স্বচ্ছ প্রণয়াসক্ত পর্ব-২০

0
1111

#স্বচ্ছ_প্রণয়াসক্ত
#পর্ব_২০
#মুসফিরাত_জান্নাত

সরু চোখে তাকায় সাদাত।ডিজাইনের সমাপ্তি মুহুর্তে এসে উঠে দাঁড়ায়।ওয়াশরুমে যেতে নিয়ে ধাতস্থ কণ্ঠে বলে,

“সব প্রেমিক পুরুষই পা’গল।শুধু জীবনে একটা শখের নারীর প্রয়োজন।”

মুহুর্তেই ঐশীর হৃদয়জুরে শীতেরা হানা দিলো।অজানা অনুভুতির সাক্ষাৎ পেলো আবারও।শখের নারী শব্দটা তোলপাড় তুলে দিলো হৃদয়ে।সে সাদাতের শখের নারী।এর চেয়ে মধুর সম্বোধন দ্বিতীয়টি আর হয় নাকি!স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সে সাদাতের দিকে।ঠোঁটের হাসি যেনো আরও আশকারা পেলো।প্রশস্ত হলো মুহুর্তেই।

নিজের হাসি লুকিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো,

“আমি আপনার শখের নারী?”

থমকে দাঁড়ায় সাদাত।এক পলক তাকায় ঐশীর পাণে।প্রখর চোখের অধিকারী ব্যক্তিটির দৃষ্টিতে আজ কি যেনো খুঁজে পেলো ঐশী।যা দ্বিধাগ্রস্ত করে দিলো তাকে।অপ্রস্তত হয়ে পড়লো সে।সাদাত মোহগ্রস্ত কণ্ঠে জবাবে ছোটো করে বললো,

“হুম।”

একটু থামলো সে।পরক্ষণেই কণ্ঠে তুললো এক নেশাগ্রস্ত বাক্য।মুগ্ধতা মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,

“তুমি আমার অনেক শখের।অনেক অপেক্ষার প্রাপ্তি।”

থমকালো ঐশী।বাক্যটার অর্থ ব্যাখ্যায় বিষ্মিত হলো সে।অনেক অপেক্ষার প্রাপ্তি?তারমানে সাদাত আগে থেকেই তাকে পছন্দ করতো ও চাইতো?ব্যাপারটা পূর্নরুপে জানার আগ্রহ হলো ঐশীর।কৌতুহল দমাতে না পেরে চঞ্চল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

“মানে!নাটক সিনেমার মতো আপনিও কি আগে থেকেই আমাকে পছন্দ করতেন?আর আমাকে বিয়ে করার জন্য ঘটক পাঠিয়ে ভুল করে আপুর সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো?পরে আপু পালিয়ে যাওয়ার টুইষ্ট হয়ে আবার আমাকেই বিয়ে করেছেন?”

ঐশীর এহেন প্রশ্নে বিষম খেলো সাদাত।ঐশীর দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকালো একবার।মেয়েটার মনে এমন চিন্তার দল এলো কোথেকে?মেয়েটা কি বাচ্চা নাকি?মাঝে মাঝে তো সব কিছু ঠিকঠাকই মনে হয়।আবার হুট করেই মাথার নাট বল্টু ঢিলা হয় হয়ে যায় কেমনে?কেমন অভুদ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সাদাত।

ঐশী এতে খানিকটা বিব্রত হলো।নিজের করা বিবৃতিটা নিজ মনেই ভেবে নিলো একবার।সে তো সরল মনে পরবর্তী প্রতিক্রিয়া বিবেচনা না করেই এসব বলে ফেলেছে।এখন কি করবে?লোকটা কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। মুখ নত করে নিজেকে আড়াল করার আপ্রান চেষ্টা চালালো ঐশী।মেয়েটির এমন অভিব্যক্তিতে স্মিত হাসলো সাদাত।নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বললো,

“নাটক সিনেমা হয়তো একটু বেশিই দেখো তুমি।তাই সব সময় ওসবই মাথায় খেলে।ভুলে যেও না বিয়ের পূর্বে তুমি আমার শুধুই ছাত্রী ছিলে।আর সকল শিক্ষার্থী শিক্ষকদের নিকট সন্তান তুল্য হয়।যদিও এখন বউ হয়ে গিয়েছো।কিন্তু পূর্বে আর পাঁচ দশ জনের চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিলে না।”

এবার আরও বিহ্বলিত হলো ঐশী।সাদাতের পূর্বের ও পরের কথাগুলো একই সমীকরণে মেলাতে ব্যর্থ হলো সে।নিচু স্বরে মিনমিন করে বললো,

“মাঝে মাঝে আপনার কথাগুলো বেশ দুর্বোধ্য হয়ে যায়।আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারি না।আপনিই বললেন অনেক অপেক্ষার প্রাপ্তি আমি।আবার আপনিই বলছেন ছাত্রী ছাড়া অন্য কোনো নজরে দেখতেন না আমাকে।আমি এখন এর মানে কি বুঝবো?”

ঐশীর বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুটি করে সাদাত। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

“স্ত্রী হিসেবে তুমি আমার অনেক শখের।ব্যক্তি হিসেবে নও।এবার ক্লিয়ার হয়েছো?”

আহত দৃষ্টিতে তাকালো ঐশী।মাথা দুলিয়ে বললো,

“এখনও বিষয়টা অস্পষ্টই রয়ে গেলো।”

একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লো সাদাত।মেয়েটির নিকট দূর্বোধ্য লাগা কথাগুলোর সরল বিবৃতি দিতে গলা পরিষ্কার করে সে।স্মিত হেসে বলে,

“আমার জীবনের এতোগুলো বছর আমি পিওর সিঙ্গেল লাইফ লিড করেছি।অনেক চান্স পাওয়ার পরও কখনো কারো সাথে টাইম পাস করার জন্য বা সিরিয়াসলি কোনো অ্যাফেয়ার বা কমিটমেন্টেও যাই নি ।কারণ আমি সর্বদা বিশ্বাস করতাম আমি যার সাথে রিলেশনশীপে যাবো তাকে আমার জীবনের শেষ পরিনতি হিসেবে নাও পেতে পারি।কিন্তু আল্লাহ তায়ালা আমার জন্য কোনো না কোনো ব্যক্তিকে জীবন সঙ্গী হিসেবে নির্ধারণ করে রেখেছেন।যার সাথে আমার কোনো অ্যাফেয়ার না থাকলেও সে আমার হবে।আর আল্লাহ প্রদত্ত সেই মানুষটার জন্যই অপেক্ষা করে জীবনের এতোগুলো বছর একা কাটিয়ে দিয়েছি আমি।আমার বন্ধুরা যখন অবৈধ প্রেমিকার হাত ধরে রাতের রাস্তায় হেঁটেছে বা বিভিন্ন রেস্তোরাঁয়, পার্কে বসে প্রেমালাপ করেছে।আমি তখন আমার বৈধ প্রেমিকা,আমার স্ত্রীর জন্য সময়গুলো তুলে রেখেছি।অবৈধ সম্পর্কে আমি কখনোই বিশ্বাসী ছিলাম না।যাকে আমি কারো সামনে সৎ সাহসে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবো না,লুকিয়ে ছাপিয়ে চলতে হবে,এমন সম্পর্কের পিছনে ছোটার মতো কোনো নেশা আমি খুঁজে পাই নি।তারচেয়ে সৎ সাহস বুকে নিয়ে লোকের সামনে যাকে নিয়ে চলতে পারবো তার জন্য অপেক্ষা করেছি।আমার জীবনের সব সাধ,আহ্লাদ সবকিছু আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত আমার স্ত্রীর জন্য জমা করে রেখেছি।আমি যদি বিবাহ পূর্ব সম্পর্কে জরিয়ে অন্য কাওকে মন দিতাম তবে আমার স্ত্রীর সাথে অন্যায় করা হয়ে যেতো।এটাও আমার প্রেম না করার আরেকটা কারণ।আমি বিশ্বাস করি,একজন পুরুষের সবটুকু ভালোবাসা ও একজন নারীর জীবনের সবটুকু ভালোবাসা তাদের জীবন সঙ্গীর জন্যই বরাদ্দ রাখা উচিৎ।এতে সম্পর্কের মাধুর্যতা বজায় থাকে।যেহেতু এখন তুমি আমার স্ত্রী,আর আমার জীবনের সব প্রেম স্ত্রীর জন্যই জমানো ছিলো।তাই বলেছি আমার এতো অপেক্ষার প্রাপ্তি তুমি।আমার অনেক সাধনার জিনিস।ব্যাপারটা এতোটুকুই।এখানে নাটক সিনেমার মতো কোনো টুইষ্ট নেই।”

সাদাতের মাধুর্যপূর্ণ জাদুকরী কথাগুলো শুনে থমকাতে বাধ্য হলো ঐশী।মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে।পুরো ব্যাপারটা মাথায় ঢুকতেই ভালো লাগার স্রোতে ভেসে গেলো সে।এতো ভালো মানসিকতার একজন মানুষকে তার জীবন সঙ্গী হিসেবে পাওয়ায় নিজের উপরই নিজের ঈর্ষা হলো।এভাবে তো কখনো ভেবে দেখেনি সে।ইশ!সে কেনো এমন মনের অধিকারী হলো না?ভীষণ আফসোস জন্মালো মনে।এক রাশ মুগ্ধতা ও আফসোসের মিশ্র অনুভুতির চক্করে ডুবে গেলো সে।সেদিকে তোয়াক্কা না করে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে চলে গেলো সাদাত।রাত প্রায় শেষ প্রহরে নিমজ্জিত হয়েছে।ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়া দরকার।
________
চৈতালী ভোরের আকাশে রবি উঁকি দেওয়ার পূর্বেই একটু একটু করে কলরবে পূর্ণ হলো খাঁন নিবাসের প্রতিটি ইট পাথর।একে একে বড়রা থেকে শুরু করে জেগে গেলো ছোট সদস্যরাও।কাল রাতে অন্য সকলের চেয়ে আরও খানিকটা জেগে একদম শেষ রাত্রির দিকে ঘুমিয়েছে ঐশী ও সাদাত।ঐশীর হাতের মেহেদী শুকানো অবধি গল্পে গল্পে সময় পার করতে যেয়ে অনেকটা সময় গড়িয়ে গিয়েছিলো।যার দরুন এতো ভোরে ঘুম ছুটতে চাইছে না তাদের।অথচ এতো কোলাহলে ঘুমানোও যাচ্ছে না।হটাৎ মস্তিষ্কে নাড়া দিয়ে উঠলো,ফজর নামাযের সময় চলে যাচ্ছে।অগত্যা বিছানা ছাড়তে হলো তাদের।সাদাত তড়িঘড়ি করে চলে গেলো ওয়াশরুমে।ফজর নামায আদায় করা দরকার।তার জীবনে কোনো কারণ ছাড়া এক ওয়াক্ত নামাজ কাযা করে না সে।কোনো কারণে নামায ওয়াক্তে মিস হয়ে গেলেও যত দ্রুত সম্ভব কাযা সালাত আদায় করে নেয়।এটা প্রায় অভ্যেসই হয়ে গিয়েছে তার।আজকেও দ্রুত ওজু করে ফজর সালাতটা আদায় করতে দাঁড়ালো সে।ঐশীও একই ঘটনার অনুসারী হলো।ওজু দিয়ে এসে সাদাতের পাশে থেকে একটু পিছন করে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাযে দাঁড়িয়ে যায়।বিষ্মিত হয় সাদাত।তার সাথে বিবাহের পর স্ত্রী হিসেবে ঐশীকে সময়মতো নামায পড়তে অনেক তাগিদ দিতো সে।কিন্তু ফজর নামাযের সময় বেশিরভাগ দিনই ঘুমে তলিয়ে থাকতো ঐশী।এছাড়াও আলস্যতার দরুন বেশিরভাগ দিনেই ফজর সালাতের কাযাও আদায় করতে ভুলে যেতো।যা বেশ অপছন্দ ছিলো সাদাতের।তার ধ্যান ধারণায় প্রত্যেকটা মানুষের মাঝে আধুনিকতার পূর্বে ধর্মীয় সংস্কৃতির চর্চা থাকাটা জরুরী।তবেই একজন পূর্ণ রুপে মানুষ হয়ে উঠতে পারে।ধর্মীয় জ্ঞান মানুষকে অন্যায় থেকে দূরে রাখে।আর সঠিক সময়ের সঠিক ভাবে আদায় করা নামায হৃদয়কে শীতলতা দান করে।কিন্তু এসব বার বার বুঝালেও কানে তুলতো না ঐশী।ঘুমিয়ে গেলে তার কোনো ধ্যান থাকতো না।যদিও অন্য চার ওয়াক্ত নামায সে সঠিক সময়েই আদায় করতো।কিন্তু ফজর সালাতে অনীহা ছিলো।যে অভ্যাসটা হসপিটাল থেকে ফেরার পর বদলে গিয়েছে।সাদাতের থেকে সৃষ্টি হওয়া দৈহিক দুরত্ব প্রতি মুহুর্তে মেয়েটিকে সাদাতের পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে ভাবিয়েছে।যার দরুন সে তার তালিকায় ফজর সালাতটাকেও স্থান দিয়েছে।তাই তো সে অলস্যতা ভুলে সঠিক সময়ে ফজর নামায আদায় করে।এছাড়াও কোনো কারণে মিস হলে সাথে সাথে কাযা আদায় করে নেয়।সেই সুবাদে আজও নামাযে দাঁড়িয়ে গিয়েছে সে।অতপর নামায শেষে কিছু ওজীফা শেষ করে রাতের ঘুমের ঘাটতি পূরণ করতে বিছানায় আসে সে।ঐশীর অভ্যাসের এই বদল দেখে বিষ্মিত সাদাত বলে,

“অলসতা ছেড়ে দিয়েছো দেখছি।এতো পরিবর্তন হলে কবে থেকে?”

সাদাতের প্রশ্নে নিজের গতিবিধি থামিয়ে দেয় ঐশী।ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে পুরুষটির ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি খেলা করছে।চোখেমুখে মুগ্ধতা ছেয়ে আছে।মনটা আনন্দে নেচে ওঠে ঐশীর।স্মিত হাসে সে।সাদাতের মতো গম্ভীর হয়ে বলার চেষ্টা করে,

“আমার একটু অলস্যভাবের পরিবর্তন যদি কারো এতো প্রশান্তির কারণ হয়, তবে পুরো আমিটাই পরিবর্তন হয়ে যাবো।”

কথাটা বলে সাদাতের ন্যায় ভঙিমা করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে ঐশী।রাতের ঘুমটা পুষিয়ে নেওয়া যাক।ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করে সাদাত।ঐশী যে তাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করছে তা পরিলক্ষিত হতেই হেসে ওঠে সে।পাশে শুয়ে ঐশীর দিকে ফিরে বলে,

“অনুকরণ তো ভালোই শিখেছেন ম্যাডাম।তা আমার সবকিছুই কি অনুকরণ করতে সক্ষম হবেন আপনি?”

পূর্ণ জোরের সহিত ঐশী বলে,

“অবশ্যই পারব।আপনি আমার স্বামী না?আপনাকে অনুকরণ না করলে সমানে সমান হবো কি করে?”

ঐশীর ভাব নিয়ে বলা কথায় তড়িৎ দুষ্টু চিন্তা মাথায় উঁকি দেয় সাদাতের।বাঁকা হাসি দেয় সে।নিজেকে যথাসম্ভব গম্ভীর করে বলে,

“অসম্ভব।তুমি এমনটা করতে পারবে না।এতোটা পারদর্শী তুমি হয়েই উঠো নি এখনো।”

সাদাতের হেয় করে বলা কথার তীব্র প্রতিবাদ করে ঐশী।

“কে বলেছে আমি পারব না।আপনার করা সব কাজ আমি হুবহু কপি করতে পারবো।বিশ্বাস না হলে প্রুভ নিয়ে দেখেন।”

সরু চোখে তাকায় সাদাত।

“তাই নাকি?তাহলে প্রমান হয়ে যাক।এখন আমি যেই কাজটা করবো তার হুবহু কপি করে দেখাও দেখি।”

সাদাতের কথায় নড়েচড়ে ওঠে ঐশী। তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় সাদাতের দিকে।পূর্ণ মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করে যেনো কোনো কিছু বেখেয়ালে না পড়ে যায়।তার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটিয়ে আকষ্মিক এক হাতে ঐশীর কোমড় জড়িয়ে কাছে টেনে নেয় সাদাত।মেয়েটি কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই তার অধরে নিজের অধর ছোঁয়ায়।আলতো এক টুকরো গভীর স্পর্শ দিয়ে নেশাগ্রস্ত কণ্ঠে বলে,

“কেমন কপিবাজ হয়েছো এখন দেখাও দেখি।একটু হেরফের হয়ে এর চেয়ে গভীর স্পর্শ হলেও চলবে।আমি দয়াবান পুরুষ।মার্ক কাটতে পারবো না।”

আকষ্মিক ঘটনায় বিষ্ময়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হলো ঐশী।চোখ দুটো আপন শক্তিতে প্রশস্ত হলো।পুরো ব্যাপারটা মস্তিষ্ক ব্যাখ্যা করতেই কেঁপে ওঠে ঐশী। ত্রপায় রক্তিমা হলো তার দুই গাল।লজ্জার পাহাড়ে চাপা পড়ে গেলো সে।দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে ধাতস্থ করার বৃথা চেষ্টা চালালো সে।ঐশীর এই অভিব্যক্তির পুরোটা নিজ দৃষ্টি দিয়ে পরোখ করলো সাদাত।প্রেমময়ীর লজ্জামিশ্রিত বদন দেখার সুখটা লুফে নিলো সে।ঐশীকে আরও একটু আড়ষ্ট করতে ভ্রু নাচিয়ে সে বললো,

“এতোটা সময় নিচ্ছো কেনো?ধরতে পারোনি পুরো ব্যাপারটা?আচ্ছা আবারও রিপিট করে দেখাচ্ছি।এতো গর্ব করে তুমি চ্যালেঞ্জ করলে।তারপর হেরে গেলে ব্যাপারটা আমারও ভালো লাগবে না।আফটার অল বউ হও তুমি।”

সাদাতের বদমাইশি কণ্ঠে লজ্জা সংবরণে ব্যর্থ হলো ঐশী।বরং লজ্জার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেলো।সাদাত আরও একটু এগিয়ে যেতেই তড়িৎ উঠে পড়লো বিছানা থেকে।এক প্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে।এই লোকটার সান্নিধ্যে থাকলে নিশ্চিত লজ্জায় ম’রে যাবে সে।দরজার বাহিরে এসে থামলো ঐশী।বিড়বিড় করে বললো,

“দয়াবান পুরুষ না নির্লজ্জ পুরুষ।আমাকে লজ্জায় মে’রে ফেলার ফন্দি এঁটেছে।বদমাশ কোথাকার।”

_______
গোধুলীর বিদায়ে রাত্রি নামতেই পরিবেশটা আরও আলোকিত হয়ে ওঠে।বিভিন্ন রকমের আলোকসজ্জায় সজ্জিত কমিউনিটি সেন্টার প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্ধকারে নিজেদের কৃত্রিম আলোর বহিঃপ্রকাশ পূর্ণ রুপে করে।এক টুকরো করে মিষ্টি ও এক গ্লাস করে ঠাডা শরবত একে একে নিজেদের দখলে নেয় ঐশী ও সিন্থিয়া।মিষ্টিটা শেষ করে ঠান্ডা শরবত পান করে তারা।কাঠফাটা রৌদ্দুরের এই মৌসুমে ঠান্ডা শরবত বেশ প্রশান্তি দেয় তাদের।সকাল থেকে সারাদিন সিন্থিয়ার সাথে কাটিয়ে দিয়েছে ঐশী।এক বারের জন্যও আর সাদাতের কাছে যায় নি সে।যার দরুন সিন্থিয়ার সময়টা বেশ ভালো কেটেছে।কখনো বোরিং হতে হয় নি।কিন্তু বিবাহ অনুষ্ঠান শুরুর এই পর্যায়ে এসে মুখ গোমড়া করে আছে সে।বিষ্মিত হয় ঐশী।ভ্রু কুঁচকে বলে,

“কিরে আল্লাহর বান্দী,মুখ এমন বাংলা পাঁচের মতো করে রেখেছিস কেনো?তোর আবার কি হলো?”

সিন্থিয়া নিজের ভিতর চেপে রাখা সম্পূর্ণ বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,

“মুখ এমন করে রাখবো না?সেই তখন থেকে ওই বাচ্চা ছেলেটা আমাকে ফলো করে যাচ্ছে।”

সিন্থিয়ার কথার বিপরীতে দাঁত কেলিয়ে ঐশী বলে,

“কোন বাচ্চা ছেলেটা?তখন প্রপোজ করলো যে তোকে ওই নিব্বাটা?যাই বলিস সুন্দর আছে কিন্তু ছেলেটা।”

রেগে যায় সিন্থিয়া।দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“তোর যদি এতোই পছন্দ হয়, তো যা প্রেম কর ওর সাথে।এইখানে কি করিস?”

“নাউজুবিল্লাহ দোস্ত।এসব কি বলিস?ছ্যাহ!জামাই আছে না আমার?নিজের ভাইয়ের বউকে কেও কি পরকীয়া করার জন্য প্রস্তাব দেয়?”

“তো নিজের ননদিনীর সাথেও কেও এসব নিয়ে লেগপুল করে?”

“অবশ্যই করে।এটা আমার ভাবিগত প্লাস বান্ধবীগত হক।”

“তোর ওই বা*র হক তোর কাছেই রাখ।আর একটা বার যদি ওই বেটায় ইশারা করে ঠাটায়া থা*প্প*র মা” রবো আমি দেখে নিস।”

সিন্থিয়ার এমন রাগ দেখে মুখ চিপে হাসে ঐশী।রগড় করে বলে,

“এজন্যই বলি বিয়ে কর।নামের পাশে বিবাহিত ট্যাগ থাকলে আর কেও এভাবে জ্বালাবে না।”

আরও তেতে উঠে ঐশী।

“ভাইয়ার সাথে বিয়ে হইতে না হইতেই ভাবিগিরি শুরু করে দিছোস তাই না?আমাকে বিয়ে দিয়ে তাড়ানোর ফন্দি আটতেছিস।যেনো শশুর বাড়ি গেলে কোনো ঝামেলা পোহাতে না হয়।বেদ্দপ মহিলা।”

সিন্থিয়ার কপট রাগ দেখেও ফুঁসে ওঠে ঐশী।ব্যাপারটা বেশ ভালোই লাগে তার।সুযোগটা পেয়ে সিন্থিয়ার রাগের মাত্রাটা আরও বাড়িয়ে দিতে বলে,

“ভালো কথা বললাম তো,দাম দিলি না…।”

আরও কিছু বলতে যায় ঐশী।কিন্তু কথার সমাপ্তি টানতে পারে না।কেও একজন এসে ডাকে ঐশীকে।তাবাসসুম তাকে কাছে ডাকছে এই সংবাদ দিয়ে ফুড়ুৎ করেই ভীরের মাঝে মিলিয়ে যায়।সিন্থিয়াকে সাথে নিয়ে তাবাসসুমের কাছে যায় ঐশী।তাবাসসুম মলিন স্বরে বলে,

“আমার ফোনটা বাড়িতে রেখে আসছি।একটু এনে দিবি বইন?”

“যাইতেছিস জামাই বাড়ি।বাসর রাতে জামাই রেখে ফোন দিয়ে কি করবি?”

ঐশীর রগড়পূর্ণ কণ্ঠের বিপরীতে কিছু একটা বলতে মুখ খোলে তাবাসসুম।কিন্তু তার মুখের কথা টেনে নিয়ে এক পুরুষ কণ্ঠ বলে,

“ফোন একটি প্রয়োজনীয় জিনিস।কখন কোন কাজে লাগে বলা যায় না।আপুরও দরকার হতে পারে।বাসা তো খুব দূরে নয়।আমি সাথে গিয়ে এনে দিচ্ছি চলো।”

ঘাড় ঘুরিয়ে সাদাতকে দেখে ঐশী।মুহুর্তেই সকালের কথা মনে হয়।শুষ্ক একটা ঢোক গিলে সে।এই মানুষটার সাথে যাবে না বলে নাকচ করতে গিয়েও লাভ হয় না কোনো।তাবাসসুম খুশি মনে সায় দিয়ে ঐশীকে জোর করে পাঠিয়ে দেয়।সিন্থিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,

“ঐশী ফিরে আসার আগ অবধি তুমি আমার কাছে বসো বোন।”

হাসি মুখে সায় দিয়ে বসে যায় সিন্থিয়া।

_______
নিজ ফ্লাটের কাছে এসে গাড়ি থামিয়ে ঐশীকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে সাদাত।ঐশী দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে ফ্লাটের লক খুলে ভিতরে প্রবেশ করে।পিছু নেয় সাদাত।ঐশীকে নিজের সান্নিধ্যে আনার প্রচেষ্টা হিসেবেই সবার থেকে আড়াল করে কৌশলে এখানে এনেছে সে।মেয়েটিকে নিজের দখলে এনে কড়া কয়টা কথা বলা তার উদ্দেশ্য।মেয়েটির আজকের সাজ পোশাক হলুদ সন্ধ্যার সাজের চেয়েও জাঁকজমকপূর্ণ।যা আবারও বেসামাল করে দিচ্ছে সাদাতকে।কিন্তু কথাটা বলার মতো করে মেয়েটিকে কাছে পায় নি সাদাত
।দূর থেকেই দেখে গিয়েছে শুধু।এখন নিকটে পেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে সে বলে,

“তোমাকে না বলেছি এভাবে আর কখনো সাজবে না তুমি।তাও সেজেছো কেনো?”

বিষ্মিত হয় ঐশী।সে এভাবে সাজলে লোকটার সমস্যা কোথায়?বিয়ের অনুষ্ঠানে কেও সাজ সজ্জা ছাড়া যায় নাকি?মুখে কোনো উত্তর দেয় না সে।সাদাত আবারও গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

“যাও শাড়িটা বদলে থ্রি পিচ পড়ে আসো।মাথায় হিজাবও পেঁচাবে।আর কখনো আমার সামনে এভাবে শাড়ি পড়বে না।”

এবার খানিকটা রুষ্ট হয় ঐশী।ত্যাড়ামো করে বলে,

“যদি না বদলাই তো কি করবেন?”

“আমার কথার অবাধ্য হয়ো না ঐশী।ফলাফল তোমার জন্য হিতকর হবে না।”

“আপনার জন্য হিতকর হবে?হলে আলহামদুলিল্লাহ। আমার হিতকর রেজাল্টের দরকার নেই।কিচ্ছু বদলাবো না আমি।চলেন তো।”

কথাটা বলে ফোনটা হাতে নিয়ে বের হয়ে যেতে নেয় ঐশী।ঐশীর এমন আকর্ষণীয় সাজ পোশাক ও রাগী চেহারা উ’ন্মাদ করে দেয় সাদাতকে।তার উপর ঐশীর পিন আপ করা শাড়িটা পেটের দিকে একটু ঢিলা হয়ে ফর্সা পেট দৃশ্যমান হয়।যা চোখে পড়তেই নিজেকে সংযত করতে ব্যর্থ হয় সাদাত।দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বুঁজে নিজেকে ধাতস্থ করার আপ্রান চেষ্টা করে সে।

দুই এক কদম ফেলে সামনে এগিয়েও সাদাতের কোনো রেসপন্স না পেয়ে পিছন ফিরে তাকায় ঐশী।অভিজ্ঞ ভাবে সাদাতকে পর্যবেক্ষণ করে কিছু একটা উপলব্ধি করে সে।তড়িৎ তার মাথায় দুষ্টুমি ভর করে।সকালে তো খুব লজ্জা দিচ্ছিলো তাকে,এখন প্রতিশোধ নিবে সে। কোমড়ে হাত রেখে রগড় করে বলে,

“কি এগুচ্ছেন না কেনো?বেসামাল হয়ে যাচ্ছেন নাকি?না হলে তো সমস্যা।আমার কম সাজের জন্য যদি আপনার বেসামালের পারফরমেন্স খারাপ হয় তো আমারই খারাপ লাগবে।দরকার পড়লে আরও কড়া করে লিপস্টিক দিবো।আমি দয়াবতী মেয়ে।আপনাকে বেসামালে দশে দশ পেতে ফুল হেল্প করবো।আফটার অল আমার স্বামী আপনি।তারউপর আবার টিচার মানুষ।এক মার্ক কাটলেও তো আপনার জন্য লজ্জাজনক ব্যাপার হবে।”

সকালে সাদাতের বলা কথার ভঙিতেই কথাগুলো বলে ঠোঁট চেপে হাসে ঐশী।চোখ মিলে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে সাদাতের অভিব্যক্তি।কিন্তু তার মুখের হাসি বিলীন হয়ে যায় মুহুর্তেই।তার ধারণাকে উল্টে দিয়ে তাৎক্ষনিক গলার স্বর গম্ভীর করে ফেলে সাদাত।সরু চোখে তাকিয়ে বলে,

“লজ্জাজনক ব্যাপার কার হয় তা একটু পরেই না হয় দেখা যাবে।আমার পারফরম্যান্স নিয়ে যখন এতোই আগ্রহ তোমার,পুরো ব্যাপারটা প্র্যাক্টিকালি দেখিয়ে দেই চলো।”

কথাটা শেষ করেই ঐশীর এক হাত ধরে ঘরে নিয়ে দরজা আটকে দেয় সাদাত।আঁতকে ওঠে ঐশী। নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই যে এভাবে ফসকে পড়বে তা কল্পনাতীত ছিলো তার নিকট।আকষ্মিক ঘটনায় বিহ্বল হয়ে দ্বিরুক্তি করার সময়টাও পায় না সে।তার পূর্বেই মিশে যায় সাদাতের গভীর স্পর্শে।একেবারে বিলীন হয়ে যায় পবিত্র বন্ধনে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে