গল্পঃ নিরুত্তাপ

0
1991

গল্পঃ নিরুত্তাপ

হাবিবা সরকার হিলা

অংশুকে আমার হিংসে হয়। মেয়েটা আমাদের পাশের বাড়ি থাকে। রঙউঠা হলদে দেয়াল, টিনের ছাদ, দুইঘরের ছোট্ট বাড়ি।সামনে এক চিলতে উঠোন পেরিয়ে লোহার গেট। ঝাঁকড়া আমগাছের ডাল-পালায় ভেতর বাড়ি ঢেকে থাকে। আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে শুধু অংশুর ঘরের খানিকটা দেখা যায়। আমার মা যতবার ছাদে যায় কার্নিশে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে ওদের দৈনন্দিন কাজকর্ম লক্ষ্য করে।

ঘরে ফিরে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে।

-অংশুরে যখন দেখি তখনি পড়ার টেবিলে। মেয়েটা এত লক্ষী। দেখিস এইচ.এস.সিতে ও গোল্ডেন এ প্লাস পাবে।

-পেলে আমি কি করব?

মা চিরুনী ছুঁড়ে মারে।
-হারামজাদা তুই মোবাইল টিপ। চারটা টিচার প্রাইভেট পড়ালাম এস.এস.সি তে এ প্লাস পর্যন্ত পাইলি না। দেখ গা, অংশুর বাপ একটা ভাদাইম্মা। ঠিকমত মাছ দিয়ে ভাত খেতে পায় না অথচ মেয়ে দুটো আল্লাহ নিজ হাতে গড়াইছে এমন লক্ষী। আর আমার ঘরে কুজাত হইছে।

-আমাকেও তো আল্লাহ বানাইছে মা, ফেরেশতারা বানায় নাই।

-নাফরমানি কথাবার্তা বলবি না। অংশু তোর থেকে দেড় বছরের ছোট হয়েও একই ক্লাসে পড়ে। পড়াশোনায় কি ব্রিলিয়ান্ট! ওর পা ধুয়ে পানি খা, যা।

মায়ের উপর রাগ উঠে তারচেয়েও বিরক্তিকর লাগে অংশুকে। ফর্সা মুখ, টিকালো নাকের উপর গভীর দু’খানা চোখ। কোঁকড়া চুল যতই আঁটোসাটো করে বাঁধুক,একগুচ্ছ চুলে কপাল ঢাকা থাকে। পাড়ার ছেলেরা অংশু বলতে পাগল। ওইরকম অহংকারী চেহারার মেয়ের মাঝে ওরা কি মধু পায় জানি না। আমার মায়েরও সারাদিন ওর সাথে আমার তুলনা দেওয়া চাই। অংশু বরাবর স্কুলে ফার্স্ট হত সেখানে আমি মধ্যমমানের ছাত্র। টেনেটুনে দশের মধ্যে রোল নাম্বার রাখলেই যথেষ্ট। সরস্বতী পূজায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে রিনরিনে গলায় রবীন্দ্র সংগীত বাজায়।আমি ভাই, অতশত বুঝি না। আমার আর্টসেল হলেই চলে। মায়ের কাছে “নিকৃষ্ট”মানে শেয়ালের হুক্কাহৃয়া।
সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি মা সোফায় পা ছড়িয়ে বসে তেঁতুলের আচার খাচ্ছে। আমায় দেখে সাধল।

-খাবি? হা কর।

-বাহ! দারুণ হয়েছে তো। তুমি বানিয়েছ?

-না। অংশু বানিয়েছে। আরেকটু নিবি?

চুপচাপ বেসিন গিয়ে মুখের পাচনটা কুলি করে ফেলে দিলাম। অংশু আমার দুই চক্ষের বিষ।

এইচ.এস.সি পরীক্ষার কয়েকমাসে বেশ চিন্তায় ছিলাম।মা কানের সামনে ঘ্যানঘ্যান করে অংশু সারারাত জেগে পড়ে।আমার পাস করাই দুষ্কর হবে।কেমিস্ট্রি সেকেন্ড পেপার মাথায় ঢুকে না আর বোটানি কিসব হিবিজিবি নাম! মায়ের ভীষণ আশা অংশুর সমান সমান না হোক অন্তত রেজাল্ট যেন একটু ভালোমানের হয়। টেনশনে রাতে আমার ঘুম হয় না।

টেস্ট পরীক্ষার পর পর একটা দারুণ সুসংবাদ পেলাম। অংশুর বিয়ে। আমার ছোট ভাই এসে যখন লাফাতে লাফাতে খবরটা দিল, বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। অংশু তো ছোট,এই এতোখানি।আমার কাঁধ সমানও লম্বা হয় নি। হাত-পায়ের গড়নে মেয়েলি ভাব নাই,ওড়না ছাড়া ঘোরাঘুরি করে। মাকে প্রশ্ন করতেই হড়হড় সবটা বলে দিল,
-অংশুকে কলেজ থেকে আসার সময় ছেলের মা পছন্দ করেছে। ছেলেদের ঢাকা তিন তিনটে বাড়ি। বিরাট ব্যবসায়ী। অংশুর বাবার রাজ কপাল। উপঢৌকন কিছু দিতে হবে না উল্টো মেয়েকে ওরা সাজিয়ে গুছিয়ে নিবে।

-কিন্তু মা, ও তো খুব ভালো স্টুডেন্ট। নির্ঘাত মেডিকেলে চান্স পাবে।

মা এ জীবনে আমার মুখে অংশুর প্রশংসা শুনে নি। অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত।
তারপর বলল,

-ওদের পরিবারের অবস্থা তো জানিস। বাপটা কোনো কাজ করে না, মেয়ে দুটো বড় হয়ে গেছে, ভাই ছোট। ওর মা এতবড় সংসার কতদিন টানবে! মেয়ে হয়ে জন্মালে পরের ঘরে তো যেতেই হবে একদিন আগে আর পরে।

মায়ের এসব ছাপোষা কথাবার্তা শুনতে ভালো লাগছিল না। অংশুদের বাড়ি গেলাম।

-কীরে, তুই নাকি বাসন মাজতে যাচ্ছিস?

অংশু ঠোঁট উল্টায়।

– বাসন মাজলেও তোর চেয়ে ভালো রেজাল্ট করব।

-তোকে ওরা বিয়ের পর পড়তে দিবে?

-অবশ্যই দিবে।বাবার সাথে ওদের কথা হয়েছে।

– তোর বরের ভুড়ি আছে?

-যা ভাগ।

-তাহলে নিশ্চয়ই মাথায় টাক আছে।

-আমি দেখি নি৷ ওর মা এসে আঙটি পরিয়ে দিয়ে গেছে।

অংশুর অনামিকায় ডায়মন্ডের আঙটি জ্বলজ্বল করে।

-ছি! তুই ও শাড়ি গয়নায় বিক্রি হয়ে গেলি!

অংশুর চোখের কোণায় এক বিন্দু জল।

-আমার বিয়ে হয়ে গেলে একটা খাওয়ার মুখ কমে।

ও আঙটি ঘোরাতে ঘোরাতে জবাব দেয়।

সত্যি সত্যি অংশুর বিয়ে হয়ে যায়। ভুড়িওয়ালা আধবুড়ো নয় অংশুর বর রাশভারী গম্ভীর লোক। লম্বা চওড়া লোকটার পাশে বেনারসি পরা অংশুকে জবুথবু লাগে। একগাদা গয়না মেকআপে ও কেমন বড় হয়ে গেল। স্টেজে ছবি তোলার অজুহাতে অংশুকে একা পেলাম।

-সঙ সেজে বসে আছিস! বিশ্রী লাগছে।

-তোর পাঞ্জাবির হাতায় ঝোল। কয়টা রোস্ট গিলেছিস রে?

-ওনলি চার পিস।

-রাক্ষস একটা।

-যা! যা! তোর স্বামী দেবতা হলেই চলবে।

-তোর জন্যে ক্যালকুলাস নোট করে রেখেছিলাম। অনুর থেকে চেয়ে নিয়ে যাস।

-অংশু, তোকে মিস করব।

ও কিছু বলার জন্যে ঠোঁট নাড়ল কিন্তু আমার কান পর্যন্ত পৌঁছাল না।

অংশুর বিয়ে হয়ে যাবার কয়েক সপ্তাহ পরও অংশুকাহন শেষ হচ্ছিল না। দামী গাড়িতে চড়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে আসে, শাড়ি গহনার ভারে ঝুকে গেট পেরোয় এতো রীতিমত বাদশাহি কাণ্ডকারখানা। আমার মা ছাদ থেকে অংশুর আসা-যাওয়া লক্ষ্য করে আর ঘরে এসে আফসোস করে।

-অংশুর মা কপাল করে জন্মেছে তাই তো রাজরানী পেটে ধরেছে।

এইচ.এস.সি পরীক্ষার ফল বের হল। আমার জিপিএ ফাইভ পাওয়া হল না। অংশু কি পেয়েছে তাও জানা হল না। আমার মায়ের কাছে ততদিনে ওর রেজাল্টের চেয়ে ওর সংসারের বনেদি আভিজাত্যে বেশি উৎসাহী হয়ে উঠেছে।অবশ্য দিন যায় উৎসাহ কমে।

ফ্যাশন ডিজাইনার পড়তে ইন্ডিয়া চলে এলাম। ব্যস্ত থাকি খুব,বাড়িতে নিয়ম করে দিনে একবার ফোন করা হয়
। দশ -পনের মিনিট বাড়ির খবরাখবর দিতেই চলে যায় মা আর পড়শীদের খবর দেবার প্রয়োজন বোধ করেন না।

পাঁচ বছর পর ইর্ন্টানি শেষ করে দেশে চলে এলাম। আমান চাকরি ভাগ্য ভালো বলতে হবে তিনটা ইন্টারভিউ দিতেই একটাতে টিকে গেলাম। আমাদের বাড়িটা নতুন রঙ করা হয়েছে। আগে ছিল ঘিয়ে রঙা এখন আকাশী নীল। দোতলা কমপ্লিট করে বাবা তিনতলার কাজে হাত দিয়েছে। বাবার ব্যবসাও উন্নতির পথে। অংশুরা আগের মতই আছে। মরিচাধরা লোহার গেট, প্লাস্টার উঠে যাওয়া বাড়ির দেয়াল। শুধু আমগাছটা আরো ঝাঁকড়া হয়ে অংশুর ঘরের জানালাও আড়াল করে ফেলেছে।

একদিন রাস্তায় অংশুর সাথে দেখা৷ আমি প্রথমে ঠিক চিনতে পারি নি। খানিকটা লম্বা হয়েছে।পরনে নীল-সাদা থ্রিপিস, চোখেে রোদচশমা। এগিয়ে গেলাম,

-অংশু,কেমন আছ?

-সে কি,বাবু! দেশে আসলে কবে! আমি প্রথম দেখে চিনতে পারি নি।

-চেনার কথা না। পাঁচ বছর আগে দাড়ি-গোঁফ ছিল না।
কোথায় যাচ্ছ?

-ক্লাস আছে। এমবিএ করছি।

-বাহ! তোমার বর তোমাকে অনেক পড়াল।

অংশু হাসে।
-বর করায় নি। তিন বছর আগে ডির্ভোস হয়ে গেছে।

-কেন? কিভাবে?

-সে অনেক কথা৷ দেশেই থাকবে?

-হ্যা। তুমি থাকো কোথায়? বাড়িতে তো দেখি না।

-বাড়িতে বাবা ঠাঁই দিলে তো,গার্লস হোস্টেলে থাকি৷ আজ আসি, তাড়া আছে।

অংশু জোর করেই চলে যায়৷ অনেকগুলো প্রশ্ন বুকের ভেতর খচখচ করে।অফিস থেকে ফিরেই মাকে প্রশ্ন করি,

-মা,অংশুর ডির্ভোস হয়ে গেছে?

মা ঠোঁট উল্টায়।

-ওই গল্প বাদ দে। গরীব ঘরের মেয়ে টাকাপয়সা হাতে পেয়ে সাপের পাঁচ পা দেখেছিল। বেশি চটাং চটাং করেছিল স্বামী দিছে লাথি মেরে ফেলে।

-মা, প্লিজ। আসল ঘটনা বলো।

মায়ের অনেকক্ষণ গালগল্প শোনার পর যা বুঝলাম অংশু মেনে নিতে পারে নি ওর বরের সাথে অন্য মেয়েদের ঘনিষ্ঠ হওয়া যার ফলস্বরূপ ডির্ভোস।
মা বলল,

-হঠাৎ অংশুর কথা কেন?

-ওর সাথে রাস্তায় দেখা হয়েছিল। মনে হল, ভালোই আছ।

-আর ভালো থাকা। পুরুষ মানুষের একটুআধটু বাজে স্বভাব থাকেই! মানিয়ে নিলে কি হত!রানীর মত থাকত পছন্দ হয় নাই এখন টিউশন করে পেট চালায়। অলক্ষী মেয়ে।

-মা, মনে আছে অংশুর পা ধুয়ে পানি খেতে বলতে?

মা তাকিয়ে রইল।

-তোমরাই সমাজ।সুসময়ে মাথায় তুলে নাচো,সময় শেষে ছুঁড়ে ফেলো।

জামাকাপড় চেঞ্জ না করেই ছাদে চলে আসলাম।জ্যোৎস্না রাত। আমগাছের ছায়ার অংশুর ঘর নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে। ওই ঘরে ওর জায়গা হয় নি। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। অংশুর বিয়েটা বাঁচে নি ওর স্বপ্নগুলো বেঁচে থাকুক।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে