Sunday, July 20, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 384



কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-২৪

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২৪ (ক)

আজকের চেকআপে ডক্টর নিশ্চিত করেছেন অর্ণবের পুরোপুরি সুস্থতা। হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে নুপুরের ভার্সিটির সামনে গিয়ে কল দিলো তাকে। রিসিভ হলো না দেখে সে আবার রিকশা খুঁজছিলো বাড়ি ফেরার জন্য তখনই চোখে পড়লো কিছুদূরে নুপুর। এদিকেই আসছে ছুটে।

– ছুটি হয়ে গেছে?

-না একটা ক্লাশ আছে পনেরো মিনিট পর।

-চলে এলে যে!

-আপনার কল দেখলাম….

– ধরলে নাতো

– জানি তো এখানেই আছেন তাই চলে এলাম।

-কল দেখেই বুঝলে আমি এখানে আছি!

– এ সময় ভার্সিটিতে থাকি তা আপনার জানা। এখানে না আসলে আপনি কলই দিতেন না তাই বুঝেছি আপনি এসেছেন।

-ভাল।

নুপুর একবার আগাগোড়া দেখে নিলো অর্ণবকে। সমুদ্রনীল শার্ট গায়ে, চুলগুলো এলোমেলো, হাতে ঘড়ি আর মুখভর্তি কয়েকদিনের অযত্নে বেড়ে ওঠা দাঁড়ি। দেখতে তাকে লাগছে সদ্য ছ্যাকা খাওয়া প্রেমিক পুরুষ। নুপুরের স্থির দৃষ্টি দেখে হাসি পাচ্ছে অর্ণবের।

-মেয়েদের নজরও এতোটা বেহায়া হতে পারে!

কথাটা শুনে লজ্জা পেল নুপুর একটু বোধহয় অপমানিতও হলো তাই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। আজ সকাল থেকেই রোদ ঝলমলে আকাশ কোথাও মেঘের দেখা নেই। রাস্তায় যেখানে তারা দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে কয়েক কদম পেছনেই ভার্সিটির মূল গেইট। অনেকেই আসছে যাচ্ছে কেবল কেউ আবার রাজার জমানার শাহানশাহের মত গোঁফ দেখে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে৷ চমৎকার, সুতনু, সুদর্শন এই ছেলেটাকে দেখে অনেকেই হয়ত জল্লাদের চেয়ে শাহেনশাহ খেতাবটাই বোধহয় দিচ্ছে মনে মনে কিন্তু নুপুরের যে আর ভালো লাগছে না এত লোকের নজর। অর্ণব অবশ্য সেসবে পাত্তা না দিয়ে হাসি হাসি মুখে অন্য কথায় গেল।

-বাড়ি ফিরবে এখন?

-কেন

-না ফিরলে আরেকটু সময় নিজেকে ভিজিয়ে নিতাম নি র লজ্জ দৃষ্টিতে। হা হা

নির্লজ্জ শব্দটাকে খুব করে টেনে ভেঙে ভেঙে বলেই সল্প আওয়াজে হেসে উঠলো অর্ণব। নুপুর বেশ বুঝতে পারলো অর্ণবের ঠাট্টা তাই রেগে গেল ভীষণ।

-চলে যান আমি যাব না।

-আরেহ আরেহ রাগ করলে নাকি! আমি কি হাত ধরে, গাল টেনে, নাক চেপে রাগ ভাঙাবো? এহ না লোকে কি বলবে, বোনের বান্ধবীর রাগ ভাঙাচ্ছি!

‘বোনের বান্ধবী!’ এবার যেন রাগের স্ফুরণ ঘটল আগের চেয়েও বেশি। কথায় কথায় আজকাল অর্ণব তাকে এভাবেই খুঁচিয়ে কথা বলে। সে বোঝে এটা শুধুই মজার ছলে বলা তবুও তাদের মধ্যে কি সম্পর্কটা কি এখনও অতটুকুই নাকি একটুখানি বদলেছে? হঠাৎই যেন মনে হলো নুপুরের এই কথাটা। আদতে তাদের মধ্যে এর বাইরে কিছু আছে কি! গত দিনগুলোতে অর্ণবের সাথে থাকা যোগাযোগটাকে সে একটু বেশিই কিছু ভেবে নিয়েছিলো। ঠিক এই মুহূর্তেই সে নিজের ভাবনার ভুল শুদ্ধ বিচারে ডুবতেই অর্ণব তাকে ভাসিয়ে নিলো একটানে এক বাক্যে।

– আমি ভাবছি কথা বলব তোমার আব্বুর সাথে।
-কেন?
আৎকে উঠে প্রশ্ন করলো নুপুর। অর্নবও সহজ ভাষায় জবাব দেয়।

-আমি কি নিব্বাদের মত প্রেমিকা নিয়ে ডেটের নামে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াবো নাকি! সাড়ে সাতাশ বছর বয়স হয়েছে, কাজেকর্মে অলস নই সংসার করার যোগ্যতাও আছে।

হাতে গুণে কথা বলা লোকটা সরাসরি না হোক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বিয়ের কথাই কি বলল! লজ্জায় এবার মরি মরি অবস্থা যে হলো নুপুরের। প্রেম করবে না বিয়ে করবে আহ্ কি শখ!

এখানে আর দাঁড়িয়ে লাভ নেই।বাড়ি ফিরবে এখন?

নুপুর মাথা নেড়ে সায় দিতেই অর্ণব দুটো রিকশা ঠিক করলো। একটা নুপুরের জন্য অন্যটায় অর্ণব ফিরবে।

‘কাল যেও বাসায়।’

-কাল! অর্নি আসবে। রিদওয়ান আসছে আজ রাতের ফ্লাইটে।

-কই অর্নি তো কিছু বলেনি।

-ও নিজেও জানে না ইনফ্যাক্ট আমি ছাড়া কেউ জানে না।

-তাহলে অর্নি আসবে কি করে?

-সারপ্রাইজ দেবে বলে রিদওয়ান আগে অর্নির কাছে যাবে। ওকে সাথে নিয়ে ঢাকা আসবে।

-ওহ!

– আচ্ছা আর দাঁড়াতে হবে না রোদে। ওঠো রিকশায় বাড়ি পৌঁছে টেক্সট করে জানিয়ো।

নুপুর রিকশায় উঠে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় অর্ণবের দিকে। লোকটা আর একটুও ফিরে তাকালো না। হাড়ে-মজ্জায় একদম নিরামিষ একটা। একটু ফিরে তাকাবে মিষ্টি করে বিদায় জানাবে এমনটাই তো হয় পছন্দের মানুষগুলোর মাঝে৷ অথচ উনি কেমন দায়সারা সবটাতেই।দু দিকে চলে গেল রিকশা দুটো সেই সাথে মানুষ দুটোও।

______________
বসার ঘরটাতে চায়ের কাপ আর মিষ্টির শোরগোল। পাঁচ গদির সোফার সাথে যুক্ত হয়েছে সিঁড়ির নিচে থাকা ডিভানটাও। বসার ঘরে জায়গা অনেক থাকলেও প্রয়োজন হতো না বলেই অর্ণব নতুন কোন আসবাব কেনার চিন্তা করতো না। আজ বাড়ি ফিরতেই চোখে লাগলো বসার মত আসবাবের কমতি৷ তিন সেটের বড় সোফাটায় মাঝখানে বসা দাদী, তাঁর দু পাশে বৃষ্টি আর বড় খালামনি৷ বাকি দুই সোফায় একটাতে খালুজান, অন্যটায় বড় দাদা তাঁরই পাশে আলাদা চেয়ারে সাখাওয়াত ভাই। ডিভানে আছে সাখাওয়াত ভাইয়ের বড় ছেলে আর দু জন ছোট বাচ্চা ছেলে সম্পর্কে সে দুটোও ভাতিজা৷ চাচাতো ভাইদেরই সন্তান ওরা। সকলের আচমকা এই ভর দুপুরের উপস্থিতিতে ভড়কালো অর্ণব। সকালেও বাড়িতে দাদী আর রোজিনা খালা ছাড়া কেউ ছিলো না। আজ কি কোন বিশেষ কিছু আছে! নাহ তেমন কিছুই মনে পড়লো না তার। অর্ণবকে দেখতেই সাখাওয়াত ভাই বলে উঠলেন, আরে অর্ণব তোর জন্যই সবাই অপেক্ষা করছে আয় এখানে।

সালাম দিয়ে এগিয়ে যেতেই দাদী মুখ গোমড়া করে বললেন, ও আগে মুখ হাত ধুইয়া এট্টু বিশ্রাম করুক। মাত্রই তো অসুখ ছাড়লো।

– তা ঠিকই বলছো ছোট বউমা।

বড় দাদা সায় দিলেন দাদীর কথায়।সম্পর্কের সমীহ এখনো বৃদ্ধাদের মাঝে অটুট বলেই বাড়ির অন্যরা এখনো মুখের ওপর কথা বলেন না। তবে অর্ণবের এই দাদা-দাদীদের বিশেষ ভাব দেখানো বাশার শেখের খুব একটা পছন্দ নয়। তিনি মনে মনে বিরক্ত হলেও অর্ণবের মন মর্জিতে রাশ টানতেই তাদের কথায় কর্ণপাত করা। অর্ণব কৌতূহলী সকলের উপস্থিতিতে কিন্তু দাদীর কথা মেনে সে আগে ঘরে গেল৷ রায়না বেগমও আর বসলেন না। এতগুলো মানুষ একসাথে হওয়ায় তিনি নিজেই হাত লাগিয়ে রান্নার আয়োজন করেছিলেন এখন ভাবছেন কথাবার্তা পরে হোক আগে টেবিল সাজাবেন৷ বৃষ্টিও মায়ের সাথে উঠে গেল। তার পেছন পেছন গেল অর্ণবের সেই ছোট্ট ভাতিজা দুটোও৷ বৃষ্টির সাথে তাদের আবার খুব ভাব। খুব একটা সময় না নিয়ে অর্ণব গোসল সেরে ফিরে আসলো নিচে। খালামনি সবাইকে একসাথে খেতে ডাকলেন। খাওয়ার মাঝেই কথা পাড়লেন বড় দাদা, ‘অর্ণব আমি আর সাখাওয়াত এসেছিলাম ব্যবসায়িক কথাবার্তার জন্য কিন্তু এখানে এসে বাশারের কথা শুনলাম। তাই এখন সেই আলোচনাই হোক। রাতে ফ্রী হয়ে আমার ওখানে যাস।’

-কোন আলোচনা?

-বিয়ে-শাদির।

বড়দাদাই বললেন কথাটা। অর্ণব ভাতের লোকমা মুখে তুলতে গিয়েও থেমে গেল। হঠাৎই আনন্দের একটা অনুভূতি ছুঁয়ে গেল তাকে। এতদিনে তবে বোনের সংসারে পা রাখার আয়োজন হবে। রিদওয়ান কি তাহলে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্যই দেশে আসছে!

– এটা তো আনন্দের খবর। কিভাবে কি করতে হনে আমাকে বলে দিয়েন খালু আমি সেভাবেই আয়োজন করব।

খালুর দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল অর্ণব। তার কথা শুনে বাবার পাশে খেতে বসা বৃষ্টি লজ্জায় লাল হলো। অর্ণব ভাই বিয়ের জন্য এত উদগ্রীব! বাবাহ কেমন ছটফট করে বলছে আয়োজন করবে। টেবিলে থাকা প্রত্যেকেই বোধহয় অবাক হলো কিছুটা।

-তোমাকে কিছু করতে হবে না অর্ণব। মেয়ে দিব আমি আয়োজনও আমিই করব তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।

খালুর কথা বোধগম্য হয়নি অর্ণবের। সে প্রশ্ন করতে গেলে খালু আবার বলে উঠলেন, তোমাদের বিয়ের দিনই রিদওয়ান অর্নিতার রিসেপশন হবে।

ভাদ্র মাসের প্রবল দাবদাহের আকস্মিক আগমন হলো যেন অর্ণবের খাবার টেবিলে। খালু কি বলল তার বিয়ে, তাদের বিয়ে! সে অস্থির হয়ে চোখ ঘোরালো দাদী নেই এখানে। একবার কেমন অবাক হয়ে বৃষ্টির দিকেও তাকালো। মেয়েটা তবে সত্যিই তাকে ভালোবাসার কথা সকলের সামনে প্রকাশ করে বসলো। খাবার আর গলা দিয়ে নামতে চাইলো না তার।

‘রাতে আমি দেখা করবো আপনার সাথে’ কথাটা বড় দাদাকে বলে উঠে গেল অর্ণব। টেবিলে উপস্থিত প্রত্যেকেই যেন কিছু বলার জন্য উৎসুক সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সে নীরবে চলে গেল দোতলায়। বৃষ্টির লজ্জা মাখা মুখটায় নেমে এলো আষাঢ়ে নীরদ। মনে পড়ে গেল রিমন ভাইয়ের বলা কথাগুলো। সকালেই রিমনকে জানানো হলো আজ অর্ণবের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া হবে। রিমন জানতে চাইলো, কার বিয়ে?
বাশার শেখ সহাস্যে বললেন অর্নব, বৃষ্টির। তারপরই হয়ে গেল বাবা ছেলের মধ্যকার শান্ত লড়াই৷ রিমন বোনের দিকে তাকিয়ে সহজ করেই বলেছে, অর্ণব ভাইয়ার সাথে বৃষ্টির বিয়ে সম্ভব নয় আব্বু। আমরা অন্য ছেলে খুঁজব আমার বোনের জন্য৷

বাবা জানতে চাননি কেন সম্ভব নয় শুধু বলেছেন, আর কোথাও খোঁজাখুঁজি হবে না। আমি বলেছি মানে অর্ণবই ফাইনাল।

-অর্ণব ভাইয়ার অন্য জায়গায় পছন্দ আছে।

-সেসব জেনে কাজ নেই এখন আর। আজকের পর থেকে বৃষ্টিই হবে তার পছন্দ। লাঞ্চের সময়তুমিও চলে এসো ও বাড়ি আমরা একটু পরই চলে যাব।

রিমন আর কথা বাড়ায়নি এখানেও এসে উপস্থিত হয়নি। বৃষ্টির কান্না পাচ্ছে এখন। এতগুলো মানুষের সামনে কান্না করলে কি ভাল দেখাবে! সেও বসা থেকে উঠে গেল। সাখাওয়াত আর বড় দাদু পরিস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত খাওয়া শেষ করে বিদায় নিলেন।
__________

ঘরে ঢুকে ফোনের শব্দ পেলো অর্ণব। হাতে নিতেই দেখলো নুপুরের কল। ধরবে না ধরবে না করেও রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো রিনরিনে স্বর।

-নিজেই বলেছেন বাড়ি পৌঁছে জানিও এখন নিজেই মেসেজ সিন করছিলেন না।

– রাতে কল দিচ্ছি।

এতটুকু বলেই কল কেটে দিলো অর্ণব। হতভম্ব হয়ে গেল নুপুর এভাবে কেন কল কাটলো? অর্ণব কাউকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। রাতে যখন বাড়ি ফিরলো তখন পুরো বাড়ি নীরব, নিস্তব্ধ। বসার ঘরের আলো নেভানো শুধু দাদীর ঘরে তখনও আলো জ্বলছিল। অর্ণব আন্দাজ করলো কোন কারণে দাদী জেগে আছেন এখনো। রাত বাজে বারোটা এরই মাঝে নুপুরের একটা মেসেজ এসেছে, অর্নিতার একটি কল। নুপুরের মেসেজটা ইচ্ছে করেই দেখলো না। অর্নিতার কল রিসিভ করতেই সে জানালো রিদওয়ান এসেছে দেশে। অর্ণব কথা বাড়ায়নি, কাল ওর সাথে বাড়ি আয় বলেই কথা শেষ করলো। এবার ধীর পায়ে এগিয়ে গেল দাদীর ঘরের দরজায়।

খাটের পাশেই খালি জায়গায় ম্যাট্রেস বিছিয়ে, মশারি খাটিয়ে রোজিনা খালা ঘুমায়। ঘরের বাতি জ্বালানো বলে তিনি আজ মশারির ওপর পাতলা চাদর ছড়িয়ে দেওয়া। এ ঘরে থাকা দুজন মহিলাই তার ভীষণ শ্রদ্ধার। ঘরে ঢুকতে বরাবরই সে অনুমতি নেয় আজও অর্ণব বাইরে থেকে দু বার নক করে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। দাদী বুঝলো অর্ণব এসেছে তাই একবার রোজিনার বিছানায় তাকালেন।।

-ভেতরে আয়।

অর্ণব ভেতরে এসে দাদীর সামনে দাঁড়ালো।

-বয়

অর্ণব বসলো দাদীর পায়ের কাছে।

-কি কইবি?

-তুমি বলো।

– কষ্ট পাবি।

-তবুও বলো।

-বৃষ্টিরে বিয়া কর।

-আচ্ছা।

আর কোন কথা না বলে অর্ণব বেরিয়ে গেল নিঃশব্দে। রোজিনা খালার ঘুম আগেই ভেঙে গেছে এবার তিনি শোয়া থেকেও উঠে বসলেন। কাজের লোক হয়ে মনিবের কোন কাজে নাক গলানো উচিত নয় জেনেও সে মুখ খুলল।

– সারাদিন তো রাগ কইরা বইসা ছিলেন খালাম্মা এখন ক্যান এমন কইলেন?

-পোলার সুখ আর মাইয়ার সুখ একরকম না। অর্নিতার ঘর বদল হইবো কিন্তু অর্ণব নিজের বাড়ি, নিজের ঘরেই থাকব। তারে দশ কথা কইবার কেউ থাকবো না অথচ নাতিনডা যখন ওই বাড়ি যাইব সকাল বিকাল খোঁটা হুনব শুধু বৃষ্টিরে এই বাড়িতে না আনার জন্য। অর্ণব বিয়া না করলেও বৃষ্টির ভালা পাত্রের অভাব হইব না কিন্তু সবসময় অর্নির থাকব কষ্ট। বিয়া হইছে বছর গড়াইতাছে এহনও ওরা বউ ঘরে নেয় নাই আজকা বাশার কথায় কথায় বুঝাইয়া দিল তার মাইয়া এই ঘরে আইব আমাগো মাইয়া ওই ঘরে যাইব। এইবার বল তোর কি মনে হয় এই কথাতে।

বৃদ্ধার কথা মনোযোগে শুনলো রোজিনা খালা সেই সাথে শুনলো দরজার বাইরে থাকা অর্ণবও। সে ঘর থেকে বেরুয়েও আবার ফিরেছিল দাদীকে জানাতে রিদওয়ান এসেছে দেশে। বলা হলো না আর ফিরে গেল নতুন ভাবনা মাথায় নিয়ে।
__________________

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২৪(খ)

কাল আর বড় দাদার সাথে দেখা করতে যায়নি অর্ণব। রাতে বাড়ি ফিরে দাদীর সাথে কথা শেষ করেই শুয়েছিল ঘুমের আশায়। শেষরাত অবধি ঘুম আর ধরা দেয়নি তাকে। ভোরের দিকে দু চোখে ঘুম নামতেই অতি পুরনো এক স্মৃতি দুঃস্বপ্ন হয়ে নেমে এলো চোখের দোরগোড়ায়। তখন তাদের সংসার উপর থেকে সাজানো, গোছানো চকচকে। বাবা নেশা করলেও তা বাড়ির বাইরে নির্দিষ্ট এক ডেরায়। মা বাড়িতে সংসার দেখেন, দিনে দু দিনে ঘুরতে যান, শপিং করেন আর অর্ণবের পড়াশোনায়ও খেয়াল রাখেন অর্নিতাটা বোধহয় তখনো বসতে শিখেনি। মায়ের সাথেই একদিন ঘুরতে বেরিয়েছে সে। ছুটির দিন ছিল বলে এক বিকেল বাইরে কাটিয়ে সন্ধ্যের দিকে তারা পৌঁছুলো মায়ের বান্ধবী আসমার বাড়িতে। বান্ধবীকে না জানিয়েই মা গিয়েছিল ভেবেছিল খুশিই হবে বান্ধবী তাঁকে দেখে। যাওয়ার পর ঘটনা ঘটেছে ভিন্নরকম। মায়ের বান্ধবীর কপাল ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে , হাত ভেঙেছে বাড়িতে তাদের ভীষণ ঝামেলা। মা সেদিন বাচ্চা অর্নি আর তাকে নিয়ে তড়িঘড়ি জায়গা ত্যাগ করলেও বছর খানেক পর খবর পেল সেই বান্ধবীটি আত্মহত্যা করেছে। অর্ণবের সবটা ঠিকঠাক মনে না পড়লেও কিছু কিছু মনে আছে মা বলছিল বাবাকে সেই আত্মহত্যার ঘটনা। ঘটনা ঠিক এমন ছিল, আসমা আন্টির একটি বোন আছে যাকে বিয়ে করতে চাইতো আন্টির দেবর। আন্টির বোন কিছুতেই রাজী হচ্ছিলো না বলে শ্বশুরবাড়ির লোকে তাকে অত্যাচার করতে লাগলো। নির্মমভাবে আঘাত করতো সবাই মিলে এমনকি তাঁর স্বামীও শামিল হতো। ধীরে ধীরে সেই অত্যাচার আর সহ্য করতে না পেরেই তিনি ফাঁস নিলেন৷ অর্ণব ছটফটিয়ে বিছানা ছাড়লো। এতবাজে স্বপ্ন কেন দেখলো! মোচড় দিলো বুকের ভেতর এটা কি তবে তার জীবনের সাথে সংযুক্ত কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেখলো? ভোরের আলোয় ঘরটা ঝাপসা আলোকিত। হঠাৎ মনে পড়লো লোকে বলে ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। ভয় আরও গেঁড়ে বসলো অন্তরে। খালুজান কি ইচ্ছে করেই কাল অর্নি রিদওয়ানের রিসেপশনের কথা তুললেন। তাকে কি কোন ভাবে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য ছিল সে কথা! নিজেই নিজের ভাবনায় বোকা হয়ে গেল অর্ণব অথচ বুঝতেই পারলো না তার এই স্বপ্ন আদতে তার কাল রাতের অতি ভাবনার ফল। না তার মায়ের জীবনে কোন বান্ধবীর সাথে এমন হয়েছে আর হয়ে থাকলেও সে কথা তার জানা নেই। যা দেখলো আর যা ভাবছে এখন সবটাই অলীক কল্পনা। ভয়ে ভীত মনের সাজানো রূপকথার ভয়ংকর গল্প বৈ কিছুই নয়। তবুও সারা সকাল তাকে অশনি অস্থিরতা ঘিরে রইলো। ধারালো, তীক্ষ্ণ চোয়ালে আতংকের লেগে রইলো সারাটাক্ষণ এরই মাঝে মনে হলো দাদার সাথে দেখা করা জরুরি। কোনমতে নাশতার পাট চুকিয়ে সে বেরিয়ে গেল ও বাড়িতে। ইচ্ছে করেই সে গেল দশটার পর যেন দাদার সাথে আলাপের সময়টাতে সাখাওয়াত ভাই কিংবা সোহরাব ভাই না থাকেন। বলতে নেই, বংশের সবচেয়ে বড় এই ভাই দুটোকে অর্ণব ভেতরে ভেতরে অসম্ভব অপছন্দ করে। তারা অর্থবিত্তের বলয় আবৃত মুখোশধারী গিরগিটি। তাদের দু ভাইয়ের বরাবরই ছোট দাদার সম্পত্তি, অর্ণবের দাদার সম্পত্তিতে কুনজর বহুদিনের। অথচ ছোট দাদার প্রয়োজনে কোনদিনও তারা পাশে দাঁড়ায়নি আর না তার বাবার মৃত্যুর পর তাদের পাশে। ইদানীং কোন এক কারণে যেচে পড়ে তারা বেশ খোঁজই রাখছে অর্ণবের তা বড়ই সন্দেহজনক ব্যাপার। ও বাড়ি যাওয়ার আগে অর্ণব ছোট দাদীকে জানিয়ে গেল। দাদীও যেন শঙ্কায় ছিলেন বড় দাদার এই অর্ণবের সাথে আলোচনার বিষয় নিয়ে৷ কি নিয়ে এত তলব তাদের! ভাসুরকে তিনি খুব অপছন্দ না করলেও ভাসুরের নাতিদের মতলব নিয়ে অর্ণবের মত তিনিও সন্দিহান তবুও বারণ করা যায় না বলেই অর্ণবকে পাঠালেন৷ অর্ণবের প্রস্থানের ঠিক পরপরই রিদওয়ান এসে হাজির হলো বাড়িতে। কথা ছিল অর্নিতাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে তা আর হলো না। গুরুত্বপূর্ণ ক্লাশের জন্য সে ঢাকায় আসতে পারেনি তাই রিদওয়ানই চলে এসেছে দুদিনের জন্য। বাড়িতে দুটো দিন থেকে আবার ফিরবে চট্টগ্রামে। নিজের পরিচিত তেমন না থাকলেও সাহায্যটা বাবার থেকেই নিতে পারবে বলে ভেবে নিয়েছে। ব্যবসায়ের সূত্র ধরে সেখানে বাবার পরিচিত অনেক মানুষজন আছেন। খোঁজ নিলে মাস খানেকের জন্য একটা ফ্ল্যাট, বাড়ি অথবা একটা ঘর যাহোক ব্যবস্থা করে নেবে। এতদিন পর দেশে এসে বউ থাকতেও ব্যাচেলর থাকার মানেই হয় না তাই এবার উপোষ ভাঙার ব্যবস্থাই করবে সে। ভদ্র সমাজে এ কথা মুখে না বলতে পারলেও সাধু তো সে নয় তাই যেন নিজে নিজেই সব পরিকল্পনা সাজিয়ে এসেছে। অর্নিতাকে সে কথা আগেই বলে রেখেছিল। এ নিয়ে তো মেয়েটা তাকে দিনরাত নতুন নামে ডাকে৷ ‘বেহায়া বর’ নামটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে রিদওয়ানের।

রিদওয়ানকে দেখেই দাদী ভীষণ খুশি হয়েছেন৷ ভোর থেকেই তিনি রোজিনা খালাকে দিয়ে নাশতায় কত কি রেখেছেন সাথে সুজির হালুয়াটা নিজেই রান্নাঘরে বসে থেকে তৈরি করিয়েছেন। তা দেখেই অর্ণব দাদীকে চটিয়েছে, ‘বুড়ির ঢং দেখলে আর বাঁচি না। অর্নিতার না যেন নিজের বর আসবে তাই কত কি করছে কই আমার জন্য তো একবেলা দাঁড়িয়ে থেকে ভাতটাও খাওয়াও না।’

-তোর জন্য তোর বউ থাকবে যা এখন সামনে থেকে।

দাদীও তার ফাজলামোতে তাল মিলিয়ে যেন ভারী সকালটাকে হালকা করেছিল কিছুটা। এখন রিদওয়ানকে দেখে আরেকটু শান্ত হলো মন। সে বড় দাদার বাড়িতে চলে গেল রিদওয়ানও দাদীর সাথে বসে টুকটাক গল্প করছে। তাদের গল্পের মূল কেন্দ্রই রিদওয়ান কি করে একটা মাস বউয়ের সাথে কাটাবে। কথায় কথায় দাদী বললেন সেদিনের কথা বাশার শেখ অর্ণবকে মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। দাদী ভেবেছিলেন রিদওয়ান সব জানে। বৃষ্টির জন্য অর্ণবকে প্রস্তাব দেওয়া কথাটা শুনেই অবাক হয়েছে সে অবাক দাদীও হয়েছেন। বিয়ের মত একটা সিদ্ধান্ত হুট করে কেন নিলো বাশার শেখ তবে কি সত্যিই এখানে চালবাজির কোন ঘটনা আছে? অর্নিতাকে যে মানুষ একটা বছরে একটি দিনের জন্যও ছেলের বউ বলে বাড়িতে নিলো না সে এখন ধুমধামে ঘরে তুলবে এটা শুধুই তবে নিজের মেয়ের জন্য তা বুঝতে আর একটুও বাকি নেই। রিদওয়ানও যেন কিছু আঁচ করতে পারলো। বৃষ্টি তার একটিমাত্র আদরের বোন সেই বোনকে সে অতি আহ্লাদে না ভাসালেও আদরে কখনোই কমতি রাখেনি আর অর্ণবকেও সে বন্ধুর মত জানে। নুপুর মেয়েটাও বড্ড ভালো, অর্ণবও যে তাকে পছন্দ করে এ কথা তো অজানা নয়। বড় একটা ব্লান্ডার হতে চলছে টের পেতেই অস্থির হলো রিদওয়ান। এখানে আর বসে থাকা সম্ভব নয় ভেবেই দাদীকে নাশতার কথা বলল। বৃদ্ধা যে তার জন্য ভালোবেসে আয়োজন করেছে তা ফেলে উপেক্ষা করার সাধ্য রিদওয়ানের নেই। দাদীকে পাশে বসিয়ে দ্রুতই নাশতা শেষ করে বিদায় নিলো সে।

___________
বড় দাদা অর্থের দাপটে বরাবরই বংশে সবার উঁচুতে ছিলপন সম্মানেও কমতি নেই। বিশাল অর্থ ব্যয়ে বহু বছর আগে নিজেই একটি দালান গড়েছিলেন যা অর্ণবের থেকে দ্বিগুণ খরচে হয়েছিল। সেই বাড়িটি প্রায় চল্লিশ বছর পর আবার নতুন করে দাদার নাতিরা সংস্করণ করেছেন। আভিজাত্য আগেও যেমন ছিলো এখনও তেমনই৷ এ বাড়ির নতুন রূপ তৈরি হওয়ার পর অর্ণব একবারো আসেনি এখানে। আজ উপস্থিত হয়ে কিছুটা বিভ্রান্ত হলো বড় দাদাকে খুঁজে পেতে। বাড়ির সদর দরজায় বেল বাজাতেই নতুন একজন পরিচারিকা এসে দরজা খুললে পরিচয় চাইলো। এ বাড়িতে কখনো পরিচয় বলে তবেই প্রবেশাধিকার মিলবে এটাই বেশি বিব্রত করলো তাকে। তবুও ছোট্ট করে জানালো আমি অর্ণব বড় দাদুর সাথে দেখা করতে এসেছি। গৃহপরিচারিকা মেয়েটি অল্পবয়স্কা বুদ্ধিশুদ্ধিতেও বোধহয় একটু খাটো। সে শুধুই নামের পরিচয়ে ঢুকতে দিলো না অর্ণবকে। আবারও প্রশ্ন জুড়লো, সে কোথা থেকে এসেছে এবং কি কাজে তা যেন ছোট করে জানায় তাতে সে ভেতরে গিয়ে খবরটা দিয়ে তবেই অনুমতি পেলে ভেতরে ঢুকতে দেবে। প্রথমে যতটুকু বিব্রতকর লাগছিল এবার পরিস্থিতি উল্টে গেল৷ অর্ণবের দুশ্চিন্তা গ্রস্ত মাথায় রাগ ধরে গেল প্রচণ্ডরকম। ভদ্রতা বজায় রেখে দাঁড়িয়ে থাকার ধৈর্য্যটুকু সে নিমেষেই হারিয়ে এবার ধমকে উঠলো, এ্যাই সরতো সামনে থেকে কখন থেকে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। আগুন্তকের আচমকা জোর ধমক মেয়েটিকে ভড়কে দিলো ভয়ও পেলো। অর্ণব সেদিকে তোয়াক্কা করলো না পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকলো। প্রাসাদ রূপ বাড়িটা ফটক পেরিয়েই চারকোণা বসার ঘর। চারপাশে তাকিয়ে কাউকে চোখে পড়লো না তার। আবারও তাই ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েটির দিকে তাকালো, দাদুর ঘর কোনটা।

ভয়ে মেয়েটির যারপরনাই ভীত অবস্থা কোনমতে স্বর তুলল, বাম দিকের তিন নাম্বার ঘর।

আর কিছু শোনার ধৈর্য্য নেই সে বসার ঘর পেরিয়ে বা দিকের সফেদ রঙা দেয়াল দেখলো। পাশাপাশি লম্বাটে চারটে ঘরের তিন নম্বরটাতে টোকা দিলো বার কয়েক। সাড়া না পেয়ে এবার জোরে ডাকলো, বড়দাদা ঘরে আছেন?

কয়েকবার ডাকার পর দরজা খুলে গেল। ভেজা মুখ, তোয়ালে হাতে দাদা দাঁড়িয়ে আছেন।

– ঘুমাইছি নামাজের পর বাথরুমে তাই মুখ হাত ধুইতেছিলাম তাই দরজা খুলতে দেরি। রাতে অপেক্ষা করলাম তোর।

সালাম দিয়ে অর্ণব জনালো রাতে ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেনি। দাদাও বললেন সমস্যা নাই কিন্তু এখন তো সাখাওয়াত বাড়ি নাই।

অর্ণব বুঝতে পারলো প্রয়োজনটা তবে সাখাওয়াত ভাইয়ের। নিশ্চয়ই এমন কোন কথা যার জন্য দাদার মতামত আবশ্যক।

-আচ্ছা দাদা তাহলে রাতে আবার আসি।

-আচ্ছা। এখন বোস নাশতা খেয়ে যাবি।

-না দাদা রিদওয়ান আসছে ওর সাথে নাশতা করতে হবে দাদী অপেক্ষা করছে।

-ওহ তাহলে নাত জামাইরে বল এখানে আসতে। দাওয়াত ও করা দরকাই ওরে জামাই মানুষ।

-পরে একদিন হবে আমি এখন যাই।

বিদায় নিয়ে অর্ণব চলে যেতেই কাজের মেয়েটি বাড়ির ছোট মালকিন সোহরাবের বউকে জানালো অর্ণবের ধমকের কথা। বউটি হেসে হেসে বলল, ও বাড়িরই ছেলে তাই রেগে গেছে। মাথাটা তার একটু গরম স্বভাবের পরের বার এলে প্রশ্ন করিস না। মেয়েটি সে কথা শুনে বিড়বিড় করতে লাগলল, তওবা কাটছি এই বেডারে দেখলে আমি দরজাই খুলতাম না।

_________

রিদওয়ান বাড়ি চলে গেছে শুনে অর্ণবও আর দেরি করেনি৷ নাশতা শেষ করে সেও গেল অফিসে। বহুদিন হয় সে ব্যবসা বানিজ্যে ভীষণ অনিয়ম৷ গত মাসের প্রোডাক্ট ডেলিভারিতে ঝামেলা হয়েছে বায়ার হাত থেকে ছুটে যাওয়ার অবস্থা প্রায়৷ এভাবে চলতে থাকলে রুজি পুঁজি সব হারাবে তা নিশ্চিত। অফিসে ফিরে কাজকর্মে প্রায় ডুবতেই বসেছিল হঠাৎ সেই ডুবকি থেকে তুলে আনলো নুপুরের ফোনকল। হাতের ঘড়িটাতে চোখ বুলিয়ে দেখলো দুইটা বেজে বাইশ মিনিট। নুপুর কি ক্লাশ শেষে কল দিলো তাকে! আকস্মিক টের পেল বুকটা জ্বলছে। না গ্যাস্ট্রিক না হৃদরোগে এই জ্বলন হৃদয়ে গড়া এক নিরদছাওয়া ঘর ভাঙার। হ্যা় ঘরই তো ভেঙেছে তার কালকের দুপুরে হওয়া বাক্যলাপে। আজ আরও একবার তার কষ্ট হচ্ছে কেন সে এতিম? বাবার কাঁধ, মায়ের আদর কিছুই কেন নেই তার কাছে? এই রুদ্ধশ্বাসে আটকে পড়া ময়দানে তাকে কে বাঁচাবে। কে বলবে তার সুখের কথা? কে জানবে তার অন্তরে বিঁধেছে ওই শ্যামাঙ্গিনী রুমঝুম মেয়েটি! কাকে বোঝাবে চাই না তার বদ্ধদশার জীবন তার যে জীবনে স্বস্তির নামে হঠাৎ আসা ওই এক টুকরো চঞ্চল হাওয়াকে ভীষণ দরকার।

কলটা আজও কেটে গেল অবহেলায়। ওপাশের মানুষটির বোধহয় ক্লান্তি নেই তাকে স্মরণ করতে তাইতো কাল রাতে তিনটের পর লাগাতার মেসেজ এসেছে প্রতিটা মেসেজে ভেসে এসেছে অদৃশ্য চিন্তার সুর৷ কালকে কি সে ভুল করেছে ওই একটি বাক্য বলে। ‘আমি ভাবছি কথা বলব তোমার আব্বুর সাথে’ কেন বলেছিলাম কাল! আফসোস হলো দুঃখও কি হচ্ছে না? ‘বড় ভুল হয়ে গেছে নুপুর ভালোবাসা আমার জন্য তো জীবন ভালোবাসার নয়।’

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-২৩

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২৩

চোখের কোণের চিকন জলস্রোত দূর থেকেও স্পষ্ট ধরা পড়লো রিমনের চোখে। একে একে দুই, দুইয়ে দুইয়ে চার মিলেই গেল আজ তার কাছে। অর্নিতার এই বান্ধবীটি তবে অর্ণবের মনের মানুষ নাকি তার দেখায় ভুল! ভুল তো হওয়ার কথা না। অর্ণবের বাড়িতে মেয়েটির উপস্থিতি বান্ধবীর বাড়ি হিসেবেই অত বেশি পাওয়া যেত এ যুক্তি অগ্রহণযোগ্য লাগে রিমনের। কোন উপলক্ষ ছাড়াই প্রায় অনেক অনেকবার নুপুর সে বাড়িতে আসতো শুধু মাত্র অর্ণবের জন্যই তবে৷ করিডোরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে রিমন। এবার তবে বয়সে পিচ্চি আরও এক ভাবীর ব্যবস্থা হয়ে গেল। অর্নি কফির কাপ হাতে সেখানে এসে রিমনকে দেখে অবাক হলো।

-হাসছো কেন ভাইয়া কখন এলে তুমি?

-এ্যা এ্যাই ওদিকে যা ওদিকে যা জলদি… বলে রিমন নিজেই অর্নিকে টেনে নিয়ে কেবিনের সামনে থেকে দূরে সরিয়ে নিলো।

-কি হয়েছে!

-ভাই ভাবীর হৃদয়ঘটিত মুহূর্ত চলছে আমরা আর না যাই সেদিকে৷

-বুঝলাম না।

-বুঝতে হবে না তোর কফি কার জন্য?

-নুপুর…

– সে অন্য কিছু খাচ্ছে এটা আমাকে দে।

রিমন ভাইয়া মজার মানুষ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে তার একটি কথাও বোধগম্য হচ্ছে না অর্নিতার। সল্পভাষী মেয়ে অর্নি আর কৌতূহল প্রকাশ না করে একপাশে দাঁড়িয়ে কাপে চুমুক দিতে লাগল। রিমনও গরম গরম কফিতে চুমুক দিয়ে টের পেল ক্লান্তিতে আরাম মিলছে। কাজের চাপ বেশি থাকায় আজ নয়টা পর্যন্ত অফিস ঘরেই ছিল। এখন বেরিয়ে সোজা হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয়েছে অর্নিকে নিয়ে যেতে তারপর আবার তাকে ফিরতে হতো রাতটা কাটাতে। ডাক্তার জানিয়েছে অন্তত দশটা দিন তাকে রাখা দরকার হাসপাতালে শুধুমাত্র পায়ের জন্যই। কাজের মানুষ বাড়ি ফিরে অসাবধানতায় নড়াচড়া সমস্যা দ্রুত ঠিক হওয়ার পরিবর্তে আরও খারাপ হতে পারে ভেবেই বাশার শেখ নিজেই বলেছেন কিছুদিন এখানেই থাক৷

__________

বাড়ি ফিরে রাতের রান্না শেষ করে রায়না বেগম সবেই বিছানায় গা এলিয়েছেন একটুখানি বিশ্রামের আশায়। অতিরিক্ত টেনশনে ব্লাড প্রেশার অনিয়ন্ত্রিত আর প্রচণ্ড ঘাড়ের ব্যথায় এখন চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন৷ অথচ কাউকে ডেকে বলতে ইচ্ছুক করছে না একটুখানি যত্নের জন্য৷ চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে তবুও চোখ বুঁজে দু দন্ড ঘুমিয়ে নেওয়ার জো নেই। মাথায় ঘুরছে অর্নিতাটা একা হাসপাতালে কিছু প্রয়োজন হলে কিভাবে কি করবে! বাশার শেখও আজ অফিস থেকে দেরি করে ফিরেছেন৷ এখন ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকেছিলেন। পোশাক বদলে, মুখ- হাত ধুয়ে বের হতেই স্ত্রীকে বিছানায় দেখে কপাল কুঁচকালেন।বরাবরই দেখেছেন এ সময়টা রান্না রান্নাঘরে থাকেন উনি ফিরলে এক কাপ চা নিয়ে দৌঁড়ে আসেন। আজ ব্যতিক্রম দেখে বুঝলেন পরিস্থিতির চাপ স্ত্রীকে অসুস্থ করে দিচ্ছে। ঘাড়ের ওপর হাত দেখে আন্দাজ করলেন প্রেশার নিয়ন্ত্রণে নেই হয়তোবা। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে মেয়ের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। বৃষ্টি পড়ার টেবিলে মাথা ঝুকিয়ে বসা। দরজার বাইরে থেকে এই দৃশ্য দেখে ভাবলেন মেয়েটা বোধহয় পড়তে বসেছে ঠিক তখনই মনে হলো মেয়েটা কেঁপে কেঁপে উঠছে৷ বৃষ্টি কি কাঁদছে! বাবার মন মানলো না ফিরে যেতে তাই ঘরে ঢুকে মেয়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। এইতো ফোপাঁনোর শব্দ৷

-বৃষ্টি! আমার মা কি হয়েছে কাঁদছো কেন মা?

বাবার গলার স্বর নিজের খুব কাছে শুনে কান্নার দমক যেন বেড়ে গেল বৃষ্টির। বাবার আদুরী কন্যা দুনিয়ার সকল দুঃসহ যন্ত্রণা যে মেয়েটি প্রথমে বাবাকেই জানায় সে আর এই মুহূর্তে লুকাতে পারলো না নিজের অনুভূতি। পেছন ফিরে বাবার কোমর জড়িয়ে উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগল। মেয়ের এমন কান্নায় হকচকিয়ে গেলেন বাশার শেখ। বুকটাও মুচড়ে উঠলো কলিজার টুকরো কন্যাটির কান্নার শব্দে। দু হাতে আগলে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে জানতে চাইলেন কি হয়েছে কেন কাঁদছে? বৃষ্টিও সব ভুলে কাঁদতে কাঁদতেই বলে চলল, অর্ণব ভাইয়া অসুস্থ তার কষ্ট লাগছে। কত ব্যথা পেয়েছে মানুষটা তার সহ্য হচ্ছে না। বাশার শেখ আগে থেকেই তো জানতেন মেয়ের মনের অভিপ্রায় আজ তা আরও স্পষ্ট হলো। এমনিতেও অনেক কিছু তিনি আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন মুশকিলে ফেলল তো গর্ধব রিদওয়ানটা তাই এতোদিন এ বিষয়ে কিছু ভাবতে পারছিলেন না। আজ আবার মাথায় ঢুকলো পুরনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা। মেয়ের মাতায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতলেন এই বলে, ‘ভয় পেয়ো না মা অর্ণব জলদিই সুস্থ হয়ে উঠবে। আমি নিজে ডাক্তারের সাথে আলাপ করেছিলাম তো। এ তেমন আঘাত নয় একটু বেডরেস্ট আর প্রোপার ট্রিটমেন্টে সে একদম ভাল হয়ে যাবে৷ আর তারপরই আমি তার সাথে কথা বলে দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলব। কাঁদে না মা আমার তোমার আম্মুও তো অসুস্থ হয়ে পড়ছে তাকে সান্ত্বনা দিতে হবে না!’

বাবার আহ্লাদের স্বরে বোধকরি হুঁশ ফিরলো বৃষ্টির। আবেগে কেঁদেকেটে কি বলছিলো সে এতক্ষণ। আব্বুই বা কি বলল দিনক্ষণ মানে! এবার কান্না আপনাআপনিই থেমে গেল তার৷ লজ্জা লাগছে খুব এখন তাই চোখ, মুখ মুছে সে বাবার জন্য চা বানাবে বলে চলে গেল রান্নাঘরে। বাশার শেখ ফিরে গেলেন নিজের ঘরে এখন দেখা যাক রায়নার জন্য কি করা যায়।
__________

প্রতি ঘন্টায় রিদওয়ানের ফোনকল চলছে আজ দু দিন ধরেই। দেশে না থাকলেও যেন আপন মানুষগুলোর খুব কাছে থাকার চেষ্টা। বয়সে দু বছরের ছোট অর্ণব তার জন্য বরাবরই বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। খালাতো ভাই কিংবা সুমুন্দি সম্পর্কের আগে অর্ণব তার বন্ধু এটাই বড় সত্যি তার মনে৷ তাইতো অর্ণবের দূর্ঘটনার খবর শুনতেই সে ছটফট করছে। লিসবনে এখন সবে দুপুর ফুরিয়েছে রেস্টুরেন্টে এখন মোটামুটি ভীড়। আজ সেখানে ছুটির দিন বলেই এক্সট্রা ইনকাম ভালো হচ্ছে তার। একটু আগেই আব্বু নিজে ফোন করেছেন তাকে। তার বিদেশ বিভূঁইয়ে এতগুলো মাসে এ পর্যন্ত মোটে চারবার কল করেছেন তাও কিনা নিজের প্রয়োজনে। গত তিনবার অফিস সংক্রান্ত ত্রুটির জন্য যা রিদওয়ানের দ্বারাই সৃষ্ট আর আজ করেছেন বৃষ্টির বিয়ের কথা বলতে। সেসময় রিদওয়ান খুব ব্যস্ত থাকায় আব্বুকে বলেছিল, একটুখানি সময় চাই তার। হাতের কাজটা শেষ হতেই কল করছি৷ বাশার শেখ জানতে চাইলেন ছেলে তার কি করছে এই মুহূর্তে৷ রিদওয়ানও বোধহয় হাসিমুখে বলল, পিজ্জা ওভেনে আছে হয়ে এসেছে সেটা নামিয়ে একটা অর্ডার সার্ভ করতে হবে। বেশি না আর বিশটা মিনিট লাগবে তার কাজগুলোতে৷ তা শুনেই যেন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন তার বাবা। যার কোটি কোটি টাকার ব্যবসা, যার উত্তরাধিকারীরা কম করে হলেও কোটির সাথে শ’ যুক্ত করা সম্পত্তির অংশীদার সেই অংশীদার নাকি লোকের সম্মুখে মাথা ঝুকিয়ে কিছু ইউরোর অর্ডার নেয়, চাকরের মত মাথা ঠুকে খাবার সার্ভ করে! ভেতরে ভেতরে বোধহয় রাগও উথলে উঠছিল সমুদ্রের ফেনিল ঢেউয়ের মত। তিনি কল কেটে দিলেন তৎক্ষনাৎ। রিদওয়ান সেদিকে আর পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজে মন দিল। ফ্রী হয়ে কল দিয়ে কথা বলে নেবে। অর্থ বিত্ত জরুরি কিন্তু তা নিয়ে বড়াই কিসের! কথায় আছে যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। আজ বেঁচে আছে বলেই অর্থ চাই কাল নিঃশ্বাস ফরিয়ে গেলে এই অর্থ, বৈভব কোথায় থাকবে তার কেন বোঝে না অহংকারে ডুবে থাকা মানুষগুলো! হাতের কাজ ফুরিয়ে যেতেই রিদওয়ান ফোন হাতে বেরিয়ে এলো কর্মস্থল ছেড়ে। দেশে এখনো রাত ফুরোয়নি এত রাতে বাবাকে কল দেয়াটা ঠিক হবে না ভেবে এবার কল দিলো অর্নির নম্বরে। একটু আগেও মেসেজ এসেছে অর্নির নম্বর থেকে তারমানে আজও রাতটা ঘুমাবে না পাগল মেয়েটা। হাঁটতে হাঁটতে কল ধরলো অর্নির নম্বরে। ওপাশে বোধহয় এই ফোন কলটার অপেক্ষাই চলছিলো তাইতো সেকেন্ডেই রিসিভ হলো।

____________________

ডান হাতের আঙ্গুল গুলো আর মুখটা ফুলে ফেঁপে যেন ফেটে যেতে চাইছে। আলতো স্পর্শে নুপুর প্রতিটা আঙ্গুলই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে অর্ণবের। কেবিন জুড়ে আবছা আলো সেই আলোতেই নিভু নিভু চোখে অর্ণব দেখছে নুপুরকে। রাত শেষ হয়ে এলো প্রায় তবুও নুপুরের চোখে ঘুমের একটুও আভাস নেই যেন এটাই স্বাভাবিক। নুপুর যখন কপালে চুমু দিলো তখনই ঘুম ভেঙেছিল অর্ণবের কিন্তু চোখের পাতা খোলা মুশকিল তাই চেয়ে দেখেনি সেই মুহূর্তের মোহনীয় সৌন্দর্যটুকু। রিমন, অর্নিতা একসাথে কেবিনে আসার পর নুপুর সরে গিয়েছিল কিছুটা দূরে তা দেখে রিমনের খুব হাসি পেলো। সবকিছু বুঝে গেছে এমনটা ভাব করেই সে চাইছিলো একটু মজা করা যাক অর্ণব ভাইয়ের এই বাচ্চা প্রেয়সীর সাথে। তা আর সুযোগে মিলল না। আব্বু কল দিয়ে তাড়া দিলেন বাড়িতে ফিরতে হতে পারে আম্মুকে নিয়ে আবার আসতে হবে হসপিটালেই। পরিবারের মানুষগুলোর অসুস্থতায় ক্লান্তির অযুহাত চলে না তার কাছে একদমই। এদিক থেকে সত্যিই সে রিদওয়ানের চেয়ে যোগ্য সন্তান বাবা মায়ের। রিমন চলে যেতেই অর্নিতা আর নুপুর কেবিনের ভেতরেই বসেছিল চুপচাপ। মধ্যরাত অবধি জোর করে অর্নিকে নিজের কোলে চেপে রেখে গুমাতে জোর করেছে নুপুর। কাল থেকে একেবারে নিদ্রাহীন মেয়েটা সেও যে এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে৷ কিন্তু লাভ কিছুই হয়নি৷ ক্ষণে ক্ষণে ভাইয়ের দিকে তাকিয়েই ফুপিয়ে উঠেছে কান্নায়। একটু আগে আর ভালো লাগলো না নুপুরের এই কান্নাকাটি তাই বলে বসলো, রিদওয়ান ভাইয়ার মেসেজগুলোর রিপ্লাই দিসনি উনি নিশ্চয়ই চিন্তিত হচ্ছেন। কাজ হলো বাক্যটায়; চোখ মুখ মুছে রিদওয়ানকে রিপ্লাই করলো আর এখন ফিরতি কল পেয়ে করিডোরে গেল কথা বলতে। নুপুর একাই এখন বেডের কাছে বসে অর্ণবের আঙ্গুল ছুঁয়ে দিচ্ছিলো। আবারও ঘুম ছুটলে এবার আর নুপুরকে সরতে দেয়নি। বা হাতে বড় কষ্টেই হাতটা ধরেছে সে নুপুরের। ভারী স্বরটা ব্যথায় আর্তনাদে আগের চেয়েও গম্ভীর আর ভাঙা ভাঙা হয়েছে। সেই ভাঙা ভাঙা স্বরেই অর্ণব বলতে লাগল, পাগলামি করে ফেললে কেন?

-হু!

-বোঝোনি?

মাথা নেড়ে ‘না’ জানায় নুপুর। সত্যিই সে বোঝেনি তার কথা।

– বান্ধবীর ভাইয়ের জন্য রাত বিরাতে এসে উপস্থিত হয়েছো!

অর্ণবের কথাটা কাঁটার মত খুঁচিয়ে দিলো নুপুরকে। সে তৎক্ষনাৎ হাত ছেড়ে দিলো অর্ণবের। সেদিকে খেয়াল করে অর্ণব বেলুনের মত ফোলা ঠোঁট দুটো অল্প টেনে হাসতে চেষ্টা করলো।

-হাত ধরলে ছাড়তে নেই।

নুপুর এবার বসা থেকেই উঠে পড়লো তা দেখে অর্ণব হাত বাড়ালো নুপুরের হাতের দিকে। কেবিনের বাতি বন্ধ বেড সাইড মেডিসিনের ড্রয়ারের ওপরে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে নুপুরের ফোনটা রাখা। সেই সল্প, সাদা আলোটাতেই অর্ণব দেখতে পেল মেয়েটির চোখের কার্নিশ চিকচিক করছে। এবার আরেকটু এগিয়ে হাত বাড়িয়েই ধরলো হাত। নুপুর সরিয়ে নিলো আর নিজের হাতটাকে। নিঃসংকোচ, দ্বিধাহীন হয়ে অনুভব করলো অর্ণবের স্পর্শ।
-একটা সময় জোর করেই কথা বলতে চাইতে। আজ শুনতে কান পেতে রেখেছি বলেই কি চুপচাপ হয়ে আছো?

-অসুস্থ মানুষের এত কি কথা চুপ করে ঘুমান।

-যেন আরও একবার সুযোগ নিতে পারো!

-কি বলছেন এসব?

-ওই যে যা করেছিলে… আমার কপাল তোমার ঠোঁট…

কথা শেষ করার আগেই নুপুর ঠোঁট চেপে ধরলো অর্নবের। চোখ, কপাল একসাথেই কু্ঁচকে এলো হাতের চাপে। নুপুর বুঝতে পারলো ভুলটা দ্রুতই সরিয়ে নিলো হাত।

-স্যরি স্যরি আমি একটুও বুঝতে পারিনি।

-অস্থির হইয়ো না আমি ঠিক আছি।

-আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি।

-হুশশশ, ব্যথা পাইনি তেমন।

আরও কিছু বলার ছিলো হয়ত দুজনার বলা হলো না। অর্নিতা এসে ঢুকেছে কেবিনে। বাকি রাতটুকু আর কারোই ঘুম হলো না তবুও চুপচাপ রইলো তিনজনই। সকালে আটটার পরই নুপুর চলে গেল বিদায় নিয়ে৷ তারপর থেকে রোজই সে অর্ণবের খোঁজ নিতে থাকলো প্রথম প্রথম অর্নিতার মাধ্যমে৷ পরে অবশ্য অর্ণব কিছুটা সুস্থ হতেই ফোনকলে তার সাথেই কথা চলল। অর্নিতার পড়াশোনার কথা ভেবে দিন তিনেক পরই অর্ণব জোর করে তাকে পাঠিয়ে দিলো চট্টগ্রামে। হাসপাতালে পরের সময়গুলো মোটামুটি একা কাটলো তার। দিনের কিছু সময় বৃষ্টি, সন্ধ্যের পর রিমন আর রাতটা তার পাশে ওয়ার্ড বয়দের একজনকে রাখা হলো তার জন্য।ডাক্তার প্রথমে দিন দশের কথা বললেও পায়ের অবস্থা খারাপ থাকায় টানা আঠারোটা দিন তার কেটে গেল হাসপাতালের বদ্ধ কেবিনে। ম্যানেজার আঙ্কেল অফিসের কাজকর্ম ঠিকঠাকই গুছিয়ে রাখলেন সেইসাথে নিজ দ্বায়িত্বে দাদীর খেয়ালও রাখতে ভোলেননি। নাতির চিন্তায় দাদীও কিছুটা দূর্বল হয়ে পড়েছেন তা দেখে অর্ণব একরকম জোর করেই হাসপাতাল ছেড়ে গেল। ওয়াক স্টিক ব্যবহার করে সাবধানে চলাফেরা শুরু করতেই অফিস যাতায়াত শুরু হলো তার। পুরোপুরি সেড়ে উঠতে দেড় মাসেরও বেশি সময় লেগে গেল তার। ততদিনে নুপুরের সাথে তার কথা বলা সহজ হয়ে গেছে। রোজ যেন নিয়মে বাঁধা পড়া কথা হয় তাদের। সে কথায় নেই ভবিষ্যত পরিকল্পনা, না আছে ভালোবাসা প্রকাশের প্রয়াস। তবুও তারা টের পায় একে অপরের অনুভূতির তীব্র আলোড়ন ভিন্ন এক জগত সৃষ্টি করছে তাদের। সে জগতে তারা একে অন্যের ধারক, বাহক সবটাই হয়ে উঠেছে অপার মায়ায়।

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-২১+২২

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২১

ব্যাগপ্যাক গোছাগাছ হতেই যেন হাফ ছেড়ে বসলো অর্নিতা, নুপুর। অর্নিতার জীবনে কাঙ্খিত মুহুর্তগুলোর এটাও তো একটা। মনেপ্রাণে অপেক্ষা করছিল এই দিনগুলোর। যেদিন অর্ণব এসে বলল, ‘রেজাল্ট বেরিয়েছে অর্নি। রিদওয়ানকে বলে দে টিকিট কাটতে।’

-টিকিট!

আঁতকে উঠেছিল অর্নিতা তবে কি সে চান্স পায়নি কোথাও। তাকে আরও একটু ভড়কে দিয়ে অর্ণব নিজেই কল করলো রিদওয়ানকে।

-হ্যালো, রিদু টিকিট কাটতে হবে রে…..
অর্ণব আর কথা শেষ করতে পারেনি। তার চোখ পড়েছে অর্নিতার মুখে। নোনা জলে গাল চিকচিক করছে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার দমকে দুলে উঠছে তার শরীর তা দেখেই দুষ্টুমিতে রাশ টেনে বলে উঠলো, ‘হলে সিটের ব্যবস্থা করব নাকি বাইরেই কোন ফ্ল্যাট বাড়ি ঠিক করব বল তো।’

সেদিন প্রথমবার ভাইয়াকে দেখলো কিরকম মজা করতে। টিকিটটা বলেছিলো চট্টগ্রামের জন্য৷ অর্নিতা চট্টগ্রামে চান্স পেল সেই সাথে পেয়ে গেল তা জেনেই অর্ণব বোনের সাথে একটু মজা করতে ছেয়েছিল। বোকা মেয়েটা ভেবেছে সে চান্স পায়নি বলে রিদওয়ান ফিরে আসবে। পরে বুঝলো তার চট্টগ্রামের টিকিটের কথা বলছে। সেই থেকেই গোছগাছের শুরু কি নেবে কি নেবে না এই করতে করতে কখনো রিদওয়ান, কখনো অর্ণব আর কখনো খালামনির তাড়া। শেষ পর্যন্ত কাপড়চোপড় ছাড়া কিছুই নেওয়া হচ্ছে না। আজ জোর করেই নুপুরকে আনা হয়েছে তাদের বাড়ি। কথা ছিল বৃষ্টি আপুও আসবে কিন্তু কোন একভাবে নুপুরের কথা জানতে পেরে এলো না বৃষ্টি। অনেক আগে থেকেই কেন যেন মেয়েটা শ্যামাকন্যাটিকে সহ্য করতে পারে না। অর্নিতার বিয়ের দিনেও বেশ সুক্ষ্মভাবে তাকে এড়িয়ে গেছে সে কিন্তু আজকেও নুপুর আসবে শুনে মুখের ওপর কিছু কথা বলে দিয়েছিল। অর্নির মন খারাপ হলেও ঠিক বুঝে উঠেনি এমন কি করল সে যার জন্য বৃষ্টি আপু রেগে গেল!

– আমার খুব খিদে পেয়েছে অর্নি চায়ের খিদে।

-একটু বোস আমি আনছি।

-আচ্ছা।

অর্নিতা ঘর ছেড়ে বের হতেই নুপুর হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। বছরেরও বেশি সময় হলো নুপুরের এ বাড়িতে যাতায়াত চলছে। প্রথম দিকে সংকোচ হলেও ধীরে ধীরে তা দূর হয়েছে। অর্ণবকে নিয়ে মনের ভেতরের স্নিগ্ধ অনুভূতি এখন অনেকটা শিথিল, শান্ত। এর কারণ বোধহয় বাড়িতে লেগে থাকা তার বিয়ের আলোচনাই মূল কারণ৷ আজ সকালে এ বাড়িতে পা রেখেই টের পেয়েছে অর্ণব বাড়িতে নেই তবুও অস্থির হয়নি সে লোকটাকে দেখার জন্য৷ যেন এটাই স্বাভাবিক তার জন্য অথচ মাস দুই আগেও কেমন পাগল পাগল লাগতো ওই জল্লাদমুখে মানবের একপলক দর্শনের অপেক্ষায়।

-এই নে…. চা করা হলো না ভাইয়ার কফির জন্য।

কফির একটা মগ নুপুরকে এগিয়ে দিয়ে পাশেই বসলো অর্নি। মুহূর্তেই ফোন বাজলো তার রিদওয়ান কল করেছে। কল ধরতেই ওপাশ থেকে উত্তেজিত স্বর, ‘ব্যাগ গোছানো হয়ে গেছে?’

-হ্যা

– বের হবি কখন?

-কাল ভোরে।

– শুভ কামনা….. আর কি বলা যায় বল তো!

-আমার জন্য শুভেচ্ছা সম্ভাষণ আমিই বলে দেব?

– বউকে শুভেচ্ছা জানাতে হয় বুকের মাঝে চেপে ধরে ললাটে উষ্ণ স্পর্শে আমার নসীবে তো তেমন কিছু নেই রে। এক কাজ করলে হয় আমি চলে আসি? তারপর সবটা পূরণ করবো।

হা হুতাশে ভরা রিদওয়ানের কণ্ঠ। সত্যিই তার খুব ইচ্ছে করে অর্নিকে একটিবার বুকে চেপে ধরে লম্বা একটা নিঃশ্বাস টেনে নিতে। কবে আসবে সেই দিন ভাবতেই বুকের ভেতর ফাঁপা লাগে। দুজনে কথা চলতে লাগলো আর নুপুর বিছানায় বসে কফির মগে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক। সন্ধ্যের আগেই এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে তাকে৷ ভেবেছিল ঘন্টা দুয়েক থেকেই চলে যাবে তা আর হলো কই! অর্নিটা বড্ড আপন তার এ জীবনে৷ নিজের আত্মার আত্মীয় বলতে এক ওই তো আছে৷ মা নেই, বাবা থাকলেও বন্ধুতা নেই বাবার সাথে। যা আছে শুধুই আদর, স্নেহের সম্পর্ক যেমনটা সাধারণত হয়। স্কুল জীবনে বান্ধবী তেমন হয়নি তার কলেজে এসে প্রথম এই শান্ত শীতল মেয়েটাই তার কাছের হলো। বলতে নেই, তার চঞ্চল, ছটফটে স্বভাবটাকে নিশ্চুপে গ্রহণ একমাত্র অর্নিতাই করেছিল বলে গড়েছে তাদের এই মজবুত বাঁধন। অর্নি কথা বলায় ব্যস্ত তাই নুপুর কফিতে চুমুক দিতে দিতে ফোন স্ক্রল করছিল। দরজায় ঠকঠক শব্দ হতেই চোখ তুলে সে চাইলো সেদিকে। অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে চেয়েই। শিরশির করে উঠলো তার মেরুদণ্ড এ কেমন দৃষ্টি!

– কথা ছিল আমার একটু নিচে আসবে?

কথাটায় মিনতি ছিল কি আদেশ ঠিক বোঝা গেল না। আধ খাওয়া কফিসহ মগটা খাটের ওপর রেখেই নুপুর পা বাড়ালো অর্ণবের দিকে। অর্নি তখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে রিদওয়ানের সাথে কথায় ব্যস্ত।
________

-কাল ভোরেই অর্নি চট্টগ্রামে চলে যাবে। আমি আজ একটু ও বাড়ি যাই…..

– কেন? আর কখনো ফিরবে না তোমার বোনঝি?

বাশার শেখের কথার ধরণে থমকে গেছে রায়না। মেয়েটা কাল গেলে প্রথম সেমিস্টারের আগে আর ঢাকায় ফিরবে না এ কথা তিনি আন্দাজ করতে পারেন। এদিকে তিনি নিজেও মেয়েটাকে দেখতে অতদূর যেতে পারবেন না জানেন বলেই আজ যেতে চাচ্ছিলেন। কত সাধ করে মেয়েটার পছন্দের হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি রেঁধেছেন নিজ হাতে। নিজ হাতে না খাইয়েও শান্তি পাবেন না। আজ কতগুলো মাস হয়ে এলো অর্নিতা এ বাড়িতে পা রাখেনি কে জানে কখনো রাখতে পারবে কিনা! রায়না মনে মনে খুব কষ্ট পান স্বামীর আচরণে তবুও মুখ ফুটে কিছু বলেন না। শেষ পর্যন্ত বিরিয়ানি বক্সে ভরে রিমনকে দিয়েই পাঠিয়ে দিলেন ও বাড়িতে। বৃষ্টি বসেছিল তার বাবার পাশে আজকের সকালের পত্রিকা নিয়ে৷ বাবা-মায়ের কথা শুনে তার বিরক্ত লাগল খুব রাগও হচ্ছে। এই যে সামান্য বিরিয়ানি নিয়ে একজন মন খারাপ করছে এটা কিছুতেই হতো না যদি সে যেতো। সে নিজেই আব্বুকে বলে আম্মুর যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতো কিন্তু এখন তো সে নিজেই যাচ্ছে না। সব দোষ ওই কালী মেয়েটার হাহ! মনে মনে বৃষ্টি ওই মেয়েটিকেই গালি শোনাচ্ছে৷

_______

রাতটা থাকার জন্য বড় জোরজারি করেও নুপুরকে রাজি করানো গেল না। অর্নিতা বুঝতেই পারছে একটুখানি সময়ে এমন কি হয়ে গেল যার জন্য নুপুর বেঁকে বসলো! প্রথমে তো তার কথাতে রাজিই হয়েছিল রাতটা থাকবে সকালে দাদীর সাথে নাশতা করে তারপর যাবে সে। রিদওয়ানের সাথে কথা শেষ করে অর্নিতা তাকে রুমে খুঁজে পায়নি। নিচে গেলে দেখতে পায় বাগানের দিক থেকে অন্যমনস্ক হয়ে আসছে সে একটু দূরে চোখে পড়লো ভাইয়ার রাগান্বিত মুখটা। কিছু কি হয়েছে দুজনাতে! হবে বোধহয়, রিদওয়ান অনেক আগেই তো বলেছিল ভাইয়া আর নুপুরের মাঝে কিছু চলছে। অর্নিতা এ নিয়ে ঘাটায়নি কাউকে। তার আত্মকেন্দ্রিক স্বভাব আর চিন্তা চেতনাই তাকে বারংবার চুপ রেখেছে। মনে মনে অপেক্ষা করে গেছে সঠিক সময়ের। সময় হলে তারাই কিছু জানাবে কিন্তু আজকের দৃশ্য দেখে ভয় হলো। তারপরই নুপুর কেমন যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে গেছে। রিমন ভাইও ঠিক সে সময়ে এসে উপস্থিত হলো বিরিয়ানি নিয়ে। বেশি সময় নেই রিমন আবার অফিসেও যাবে তাই সে দ্রুতই অর্নির সাথে কথা বলে বিদায় নিচ্ছিলো অমনি এসে নুপুর বলল, ‘ রিমন ভাইয়া আমাকে কি সাথে নেয়া যাবে?’

নুপুর ততক্ষণে একদম প্রস্তুত হয়েই সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল৷ রিমন তার সহজাত প্রবৃত্তিতেই জবাব দিলো, কেন নয় সুন্দরী। চলো চলো… ‘

– থেকে যা না নুপুর।

-না অর্নি কাজ আছে বাড়িতে। বাবা ফোন করছে তাড়াতাড়ি ফিরতে।

-থাকো না বুবু অর্ণব আইসা দিয়া…..

দাদীকে থামিয়ে দিয়ে নুপুর বলল, ‘না দাদী রিমন ভাইয়ার সাথেই বাজার পর্যন্ত চলে যাই। বাজারের মোড় থেকে রিকশা নিয়ে চলে যাব।’

অর্নি আর কিছুই বলতে পারেনি। নুপুর চলে গেল সন্ধ্যের অনেক আগেই। অর্ণব লাঞ্চ না করেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। মূলত নুপুরের ওপর রাগ প্রকাশ করতে অপারগ হওয়ায় সে অফিসে ফিরে বসেছিল চুপচাপ নিজ কেবিনে। মাথা ঠান্ডা করে ভেবে নিয়েছে রাতে ফিরে আরেকবার কথা বলবে মেয়েটির সাথে। কাজেকর্মে মন বসলো না তার ঠিকঠাক তাই সন্ধ্যের পরই বাড়ি ফিরে এলো। বাড়িতে নুপুরকে না দেখতে পেয়ে আমতা আমতা করেই অর্নিকে জিজ্ঞেস করলো, তোর বান্ধবী চলে গেছে?

অর্নি বিষ্ময় চেপে মাথা নেড়ে জবাব দিল, রিমন ভাইয়ার সাথেই বেরিয়েছিল।

জবাবটা বোধহয় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করল অর্ণবকে। ক্ষুরধার মুখটাতে ধার আরো দ্বিগুণ হয়ে উঠলো তার। অর্নি কিছু বলতে চেয়েও চুপ রইলো রিদওয়ানের কথা মনে করে৷ সে তাকে আগেই সতর্ক করেছিল অর্ণব, নুপুরের মাঝে কিছু চলছে এ নিয়ে সে যেন আগ বাড়িয়ে কিছু বলে না বসে কখনো৷ সময় একদিন ঠিক করে দেবে তাদের গন্তব্য।

________

অর্নি চলে গেছে চট্টগ্রামে। নতুন পরিবেশ, পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ততা সেই সাথে রিদওয়ানকেও সময় দেয়া সব মিলিয়ে কিছুটা আলগা হয়েছে সবার সাথে যোগাযোগ। শুরু হয়ে গেছে নুপুরেরও নতুন ভার্সিটিতে ক্লাশ। সে ঢাকারই একটি ভার্সিটিতে থাকতে পেরেছে এই যেন তার জন্য ঠিকঠাক। এখন আর আগের মত উচ্ছ্বসিত সময় কাটে না তার কিছুতেই। ক্লাশ, টিউশন আর বাড়ি এই করেই হাঁপিয়ে উঠেছে অল্প কদিনেই। তারওপর অর্ণবের সাথে শেষ বার হওয়া কথপোকথন মনে হলেই ভেতরটা তার ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যায়। লোকটা কি শেষ পর্যন্ত তার দিকে আগ্রহের সাথে আগাতে চাইছে! নইলে অমন করে কেন বলল, ‘ও পাড়াটা ভাল নয় সন্ধ্যের পর বের হলে আমায় নক দিও অথবা আঙ্কেলকে বলবে তোমায় নিয়ে যেতে।’

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২২

পরের চেয়ে ঘরের শত্রুই ঘাতক হয় বেশি এ কথাটা অর্ণব মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। চোখ, কান খোলা রেখেও সেইসব শত্রুকে প্রতিরোধ করা মুশকিল এ কথাও তার জানা। বিগত সময়গুলোতে খুব সতর্কতার সাথে সে খুঁজে বেরিয়েছে তার মূল শত্রু কে আর কেন? সন্দেহের তীর বংশেরই লোকদের ওপর ছিল কিন্তু তারা ঠিক কতটুকু খতরনাক তা ঠাওর করতে পারছিলো না। অর্নিকে নিয়ে মস্ত যে ভয় ছিল তা এখন নেই অনেকটা। খালুজান ছেলের বিয়ে নিয়ে রুষ্ট এ কথা তার জানা তবুও মন বলে ঠিক হয়ে যাবে সব৷ কিন্তু ঘরকোণের শত্রুর বিষদাঁত কেমন করে খুজেছে বের করবে সে! ব্যাংক লোন ক্যান্সেল হওয়ার ঘটনা ঘটেছে আরও দশ কি এগারো মাস আগে তখন অর্নি ঢাকাতেই ছিল। সে নিয়মিত কলেজে যেত আর তখন আতঙ্ক ছিল কেউ অর্ণবকে ফলো করে। অর্নিতার কলেজের আশেপাশেও দেখা গেছে সেই লোকটাকে তাতে শতভাগ নিশ্চিত হয়েছিল বিপদ শুধু তার একার নয় বরং তার বোনের আশেপাশেও ঘুরছে৷ সন্দেহ দূর করতে আর বিপদ এড়াতেই অর্ণব নিজে একজনকে রেখেছিল অর্নিতার সেফটির জন্য তবে লোকটির কাজ ছিল আড়ালে থেকে অর্নিকে নিরাপদ রাখা। এরই মাঝে ঘটে গেছে কতশত ঘটনা। অর্ণবের লোন ক্যান্সেল হওয়া, জমির দলিলের আসল কপি গায়েব, শিবলীর সাথে অর্নিতার বিয়ে ঠিক হওয়া, রিদওয়ানের সাথে বিয়ে হওয়া এসবের মাঝে হঠাৎই অর্ণবের উপলব্ধি হলো বিপদ কেটে গেছে। আদৌও কেটেছে কিনা তখনও অর্ণবের সঠিক জানা নেই সে মনের কথাটাই ঠিক ধরে নিয়েছিল। তার ধরে নেওয়া ভাবনাটা যে কতবড় ভুল ভাবনা তা সে আজ টের পেল নুপুরের সাথে দেখা করার সময়। আজ হঠাৎই তার মনে হলো নুপুরকে সে মিস করছে। যেন তেন মিস নয় একেবারে অন্তর পুড়ে যাওয়া কমতি যাকে বলে ঠিক তেমনটাই অনুভূতি। গত কয়েকদিন জোর জবরদস্তিই সে চেষ্টা করছিলো মেয়েটাকে মন থেকে সরিয়ে ফেলতে। তার সেই চেষ্টাই বিফল হলো শেষ অব্ধি। যত ভুলতে চায় ততই মনে পড়ে আর এটাই স্বাভাবিক। আমরা ভুলে থাকার চেষ্টায় প্রতিনিয়ত মনে করতে থাকি এই জিনিসটাই বুঝে উঠতে পারি না। পরিচয়ের শুরু থেকে কড়া দৃষ্টিতে অবহেলা করা, এড়িয়ে চলা মেয়েটা শক্ত খুটির ন্যায় কবে যেন গেড়ে বসলো অর্ণবের হৃদয়ে টের পেলো না সে। আর তাতেই আজ উতলা হয়ে পৌঁছে গেল নুপুরের ভার্সিটির সামনে। বাইক দাঁড় করিয়ে দাঁড়িয়েছিল গেইটের এক পাশে। জানা নেই কখন নুপুর বের হবে তাই প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করার। তার অপেক্ষায় সময় খুব বেশি লাগেনি৷ ঘন্টা খানেক পর প্রায় কড়া রোদের দুপুরটাতেই দেখা মিলল শ্যামাকন্যার। নুপুর উদাস মুখে, শুষ্ক চোখে দৃষ্টি নিচে রেখে বের হতেই কানে এলো অর্ণবের ডাক, নুপুর!’

এই প্রথম! হ্যাঁ পরিচয়ের বছর আড়াই কি তিনের মাঝে এই প্রথমই বোধহয় অর্ণব তাকে নাম ধরে ডাকলো৷ এই ডাক কান পেরিয়ে অন্তস্থলের গভীরে কোথাও গিয়ে স্পর্শ করলো নুপুরের। গায়ে, পায়ে শিরশিরে অনুভূতি, হৃদস্পন্দনেও উঠলো ঝড়। ঝংকার তোলা স্বরের স্পষ্ট উচ্চারণ, নুপুর! এই ডাক শুনে জবাব দিতেও যেন ভুলে গেল সে। জবাবের অপেক্ষা না করে অর্ণব এগিয়ে এসে বলল, ‘টিউশনি আছে এখন?’

মাথা নেড়ে না জানায় নুপুর।

-একটু কথা ছিল আমার একটু সাথে আসবে?

আগের বার ঠিক এমন করেই বলেছিলো না লোকটা, ‘কথা ছিল আমার একটু নিচে আসবে?’
ভয় হলো সেদিনের মত আবারও বলবে না তো কেন জ্বালিয়ে মারছো আমায়। এখন তো সে আর অর্ণবকে কল, মেসেজ দেয় না৷ সেদিন অর্নি যখন বারান্দায় ফোনে কথা বলায় তখন অর্ণবের ডাকে নুপুর নিচে গিয়েছিল। বসার ঘরে তারা ব্যতিত অন্য কেউ ছিল না। অর্ণব কোন ভণিতা না করে সরাসরিই বলে বসল, কেন জ্বালিয়ে মারছো আমায়? আগে বারণ করতাম তবুও কল, মেসেজ দিয়ে বিরক্ত করতে। বিরক্ত করতে করতেই একদিন আমার অভ্যাসে জায়গা নিয়ে এখন আবার ঢং জুড়েছো আমাকে এড়িয়ে চলার! ফাজলামো পেয়েছো, সবকিছুই ফাজলামো মনে হয়! নুপুরের মন সতর্ক করলো তাকে দরকার নেই লোকটার কথা শোনার।

– আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে এক্ষুনি।

-আমি বেশি সময় নেবো না।

-একটুও দেরি করা যাবে না বাবা ফোন করেছে জলদি ফেরার জন্য।

প্রতিটা কথা নুপুর অন্যদিকে তাকিয়েই বলেছে৷ অর্ণবের মনে হলো ইচ্ছে করেই দৃষ্টি লুকিয়েছে নুপুর। সে আর জোর করেনি তাকে নুপুরও দ্রুত চলে গেল জায়গাটা থেকে। নুপুরের প্রস্থানের পরই অর্ণবের চোখে পড়লো রাস্তার বিপরীতে থাকা একটি লোককে। অনেকদিন পর দেখলেও তার চিনতে ভুল হয়নি এই বেঁটেখাটো লোকটিকে। এই লোক তাকে অনেকবার ফলো করেছিল সে কয়েকবার লোকটাকে ধরার চেষ্টা করেও ধরতে পারেনি। আজ আর সময় নষ্ট না করে সে দৌড়ে নেমে গেল রাস্তায়। নুপুরের এড়িয়ে যাওয়াটা তাকে খুব পীড়া দিচ্ছে সেই সাথে পুরনো এই শত্রুপক্ষের নজরদারি তাকে শঙ্কিতও করলো। হঠাৎই খেয়াল হলো তার পাশে নুপুরকে দেখে ফেলল নাতো! তার সাথে সাথে মেয়েটিরও বিপদ হবে নাতো আবার? সে আর কিছুই ভাবতে পারে না দিক বিদিক ভুলে লোকটাকে ধরতে এগিয়ে যায় সামনে। রাস্তার দু পাশ থেকে চলন্ত গাড়ি ছুটছে তাও যেন চোখে পড়লো না। রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে পৌছানোর ঠিক আগেই ঘটলো ঘটনাটা। ডান পাশ থেকে দ্রুত বেগে ছুটে আসা সিএনজির ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লো অর্ণব কিছুটা দূরে। মুহূর্তেই লোকের ভীড় জমে গেল রাস্তায়। অর্ণব শুধু বোকার মত তাকিয়ে রইলো তাকে ঘিরে রাখা মানুষগুলোর দিকে।

_______________

কাঁদতে কাদতে টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার গুছিয়ে নিচ্ছে বৃষ্টি। আধঘন্টারও বেশি সময় ধরে চলছে এই কান্না আর রিমনের ধমক। কাল শেষ রাতে ঢাকায় ফিরেছে অর্নিতাকে নিয়ে সেই মেয়েও কান্না করে কানে তব্দা লাগিয়ে দিয়েছে আজ আবার বৃষ্টি! মেজাজের পারদ উঁচুতে উঠছে তার এখন। অর্ণবের এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে রিমনই করছে সকল ছুটোছুটি। কাল ঘটনাস্থল থেকে কেউ একজন অর্ণবের ফোন অক্ষত অবস্থায় পেয়ে কল করেছে তাকে। সর্বশেষ কলটা তারই ছিল ব্যক্তিগত কোন কাজে তাই রিসেন্ট কলে তাকেই পেয়েছে লোকটা। কিন্তু দূর্ভাগ্য তাকে দূর্ঘটনার কথা জানালেও ফোন আর ফেরত দেয়নি। সে যাহোক, যথাসময়ে খবর দিয়েছে এই ঢের। রিমন নিজেই গিয়ে অর্নবকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। পায়ের হাড়ে চির ধরেছে, হাত ভেঙেছে সেই সাথে ডান গালটাও চোট পেয়েছে ফলে হাত, পায়ে প্লাস্টার আর মুখটা ফুলে ঢোল হয়ে আছে৷ সন্ধ্যের মধ্যেই তার চিকিৎসা প্রদান সম্পন্ন হলেও জ্ঞান ফিরেছে আজ ভোর চারটার দিকে। কাল তাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়ে দিয়েই সে আবার ফ্লাইট ধরে চট্টগ্রাম গিয়েছে অর্নিতার হলে। ফিরতেও চেয়েছিল ফ্লাইটেই কিন্তু সম্ভব হয়নি বিধায় ক্যাব নিয়ে রাতভর জার্নি করেছে। সারা রাস্তা অর্নি কেঁদেকেটে হয়রান। হাসপাতে পৌঁছে অর্নিকে রেখে বাড়ি ফিরে ঘন্টা দুই ঘুমিয়ে আবার ছুটেছে অফিসে। দুপুরে বাড়ি ফিরে গোসল সেরে লাঞ্চ করতেই কানে এলো বৃষ্টির কান্না। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে খাবার গোছাচ্ছে আর নাকি সুরে কাঁদছে কারণ জিজ্ঞেস করলে জানতে পারলো অর্ণব ভাইয়ার কথা মনে করেই কাঁদছে। সেই থেকে আধ ঘন্টা পেরিচ্ছে চলছেই কান্না৷ রিমন নিজের ঘরে ফিরে গাড়ির চাবি আর ফোন নিয়ে বৃষ্টিকে ডাকলো, ‘কান্না শেষ হলে বের হ আমি আর দেরি করতে পারবো না আর।’

চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দ্রুত নিজে ঘরে ঢুকে মুখে সানস্ক্রিন, ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে নিলো বৃষ্টি। আর যাইহোক অর্ণব ভাইয়ার সামনে সে কোন অবস্থাতেই অগোছালো, অসুন্দর হয়ে যেতে চায় না। নিচে থেকে গাড়ির হর্ন কানে আসছে। রিমন এবার পুরোপুরি বিরক্ত। আর দেরি করা চলে না তাই এবার একরকম দৌড়ে বের হলো টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই কান্না থেমে গেছে বৃষ্টির। অর্ণবকে পাওয়া গেল ঘুমন্ত অবস্থায়। এনেস্থেসিয়ার ঘোর এখনো পুরোপুরি কাটেনি বলেই হয়ত ঘুমেই সময় পার হচ্ছে তার। মুখটা এখনো কি ভীষণ ফোলা! বৃষ্টির আনা খাবার খেয়ে রায়না বেগম একটু পিঠ ঠেকিয়েছেন চেয়ারে৷ অর্নিকে জোর করেই বৃষ্টি একটুখানি খাবার খাইয়ে বাড়ি পাঠালো। রাত অবধি এখন বৃষ্টি আর রায়না বেগমই থাকবেন এখানে। রাতে বাশার শেখ এলে সাথে যাবেন তারা রাতটা রিমনই থাকবে সাথে এমন কথা হয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যের পর আর তা হলো না। হাসপাতালে ঔষধের গন্ধে বৃষ্টি টিকতে পারে না বিকেলেই শুরু হলো মাথাব্যথা। বাধ্য হয়েই তাকে নিয়ে রায়না ফিরে গেলেন বাড়িতে৷ সন্ধ্যের পর আর জোর করেও অর্নিকে বাড়িতে রাখা গেল না। কান্নাকাটি করে দাদীকে বুঝিয়ে একাই চলে এলো হাসপাতালে ভাইয়ের পাশে থাকবে বলে। এরই মাঝে একবার নুপুরের সাথে কথা হওয়ায় নুপুর জানতে পারলো অর্ণবের দূর্ঘটনার কথা। ঘটনার মোটামুটি ব্যাখ্যা শুনতে বুকের ভেতর যন্ত্রণা বাসা বাঁধলো। ঘটনার সময় তার সাথে দেখা হওয়ার সময়টা তারমানে কি দেখা হওয়ার পরই হলো! নিজের মনকে বোঝাতে লাগলো অনেক কিছুই মন কি বুঝলো তার কথা? বোঝেনি একটুও বরং অন্তর্দাহ তাকে এক কদম এগিয়ে নিলো অর্ণবের দিকে। কোন দিক বিবেচনা না করেই বাবার কাছে মিথ্যে বলে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। পরনে ছিল বহুদিনের পুরনো এক জামা তার ওপরই ওড়না বদলে কোনরকমে বেরিয়ে এলো সে। সন্ধ্যার পর বান্ধবীর বাড়ি যাওয়ার কথাটা ঠিক হজম হলো না বাবা আর ছোট মায়ের। নাজিম সাহেব মেয়েকে কষ্ট দিতে চাননা বলেই রাজি হলেন তবে তিনি চাইলেন নিজেই পৌঁছে দিয়ে কথা বলে যাবেন অর্নিতার সাথে। সে সুযোগ আর নুপুর তাঁকে দেয়নি। মেয়ের কথামতো নাজিম সাহপব নুপুরকে নিয়ে এলেন অর্ণবদের বাড়িতে। নুপুরই বলেছে অর্নি ঢাকায় এসেছে দুদিনের জন্য তাই খুব করে চাইছে নুপুরকে সাথে রাখতে। নুপুরের মিথ্যে বলার ধরণটা পাকা না হলেও বাবা মেনে নিলেন। বিপত্তিটা হলো অর্ণবদের বাড়ির গেইটে। রিকশা থেকে নেমেই নুপুর বলল, তোমার তো দেরি হয়ে যাবে বাবা তুমি চলে যাও বাড়ি পৌঁছে কল দিও আমায়।

এইটুকু কথার পর আর একটুও দাঁড়ায়নি নুপুর তাতে যেন আরও বেশি সন্দিগ্ধ হলেন নুপুরের বাবা। তিনি পুনরায় রিকশায় চড়ে চলে যেতেই নুপুর গেইট পেরিয়ে আবারও এলো রাস্তায়। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নেমেছে শহর জুড়ে। রাস্তার ধারে সোডিয়ামের কৃত্রিম আলোয় রাস্তাঘাট হলদে সাজে সজ্জিত। ভেতর ভয়ে অন্তর পুড়ছে অথচ শরীর জুড়ে সীমাহীন কাঁপন। এ কাঁপুনি শুধুই কান্না চাপা দেওয়ার সাক্ষী। মিনিট কয়েক নিশ্চল দাঁড়িয়ে থেকেই যেন নিজের অস্তিত্বে বিস্বাদ অনুভব করছিলো নুপুর। তারপর…. পরের সময়ুটুকু জোর করেই নিজেকে এগিয়ে নিলো রিকশায়, রিকশা থেকে হাসপাতাল আর তারপর প্রিয় সেই জল্লাদমুখো প্রাণসখার কেবিনের সামনে। ঘড়ির কাঁটা তখন টিকটিক করে জানান দিচ্ছে আটটা বাজার কথা। ঝোঁকের বশেই হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে চলেই এসেছে সে হাসপাতালে কিন্তু এরপর কি! এতক্ষণে যেন হুঁশ ফিরলো তার৷ প্রিয় বান্ধবীর ভাইয়ের দূর্ঘটনা শুনে এই তমসাঘেরা রাতেই সে এভাবে ছুটে এলো! এমনটাই কি হয়! হতে পারে! কিন্তু এখন কি হবে চলে তো এসেছে তবে কি ফিরে যাবে আবার? কাল না হয় দিনের আলোয় এসে দেখে যাবে। মন যে মানে না অথচ মস্তিষ্ক তাকে সতর্ক করছে ফিরে যা নুপুর। মন, মস্তিষ্কের চরম লড়াইয়ে যখন মস্তিষ্কের জিত হলো উল্টো ঘুরে ফিরে যেতে উদ্যত হলো নুপুর ঠিক তখনই ডাক এলো, নুপুর!

আহ্ বড্ড মিল তাদের দু ভাই বোনের। একই সুরে, একইরকম জোর খাটিয়ে ডেকে ওঠে তারা। নুপুরের শক্তি কই এমন ডাক উপেক্ষা করার? সে পিছন ফিরলো। কফি হাতে অর্নিতা ভাইয়ের কেবিনেই ঢুকতে যাচ্ছিলো।

-তুই কখন এলি?

-আমি… আমি মাত্রই এসেছি।
চোখে-মুখে সংকোচ, ঠোঁটে তার জড়তা।

-তাহলে ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?

– ওদিকে তো… আসলে রিকশাওয়ালাকে দাঁড়াতে বলতে ভুলে গেছি তাই ভাবলাম….

অর্নিতা জানে তার ভাইকে নিয়ে প্রিয় এই বান্ধবীটির মনে কি চলে। তাই আর ঘাটাতে না চেয়ে সহজ করলো আলাপটা।

-থাক, চলে যাক রিকশা। রিমন ভাই আসবে আবার তিনিই না হয় ব্যবস্থা করবে একটা।

-আচ্ছা।
আর কথা বাড়ায়নি কেউ বরং অর্নিতা ইচ্ছে করেই নুপুরকে কেবিনে পাঠিয়ে আবারও গেল ক্যান্টিনে। নুপুরের জন্যও এক কাপ কফির উছিলায় অনেকটা সময় বসে রইলো নিচে। নুপুর কেবিনে ঢুকে বিছানায় তাকালো। লম্বা, চওড়া মানুষটা যেন অসুস্থ হয়ে আরো বেশিই লম্বা হয়ে গেছে। পা থেকে মাথা অবধি পলক ফেলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো নুপুর। কালও তো তার সামনে ছিল সটান দাঁড়ানো গম্ভীর মুখে কপাল কুঁচকে। আর আজ! জ্বলে যাচ্ছে অন্তর এ কেমন বেদনা। যার সাথে প্রণয় নেই আর না ভাবের সম্পর্ক অথচ একতরফা ভালোবাসায় কি ভীষণ যন্ত্রণা তার জন্য ! কান্না চাপার চেষ্টা করেই আরেকটু এগিয়ে অর্ণের মাথার কাছে দাঁড়ালো নুপুর। আলতো হাতে স্পর্শ করলো অর্ণবের ফোলা মুখটা। গাল ছুঁয়ে, কপাল ছুঁয়ে আনমনে চোখ বুঁজলো সে। তাতেই যেন চোখের কার্নিশ ছুঁয়ে টুপ করে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো অর্ণবের চোখের পাতায়। খানিকটা কেঁপে উঠলো চোখের পাতা ঘুমের রেশও কাটতে লাগলো একটু একটু। নুপুর খেয়াল করলো না তা। কোনদিক না দেখেই সে করে বসলো দুঃসাহসিক একটি কাজ। একটু ঝুঁকে ঠোঁট ছোঁয়ালো অর্ণবের কপালে। বুঝতেই পারলো না তার অধর পল্লবের উষ্ণ ছোঁয়া ঘুমন্ত মানুষটির ঘুমকে কেমন তাড়িয়ে দিয়েছে ফু দিয়ে। সে জানতেই পারলো না তার এই চুম্বনের স্বাদ যেমন অনুভব করেছে ঘুমন্ত মানুষটা তেমনই সেই দৃশ্য দূর থেকেই দেখে নিয়েছে আরও একজন।

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-২০

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২০ (ক)

প্লেনে চড়ে প্রথমেই রিদওয়ান কল করলো অর্নিতাকে। অন্যান্য স্বামীদের মত করেই সেও তার স্ত্রীকে জানিয়ে দিলো সিটে বসে গেছে। পৌঁছেই আবার ফোন করবে বলেও জানিয়ে কল কাটলো। ফোন রেখে অর্নিতা গেল দাদীর ঘরে। নুপুর এসে অব্ধি সে ঘরে বসেই গল্পে মেতেছে। অর্নিতা ভেবে পায় না এত কি কথা পায় তারা বলার জন্য!

– তুই গোসল করে আমার জামা পরে নে নুপুর।

দাদীর পাশে বসে পান চিবুচ্ছে নুপুর। হাতে তর্জনীতে আছে একটুখানি চুন৷ বয়স্কদের মতই পান চিবুতে চিবুতে আঙ্গুল মুখে পুরে একটু একটু চুনও খাচ্ছে সাথে৷ ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ছে পানের পিক৷ অর্নিতা তাকে ভালো করে দেখেই হি হি করে হেসে উঠলো৷ এই মেয়ে পান খাওয়ার খায়েশ মেটাতে গিয়ে চুনসাদা কলেজ ড্রেসের বুকের কাছটা রাঙিয়ে ফেলেছে একদম। অর্নিতা হাসতে হাসতেই আবার বলল, ‘চল গোসল করবি আর আঙ্কেলকে ফোন করে বলেছিস না তুই এখানে আছিস?’

-এই নারে ভুলে গেছি একদম৷

-ইডিয়েট!

-আচ্ছা দাদী আজকের মত পানবিলাস এতটুকুই থাক। অর্নি চল তোর ঘরে।

নুপুর ছুটলো অর্নির ঘরে৷ প্রথমেই বাবাকে কল করে বলল একটু কাজে সে অর্নিতাদের বাড়ি এসেছে। এখান থেকেই টিউশনিতে চলে যাবে। নাজিম সাহেব তাকে নিতে আসবে বলতেই সে তড়িঘড়ি বলল বাবাকে আসতে হবে না নিজেই যেতে পারবে এখন কয়েকবার তো এলো এ পথে। বাবার মন মানতে না চাইলেও কন্যার জোর করায় বললেন, ঠিক আছে সাবধানে আসিস। গোসল সেরে অর্নিতার জামা গায়ে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে খাটে বসলো নুপুর। গায়ের কোট খুলে হাতে নিয়ে ফোন চাপতে চাপতে দরজা পেরিয়ে এগোচ্ছিলো অর্ণব। চোখে কিছু লাগল কি! অর্নিকে তো খাবার টেবিল গোছাতে দেখেছে তবে এ ঘরে কে? আবারও পা দুটো পিছিয়ে ঘাড় কাত করে চাইলো সে। এক পশলা বৃষ্টি শেষের শীতল হাওয়া বইলো যেন করিডোরে। স্নিগ্ধ, কোমল শ্যামা সেই মুখটা তোলপাড় করলো পাথর বুকটাতে। কালই তো মনকে শাসিয়েছিল আর যেন এই মেয়ের নামে অস্থির যেন না হয় সে। অবাধ্য মন শুনলো কই! থেমে যাওয়া পা টেনে ঢুকেই পড়লো এ ঘরটাতে। পায়ের শব্দে নুপুর চোখ তুলেই বিষ্মিত হলো খুব। অর্ণব এখানে কেন?

-আপনি?

প্রশ্নটা করেই নুপুর গলায় পেঁচানো ওড়ানাটা টেনে আরেকটু ছড়িয়ে নিলো।

অর্ণব কিছু বলল না শুধু তাকিয়ে থাকলো মেয়েটির মুখে জমা বিন্দু বিন্দু জলকণায়। অনুজ্জ্বল ত্বকেও জলের ফোঁটা চকচকে লাগছে। এতদিন সে ভাবতো শুধুই ফর্সা ত্বকে এই জলবিন্দু মুক্তোর মত সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। আজ ধারণায় বদল এসে গেল। হাত বাড়িয়ে নুপুরের কপাল ছুঁয়ে এক ফোঁটা জল সরিয়ে আনমনেই বলে উঠলো, ‘এত স্নিগ্ধতা কেন!’

-জ্বী!

হুঁশ ফিরল অর্ণবের। এত বেমালুম হয়ে এগিয়ে চলল সে কতোটা কাছে। আজকাল খুব বেশিই ভুল হয়ে যাচ্ছে। মনটারই সব দোষ জেনেশুনে বারবার ভুলের পথে এগিয়ে চলছে তার। আর এক পলও এখানে ব্যয় করা ঠিক হবে না ভেবেই উল্টো পায়ে ঘর ছেড়ে চলে গেল সে। নুপুরকে রেখে গেল এক আকাশ বিষ্ময়ে।

দুপুরের খাবারে একসাথে বসেছে নুপুর, অর্নিতা আর রিদওয়ান। রুজিনা খালা নিজের খাবার নিয়ে চলে গেছে দাদীর ঘরে একসাথে খাবেন তারা। খাওয়ার মাঝেই অর্নিতা জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এখনই অফিসে যাবে ভাইয়া?

-কেন?

– তিনটার পর গেলে নুপুরকেও সাথে নিয়ে যেতে!

বোনের কথা শুনে অর্ণব হাত ঘড়িতে সময় দেখলো। তিনটা বাজতে এখনো পনেরো মিনিট বাকি। ইচ্ছে ছিল একটা কাজে একটু পরই তেজগাঁও যাবে। অর্নিতার কথা শুনে ইচ্ছে করেই সময় পেছালো বলল, ‘সাড়ে তিনটায় বের হব।’

-আচ্ছা। ভালো হলো রে নুপুর….

কথার মাঝেই অর্নিতার ফোন বাজলো। স্ক্রীণে খালামনির নাম দেখেই সে ফোন হাতে উঠে গেল বসার ঘরের দিকে। টেবিলে রইলো অর্ণব – নুপুর। ভাতের থালায় আঙ্গুল নড়ছে এলোমেলো অথচ একটা দানাও আর মুখে তুলতে পারছে না নুপুর। অর্ণব অতি দ্রুত খায় বলেই তার খাওয়া শেষ। বসা থেকে ওঠার আগে একটিবার তাকালো মেয়েটির দিকে। কাঁপা হাত, এলোমেলো দৃষ্টি আর জড়তার মহাসমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে যেন!

-ফোনে তো খই ফুটে মুখে সামনে এলে এমন ভেজা দরবেশ কেন হও?

কথাটা বললেও জবাবের অপেক্ষা না করেই চলে গেছে অর্ণব৷ মুখ হা হয়ে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে নুপুর। ব্যাটা জল্লাদ কি তাকে অপমান করে গেল! রিদওয়ান ভাই অযথাই তাকে এখানে ফেলে গেল জল্লাদের মুখে। তিনি তো আর জানেন না এ ব্যাটা তাকে পৌঁছে দেবে ঠিকই কিন্তু নিজের বাইক কিংবা এক রিকশায় বসে না। তাকে নিশ্চিত অন্য এক রিকশায় বসিয়ে প্রস্থান করাবে।

রিদওয়ান যখন দ্বিতীয়বার ফোন করলো তখন নুপুরের কলেজ ছুটিই হয়ে গেছে। কলেজ গেইটে দেখা হতেই রিদওয়ান প্রথমেই তাকে এক গাদা চকলেট দিয়েছে। চকলেট, আইসক্রিম পাগল মেয়ে চকলেট পেয়েই খুশিতে ঝুমঝুম করছিলো। তার খুশির ওপর লজ্জা ছিটিয়ে রিদওয়ান আকস্মিক বলে উঠলো, ‘ এখন চকলেট নাও বিকেলে রাজপুত্তুরের বাইকে চড়বে।’

– রাজপুত্তুর!
দুই বান্ধবী একসাথেই মুখ খুলেছিলো।

-তোর জানতে হবে না।

অর্নিকে কথাটা বলেই রিদওয়ান একটু এগিয়ে নুপুরের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে দিল, ‘অর্ণব কোনো রাজপুত্তুরের চেয়ে কম কিসে!’

কথাটা ভুল নয় ; নুপুরের চোখে সাত সাগর তেরো নদী পার হয়ে আসা সফেদ ঘোড়ায় চড়া রাজপুত্রই অর্ণব৷ সে নানী,দাদীর সঙ্গ পায়নি মজার ছলে কেউ কখনো এমন রাজার ছেলের গল্পও করেনি। তবুও সে কৈশোরের শুরু থেকেই কল্পনায় সাজায় তার জীবনসঙ্গীকে রাজপুত্রের বেশে। অর্ণবকে দেখার পর থেকেই সেই কল্পনায় রাজপুত্রের রূপ আশির দশকের জল্লাদের মতই গোঁফওয়ালা। কিন্তু রিদওয়ান ভাই এমন কেন বলল তাকে!

রিদওয়ান চলে যাবার পর অর্নিতা অনেকবার জানতে চেয়েছে কি বলল অমন ফিসফিসিয়ে? নুপুর মুখ খোলেনি লজ্জায় রাঙা হয়েছে শুধুই। কিন্তু এখন অর্ণবের কথা শুনে লজ্জা উবে রাগ হচ্ছে। যাবে না সে এমন ভেড়ার ছানার সাথে। ভেড়াই একটা যখনই মুখ খোলে রুক্ষ সুক্ষ গলা শোনায়। অর্নিতার ফোনালাপ শেষ হয়েছে মাত্রই। বিয়ের দিনের পর থেকেই রোজ কল আসে খালামনির। আগেও আসতো তবে এখন আলাপে ভিন্নতা এসেছে অনেক। আগে শুধুই অর্নিতার খোঁজ নিতো, কখন ও বাড়ি ফিরবে কৈফিয়ত চাইতো এখন সেসবের পরিবর্তে সকল কথা রিদওয়ান কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। ছেলেটা কল করলো কিনা, দুজনাতে ভাব ভালোবাসা হবে এমন কোন গল্পই যেন খালামনির একান্ত আলোচনার বিষয়। আর প্রত্যেক মুহূর্তের একটাই চাওয়া সময় কাটুক ঘোড়ার খুঁড়ে টগবগিয়ে । পরীক্ষা শেষ হলেই বউ ঘরে তুলবেন তিনি সে অপেক্ষাতেই এখন দিন গুণছেন। অর্নিতাও কল কেটে আর খেতে বসলো না। খাওয়ার ইচ্ছে মজে গেছে এখন। টেবিল গুছিয়ে দোতলায় উঠে নুপুরকে নিয়ে বসলো অল্প সময়। চোখের পলকেই সাড়ে তিনটা বেজে গেল। অর্ণব নিজের ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই নুপুর বেরিয়ে পড়লো তৈরি হয়ে। দাদী আর অর্নিতার কাছে বিদায় নিয়ে গেইটের কাছে পৌছুতেই অর্ণবও এলো। রিকশা ডেকে নুপুরকে বসতে ইশারা করে দাঁড়িয়ে রইলো সে। তা দেখেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসলো নুপুর। এরপর….. খুব আচমকা তাকে ভড়কে দিয়ে তার পাশেই অর্ণব বশে পড়লো। শিরশিরে মৃদু বাতাস কাঁপিয়ে দিয়ে গেল নুপুরকে। এ কি স্বপ্ন নাকি সত্যি!

_____________

সময়ের জন্য অপেক্ষা চলে না। অপেক্ষায় সময় থমকেও যায় না কারো। রিদওয়ান ঢাকা থেকে চলে যেতেই বাশার শেখ নিজেও গেলেন সেখানে। রাঙামাটির পাহাড় ঘেঁষে এক খন্ড জমি কিনলেন তিনি। রিদওয়ান আর রিমন দুজনেরই অজানা ছিলো বাবার পরিকল্পনা। এদিকে রিদওয়ানেরও নিজ ভবিষ্যৎ নিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা বাবার অজানা। তিনি পুত্রকে আটকাতে চাইছিলেন পাহাড় খন্ডে পুত্র আগেই নিজের অবস্থান ঠিক করেছিলো পর্তুগালের এক শহরে। শেখ পরিবারে হঠাৎ করেই নেমে এলো এক তোলপাড় করা দূর্যোগ। বাবা ছেলেতে শুরু হলো স্নায়ুযুদ্ধ। ততদিনে অর্নিতারও ফাইনাল পরীক্ষা শুরু। রিদওয়ান বাড়িতে একমাত্র মায়ের সাথেই কথা বলতো নিজের সকল পরিকল্পনার। চট্টগ্রামে ঠিক সাত দিন থেকেই ঢাকায় ফিরেছিলো সে। ইচ্ছে থাকলেও একবারও যায়নি অর্নিতার কাছে। রোজ রোজ হাতে গুনে অল্প একটু সময় অর্নিতার সাথে ফোনালাপ করে তারই মাঝে জানিয়ে দেয় তার বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। অর্নিতা অনুভব করতে পারে রিদওয়ানের অপারগতা। শুধুমাত্র অর্নিতা যেন সংসারে বাঁধা না পরে সেজন্যই তার এই বিদেশ বিভূঁইয়ের সিদ্ধান্ত। বাশার শেখের কান অবধি এ খবর পৌঁছুতেই তিনি দেখা করেন অর্নিতার সাথে। সবসময়ই কোমল সুরে কথা বলা খালুজান সেদিন সর্বোচ্চ রূঢ় আচরণেই কথা শুনিয়ে যান অনেকগুলো। বাড়ির কেউ জানতেই পারলো না সে কথা। অর্নিতার শেষ পরীক্ষার দিনই ফ্লাইট ডেট পরে রিদওয়ানের। যাওয়ার সময় বাবা-মা, ভাই-বোন, আর অর্ণবকে দেখতে পেলেও অর্ধাঙ্গিনীর দেখা মেলে না শেষ মুহূর্তে। বুকের ভেতর হু হু করে জেগে উঠা কান্না বুকের ভেতরই চাপা পড়ে রিদওয়ানের। অর্নিতারও হয় একইদশা। বলতে নেই, গত মাস ছয়েকেই একটু একটু করে তাদের সম্পর্ক কাছের হয়েছিলো অনেকটা। ভালো বাসাবাসি দু পক্ষের না হলেও ভালো লাগার শুরুটা হয়েই গিয়েছিল অর্নিতা। রিদওয়ান তাতেই যেন তৃপ্ত হয়েছে। তবুও অপেক্ষা তার এই ভালো লাগার শেষটা যেন ভালোবসাই হয়।

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২০(খ)

‘মুখ নেই তোর…. গাধা! ভালোবাসি মুখে বলতে সমস্যা কোথায়?’

ধমকের সুরেই বলছে রিদওয়ান এদিকে লজ্জায় কখনো ওড়না মুখে পুরছে, কখনো নখ কামড়াচ্ছে আবার বইয়ের পাতা টেনে ছিঁড়ে ফেলছে। ফোনের দু প্রান্তে দুজনের অবস্থা দেখলে এ মুহূর্তে যে কেউ বলেই ফেলবে দুটোর মাথায় গন্ডগোল আছে বিরাট মাপের গন্ডগোল। রিদওয়ান যাওয়ার পর থেকেই তাদের ফোনালাপ বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। আজকাল অর্নিতাকে পড়ার টেবিল আর বিছানা ছাড়া সচরাচর কোথাও পাওয়া যায় না অবশ্যই পাশে ফোন থাকবে। রিদওয়ান যেতে যেতে অর্নিকে শাসিয়ে গিয়েছিল, ‘বউ ফেলে বিদেশ যচ্ছি বড় মাপের ত্যাগ স্বীকার করে। তোর মেডিকেল চান্স যেন মিস না হয় মনে রাখিস, চান্স মিস হলে আমার এই ত্যাগের প্রতিদানে বছরে বছরে বাচ্চার মা হতে হবে।’

রিদওয়ানের এই নির্লজ্জ কথাবার্তায় অর্নিতার নিঃশ্বাস আটকে আসা অবস্থা। প্রথম প্রথম একটু আধটু এমন বললেও পরে একেবারেই লাগামহীন হয়ে পড়েছে সে। অর্নিতারও লাজ কমেছে কিছুটা। আজকাল সে সহসাই অপ্রস্তুত হয় না। এই তো কদিন আগেই সে পড়া রেখে নুপুরদের বাড়ি গেল প্রথমবার। অল্প সময়েই ফিরবে বলেও একরাত পার করে ফিরলো। সে রাতে ঝড়বৃষ্টি থাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল নুপুরদের। ওয়াইফাই কানেকশন নেই উপরন্তু, অর্নিতার ফোন চার্জ নেই বন্ধ পড়েছে । রিদওয়ানের কাছে নুপুরের নম্বর নেই আর মাথায়ও এলো না অর্ণবের কাছ থেকে নেওয়ার। সব মিলিয়ে একটা দিন-রাত আর কথা হলো না দুজনার। পরের দিন বাড়ি ফিরতেই দাদী থেকে শুরু করে বৃষ্টি আপু পর্যন্ত প্রত্যেকের কাছেই শুনতে হলো, ‘অর্নিতা তোর জামাই পাগল পাবনা পাঠা।’

অর্নিতার সাথে যোগাযোগ না করতে পেরে অর্ণব আর তার আব্বু ছাড়া বাকি সকলকেই সে ফোন করে করে বউকে চাই বলে পাগল করে দিয়েছেে। সেদিন সকল লজ্জা কাটিয়ে সেই প্রথম ধমকে উঠেছিল সে, ‘এ্যাই তোমাকে বিদেশে কে যেতে বলেছে, হ্যাঁ! বউ কি চুরি হয়ে গেছে? একটা দিন কথা না হওয়াতে এমন করতে হবে? লোকে কি ভাববে এসব দেখলে দুনিয়ায় আর কারো বউ নেই নাকি৷’

কে কি ভাবলো সে নিয়ে রিদওয়ানের মাথাব্যথা নেই। তার এক কথা, ‘আমার বউ নিয়ে আমি অস্থির হবো না তা কি হয়! কত সাধের বউ আমার।’

এরপর সত্যিই আর মুখ খোলার জো নেই অর্নিতার৷ তবুও রোজ কপট রাগের ভাণ করে। চোখের পলকে যখন মাস কতক পেরিয়ে অর্নিতার পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলো সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিলো আরেক পরীক্ষার পড়া। মেডিকেলে চান্স পেতেই হবে রিদওয়ান জোর খাটিয়ে কথাটা বললেও মনে মনে সে ভেবেই নিয়েছে সরকারিতে চান্স না হলে সে টাকা ঢালবে খুব৷ বেসরকারিতেই না হয় পড়বে তার বউ। এ নিয়েও তার বেড়েছে ব্যস্ততা। অর্নিতা পড়ায় ব্যস্ত রিদওয়ান কাজে। পর্তুগালের লিসবনে গিয়েছিলো সে এক বন্ধুর মাধ্যমে কাজ পেয়ে। কাজটা ছিলো কোন এক রেস্টুরেন্টের। পার্ট টাইম জব পেয়ে গেলেও পরবর্তীতে আরও অনেক খোঁজ নিয়ে সে যুক্ত হয়েছে কার কোম্পানিতে। প্রথম প্রথম পর্তুগিজ না জানার ফলেই রেস্টুরেন্ট জবটাতে ভীষণ ঝামেলা পোহাতে হতো৷ দ্বিতীয় জবটার সময় কিছুটা শেখা হয়ে গেছে সে দেশীয় ভাষা তারওপর সেখানে ইংলিশটাই বেশি কাজে দিয়েছিল। দুজনের দু দিককার পরিশ্রম একটাই স্বপ্নের পেছনে ঢালছিলো তারা। বিদেশে এসে মা, ভাই, বোনের সাথে সম্পর্ক ঠিক থাকলেও সম্পর্কের সুতো ঢিল হয়ে গেছে বাবার সাথে। বাশার শেখ খোঁজ নেন না বড় ছেলের আর ছেলেও সরাসরি নেয় না বাবার খোঁজ। তবুও ভালো কাটছে জীবন ছন্নছাড়া রিদওয়ানের। আপাতত তার অপেক্ষা শুধু অর্নির ভর্তি পরীক্ষার ফল জানার।

________

সময়গুলো খুব ফ্যাকাশে কাটছে নুপুরের। ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার আগে থেকেই যোগাযোগ কমে এসেছে অর্নিতার সাথে। না চাইতেও বান্ধবীকে স্পেস দিতে হচ্ছে এই যেন বড় দুঃখ তার। আজকাল তো কোন বাহানাতে অর্ণবকেও দেখার সুযোগ নেই। সকালে নাশতা সেরে কিছুক্ষণ নিজের ঘরেই এটা সেটা নিয়ে। দশটার পর টিভি খুলে বসে বিখ্যাত সব জলসা আর জি বাংলার সিরিয়াল দেখতে। জীবনে সবচেয়ে অপছন্দের কাজটাই ছিলো তার বাংলাদেশের নারীদের অতি প্রিয় সব সাংসারিক কূটনীতি সমৃদ্ধ সিরিয়ালগুলো অথচ পড়াশোনার বিরতিতে ছোট মায়ের সঙ্গ তাকে সেসবই দেখার অভ্যাস গড়ে দিয়েছে। প্রায় এগারোটা পর্যন্ত এসবে সময় ব্যয় করে আস্তে ধীরে বাথরুমে ঢোকে সে। গোসল, নামাজ আর খাওয়ার পর এক ঘন্টার ভাতঘুম শেষে সাড়ে তিনটায় বের হয় টিউশনিতে। চারটা থেকে টিউশনি তার স্থানও বাড়ি থেকে রিকশায় দশ মিনিটের রাস্তা। তবুও সে আগেই বেরিয়ে হাঁটতে হাটতে এগিয়ে চলে পথটুকু৷ আজকাল সময় খরচের জন্যই যেন তার এই পায়ে চলা পরিশ্রম। মন খারাপ হয় অর্ণবকে ভেবে সেই মন খারাপটুকুকেও যেন চলতি পথে টানতে টানতে ক্লান্ত করে দিতে চায়৷ পাষাণ সেই জল্লাদকে মনে করে লাভ কি তার! সে ব্যক্তি জানে তো তার মনের ঘরের তান্ডব চলে লোকটার। অথচ কি অনায়েসেই না তাকে এড়িয়ে চলে মানুষটা! সেদিন তো তার জন্মদিন বলেই এসেছিলো অর্নিতা তাদের বাড়িতে। নুপুর ভেবেছিলো লোকটার কানে পৌছুবে তার জন্মদিনের কথা আর তা জেনে নিশ্চয়ই একটিবার শুভেচ্ছা জানাবে৷ কিন্তু লোকটা সব জেনেও উইশ করেনি এমনকি অর্নিতাকে দিতে এসে তাদের গেইটের বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিল। নুপুরের বাবা কত করে বলল, ভেতরে এসো একটু বসে যাও। শুনলো না সে কথাটা। সেদিনের কথা ভাবতে ভাবতেই নুপুর পৌছে গেল ছাত্রের বাড়ির দরজায়৷ এমনই হয় তার আজকাল। লোকটার কথা ভাবতে ভাবতে কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে যায় টেরই পায় না। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বাড়ির ভেতর ঢুকে যায় নুপুর। তাকে ভেতরে ঢুকতে দেখেই উল্টো দিকে পা বাড়ায় অর্ণব৷ হ্যাঁ অর্ণব রোজই এমন করে। কবে থেকে ঠিক মনে পড়ে না তার সে আনমনেই এসে দাঁড়ায় এ পাড়ার মোড়ে৷ যেদিন প্রথম সে নুপুরকে পাশে বসিয়ে পৌঁছে দিয়ে গেল তার ছাত্রের বাড়িতে সেদিনের পর হঠাৎ করেই সে এসে উপস্থিত হয় এখানটায়। রোজ ঠিক এ সময়েই তার অবচেতন মন অপেক্ষা করে এই মেয়েটিকে এক পলক দেখার জন্য। তোলপাড় করা বুকের ভেতর টিমটিমে এক আলো হয়ে ধরা দিচ্ছে মেয়েটা তাকে৷ মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় এগিয়ে এসে আদেশ করে, চলো তো আমার সাথে৷ একটা দুপুর কাটিয়ে নেবো নিরালায় কোন নির্জনতায়। পরমুহূর্তেই মনে হয় এ অন্যায় সে কি করে করবে! বহুদিন ধরেই খালুজান তার প্রতি বিরূপ আচরণ করছেন৷ ভয় হয় অর্নিতাকে নিয়ে তিনি বোধহয় রিদওয়ানের বিয়েটা নিয়ে খুশি নন৷ তারওপর বৃষ্টির আচরণ তাকে ভীত করছে অনেক বেশি। জটিল জীবনটাকে কিছুতেই সরল সমীকরণে আনা যাচ্ছে না বলেই আরও বেশি করে লুকিয়ে রাখছে নিজের অনুভূতিকে। নুপুর মিষ্টি একটা মেয়ে, প্রাণচঞ্চল আর ভালো একটা মেয়ে সে ভালো থাকুক তার জগতে৷ অর্ণবের জীবনের প্যাচ লাগা জালের ভেতর আটকে গেলে তাকে ছটফটিয়ে দম ত্যাগ করতে হবে এমনটা ভেবেই আরও আড়াল হয়ে যায় অর্ণব৷ নিজের মতই সবটা ভেবে ভেবে আর এগোয় না সে কিন্তু আজ ঠিক ধরা খেয়ে গেল৷ অর্ণব ভেবেছিলো নুপুর তাকে দেখেনি। সেও এবার জায়গাটা ত্যাগ করার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে ভেসে এলো চেনা স্বর, ‘পুরুষ মানুষ কাপুরুষ হয় জানতাম তাই বলে এতোটা আজ বুঝতে পারলাম।’

-মানে!

-রোজই মনে হতো কেউ বুঝি নজর রাখছে৷ আম হাতেনাতে চোর ধরেই ফেললাম।

ফূর্তির সঙ্গেই বলছে নুপুর। অর্ণব কপাল কুঁচকে দাঁতে ঠোঁট চেপে নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে নুপুরের দিকে তাকিয়ে।

-এভাবে তাকাচ্ছেন কেন?

-বোকার হদ্দ দেখলে আর কেমন করে তাকানো যায়?

-এহ, ধরা খেয়ে এখন ড্রামা করছেন। আপনি সবসময়ি আসেন আমি টের পাই৷ কি দেখেন রোজ!

শেষের কথাটা বড় আকুলতা মিশিয়ে বলল নুপুর। অর্ণবের খারাপ লাগছে মুখের ওপর মিথ্যে বলতে তবুও বলতে হবে।

-একটা কাজে এসেছিলাম। ব্যাপারটা কাকতালীয় তাই যেচে কোন ভুল ধারণ পুষে ফেলো না।

-কাকতালীয়!

-হ্যাঁ

-বুকে হাত রেখে বলুন তো।

– তুমি না টিউশনিতে এসেছিলে এখানে দাঁড়িয়ে বকবক করছো কেন?

-যাচ্ছি। হুহ…. ঢং দেখলে আর বাঁচি না। লুকিয়েই রাখেন নিজের আবেগ৷ একদিন আমার জন্য ঠিক কাঁদাবো আপনাকে ব্যাটা জল্লাদ। কিছু না কিছু তো ফিল করিসই বললে কি হয়! নাকি আমি কালো বলে অবহেলা করছিস?…… বিড়বিড় করতে করতেই চলে গেল নুপুর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্ণবও চলে গেল জায়গাটা ছেড়ে। সত্যিই সে ফিল করে নুপুরকে, ফিল করে সেই আবছা ভোরে দেখা শ্যামা কন্যার তেল চিটচিটে মুখের মায়াকে। ফিল করে সেই ভেজা চুলের স্নিগ্ধতায় ডোবা মেয়েটিকে কিন্তু ভাগ্য! তার ভাগ্য যে বড্ড দূর্ভাগা। ঠিকই বলে গেল মেয়েটা কাঁদতে হবে তাকে এই মেয়েটির জন্য যদি নিজেকে এখনই না সামলায়। যত দিন গড়াবে হদয়ের দূর্বলতা ততোই হবে গাঢ়।

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-১৯

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৯ (ক)

মাথার ওপর এক ফালি চাঁদ, সামনে শান্ত তটিনী আর পাশে একান্ত ব্যক্তিগত চন্দ্রিমা। আঁধার ঘেরা শান্ত এই নদীর পাড়ে এক খন্ড সুখ পাশে নিয়ে বসে আছে ভাবতেই রিদওয়ানের অন্তর পুলকিত হয়। থেকে থেকে বাতাসের ঝাপটা গায়ে লাগে সেই সাথে নাকে এসে লাগছে অর্নিতার গায়ের সুবাস। আধখাওয়া চাঁদের শুভ্র আলোয় নদীর পানি চিকচিক করছে। ঝিরিঝিরি বাতাসে গায়ের পাতলা শাড়ি ভেদ করে খুঁচিয়ে দিচ্ছে পশমের গোড়ায়। দাদীর সাজিয়ে দেওয়া বেশে রিসোর্টে এলেও তা একটু আগেই বদলে নিয়েছে অর্নিতা। গায়ে জড়িয়েছে রিদওয়ানের দেওয়া পাতলা হ্যান্ডপেইন্টেড সুতির শাড়ি আর চিকন এক গাছি স্টিলের চুড়ি। রিদওয়ান চট্টগ্রামে নিজস্ব গাড়ি নিয়ে যায়নি বলে বাড়ি থেকে উবারে গাজীপুর এসে নামে ঠিক রিসোর্টের সামনে। আগে থেকে বুকিং না থাকায় প্রথমেই তাই থাকার ব্যবস্থা করে অর্নিকে তাদের নির্দিষ্ট কক্ষে বসিয়ে দেয়। আকাশ তখন সন্ধ্যের আয়োজনে রাঙা গৌধূলিকে বিদায় জানাতে তৎপর। অর্নি বসে বসে দেখছিলো কক্ষের ভেতরটা। রিদওয়ান তার দৃষ্টি খেয়াল করে বলল, ‘ ওপাশের দরজাটা খুলে সামনে যা দারুণ জায়গা ওপাশটায়।’

অর্নিতা নিঃশব্দে তাই করলো। দরজা খুলতেই আবছা আঁধার ছাপিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকলো অবাধ্য হাওয়ার দল। চক্ষু মেলে সামনে লক্ষ্য করতেই চোখে পড়লো কাঠের সরু পথ যার শেষ টলটলে জলের ধারার সূচনাতে। সহজ করে বলায় যায় বেলকোনির মত অংশটা শেষ হয়েছে জলের শুরুটা যেখানে। লেকের মত লম্বা সে পুকুরটাতে পাশাপাশি অনেকগুলো বেলকোনিসহ কক্ষ। প্রতিটাই বোধহয় অর্নিতাদের রুমের মত বড়সড় একটি কাঠের ফ্ল্যাট। দরজা খুলতেই চমৎকার একটি বসার ঘর তার পেছনেই একটা বেডরুম, লাগোয়া বাথরুম আর এই বেলকোনিটা। মজার ব্যাপার হলো এখানে কোন কিচেন নেই। খাবারের দিকটা সম্পূর্ণ কতৃপক্ষের হোটেল ম্যানেজমেন্টেই দেখা হচ্ছে। রিদওয়ানের এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। একটি মাত্র রাত আছে তার হাতে এরপর আবার তাকে ফিরতে হবে চট্টগ্রামের সেই পাহাড় কাটা ঝোপে জঙ্গলে। আব্বুর পরিকল্পনা সে জানে না তবে এইটুকু তার বোঝা হয়ে গেছে, আব্বু খুশি নয় তার বিয়েতে। তাইতো সে আজ কাউকে না জানিয়েই ছুটে এসেছে প্রিয় চন্দ্রিমাকে একটুখানি কাছ থেকে দেখতে। ভাগ্যিস, দাদী অনুমতি দিয়েছেন নইলে অর্ণব পর্যন্ত অনুমতির আবেদন তার পক্ষে অসম্ভব হতো। হাতে সময় কম আর সুন্দর মুহূর্তটা ফুরিয়ে না যায় তা ভেবেই সে নিজের ব্যাগ থেকে শপিং ব্যাগটা বের করে এগিয়ে দেয় অর্নিকে।

– হুট করে আসা তো তেমন কিছু আনতে পারিনি তোর জন্য। দ্যাখ তো এটা পছন্দ হয় কিনা!

অর্নিতা হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় ব্যাগটা। আলতো হাতে খুলে দেখতে পায় শুভ্ররঙা শাড়ি আর সাথেই দু মুঠো চুড়ি। ভারী পছন্দ হয় শাড়িখানা তা যেন অর্নিতার চোখ দেখেই বুঝে নেয় রিদওয়ান। সেও সুযোগ পেয়ে আদেশ করে, ‘অত ভারী শাড়ি পরে কতক্ষণ থাকবি৷ ওটা বদলে এটা পরে আয় আমি বাইরে যাচ্ছি খাবারের অর্ডার করতে।’

রিদওয়ান রুম থেকে বের হতে গিয়েও ফিরে আসে আবার, ‘খাবার কি রুমে খাবি না বাইরে?’

– যেখানে বলবেন….

গাড়িতে বসার পর থেকে এ পর্যন্ত সময়ের মাঝে এই প্রথম কথা বলল অর্নিতা। রিদওয়ান বেরিয়ে যেতেই সে ঝটপট শাড়ি বদলে নেয়। রিদওয়ান ফিরে এসে দেখলো শাড়ি গহনায় এখনো পুচকে মেয়েরাকে পাক্কা বিবাহিত রমনীই লাগছে। হঠাৎই তার মনে হলো অপরিচিত পরিবেশে এত স্বর্ণালংকার রিস্কি না হয়ে যায়। হালকা পাতলা বলেও প্রায় ভরি তিনের বেশি স্বর্ণ আছে মেয়েটার গায়ে। চুড়ি দুটি, এক জোড়া দুল আর মোটা চেইন এসব দেখেই সে আবার বলল, চাইলে ওগুলো খুলে রাখতে পারিস।

রিদওয়ানের দৃষ্টি অনুসরণীয় করে অর্নিতা নিজের গলায় হাত দিল। ভালো হলো তারও ইচ্ছে করছিল না এমন বালা, দুল পরে চলতে তবে গলারটা মন্দ লাগছিলো না। সে একে একে প্রথমে চুড়ি তারপর দুল খুলে গলায় হাত দিতেই রিদওয়ান বারণ করল।

-ওটা থাক চল বাইরে যাব।

এরপরই দু জনে চলে এসেছে রিসোর্টের উল্টো দিকে নদীর কিনারায়। কেটে গেছে অনেকটা সময় এরই মাঝে একবার উঠেছিল দুজনেই৷ কফি খেয়ে আবারও ফিরে এসে বসে আছে একই জায়গায় পাশাপাশি, কাছাকাছি। অর্নিতার কাছে এ শুধুই বিয়ের পরের একটি বিশেষ সাক্ষাৎ যা রিদওয়ানের কাছে মোটেই নয়। সে এখানে এমন প্রকৃতির সম্মুখে আজ মনের মানুষটিকে নিয়ে আসার পেছনে লুকায়িত আছে বিশেষ কিছু কারণ। অনেক তো হলো সময় নেয়া এবার ভণিতায় না গিয়ে কথাটুকু সেরে নেওয়ার তাগিদ অনুভব করল। আঁধারের মাঝেই ঘাড় ফিরিয়ে অর্নিতাকে একবার দেখে নিয়ে বলা শুরু করল, ‘আমার কিছু কথা ছিল অর্নি৷ তোকে আজ মূলত সেই কথাগুলো বলতেই এখানে নিয়ে আসা।’

শো শো বাতাস আর নদীর শান্ত সুরের কলকল ধ্বনিতে বেয়ে চলা এরই মাঝে অতি পরিচিত কণ্ঠের ঝংকার তোলা বাক্য কেমন শিউরে দিলো অর্নিতার গা। ক্ষণে ক্ষণে এক ভালো লাগার কাঁপন অনেকক্ষণ ধরেই তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল নতুন অনুভূতিতে। এবার যেন কাঁপন থেকে আতঙ্কিত বরফখণ্ডে পরিণত করলো। কি এমন বলার ছিল যার জন্য এই অদূর নির্জনতার ছাউনিতে আসা হলো! বেশি সময় সে ভাবার সুযোগ পেলো না রিদওয়ান এরই মাঝে বলতে শুরু করলো, বরাবরই জেনে এসেছি তুই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখিস। আমিসহ বাড়ির প্রায় প্রত্যেকেই জানে সে কথা। তোর বিয়ে নিয়ে কখনো আগ্রহ চোখে পড়েনি কারো অনেস্টলি স্পিকিং, আমি নিজেও অনেক অনেকবার লক্ষ্য করেছি তোকে নিজ স্বার্থেই হয়ত। শিবলী ভাইয়ের সাথে বিয়ে নিয়ে কখনোই তোকে খোশমেজাজে কথা বলতে দেখিনি৷ এমনকি আংটিবদল, আদারস ফাংশনে তোদের দেখা সাক্ষাতেও বিন্ন কিছু চোখে পড়েনি তবে তোর সকল আনন্দ উল্লাস আর আগ্রহের দিক শুধুই তোর পড়াশোনায় দেখেছি আমরা। সেই সুবাদেই তোর স্বপ্ন জানি৷ আর…. ‘

থেমে গেল রিদওয়ান। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে পুনরায় বলতে লাগল, ‘তোর বয়সও কম আর আমিও প্রতিষ্ঠিত নই৷ প্রতিষ্ঠিত বলতে অনেক টাকা পয়সা বোঝাচ্ছি না৷ আমার আসলে নির্দিষ্ট কোন পারমানেন্ট কাজকর্ম এখনো হয়ে উঠেনি। তাই পরিবার চাইলেও আমি তোকে এখনই বাড়িতে নিতে চাইছি না এতে কি তোর কোন আপত্তি আছে?’

রিদওয়ানের প্রশ্নের জবাব কি হওয়া দরকার বুঝতে পারলো না অর্নিতা। তবুও তার হ্যাঁ তে হ্যাঁ হওয়া জরুরি ভেবেই ধীরকণ্ঠে বলল, ‘না’

-জোরে বল।

-না আপত্তি নেই।

-হু থাকার কথাও না। আমিও তো তোর জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত।

এ কথাটা অর্নিতার কানে খুব বাজলো। বিয়ে নিয়ে যেখানে কোন আবেগটাই ছিল না সেখানে কাঙ্ক্ষিত, অনাকাঙ্ক্ষিতের কথা আসে কি করে!

-আমি তোকে তোর প্রয়োজনের পুরো সময়টা দিতে চাই। বিয়ে মানেই বন্ধন, সংসার এসব থিওরিতে আমি বিশ্বাসী না। আমার তোকে ঘিরে অনুভূতির কথা বোধহয় তোর অজানা নয় তাই আমার জীবনে তোকে পাওয়াটা কতো বড় পাওয়া তুই আন্দাজ করতেই পারিস। ঠিক এ কারণেই আমি আজ তোকে পরিষ্কার করে জানিয়ে দিতে চাই আমি তোকে তোর প্রয়োজনের পুরো সময়টা দিয়ে যাব যেটুকু তোর স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রয়োজন। তোর কাছে থাকলে, আশেপাশে থাকলে তা আমি কখনোই পারব না। নিজেকে আটকে রাখার মত মহাপুরুষ আমি নই। এজন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি দেশের বাইরে চলে যাব আর তা অতিশিগ্রই।

চমকে উঠে অর্নি; রিদওয়ান ভাই বিদেশে চলে যাবে!

– আগেই কিছু ভাবিস না। আমি চলে যাব বলেছি আবার ফিরেও আসব। তোর স্বপ্নপূরণের জন্যই আমার এই দূরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তারমানে এই না তুই ততদিন মুক্ত পাখির মত উড়তে থাকবি। ডানা অবশ্যই মেলবি তবে তার গন্ডি আমার বাইরে যেন না হয়। কাল থেকে তুই ঠিক আগের মতই থাকবি, পড়াশোনা যেমন করতি তেমনই করবি আর… মনে মনে তোর জীবনে আমার জন্য নির্দিষ্ট একটা জায়গা তৈরি করবি৷ তোর জন্য আমি সব করব তুই শুধু আমার জন্য ওইটুকুই করিস। আমার নামের জায়গায় ভুল করেও যেন অন্য কেউ ঠাঁই না পায়।

শীতল কণ্ঠে যেন কঠিন কোন থ্রেট দিয়ে দিলো রিদওয়ান। কথা শেষ করেই তারা ফিরে গেল রাতের খাবার খেতে। খাওয়া শেষে দুজনে রুমে ফিরলেও রিদওয়ান বসে রইলো বসার ঘরের ডিভানটাতে। অর্নিতা ততক্ষণে বেডরুমে ঢুকে গা এলিয়েছে বিছানায়। কারোই দু চোখের পাতায় ঘুমের রেশ মাত্র নেই৷ যেন সবেই তারা ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। তোলপাড় করা ভেতর- বাহির নিয়ে ছটফটায় দু পাশে দুজন৷

__________________

বহুদিন পর আজ বেশ রাত করেই বাড়ি ফিরলো অর্ণব৷ সারা বিকেল, সন্ধ্যা সাভারের সেই ছোট্ট গ্রামটাতে কাটিয়ে সে নিজ শহরে ফিরেছিল রাত আটটারও পর। ইচ্ছে হয়নি বাড়ি ফিরতে তাই এদিক সেদিক আরও কিছুক্ষণ কাটিয়ে সে রাস্তার পাশে এক চায়ের দোকানে বসে কল দিয়েছিল দাদীকে। প্রথমে রেগে বকাবকি করলেও পরে বেশ শান্ত গলায় বলল রিদওয়ান এসেছিল। তারা ঘুরতে যাবে আজ আর ফিরবে না তাই অনুমতি নেওয়ার জন্যই দাদীকে দিয়ে কল করিয়েছিল ছেলেটা। অর্ণব জানিয়ে দিলো দাদীর অনুমতিই তো যথেষ্ট সে কি বলবে আর। দাদীর সাথে কথা শেষে খালামনিকে কল দিলে তিনিও জানালেন একই ইস্যু ব্যস আর কোন কথা নেই তবে৷ এরপর যখন চোখে পড়লো নুপুরের ছোট্ট একটি মেসেজ, ‘আপনি ঠিক আছেন? না মানে হঠাৎ নিজেই কল দিলেন যে!’

মেয়েটা কি ভাবে সে ঠিক নেই বলে তাকে কল করেছে? আশ্চর্য! আগে কি কখনও সে ঠিক না থাকলে কল করতো নুপুরকে? ইচ্ছে করছিল কল দিয়ে সে প্রশ্ন করবে মেয়েটা এমন কেন ভাবলো? নাহ, অর্ণব কল করলো না তাকে। এমন করে ছোট ছোট কথাবার্তাই একসময় লম্বা হয়ে উঠবে। দরকার কি যেচে পড়ে কাউকে এভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে ফেলার! অর্ণব আর ভাবতে চাইলো না তাকে নিয়ে। বাড়ি ফিরে সোজা ঢুকলো নিজের ঘরে৷ দাদী আজ অপেক্ষায় নেই তার সাথে খাওয়ার জন্য৷ অর্নিটাও নেই বাড়িতে ক’দিন পর হয়তো একেবারের জন্যই থাকবে না আর৷ গায়ের পোশাক বদলে নিয়ে সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে গেল বারান্দায়। আজ রাতে তার খিদে পাবে না, শুধুই থাকবে সিগারেটের তৃষ্ণা। মাথার ভেতর চলতে থাকবে অজস্র পরিকল্পনা আর হাতে জ্বলবে সিগারেট। কালকের ভোর হবে নতুন করে নতুন দিনের সূচনা নিয়ে। এতদিনের এঁকে রাখা ছক আবার নতুন করে সাজাতে হবে তাকে।

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৯(খ)

রাতটা কাটলো দু ঘরে দুজনার। অর্নিতা হয়ত উদগ্রীব ছিল এই ভেবে মানুষটা নিশ্চয়ই পাশেই থাকবে রাতভর। স্বামীসুলভ আচরণ সে চায় না রিদওয়ান করলেও সে নিতে পারতো না। কিন্তু এত বেশি নির্লিপ্ততা সে আশা করেনি। অনেকটা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে পরেই ঘুমিয়েছে সে। রিদওয়ান বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারেনি। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা জার্নি, আধ ঘন্টার রেস্ট তাও কিনা সোফায় বসে এরপর আবারও ঢাকা টু গাজীপুর জার্নি। তারপরের সময়টা নদীর পাড়ে বসেই কেটেছে। সব মিলিয়ে শরীরটা খুব করে বিছানা চাইছিলো বলেই বোধহয় সে আরও আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ভোরের আলো ফুরতেই আবার সে ঘুম তার দেহের ব্যথায় পগারপার। বড্ড ভুল হয়েছে ডিভানে ঘুমানোটা। আসলে অর্নিতাকে সে ভালো যতই বাসুক হুট করেই পাওয়া অধিকারটা কেন জানি মন মানতে চাইছে না। হতে পারে অর্নিতার নির্বিকার আচরণ তাকে অপ্রস্তুত করছে ভেতরে ভেতরে। তাইতো সুযোগ থাকার পরও ও ঘরে একই বিছানায় থকতে ভীষন ইতস্তত বোধ করছিল। কিন্তু এখন আর শরীর ঠিক নেই। যাওয়ার আগে একটু ঘুম তৃপ্তির না হলে ফেরার পথে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ফোনে সময় দেখে নির্দিষ্ট একটা সময়ের এলার্ম লাগিয়ে চলে গেল বেডরুমে। ভোরের ফ্যাকাশে আলো বেলকোনির পর্দা ভেদ করে ঘরটাকে করেছে কুয়াশায়ময় ঘোলাটে ফর্সা৷ বিছানার দিকে এগুতেই চোখে পড়লো এলোমেলো শাড়ি গায়ে ঘুমন্ত অর্নিতা, বালিশের পাশেই তার আয়াতাকার চশমা সেই সাথে মুঠোফোনটা। নিঃশব্দে বিছানায় উঠে প্রথমেই মোবাইল আর চশমাটা সরিয়ে রাখলো রিদওয়ান সাইড টেবিলে। নিজের ফোনটাও রেখে দিলো সেখানে। গায়ের টি শার্টটা খুলবে না খুলবে না করেও খুলেই ফেলল। অভ্যাস তার বরাবরই উদোম গায়ে ঘুমানোর। আজ অর্নিতার জন্যই খুলতে চাইছিলো না পরমুহূর্তেই মনে হলো এই মেয়েটির সামনে সাধু সাজার মানেই হয় না। এই প্রথম নয় একই বাড়িতে থাকার সুবাদে সে আগেও অর্নিতার সামনে উদলা গায়ে পড়েছে। বালিশে মাথা এলিয়ে চোখ বুঁজতেই টের পেল তার ভেতরে ভেতরে কিছু হচ্ছে। কি হচ্ছে কেন হচ্ছিলো জানে না শুধুই টের পাচ্ছে পাশের মানুষটির উষ্ণতা তাকে আকর্ষণ করছে তীব্রভাবে।কয়েক মিনিট দম আটকেই যেন গড়াগড়ি খেল বিছানায় তবুও ক্লান্ত চোখ জোড়ায় ঘুম নামলো না৷ আসার কি কথা! শত জন্মের একটি চাওয়া যখন পাওয়া হয়েও হয় না তখন তনুমন শান্ত হয় কেমন করে! ঝট করে চোখ খুলে ফেলল রিদওয়ান৷ অপলক তাকিয়ে রইলো হৃদয়পটে বসত করা মানবীর দিকে। কিছু সময় কেটে গেল নিষ্পলক দৃষ্টি ফেলে। ততক্ষণে আবছা আঁধারও হারিয়ে গেছে উজ্জ্বল দিনের সূচনায়। বড় করে শ্বাস টেনেই ধীরস্থির এগিয়ে এলো রিদওয়ান একেবারে অর্নিতার মুখের কাছে। বড্ড আলতো আর স্নেহের মাঝে ভালোবাসার আঁশ মিলিয়ে তপ্ত চুমু এঁকে দিলো অর্নিতার কপালে। নিজেকে আর এখানে রাখলে সে ক্রমেই নিয়ন্ত্রণ হারাবে বুঝতে পেরে বিছানা থেকে নেমে গেল। পাশেই রাখা টি শার্ট গায়ে জড়িয়ে নিজের ফোনটা তুলেই বেরিয়ে পড়লো কক্ষ থেকে। বাইরে থেকে লক করে চাবি সঙ্গে করেই সে রিসেপশনে গেল। এত ভোরে কেউ থাকবে কি থাকবে না সংশয় নিয়েই গেল। ভাগ্য প্রসন্ন পেয়ে গেল রিসেপশনিস্ট সাথে দুজন রিসোর্টেরই কর্মী। রিদওয়ান বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই ধড়ফড় করে উঠে বসলো অর্নিতা। বুক ওঠানামা করছে তীব্র বেগে সেই সাথে কাঁপছে পুরো দেহই। মানুষটা এমন কেন! এত কাছে এসে কেমন এলোমেলো করে দিলো তাকে। এইটুকুনি স্পর্শেই তার এত বেহালদশা কেন বুঝে পায় না অর্নিতা। স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গতা কি খুব ভয়ানক কিছু! তার মন তো এমনই বলছে অন্তত এই মুহূর্তে নিজের অবস্থায় তাই মনে হচ্ছে।
________

-খালি রুম পাওয়া যাবে?

রিদওয়ানের আকস্মিক প্রশ্নে অবাক হলো তিনজনই৷ এরা বোধহয় তিনজনই জানে রিদওয়ান তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে এখানে। সে বুঝতে পারলো সামনের মানুষগুলোর বিষ্ময়ের কারণ তাই নিজের মতই বলল আবার, ‘ ওয়াইফের সাথে মনোমালিন্যতা হয়েছে। দু তিনটা তাই আলাদা ঘুম দেব ভাবছি।’

এবার ঠোঁট চেপে হাসলো তিনজনই। রিসেপশনিস্ট ছেলেটা তার কম্পিউটারে নজর ফেলে কিছু চেক করলো।

-রুম একটা বুকড কিন্তু গেস্টরা আসবেন দুপুরে। আপনি চাইলে সেটা নিতপ পারেন তবে বারোটার মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে।

-ব্যাটার! চাবি….

ওয়ালেট বের করে হাফ ডে পেমেন্ট করে চাবি নিয়ে গেল রিদওয়ান। টানা তিনটি ঘন্টা ঘুমিয়ে সাড়ে দশটায় ঘুম ভাঙলো তার বাবার ফোনকল পেয়ে। বুঝতে সময় লাগলো সে কোথায় আছে পরমুহূর্তেই মনে পড়লো সব। কল রিসিভ না করে প্রথমেই গেল অর্নিতার কাছে। গেট লক! মনে পড়লো নিজেই করেছিল। আহ, এত বেলা হলো অর্নিতা নিশ্চয়ই জেগে গেছে। ভয় পাচ্ছে না তো সে আবার? খিদেও লেগেছে নিশ্চয়ই। অস্থির হয়ে এক হাতে মাথার চুল টানতে টানতে অন্যহাতে লক খুলে ঘরে প্রবেশ করল রিদওয়ান। দ্রুত পায়ে বেডরুমে ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অর্নিতা ঘুমাচ্ছে এখনো। আবার খেয়াল হলো মেয়েটার অবস্থান দেখে। শাড়ি, চুল পরিপাটি এমনকি মুখটাও একদম স্নিগ্ধ, সতেজ। তবে কি সে ঘুম থেকে আগেই উঠে তৈরি হয়ে আছে? রিদওয়ান একেবারে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে হাত রাখলো অর্নিতার মাথায়।

-এ্যাই অর্নি উঠে পড়। নাশতা করবি না!

মাত্রই চোখ লেগেছিল তার। রিদওয়ানের ডাক শুনে চোখে ঘষে তাকালো। কাত হয়ে শোয়া ছিল এবার উঠে বসলো।

-অনেকক্ষণ আগেই উঠেছিলি?

-নাহ একটু আগেই৷

-ভয় পেয়েছিলি? কল করিসনি কেন আমাকে?

-ভয় পাইনি৷

– আচ্ছা একটু অপেক্ষা কর আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। নাশতা সেরে রওনা দেব কেমন!.
অর্নিতা ঘাড় কাত করে সায় দিলো। মিনিট বিশেকের মাঝেই দুজন পুরোপুরি গুছিয়ে বেরিয়ে গেল রিসোর্ট থেকে। নাশতার জন্য রিদওয়ান খুঁজে বেছে নিয়ে গেল গাজীপুরের খুব নামী এক হোটেলে। খাসীর মাংস, পরোটা, আর কষা হাসের মাংসে শেষ হলো নাশতা। অর্নিতা তেমন কিছুই খেতে পারেনি। রিদওয়ান তা লক্ষ্য করেই অর্নিতার জন্য পরোটা, ডিম ভাজা পার্সেল নিলো। ট্যাক্সি নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হতেই আবারও কল এলো বাবার নম্বর থেকে। এবার কিছুটা আতঙ্কিত হয়েই সে কলটা ধরলো৷ মিনিট তিনেকের কনভার্সেশনে অর্নিতা বুঝে গেল রিদওয়ানকে ফিরতে হবে বিকেলের আগে। তবে চুপ করে রইলো শোনার জন্য রিদওয়ান কি বলে।

– তোর ফোন থেকে নুপুরকে কল করতো।

-জ্বী!

-জ্বী কি? যা বলেছি কর।

অর্নিতা বিষ্ময়ে হা হয়ে কল করলো নুপুরকে। কল রিসিভ হওয়ার আগেই রিদওয়ান ফোনটা নিয়ে নিজের কানে ধরলো। ওপাশ থেকে জবাব পেতেই সে বলে উঠলো, ‘শালিকা আমি রিদওয়ান৷ একটা কাজ করতে পারবেন?’

নুপুরও বোধহয় অর্নিতার মত বিষ্মিত সেও কোন কথা বলছে না। রিদওয়ান ব্যাপারটা আন্দাজ করে নিজের মতই বলে গেল, ‘কলেজে আছেন নিশ্চয়ই। একটার মধ্যে কলেজ গেইটের সামনে আপনার বান্ধবীকে নিয়ে আসছি আপনি তাকে একটু তার বাড়ি পৌঁছে দেবেন৷ বাকি কথা সামনেই বলবো শুধু ফোনটা রিসিভ করবেন পরবর্তী কল পেলে।’

দু প্রান্তে দু বান্ধবীই হা হয়ে বসে আছে। রিদওয়ানের কথার বোধগম্য হলো ঠিক কলেজের সামনে পৌঁছেই।

____________
চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-১৭+১৮

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৭

ভোরের আলো ফোটার আগেই চোখ মেলল নুপুর। রাতের অর্ধেকের বেশি তার জেগেই কেটেছে। এইতো ঘন্টা খানেক আগেই নিশ্চিন্তে ঘুম নেমেছিলো চোখের পাতায় আবার তা হুট করেই পালিয়ে গেল। কানে আসছে একটা দুটো পাখির ডাক। ফজরের আজান কি হয়ে গেল! পাশ ফিরে ডান দিকে তাকাতেই ঝাপসা আঁধারে চোখে পড়লো অর্নিতার মুখটা। আঁধার কাটছে ধরণীতল ছাড়িয়ে তারই প্রমাণ ওই হলুদাভ মুখটার অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। জীবনে এই প্রথমবার তার বাড়ির বাইরে অল্পচেনা এক বাড়িতে রাত কাটলো। প্রথমবার বলেই ঘুমটা হলো না ঠিকঠাক তবুও চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। মাথার কাছটা হাতড়ে ফোনটা নিয়ে সময় দেখলো ভোর চারটা পঁয়তাল্লিশ। আজান কখন হয় সঠিক সময় জানে না সে। প্রতিদিন তো পাঁচটায় এলার্ম বাজে তখন উঠে নামাজ আদায় করে পড়তে বসে। আজান এর আগেই হয়ে যায় তা জানা আছে৷ এখন আর ঘুম আসবে না খুব করে বুঝতে পারছে সে তাই বিছানা থেকে নামলো। ওয়াশরুমে যাওয়ার তাড়া নেই কিন্তু ঘরটাতে বসতে ইচ্ছে করছে না৷ অর্নির ঘরে লাগোয়া ছোট্ট একটা বারান্দা আছে নুপুর পা বাড়ালো সেদিকেই। ঝাপসা আঁধার কেটে অলস পায়ে বারান্দার দরজা খুলে সেখানে দাঁড়াতেই শীতল বাতাসের আলিঙ্গনে গা শিউরে উঠলো। বাতাসে বৃষ্টির আগমনী বার্তা ছুঁয়ে গেল নুপুরের পাতলা দেহ। ঘরের কৃত্রিম বাতাসটাকে তিরস্কার করতেই যেন এ বাতাসের দমক। নুপুর তাজা হাওয়ায় সতেজ মন নিয়ে আঁধারে নজর বুলালো চারপাশে। ভোরের এ কালোরঙে এক ফোটা চুন সাদার ছোঁয়া লেগে আশপাশের সবটা স্বচ্ছ হয়ে অক্ষিকোটরে ধরা দিচ্ছে। দোতলা বাড়িটার এটা পেছন দিক দেখতেই বোঝা যায়। আগের বার এলেও বারান্দা দর্শনের সুযোগ হয়নি তার। আজ সুযোগ মিলল বলেই হয়ত ঘোর লাগা চোখে দেখছে এদিকটা। খোলা জায়গা অনেকটা তার পরই অনেকগুলো গাছের গুঁড়ি তার পেছনেই আরও নতুন কিছু চারাগাছ। হঠাৎ…. ঘোলাটে আঁধার ছাপিয়ে ভেসে এলো এক ছায়া মানব। এক মুহূর্তের জন্য ছায়া মানবই মনে হলো নুপুরের ওই গোঁফওয়ালা জল্লাদটাকে। কিন্তু এত ভোরে ওই মানুষটা কোথা থেকে এলো! রাতের অর্ধেকটা তো ছাদেই কাটলো এরপরও কি ঘরে থাকেনি? আনমনেই ভাবনা টেনে আরও কিছু ভেবে চুপিসারে পা বাড়ালো নিচে নামার জন্য। এক পলক দেখে নিলো অর্নিতাকে। ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে তারমানে গাঢ় ঘুমেই আছে মেয়েটা। অর্ধপরিচিত জায়গায় এমন সাহস দেখানোটা বোকামি হলো কিনা একটিবারও না ভেবেই নুপুর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধতার চাদরে ঢাকা সেই নিস্তব্ধতার দেয়াল মাড়িয়ে নুপুর বের হলো সদর দরজা খুলে। অর্ণব যেখানে দাঁড়ানো সেখানটাতে যাওয়ার রাস্তা কোনদিকে তা ঠাওর করা গেল না এক দিকে সামনের দিকের ফুল বাগানটা আর অন্যদিকটায় সরু ড্রেন দেখে। মিনিট দুয়েক হতাশ চোখে তাকিয়ে থেকে সে পা বাড়ালো সরু ড্রেনের পাশ ঘেঁষে। এক পা দু পা করে পুরো বিল্ডিংয়ের দেয়াল ঘেঁষে পৌঁছে গেল বাড়ির পেছনে। খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে সামনে তাকাতেই দেখা গেল ওই তো অর্ণব এখনো আগের জায়গায় বসে আছে। নুপুর এবার আরও কয়েক কদম দ্রুত এগোতেই পায়ের তলায় শুকনো পাতা মড়মড়, খচখচ আওয়াজ তুলে চুরচুর হয়ে গেল। কাল না বৃষ্টি হলো তবুও পাতাগুলো শুকনো! বোকা শ্যামাঙ্গীনি খেয়ালও করলো না পায়ের তলায় প্লাস্টিকে ঢাকা ওই শুকনো পত্রদল এই নিশিসমাপ্তির নীরবতাকে ভেঙেছে আক্রোশে। তবে জানতে পারলো সামনের ওই মানুষটা আকস্মিক এই ছন্দ তোলা রুঢ় আওয়াজে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকেই দেখছে লোকটা। চৌকশ নজর তাকে ঘিরেই গম্ভীরতায় ডুবেছে।

-এখানে কি করছ?

স্বভবসুলভ ভারী স্বরটায় দ্বিগুণ ভার মনে হলো নুপুরের। তৎক্ষনাৎ জবাব এলো না তার ঠোঁটের ডগায়। অর্ণব আবারও একই প্রশ্ন করলো,

-এখানে কি করছ!

-এখানে….

ঠিকঠাক কোন উত্তর মুখে আসছে না নুপুরের। অর্ণব উত্তরের অপেক্ষা করলো না।

-ঘরে যাও।

-রাতে ঘুমাননি?

– ঘুম আসছিলো না।

– মন খারাপ?

ছোট্ট প্রশ্নটায় আহ্লাদের ছোঁয়া ছিল কি! কখনো কারো সাথে অবাধ কথাবার্তায় না জড়ানো অর্ণব আলগোছে বলে দিলো মনটা তার সত্যিই খারাপ। কাল রাতে যা হলো তা কি ভালো হলো! অর্নিতা আত্মকেন্দ্রিক স্বভাবের এ কথা সবারই জানা।বোনটার বয়সটা কম, পড়াশোনার স্বপ্ন তার দীর্ঘ সব জেনেও অর্ণব বাবা-মা’হীনতার কমতি দেখিয়ে যে যা বলল তাই চাপিয়ে দিলো বোনটার ঘাড়ে। ফলশ্রুতিতে কাল রাতের সে অঘটন দেখতে হলো। এটা যে ভীষন অন্যায় হলো তা ভেবেই মনটা বেশি খারাপ অর্ণবের। আঁধার হালকা হচ্ছে সেই সাথে কানে আসছে মুয়াজ্জিনের সুরেলা কণ্ঠে ফজরধ্বনি। কথার মাঝেই থেমে গেছে অর্ণব। নুপুরও আলতো হাতে গলার ওড়নাটা তুলে দিলো মাথার ওপর। বিড়বিড় করে জবাব দিতে থাকলো আজানের সেই সাথে কেটে গেল পাশাপাশি কিছু মুহূর্ত। আজান শেষ হতেই নুপুর মুখ খুলল এবার।

– আপনার বোধহয় আর মন খারাপ করার দরকার নেই।

অর্ণব ফিরে তাকালো মেয়েটার দিকে। বড্ড চঞ্চল, ফরফরে, চটপটে এই এতটুকু মেয়ে কি করে হতে পারে বোঝে না সে। কই অর্নিতা বা বৃষ্টিকে তো কখনো এত কথা বলতে শোনেনি৷ অবশ্য কলেজে তার এক ক্লাসমেট ছিল এমন বাঁচাল স্বভাবের। মেয়েটা যেচে পড়ে সবসময়ই তার সাথে কথা বলতে আসতো আর এজন্য অর্ণব মেয়েটার ওপর খুব বিরক্তও থাকতো৷ এছাড়া ইউনিভার্সিটি জীবনে তার তেমন কোন মেয়ের সাথে পরিচয় হয়নি। হওয়ার সুযোগই ছিল না কারণ বি.এ পড়াশোনা ছিল তার জন্য শুধুই সার্টিফিকেট সংগ্রহের একটা মাধ্যম৷ ক্লাশে সে হাতে গুণে দশ দিনও ছিল কিনা সন্দেহ৷ সারা বছর দু ঘন্টার কোচিং করেই পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে। কাঁধের ওপর ব্যবসায়ের ভার তাকে সে বয়সেই দায়িত্বশীল পুরুষ বানিয়ে দিয়েছিলো। ঠেকায় পড়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুবাদেই কারো সাথে সখ্যতা নেই, জানা নেই এ ধরাধামে কত রকমের মেয়ে হতে পারে। আজ নুপুরের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল এই মেয়েটা নিশ্চিত পাগলাগারদ ফেরত। কথাটা ভাবতেই তার ঠোঁট ফিচলে হাসির উদ্বেগ প্রকাশ পেলো। নুপুর তখনও বলে চলছে, ‘আমার কথা শুনে আপনার এই মুহূর্তে সকল টেনশন শেষ হয়ে যাবে।’

-তাই!

-সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না আমার কথা? সত্যি বলছি।

-আমার টেনশন কি নিয়ে?

-অর্নিতা খুশি আছে কিনা এটা নিয়ে ভাবছেন আপনি তাই না!

-হু। তা টেনশন না করতে বলার কারণ কি?

– কারণ…… বলে দেব?

-বলো।

— বলবো?

-সমস্যা কি!
রাগত স্বর অর্ণবের।

-আচ্ছা বলছি….

একটু থেমে নুপুর এবার কিছুটা চেঁচিয়েই বলল, অর্নিতা এই বিয়েতে খুশি আছে। রিদওয়ান ভাইয়াকে বর হিসেবে তার খুব পছন্দ।’

হতাশ চোখে অর্ণব তাকালো নুপুরের দিকে। এই কথাটা এভাবে চেঁচিয়ে বলার কি দরকার ছিল! এই কাক ডাকা ভোরে বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে চারপাশ নিস্তব্ধ। এমন অবস্থায় একটু আওয়াজও অনেকটা জোরে শোনায় তাই কথাটা আস্তে বলা উচিত। এতটুকু কমনসেন্স নেই মেয়েটার মাঝে? আধপাগলি বটে! শান্তশিষ্ট অর্নিটার কপালে এমন বান্ধবীই জুটলো! অর্ণব যখন আফসোসের থালা সাজায় নুপুর তখন আরও একবার তাকে ভরকে দিয়ে বলে বসলো, জানেন কাল অর্নিতা বাসর গিফট হিসেবে রিদওয়ান ভাইয়ার কাছ থেকে কি পেয়েছে?

– চুপ…. একদম চুপ। কাকে বলছো হুঁশ নেই তোমার?

আচমকা ধমক ঠিক হজম হলো না নুপুরের। কপাল কুঁচকে, মুখ ফুলিয়ে বলল, কেন কি হয়েছে?

-ছোট বোনের বাসর রাতে কি পেল না পেল সেটা কি তার ভাইকে বলা যায়?

-কেন যাবে না? চমৎকার একটা গিফট বললে সমস্যা কি?

– চুপচাপ ঘরে যাও।

এবারের ধমকটা ভয়ংকর মনে হলো নুপুরের। সে আর এক মুহূর্তও এখানে থাকবে না বলে পা বাড়ালো চলে যেতে।

-ওদিকে কোথায় যাচ্ছো?

ড্রেনের দিকে যেতে দেখেই অর্ণব তাকে ডেকে উঠলো। নুপুর পেছনে না ফিরেই জবাব দিলো, আপনিই না বললেন ঘরে যেতে।

-তাই বলে ড্রেনের পাশ দিয়ে! তুমি ওদিক দিয়েই এসেছিলে?

-হ্যা। তো আর কোথায় রাস্তা আছে?

-বোকার হদ্দ….
অস্ফুটে আওড়ালো অর্ণব তারপরই আবার ডাকলো, আমার সাথে এসো।

বাগানের ভেতর দিয়েই অল্প একটু পথ যা বাড়ির সামনে থেকে পেছনে আসার রাস্তা। অর্ণবের পিছু যেতে যেতে এবার দুঃখ হলো নুপুরের। এত সুন্দর রাস্তা রেখে সে কিনা ড্রেন ঘেঁষে গিয়েছিল! ইশ, যদি পা ফসকে নিচে পড়ে যেত? ইয়াক….. ভাবতেই তো গা গুলিয়ে আসে।

বাগান পেরোতেই অর্ণব তাকে ইশারা করলো ভেতরে যেতে। নিজেও চলে গেল গেইট পেরিয়ে বাড়ির বাইরে। পুরো বাড়ি শুনশান তখনো কেউ ঘুম থেকে জেগে উঠেনি। নুপুর নিঃশব্দে দোতলায় উঠে ঢুকে গেল অর্নিতার ঘরে।

____________

হাতের মুঠোয় টাইটাকে লাগছে গলার ফাঁস, টেবিলের ওপর থাকা নীল রঙের ফাইলটাকে মনে হচ্ছে জজের লেখা শাস্তিনামা। যেখানে লেখা আছে তার জন্য বরাদ্দকৃত শাস্তির কথা। আসলেই তাই! কত বছরের চাওয়া তার আবেগমাখা প্রেম পথ বদলে সরাসরি বৈধ নথি হয়ে জীবনে এলো অথচ ভোর না হতেই তাকে শহর ছাড়তে হচ্ছে৷ এ শহরে তার কাল রাতে যুদ্ধ শেষের উপহারটা রয়ে যাবে আর সে সপ্তাহ জুড়ে পড়ে থাকবে চট্টগ্রামের কোন এক পাহাড়ি খাদে! প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে রিদওয়ান টাইটা রেখে দিলো ব্যাগের ভেতর। এখন ফ্লাইট ধরে প্রথমে যেতে হবে চট্টগ্রাম সুনামধন্য একটি পাঁচ তারকা হোটেলে। সেখানে ঘন্টা দুই রেস্ট নিয়ে মিটিং শুরু করতে হবে খাগড়াছড়ির নতুন প্রজেক্টের। সে ভেবে পায় না কাল পর্যন্ত যে প্রজেক্টকে আব্বু অপশনাল ফেলে রাখলো অর্ধরাতেই তা জরুরি কি করে হতে পারে? রাতভর ঘুম হয়নি তার এরই মাঝে রাত চারটায় আব্বুর কল, বাড়ি যাও এখন এবং ভোর সাতটার আগেই ব্যাগ, ল্যাপটপ আর কাগজপত্র গুছিয়ে রওনা হও চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। ব্যস, রিদওয়ানও তাই করল বিনা প্রশ্নেই। এর পেছনে অবশ্য একটা সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। কাল রাতে হুট করেই মা আর ভাইটার সাপোর্টে সে জীবনের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপটা নেওয়ার সময় একটিবার আব্বুর অনুমতি নেয়নি। এমনকি চোখ মেলে একটিবার তাকায়নি সে আম্মুর কথা মেনে। হ্যাঁ এ কথা সত্যি কাল যদি সে আব্বুর দিকে তাকাতো তবে হয়তো অর্নিকে আর নিজের জীবন পৃষ্ঠায় টুকে নেওয়া সম্ভব হতো না। কিন্তু আজকের এই দূরে যাওয়ার শাস্তি অর্নিকে পাওয়ার জন্য একদমই কিছু না৷ আব্বু যদি অর্নিতাকে বিয়ের শাস্তি এরচেয়েও বড় কিছু দিতো সে অনায়েসেই মেনে নিতো এমনটা ভাবতে ভাবতেই তৈরি হয়ে গেল রিদওয়ান৷ ঠিক সাড়ে ছয়টায় রওনা দিলো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। সে জানতেই পারলো না এই শাস্তির পেছনেই জমে আছে আরও কোন বড় শাস্তি৷ শুধু সময়ের অপেক্ষা!

_________________

নাস্তার প্লেট হাতে নিয়ে এবার চরম বিরক্ত হলো নুপুর। সেই কখন অর্নিতাকে বলল, চল একসাথে খাই আমি একটু পরই চলে যাব। অর্নিতা বলল, ‘আয় খাই’ এ পর্যন্তই। রুজিনা খালা ঘরেই এনে দিল দুই বান্ধবীর জন্য পরোটা, সবজি, বুটের ডাল অথচ অর্নিতা ফিরেও দেখছে না খাবারে৷ এই মেয়ে নাকি কখনো কাউকে ভালোবাসেনি নুপুর এ কথা আজ এ ক্ষণে একদমই মানতে পারছে না। রাতে হুট করে বিয়ে হলো, বর কি এক উপহার দিল সেই থেকে মেয়েটার মাথাই গেছে! পরাস্ত নিঃশ্বাস ফেলে নুপুর পরোটার প্লেট হাতে বসলো বিছানায় অর্নিতার মুখোমুখি৷ পরোটা একটুখানি ছিঁড়ে তাতে সবজি নিয়ে অর্নিতার মুখের কাছে ধরলো এবার।

-হা কর।

বান্ধবীর আদেশ শুনতেই ঘোর কাটে অর্নির।
-তুই খা আমি পরে খাব।

-হু পরে যে কি খাবি তুই তাতো দেখছিই। কি এক চকচকে একশো টাকা দিলো তাতেই তোর মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে।

– টাকার পরিমাণ দেখছিস কেন! লেখাটা পড়।

-আর লাগবে না বইন মাফ চাই। সেই রাত তিনটা থেকে এখন সকাল আটটা পর্যন্ত কম করে হলেও এক’শবার এক’শ টাকার ভেতরে লুকায়িত চিঠিপত্রের খবর বলছিস। আর না এবার ক্ষ্যামা দে, খাবার খা আর আমারে যাইতে দে।

একদমে সবটা বলে তবেই থামলো নুপুর। তার কথা শুনে অর্নিতার গাল লাল হয়ে উঠলো। লজ্জা পাচ্ছে সে এখন৷ এ কথা তো সত্যি এই টাকা নিয়ে সে কুব জ্বালিয়েছে নুপুরকে তাই বলে এভাবে বলতে হবে নাকি? সে লজ্জা পায় তো!

– এভাবে বলিস কেন তোর বেলায়ও দেখব কিন্তু।

-অবশ্যই দেখবি। কিন্তু আমি বইন বারবার দেখামু না জামাইর দেয়া জিনিস। আচ্ছা অনেক হইছে এবার চল নাশতা কর আমি চলে যাব৷

এবার আর বিলম্ব হয়নি অর্নিতার। সে নুপুরের সাথে নাশতা শেষ করেই ছুটলো ভাইয়ের খোঁজে। অর্ণব বাড়ি নেই তবে রিমন এখনো আছে দেখে স্বস্তি পেলো সে। নুপুরকে একা ছাড়তে মন সায় দেয় না তার। আঙ্কেলের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিজেই খালামনিদের গাড়ি পাঠিয়ে এনেছে মেয়েটাকে। ভেবেছিলো যাবার বেলায় ভাইয়া তাকে পৌঁছে দেবে। এখন তো দেখা যাচ্ছে ভাইয়া তার বাড়িতেই নেই। অনেকটা জোর করেই সে নুপুরকে রাজি করালো রিমন ভাইয়ের সাথে যাওয়ার জন্য। রিমন গাড়ি এনেছিলো তার তাই যাওয়ার বেলায়ও গাড়ি বের করলো৷ গেইটের বাইরে গাড়ি নিয়ে সে অপেক্ষা করলো নুপুরের জন্য কিন্তু মেয়েটার তো দেখাই নেই। অফিসের দেরি না হয়ে যায় ভেবেই সে অর্নিতাকে কল করতে ফোন হাতে নেয়। তখনই ঠিক চোখে পড়ে গেইট পেরিয়ে এগিয়ে আসছে নুপুর। রিমন নিজেই এবার ড্রাইভিং সিট থেকে কাত হয়েই পাশের দরজা খুলে দেয়।

– এই পিচ্চি সামনেই বসো।

-আমি পিচ্চি? গাড়ির ভেতর বসতে গিয়েই প্রশ্ন করে নুপুর।

-পাঁচ ফিট দুই ইঞ্চি পিচ্চি নয়তো কি!

-হা…. ঠিকঠাক কি করে বললেন ভাইয়া। আপনি তো ভীষণ জিনিয়াস!

-ট্যালেণ্ট পিচ্চি বুঝলে!

কথায় কথায় বেশ জমে গেল দুজনের। রিমন মনোযোগে ড্রাইভ করতে করতেই বেশ গল্প হলো। তারা যেতে যেতে পেছনে ফেলে গেল একরাশ কনফিউশান যা একটা সময় নুপুরের জীবনে প্রভাব ফেলবে আশ্চর্যজনকভাবে তা ঘুণাক্ষরেও টের পেল না কেউ। নুপুর যখন গেইটের বাইরে রাস্তার পাশ থেকে রিমনের গাড়িতে বসলো তখন রাস্তার অন্যপাশ থেকে এক জোড়া চোখ দেখলো তাকে। তৎক্ষনাৎই ফোন করলো তার বসকে। রিমনের বর্ণনা দিয়ে আজও সেই লোকটা নুপুরকে অর্নিতা ভেবেই খবর পৌঁছালো ওপাশের ব্যক্তিটিকে। লোকটাও সহাস্যে জানিয়ে দিলো, ‘খালাতো ভাইয়ের সাথে যাচ্ছে! তাহলে বোধহয় খালার বাড়িই ফেরত যাচ্ছে৷ ওর ওপর বাদ দে শুধু অর্ণবের ওপর নজর রাখলেই চলবে তোর।’

চলবে
#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৮

” আমি -রিদওয়ান শেখ আজ থেকে তোর সকল স্বপ্ন পূরণ করার দায়িত্ব নিলাম। তুই – অর্নিতা চৌধুরীশেখ’কে আমার সম্পূর্ণ জীবনের দায়িত্ব দিলাম এই মর্মে এই পত্রে স্বাক্ষর করলাম।”

সত্যিই ছোট্ট করে একটা স্বাক্ষর করেছে রিদওয়ান উপরোক্ত লাইনদুটোর নিচে। এক’শ টাকার নোট যেন তার কাছে সরকারি কোন রেজিস্ট্রার পেপার ছিল সেই রাতে। অর্নিতার হাতে এই নোট গুঁজে দিয়েই চলে গিয়েছিল রিদওয়ান। অর্নিতা অপ্রস্তুত ছিল তবুও যেন একটুখানি প্রস্তুত ছিল রিদওয়ান হয়তো তাকে স্পর্শ করতে চাইবে। খুব না হোক একটু হাতটাই না হয় ছুঁয়ে দেখবে। এমন কিছুই করেনি মানুষটা। কত আরাধ্য জিনিস হাতের কাছে পেয়েও কেমন নিরাসক্ত হওয়ার ভাণ করেই নোটখানা হাতে দিয়ে চলে গেছে। সেই থেকে নিঃশব্দেই যেন কেটে গেছে তিনটা দিন। অর্নিতার মনের ভেতর শিবলীর সাথে বিয়ে নিয়ে যে চাপা ভয়, আতঙ্ক ছিল সবটাই উবে গিয়ে এখন অন্যরকম অপেক্ষা তৈরি হয়েছে। কখনো একটি ফোন কলের অপেক্ষা কখনোবা মানুষটা নিজেই সম্মুখে উপস্থিত হবে সেই অপেক্ষা। ভেতর -বাহিরে অপেক্ষার সাথে যুক্ত হয়েছে লজ্জারুণ শিহরণ। বিয়ে নিয়ে আগে কখনো আবেগের আভাস ছিল না অর্নির। বারংবার মনে হতো বাবা-মা’হীন জীবনে বিয়ে তার জন্য শুধুই একটি ফরমালিটি যার মাধ্যমে তার জীবনের বাকি দিনগুলোর নিয়ন্ত্রণ নির্দিষ্ট একজনকে হস্তান্তর করা মাত্র। যেই মুহূর্তে সে রিদওয়ানের নামে কবুল পড়লো ঠিক তখন থেকেই যেন বদলে গেল ভাবনারা। সত্যিই বদলেছে তার ভাবনা সেই সাথে বদলেছে জীবনের গতিবিধিও। রিদওয়ান পরের দিন ভোরেই শহর ছাড়লো। অর্নিতা থেকে গেল নিজ বাড়িতে আর চলে গেল তার শ্বশুর বাড়ির প্রত্যেকেই। সেদিন থেকে আবার শুরু হলো নতুন নিয়ম। দাদী শিখিয়ে দিলো খালামনিকে ‘আম্মু আর খালুজানকে আব্বু ডাকবি’। অর্নি অনেক চেষ্টা করে খালামনিকে আম্মু ঠিকই ডাকতে পারলো কিন্তু খালুজানকে বহু কষ্টে বাবা ডাকতে পেরেছে। আব্বু তার মুখে কিছুতেই যেন এলো না আর। তবুও খালুজান খুশি হয়ে তাকে নাশতার টেবিলে হাজার টাকার দুইটা নোট সালামি দিয়েছে। সম্পর্কে এখন সে শেখ বাড়ির বড় বউ বলে রিমন আর বৃষ্টিও হাসি ঠাট্টায় নাশতার সময়টুকু আদায় করে নিয়েছিল। প্রত্যেকের আচরণে বেশ লজ্জা লাগছিল তার। সেই লজ্জার আঁচ তার মুখশ্রীতে প্রভাব ফেলতেই ছোট দাদী তৃপ্তির হাসি হেসেছিলেন। মানুষটা শুরু থেকেই অর্নির পাশে শিবলীকে অপছন্দ করতেন কিন্তু রিদওয়ানকে অর্নিতার জোড় হিসেবে একটুও অপছন্দ হয়নি তাঁর। কিন্তু এই যে, এত সুখ সুখ অনুভবে রিদওয়ান অনুপস্থিত তাতে বিশেষ ভালো ঠেকছে না দাদীর। তিনি গত দু দিনে অর্ণবকে খুব জ্বালিয়েছেন এই নিয়ে। কথায় কথায় বলেছেন অর্নিতা -রিদওয়ানের বড় করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে৷ বাশার শেখ নিজে থেকে এই বিয়ে নিয়ে কিছুই বলেননি সে ব্যাপারটাও দাদীর ভালো ঠেকছে না। যেভাবেই হোক বিয়েটা তো হয়েছে এবং পরিবারের সামনেই হয়েছে। তারপরও কেন রিদওয়ানের বাবা পরবর্তী কোন পরিকল্পনা জানাচ্ছেন না! অর্নিতা আজ কলেজ থেকে ফিরে দাদীর ঘরে এলো প্রথমেই। ঝুড়িভর্তি সুপারি নিয়ে বসেছেন তিনি সেগুলোকে টুকরো করতে। এক দুপুর খুব চেঁচিয়েছেন রুজিনা খালার ওপর সুপারি কেন কাটা হয়নি। এরপর নিজেই দুপুরে খাবার খেয়ে এগুলো নিয়ে বসেছেন।

– কি করো দাদী?

– একি! কাপড় বদলাস নাই ক্যা?

-মাত্রই এলাম তো। একটা কথা বলার ছিল তাই ভাবলাম আগে বলি।

-কি কথা?

-রিদওয়ান ভাই ফোন করেছেন একটু আগে।

লজ্জা লজ্জাভাব অর্নিতার চোখে মুখে। এমন লজ্জা পছন্দের মানুষ ছাড়া অন্যের জন্য পায় না মেয়েরা। বৃদ্ধা নিশ্চিত শিবলীর সাথে বিয়েটা হলে এমন অর্নিকে তাদের দেখা হতো না। মনে মনে তিনি এখন প্রশান্তি অনুভব করছেন, যাক একটা হাত সঠিক জোড়ায় মিলে গেছে এবার নাতিটার কিছু হোক। দাদী সহাস্য উজ্জ্বল মুখে বললেন, ‘ কি কইলো নাত জামাই কবে আসব সে? বিয়া কইরাই তো ফুড়ুৎ হইলো পাখি।’

– আমাকে দেখা করতে বলেছে বিকেলে।

-বুঝলাম না!

-ইয়ে… আসলে দাদী উনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন এ কথা নাকি বাড়িতে কেউ জানে না।

-তাইলে তোরে কই যাইতে কয়?

– উত্তরা….. অর্নির কথা শেষ হয়নি তার আগেই হাতের ফোনটা বাজলো আবার। অর্নি দেখলো রিদওয়ান কল করছে। দাদী ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জামাই ফোন দিছে?’

অর্নিতা মাথা দোলায়, হ্যাঁ জানায়। দাদী ইশারা করলেন কথা বলে নে। অর্নিতা কল ধরলো সালাম দিলো৷ রিদওয়ান প্রথমেই প্রশ্ন করলো, বলেছিস দাদীকে?

-না।

– তোর বলতে হবে না ফোন নিয়ে দাদীর কাছে যা।

-পাশেই আছে।
– দে

অর্নিতা ফোনটা দাদীর দিকে বাড়িয়ে ধরলো।

-কি? দাদী জিজ্ঞেস করলেন?

-তোমার সাথে কথা বলবে।

দাদী হাতের সুপুরি কাটার জাতিটা একপাশে সরিয়ে রাখলেন। ফোন কানে ধরেই বললেন, কি খবর নাতজামাই?

দাদীর গলা শুনে প্রথমেই রিদওয়ান সালাম দিয়ে হাল জানতে চাইলো। এরপর ভণিতা ছাড়াই বলল, ‘দাদী আমি একটু আমার বউকে নিয়ে বাইরে যেতে চাইছিলাম৷ অনুমতি দিবা?’

-তোর বউ তুই নিবি ভাই আমি কি কমু?

– বউ আমার হলেও এখনো তো আমায় দাওনি তাই অনুমতি ছাড়া নেই কি করে! আর বউও আমার তোমরা না বললে এক পাও আসবে না আমার সাথে।

– বুঝছি। তা যাইবা কই আর আসবা কখন?

-ইয়ে… দাদী

– ওরে বাবা নাতজামাই কি লজ্জা পাইতাছোনি?

সত্যিই লজ্জা পাচ্ছে রিদওয়ান। বউকে নিয়ে এক রাতের জন্য কোথাও যাওয়ার অনুমতি নেওয়া এতোটাই বিব্রত করবে তাকে আগে বুঝতে পারেনি৷ কিন্তু দাদী সহজ করে দিলো তার কথা।

– কি হইলো রাইতে কি থাকবা তোমরা?

-হ্যা দাদী।

-আচ্ছা। রায়না জানে কথাটা?

সবচেয়ে বড় আতঙ্ক ঠিক এটাই ছিল। তাইতো আগেভাগেই অর্নিকে বলেছিলো কাউকে না জানিয়েই সে যাচ্ছে। এখন কি বলা যায়!

-না মানে আম্মুকে এখনো ফোন করা হয়নি।

-বুঝছি৷ বিয়া করতে তো শরম পায় না ব্যাটামানুষ কিন্তু বউরে কাছে রাখতে যে এত শরম কেমনে পায় বুঝি না। তুমি বাড়ি আসো আমি ততক্ষণে তোমার আম্মার লগে কথা কই অর্নিতাও রেডি হউক।

-থ্যাংক ইউ দাদী এটা আরও বেশি ভালো হয়।

রিদওয়ান ফোন রাখতেই দাদী অর্নিতাকে তাড়া দেন ভালো করে গোসল শেষে তৈরি হতে। নিজেই আবার আদেশ করেন আলমারি খুলে একটা শাড়ি বের করতে। রিদওয়ানের কণ্ঠ শুনে তার যে উচ্ছ্বাস টের পেয়েছিল সে এখন দাদীর কথায় মনে হচ্ছে রিদওয়ানের পর দাদীও খুব উচ্ছ্বসিত তার ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারটায়। সেও আর বিলম্ব না করে দাদীর ইচ্ছে মত গোসল সেরে শাড়ি নিয়ে পড়লো তৈরি হবে বলে।

___________

শেষতক লোনটা ক্যান্সেল হয়ে গেল অর্ণবের। কাগজপত্রের ঝামেলা যেভাবে কাটিয়ে উঠেছিল তাতে করে সে নিশ্চিত ছিল এবার নতুন কোম্পানিটা নির্দ্বিধায় চালু করতে পারবে। যেখানে মাস শেষে অর্ধকোটির হিসেব হতো সেখানে এখন দু কোটির বড় রকমের লেনদেন হবে সে ধরেই নিয়েছিল। লাভ লোকসানের দিকটাও যে তার অনুকূলে থাকবে এবারের ব্যবসা তেমনভাবেই শুরু করতে চাইছিলো। হলো না কিছুই। একটু আগেই তো একে একে তিনটা ইমেইল জমা হলো এই নিয়ে। ম্যানেজার আঙ্কেলই প্রথম দেখেছেন নোটিশ তাইতো অর্ণবকে একটু আগে ছলাকলা বুঝিয়ে অফিসে আসতে বারণ করেছিলেন সকালে। ছেলেটার বহুদিনের স্বপ্ন যে এক মুহূর্তেই শেষ হয়ে যাবে তা কল্পনাও করেননি। সেই কিশোর বয়স থেকে দেখে আসছেন এই ছেলেটার পরিশ্রম আর আজ তাকে ভেঙে পড়তে দেখা যে উনার জন্যও কষ্টসাধ্য। কেবিনের ভেতর এসির শীতলতা কাজে লাগছে না অর্ণবের। রিভলভিং চেয়ারটায় গা এলিয়ে চোখ বুঁজে লম্বা লম্বা শ্বাস টেনে নিচ্ছে সে। বারংবার চেষ্টা করছে নিজেকে স্থির রাখতে। উত্তেজনার বশে অসুস্থ হয়ে বিছানায় যাওয়ার একদমই ইচ্ছে নেই এমনকি তার সুযোগটাই নেই। তার কিছু হলে বোনটার কি হবে, দাদীর কি হবে? তবুও দাদীর ভার না চাইতেও বড় দাদার বাড়িতে কেউ না কেউ ঠিক নেবে কিন্তু অর্নিতা! গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো অর্ণব। টেবিলে থাকা পানিভর্তি গ্লাসটা হাতে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ চেয়ে থাকলো সেদিকে। এরপর এক চুমুকে সবটা পানি পান করে ফোন হাতে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। সামনেই পড়লো ম্যানেজার সাহেব তিনি অর্ণবের কাছেই আসছিলেন।

-অর্ণব কোথায় যাও বাবা!

-আপনি ইমেইলগুলো দেখেছেন আঙ্কেল?

– উকিল সাহেবের ফোনটা আমিই ধরেছিলাম কিন্তু তোমাকে বলার মত শক্তি পাচ্ছিলাম না।

অর্ণব খুব স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালো ম্যানেজারের দিকে। বুঝতে পারলো ম্যানেজার আঙ্কেল ভুলে গিয়েছেন হয়তো সকল নোটিশ শুধু কাগজে নয় অর্ণবের ইমেইল এড্রেসেও আসবে।

-আমি দেখেছি সবটা। ভয় পাবেন না আমি ঠিক আছি আঙ্কেল। একটু বাইরে যেতে চাই নইলে দমবন্ধ হয়ে আসবে।

-আমি সাথে আসি?

-নাহ।

আর কোন কথা না বলেই বেরিয়ে গেল অর্ণব। বাইক নিয়ে শ্লথ গতিতে এগিয়ে গেল অফিস এরিয়া থেকে অনেক দূর। জায়গাটা সাভারের দিকে একটু গ্রাম্য পরিবেশ। চারপাশে অনেক ফসলি জমি চোখে পড়ছে সেই সাথে কড়া রোদের তেজ। অফিস থেকে বের হয়েছে প্রায় দেড়টা ঘন্টা পার হয়েছে এখানে পৌঁছাতে। তবুও যেন জরুরি ছিল একটু দূরে সরে আসা। এতদিনের পরিশ্রম আর গোছানো স্বপ্ন যখন এক নিমেষেই শেষ হয়ে যেতে দেখলো ঠিক তখনই মনে হলো তার দমটা বন্ধ হয়ে আসছে। চোখের পাতা এবার বুঝি বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে। নিঃশ্বাসটাও কেমন ভারী লাগছিল। তাইতো হঠাৎ বাইক নিয়ে বেরিয়ে এলো অজানার উদ্দেশ্যে৷ এরই মাঝে দাদী আর বড় খালামনির নম্বর থেকে কল এসেছে বারকয়েক। অর্ণবের মনে হলো তারা ম্যানেজার আঙ্কেলের কাছে কিছু শুনেই টেনশনে কল করছেন। কিন্তু এখন যে তার একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না কারো সাথে কথা বলার কারো কাছে কিছু শোনার! রাস্তা ঘেঁষে ক্ষেতের আইলে বাইক রেখে বসে পড়লো সে। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল ছুঁয়েছে। শ্রাবণের আকাশে দলছুট মেঘেরা ঘুরছে এদিক সেদিক। কোথাও কালো কোথাও সাদা মেঘের দল মন খারাপের পসরা নিয়েই যেন জানান দিচ্ছে ঝরে পড়তে চায়। অর্ণব দৃষ্টিতে অনেকটা সময় চেয়ে দেখলো অন্তরীক্ষের রং পরিবর্তন এরপর খুব হঠাৎই ফোন হাতে কল করলো অর্ধপরিচিত সেই নম্বরটাতে। আজ আর সেটা অর্ধপরিচিত বলা যায় না বোধহয়। এক, দুই, তিন, চার করে কয়েক সেকেন্ডেই কল রিসিভ হলো ওপাশ থেকে অথচ সে কথা না বলেই কেটে দিলো কলটা।

______________

কথা ছিল উত্তরা যাবে চমৎকার এক হোটেলে হানিমুন স্যুইট পর্যন্ত বুক করে রেখেছিল রিদওয়ান। অর্ণবদের বাড়ি এসে অবধি তার পরিকল্পনা সেটাই ছিল। অথচ মত বদলে গেল অর্নিতাকে দেখতেই। রিদওয়ান যখন এসে পৌছুলো অর্নিতার তখন সাজ শেষ হয়ে গেছে। দাদীর ইচ্ছে মত একটা ক্রিম রঙের জমিনে লাল পেড়ে কাতান পরেছিল অর্নি। হাত, কান আর গলায় জোর করেই স্বর্নের চুড়ি, দুল আর চেইন পরিয়ে দিয়েছেন দাদী তাকে৷ মাথার চুল খোঁপা করতে চেয়েও করেনি চশমার কারণে। রুজিনা খালা বলে বসলেন, আম্মাগো চশমার লগে খোঁপা কইরো না তোমারে এমনেই ভালা দেখা যায়। ব্যস, মেঘরাশির মত কেশগুলো রয়ে গেল খোলাই। আখিপল্লবে টান পড়লো লাইনারের ঠোঁটও রঙিন হলো। অর্নিতাকে এক নজর দেখেই দাদী তড়িঘড়ি কাজলের ফোঁটা দিলেন তার কানের পেছনে। সাজতে গিয়ে তার যতটা না লজ্জা লাগছিল তার চেয়েও বেশি পেল দাদীর এই কান্ড দেখে। সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে রিদওয়ানের সামনে এসে দাঁড়াতেই অর্নিতার অসহ্যরকম লজ্জা বাড়লো। আজ থেকে তিনটা দিন আগেও তার এই মানুষটাকে দেখলে এমন লাগতো না। হুট করেই সম্পর্কের আদল পাল্টে কেমন আজব লাগছে সব৷ আসার পর থেকেই দাদীর কথামতো রুজিন খালা একের পর এক আপ্যায়নের অত্যাচার চালিয়েই যাচ্ছিলো রিদওয়ানের ওপর। অথচ সে বসে বসে ভাবছে তার চন্দ্রিমার মুখটা কখন দেখবে! যখন দেখলো তখন মনে হলো না দেখলেই ভালো হতো। হৃৎস্পন্দনের গতির যে বেহালদশা ওই চাঁদপানা মুখে তাকিয়ে এবার বুঝি দুনিয়া ছাড়াটা নিশ্চিত হলো।

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-১৫+১৬

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৫

শুক্রবার সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন বোধহয় প্রত্যেকটা কর্মজীবী মানুষের জন্য। মুসলিমদের জন্য পবিত্র দিনও বটে! জুম্মার এই দিনে অসংখ্য আনন্দ অনুষ্ঠানেরও কি কমতি হয় আমাদের এ দেশ জুড়ে! অর্নিতার জন্যও তাই এ দিনটিকে শুভ দিন হিসেবে তৈরি করতে চেয়েছিলো আপনজনেরা। খালুজানের পর অর্ণবেরও সম্মতি নিয়েছে অর্নিতা আর শিবলীর আকদের জন্য। অর্ণব ছোট দাদীর সাথে আলোচনা করে অর্নিতাকেও জিজ্ঞেস করেছিলো সে কি চায়! বোকা মেয়েটা বুঝতেই পারেনি তার ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ এর গুরুত্ব তার ভাইয়ের কাছে ঠিক কতখানি। তাইতো দ্বিধায় ডুবে বলেছিল, ‘তোমাদের যা ভালো মনে হয় ভাইয়া তাই করো।’

অর্ণবের মন তখনও মানছিলো না অর্নিতার আকদটা এত দ্রুত করার। তবুও সে ছোট দাদী আর বড় খালামনির যুক্তি মাথায় রেখে ঠিক এক সপ্তাহেই সব আয়োজন করে ফেলল। ছোট দাদী আর খালামনির এক কথা, শুভ কাজে দেরি করা অশুভ লক্ষ্মণ। তখনো কেউ জানতো না অর্নিতার ক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি করাটাই অশুভ হবে। বাশার শেখের শরীরের অবস্থা যথেষ্ট ভালো এখন। নিজের বাড়িতেই তিনি আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। অর্ণব বা ছোট দাদী কেউই রাজী হলো না। অর্ণব নিজে খালামনির হাত ধরেছিল দিন তিনেক আগে। আকুল আবেদন এর গলায় বলেছিল, ‘অনেক করেছো খালামনি তুমি। মাথার ওপর ছায়া আমাদের তুমি আর খালুজান সবসময় ছিলে বলেই আমরা দু ভাই বোন অনেক ভালো থাকতে পেরেছি। যে বয়সে মা বাবার সঙ্গ হারিয়েছি সে বয়সে অনেকেই কচুরিপানার মত ভেসে যায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতে। আমরা ভাসিনি বরং শক্ত হয়ে গেঁথে গেছি মাটির উপর। এ বড় ঋণ আমার তোমার কাছে যা কখনো শোধ হবার নয়। কিন্তু সেই ছোট্ট বয়স থেকেই আমার সাধ ছিল বোনটার সকল দায়িত্ব নিজ কাঁধে নেব। পারিনি অনেকটা কিন্তু এখন সুযোগ এসেছে আমাকে এইটুকু দায়িত্ব পালন করতে দাও। নিজ বাড়ি থেকে অর্নিতার বিয়ে, বিদায়ের আয়োজন করতে চাই।’

রায়না বেগম, বাশার সাহেব দুজনেই মেনে নিয়েছিলেন সে কথা। আর তাই আজকেই চৌধুরী বাড়ি সেজে উঠেছে নতুন কনের মত। ধুমধামে আকদ হবে না বলেও কাছের আত্মীয়ই হয়ে গেল জনা পঞ্চাশেক । অর্ণবের দোতলা বাড়ির ছাঁদে শামিয়ানার চারপাশে দিনের বেলায়ও জ্বলছে সাদা আর সোনালি আলো। আকদ হওয়ার কথা ছিল সন্ধ্যায় তাইতো মেহমান সব উপস্থিত হয়েছে গৌধূলি লগ্নে। নানার বাড়ির আত্মীয় বলতে শুধু বড় খালামনির পরিবারটাই আছেন মেজো খালামনি তো এসেছিলেন পাত্রপক্ষ হয়েই এছাড়া আর কাউকেই দাওয়াত করেনি অর্ণব। বাকি সব আত্মীয় বড় দাদারই বিশাল পরিবার। একটু আগেই বৃষ্টি আর নুপুর ফিরেছে অর্নিতাকে নিয়ে। পার্লারে যাবে না যাবে না করেও যেতে হয়েছে কনে সাজের জন্য। অর্ণব জেদ ধরেছে তার একটি মাত্র বোনের আকদ, বউ সাজাতেই হবে বোনকে। এক একটা অনুষ্ঠানের হাজারটা স্মৃতি বাক্সবন্দি করে রাখতে চায় সে। তাইতো আকদ উপলক্ষেই কাল রাতে হলুদ আর মেহেদী এনেছে এক গাদা। অর্নি আর বৃষ্টিকে বলেছিলো, তোরা তোদের সব বান্ধবীদের দাওয়াত কর, খাওয়া-দাওয়ার থেকে যা যা লাগে সবটাই দেব আমি। বৃষ্টি সেই খুশিতে তার তিনজন বান্ধবী আর দুই বন্ধু দাওয়াত করেছে, রিমন করেছে তার দুই বন্ধু আর অর্নিতা করেছিল তার একমাত্র বান্ধবী নুপুরকে। হলুদে আসার অনুমতি পায়নি নুপুর তবে আজ ঠিকই সুযোগ দিয়েছে তার বাবা। তাইতো একটু আগে ভাগেই সে উপস্থিত হতেই যেতে হলো পার্লারে। দিনের আলো ফুরানোর মুহুর্তে বাড়ি ফিরলো তারা। অর্ণব নিচে আঙিনায় দাঁড়িয়ে তদারকি করছিলো বাবুর্চির কাজকর্মের ঠিক সে সময়েই প্রধান গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলো নব বধূসাজে শুভ্রকন্যা। সাদা আর গোলাপির মিশ্রণে জামদানী গায়ে বউ সাজে আছে অর্নিতা। বোনের দিকে কয়েক পল তাকিয়েই বুকের ভেতর কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগল। অর্নিতা…. ছোট বোনটার আজ বিয়ে হয়ে যাবে? আহ! আপন বলতে তার তো ওই একটাই মানুষ এই ভুবনে৷ যতই দাদা,দাদী, খালা, খালু থাকনা কেন বাবা-মা হীন এ জগতে তারা দুটি ভাইবোনই এক সুতোর দুই গিঁট। চোখের দু কোণ ঝাপসা হয়ে গেল অর্ণবের। জল ঝরানোর সময় নয় এখন ভেবেই চোখ ফেলল অর্নিতার পাশের কন্যাটির দিকে। বৃষ্টিও সেজেছে খুব মেরুন রঙা লেহেঙ্গার সাথে গাজরাময় খোঁপায়। ভালো লাগছে দেখতে তাকে। এবার অর্ণবের দৃষ্টি আপনাতেই খুঁজলো তৃতীয় কন্যাটিকে। মেয়েটা তো তাদের সাথেই গিয়েছিল সে কি ফেরেনি! কপালের মধ্যভাগে সৃষ্টি হলো কুঞ্চনরেখা ভাবনায় চলল শ্যামাকন্যার ক্ষণিক তান্ডব আর তার পরই মেয়েটি এসে উপস্থিত হলো দৃষ্টির দোরগোড়ায়। ওই তো দেখা যাচ্ছে এক হাতে গালের পাশের এক গাছি চুল কানের পেছনে গুঁজতে গুঁজতে এসে দাঁড়ালো বাড়ির আঙিনায়। অর্ণবের হঠাৎ মনে হলো ওখানে এক এক টুকরো আকাশ দাঁড়িয়ে আছে। আকাশরঙা কামিজের শুভ্র ওড়না, খোলা চুলের এক পাশে লাগানো সাদা ফুল। হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা টের পেল অর্ণব। কোথাও বুঝি ধড়াক ধড়াক করে আওয়াজ তৈরি হলো! হয়েছে তো৷ অর্ণবের বুকের ভেতরই হচ্ছে এই আওয়াজ। ওই মেয়েটা নির্ঘাত কোন জাদুকরী নয়তো এমন হবে কেন? মেয়েটার কথা মনে হলেই কেমন এক ভরা ভরা অনুভূতি হয় অন্তরে। আপনাতেই মন বলে আপনের ঘরে নতুন করে এই মেয়েটা যুক্ত হচ্ছে তার জীবনে। আজ যেন তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো। অর্নিতাকে নিয়ে বৃষ্টি আগেই পৌঁছে গেছে দোতলায়। নুপুর গাড়ি থেকে অর্নিতা আর বৃষ্টির কাপড়ের ব্যাগটা নিতে গিয়ে দেরি হলো ভেতরে ঢুকতে৷ সে এবার সদর দরজায় পা দিতেই শুনতে পেল অর্ণবের ডাক, শোনো।

অর্ণবের ডাক চৈত্র্যের খরায় এক পশলা বৃষ্টির মত শোনালো নুপুরের কানে। গত তিনটা দিন ধরে সে অপেক্ষায় ছিল এই মানুষটার একটা রিপ্লাইয়ের। কিন্তু পায়নি সে রিপ্লাই আর তাইতো ভেবেছিল আসবে না অর্নিতার আকদে। শেষ পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি। কিন্তু তাই বলে কি সে লোকটার ডাকে জবাব দেবে! উহু, একদমই না। নুপুর থামল কয়েক সেকেন্ডের জন্য তবে ফিরে তাকালো না। যখন দেখলো মিনিট পেরিয়েও অর্ণব কিছু বলছে না তখন সে আবারও পা বাড়ালো সামনে।

-আচ্ছা স্যরি।

-জ্বী!
ফিরে তাকালো নুপুর এবার। এক হাতে তার কাপড়ের ব্যাগ অন্য হাতে ওড়নার একপাশ গুটিয়ে ধরেছে। অর্ণব গম্ভীর মুখটাকে আরও গম্ভীর করে বলল, ‘সেদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম তাই রিপ্লাই করতে পারিনি।’

-আচ্ছা!

ভাবলেশহীন জবাব দিয়ে নুপুর আবার পা বাড়াতেই অর্ণব অধৈর্য্য গলায় বলে উঠলো, ‘ আসলে ইচ্ছে করেই… ‘

– ইগনোর করেছেন! স্বাভাবিক।

অর্ণবের পছন্দ হলো না নুপুরের আগ বাড়িয়ে দেওয়া জবাব৷ এইটুকুনি মেয়ে অথচ তেজ দেখো! কিন্তু তারও কেন এত কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে? নিজের ওপরই রাগ হলো তার। নুপুর চলে গেল অর্ণব অবাক হয়ে দেখলো সেই প্রস্থান৷ ভাবতে লাগল সে কেন এমন স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে।
_________________

জ্বলন্ত সিগারেটটা এ্যাশ ট্রে তে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চাপলো রিদওয়ান। গুনে গুনে সাঁইত্রিশ নম্বর কলটা এবার ধরবে বলেই মনস্থির করল সেই সাথে গুছিয়ে নিলো এ জীবনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট কিছু কথা। যে কথা কখনো মা কিংবা মায়ের বয়সীদের বলা যায় না। ময়না খালামনি সেই দুপুর থেকে একের পর এক কল করেই যাচ্ছেন। অর্নিতার আকদের খবরটা তিনি জেনেছেন রিদওয়ানের কাছ থেকেই। ফলস্বরূপ এখন তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা রিদওয়ানকেই জালাচ্ছেন। কারো কল ধরে দুটো কথার জবাব দেওয়ার মত মন এখন তার একটুও নেই। সেই ভোরেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সে গাড়ি নিয়ে৷ পরনে ছিল সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট আর গলায় ছিল কালো টাই। সাজটা তার অফিসারদের মত থাকলেও সে অফিসের ধারেকাছেও যায়নি। ছুটির দিনে তার ছুটিই ছিল কিন্তু বাবার কাছে বলল আজ সে ওভারটাইম করতে চায় তাও আবার কারখানার শ্রমিকদের সাথে। বাউণ্ডুলে ছেলের মতিগতি বাশার শেখ কখনোই ঠিকঠাক বুঝে উঠেননি তবুও ভাবলেন পাগলকে একটু ছাড় দিলে সমস্যা নেই। রায়না বেগম অবশ্য ছেলের মানসিক অবস্থা অনেকটাই অবগত হওয়ায় তরল মনে দোয়া করতে লাগলেন ছেলেটা যেন কোন ভুল না করে। মায়ের দোয়া কবুল হলো রিদওয়ান বাড়ির বাইরে কোন কিছুই করেনি। এমনকি বাবাকে বলল কারখানায় যাবে সেখানেও যায়নি। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে ছিল রমনায়। একা একমনে বসেছিল মাটিতে পা ছড়িয়ে। দুপুরের পর আবার ফিরে এলো বাড়িতে তখন পুরো বাড়ি শুনশান। আগের রাতেই বৃষ্টি, রিমন চলে গিয়েছিল অর্ণবদের বাড়িতে। সকালে নাশতার পর মা-বাবাও চলে গেছেন। বাড়িতে দারোয়ান আর কাজের দুজন মহিলাই ছিলো উপস্থিত। সন্ধ্যের আগেই রিদওয়ানকে বাড়িতে ফিরতে দেখে একজন এসে জিজ্ঞেস করলেন, রিদওয়ান বাবা কিছু লাগবো?

রিদওয়ান ছোট্ট করে জবাব দিলো, না খালা। সে চলে গেল নিজের ঘরে এরপর আর ঘর থেকে বের হয়নি এক সেকেন্ডের জন্যও৷ একের পর এক সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবছিলো সে। আজ কতগুলো বছর হলো সে ওই পুচকে অর্নিটাকে ভালোবাসে! আম্মু জানে সে খবর। অর্নির ওই হলদেটে মুখখানার চশমার আড়ালে থাকা ভ্রমর কালো চোখদুটোতে রিদওয়ান হারিয়েছিল আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে। তিলে তিলে অনুভূতির মেঘ জমে এখন বৃষ্টি হয়ে ঝরতে চাইছে তার চোখে। আর ঠিক তখন থেকেই অর্ণব, অর্নিতার জন্মদাত্রী একের পর এক কল করে যচ্ছেন রিদওয়ানকে। প্রথম তিন চারটে কল সে কেটে দেওয়ার পরও খালামনির লাগাতার কল আসতেই থাকল। এতেই মেজাজ ঝলসে উঠলো তার আর তাইতো এখন ঠিক করে নিলো কিছু বিশ্রী কথা।

-কেন এতবার কল দিচ্ছো বলো তো! মেয়ের বিয়ের খোঁজ নিতে? এতই যদি ছেলে মেয়ের চিন্তা হয়, কথা মনে পড়ে তবে কেন গিয়েছিলে অন্য পুরুষের কাছে!

এতটুকু বলেই রিদওয়ান থেমে গেল। তার যেন মাত্র হুঁশ ফিরল সে কি বলছে এসব! নিজের অপারগতা আড়াল করতেই কি খালামনিকে কথা শোনাচ্ছে? হ্যা তাই হবে। নিজের চারপাশে হঠাৎই অক্সিজেনের কমতি অনুভব করল সে। অর্নির কি আকদ হয়ে গেছে এতক্ষণে! ফোনের ওপাশ থেকে ফোঁপানোর আওয়াজ পেল রিদওয়ান। আর সহ্য হলো না তার কিছু একটা করতে হবে। এভাবে বসে থেকে অর্নিতাকে হারিয়ে ফেললে যে সে নিজেই বাঁচতে পারবে না। কল কেটে দ্রুত আঙ্গুল চালিয়ে ডায়াল করলো একটা নাম্বার। কলটা রিসিভ হতেই সে বলে দিলো, ‘ যে কয়টা আইডি দিব সে কয়টা আইডি আর যে কয়টা ফোন নম্বর দিব সে কয়টাতে কল দিবি। যেভাবে বলেছিলাম ঠিক সেভবেই বলবি। আর হ্যা,, ভিডিওটা যেন সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ভুল করেও না আসে৷’

কথাটা শেষ করেই রিদওয়ান বসা থকে উঠে দাঁড়ালো৷ তার তর্জনী আর মধ্যমায় এখনো জ্বলছে আরও একটি সিগারেট। ঠোঁটের ভাজে ফুটে উঠলো ক্রুর হাসি আর কপাল থেকে সরে গেল ভয়ের ছাপ।
__________

এশারের আজানের পূর্বেই সারবে বিয়েটা তাই অর্ণব গেল মেজো খালামনির সামনে। সেই মাগরিবের পরপরই এসেছে বরপক্ষ অথচ বর আসেনি৷ শিবলীর নাকি কি জরুরি একটা কাজ পড়ায় সে আসতে পারেনি৷ একটু পরই ফিরবে সে। শায়নার এমন কথা একদমই পছন্দ হলো না ছোট দাদী আর বড় দাদার। অর্ণবদের বংশে মুরুব্বি বলতে এখন এনারাই তো আছেন। তাই অর্ণবও দাদা, দাদীর কথা শুনে খালামনিকে জোর দিলো শিবলীকে বলার জন্য তাড়াতাড়ি আসতে । এরই মাঝে বেজে উঠলো অর্ণবের ফোনখানা। ছাদ ভর্তি মেহমান থাকায় সে ফোনটা নিয়ে নেমে এলো দোতলায়। রিসিভ করতেই কেবল একজন বলে উঠলো, ‘হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও চেক করুন।’

কথাটা বলেই কলটা কেটে দিল ওপাশের মানুষটা। আকস্মিক এমন এক কথায় অর্ণব হকচকিয়ে গেল। কিছু সময় পর ধাতস্থ হলো কি বলল ফোনের ওপাশ থেকে কেউ একজন! কিন্তু কে ছিল? সন্দিগ্ধ মন নিয়ে সে অনলাইন হলেও ঠিক বোধগম্য হলো না কোথায় কি চেক করবে! এর ঠিক মিনিট দুই পরেই তার হোয়াটসঅ্যাপে এসে জমা হলো কিছু ছবি আর ভিডিও। ছবিগুলো দেখে ভিডিও অন করতেই তার চোয়াল শক্ত হলো। মুহূর্তেই যেন সারা শরীরের রক্ত টগবগিয়ে ফুটতে থাকলো।

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৬

ভরা মজলিশে শিবলীর উপস্থিতি হলো চমকপ্রদ। উহু, না ঠিক তাও নয়। বিস্ময়াভিভূত হওয়ার মত উপস্থিতি ছিল তার অথবা বলা যায় চরম রহস্যজনক। পথিমধ্যে গাড়ি দূর্ঘটনায় পড়েনি সে তবুও হাত ভাঙা, কপাল কাটা আর পায়ের গোড়ালিতে ছিলে যাওয়া চামড়ার রক্তাক্ত অংশ নিয়ে এসেছিল সে রাত দশটার পর। এসেছিলো সে অর্ণব ও রিদওয়ানের কাঁধে ভর দিয়ে। নতুন দুলহা হাত পায়ে সফেদ ব্যান্ডেজে মুড়ে এসে দাঁড়ায় বিয়ের আসরে। ছাদ জুড়ে প্রতিটি মেহমানের চক্ষু চড়কগাছ বরের বেহালদশা দেখে। অর্ণবের ফোনে যে ভিডিও এসেছিল তা দেখা মাত্রই তার পায়ের রক্ত মাথায় চড়লো। বাড়িভর্তি মানুষের দিকে এক পলক নজর ফেলতেই তার মনে হলো এই জলসা, এই আয়োজন সব বৃথা। অর্নিতার ভাগ্য এত খারাপ কিচুতেই হতে পারে না। তার পদ্মকোমল অর্নিতা থাকবে সদা সূর্যের আলোর মত ঝকঝকে। তার জীবনে কোন দুশ্চরিত্র পুরুষের জায়গা নেই অন্তত তার ভাইয়ের দেহে যতদিন প্রাণ আছে ততদিন। সে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে বের হয়েই খোঁজ নেয় শিবলীর লোকেশন। ভাগ্যিস লোকটা ফোনটা চালু রেখেছিল! নইলে কোথায় পেতো সেই মুহূর্তে অর্ণব। এদিকে রিদওয়ানও শেষ মুহূর্তে সংযম হারিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় তখন৷ পুনরায় দারস্থ হয় ছোট ভাইয়ের সাহায্যের। রিমনও ভাইয়ের মনস্তাপ টের পেয়ে প্রেমিকার শরণাপন্ন হয়। অর্নিতার বিয়ে নিয়ে ভাইয়ের মাধ্যমে সে বিনোদন নেয়ার অভিপ্রায়েই কাল থেকে উপস্থিত ছিল অর্ণবদের বাড়িতে। কিন্তু ভাই তার গকশন মুভি হিরো হতে চাইলেও ভরা মজলিশে থাকে ছুপা রুস্তম আর তাইতো তিনি নিজ বাড়িতে বসেই সময় গুণছিল কোন পদক্ষেপ নেওয়ার। শেষ মুহূর্তে আবারও তাকেই উত্যক্ত করলো শিবলী ভাই কোথায় আছে জানার জন্য। নাজনীনকে হতে হলো রিমনের হেল্পার। রিমনের কথা মত মেয়েটা কল দিল তার কাজিনকে। ইনিয়ে বিনিয়ে জেনে নিলো শিবলী ভাই কোথায় আছে তার প্রেমিক মানুষটা একটু দেখা করতে চায়, কথা বলতে চায়। রূপাও সরল মনে শিবলীকে ফোন করে জেনে নেয় লোকেশন সেই লোকেশন পৌঁছায় রিদওয়ান অবধি। গুলশানের আশপাশেই এক রেস্তোরাঁয় বসে ছিল শিবলী তার সাথে ছিল তারই এক বন্ধু। পশ এলাকা, বেশ নিরিবিলি রেস্তোরাঁ গা ঢাকা দেওয়ার জন্য বোধহয় উপযুক্ত স্থানই সেটা তবুও শিবলীর জন্য তা ছিল বিপদজনক আর ভয়ংকর স্থান৷ অর্ণব সেখানে পৌঁছুতেই দিক বিদিক ভুলে ঘুষি মেরে বসেছিল শিবলীর নাক বরাবর। আকষ্মিক আক্রমণ বুঝে ওঠার আগেই এসে পৌঁছায় রিদওয়ান। সময়, কাল, স্থান তারও মাথায় ছিল না শুধুই ছিল শিবলীকে রক্তাক্ত করা আর তাইতো মুহূর্তেই এলোপাথাড়ি আঘাত চলল শিবলীর ওপর। মিনিট দশেকের মাঝে লেগে গেল চরম হুলস্থুল কান্ড যা রেস্তোরাঁয় থাকা প্রত্যেকটি মানুষকে ভীত করে তুলল৷ আর এমনটা হওয়ারই কথা বিশেষভাবে বলতে হয় অর্ণবের মুখাবয়বই অর্ধেকটা সংশয় তৈরি করেছিল। লম্বা, চওড়া, সুঠাম দেহের গম্ভীর গাঢ় চাহনি, ক্ষুরধার চোয়ালের শক্তভাব আর তার চেচিয়ে বলা কথার সাথে তাল মেলানো আঘাত প্রত্যেকটা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো গভীরভাবে৷ রেস্তোরাঁর ওনার শিবলীরই খুব কাছের বন্ধু ছিল তবুও সে ব্যবসায়ের দূর্নাম এড়াতে পুলিশে খবর দেয়নি। নিজে এগিয়ে এসেছিল কিছু স্টাফসহ রিদওয়ান, অর্ণবকে থামাতে। বিধিবাম! বেচারা নিজেই আহত হয়ে বসে পড়লো একপাশে। শিবলীর অবস্থা বেজায় করুণ হতেই হুঁশ ফেরে অর্ণবের। জ্ঞান থাকলেও সে বেহুশের মত পড়ে রয় মেঝেতে। রিদওয়ানের শেষের আঘাতগুলো বেশ শক্ত হওয়ায় শিবলীর অবস্থা গুরতর হয়। কিছুটা সময় নিয়ে ধাতস্থ হয় অর্ণব, রিদওয়ান দুজনেই তারপর নিজেরাই শিবলীকে নিয়ে রওনা হয় হাসপাতালে। ওদিকে বাড়ি থেকেও একের পর এক কল আসতে থাকে রায়না আর ছোট দাদীর। রাত তখন গড়িয়েছে অনেকটা। আকাশ কালো করে বিজলি চমকাচ্ছিলো ক্ষণে ক্ষণে। বর উপস্থিত নেই, মেয়ের ভাইটাও হঠাৎ উধাও। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে উপস্থিত সকলেই আর শায়না তো ভয়েই মূর্ছা যাচ্ছিলেন। কতগুলো আত্মীয়স্বজন নিয়ে তিনি এসে তো পড়েছেন আর আসতে আসতেই ছেলেকে হুমকিও দিয়েছিলেন যেন যথা সময়ে উপস্থিত হয়। একটা সপ্তাহ ধরে ছেলের সাথে বেশ যুদ্ধই চলছিল তাঁর এই বিয়ে নিয়ে। দোষটা বোধহয় সম্পূর্ণ শিবলীর ওপর দেয়া যায় না অনেকটা বর্তায় তার বাবা-মায়ের ওপরই৷ শিবলী জানিয়েছিল বাবা-মাকে তার মনের কথা তারা সেসবে পাত্তা দেয়নি। বরং তার দাদী মানুষটা বড্ড একরোখা আর জেদী। যেদিন থেকে বলেছেন অর্নিতাকে নাত বউ করবেন সেদিন থেকেই শিবলীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। কোন মতেই প্রণয়ে জড়ানো যাবে না কোথাও। তার এ নিয়েও হয়েছে বেশ সভাসালিশ৷ তাদের বাড়িতে প্রেমের বিয়ের নিয়ম নেই সেই নিয়ম ভঙ্গ করার শাস্তি একমাত্র ত্যাজ্য হওয়া। শিবলী প্রফেশনে প্রতিষ্ঠিত হলেও দিনশেষে মাথার ছাদ তার বাপ- দাদার বাড়িটাই। তাই সহজ মস্তিষ্ক হঠাৎই ক্রুর সিদ্ধান্ত নেয়। বাবা-মায়ের ইচ্ছে পূরণ করে অর্নিতার সাথেই আকদ করবে অথচ রূপাকেও নিজের করবে লুকিয়ে। লুকিয়ে বিয়েটা করার কথা আরও অনেকদিন পর সে পর্যন্ত হয়ত কিচু একটা করে অর্নিতার সাথে বিচ্ছেদ ঘটানো যেতেও পারে এমনটাই অভিলাষ গোপন ছিল। অথচ আজ সকাল থেকে মন মানলো না তাইতো সন্ধ্যায় বরযাত্রী পাঠিয়ে দিয়ে নিজেই গায়েব হলো গাড়ী নিয়ে। দূর্দশা তার নসীব বরাবর সিলমোহর আগেই টাঙানো ছিল হয়তো। তাই গত সপ্তাহে রিদওয়ানের অত মার খেয়েছে আবার আজকেও একেবারে রিদওয়ান, অর্ণব দু দুটো ছোট ভাইয়ের হাতে চ্যাঙদোলা হতে হলো। ঘটনা তখনো থামেনি চৌধুরী বাড়িতে। দশটার পর শিবলীকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরেই অর্ণব ঝামেলা বাঁধালো খালামনির সাথে। এত কাছের, এত আপন হয়েও তার বোনটাকে নিয়ে এই খেলার জন্য সে কাউকে ছেড়ে কথা বলল না। শিবলীর দাদীও উপস্থিত মহলে নাতির শারীরিক অবস্থা দেখতেই তুমুল ঝগড়া করলেন অর্ণবের সাথে। কুঁচকে যাওয়া চামড়ার ওপর মেকাপের আস্তরণ ঠিক বুঝিয়ে দেয় বৃদ্ধার দেমাগ আর সৌখিনতা।পায়ে বেঁধে ঝগড়ায় অর্ণবকে তিনি ভীষণরকম অপমান করতে গিয়ে শাপ শাপান্ত করে বসলো অর্নিতাকে। এক ছাদ মানুষের সামনে বলে বসলেন, ‘এই মেয়ের জীবনে বিয়ে হবে না তিনি বলে দিলেন মুখের ওপর এমনকি এই মুখচোরা মেয়ে, দুশ্চরিত্র মা-বাবার সন্তানকে তারা বলেই নাকি আপন করতে চেয়েছেন অন্যরা তাকে পুছবেও না৷’

মানুষ কত কি বলে কত কি ভাবে তার সবটাই কি পূরন হয়! শিবলীর দাদীর কথাখানা বড্ড লাগলো অর্ণবের গায়ে। সে চোখ মেলে দেখলো একবার সিঁড়িগোড়ায় দাঁড়ানো অশ্রুসজল বোনের মুখশ্রী৷ মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিলো সে তার বোনকে বিয়ে দেবে আজ এ ক্ষণেই। বিয়ে কি মুখের কথা! কে বোঝাবে অর্ণবকে? সে উদ্বাস্তু বোনের বিয়ে আজকের এ লগ্নেই হবে। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত আত্মীয়ের মাঝে অনাত্মীয় খুব কাছের একজন মানুষই ছিলেন আর তিনি ম্যানেজার আঙ্কেল। অর্ণবের মনে আছে এখনো আঙ্কেলের মাধ্যমে একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল অর্নিতার জন্য। অর্থবিত্তে খুব প্রতাপ না থাকলেও সচ্ছল পরিবার থেকেই এসেছিল। মূলত, পাত্র নিজে অর্নিকে কলেজে এসে দেখেই খোঁজ নিয়ে প্রস্তাব রেখেছিল। অর্ণব তখন সে প্রস্তাবে নজর দেয়নি, দেয়ার কথাও ছিল না কিন্তু আজ এ মুহূর্তে মনে হলো সেই পাত্রের খোঁজ চাই তার। অর্ণব যখন আকুল হয়ে ম্যানেজার আঙ্কেলের কাছে চাইলো ঠিক তখন পাশেই দাঁড়ানো রিদওয়ান টের পেল বুকের ভেতর আর্তচিৎকার। রায়না বেগম আর রিমনটাও কি টের পেল কিছু! পেল বোধহয় তবে মুখ খুলল না তারা। রিমন শুধু বিড়বিড় করে গালি দিতে থাকলো, হাঁদারাম সন্নাসী এ বেলায়ও কি আমি বলব সব! নাকের ডগায় সুযোগ এসে মুখিয়ে আছে এখনও তিনি মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছেন৷ বলি বিয়েটা কি আমিই করে ফেলব? উফ! রিমনের সত্যিই আর সহ্য হচ্ছিলো না এসব আর। কি ড্রামা লাগিয়ে রেখেছে অর্ণব ভাই আর উপভোগ করছে সকলে। কেউ ভাবছে না ওখানে দাঁড়ানো ওই বাচ্চা মেয়েটার কথা। সে নিজেই এবার এগিয়ে এলো সামনে।

-অর্ণব ভাই!

রিমনের ডাক শুনলেও অর্ণব ফিরে তাকালো না।সে ব্যস্ত ম্যানেজারের থেকে সদ্য নেওয়া পাত্রের ফোন নম্বর ডায়াল করায়। রিমন ধৈর্য্যচূত্য হয়ে কেড়ে নিলো অর্ণবের ফোন। গলা ছেড়ে চেঁচিয়েই বলল প্রায়, ‘ডাকছি কথা কানে যায় না! নাকি ছোট বলে দাম দিতে চাও না? কি সমস্যা বলো তো তোমাদের? একেকজন বাচ্চা মেয়েটার জীবন নিয়ে এত কিসের ড্রামা করছো? কেউ বাচ্চা কালেই নিয়ে ঠিক করে ফেলছো, কেউ প্রেমিকা থাকতেও সেই বিয়েতে মত দিচ্ছো আর কেউ তো বছরের পর বছর ভালোবেসেও মুখে তালা মেরে রাখছো কারণ মেয়েটি তো অন্যকারো বাগদত্তা৷’

বাড়ি ভর্তি মেহমানের কেউ চমকাল, কেউ থমকালো তো কেউ বিনোদন নিতে আগ্রহী চোখে তাকালো রিমনের দিকে। রায়না বেগম ভয়ে ভয়ে তৎক্ষনাৎ চোখ ফেরালেন স্বামীর দিকে। বড় ছেলের মনের খবর বাড়িতে শুধু তার একার নয় রিমনেরও জানা এ কথা তিনি জানতেন। বাশার শেখ কখনোই অর্নিতাকে ছেলের পাশে দেখতে চান না এ কথা বহু আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন৷ রিমনটা কেন এমন বলছে সবার সামনে!

-কি বললি রিমন?
কৌতূহলী অর্ণবের স্বর। অর্নিতা চোখ বুঁজে মাথা এলিয়ে দিয়েছে নুপুরের কাঁধে শরীরটা তার ভীষণ টলছে। সে জানে রিমন ভাইয়ের কথার অর্থ। সেদিনও তো দেখলো রিদওয়ান ভাইয়ের চোখের তারায় নিজের জন্য অনুভূতির মেলা। সে যে টের পেয়েছে বহু আগেই ওই মানুষটার মনের চাওয়া। তাতে কি! মানুষটা ছন্নছাড়া হলেও কখনো অবাধ নয়। নয়ত সেই কবেই বলে দিতো মনের আগল খুলে জমিয়ে রাখা হৃদয়ের কথাগুলো। অর্নিতার এই সপ্তদশী জীবনে প্রেমের জোয়ার এসেছিল তো ওই একজনের নামেই। হ্যা এটাই তো ধ্রুবসত্য তার নিশ্চুপ জীবনের গোপন এক সত্য। কৈশোরে পা রাখতেই মন চঞ্চল হয়েছিল বাউণ্ডুলে রিদওয়ানের ভাইয়ে তা আবার অচিরেই নিথর হলো শিবলী ভাইয়ের নামে। তখন থেকেই বোধহয় অর্নিতা একেবারেই চুপ হয়ে গেল সব ব্যাপারেই কিন্তু আজ রিমন ভাই কেন পুরনো ঘা খুঁচিয়ে দিলো!

-পাত্র খোঁজাখুঁজির কি আছে? বোনকে বিয়ে তুমি আজই দেবে তাইতো! আমরা দু ভাই কি মরে গেছি যে এদিক ওদিক দেখতে হবে।

অনেক অনেকটা সময় মাথা নিচু করে দম আটকে দাঁড়িয়ে ছিলো যেন রিদওয়ান। হঠাৎই রিমনের কথায় সে গাঢ় উঁচু করলো, অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো ভাইয়ের দিকে।

-কি বলতে চাস ঠিক করে বল।

-ওর কথা বাদ দাও অর্ণব তুমি কল দাও সেই ছেলেকে।
বাশার শেখ অর্ণবকে তাড়া দিলেন। রায়না বেগম এবার ফুপিয়ে উঠলেন। এমন মুহূর্তেই তাঁর স্বামী যে অর্নিতাটাকে অবজ্ঞা করছেন তা স্পষ্ট। কিন্তু রিমন থেমে যাওয়ার পাত্র নয়। সে চতুর ঠিক তার বাবার মতই। বাবা যে কথা ঘুরিয়ে নিতে চাইছেন তা সে মানবে না। ভাইটা বাবার বাধ্য সন্তান বলেই হয়ত জোর দেখিয়ে কিছু বলছে না কিন্তু আজ এ সময়টাকে লুফে না নিতে পারলে আজীবন আফসোস থেকে যাবে। তাইতো সে বাবার কথায় তোয়াক্কা না করে সরাসরি বলে দিলো, ‘ ভাইয়া খুব অর্নিতাকে ভালোবাসে। অর্নিতার হাত দুটো আমার ভাইয়ের হাতে দাও অর্ণব ভাই আমি কথা দিচ্ছি তোমার বোন কখনো অসুখী হবে না।’

পুরুষরা কি কাঁদে! রিদওয়ানের চোখ জল ছলছল করছে৷ রায়না বেগম অবাক চোখে দেখছেন তার সাহসী ছোট ছেলেটাকে৷ তিনি এবার নিজেই এগিয়ে এলেন, ‘অর্ণব রিমনের কথা সত্যি আমার ছেলেটা বড্ড ভালোবাসে অর্নিটাকে। শিবলীর সাথে আগেই কথা পাকা হয়ে ছিল বলে ছেলেটা আমার কোনদিনও প্রকাশ করেনি তার ভেতরের খবর। আজ তো সব সামনেই তোর। অর্নিটাকে দিবি আমায়!’

পরিস্থিতি বদলে গেল নাটকীয়ভাবেই। শিবলীর পরিবার আর একটুও দাঁড়ালো না সেখানে। ঘড়ির কাঁটায় রাত তখন বারোর ঘরে। কাজী সাহেব আগেই এসেছিলেন আবার চলেও গেছেন অনেক আগে। এতরাতে বিয়ের জন্য কাজী কোথায় পাওয়া যাবে এ নিয়ে চিন্তিত সবাই। এ চিন্তা থেকে উদ্ধার করলো বর নিজেই। না চাইতেও সবার সামনে বলেই ফেলল, ‘কাজী একজন জোগাড় করা সম্ভব।’

-বাহ ভাইয়া! তর সইছে না বুঝি?

-তেমন কিছু না সবাই চিন্তা করছিস তাই বললাম।

-আসলেই কি তাই! টিপ্পনী কাটলো রিমন।

রাত বাড়ছে তাই আর মশকরাতে ভিড়লো না কেউ। রিদওয়ানের বন্ধুর বাবাই একজন কাজী সেই সুযোগটাই কাজে লাগালো। মধ্যরাতেই বন্ধুকে খবর দিতেই সে এলো তার বাবাকে নিয়ে৷ এরই মাঝে অর্ণবের অনুমতি নিয়ে রিদওয়ান কথা বলেছে। সে জানতে চেয়েছিলো অর্নিতার আপত্তি আছে কিনা তাকে বিয়ে করতে। নাহ, অর্নিতা এ নিয়ে কিছুই বলেনি। তার জবাব ছিলো ভাইয়া আর খালামনির ইচ্ছাই তার জবাব৷ এরপর আর কথা থাকে না। রাত ঠিক একটায় সইসাবুদসহ কবুল বলল অর্নিতা, রিদওয়ান৷ প্রতিধ্বনিত হলো আলহামদুলিল্লাহ প্রত্যেকের মুখেই তবে কারোটা আনন্দে আর কারও কারও ছিলো লোক দেখানো উচ্চারণ। বড় দাদা আর তার পরিবারের যে ক’জন ছিলো সকলেই সে রাতেই চলে গেল নিজেদের বাড়ি৷ পাশাপাশি বাড়ি দুরত্ব শুধু গেইট দুটোর। যেতে যেতে আফসোস ঝরলো বড় দাদুর গলায়। অথচ তাঁরই পাশে দাঁড়িয়ে তার বড় ছেলে ভাবলো ভিন্ন কিছু৷ বাড়িতে এখন শেষ এক সুযোগ রয়ে গেছে মারিয়া তারই ছোট কন্যা।

বিয়ের আসর ভেঙেছে অনেক আগেই। দোতলা, নিচতলা মিলিয়ে থাকার ব্যবস্থা হলো সকলের। দাদীর শরীর আজ বেজায় খারাপ সন্ধ্যের ঘটন থেকেই তাই বাধ্য হয়েই ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছেন তিনি তাঁর পাশেই শুয়েছে বৃষ্টি। নিচতলার সবচেয়ে বড় ঘরটায় আছেন রায়না বেগম আর বাশার শেখ। দোতলায় রিমন নিয়েছে একটা ঘর তাতেই থাকবে রিদওয়ান। বিয়েটা স্বাভাবিক অবস্থায় হলে হয়ত আজ কনের পাশেই থাকতো তার বর। এখানে পরিস্থিতি ভিন্ন হওয়ায় তাদের থাকার চিত্রও ভিন্ন। কথা উঠেছিলো রিদওয়ানের থাকার ব্যবস্থা হবে অর্নিতার ঘর। সে মেনে নেয়নি এ কথা। একবারেই সবটা পেলে কেমন করে চলবে! সে চায় তার ভালোবাসার ঘরটা ধীরে ধীরে কোমল হাতে বুনন করতে। সময় দেবে সে অর্নিকে পূরণ করবে তার প্রতিটা স্বপ্ন ততদিনের এক অদৃশ্য বিচ্ছেদ চলুক দুজনাতে। তাই সুযোগ পেয়েও কাছে চায় না মেয়েটাকে। অর্নিতা থাকবে নিজের ঘরেই সাথে থাকবে নুপুর। রাত বাড়লো বাড়লো বাড়ির নিস্তব্ধতা। প্রত্যেকেই ঘুমের প্রস্তুতি নিয়েছে অথচ ঘুম নেই জনা কয়েক মানুষের চোখেই। অর্নিতা চোখ বুঁজে শুয়ে আছে তার হাতের মুঠোয় একটা একশ টাকার নোট। একটু আগে ঘুমুতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে রিদওয়ান এসেছিলো এ ঘরে। নুপুর তাকে দেখেই ঘর ছেড়েছিলো। রিদওয়ান দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় অর্নিতার সামনে। ব্যগ্র গলায় বলে বসলো, কলম দে তো একটা।

অর্নিতা বিষ্মিত চোখে তাকায় সামনের মানুষটার দিকে৷ এত রাতে কলম কি কাজে লাগবে! রিদওয়ান আবারও তাড়া দিলে অর্নিতা একটা কলম এগিয়ে দেয় রিদওয়ানকে। সে ওয়ালেট থেকে একশ টাকার একটি নোট বের করে তাতে ঝটপট কিছু লিখেই তা বাড়িয়ে দেয় অর্নিতার দিকে।

– বিয়ের রাতে নাকি বউকে কিছু উপহার দিতে হয়! আমার সাথে এখন টাকা ছাড়া কিছুই নেই। এটাই তোর উপহার। যেদিন তোকে বাড়ি নেব ইনশাআল্লাহ সেদিন বিশেষ কিছু উপহার দেব, ঘুমিয়ে পড়।

যেমন বেগে এসেছিলো তেমন বেগেই চলে গেল রিদওয়ান৷ অর্নিতা হতবাক, কি হলো এটা! অর্নিতার ভাবনা লম্বা হওয়ার আগেই আবার ঘরে ঢুকলো নুপুর।

-কেন এসেছিলো রে!

-উপহার দিতে।

-কিসের উপহার?

-বিয়ের।

চলবে….

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-১৪

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৪ (ক)

‘ধন্যবাদ’

ছোট্ট এই শব্দটা মাত্রই এসেছে কাঙ্ক্ষিত পুরুষের পক্ষ থেকে। কেন এই ধন্যবাদ! জানতে ইচ্ছে করছে ভীষণ নুপুরের। শেষ বিকেলের নিভু আলোয় যে মুখটা দেখেছিল গম্ভীর এখন সেই মুখটা কি একটু নরম, কোমল ঘাসের মতন হয়ে আছে? ধন্যবাদ লিখতে কি অনুভূতি খরচ করেনি লোকটা? অর্নিতাদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত ভীষণ মন খারাপ ছিল কিন্তু বাড়ি ফিরতে ফিরতে একটুও মন খারাপ থাকেনি নুপুরের। কত সাধ করে সে রান্না করেছিল আর তারও বেশি আগ্রহ নিয়ে লোকটাকে মেসেজ করেছিল। মিনিট গড়িয়ে ঘন্টা যখন পার হলো তখন মনে হলো হয়ত ব্যস্ত আছে তাই মেসেজ দেখেনি ওই মানুষটা। তার ধারণা ভুল হয় যখন দু ঘন্টা পরও কোন পাল্টা জবাব এলো না। একটা অতি মাত্রায় ব্যস্ত মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন না দেখে থাকতে পারে! হয়ত পারে তবুও নুপুরের মন মানলো না। তার বিশ্বাস লোকটা ইচ্ছে করেই তার মেসেজ দেখেনি। এড়িয়ে গেল তাকে যেমনটা আগেও করেছে। মন খারাপ হলো লজ্জাও লাগলো ভীষণ তার। নিজেকে বেহায়ার ঠিক নিম্মস্তরের মনে হতেই সে বাড়ি ফেরার তাড়া দেখালো। অর্নিতা আর দাদী কেউই তাকে ছাড়তে চাচ্ছিলো না। দাদী তো নুপুরকে বলেই বসলো, ‘তোমার আব্বার সাথে কথা বলায়া দেও বুবু। আমি বলে দিতাছি আইজ তুমি থাকবা এইখানে সকালে আমার দাদায় দিয়া আসব তোমারে।’

নুপুর শোনেনি সেকথা সে তৈরি হয়ে বের হচ্ছিলো তখনই তো এলো অর্ণব৷ আর এখন তার থেকে আসা ধন্যবাদটা আবার নুপুরকে বেহায়া করে তুলছে৷ বাড়ি ফেরার পর থেকেই ছোট মা মুখ চালাচ্ছেন এখনো চলছেই। জাকির ভাই আজ আবারও একটা বিয়ের প্রস্তাব রেখেছেন সেই নিয়েই ঘ্যানরঘ্যানর। বাবাও চুপ করাতে পারছেন না মানুষটাকে। নুপুর ভেবে পায় না সে কি এমন খায়, পরে যার জন্য ছোট মার সংসারে অভাব হবে! এত কেন অপছন্দ করেন তিনি তাকে? সৎ মা হলেই কি খারাপ আচরণ থাকতে হবে মানুষের চরিত্রে! ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে নিয়ে পড়ার টেবিলে বসলো। গত কয়েকদিনে অনেক গাফিলতি ছিল পড়াশোনায়। আজ সবটা পুষিয়ে নেবে বলে মনস্থির করেই বই নিয়ে বসলো। খিদে না পেলে সে আজ আর ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না।
_________

ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থেকেও দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আছে। হাতের মুঠোয় একটা রূপোর আংটি, তার বাবার আংটি। কত তখন বয়স তার নয় নাকি দশ! মায়ের তখনও দ্বিতীয় বিয়ে হয়নি তবে তারা তখন আলাদাই থাকেন৷ বাবার সাথে কি নিয়ে এক ঝগড়া হলো তারপরই মা ব্যাগপত্র গুছিয়ে অর্নিতা আর তাকে নিয়ে চলে গেলেন বাবার বাড়ি। অর্নিতা তখন টুকুর টুকুর হাঁটতে শিখেছে। মামা-মামী আর নানা-নানি তখন অর্নিতা, অর্ণবকে বেশ আদরই করতেন। প্রথম এক সপ্তাহ তাদের সেখানে কাটলো প্রচণ্ড আদর আহ্লাদে এরপর একদিন বাবা গেলেন তাদের আনার জন্য ঠিক সেদিন থেকেই শুরু হলো জীবনের বিভীষিকাময়। মা ফিরলেন না বাবার সাথে তাদের দু ভাই বোনকেও দিলেন না। মা কিসব যেন অভিযোগ তুললেন বাবার নামে তাই সেদিন দুই মামা মিলে মারধোর করলেন বাবাকে। চোখের সামনে বাবার অমন দশা অর্ণব সইতে পারলো না। দৌড়ে গেল বাবার কাছে মা জোর করে তাকে দোতলার ঘরে আটকে রাখলেন। উপায় না পেয়ে অর্ণব জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই দেখলো বাবার কপাল ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে। ছোট্ট অর্নিতা তার ছোট ছোট পায়ে দৌড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো বাবার কোলে৷ নির্দয় তাদের মা রক্তাক্ত বাবার কোল থেকেই টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলো বাবার সেই পুতুল কন্যাকে। সেই ছোট্ট পুতুলটা বাবার আঙ্গুল জড়িয়ে সেকি কান্না! সেদিনই হয়েছিল অর্নিতার সাথে বাবার বিচ্ছেদ রয়ে গিয়েছিল বাবার আঙ্গুলের আংটিখানা ছোট হাতটার মাঝে। বাবা সেদিন অচেতন প্রায় কোনমতে নানার বাড়ির গেইট পেরিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরই ছাড়া পেয়েছিল অর্ণব৷ আর সে সময়েই দেখতে পেল মা অর্নিতার হাতে বাবার আংটিটা দেখতে পেয়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল আঙিনার ঘাসের ওপর। অর্ণব খুঁজে বের করে যত্নে রেখেছিল সেটা। আজ সেটা চোখে পড়ায় হাতে নিয়ে বসে ভাবছিল পুরনো সেই সময়টার কথা। সেদিনের ঘটনা এখনও তার মনে পড়ে খুব। চোখের জল এবার কার্নিশ ছুঁয়ে টুপ করে পড়ে গেল নিচে। তখনই কানে এলো বোনটার ডাক, ভাইয়া খেতে আসো।

-আসছি।

দু হাতে চোখ-মুখ মুছে অর্ণব নিজেকে স্বাভাবিক করে নিচে গেল। দাদী আর অর্নিতা খাওয়া শুরু করে দিয়েছে।

-আমাকে ছাড়াই শুরু করে দিলে তোমরা?

– অপেক্ষা করনের কারণ আছে নাকি!
দাদীর কথায় সুক্ষ্ম খোঁচা। হাসলো অর্ণব। দুপুরে খেতে না আসার জন্যই এটা পাওয়া কিন্তু সেই মেয়েটা কেন এমন করে কিছু বলল না! বললেই পারত।

-আরও দেব?

প্লেটের দিকে অমনোযোগী ভাইকে দেখে অর্নিতা ইচ্ছে করেই বলল। প্লেটে দু চামচ দুপুরের রান্না করা ভুনা খিচুড়ি দিয়েছে সে। অর্ণব বোনের ডাকে সেদিকে তাকিয়ে বলল, এইটুকুতে কি হবে আমার! তার পাশেই দাদী বসেছিলেন। খিচুড়ির ডিশটা ঠেলে তার দিকে এগিয়ে দিলেন, ‘নিয়া নে যত লাগে। তুই বস বুবু অরে নিজে নিয়া খাইতে দে।’

অর্নিতাও তাই করল। অর্ণব এবার পুরো টেবিলে এক পলক তাকিয়ে বুঝলো আজ রান্নাবান্না ভালোই হয়েছিল। ভুনা খিচুড়ি, ইলিশ ভাজা, মুরগির ঝাল মাংস সাথে আবার টক আমের আচারও।

-আম তো আজই আনলাম আজকেই আচার বানানো হয়ে গেল?

অর্ণবের প্রশ্নে দাদী বিরক্তির চোখে তাকালেন। আজ বারংবার তিনি নাতির দিকে রুষ্ট দৃষ্টি ফেলছেন মানে কোন কারণে ভীষণ রেগেই আছেন। অর্ণবও তা বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলো, কি করলাম আমি?

-বৃষ্টিরে নিয়া কই যাবি তুই?

-মানে?

একই সাথে দু ভাইবোন প্রশ্ন করলো। বৃষ্টিকে নিয়ে কোথায় যাওয়ার ছিল মনে করতে পারলো না অর্ণব।

-তোর খালায় বলছে শুক্কুরবার নাকি অর মাইয়া বন্ধুবান্ধব নিয়া চিটাগাং যাইব লগে তুই যাবি। ক্যান অর দুই দুইডা ভাই আছে কি ঘাস কাটতে তোর ক্যন যাওন লাগব?

দাদী কোন এক কারণে বৃষ্টিকে খুব একটা পছন্দ করেন না এ কথা অর্নিতা-অর্ণব দুজনেই জানে। কিন্তু কেন করেন না তা আজও জানতে পারেনি। আর বৃষ্টিকে নিয়ে কোথাও যাওয়ার প্ল্যান কে করল আর করলোই তো তাকে না জানিয়ে কেন! অর্ণব কিছু বলতে চাইলো তার আগেই দাদী বলল, ‘তোমার যাওয়া লাগব না কোন জায়গায়। আমি রায়নারে না করে দিছি আর শোনো দাদাভাই অর্নিতারে এইখানেই রাখো।’

দাদীর কথার অর্থ দু ভাই বোনেরই জানা। আগেও অনেকবার বলেছেন, আমাগো মাইয়া বড় হইছে অগো বাড়িতেও বড় বড় পোলা আছে ভালা দেখায় না ওই বাড়িতে মাইয়ারে রাখা। আমিই দেইখাশুইনা রাখতে পারমু অরে।

অর্ণব শোনেনি সে কথা। যতই বলুক দাদী খেয়াল রাখবে তার মাথা থেকে চিন্তা দূর হবে না। ওখানে খালামনি আছক বৃষ্টি আছে আর রিদওয়ান, রিমনও তাকে কেয়ার করে৷ খালুজান নিজেও বৃষ্টির মতই অর্নিতাকে ভালোবাসেন। ভয় হয় না তার অর্নিকে সেখানে রাখতে উল্টো মন বলে সে ওখানেই সবচেয়ে নিরাপদ। কথাবার্তার ফাঁকেই খাওয়া শেষ হয়েছে অর্ণবের। সে আবারও ঘরে ঢুকে কাজ নিয়ে বসলো। এবার আর মনযোগে বিঘ্ন ঘটেনি একটিবারও। প্রায় মধ্যরাতে কাজ শেষ হলে ফোনটা হাতে নিলো। বিছনা ঝেড়ে গা এলিয়ে ফোনের স্ক্রীণে নজর ফেলেই চমকে গেল সে। বৃষ্টির নম্বর থেকে সাতটা কল। সময় দেখলো তখন রাত বারোটা পঁয়তাল্লিশ। কল এসেছে এগারোটার দিকে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে বৃষ্টি। সকালে উঠে কল করবে বলে ভেবে এবার মেসেজ অপশনে নজর ফেলল। নাহ, ধন্যবাদের বিপরীতে কোন জবাব দেয়নি মেয়েটা। হয়ত রাগ করেছে! কিন্তু প্রথম ধন্যবাদটা ছিল আমের শরবতের জন্য। বাড়ি আসার পর দাদী শরবত দিয়েছিল পরেই জানলো নুপুর বানিয়েছে। কিন্তু এখন যে সে মজা করে খিচুড়ির সাথে মুরগির মাংস খেল সেটার জন্যও আরেকটা ধন্যবাদ প্রাপ্য মেয়েটার। ভবতেই ঠোঁটে হাসির ফোয়ারা। হাজারো বিষাদে আকণ্ঠ ডুবে থাকা ছেলেটা এখন সময়ে অসময়ে হেসে উঠে ওই শ্যামকন্যার কান্ড- কারখানায়। এজন্যে হলেও মেয়েটা অনেকগুলো ধন্যবাদ পায়।ভরা বর্ষায়, নিরদ ঢাকা আকাশটাতে হুট করে সূর্যের উঁকি এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তো ওই পাগল মেয়েরই। রাতের সময়টা হিসেবে রেখেই অর্ণব আবারও একটা ধন্যবাদ লিখে মেসেজ করল। সামান্য একটা মেসেজ টোনে নিশ্চয়ই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে না তার!

_______

ভর সন্ধ্যেতে মন খারাপের পাহাড় মাথায় নিয়ে বসে আছে রিদওয়ান। রায়না বেগম করুণ চোখে দেখছেন ছেলের মুখখানা। একটু আগেই বাশার সাহেবকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি আনা হয়েছে। কাল রিমন বাড়ি এসে বড্ড স্থিরতার সাথে জানিয়েছিল বাবার অসুস্থতার কথা। রায়না বেগম প্রথমেই উতলা হননি পরে অবশ্য হাসপাতালে পৌঁছে অসুস্থ স্বামীর চেয়ে বড় ছেলের চেহারা দেখেই বেশি ভেঙে পড়েন৷ রিদওয়ানের চোখমুখ দেখে মনে হলো তার বাবা অনেক বেশিই অসুস্থ কিংবা হয়ত হার্ট অ্যাটাকই করেছেন। রিমন বাস্তবজ্ঞান সম্পন্ন আর খুবই প্র্যাকটিক্যাল সে। ডাক্তারের সাথে কথা বলিয়ে মাকে আশ্বস্ত করেছে বাবার শারীরিক অবস্থা। রাত আর দিনের পুরো সময় বাশার সাহেবকে অবজারভেশনে রেখে একটু আগেই বাড়ি আনতে পেরেছেন। এরই মাঝে আত্মীয় স্বজন অনেকেই এসেছেন। অর্ণব খবর পেয়েছিল আজ সকালেই। সেও অর্নিতাকে নিয়ে চলে এসেছিল তখন। সারাদিন অর্নি এ বাড়িতেই ছিল আর অর্ণব ছিল রিদওয়ানের পাশেই। বয়সে বছর দুইয়ের বড় রিদওয়ান সবসময়ই অর্ণবের জন্য ছিল বন্ধু। তার মানসিক অবস্থা টের পেয়েই সে একটু আগ পর্যন্তও ছিল৷ কিন্তু একটু আগেই ম্যানেজার আঙ্কেল কল জরুরিভাবে অফিসে দেখা করতে চাইলেন। আঙ্কেলের কণ্ঠ শুনেই অর্ণবের মনে হলো বড় কোন অঘটন ঘটেছে নইলে এভাবে উনি তাকে ডাকতেন না। তাই আর দেরি না করে সে বেরিয়ে পড়লো। মনে মনে উপরওয়ালাকে ডাকছে যেন, সইবার মত কোন ঘটনা হয়৷ এমনিতেই চারপাশের এত বিপদশঙ্কুল আবহাওয়া তাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। আজকাল এমনিতেই মনে হয় বোনটাকে দ্রুত একটা নিরাপদ হাতে দিতে পারলে কোথাও হারিয়ে যেত সে। এই পৃথিবী তার বসবাসযোগ্য নয়।

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৪(খ)

অর্ণবের ধারণা ভুল করে তার মেসেজের জবাবটা রাতেই এসেছিল৷ নুপুর তৎক্ষনাৎ লিখেছিল, ‘লাগবে না আমার আদিখ্যেতা দেখানো ধন্যবাদ। ধন্যবাদ নিয়ে যারটা সে লুডু খেলুক।’

পাল্টা জবাব এমন আজব হবে ধারণা ছিল না অর্ণবের তবুও রাত বেশি হওয়ায় আর কোন মেসেজও সে দিল না। ভেবেছিল পরের দিন কিছু একটা বলবে কিন্তু সেই সুযোগটাও হয়নি। সকালেই খবর পেল খালুজানের অবস্থা এরপরই অর্নিতাকে নিয়ে ছুটলো সে বাড়ি আর তারপর হাসপাতাল থেকে আবার নিজের কারখানায়। ম্যানেজার আঙ্কেল আর অফিসের দারোয়ান মিলে সন্দেহভাজন একজনকে আটকে রেখেছিলেন। কয়েক দিন ধরে অর্ণবকে কেউ ফলো করে এ ব্যাপারে তাদের বলেছিল অর্ণব কিন্তু তারা যে গাঁজাখোর দেখলেও সন্দেহে আটকে রাখবে তা কে জানত! অর্ণব সেদিন আটকে রাখা ছেলেটাকে আটকে রেখে অনেকটা জেরা করে ছেড়ে দিল। সে যেমন দেখেছিল ফলোকারীকে এই ছেলের সাথে তার মিল নেই। সামনাসামনি না দেখলেও মোটামুটি কাছ থেকেই দেখেছিল লোকটা বয়সে তারচেয়েও বড় আর স্বাস্থ্যের দিক থেকেও কিছুটা পেটানো শরীর। এদিকে দারোয়ান যাকে আটক করেছে সেই ছেলেটা নেহায়তই এলাকার পাতি মাস্তান, গাঁজাখোর। চোখ, মুখ চেহারা দেখেই বোঝা যায় নেশায় বুদ থাকে সারাক্ষণ। সেদিন ওই ছেলেটাকে ছেড়ে দিলেও চিন্তা শেষ হয়নি মাথা থেকে। তারওপর খালুজানের অবস্থাও খুব বেশি উন্নত হচ্ছিলো না। এসবের মাঝে প্রায় একটা সপ্তাহ কাটতেই মেজো খালামনি ফোন করে বললেন, অর্নিতা আর শিবলীর বিয়েটা তিনি অতি দ্রুত রাখতে চাইছেন। অর্ণব মানসিকভাবে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে যেন আজকাল। বারংবার মন বলছে থাক মাতাল থাক নেশাড়ু তবুও বাবাটা বেঁচে থাকলে বোধহয় ভাল হত। বাবার জিন্দাদশার অযুহাতে কি দায়িত্বটাকে সে এড়িয়ে যেতে পারতোনা! কিন্তু এখন? বোনটার ভবিষ্যতের ভাবনাটা না থাকলে সে অনায়েসে নিজেকে মুক্ত পাখির মত উড়িয়ে দিতো কোন এক অজানা হাওয়ায়। চোখ বুঁজে মাথা উঁচিয়ে লম্বা শ্বাস টেনে নিলো অর্ণব। চোখ মেলে তাকালো রাস্তার ওপাশে ঝোলা কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যামা কন্যাটির দিকে৷ কয়েকটা দিন ধরেই তার মনে হয় ওই যে ওই মেয়েটির ছটফটে কিছু কথা তাকে একটুক্ষণের জন্য হলেও রিলিফ দেয় তার দমবন্ধ দুনিয়া থেকে। এমন নয় মেয়েটির কণ্ঠস্বর সে শোনে। শুধুই দু চারটে মেসেজ পাল্টা মেসেজেই মেলে স্বস্তির দেখা। নিজের গাম্ভীর্যের খোলস থেকে বেরিয়ে কখনো সে সহজ হয়ে কথা বলতে পারেনি তাই প্রযুক্তির চমৎকার দানের একটি মুঠোফোন আর তার মাধ্যমে পাওয়া মেসেজ অপশনই অর্ণবের মাধ্যম৷ এর বাইরে যা করে তা হল মনের অজান্তেই সে গত চারদিন ধরে ঠিক গৌধূলিলগ্নে এসে এখানটায় দাঁড়ায়। কপাল কুঁচকে, চোয়াল শক্ত করে শুধু মিনিট কয়েক দেখে রাস্তার ওপাশের মেয়েটিকে। তারপরই আবার ফিরে যায় নিজ গন্তব্যে। যতটুকু সময় সে ওই মুখটি দেখে ততটুকু সময়ে পৃথিবীর এ প্রান্তের গৌধূলি রঙ মাখিয়ে যায় অর্ণবের পাথরঘষা দিলে। এখনো তাই হচ্ছে তবে আজ রঙ মাখেনি অন্তরের কোথাও। বরং তার ঠিক পেছনে বসা কয়েকটা ছেলের কথোপকথন তার কর্ণকুহরে গরম সীসার মত ঢুকে ঝলসে দিল ভেতরটা। না চাইতেও ঘাঢ় ফিরিয়ে সে পেছনে চায়ের দোকানটায় একপলক তাকালো। বয়স কত হবে ছেলেগুলোর সতেরো কি আঠারো! দেখেই বোঝা যাচ্ছে কলেজ পড়ুয়া সবগুলো কিন্তু মুখের ভাষা ঠিক কিছু গাঞ্জা টানা ছাগলদের মত। অর্ণব চুপচাপ আরও মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করলো ততক্ষণে রাস্তার ওপাশে থাকা নুপুর রিকশায় উঠে চলে গেছে। এবার অর্ণব হাতের ফোন আর কানের ব্লুটুথটাও পকেটে পুরে নিলো। ফুল স্লিভ শার্টের স্লিভ দুটোই ছিল বোতাম লাগানো ছিল সেগুলো দ্রুতই গুটিয়ে নিলো। চারপাশে কিছু একটার খোঁজ করলেও চোখে কিছু না পড়ায় খালি হাতেই এগিয়ে গেল ছেলে গুলোর সামনে। দিক বিদিক না দেখেই সে সামনে থাকা ছেলেটার টি শার্ট ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে কষে থাপ্পড় লাগায় দুটো। আকস্মিক ঘটনায় দোকানে থাকা প্রত্যেকেই চমকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। থাপ্পড় খাওয়া ছেলেটির বাকি বন্ধুরা অর্ণবের দিকে তেড়ে এলে সে প্রত্যেকটাকেই কলার চেপে ধরে থাপ্পড় লাগায়। থাপ্পড়ের সাথে সাথে তার মুখ থেকে উচ্চারিত হয় মাত্র কয়েকটা বাক্য, ‘সে*ক্সি লাগো! ফিগার মাপতে তোর হাতই যথেষ্ট তাই না! দেখি কোন হাতে মাপবি? বিছানায় নিতে চামড়া সাদা দরকার আছে বলেও সাজেশন দিচ্ছিলো কে যেন বল?’

অর্ণব কথাগুলো বলতে বলতেই এলোপাথারি থাপ্পড় লাগাচ্ছিল চারটে ছেলেকে। দোকানটাতে আরও দু তিনজন যারা ছিল তারা হকচকিয়ে গেল কিন্তু কেউই মুখ খুলল না অথবা সাহস পায়নি কিছু বলার। হতে পারে অর্ণবের দেহাবয়বের বিশেষত্বয় ঠিক কারো সাহস হয়ে উঠেনি৷ এদিকে দোকানদারসহ অন্য কাস্টমাররা ততক্ষণে বুঝে গেছে আকস্মিক আক্রমণের কারণ।

-এই নাম বল তোদের সাথে বাবার নাম আর ঠিকানা।

প্রত্যেকটা ছেলেই এবার ভড়কালো। তবে কি বাড়িতে নালিশ যাবে এখন! ছেলেগুলো ভয় পাওয়া চেহারায় তাকিয়ে আছে। কিন্তু তাদের সাথে যে আরও একজন ছিল এবং এমন কথাগুলোর শুরুটাই যক করেছিল সে এখান থেকে অর্ণব ঘাঢ় ফিরিয়ে দেখার আগেই পগারপার হয়ে গেছে তা আর জানা হলো না অর্ণবের। শেষ পর্যন্ত কারো বাবার নাম, ঠিকানা না নিলেও প্রত্যেকের একটা ছবি তুলে নিলো সে। আপাতত এদের জন্য এইটুকুই ভয়ের ছিল। মাগরিবের আজান কানে যেতেই অর্ণব সেখান থেকে চলে গেল৷
___________
বাশার শেখ এখন কিছুটা সুস্থ আছেন। এই সুস্থতায় আছে সাবধানতার আদেশ ডাক্তার কতৃক। টোটাল বেড রেস্ট না থাকলেও ছুটোছুটি আর অতিরিক্ত চিন্তার উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা। বাধ্য হয়েই এক সপ্তাহের মাঝে একবারও বাড়ির বাইরে যেতে পারেননি। কোটি টাকার ব্যবসা এখন পড়ে আছে দুই ছেলের অপরিপক্ক কাঁধে। উহু, দুজনই না একজন অপরিপক্ক ব্যবসায়িক ব্যাপারে অন্যজন এতোদিনে পাকা ব্যবসায়ীই হয়ে উঠেছে বলা যায়। জীবনের অর্ধেকটা সময় ব্যবসার যাতাকলে পিষতে থাকা মানুষ হঠাৎ করেই অবসরে পড়ে সময়টা ঠিকঠাক উপভোগ করতে পারেন না বোধহয়। অন্তত বাশার শেখকে দেখে তেমনটাই মনে হচ্ছে রায়না বেগমের। রান্নাঘরে গ্রিন টি আর এক প্যাকেট নোনতা বিস্কিট ট্রে তে রাখতে রাখতে ভাবছিলেন এই একটা সপ্তাহের কথা। মানুষটা বোধহয় আচরণে একটু নরম হচ্ছেন। গত সপ্তাহেও যে মানুষটা তাঁকে রুক্ষ স্বরে ডাকতেন, নিজের প্রয়োজনগুলোতে আদেশ করতেন সে মানুষটা হাসপাতাল থেকে আসার পর থেকেই নরম হয়ে কথা বলেন। কিছু প্রয়োজন পড়লে সরাসরি আদেশ নয় বরং আবদার অথবা আহ্লাদে বলেন। আর তাই রায়না বেগম এখন মনে মনে গুছিয়ে নিলেন বড় ছেলে সম্পর্কিত কিছু কথা যা খুব শিগগিরই বাশার শেখের সামনে পেশ করবেন। । তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না তাঁর ভাবনার সুতোও অচিরেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ লেগে সবটা ঝলসে যেতে পারে। আজ বিকেলটা ঘরে বসে কাটাতে চাচ্ছিলেন না বাশার শেখ তাই মেয়েকে ডেকে বললেন বাইরে যাবেন। বৃষ্টিও তৎক্ষনাৎ আব্বুকে হাত ধরে নিয়ে এলো বাগানের দিকটায়। অর্নিতাও আজ এ সময়ে একদমই ফ্রী থাকায় সেও যুক্ত হলো খালুজান আর বৃষ্টি আপুর সাথে। তিনজনে বসে কথা বলছিল বাগানের গাছপালা আর ফুল, ফল নিয়ে৷ ঠিক তখনই রায়না বেগম এলেন চা নিয়ে সাথে বাশার শেখের মোবাইলটা নিয়ে।

‘আপনি কি একটু কথা বলতে পারবেন?’
রায়না বেগম কথাটা বলেই ফোনটা বাড়িয়ে দিলেন স্বামীর দিকে।

-কার কল?

-শিবলীর বাবা।

‘শিবলীর বাবা’ কথাটা শুনতেই অর্নিতার হৃৎপিণ্ডের রক্ত চলকে উঠল যেন। মনে মনে যতই চাইছে মাথা থেকে বিয়ে আর শিবলীকে সরিয়ে রাখতে ততই যেন সময়টা এগিয়েছিল যাচাই সেদিকেই। বাশার শেখ স্ত্রীর হাত থেকে ফোন নিয়ে ধীরে ধীরে কথা বললেন ভায়রা ভাইয়ের সাথে। সল্পবাক্যে কথা শেষ করে বললেন এ সপ্তাহেই তারা আকদ করতে চাইছেন। অর্ণবকে জানানোর আগে বাশার শেখকেই অর্নিতার অভিভাবক মনে করেন তারা আর তাই প্রথমে বাশার সাহেবের কাছেই রাখলপন প্রস্তাব। বাশার শেখ সম্মতি দিয়ে দিয়েছেন৷ অর্নি পাশে বসেই খালুজানের কথা শুনেছে। বুঝেও নিয়েছে কি হতে চলেছে শিগগিরই। না চাইতেও তার বিষন্নতার ঘরটাতে একঝাঁক কষ্ট আবারও এসে জমা হলো। খুব বেশি কিছু তো চাই না তার শুধুই একটা স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া। জীবনটা কি তাকে সেই সুযোগটা দেবে না! খালামনি, খালুজান কিংবা বৃষ্টি আপুর সামনে নিজের অনুভূতি স্পষ্ট না হয়ে যায় সেই ভয়ে বসা থেকে উঠে গেল অর্নিতা। চোখের চশমাটা এতক্ষণ ঝাপসা চোখে বৃষ্টি ভেজা জানালার শার্সির মত ঘোলা লাগছে তার। দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে অশ্রুকণাদের মুক্ত করে দিল। চশমা খুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে চোখটা মুছতেই দেখতে পেল সামনে রিদওয়ান ভাই। চশমা চোখে দিলো আবারও, সে কি ভুল দেখছে! নাহ চশমা চোখে দিতেই সামনের মানুষটার মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠলো তার দৃষ্টি সীমানায়। রিদওয়ান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অর্নিতার দিকে। হলদে ফর্সা মুখের ভরাট গালদুটোয় নোনা জলের সরু রেখা ঠোঁট দুটো কুঁচকে আছে। মুহূর্তেই রিদওয়ান আনমনে আঙ্গুলে ছুঁয়ে আলতো করে মুছে দিলো অর্নিতার ডান গালটা আর ঠিক তখনি ছিটকে সরে গেল অর্নিতা। এতেই বুঝি হুঁশ ফিরল রিদওয়ানের। কি করতে যাচ্ছিলো সে! অর্নিতার মুখের দিকে আবার তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই উল্টো ঘুরে দ্রুত পায়ে উঠে গেল দোতলায়। অর্নিতা খেয়াল করেছিল রিদওয়ান ভাইয়ের সাদা শার্টের ইন খোলা একপাশ, গলার ওপর লাল টাইটা আলগা হয়ে আছে, থুতুনির দিকে কিছুটা লাল রঙ নাকি রক্ত ছিল! এবার টনক নড়লো যেন অর্নির। রিদওয়ান ভাই কি মারামারি করেছে কারো সাথে? শার্টের কলারের ঠিক নিচেই একটু ছেঁড়াও ছিল বোধহয়। অর্নি চটপটে হয়ে কখনোই কিছু করতে পারে না এখনো পারলো না।খুব ধীরেই সে দোতলায় উঠে রিদওয়ানের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দরজার পর্দা ছড়ানো কিন্তু দরজার কপাট খোলাই আছে। অর্নি ইতস্তত করছিল ভেতরে ঢুকে কিছু জিজ্ঞেস করবে কি করবে না তখনই কানে এলো রিদওয়ানের কথা।

-হ্যাঁ মেরেছি। ওর সাহস কি করে হয় এমন ডবল গেম খেলার?
রিদওয়ান এটুকু বলেই থামলো হয়তো ওপাশের ব্যক্তিটি কিছু বলছে। মুহূর্তেই আবার রিদওয়ানের গলা, ‘ খু’ন করিনি সেই তো তার ভাগ্য। সকল প্রমাণ আমার হাতে থাকার পরও ভন্ডামি করছিল। ওর যে কলিজা খুলে হাতে নেইনি সেই তো অনেক।

…….

-বড় ভাই মাই ফুট! ওর মত এমন খালাতো ভাইকে আমি বালের দামও দেই না। যার চরিত্রের ঠিক নেই সে মানুষের কাতারে পড়ে নাকি। ও আসুক অর্নিকে বিয়ে করতে আমি যদি ওর দেহ থেকে মাথা আলাদা না করছি তো আমার নামও রিদওয়ান শেখ না৷

প্রচণ্ডরকম রেগে আছে রিদওয়ান৷ গলার টাইটা খুলে ছুঁড়ে মারলো বিছানায়। শার্টের বোতামগুলোর যেন একটু ধৈর্য্যও নেই তাই জোরে টানলো আর ঝরঝর করে ছিঁড়ে পড়লো বোতাম একটা একটা করে। কলটা কেটে ফোনটা বিছানায় ফেলতেই রিদওয়ানের মনে হলো দরজার সামনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। সে এগিয়ে গিয়ে পর্দাটা সরাতে দেখলো কেউ নেই সেখানে। অর্নিতা আগেই সরে পাশেই রিমনের ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। ভেতরের রাগটা ঠিকঠাক শীতল করা খুব প্রয়োজন ভেবে রিদওয়ান এবার ঢুকে গেল বাথরুমে৷ আজ বোধহয় একটা খুনোখুনি হতে হতেই আর হলো না। তবে অতিসত্বর কিছু একটা হবে আর তা যে রিদওয়ানের মাধ্যমে তা আন্দাজ করে নিলো দরজার বাইরে থাকা অর্নিতা।

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-১৩

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৩ (ক)

নাশতা শেষ করেই অর্ণব অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। মনে মনে ঠিক করে নিলো আজ আর দুপুরে খেতে বাড়িতে আসবে না। অন্তরাত্মা আগেই জানান দিয়েছে মন আগাচ্ছে ভুল পথে। ছোট্ট একটা জীবন তাতে অনেক কিছু আছে করার মত। জেনেশুনে ভুলে জড়িয়ে গেলে অনেকগুলো কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। দরকার কি এমন ভু্ল করার! নুপুর নিশ্চয়ই দুপুরের পর চলে যাবে ততক্ষণ বাড়িঘর ভুলে থাকলেই চলবে৷ অন্যান্য দিনও তো এমন হয় কাজের চাপে বাড়িতে যায় না আজও না হয় তেমনই দিন ভেবে নেবে। অফিসে এসেই প্রথমে চেক করলো ইমেইলগুলো। বরাবরের মতই হতাশ হতে হলো অর্ণবকে লোন সংক্রান্ত কোন বার্তা নেই।
_____________

এই রোদ এই বৃষ্টি যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে মেঘ আর সূর্য। নুপুরের চমৎকার সকালের এক ভাগ নষ্ট করেছিলো জাকিরের ঔদ্ধত্যপূর্ণ কিছু কথা আর এক ভাগ মিষ্টি করেছিল অর্ণবের ছোট একটা ধন্যবাদ। আদৌও ছোট নয় সেটা নুপুরের কাছে। নাশতা নিজের ঘরে বসে করতে চেয়েও করতে পারেনি অর্ণব। নিচ থেকে দাদী ধমকে উঠে বলেছিলেন, কই দিব নাশতা নিচে আয় তুই।

দাদীর তো অজানা কি চলে ওই গোমরামুখো নাতির অন্তরে আর উড়ুক্কু প্রজাপতির ন্যায় উড়তে থাকা নুপুরের মনে। নুপুরের নিক্কণ তোলা ধ্বনির মতই তো ছন্দ তুলে চলে ওই শ্যামাবতী। অর্ণব নিচে এসেছিল একেবারে তৈরি হয়েই। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট আর এই প্রথম গলায় টাই পরতে দেখেছে নুপুর জল্লাদমুখো মানুষটাকে। কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে বড় আলগোছে ঠোঁটের ডগায় আওয়াজ তুলল, মাশাআল্লাহ! পরেই আবার বলল, নাউজুবিল্লাহ! খুব কাছেই ছিল অর্ণব তাই শব্দদুটো শুনতেই চোখে চোখ রেখেছিল নুপুরের। আধপাগল, ক্ষ্যাপাটে বড় এই মেয়েটা। সে চোখ নামিয়ে নাশতায় মনোযোগ দিল। মিনিট পাঁচেকেই নাশতা সেরে কোন রকমে ত্যাগ করতে চাইলো বাড়ির সীমানা। তারপরও তাড়াহুড়োর মাঝে মনে পড়ে গেল জন্মদিনের সেই উপহারের কথা।বলতে নেই, অর্ণব চেষ্টা করেছিল উপহারখানা ফেলে দিতে কিন্তু মন মানলো না। হাতে নিয়ে বার কয়েক সেটাকে দেখে ভালো লেগেছিল৷ ঘড়ি ছাড়া কখনোই হাতে অন্যকিছু পরে না সে তবুও কলেজ আর ভার্সিটিতে অনেকেই বলেছে তার হাতে শিকল কিংবা চওড়া ধরণের দেখতে ব্রেসলেট বেশ মানাবে। রিদওয়ানও একবার মালায়শিয়া থেকে এনে দিয়েছিল একটা চমৎকার জিনিস তবুও পরেনি অর্ণব অথচ এই ছোট্ট সাধারণ উপহারটা পরার সাধ জেগেছিল তার। স্বভাববিরুদ্ধ বলেই কিনা কে জানে তুলে রেখে দিয়েছে সেটা। তবুও পছন্দ তো হয়েছিল! তাই সে বাড়ি থেকে বেরুবার পথে পেছন ফিরে বলল, ধন্যবাদ।

নুপুর কথাটা শুনে বোকার মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো অর্ণবের যাওয়ার পথে। ধন্যবাদ কেন দিলো! যে তাড়াহুড়োয় বেরিয়ে গেল লোকটা প্রশ্ন করার সুযোগই পেল না। তারপর হঠাৎ, একেবারে আকষ্মিক মনে হলো, লোকটা কি সেই বার্থডে গিফটের জন্য ধন্যবাদ দিলো! নুপুরের বুঝতে সমস্যা হয়নি ওই জল্লাদমশাই তাকে ইগনোর করতেই অত দ্রুত বাড়ি ছেড়েছে। তারমানে কি তার উপস্থিতির মূল্য আছে লোকটার জীবনে? ব্যাপারটা আনন্দের! সত্যিই ভীষণ মুগ্ধ হয়েছে নুপুর। তারমতো কাল কাঞ্চনও একজন সুদর্শন পুরুষের ভয়ের কারণ হতে পারে! ভাবতে ভাবতেই ফিক করে হেসে উঠেছিল সে। দাদীর চোখ এড়ায়নি সে হাসি তিনিও যেন আগাম কোন সংকেত পেয়ে গেলেন। অর্ণবের আনা মাছ আর আমের দিকে তাকিয়ে জোরে হাঁক ছাড়লেন, বুবুরা এইদিকে আসো একটু।

‘বুবুরা’ শব্দটা শুনে ভাল লাগল অর্নিতার। দাদী নুপুরকে আপন ভেবে ডাকছে বলে সত্যিই আনন্দ হলো অর্নিতার। তার ধারণা, বান্ধবী তার ভাইকে পছন্দ করে এখন মনে হচ্ছে দাদীও খুব পছন্দ করেছে। আকাশকুসুম ভাবনা কখনো অর্নিতার মনে আসে না কিন্তু আজ এ ক্ষণে নুপুর আর ভাইকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে। দু’জনের মাঝে যদি কিছু হয় তবে সে খুশিই হবে খুব। তার ভাই, নুপুর আর সে তিনজনই যেন একই স্রোতে ভাসতে থাকা ভাঙা নৌকা। নিজেরটা তো তার জানা হয়েই গেছে তাকে ভেসে গিয়ে বসত গাড়তে হবে মেজো খালামনির ডেরায়। কিন্তু ভাইটার কি হবে! দাদীর বয়স হয়েছে সেও এখন বাড়িতে কাউকে কাছে চায়। সেই চাওয়া বড় আপন কারো সঙ্গ। সবাই কি আপন হতে পারে বা পারবে? দাদীর ডাক আবারও কানে আসতেই সে এগিয়ে গেল দাদীর কাছে। দাদী মাছ আর আম দেখিয়ে বললেন, আজকে এইগুলান তোমরা কাটবা পারবা না!

অর্নিতা কিছু বলার আগেই নুপুর বলে উঠলো, শুধু কাটবো কেন রান্নাও করব।

-তুই ইলিশ রাঁধতে পারিস!
অর্নিতা চোখ রাঙালো বান্ধবীকে।

-পারি না বলে চেষ্টাও করব না নাকি?

টেবিলে সাজানো নাশতা দাদী বসে আছে। পাশেই নুপুর নিজ হাতে দাদীর প্লেটে রুটি তুলে দিচ্ছে। অর্নিতাও অপর পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়লো। নাশতার পর্ব শেষ করতেই দাদী নিজে ঠিক করে দিলেন রান্না আজ অর্নিতা করবে। কথায় কথায় দাদী আর নুপুর মিলে ক্ষেপালোও তাকে বেশ শিবলী ভাইয়ের নাম করে। রুজিনা খালা মাছ নিজেই কেটে দিলে নুপুর যেচে মাছ ভাজলো সাথে মুরগির মাংসটাও রাঁধলো। অর্নিতা ভুনা খিচুড়ি রাঁধলো আর সবটাই দাদী রান্নাঘরে বসে শিখিয়ে দিলেন। রান্নার পাট চুকাতেই ঘড়িতে বাজলো বারোটার বেশি। অর্ণবের আনা আমের ব্যাগে চোখ পড়তেই নুপুর দাদীকে বলল, আম দিয়ে কি আচার হবে দাদী?

-হু,

-টক নাকি মিষ্টি হবে?

-আমি আর অর্ণব আলুর ভর্তা আচারের তেল ছাড়া খাইতে পারি না। এইজন্য টক আচার করমু আর রায়নার বড় পোলাডা আমার বানানি মিষ্টি আচার পছন্দ করে অনেক। ওর লাইগা এক বৈয়াম খোসাওয়ালা মিষ্টি আচারও বানামু ভাবছি।

নুপুর অবাক হয়ে তাকালো অর্নিতার দাদীর দিকে। বরাবরই অর্নি তার এই দাদীর খুব প্রশংসা করে। কথায় কথায় অনেকবার বলেছিল দাদী সবার খাবারের পছন্দটা একটু বেশিই খেয়াল রাখেন। সত্তর পেরোনো এই মানুষটা বিভিন্ন রোগে কাহিল হয়ে চলতে ফিরতে কষ্টবোধ করেন তবুও মাঝেমধ্যে নাকি নাতি-নাতনির জন্য রান্নাঘরে ঢোকেন। শীতের মৌসুমে পিঠাপুলি বেশি না হোক কম করে হলেও নিজ হাতে তৈরি করেন অর্ণব -অর্নিতার জন্য। নুপুরের মন খারাপ হয় ভাবতে গিয়ে। তার মা নেই সেই ছোট্ট থেকেই। বাবার দ্বিতীয় বিয়ের জন্য নানা বাড়ির মানুষরাও এখন আর খোঁজ নেয় না তেমন। নুপুরের জীবনে আদর-আহ্লাদ শুধু এক বাবাই করেন। কিন্তু মায়ের মত কিংবা দাদী, ফুপু অথবা খালার মত কোন স্নেহের পরশ তার জীবনে আসেইনি কোনদিন৷ অর্ণব অর্নিতা নাকি ছোট থেকেই মা-বাবার সঙ্গ পায়নি কিন্তু তবুও যেন মা-বাবার ভালোবাসার অভাবটাও হয়নি তাদের। সে ভেতরের চাপা শূন্যতাকে দীর্ঘশ্বাসের সাথে বের করে দিতে চায়। মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে অর্নিতার দাদীকে বলল, আমি আমগুলো কেটে দেই দাদী?

– না গো বুবু। দাওয়াত কইরা আনছি আর কাজই করাইতাছি তখন থাইকা। এইবার গিয়া জিরাও তুমি৷ আমি গোছল দিমু, নামাজ পড়মু তারপর তোমাগো নিয়া খাবার খামু।

-আপনি গোসল আর নামাজ শেষ করে আসেন দাদী ততক্ষণে আমি এগুলো কেটে রাখি। বলেন তো কিভাবে কাটতে হবে?

জোর করেই নুপুর বসে পড়লো আম কাটতে। তা দেখে অর্নিও বসলো তার পাশে। রুজিনা খালা দুজনকে বারণ করলেও কেউ শুনলো না সে কথা। দাদীর গোসল আর নামাজ শেষ হওয়ার আগেই দু বান্ধবী মিলে হাসি ঠাট্টায় কেজি পাঁচেক আম কেটে নিলো। নুপুর মুখ হাত ধুয়ে চুল আঁচড়ে নিজেকে কিছুটা পরিপাটি করে নিতেই অর্নিতা গেল গোসল করতে।

____________

-মে আই কাম ইন স্যার!

-ইয়েস…

ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিতেই রিদওয়ান ঢুকলো বাবার কেবিনে। সকাল আটটায় এসে নিজের ডেস্কে বসেছিল সে। তারপর ঠিক দেড়টায় বাবার কেবিনে নক করলো। বাশার সাহেব তখন সবে কাজ এড়িয়ে লাঞ্চের কথা ভাবছিলেন। হুট করে গায়েব হওয়া ছেলেটা আজ অফিস টাইমের আগেই নাকি অফিসে ঢুকেছে স্পেয়ার চাবি নিয়ে সে কথা তিনি জানতে পেরেছেন সকালেই। ইচ্ছে করেই এ নিয়ে নিজে থেকে তিনি কোন কথা বলেননি তবেই অবশ্যই অপেক্ষায় ছিলেন। বাউণ্ডুলে ছেলেটা কখন কি করে আর কেন করে তা তিনি জানেন না স্বয়ং ছেলে নিজেই জানেন না। তাই তিনি ধৈর্য্য রেখেছেন কোন দুঃসংবাদ পাওয়ার। সারা সকাল পেরিয়ে দুপুর হতেই আতঙ্ক বাড়ছিলো যেন। তাই ছেলে এসে ঘরে ঢুকতেই তিনি শান্ত স্বরে জানতে চাইলেন ছেলের আসার কারণ। রিদওয়ান হাতে একটা নীলরঙা ফাইল এনেছিলো সেটা এগিয়ে দিলো বাবার দিকে।

-কি এটা?

-নতুন প্রজেক্টের ফাইল। আর…..
সাদা একটা খাম এগিয়ে দিয়ে রিদওয়ান এবার কথা সম্পূর্ণ করল, আমার রেজিগনেশন লেটার।

কাঁচ-ঘেরা অফিস রুমটায় কিছু সময় চলল পিনপতন নীরবতা তারপরই এক রকম বজ্র হুংকার ছাড়লেন, আর ইউ কিডিং উইদ মি!

-নো স্যার।

-ইয়েস ইট’স…

-নো স্যার আ’ম ন’ট জোকিং উইদ ইউ।

বাশার শেখ অনেক বেশিই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু উচ্চরক্তচাপ আছে বলেই তিনি নিজেকে সবসময় সকল ব্যাপারেই স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন এবং যথেষ্ট সফলও হয়েছেন এ পর্যন্ত। কিন্তু আজকের বিষয়টা একদমই ভিন্ন। মাত্রই সপ্তাহ দুই আগে খুব ভরসা করে বড় ছেলেকে দেশের সবচেয়ে খ্যাত এক কোম্পানির সাথে নতুন চুক্তির কাজটা হাতে কলমে শিখিয়ে পড়িয়ে ধরিয়ে দিয়েছেন। এখন এই মুহূর্তে ছেলের মুখে সেই প্রজেক্টে কাজ না করতে চাওয়ার কথা শুনে নার্ভে ভীষণ চাপ অনুভব করলেন। অকস্মাৎ এমন কিছু হলে জীবনের সবচেয়ে বৃহৎ অঙ্কের মা’রটা তাঁকে এখানেই খেতে হবে। রিদওয়ান বাবার চোখ, মুখের অস্বাভাবিক পরিবর্তন আর শরীর ভিজে উঠা দেখে ভয় পেয়ে গেল। না চাইতেও মনে ভয় ধরে গেল, বাবা কি স্ট্রোক করল!

_________

রিমন লাঞ্চে আওয়ারের আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছিল আজ। সন্ন্যাস বাবাজী যে নিজে থেকে কিছু করবে না তা মনে হতেই সে নিজ দায়িত্বে শিবলীর ভিডিও আর ছবিগুলো নিজেই এক বন্ধুর মাধ্যমে অর্ণবকে পাঠাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো কিন্তু তার আগে রূপা মেয়েটার সাথে কথা বলা জরুরি। শিবলী ভাই কি রূপার সাথে টাইমপাস করছে নাকি অর্নিতাকেই ধোঁকা দিবে সবটা খতিয়ে না দেখে কিছু করা বোকামি হতে পারে ভেবেই রিমন আজ দিনের বাকিটা সময় অফিস ছেড়ে বন্ধুদের কাছে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও বুঝি তার মন্ত্রনা ভেস্তে দোওয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছিল! কোন কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই তাকে আগাতে হলো হাসপাতালের দিকে।

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১৩(খ)

দুপুর থেকে হাসপাতালের বদ্ধ কেবিনে থম মেরে বসে আছে রিদওয়ান। তার বাবাকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে বলে এখনো ঘুমে তিনি৷ রিমন একটু আগেই বেরিয়েছে বাড়িতে যাবে বলে। এখন বাড়ি গিয়ে খুব সাবধানে মাকে জানাতে হবে বাবার কথা। খুব কৌশলে বোঝাতে হবে একটি রাত বাবাকে হাসপাতালে রাখা জরুরি। সৌভাগ্যক্রমে বাবার বুকে ব্যথা হলেও হার্ট অ্যাটাক হয়নি। এক মুহূর্তের জন্য রিদওয়ানের মনে হয়েছিল বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছেন কিন্তু সকল পরীক্ষা নিরিক্ষার মাধ্যমে জানা গেল রক্ষা করেছে আল্লাহ্ আজ তবে অতিরিক্ত চিন্তান্বিত অবস্থা হলে পরের বার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হতে পারে৷ উচ্চ রক্তচাপের সমস্যাটা তো বাবার বহু পুরনো তাই ভয়টা নেহাৎ কম নয়। দুপুরে রিদওয়ানের অফিস ছেড়ে যাওয়া এবং কয়েক কোটি টাকার একটা ডিল নষ্ট হওয়ার আতঙ্কেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বাশার শেখ। মূলত এবারের কাজের সকল প্রকার প্রস্তুতি তিনি রিদওয়ানকে দিয়ে করিয়েছেন। প্রেজেন্টেশনটা যখন রিদওয়ান তৈরি করেছে তখন অল্প সময়ে অন্য হাতে যাওয়া মানেই সবটা ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা নব্বই শতাংশ। রিদওয়ান বাবার অবস্থা খারাপ হচ্ছে টের পেতেই দ্রুত হাসপাতালে আনে বাবাকে। রিমনকেও ফোন করে জানিয়ে দেয় আসার কথা কিন্তু বাড়িতে মা, বোনকে জানানোর সাহসটা আর হলো না তার। ডাক্তার বলেছেন রাতটা অবজারভেশনে রেখে কাল স্বাস্থ্যের উন্নতি হলেই ডিসচার্জ করবেন৷ তাই বাধ্য হয়েই এবার বাড়িতে জানাতে গেল রিমন সেই সাথে মাকেও নিয়ে আসবে সঙ্গে করে। রিদওয়ানের মাথার ভেতরটা সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে আছে একদম। কি করতে চাইলো আর কি হয়ে গেল! সে তো কারো ক্ষতি চায় না, কারো দুঃখ, কারো মনোমালিন্যতাও চায় না। জীবনে সকল চাওয়া পাওয়ার গলা টিপে অনেক আগেই সে নিজেকে করতে চাইছিলো বাবার হাতের পুতুল। শেষ পর্যন্ত পারলো কই! একটা মেয়ের প্রেমে পাগল প্রায় হয়ে সে ভাঙতে চাইছিলো বাবার তৈরি লৌহ দেয়াল এখানেও এসে বাবার জীবনহানির কারণ হওয়ার পথে। ইশ, ভাবনায় ডুবে প্রহসন করে ফেলছে সে। ওই মেয়েটার কথা কেন ভাবতে গেল রিদওয়ান নিজেই নিজেকে শুধায়। সকালে নাশতা করা হয়নি ঠিকঠাক তারপর সারা দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল। পেটে এক ফোঁটা পানিও পড়েনি তার। রিমন যাওয়ার আগে হসপিটাল ক্যান্টিন থেকে ওয়াটার বোতল আর চিকেন রোল কিনে রেখে গেছে৷ খিদে পেটে এখন সেদিকে দৃষ্টি যেতেই খিদে আরও বেড়ে গেল তার।
__________

দুপুর থেকে সাতটা মেসেজ পেল অর্ণব নুপুরের নম্বর থেকে। বারণ ছিল সেই কবেবার মেয়েটা শুনলো না। অনেকদিন কোন কল, মেসেজ কিছুই দেয়নি আজ হঠাৎ করে এতগুলো মেসেজ একসাথে দেয়ায় একটু অবাক হলেও সেগুলো দেখার আগ্রহ বোধ করলো না হতে পারে আগ্রহটাকে সে চাপা দিলো। বহুদিনের গড়ে তোলা প্রতিরোধ তার কোন মেয়ের মায়ায় আটকাবে না সে৷ কিন্তু এই শ্যামাকন্যা বড্ড পাজি। আঠার মত লেগে আছে অদৃশ্য সত্তা নিয়ে৷ মেসেজগুলো না পড়লেও সে আর কাজে মন দিতে পারছে না ঠিকঠাক। দুপুরে সত্যিই সে খাবার খেতে বাড়ি যায়নি তাই দাদী একবার ফোন করে বকাঝকা করেছিলো। তারপর আর কোন কল আসেনি কিন্তু এখন এই মেসেজ তার কাজের দিক থেকে মনকে সরিয়ে দিচ্ছে। হাতের সামনে নতুন কাঁচামালের হিসেব অথচ চোখ বারবার আটকে যাচ্ছে ফোনের ওপর। কি লিখেছে মেসেজে সে? এবার আর মন মানলো না। কাজ রেখে ফোনটাই হাতে তুলল অর্ণব।

– খাওয়ার পর অবশ্যই প্রশংসা করবেন।

প্রথম বার্তা এইটুকুই। অর্ণবের প্রথমে বুঝতে সমস্যা হলো কি খাবে আর কিসের প্রশংসা করবে! পরে সে এই খুদে বার্তা আসার সময়টা দেখলো দুপুর একটা বারো মিনিট। আন্দাজ করে নিলো আজ বাড়িতে নুপুর নিশ্চয়ই রান্না করেছে রুজিনা খালার সাথে। পরবর্তী বার্তাটা ছিলো এমন, ‘এত লেট!’

অর্ণবের মনে হলো তার ঘরের একজন তাকে বকা দিচ্ছে বাড়ি ফেরেনি বলে। এই বার্তার সময়টা ছিল দুইটা পঁয়তাল্লিশ। এরপরের বার্তাগুলো একটু আগে মানে বিকেলের শেষ মুহূর্তে এসেছে একসাথে। প্রত্যেকটাতেই শুরুর শব্দ ‘স্যরি।’ খারাপ লাগল এবার তার। মেয়েটা আন্দাজ করে নিয়েছে তার উপস্থিতির জন্যই অর্ণব বাড়ি ফেরেনি। মেয়েটাকে ইগনোর করতে গিয়ে তাকে কেমন গিল্ট করে দিলো এটা বোধহয় ঠিক হয়নি। অনুভূতির ওপর কারো হাত নেই তবুও মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে তাকে প্রতিরোধ করতে চায়। বড় যন্ত্রণা এসে ধরলো তাকে অসময়ে। হাতের কাজ আর আগানো সম্ভব নয়। ফাইলগুলো আর কম্পিউটারের ডিটেইলগুলো পিডিএফ করে দ্রুত সেন্ড করলো ল্যাপটপে। যা কাজ আছে আজ বাড়িতে বসে করতে হবে এই মুহূর্তে মন টানছে বাড়িতে। অফিস থেকে বেরিয়ে খুব একটা সময় লাগেনি অর্ণব পৌঁছে গেল বাড়িতে। দিনের আলো পশ্চিমে ডুবছে মুহূর্ত মাথার ওপর আকাশটাতে মেঘ ছাওয়া। অর্নিতা হাতটা ধরে নুপুরের সাথে গেইট পর্যন্ত চলে এসেছে আর সদর দরজায় রুজিনা খালার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন দাদী। বাড়ি এসে এমন একটা দৃশ্য দেখবে বলে আশা করেনি অর্ণব পরক্ষণেই নিজেকে প্রবোধ দিলো তবে কি সে আশা করেছিল মেয়েটা আজীবন থেকে যাবে!

-ওহ ভাইয়া এসেছো ভালো হয়েছে।

-কেন কি হয়েছে?
নুপুরের দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা করলো সে। সদা চঞ্চল আচরণ করা মেয়েটা কেমন মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে ভাল লাগল না অর্ণবের।

-ওর বাড়ি ফিরতে হবে কিন্তু আঙ্কেল একটু ব্যস্ত আছেন তাই বাজার পর্যন্ত একা যেতে হবে।

– চলেই যদি যাবে তো বিকেলে যেতে পারেনি?

বিড়বিড় করেই বলল সে কিন্তু অর্নিতা শুনলো ভাইয়ের অস্পষ্ট বাক্যটা।

-কিছু বললে ভাইয়া?

– না, তুই বল কি বলতে চাইছিলি?

-ওকে একটু বাজার অব্দি এগিয়ে দিলে ভাল হয়। আঙ্কেল ততক্ষণে ফ্রী হয়ে চলে আসবেন।

অর্নিতার কথা শুনে নুপুর আঙ্গুল টেনে ধরলো বান্ধবীর। বোঝাতে চাইলো থেমে যা আমি একাই যেতে পারব। অর্নি বোঝেনি পুরো কথাই সে শেষ করেছে। পেছন থেকে দাদীও বললেন, দাদাভাই একটু দিয়া আসো অরে। আমিই জোর করে রাখতে গিয়া সন্ধ্যা করছি। মাইয়া মানুষ একলা ছাড়ন মুশকিল।

‘এ্যাহ্ আসছে মেয়ে মানুষ দাদী তো জানে না এই মেয়ে একাই দুনিয়া ভেজে খায়।’ মনে মনে এমনটা বললেও মুখে বলল, ‘তুমি এসো। আর তোরা ভেতরে যা।’

নুপুরকে নিয়ে গেইট পেরিয়ে যেতেই অর্নিতা বাড়ির ভেতরে চলে গেল। অর্ণব কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে রিকশা ডেকে নুপুরকে ইশারা করলো উঠে বসতে। নুপুর উঠে পড়লো রিকশায় আর একটু চেপে অপরজনের জন্য জায়গা রেখে তাকাতেই দেখলো অর্ণব চলে গেল পেছনের দিকে।

-এ্যাই…..

পুরো কথা বলার আগেই নুপুর খেয়াল করলো মানুষটা অন্য এক রিকশায় উঠেছে। না চাইতেও খুব মন খারাপ হয়ে গেল তার। সে কি চাইছিলো লোকটা তার পাশে বসুক! মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল আজ দুপুরে অর্ণব বাড়ি আসেনি খেতে এমনকি তার দেয়া মেসেজগুলোর কোন জবাবও দেয়নি। বলা যায়, সম্পূর্ণরূপে অবহেলা করেছে এমন একজনের জন্য তার মন খারাপ হচ্ছে? ধিক্ নুপুর তোমার ওপর ধিক্! চোখজোড়া আপনাতেই জলে ভরে গেল।রিকশা গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই হাতের ব্যাগটা থেকে ফোন বের করে সে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো কোথায় আছে? নাজিম সাহেব সবেই এসে পৌছেছেন বাজারে মেয়েকে বলে দিলেন ঠিক কোথায় এসে নামবে৷ নুপুরও রিকশাওয়ালাকে বলল নির্দিষ্ট জায়গার কথা। অর্ণবের রিকশাও সামনের রিকশা অনুসরণ করলো। নুপুর রিকশা থেকে নেমে সামনেই পেল বাবাকে।

-একাই এসেছিস? বললাম না আমি আসছি ঠিকানা বল।
চিন্তিত নাজিম সাহেব মেয়েকে রাগ দেখাতে চাইলেন। নুপুরও বলে উঠলো, ‘ একা আসিনি অর্নিতার ভাইয়া এসেছে।’

নুপুরের কথার মাঝেই অর্ণব পেছনের রিকশা থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে পাশে। দু রিকশার ভাড়া দিয়ে এগিয়ে এসে সালাম দিলো নাজিম সাহেবকে।

-ইনি অর্ণব… ভাইয়া অর্নিতার ভাই।

নাজিম সাহেব অবাক হলেন আবার বোধহয় খুশিও হলেন। ছেলেটি দারুণ তো! অন্যান্য ছেলেদের দেখা যায় বোনের বান্ধবী, নিজের বান্ধবী কিংবা আত্মীয়মহলের মেয়েদের সাথে সুযোগ পেলে একসাথে বসে পড়ে অথচ ছেলেটি কি সুন্দর করে আলাদা রিকশায় চড়লো। অর্ণবের এ আচরণ দেখে শুধু নাজিম সাহেব নয় নুপুরও অবাক হয়েছিল তবে তার মুগ্ধতার পরিমাণটাই বোধহয় বেশি। পছন্দের মানুষটির ব্যক্তিত্ব চমৎকার হলে মন এমনিতেই পুলকিত হয় নুপুরেরও হচ্ছে। কিন্তু মানুষটা বড্ড গোমরামুখো। এমন মানুষের প্রেমে পড়াটাই যে অন্যায় এ কথা ভুলে গেলে চলবে না এই বলে নুপুর নিজেকে শাসায়।

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-১১+১২

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১১

সকাল সকাল ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে বাড়িতে পা রাখলো রিদওয়ান। অফিস টাইমে এখনো অনেকটা বাকি তবুও সে গোসল সেরে দ্রুত তৈরি হলো অফিসের জন্য৷ রান্না ঘরে এখনো নাশতার আয়োজন হয়নি তাই নিচে নেমেই রিদওয়ান মাকে বলল, ‘ইজি টু রেডি কিছু হবে খাওয়ানো জন্য? ‘

-এত জলদি কেন?

-কাজ আছে।

-‘দাঁড়া’ বলেই রায়না বেগম ফ্রিজ থেকে পিনাট বাটার আর পাউরুটি-বিস্কুট এগিয়ে দিলেন। রাতে দুধ জ্বাল করে রেখেছিলেন পুডিংয়ের কিন্তু মন ভালো না থাকায় বানানো হয়নি৷ এক গ্লাস দুধও এগিয়ে দিলেন ছেলের দিকে। রিদওয়ান ব্যস্ত হাতে পাউরুটি দুধে ভিজিয়ে খেয়ে নিলো৷ দু পিস রুটি আর গ্লাসের বাকি দুধটুকু খেয়ে মায়ের কাছে জানতে চাইলো আব্বু কোথায়? রায়না অমনোযোগী আর খুব বেশিই চিন্তিত থাকায় সময়ের খেয়াল করলেন না। ছোট করে জবাব দিলেন, অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছেন বোধহয়।

রিদওয়ান এবার বাবা-মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। দরজায় দাঁড়িয়ে নক করলো বার দুয়েক কিন্তু কোনো সাড়া পেলো না। বাধ্য হয়েই ভেজানো দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। বাশার সাহেব ঘুমিয়ে আছেন বা কাত হয়ে তাই দরজা থেকেই মুখটা স্পষ্ট চোখে পড়ছে। ঘুম এখনো গভীর বুঝতে পেরে সে আর ডাকলো না বাবাকে। বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে দোতলায় নিজের ঘরে ঢুকে অফিসের ফাইলপত্র নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। রিদওয়ান চলে যাবার প্রায় ঘন্টাখানেক পর রিমন এলো নাশতার জন্য তখন রায়না বেগম খেয়াল করলেন বড় ছেলের অফিসে যাওয়ার ব্যাপারটা। তারপর আবার মনে হলো রিদওয়ান তো সবসময়ই বাবা আর ভাইয়ের এক ঘন্টা আগে উপস্থিত হয় অফিসে তাদের চেয়েও নিচু পদে আছে বলে। কথাটা ভবতেই ভেতর থেকে প্রলম্বিত শ্বাস বেরিয়ে এলো তাঁর। রিমন লক্ষ্য করলো মায়ের উদাসীনতা।

-কি হয়েছে আম্মু?

-কিছু না তো! পরোটা বানাইনি পাউরুটি খেয়ে যেতে পারবি না?

– তুমি বোসো তো এখানে তোমাকে চিন্তিত লাগছে।
রিমন মায়ের হাত ধরে বসিয়ে দিলো নিজের পাশের চেয়ারটাতে।

-তুই তো নিজের জন্য একজনকে পছন্দ করেছিস তা কি তোর বাবা জানে?

-হঠাৎ এই কথা!

-বল না তোর বাবা কি জানে? মেনে নিয়েছে সব?

-আম্মু, তুমি আমাদের ভাই-বোনদের সব খবরাখবর জানো বলে কি আব্বুও জানবে নাকি! আব্বু কেমন তা জানো না, নাজনীনের কথা এখনই বলা যাবে না। তুমি কি এই নিয়েই চিন্তত!

রায়না বেগম জানেন তার তিন সন্তানের মধ্যে একমাত্র রিদওয়ানটাই উদাসীন জগৎ-সংসারের হিসেব-নিকেশে কিন্তু মনের জগতে সে-ই সবচেয়ে সৎ আর ধনী। রিমন কিংবা বৃষ্টি কখনোই বৈষয়িক ব্যাপারগুলোতে এক চুল ছাড় দেয়ার মানুষ নয় আবার মনের দিক থেকেও তাদের একই নীতি কিন্তু রিদওয়ানটা বড্ড বেশিই সৎ। মনের খোরাকের জন্য সে কখনোই না বাবার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করবে আর না বৈষয়িক কোন ব্যাপারে মনোযোগী হয়ে নিজেকে এগিয়ে নেবে! রায়না বেগম জবাব দেন না রিমনের কথার। রিমনও আর কিছু জানতে না চেয়ে নাশতা শেষ করে৷ অফিসে যেতে এখনো অনেক দেরি তবুও তাড়াতাড়ি বের হচ্ছে আজ এক বন্ধুর সাথে দেখা করার কথা। সন্ন্যাসী বাবুর জন্য শেষ একটা উপকার আজই করবে সে তারপর আর কোন হেল্প সে করবে না। যার দায় সে উঠালে অন্যরা ঠিকঠাক আগাতে পারে না। সে তো রিদওয়ানকে কালই টাটকা ভিডিও পাঠিয়েছিলো কই এখন অবধি নো রেসপন্স। এমন নির্লিপ্ত মানুষের উপকার করে মজা নেই! রিমনও নাশতা শেষে বেরিয়ে পড়লো। এত সকালে দুই ছেলে কোথায় গেল মা রায়না নিজ ভাবনায় তা খেয়াল করল না৷ তিনি এখনো রাতের সেই ঝগড়ার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। সংসার জীবনের ত্রিশ বছরে কাল প্রথম তিনি স্বামীর মুখে মুখে তর্ক করেছেন। করতে বাধ্য হয়েছেন।

_____________

চমৎকার এক সকাল হবে আজ এমন ভেবে ভেবে রাতের ঘুম হারাম করেছিল নুপুর৷ কিন্তু এ কি হলো ঘুম ভাঙতেই বৃষ্টি! সকাল সকাল বৃষ্টি মানেই দিনটা কাটবে বিশ্রী…. স্বগোতক্তির মত করে বলল সে।বিছানা ছেড়ে বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে টের পেল দরজা বন্ধ। বাবা-ছোট মায়ের বাথরুম রুমের ভেতর এ বাথরুম শুধুই দু ভাই-বোন আর ছুটা কাজের বুয়া আর মেহমান এলে ব্যবহার করে। প্রয়োজনের সময় তৎক্ষনাৎ বাথরুমে ঢুকতে না পারার মত যন্ত্রণা বোধহয় বিশেষ দিনগুলোতেও হয় না। নুপুরের মনে হলো বাথরুমে নিশ্চয়ই বুয়াই হবে তোতন তো এখন স্কুলে আছে।

-খালা জলদি বের হন আমার অবস্থা সিরিয়াস।

কাতর কণ্ঠে বার দুয়েক ডাকলো নুপুর। মিনিট পাঁচেক পর ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে কুলকুচির আওয়াজ এলো ভেতর থেকে। সেই আওয়াজ শুনেই নুপুরের তীব্র চাপের কথাও মনে রইলো না। সে দরজা থেকে সরে দাঁড়ানোর আগেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো জাকির।

– চাপ কি বেশি পড়ছে তোমার?

দাঁত কেলিয়ে বাজেরকম হেসে প্রশ্ন করলো জাকির৷ তার এই ছোট্ট প্রশ্নটার ধরণ শুনেই রাগে গা রি রি করতে লাগলো নুপুরের৷ পারতপক্ষে কখনোই কথা বলে না সে জাকিরের সাথে তাই এখনো চুপচাপ চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু না অসভ্য, বেজাত লোকটা তার স্বভাব থেকে বেরিয়ে চলার মানুষ নয়। পুনরায় বলে উঠলো, আরে যাও কই তোমার না চাপ পড়ছে বললা! যাও যাও খালি হয়ে আসো নইলে আবার ঘরেই না….. হে হে।

– মুখ সামলে কথা বলবেন জাকির ভাই। সবাই আপনার ঘরের বউ না তাই মুখ খোলার আগে ভেবে নিবেন কি বলতেছেন।

-চাইলেই তো হইতে পারো ঘরের….. জাকির এরপর আর কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারেনা৷ নুপুর তার ঠিক মুখের সামনেই হাত তুলে দাঁড়িয়েছে । না, থাপ্পড় সে দেয়নি। অন্তত এমন নোংরা লোকের গায়ে হাত ছোঁয়ানোর কথা সে স্বপ্নেও ভাবে না। নুপুর নিজের ঘরে গিয়ে দড়াম করে দরজা আটকে দেয়। জাকির সেখানেই দাঁড়িয়ে আবারও হেসে বিড়বিড় করে, ফাঁক পাইতে দাও সোনা আর কয়টা দিন। আগে তো ভোগ আমিই করমু তোমারে তহন ভাঙমু তোমার এই ভাবের দুয়ার হে হে……।

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-১২

বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ সেই সাথে শেষ হয়েছে নুপুরের সাজগোজ। এখন পর্যন্ত অর্নিতা সাতবার কল করে ফেলেছে তাকে। মজার ছলে কাল অর্নিতার দাদীকে বলেছিল আজ সে যাবে তাদের ওখানে কিন্তু আজ সত্যিই দাদী তার অপেক্ষায় অস্থির হবেন বুঝতে পারেনি। এদিকে বাবাকে না জানিয়ে কোথাও যাওয়া হয় না নুপুরের। এক টিউশন আর কলেজ এ দুইয়ের বাঁধা রুটিন বাবার জানা কখনো শপিং করতে গেলেও ফোনে লোকেশন জানিয়ে রাখে৷ কিন্তু আজ বাবার সাথে কথা বলার সুযোগ একদমই মিলল না। জাকির ভাই সেই যে এসেছে এখনো কি এত জরুরি কথা বলছে বাবার সাথে! নুপুরের সেজেগুজে থাকা মুখটাতেও ভাসলো দুশ্চিন্তার ছাপ৷ গত কয়েকদিনে সে জানতে পেরেছে জাকির ভাই একটা বিয়ের প্রস্তাব এনেছিল তার জন্য। কোনভাবে কি সেটা নিয়ে বাবাকে উস্কাতে চাইছে? তার ভাবনার মাঝেও আরও একবার কল এলো অর্নির নাম্বার থেকে। নুপুর কল রিসিভ না করেই ব্যাগটা নিয়ে বাড়ি থেকে চুপচাপ বেরিয়ে পড়লো। এখন বাবাকে বলতে যাওয়া মানেই ওই বদমাশটারও কণ্ঠও শুনতে হবে। বাড়ির গেট পেরিয়ে রাস্তায় উঠতেই রিকশা পেল নুপুর কিন্তু রিকশাওয়ালাকে ঠিকানা বলতেই লোকটা জানালো অতদূর যাবে না। ওখানকার বাজার পর্যন্ত হলে যেতে পারে। একা একা অতদূর রিকশা বদল করে যাওয়াটা একটু ভয়ের লাগল। অর্নির খালার বাড়ি চেনা তার সেখানে হলে স্কুটি নিয়ে চলে যেত কিন্তু উল্টো পথে অর্নিদের বাড়ি তারপর রাস্তা তার চেনা নেই৷ কিন্তু অত ভেবেও কাজ নেই এখন বেরিয়ে যখন পড়েছেই আল্লাহ ভরসা। রিকশায় বসে অর্নিতাকে কল করল সে।

– এখনো রওনা দিসনি?

-দিয়েছি কিন্তু রিকশা তো বাজার পর্যন্ত যাবে সেখান থেকে কি করে যাব?

-আরে তুই… এক মিনিট।

নুপুরকে লাইনে রেখেই অর্নিতা ভাইকে ডাকল, ভাইয়া!

বুকের মাঝে ধুকপুক শুরু হলো নুপুরের৷ অর্নিতা তার ভাইকে ডাকছে কেন?
অর্ণব বাজারে যাচ্ছে কাজের লোককে নিয়ে।বৃষ্টি থামতে দেরি দাদীর শুরু হয়েছে আম নিয়ে আয় আচার বানাব। জৈষ্ঠ্যমাস ফুরিয়ে গেছে আচার বানায়নি এখনো এদিকে আবার ইলিশ, খিচুড়ির বায়নাও আছে তাই বাধ্য হয়েই এক প্রকার সে নিজে বাজারে যাচ্ছে। অর্নিতার ডাক শুনে পিছু ফিরল অর্ণব।

-বল

-দাদী নুপুরকে দাওয়ত করছে।

-তো!

– ও যে রিকশায় আছে বাজার পর্যন্ত আসবে।

-ওহ

– এখানকার রাস্তা ও চেনে না তুমি কি কাউকে পাঠাতে পারবে?

-দেখছি।

অর্ণব চলে গেল। মুখে বলল দেখছি মনে মনে বলল, পুচকে মেয়ে একাই বেরিয়ে পড়ে সব জায়গায়!

অর্ণবের বাজার করা শেষ হবার আগেই নুপুর পৌঁছে গেল বাজারের মোড়ে। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে সে আবার কল করলো অর্নিকে। অর্নিও পুনরায় ভাইকে কল করে বান্ধবীর অবস্থান জানিয়ে দিলো। আম কেনা বাকি ছিল বলে অর্ণব বাজারের ব্যাগ নিজের হাতে নিয়ে কাজের লোক রিপনকে টাকা ধরিয়ে বলে দিলো কাচা আম কিনে বাড়ি ফিরতে। সে এগিয়ে গেল অর্নির বলে দেওয়া জায়গায়। মিনিট খানেক সময়ের মাঝেই অর্ণব বাজার ছেড়ে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালো ঠিক নুপুরের সামনে। মেঘলা দিনেও ঘামে ভেজা টি শার্ট আর গম্ভীর মুখো অর্ণবকে দেখে থমক গেল নুপুরের মুহূর্ত। চোখের পলকে রিকশা ডেকে ইশারা করল অর্ণব তাকে রিকশায় চড়তে। হৃৎপিণ্ডের ধকধকানি কি একটু বেশিই হচ্ছে! বুঝতে পারছে না নুপুর তবে সামনের মানুষটার ইশারা বুঝে সে আর দেরি করেনি রিকশায় উঠতে। সেকেন্ড না গড়াতেই অর্ণবও যখন বাজারের ব্যাগসুদ্ধ নিজেও চড়লো রিকশায় তখন নুপুরের অবস্থা পটল তুলল বলে! সে ভেবেছিল অর্ণব তাকে রিকশা করে ঠিকানা বলে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু একি! মানুষটা যে স্বশরীরে তারে পাশেই উঠে বসল। হৃদযন্ত্রের এমনিতেই তো বিকল অবস্থা এখন কি তবে কবরস্থ করে ছাড়বে! এত সুখ সুখ যন্ত্রণা সইবে কেমন করে? মাতাল মাতাল লাগছে তার অর্ণব এমন নির্বিকার বসে আছে কি করে? সে তো পারছে ন স্থির থাকতে। হাত, পা ঝিমঝম করছে, বুকের ভেতর আকাশসম আনন্দের অনুভূতি তাকে শেষ করে দিচ্ছে তারওপর পাশের মানুষটার গা থেকে কেমন আদুরে এক ঘ্রাণ এসে লাগছে নাকে। রিকশা চলছে মহল্লার রাস্তায়। রাস্তার দু পাশে গাছ আর উঁচু দালানকোঠা। কোথাও কোথাও বৃষ্টিতে ভিজে কৃষ্ণচূড়ায় ছেয়ে আছে রাস্তা। নুপুরের মনে হচ্ছে এ যেন আষাঢ়ে চলছে বসন্তের উৎসব। এতসব ভাবনা আর বুকের ভেতর প্রজাপতির ফড়ফড়, ধড়ফড় আনন্দের মাঝে তার নজর আটকে গেল অর্ণবের কোলের ওপর হাতে। পশমভর্তি চন্দনরঙা হাতদুটো দেখে তৎক্ষনাৎ আবার চোখ রাখলো থ্রী কোয়ার্টার স্লিভের বাইরে নিজের শ্যামলা হাতে। এক মুহূর্তে মনে হলো আকাশ-পাতাল তফাৎ তাদের গায়ের রঙে। একটা পুরুষ মানুষের উজ্জ্বল হাতের পাশে শ্যামলা মেয়েলি হাত বড্ড বেমানান। এতক্ষণের সকল উত্তেজনা এক লহমায় বদলে গিয়ে মেঘময় হয়ে উঠলো নুপুরের মন। ভালোবাসতে রূপ লাগে এমনটাই ভেবে মন খারাপ হতে থাকল তার। পাশাপাশি বসা অর্ণব তখনো নিশ্চুপ বসে তাকিয়ে ছিল সামনে। হঠাৎই তার মনে হলো পেছনে একটা বাইক আছে। আকস্মিক ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলো সত্যিই পেছনে একজন বাইক নিয়ে আসছে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল এই লোকটা আগেও তাকে ফলো করেছে। একবার মনে হলো রিকশা থামিয়ে ধরা যাক পরমুহূর্তেই ভাবনা বদল হলো পাশে বসা মেয়েটির জন্য। পরের মেয়েকে বিপদে ফেলার কোন মানেই হয় না! রিকশা এসে বাড়ির সামনে থামলে অর্ণব ভাড়া মিটিয়ে নুপুরকে বলল ভেতরে যেতে। হাতের ব্যাগ দারোয়ানকে দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে নিজে কাউকে কল করলো সেই সাথে দেখলো আশেপাশে বাইকারটা আছে কিনা!
_________________

-একটা মাইয়া ছিল সাথে।

-ওর সাথে মেয়ে কে থাকবে? প্রেমিকা আছে বলে তো জানতাম না।

-বাড়িতে নিয়া আসছে স্যার।

-বয়স কেমন হবে?

-বেশি না। স্কুল নইলে কলেজে পড়ে এমন বয়সী।

-ওহ তার বোন হবে তাহলে।

-না স্যার মাইয়া অন্য জায়গা থাইকা আসছে। ওই পোলায় বাজার কইরা আসার সময় নয় আইছে।

-ওর বোনই হবে তাহলে। বোন নিজের বাড়িতে বেড়াতে আসে এমনিতে খালার বাড়ি থাকে সে।

অনেকটা আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল সারোয়ার। সে জানতেই পারলো না তার দেওয়া তথ্যটা ভুল। আর এই একটা ভুল সামনে তাকে আরও কত ভুলে জড়িয়ে নেবে সে আন্দাজটাও রইলো না তার। ঝড়ো হাওয়ায় উলোটপালোট হয় যেমন করে খড়ের ছাউনি তেমন করেই পালটে যাবে এবার পাশার দান, কারো জীবনের ছক আর কারো জীবন বাতিটাই ধ্বংস হবে।
_____________

-অবশেষে এলি তুই!

– আসব না মানে? দাদীজান এত করে ডাকলেন আর আমি আসব না তা কি করক হয়! আর জল্লাদ ব্যাটাকেও তো দেখার ছিল….. শেষের বাক্যটা বিড়বিড় করে বলল নুপুর। বাইরে বৃষ্টি নেই আবার রোদও ছিল না তবুও ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে নুপুর। সারাটা পথ তার হাত পায়ের ঝিমঝিমানি একটুও কমেনি উল্টো ভুলবশত অর্ণবর বাহুতে তার বাহু ঠেকতেই কেমন শিউড়ে উঠেছিল! নুপুর যেন এখনো অনুভব করছে সে স্পর্শ। চোখ বুঁজে বড় করে নিঃশ্বাস নিতেই কানে এলো দাদীর কণ্ঠ, ‘ কি খবর রঙ্গ বানু কখন আইলা?’

-মাত্রই আসছি দাদী দেখেন হাতর ব্যাগটাও রাখতে পারিনি। আপনার নাতনি আমাকে ঠিকঠাক ঘরে ঢুকতেই দিচ্ছে না।

ছটফটিয়ে জবাব দিয়েই নুপুর সোফায় গিয়ে বসলো। দাদীও ততক্ষণে বসেছেন সোফায় তার পাশেই অর্নিতা এসে দাঁড়ালো। হাতে তার সবজি কাটার ছুড়ি। আজ ভুনা খিচুড়ি, ইলিশ ভাজা আর ঝাল করে মুরগির মাংস রাঁধবে বলে আয়োজন চলছে। অর্ণব বাইরে থেকে ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল সোফায় বসা দুই জেনারেশনের তিনজনকে৷ হঠাৎ কেমন মনে হলো এরা সবাই তার আপনজন। নিজের ভাবনাতে নিজেই চমকে গেল সে। এরা সবাই আপনজন! নুপুর কে? মন -মস্তিষ্কের ভাবনাগুলো আজকাল জট পাকিয়ে যায় কেবল। চারদিকে হাজারো ঝামেলা, বিপদ-আপদ সারাক্ষণ মাথায় ঘুরছে চরকির ন্যায়৷ তাই বোধহয় এমন উল্টাপাল্টা ভাবছে সে। বসার ঘরের বড় ঘড়িটাতে চোখ বুলিয়ে নিঃশব্দে চলে গেল দোতলায়। অফিসে আজ যাবে দুপুরের পর। উকিল সাহেব আজও ডেকেছেন গুরুত্বপূর্ণ কোন কথা বলবে বলে। দোতলায় পা রাখার পরই অর্ণব চেঁচিয়ে ডাকলো রুজিনা খালাকে।

‘খালা নাশতা দিয়েন একটু পরই বের হতে হবে।’

চলবে