নষ্ট গলি পর্ব-২৫
লেখা-মিম
-দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বসো এখানে।
গুটিগুটি পায়ে নজরুল সাহেবের মুখোমুখি সোফাটায় বসলো মায়া। মাথার উপর ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে৷ তবু কানের পাশ দিয়ে ঘাম বেয়ে পড়ছে মায়ার।
– পানি খাবে মায়া?
খানিকটা অবাক হলো মায়া। সোহানের বাবা ওর নাম জানেন। কিন্তু কিভাবে?
– শামীম ওকে এক গ্লাস পানি দাও তো।
পায়ের উপর পা তুলে সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন নজরুল সাহেব। মায়ার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো শামীম। গ্লাসটা হাতে নিয়ে বসে আছে মায়া। হাতে থাকা গ্লাসটা সামান্য কাঁপছে। নজরুল সাহেব ঠান্ডা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
– তুমি হয়তোবা ভাবতে পারো হুট করে আমি এখানে কেনো? তোমার নাম জানি কিভাবে? তাই না।
উত্তর দিচ্ছে না মায়া। প্রশ্নগুলো সত্যিই ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু মুখ ফুটে বলার শক্তি বা সাহস কোনোটাই নেই।
– দেখো, আমি কম সময় নিয়ে এসেছি। অফিসে অনেক কাজ ফেলে এসেছি। ঘন্টা তিনেক পরই আবার ব্যাক করবো। এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছো তুমি। তোমার সাথে কিছু ব্যাপারে কথা বলবো এরপর চলে যাবো।
-………….
– তুমি তো বোবা না। তাহলে কথা বলছো না কেনো?
– জ্বি।
– সোহান আমার বড় ছেলে। সালমানের চেয়ে ওর প্রতি আমার এক্সপেকটেশন্স অনেক বেশি। আমার বিজনেস সামাল দেয়ার মতো যোগ্যতা সোহানের চেয়ে সালমানের অনেক কম৷ আমার প্রপার্টি কি পরিমান আছে সে কথা নিশ্চয়ই সোহান তোমাকো জানিয়েছে?
– জ্বি না।
– ও যদি না বলে থাকে তাহলে সেসব নিয়ে আমি তোমার সাথে কথা বলবো না। আশা করি এই কয়মাসে তুমি সেটা আন্দাজ করে নিয়েছো। দেখো মায়া, তোমার সাথে সোহানের বিয়ে হয়নি সেটা আমি জানি।
চোখ বড় করে নজরুল সাহেবের দিকে তাকালো মায়া। টি টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসে চুমুক দিলেন নজরুল সাহেব। আবারও হেলান দিয়ে বসলেন সোফায়।
– এতটা অবাক হওয়ার কি আছে? সোহান আমার সন্তান। হতে পারে ও আমার কাছ থেকে দূরে থাকে। ও এখন বড় হয়ে গেছে। তারমানে তো এই না আমি ওর খোঁজ নিবো না। কখন কি করছে না করছে সেসব জানবো না। শুনেছি ও নাকি তোমাকে প্রচন্ড যত্নে রাখে। যত্নটা কিজন্য রাখে সে ব্যাপারে আমার জানা নেই। হতে পারে ও তোমাকে সত্যি ভালোবাসে আবার হতে পারে এটা ওর সাময়িক মোহ। এটা তোমাদের নিজস্ব ব্যাপার। তোমরা ভালো বলতে পারবে। আমি সেটা জানি না। তবে আমার ধারনা এটা মোহ। সোহানের এখন ত্রিশ চলছে। স্বাভাবিকভাবে ওর এই মূহুর্তে কাউকে প্রয়োজন যে ওর যত্ন নিবে। ওর চাহিদাগুলো মিটাবে৷ ওর একাকীত্ব দূর করবে৷ বলতে পারো তোমাকে ও এনেছে ওর রিফ্রেশমেন্টের জন্য। হতে পারে ও এখনই বিয়ে করার জন্য মেন্টালি প্রিপেয়ারড না৷ এজন্য তোমাকে নিয়ে এসেছে। তোমাকে কিছুদিন এখানে রাখবে। যখন মেন্টালি প্রিপেয়ারড হবে তখন তোমাকে আবার তোমার আগের জায়গায় ফেরত রেখে আসবে।
চোখে ছলছল পানি নিয়ে মায়া বললো,
– উনি আমাকে বলেছে ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে।
– আচ্ছা ঠিকাছে ধরে নিলাম ও তোমাকে ভালোবাসে। তুমি ও তো ওকে ভালোবাসো তাই না?
-……………
– থাক বলতে হবে না। আমি উত্তর জানি। আচ্ছা মায়া যাকে ভালোবাসো তার মন্দ নিশ্চয়ই কখনো চাইবে না?
– না।
– তুমিই বলো, তুমি কি সোহানের যোগ্য? সোহানের পাশে কি তোমাকে মানায়? সোহানের স্ট্যাটাস আর তোমার স্ট্যাটাস কি ম্যাচ হয়? তোমার বাবার পরিচয়টা পর্যন্ত তুমি জানো না। তোমার মা আর তুমি একটা নষ্ট পাড়ায় বড় হয়েছো। সোহানকে আমরা কতটা যত্নে কতগুলো স্বপ্ন নিয়ে বড় করেছি জানো? সোহান সবাইকে বলে বেড়ায় তুমি ওর ওয়াইফ। তুমি কি এটা জানো ওর অফিসের কর্মচারীদের মাঝে তোমার ব্যাপারে কথা চলছে৷ তুমি কোত্থেকে এসেছো সেটা অফিসের কমবেশি সবাই জানে। কিন্তু সোহানের মুখোমুখি এসব কথা কেও বলতে পারে না ভয়ে। আজকে অফিস জানাজানি হয়েছে। কালকে সোসাইটির লোকজন জানাজানি হবে। কর্মচারীরা নাহয় ওর সামনে মুখ খুলে না চাকরি চলে যাবে সে ভয়ে৷ কিন্তু সোসাইটির লোক? ওরা নিশ্চয়ই চুপ করে থাকবে না। সোহানকে ইঙ্গিত দিয়ে অথবা সরাসরি তোমার ব্যাপারে কথা বলে বসবে। আবার তুমি কোথাও ওর সাথে বেড়াতো গেলে। তোমার পুরানো কোনো কাস্টমারের সাথে দেখা হয়ে গেলো। সোহানের সামনেই তোমাকে খারাপ প্রস্তাব দিয়ে বসলো। তখন কি হবে? ওর কতটা ইনসাল্ট হতে হবে আন্দাজ করতে পারছো? ও কি এধরনের বাজে ব্যাপারগুলোর মুখোমুখি হওয়ার যোগ্য? আজ যদি তোমার সাথে না জড়িয়ে আমাদের স্ট্যাটাসের কারো সাথে সম্পর্কে জড়াতো তাহলে নিশ্চয়ই ওকে এসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো না। এই ব্যাপারগুলো কি আমার ছেলেকে শান্তিতে থাকতে দিবে? যাকে ভালোবাসো তুমি কি চাও না সে ভালো থাকুক? তার জীবনটা সুন্দর হোক?
নিঃশব্দে কাঁদছে মায়া। মনে হচ্ছে কেও গলা টিপে ধরে রেখেছে৷ নিজেকে তুচ্ছ থেকে আরো বেশি তুচ্ছ মনে হচ্ছে। উনার প্রতিটা কথা খুবই যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে মায়ার। কথাগুলো সত্যি ছিলো। বাস্তবতাটা আজ বোধহয় একটু বেশিই নির্মম মনে হচ্ছে। নিজের পরিচয়টা এতদিন মেনে নিলেও আজ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না মায়া। ইচ্ছে হচ্ছে গায়ের চামড়া কেঁটে আবার নতুন চামড়া লাগিয়ে নিতে। যে চামড়ায় কোনো ময়লা লেগে থাকবে না।
– এখন বাকিটা তোমার ইচ্ছা। তুমি কি সোহানকে ভালোবেসে ওর ক্ষতি করবে নাকি দূরে সরে গিয়ে ওর উপকার করবে। আমার যা বলার ছিলো আমি বললাম। তুমি কি সিদ্ধান্ত নিবে তা তুমি নিতে পারো। আসি।
সোহানের বাবা উঠে চলে গেলেন। মায়ার মাথায় কথাগুলো তীরের মতো বিঁধছে। মনে হচ্ছে যেনো মস্তিষ্কের ভিতরটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে।
পুরো আধাঘন্টা ড্রইংরুমের সোফায় বসে ছিলো মায়া। এই আধাঘন্টায় মন খুলে কেঁদেছে এবং নিজের সাথে বোঝাপড়া করেছে । থাকবে না ও সোহানের জীবনে। চলে যাবে আগের জায়গায়। যাকে ভালোবাসে তার অপমান বা কষ্টের কারন সে হতে চায়না। পাশে থেকেই ভালোবাসতে হবে এমন কোনো কথা নেই। দূর থেকেও ভালোবাসা যায়। দূরে সরে গিয়ে যদি ভালেবাসার মানুষটা ভালো থাকে তবে তাই হোক। সবার গল্পের সমাপ্তি সুন্দর হয়না। ওর ভাগ্যে অসুন্দর সমাপ্তি ছিলো। ভাগ্যকে মেনে নিতে হবে। নিজের অবস্থানটাকে মেনে নিতে হবে। দাঁত মুখ শক্ত করে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে মায়া। রতনের হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে বেরিয়ে এসেছে সংসার থেকে। ওর সংসার, যেটা সোহান ওকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো। যা আজ এই এ মূহূর্ত্ব থেকে মায়ার জন্য প্রাক্তন হয়ে গেছে।
(চলবে)