ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠা পর্ব-০৪

0
60

#ডায়েরির_শেষ_পৃষ্ঠা
#পর্ব_৪
#সমৃদ্ধি_রিধী

‘আমার জন্ম হয় ২১ই এপ্রিল। এর ঠিক ৭ দিন আগে ১৪ই এপ্রিল আমার বাবা মারা যায়। ওই ১৪ই এপ্রিল আবার ভাইয়ার জন্মদিন। আমার দাদি কখনোই মেয়ে পছন্দ করতেন না। অথচ ওনারই কিন্তু দুই মেয়ে ছিল। তাও মেয়ে ওনার সহ্য হতো না। বর্তমানে নাকি আল্ট্রা করলেও ফিটাসের লিঙ্গ বলা হয় না। কিন্তু আমার জন্মের সময়টায় বলা হতো। আমার আম্মু যখন পাঁচ মাসের প্রেগনেন্ট তখনই জানতে পারেন তাদের পরবর্তী সন্তান হবেন মেয়ে। সেই থেকেই আমার দাদি উঠতে বসতে এই সন্তানকে মেরে ফেলতে বলতেন। কিন্তু আমার বাবা চান নি। ভাইয়ার জন্মদিনের দিন কোনো এক কারণে বাবা বাসা থেকে বের হন। কিন্তু আর জীবিত অবস্থায় বাসায় ফিরতে পারেননি। আমার জন্যই নাকি আমার বাবা মারা যান। হাহ জন্মের সাতদিন আগে থেকেই আমি ভুল করে আসছি। এখনও করছি। কখনোই আমি ঠিক করিনি। দাদি মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ভাইয়া তো আমাকে দেখতেই পারতো না। আম্মু না থাকলে আমাকে অযথাই মারতো। চুল টেনে ধরতো। দুপুরে খেতে বসলে খাবারে পানি ঢেলে দিতো।আবার আম্মুর সামনে স্বাভাবিক চলতো।অবশ্য ভাইয়াও তো ছোট ছিল। দাদির শিখিয়ে দেওয়া কাজগুলোই করতো। এইসবের কারণে তখন থেকেই ভাইয়াকে ভয় পাই। ওকে দেখলেই আমার ছোটবেলার কথাগুলো মনে পরে। ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। ভাইয়া হয়তো মনে করে বাবার মৃত্যুর জন্য জন্ম না হওয়া মেয়েটিই দায়ী।

আম্মু কিন্তু আমাকে ছোটবেলা থেকে খুব স্নেহ করতো। কিন্তু আমাকে সেইভাবে সময় দিতে পারেনি। সকাল আটটা থেকে বারোটা পর্যন্ত স্কুল সামলিয়ে বাসায় আসতো। তারপর দুপুর দুইটা থেকে আবার টিউশানি পড়াত। দাদির খেদমতও করতে হতো। আবার এক্সট্রা টাকা ইনকাম করতে মাঝে মাঝে রাত জেগে সেলাইও করতো। তারমধ্যে যতটুকু সময় পেতো আমাকে বা ভাইয়াকে দেওয়ার ট্রাই করতো। তবে একটা জিনিস, কখনোই আম্মু ভাইয়াকে সেভাবে ধমক দেয়নি, যেভাবে আমাকে দেয়। সবসময় আমাকে চুপ করিয়ে রাখে।
আমার ফুফুরা ইদে ভাইয়াকে গিফট, সালামি দিলেও কখনো আমাকে দিতো না৷ সবসময় কুকুর বিড়ালের মতো দূরছাই করতো। খুব খারাপ লাগতো। তবে এখন আর লাগে না। অভ্যাস হয়ে গেছে।

আজকে আমাকে রুমে পাঠিয়ে দেওয়ার পরও ভাইয়া অনেকক্ষণ চেঁচামেচি করেছে। আমার মধ্যে ভদ্র মেয়ের কোনো লক্ষণ নেই। আমার জন্য একদিন নাকি আম্মুর সম্মান নষ্ট হবে। আম্মু ওকে শান্ত করতেও থাকলো। একবারও ভাবেনি ‘নাহ আমার মেয়ের কাছে যাওয়া উচিত’। হুহ, আমি কারো ভাবনাতেই নেই। কি এক দূর্বিষহ জীবন।

আরেকটা কাজ করেছি, মাহিদ কল করার পরে কেঁদেছি। কেঁদে ছ্যাছড়ার মতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে বলেছি। ছিহ: এতে আমার ওয়েট কতখানি কমে গেল! লোকটা নিশ্চয়ই আমাকে ছ্যাছড়া মেয়ে মনে করছে। আবারও একটা ভুল করলাম। কি দরকার ছিল এমনটা করার! আমার জীবনের নতুন একটা মানুষ হতো, ওর সামনেও আমি পুরা কালার হয়ে গেছি। ছিহ’

কলমের খসখস শব্দ থেমে গেল। অহমির চোখে পানি চিকচিক করছে। মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। সে লিখাগুলোর নিচে লিখলো ‘অহমিকার ডায়েরির নবম পৃষ্ঠা।’ ডেট দিলো ২৬ই মে (ঘটনা ২৫ই মে)। কারণ ডায়েরিটা রাত ১২ টার পরে লিখেছে। অহমির ডায়েরির কিছু শ্রেণীভাগ আছে। কিছু কিছু ডয়েরি শেষও হয়ে গেছে । এদের মধ্যে সে দৈনন্দিন জীবনের কিছু কথা একটা ডায়েরিতে লিখে। আবার যখন খুব মন খারাপ হয়, নিরবে কাঁদে তখন এই ডায়েরিতে হাত দেয়। আরেকট ডায়েরিতে আছে অহমিকার বিভিন্ন সৃষ্টি।এখন সেই ডায়েরিটা খুললো। আবারও কলমের খসখস শব্দ শুনা গেল। এবারের গল্প – ‘অমাবস্যার ক্রিনিকোলাস’- অধ্যায় তেরো।

______________________________________________

মাথায় কারো হাতের স্পর্শে অহমির ঘুম ছুটে গেল। ওর ঘুম এমনিতেই খুব পাতলা। তাছাড়া রাতে ওর তেমন ঘুমও হয় না। সকালেও আবার তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙে যায়। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলো আফরোজা বেগম বসে আছেন। রেডি হয়ে এসেছেন। মানে এখন মা ভাই একসাথে নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়বেন। উঠে বসে চুলগুলো রাবার ব্যান্ড দিয়ে ঝুটি করে ফেললো। ও জানে মা কেনো এসেছে।
আফরোজা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বলেন, “অহমি ভাই তোমার ভালোর জন্যই বকে। সবসময় এমন রাগ করলে চলে না৷”

অহমি কোনো জবাব দেয় না। আফরোজা বেগম আবারও বলেন, “তুমি তো জানো তোমার ভাই একটু ওল্ড মাইন্ডের, ও এভাবে চলাফেরা পছন্দ করে না। তুমি এতো লেটে বাড়ি ফিরেছো বলেই ভাই কাল রেগে গিয়েছিল। সাইফাকেও তো এভাবে চলাফেরার জন্য বকাবকি করে।”

সাইফা, আহিরের বউ। ওদের আক্দ হয়ে আছে। অহমির বিয়ের পরপরই ওকে উঠিয়ে আনা হবে। আফরোজা বেগম
একটু থেমে বলে, “তাছাড়া তুমি কাল ওর মুখে মুখে কথা বলে অন্যায় করেছো। এটা উচিত হয়নি।”

অহমি মলিন হেসে বলে, “বুঝেছি আম্মু।”

“ভাই এখন বেরিয়ে পড়বে। ওকে সরি বলে এসো।”

যা প্রতিবার হয়৷ আজকে মুখে মুখে কথা বলার জন্য সরি বললেও অন্যবার তো অহমি মুখে মুখে কথা বলে না। তাও ওকেই সরি বলতে হয়। ছোট হতেই বলতে হয়। যদি না বললে আম্মুর খারাপ লাগে! ভাইয়ের রুমের সামনে গিয়ে দুইবার নক করে। আহির রেডি হতে হতে ভিতর থেকে বলে, “আয়।”

আহিরও জানে মা অহমিকে বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠিয়েছেন। আর অহমি তো তোতাপাখি। যে যা শিখিয়ে দিবে তাই বলবে। মায়ের শেখানো বুলি গড়গড়িয়ে বললো, “কালকে ওইভাবে কথাগুলো বলা উচিত হয়নি। সরি।”

আহির মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “আাশা করবো পরের বার এমনকিছু করবি না। এতোক্ষণ বাইরে থাকলে ভাইয়ার চিন্তা হয়। এখনকার পরিস্থিতি ভালো না।”

অহমি কেবল মাথা উপর নিচে করলো। আর কিছু বললো না। আহির আরো একবার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেল। অভিমানে টইটুম্বুর অহমি একবারও ভাইয়ের এহেন দু:চিন্তা বুঝলো না। ওর কেবল মাথায় ছিল কালরাতে ভাইয়া ওকে বকাঝকা করেছে। ওকে মারতে চেয়েছে। এইসবের পিছনের ভয়ের কারণ বুঝলো না।

__________________

ক্যালান্ডারের পাতাগুলো একটার পর একটা নি:শব্দে উল্টে গেল। পূর্ণিমা খুব সন্নিকটে। রাত এখন সাড়ে এগারোটা। অহমি বারান্দায় দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়া লম্বা আঁচল মাটিতে গড়াগড়ি করছে। দৃষ্টি হালকাভাবে জ্বল জ্বল করতে থাকা চাঁদের দিকে। মাঝে মাঝে একটু-আধটু শীতল হাওয়া বইছে। বারান্দার পর্দাগুলো নড়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। অহমির বারান্দা থেকে বাইরের কিছুই দেখা যায় না দেওয়াল ছাড়া। পাশের লাগোয়া বিল্ডিংটার জন্য এই অবস্থা। অথচ এই ঘরের বারান্দা থেকে বাইরের পরিবেশ দেখা যায়। আলো-বাতাস পাওয়া যায়। কিন্তু এতো প্রশান্তির মাঝেও ওর মাথাটা প্রচন্ড ঝিমঝিম করছে।

“অহমিকা!”

অহমি মাহিদের দিকে তাকালো। স্মিত হাসালো। এইতো আজ তিন কবুল বলে মানুষটার সাথে আজীবনের মতো জড়িয়ে গেলো। মাহিদ অহমির দিকে এগিয়ে এলো। হাতে দু কাপ কফি। অহমির দিকে এক কাপ বাড়িয়ে দিলো। অহমির এখন কফিটার খুব দরকার ছিলো। মাহিদ ওর পাশেই দাঁড়ালো। মাহিদের ডান হাতের বাহুর সাথে অহমির বাম হাতের বাহু লেগে আছে। মাহিদ ওকে একদিন কথায় কথায় বলেছিল বিয়েতে মেহেদী দিলে অবশ্যই যেন ওর নাম লিখে। ও বিয়ের রাতে বউ এর হাতে নিজের নাম দেখতে চায়। অহমি অবশ্য কথা রেখেছে।

“আপনার নাম খুঁজতে পারবেন?” অহমি কফি মগটা রেলিং এর উপর রেখে নিজের দুইহাত মাহিদের দিকে বাড়িয়ে দিলো।

“বড় বড় করে লিখোনি? অহমিকা + মাহিদ এভাবে লিখো নি?”

অহমি লজ্জা পেল। বলে, “তা করিনি, তবে আপনার নামটা ঠিকই লিখেছি। ”

মাহিদ নিজেও কফি মগটা রেলিং এর উপর রেখে অহমির দুই হাত আঁকড়ে ধরলো। বেশ কিছুক্ষণ খুঁজার পরও যেন পেলো না তখন এক অযুহাত দিয়ে বলে, “আমার চশমা নেই তুমি দেখছো না? আমি এখন নাম কি করে খুঁজে পাবো?”

মাহিদ যে খুঁজে পায়নি অহমি বেশ ভালো করেই বুঝেছে। দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে, “তবে রুমে গিয়ে চশমা পরে ভালো করে খুঁজুন? ”

মাহিদ ফুল দিয়ে সাজানো বিছানায় বসে খুঁটে খুঁটে দেখেও নাম খুঁজে পায়নি।

“আরেকটা লাইট জ্বালাবো?”

মাহিদ চশমা পরেও যখন নাম খুঁজে পাচ্ছিলো না তখন বলেছিল লাইট কম হওয়ায় খুঁজে পাচ্ছে না। তাই অহমি নিজের মেবাইলের ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে হাতের উপর ধরেছিল। মাহিদ এখন অহমির এমন কথা শুনে ঝাঁঝিয়ে উঠে। বলে, “তুমি তখন থেকে কথা বলছো দেখেই পাচ্ছি না। চুপ থাকো।”

একটু পরই বলে,”দুর পাচ্ছিই না।”

অহমি তা শুনে হেসে উঠে। ডান হাত দিয়ে বাম হাতের মিডেলে একদম ছোট করে আঁকা ফুলের পাপড়ির দিকে নিদের্শ করে বলে, “এই দেখেন প্রতিটি পাপড়ির মধ্যে আপনার নামের একেকটি অক্ষর লিখা। ভালো করে দেখুন।”

মাহিদ নিদেশর্না মতো খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখে অবাক হয়ে বলে, “এখানে তো মাহিদ লিখা নেই, আতহার লিখা। আমি তো মাহিদ খুজছিলাম।”

“ওমাহ আতহার আমার স্বামীর নাম, লিখবো না? খামোখা মাহিদ কেনো লিখতে যাবো বাপু?”

মাহিদ হেঁসে ফেলে। অহমিও হেঁসে রসিকতা করে বলে, “ছিহ ছিহ আপনি আমার হাতে আপনার নাম খুঁজে পাননি।”

মাহিদের আচমকা কি হলো কে জানে! অহমির হাতে টান মেরে নিজের খুব সন্নিকটে আনে। অহমি মাহিদের বুকে আঁচড়ে পরে। ভারসাম্য রক্ষার্থে অহমি মাহিদের বুকে হাত রাখে। মাহিদ অহমির চোখে চোখ রেখে বলে , “যে মানুষটা এখন থেকে সম্পুর্ন আমার, যার জীবনের সাথে আমার নাম ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে গেছে তার হাতে শুধু শুধু নাম খুঁজে পাওয়া বা না পাওয়ায় কি লাভ অথবা ক্ষতি হবে অহমিকা আতহার হুসাইন?”

চলমান…………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে