#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_২৯
– “তোমাকে আমি বোকা মনে করেছিলাম, আদিব। কিন্তু তুমি দেখি ধুরন্ধর! মানে, প্রথমে জাহানারাকে পছন্দ করো না, সে তোমার যোগ্য না—ইত্যাদি ইত্যাদি বলে কি নাটকটাই না করলে! তারপর যেই দেখলে মেয়েটা নাম-যশ-খ্যাতি অর্জন করেছে, তোমার থেকে ভালো আছে, অমনি তল্পিতল্পা গুছিয়ে ওর জীবনে গেড়ে বসলে! লজ্জা করলো না তোমার?”
সামনে দৃষ্টি রেখে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল রাকিব। আদিব তার কথা শুনে শীতল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। রাকিব এবার ঘাড় ঘুরাল। দৃষ্টি ফেলল আদিবের মুখে। আদিব তাকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে ঠোঁট কোণে বাঁকা হাসি টানলো। শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
– “রাকিব ভাই, ইউ সাউন্ড লাইক সেলিনা আ্যন্টি। ভদ্রমহিলা আমাদের ঐ সামনের বাসায় থাকে,কখনো সোজা কথা সোজা ভাবে বলে না,ইনিয়ে বিনিয়ে মানুষ কে ছোট করে। আপনার ব্যক্তিত্বের সাথে তার এই কথার ধরণ ঠিক মানাচ্ছ না।।যা বলার সোজাসুজি বলুন। খামাখা মেয়েলি প্যাচাল পাড়ছেন কেন? যার নাম-যশের লোভের কথা বলছেন, তার নাম-যশ-খ্যাতি পাওয়ার জন্য মনে হয় না আমার সামান্যতম এফোর্টের প্রয়োজন ছিল।সে যে আমার নামে সব লুটিয়ে বসে আছে— এটা আর কেউ না জানলেও, আশা করি আপনি ভালোই জানেন! অ্যাম আই রাইট?”
আদিবের স্পষ্ট কথা। রাকিবের চোয়াল শক্ত হলো। সহজে রাগের বশবর্তী না হওয়া মানুষটা তড়াক করে রেগে উঠল। আদিবের দিকে এগিয়ে এল। মুখোমুখি দাঁড়াল। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
– “স্বামীর অভিনয় করতে বলা হয়েছিল তোমাকে,স্বামী হতে বলা নয়! হাউ ডেয়ার ইউ টাচ মাই জাহান?”
রাকিবের কণ্ঠে আক্রোশ, চোখে আগুন। যে মেয়েটাকে এতগুলো বছর আগলে আগলে রেখেছে, কাউকে তার ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেয়নি, তার গায়ে একটা ফুলের টোকা পড়তে দেয়নি—সেই মেয়ের গায়ে এই ছেলের থাবা মেনে নিতে পারছে না সে। ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে তার। তার জাহানকে কেউ ছুঁয়েছে—এটা ভেবে দুনিয়া জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে।
– “অ্যান্ড হু আর ইউ? আপনি কে হন?আমি আমার স্ত্রীকে স্পর্শ করবো কি করবো না, সেই কৈফিয়ত আপনাকে কেন দেব?”
“স্ত্রী” শব্দটা ধারালো ছুরির মতো বিধল রাকিবের অন্তরে। চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিল সে। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল, কিন্তু পুরনো অভ্যাস নতুন যন্ত্রণায় খুব একটা কার্যকর হলো না। উল্টো, বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠল জাহানারার মসৃণ গলায় লালচে বর্ণের সূক্ষ্ম ক্ষতটা—যেটা তার বেদাগ ত্বকে মানিয়ে গেলেও রাকিবের মন মানলো না। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলল সে। আদিবের চোখে চোখ রাখল। বিষধর সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল,
– “আই হেইট ইউ, আদিব!”
কথাটা বলে হাঁটা দিল সদর দরজার দিকে। আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। যেকোনো সময় নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে সে—যেটা তার জন্য ভালো হবে না, মোটেও ভালো হবে না। এ কথা মাথায় রেখে প্রস্থান করল রাকিব।
রাকিব চলে যেতেই সামনে পড়ে থাকা গাছের খালি টবে সজোরে লাথি মারল আদিব। টবটা ছিটকে গিয়ে পড়ল সামনে। ইটের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে ঠাস করে শব্দ তুলে ভেঙে গেল সেটা। টব ভাঙার শব্দে চমকে তাকাল হাশেম। আদিব অবশ্য সেদিকে খেয়াল করল না। সে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ভেতরে ঢুকল। ড্রইংরুম পার করার সময় জাহানারা এসে সামনে দাঁড়াল। তার পিছন দিকে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “রাকিব ভাই আপনার সঙ্গে ছিল না? কোথায় গেল?”
রাকিবের কথা শুনে ক্রমবর্ধমান রাগটা আরো বাড়ল আদিবের। জাহানারার দিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে বলল,
– “জাহান্নামে।”
কথাটা বলে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল সে। জাহানারা তার কথায় অবাক হলো। বুঝতে পারল না, হঠাৎ কী হলো ছেলেটার। উঁকি মারল বাইরে, কিন্তু রাকিব কিংবা তার বড় গাড়িটাও চোখে পড়ল না। অজ্ঞাত নেহাকে রাকিবের নাম্বারে ফোন করার কথা বলে ছুটল সে আদিবের পিছু। আদিবের ঘরে ঢুকে বারবার জিজ্ঞেস করল,
– “কী হয়েছে? আপনি এমন করছেন কেন?”
কিন্তু আদিব তার কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না।
– “কী হয়েছে, বলবেন তো? এমন উইয়ার্ড বিহেভ এর মানে কি?”
এবার ধৈর্য্য চ্যুত হলো আদিব। জাহানারার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
– “ভাইয়ের ভাগারের আকাল পড়েছে তোমার, যে আবার একটা ভাই যোগাড় করেছ? রাকিব সারোয়ারের সঙ্গে কি তোমার?কান খুলে শুনে রাখো, আজ থেকে ওনার সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করবে তুমি। আন্ডারস্টুড?”
গর্জে উঠল আদিব। জাহানারা চমকাল। ভয়ভীত চোখে তাকাল। আদিব ছেড়ে দিল তাকে। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলে পায়চারি করতে লাগল। *”কত বড় সাহস! সে তার বউকে ছুঁবে কি ছুঁবে না, তার কৈফিয়ত না কি বাইরের লোককে দিতে হবে!”* বয়সে বড় না হলে থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দিত লোকটার। বেয়াদব!ভেতরে ভেতরে ফুসে উঠে বলল আদিব।
আদিবের গর্জন-তর্জন দেখে প্রাথমিকভাবে জাহানারা ভড়কে গেলেও নিজেকে সামলে নিল।একটু সময় নিয়ে ধাতস্থ হলো । তারপর ইতস্তত কণ্ঠে জানতে চাইল,
– “রাকিব ভাই কিছু বলেছে আপনাকে?”
আদিব চুপ। বড় বড় দম ফেলছে। জাহানারা একটু এগিয়ে গেল। রাগে গনগনে লাল মুখটার দিকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে বলল,
– “এমন ধোঁড়া সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছেন কেন? কী হয়েছে, বলুন!”
জাহানারার কথা শেষ হতেই তার উপর অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করল আদিব। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
– “গেট আউট!”
– “আরে, বলবেন তো—”
– “আউট!”
ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল আদিব। জাহানারা তড়িঘড়ি বেরিয়ে এল ঘর থেকে। জাহানারা বের হতেই স্বজোরে ঘরের দরজা আটল আদিব। জাহানারা বিরক্ত হলো তার উপর। কী হয়েছে সেটা না বলে জংলি হাতির মতো আদিবের এই দাপাদাপি পছন্দ হলো না তার। তবে চিন্তিত হলো কিঞ্চিৎ। হঠাৎ কী এমন হলো, ভেবে পেল না। রাকিব আর আদিব পূর্বপরিচিত—খুব বেশি সখ্যতা না থাকলেও একেবারে খারাপ সম্পর্ক না তাদের। দেখা-সাক্ষাৎ হলে খুব সুন্দরভাবে নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করে। তাহলে আজ কী এমন হলো যে আদিব এমন করেছে?
এমন সব বিভিন্ন কথা ভাবতে ভাবতে নিচে নামল জাহানারা। সোফায় বসে নেহাকে ডাকল। চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
– “রাকিব ভাইকে ফোন করেছিলে? কেন হঠাৎ চলে গেল, বলল কিছু?”
– “ফোন ধরেনি, স্যার।”
মুখ কাঁচুমাচু করে বলল নেহা। তার মনে হচ্ছে, আদিব হয়তো কিছু বলেছে রাকিবকে। তখন যেভাবে তার কাছে রাকিব আর তার ম্যামের সম্পর্কে প্রশ্ন করছিল… নেহা আমতা আমতা করে বলল,
– “ম্যাম, আমার মনে হচ্ছে আদিব স্যার কিছু বলেছেন রাকিব স্যারকে।”
– “এবং এটা তোমার কেন মনে হচ্ছে?”
– “আদিব স্যার তখন আমার কাছে রাকিব স্যার আর আপনার বিষয়ে জানতে চাইছিলেন। এই যেমন—রাকিব স্যার প্রতি বছর আপনার জন্মদিনে এভাবে আসে কি না, তারপর আপনাদের মধ্যে কেমন সম্পর্ক…”
– “এসব আদিব ভাই জিজ্ঞেস করেছে?”
বিস্মিত কণ্ঠে জাহানারা। আদিব সচরাচর কারো বিষয়ে মাথা ঘামায় না—আর যদি বিষয়টা হয় তার, তাহলে তো প্রশ্নই ওঠে না। আদিবের তার প্রতি এমন কৌতূহল তার বিস্ময়ের কারণ।
নেহা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। নেহার সম্মতি পেয়ে জাহানারার ঠোঁটের কোণে দেখা দিল বাঁকা হাসি। টি-টেবিলের উপর দুই পা তুলে আয়েশ করে বসল সে। মাথার পিছনে দুই হাত দিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে পা নাড়াতে নাড়াতে বলল,
– “বুঝেছো, নেহা? চাচির ছেলে জেলাস। তাও আবার সেই লেভেলের!”
ঠোঁটের হাসি চওড়া হলো জাহানারার। নেহা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এতক্ষণ আদিব তার কথা শুনে কী না কী মনে করেছে, এটা ভেবে ভয়ে ভীত হওয়া মনের ভয় দূর হলো।
______
– “রাকিব সারোয়ার বলেছে তোকে এসব কথা?”
অবিশ্বাস্য কণ্ঠে সজীবের। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না এটা, যে রাকিব সারোয়ারের মতো ভদ্র-সভ্য, শান্ত-শিষ্ট স্বভাবের লোক এমন কিছু বলতে পারে। আদিব বিরক্ত হলো। মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক শব্দ বের করে তেতে উঠে বলল,
– “না, আমি মিথ্যা বলছি। খুশি?”
– “আহা…! চেতছিস কেন? আমি তো শুধু মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর করছি। আসলে লোকটাকে এত বছর ধরে যেমন দেখে আসছি, মনে হয়নি এমন ধরনের কথা সে বলতে পারে। যাই হোক, তুই কি চুপচাপ তার কথা হজম করেছিস?”
– “আমার যা বলার বলেছি। ওসব বাদ দে। তুই তোর ভাগ্নীকে একটু বোঝা। আমি সতর্ক করেছি, তবে মনে হয় না মহারানী আমার কথা শুনবে। রাকিব ভাইকে আমার মোটেও সুবিধার লাগেনি, সজীব। আমার মনে হচ্ছে, লোকটা এতদিন একটা সভ্য-ভদ্র, পশ ভাব বজায় রেখেছিল—জাহানারার কাছাকাছি থাকার জন্য, তাকে পাওয়ার জন্য। এখন যেই দেখেছে জাহানারাকে পাওয়ার সম্ভাবনা আর নেই, সেই নিজের খোলস ছাড়তে শুরু করেছে।”
থামল আদিব। সজীব তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। আদিব কি যেন ভেবে ফের বলল,
– “এটা অবশ্য আমার ধারণা, আমি নিশ্চিত না।আবার হতে পারে ‘ভালোবাসার মানুষ’কে হারানোর ভয়ে ভড়কে গিয়ে এমন আচরণ করেছে। অনেক কিছুই হতে পারে, তবে আমার একটুও ভালো লাগেনি তার ব্যবহার। তাছাড়া, তার চোখে যে আক্রোশ দেখেছি, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। ইট কুড বি হার্মফুল ফর জাহানারা।”
শ্বাস ফেলল আদিব। সজীব তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
– “আচ্ছা, তুই চিন্তা করিস না। আমি দেখছি। বাই দ্য ওয়ে, আজ পাগলিটার জন্মদিন—ইচ্ছা হলে স্পেশাল কিছু করিস।”
রাকিবের গা জ্বালানো কথার তাপে জাহানারার জন্মদিনের কথা মাথা থেকেই বের হয়ে গিয়েছিল আদিবের।সজীবের কথায় শুনে যেটা মনে হলো।তবে স্পেশাল কী করবে, সেটা ভেবে চিন্তায় পড়লো। কারো জন্য কীভাবে স্পেশাল কিছু করা যায়, সে সম্পর্কে একদম ধারণা নেই আদিবের। সারাজীবন পড়াশোনার নামে বইয়ের পুকুরে ডুবে থেকেছে। কপালগুণে যে সব বন্ধুবান্ধব জুটেছে, তাদের সাথে নির্দিষ্ট বিষয় ব্যতীত ব্যক্তিগত ব্যাপারে খুব একটা খোশগল্প হয়নি। কথাটা অদ্ভুত হলেও সত্য যে, আজ পর্যন্ত কোনো বন্ধুবান্ধবের বিয়ে-শাদি বা জন্মদিনে যাওয়া হয়ে ওঠেনি তার। খুব কাছের কেউ হলে শুধু ‘হ্যাপি বার্থডে’ টেক্সট পাঠিয়ে নিজের দায় সেরেছে। সুতরাং, তার তেমন কোনো জ্ঞান নেই এ বিষয়ে। সজীব বলল, “ইচ্ছে হলে কিছু করিস।” কিন্তু ইচ্ছা হলেই যে সব কিছু করা যায় না বা পারা যায় না, এটা কীভাবে বোঝাবে সে ছেলেটাকে?
সজীবের কথার প্রেক্ষিতে নীরব রইল আদিব। সজীব ধারণা করল, তার ভাগ্নির প্রতি এখনো অতটা টান আসেনি আদিবের। গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ম্লান হেসে বলল,
– “বেশি চিন্তা করতে হবে না। বাগান থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে দিস, তাতেই মেয়েটা খুশি হয়ে যাবে। আচ্ছা,ভালো থাকিস। রাখছি।”
ফোন কাটল সজীব। সজীব ফোন কাটতেই জানালা দিয়ে বাগানে উঁকি দিল আদিব। তার ঘরের উত্তরের জানালা দিয়ে দেখা যায় তাদের বাগান। হাশেম ইতিমধ্যে বাগানের ময়লা পরিষ্কার করে পরিপাটি করে গুছিয়ে নিয়েছে। আদিব চারিদিকে চোখ বোলাল, কিন্তু ফুল তো দূরের কথা, ফুলের কলিও চোখে পড়ল না। গত রাতের ঝড় বাগানের গাছগাছালি সব পিষে রেখে গেছে। নিরাশ হলো আদিব। জাহানারাকে ঠিক কী দেওয়া যায়, এটা ভেবে পেল না।
এরমধ্যে দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। আদিবের বুঝতে অসুবিধা হলো না কে এসেছে। দরজা খুলল সে। দরজা খুলতেই জাহানারা দাঁত কেলিয়ে হাসল। আদিবের হাতের নিচ দিয়ে চড়ুই পাখির মতো ফুড়ুৎ করে ঘরে ঢুকে গেল। দাঁত বের করে হেসে বলল,
– “আপনি যে এত হিংসুক, জানা ছিল না তো! আদিব ভাই।”
– “আই অ্যাম নট ইয়োর ভাই।”
শব্দ মিশ্রিত হতাশ শ্বাস ফেলল আদিব। দরজা ঠেলে দিয়ে সোফায় এসে বসল। তারপর জাহানারার দিকে তাকিয়ে সেভাবেই বলল,
– “এক সময় তো মেরে মেরেও মুখ দিয়ে ‘ভাই’ বের করা যেত না। এখন কথায় কথায় তিনবার করে ‘ভাই’ ডাকো। তোমার কি মনে হয়, আমি বুঝি না তুমি কেন এমন করো?”
আদিবের কথায় থতমত খেল জাহানারা। সে ইচ্ছাকৃতভাবে আদিবকে ‘ভাই’ বলে, যেন আদিব বিরক্ত হয়। কিন্তু ছেলেটা যে তার অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছে, এটা ভেবে একটু অপ্রস্তুত হলো। তবে স্বভাবসুলভ দমল না। আদিবের পাশে গিয়ে বসল। অবুঝ সুরে বলল,
– “আমি কেন এমন করছি, আদিব ভাই……?”
জাহানারার এই বিরক্তিকর কথায় ভাবান্তর হলো না আদিবের।সে নির্লিপ্ত চোখে জাহানারার দিকে তাকাল।চোখ পড়ল জাহানারার পরিবর্তিত ঠোঁটে ও গলায় থাকা লালচে দাগে। মনে পড়ল গতকাল রাতের কথা। আদিবের মনে হলো, মেয়েটা ভুলে গেছে হয়তো গতকালের কথা, তাই তো এতটা স্বাচ্ছন্দ্যে তার চোখে চোখ রাখছে, তার সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে আদিবের মনে দুষ্ট বুদ্ধি উঁকি দিল।মন বলল,” মেয়েটাকে গতকালের কথা বলে একটু লজ্জায় ফেললে কেমন হয়!”
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। কোনো কথাবার্তা ছাড়া হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল রাখল সে জাহানারার ঠোঁটে। মিহি কণ্ঠে বলল,
– “ইয়োর লিপস লুক ইভেন মোর অ্যাট্রাক্টিভ টুডে দেন লাস্ট নাইট।”
– “কিন্তু কাল রাতে তো লাইট ছিল না, অন্ধকারে আপনি আমার ঠোঁট দেখলেন কীভাবে?”
বাকশূন্য হলো আদিব। বুঝতে পারল, ভুল হয়েছে তার। লজ্জাহীন মানুষকে অযথাই লজ্জায় ফেলতে চেয়েছে সে। জাহানারাকে লজ্জায় ফেলতে গিয়ে আদিব নিজেই লজ্জায় পড়ল। এমন পরিস্থিতিতে পরিত্রাণ পেতে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ালো । দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। যেতে যেতে দুই দিকে মাথা নেড়ে বিড়বিড়ালো,
– “শেমলেস!”
আদিব উঠে যেতেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল জাহানারা। তবে সেই হাসিটা ততক্ষণই স্থায়ী হলো, যতক্ষণ আদিবের পদধ্বনি শোনা গেল। আদিবের পায়ের শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যেতেই বড় বড় দম ফেলল জাহানারা। সামনে থাকা পানির জগ হাতে তুলে নিয়ে জগ থেকেই পানি খেতে লাগল। পানির জগ নিচে রেখে কম্পমান হাত দিয়ে সোফার ফোম চেপে ধরে অনেকটা স্বগোতক্তি করে বলল,
– “ওয়েল ডান, জাহানারা! আরেকটু হলে ইজ্জত পাংচার হয়ে যেতো!”
আদিবের স্পর্শ পাওয়ার পর নিজেকে কিভাবে যে স্বাভাবিক রেখেছে সেটা জাহানারা নিজেও জানে না।তবে আদিবের হঠাৎ কথার মোড় ঘুরানো তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল— ছেলেটা তাকে নাস্তানাবুদ করতে চাইছে।সেই জন্য নিজের অনুভূতির আলোড়ন লুকিয়ে আদিবের সামনে এমন ভাব করেছে যেন উল্টো সে লজ্জা পেয়ে পালিয়ে যায়। কারণ এই ছেলে কে সে যতটুকু জানে ,যদি একবার বুঝতে পারতো জাহানারা লজ্জা পাচ্ছে তাহলে সেটা নিয়ে বারবার তাকে লজ্জায় ফেলতো।সময় নতুন হলেও মানুষ টা তো পুরনো! কথাটা মনে করে ঠোঁট চওড়া হলো জাহানারর ।এ যাত্রায় এক ভ’য়াব’হ বি’পদ থেকে রক্ষা পেয়েছে সেটা ভেবে স্বস্তির শ্বাস ফেলল সে।
_______
– পাগলামির একটা সীমা আছে, রৌদ্র! কী শুরু করেছো কী?”
মায়ের কণ্ঠে ভাবান্তর হলো না রাকিবের। হাতে থাকা ফোটো ফ্রেমটা শ্বেতপাথরের মেঝেতে সজোরে ছুঁড়ে ফেলল। মায়ের দিকে ফিরে শীতল কণ্ঠে বলল,
– পাগলামি তো এখনো শুরুই করিনি এখ…
কথা শেষ করতে পারল না রাকিব। তার আগেই মিসেস সারোয়ার সজোরে চড় বসাল ছেলের গালে। রাকিব স্তব্ধ হলো। তবে ‘টু’ শব্দ করল না। ক্লান্ত পথিকের মতো পা ছড়িয়ে বসে পড়ল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা চূর্ণ-বিচূর্ণ জড়বস্তুর মাঝে।মিসেস সারোয়ার ছেলের এমন স্থবিরতায় গুরুত্ব দিল না।সে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
– “বড্ড বাড়া বেড়েছো, হ্যাঁ? কিছু বলি না বলে যা খুশি তাই করবে? বেয়াদব! আর একটা কথা বললে চাপকে পিঠের ছাল তুলে নেবো তোমার!”
চোখ ঘুরিয়ে ঘরের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে মেজাজ খারাপ হলো মিসেস সারোয়ারের। সে রাগে গজগজ করতে করতে ফের বলল,
– “আমি তোমার বাবাকে আজই বলছি—শামসুল ভাইয়ের সাথে কথা বলতে। লাবিবার সাথে তোমার বিয়ে পাকা করতে। অনেক হয়েছে, আর না। জাহান-জাহান করতে করতে পাগল হয়ে গেছ। এবার—! রৌদ্র!”
আতকে উঠল মিসেস সারোয়ার। রাকিব মায়ের আতঙ্কিত মুখ দেখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো। হাতে থাকা ধারালো কাঁচের টুকরোটা কব্জির কাছে আরেকটু গেঁথে পাগলের মতো হেসে বলল,
– “আমার ভেতর পুড়ছে, মা। আমার ভেতর পুড়ছে। জাহানকে ডাকো, মা। জাহানকে ডাকো… জাহানকে ডাকো…!”
চিৎকার করে উঠল রাকিব। তার গগনবিদারী চিৎকারে সারোয়ার নিবাসের সাথে কেঁপে উঠল মিসেস সারোয়ার। হতবাক হলো। আতঙ্ক মিশ্রিত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ছেলের বিদ্ধস্ত সত্তায়।
চলবে, ইনশাআল্লাহ।