স্বচ্ছ প্রণয়াসক্ত পর্ব-২৫

0
1056

#স্বচ্ছ_প্রণয়াসক্ত
#পর্ব_২৫
#মুসফিরাত_জান্নাত

চিকিৎসাকেন্দ্র এক অদ্ভুত জায়গা।যেখানে উপস্থিত হলে ধীর চিত্তের মানুষও অস্থির হয়ে ওঠে।এখানে অপেক্ষা করাটা ভীষন কষ্টদায়ক হয়ে যায়।ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষারত রুগীগুলোর ক্লান্ত মন অনেকটা সুবাধাবাদী হয়ে ওঠার চেষ্টা চালায়।অনেকের পরে এসেও নিজের সিরিয়াল আগে আসুক এই বাসনা মনের ভিতরে পোষণ করে।প্রত্যেকটা হৃদয়ের জন্যই একই নিয়ম প্রযোজ্য।ঐশীও তাদের ব্যতিক্রম নয়।ডাক্তারের চেম্বারের সামনে নিজস্ব সিরিয়াল পাওয়ার অপেক্ষায় বসে রয়েছে সে।পাশে সাদাত বসা।চোখে মুখে তার অন্যরকম চাঞ্চল্য বিরাজ করছে।বাবা হওয়ার সম্ভাবনাটা বসন্ত সুখ দিচ্ছে মনে।সেই সুখটা ভাগ করে নিতে ঐশীর দিকে আড় চোখে তাকায় সে।মেয়েটির এক হাত নিজের হাতে পুরে নিয়ে বলে,

“আচ্ছা একটা কথা বলোতো। আমাদের সন্তানটা ছেলে হবে নাকি মেয়ে?”

সাদাতের মোহনীয় কণ্ঠে প্রশ্নটা শুনে নিমিষেই সিরিয়ালের অপেক্ষার বিরক্তি কমে যায় ঐশীর।তার স্থানে আগ্রহের দল হানা দেয়।দীপ্তিময় মুখে সে জিজ্ঞেস করে,

“আপনি কি চান?”

“আমি চাই আমাদের কন্যা সন্তান হোক।”

“সবাই তো পুত্র সন্তানের বাবা হতে চায়।আপনি কন্যা সন্তান চাইছেন কেনো?”

“ভুল বললে।সবাই না, বেশিরভাগ মানুষ চায়।কন্যা সন্তান হলে মুখ বেজার করে তারা।কিন্তু তারা হয়তো বোঝে না,পৃথিবীতে কোনো কন্যা সন্তান না হলে পরবর্তীতে কোনো পুত্র সন্তানেরও জন্ম হবে না।আর সবগুলো পুত্র সন্তান হলে এক সময় পৃথিবী থেকে মানব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।তাছাড়াও কন্যা সন্তান আল্লাহ প্রদত্ত রহমত।তাকে সঠিক কায়দায় মানুষ করে তুললে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জাহানে লাভবান হওয়া যায়।আর পুরুষ ছাড়া যেমন নারী অসম্পূর্ণ, তেমনি নারী ছাড়া বাড়িও অসম্পূর্ণ।একটা বাড়িকে মাতিয়ে রাখতে হলেও নারী দরকার।তাই আমি চাই আমার প্রথম সন্তান হিসেবে নারীই আসুক।”

সাদাতের কথাগুলো শুনে বিমোহিত হলো ঐশী।মুগ্ধ মন্ত্রের ন্যায় বললো,

“আপনি সবদিক দিয়ে সবার থেকে আলাদা।একদম অন্যপুরুষ।যার শিরা উপশিরায়,রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমাকে বিমোহিত করার মন্ত্র মেশানো।”

ঐশীর বচন শুনে স্মিত হাসে সাদাত।ঐশীকে এক হাতে আগলে ধরে বলে,

“আমার জীবনে তুমিও অন্য নারী।আমার হৃদয়েও তোমার স্থান সবার থেকে আলাদা।আর আমি চাই আমার কন্যাটা যেনো তোমার মতোই হয়।”

“তাহলে তো সে একদম খারাপ ছাত্রী হবে।আমার মতো টেনেটুনে প্রোমোটেড হবে।”

ঐশীর রগড়পূর্ণ কণ্ঠ শুনে হেসে ফেলে সাদাত।দ্বিধাবিভক্তি নিয়ে বলে,

“আমার বউকে একদম খারাপ ছাত্রী বলবে না।সে অনেক ভালো ছাত্রী।শুধু একটু পড়ালেখায় ফাঁকি বাজ তাই আশানুরূপ মার্ক পায় না।কিন্তু আমার মেয়ে ফাঁকিবাজ হবে না দেখো।বাবার গুনও তো কিছু পাবে নাকি?”

সাদাতের কথায় এক পশলা হাসে ঐশী।নিষ্কম্প নয়নে তাকায় সাদাতের দিকে।মনে মনে বলে,

“আমার সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে।আমি চাই সে তার বাবার একটু নয়,পুরো গুনটাই পাক।তবে আমার মতো পৃথিবীর আরও একটা নারী অথবা পুরুষ জীবনের সব দুঃখ ভুলে অসম্ভব সুখী হয়ে যাবে।”

কথাগুলো ভেবে স্থির নয়নে সাদাতের দিকে তাকিয়ে থাকে ঐশী।এর ফাঁকে তার সিরিয়াল চলে আসে।ডাক্তার দেখায় সে।ঐশীর পেটে হাত রেখে হালকা চেপে কিছু একটা পরোখ করে ডাক্তার।অতপর আল্ট্রাসাউন্ড করতে পাঠিয়ে দেয়।সময়ের বহমানতায় ধীরে সুস্থে আল্ট্রাসাউন্ড এর রিপোর্ট আসে।সেখানের কমেন্ট দেখে চুরমার হয়ে যায় ঐশী।চরম হতাশা ঘিরে ধরে তাকে।রেজাল্ট নেগেটিভ।সাথে পিসিওডি নামক অসুখ বাসা বেঁধেছে তার শরীরে।রোগটি সম্পর্কে কোনো ধারণা তার নেই।কিন্তু প্রেগন্যান্সির রেজাল্ট নেগেটিভ দেখে হতাশ সে।বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যায়।সাদাতের দিকে নিষ্প্রভ নয়নে তাকায় সে।লোকটার মুখটা দৃষ্টিতে স্পষ্ট হতেই বুকটা কেঁপে ওঠে তার।বাবা হওয়ার সন্দেহে কতোটা খুশি হয়েছিলো সাদাত তা সেও বেশ টের পেয়েছিলো।এখন কি করে তাকে বলবে ওটা মিথ্যা আমন্ত্রণ মাত্র।

ঐশীকে থমকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুটি করে সাদাত।মেয়েটির মুখাবয়াব দেখে সন্দিগ্ধ হয় সে।মনের ভিতর কু গেয়ে ওঠে।নিজেকে সামলে নেয় সে।ধাতস্থ কণ্ঠে বলে,

“মুখটা এমন চুপসে ফেললে কেনো?রিপোর্টটা এদিকে দেও দেখি।”

কথাটা বলে ঐশীর হাত থেকে রিপোর্ট নিজের দখলে নেয় সাদাত।কমেন্ট দেখতেই বুকটা ধক করে ওঠে তার।রেজাল্ট নেগেটিভ এর চেয়ে উল্লিখিত রোগটা নিয়ে বিচলিত হয় সে।কঠিন কিছু হয় নি তো ঐশীর?এমনটা হলে যে সে সহ্য করতে পারবে না।মেয়েটি তার পুরো হৃদয় দখল করে আছে।ঐশীর গায়ে একটু আঁচর লাগলেও যেখানে তার হৃদয়ে ব্যাথা হয় সেখানে মেয়েটির অজানা এই রোগটিও দহন সৃষ্টি করে মন মসজিদে।ঐশীর চিন্তায় নিজের পিতৃত্বের সুখ স্বপ্ন মুহুর্তেই মিলিয়ে যায় তার মনেরর মাঝে থেকে।অর্ধাঙ্গিনীর অসুস্থতাকে ছাপিয়ে স্বপ্ন ভাঙার যন্ত্রণা যে একটুও জায়গা করে উঠতে পারে না হৃদয়ে।বাধ্য হয়ে সাদাতের মন থেকে বিদায় নেয় ওই ক্ষীণ যন্ত্রণাটা।তৎস্থলে হানা দেয় অন্য চিন্তার দল।

ঐশীর দিকে চোখ তুলে তাকায় সাদাত।তার এক হাত ধরে রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করে সে।রিপোর্ট দেখে ও ঐশীর শরীরের সকল সিম্পটম শুনে গাইনি ডা. রুবাইদা ইসলাম রোগটি সম্পর্কে হালকা ব্যাখ্যা করে বলেন,

“আপনার যে রোগটি হয়েছে তাকে সংক্ষেপে পিসিওডি বলে।এর পুর্নরুপ পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ।এটি এক ধরনের বন্ধ্যাত্বজনিত রোগ।সাধারনত হরমোনাল ইমব্যালেন্স এর জন্য এই রোগটি হয়ে থাকে।মেয়েদের শরীরে পুরুষ হরমোন অ্যান্ড্রোজেন এর পরিমান স্বাভাবিকের থেকে বৃদ্ধি পেলে এই রোগটি হয়।লক্ষণ স্বরুপ অনিয়মিত মাসিক,শরীরে অবাঞ্ছিত লোম,ব্রন,অতিরিক্ত চুল পড়া,ওজন বৃদ্ধি,ওভারিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সিস্ট,মুড সুয়িং ইত্যাদি সমস্যাগুলো দেখা দেয়।অনেক রেয়ার ক্ষেত্রে স্কিন টোন কালোও হয়ে যায়।পিসিওডি এর সমস্যা থাকলে ডিম্বাশয়গুলি থেকে অপরিণত বা অর্ধ পরিণত ডিম নির্গত হয়।ফলে সন্তান জন্মদানে বাধা সৃষ্টি করে।কিন্তু ভয় পাবার কিছু নেই।চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন অনেক উন্নত।পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজিজ প্রতিরোধ করা মোটেও কঠিন নয়, প্রয়োজন সদিচ্ছা।নিয়ম মতো চললে প্রায় তিন মাসের মাঝেই এই রোগ নিয়ন্ত্রনে আনা সম্ভব।আপনার বাড়তি ওজন ঝরিয়ে ফেলতে হবে। ওজন স্বাভাবিক রাখতে নিয়ম করে হালকা এক্সারসাইজ ও শ্বাসের ব্যায়াম করতে হবে। টাটকা শাক, সব্জি, ফল খেতে হবে নিয়ম করে। ফাস্ট ফুড ও চিনি খাওয়া মানা। মানসিক চাপ কমিয়ে মন ভাল রাখতে হবে। অবশ্যই আমার দেওয়া পরামর্শগুলো মেনে চলবেন এবং নিয়মিত চেকআপ করবেন।তা হলে সন্তান ধারণ করতে কোনোরুপ সমস্যা হবে না আশা করছি।”

কথাগুলো বলে কিছু মেডিসিন লিখে দেন তিনি।এছাড়াও টিএসএইচ,টি ফোর,টি থ্রি থায়রয়েডজনিত এই হরমোনগুলো পরীক্ষা করতে পরামর্শ দেন।

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে ওনার লিখে দেওয়া ওষুধগুলো কিনে বাড়ি ফেরে ঐশী।আজকের রাতের জন্য সাদাত তার সঙ্গী হয়।মেয়েটির এই অবসন্ন চিত্তে তাকে একা ছেড়ে দেওয়া মোটেও সমীচীন নয়।

________
কৃষ্ণপক্ষের শেষ তিথির রাত।আকাশে চাঁদের আনাগোনা নেই।নেই তার স্নিগ্ধ আলো।শহরের বুক ঘোর আঁধারে তলিয়ে আছে।সেই আঁধারের রেশ এসে ঠেকছে ঐশীর চোখে মুখে।করিডোরে এসে একটু একাকীত্বের সন্ধান পেতেই ক্লান্ত, অবসন্ন চিত্তে কঠোরতার খোলসে আবৃত থাকা ঐশী ভেঙে পড়লো।ডুকরে কেঁদে উঠলো সে।বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে তার।মা হওয়ার আশা বুকে চেপে ডাক্তারের কাছে গিয়ে নিজে মা হতে অক্ষম জানাটা যে কতোটা বিষাক্ত অনুভুতি, তা হয়তো এই মুহুর্তে সে ছাড়া কেও অনুভব করতে পারছে না।অনুভুতির বিষে জর্জরিত হয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে সে।গগন বিদীর্ন করে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে তার।কণ্ঠস্বর গলিয়ে কষ্ট গুলো উজার করে দিতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু এসবে কোনে ফায়দা হবে না।যত যাই করুক না কেনো তার কষ্ট একটুও লাঘব হবে না।তার কষ্টের উৎপত্তি যে নিজস্ব অপূর্ণতা।

করিডোরের এক কোনে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে ঐশী।বাতাসে উড়ছে তার পাতলা চুল।ডাক্তারের বলা লক্ষণ গুলোর মাঝে ব্রন ব্যাতিরেকে সব লক্ষণই সঙ্গী হয়ে আছে তার।মুড সুয়িং এর করালগ্রাস থেকে মুক্তি পেতে এক সময় কত রাত ছটফট করেছে সে একমাত্র নিজেই ভালো জানে।কতোবার নিজের জীবনের হাল ছেড়ে দিয়ে ভেঙে পড়েছে তা সে ছাড়া কেও জানে না।কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তাকে একেবারে গুড়ো হয়ে ধুলোয় মিশে যেতে দেয় নি।বার বার নতুন উদ্যোমে বেঁচে ওঠার স্বপ্ন দেখিয়েছে তাকে।সে আবারও উঠে দাঁড়িয়েছে।তার এই ঘন ঘন বিষন্নতা থেকে মুক্তি পেতে বান্ধবীদের পরামর্শে জীবনে মাহিনকে জায়গা দিতে চেয়েছিলো সে।নয়া প্রেম যদি মনে বসন্ত আনতো সেই তৃষ্ণায় সেদিকে ঝুকেছিলো সে।কিন্তু সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা ভিন্ন ছিলো হয়তো।তার মুড সুয়িং এর নিরাময় হিসেবে সাদাতকে পাঠালেন ঐশীর জীবনে।সাদাত তার জীবনে আসায় সবকিছু বদলেই গেলো প্রায়।লোকটা জীবনে জড়িয়ে যাওয়ার পর থেকেই বিষন্নতার জায়গা হয় নি তার মন মসজিদে।কিন্তু সেই লোকটাকেই এখন হতাশ করে দিলো সে।সব বিষন্নতা উজার করে ঢেলে দিলো সাদাতের মাঝে।ব্যাপারটা মনে আসতেই চিন চিনে ব্যাথা হলো বুকে।অক্ষিপটে লোকটার শুদ্ধ চেহারা বার বার ভেসে উঠছে তার।বুকটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে তার।নিজের সাজানো স্বপ্নের সাম্রাজ্য এভাবে মিথ্যা হয়ে তাদের মুখ থুবড়ে দিবে কল্পনাও করে নি ঐশী।অসহ্য যন্ত্রণায় ঘোলা হয়ে যাচ্ছে তার চক্ষু যুগল।বেদনার অশ্রু চুইয়ে পড়ছে চিবুক বেয়ে।শরীরে কাঁপন ধরিয়ে এক টানা কেঁদে চলেছে সে।

একটু পরে ঘরে একটা প্লেটে খাবার নিয়ে উপস্থিত হয় সাদাত।ঘরে মেয়েটির উপস্থিতি না দেখে টেবিলে খাবারের প্লেটটা রাখে সে।গোছানো পা ফেলে এগিয়ে যায় ঐশীর কাছে।সাদাতের আগমনী বার্তা পেয়ে দ্রুত চোখ মুছে ফেলে ঐশী।নিজেকে ধাতস্থ করার আপ্রান চেষ্টা চালায়।কাছে এগিয়ে এসে সাদাত বলে,

“একা একা এখানে কি করছো?খাবার রেডি।খেতে চলো।”

ঘর থেকে আসা আবছা আলোয় সাদাতের মুখের দিকে তাকায় ঐশী।সাদাতের কথায় বেশ অবাক হয় সে।লোকটা বাক্যগুলো এমন ধাঁচের যেনো কিছুই হয় নি তাদের মাঝে।ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ঐশী।নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলে,

“খিদে নেই।খেতে ইচ্ছে করছে না আমার।”

সাদাত বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“কিন্তু কেনো?”

সাদাতের ভাবলেশহীন কণ্ঠে আরও অবাক হয় ঐশী।লোকটা এমন পাথুরে কেনো?সে কি একটুও বুঝছে না এমন একটা বিষয় জানার পর তার গলা দিয়ে খাবার নামবে না।আর সেও বা এতো স্বাভাবিক আছে কি করে?ঐশীর অপূর্ণতায় কি তার একটু অবহেলা হচ্ছে না?এমন হাজারো প্রশ্ন জাগে ঐশীর মনে।কিন্তু উত্তরের তলানি শূন্য।সাদাতকে কখনো পড়তে পারে না সে।লোকটার এই নির্লিপ্ত স্বভাবের জন্য সবার আড়ালেই যে থেকে যায় সে।

সাদাতের মুখের দিকে নিষ্প্রভ নয়নে তাকিয়ে থাকে ঐশী।চোখের মটক পড়ে না তার।মেয়েটিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে প্রশ্ন করে,

“কি দেখছো এভাবে?”

“আপনাকে।”

কাঁপা গলায় ছোট্ট করে জবাব দেয় ঐশী।মেয়েটির বিধ্বস্ত কণ্ঠ শুনে কিছু একটা ভাবে সাদাত।মেয়েটিকে স্বাভাবিক করা দরকার।এভাবে চললে একদম ভেঙে পড়বে সে।ঠিক এমন থমকানো মুহুর্তে সে রসিকতা শুরু করে।ধাতস্থ কণ্ঠে বলে,

“কেনো?আমাকে কি চিড়িয়াখানার জন্তু জানোয়ারের মতো দেখাচ্ছে, যে এভাবে দেখছো।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঐশী।লোকটা যে তাকে স্বাভাবিক করতে এমনটা করছে তা বুঝতে বাকি থাকে না তার।ক্লান্ত স্বরে সে বলে,

“আপনি এমন কেনো বলেন তো?আপনার কি একটুও অনুশোচনা হচ্ছে না?”

“কিসের জন্য অনুশোচনা হবে?”

ভ্রু কুটি করে জিজ্ঞেস করে সাদাত।ঐশী নেতিয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলে,

“এইযে একটা বন্ধ্যা মেয়ে আপনার কপালে জুটেছে।রাজ্যের বিষন্নতা আপনার মাঝে ঢেলে দিয়েছে।”

“তোমার সব বিষন্নতা আমাকে উজার করে দাও।
বিষন্নতা মুক্ত তোমার মুখ পানে তাকালেই উল্লসিত হবো আমি।”

সাদাতের কথাগুলোয় অন্যসময় মনটা হালকা হলেও আজ বুক কেঁপে ওঠে তার।এমন শুদ্ধ মনের অধিকারী একজন কিনা তার মতো মেয়ে পেলো।করুন গলায় সে বলে,

“আচ্ছা আপনাকে যদি কখনো বাবা হওয়ার সুখ না দিতে পারি আমি।তখন কি হবে?একটা অপূর্ন মেয়ে আপনার জীবনসঙ্গী,এটা নিয়ে অনুশোচনা হচ্ছে না আপনার?একটুও অবহেলা জন্মাচ্ছে না আমার প্রতি?”

ঐশীর কথাগুলো শুনে লম্বা স্বাস টানে সাদাত।মেয়েটি যে বিধ্বস্ত অবস্থায় ভুলভাল বকছে স্পষ্ট বোঝে সে।এই মুহুর্তে চাপা রাগ কাজ করলেও তাকে শাশাতে ইচ্ছে করে না তার।নিজেকে সংযত করে সে।গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

“নিজের অপূর্ণতা নিয়ে নিজেকে অবহেলা করতে দেখেছো কাওকে?দেখোনি তো!তবে নিজের অর্ধেক অংশ,আমার অর্ধাঙ্গিনীর অপূর্ণতায় কেনো অনুশোচনা করব আমি?লাইক সিরিয়াসলি।আমাকে এতোটা বোকা মনে হয় তোমার?যেখানে তোমার অপূর্ণতা মানে আমার অপূর্ণতা সেখানে তোমাকে হেয় করবো কোন যুক্তিতে।সেই অবহেলার দাগ তো আমার গায়েই আগে পড়বে।আমি বরং আমার অর্ধেক অংশের অপূর্ণতাকে পূর্ণ করার চিন্তা করবো।আর ডাক্তার বলেছে বন্ধ্যাত্বজনিত রোগ আছে তোমার মাঝে।কিন্তু এটা সাড়বে না বা তুমি কখনো কনসিভ করতে পারবে না এমনটা তো বলেনি।”

“যদি কনসিভ না করে কখনো?”

“কনসিভ না করলে যে মা হওয়া যায় না এমনটাও তো নয়।তখন একটা বেবি এডপ্ট নিবো আমরা।কোনো না কোনো ব্যবস্থা তখন হবেই।এখন চলো খেয়ে নিবে।নিয়ম মতো চলে সেড়ে উঠতে হবে তোমাকে।”

সাদাতের স্বাভাবিক কথায় মনের অস্বাভাবিকতা অনেকটা হালকা হয় ঐশীর।বসা থেকে উঠে পড়ে সে।তার এক হাত ধরে তাকে ঘরে এনে রাতের খাবারটা খাইয়ে দেয় সাদাত।খাদ্যতালিকায় স্থান পেয়েছে পাতলা দুটো রুটি,এক বাটি সব্জি,এক কাপ ডাল ও একটা সিদ্ধ ডিম। এক টুকরো রুটি ছিড়ে সব্জি পুরে ঐশীর মুখে ধরে বলে,

“সুস্থ হওয়ার জার্নিটা আজ থেকেই শুরু করে দিলাম।এখন থেকে ডায়েট চার্ট মেনে চলবে তুমি।বাচ্চা যদি নাও হয় তো আমার কোনো আপত্তি নেই।কিন্তু আল্লাহ তায়ালা অন্যের যেই বাচ্চাটাকে আমার নিজস্ব সম্পদ করে দিয়েছে তাকে সুস্থ না রাখতে পারলে ঘোর আপত্তিতে ডুবে যাবো আমি।”

সাদাতের গম্ভীর্যপূর্ণ কথায় একটু হাসার চেষ্টা করে ঐশী। তার কথাগুলোর যাদুতে নতুন উদ্যোমে জেগে ওঠার স্বপ্ন খুজে পায় সে।সত্যি সুস্থ হতে হবে তাকে।এই মানুষটার জন্য হলেও সুস্থ হতে হবে।এতো ভালো একটা মানুষের মনে কোনো আপত্তির জন্ম দেওয়া যাবে না।অন্তত পক্ষে চেষ্টা তো করবে সে।রাতের খাবারটা শেষ করে দশটার মাঝে ঘুমিয়ে যায় দুজনে।সকালে ফজর পরে আর ঘুমানোর জন্য বিছানায় যায় না ঐশী।সকালপ ঘুমানো যে তার বারণ।ওজন কমানোর উদ্দেশ্যে হাঁটতে বের হয় সে।তার চলার সঙ্গী হয় সাদাত।পাশাপাশি পা ফেলে এগিয়ে চলে দূর পথে।এই পথচলা যে তার নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য প্রথম পদক্ষেপ।সে কি আদৌ পূর্ণ রুপে পিসিওডি প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে?নাকি ওভাবেই পড়ে রইবে।জানতে হলে গল্পের আরও কয়েক পাতা উল্টাতে হবে।সাথে উল্টাতে হবে ঐশীর জীবন ব্যবস্থা।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে