নবপূর্ণিমা পর্ব-০৫

0
25

#নবপূর্ণিমা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৫

রিমঝিম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল গুছাচ্ছিল। ঠিক তখনই সালমান রুমে এসে হঠাৎ বলল,
“তুমি চাইলে আজ বাপের বাড়ি যেতে পারো। কয়েকদিন ঘুরে এসো।”

রিমঝিম থমকে গেল। আয়নার ফ্রেমে ধরা নিজের মুখটা যেন কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। গলায় স্পষ্ট বিস্ময় টেনে সে শুধায়,
“কি বললে? আমি যেতে পারি?”

সালমান চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, একটু দূরে গিয়ে নিজের মতো করে থাকো। তোমারও তো বিশ্রামের দরকার।”

রিমঝিম চুপ করে গেল। এটা সেই মানুষ, যে বিয়ের পর তাকে যেন নিজের ছায়ার মতো আগলে রাখতো -কিন্তু সেটা যত্ন নয়, যেন কোনো দায়িত্বে বাধা। সে কোথাও গেলে আগেই জানিয়ে রাখতে হতো, অনুমতির তালগোল পাকিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে না যাওয়াই ভালো -এই ছিল সালমানের অভ্যেস।
বাপের বাড়ি যেতে চাওয়ার মানেই ছিল অজস্র প্রশ্ন, একরাশ অনিচ্ছা, আর কেবল একদিনের অনুমতি, তাও ‘মা’কে একা ফেলে না যাওয়ার শর্তে।
আজ হঠাৎ নিজে থেকেই যেতে বলছে?
কিছু একটা নিশ্চয়ই আছে… বা নেই। হয়তো আর কিছুই নেই।
রিমঝিম আয়নার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে নেয়। ভেতরে ভেতরে সে জানে, এটা ভালোবাসার স্থানচ্যুতি নয়-মায়ার মুক্তি নয়-এটা একটা সাময়িক ছুটি।

সবকিছুর উর্ধে রিমঝিম ভাবলো, যাবেই। নিজের মনটাকে নতুন করে গুছিয়ে আনার জন্য সময় দরকার। তাই সে শান্ত গলায় বলে,
“ঠিক আছে। আমি যাবো।”

এমন করে হয়তো প্রথমবার-সে কারো অনুমতিতে নয়, নিজের সিদ্ধান্তে হাঁটছে একটা দরজার দিকে।

সালমান ওয়াশরুমে ঢুকে পড়তেই রিমঝিম ধীরে ধীরে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। শরীরটায় এখনও ক্লান্তি ভর করে আছে, তবু কোনো এক অদৃশ্য অভ্যাসের টানে সে হাঁটতে শুরু করল রান্নাঘরের দিকে।

চুলায় হাঁড়ি বসিয়ে তরকারি চড়ে দিল। অন্য হাতে রুটি বানাতে শুরু করল। চুলার আঁচে হাতের রন্ধন আর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া ঘামের বিন্দু -দুটোই একসাথে যেন জ্বলছিল।

এদিকে সালমান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে চারপাশে তাকায়-রিমঝিম কোথাও নেই। রুম ফাঁকা। হালকা অস্বস্তি নিয়ে সে রান্নাঘরের দিকে এগোতেই চোখে পড়ে-রিমঝিম একা হাতে একদিকে তরকারি নাড়ছে, আরেকদিকে বেলনায় রুটি গড়াচ্ছে।
রান্নাঘরের ছোট্ট জায়গাটা ভরে গেছে চুলার তাপ আর মাটির গন্ধে। কিন্তু তার মাঝেই রিমঝিমের মুখে এক অদ্ভুত নীরবতা।
সালমান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হালকা কণ্ঠে বলে, “তুমি এখানে? শরীর তো এখনও ভালো না।”

রিমঝিম তাকায় না। রুটি বেলতে বেলতে চোখ স্থির রাখে মাটির দিকে। তারপর মৃদু একটা হাসি ঝরে পড়ে তার ঠোঁটে।
সালমানের প্রতুৎত্তর করে,
“তাই বলে নিয়ম ভাঙলে চলে?”
শব্দগুলো স্নিগ্ধ, কিন্তু কোথায় যেন ব্যথা গাঁথা।

সালমান তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সেই চিরচেনা মেয়েটা যেন আজ একেবারে অপরিচিত। তার হাসিটাও যেন কোনো অভিমান পেরিয়ে এখন কেবল অভ্যাসে দাঁড়িয়ে আছে।

“এতগুলো খাবার কেন রান্না করছো?” সালমান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

রিমঝিম থামলো। হালকা অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকাল। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল,
“কেন, এগুলো কি আজ নতুন কিছু?”

“মানে?” সালমান কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায়।

রিমঝিম একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলে,
“মানে, আমি যখনই বাপের বাড়ি যেতাম, ততদিনের জন্য রান্না করে হিসাব করে রেখে যেতাম। প্রতিদিনের মতো খেতে যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। তুমি যেন বুঝতেই না পারো আমি নাই।হাহা।”

সালমান চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ।
রিমঝিমের বলা কথাগুলো যেন মাথার ভেতর ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে-প্রতিবার যখন সে বাপের বাড়ি যেত, তখন আগেভাগেই হিসেব করে রান্না করে যেতো।
তাই বুঝি সে চলে যাওয়ার পরেও প্রতিদিন সেই একই স্বাদের খাবার পাওয়া যেত?

একটা পুরনো দৃশ্য আচমকাই স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠল সালমানের চোখের সামনে-

সেদিন সকালে রিমঝিম বাপের বাড়ি চলে গিয়েছে।
রাতে অফিস থেকে ফিরে খেতে বসেছিল সালমান। পাশে বসা মা ধোঁয়া ওঠা পাতিল থেকে চামচে করে একে একে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন তার প্লেটে। নিজেও পরে খেতে বসে পড়লেন।

সালমান প্রথম লোকমাটা মুখে নিয়েই থমকে গিয়েছিল।
এই তো সেই চেনা স্বাদ- যা রোজ প্রতিদিন খায়। অথচ, আজ তো রিমঝিম নেই!
তবে কি মা-ই প্রতিদিন রান্না করতেন? মা তো সবসময় এটাই বলতেন।
তখনো সালমান দ্বিধায় ছিল। মন বলত, রিমঝিম এমন নয়। একটা মুরব্বিকে দিয়ে এভাবে সে মোটেও কাজ করাবে না। সে নিশ্চয়ই রান্না করে, কারণ মেয়েটা কখনো অভিযোগ করেনি, কখনো কৃতিত্ব দাবি করেনি।
কিন্তু মা যখন বলতেন, “প্রায়ই আমি রান্না করি। তোর বউ তো সবসময় পারে না”—তখনও একরকম মায়ের কথা বিশ্বাস করেই নিয়েছিল সে।
শুধু কারণ, সেই সময় তার মনটাও একটু একটু করে রিমঝিমের ওপর থেকে সরতে শুরু করেছিল।

আজ, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সালমান নিজেরই স্মৃতিকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

তার মনে হচ্ছে-রিমঝিমই প্রতিবার, প্রতিদিন নিঃশব্দে এই ঘরটাকে আগলে রেখেছিল।
এমনকি নিজের অনুপস্থিতিতেও, তার জন্য রান্না করে যেত, যেন খাবারের স্বাদে কোনো ফাঁক না থাকে।

এত বছর ধরে সেই খাবারে যে মায়া, যত্ন, ভালোবাসার স্পর্শ সে অনুভব করেছে, সেটা তো কারও আদেশে তৈরি হয়নি।
এটা ছিল একান্ত রিমঝিমের নিরব ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।

সালমানের বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল।
সে চোখ তুলে তাকাল রিমঝিমের দিকে -এক হাতে রুটি বেলছে, আরেক হাতে তরকারি নেড়ে দিচ্ছে।
মুখে হাসি, কিন্তু সেই হাসিতে একটা ক্লান্তির ছাপ।
একটা অপমানিত, অবহেলিত অথচ হৃদয়ভরা স্ত্রীর অসীম সহ্যশক্তির চিহ্ন যেন ফুটে আছে তার চোখে-মুখে।

সালমান আর কিছু বললো না। শুধু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো মনে মনে—
“তাকে আমি কীভাবে দেখেছিলাম এতদিন? যে মেয়েটা নিরবে আমাকে আগলে রেখেছে, আমি তাকেই ভুল বুঝেছি। সত্যিই, আমি মানুষটাকে বুঝতে পারিনি।”

সালমানের মনে হাজারো প্রশ্ন এসে ভিড়ে। সেদিন রাতে তার মাকে জিজ্ঞেস করার দৃশ্যটা চোখে ভেসে উঠে।
সেদিন রাতে খাবার চিবোতে চিবোতে সালমান থেমে গেল। চেনা স্বাদ মুখে এলেও মনটা কেমন খচখচ করছিল। চোখ ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখল মা বসে আছেন, ঠিক আগের মতোই ধোয়া ওঠা পাতিল থেকে খাবার তুলে দিয়েছেন তার প্লেটে।

সালমানের ভুরু কুঁচকে উঠল। কিছু একটা মিলছে না।

সে ধীরে কণ্ঠে শুধায়,
“খুব মজা হয়েছে খাবার… কিন্তু মা, রান্না কে করেছে?”

হালিমা বেগম একটুও না থেমে সোজা জবাব দিলেন,
“আমি-ই তো! এইতো এখনই তো রান্না করলাম। ধোয়া উঠছে,দেখছিস না?”

সালমান চুপচাপ তাকিয়ে রইল। এরপর খানিকটা থেমে আবার বলল,
“কিন্তু প্রতিদিনের মতো একই স্বাদ পাচ্ছি। একটুও হেরফের নেই। এটা কেমন করে সম্ভব?”

মুহূর্তের জন্য হালিমা বেগম থমকে গেলেন। তারপর গলার স্বর কড়া করে বললেন,
“তোর বউ তোরে যা খুশি তাই বোঝায়, আমি বলছি, প্রায়ই আমি নিজে রান্না করি। তাই তো স্বাদ একই পাচ্ছস। তোর বৌ এর প্রতিদিনের কারসাজি তো তোর তো জানাই নেই!”

সালমান তখন তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর না দিলেও আজ হারে হারে সব বুঝতে পারলো। মনে মনে অতীতের পাতা উল্টিয়ে কিছু একটা বুঝতে পেরে তার মধ্যে অনুশোচনা এলো।
সেইসব দিনগুলো, যখন রিমঝিম নিরবে সব দায়িত্ব পালন করতো।
সে বলতো না কিছু, দাবি করতো না কিছু।
তবুও রান্না থেকে শুরু করে ঘর সামলানো-সব কিছুতে ভালোবাসার ছাপ থাকতো।
কিন্তু মা?
তিনি কখনো স্বীকার করেননি,বরং এক ধরনের প্রতিযোগিতা চালিয়েছেন অদৃশ্যভাবে। নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে ছেলের স্ত্রীকে ছোট করতে কোনো কসুর করেননি।

আর সালমান?
সে চুপ থেকেছে। প্রশ্ন করেনি কিছু।চুপচাপ মায়ের কথা বিশ্বাস করেছে। একটা সময়, যখন সন্দেহ হয়েছিল-তখনও স্পষ্ট করে রিমঝিমকে কিছু না বলে মনে মনে কষ্ট পুষে রেখেছিল।
আজ বুঝতে পারছে—সে আসলে ভালোবাসার বদলে অবহেলাকেই পুরস্কার হিসেবে ফিরিয়ে দিয়েছে রিমঝিমকে।
চোখের কোণে একটা দগদগে লজ্জা এসে ভিড় করে।
আর মনে হয়—”আমি নিজেই তো কখনো জানতেই চাইলাম না, কে প্রতিদিন আমার জন্য এই মায়া মেখে রান্না করতো।
আমি যদি একবারও জিজ্ঞেস করতাম, তাহলে কি আজ এতটা দেরি হয়ে যেত?”

সালমান বাস্তবের মধ্যে ফিরে এল। গত রাতের স্মৃতি যেন এক টান দিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনল -তখনও রিমঝিম তার প্রতি যত্নবান ছিল, আর সে? তার চোখে ছিল শুধু অবিশ্বাস আর মায়ের প্রতিটি কথা। আজ, সব পরিষ্কার। আজ সে দেখতে পাচ্ছে—রিমঝিম-ই প্রতিবার নিঃশব্দে দায়িত্ব পালন করে গেছে। কাল ডাক্তার যদি রিমঝিমের মেন্টালি ডিসটার্ব এর কথা না বলতো তাহলে হয়ত সে কোনোদিন ঐভাবে রিমঝিমকে খুঁটিয়ে দেখতোই না!

সালমান ভাবনা থেকে বেরিয়ে রিমঝিমের দিকে তাকায়। রিমঝিম তখন অসুস্থ শরীর নিয়ে একে একে টিফিন বক্সগুলো ভরছে। প্রতিটি বক্সে পরের কয়েকদিনের খাবার হিসেব করে গুছিয়ে রাখছে।

সালমান নরম স্বরে শুধায়,
“তুমি কি সত্যিই প্রতিবার এরকম করতে?”

রিমঝিম সংক্ষেপে বলে,
“হ্যাঁ।”

তারপর আর কিছু না বলে ফ্রিজের দরজা খুলে একে একে বক্সগুলো রাখতে শুরু করে। সালমান তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মলিন শ্বাস ফেলে এগিয়ে এসে রিমঝিমের হাতে আলতো করে স্পর্শ করে,
“তুমি না অসুস্থ? তোমার বিশ্রাম দরকার। এত কিছু করতে যেও না, প্লিজ।”

রিমঝিম একবারও তাকায় না। শুধু শান্ত গলায় বলে,
“তোমার মায়ের জন্য আগামী ক’দিনের খাবার। উনি আর তুমি যেন খাবারের কষ্ট না পাও, এজন্যই করছি।”

ঠিক সেই মুহূর্তে হালিমা বেগম দ্রুত পায়ে এসে হাজির হন রান্নাঘরে।
ছেলেকে বৌয়ের হাত ধরা অবস্থা ময় দেখে তিনি ফুষে উঠেন। চোখে আগুন, কণ্ঠে কটাক্ষের ছোঁয়া ঢেলে চেঁচিয়ে উঠলেন,
“তুমি কেন অসুস্থ শরীর নিয়ে এসব করতে যাচ্ছ? আমার ছেলের সামনে আমাকে ছোট করে দেখাতে চাইছো? যেন আমি কিছুই করি না?”

রিমঝিম ধীরে ফিরে তাকায়, ক্লান্ত গলায় বলে,
“আম্মা, আমি এমন কিছু বলিনি। আর দেখানোর কিছু নেই, আপনি তো প্রতিবার নিজেই এমন করে সব রেখে যাওয়ার জন্য বলতেন।”

হালিমা বেগম ছেলের দিকে এক পলক তাকান। এরপর রিমঝিমের উদ্দেশ্যে তোতলানো কণ্ঠে শুধায়,
“কখন বলেছি এসব করে রেখে যেতে?” এরপর এর প্রতুৎত্তর রিমঝিমকে দেওয়ার সময় না দিয়ে নিজেই বলে উঠলেন,
“আগবাড়িয়ে এসব করে আর ভালো সাজতে হবে না। যেখানে যাওয়ার সেখানে যাও।”

সালমান চুপ করে সব শুনছিল। এই প্রথম, তার চোখে নিজের মা সম্পর্কে এক অনুচ্চারিত প্রশ্ন জেগে উঠলো।
সে কিছু না বলে ধীরে ধীরে সরে আসে রান্নাঘর থেকে।
ভেতরে কোথাও অদৃশ্য কষ্ট খোঁচা দিচ্ছে।

একসময় যে মা’কে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতো, আজ তার প্রতিটি কথায় প্রশ্ন উঠছে।
আর যে স্ত্রীকে কখনো বোঝার প্রয়োজন মনে করেনি-তার নিঃশব্দ দায়িত্ববোধ আজ বুকের গভীরে গেঁথে যাচ্ছে।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে