গল্প সিদ্ধান্ত

0
1011

গল্প সিদ্ধান্ত

শায়লা স্কুলে টিফিনের পরের পিরিয়ডে ক্লাশ নিচ্ছিল। হঠাৎই ফোনটা এলো। মণিখালার হাজবেন্ড মানে জামাল খালু মারা গিয়েছেন কিছুক্ষন আগে।
ঢাকা হসপিটালের ভর্তি ছিলেন। তাকে নিয়ে রওনা হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই।
ঢাকা থেকে এখানে পৌছাতে পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা লাগতে পারে।
শায়লা ক্লাশটা শেষ করে হেডস্যারের কাছে বলে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে গেল। মণি খালার বাড়িতে যেতে হবে।
বাড়ি বলতে শ্বশুরবাড়ি। সেখানে মণিখালার ভাসুর, দেবর থাকে পরিবার নিয়ে।
শায়লা ভাবলো রান্না করার দরকার নেই, ওখানে তো মণিখালার আত্নীয় স্বজন আছেই।
একই বাড়ির উপর তিনটা ঘর।
মণিখালার ঘরটা তালাবন্ধই থাকে।
শায়লার কাছে একটা চাবি আছে, তবে সেটা কেউ জানে না।
ও বাড়িতেও হয়ত চাবি আছে।
মণিখালা শায়লার মায়ের খালাতো বোন হয়।
ছোটবেলায় অনেক থেকেছে শায়লাদের বাড়িতে।
শায়লা মাকে ফোন করে খবরটা দিলো।
খালুর বেশি বয়স না,ফুসফুসে ক্যান্সার হয়েছিল।
ধাক্কাটা সামলাতে পারলেন না।
ছোট ছোট দুইটা বাচ্চা, ভাগ্যিস মণিখালার নিজের চাকরিটা আছে। না হলে পানিতে পরতে হতো এখন।
চিকিৎসায় ও তো কম খরচ হয়নি।
ইন্ডিয়ায় গিয়েও চিকিৎসা করিয়েছেন।
শায়লা মা কে বললো, আমি চলে যাই আগে। তুমি একটু পরে আসো।
শায়লা পৌছে দেখে, আত্মীয় স্বজন আসতে শুরু করেছে মণিখালার শ্বশুরবাড়িতে।
ভাসুরের ঘরে বসেছে সবাই, মুখ গম্ভীর করে কথা বার্তা বলছে।
মণিখালার জা, একের পর এক ট্রে ভর্তি চা বানিয়ে পাঠাচ্ছেন।
শায়লা গিয়ে বসলো ভিতরে এক রুমে।
মণিখালার ভাসুরের ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো, ওই ঘরটা খুলতে হবে না??
ছেলেটি বললো, কি জানি, আব্বা জানে।
শায়লা উঠে গিয়ে মণিখালার বড় জা কে জিজ্ঞেস করলো, চাবি কোথায় আন্টি, ঘরটা খুলে একটু গোছানো দরকার না?
তিনি রান্নাঘর থেকে বললেন, কি দরকার আগে ভাগেই সব গোছানোর।
মণির ঘর, ও এসেই খুলুক!
এর মধ্যে তাদের মামাতো ভাই বোন চলে এসেছে, সবাই চা বিস্কুট খেয়ে গল্প শুরু করেছে।
বাড়ির পুরুষেরা বাইরের দিকটা ঠিকঠাক করছে।
মণিখালার জা দুজন বাড়িতে আসা আত্মীয়দের সাথে কুশল বিনিময় করে গল্প করছে, কতদিন পরে দেখা হলো সবার সাথে!
শায়লা আবারও জিজ্ঞেস করলো, ওদের আসতে তো রাত হয়ে যাবে, খাওয়া দাওয়ার কি ব্যবস্থা করা যায়??
মণিখালার ছোট জা বললো, কোন বাড়ি থেকে খাবার পাঠাবে নাকি!
মৃতের বাড়িতে তিনদিন বিভিন্ন আত্মীয় স্বজন রান্না করে পাঠায়, পাড়া প্রতিবেশীও পাঠায়।
কিন্তু ওদের তো সংসার আলাদা।
তাই ওরা কেউ রান্না করলে পারতো, শায়লা মনে মনে ভাবলো।
পরে আর কথা বাড়লো না খুব একটা।
মহিলারা খুব গল্প করছে ভেতরের ঘরের চৌকিতে বসে, অমুকের মেয়ের বিয়ে হয়েছে, তমুকের ছেলের বউ ফর্সা, তমুকের নাতি হয়েছে ইত্যাদি।
শায়লার ভাল লাগছিল না।
তবুও চুপচাপ বসে রইলো।
রাত আটটার দিকে খাবার এলো এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে, কিন্তু উপস্থিত মেহমানরা সবাই খেয়ে যাবেন।
তাই ঘরে বাইরে খাইয়ে খুব একটা খাবার রাখা যাবে বলে মনে হয় না!
মণি খালার মেয়ে মোহক আর রায়না, একজন সিক্স এ পড়ে আর একজন এসএসসি দিবে।
শায়লা দেখলো, সবাই বেশ তোরজোর করে খাচ্ছে, সবাইকে আপ্যায়নও করা হচ্ছে।
শায়লা মা কে ফোন করে বললো, একটা টিফিন ক্যারিয়ারে করে একটু ভাত, তরকারি যেন নিয়ে আসে।
এরপর শায়লা শুনলো, সবাই আলাপ করছে ক্যান্সার নিয়ে, কেন ক্যান্সার হয়, এত কারণ বোধকরি অঙ্কোলজিস্টরাও জানেন না!
কতক্ষণ আহা উহু চললে, বাচ্চা দুটো কত ছোট!
শায়লা এক ফাঁকে মণিখালার ঘরে গিয়ে ঘরটা খুললো।
বাড়িটা খালু শখ করে বানিয়েছেন, দু তিনটে রুম, এসে থাকার জন্য।
তেমন জিনিসপত্র নেই।
বিছানা আর টেবিল, একটা আলমারি, শায়লা আস্তে আস্তে ঢেকে রাখা বিছানা গুলো চাদর সরিয়ে ঝাড় দিয়ে ঠিক করলো।
ওকে কেউ খেয়াল করেনি।
ভাসুরের ঘরে ফিরে এসে শুনলো, তারা আলোচনা করছে খালুর বিষয় আশয় নিয়ে। শায়লার মা চলে এসেছে।
শায়লা মাকে নিয়ে মণিখালার ঘরে বসলো।
ঢাকা থেকে ওরা এসে পৌছালো রাত এগারোটার দিকে।
সাথে খুব বেশি কেউ নেই। মণিখালার ভাসুরের ছেলে ছিল ঢাকায়, সেই নিয়ে এসেছে।
ঢাকা থেকে আগত সবাইকে খাওয়ানোর পরে দেখা গেল, সত্যি খাবারে কম হলো।
শায়লা মনিখালার ছেলে মেয়েকে খাওয়ালো বসিয়ে, মায়ের আনা খাবার।
মনি খালা কাদছিলেন না, চুপচাপ বসে ছিলেন।শায়লা গিয়ে পাশে বসলো, রাত বাড়ছে, বেশির ভাগ আত্মীয় স্বজন ঘুমাচ্ছে, আশপাশের কেউ কেউ বাড়িতে চলেও গিয়েছে।
মণি খালা বললেন, তুই আছিস, এজন্য আমি চিন্তা করি নি, তুই ম্যানেজ করে নিবি ঠিক।
শায়লা মনি খালাকে শুইয়ে দিলো। নিজেও পাশে শুয়ে পড়বে বলে বসলো।
মা কে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে একটু আগে, শায়লার হাজবেন্ডের সাথে।
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো মনিখালার বড় জা, সাথে দুজন প্রৌঢ়া।
তিনি বললেন, ও মনি, বুড়ি ফুপু আর নুসু বু তোর কাছে শোবে, ওদিকে মানুষ অনেক বেশি!
শায়লা উঠে বসলো, বললো, আন্টি এখানে তো অল্প জায়গা, খালার ঘুমানো দরকার একটু।
মনিখালা উঠে বসলেন।
এর মধ্যে প্রৌড়া দুজন বিছানায় বসে পরেছে, বললে, আমরা এক কোনায় পইরা থাকবো, জায়গা লাগবে না বেশি। মনি খালার জা গজগজ করতে করতে চলে গেলেন৷ সারা রাত প্রৌড়া দুজন পুরো বিছানা জুড়ে ঘুমালো, মনিখালা বসে রইলো, শায়লা তার পাশে চেয়ার দিয়ে বসে থাকলো।
পরদিন নিয়মকানুন শেষে, খালুকে পারিবারিক গোরস্তানে নেয়া হলো।
সব কাজ শেষ করে সবাই ফিরে এলো।
দুপুরে আর এক আত্মীয় বাড়ি থেকে ভাত তরকারি পাঠানো হলো।
মনিখালার ঘর বাদে অন্য সব ঘরে উৎসবের আমেজ।
শায়লা স্কুলে গেল না সেদিন।
আত্মীয় স্বজন আসছে, খাচ্ছে।
গল্প গুজব করছে।
রাতে পারিবারিক মিটিং বসানো হলো।
তিন দিনের দিন মিলাদের বিষয়ে।
মুরব্বি ধরনের দু একজন বললেন, আত্মীয় স্বজন আসছে সবাই, তাদের তো খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা লাগে, দোয়া দুরুদ ও পড়া লাগে।
শায়লার জামাই বললো, ভাল হয় এতিম মিসকিন খাওয়ালে।
সেটা তোমরা যা করো, আত্মীয় স্বজনদেরও খাওয়ান লাগে।
তারপর জামালের জমিজমা, বাড়ির অংশ কে দেখবে ঠিক করা লাগে। জামালের নামের জমি তো এখন ভাই, ভাইপো রাও পাবে। ওর তো ছেলে নাই।
বাড়ি যা করা সবই তো জামালের নামে।
শায়লা শক্ত মুখে বসে রইলো, এখনো তিন দিন হয়নি, আর এরা এখন জমি জমা খাওয়া দাওয়া নিয়ে কথা বলছে!
মণিখালা সবই শুনলেন।
শেষে তিনি কথা বললেন, আপনাদের ছেলে, আমার সন্তানের বাবা অনেকদিন অসুস্থ ছিলেন, তিনি চলে গিয়েছেন, আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন, তার চিকিৎসার জন্য জমি বিক্রি করতে হয়েছে, তখন তিনি সব জমি আর বাড়ি আমার মেয়েদের উইল করে দিয়েছেন।
তাই এখন আর কেউ কিছু পাবে না।

আর আমার বা আমার মেয়েদের এখন কোন আয়োজন করে খাওয়ানোর মানসিকতা নেই। পাশের এতিমখানায় উনি জাকাতের টাকা দিতেন, সেখানের বাচ্চাদের একবেলা খাওয়ানোর ব্যবস্থা আমি করবো, ওখানে কথা হয়েছে।

মুরুব্বিরা চুপ হয়ে গেল।
তাইলে তো আর কোন কথা নাই, সব তুমি কইরা ফেলাইছো!
সবাই বের হয়ে চলে গেল।
গুন্জন শোনা গেল, ওরে আল্লাহ, কি মেয়ে মানুষ, সব লিখাইয়া নিছে!!
কেউ কেউ বললেন, মানুষ যারা খাওয়ায় না, হেগোর কত মসলা থাকে!
আমরা কি খাই নাই জীবনে!
মণিখালার কানে গেল এসব কথা।
শায়লা পাশে ছিল, তিনি শায়লাকে বললেন, এতদিন মানুষটা অসুস্থ, কাউকে দেখি নি পাশে।
তাই জীবনে কঠিন সময়ে শক্ত হয়ে শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে হয় রে!
শায়লা একটু হাসলো শুধু!

লেখা: শানজানা আলম

( প্রিয় পাঠক আপনাদের যদি আমার গল্প পরে ভালোলেগে থাকে তাহলে আরো নতুন নতুন গল্প পড়ার জন্য আমার facebook id follow করে রাখতে পারেন, কারণ আমার facebook id তে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গল্প, কবিতা Publish করা হয়।)
Facebook Id link ???
https://www.facebook.com/shanjana.alam