কাকতাড়ুয়া পর্ব-৬+৭

0
966

#কাকতাড়ুয়া
#পর্ব_৬+৭
#লেখিকা_নূরজাহান_ফাতেমা
______
অঘ্রায়ন মাস।জমির ধান পেকে সোনালি বর্ণ ধারন করেছে।গ্রামের সর্ব দক্ষিনে বাড়ি আমাদের।দক্ষিনে তাকালে চোখে পড়ে ধু ধু জমি।শেষ প্রহরের রাঙা আলোয় ধানের সোনালী ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে আমার।অনেক জমির ধান কাটা শুরু হয়েছে।কৃষকেরা ধান কাটতে ব্যস্ত।একদল আবার কাটা ধানের আঁটি মসৃন বাঁশের দুই প্রান্তে বেধে কাধে চড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে গারস্ত বাড়ি।মাটির কাচা সড়কে সারি সৃষ্টি করে সমান তালে পদাচারন করছে তারা।পরিবেশে হালকা শীতলতা বিরাজমান।তবুও কাজের দরুন মুক্তকনা জমে রয়েছে তাদের নগ্ন শরীরে।শেষ প্রহরের কমলা রোদে এই দৃশ্য দেখতে মারাত্নক লাগছে।পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে এসবই দেখছি আমি।হটাৎ নিশান ভাই ফোন ক্রল করতে করতে পাশে এসে দাঁড়ালেন।প্যান্টের পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে রেখেছেন।গায়ে ফুল স্লিভ পাতলা জ্যাকেট।অনেক দিন পর নিশান ভাইকে তার চিরচেনা রুপে দেখলাম।নিশান ভাই দৃষ্টি ফোনেই বিদ্যমান রেখে বললেন,

“এখানে দাড়িয়ে কি করিস?”

“প্রকৃতি দেখছি।আমাদের দেশে সত্যিই সোনা ফলে তাই না নিশান ভাই?সোনা রঙা নতুন ধানের কি মিষ্টি ঘ্রাণ দেখেছেন।হৃদয় পুলকিত করতে সব কৃত্রিম ঘ্রাণের চেয়ে সেরা এটা।”

আমার কথায় মুচকি হাসলেন নিশান ভাই।সেই হাসিতেও মিষ্টতা দেখতে পেলাম।আজ মনটা ভীষণ ফুরফুরে আমার।সিলেবাসের সন্ব পড়া শেষ।দুইবার রিভাইজও করা হয়ে গেছে।এ কারণেই হয়ত যা দেখছি সবকিছুই মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাচ্ছে।দৃষ্টি এখনো নিশান ভাইয়ের পানে নিবদ্ধ।নিশান ভাই ফোনটা প্যান্টের পকেটে গুজে বললেন,

“আমার মুখে কি লেগে আছে এরিন?এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”

ওনার প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরে আমার।লজ্জিত হলাম আমি।আমার লজ্জা কয়েকগুন বাড়াতে নিশান ভাই বললেন,

“আমি জানি আমি খুব সুন্দর।এই সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে যাস নি তো আবার?”

হটাৎ নিশান ভাইয়ের ফোন বেজে ওঠে।ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তার এক বন্ধু বলে ওঠে,

“কি মামা।কি অবস্থা তোর?আসবি কবে?”

“ব্যান্ডেজ খুললেই চলে আসব মামা।আরও পাঁচ সাতদিন লাগবে খুলতে।”

কি ধাতস্থ কন্ঠে মিথ্যেটা বললেন নিশান ভাই।তার মতো মানুষের মুখে মিথ্যা শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি।চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছি।ফোনের সাউন্ড বেশি থাকায় পাশ থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে অপর প্রান্তের পুরুষালী কন্ঠ।

“সত্যি করে বল তো মামা কাহিনি কি?ব্যান্ডেজ খুলতে এতোদিন সময় লাগে?”

“মারাত্মক ইনজুরি ছিলো ইয়ার।তুই ওটা বুঝবি না।”

“সিরিয়াসলি!তাহলে তো দেখতে যেতে হয়।তোর কেমন ইনজুরি হয়েছে।”

ওনার বন্ধুর কন্ঠে ফাইজলামি ভাব স্পষ্ট।বিষম খেলেন নিশান ভাই।প্রতিউত্তরে আমতা আমতা করে বললেন,

“খবরদার তোরা আসবি না।এতোদিন হল পড়ে আছি দেখতে আসিস নি।এই শেষ বেলায় তোদের কারো প্রয়োজন নেই আমার।”

হেসে দিলেন ওনার বন্ধু।নিশান ভাই আরও অল্প কথা বলে লাইন কেটে দিলেন।আমি এখনো ওভাবেই তাকিয়ে আছি।অপ্রকৃতস্থ হলেন নিশান ভাই।ইতস্তত করে বললেন,

“ওভাবে হা করে কি দেখছিস?এতো অবাক হওয়ার কি বলেছি?”

“আপনি মিথ্যাও বলতে জানেন জানা ছিলো না।”

“মিথ্যার কোনটা দেখলি তুই?”

“সত্যি কোনটা ছিলো তাই তো বুঝতে পারছি না।মিথ্যা বলা পাপ জানেন না আপনি?”

“বাহ মেয়ে বাহ যার জন্য করলাম চুরি সেই বলে চোর।”

“চুরি করলে তার শাস্তি পাবেন না?আপন কেউ হলেই কি আর পাপের শাস্তি মুছে যায়?”

“তুই নামক প্রিয়ার সান্নিধ্য পেতে মিথ্যা বলেছি।এতে যদি পাপ হয় তাহলে আমি এক সমুদ্র পাপে ডুব দিব।সর্বাঙ্গ পাপে জর্জরিত করে ফেলব।দিনশেষে তওবা পড়ানোর জন্য পাশে থাকিস।”

কানে বাজল ওনার ঘোড় লাগানো কন্ঠস্বর।নিশ্বাস ফেলছেন ঘন ঘন।দৃষ্টিতেও নেশা মিশ্রিত।ওই চোখে তাকাতে পারছি না আমি।পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিচ্ছে আমাকে।হৃৎস্পন্দনের হার মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছে।যেন সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে আসবে।হয়তো এখনই হার্ট এটাক হবে।দৃষ্টি নত করে ফেললাম।কিছু সময় পর হেসে দিলেন নিশান ভাই।নিজেকে ধাতস্থ করলেন দ্রুত।

“কি ভেবেছিস এটাই বলব?আর এ গাধা আমি এখন গেলে তোর পড়াশোনার কি হবে?এজন্যই মিথ্যেটা বলা।আফটার অল দয়ার শরীর আমার।তোদের মতো অবলাকে দেখার জন্যই আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছেন।”

হৃদস্পন্দন স্বভাবিক হল।ওনার দৃষ্টিতেও আর অন্যরকম কিছু দেখতে পাচ্ছি না।নাহ আমার মাঝেও অজানা অনুভুতি নেই।কি দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে ফেললেন।হটাৎ কয়েকজন দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল ওনাকে।নিশান ভাইয়ের বন্ধু ওনারা।তাদের মাঝে দুইটা মেয়েও ছিলো।একটু আগে মিথ্যা বলার জন্য সবাই লেগপুল করতে লাগল ওনাকে।ওনার এক বন্ধু বলল,

“তোর না ব্যান্ডেজ খোলা হয়নি।কোথায় গেল সে ব্যান্ডেজ?এটা অদৃশ্য ব্যান্ডেজ নাকি মামা?সবাই খালি চোখে দেখতে পায় না নাকি।”

পাশ থেকে আরেকজন বলল,

“আরে এটা তো ওর মনের ব্যান্ডেজ।সারাবছর লেগে থাকে।যেটা শুধু নিশানই দেখতে পায়।একারণেই তো বেটা বাড়ি এলে আর ঢাকা ফিরতে চায় না।”

একটা মেয়ে ফাইজলামি করে বলল,

“যার টানে এতো বাড়ি থাকিস।তাকেও মাঝে মধ্যে টান দিলে পারিস।সে ঢাকায় থাকলে তো আর বাড়ি আসবি না।”

সেই মেয়ের মাথায় পাশের ছেলেটা চাটি মেরে বলল,

“কানাকে চোখ দেখিয়ে দে।পড়ে আর আমাদের ঢাকাতেও চিনবে না।”

ওনারা নিজেরাই নিজেদের মতো ফাইজলামি করছেন।উনি লজ্জা পেলেন বেশ।চোখের ইশারায় আমাকে দেখিয়ে থামতে বললেন।অতঃপর এক এক করে আমার সাথে সবাই পরিচয় করিয়ে দিলেন।যেই মেয়েটা ফাইজলামি করছিলো ওনার নাম প্রেমা।আপু আমার গালে হাত দিয়ে আদর করে বললেন,

“ওহ তুমিই এরিন।কি মিষ্টি চেহারা।ঠিক যেন উপন্যাসের নায়িকা।”

লিমন ভাই হাসতে হাসতে বলল,

“ঠিক যেন কি রে?ওতো নায়িকাই।কারো জীবন উপন্যাসের নাইকা।”

আবির ভাইয়া বদমাইশি করে বলল,

“এমনি কি আর কেউ বাড়ি এলে কোথাও যেতে চায় না।”

নিশান ভাই কপট রাগ দেখিয়ে থামিয়ে দিলেন ওদের।অতপর বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন ফ্রেশ হতে।

_____
আজকে বহুদিন পর নিজে থেকে মামির কাজে সাহায্য করতে এসেছি।এতোদিন মামি কাজে ডাকেনি আর আমিও করিনি।নিশান ভাইয়ের দেখাশোনার দ্বায়িত্ব আমার কাধে চাপিয়ে সংসারের বাকি কাজগুলো করতেন মামি।আমিও নিখুঁতভাবে নিজের দ্বায়িত্ব পালন করতাম।কয়েকদিন হল সেই দ্বায়িত্বও নেই।আজকে নিশান ভাইয়ের বন্ধুরা আসায় কাজ অনেক বেড়ে গেছে।মামি একা একা কাজ করছে দেখে মায়া লাগল আমার।তাই এগিয়ে গেলাম তাকে কাজে সাহায্য করতে।অন্যান্য দিন হলে মামি আমাকে কটুকথা শোনাতো।বলতো লোক দেখাতে কাজ করতে এসেছি।কিন্তু আজকে কি যেন মনে করে তা আর করলেন না।

রান্না সহ সব কাজ শেষ করে নিশান ভাইয়ের ঘরে গেলাম আমি।রাতের খাবারের জন্য তাদের ডাকতে আদেশ দিয়েছেন মামি।সেখানে নিশান ভাইদের কাউকে দেখতে পেলাম না।চাঁদের আলোয় বাইরে পাতা মাঁচার উপরে বসে আড্ডা দিচ্ছে তারা।মামির আদেশ অনুযায়ী তাদেরকে খাওয়ার জন্য ডাকলাম।গরুর মাংস ভুনা ও আলুর ঝুরি ভাজি আমি করেছি।সেগুলো নাকি অনেক মজা হয়েছে এসব ভুয়সী প্রশংসা করল নিশান ভাইয়ের বন্ধুরা।আবির ভাই আমাকে প্রশ্ন করলেন,

“এরিন তুমি কি প্রতিদিন রান্না কর?অভিজ্ঞ হাত ছাড়া এত মজার রান্না সম্ভব না।”

ওদের কথায় স্মিত হাসলেন মামি।এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“এরিন প্রায় প্রতিদিনই রান্না করে বাবা।এমনকি আমার সব কাজ সাহায্য করে।আমি সত্যিই খুব খুশি এরকম একটা ভাগিনি পেয়ে।”

মামির উত্তর শুনে আমি ও নিশান ভাই দুজনেই চোখ তুলে তাকালাম মামির পানে।একটা ভ্যবলাকান্তমার্কা হাসি দিলেন মামি।এই প্রথম মামি আমার প্রশংসা করলেন।নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছি না।আমি কি ভুল কিছু শুনলাম?আমার আচরণ যেদিন পরিবর্তন করেছিলাম সেদিন মামি বেশ অবাক হয়েছিল।ভেবেছিলেন মানুষিকভাবে অসুস্থ হয়েছি।আজকে ঠিক ততটাই অবাক হলাম আমি।আচ্ছা এতোদিন একা একা কাজ করায় তিনিও কি অসুস্থ হয়ে গেছেন?নিজের মেয়ের মতো ভালো ব্যবহার করে চলেছেন আজ।অন্যন্য দিন কাজে না বাতালেও কথাও বলেন না আমার সাথে।কিন্তু আজ তার কোনটাই করছেন না।পরক্ষণেই মনে হল স্থান,কাল,পাত্রভেদে মানুষের আচরণ পরিবর্তিত হয়।হয়তো নিশান ভাইয়ের বন্ধু-বান্ধব এসেছে বলেই তিনি আমার সাথে এত ভালো ব্যবহার করছেন।পরে ঠিকই পাল্টে যাবেন।তাকে দেখে অবশ্য এটা বোঝার উপায় নেই।মানুষ এত নিখুঁত অভিনয় করতে জানে তাকে না দেখলে বুঝতাম না।অবশ্য পুরো জগত সংসারই অভিনয়ে চলে।তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম আমি।মনে মনে আওড়ালাম আমিও কি অভিনয় করছি না?
_______
এইচ এস সি পরীক্ষা চলছে আমার।বাড়ি থেকে আমার পরীক্ষার কেন্দ্রে যেতে দেঢ় ঘন্টা সময় লাগে।
প্রতিদিন একাই পরীক্ষা দিতে যাই আমি।
প্রথম পরীক্ষার দিন গিয়ে দেখি অন্যান্য স্টুডেন্টদের সাথে তাদের বাবা-মা এসেছে।কিন্তু আমার সাথে কেউ যায়নি।আর যাবেই বা কে?আমারতো বাবা মা থেকেই নেই।আর মামা তো ঢাকায় গিয়েছিলো নিসা পরীক্ষা দিবে বলে।আজকে আমার শেষ পরীক্ষা ছিল।আল্লাহর রহমতে খুব ভালো হয়েছে সব পরীক্ষা।শেষ পরীক্ষা বলে সবার মাঝে অন্যরকম আমেজ বিদ্যমান।পরীক্ষা শেষে সবাই এদিক সেদিকে ঘুরে আনন্দ উল্লাস করছে।তাদের সকল কথার ঝুড়ি মেলে ধরেছে এক এক করে।যার কিয়দংশ কর্নগোচর হচ্ছে আমার।কে কোথায় কোচিং করবে,কার কোথায় ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে এসব বিষয়েও আলোচনা করছে অনেকে।হঠাৎ নিশান ভাইয়ের কথা মনে পড়ল।তিনি আমাকে ঢাকা ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন।বেশ কয়েক মাস হয়ে গেছে নিশান ভাই ঢাকা চলে যাওয়ার।এর মাঝে তার সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি আমার।মাঝে পড়ার যেই ঘাটতি পড়েছে তা পুষাতে ব্যস্ত হয়েছেন তিনি।এক্সিডেন্ট করে দেড় মাস থেকে গিয়েছিলেন বাড়িতে।এই দেড় মাস ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়।অজানা কিছু অনুভূতির পরিচয় পেয়েছি সেই দেড় মাসে।নিশান ভাইয়ের আমার প্রতি লুকানো সুপ্ত আবেগ ভেসে উঠছে এক এক করে।যা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে সক্ষম হয়েছি অনভিজ্ঞ আমিও।

নিশান ভাই যেদিন চলে যায় সেদিন বিষাদে ডুবে ছিলাম আমি।ওনার বন্ধুরা উপস্থিত হওয়ার পর থেকেই উনি আমাকে এভয়েড করে চলছিলেন।যেটা তীব্র দহনে পুড়িয়েছিলো আমার হৃদয়।সকালে ঘুম থেকে উঠে কনকনে শীতে বাইরে বেড়িয়েছিলাম।বাড়ির দক্ষিণে একটা বড় পুকুর আছে।তার পাড়ের এক কোনেই লাগানো হয়েছে শিউলি গাছ।গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নিজের অজানা অনুভূতিকে বিসর্জন দিচ্ছিলাম।গায়ে পাতলা চাদর জড়ানো।ঠান্ডা আবহাওয়া মৃদু কম্পন তুলেছিলো সারা অঙ্গজুড়ে।সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করিনি আমি।ভীষন অভিমান জমেছে যে হৃদয়ে।নিশান ভাইয়ের উপস্থিতি ঘটে পরক্ষনেই।আমি ওনাকে দেখেও না দেখার মত করে ছিলাম।হটাৎ কর্ণগোচর হল ওনার কন্ঠ।

“এই সাত সকালে এখানে কি করিস?”

“তা জেনে আপনার কি?”

আমার উত্তরে ভড়কে গেলেন তিনি।গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

“এভাবে কথা বলছিস কেন?”

“কীভাবে কথা বলতে হবে আপনার সাথে তা আমার জানা নেই।দয়া করে শিখাবেন প্লিজ।”

“কি হয়েছে তোর?কেউ কিছু বলেছে?”

“জানাটা কি খুব জরুরি?”

“অবশ্যই জরুরি।দোষ কি বান্দার বলবি তো।”

“কাল আপনার বন্ধুরা আসার পর তো আমাকে ভুলেই গিয়েছেন।সান্নিধ্যে ছিলেন নাকি আমার যে দোষ করবেন।”

গাল ফুলিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম আমি।প্রতিউত্তরে উনি স্মিত হেসেছিলেন।

“তোকে কি সখে গর্দভ বলি।ওরা কি আমার বাড়ি সারাজীবন পড়ে থাকবে বল।ওরা আমাদের মেহমান।আমার উদ্দেশ্যেই এসেছে।ওদের সময় না দিলে কেমন দেখায় না বিষয়টা।”

“কিন্তু আপনি আমাকে বাদ দিয়ে ওই আপুদের সময় দিলেন এটা আমি মানতে পারছি না।”

“ওরাও তো আমাদের মেহমান।”

তারপরও গাল ফুলিয়ে ছিলাম আমি।উনি হটাৎ বললেন,

“আজ আমি চলে যাব।তাও এমন করছিস তুই?”

নিশান ভাইয়ের ঢাকায় প্রস্থানের কথা শুনে বুকের মাঝে ক্ষীন ব্যথা অনুভূত হচল আমার।এই এক মাসে যে তার মাঝে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম আমি।ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে তার মুখ দেখতাম।ঘুমাতে যেতামও তার মুখ দেখেই।প্রতিটা মুহুর্ত কাটতো ওনার সান্নিধ্যে।এই বাজে অভ্যাস কিভাবে কাটিয়ে উঠবো এখন?আর এভাবে কখনোই নিশান ভাইকে পাবো না।ভেবেই বিষাদে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম।

“আর কয়েকটা দিন থাকলে হত না।আজই যাবেন?”

“হুম।এতোদিন তো এক্সিডেন্ট করে অসুস্থ ছিলাম।এখন কোন অযুহাতে থাকব?”

মন খারাপের নদীতে ডুব দিলাম।এমন সময় নিশান ভাই আমার স্বপ্নকে নতুন করে জাগিয়ে দিল।পড়াশোনা করতে আগ্রহী করে তুলল,

“শোন তুই কিন্তু মনযোগ দিয়ে পড়াশোবা করবি।আমার ক্যাম্পাসটাকে আপন করে নিবি।আমার এতোদিনের কষ্টকে প্রাপ্তিতে ভড়িয়ে দিবি।আর এর জন্য ভালো রেজাল্ট করতে হবে।ভর্তি পরীক্ষায় রেজাল্ট গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে।”

আমিও উজ্জীবিত হয়েছিলাম।নিশান ভাইয়ের মুখে হাসি ফোটাব আমি।কিন্তু মনের মেঘ কাটছিলো না কোনভাবেই।তখন নিশান ভাই বিভিন্ন কথা বলে রাগানোর চেষ্টা করে আমাকে।কিন্তু বিষাদে পুঞ্জীভূত হৃদয়ে কোনভাবেই কপট রাগ সুবিধা করে উঠতে পারছিলো না।ব্যর্থ হন তিনি।অগত্যা যাওয়ার সময় আমার হাতে একটা চিরকুট গুজে দিয়ে বলেছিলেন ,

“সবসময় সকল বিপদে স্ট্রং থাকিস।মনে রাখিস পৃথিবীতে সবাই একা।মাঝে মাঝে সাহায্যের হাত বাড়ালেও কেউ সারাজীবন তোর পাশে থাকবে না।নিজের সকল বিপদ থেকে মুক্তির পথ নিজেকেই বের করতে হয়।নিজের প্রতি নির্ভরশীল হতে হবে।নিজেকে বিশ্বাস করতে হবে।নিজেকে সম্মান করতে হবে।তবেই মানুষ তোকে সম্মান দিবে।নিজের সম্মান নিজে না দিলে কেউ দিবে না।যতদিন পরই ঢাকা থেকে ফিরি তেকে যেন অক্ষত দেখতে পাই।”

মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়েছিলাম আমি।ভরসাযোগ্য হাসি দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করি যে আমি বদলে গেছি।উনিও আমার প্রতি বিশ্বাস রেখে বিদায় হন।ওনার প্রস্থানের পর চিরকুটটা খুলে দেখি দুটি লাইন লেখা।

“তার হৃদমাঝারে বিষাদ নামা বারণ।
ওই বিষাদ যে আমার সকল অসুখের কারন।”

চিরকুটটা পড়ে মুচকি হাসলাম আমি।হৃদয় জুড়ে ছড়িয়ে গেল প্রশান্তি।ব্যাস মন ভালো করতে তার দুই লাইনের একটা চিরকুটই যথেষ্ট।এই কয়েক মাসে যখনই মন খারাপ হত তার দেওয়া চিরকুটটা খুলে দেখতাম।কতশত বার যে পড়া হয়েছে আমি নিজেও বলতে পারব না।

_______
হল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি গাড়ির উদ্দেশ্যে।হঠাৎ চোখে পড়লো একটি সুন্দর দৃশ্য।বছর তিনেকের একটা বাচ্চাকে নিয়ে এক দম্পতির মাতামাতি।কিছু নিয়ে অভিমান করেছে বাচ্চাটি।তার বাবা-মা হাস্যউজ্জল মুখে ব্যস্ত হয়েছে বাচ্চাটির অভিমান ভাঙাতে।দোকানের বিভিন্ন খেলনা দেখাচ্ছে কিনে দিতে।বাচ্চাটি কোনভাবেইসেদিকে তাকাচ্ছে না।মুখ ভাড় করে রেখেছে।তাকে শান্ত করতে বাবা-মায়ের কত প্রয়াস।হাতে ধরি পায়ে পড়ি বিভিন্ন আদরের বুলি আওড়াচ্ছেন তারা।মেয়েটিকে দেখে চোখের কার্নিশ ভিজে গেল আমার।সেও মেয়ে আমিও মেয়ে।পার্থক্য তার বাবা-মা আছে আর আমার নেই।একারণেই আমার অভিমান তুচ্ছ।কিন্তু ওর অভিমান ভীষণ দামী।
এক সময় আমার বাবা-মাও আমাকে এভাবে আদর করত।আব্বুর অফিস থেকে ফিরতে দেরী হলেই কান্না জুড়ে দিতাম আমি।আব্বু ফিরলে কত অভিমান জমাতাম।তার কাছে সহজে যেতাম না।হাজার অনুনয় বিনয় করে আমার রাগ ভাঙিয়ে তারপর শান্ত হতাম আমি।আবার খেতে চাইতাম না বলে আম্মু বকা দিয়ে খাওয়াতো।কান্না করতাম আর বলতাম,

“আব্বুকে নালিশ দিব কিন্তু।”

আব্বু আসলে গড়গড় করে সব অভিযোগ জানাতাম।আব্বুও কপটা রাগ দেখাতো আম্মুর উপর।আর আমি প্রাপ্তির হাসি দিতাম।এমন হাজারো মধুময় প্রহর কেটেছে ছোটবেলায়।যদিও সব স্মৃতিতে নেই।
তবুও যতটুকু আছে তা মনে করে একটা নির্ঘুম রাত কাটাতে যথেষ্ট।আমি অবশ্য এখন তা কাটাই না।যেসব স্মৃতি ভেবে আমি কষ্ট পাই তারা তো সেসব ভুলে দিব্যি সুখেই আছে।তাদের কথা ভেবে কষ্ট পাওয়া বোকামি।এই বোকামি আর কখনোই করব না।আমি গুছিয়ে নিব নিজেকে।একদম আমার মত করে।
__________
গাড়ির অপেক্ষা করতে করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে।অগত্যা ভাড়া বেশি হলেও একটা ফাঁকা সি এন জি নিলাম।শুরুতে রাজী ছিলো না গাড়িওয়ালা।পুরো সি এন জি এর ভাড়া আমি দিবো এই শর্তে রাজি হয়েছে পরে।এতো ভাড়া মিটাবো কি করে এই চিন্তা থাকলেও বাড়ি তো ফিরতেই হবে।মেয়ে মানুষ অপরিচিত একটা জায়গায় কিভাবে কাটাব।জানি কেউ আসবে না আমাকে নিতে।গাড়ি চলছে নির্দিষ্ট গতিতে।মাগরিবের আজান পড়ে গেছে।হটাৎ সি এন জি ওয়ালার আচরণে অস্বাভাবিকতা আবিষ্কার করলাম।তিনি অনেক দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছেন।বাইরে তাকিয়ে নিজেদের অবস্থান বুঝলাম।সোজা রাস্তা ধরে আর একটু গেলেই আমাদের গ্রামের মোড় পাবো।চিন্তা মুক্ত হওয়ার কথা।কিন্তু ভীষণ ভয় করছে আমার।লোকটাকে বিশ্বাসযোগ্য লাগছে না কোনভাবেই।লোকটা সন্দেহজনক।আগে বুঝতে পারলে কখনোই উঠতাম না এই গাড়িতে।আমার ভয়টাকে সত্যি করে তিনি আকষ্মিকভাবে সি এন জি অন্য রাস্তায় ঢুকিয়ে দিলেন।বুকের মাঝে ধক করে উঠল আমার।নিশ্চিত বুঝতে পারছি যেকোন একটা হারাবো আজ।হয় সম্মান না হয় প্রান।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে