#স্বচ্ছ_প্রণয়াসক্ত
#পর্ব_২১
#মুসফিরাত_জান্নাত
কোনো মতো তৈরি হয়ে আবারও কমিউনিটি সেন্টারের উদ্দেশ্যে বের হতে পা বাড়ায় ঐশী।চাল চলনে বেশ সংকোচ তার।সাদাত বিছানায় বসে ফোন স্ক্রোল করছিলো।মেয়েটির দিকে এক পলক তাকায় সে।মেয়েটির পড়নে একটা দামী থ্রি পিচ স্থান পেয়েছে।ভারী কাজের ওড়নাটা পিন দিয়ে সুন্দর মতো গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে।যখন সে দরজার কাছে যেতে নেয় তখন গম্ভীর কণ্ঠে ডেকে ওঠে সাদাত।থমকে দাঁড়ায় ঐশী।লজ্জামিশ্রিত বদন তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সে।মেয়েটির অভিব্যক্তি দেখে সাদাত নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে,
“তোমার কি মাথা গিয়েছে নাকি?এভাবে অতো মানুষের ভীরে যাবে তুমি?”
অবাক হয় ঐশী।আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলে,
“তো কিভাবে বের হবো?সাজ পোশাকে তো বের হতে দিবেন না।তাছাড়া এখন সাজার সময়ও নেই।আপু ওয়েট করছে।”
“তাই বলে এভাবে যাবে?একটু লিপস্টিক লাগাও।”
বিষ্ময়ের মাত্রা আকাশ ছোঁয় ঐশীর।সাদাত তখন লিপস্টিক দেওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করলো।এখন আবার নিজেই লিপস্টিক দিতে সাধছে।
লোকটার কি তার মতো মুড সুয়িং হচ্ছে নাকি?কখন কি বলে কিছুই বুঝছে না ঐশী।বিষ্মিত ভঙিতে সে জিজ্ঞেস করে,
“লিপস্টিক কেনো?”
“আয়নার সামনে দাঁড়াও।তবেই সবটা বুঝতে পারবে।”
নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিয়ে আবারও ফোনের স্ক্রিনে মনোযোগ দেয় সাদাত।ঐশী সন্দিহান হয়।সন্দিগ্ধ নয়নে তাকিয়ে প্রথম ও শেষ বারের ন্যায় নিজেকে পূর্ণ রুপে পর্যবেক্ষণ করতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায় ঐশী।নিজের চেহারাটা দেখতেই কুঁকড়ে যায় সে।সাথে চোখমুখ ঢেকে যায় প্রগাঢ় লজ্জায়।ঠোঁটের নিচের দিকের একটু অংশে সাদাতের লাভ বাইট লালাভ বর্ণ ধারণ করে স্পষ্ট হয়ে ফুটে রয়েছে।গলদেশের বিভিন্ন অংশ লালাভ বর্ণ ধারণ করে আছে।বিশেষত তীল যুক্ত স্থানটা চোখে পড়ছে বেশ।ঐশী বুঝলো শুধু লিপস্টিকে যথেষ্ট নয় হিজাবেও আবৃত হওয়া জরুরি।পুনরায় সাজ সজ্জার ইচ্ছা বা এনার্জি কোনোটা না থাকা সত্বেও গাঢ় রঙা একটা লিপস্টিকের প্রলেপ দিয়ে নিজেকে লজ্জিত হওয়া থেকে মুক্তি দেওয়ার ব্যর্থ প্রয়াস চালালো সে।লিপস্টিকের নিঁখুত প্রলেপে পুরো ঠোঁট ঢেকে গেলেও ঠোঁটের নিচের দিকটা ঢাকা পড়েনি।সেখানটার লালাভ অংশ লিপস্টিকের ফাঁকে উঁকি দিয়েই চলেছে।সেচ্ছায় সেখানটায় কিঞ্চিৎ ছড়িয়ে লিপস্টিক লাগিয়ে দিলো সে।তারপর গিয়ে কাবার্ড থেকে হিজাব বের করলো।তড়িৎ নিচে কিছু একটা পড়লো।শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকালো সাদাত।তার গিফট করা চকোলেটটা হিজাবের সাথে বেরিয়ে এসেছে।ঐশী পুনরায় সেটাকে কাবার্ডে রাখতে নিতেই কানে বাজে সাদাতের কণ্ঠ।
“ওটা শিক্ষা সফরের দিনে আমার গিফট করা চকোলেট না?”
মাথা নাড়িয়ে সায় জানায় ঐশী।আশ্চর্য হয় সাদাত।বিমূঢ় কণ্ঠে শুধায়,
“ওটা তুমি খাওনি কেনো?”
অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ঐশী।এখন কীভাবে সে বলবে শেষ হয়ে যাবে বলে খায়নি।ব্যাপারটা ভীষণ লজ্জাজনক হবে।একটু পূর্বের ঘটনায় এমনিতেই চোখ মুখ থেকে লজ্জা সড়ছে না তার।এখন আবার তাকে লজ্জায় ফেলে দেওয়ার জন্য সাদাতকে নতুন টপিক দেওয়া যাবে না।কিছুটা আমতা আমতা করে সে বলে,
“চকোলেট আমার খুব বেশি পছন্দ নয়।”
“কলেজে যখন বান্ধবীদের সাথে কাড়াকাড়ি করে খাও তখন অপছন্দ লাগে না?”
সাদাতের বাঁকা প্রশ্নে চুপ করে থাকে ঐশী।সাদাত তার নিরবতা দেখে যায় কিছু সময়।অতঃপর সুক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বলে,
“আমি দিয়েছি বলে খাওনি তাই না?এতো অবজ্ঞা?”
সাদাতের উচ্চারিত বাক্য দুটিতে স্পষ্ট অভিমান মেশানো।বুকটা কেঁপে ওঠে ঐশীর।সাদাতের ভুল ভাঙাতে ব্যস্ত হয় সে।ক্ষীন স্বরে জবাবে সে বলে,
“ব্যাপারট এমন নয়।আপনার দেওয়া প্রথম দান ফুরিয়ে যাবে বলে খাইনি আমি।যত্নে রেখেছি।”
ক্রমেই মনের মেঘ কেটে যায় সাদাতের।মেয়েটার আবেগী আলাপনে মুগ্ধ হয় সে।যার রেশ দেখা যায় তার দু ঠোঁটের কিনারে।হালকা হেসে নিজের মুগ্ধতার চেয়েও ঐশীকে অধিক মুগ্ধ করতে সে বলে,
“এটা যত্নে রেখেছো কাবার্ডের দখলে।অথচ আমি এটা তোমার দখলে রাখতে দিয়েছিলাম।”
“মানে?”
বিমূর্ত হয়ে শুধায় ঐশী।প্রতিউত্তরে নিস্পৃহ কণ্ঠে সাদাত বলে,
“তোমাকে দেওয়া আমার প্রথম উপহার হিসেবে আমি ফুল না দিয়ে খাদ্যসামগ্রী নির্ধারন করেছি কেনো জানো?এমনটা করার মুল কারণ হলো খাবারটা তুমি গলাধঃকরণ করলে তোমার শরীর গঠনে ব্যবহৃত হবে এটা।তাই আমার ভালোবাসার দানের সারাংশ তোমার মাঝেই থেকে যাবে।তাই ওটা যত্নে তুলে না রেখে,পরম যত্নে খেয়ে ফেলো।”
কিন্তু চকোলেটটা ঐশীর খাওয়ার কোনো ইচ্ছা হয় না।তার অনিচ্ছার কারণ ব্যক্ত করে সে বলে,
“হুম সারাংশ আমার মাঝে থাকবে আর বাকিটুকু পায়ুপথে নির্গমন হবে।আপনার ভালোবাসার দানের কিঞ্চিৎ পরিমানও দুর্গন্ধ যুক্ত মলে রুপান্তরিত হোক তা আমি চাই না।তাই ওটা আমি খাবো না।আপনার দান থাক না আমার কাবার্ডের দখলে।তাও তো আমার চোখের প্রশান্তি হয়ে থাকবে।”
ঐশীর যুক্তিটা শুনে বিষম খেলো সাদাত।মেয়েটার মাথায় সবসময় উদ্ভট চিন্তা খেলা করে।তার এতো মধুর ভাবনাকে কেমনে ধর্ষন করে দিলো।কেনো যে সে এর সাথে নিজের মনোভাব প্রকাশ করতে গিয়েছিলো কে জানে।নিজেকে পদলেহন করার জন্য আফসোস হয় তার।কোনো দ্বিরুক্তি না করে ফোনের মাঝে ডুবে যায় সে।আর ঐশী হিজাব লাগানোয় মন দেয়।
______
কোলাহলে পূর্ণ কমিউনিটি সেন্টারের পরিবেশ বিষিয়ে উঠেছে তাবাসসুমের নিকট।ঐশীকে সেই কখন ফোনের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে অথচ মেয়েটা আসার নাম নিচ্ছে না।তাদের জন্য অনেকটা সময় বিলম্ব করেছে সে।অথচ তাদের হদিস মেলেনি।কল দিয়েও পাওয়া যায়নি দুজনকে।অগত্যা ছোট বোন ও বোন জামাই রেখেই তিন কবুল বলে ফেলেছে সে।বৈবাহিক অনুষ্ঠান শেষের দিকে চলে এসেছে প্রায়।ফটোগ্রাফার তখন থেকে ফটো তুলতে ব্যস্ত।শুরুতে উৎফুল্ল হয়ে ছবি উঠলেও এখন মুখটা ভার করে রেখেছে সে।ফটোগ্রাফার লোকটা বার বার তাকে হাসিমুখে পোজ দিতে বললে ধমক দেয় সে।
“আরে ভাই যেমনে আছি ওমনেই ছবি তুলেন তো।এতো ক্যাচাল করেন কেন?”
তাবাসসুমের ধমক খেয়ে ভড়কে যায় ফটোগ্রাফার। লোকটা।নিজের দোষটা কোথায় বুঝতে অক্ষম হয় সে।একদম চুপসে গিয়ে গোমড়ামুখো বধুর ক্যান্ডিড পিকচার ধারন করা শুরু করে।ব্যাপারটা লক্ষ করে রাসেল নিচু কণ্ঠে শুধায়,
“টেম্পার এতো হট কেনো?কি হয়েছে তোমার?”
“সেই কখন গিয়েছে ফোনটা আনতে।তাদের আসার কোনো নাম আছে?”
“এজন্য এমন মন খারাপ করতে হয়?পা’গলী মেয়ে।আজ রাতে ফোন দিয়ে কি করবেটা তুমি?”
“বাসরের জন্য ফুলে সজ্জিত খাটে ইচ্ছামতো ছবি উঠবো।অন্যরা কেমন ছবি তুলবে তার ঠিক আছে?আর তাদের সামনে তো আমি ইচ্ছানুযায়ী পোজ ও দিতে পারবো না।সবাই বের হয়ে গেলে তখন ছবি তুলব আমি।”
তাবাসসুমের কথা শুনে তটস্থ হয় রাসেল।মেয়েটার বিয়ের চেয়ে যেনো বউ সাজা ও ছবি ওঠাতেই আগ্রহ বেশি।তাকে নিয়ে কোনো প্লানই নেই।নিজেকে ধাতস্থ করে নেয় রাসেল।তাবাসসুমকে আশ্বাস দিয়ে বলে,
“ইচ্ছেমতো ছবি তো আমার ফোন দিয়েও উঠতে পারবে।এটা নিয়ে গোমড়া মুখে থেকে বর্তমানের ছবি গুলো গোল আলুর মতো বানাচ্ছো কেনো?হাসি মুখে থাকো।তাছাড়া পরে পস্তাতে হবে।”
সম্বিত ফিরে তাবাসসুমের।সত্যি তো।এটা তো সে ভেবে দেখেনি।পরবর্তী ছবি ওঠার চিন্তায় বর্তমান ছবিগুলো খারাপ করছে সে।রাসেলের দিকে কৃতজ্ঞতা নিয়ে তাকায় সে।অতপর ছবি ওঠায় মন দেয়।পরক্ষণেই ঐশী এসে সেখানটায় হাজির হয়।ঐশীকে দেখে অবাক হয় তাবাসসুম।বিষ্মিত হয়ে বলে,
“অবশেষে আসলি তাহলে।তা তুই গিয়েছিলি কি করতে?ফোন আনতে না গেটআপ চেঞ্জ করতে?”
তাবাসসুমের ব্যাঙ্গাত্মক কথার বিপরীতে তটস্থ হয় ঐশী।পুরো বিষয়টিকে স্বাভাবিক করতে সে মিন মিন করে বলে,
“দেখলাম এসেছিই যখন চেঞ্জ করে যাই।”
“তাই বলে এতো সময় নিবি?”
প্রতিউত্তরে নিরব রয় ঐশী।তাবাসসুম সরু চোখে ঐশীকে দেখে কিছু সময়।কেমন কাঁচুমাচু করছে মেয়েটা।অকারণেই তাবাসসুমের মনে হয় ঐশী লজ্জা পাচ্ছে।তীক্ষ্ণ চোখে ঐশীর দিকে তাকিয়েই সে বলে,
“তোর ভাবতাল তো ভালো ঠেকছে না ঐশী।বিয়ে হচ্ছে আমার অথচ চোখেমুখে লজ্জা তোর।কাহিনি কি বলতো?”
তাবাসসুমের কথায় অপ্রস্তুত হয়ে যায় ঐশী। লজ্জারা রুপান্তরিত হয় অসস্তিতে।এমন প্রশ্নের জবাব কি দিবে সে?কিছুটা হাঁসফাঁস করে সে।অতপর কিছু একটা ভেবে তাবাসসুমের হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“এটা জানা তোর ব্যাপার না।ফোনটা বুঝে পেয়েছিস মিটে গিয়েছে।সিন্থিয়া কোথায়?ওকে দেখছি না যে!”
বোনের এমন ইতস্তত করা আচরণে সন্দিহান হয় তাবাসসুম।হাত দিয়ে ইশারা করে সিন্থিয়ার অবস্থান দেখিয়ে দেয় সে।কিছু একটা বলতে যাবে তার পূর্বেই দ্রুত প্রস্থান করে ঐশী।সেদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তাবাসসুম।মনে আসা কৌতুহল মনেই চাপা পড়ে যায় তার।তার আর পুরো ব্যপারটা জানার আগ্রহ পুরন হয় না।
ঐশীকে দেখে উৎফুল্ল হয় সিন্থিয়া।এতোটা সময় খুব একটা মজা করতে পারছিলো না সে।প্রিয় বান্ধবীকে কাছে পেয়ে প্রাণ ফিরে পায় দেহে।বকবক শুরু করে দেয় সে।ঐশী যাওয়ার পর থেকে বিয়ে হওয়া অবধি সব কাহিনি শুনায়।উদাস হয়ে সবটা শুনে যায় ঐশী।কথার ফাঁকে হটাৎ সিন্থিয়া বলে,
“শাড়ি চেঞ্জ করে ভালো করছিস তুই।এমনিতে আজ যা গরম পড়েছে।এখন অনেকটা শান্তি পাবি।”
ঐশীও বিচক্ষণের সহিত মাথা নাড়ায়।ভঙ্গিমা এমন, যেনো এ কারনেই শাড়ি বদলেছে সে।ঐশীকে কিছু সময় পর্যবেক্ষণ করে সিন্থিয়া।অতপর একটা টিস্যু নিয়ে ঐশীর ঠোঁটের নিচে এগিয়ে নিয়ে বলে,
“লিপস্টিপ খানিকটা ছড়িয়ে গিয়েছে।আয় মুছে দেই।”
তড়িৎ সরে যায় ঐশী।কড়া কণ্ঠে বলে,
“খবরদার এখানটা মুছতে আসবি না।”
“কিন্তু কেনো?”
সিন্থিয়ার আলাভোলা চেহারার প্রশ্নে থতমত খায় ঐশী।কিছু একটা ভেবে সে বলে,
“কারণ এটা এখনকার ট্রেন্ড।ছড়িয়ে লিপস্টিক দিতে হয়।”
ভ্যাবলাকান্ত বনে যায় সিন্থিয়া। তটস্থ কন্ঠে বলে,
“লিপস্টিক ছড়িয়ে দেওয়া ট্রেন্ড এটা আমি জানলাম না কেনো?আমি কি এই যুগের মেয়ে না?”
ঐশীর ঐকান্তিক অভিব্যক্তিতে যে সিন্থিয়া নিজেকে ব্যাকডেটেড ভাবছে তা স্পষ্ট বোঝে ঐশী।ঠোঁট কামড়ে হাসে সে।মনে মনে বলে,
“জানবি কেমনে?এই ট্রেন্ডের প্রচলনকারী তো আমি।আর ট্রেন্ডের শুরুও আজ থেকে।”
অথচ মুখে কিছু বলে না।নিরবেই সময়টা কেটে যায়।তাবাসসুমকে তুলে দেওয়ার প্রহর ঘনিয়ে আসে।কান্নার রেওয়াজটা প্রায় কমে গেলেও বিদায় বেলায় চোখ ভেজাতে ভোলে না তারা।সব অনুভুতির বিরাম দিয়ে বাবা মা’কে জাপ্টে ধরে কান্না করে তাবাসসুম।আজকের পর থেকে হয়তো আর কখনোই তাদের এভাবে কাছে পাওয়া হবে না।এতো অধিকার, আপত্তি সব কিছু আড়ালে পড়ে যাবে বাস্তবতার করালগ্রাসে।
শেষবেলায় রাসেলের হাতের মুঠোয় পুরে দেওয়া হয় তাবাসসুমের কোমল হাত।মেয়েকে রাসেলের হাতে তুলে দিয়ে ধরা গলায় আনোয়ার খাঁন বলেন,
“মেয়ে দুইটা আমার অনেক শখের রত্ন বাবা।তার মাঝের একটা তোমায় দিলাম।আমার বড় কন্যা।প্রথব বাবা ডাক শোনার ধন।অতি যত্নে গড়া মোমের পুতুল সে।অনেক ভুল ত্রুটি করবে।চাইলেই ভালোবাসার উত্তাপে গলিয়ে নিজেদের মতো গড়িয়ে নিতে পারবে।কিন্তু আঘাত করো না কখনো।অল্প আঘাতেই যে সে মোমের ন্যায় চুরমার হয়ে যাবে।”
পাশ থেকে রাহেলা খাঁনম বলেন,
“সুখী হও দুজনে।এক সাথে সারাজীবন কাটাও।অনেক দোয়া রইল।”
চোখে তার টলমলে পানি।আনোয়ার খাঁনের হাতের উপর আরেক হাত রাখে রাসেল।শাণিত কন্ঠে জবাব দেয়,
“আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে আপনাদের মেয়েকে সুখে রাখার।আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।আমার দ্বারা কখনো কষ্ট পাবে না সে।”
হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছেন আনোয়ার খাঁন ।তাবাসসুমের দিকে তাকান এক পলক।মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“ও বাড়ি সবার সাথে মানিয়ে থাকিস আম্মা।ভালো থাকিস অনেক।দোয়া রইলো।”
সেই প্রথম বারের মতো করে এখন বাবার আম্মা ডাকটা হৃদয় প্রশান্ত করে না।বরং উত্তাল ঢেউ তোলে।এভাবে যখন তখন আর আম্মা ডাক শোনা হবে না তার। ডুকরে কেঁদে ওঠে তাবাসসুম ।তার বাবার চোখেও অশ্রু বর্ষন।তার প্রতি বাবার ভালোবাসা কতোটা গভীর উপলব্ধি করে সে।বুকের মাঝে হু হু করে ওঠে।চোখ ফে’টে অশ্রু আসে।নিজেকে সংযত করতে পারে না।আচমকা জড়িয়ে ধরে জন্মদাতা পিতাকে।বর্তমানে এই মানুষটার মাঝেই মিশে যেতে ইচ্ছে করে তার।কোথাও যেতে মন চাচ্ছে না এদের ছেড়ে।এমনকি এতোদিনের ভালোবাসার টানেও নয়।হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠেন আনোয়ার খাঁন।উপস্থিত সকলের চোখে অশ্রু ভীর করে।ফুপিয়ে কেঁদে সে বলে,
“আমাকে ক্ষমা করো আব্বু।অনেক অবাধ্যতা করেছি আমি।তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।অথচ তোমরা আমার জীবনের সেই গাছ ছিলে যা নিজেরা রোদে পুড়ে আমাকে ছায়া দিয়েছে।তুমুল বর্ষনে যারা ঠিকই ভিজেছে অথচ আমার গায়ে এক ফোটা পানি পারতে দেও নি।তোমরা আমার জীবনের সেই অমূল্য রত্ন যা আমাকে কখনো প্রয়োজন,কোন অভাব অনুভব করতে দেও নি।না চাইতেও আমার কতশত প্রয়োজন পূরণ করেছো তোমরা।আমার সকল শখ পুরণের কারিগর তোমরা।যখন আমি পূর্ণ রুপে অসহায় ছিলাম,সেই জন্ম থেকে আমাকে লালন করেছো।নিজে কষ্ট করলেও আমাকে কষ্ট পেতে দেও নি।তোমাদের ছেড়ে আমি কি করে অন্যত্র যাবো বলো?”
আনোয়ার খাঁনের চোখের কান্নার সাথে মন কেঁদে ওঠে।পাশে দাঁড়িয়ে মুখে আঁচল গুজে কাঁদছিলেন রাহেলা বানু।মেয়ের কথাগুলে শুনে প্রশান্তি অনুভব করেন।শত কষ্টেও বুক ভরে যায়।মেয়েকে তিনি সঠিক বুঝ দিয়েই মানুষ করেছেন।হটাৎ বাবাকে ছেড়ে দিয়ে মা’কে জাপ্টে ধরে তাবাসসুম।
“কারণে অকারণে তোমাকে কতো জ্বালাতন করেছি আম্মু।রাগের মাথায় কতো কি বলেছি।তোমরা তো আমার জ্ঞানের উর্ধ্বে।তোমাদের জ্ঞানেরই ক্ষুদ্র একটা অংশ পেয়েছি মাত্র।এই জ্ঞানে ভুল হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।ভুল হলে ক্ষমা করো।”
“সন্তানদের ভুল পিতা মাতার মনে আটকে থাকে না মা।সন্তান বলেই তোর কোনো ভুল নেই।”
মেয়েকে বাহুডোরে তিনিও আগলে নেন।গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনাজল।বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে।মাত্র তিনটা কবুল,এটাই যেন পর করে দিলো তার মেয়েকে।কেমন করে সে ক্ষমা চাচ্ছে।কন্যার কথা শুনে নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে রাহেলার।প্রায়শ্চিত্ত স্বরুপ কিছুই করার নেই।মেয়ের কাধে মাথা গুজে সারা জীবন কাটাতে মন চাচ্ছে তার। অথচ নিরুপায় তিনি।মেয়েকে বিয়ে দিয়ে তো আর এমন করলে চলবে না।নিজেকে কঠোর রেখে চোখের পানিতে তালা দেন।তিনি যদি এভাবে কাঁদেন তার মেয়ে ও বাড়ি গিয়ে নিজেকে সামলাতে পারবে না।
ঐশী ও তুষারকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,
“অনেক ঝই ঝামেলা করেছি তোদের সাথে।ক্ষমা করিস আমাকে।আর মিলেমিশে ভালো থাকিস সব সময়।”
“আমাদের ছেড়ে যাস না আপু।তোকে ছাড়া কেমনে থাকবো।আমার একদিনও যে কাটবে না।”
কথাগুলো বলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে তুষার।ঐশীও কান্নার সামিল হয়।অথচ মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না।
যাত্রার সময় ঘনিয়ে আসে।শক্ত পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে কন্যাকে গাড়ি তুলে দেয় তারা।ঘ্যাড়ঘ্যাড় আওয়াজ তুলে আপন গতিতে ছুটে চলে যান্ত্রিক বাহন।সেদিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সবাই।গাড়ির দুরত্ব বৃদ্ধির সাথে বৃদ্ধি পায় তাদের কান্নার বেগ।গাড়িটি সম্পূর্ণরুপে চোখের আড়াল হলে গগন ফা’টিয়ে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রাহেলা খাঁনম।বুক পু’ড়ে ছাই হয়ে যায়।অসহনীয় যন্ত্রনায় কা’টা মুরগির ন্যায় ছটফট করেন।বুক চাপড়ে উচ্চশব্দে আল্লাহকে ডাকেন বারংবার।সেই শব্দে কেঁপে ওঠে আকাশ বাতাস।থেমে যায় পাথুরে জীবন।নীড় হারা হয় বুনো পাখির দল।
সবাই সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে আসে।ওনাকে নিয়ে গাড়ি করে বাড়ি ফেরে সবাই।একে একে আত্মীয়ের ভীর জমে যায় খাঁন নিবাসে।বাড়ি ফিরে আরও ভেঙে পড়ে বাড়ির অন্য চারটি সদস্য।বাড়ি ভর্তি লোকজন।অথচ সারা বাড়ি খাঁ খাঁ শূন্যতা দেখে চারজনে।চোখ বুলিয়ে দেখে,বাড়ির প্রত্যেকটা সিমেন্ট কনায় লেপ্টে আছে তাবাসসুমের স্মৃতি।তাবাসসুম শূন্য এই স্মৃতির রাজ্যে এখন কি করে প্রবেশ করবে তারা?কলিজা যে চি’রে যাচ্ছে।রাহেলা খাঁন বুক চাঁপড়ে ধড়েন।মেয়েকে মানিয়ে নেয়ার উপদেশ দিলেও আদৌ কি তিনি পারবেন মেয়ের শূন্যতা মেনে নিতে?
চলবে