স্মৃতির পাতা
লেখা –সুলতানা ইতি
আমাকে আপনার কেমন লেগেছে?
– মানুষকে যেমন লাগে আপনাকে ও ঠিক তেমনি লেগেছে
– নাহ মানে এই যে আমার আর আপনার বিয়ের কথা চলছে, লাইফ পার্টনার হিসেবে কেমন লেগেছে
ইতি এই প্রশ্নের উত্তর দেয়নি কি বা দিবে, বলবে যে আপনাকে আমার পছন্দ হয়নি এই তো, এই নিয়ে বারোজন পাত্র পক্ষ এসে দেখে গেলো ইতি কে
সব গুলোর কোন না কোন খুঁত বের করে বিয়ে ভেঙে দিয়েছে ইতি আজ তের নাম্বার পাত্রে সামনে দাঁড়িয়ে
এই তেরো নাম্বার পাত্রের নাম তন্ময়, সরকারের উচ্ছপদস্থ কর্ম কর্তা সে
ইতি কে চুপপ করে থাকতে দেখে তন্ময় বল্লো
– কি হলো চুপ করে আছেন যে
ইতি- আমার কিছু বলার নেই
তন্ময়- তা হলে কি বুঝে নিবো আপনি আমায় পছন্দ করেন নি
ইতি- আপনার যা ইচ্ছে বুঝতে পারেন আমার কিছু করার নেই
তন্ময় চলে যাচ্ছিলো কি ভেবে থেমে গিয়ে ইতিকে বল্লো
– আপনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে
নাহ আপনি এতো সিরিয়েসলি নেবেন না, মেয়ে দেখতে আসলে পছন্দ হবেই তাই বলে সে পছন্দ বিয়ে অব্দি যায় না, আপনার ইচ্ছে না থাকলে বিয়ে হবে না
পাত্র পক্ষ চলে গেছে অনেক্ষন
আকাশ ঘোমরা হয়ে আছে যে কোন মুহুর্তেই কান্না শুরু করে দিতে পারে
ইতি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে
কিছুক্ষন পর ইতির মা এসে ইতির পাশে দাড়ালো
মেয়ে কে তিনি বললেন
– কি রে মন খারাপ কেনো তোর
ইতি মায়ের দিকে না তাকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বল্লো
– মা মনে হয় বৃষ্টি আসবে তাই না চারিদিকের পরিবেশ টা কেমন ঘুমোট বেধে আছে
ইতির আম্মু বল্লো আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি
ইতি আকাশের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মায়ের দিকে তাকালো
মা বলো তো এতো তাড়া কেনো তোমাদের আমার বিয়ে নিয়ে সবে মাত্র কলেজে উঠলাম এখন বিয়ে না দিলে ই নয়
ইতির আম্মু মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বল্লো
– এখন বিয়ে হলে সমস্যা কি মা,তন্ময় ছেলেটা খুব ভালো, তোকে ওর খুব পছন্দ হয়েছে,এবার আর না করিস না মা বিয়েটা করে নে,আমরা তোর ভালো চাই
ইতি- মা তোমার সাথে কথা টা না বললেই ভালো হতো এই বলে ইতি রাগ দেখিয়ে চলে যায় ব্যালকেনি থেকে
রুমের সব দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে রুম টা কে অন্ধকার করে খাটের মাঝ খানে বসে আছে ইতি
ভাবছে ছোট বেলার কথা কি সুন্দর ছিলো জীবন টা তখন সারা দিন ক্লাস করে ফেরার পথে হৃদয়ের সাথে দুষ্টুমি করতে করতে বাড়ি ফেরা তার পর বাড়িতে এসে ও বিকেল হৃদয়ের সাথে খেলতে বের হওয়া, কি যে ভালো লাগতো, ঝগড়া বাধতো তখন যখন হৃদয় অন্য ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলতে যেত,
তখন ইতির খুব কষ্ট হতো, কান্না চলে আসতো কিন্তু ইতি চোখের পানি কাউকে দেখতে দিতো না,লজ্জা করতো ইতির কারো সামনে কাঁদতে গেলে
এই সময় ছোট নিহা দরজা ধাক্কা তে শুরু করলো
ইতি কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে এলো
দরজা খুলে দিলো
ইতি- নিহু এতো জোরে দরজা ধাক্কালি কেনো
নিহু- আপি বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে চলো ভিজি
ইতি- আমার ভালো লাগছে না তুই যা
নিহু মুখ কালো করে চলে যায়
ইতি আবার ভাবনাতে ডুবে গেলো ইদানীং খুব বেশি হৃদয়ের কথা মনে পড়ে জানতে ইচ্ছে করে হৃদয় এখন দেখতে কেমন হয়েছে, ও কি আমার কথা মনে রেখেছে
ভাবনার মধ্যে ইতির সময় কেটে গেলো
পরদিন সকালে স্নেহার ফোন, স্নেহা ইতির বান্ধুবী ক্লাস সিক্স থেকে তাদের এই বন্ধুত্ব,এখন কলেজ অব্দি টিকিয়ে রেখেছে স্নেহা
স্নেহা ফোন করে বল্লো
– কিরে ইতি আজ তিন দিন কলেজে আসিস না, আজ ও কি আসবি না নাকি
ইতি-কলেজে যেতে ইচ্ছে করছে না
স্নেহা- আজ কলেজে না গেলে বিরাট কিছু মিস করবি
ইতি- কেনো কলেজে কি হয়েছে?
স্নেহা- আজ হৃদয়, সায়নি কে প্রপোজ করবে তা ও ক্যাম্পাসে সবার সামনে
ইতি- ঠিক আছে আমি আসছি
ইতি কল অফ করে দেয়
হৃদয় নাম টার প্রতিই তার একটা মায়া জমে গেছে হৃদয় নামের কেউ যদি কোন মেয়ে কে ভালোবাসে এটা শুনতে ও ইতির ভালো লাগে
তার উপর কলেজ সুন্দরী সায়নি কে প্রপোজ করবে তার থেকে বয়সে দু বছরের ছোট হৃদয় ব্যাপার টা সত্যি মিস করা যায় না
ইতি কলজের জন্য রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লো
কলেজে গিয়ে ইতি ক্যাম্পাসে বসে আছে পাশে স্নেহা, কখন শুরু হবে সায়নিদের প্রপোজ পর্ব কে জানে
স্নেহা অনেক্ষন চুপ করে থেকে ইতি কে বল্লো
– কিরে শুনলাম তোকে নাকি আবার ও কালকে পাত্র পক্ষ দেখে এসেছে
ইতি একটা নিশ্বাস ফেলে বল্লো এ আর নতুন কি
স্নেহা- হুম সেটাই,কিন্তু সব সময় শুনতাম ছেলেরা মেয়েদের রিজেক্ট করে আর তোর বেলায় পুরো ভিন্ন তুই সব ছেলে কে রিজেক্ট করিস তা ও ছেলেদের কোন ক্রুটি না থাকলে ও তুই ঠিক খুজে বের করে বিয়ে ভেংগে দিস, কিন্তু কেনো এমন করিস তুই আজ ও বললি না
ইতি- এমনি, এখন বিয়ে করার ইচ্ছে নেই তাই
স্নেহা- আন্টি আংকল আসলেই বোকা এতো ভালো প্রপোজাল গুলো আসে তবু ও তারা তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে না গিয়ে বিয়ে ভেংগে দেয়,আর আমার বাবা মা হলে আমাকে জিজ্ঞাস ও করতো না নিজেরাই বিয়ে দিয়ে দিতো
ইতি- হয়তো আমার মা বাবা বেশি ভালো
স্নেহা- হয় তো,কিন্তু তুই আমার কাছে সত্যি কথা বলছিস না
ইতি- তোকে আমি মিথ্যা বলবো কেনো
স্নেহা- মিথ্যা ই তো বলছিস, তোকে কখনো ক্লাসের ছেলেদের সাথে কথা বলতে দেখিনি, কোন প্রপোজাল একসেপ্ট করিসনি তুই, সব সময় ছেলেদের এড়িয়ে গেছিস, কিন্তু কেনো এই সব জানতে ইচ্ছে করে প্লিজ বলনা
ইতি – যে কথা আমি জীবনে ও কাউকে বলিনি আজ তোকে সে কথা বলবো কিন্তু তুই হাসতে পারবি না আমার কথা শুনে
স্নেহা- আরেহ আগে তো বল তার পর না হয় ঠিক করবো
ইতি বলতে শুরু করলো
আমি তখন ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে উঠবো হঠ্যাৎ ই বাবা কে টান্সফার করে ফেনি নেয়া হয়,বুঝিস ই তো সরকারি চাকরি করলে যা হয় আর কি
নতুন স্কুল নতুন সব কাউকে ই চিনতাম না
ক্লাসের প্রথম দিন ই আমি একে বারে পিছনে গিয়ে বসি, টিপিনের সময় সবাই যখন খেলতে গেলো তখন আমি একা একা বসে আছি
এমন সময় একটা ছেলে আমাকে বল্লো,এই মনি খেলবি আমার সাথে
আমি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললাম
আমার নাম মনি নয় ‘ইতি’
ছেলেটি বল্লো ঠিক আছে আমার নাম হৃদয়, চল আমরা খেলবো
তখন আমি সহ হৃদয় আর তিন চার টা মেয়ে মিলে ‘বউ সি’ খেলি
তার পর ছুটির পর হৃদয় আমাকে ডেকে বল্লো এই মনি তোর বাসা কোথায় রে
আমি আমার বাসার এড্রেস দিলাম
হৃদয়- আরেহ সেখানে তো আমার ও বাসা, তোকে তো আগে দেখিনি
ইতি- আমরা এই কয়েকদিন আগেই এসেছি
হৃদয়- তা হলে চল দুজনে মিলে বাসায় যাই
ইতি- নাহহ আমার আম্মু আমাকে নিতে আসবে
হৃদয়- দুজনের বাসা তো এক ই জায়গাতে চল আমরা যাই, হৃদয়ের সাথে কথা বলতে বলতে চলে এলাম বাসায়
আম্মু বল্লো কিরে একা একা কি করে এলি
আমি বললাম আম্মু উপরের প্লাটে থাকে না হৃদয় সে আর আমি এক ই ক্লাসে পড়ি তার সাথে এলাম
এভাবেই হৃদয়ের হয়ে উঠে আমার খেলার সাথি একি সাথে অন্যতম একজন বন্ধু ক্লাসে ও হৃদয়ের সাথে বসতাম, অন্য মেয়েরা আমাকে খেফাতো বলতো ইতি হৃদয় জামাই বৌ,
শুনে আমি খুব কান্না করতাম আর হৃদয় লজ্জা পেতো ও আমার সাথে বসতে চাইতো না
বাসায় ও আমার এক সাথে ই খেলতাম হৃদয় পাড়ার ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলতে গেলে আমি দাঁড়িয়ে দেখতাম মাঝে মাঝে প্লেয়ার কম হলে আমি বলতাম হৃদয় আমি ও খেলবো নে না
আমাকে সাথে,
একদিন তো প্রথম বলে আমি ছক্কা মারি, তার পর সে ম্যাচে হৃদয় কে হারিয়ে দিই হৃদয় সেদিন কি রাগ না ই করেছে
হৃদয় আমাকে কেনো জানি মনি নামেই বেশি ডাকতো কিন্তু আমি মনি নাম টা পছন্দ করতাম না
একদিন হৃদয় বল্লো তোকে মনি বললে তুই রেগে যাস কেনো
আমি বললাম
-মনি তো কালো মেয়েদের নাম হয়,আর আমি তো সুন্দর
হৃদয় অনেক হাসে
আর আমার খুব রাগ লাগছিলো তখন।
হৃদয় বল্লো কে বল্লো তুই সুন্দর আমি তো দেখি তুই ফেত্নি” মনি ফেত্নি”
সেদিন আর হৃদয়ের সাথে খেলতে বের হইনি
ইতির কথা গুলো স্নেহা গ্রোগ্রাসে গিলছিলো ইতি থামতেই স্নেহা বল্লো
– আহ থামলি কেনো বলনা তোর ছোট বেলার প্রেম কাহিনি একটু শুনি
ইতি- একদম ফাজলামি করবি না স্নেহা, নইলে বলবো না আর
স্নেহা- ঠিক আছে করলাম না বলতো এবার
ইতি – একদিন আমরা ঠিক করলাম পাশের বাসার সানিয়াদের পেয়ারা চুরি করবো কিন্তু কি করে পেয়ারা পাড়বো জানিই না হৃদয় তো গাছে উঠতে পারে না
আমি ও পারি না
হৃদয় বল্লো
– ইতি তুই গাছে উঠ আমি তোকে পিছন থেকে ঠেলে ধরবো
হলো ও তাই, তবুও পেয়ারা পাড়তে পারিনি বরং পড়ে হাতে ব্যাথা পেয়েছি
ফাইভের বছরের পরেই বাবা আবার এখানে চলে আসে তার পর তুই আমার বন্ধু এই তো
স্নেহা- সেকি মজনুর সাথে আর কখনো কথা হয়নি
ইতি- স্নেহায়ায়ায়া
স্নেহা- ওকে ফাইন আর মজা করবো না এই জন্য ই তো বলি ফেজবুকে তোর ফ্রেন্ডলিস্টে হৃদয় নামের এতো ছেলে কেনো
ইতি- হুম বলতে পারিস হৃদয় নামটা ই এখন আমার অনেক প্রিয়ো,হৃদয় নামের সব ছেলের ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট আমি একসেপ্ট করি আর তাদের ব্যাক গ্রাউন্ড চেক করি, কিন্তু কাউকে আমার হারানো হৃদয়ের মতো লাগে না
স্নেহা- আচ্ছা একটা কথা বল,তুই যখন কার কথা বলছিস তখন তুই ভালোবাসার ‘ভ’ টা ও বুঝতি না তা হলে এখন ও তাকে ভুলতে পারিসনি কেনো
ইতি- জানি না কেনো ভুলতে পারিনি যতো ই বড় হতে লাগলাম ততই হৃদয় কে এক নজর দেখার লোভ হতে শুরু করে, আজ ও মনটা হা হাকার করে হৃদয় কে একটু দেখতে,শুধু দেখবো বড় হওয়ার পর এখন ও দেখতে কেমন হয়েছে,ও কি অনেক মেয়ের সাথে প্রেম করে নাকি, আমার মতো একা থাকে
স্নেহা- হৃদয় তোর মতো পাগল হয়তো নয় বুঝলি,ছোট বেলার কথা কেউ মনে রাখে নাকি
ইতি- আচ্ছা চল বাসায় যাই
স্নেহা- হুম চল,আচ্ছা মনি নামের মেয়েরা কালো তোর এই ধারনা কি এখন ও আছে
ইতি- তুই কি পাগল,তখন আমাদের কাজের মেয়েটার নাম মনি ছিলো আর সে ছিলো কুচকুচে কালো,তাই আমি ভাবতাম বুঝি মনি নামের মেয়েরা ই কালো,এখন আর সে ধারনা নেই
ইতি বাসায় চলে আসলো বাসায় এসেই শুনে
এবার বাবা অতিস্ট হয়েগেছে আমার উপরে আর তাই তিনি নিজেই তন্ময়ের সাথে বিয়ের কথা ফাইনাল করে
ইতি কথা শুনেই অনেক রেগে যায় তার পর কাদতে কাঁদতে স্নেহাকে ফোন করে সব বলে
স্নেহা বল্লো- ইতি পাগলামি ছাড়,তন্ময় কে বিয়ে করে নে,দেখবি হৃদয়ের কথা আর মনে হবে না,আর দেখ তুই তাকে মনে রেখেছিস সে তোকে মনে না ও রাখতে পারে,ঐ বয়সের কথা অনেক ই বড় হলে আর মনে রাখে না
ইতি- তুই ও বলছিস
স্নেহা- হুম বলছি কারন আমরা সবাই তোর ভালো চাই,এবার স্মৃতির পাতা বন্ধ কর বাস্তবতার পাতা উলটা দেখবি সব ঠিক আছে
ইতি কল অফ করে দেয় স্নেহার কথা গুলো শুনতে ভালো না লাগলে ও কথা গুলো যুক্তিযুক্ত, ইতি মেনে নেয় তার ভাগ্যকে তৈরী হয় তন্ময়ের বউ হওয়ার জন্য
কিন্তু সত্যি কি ইতি স্মৃতির পাতা বন্ধ করতে ফেরেছে
হয়তো পারেনি,কোন এক ক্লান্ত দুপুরে হয়তো স্মৃতির পাতায় খুজবে তার প্রিয়ো নাম টা, হৃদয়ে হৃদয়
সমাপ্ত