#নবপূর্ণিমা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৭(অন্তিম)
সালমান দরজায় ঢুকতেই বুঝতে পারলো।
ঘরের পরিবেশ এক অদ্ভুত নীরবতায় মোড়ানো।
ডাইনিং টেবিলের এক কোণে হালিমা বেগম বসে আছেন, মুখটা কুঁচকে, চোখে কেমন একটা দুঃখ আর অভিমান মিশে আছে। তার চোখে চোখ পড়তেই মুখ ফিরিয়ে নেন।
সালমান বুঝে যায়-সকালবেলার ঘটনাগুলো এখনো তার মায়ের মনে গেঁথে আছে। তিনি অভিমান করেছেন, আর আজকের রাতের খাবারটা সেই নীরব অভিমানের সাক্ষী। খেতে বসেও হালিমা বেগম টু শব্দও করলেন না।
সবকিছু যেন বোবা ভাষায় বলছে—“তুমি আজকে আমার হয়ে কথা রাখোনি!”
খাওয়ার পর সালমান এগিয়ে যায়, ধীরে গিয়ে বসে পড়ল মায়ের পায়ের কাছে।
একটু ঝুঁকে আদুরে ভঙ্গিতে ডাক দিলো,
– “মা।”
হালিমা বেগম মুখ ফিরিয়ে নিলেন, কথা বললেন না।
সালমান এবার তার কণ্ঠে কোমলতা মিশিয়ে আবার বলল,
– “মা, একটা কথা বলবো? রাগ করে থেকো না… শুধু শুনো।”
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বলল সে,
– “তুমি জানো? তুমি আমার জীবনের সেরা মা। কিন্তু একটা প্রশ্ন করবো? যেটা তুমি তোমার সময়ে পাওনি, সেটা তুমি অন্য কাউকে দিতে চাও না কেন? তুমি তো বলো, মায়ের মতো কেউ হয় না। তুমি তো নিজে ভালো, কিন্তু কেন নিজের ভেতরে এখনো অতীতের সেই কষ্টের পাথর বয়ে বেড়াচ্ছো?”
হালিমা বেগম চোখ তুলে তাকান ছেলের দিকে। এরপর বেশ রাগীস্বরে শুধালেন,
“বউ এর হয়ে সাফাই গাইতে এসেছিস? এমন কবে হলি তুই?”
সালমান হাসলো। হেসে শুধায়,
“এটাকে সাফাই গাওয়া বলে না মা। সেটা তুমি নিজেও জানো।”
হালিমা বেগম মুখ ফিরিয়ে নিয়ে প্রতিত্তর করে,
“আমি ছোট বাচ্চা না। আমাকে কিছু বোঝাতে আসিস না। আমি রুমে যাবো। ছাড় আমায়।”
সালমান আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো হালিমা বেগমকে। এরপর আদুরে ভঙ্গিতে বলে,
“গল্প তো প্রতিদিনই হয়। আজ নাহয় বাস্তবতা নিয়ে হোক।”
“আমার দরকার নেই। তুই সর।”
সালমান ছাড়ে না। সে তার আগের কথা চালিয়ে যায়,
– “জানি, তুমি অনেক কষ্টে সংসার করেছো। বিয়ের পর দাদু তোমাকে শুধু দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু অধিকার বা ভালোবাসা না। আমি জানি মা, তুমি ভালো থাকতে পারোনি।
কিন্তু তুমি কি সত্যিই চাও, রিমঝিমও তেমনি একটা চাপা রাগ নিয়ে বেড়ে উঠুক? সেও যেন ভবিষ্যতে কারো শাশুড়ি হয়ে বলে—‘আমি পাইনি, ওকে কেন দেবো?’”
সালমান থেমে যায় কিছুক্ষণের জন্য।
তারপর একটু ঝুঁকে মায়ের কোলের কাছে মাথা রাখে।
– “মা, তুমি যদি তোমার কষ্টের চক্রটা এখানেই ভেঙে ফেলো… তাহলে বুঝবে, তুমি শুধু মা নও, তুমি ইতিহাস বদলে দেওয়া একজন নারী। কারণ তুমি সবকিছু বুঝে নিতে পারলে, পরেরগুলোও বুঝে নিতে পারবে। তুমি ভালো থেকো না থেকো, অন্তত পরের কেউ তো ভালো থাকুক।”
সালমানের কণ্ঠের কথাগুলো যেন হালিমা বেগমের হৃদয়ের দেয়ালে ছুরির মতো বিঁধে যায়।
সে চুপ করে যায়, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টিতে একেকটা ঝড় বইতে থাকে।
সে সামনে তাকিয়ে থাকলেও চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার নিজের অতীত—একটা বিষণ্ন, অপমান আর অবহেলার দিনগুলো।
সে মনে করতে থাকে…
তখন সদ্য বিয়ে হয়ে এসেছে হালিমা। শাশুড়ি একটিবারের জন্যও তাকে বউ বলে গৃহে স্বাগত জানায়নি।
বরং রান্নাঘরে ঢুকেই শুনতে হয়েছিল—
“ঘরের বউ যদি কাজে পারদর্শী না হয়, তাহলে তার জায়গা রান্নাঘরের মেঝেতে, সবার পায়ের নিচে।”
প্রতিদিন ভোর হতে না হতেই ঘুম থেকে উঠে কাজ সামলাতে হতো।
একদিন বাবার বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করায় শুনতে হয়েছিল—
“ঘনঘন এতো বাপের বাড়ি কিসের?শোনো মেয়ে, বাপের বাড়ি টারি ভুলে যাও। বছরে একদিনের জন্য গিয়ে ঘুরে আসবে। এতে বাপের বাড়িতে কদর থাকবে। ”
হালিমা তখন হেসে দিতো। তার ইচ্ছে হতো জবাব দিতে যে -বাপের বাড়িতে মেয়েরা কদরের জন্য যায় বুঝি! কিন্তু সেই জবাব মুখ ফুটে দিতে পারতো না। রিমঝিম এখন সেই জবাব মুখ ফুটে দেয়। রিমঝিমের জবাব দেওয়া দেখে তার নিজের অতীত মনে পড়ে বি’ষ ধরে যায় শরীরে।
তারপর বাপের বাড়ি গেলেও, যাত্রার আগের রাতে দুই-তিন দিনের ডাবল রান্না করে রেখে যেতে হতো, প্রতিটা লোকের জন্য আলাদা আলাদা করে।
তবু ফিরে এসে শাশুড়িরকে প্রতিবেশী আর স্বামীকে বলার সময় শুনত—
“সব কাজ আমি একাই করেছি!”
হালিমা বেগমের বুকটা হঠাৎ টনটন করে ওঠে।
সে তখন অসহায় ছিল। কিন্তু এখন?
তার সামনে এখন একজন মেয়ে, যে তার নিজের ছেলের ঘরের বউ।
সেই মেয়েটাকেই সে নিজের শাশুড়ির মতো আচরণ করে ধীরে ধীরে পিষে ফেলছে!
সে নিজে যতটা কষ্ট পেয়েছে, ঠিক ততটাই অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়ার অজান্তেই প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছে!
সে হঠাৎ জ্ঞান ফিরে পাওয়ার মতো চমকে ওঠে।
“আমি কি এতটাই খারাপ হয়ে গেছি…?”
সে ফিসফিস করে নিজের মনে।
তখনই সালমান তার কণ্ঠে একরাশ ব্যথা মিশিয়ে বলে ওঠে,
– “আমরা কি পারি না, মা?আমরা কি পারি না, রিমঝিমকে তোমার মতো অতীত না দিয়ে, একটা সুন্দর অতীত দিতে?
তুমি কি এতটাই স্বার্থপর, মা?”
এই কথাগুলো যেন হালিমা বেগমের ভেতরটা চুরমার করে দেয়। সে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে।
তার ভেতরের কঠিন দেয়ালগুলো যেন একটা একটা করে ভাঙতে শুরু করে।
না, সে আর সেই বিষাক্ত ইতিহাস কাউকে দেবে না।
সে রিমঝিমের ওপর তার নিজের অতীতের রাগ চাপিয়ে দেবে না।
সে জানে, আজ যদি না বদলায়—তবে ভবিষ্যতের আরেকটা হালিমা তৈরি হবে, আরেকটা ছেলের সংসার বিষিয়ে যাবে।
সালমান ধীরে ধীরে মায়ের হাতটা ধরে আদুরে ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
– “আমি যেটা পাইনি সেটা আর কাউকে দেবো না—এটা না ভেবে বরং এটা ভাবো-যেটা আমি পাইনি, তার অভাব আর কাউকে বুঝতে দেবো না। বরং তাকে তার প্রাপ্যটা পূর্ণ করে দেবো, যাতে সে কোনো কষ্ট না পায়।”
একটু থেমে সে আবার বলে,
– “তুমি যদি তোমার শাশুড়ির মতোই হও, তাহলে তোমার আর তার মধ্যে পার্থক্য কোথায়, মা? তুমি তো তারই পথ ধরে হাঁটছো। আর যদি রিমঝিমও এই ব্যথা আর বিষ বুকে জমিয়ে রাখে, তবে হয়তো একদিন সেও তার ছেলের বউয়ের সঙ্গে এমনই আচরণ করবে। তখন তো এই বি’ষ এক বংশের ভেতর চলতেই থাকবে। একবার ভাবো মা, এই পুরো চক্রে ছেলের বউ হয়ে আসা মেয়েটার দোষ কোথায় থাকে?
তুমি যদি স্বার্থপরতা ছেড়ে দিয়ে অন্যের ভালোটা ভাবো তাহলে এই চক্র এখানেই ভেঙে যাবে। তুমি বরং সব রাগ ভুলে গিয়ে সবার জন্য একটা সুন্দর, উষ্ণ সংসার তৈরি করে দাও, মা…”
এরপর থেমে আবার বলে উঠে,
“তুমি কি বুঝতে পারছো না? তুমি নিজের অতীতের সেই বি’ষ ঢালতে গিয়ে নিজের ছেলের ক্ষতি করছো মা! অন্য মেয়ের সংসার মানে তো সেটা তোমার ছেলের সংসার। সেই মেয়েকে যদি তুমি কষ্ট দাও -সেই মেয়ে যদি অসুখী হয় তাহলে তোমার ছেলে কীভাবে সুখী হবে মা! তুমি একটু স্যাক্রিফাইস করো মা।”
সালমানের কথাগুলো যেন হালিমা বেগমের বুকের দেয়াল ভেঙে দেয়।
তার চোখের কোণে জমে ওঠে দীর্ঘদিনের অভিমান, চাপা ব্যথা, আর একরাশ অনুশোচনার জল।
সে বুঝতে পারে, সত্যিই তো -সে তো নিজের মতো করেই ভালো হতে পারত। কিন্তু না… সে তো অবচেতনেই সেই একই পুরোনো বিষকে বেছে নিয়েছে।
শুধু বদলেছে চরিত্র, বদলায়নি মন।
সে তো ভুলে গিয়েছিল—অন্যের সুখ দেখে জ্বলে ওঠা নয়, নিজের কষ্টের শেষ হোক সেইটুকুই সবচেয়ে বড় জয়।
সালমান মায়ের দিকে তাকিয়ে শুধায়,
“তুমি কি আসলেই এতটা খারাপ? মা?
হালিমা বেগম চোখেজল গড়িয়ে পড়ে। আপনমনেই বিড়বিড় করে মৃদু কণ্ঠে বলে উঠে,
– “ না, আমি খারাপ হতে চাইনি। আমি খারাপ না।”
মায়ের চোখে জল দেখে সালমানের খারাপ লাগে। তবু থামলে তার চলবে না। সে মায়ের হাতের উপর হাত রেখে শুধায়,
“আমি জানি তুমি খারাপ নও। কিন্তু সময় আর অভিমান আমাকে এমন বানিয়ে ফেলেছিল…তাই শুধরে নিয়ে ভালো থাকো মা।”
হালিমা বেগম হুট্ করেই বলে উঠলেন,
“তোর বউকে আমি কষ্ট দেবো না। এবার থেকে ওকে মেয়ের মতোই ভালোবাসার চেষ্টা করব…!”
সালমান শান্ত হেসে মাথা হেলিয়ে বলে,
– “এই তো আমার মা…”
ঘরের কোণার বাতি তখনো জ্বলে। ঘরের বাতাসে তখন কোনো অভিযোগ নেই, শুধু একধরনের নরম উষ্ণতা।
বিষণ্ন ইতিহাসের চক্র ভেঙে এক নতুন ভোর আসার ইঙ্গিত দেয়।একটা সম্পর্ক বুঝে ওঠে—ভালোবাসা কেবল অধিকার নয়, দায়িত্বও।
—
সেই মুহূর্তে, বাপের বাড়ির বারান্দায় বসে থাকা রিমঝিম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কানের পাশ থেকে ফোনটা সে নামিয়ে নেয়। এতক্ষন ধরে একটা সুন্দর কথোপকথন শুনেছে সে। এখন আর প্রয়োজন নেই।
ঠিক তখনই সাদা মেঘের ফাঁক দিয়ে হেসে ওঠে এক ফালি পূর্ণিমা।
তার মুখেও ধরা পড়ে এক শান্ত, হালকা হাসি।
এই তো সে—রিমঝিম।
যে এতদিন কেবল বুঝে গেছে, কেবল সহ্য করে গেছে।
আজ বুঝেছে, কখনো কখনো নীরব প্রতিবাদই বদলের প্রথম আলো হয়ে ওঠে।
আজ তার জীবনের আকাশেও এক নতুন চাঁদ উঠেছে।
অভিমানের রাত পার করে
তার জীবনেও আজ—”নবপূর্ণিমা”।
সমাপ্ত।
(উঁহু না, আপনাদের কি মনে হয়! হালিমা বেগম সব বুঝে,ওদের সংসার জীবন সুন্দর হবে তো! নো নেগেটিভিটি, অলওয়েজ বী পজেটিভ। অবশ্যই সুন্দর হবে 💙)