#নবপূর্ণিমা
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৪
রিমঝিম স্থির দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। তারপর ধীরে ধীরে মুখ তোলে সালমানের দিকে তাকিয়ে বেশ শান্তস্বরে শুধায়,
“তোমার না, বিয়ে করা উচিতই ছিল না। তুমি মায়ের ছেলে হয়েছো ঠিকই কিন্তু এখনো মানুষ হওনি, স্বামী হওয়ার তো অনেক পরের কথা।”
তারপর ধীরে তাকায় হালিমা বেগমের দিকে। বিষাদে ভেজা কণ্ঠে শুধায়,
“আর আপনার উচিত ছিল, আপনার ছেলেকে আজও কোলে করে রেখে দেওয়া। কাউকে জীবনের সঙ্গী বানাতে পাঠানো নয়। বিয়ে করিয়ে বড়ো ভুল করেছেন। আর সেই ভুলের খেসারত আমি দিচ্ছি। আমি আপনাদের অভিশাপ দিচ্ছি না। কিন্তু যেদিন আপনার মেয়ের সাথেও কেউ এমন করবে- সেদিন বুঝতে পারবেন, কতোটা অন্যায় করেছেন একজন মেয়ের সাথে।”
রিমঝিনের কড়া কড়া কথায় হালিমা বেগমের চোখ কুঁচকে ওঠে। তিনি ধমকের ভঙ্গিতে বলেন,
“দেখছোস সালমান? তোর বউয়ের জবান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! কত বড়ো সাহস!”
কিন্তু সালমান চুপ। সে শুধু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে রিমঝিমের দিকে। চোখে বিস্ময়, অপরাধবোধ আর একফোঁটা অনুশোচনা। এই মেয়েটা – যে দুবছর ধরে মুখ বুঝে সহ্য করেছে, সে আজ এতো শক্ত হয়ে গেল কীভাবে?
এক মুহূর্তে তার মনে পড়ে, প্রথম প্রথম রিমঝিম কেমন ছিল ; নরম, নিঃশব্দ, একটু হাসলেই যেন চোখে আলো পড়ে যেতো। আর এখন? মুখে বিষ, চোখে বিদ্রোহ! ওর এই রূপের গড়ন কি তারাই নয়? সে আর তার মা?
সে নিঃশ্বাস ফেলে। কিছু বলার ছিল, কিন্তু কোনো ভাষা খুঁজে পায় না।
রিমঝিম ধীর পায়ে রুমে চলে যায়। দরজা বন্ধ হয়ে যায় উচ্চশব্দে।
হালিমা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সালমান কোনো কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে রিমঝিমের রুমের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। মুহূর্তপরে সে যেন নিজেই নিজের অজান্তে কয়েক পা রিমঝিমের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। কণ্ঠে একটুকরো অনুশোচনা ভেসে ওঠে, “রিমঝিম…”
এইটুকু উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই হালিমা বেগম তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে যান। কণ্ঠে রাগ আর অপমানের ঝাঁজ,
“তুই কি পাগল হইছোস সালমান? তোর ওই বেয়াদব বউকে শাসন করবি তা না করে উল্টো ডাকতে ডাকতে ওর পেছনে যাস? ছেলের বউয়ের কথায় এভাবে নত হইতে হয়?ছেলেমানুষ এমন হইলে চলে না।”
সালমান একদৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মুখে আর আগের সেই চিরচেনা নির্ভরতা নেই, বরং কিছুটা ক্লান্তি আর স্পষ্ট উপলব্ধি।
“তুমি কি জানো, সে বেয়াদব হয়ে উঠেছে কার জন্য? আমরা তাকে বাধ্য করেছি, মা। তুমি,আমি—আমরাই তো ওর নরম মনটাকে পিষে পিষে এমন বানিয়ে দিয়েছি।”
হালিমা বেগম কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সালমান থামিয়ে দেয়।
“সত্যিই তো! ভেবে দেখেছ কখনো? আজ যদি এটা তোমার মেয়ের সাথেও কেউ বলতো—যে, ‘তুই নিচু জাত’—তখন কি তুমি চুপ থাকতে? তখন কি বলতে, ‘বউদের সব সহ্য করতে হয়’?”
কথাগুলো শেষ করেই সালমান ধীরে হেঁটে চলে যায় রিমঝিমের রুমের দিকে।
হালিমা বেগম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। গলা কেঁপে ওঠে। এরপর বিছানার পাশে বসে হঠাৎ করেই মুখ চাপা দিয়ে বিলাপের মতো কেঁদে ওঠেন।
“ওগো আল্লা, এ আমি কী কইরা ফেললাম! ছেলেও আমারে কথা কইতে ছাড় দেয় না…!”
—–
সালমান রুমে ঢুকতেই রিমঝিমকে এক দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। তার চোখে অনুশোচনা। কণ্ঠে এক ধরনের নম্রতা টেনে নিয়ে সে শুধায়,
“রিমঝিম… আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার… ঐরকম রিঅ্যাক্ট করা উচিত হয়নি।”
রিমঝিম ধীরে ফিরে তাকায়। চোখে হতাশা জমাট। কিন্তু কণ্ঠে ক্ষীণ স্থির ঝাঁজ রেখে সে প্রত্যুত্তর করে,
“হিসাব করে দেখো তো? মানুষ ভুল কয়বার করে? এই দুই বছরে তুমি ভুল করছো নিয়ম করে, মাসে নয়—প্রায় প্রতিদিন। তুমি ক্লান্ত হচ্ছ না?”
সালমান ব্যাকুল হয়ে এক কদম এগিয়ে আসে, যেন কাছে গিয়ে বোঝাতে চায়, সান্ত্বনা দিতে চায়। কিন্তু রিমঝিম হাত তুলে থামিয়ে দেয়।
“থাক। আর দরকার নেই। সেই একই নাটক বারবার না করলেও চলবে। তুমি ক্লান্ত না হলেও আমি ক্লান্ত। আমি বিরক্ত, আমি বিদ্ধস্ত। তুমি এখন স্যরি বলবে, তারপর কালকে আবার মায়ের পক্ষ নেবে। আবার বলবে, ‘ক্ষমা করে দাও রিমঝিম’। এসব আর ভালো লাগে না। এবার থামো।”
সালমান স্তব্ধ। কণ্ঠে বিস্ময়ের ছোঁয়া, “আমি নাটক করছি? তুমি এটা বলতে পারলে?”
রিমঝিম কণ্ঠ নামিয়ে ঠান্ডাভাবে বলে, “হ্যাঁ। যদি এভাবে মায়ের আঁচলের নিচে থাকার সিদ্ধান্ত আরো আগে নিতে,তাহলে বিয়ে না করে সেখানেই থেকে যেতে পারতে!” বলেই একটু থেমে দম নেয়। কণ্ঠটা হাল্কা কেঁপে উঠলেও সে নিজেকে সামলে আবার বলা শুরু করে,
“সংসার মানে শুধু বউ নয়, শুধু মা-ও নয়। ব্যালান্স রাখতে হয়, সালমান। প্লিজ এটা বুঝো। আজ যদি তোমার বোনের সাথে এমন কিছু হতো—এক বউ হয়ে তাকে কেউ এভাবে ছোট করতো—তাহলে তুমি ভাই হয়ে এটা কী মেনে নিতে?”
রিমঝিম কথাটা আস্তে বললেও সালমানের মনে হলো ; কথাটার রেশ যেন ঘরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সে চুপ করে রইল।
রিমঝিম আরো কিছু বলতে নেয়ার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতে নিতেই হঠাৎই রিমঝিমের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আসে। সে কপাল চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে মুহূর্তখানেক। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা লাগে।
সালমান বিস্ময়ে ডেকে ওঠে, “রিমঝিম?”
রিমঝিম কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ তার হাঁটু ভেঙে পড়ে যেতে থাকে। সালমান দৌঁড়ে এসে তাকে ধরে ফেলে, “এই! রিমঝিম! কী হলো তোমার?”
রিমঝিম কোনো উত্তর দেয় না। চোখ বুঁজে আসে।
সালমানের কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, “রিমঝিম! রিমঝিম..!”
#চলবে ইন শা আল্লাহ।