ডায়েরির পাতায়(অনুগল্প)

0
1856

#ডায়েরির_পাতায়(অনুগল্প)
#নিমিশা_জান্নাত

রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে সাজানো বিছানার মাঝখানে বসে আছি।প্রায় একঘন্টা হতে চললো একইভাবে বসে আছি।রুমতো নয় যেন স্টেডিয়াম,বিছানাটাও সুন্দর করে সাজানো।কিন্তু মানুষটা কেমন হবে কোন ধারণা নেই।
আজ বিকেলেই বাবা-মা এর ইচ্ছেতে কবুল বলে ঈশান নামে একজনের স্ত্রী হয়ে গেছি।আজ থেকে আমার ওপর সবচেয়ে বেশি অধিকার সেই মানুষটার।আজকের পর থেকে সম্পূর্ণ নতুন মানুষকে নিয়ে জীবন শুরু করতে হবে।অথচ তাকে এখনও পর্যন্ত আমি দেখিইনি।আমাকে দেখার জন্য শুধু আমার শশুর শাশুড়ী গিয়েছিলেন।আর বিয়ের আগে দেখা করা কিংবা কথা বলা হয়ে ওঠেনি।
দরজা লাগানোর শব্দ পেয়ে তাকিয়ে দেখি ছয় ফিট উচ্চতার সুদর্শন একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন।একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম।ওনি বিছানার কাছে এসে দাঁড়াতেই আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো।তিনি ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন,,,

—” তনু,ভালো আছেন আপনি..??

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।তারপর আবারও বললেন,,,

—” আজ সারাদিন আপনার ওপর অনেক ধকল গেছে।আর কালও এমনি হবে।তাই এখন একটু রেস্ট নিন।

এটুকু বলেই তিনি সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন।আমিও গায়ে চাদর টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লাম।
,
,

চোখের ওপর সূর্যের আলো পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল।উঠে বিছানায় বসতেই মনে পড়লো আমি এখন আর নিজের বাড়িতে নেই।আম্মু আর হাজার বার ডেকে ঘুম থেকে ওঠাবে না।বরং আমাকে নিজেকেই সবার আগে উঠতে হবে।পারলে বাড়িসুদ্ধ সকলকে ঘন্টি বাজিয়ে ডেকে তুলতে হবে।সাইডে তাকিয়ে দেখি সোফা খালি।তারমানে ঈশান উঠে পড়েছেন।বউয়ের আগে বর উঠে গেছেন।কি ভয়ানক ব্যাপার।তাছাড়া ওনি কেমন মানুষ,নিজে উঠে বাইরে চলে গেলেন আমাকে একবার ডাক দিতে পারলেন না।গজরাতে গজরাতে বাম সাইডে তাকিয়ে দেখি বেডসাইড টেবিলে একটা ঢাকনা দেয়া কফির মগ রাখা আর মগের নিচে চাপা দেওয়া একটা চিরকুট।মগটা হাতে নিয়ে চিরকুটটা খুলে দেখি গোটা গোটা অক্ষরে কয়েকটা লাইন লেখা,,,,

—” আমি বাইরে যাচ্ছি।আপনি ঘুমুচ্ছিলেন তাই আর বিরক্ত করিনি।তবে আপনি চিন্তা করবেন না।আমার বাসার সবাই দেরী করেই ওঠে।কফিটা খেয়ে নিবেন।শুনেছি আপনার পছন্দ,তাই নিজের হাতে বানিয়েছি।দুপুর নাগাদ চলে আসবো আমি।নিজের খেয়াল রাখবেন।

চিরকুট পড়ে আপনাআপনিই মুখে হাসি ফুটল।যেখানে নিজের মাকে কোনদিন সকালে এককাপ কফি দেয়ার জন্য রাজি করাতে পারিনি,সেখানে অচেনা একজন মানুষ এতোটা খেয়াল রেখেছেন।ভাবতেই ভালো লাগছে।
ফ্রেশ হয়ে হলুদ রঙের একটা শাড়ি পড়ে নিলাম।শাশুড়ী রুমে এসে নিজের হাতে নাস্তা খাইয়ে দিলেন।তারপর ড্রয়িং রুমের সোফায় পুতুলের মতো বসিয়ে রেখেছেন।একের পর এক মানুষ আসছে আর সবাইকে আমার মেকাপ ঘষে সাদা বানানো চেহারাটাকে একবার করে দেখাতে হচ্ছে।
দুপুরের দিকে আমাদের বাড়ি থেকে মেহমান এলো।সাথে ঈশানকেও দেখলাম।তারমানে ওনি এই কাজে গিয়েছিলেন।আব্বুকে দেখে নিজেকে সামলাতে পারিনি।কেঁদে ফেলেছিলাম।আব্বু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করলো।

——————————————–

দেখতে দেখতে নতুন শশুর বাড়িতে এক সপ্তাহ কেটে গেল।বৌভাতের পরে আমাদের বাড়ি থেকে এসেছি।কি অদ্ভুত নিজের বাড়িতেই মেহমান হিসেবে আসা যাওয়া করছি।শশুর শাশুড়ির আদর ভালোবাসায় বেশ দিন কেটে যাচ্ছে।ঈশানও অফিসে জয়েন করেছে।কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা আগানো হয়ে ওঠেনি।এমনিতে ঈশান আমার অনেক খেয়াল রাখে।অফিস থেকে ফেরার পথে ফুল চুড়ি এগুলো নিয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখে দেয়।আমিও মুচকি হেসে তুলে রাখি।কিন্তু সামনাসামনি প্রয়োজন ব্যতীত কথা বলা হয় না।

সকালে নাস্তার পরে ভাবলাম কাবার্ড গুছাবো।এইসময় টায় কোন কাজ থাকেনা।তাছাড়া এতোদিন বিয়ের ঝামেলায় এদিকে নজর দেয়া হয়নি।
রুমে এসে কাবার্ড খুলে সব কিছু বের করে ফেললাম।এককোনে ঈশানের সব টি-শার্ট রাখা।সেগুলো বের করতেই একটা মোটা ডায়েরি উঁকি দিলো।হাত বারিয়ে বের করে দেখলাম গাড়ো নীল মলাটের একটা মোটা ডায়েরি।মনের মধ্যে ভীষণ কৌতুহল হতে লাগলো।কি আছে ওই ডায়েরিতে।এমন কিছু কি যেটা আমি কোনদিন শুনতে চাই না।কারো পারসোনাল জিনিস বিনা অনুমতিতে দেখতে নেই এটা ভেবে ডায়েরিটা রেখে দিলাম।কিন্তু পরক্ষনেই মনে হচ্ছে ঈশানের সব পারসোনাল বিষয়ের ওপর একমাত্র আমার অধিকার আছে।তাই আমি এটা দেখতেই পারি।সাতপাঁচ ভেবে অবশেষে ডায়েরিটা নিয়ে বেডের ওপর বসলাম।মলাটের ওপর মার্কার পেন দিয়ে ঈশান লেখা।উল্টেপাল্টে দেখলাম প্রথম থেকে চারটা পাতায় কিছু কিছু লেখা।বাকি সব পাতা খালি।প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই পড়া শুরু করলাম,,,,

—” জীবনে কোনদিন ডায়েরি লিখবো স্বপ্নেও ভাবিনি।আমার মতো আনরোমান্টিক রোবট টাইপের ছেলেরও আজ দুকলম লিখতে ইচ্ছে করছে।
অফিসের কাজে প্রায়ই এদিকওদিক যেতে হয়।সেই অনুযায়ী আজকেও বেরিয়েছিলাম।প্রথমে খুবই বিরক্তি নিয়ে বেরোলেও ওখানে পৌঁছানোর পর মনে হল না আসলে অনেক কিছু মিস করে ফেলতাম।রাস্তার পাশে ফুল বিক্রেতা মেয়েটাকে পরম যত্নে বিরিয়ানি খাইয়ে দিচ্ছিলে তুমি।হাজারো মর্ডান মেয়েদের ভীড়ে এই অতি সাধারণ কালো হিজাব পড়া তোমাকে দেখে মন হারিয়ে ফেলেছিলাম।তোমার সুন্দর পরোপকারী মনটাই আমাকে বেশী আকৃষ্ট করেছে।একটু পরেই খাওয়ানো শেষ করে তুমি রিকশা নিয়ে চলে গেলে।আমার জন্য রেখে গেলে একগুচ্ছ স্মৃতি আর নির্ঘুম রাত।

প্রথম পাতায় এটুকুই লেখা।প্রথমে ভেবেছিলাম অন্য কিছু,কিন্তু এতো আমাকে নিয়েই লিখেছে।দ্বিতীয় পাতা উল্টিয়ে পড়া শুরু করলাম,,,,

—” আজও সেই জায়গায় গিয়ে একঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম।কিন্তু অপেক্ষার আর শেষ হলো না।তুমি আসলেনা আজ।তবে ফুল বিক্রি করা মেয়েটার থেকে তোমার ডিটেইলস পেয়ে গেলাম।তনু,পাশের ভার্সিটিতে পড়ো।এটুকুই যথেষ্ট ছিল আমার জন্য।বাসায় ফিরে আম্মুকে বললাম।আম্মু আব্বু বিনাবাক্যে রাজি হয়ে গেছেন।আমার ভালো থাকাই তাদের একমাত্র চাওয়া।তাই আমি যাকে পছন্দ করবো ওনার তাকেই বাড়ির বউ করবেন।

—-” অবশেষে তোমাককে পেয়েই গেলাম একান্ত নিজের করে।আব্বু তোমাদের বাসায় প্রস্তাব দিয়েছিলেন।সাথে তোমার বাবা-মা ও রাজি হয়েছিলেন।তাই খুব অল্পসময়ের মধ্যেই বিয়েটা হয়ে গেল।ভেবেছিলাম বাসর রাতে সারারাত তোমার সাথে গল্প করবো।কিন্তু মুখ থেকে একটা শব্দও বেরোচ্ছে না।তাই বাধ্য হয়ে তোমাকে ঘুমিয়ে পড়তে বললাম।
তুমিতো ঘুমিয়ে আছো।কিন্তু জানো কি কেও একজন তোমাকে তৃষ্ণার্ত চোখে দেখছে।ভেবেছিলাম তুমি আসলে রাতজাগার অবসান ঘটবে।কিন্তু সেটাতো হলো না।তাই আবার ডায়েরি নিয়েই বসলাম।

—” তুমি কি জানো এই কদিনে হাজার বার তোমার প্রেমে পড়েছি।তুমি যখন আব্বু আম্মুকে নিজের বাবা-মা এর মতো ভালোবাসো তখন গর্ব হয় আমার।আমার দেওয়া সামান্য গিফটগুলো যখন তুমি পরম যত্নে আগলে রাখো তখন মনে হয় তুমিই আমার জন্য পারফেক্ট।আজকে গোলাপী শাড়িতে দারুন লাগছিল তোমায়।ইচ্ছে করছিল গাছ থেকে বেলীফুল নিয়ে চুলে গুঁজে দিতে।কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারলাম না।আমি বড্ড মুখচোরা।তোমার সামনে কথা বলতে গেলেও লজ্জা লাগে।

এখানেই শেষ হয়েছে লেখার অংশ।মুখচোরা ছেলেটা তো বেশ রোমান্টিক।শুধু আমার সামনে আসলেই পালাই পালাই করে।ছেলেরা এতো লাজুক হলে চলে।তবে ডায়েরি পড়ে যতটা বুঝলাম ও কোনদিনও নিজে থেকে ধরা দেবে না।আমাকেই কিছু করতে হবে।সবার ক্ষেত্রে তো রাজকুমার ভালোবাসি বলে।আমাদের গল্পে নাহয় আমিই বলবো আমার রাজকুমারকে।

প্লান অনুযায়ী সন্ধ্যে হতেই রুমটা হালকা সাজালাম।কয়েকটা কালারফুল মোমবাতি জ্বালিয়ে একসাইডে রেখে দিলাম।ভয়ও লাগছে একটু।যেই অকম্মার ঢেঁকি আমি।দেখা যাবে ঘরেই আগুন লাগিয়ে দেব।শেষে ভালোবাসি বলা বাদ দিয়ে হসপিটালে দৌড়াতে হবে।সবকিছু সাজানো শেষ করে বারান্দা থেকে একটা গোলাপ ছিড়ে টেবিলের ওপর রাখলাম।এরমধ্যেই ও চলে এসেছে।আজকে তুলনামূলক আগেই এসে পড়েছে।আসবেনা কেন,আমার কাজের চৌদ্দটা বাজাতে হবে না।
ঈশান দরজা নক করছে।তাই দরজা খুলে এক সাইডে দাঁড়িয়ে আছি।কিন্তু ঈশান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে কোট ঘড়ি খুলতে লাগলো।মনে হচ্ছে এখানে কোন মানুষের অস্তিত্বই নেই।প্রচন্ড রাগ হচ্ছে,তবুও নিজেকে সামলে ফুল হাতে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।কিন্তু ওর চোখের দিকে তাকাতে পারছি না।অবশেষে ঈশানই আমার হাত থেকে ফুলটা নিল।তারপর হাঁটু গেড়ে বসে প্রপোজ করলো।
শুরুটা আমি করেছিলাম।শেষটা ঈশান করলো।ঈশানের আমার প্রতি অনুভূতিটা ডায়েরির পাতায় লুকায়িত ছিল।যেটা আমি প্রকাশ করেছি।ঈশানকে বলিনি আমি ওর ডায়েরি পড়েছি।আর কখনও বলবোও না।থাক না কিছু কথা আড়ালে।অপ্রকাশিত,যেমনটা ও রেখেছিল।।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে