিজের মতো করেই সন্তুষ্টিতে ঢেকুর তুলছে।
হালিমা বেগম আশেপাশে দৃষ্টি দিলেন। ছেলে তার কোথাও নেই। তার মানে! সালমান আজ একা একা খেয়ে বেরিয়ে গেছে! তাকে একবার ডাকলোও না!
তিনি আপন ভাবনায় মশগুল হলেন, তার ছেলেকে এই মেয়ে রাতে কিছু করেনি তো? নাহয়, সকালে উঠে এতো ফটর ফটর করে কোন সাহসে! বিয়ের এই দুইবছর তো কোনোদিন চোখ তুলে কথা বলেনি – সেই মেয়ে আজ এতো কথা! তার উপর, ছেলে আজ তাকে একটাবার খাওয়ার জন্যও ডাকলো না!
এসব ভেবে মনের মধ্যে ছেলের উপর অভিমান আসতেই মুহূর্তে তিনি ক্রোধে ফেটে পড়লেন। এতো সহজে তার মা ভক্ত ছেলেকে ঐদিকে নিতে দেওয়া যাবে না। আসুক আজ সন্ধ্যায়। আপাতত এখনেরটা দেখা যাক।

হালিমা বেগম এগিয়ে গেলেন। তাদের চোখাচোখি হলো।
কিন্তু আজ রিমঝিম চোখ সরিয়ে নিল না। সে আপনমনে খেতে ব্যস্ত। চোখের ভাষায় যেন স্পষ্ট বলে দিল –
“এবার আমি আমার মতো করে বাঁচবো।”

হালিমা বেগম ধীরপায়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে এলেন।
রিমঝিম তখনো নিজের প্লেট থেকে শেষ খাবার তুলছে মুখে।

হালিমা বেগম চেয়ারে বসে পড়েই বলে উঠলেন,
“কাল এই বাড়িতে তামাশা কম হলো নাকি! আর তুমি আজ দেখি আগে আগে খেয়েও নিচ্ছো! যাও তো, আমার নাস্তা আনো দেখি!”

রিমঝিম মুখে শেষ গ্রাসটা গিলে নিয়ে শান্ত স্বরে শুধালো,
“কিসের নাস্তা?”

“মানে? আমি খাবো না?” -চোখ কুঁচকে উত্তর দিলেন হালিমা বেগম।

রিমঝিম মৃদু হাসলো, কিন্তু সে হাসির নিচে চাপা পড়া অভিমানটা স্পষ্ট।
“আপনি খাবেন?”

“কী বলতে চাইছো তুমি? আমার সাথে মশকারা করছো তুমি?”

রিমঝিম এবার স্পষ্ট গলায় বলল,
“কাল রাতে আপনি আমাকে খেতে দেননি। এমনকি ইঙ্গিতে বলেছিলেন, আমি নিচু জাত। তাহলে সেই নিচু জাতের রান্না করা খাবার খেলে তো আপনার গায়ে লাগতেও পারে! তাই, আপনার কথা ভেবেই আজ আপনার জন্য কিছু বানাইনি, আম্মা।”

হালিমা বেগম থ হয়ে গেলেন। এমন কথা শোনার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রাগে আবার মুখ খুললেন,
“বাড়াবাড়ি কইরো না। যাও, আমার খাবার দাও।”

রিমঝিম এবার আর একচুলও সরলো না। চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“আপনি কি অসুস্থ আম্মা?”

“মানে?”

হালিমা বেগমের প্রশ্নে রিমঝিম স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দেয়,
“আপনার তো হাত-পা দিব্যি সবল আছে, আম্মা। নিজের জন্য কাজ করুন। কারণ যখন বয়স হবে, আর হাত-পা অবশ হয়ে যাবে – তখন কেউ এসে থালায় সাজিয়ে খাওয়াবে না। তখন আপনার এই অহংকারও আপনাকে ভাত তুলে দেবে না।”

এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এলো টেবিলে। রিমঝিম প্লেট নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

রিমঝিম চেয়ারে বসেই একবার তাকালো হালিমা বেগমের দিকে। নিজেকে ছোট করে আর কারো অহংকারের খাদ্য হতে দেবে না সে।
সে প্লেট নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে উঠল,
“যাকে আপনি ছেলের বউ করে আনতে চাইছেন, সে ভুল করেও কখনো কোনো অচল মানুষকে টেনে বাঁচাবে না, আম্মা। আপনার শরীর যদি একদিন চলতে না পারে, তখন সে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে।”

হালিমা বেগম বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। মুখে কোনো শব্দ নেই।

“আমি সব জানি। আপনি যা লুকিয়ে রেখেছেন, তা অনেক আগেই জেনেছি। চিন্তা করবেন না, এই অসুস্থ পরিবেশে আমি আর বেশিদিন থাকবো না। আপনার উদ্দেশ্য সফল হোক, এটাই চাই। ততদিন… দয়া করে আমাকে আমার মতো থাকতে দিন। নাহয়, আমি অন্য ব্যবস্থার সাব্যস্ত হবো।”
কথাটা বলেই রিমঝিম ধীরে ধীরে টেবিলে রাখা বাকী খাবার প্লেটে তুলে নিল।

হালিমা বেগম চেয়ারে বসা অবস্থায় ঘামলেন। নীরবতার ভেতর চামচের আওয়াজও তখন যেন তার কাছে কর্কশ মনে হচ্ছিল।

রিমঝিম সব গুছিয়ে নিজের প্লেট নিয়ে সে রুমের দিকে এগিয়ে গেল। পিঠ সোজা, চোখে জল নেই, কিন্তু বুকের ভেতর কষ্টটা জমে জমে শক্ত হয়ে উঠেছে।
নিজেকে সে আজ একটু বেশিই ভালোবাসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

‘সবসময় নরম থেকে জীবন চলে না।
কারো সম্মানের জন্য নিজের অপমান মেনে নেওয়া দুর্বলতা নয়—কিন্তু বারবার একই জায়গায় নিজেকে হারানোটা বোকামি।’

হালিমা বেগম চুপচাপ রিমঝিমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
রিমঝিমের হেঁটে চলে যাওয়া, দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ,সবকিছু যেন এক অলিখিত চাবুক হয়ে এসে আঘাত করলো তাঁর গায়ে।

সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছিল ঘরের কোণায়।
রিমঝিম একা বসে ছিল টেবিলের পাশে।
চোখের সামনে আচারের বয়ামগুলো সারি করে সাজানো।
একটা একটা করে ঢাকনা খুলে যাচ্ছিল আর একটা একটা থেকে চামচ তুলে মুখে দিচ্ছে। লেবুর আচার, আমের আচার, ঝাল কুল, আর নিজের হাতে বানানো মিষ্টি টক জাম। সবগুলো থেকে পরপর চামচ মুখে পুরে তৃপ্তির সহিত ঢেকুর তুলছে।
সে নিঃশব্দে আপনমনে খেয়ে যাচ্ছে।
“চলে যাবো যখন,আমার হাতে বানানো কিছু দিয়ে অন্যরা মুখ মিঠা করবে, সেটা কেন হবে?”
ভাবনাগুলো কাঁটার মতো খচখচ করছিল বুকের ভেতর। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও সে পরপর আচারভর্তী চামচ মুখে তুলছে।

হঠাৎ…একটা থা’প্পড় এসে সজোরে পড়ে গালে।

তার চোখ কেঁপে উঠল। আচারের একটা বয়াম টেবিল থেকে পড়ে গড়িয়ে গেল। মেঝেতে ঠুকে “টুক” করে একটা শব্দ হলো।
সে ধীরে ধীরে চোখ তুলতেই দেখে সালমান দাঁড়িয়ে আছে। রক্তচোক্ষু দৃষ্টিতে চেহারায় ঘৃণা নিয়ে রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

কিন্তু রিমঝিম কেঁদে উঠল না। চোখ ভর্তি জল নিয়ে চুপচাপ তাকিয়ে রইল। না কোনো প্রশ্ন,না প্রতিবাদ।
শুধু গালে লালচে ছাপটা জ্বালিয়ে যাচ্ছে হাল্কা।
সেই যন্ত্রণার চেয়ে বড় যন্ত্রণা ছিল এই নীরব অপমান – যেটা সে নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম।)

#নবপূর্ণিমা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৩

সালমান গর্জে উঠল,
“তুমি আম্মার সাথে এরকম কেন করেছো?”

রিমঝিম স্থির চোখে তাকিয়ে শুধায়,
“কি করেছি?”

“কী করেছো জানো না?”

রিমঝিম শান্ত গলায় বলে,
“তুমিই বলো, কি করেছি আমি?”

“মায়ের জন্য রান্না করোনি কেন?”

রিমঝিম এবার চোখে একরাশ হতাশা নিয়ে বলে,
“তোমার আম্মা আমাকে খাবার ছাড়া রেখেছে একদিন। আমাকে নিচুজাত বলেছে। মুখে মুখে তর্ক করা মেয়ে বলেছে। সেই বেয়াদব মেয়ের হাতের রান্না খেতে তার গায়ে লাগবে না? তাই করিনি রান্না।”

সালমান রেগে গলা চড়িয়ে বলে,
“কি বড়ো মুখ করে সেটা বলছো! লজ্জা করছে না?”

রিমঝিম হালকা হেসে, গলার নিচে আটকে থাকা দীর্ঘশ্বাসটা ঠেলে বলে,
“সব লজ্জা বাড়ির বউদেরই কেন হবে, সালমান?”

সালমান এবার এক ধাপ এগিয়ে এসে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“একদিনেই মুখ বেশি চলছে তোমার।”

রিমঝিম আর চুপ থাকল না। ভাঙা গলায় জেদে ঠাসা সুরে বলল,
“তোমরাই বাধ্য করেছো আমার মুখ চালাতে। খেয়াল করে দেখো – আমি কি আগে এমন করেছিলাম? দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ আর পিছিয়ে যেতে পারে না। তখন সামনে এগোনো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। আমিও আর পিছু হটতে পারছি না।”

রিমঝিমের কথার অর্থ সালমান বেশ বুঝলো। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর একটু নরম হয়ে প্রশ্ন করে,
“বেশি বাড়াবাড়ি করছো না?”

রিমঝিম তৎক্ষণাৎ মুখ ঘুরিয়ে বলে,
“সবসময়ই আমারটাই বাড়াবাড়ি হয়, তাই না? দু’বছর ধরে শুধু দিয়েই গেলাম। অথচ বিনিময়ে তো কোনো মনই পেলাম না।”

সালমান এবার শান্ত গলায় বলে,
“মা তো বয়স্ক মানুষ। একটু বুঝে নিতে পারো না?”

এই একটুকু কথায়, এতক্ষণ কঠিন মুখোশের আড়ালে থাকা রিমঝিম যেন মুহূর্তেই গলে যায়। চোখের কোণে জমে থাকা কষ্ট ফুঁপিয়ে উঠে বেরিয়ে আসে।
সালমান সুযোগ বুঝে রিমঝিমের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, চুপচাপ হাত রাখে রিমঝিমের গালে। তাতেই যেন রিমঝিমের সব ক্ষোভ, অভিমান, গলায় আটকে থাকা কান্না ঝরে পড়ে।
ভেজা গলায় রিমঝিম ফিসফিস করে বলে,
“তুমিও আমাকে সবসময় ভুল বুঝো। তুমি অন্তত যদি আমাকে বুঝতে, আমি কখনো এমনটা করতাম না।”

সালমান এবার একটুখানি হেসে আদুরে ভঙ্গিতে বলে,
“সারাদিন অফিস করে এসে এসব টানাপোড়েন আর ভালো লাগে না। তুমি একটু নরম হয়ে মাকে শুধিয়ে দিতে পারো না?”

রিমঝিম চোখ মুছে মাথা নাড়ে,
“চেষ্টা করছি তো, পারছি কই!”

সালমান এবার একটু গভীর হয়ে বলে,
“উঁহু, আরো পারতে হবে। আমি জানি তুমি পারবে।”

বলেই সে রিমঝিমকে আলতো করে বুকে টেনে নেয়।
রিমঝিমও নির্ভরতার সেই ছায়ায় ঢুকে পড়তেই
সব অভিমান, সব রাগ – নিমেষেই গলে পড়ে যায়।

——-

রাতের খাবারটা রিমঝিম ফুরফুরে মেজাজে নিজেই রান্না করেছিল। একে একে টেবিলে সাজিয়ে রেখে সালমানকে ডেকেছিল খেতে। সালমান এসে মাকে ডেকে নিয়ে এলো, তারপর দু’জনেই টেবিলে বসে পড়লো।
সালমান নিজের হাতেই হালিমা বেগমের প্লেটে খাবার তুলে দিল। নিজেও চুপচাপ খেতে শুরু করলো।

কিন্তু হালিমা বেগমের মুখ কঠিন। তিনি ঠোঁট শক্ত করে রেখেছেন। একবারও কোনো খাবার হাতে তুললেন না।
মুখে খাবার তুলবেন না ঠিকই, কিন্তু ছেলের পাশ থেকেও নড়বেনও না।
এই নীরব অনাস্থার মাঝে ছেলের মুখ থেকেও হাসি ঝরে গেল।

এক মুহূর্ত, দুই মুহূর্ত – তারপরই সালমান ধীরে ধীরে মুখ তুলে কড়া চোখে রিমঝিমের দিকে তাকায়। সে দাঁড়িয়ে ছিল একটু দূরে।
সালমান ধীরকণ্ঠে আদেশের ভঙ্গিতে বলে,
“মায়ের কাছে ক্ষমা চাও। এক্ষুনি।”

রিমঝিম কিছুটা বিস্মিত হয়। চোখে বিস্ময়ের ছায়া।
শান্ত গলায় জবাব দেয়,
“উনার হয়ত বদহজম হয়েছে। তাই খাচ্ছেন না। এখানে আমি কেন ক্ষমা চাইবো?”

সালমান এবার খানিক কড়া সুরে প্রশ্ন করে,
“কেন চাইবে তুমি জানো না?”

“না ”

সালমানের কণ্ঠে রাগ বাড়তে শুরু করে। সে কিছু বলবে বলেই মুখ খুলেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে হালিমা বেগম নিজেই বলে উঠলেন,
“থাক বাবা, আমার জন্য তোদের মধ্যে অশান্তি করিস না। আমি পানি মুড়ি খেয়ে রাত কাটিয়ে দিবো।”
তার কণ্ঠে অভিমান, চোখে জল জমে আছে।
সালমান এবার চুপ করে গেলেও দৃষ্টিতে অনুযোগ স্পষ্ট।

সে ধীরে রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে কড়াকণ্ঠে বলে,
“দেখছো? তুমি এখনো বুঝতে পারছো না? তুমি কেন ক্ষমা চাইবে?”

রিমঝিমের কণ্ঠ এবার অনেক শান্ত, অনেক ঠান্ডা। সে নিজেকে সামলে প্রতিত্তর করে,
“আমি কোনো ভুল করিনি যে ক্ষমা চাইবো।ভুল উনি করেছেন। ক্ষমা চাওয়ার হলে উনি চাইবে।”
এরপর একটু থেমে যায় রিমঝিম। যেন নিজের ভেতরেই কিছু ভেঙে যাচ্ছে, তবু গলায় অনুরণিত হয় এক কঠিন সিদ্ধান্তের রেশ,
“তবে, ক্ষমা চাইলে যদি সব ঠিকঠাক হয়… তাহলে আমি চাইতেই পারি। আমি চাই, সব ঠিক হয়ে যাক।”
সে ধীরে হালিমা বেগমের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলে,
“আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি… তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন, মা ।”
এতকিছুর পরেও রিমঝিম ক্ষমা চাইলো। শুধু এক ক্লান্ত মানুষের একটুখানি শান্তির আকুতির জন্য।

এতক্ষণ চুপচাপ থাকা হালিমা বেগম যেন নিজের জয় নিশ্চিত করলেন, তিনি মুখে বিজয়ের ছায়া টেনে নিলেন।
তবু ছাড় দেওয়ার পাত্রী উনি নন। রিমঝিমের কথার প্রেক্ষিতে তিনি মৃদু গলায় তীক্ষ্ণ কটাক্ষে বলে উঠলেন,
“তুমি যেটা করেছো, সেটা অনেক বড়ো ভুল। মায়ের মতো একজন মানুষকে না খাইয়ে রেখেছো। তোমার নিজের মা হলে, এমনটা করতে পারতে?”

রিমঝিম চোখ তুলে তাকায়। নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করে সে। তার গলায় ধ্বনিত হয় একরাশ ব্যথা ও প্রতিবাদ,
“আপনি কি কখনো আমাকে মেয়ে ভেবেছেন, যে আমি আপনাকে মায়ের মতো ভাববো? সামিয়াকে আর আমাকে তো আপনি সবসময় এক কাতারে ফেলেন না। আপনি তো কখনো মা হয়ে আসেননি আমার কাছে—আপনি যদি একদিনও মা হয়ে দেখাতেন, আমি দশদিন মেয়ে হয়ে দেখাতাম। আপনি যদি কিছু না দেন, তাহলে আমার কাছ থেকে কী আশা করেন?”

কথাগুলো শেষ না হতেই আচমকা,
সালমানের দ্বিতীয় চড়টা এসে পড়ে রিমঝিমের গালে।

সব শব্দ থেমে যায়।

রিমঝিম স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে, চোখের কোণে নীরবে ঝরে পড়ে এক ফোঁটা অশ্রু।
সে কিছু বলে না। শুধু মনে মনে একটা চিরচেনা সত্যকে আবার অনুভব করে-
একটুখানি আদর পেলেই ভুলে যেতে নেই।

সে ভুলে গিয়েছিল, মা-ভক্ত ছেলেরা কখনোই একজন স্ত্রীকে সত্যিকার অর্থে ভালো রাখতে পারে না।
তারা বোঝে না, বিয়ের মানে শুধু একজন কাজের মেয়ে বাড়িতে আনা নয়।
তারা ভুলে যায়, বিয়ের পর মা আর বউ—এই দুই জনের দড়ির টান সামলাতে হয় ভারসাম্যে, কাউকে হারিয়ে নয়।
কিন্তু তারা পারে না।
তারা শুধু একপাশ নিজের দিকে রেখে, অন্যপাশটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দেয়।
রিমঝিম জানে, সালমান আবার ক্ষমা চাইবে।
আবার একটু আদর করে বলবে, “ভুল হয়ে গেছে।”
আর আবারও সেই একই কষ্ট ফিরে আসবে।

কারণ, অতিরিক্ত মা-ভক্ত ছেলেরা স্ত্রীকে তার প্রকৃত মর্যাদা কোনোদিনও দিতে পারে না।

আর রিমঝিম?
সে আবারও গলে যাবে সেই একটুখানি মায়ায়, আবারও ক্ষমা করে দেবে।
এটাই তো নিয়ম!
কিন্তু কেন সে পারে না শক্ত হতে?

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে