Sunday, July 20, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 383



কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-৩৫

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৩৫(প্রথমাংশ)

তুমি বুকে টেনে নাও না প্রিয় আমাকে…

ঘুমঘুম জাগরণে ধোঁয়াশা লাগছে চোখের সামনে সব। ঘাড়ের ডান পাশটায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল সেই সাথে জ্বরও ছিল একশো তিন। ডাক্তার এসবের জন্য কি যেন ইনজেকশন দিলো একটা তারপর লম্বা সময় পর্যন্ত কোন ব্যথার অস্তিত্ব টের পায়নি সে। এখন দীর্ঘ বছর পর ঘুমটা ভেঙে গেল কানে ওই মধুর একটি গানের সুর শুনে। কেউ একজন খুব কাছে বসেই বোধহয় মৃদু আওয়াজে শুনছে গানটা। নাকে আসছে ঔষধের কড়া গন্ধ সেই সাথে পরিচিত একটা পারফিউমের সুবাস। হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে সে কি স্বপ্ন দেখছে!

-ব্যথা আছে এখনও?

মুখের ওপর ঝুঁকে অর্ণব প্রশ্ন করতেই ঘুম পুরোপুরি কেটে গেল নুপুরের। গানের শব্দটাও আসছে না আর শুধু নাকের ভেতর পারফিউমের সুবাসটা এবার তীব্র ঠেকছে। মানুষটা এত বেশি কেন ঝুঁকে আছে তার বুকের কাছে? হৃৎপিণ্ড বিকল করে দিতে চাইছে নাকি! চোখ মুখ খিঁচে নুপুর বড্ড জোর খাটিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল, সরে দাঁড়ান।

-নাহ, আরও কাছে আসতে চাইছি অনুমতি পাশ না করলেও আসব।

কথাটা বলে ঝট করে দূরে সরে গেল অর্ণব।কেবিনের দরজা ঠেলে একজন নার্স ঢুকলো ভেতরে।
-আপনাকে যে বাইরে যেতে হবে এখন।

-শিওর

অর্ণব কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। নুপুর নার্সটিকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলো তার আগেই নার্স জানালো ড্রেসিং হবে এখন। বা হাতের কনুই থেকে ইঞ্চি দুয়েক উপরের এবং কোমরে আঘাত পেয়েছিলো সেটারই ড্রেসিং। নুপুর দম খিচে রইলো যেন পুরোটা সময়। নার্স চলে যেতেই অর্ণব হাজির হলো একজন পুলিশ নিয়ে। লোকটিকে নুপুর গত দু দিনে খুব ভালো করেই চিনে ফেলেছে। কিন্তু তার জবানবন্দি তো আগেই সে দিয়েছিলো!

– কেমন আছেন মিস.. মিসেস অর্ণব?

-আমার নাম নুপুর।

অফিসার মুচকি হাসলেন। এরা তো ভারী আজব কাপল! একজন বলেন আমার বিয়ে করা বউ মিসেস চৌধুরী বলবেন। অন্যজন বলে আমার নাম নুপুর। যাহোক, আপাতত কেস সলভের উদ্দেশ্যে আসা তাইহোক। শরাফত সাহেব নিজের ফোনটা নুপুরের দিকে এগিয়ে একটা ফটো দেখালেন। নুপুর দেখলো ফটোটা তাতে দুটো লাশ। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, দুটো লাশকেই নুপুর চিনলো। এরাই তাকে অপহরণ করেছিলো এমনকি বছর খানেক আগে থেকে এদেরমধ্যের একজনই তাকে সবসময় ফলো করতো। আজ আর কিছুই এড়িয়ে গেল না নুপুর। টুকটুক করে সব বলল যতোটা প্রয়োজন ছিল। তাজ্জব ব্যাপার তাকে তুলে নেয়া দুজনই আজ মৃত। তবে তার সম্ভ্রমে হাত দেয়া ছেলেটারই কোন হদিশ পেলো না কোথাও। পুলিশও বর্ণনানুযায়ী খুঁজে চলছে। পুলিশের ধারণা তিনজন আসামীর একজন যে বেঁচে আছে সেই মূল আাসামী আর এরা তার সহকারী। অফিসার শরাফত চলে যেতেই অর্ণবও হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেল। আজ অফিসে একটা মিটিং আছে। হেলায় সব ছেড়ে দিলে চলবে না। সারা বিকেল নুপুর পড়ে রইলো একা কেবিনটাতে। একজন নার্স অবশ্য একটু পরপর এসে চেক করে গেছেন অর্ণবের কাছ থেকে আলাদা কমিশন পেয়ে। শহরের আকাশে রোদ নিভে গেছে আরও কিছুক্ষণ আগে। হাসপাতালে এমনিতেই নীরবতা তারওপর এই সন্ধ্যের আলাদা এক নিস্তব্ধতা নুপুরকে শূণ্য করে রাখলো কেমন যেন। সেই শূণ্যতাকে এড়িয়ে যেতেই নুপুর কল্পনা করতে চাইলো কালকের ঘটনাগুলো। কাল সকালে অর্ণব কোলে তুলে দাদীকে নিয়ে হাজির হলো তার কেবিনে। অসুস্থ দাদী এসেই তাকে দেখে কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে উঠলেন। বোধহয় ভাবছিলেন তার নাতির পাশে এমন অপবিত্র, কলঙ্কিত এক মেয়েই কেন থাকবে। যে দাদী একটা সময় নুপুরকে কাছে পেলেই আহ্লাদে হাত টেনে নিজের কাছে কাছে রাখতেন তিনি কাল নুপুরকে একটুও ছুঁয়ে দিলেন না। বরং দূর থেকে চুপচাপ তাকে কিছু সময় দেখে অর্ণবকে বলল, আমার জন্য চা বা কফি কিছু নিয়া আয় অর্ণব। এই আচরণ ছিলো দাদীর একদমই স্বভাব বিরুদ্ধ। নুপুর অবাক না হলেও তারা ভাইবোন দুজনেই বোধহয় হয়েছিল। অর্ণব চলে গেলে দাদী অর্নির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, ওরে কি ডাক্তারে সবরকম ঔষধপত্র দিছে?

অর্নি সায় জানায়, হ্যাঁ দাদী ডাক্তার ভালো করে ট্রিটমেন্ট করছে তো।

– ঐসব ঔষধপাতি কিছু দিছে যাতে পেটে কিছু না থাকে… কথাটা বলতে বোধহয় দাদী নিজেই সংকোচ বোধ করছিলো। অর্নিতা বিষ্ময়ে তাকায় দাদীর দিকে। দাদীর কথার অর্থ যে সে এবং নুপুর দুজনেই ভালো বুঝতে পেরেছে। নুপুরের চোখে জলের ধারা থামার নয় তবুও সে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। অর্নি নির্বাক দাদীর চিন্তা ভাবনার লাগামহীন আচরণে। দরজার কাছে থেকে অর্ণবও যে শুনলো সবটা। ভাগ্যিস,দরজাটা খোলা ছিল তাই দাদীর প্রশ্নের জবাবটা সেই দিলো, “আমার দাদাদের সম্পদের তো কমতি নেই দাদী তাই আর কিছু করতে দেয়নি। আল্লাহর মাল দু চারটা চলে এলেও সমস্যা নেই।”

দাদী ক্রুদ্ধ নজরে তাকান অর্ণবের দিকে। নুপুরকে নাতির পাশে দেখে তিনি অখুশি নন কিন্তু তাই বলে কোন জারজ বাচ্চাকে নিজের বাড়ির অংশ করার কথা তিনি মানবেন না। নুপুর চুপ ছিলো পুরোটা সময়। দাদী বেশিক্ষণ থাকেন না হাসপাতালে। অর্নি আর দাদীকে অর্ণব বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসতেই নুপুর তাকে ফিরে যেতে বলে।

-কেন করছেন এসব?

অর্ণব কমলার খোসা ছাড়ানোতে ব্যস্ত যেন শুনতেই পায়নি নুপুরের কথা। নুপুর আবারও বলে, এত মহান সাজতে চাইছেন কেন? আপনি অনেক মহান আমরা বুঝতে পেরেছি প্লিজ চলে যান এবার। আমার বাবা যতটুকু পারে করবে আমার জন্য।

-একা তোমার জন্য করবে কেন? একমাত্র জামাই হিসেবে আমারও হক আছে।

-বন্ধ করেন এসব নাটক। আমাকে করুণা করতে হবে না আরও অনেক মানুষ পাবেন করুণা করতে।

হুট করে অর্ণব খুব কাছে এসে দাঁড়ালো নুপুরের। তার কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বলল, “অন্যকে না আমি তোমাকেই করব করুণা। আমি নিজের জন্য তোমাকেই ডোবাবো করুণার সাগরে। সাধ্য থাকে তো এড়িয়ে যাও দেখি কতটুকু যেতে পারো।” কথা শেষ করে আবারও আগের জায়গায় ফিরে গেল অর্ণব। কালকের সেসব কথা মনে পড়তেই ফুপিয়ে কাদতে লাগল সে। কখন যে অর্ণব এসে ঢুকেছে কেবিনে টেরই পেলো না। সন্ধ্যের বিষন্ন নিস্তব্ধতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কান্নারত নুপুরের ওপর আবারও সেই দুপুরের মতই ঝুঁকে এসে চটাস করে চুমু বসিয়ে দিলো কপালে৷ এত আকস্মিক এত বেপরোয়া স্পর্শ করে লোকটা তাকে বড্ড অসহায় পড়ে নুপুর এই স্পর্শে। কখনো কাছে দাঁড়িয়ে দুটো মিঠে কথা না বলা পুরুষটা বিয়ের স্বাক্ষর করেই যেন লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে।

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৩৫(শেষাংশ)

অর্নির পাসপোর্ট এর ঝামেলা শেষ করে রিদওয়ান এবার ছুটছে অর্নির কাছে। আমাদের দেশে অনেক জায়গাতেই টাকা ছড়িয়ে কাজ হাসিল করা যায় অথচ বাইরের উন্নত দেশ, উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থায় যোগ্যতা ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়৷ অর্নিকে নিয়ে সে যেমনটা ভেবেছিলো তেমনটা হলো না। বিদেশে পড়াশোনার নামে প্রস্তুতি কিছুই সে নিতে পারেনি। বাড়ির পরিস্থিতি রিদওয়ানের অনুকূলে নেই সে এই মুহূর্তে চাইছেও না আব্বুর সাথে বাকযুদ্ধে জড়াতে। আব্বু যেমনই হোক নিশ্চয়ই সন্তানের ভালোটাই চেয়েছেন সবসময় এমনটা ভেবেই রিদওয়ানের একটুও রাগ নেই তার বাবার প্রতি। বাশার শেখ বলেছেন এ বাড়ির সাথে রিদওয়ানের কোন সম্পর্ক নেই। রিদওয়ানও চুপচাপ সে কথা মেনে নিয়ে অর্নিকে পাঠিয়ে দিলো চট্টগ্রামে। পড়াশোনায় মনোযোগ দিক সে আপাতত ছুটিছাটায় বাপের এসে থাকবে। তার সময় ফুরিয়েছে দেশের মাটিতে থাকার। আগামী সপ্তাহে তার ফিরে যাওয়ার দিন ঠিক হয়েছে এ কয়টা দিন ইচ্ছে ছিলো স্ত্রী,মা,ভাই-বোনকে নিয়ে কাটানোর কিন্তু তা আর হলো কই এখন শুধু স্ত্রীর সাথেই সময় কাটাবে। আবারও উঠতে হলো হোটেলে অর্নিকে নিয়ে। হাতে টাকাও আছে সীমিত তাই এবার একটু ছোট আর সস্তার হোটেলেই উঠতে হলো। মনে মনে সে ঠিক করে নিয়েছে এবার আর কোন হেলাফেলা নয় ফিরে গিয়ে রেস্টুরেন্ট জবটা চেঞ্জ করবে। রিদওয়ান যখন পৌঁছুলো তখন রাত নয়টা। অর্নি হল থেকে বের হতে পারলো না বলে রিদওয়ান একাই থাকলো সে রাতটা হোটেলে।পরের দিন সারাটা সময় চট্টগ্রামের কিছু পরিচিত জায়গায় ঘুরে এলো। সে জায়গা গুলো মূলত তার বাবার কাজের জায়গা আর তাদের নিজস্ব একটা কোম্পানিও আছে সেখানে। আগে রিদওয়ান কাজ করেছে সেখানে এখন সে কোম্পনির দায়িত্ব অবশ্য রিমন পালন করছে। আজ ভোরেও এসে উপস্থিত হওয়ায় সে ভাইকে ডাকলো দুপুরে একসাথে খাবে বলে। রিদওয়ান যখন পৌঁছুলো তখন আকাশ মেঘলা। ভরদুপুরে রোদ ঢেকে গেছে কুয়াশার মত ধোঁয়াটে মেঘের আড়ালে। বিষন্ন মুখটাতে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে সে দাঁড়ালো রিমনের কেবিনের সামনে।

-মে আই কাম ইন!

ভাইয়ের কণ্ঠস্বর শুনতেই বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল রিমন।

-ভাইয়া! ফরমালিটি দেখাচ্ছো?

অভিমানী শোনালো রিমনের গলাটা। রিদওয়ান এগিয়ে গিয়ে বুক মিলিয়ে পিঠ চাপড়ালো।

-অফিস তো!

-তো!

-কিছু না। আম্মু কেমন আছে?

-কাল যেমন দেখেছো।

-আব্বু আর বৃষ্টি!

-আব্বুর শরীর ভালোই ঠেকছে তবে মনে কি চলছে বোঝা যাচ্ছে না। আর বৃষ্টি আপাতত… বুঝতেই পারছো।

কথা বলার ফাঁকে রিমন পিয়নকে খাবারের ব্যবস্থা করতে বলে দিলো। দু ভাইয়ে কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে রিদওয়ান বের হলো সেখান থেকে। অর্নিকে কল করতেই জানা গেল মেয়েটা ক্যাম্পাসেই বসে আছে অপেক্ষা রিদওয়ান কখন আসবে!
__________

– আর কিছু বাকি আছে গোছানোর?

নাজিম সাহেব ব্যস্ত ভঙ্গিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন। নুপুর নিরুত্তর যেন শুনতেই পায়নি বাবার কথা। আজও ছোট মা এসেছেন তবে দায়ে পড়েই বোধহয় এসে উপস্থিত হয়েছেন। আজ ডিসচার্জ করায় অর্ণব গেছে বিল পরিশোধ করতে। নাজিম সাহেব নিজেই করতে চাইছিলেন অর্ণব শোনেনি সে কথা সে কারণেই ছোট মা কিছুটা প্রসন্ন হেসেছেন। বাবার তাড়াহুড়ো দেখে নুপুরের খুব মায়া হলো। আজ পাঁচদিন সে হাসপাতালে আছে আর সাত দিন পার হলো নিজের বাড়ি, নিজের ঘরের বাইরে। সেদিন বাড়ি থেকে বের হওয়ার একবারও কি মনে হয়েছিলো তার জীবনটা এতখানি বিভৎস হয়ে যাবে সেদিনের পর! এখনো সে সময়গুলো মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

-এসো…

অর্ণব কেবিনে ঢুকেই নুপুরকে উদ্দেশ্য করে বলল। নাজিম সাহেব তাকালেন একবার অর্ণব একবার নুপুরের দিকে। মনের ভেতর খচখচানি চলছে অর্ণব কি নুপুরকে তার বাড়িতে নিতে চাইছে? মন বলছে ছেলেটা বলুক নিজের বাড়িতে নিতে চায় এতে মনটা স্বস্তি পাবে। মেয়েকে তিনি এ অবস্থায় নিজের কাছেই নেবেন তবুও বাপের মন বোধহয় মেয়ের বিয়েটা নিয়ে এখনো সাং সংশয়িত আছে। সে সংশয় অল্প সময়ের মধ্যেই দূর হয়ে গেল অর্ণবের কথা শুনে।

-আংকেল আপনারাও এখন আমার বাড়িতেই আসুন। বিকেলে আমি নিজে আপনাদের বাড়ি পৌঁছে দেব।

-না বাবা….

-আমার বাড়িতে দাদীই একমাত্র বয়স্ক মানুষ। ওকে নিয়ে যাব আপনারা একটু সাথে গেলেই আমার জন্য ভালো হতো।

ভারী স্বরটাকে যতোটা সম্ভব নমনীয় রেখে বলার চেষ্টা করলো অর্ণব। নুপুর এ কথা শুনে তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করার মতই জোরে বলে উঠলো, “বাবা আমি বাড়ি যাব। আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও অন্য কোথাও যাব না।”

-বাড়িতেই যাব আমরা এখন।

অর্ণবের কথা শুনেও না শোনার ভান করে নুপুর আবারও বলল, “আমাদের বাড়ি যাব আমি।”

– আমাদের বাড়িতেই…

-আপনার বাড়িতে না।

দৃঢ় স্বরে জবাব দিলো নুপুর। নাজিম সাহেব বিপাকে পড়লেন তবে মন চাইলো মেয়ের কথাটাই শুনতে। তিনিও এবার বললেন, “বাবা নুপুর ঠিকই বলতেছে। এমনিতেও তোমার দাদী অসুস্থ দেখলাম তারওপর ওরেও সাথে নিলে তুমি কারে দেখবা। তোমারও কাজবাজ আছে… ও এহন বাড়িতে থাক। সুস্থ হইলে না হয় মায়ই’মা আর অর্নিরে নিয়া ওরে নিয়া যাইবা।”

অর্ণব বুঝলো নাজিম সাহেবের কথার অর্থ। তিনি মেয়েকে নিজ বাড়ি থেকেই বিদায় করতে চান।তাি কথার বাড়াবাড়ি না করে সেও মেনে নিলো। উবারে করে নুপুরকে নিয়ে পৌঁছে গেল তাদের বাড়িতেই। নুপুরকে তার ঘরে বসিয়ে নিজেও বসলো চেয়ার টেনে। পুরো সময় নুপুর একটিবারও তাকালো না তার দিকে। ছোট মা আজ হাসি হাসি মুখেই খাবার আয়োজন করছেন রান্নাঘরে। এরই মাঝে জাকির এসে উপস্থিত হলো খালার বাড়ি। খালার মুখের হাসি দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইলো, “এত খুশি ক্যান খালাম্মা?”

-খুশি হমু না! আপদ বিদায় হইবো ঘাড় থাইকা আর কয়টা দিন।

-ওহ ওই কালির তো এখন বড়লোক জামাই আছে। তা কি রানতেছেন ওর জামাইর জন্য!

অনেকটা ব্যঙ্গ করেই জানতে চাইলো জাকির। তাদের কথার মাঝেই হঠাৎ মনে হলো কেউ একজন রান্নাঘরের বাইরে আছে শুনছে তাদের কথা। সন্দেহ বশত জাকিরই উঁকি দিলো বসার ঘরটার দিকে। নাহ, কেউ নেই সেখানে হয়ত মনের ভুল তারা আর পাত্তা দিলো না। তারা জানলো না তাদের বলা প্রতিটা কথাই নির্ভুল শুনে গেছে অর্ণব। গলা শুকিয়ে গেছে নুপুরের ঘরে পানিও নেই তাই নিজেই এসেছিলো পানির জন্য। বসার ঘরেরই একাংশে রাখা ডাইনিং টেবিলে জগ থেকে পানি খেতে খেতে প্রতিটা কথাই স্পষ্ট শুনেছে সে। সোফায় বসা তুতুনকে দেখলো টিভি দেখায় মগ্ন। ছেলেটাকে ডেকে বলল, “চলো তুতুন আমরা ঘুরতে যাই।”

রান্নাবান্না শেষে দুপুরের খাবার সাজাতেই বিকেল তখন চারটা বেজেছে।নাজিম সাহেবও ততক্ষণে বাড়ি ফিরেছেন। এসেই দেখলেন, অর্ণব, তুতুন কেউ বাসায় নেই৷ স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতে তিনিও জানেন না বলে নুপুরের ঘরে গেলেন।

-জামাই কই?

বাবার প্রশ্নে চমকে তাকায় সে। যাকে নাম সম্মোধনে অপছন্দ করতেন তাকে আজ ‘জামাই’ বলে স্নেহের সম্মোধন! সামান্য একটা স্বাক্ষরে এত জোর? নুপুর জবাব দিলো জানি না। নাজিম সাহেব ফোন করতে উদ্যত হলেন তখনই বসার ঘর থেকে আওয়াজ এলো, “আম্মু দেখো ভাইয়া কি এনেছে।”

তুতুনের গলার স্বর। নাজিম সাহেব বেরিয়ে গেলেন পেছনে তার স্ত্রীও। অর্ণব বাজার করে এনেছে। কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে মাছ, মাংস এমনকি লিটার পাঁচেক দুধ। অর্ণবের পেছন পেছনে দু জন লোকও এসে ঢুকলো দুই ঝুড়ি মুদি বাজার নিয়ে। ছোট মা সেসব দেখে হা হয়ে গেলেন একদম। সাবান থেকে শুরু করে টয়লেট ক্লিনার অব্ধি আছে সেই বাজারের ঝুড়িতে। নাজিম সাহেব কেমন ক্ষুন্ন দৃষ্টিতে তাকালেন অর্ণবের দিকে৷ ছেলেটা কি তাঁকে নিজের অর্থবিত্ত বোঝাতে এমনটা করলো! না খুব একটা সময় লাগেনি নাজিম সাহেবের মনের মেঘ কাটতে। অর্ণব নিজেই উনাকে পাশে বসিয়ে কৈফিয়ত দেয়ার মত করে বলল, “রাগ করবেন না আঙ্কেল। ইচ্ছে ছিলো ওকে আমি আজই আমার বাড়িতে তুলব এবং সকল দায়িত্ব পালন করব। কিন্তু সে যেতে চাচ্ছে না আমিও তার অসুস্থতার দোহাই নিয়ে মেনে নিচ্ছে৷ যত্নটা আপনারাই করুন আমি শুধু তার এ কদিনের ভরণপোষণটা দেই। ও আমার ওখানে চলে গেলে না হয় আর করব না এমন কিছু!

অর্ণব কথাগুলো যেন ইচ্ছে করেই ছোটমাকে শোনালো। এই মহিলার চিত্ত জুড়ে লোভ, লালসা তা আন্দাজ করেই সে এমন পদক্ষেপ নিলো। কে জানে হয়ত লোভে পড়েই হয়ত নুপুরের প্রতি যত্নবান থাকবে মহিলা। তার ধারণা ভুল নয় তা কয়েক ঘন্টাতেই টের পেয়ে গেল অর্ণব। একটু পরপরই নুপুর কি করছে, কি খাবে সেসবের খোঁজ নিতেই ব্যস্ত হয়ে গেলেন মহিলা। অর্ণব চলে গেল সন্ধ্যের পর। যাওয়ার আগে ঘুমন্ত নুপুরকে একটু আদর করতে ভুলল না সে। আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে চুমু খেলো কপালটাতে। রাতটা সে বাড়িতেই থাকবে দাদীর জন্য৷ মানুষটা কিছুদিন ধরে বেশ নুয়ে পড়ছেন বয়স আর অসুস্থতায়। রাতটা বাড়ি, দিনটা অফিস, সন্ধ্যেটা নুপুর তিন ভাগ হয়ে গেছে তার সময়টা এখন। টানা চারদিন এভাবে কাটানোর পর হুট করে সে চলে গেল চট্টগ্রামে। অর্নি জানতো না ভাইয়া আসবে চট্টগ্রামে। রিদওয়ান চলে যাবে ভোর বেলাতেই তাই মুখ ভার করে বসেছিলো হোটেলের রুমটাতে। নির্দিষ্ট রুমের দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ হলো ঠিক রাত্রি এগারোটা আটান্নতে। রিদওয়ান তখন হোটেলের লবিতে গেছে একটা সিগারেট খেতে।অর্নিতাও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। রিদওয়ান এসেছে ভেবেই সে দ্রুতপায়ে গেল দরজা খুলতে।

-এত দেরি করলে ঘুমাবে কখন আর উঠবেই কখন!
দরজা খুলে কথাটাই সে আগে বলল। পরমুহূর্তেই থমকে গেল দরজায় দাঁড়ানো ভাইকে দেখে।

-ভাইয়া তুমি!
-হুশশশ। এটা রাখ।

কেকের বক্স আর একটা ছোট্ট শপিংব্যাগ এগিয়ে দিলো অর্নিকে৷

-আর মাত্র এক মিনিট বাকি। দ্রুত কেকটা আনবক্সিং কর ওকে দেখলাম বসা থেকে উঠেছে।

অর্নি বুঝলো ভাইয়া রিদওয়ানের কথা বলছে। অর্নির খুশিতে চোখ ছলছল। দ্রুত হাতে কেক আনর্যাপ করে ছোট্ট টি টেবিলটাতে রাখলো৷ দরজায় এসে তখন উপস্থিত রিদওয়ান৷ দু ভাইবোন একই সুরে গেয়ে উঠলো, “হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।”

রিদওয়ান চমকে গেল। আজ তারিখ কত? আজ তার বার্থ ডে! ওহহো সে ভুলেই গেছে কিন্তু আম্মু তো উইশ করলো না। প্রথম উইশ তো আম্মুই করে তাকে৷ হঠাৎ করে বিষন্ন মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। অর্ণবকে দেখে সুখী বা দুঃখী কোনটাই হতে পারলো না রিদওয়ান। অর্ণবের কি তা বুঝতে বাকি আছে? মোটেই না। সে ঠিক এ কারণেই এসে আজ উপস্থিত হয়েছে। হাতে সময় কম অথচ তার কতগুলো সম্পর্ক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। সময় থাকতেই সেগুলোকে গুছিয়ে নেয়া চাই। মনটা বড্ড পালাই পালাই করে সে ভেবে নিয়েছে সত্যিই কোনদিন পালিয়ে যাবে কোথাও। তার আগে সমস্ত সম্পর্কের দায় শেষ করে নেবে। সেসবের প্রথম ধাপটাই রিদওয়ানের সাথে দায় চুকানো। কেকের পাশে ছোট্ট গোলাপিরঙা একটি মোম জ্বালিয়ে নিজেই রিদওয়ানকে টেনে নিয়ে বসালো খাটের ওপর।

– খালামনি পাঠিয়েছে আমাকে। দ্যাখ তোর পছন্দের কেক আর সুজির হালুয়া।

ছোটো শপিং ব্যাগটাতে ছিল ছোট্ট একটা বক্স৷ তাতেই আছে হালুয়া আর চালের রুটি। এগুলো রিদওয়ানের সত্যিই খুব পছন্দের তবে তা রায়না বেগম পাঠাননি৷ রুজিনা খালার হাতেই তৈরি করিয়েছিলো সে৷ খালুজান যে রিদওয়ানের সাথে যোগাযোগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সে কথা অর্ণব জানে বলেই এমনটা করেছে৷ এরই মাঝে ফোন বাজলো রিদওয়ানের।

-আম্মু!

– থ্যাঙ্কিউ আম্মু৷ তুমি অর্ণবকে দিয়ে কেন পাঠালে এসব। আমি তো কালই চলে যাচ্ছি। হালুয়াটা দেখতে দারুণ হয়েছে আম্মু। আব্বুও কি খেয়েছে এগুলো!

আনন্দ, উচ্ছাস, কি যে আহ্লাস! অর্ণব, অর্নিতা মুগ্ধ হয়ে তাকায় রিদওয়ানের দিকে। ছোট্ট বাচ্চাদের মত করে কথা বলছে রিদওয়ান৷ মায়ের সাথে কথা বলার সময় প্রত্যেকটা সন্তানই কি এমন বাচ্চা হয়ে যায়! একই প্রশ্ন বোধ দু ভাই-বোনের মনেই উঁকি দিলো। তাইতো তারা দৃষ্টি আড়াল করলো একে অপরের থেকে। অর্ণব অর্নিতা যখন নিজেদের অপূর্ণতায় চোখ সরায়, রিদওয়ান যখন মায়ের সাথে আহ্লাদে মেতে ওঠে কথা বকায় ঠিক তখনই আসে অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ফোন কল অর্ণবের নম্বরে।

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-৩৩+৩৪

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৩৩

রেজিস্ট্রি কাগজ, কলম, কাজী, স্বাক্ষী সব প্রস্তুত অথচ স্বাক্ষর করার মানুষটাই রাজী হচ্ছে না। নুপুরের বেডের পাশে প্রত্যেকটা মানুষ কত আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার হ্যাঁ শোনার জন্য। ঠিক প্রত্যেকে না, বৃষ্টি মনে মনে চাচ্ছিলো প্রত্যাক্ষান করুক নুপুর, রিদওয়ান অবশ্য নির্বিকার। অর্নিও বিকারহীন তবে নুপুরের ছোট মা একমাত্র মানুষ যিনি ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন কখন হবে সইসাবুদ কখন ঘাড় থেকে নামবে আপদ। ক্ষণকাল ব্যয় না করে অর্ণব কাজী সাহেবকে বলেছিলেন বিয়ে পড়ানো শুরু করুন। কাজী সাহেব শুরু করেছিলেন তখনই নুপুর বাঁধা দিলো। শারীরিক যন্ত্রণা এড়িয়ে খুব কঠোর কণ্ঠে জবাব দিলো তার বাবাকে, “এখন কেন! আমি নষ্ট হয়ে গেছি বলে সুযোগ হাত ছাড়া করতে চাইছো না বাবা? এতদিন ভালো ছিলাম চাইলেই সমন্ধ জোগাড় করা যেত কিন্তু এখন আমাকে কয়েকজন মিলে ভোগ করেছে। শুনতে খারাপ লাগবে, নষ্ট করে দিয়েছে আমাকে তাই এখন ওই লোকের হাতে দিতে চাচ্ছো!”

‘ওই লোক’ বলে হাত উঁচিয়ে অর্ণবকে দেখালো নুপুর। বাবা নিশ্চুপ মাথা নিচু করে বসে আছেন মেয়েরই পাশে৷ নুপুরই আবার বলতে লাগল, “ইনি আগেও তো বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো, আমিও তাকে চাইতাম জানতে তবুও রাজী হওনি কারণ তার পরিবার সঠিক নয়, বাবা-মায়ের সম্পর্ক ঠিক ছিলো না আবার টাকা পয়সাতেও আমাদের চেয়ে অনেকটা উপরে। এখনও তো সে আগের মতই আছে তাহলে এখন কেন চাও? আর আপনি!”

এ পর্যায়ে কঠোর দৃষ্টি আর কঠিন কণ্ঠে অর্ণবকে উদ্দেশ্য করে ডেকে উঠলো নুপুর। সবাই চমকে তাকায় মেয়েটার দিকে৷ এইতো ঘন্টা কয়েক আগেই এই মেয়েটার অবস্থা ছিলো মৃত্যুসম। এখনও সে শরীর টেনে বসতে অপারগ, নিজের ভার বহনের শারীরিক শক্তিহীন অথচ মানসিক দিক থেকে ভীষণ কঠিন আছে এমনটাই উপস্থাপন করছে। প্রচণ্ড ক্রোধ প্রকাশ করতেই যেন এবার সাধ্যমত চেঁচিয়ে উঠলো, ” আর আপনি কি করতে এসেছেন এখানে? উদ্ধার! উদ্ধার করতে এসেছেন আমাকে? উদ্ধার করবেন আমার কন্যা দায়গ্রস্ত বাবাকে! এতোটাই করুণা জেগেছে যে, বিয়ের আসরে বউকে ফেলে চলে এসেছেন! অনেক করেছেন প্লিজ এবার যান। আর কখনো আমার সামনে আসবেন না অনুরোধ রইলো।”

এইটুকু বলে হাঁপাতে লাগলো নুপুর। অর্নি তার অবস্থা দেখে দ্রুত এগিয়ে এলো কাছে৷ নুপুর ধরতে দিলো না তাকে। আবারও বলল, “সবাই অনেক করেছেন আমার জন্য তা অনুমান করতে পারছি৷ এখন আর করতে হবে না চলে যান সবাই দয়া করে৷ আর বৃষ্টি আপু আমি জানি না আপনি এত উদারতা কেন দেখাচ্ছেন। আজ আপনার বিয়ে আপনি উনাকে নিয়ে বাড়ি যান আপনাদের বিয়ে সম্পন্ন করুন।”

-তোমার বলা শেষ হয়েছে?

অর্ণব গাঢ় স্বরে প্রশ্নটা করলো। সে কথার জবাবে নুপুর শুধু মুখ ফিরিয়ে বাবার মুখে তাকিয়ে রইলো। কিছুটা সময় মৌন রইলো প্রত্যেকেই৷ কাজী সাহেব বোধহয় মনে মনে অতিষ্ঠ বোধ করছিলেন এত সব নাটকে। তিনি কিছুটা মিনমিন করেই বলে বসলেন, “বাবাজী রাত তো বাড়তাছে আমি কি চইলা যাব?”

নুপুরের মামা ইশারা করলো, সবুর করেন একটু। আরও কিছু সময় সবাইকেই ধৈর্য্য ধরতে হলো তারপর খুব আচানক, অর্ণব কাজী সাহেবকে বলল, বিয়ে পড়ানো শুরু করেন কাজী সাহেব। কনের নাম নুপুর, বাবার নাম নাজিম, আমার নাম অর্ণব চৌধুরী, পিতা…. কাজী সাহেবসহ অন্যরাও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো অর্ণবের দিকে। কত উদগ্রীব একটা পুরুষ তার ভালোবাসার মানুষের জন্য হতে পারে! অথচ এই মানুষটাই নাকি অন্য কাউকে বিয়ে করতে বর বেশে রওনা হয়েছিলো। অর্ণব ঠিক কোন জায়গাটাতে অধিকার পরায়ণ সে বোধটা সকলের নেই। অনেকে হয়তো ভাবছেন, এখন কেন এত ঢং বাপু! প্রথমে তো খুব ভাব দেখিয়েছিলে মেয়েটাকে অবহেলা করে৷ তারা বুঝবেন না এই ভগ্ন হৃদয়ের মানুষটার মানসিক শক্তি ঠিক কোন পরীক্ষাটা দিচ্ছিলো। সে চাইলেই পারতো শুরুতেই মেয়েটাকে নিজের করতে৷ তাতে কি কি লাভ হতো! নুপুর তার হতো কিন্তু নুপুরের সুখ আর স্বস্তি আটকে যেত তার বাবার অমতের মাঝেই। সে বাবা-মা’হীন জীবনে আরো একজনকে এনে ফেলে দিতো তার নিগূঢ় একাকীত্বে। এরপর সে বৃষ্টিকে বিয়ে করতে রাজী হলো ভেবেছিলো জীবনটাকে ব্যবসার মত উল্টেপাল্টে ব্যবহার করবে তাতেও বুঝতে পারলো চরম নির্বুদ্ধিতায় সে ভুল মানুষদের আপন ভেবেছে। যারা আপন হয়ে তাকে সাহায্য করছিলো প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বার্থোদ্বার করতে তৎপর৷ হোক সেটা তার রক্তের মানুষ বড় দাদা আর তার নাতিরা কিংবা খালুজান। এরপর ভাবলো যা হোক ভালোবাসার মানুষের বিয়ে ঠিক হচ্ছে সে নিজে কোন দায়বদ্ধতায় না জড়ালে হয়ত মেয়েটাকে এড়াতে পারবে না। বৃষ্টির পক্ষ থেকেও জেদ অনড় তাই এখানেই এগোনো সমীচীন লেগেছে তার অন্তত দিনশেষে বৃষ্টি তাকে প্রত্যাশা অপূরণ থাকার দাবী নিয়ে সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে না। উপরওয়ালার লিখন তার ভাবনা থেকে অনেক ভিন্ন। তাইতো ঠিক সেই মুহূর্তটাতেই তার কানে পৌঁছুলো প্রিয় মানুষটার নিঃশেষ হওয়ার খবরটা। নিঃশেষ তো সেও হয়েছে সে মুহূর্তে আর তাইতো এখন আর সুযোগ ছাড়তে চাইছে না নিজেকে নতুন করে গড়িয়ে নিতে৷ কাজী সাহেব বিয়ের কাগজটা সামনে এগিয়ে নুপুরকে বলল, এইখানে সই করেন মা।

নুপুর ফিরে তাকালো না কারো দিকে। নুপুরের বাবা অসহায়ের মত চেয়ে আছেন মেয়ের দিকে। সত্যিই তিনি এখন নিজের প্রতি অসহ্যবোধ করছেন। এখানে যা হচ্ছে তা ঠিক না বেঠিক সে কথাও যেন বোধগম্য হচ্ছে না তাঁর।

-শুধু টিপসই চলবে? প্রশ্নটা অর্ণব কাজীকে করলেও উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার জানতে চাইলো কালি আছে? কাজী সাহেব এগিয়ে দিলেন ছোট্ট বক্সখানা। অর্ণব সবাইকে আরও বেশি অবাক করে দিয়ে নিজেই নুপুরের হাত টেনে জোর করে আঙ্গুল চেপে টিপছাপ নিয়ে নিলো। এরপর বাকিদের উদ্দেশ্যে বলল, “নাটক যখন চলছে আরেকটু চলুক। সবাই ভাববেন কনে অশিক্ষিত নিজের নাম সই করতে পারে না তাই টিপছাপ দিয়েছে। এই নেন আমিও মূর্খ আমিও টিপসই দিছি। কবুল কবুল কবুল তিন কবুল। ওরটা বাকি রইলো যেদিন ওর মন বলবে আবার বিয়ে করবো শিক্ষিতের মত। স্বাক্ষীরাও কি টিপছাপ দিবেন?”
প্রশ্নটা ঠিক কার জন্য অর্ণব নিজেও জানে না। বৃষ্টি একটু দূরে দাঁড়িয়ে এক নজরে শুধু অর্ণবকে দেখে গেল। একটা মানুষ ঠিক কতোটা পাগল হলে এমনটা করে? এই যে বিয়েটা হলে আদৌও তা হলো কিনা কে জানে বৃষ্টি শুধু দেখলো এটা বিয়ে নয় নিজের প্রিয় মানুষটাকে ভঙ্গুর অবস্থায় নষ্ট এ সমাজে একা ছাড়তে চায় না বলে এসব করে গেল। নয়ত কাল অব্দিও সুস্থ প্রেয়সীকে সে পাওয়ার জন্য একটুও জোর করেনি৷ এই পুরুষটা চমৎকার প্রেমিক হতে পারবে না কখনও তবে সে ভয়ংকর এক প্রেমিক তা আজ প্রমাণ হয়েই গেল। পরিবেশ শীতল হয়ে গেল আর কিছুক্ষণের মাঝেই। রিদওয়ান বৃষ্টিকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেও অর্নিতাকে পৌঁছে দিলো অর্নিতাদের বাড়িতে। নুপুরের বাবার জন্যও আলাদা এক কেবিন নিয়ে সেখানেই রইলো নাজিম সাহেব, স্ত্রী আর পুত্রসহ। নুপুরের মামা রাতেই চলে গেছেন কাজী সাহেবকে বিদায় করে। নুপুরের কেবিনে এখন শুধুই অর্ণব উপস্থিত। চোখ বুঁজে পড়ে আছে নুপুর হয়তো একটুপরই ডুবে যাবে ঘুমের অতলে। নার্স কিছুক্ষণ আগেই এসে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে গেছেন। চিৎকার, চেঁচামেচি করার দরুন প্রেশার ফল করেছে তার। ড্রিপ চলছে এখন তাই আলাদা খাবারের চিন্তাটা রইলো না। নুপুর এখনো ঘুমিয়ে পড়েনি তবুও চোখ খুলছে না। অর্ণবও বলছে না কিছু সে চুপচাপ বসে আছে বেডের পাশের চেয়ারটাতে। রাত বাজে এগারোটার উপরে আজ এখনো দাদীর কোন খোঁজ নেয়া হয়নি। রুজিনা খালার নম্বরেই করলো কলটা৷ খালা ফোন রিসিভ করে জানালেন দাদীর শরীরটা বেশি ভালো না আজ তাই দ্রুতই খাবার, ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে গেছেন। এরপরই অর্ণব কল দিলো রিদওয়ানকে৷ সে রিসিভ করেনি তবে কিছু মুহূর্ত বাদই ছোট্ট বার্তা পাঠালো, কোন কিছু নিয়ে টেনশন করিস না৷ সকালে কথা হবে।

মেসেজটা পাওয়ার পর টেনশন বেড়ে গেল। ও বাড়িতে নিশ্চয়ই কিছু ঠিক নেই। কিন্তু এখন কিছু করাও সম্ভব না। কাল সকালেই যা করার করতে হবে। নুপুরের দিকে আরেকবার তাকিয়ে এবার কল করলো অফিসার শরাফত এর কাছে। ভদ্রলোক যথেষ্ট ন্যায়পরায়ণ তা অল্প সময়েই আন্দাজ করা গেছে। ফোন নম্বরটাও অর্ণব তাই যেচে রেখে দিয়েছে কিছু জরুরি আলাপ এবার তাকে করতেই হবে৷ হঠাৎ কানে এলো ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। নুপুর কাঁদছে! কাঁদুক। সে বাঁধ সাধবে না৷ এ কান্নাটুকুই হোক তার ভেতরটাকে ধুয়ে ফেলার অস্ত্র৷ এরপর সব বর্ষার জলের মত ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে নতুন করে জমবে পলিমাটি। তৈরি হবে তার নুপুর তার একান্ত আপনজন। অর্ণব চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এসে কুঁজো হলো। আলতো ঠোঁটের স্পর্শ দিলো কপালে দু হাতে চেপে ধরলো নুপুরের কোমল দু হাত। নিঃশব্দে আশ্বাস দিলো ভয়হীন এক নতুন ভোরের।

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৩৪

‘বিয়ে’ শব্দটা মানব জীবনে অতি পবিত্র অতি সুখকর এক ব্যাপার যদি তা হয় আপনজনদের আনন্দ, অনুমতি মিলিয়ে। অর্ণবের জীবনে সুখ বরাবরই ছিন্নমুকুল। সুখের লহরী একপাশ দিয়ে প্রবেশ করতেই দুঃখকূলও এসে জড়ো হয় জানান দেয় উপস্থিতি। আর তার বিয়ের ক্ষেত্রেও তাই প্রমানিত হলো। ভালো লাগা, ভালোবাসার মানুষটার সাথেই বিয়ে হলো সেই সাথে হলো কতগুলো আপনজনের সাথে বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদের প্রথম নামটাই খালামনি৷ ভোরের আলো ফোটার পর খুব বেশি সময় অর্ণব হাসপাতালে থাকতে পারেনি৷ কাল অন্যায় তো বৃষ্টির সাথেও করেছিলো সে অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতেই আজ তার শর্ত মোতাবেক বৃষ্টির সাথে বিয়েটা সম্পূর্ণ করবে ভেবেছে। নুপুরের নাশতা, ঔষধ সেবন কমপ্লিট হতেই সে স্পষ্ট ভাষায় নুপুরকে অবগত করলো তার বৃষ্টিকে বিয়ে করার কথা। শুনতে হাস্যকর লাগছিল বটে তবুও বলতে হলো। নুপুর নিশ্চুপ তার সকল কথার জবাবে৷ অর্ণব বুঝতে পারলো নুপুর তার সাথে কথা বলবে না। হয়তো অনুভূতিও হারিয়ে গেছে কিছু বলার, বোঝার কিন্তু অর্ণব আর করবেটাই বা কি! তবুও যাওয়ার আগে রাতের মত আরেকটিবার ঠোঁট ছোঁয়ালো শ্যামাঙ্গীনির ললাটে৷ ফিসফিসানি স্বরে বলে গেল, “তোমার অধিকার এক বিন্দু পরিমাণও হরণ হবে না অন্যকারো অনুপ্রবেশের কারণে। আসছি।”

কেবিন ছেড়ে অর্ণব বেরিয়ে যেতেই চোখ খুলল নুপুর। চোখের কার্নিশ গড়িয়ে পড়ল তপ্ত জল।
_______

বাশার শেখের চেকআপ করতে ভোর বেলাতেই হাজির হয়েছেন ডক্টর আশরাফ। বন্ধুমানুষ আশরাফ কালও উপস্থিত ছিলেন এ বাড়িতে তাই বাড়ির পরিস্থিতি সবই তার নখদর্পনে। বন্ধুর ঔষধ পত্র চেক করে প্রেশারের ঔষধটা বদলে দিলেন সেই সাথে যুক্ত করলেন নার্ভ শীতল রাখার ঔষধ। বাশার শেখ বসে আছেন নিজ কক্ষে ডিভানে হেলান দিয়ে। আশরাফ বুঝতে পারলেন এভাবে বন্ধুর উচ্চরক্তচাপ আপাতত ঠিক হবে না তাই তিনি ভাবলেন অন্য কাজ করতে হবে।

-সকালে আমার ওয়াক, ব্রেকফাস্ট কিছুই হয়নি তোর জন্য ।

-হ্যাঁ! ওহহহ ভুলে গেছিলাম আমি… দাঁড়া তোর ভাবীকে বলছি নাশতা দিতে।

বাশার শেখ ব্যস্ত হলেন নাশতার জন্য। আশরাফ তা দেখে বলল, মর্নিং ওয়াক তারপর পানি এরপর নাশতা খেতে হয় নইলে এই বুড়ো শরীরে ঝামেলা পাকিয়ে যায়। তুই চল নাশতার কথা বলে আয়, তোর বাড়িতেই একটু হাঁটি।

বাশার শেখ বুঝলেন বন্ধু মূলত তাকেই হাঁটার কথা বলছেন। উঠলেন দু বন্ধুতে। কাজের বুয়াকে নাশতার কথা বলে দুজনে হাঁটছেন বাড়ির বাগানের ভেতর।

-বৃষ্টির বয়স কত?

– তেইশ চলছে।

-পড়াশোনাও তো শেষ হয়নি তাই না!

-হু।

-আমাদের বৃষ্টি মামনি দেখতে মাশাআল্লাহ, শিক্ষিতা, বাপেরও অবস্থা দুনিয়া জানে। তবুও কেন তুই যেচে অর্ণবকেই বাছাই করলি যখন তোর জানা ছেলেটা অন্য কাউকে পছন্দ করে!

বাশার শেখ চুপ করে আছেন। সত্যি বলতে জবাব দেয়ার মত মুখ নেই তাঁর এখন। বন্ধুকে সত্যিটা বলা সম্ভব না। শুধু মেয়ে পছন্দ করে বলে নয় অর্ণবের অর্থ, সম্পদ আর ছেলেটা নিজের সম্পদের একচ্ছত্র উত্তরাধিকার সে একাই তাই মেয়ের সংসারে কথা বলার বাড়তি লোক থাকবে না এসব চিন্তা করেই তিনি পেছনে পড়েছিলেন। এক কথায়, লোভ পেয়ে বসেছিলো তাই আর তাই অর্ণব ছাড়া কিছু বুঝতে চাচ্ছিলেন না। বন্ধুকে এসব বলে নিজেকে লোভী প্রমাণ করার মত লোক বাশার শেখ নন। তিনি ছোট্ট জবাব দিলেন, মেয়ের ভালোবাসা ওই হারামজাদা তাই চেয়েছিলাম।

আশরাফ মুচকি হাসলেন। তিনি চেনেন তার বন্ধুকে তাই জবাবটা হাস্যকর লাগলো। যে লোক প্রচুর বিত্তশালী এক মন্ত্রীর ডিভোর্সি মেয়ের সাথে পুত্রের অমতেই বিয়ে ঠিক করতে পারে সে শুধু ভালোবাসা দেখে মেয়ে বিয়ে দেবে!

আশরাফ আবারও বলেন, “তাই বলে সব জেনেও?”
বাশার শেখ জবাব দেন না।

-তোর প্রেশার এবং হার্টের অবস্থা কোনটাই সুস্থ নেই। কন্যার সুন্দর একটা গতি না করে দুনিয়া ছেড়ে শান্তিও পাবি না তাই অর্থের পেছনে না ছুটে এখন একটু স্বাস্থ্যের পেছনে ছুট আর হ্যা নিয়মিত দু বেলা হাটাহাটি কর কিছুদিন। সুস্বাদু হয়ে মেয়ের জন্য ভালো দেখে আবার পাত্র খোঁজ আমরাও খুঁজব। বৃষ্টি মামনির জন্য তার যোগ্য পাত্রের কমতি হবে না।

আশরাফ আরও কিছুক্ষণ কথা বলে বাশার শেখকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। দুজনে নাশতা করে একসাথে বেরিয়েছেন বাড়ি থেকে। অর্ণব যখন শেখ বাড়িতে পা দিলো তখন বাড়িতে শুধু বৃষ্টি, রায়না আর রিদওয়ানই ছিল উপস্থিত। অর্ণব বাড়ির ভেতর ঢুকতেই দারোয়ান একটু কেমন অবাক দৃষ্টিতে তাকায়, কাজের বুয়া আর বাগানের মালির দৃষ্টিও একই। অর্ণব বুঝতে পারে তার আজকের উপস্থিতি সকলের জন্যই আশ্চর্যজনক। কোনদিকে পাত্তা না দিয়ে সে সোজা চলে যায় খালামনির ঘরের সামনে।

-খালামনি ঘরে আছো?

রায়নার শরীরের হাল একদিনেই বেহাল হয়ে আছে। কাল থেকেই বিছানা ছেড়ে উঠার শক্তি হারিয়ে বসেছেন। রাতে বাশার শেখও অসুস্থ থাকায় দুজন দু কামরায় ছিলেন। রিমন বাবার পাশে আর রায়না মেয়ের ঘরে থাকায় রাত থেকে বৃষ্টি খেয়াল রাখছে তার মায়ের। অর্ণব বার কয়েক ডাকার পরও যখন রায়নার জবাব পেলো না তখন পর্দা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিলো। ঘরটা খালি! এবার দু পা এগিয়ে গেল রিমনের ঘরের সামনে৷ দরজা ভেজানো দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভেতরে কেউ নেই৷ করিডোরের রেলিংয়ে ঝুঁকে আবারও নিচে তাকালো। এখান থেকে বসারঘর সংলগ্ন রান্নাঘরের দরজা চোখে পড়ে। একজন কাজের লোককে দেখা গেল।

-খালামনি কোথায়?

মহিলা অর্ণবকে দেখেই কপাল কুঁচকে ফেলল। তবুও জবাব দিলো, বৃষ্টি আপার ঘরে আছে।

অর্ণব আর কোন কথা না বলে সোজা হেঁটে গেল রিদওয়ানের পরের ঘরটাতে। দরজায় এসে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড। লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে বোধহয় সাহস জোগালো কিছুটা। এরপরই ক্ষীণ স্বরে বলল, “খালামনি!”

রায়না বার তিনেক অর্ণবের ডাক শুনলেন তবুও জবাব দিলেন না৷ বৃষ্টি ঘুমাচ্ছিলো পাশেই সে জেগে গেল। মায়ের দিকে তাকাতেই বুঝলো মা কথা বলতে চান না অর্ণব ভাইয়ের সাথে। কিন্তু কথা না বলে মা’ও যে কষ্ট পাবে তা বৃষ্টি খুব জানে। আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টিকারক অর্ণব নয় বৃষ্টি নিজেই তাও সে জানে। অর্ণব বরাবরই তাকে সতর্ক করে এসেছে সে আবেগে ডুবে বাস্তবতাকে হারিয়ে দিতে চেয়েছিলো। আবেগে সে দ্বিতীয়বারের মত নিজের সাথেই খেলল। এবারের খেলাটা হয়ত বেশিই হয়ে গেছে তাইতো আজ তার পরিবারের বিধ্বস্ত অবস্থা। চতুর্থবারের মত অর্ণবের ডাক কানে আসতেই বৃষ্টি শোয়া থেকে উঠে বসে৷

-অর্ণব ভাই ভেতরে এসো।

রায়না মেয়ের দিকে তাকায়৷ বৃষ্টি নির্লিপ্ত চোখে দরজায় দৃষ্টি রাখে৷ কালকের পরিধেয় পোশাকে এলোমেলো অবস্থা অর্ণবের।

-খালামনি, আমাকে মাফ করে দাও… বলতে বলতেই অর্ণব এসে বসে রায়নার মাথার কাছে। রায়না তাকায় না তার চোখের কোণ ভিজে গেছে। অর্ণব হাত বাড়িয়ে খালামনির হাত ধরে। দু হাতের পাতায় মায়ের সমান খালামনির কোমল হাতটা চেপে ধরে কৈফিয়ত দেবার মত করেই বলে, “কাল যখন ফোনটা ধরলাম তখন শুধু কানে এলো নুপুরকে কে বা কারা রেপ করেছে। বিশ্বাস করো খালামনি ওই কথাটা অফিসার যে কয়েক সেকেন্ডে বলেছে ঠিক সেই কয়েক সেকেন্ডই আমার দম বন্ধ হয়েছিল৷ সে যেদিন কিডন্যাপ হলো সেদিন সেই মুহূর্তে ও কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়েছিলো আমার সামনে থেকে। আমি কাঁদিয়েছিলাম সেদিন আর তারপরই ওর এই অবস্থা! আমার শুধু মনে হচ্ছিল ওকে আমি শেষ দেখাও দেখতে পারবো না বিশ্বাস করো খালামনি আমি তোমাদেরও অসম্মান ক……..

অর্ণবের বাক্য পূর্ণ হওয়ার আগেই রায়না উঠে বসেন। বা হাতটা অর্ণবের মুঠোয় তিনি ডান হাতটা উঠিয়ে ঠাস করে বসিয়ে দেন অর্ণবের গালে। ঘটনার আকষ্মিকতায় বৃষ্টি চমকে মাকে ডাকে, আম্মু! এরপর পুরো ঘর নিস্তব্ধতায় ডুবে রইলো কিছু সময়৷ অর্ণব ঠায় বসে আছে বৃষ্টিও তাই৷ শুধু রায়না কাঁদলেন কিছুক্ষণ।

-“তোর বাবা নেই মা থেকেও নেই। নিজের তিন সন্তান থাকা সত্ত্বেও নিঃসন্তান মানুষদের মত আগলে রেখেছি তোকে আর অর্নিকে। শ্বশুর বাড়ির প্রায় প্রতিটা মানুষের মুখে হাজারটা কথা শুনেছি বোনের ছেলেমেয়ের দায়িত্ব নিয়েছি বলে এমনকি যে মানুষটার সংসার করি সে মানুষটা সংসার ছাড়া করবে বলার পরও তোদের ছাড়িনি। তুই একা থাকতে পারবি ততটুকু বড় ছিলি তাই তোকে তোর দাদীর কাছে রেখে অর্নিকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছি। তোকে দূরে রাখলেও তোর যত্ন, তোর দায়িত্ব দূর থেকেই পালন করেছি। হ্যাঁ হয়তো তোর বেলায় ঠিক মা হয়ে উঠতে পারিনি কিন্তু কিছু তো করেছিলাম৷ কি করে পারলি আমাকে এভাবে ঠকাতে! আমার মেয়েটার জীবন নিয়ে খেলার অধিকার কে দিয়েছে তোকে?”

সারাজীবন নিঃশব্দে সবার দায়িত্ব পালন করা মানুষটা, সবার জন্য স্নেহের ঝুড়ি উপুর করা মানুষটা আজ অভিযোগ করছে। অর্ণব জবাব দিতে পারছে না। কি বলবে সে, খালামনি তোমার মেয়ের জেদের জন্যই সে কষ্ট পেয়েছে এটা বলবে? নাকি বলবে আমার প্রিয় মানুষটাকে ভুলতেই শেষ বার তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিলাম৷ কার দোষ দেবে সে। সে কি জানতো বিয়ের দিন এমন কিছু হবে! অর্ণব তো নিজের মনকে শক্ত পাথর করে তবেই এসেছিলো। পারল না শেষ পর্যন্ত শক্ত থাকতে৷ ছোট্ট একটা সংবাদ তাকে পাথর থেকে কেমন গলিয়ে তরল করে দিলো। অর্ণবের নীরবতা যেন এবার রাগিয়ে দিলো রায়নাকে। সে হাত টেনে ছাড়িয়ে নিলো অর্ণবের হাত থেকে।

-আমার সামনে থেকে চলে যা তুই। আর কখনো তোর ছায়াও যেন আমার সামনে না পড়ে।

-এমন কথা বলো না খালামনি৷ তুমি তো আমার মা….

-আমি রিমন, রিদওয়ান আর বৃষ্টির মা, অর্নির শ্বাশুড়ি , তোর কেউ না।

-আমাকে মাফ করে দাও খালামনি৷ আমি বৃষ্টিকে বিয়ে করব তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিও না। আমার জন্য তুমি আমার, অর্নিতার মা৷ প্লিজ খালামনি…

অর্ণব এবার রায়নার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। সে কিছুতেই সরবে না খালামনির রাগ না ভাঙিয়ে। তার তো এ জগতে মা বলতে এই মানুষটাই আছে৷ রায়না অবিচল বসে আছে৷ ছুঁয়ে দেখছে না পায়ে পড়ে থাকা ছেলেটার দিকে। তবে বৃষ্টি এবার মুখ খুলল কিছু বলার জন্য।

-তোমার বিয়ে হয়েই গেছে অর্ণব ভাই৷ আমাকে বিয়ে করে আর উদ্ধার করতে হবে না। কালকের রেজিস্ট্রি পেপার যেটাতে আমি সাইন করেছিলাম তা কালই বাতিল করা হয়েছিলো। তোমার ফিরে যাও নিশ্চিন্ত মনে। আর হ্যাঁ আম্মু যা বলল মনে রেখো কখনো এসো না আমাদের সামনে।

খানিকটা গাঢ়, খানিকটা কড়া শোনালো বৃষ্টির কণ্ঠস্বর। অর্ণব সেদিকে পাত্তা দিলো না সে পা পেঁচিয়ে ধরে আছে খালামনির। রায়না বিরক্ত হচ্ছেন এমনটাই বোঝাতে যেন পা থেকে ধাক্কা মেরে সরালেন অর্ণবকে। বিছানা থেকে নেমে টেনে ধরলেন অর্ণবের হাত। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে অর্ণবকে তিনি ঘর থেকে বের করে দরজা আটকে বিছানায় বসে পড়লেন আবার৷ দরজার ওপাশ থেকে অর্ণব সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, আমাকে মাফ করে দাও খালামনি। প্লিজ ক্ষমা করো।

-চলে যেতে বলেছি তোকে। আজকের পর তোর ছায়াটাও দেখতে চাই না আমি৷

-এভাবে বোলো না খালামনি তবে যে আমি হারিয়ে যাব। আমি এতিম তোমার স্নেহও হারিয়ে ফেললে কিভাবে বাঁচব বলো?

-তুই এতিম কে বলল? মনের মত বউ পেয়েছিস, শ্বশুর শ্বাশুড়িও নিশ্চয়ই হয়েছে।

-আমার সাথে এত কঠিন হইয়ো না খালামনি নইলে যে আমি হারিয়ে যাব সত্যিই কোথাও হারিয়ে যাব আমি।

________

নুপুর আছে হাসপাতালের তিন তলায়। অর্ণবের দাদীর ডক্টর বসেন নিচতলায়। অর্নিতা দাদীকে নিয়ে ডাক্তার দেখানোর পরপরই দাদী বললেন, নুপুররে দেখতে চাই।

হাঁটুর ব্যথায় তিনি বাড়িতে দোতলার সিঁড়িই বেয়ে চলেন না আর এখানে তৃতীয় তলায় কি কডে যাবেন? হাসপাতালে এলিভেটর থাকলেও তিনি তাতে চড়তে পারেন না দমবন্ধ অবস্থা হয়। কিন্তু নুপুরকেও যে দেখতে চাইছেন এখন৷ অর্নিতা ভেবেছিলো রিদওয়ান
কে ফোন করে বলবে যেন একটু আসে৷ কল করে জানা গেল রিদওয়ান তার মাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে গেছে অন্য হাসপাতালে। অর্নি ভাবলো দাদীকে বলবে আজ নয় কাল ভাইয়ার সাথে এসে না হয় দেখবে অথবা বাড়িতে নেওয়ার পর। কাল রাতের ঘটনা সে আজ সকালেই দাদীকে একটু একটু করে বলেছে। অসুস্থতার মাঝেও দাদী যেন একটু স্বস্তি পেলেন অর্ণবের বিয়ের কথা শুনে। বয়স হয়েছে সেই সাথে আজকাল রোগভোগও বেড়েছে খুব। ইদানীং প্রায় স্বপ্নে স্বামীকে দেখেন সেই থেকে ধারণা তিনিও আর বেশিদিন বাঁচবেন না। এ অবস্থায় অর্ণবকে কোথাও স্থির দেখতে চান। আর আজ এত ঝামেলার পর অর্ণব তার চাওয়া মানুষটাকেই পেয়েছে বলেই বোধহয় তিনি স্বস্তি বোধ করছেন। অর্নিতা বাড়ি ফিরবে বলে দাদীকে নিয়ে গেইটের কছে যেতেই দেখে অর্ণব এসে ঢুকছে। দাদীর ইচ্ছের কথা জানালে সে আর দেরি করে না। পাঁজাকোলে করে সিঁড়ি বেয়ে তুলে নেয় দাদীকে তিনতলায়৷ পেছন পেছন দাদীর লাঠি হাতে এগিয়ে চলে অর্নিতা৷

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-৩২

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৩২ (প্রথমাংশ)

অবিশ্বাস, অভিযোগ আর ক্রোধের সর্বোচ্চ পর্যায় সেই অক্ষিদ্বয়ে। কি যে অসহনীয় এক যন্ত্রণা অন্তর ছাপিয়ে তার গম্ভীর মুখটাতে ভেসে উঠেছিলো তা বোধকরি, রিদওয়ান এ জনমে দ্বিতীয়বার কল্পনাও করতে চায় না। পরাক্রমশালী রবের কাছে দু হাত ফেলে শুধু বলতে ইচ্ছে করছে সব ঠিক করে দাও ইয়া আল্লাহ! দূর করে দাও সকলের এই অন্তর্দাহ। বিছানায় বসে কনুইতে ভর দিয়ে দু হাতে মুখটা চেপে ধরে বসে আছে রিদওয়ান। এই কয়েক মিনিট আগেই এ ঘরে সে দেখতে পেয়েছে অর্ণবের অন্তরে তীরবেগে লাগা অদৃশ্য করাঘাত। দেখেছে অর্ণবের সেই দৃষ্টি যা রিদওয়ানের প্রতি অবিশ্বাসে পূর্ণ ছিল। অর্ণব চলে গেছে অফিসার শরাফতের দেয়া ঠিকানায়। অর্ণব যেতে যেতে রিদওয়ানের ফোন থেকে শরাফতের ফোন নম্বরটা নিতে ভুল করেনি । বাড়ি থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ শেষ করতে তার আজ দেড় ঘন্টা লেগে গেল। মাথায় চলছিলো কত ভয়ানক রকম ভয়, আতঙ্ক। কখনো কিছুতে ভয় না পাওয়া অর্ণব আজ প্রচণ্ড ভয়ে কুঁজো হয়ে আসছিলো ৷ হাসপাতালে পৌঁছে দেখা পেল কয়েকজন পুলিশের। কাছে প্রশ্ন করলো অফিসার শরাফত আছেন কিনা। ভদ্রলোক সে মুহূর্তে ডাক্তারের সাথে কথা বলছিলেন। অর্ণব খোঁজ নিচ্ছে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার পরিচয়?

-অর্ণব চৌধুরী।

-ভিকটিম কে হয় আপনার?

নিরুত্তর অর্ণব। কে হয় সে নুপুরের? ভালোবাসার মানুষ? এমন জবাব দেয়া যায়! নাকি বান্ধবীর ভাই বলা যায়? বেনামি এক গাঁট যে আছে দুজনাতে সে কথ কি আজ মুখে আনা যায়।বেশ তো সেদিন তাড়িয়ে দিলো মেয়েটাকে নিজেই এসে হাজির হয়েছে। কিন্তু পুলিশ অফিসারের প্রশ্নে যেন সাগরের অতলে ডুবে গেল অর্ণব। ঠিক সে সময়েই তাকে বাঁচিয়ে দিলো নুপুরের মামা। ভদ্রলোক খবর পেয়েই কেমন করে যে এসে পৌঁছুলেন গন্তব্যে নিজেও জানেন না। নুপুরের বাবার অবস্থা এখনো স্বাভাবিক নয়। ঘুমের ঔষধের প্রভাবে তিনি অচেতন তাই মামা এসেছেন সঙ্গে আছে মামাতো ভাই আর এক খালু। নুপুরের মামাকে পুলিশ অফিসার আগে থেকেই চেনেন বলে জিজ্ঞেস করলেন, নুপুরের অভিভাবক হিসেবে তো রিদওয়ান শেখের থাকাটা জরুরি কোথায় উনি?

মামা জবাব দিলেন, ছেলেটার বোনের বিয়ে আজ সে আসবে হয়ত বিকেলের মধ্যেই আপনি আমাকে বলুন আমার ভাগ্নি কোথায়!

পুলিশ অফিসার আর নুপুরের মামার কথোপকথন শুনতে শুনতে মানসিক ভাবে যেন হোঁচট খেলো অর্ণব। নুপুর মিসিং ছিল তাকে খুঁজতে আইনি কাজে রিদওয়ান অভিভাবক। কি ঘটেছিলো, কবে ঘটেছিলো সে কেন কিছু জানে না! অর্নিতা গত দু দিন ধরেই লুকিয়ে কান্না করছে সে টের পেয়েছে। তার ধারণা ছিল ভাই ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করছে বলে বোনটি অমন ভেঙে পড়ছে। আসলেই কি তাই! পুলিশ আর নুপুরের আপনজন কারো কাছেই
কিছু জিজ্ঞেস না করে সে খুঁজতে লাগলো নুপুর কোথায় আছে? সরকারি হাসপাতাল তারওপর রোগী,নার্স, ওয়ার্ডবয় সব মিলিয়ে এত লোকজন চারপাশে সে ঠিক মানুষটাকে খুঁজেই বের করতে পারলো না। অনেকটা সময় ছুটোছুটি করে তার নিজেকেই পাগল মনে হচ্ছে। ঘুরেফিরে আবার এলো পুলিশগুলোর সামনে। দেখতে পেলো রিদওয়ান আর অর্নিতা এসেছে। হন্তারক হয়ে এবার রিদওয়ানকেই প্রশ্ন করলো, “নুপুর কোথায়? আমি ওকে খুঁজে পাইনা কেন রিদওয়ান কোথায় ও?”

ব্যর্থ প্রেমিকের গোপন ব্যথার প্রকাশ ছিলো যেন অর্ণবের আর্তনাদে। তার আশপাশে উপস্থিত প্রত্যেকটা মানুষই উৎসুক, চমকানো নজরে দেখছে তাকে। রিদওয়ান জবাব দিতে পারলো না। অর্নিতা মেয়ে মানুষ বলেই কিনা কে জানে কষ্ট চাপিয়ে রাখতে না পেরে অশ্রু বিসর্জন দিয়েই চলছে। কিছুটা সময় অর্ণব পুনরায় একই প্রশ্ন করলে শরাফত নিজে এগিয়ে এসে জবাব দিলো, “অপারেশন থিয়েটারে আছে। আপনি কে তা জানি না যেই হোন ধৈর্য্য ধরুন প্রিয় মানুষের জন্য শুধু দোয়া করুন আল্লাহ মালিক নিশ্চয়ই ভালো করবেন। রিদওয়ান আপনি থানায় দেখা করুন কিছু কাজ তো এখনও বাকি আর এই যে ফোনটা এটা আপাতত আমাদের হেফাজতে থাকবে ইনফরমেশনের জন্য। ”

শেষ কথাটা বলতে বলতেই শরাফত নুপুরের পাশে পাওয়া উদ্ধারকৃত ফোনটা দেখালো। অর্ণব আবার চমকালো, এটাতো অর্নির ফোন।

-অর্নি কে?

-আমার ওয়াইফ।
অর্নিকে দেখিয়ে রিদওয়ান জবাব দিলো।

-থানায় আপনার ওয়াইফকে নিয়েই তবে আসবেন । আমার হাতে সময় কম এখানে একজন কন্সটেবল থাকবেন পুরো টাইম৷

“ও কেন যাবে থানায়!” একই সাথে দুটি কণ্ঠ থেকে একই বাক্য বেরিয়ে এলো। অর্ণব, রিদওয়ান দুজনেরই মাথায় যেন আসমান ভেঙে পড়লো।

“এই ফোন যেহেতু ভিকটিমের না সেহেতু তার আশপাশের প্রত্যেকটা বস্তু,প্রাণী সবকিছুতেই ইনভেস্টিগেশন হবে। আশা করি আমার কাজে ব্যঘাত ঘটাবেন না।”

অর্ণবই এবার ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, ও কোথাও যাবে না যা বলার দরকার এখানেই বলুন।

-কুল মিস্টার…. গরম রক্তের তেজ সব জায়গায় খাটাতে যাবেন না।
সাবধানী গলায় বলল পুলিশ অফিসার। নুপুরের মামা এবার মুখ খুললেন, “স্যার এই জায়গায় না রেখে ভাগ্নিকে আমি প্রাইভেট হাসপাতালে নিতে চাইতাছি ওর বাবা যেটায় ভর্তি আছে। তারজন্য কি কোন নিয়মকানুন আছে?”

শরাফত সাহেব জানালেন হ্যাঁ একটু ফরমালিটি আছে আর এমনিতেও মাত্র অপারেশন শুরু হয়েছে পেশেন্টকে নেয়া হয়ত সম্ভব হবে না। সত্যিই তাই হলো। ডাক্তাররা ইমিডিয়েট অপারেশনের পর রোগীকে আন্ডার অবজারভেশনে রেখেছেন টানা তিন ঘন্টা। এরপর অনুমতি দিতেই নুপুরকে নেওয়া হলো তার বাবা যেখানে এডমিটেড ছিলেন৷ আর দুশ্চিন্তার ব্যাপার হলো নাজিম সাহেব চেতনায় ফিরেই স্ট্রোক করেছেন মেয়েকে এক নজর দেখার পরপরই। পুরো পরিস্থিতি সেই সাথে একটা পরিবার সম্পূর্ণ ভেঙে খানখান হয়ে গেলো কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে। সেসবের সাক্ষী হিসেবে সব বোবার মত দেখতে লাগলো অর্ণব, অর্নিতা, রিদওয়ান আর নুপুরের মায়ের দিককার কয়েকজন আত্মীয়।
________

কনের স্বাক্ষর আর কবুল বলা হয়ে গেছে অনেক আগে। কাজী সাহেব আর অন্য মুরব্বিগণ নিচতলায় এসেছেন বরের কাছে। বর কোথায়! বোর কোথায়! বর কোথায়? এই এক রবে পুরো শেখ বাড়ি সরগরম হয়ে উঠলো বেলা তিনটা নাগাদ। তারপর কেটে গেছে আরও ঘন্টা তিনেক। দিনমনি অস্তাচলে মিশে গেছে, সন্ধ্যে নেমে তাও যাই যাই শহর ঢাকা পর্দা হয়ে রাত নেমেছে এ শহরের বুক জুড়ে। শেখ বাড়ির ভরা মজলিশে নিস্তব্ধতার মেলা বসেছে। দূর আত্মীয় সকলে বিদায় নিয়েছেন অনেক আগেই এখন খুব কাছের মানুষরাও বিদায় নিচ্ছেন একে একে। অর্ণব-অর্নিতার জন্মদাত্রী তো সেই দুপুরেই ত্যাগ করেছেন বোনের বাড়ি। এবার অন্য ভাই,ভাবী আর ছেলে মেয়েরাও বিদায় নিতে এসেছে রায়নার ঘরে। প্রেশার বেড়ে ঘাড়ের শিরা ফুলে উঠেছে প্রায় রায়না বেগমের। কাজের মেয়েটি একটা আস্ত লেবুর রস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাশেই রিমন মায়ের মাথায় পানি ঢালছে। বাশার শেখ অন্য ঘরে বসে একবার ডাক্তারকে ফোন করলেন এখন পুলিশকে করছেন অর্ণবের বিরুদ্ধে কোনো একটা ব্যবস্থা নেয়ার উদ্দেশ্যে। বৃষ্টি কাঁদছে নিজের ঘরে দোর এঁটে। দ্বিতীয় বার ভালোবেসে তাকে কাঁদতে হচ্ছে তবে কি তার ভাগ্যে ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার রেখাটা নেই? তাহলে কি লাভ বাপ-ভাইয়ের অত ক্ষমতা থাকার! হঠাৎই মনে হলো ভাই হ্যা তার ভাই-ই তো তার পরম শত্রু। দুই ভাই-ই তো শুরু থেকে বাঁধা দিয়ে আসছে তার সুখে। নিশ্চয়ই এদের জন্যই আজ তার বিয়েটা ভাঙলো। তারা নিশ্চয়ই পারতো অর্ণবকে তার প্রতি দায়িত্বে বাঁধতে। আর একবার দায়িত্বে বাঁধা পড়লে ভালোও বাসতো। শুধু মাত্র ভাইদের জন্যই তার আজ এই দশা। এমনটাই ভেবে ভেবে আক্রোশে ফেটে পড়লো বৃষ্টি। হঠাৎই মনে হলো সে কথা বলবে অর্ণবের সাথে এবং সে তৎক্ষনাৎ কাউকে কিছু না বলে বাবার গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে।

________

“মাফ করেন আমারে। আমার স্বামীর চিকিৎসার জন্যই লাখ দেড়েক লাগব এই হাসপাতালে রাখতে৷ সস্তার হাসপাতালে নিলে চিকিৎসা ভাল হইব না আর আমার দরকার তিনি জলদি ভাল হোক নইলে আমার সংসারটা অচল হইয়া যাইব। ওই মাইয়ার যে অবস্থা দেখতাছি তাতে ওরে ভালা করতেও কম লাগব না তার উপ্রে কেমন ভাল হইব সেটাই কেডা কইতে পারে। এমনিতেই বিয়া শাদি আর দেওয়ার অবস্থা নাই এরে ঘরে তুললে আমার একটা বাড়তি বোঝা ছাড়া কিছুই বাড়ব না। সৎ মা হইয়াও এত বছর অনেক করছি এইবার আপনেরা বুঝেন গিয়া।”

নাজিম সাহেবের অবস্থা নাজুক জানিয়েছেন ডাক্তার। তিনি মূলত উচ্চরক্তচাপ আর অতিরিক্ত চিন্তায় ডায়বেটিস বেড়ে যাওয়ায় স্ট্রোক করেছেন। প্রথম স্ট্রোকেই তিনি যে মারাত্মক অবস্থায় আছেন তাতে অখন তখন কিছু একটা হতে পারে। ডাক্তারের উদ্দেশ্য যে ঠিক কেমন তা বুঝতে পেরেই নুপুরের মামা শঙ্কিত৷ নাজিম সাহেব যদি শয্যাশায়ী হন তবে নুপুরের দায়িত্বের নিঃসন্দেহে তাদের ওপর পড়বে। সে ভয়েই জলদি জলদি হাসপাতাল থেকে বেরুতে যাচ্ছিলেন তখনই নুপুরের ছোট মা পথ রোধ করলেন। ভদ্রলোক যে ভয় পাচ্ছিলেন সেটাও সত্যি করে তিনি জানিয়ে দিলেন নুপুরের দায়িত্ব যেন তারা নেন। তাদের এই সকল কথাবার্তা সবই একপাশে দাঁড়িয়ে শুনতে পাচ্ছিলো অর্ণব। ভেতরে ভেতরে তার একটা রাগ চিড়বিড় করে উঠছিলো। কতোটা অমানুষিক চিন্তা ভাবনা এই মহিলার! ঠিক কতখানি স্বার্থান্বেষী হলে মাত্র কয়েক ঘন্টার সমস্যাতেই এমন বলতে পারে! নুপুরের বাবাকে দেখেছে অর্ণব, তাদের আর্থিক অবস্থারও একটা আন্দাজ সে অনায়েসেই করতে পারে। কান খাড়া রেখে সে শুনতে চেষ্টা করলো নুপুরের মামা কি জবাব দেয়। হতাশ অর্ণব নুপুরের মামা কি বলল এটা! “আমার বোনই যেখানে নাই সেখানে আর কি থাকতে পারে!”

অর্ণব রেগে গেল প্রচণ্ড। একটা মেয়ে তার বাপের বাড়ির সম্পত্তিতেও হকদার হয় যেমনটা ছেলেরা হয় আবার মায়ের সম্পতিতেও। সে হিসেবে নুপুরও তো কিছু পায়? কে জানে হয়ত অনেক কিছুই পায়। অর্ণবের ইচ্ছে করলো এবার তাদের চেপে ধরে মুখের ওপর বলে দেয়, শালা তোদের সম্পত্তিতে আমি ইয়ে করি। আমার নুপুরের দায়িত্ব আমি নিজেই নেব।
চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৩২(শেষাংশ)

” প্রেমে পড়লেই জোর খাটাতে হবে এমন কোথাও লেখা নেই।”

-তাহলে এখন কেন খাটাচ্ছিস?

অর্ণবের কথার জবাবে অতিষ্ঠ হয়ে জিজ্ঞেস করলো রিদওয়ান। সে স্বার্থপর হয়নি একটিবারও কোন পরিস্থিতিতে অথচ প্রত্যেকেই রিদওয়ানকে ভেবে এসেছে স্বার্থপর, চতুর। কেউ বুঝতেই পারলো না এই ছেলেটা কখনোই নিজের বোনকে সাপোর্ট করেনি। সে বুঝিয়েছে বৃষ্টিকে, বুঝাবার চেষ্টা করেছে অর্ণবকে৷ স্নেহের পাত্রী নুপুরকেও একা ছাড়েনি কোন পরিস্থিতিতে। রক্তের চেয়ে আপন কি অন্য কিছু হতে পারে! রিদওয়ান জানে না সে কথা। সে রক্তের সম্পর্কের পূর্ণ মর্যাদার লক্ষ্যেই বাবাকে বলেছিলো অর্ণবের সাথে বোনের বিয়েটা না হোক। বৃষ্টিকে বলেছিলো, তোর জন্য সঠিক একজনকে খুঁজে বের করব তবুও ভুল মানুষকে বিয়েটা করিস না। বোনটাও শুনলো না। অর্ণবকে বোঝালো সময় তোর জন্য এখন ঠিক চলছে না৷ ঝোঁকের মাথায় রাজী হোস না আব্বুর প্রস্তাবে৷ তার আপন মানুষ কেউ শোনেনি তার কথা তাই বাধ্য হয়েই সে চাইছিলো বিয়েটা হচ্ছে হোক নির্বিঘ্নেই হতে পারে ওপরওয়ালার এটা সুন্দর সিদ্ধান্ত! নুপুরের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় তাইতো সে অর্ণবকে না জানিয়ে একাই ছুটোছুটি করেছে সব জায়গায়। এখন এই মুহূর্তে এসে সে অর্ণবের রোষানলে পড়েছে, শুনছে ফোনের ওপাশ থেকে বাবার তির্যক স্বরের ধমকি আর বোনের অভিশাপ। এতকিছুর পরও সে চুপচাপ ছিলো কিন্তু এখন আর থাকতে পারলো না কোনভাবেই। অর্ণব এখন যা করতে চাচ্ছে তা নেহায়াতই অন্যায় আবদার। এইতো খানিক আগে নুপুরের বাবার জ্ঞান সম্পূর্ণ চেতনায় ফিরে মেয়ের কাছে ছুটে এলেন। ডাক্তার জানালেন পেশেন্ট এখন বিপদমুক্ত তবে মানসিক ট্রমা নিয়ে এক্ষুনি কিছু বলা যাচ্ছে না। দৈহিক কিছু আঘাতের ওপর চিকিৎসা হয়েছে আর তাকে বেডে দেয়া হয়েছে। এনেস্থিসিয়ার প্রভাব থাকলেও টুকটাক কথা বলতে পারছে। পুলিশ গেল বয়ান নিলো জানা গেল অপরাধী একজন নয় ছিলো জনা তিনেক। তার মধ্যে দুজন ভাড়া করা লোক হলেও অন্যএকজন প্রধান ধর্ষক। নুপুরের একটু আধটু বয়ানে পুলিশ সরাসরি কোন একশনই নিতে পারবেন না বোঝা গেল। তবুও সে যেই ছাড়া ছাড়া ঘটনা বলল, ভাড়াটে একজনের ফোনে লাগাতার একজন ব্যক্তির কল আসতো নাম, সাখাওয়াত। তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিলো একটি শপিংমলের সামনে থেকে। কিডন্যাপ হওয়ার পূর্বমুহূর্তে একটি অচেনা নম্বর থেকে কল আসে তার হাতের ফোনটিতে যে ফোন অর্নিতার। এবং, তাকে ধরে নেয়ার পর যেখানে রাখা হয় সেখানে সেদিন রাতেই নুপুরেরই বয়সী একটি ছেলে উপস্থিত হয়। ছেলেটির নাম জানে না তবে কোথাও আগেও দেখেছে বলে মনে পড়ে। সেই ছেলেটিই তাকে দেখে প্রথমে যে বাক্যটি উচ্চারণ করে, এ কাকে ধরে এনেছিস এই মেয়ে তো সে নয়। এমনকি ছেলেটি তাকে পেয়েও দারুণ খুশি হয় যেন সে নুপুরকে নিজের জন্যই চাইছিলো। তার গায়ে প্রথম হাতও সেই ছেলেটিই দিয়েছে। টুকিটাকি কথাবার্তায় কনফার্ম হয়েই যায় তার জায়গায় কিডন্যাপ হওয়ার কথা ছিলো অর্নিতার। ভাবতেই তার শিউড়ে ওঠে। পুলিশ সব কিছুই রিদওয়ানকেও জানায় আর থানায় অর্নিতাকেও যেতে হয় নিয়ামানুসারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য৷ এসবের পরই তারা হাসপাতালে পৌঁছে দেখতে পায় নুপুরের সৎ মায়ের বাকযুদ্ধ তার বাবার সাথে। ঘটনা একেবারে সংসার বিচ্ছেদ পর্যায়ে চলে গেলে অর্ণব ধমকে উঠে মহিলাকে। উপস্থিত সকলের সামনে বলে দেয়, আজ এবং এই মুহূর্ত থেকে নুপুরের সকল দায়িত্ব আমার৷ তা শুনেই বাঁধা দেয় রিদওয়ান। সে প্রশ্ন করে বসে, যখন প্রেমে পড়লি তখন কেন এড়িয়ে চলেছিস?

-“প্রেমে পড়লেই জোর খাটাতে হবে এমন কোথাও লেখা নেই।”

-তাহলে এখন কেন খাটাচ্ছিস

-জরুরি বলে।

অর্ণবের চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করলো, আমি যাকে জোর না খাঁটিয়ে ছেড়ে এসেছিলাম সে ছিলো অস্পর্শী, সমাজের চোখে পুতঃপবিত্র। তাকে আমি ছাড়লেও ভালোবেসে তার হাত ধরার জন্য কেউ থাকতো। বিনা বাক্যে সে নিজেই নিজেকে গুছিয়ে নিতো কিন্তু এই যাকে একটু আগেই সে দরজার আড়াল থেকে দেখে এলো ওই মেয়েটি ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সমাজের চোখে তার গায়ে লেগে আছে অপবিত্র কিছু ছোঁয়া যা সমাজ নামের এক জগৎ তাকে কথাবার্তায় দেবে অচ্ছুৎ হওয়ার অপবাদ। ওই মেয়েটাকে সে একা ছাড়বে কেমন করে? কিন্তু না মুখে বলতে পারলো না কিছুই। শুধু বলল, “তখন জরুরি ছিলো না।”

-এখন নুপুরের ওপর অধিকার খাটানো জরুরি?

-হ্যাঁ।

-আর বৃষ্টি!

এবার যেন টনক নড়লো অর্ণবের। দিন ফুরিয়ে রাত নেমেছে এ ধরায়। সেই দুপুরে সে বেরিয়েছে ও বাড়ি থেকে আর এখন মনে পড়লো সে কথা! বৃষ্টির সাথে তো আজ তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। আচমকা দু হাতে মাথা চেপে ধরে বসে পড়লো ফ্লোরে৷ রিদওয়ান দেখলো সে দৃশ্য তবুও নড়লো না জায়গা থেকে। অর্নিতাকে থানা থেকে ফিরে সোজা বাড়িতে পাঠিয়েছিলো রিদওয়ান সে দেখতে পেলো করিডর ধরে দ্রুত পায়ে এদিকেই ছুটে আসছে সে। পেছনে পেছনে আরও দেখতে পেলো বৃষ্টি আর রিমনও আছে। দৃশ্যপট বদলে গেল পলকের মধ্যেই। সেজেগুজে থাকা বিয়ের কনে এসে দাঁড়িয়ে আছে হাসপাতালের করিডোরে তারই ঠিক পায়ের কাছে বসে আছে পূর্ণ বয়স্ক যুবক। একটি বিয়ের লগ্নে অর্ধবিবাহিত কনেকে যখন শুনতে হয় তার বরকে পাওয়া যাচ্ছে না তখন তার ভেতরে কি চলে! ভালোবাসার মানুষের ধর্ষণের সংবাদ শোনা ব্যক্তির কি এই অনুভূতি বোঝার ক্ষমতা থাকতে পারে না বলেই ধরা যায়। অর্ণবেরও ছিলো না তখন অথচ এখন ঠিক সে উপলব্ধি ফিরে এসেছে তার। কিন্তু….. এখানেই কথা থাকছে। সে বৃষ্টির অপরাধী তার পক্ষ থেকে পাওয়া শাস্তি এখন মাথা পেতে নিতে চাইছে সেই সাথে সে এও পরিষ্কার করেছে নুপুরকে সে ছাড়ছে না। এ দুইয়ের মাঝেই সে এখন অনড়, অটল, অবিচল এক পাথর হয়ে বসে আছে। তাচ্ছিল্য হেসে বৃষ্টিও তাল মিলিয়ে এবার জবাব দিলো, ওই মেয়েটাকে ছাড়তে পারবে না ঠিক আছে তাকে ধরে রাখো কিন্তু আমাকেও বিয়ে করতে হবে এটাই তোমার শাস্তি।

হাসপাতালের সরু করিডোরটাকে রিদওয়ানের মনে হলো এটা একটা নাট্যমঞ্চ, অর্ণব আর বৃষ্টি সেখানে চমৎকার দুই অভিনয়শিল্পী। ক্ষণকাল সে নিশ্চুপ সবটা অবলোকন করে আর স্থির থাকতে পারলো না। দু হাতে টেনে বোনকে সরিয়ে নিতে চাইলো। বৃষ্টি ভাইকে মেনে চলার পাত্রী নয় সে আবারও বলে উঠলো, যদি আমার কথা মানতে পারো তবে এক্ষুনি এই মুহূর্তে আমি নিজেই তোমার ওই মেয়েকে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিব।

-দ্যাখ বৃষ্টি পাগলামি করিস না।

রিদওয়ান বোনকে সতর্ক করতে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল। তার কথায় কেউ পাত্তা দিলো বলে মনেই হলো না। অর্ণব সায় জানিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। নুপুরের বাবা মেয়ের কেবিনে বসে আছেন মেয়ের মাথার কাছে। তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না এই মাত্র এখানটিতে তাঁর মেয়ের ভবিষ্যত সহসঙ্গী নির্ধারণ হয়ে গেল তারই অজানিতে।
____________

“আজ থেকে আমার জন্য রিদওয়ান মৃত। তার সাথে এ বাড়ির কারো কোন সম্পর্ক থাকবে না সেই সাথে চৌধুরী পরিবারের ওই কালসাপ দুটোর সাথেও নয়।”

অসুস্থ শরীরেই চেঁচিয়ে স্ত্রীকে শুনিয়ে কথাগুলো বললেন বাশার শেখ। রিমনও পাশের ঘর থেকে শুনেছে কথাটা তাই দু পা এগিয়ে সেও চেঁচিয়ে বলল, আর বৃষ্টির সাথে?

-আমার মেয়ের কথা তুলছো কেন সে কোন অন্যায় করেনি। তার জন্য এ বাড়ির দরজা সবসময়ই খোলা এমনকি ওই হতচ্ছাড়ার ভাগের সকল বিষয়াদিও আমি আমার মেয়েকে দেব।

রিমনের ভেতরে ভেতরে কিছুটা রাগ ছিলো বাবার ওপর সেটা জাহির করতে না পেরে বৃষ্টিকে নিয়েই কিছুটা উষ্কে দিতে চাইলো। একটু আগেই বৃষ্টি নিজে ফোন করে বাবাকে জানিয়েছে অর্ণব বিয়ে করছে তার প্রেমিকাকে কিন্তু তাকেও বিয়ে করবে। বাশার শেখ প্রথমে এ নিয়ে রেগে গেলেও মেয়ের কুমিরের কান্না আর জেদের কাছে মিইয়ে গেছেন। রিদওয়ানের মত রিমনও উদ্বিগ্ন তবে সে উপস্থিত সদ্বুদ্ধি মাথায় রেখে চলে বলেই বাবাকে সরাসরি কখনো চটায় না। আবেগ প্রকাশেও সে শতবার চিন্তা করে তবেই আগায় ঠিক সে কারণেই এই মুহূর্তে রিদওয়ান বাবার চোখে যতোটা অযোগ্য রিমন ঠিক ততোটাই যোগ্য। সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে আজকের এই পরিস্থিতির পেছনে দায়ী একমাত্র তার বাবা আর বোন। যে মানুষটার আগে থেকেই একজন মনের মানুষ আছে যেচে কেন সে মানুষটার জীবনে তৃতীয় ব্যক্তি হতে হবে! নিজের প্রেমকে এতোটা হীন করার মত মন মানসিকতা কি সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষগুলোর থাকে? রিমন আজকের পর হয়তো আর বোনের ব্যাপারে কোন প্রয়োজনেও নাক গলাবে না বলে ভেবে নিলো।
_______

রাত এগারোটা ; থমথমে মুখে নাজিম সাহেব বসে আছেন মেয়ের মাথার কাছে তাঁর হাত দু হাতে চেপে ধরে আছে অর্ণব। বসে আছেন একজন কাজী সাহেব আর অর্ণব, নুপুরের কাছের কিছু মানুষ। অপেক্ষা একটি সম্মতির। ঘন্টা খানেক আগেই বৃষ্টির শর্ত মেনে অর্ণব বিয়ের জন্য রাজী। নুপুরের বাবাকে সরাসরি প্রস্তাব রাখতে চাইলে হঠাৎই তাকে আটকে দেয় নুপুরের ছোট মা৷ তিনি হঠাৎই নুপুরের খুব সজ্জন মানুষ হয়ে আকুতির স্বরে বলে উঠে, তুমি নুপুরের কত আপনজন তা আমি বুঝতে পারছি বাবা৷ তুমি তো মানুষ না একে্কেবারে ফেরেশতা তা না হইলে কেউ এত কিছু হওয়ার পর আমাগো মাইয়াডারে আপন করতো না৷ কিন্তু বাবা তোমার তো অর্ধেক বিয়া হইয়া গেছে এই কথা নুপুরের আব্বা জানলে তোমার হাতে মাইয়ার দায়িত্ব দিব না।

অর্ণব সেদিকে কান না দিয়ে চলে যাচ্ছিলো নুপুরের কাছে। মহিলা তাকে আটকে দিয়ে বোঝাতে লাগলেন, নুপুরের জন্য অর্ণবই যোগ্য কিন্তু তার জন্য আগে তো নুপুরের বাবার রাজী হওয়া লাগবে। আর বাপ রাজী না হলে নুপুর যে স্বজ্ঞানে কেন অজ্ঞানে অর্ণবকে বিয়ের জন্য রাজী হবে না এ অবস্থা কেন সে মৃত্যু পথযাত্রী হলেও হবে না। অর্ণব আর মহিলার কথার সময় বৃষ্টি আর রিদওয়ান পাশে ছিলো না, ছিলো না অর্নিতাও। সেই সুযোগটাকেই মহিলা চমৎকারভাবে কাজে লাগিয়ে অর্ণবকে বোঝালো নুপুরের ভালো করতে চাও তো একটু মিথ্যে বলো। বৃষ্টিকে বিয়েটা করবে বলে যে সম্মত হয়েছে সে কথা অজানা থাক নুপুরের বাবার। এতে করে তাদের কালো, ধর্ষিতা মেয়েটার জীবন বেঁচে যাবে। অর্ণব হয়তো বুঝতে পারলো একটা অন্যায় লুকানোর ছলে তাকে আরও দশটা করতে হবে তবুও ভালোবাসার কাঙাল ভালোবাসাকে পাওয়ার লোভ আর সংবরণ করতে পারলো না। সে মেনে নিলো সব কথা যা নুপুরের সৎ মা ঢেলে দিলো তার কর্ণকুহরে। মহিলা নিজে নুপুরের বাবাকে বললেন মেয়েটাকে এ অবস্থাতেও যে ছেলে চাইতে পারে তাকে পায়ে ঠেলে দেয়া অন্যায়৷ অনেক বুঝিয়ে লাভ হলো এবং সত্যিই নুপুরের মামাকে ফোন করে বলা হলো কাজী নিয়ে আসতে। ততক্ষণে বৃষ্টি আর রিদওয়ানের মাঝে হাসপাতালেই হয়ে গেল এক বাকযুদ্ধ। এরপর কাজী এলে বৃষ্টি নিজেই অর্ণবের স্বাক্ষী হতে এলো। নুপুরের জ্ঞান ফিরেছে সম্পূর্ণ চেতনায় ফিরে মাথার কাছে সকলকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়। পরক্ষণেই থমকে যায় অর্ণবকে দেখে। চমৎকার সাজপোশাকে দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা চোখ দুটিতে রক্ত জমাট বাঁধা। উনি কি কেঁদেছিলেন! বুকের ভেতরটা কেমন হাহাকার করে উঠলো নুপুরের৷ মনে পড়ে গেল গত দুদিনে তার সাথে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর সেই মুহূর্ত। চোখের পলক ফেলে ভুলতে চাইলো সেই হিংস্র স্পর্শগুলো যা দেহের উপরিভাগ থেকে ভেতর অব্দি তার খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে দিয়েছে৷ তারপর আবারও চোখ খুলে সে বাবাকে খুঁজতেই দেখতে পেল অর্নিতার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টি। তার সাজানো মুখটা মনে করিয়ে দিলো আজ তো তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। আবারও তাকালো জল্লাদমুখো মানুষটার দিকে। তবে কি তার খবর জানতে পেয়েই তারা স্বামী স্ত্রীতে তাকে দেখতে এসেছে! নিশ্চয়ই মনে মনে বলছে, আহারে মেয়েটা! অন্তর ছাপিয়ে চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইলো নুপুরের। নাহ, ওই মানুষটার মায়া, করুণা, স্নেহ কিছুই চায় না সে৷ চলে যাক অর্ণব, চলে যাক দূরে বহুদূরে। কিন্তু কই, একটি আওয়াজও তো কণ্ঠধ্বনি ভেদ করে উচ্চারিত হলো না। ঠিক সেই মুহূর্তেই বাবা বললেন, অর্ণব তোকে বিয়ে করতে চায় মা এক্ষুনি। তুই কি রাজী?

-নাহ

কম্পিত ক্ষীণ স্বরে তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো নুপুর। অবাক হলো না উপস্থিত একটি মানুষও৷ অর্ণব এবার নিজেই প্রস্তাব রাখলো, “আমি তোমার আজীবনের দায়িত্ব গ্রহণ করতে চাই আমাকে তোমার অর্ধাঙ্গের জায়গাটা দেবে নুপুর?”

করুণ আর্তরব ছড়িয়ে গেল নুপুরের কানে তবুও সে স্পষ্ট জবাব দিলো, “না”
অর্ণব আবারও প্রশ্ন করলো, বারংবার করলো। এক পর্যায়ে বুঝতে পারলো ওই মেয়েটি নিজেকে আর কিছুতেই তার যোগ্য মনে করছে না বলে এমন জবাব দিচ্ছে ঠিক তখনই অর্ণব নুপুরের বাবার হাত চেপে ধরলো। সপ্রতিভ কণ্ঠে সে এবার সরাসরি নুপুরের বাবাকেই বলল, আঙ্কেল আমি ধর্মমতে বিয়েশাদি সম্পর্কে খুব একটা জানি না তবুও যতটুকু আমার জানা বাবার জীবদ্দশায় একটা মেয়ের বিয়ের জন্য তার বাবার সম্মতি প্রাধান্য পায় প্রথমে। ঠিক সেদিক থেকেই আমি আপনার মতামত চেয়ে প্রস্তাব রাখছি, আমি আপনার একমাত্র মেয়েটিকে বিয়ে করতে চাই। আপনি কি তার অনুমতি দেবেন? কথা দিচ্ছি আজকের পর থেকে তার সকল সুখ দুঃখের প্রতিটি সেকেন্ডের দায়ভার আমার থাকবে।”

নুপুরের বাবা মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন নীরবে। নুপুর তখনও বলে যাচ্ছে, এ বিয়ে হবে না আমি রাজী নই৷ নাজিম সাহেব কান্নারত অবস্থায় মেয়ের আঁচর খাওয়া মুখটাতে চেয়ে এবার সল্প আওয়াজে জবাব দিলেন, “আমি রাজী৷ আমি আমার মেয়ের সারাজীবনের দায়িত্ব তোমায় দিলাম।আমার মেয়ের আজকের পর কোন প্রকার কষ্টের কারণ তুমি হলে ওপরওয়ালার কাছে বাঁধা থাকবে মনে রেখো।”

এরপর আর জেদ খাটেনি নুপুরের। জোরজবরদস্তিই অর্ণব নুপুরকে দিয়ে সাইন করিয়েছে রেজিস্ট্রি পেপারে। কবুল বলা নিয়ে অবশ্য নাটকীয়ভাবে সময় পেরিয়েছে অনেকটা তবুও হাল ছাড়েনি অর্ণব। পুরো সময়টা জুড়ে বৃষ্টি আড়ালে দাঁড়িয়ে ফেলেছে অশ্রুজল। সে বুঝতে পেরেছে অর্ণবের জীবনে নুপুর কি! সে জেনেছে ভালোবাসা একতরফা কতোটা বিষাক্ত আর দু তরফা ঠিক কতোটা মধুর। দু তরফে ভালোবাসা থাকলে যন্ত্রণাও যে হার মেনে যায় তা সে বুঝে গেছে তবুও লোভী মন অর্ণবকে ছাড়তে চায় না৷ রিদওয়ান শেষ পর্যন্ত বোনের হাত চেপে ধরে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিলো। বুঝিয়ে দিলো শত অন্যায়ের পরও বৃষ্টি তার বোন ঠিক কতোটা আদরের কতোটা ভালোবাসার তার কাছে। অথচ সে জানতেই পারলো না অপরদিকে সে পরিবার থেকে হয়ে গেল কতকটা দূর। বুঝতেই পারলো না এক জীবনে তার জন্য কত বেশি অবহেলা ছিলো আরও কতোটা বাকি রয়ে গেল।

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-৩১

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৩১

কোন সুগন্ধি পবিত্র, আতর নাকি আগরবাতির! আতর গায়ে মেখে নিজেকে পবিত্র পবিত্র অনুভব করা যায় কি! কিন্তু মৃত দেহকে শেষ সজ্জায় আতর লাগায় নাকি আগরবাতি জ্বালিয়ে দেয় মাথার কাছে? অর্ণব খুব দ্বিধায় জড়িয়ে আজব এক কাজ করেছিল বিয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে। কোথা থেকে আগরবাতি বের করে জ্বালিয়ে দিলো তার শোবার ঘরটাতে। সাদা শার্টটা গায়ে দিয়ে একটা আগরবাতি নিজের সারা গায়ের আশপাশটা ঘুরিয়ে নিলো। বৃষ্টিদের বাড়ি থেকে চমৎকার শেরওয়ানি, পাগড়ি আর রোলেক্সের ঘড়ি এসেছে কাল। খালুজান নিশ্চয়ই নিজের দাপট প্রকাশের জন্যই বেছে বেছে ব্রান্ডেড কালেকশনগুলো পাঠিয়েছে। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে সে আলমারি থেকে বের করেছিলো মনোহারিণীর দেয়া সেই সস্তার ব্রেসলেটটা। খুব যত্ন করে হাতে পরে নিলো সেটা। ঘর থেকে বেরিয়ে অর্নিকে ডেকে বলল, বাসর সাজাবি বলে কি কোন প্ল্যান করেছিস? তার প্রশ্নে বিষ্ময়ে তাকিয়ে ছিল অর্নি কিছুক্ষণ। অর্ণব নিজেই আবার বলল, ওসব তোকে করতে হবে না বাড়ি ফিরে আমি নিজেই সব করব।

মুখে এমনটা বললেও সে যেন ভরসা রাখতে পারলো না কারো ওপর তাই বাড়ি থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে নিজের ঘরটা এই প্রথমবার লক করে বের হলো। তারা যখন বৃষ্টিদের বাড়ি পৌছুলো অর্নি তখন নিজের জোর জুলুম করে নিজের কান্না আটকে রেখেছিল। বাশার শেখ অর্ণবকে দেখে অপ্রসন্ন ভাব নিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন৷ এর মূল কারণ অবশ্য অর্ণবের গায়ের পরিচ্ছদ। শেরওয়ানি গায়ে বর বেশে উপস্থিত না হয়ে বরং সাধারণ মেহমান সেজে আসাটা একদমই পছন্দ হয়নি উনার তবুও মুখে কিছু বলেননি। মনে মনে হাসছেন এই ভেবে, এখনই ভাব দেখাও ছোড়া এরপর তোমার কলকব্জা সব নড়বে আমার ইশারাতেই।
_______

আজান হয়েছে অনেকক্ষণ হলো। জুমার নামাজটা আদায় করা দরকার এদিকে নুপুরের বাবার অবস্থাও খুব একটা ভালো মনে হচ্ছে না। ঘুমের ইনজেকশানের প্রভাবে অচেতন আছেন, স্যালাইন চলছে। নুপুরের সৎ মা ছেলেসহ একটু আগে হাসপাতালে পৌঁছুতেই নুপুরের আপন মামা চলে গেল এখান থেকে। রিদওয়ানও ভাবছে এই মহিলাকে একা ছেড়ে গেলে তিনি সব সামলাতে পারবেন তো! বাধ্য হয়েই হাসপাতালের মসজিদ ঘরে নামাজ আদায় করে এলো। নামাজের পর সে অর্নিকে কল দেবে বল ফোনটা হাতে নিতেই মনে পড়লো মোবাইলটা নুপুরের কাছে ছিল যা গত দু দিন একভাগ বাজলেও ওপাশ থেকে রিসিভ হয়নি৷ নিজেই অনেকরকম হিসেব কষেছে রিদওয়ান এই একটা ব্যাপার নিয়ে, নুপুর যদি কিডন্যাপ হয় তবে কিডন্যাপাররা ফোনটার কিছু একটা করে ফেলতো৷ আর যদি আল্লাহ করুন, নুপুর সুইসাইডাল কোন কিছু করে ফোনটাকে কোথাও ফেলে দেয় তবুও কেউ কি দু দিনে পেতো না সেটা? এমন আরও অনেক যুক্তি সাজিয়ে ভাবলেও কোন উত্তর মিলাতে পারেনি৷ বরং পুলিশ জানিয়েছে ফোনটার লোকেশন একবার কুমিল্লা আরেকবার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার দিকে পাওয়া গেছে৷ আজ সকালে আবার লোকেশন মিলল নারায়ণগঞ্জ বন্দর এলাকায়৷ কৌতূহল নিয়ে আবারও কল করলো রিদওয়ান সে নম্বরে আর বরাবরের মতোই হতাশ হলো। আবার এসে বসলো নুপুরের বাবার কেবিনে। মহিলার দিকে একপলক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনার কোন কাছের আত্মীয়স্বজন আছে যাকে আপনাদের সাথে রাখা যাবে!

ভদ্রমহিলা বোধহয় বুঝলেন না রিদওয়ানের কথা কেমন আজব দৃষ্টিতে তাকালেন।

– আমার বোনের বিয়ে আজ; একটু বাড়িতে যাওয়া দরকার। আমি ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে ফিরে আসব ততক্ষণ এখানে আপনাদের কাছে কাউকে ডেকে নিলে বোধহয় ভাল হয়।

রিদওয়ানের কথা শেষ হতেই মহিলা জানালেন তার এক ভাই আসবে হয়ত পথে দেরি হচ্ছে। রিদওয়ান আশ্বস্ত হয়ে হসপিটাল থেকে বের হয়েও আবার ফিরে এলো খাবার নিয়ে। দুপুরের মুহুর্ত পেটে খিদে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক৷ সে নিজেও ক্ষুধার্ত তাই তিনজনের জন্য খাবার নিয়ে এলো। তাদের সাথে বসেই খাবার খেয়ে বের হলো রিদওয়ান। জীবন কতোটা ভয়ংকর আজ সে যেন প্রতি সেকেন্ডে টের পাচ্ছে। মাথার ভেতর সুক্ষ্ম এক যন্ত্রণা শুঁয়োপোকার মত কিটকিট করে কামড়ে যাচ্ছে অনবরত। আচ্ছা সেদিন অর্নিতার যদি শিবলী ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়ে যেত তবে কি সে মরে যেত! মানুষ আপনজনের মৃত্যুর শোক সহজেই কাটিয়ে নিতে কিন্তু বিচ্ছেদের নয়৷ অর্নিতার শুধুমাত্র এনগেজমেন্টের কারণেই রিদওয়ান অর্ধমৃত জীবন কাটাচ্ছিলো আর আজ অর্ণব নুপুরকে ছেড়ে বৃষ্টিকে বিয়ে করছে তার কেমন লাগছে? অর্ণব তো ভালোবেসে নুপুরের ভালোবাসা দেখে কিন্তু নুপুর তো ভালোবেসেছে আগে৷ তার যন্ত্রণা লাগব হওয়ার মত নয় তাই বোধহয় মেয়েটা হারিয়ে গেছে মহাকালের অতল গহ্বরে নইলে এখনো কেন খোঁজ মিলছে না তার! পুরুষ মানুষ কাঁদে না বলেই অর্ণবের অশ্রু অদৃশ্য অথচ রিদওয়ানের এখন কাঁদতে ইচ্ছে করছে হাত পা ছড়িয়ে। একদিকে তার আদরের বোন, একদিকে বন্ধুর মত ভাই অন্যদিকে ওই অসহায় মেয়েটা যার জন্য অসীম স্নেহ আছে রিদওয়ানের অন্তরে৷ সে একটা সিএনজি নিয়ে চলে এলো বাড়িতে। বাড়ির সদর দরজা থেকেই কেউ না কেউ চেপে ধরছে, কোথায় ছিল সে দু দিন ধরে। শ্বশুরবাড়ি থাকলেও যথাসময়ে কেন আসেনি তার বউ আর সমুন্ধি সাহেব তো সেই কখন বরযাত্রী হয়ে পৌঁছে গেছে। কারোই কথার জবাব না দিয়ে সে বড় আলগোছে ঢুকে গেছে নিজের ঘরে। কারও কাছে শুনতে পেয়ে অর্নিতা এসে ঢুকেছে ঘরে। মেয়েটা কয়েক সেকেন্ড মাত্র তাকিয়ে থেকে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো রিদওয়ানের বুকে। কান্নারা বাঁধ ভাঙলো অচিরেই সেই সাথে চলল রিদওয়ানের ভারী নিঃশ্বাস। মিনিট খানেক কান্না চলার পরই রিদওয়ানের মনে হলো ঘরের দরজাটা খোলা। কান্নার শব্দ বাইরে কারো কানে গেলে হুড়মুড় করে সব এসে জড়ো হবে। এক হাতে অর্নিকে বুক থেকে সরিয়ে আগে গেল দরজা বন্ধ করতে। দরজা লাগিয়ে অর্নিকে নিয়ে বসলো বিছানায়।

-আমাদের সময় খুব খারাপ যাচ্ছে অর্নি তাই বলে ভেঙে পড়লে চলবে না। বৃষ্টি, অর্ণব, নুপুর তিনজনই আমাদের আপন খুব আপন। আমরা চাই তিন জনই খুব ভালো থাকুক কিন্তু পরিস্থিতি ভালো না আমাদের তাই না! তুই নিজেকে সামলাতে না পারলে অর্ণবকে কে সামলাবে বল তো?

রিদওয়ানের কথা শুনেই মাথা তুলে তাকালো অর্নি। সে বুঝতে পারলো না ভাইয়াকে সামলানোর কথা কেন আসছে? রিদওয়ান বোঝানোর জন্য আবার বলল, “আজ দু দিন পেরিয়ে তিন দিন চলছে। একটা মানুষ নিজে থেকে না হারালে কি এতোটা গায়েব থাকতে পারে! যদি কিডন্যাপ হতো তবে তার বাবার কাছে নিশ্চিয়ই কল আসতো। যদি রেপড অর সামথিং….. বলতে গিয়ে থেমে গেল রিদওয়ান।

” বুঝতেই পারছিস তেমন কিছু হলে নিশ্চয়ই মৃত অথবা জীবিত কোন অবস্থাতে পাওয়া যেত।”

অর্নিতার কান্নার হিড়িক বাড়লো এবার। বাইরে থেকে শোরগোল শোনা যাচ্ছে। সম্ভবত কাজী সাহেব এসে গেছেন। অর্নিতাকে অনেক বুঝিয়ে বাথরুমে নিয়ে নিজেই মুখ হাত ধোয়ালো সে। ভালো করে ফোলা চোখ, মুখ মুছে বের হয়ে গেল সে ঘর থেকে। রিদওয়ান পকেট থেকে ফোনটা বের করে খাটের ওপর ফেলল। শার্ট প্যান্ট বদলে বাথরুমে ঢুকে গেল গোসলের জন্য। লম্বা একটা গোসল দরকার মন-মস্তিষ্ক দুয়েরই শীতলার জন্য। কাজী সাহেব প্রথমেই গেলেন কনের স্টেজে। বিয়ে পড়ানো শুরু হয়ে গেছে শুনতে পেলো অর্ণব। সে বসেছে নিচতলার বসার ঘরে। ছাদে বরের জন্য স্টেজ করা হলেও সে একটিবারও যায়নি সেখানে। এখন আশপাশে তাকিয়ে রিদওয়ানকে খুঁজতে লাগলো।

_______

বাড়ির একমাত্র মেয়ে আর নিজের একটিমাত্র বোনের বিয়ে। বড় ভাই লাপাত্তা, বাবা বিশেষ রকম ব্যস্ত তাঁর ব্যবসায় সম্পৃক্ত গণ্যমান্যদের আপ্যায়নে। তাই বাধ্য হয়েই বিয়ের গোটা আয়োজনটাকে এক হাতে সামলাচ্ছে রিমন। অমতের এই আয়োজনে সে নিজের প্রেয়সীনিকেও আমন্ত্রণ করেনি। তবুও গতকাল থেকে একটা বিচ্ছিরি অনিভূতি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে তাকে। ময়না খালামনি এসেছেন তার সন্তানদের নিয়ে। ওনার মেয়েটা এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে বয়স কত হবে! পনেরো,ষোলো? এমনই হবে হয়ত রিমনের মনে নেই। বলা যায়, খালামনির সাথে সম্পর্ক আলগা করায় তার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তানদের নিয়ে তেমন মাথাও ঘামায়নি৷ অর্ণব ভাই আর অর্নিতাই তাদের প্রিয়’র তালিকায় সমাদৃত। কিন্তু কাল থেকে ময়না খালামনির সেই পনেরো কি ষোড়শী পুঁচকে মেয়েটা তার নাকে দম করে রেখেছে। সন্ধ্যায় হলুদের জন্য সেজেগুজে এসেই তার সামনে দাঁড়ালো, “রিমন ভাইয়া আপনি কি রঙের পাঞ্জাবী পরবেন?”

দু হাতে গোলাপের এক ডালি চেপে মাথায় তুলছিলো রিমন৷ নিচতলা থেকে ছাদে উঠতে হবে এসব নিয়ে। কাজের লোকগুলো একেকটা যাচ্ছেতাই, সেজন্য নিজেরই দেখেশুনে করতে হচ্ছে সব। এরই মাঝে খালামনির মেয়ে তামিমা এসে এমন প্রশ্ন করায় মেজাজ চড়লো। সে জবাব না দিয়ে চলে যাচ্ছিলো তখনি মেয়েটি আবারও প্রশ্ন করল।

– তা দিয়ে তোর… তোমার কি কাজ?
মেয়েটিকে তুই বলতে একটু আজব লাগল। জীবনে এই বোধহয় প্রথমবার তারা পরিচিতের মত এক বাড়িতে তাই সম্মোধন বদলে নিলো। মেয়েটি নিজের হলুদ আর গোলাপির কম্বিনেশনের ঘাগড়াটার দিকে তাকিয়ে বলল, “হলুদ পাঞ্জাবী অথবা পিংকিশ পরবেন কেমন!”

– পাঞ্জাবীই পরব না।

বিরক্তির সাথে কথাটা বলেই রিমন সিঁড়ির দিকে এগোলো। মেয়েটি আবার বলল, “আচ্ছা তবে কি টি শার্টেই থাকবেন?”

-আমি টি শার্ট পরি আর উদোম থাকি তাতে তোমার কি?

-বাড়ি ভর্তি অত মানুষের সামনে উদোম!

চোখ দুটি গোল গোল করে তাকায় তামিমা পরমুহূর্তেই চোখ বুঁজে নেয় যেন সে এখনই উদোম, উলঙ্গ দেখে ফেলেছে রিমনকে।

– আচ্ছা, একটা হলুদ টি শার্ট পরবেন প্লিজ। আমি ফটো তুলব আপনার সাথে।”

-কেন! নিজের ভাইবোনের মত কি এখন তোমারও এ বাড়িতে বিয়ে করার শখ জাগছে? পুঁচকে একটা মেয়ে নির্লজ্জের মত যখন তখন পিছু লাগছো কেন, দূর হও সামনে থেকে।

এই ছিল রিমনের কালকের সমাচার কিন্তু আজও মেয়েটা ওভাবেই পেছনে লেগে আছে। ভরা মজলিশে প্রত্যেকেই ব্যস্ত কোন না কোনভাবে আর এই মেয়ে করছে বাদড়ামি। কখনো তাকে ফোকাস করে নিজেরই ছবি তুলছে কখনো গোলাপ হাতে এসে বলছে খোঁপায় ফুলটা গুঁজে দিন তো! মাত্রাতিরিক্ত মেজাজ খারাপ হয়ে গেল এবার রিমনের। চারপাশে উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে বুঝলো মেহমানরা কিছু একটা ভেবে নিচ্ছে তাদের সম্পর্কে। রাগে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, সামনে থেকে যাও নইলে কপালে শনি আছে মনে রেখো।

মেয়েটি শোনেনি সে কথা রিমনের পিছন পিছনই ঘুরছিলো। এক পর্যায়ে মেয়েটির হাত টেনে ধরে নিয়ে গেল মায়ের ঘরে। সেখানেহ বসা ছিলো মা আর ছোট খালামনি৷ মেজো খালামনি অবশ্য বিয়ের দাওয়াতটাই গ্রহণ করেননি তাই মায়ের ঘরে এক মেজো খালা ছাড়া তাদের সকল ভাইবোনই উপস্থিত ছিলেন৷ তামিমার হাতে ধরে রিমনকে আসতে দেখে প্রত্যেকেই অবাক হলো। সবাইকে অবাকের শেষ সীমায় পৌছে দিয়ে রিমন এবার ময়নাকে উদ্দেশ্য করে বলে বসলো, ” চার সন্তানের মাঝে মাত্র দুটিকে লালন-পালন করে বড় করেছেন তাও সঠিক শিক্ষাটা দিতে পারেননি খালামনি। এর চেয়েও ভালো শিক্ষায় শিক্ষিত তো আপনার বাপ-মা ছাড়া সন্তান দুটিই হয়েছে। কতোটা নির্লজ্জ হলে একটা মেয়ে নিষেধ করা সত্ত্বেও বয়সে অনেক সিনিয়র একজনের পিছু লেগে থাকে তাও আবার এমন ভরা মজলিশে! সহজ বাংলা কি এর মাথায় ঢোকে না?”

প্রতিটি শব্দে অপমান, প্রতি অক্ষরেই যেন ক্ষোভ আর ধিক্কার মিশিয়ে দিয়েছে রিমন৷ এক ঘর ভর্তি আপনজনের মাঝে বয়সে বড় একজনকে এমন আচরণ দেয়াটাও অভদ্রতা বলেই মানে রিমন তবুও কেমন যেন মেজাজ হারিয়ে বলে বসলো এসব কথা। রায়না বাক্যহারা হয়ে গেলেন নিজের ছেলের এই কথাগুলো শুনে। কিন্তু তাকে ঠিক কি বলা যায় এখন কারোই যেন বোধগম্য হচ্ছিলো না। তখনই আবার শোনা গেল বাইরে সবাই বলাবলি করছে, কাজী এসে গেছে মুরব্বিরা সবাই কোথায়?

__________

হাঁসফাঁস লাগছে ভেতরে ভেতরে। জীবনে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে সে শুধুই ব্যবসার জন্য কাজ করে গেছে অথচ এখন মনে হচ্ছে তার এই প্রস্তুতিগুলো ঠিক আজকেই নেয়া দরকার ছিল। এই মুহূর্তে তার সবচেয়ে আপন কাউকে পাশে পেতে ইচ্ছে করছে। এই পার্থিব জগতে সবচেয়ে আপন কে হয়? মা! হ্যাঁ পুরো পৃথিবীতে সে আর তার বোন ছাড়া বাকি প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে বোধহয় মা মানুষটিই আপন হয়। বিয়ে পড়ানো বোধহয় শুরু হয়ে গেছে অর্নিতা কই? হঠাৎই অর্ণবের মনে হল তার এলোমেলো মস্তিষ্ককে একটু শান্তি দিতে একমাত্র আপন বোনটিকেই এখন কাছে দরকার। অর্ণবের আশপাশে এখন খুব বেশি মানুষ নেই। সকলেই গেছে কনের কাছে তাই অর্ণব যারা পাশে আছে তাদের না বলে নিজেই উঠলো অর্নিকে খুঁজতে। পেছন থেকে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করল কোথায় যাচ্ছে? সে জবাবে বলল, আসছি।

দোতলায় উঠে অর্ণব প্রথমেই গেল রিদওয়ানের ঘরে৷ দরজাটা ভেজিয়ে রাখা পর্দা সরানো। অর্ণব একবার ডাকলো অর্নি!

রিদওয়ান বাথরুম থেকেই ক্ষীণ আওয়াজ পেলো অর্নিকে কেউ ডাকছে। সে চেঁচিয়ে জবাব দিলো, অর্নি ঘরে নেই।
অর্ণব ঢুকলো সে ঘরে৷ এবার রিদওয়ানকে ডাকল, “গোসল করছিস?”

“হ্যাঁ” ওপাশ থেকে জবাব এলো৷

-কতক্ষণে বের হবি?

-মিনিট দশেক। তুই এখানে কেন?

-অর্নিকে খুঁজছি।

-ও নিচে গেছে হয়ত…. তুই যা নিচে আমি আসছি ওকেও বের করছি।

-আচ্ছা! কথাটা বলেই অর্ণব চলে যেতে পা বাড়ালো। রিদওয়ানের ফোনটা বেজে উঠল ঠিক তখনই তারস্বরে। অর্ণব ফিরে তাকালো সেদিকে। স্ক্রীণে জ্বলজ্বল করছে অর্নি নামটা। রিদওয়ানের কানেও পৌঁছেছে ফোনের টোন। সে তটস্থ হলো কে কল করলো, থানা থেকে নাতো! ওহ গড, অর্ণব আছে নাকি ঘরে? সে দ্রুত শাওয়ার অফ করে তোয়ালে হাতে বাথরুম থেকে বের হতে চাইলো ততক্ষণে কলটা রিসিভ হয়ে গেছে।

-হ্যালো অর্নি কই তুই?

ওপাশ থেকে ভেসে এলো ভারী এক পুরুষ স্বর, ব্যাড নিউজ রিদওয়ান সাহেব। এক্সট্রেমলি ব্যাড দিজ নিউজ…
অর্ণব চমকানো স্বরে বলল, “কে বলছেন?”

“আমি ইন্সপেক্টর শরাফত বলছি আপনি রিদওয়ান শেখ না?”

-আমি তার কাজিন।

-ফোন দে অর্ণব।

রিদওয়ান ফোনটা অর্ণবের হাত থেকে নেয়ার জন্য হাত বাড়ালে অর্ণব পিছিয়ে গেল। সে নিজেই আবার পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করলো, ” ঘটনা কি অফিসার?”

-রিদওয়ান সাহেবকে দেয়া যাবে?

-আমাকে বলুন সে বাথরুমে আছে।

“ফোন দে অর্ণব”

অর্ণব আরেকটু পিছিয়ে পুলিশকে আবারও প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, “উনাকে বলুন নারায়ণগঞ্জে নুপুরকে পাওয়া গেছে তবে আমাদের ধারণা ঠিক, ইট ওয়াজ আ রেপ কেস। আপনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসুন। আমরা ভিকটিমকে সেখানেই নিয়ে এসেছি।”

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-৩০

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৩০(ক)

শান্ত স্বভাবের রিদওয়ান প্রচণ্ড ক্রোধে হাত মুঠো করে রেখেছে। শপিংমলের নিচতলায় একটি মোবাইল শপের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে অর্নিতা। পরিস্থিতি দিনকে দিন কত যে বিগড়োবে তা নিয়ে আতঙ্কিত অর্নিতা ধীর স্বরে বোঝাতে লাগলো স্বামীকে।

-তুমি প্লিজ রাগ করো না ভাইয়া হয়ত এই শেষ বার নুপুরের মুখোমুখি।

“তুই নিশ্চয়ই তোদের বাড়ি ফিরবি! আমি গেলাম” বলেই রিদওয়ান পা বাড়ায় মল থেকে বেরিয়ে যেতে। অর্নিতা হাত চেপে ধরে রিদওয়ানের।

-প্লিজ…

অর্নিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই তারা লিফটে নুপুরকে দেখতে পায়। গাল বেয়ে ঝরছে তপ্ত জল , মেয়েটা কোন দিক না তাকিয়ে বেরিয়ে গেল মল থেকে। রিদওয়ানও দেখলো নুপুরের বেরিয়ে যাওয়া। অর্নিতা একটু এগিয়ে ধরতে চাইলো নুপুরকে পারলো না। রিদওয়ানও এগিয়ে যায়, “দ্যাখ কি শুরু করেছে তোর ভাই। এই মেয়েটাকে ডেকে এনে কষ্ট দেওয়ার দরকার ছিল!”

-নুপুরের কাছে আমার ফোনটা ছিল।

-তোর ফোনের চিন্তা হচ্ছে? রিডিকিউলাস!

অর্ণব তখনও নিচে আসেনি৷ রিদওয়ান আবার উপর তলায় গিয়ে খোঁজ করলো অর্ণবের। সে বিন্দাস শপিং করছে। সে এখন অপেক্ষা করছে তার স্যুটের। রেডিমেড ব্ল্যাক কোট,প্যান্ট, সাদা লম্বা স্ট্রাইপের শার্ট, লাল রঙা টাই, ক্রিস্টাল স্টোনের ব্রোঞ্জ এক কথায় বিয়ের দিনের জন্য চমৎকার কমপ্লিট স্যুট সিলেক্ট করে নিয়েছে। রিদওয়ান, অর্নি পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সহাস্যে প্রশ্ন করলো, তোর জন্য পছন্দ কর এবার। আমার বিয়েতে বোনজামাই হিসেবে তুই তো পাওনাদার।

সদা-সর্বদা নিরীহ আচরণ করা রিদওয়ান আজই প্রথম বোধহয় অর্ণবের ওপর ভয়ংকর রকম রেগে আছে। বয়সে অর্ণব ছোট সে হিসেবেও চাইলে পারতো দু চারটা থাপ্পড় মেরে নিজেকে শান্ত করতে কিন্তু নাহ, অসুস্থ মস্তিষ্কে রূপান্তর হওয়া মানুষকে আসলে মেরে-কে*টে কোনভাবেই কিছু বোঝানো সম্ভব নয়৷

-বাড়ি চল। এক্ষুনি বাড়ি ফিরে বলবি তুই এই বিয়ে করছিস না।

-ওকে নিয়ে বাড়ি যা অর্নি। কেনাকাটা আমি একাই করতে পারব।

-বাড়াবাড়ি করিস না অর্ণব…

রিদওয়ানের মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই তার শার্ট চেপে ধরলো অর্ণব। ফিসফিসিয়ে বলল, “আমি বাড়াবাড়ি করি না রিদওয়ান বাড়াবাড়ি করে আমার আমার অদৃষ্টের লিখন আর আমার কাছের মানুষজন।”

অর্ণবের আচমকা এই বজ্র আচরণে ভড়কে গেছে শপের ভেতর থাকা প্রত্যেকটা মানুষ, ভয় পেয়েছে অর্নিতা। তার মুখের ত্বক যেন মুহূর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। অর্ণব ছেড়ে দেয় রিদওয়ানকে চুপচাপ বিল মিটিয়ে ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে দ্রুত কদমে বের হয়ে যায় শপিংমল থেকে। কিছু সময় বাকরুদ্ধ থাকে রিদওয়ান -অর্নিতা। অর্ণবের চোখ জোড়া কি একটু ছলছলে ছিল! তেমনই তো দেখলো বোধহয় ভাবছে রিদওয়ান। নুপুরের চোখে জল, জলের আভাস অর্ণবের চোখেও এরপর আর কিভাবে রিদওয়ান চাইবে একমাত্র বোনটার বিয়ে হোক ওই অন্য পথের পথিকের সাথে!

অর্নিতা কষ্ট পাচ্ছে সেই সাথে লজ্জায় মাথা নত তার। তার স্বামীর শার্ট চেপে ধরে আহত করতে এগিয়ে এসেছিলো তারই ভাই। ছিহ, কি বিশ্রী এক পরিস্থিতি এই পাবলিক প্লেসে! তার চক্ষু ফেটে আগুনঝরা অশ্রু আসার পায়তারা করছিলো অমনি শুনলো স্বামীর ডাক।

-চল…

অর্নিতা জিজ্ঞেস করার সাহস পায় না কোথায় যাবে। রিদওয়ান তার হাত ধরে টেনে বেরিয়ে গেল মল থেকে। সি এন জি ডেকে নুপুরের বাড়ির ঠিকানা বলে উঠে বসলো তাতে। নির্বাক অর্নি কিছু বলতে চেয়েও বলল না। যা হচ্ছে হোক সে আর মুখটাই খুলবে না। আধঘন্টার মধ্যে তারা পৌঁছে গেল নুপুরদের বাড়ি৷ বলা বাহুল্য, রিদওয়ান এই ঠিকানায় আগে কখনো না এলেও অর্নির মুখে কয়েকবার শুনেছিলো নির্দিষ্ট এলাকায় পৌঁছে গেছে কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো নির্দিষ্ট বাড়ি বা গলি কোনটাই তার চেনা নয়। তাই এবার অর্নিতা বলল বাড়ির ঠিকানা৷ তারা যখন সিএনজি ছেড়ে প্রধান ফটকে পা দিলো তখন নাজিম সাহেব হন্তদন্ত হয়ে বের হচ্ছিলেন। অযাচিতভাবে রিদওয়ান ধাক্কা খেল নাজিম সাহেবের গায়ে।

-স্যরি আমি দেখতে পাইনি… আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।

নাজিম সাহেব নিজেকে সামলে তাকালেন সামনের যুবকটির দিকে। চেহারা দেখে পরিচিত মনে হলো না তবে পেছনে থাকা অর্নিকে দেখেই কপাল কুঁচকে ফেললেন। তিনি তো এখন সন্দেহবশত এই মেয়েটার ভাইয়ের কাছেই যাচ্ছিলেন মেয়ের খোঁজ নিতে। এখন সালাম শুনে আর তাদের দেখে থেমে গেলেন।

-তোমরা এখানে!

“আঙ্কেল আমরা নুপুরের সাথে দেখা করতে এসেছি আর…… আপনার সাথেও।” ইতস্তত করে বলল রিদওয়ান। নাজিম সাহেব বিশেষ অবাক হলেন এবার। রিদওয়ানও আবার বলল, “আমরা অর্ণব-নুপুরের বিয়ের প্রস্তাব এনেছি। আঙ্কেল আমি জানি আপনি মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন তবুও মেয়ের জন্যই আরেকবার ভাবুন প্লিজ। ছেলে-মেয়ে দুজনই একে অপরকে চায় প্লিজ আমরা তাদের আলাদা না করি। একটু ভাবুন কথাটা।”

রিদওয়ানের কথা শেষ হওয়ার আগেই নাজিম সাহেবের ফোন বাজছে। তিনি ফোনের স্ক্রীণে নজর দিতেই বলে উঠলেন, সরে দাঁড়াও আমার তাড়া আছে।

রিদওয়ান থেমে যাওয়ার পাত্র নয় সে অনুরোধের সুরে আবারও বলল, “আপনি হ্যা বলুন আঙ্কেল আপনার একটা হ্যাঁ তে সবাই সুখী হবে। আচ্ছা নুপুরকে ডাকুন তাকেই জিজ্ঞেস করুন কি চায় সে।”

এবার চোখ তুলে রিদওয়ানের দিকে ভালো করে তাকালেন তিনি। নুপুরকে ডাকতে বলছে এরা! অর্ণবের জন্য বিয়ের প্রস্তাব এনেছে! তবে কি নুপুর তাদের কাছে নেই? ভুল সন্দেহ করে অর্ণবের কাছে যাচ্ছিলেন তিনি! নুপুর কোথায়? মেয়ের বাবা বলেই বোধহয় সরাসরি প্রশ্ন করতে পারলেন না তিনি, নুপুর কোথায় তোমরা জানোনা? কে জানে পরে হয়ত তারা ভেবে নেবে তাঁর মেয়ের চরিত্র ভালো না। তিনি আর এক মুহূর্ত দেরি না করে স্ত্রীকে ডেকে বললেন, মেইন গেইট লাগায়া দাও কেউ যেন ঢুকতে না পারে ভেতরে। অত্যাশ্চর্য চাহনি মেলে চেয়ে আছে অর্নিতা। তাদের মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিতে বলছে!

________

অর্নিকে বাপের বাড়িই রেখে নিজেদের বাড়ি ফিরলো রিদওয়ান। বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ে হুট করে হলেও আয়োজন নেহাৎ কম করেননি বাশার শেখ। বাইরের আত্মীয় কম হলেও বংশের প্রায় সকল আত্মীয়কেই দাওয়াত করে ফেলেছেন দু দিনের সিদ্ধান্তে। বাড়িতে পা রেখে প্রথমেই দেখতে পেল বড় ফুপির ছোট মেয়েকে৷ তারপরই চোখে পড়লো নানী বাড়ির সব, দাদী বাড়ির তো আত্মীয়ের সাথে তাদের কাজের লোকজনও হাজির। একবার নজর ফিরিয়ে মাকে খুঁজলো সে৷ কোথাও চোখে পড়লো না। এবার খুঁজলো বৃষ্টিকে। তার প্রথমে দরকার বোনকেই। মেয়েটাকে ভালো করে বুঝিয়ে নিতে হবে এ বিয়ে সুখকর নয় তার জন্য৷ দূর্ভাগ্য বৃষ্টি গেছে পার্লারে। প্রি ওয়েডিং শুট নাকি করবে তাই সাজছে। বড্ড পাগল পাগল লাগে রিদওয়ানের বোনটার এত উৎসাহ দেখে৷ হঠাৎ বিয়ে তবুও সে ষোলআনা আনন্দ আয়োজন করতে চাইছে৷ বোনটা যদি বুঝতে পারতো তার পোস্ট ওয়েডিং দিনগুলো কেমন কাটবে তাহলে হয়ত এই প্রি ওয়েডিং শুট কল্পনায়ও আসতো না। ঘুরেফিরে সে যায় এবার বাবার কাছে।

“এখনও বিপদ হয়নি আব্বু বন্ধ করে দিন এই আয়োজন৷”

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৩০(খ)

প্রি ওয়েডিং শুটে অর্ণবকে পাওয়া গেল না। বৃষ্টির একক কিছু শট নেয়া হয়েছে। বিয়ের দিনের ভিডিও থেকে অর্ণবের কিছু শটকাট জুড়ে দিয়েই নাকি সেটা কভার করতে পারবে বলেছে ভিডিওগ্রাফির লোক। পরেরদিন বৃহস্পতিবার বেশ জমজমাট হলো বৃষ্টির গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। বাড়িভর্তি আত্মীয়ের ভীড়ে উপস্থিত ছিল ময়না আর তার মেয়ে। ছেলের বিয়ে কিন্তু ওই বাড়িতে পা রাখার অধিকার নেই আর সন্তানেরা তাকে মায়ের অধিকার দেয় তাই ভাগ্নির কাছে থেকেই স্বাদ মেটাচ্ছে ছেলের বিয়ের। অনেকটা, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মত অবস্থা। অপরদিকে চৌধুরী বাড়িতে হলুদের ছোটখাটো আয়োজন করা হয়েছে বসার ঘরেই। আমন্ত্রিত মেহমান শুধুই বড় দাদীর বাড়ির বউ, নাতি-নাতনীদের দল। কিন্তু যার জন্য আয়োজন তার দেখা মিলল না সারারাত পেরিয়ে ভোর বেলাতেও। এরই মাঝে বৃহস্পতিবার দিনটার সকল কাজের মাঝেও অর্নিতা আর রিদওয়ানের কেটেছে ভয়ংকর এক চিন্তার মধ্য দিয়ে। ঘরে যখন ফুল, বাতি দিয়ে হলুদের আসন পাতা হচ্ছিলো তখনই সেখানে উপস্থিত হয় নুপুরের বাবা আর বড় মামা। তাদের দেখে দাদী কিছুটা রেগে গেলেও অর্নিতা মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছিল। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছিলো যেন ভালো কিছু হয়, নুপুর যেন তার ভাইয়েরই হয় এবার। অর্নিতা এগিয়ে যায় নুপুরের বাবার সাথে কথা বলতে রিদওয়ানও এসে পাশে দাঁড়ায়। নিজের বাড়িতে বাবার সাথে রাগ করে রিদওয়ানও উপস্থিত হয়েছিল সেখানে। নুপুরের বাবা মলিন মুখে প্রশ্ন করেন, “নুপুর কোথায়?”

-নুপুর!

বসার ঘরে তখন দাদী,রিদওয়ান আর অর্নি ছাড়াও বড় দাদার বাড়ির অনেকেই ছিল সেখানে। প্রত্যেকেই নামটা শুনে কৌতূহলী হয়ে মনোযোগ দেয় তাদের দিকে। নাজিম সাহেব আবারও বলে উঠেন, কাজটা ঠিক করছো না তোমরা। নুপুর কোথায় ডাকো ওরে। কি করে পারলো সে এমন কাজ করতে!

অর্নিতা বোকার মত তাকায় নুপুরের বাবার দিকে। ওনার কথা কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার। রিদওয়ান কিছু আন্দাজ করতে পারলো।

-আঙ্কেল কি হয়েছে ঠিক করে বলুন, নুপুর কোথায় আমরা কি করে বলব?

-মিথ্যে বলো না আমি জানি নুপুর এখনেই আছে। সে কালকে দুপুরে অর্নিতার সাথে দেখা করতে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি৷ অর্ণবকে কোথায়?

অর্ণব! আসলেই তো ভাইয়া কোথায় সকাল থেকে? কিন্তু উনি যে বলছেন নুপুরকে কাল থেকে পাচ্ছেন না। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল অর্নিতা৷

রিদওয়ান প্রশ্ন করলো, “আঙ্কেল ঠিকঠাক খোঁজ নিয়েছেন সব পরিচিতদের কাছে?”

“দ্যাখো নাটক করবা না তোমরা আমি জানি আমার মেয়ে অর্ণবের সাথেই আসছে৷ বের করো ওকে। নুপুর এ্যাই নুপুর সামনে আয়৷ এত নাটক ভাল্লাগতাছে না। নুপুর জলদি আয়। মনে রাখিস এখন ভালোয় ভালোয় না আসলে আমি তোরে ত্যাজ্য করব।”

চেঁচিয়ে এক নাগাড়ে ডেকে হুমকি দিতে লাগলপন নাজিম সাহেব। বসার ঘরে এবার শোরগোল লেগে গেল বাকিদের কথাবার্তায়। রিদওয়ান, অর্নিতা কিছুতেই থামাতে পারছে না নাজিম সাহেবকে সাথে নুপুরের মামাও। অনেক কথার পর সকলেই শান্ত হলো সেই সাথে নুপুরের বাবাকে বিশ্বাস করানো গেল অর্ণবের সাথে নুপুর নেই। ক্ষণকাল স্তব্ধ থেকে বড় আকস্মিক হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন নাজিম সাহেব। পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ় অনাত্মীয় মানুষ গুলোর সামনে এভবে বোধহয় একমাত্র হৃদয়ের কোন খন্ডে আঘাত পেলেই এভাবে কাঁদে। রিদওয়ান এগিয়ে এসে বাহু আঁকড়ে ধরলো। নুপুরও কাঁদছে আর মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে। এতক্ষণে প্রায় সকলেরই একটি ধারণা হয়ে গেছে, এই লোকটির মেয়ে নিখোঁজ। পরিস্থিতি অনুমান করে রিদওয়ান তাকালো নুপুরের মামার দিকে।

-আঙ্কেল থানায় ডায়েরি করেছেন?

-নাহ বাবা। নাজিম তো বলল, আমার ভাগ্নির নাকি এ বাড়ির ছেলের সাথেই আছে সে। কাল রাত পর্যন্ত খোঁজখবর নিয়ে না পেয়েই আমরা ধরে নিয়েছি মেয়েটা এখানে। মোবাইলটাও তো সাথে নেয়নি।

নুপুরের মামার কথা শুনে রিদওয়ান বুঝলো তাদের চিন্তাধারা ঠিক কি ছিল। কিন্তু এখন আর বসে থাকার জো নেই এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। সে এবার নুপুরের বাবা আর মামাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে অবশ্য অর্নিতাকে সতর্ক করে গেল অর্ণব যেন ঘুণাক্ষরেও কিছু টের না পায়। বসার ঘরের প্রত্যেকেই আন্দাজ করলো রিদওয়ান যেতে যেতে নিজের বোনের আনন্দ নষ্ট না হবার চেষ্টাও করে গেল। অর্নিতা সবাইকে বুঝিয়ে তো বলল একটু আগের ঘটনা কিছুতেই ভাইয়াকে জানানো হবে না কিংবা নিজেকে কি করে বোঝাবে! কাল তো নুপুর তার সাথেই ছিল তার ভাইয়ের সাথেও কিছু একটা হয়েছে৷ নইলে, তখন মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে গেল কেন আর ভাইয়ারও চোখ অমন জলে ভেজা। বুকের ভেতর তুফান চলছে নুপুর ঠিক আছে তো! উল্টাপাল্টা কিছু করে বসেনি তো আবার? নুপুরের কাছে তো তার ফোনটা ছিল অনেকবার কল করেছে সে রিদওয়ানের নম্বর থেকে একবারও তোলেনি৷ পুরো দিন আর রিদওয়ান বাড়ি ফিরতে পারেনি৷ প্রথমেই থানায় মিসিং ডায়েরি করে সম্ভাব্য সবরকম খোঁজ নিয়েছে নুপুরের বাবার সাথে মিলে তাদের আত্মীয়ের বাড়িতে৷ সন্ধ্যে নাগাদ অর্নিতা ফোন করে কাঁদতে লাগল ভাইয়া ফোন ধরছেনা বলে। এ পর্যায়ে সে নাজিম সাহেবকে জোর করে বাড়িতে রেখে নিজে চলে গেল অর্ণবের খোঁজে। অর্ধরাত পেরিয়ে গেলেও অর্ণব ফোন তুলল না আর না তাকে খুঁজে পেল। রাত আনুমানিক তিনটার পর বাড়ির গেইটে কড়া নাড়লো অর্ণব৷ দারোয়ান গেইট খুলতেই সে বাড়ির ভেতর সদর দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। এতরাতেও দরজা খোলা! একটু অবাক হলেও তা কেটে গেল পরক্ষণেই। সোফার ওপর গা এলিয়ে পড়ে আছে রিদওয়ান৷ হলুদের জন্য পাতা হয়েছিল যে আসনটা সেটাতে চাঁদর মুড়ে শুয়ে আছে অর্নিতা৷ তা দেখেই অপরাধবোধ জাগলো অর্ণবের। ইশ, তার জন্যই বুঝি অপেক্ষা করতে করতে এখানে শুয়ে আছে বোনটা! রিদওয়ানটাও ঘুমায়নি দেখছি?

অর্ণব যখন অপরাধবোধে রিদওয়ানের দিকে সংকোচ নিয়ে তাকায় ঠিক তখনি তাকে ভড়কে দিয়ে রিদওয়ান এসে থাপ্পড় বসায় তার গালে। নিস্তব্ধ রাতে বোধকরি, থাপ্পড়ের আওয়াজেই ঘুমটা চটে গেল অর্নিতার। সে শোয়া থেকে উঠে বসতেই দেখলো তার স্বামী মানুষটা তার ভাইকে কেমন শাষণের সুরে কিছু বলছে। কি বলছে তা যেন তার সদ্য জাগা মস্তিষ্ক বুঝতে পারছে না। দু চার কথা বলেই রিদওয়ান দোতলায় উঠে গেল। অর্ণব ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে আগের জায়গাতেই। এবার অর্নিতা ডেকে উঠলো, কোথায় ছিলে ভাইয়া?

-কারখানায়।

-এত রাত পর্যন্ত!

-হু, বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিলো না। তাই নতুন মালগুলো নিজেই এক এক করে সব চেক করছিলাম।

-কেউ তোমাকে ফোন করেনি সারাদিন?

কৌশলে যেন জানতে চাইলো নুপুরের সাথে কথা হয়েছে কিনা। অর্ণব পকেট হাতড়ে ফোনটা বের করে বলল, ” ফোন সাইলেন্ট ছিল সারাদিন। এইতো অনেক গুলো মিসডকল দেখা যাচ্ছে। আটাত্তরটা কল! এত কল কি তোরাই করেছিস!”

– দেখো চেক করে অন্যরাও হতে পারে।

অর্নিতা নিজেই ভাবছে ভাইয়ের ফোনটা একবার দেখে নেবে কি! নাহ, অর্ণব নিজেই এতক্ষণে দেখে নিয়েছে। কল লিস্টের সব নম্বর রিদওয়ান, ম্যানেজার আঙ্কেল আর বৃষ্টির। ভাগ্যিস ফোনটা সাইলেন্ট ছিল নইলে তো বৃষ্টির কল দেখলে ধরে ফেলত আর উলটপালট কিছু বলে ফেলত৷

অর্নিতা আবার ডাকল, “ভাইয়া!”

-বল

-আর কয়েকঘন্টা বাদে বৃষ্টি আপুর সাথে তোমার বিয়ে সে কথা মনে আছে তোমার!

-আরেহ… আমার বিয়ে আমি ভুলে যাব?

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো যেন গোমড়ামুখো ছেলেটা। অর্নি সে হাসি দেখে বলল, ভোর হতে চলল ঘুমিয়ে নাও একটু৷

-হ্যা রে একটু ঘুম দরকার তা না হলে কাল দেখতে খুব বিশ্রী লাগবে।

আর কোন কথা নেই ভাই-বোনেতে। অর্ণব নিজের ঘরে গিয়ে চোখ বুঁজে শুয়ে পড়লো বিছানায়। কাল রাত থেকে আজ রাত পর্যন্ত কোন দানা পেটে পড়েনি তার তবুও মনের ক্লান্তির চাপেই বুঝি ঘুম নেমে এলো চোখের পাতায়। ঘুম ভাঙলো দাদীর গলা শুনে। ঘুমটা এখন প্রচণ্ড গাঢ় তবুও তাকে উঠতে হলো বিছানা ছেড়ে। মসজিদ থেকে ভেসে আসছে খুতবার সুর। হঠাৎ মনে হলো আজ তো শুক্রবার তবে কি বারোটা বেজে গেল! এতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে? এদিক সেদিক তাকিয়ে রিদওয়ানকে খুঁজলো এবার৷ রাতের থাপ্পড়টা সে ভুলে গেছে বিছানায় যেতেই৷ দাদী এবার নিচে থেকে ডাকলো, “দাদাভাই! নাশতা খাইতে আয়।”

” গোসল করে খাব দাদী।”
_________

সকাল আটটা থেকে রিদওয়ান ক্লিনিকে বসে আছে এখন বাজে বেলা বারোটা। সকাল সাতটায় সে ফোন পেয়েছে নুপুরের মামার । কোথাও একটা মেয়ের লাশ সনাক্ত করতে পুলিশ ডেকেছে তাদের। থানায় ডায়েরি যেহেতু নুপুরের বাবা করেছেন তাই প্রথম কলটা তাঁকেই করা হয়। তিনি সে সংবাদ শুনেই অচেতন হয়ে পড়েন৷ গতকাল রিদওয়ান সাথে সাথে ছিল বলেই তার ফোন নম্বরটা রেখেছিলেন ভদ্রলোক আর আজ বিপদ হতেই রিদওয়ানকে খবর দিলেন। নাজিম সাহেবকে হাসপাতালে রেখেই আবার সে লাশ দেখতে নিজেই গেল। নুপুরের অতিআপনজনদের প্রয়োজন পড়েনি রিদওয়ান নিজেই দেখে সনাক্ত করতে পারলো এটা নুপুর নয়। এ লাশের গায়ের রঙ ধবধবে সাদা আর নুপুরের শ্যামলা। নুপুরের প্রতি স্নেহ কাজ করলেও আজ মূলত অর্ণবকে সরিয়ে রাখতেই সে এত এগিয়ে এসেছে নাজিম সাহেবের বিপদে। অর্ণব যতক্ষণ নুপুর সম্পর্কিত ঘটনা না জানবে ততক্ষণ নিশ্চিত থাকা যায় বৃষ্টির বিয়েতে কোন বাঁধা আসবে না। হলোও তাই, কয়েকঘন্টার ব্যবধানে অর্ণব শার্ট,কোট, জুতো সেই সাথে নুপুরের দেয়া প্রথম উপহার সেই ব্রেসলেটটা পরে চলে গেল বিয়ে করতে। আয়োজন সে চায়নি বলেই মেহমান নেই তেমন। বরযাত্রী হিসেবে ছিলো শুধুই নিজের বাড়ির মানুষজন। অর্নিতা, বড় দাদা, দাদার ছেলে, নাতি আর তাদের স্ত্রী সন্তানরা। সব মিলিয়ে মাত্র ত্রিশ জন নিয়ে চলে গেল শেখ বাড়িতে।

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-২৯

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২৯

“তোর উড বি কিছু মনে করেনি তো!”

নুপুরকে দেখে প্রথম প্রশ্নটা করেই সবাইকে চমকে দিলো অর্নিতা৷ নুপুর অবাক হয়ে তাকায় প্রিয় বান্ধবীটির দিকে। তার দৃষ্টির বিষ্ময় আর প্রশ্ন না বোঝাটা বুঝতে পেরে অর্নিতা আবার বলল, “বলছি এখানে তোকে ডেকেছি তার জন্য কিছু মনে করেনি তো তোর হবু বর?”

স্বতঃস্ফূর্ত স্বরে কথা বলছে অর্নিতা। এমন কথাবার্তা অর্নির মুখে বোধহয় উপস্থিত তিনজনের কেউই আশা করেনি। নুপুর আহত হৃদয়ে কাতর হয়ে চেয়ে আছে। অর্ণবও যেন আঘাত পেল বোনের আচরণে মনে মনে নিজের ওপরও ক্ষোভ জমলো। আজ সে-ই মাধ্যম এই মেয়ে দুটির মধুর সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টিকারী। একটু আগে অব্দি নুপুরকে দেখে তার মস্তিষ্কে তীব্র রোষানল থাকলেও এই মুহূর্তে বোনের আচরণে তা মিলিয়ে গেল। এই মেয়েটা হেয় হওয়ার মত অন্যায় করেনি৷ দাদী তাকে আজ সকালেও খুব করে বুঝিয়েছেন নুপুরের ওপর ক্রোধ যেন প্রকাশ না পায় তার। ওপরওয়ালার ইচ্ছেতেই সব হয় আর যা হয় তার মধ্যে বান্দার জন্য নিশ্চয়ই মঙ্গলকর কিছু থাকে। অর্ণব ভেবেছিলো বোনকে থামাবে তার আর প্রয়োজন পড়লো না। রিদওয়ানই তাকে থামিয়ে দিল, “এসব কেমন কথা অর্নি! তুই এভাবে কথা বলছিস কেন?”

-খারাপ কিছু তো বলিনি।

কাটকাট জবাব দেয় অর্নিতা। চুপচাপ তখনো অর্নিদের টেবিলের সামনে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে আছে নুপুর। রিদওয়ান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। নিঃশব্দে অন্য একটি চেয়ার টেনে নুপুরকে বসতে বলে। অর্ণবও দাঁড়িয়ে ছিল এবার তাকেও বলে, তুই কেন দাঁড়িয়ে আছিস সংয়ের মত। ইনভাইট করতে হবে বসার জন্য?”

প্রচণ্ড শব্দ করে ফাঁকা আরেকটি চেয়ার টেনে অর্নিতার পাশে বসে অর্ণব। একজন ওয়েটার আসে সেময়ে তাদের অর্ডার গ্রহণ করতে৷ রিদওয়ান একপলক তিনজনের মুখশ্রীতে দৃষ্টি দিয়ে নিজেই খাবার অর্ডার করে। নুপুর বলতে চায় সে এখন খাবে না শুধু একটু সময় কথা বলবে অর্নিতার সাথে। নাহ, গলা পার হয়ে ঠোঁট পর্যন্ত আসে না তার শব্দধ্বনি৷ কিছু সময় কেটে যায় নিস্তব্ধতায় তারপর প্রথম কথা নুপুরই বলে অর্নিতার দিকে চেয়ে।

-কেমন আছিস?

-ভালো।

আবার থেমে যায় কথা তাদের। কি বলবে খুঁজেই পায় না যেন। রিদওয়ান বিচক্ষণ লক্ষ্য করে এখানে সে ছাড়া বাকি তিনটা মানুষই জড়াগ্রস্ত নিজ নিজ আবেগে। এভাবে একসাথে এক টেবিলে বসে তারা কথা বলতে পারবে না আর না খেতে৷ তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় মেয়ে দুটিকে একা ছাড়া হোক। যেমন ভাবন তেমনই কাজ, সে অর্ণবকে বলে উঠে পড়ে অন্য টেবিলের জন্য। অর্ণব আর রিদওয়ান সরে যেতেই নুপুর স্বস্তি পায়। ক্ষীণ হেসে জিজ্ঞেস করে, “খুব বেশি রেগে আছিস আমার ওপর?”

– রেগে থাকার অধিকারই কেড়ে নিয়েছিস।

-এভাবে বলিস না….

“কিভাবে বলব তবে? কি করছিস তুই, কেন করছিস? আমার ভাইটার জীবন কেমন করে কেটেছে অজানা তোর? যেচে কেন ঢুকেছিলি তার জীবনে? বিয়ে যদি অন্য কাউকেই করবি তবে আমার ভাইয়ের পিছু নিয়েছিলি কেন?”

উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলতে গিয়ে গলার স্বর চড়ে গেল অর্নিতার। একটু দূরে বসা অর্ণবের কানে সে আওয়াজ পৌঁছুতেই অর্ণব উঠে এলো আবার।

-গলার আওয়াজ নিচে রেখে যা বলার বল অর্নি। আর কি ফালতু কথা বলছিস তুই! আমি যেন একটাও এসব নিয়ে কোন কথা না শুনি নইলে ভুলে যাব আমরা কোন পাবলিক প্লেসে আছি।

অর্ণব ফিরে গেল রিদওয়ানের কাছে। খাবার এসেছে দুই টেবিলে আলাদা করে৷ রিদওয়ানের পেটের খিদে মিটিয়ে ঠিকঠাক খেয়ে নিল। বাকি তিনজনের কারোই প্লেটের খাবার উদর পর্যন্ত পৌঁছালো না।

______

নাজিম সাহেব সাড়ে তিনটেয় কল পেলেন হবু বেয়াইয়ের। আজ ছেলে মেয়ের দেখা করার কথা ছিল৷ পূর্ব পরিকল্পনার এ কথা তো জানানো হয়েছিল নুপুরকেও অথচ মেয়ে এখনো পৌঁছায়নি। ছেলে আর তার ভাবি অনেক আগেই পৌঁছে গেছে বাড়ির কাছাকাছি এক মার্কেটে। সেখানে নুপুর উপস্থিত হলে আজই বিয়ের শাড়ি কিনে ফেলবে বলে মনস্থির করেছিল পাত্রের পরিবার৷ এক ফাঁকে ছেলেমেয়েতে একটু কথাবার্তারও সুযোগ হবে৷ কিন্তু একি! মেয়ে তো এখনও পৌঁছায়নি তারওপর ফোনটাও তুলছে না। তাই বাধ্য হয়েই মেয়ের বাবাকে জিজ্ঞেস করা হলো মেয়ে কোথায়? তিনি বাড়ির বাইরে কাজে ব্যস্ত ছিলেন বলে আজ দুপুরে বাড়িতে খেতেও যাননি। এখন হুট করেকি বলবেন তার মেয়ে কোথায়! কিছু একটা তো বলতেই হয় বলে মিথ্যে বললেন, মেয়ের ফোনটা চুরি হয়ে গেছে তাই তিনিও কলে পাচ্ছেন না। বাড়ি গিয়ে পাঠাচ্ছেন মেয়েকে। মুখে এ কথা বললেও মনে মনে আতঙ্কিত হলেন মেয়ে ফোন কেন তুলছে না! বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে পেলেন ঘুমন্ত অবস্থায়। তুতুন প্রাইভেট পড়তে গেছে আর বাড়ির সদর দরজা হাট করে খোলা। প্রথমেই পুরো ঘরে মেয়েকে খুঁজলেন নাহ, ঘরে কোথাও নেই মেয়েটা। মোবাইলটা পাওয়া গেল তার ড্রেসিংটেবিলের ওপর। চিন্তার রেখা দীর্ঘ হলো ললাটজুড়ে৷ স্ত্রীকে দ্রুত ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, নুপুর কোথায়?

মহিলা প্রথমে ঘুমের ঘোর কাটাতে পারছিলেন না৷ পরে স্বামীর ধমক খেয়ে মনে করলেন নুপুর বেরিয়েছে অনেকক্ষণ হলো। এবার জবাব দিলেন, আপনার মাইয়া জামাইর লগে সাক্ষাৎ করতে গেছে আর কই যাইব!

– কখন গেছে?

-তিনটায় থাকার কথা ছিল না মার্কেটে? দুইডার পরেই বাইর হইছে।

বাড়ি থেকে মার্কেটের দূরত্ব বাসে পঁচিশ মিনিটের৷ আর যদি নুপুর ভেঙে এখান থেকে রিকশায় গেলে পনেরো মিনিট বড় বাজার সেখান থেকে অটোতে গেলে বিশ মিনিট সব মিলিয়ে এক ঘন্টা তো লাগার কথা না। এখন তো প্রায় চারটা বাজতে চলল আর বেয়াই কল করেছে সাড়ে তিনটায়। নুপুর কোথায় গেল?

-নুপুর কার সাথে গেছে?

– একলাই গেছে। কইলো কোন বান্ধবী যাইব সামনে থাইকা….

-নাম কি বলছে সে?

-নাম… একটুক্ষণ চিন্তা করলেন ছোট মা৷ মনে করে বললেন, নাম বলে নাই আমারে।

-গবেট মহিলা তোমারে আমি কাল কি বলছিলাম! আজকে যেন তুমিও ওর সাথে যাও আর তুমি পড়ে পড়ে ঘুম দিতাছো৷ তোমারে ইচ্ছে করতাছে…. দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন নজিম সাহেব। নুপুর কেয়ারলেস মেয়ে না সে বাড়ির বাইরে গেলে প্রতিবারই বাবাকে জানিয়ে যায়। ইদানীং কালে মেয়ের সাথে কিছুটা মনোমালিন্যতা চলছিলো ঠিকই কিন্তু আজ সে না বলে বেরিয়ে যাবে এমনটা ভাবেননি। গত কয়েকদিনে স্বাভাবিকভাবে কোন কথাই হয়নি মেয়ের সাথে কিন্তু কাল তো দূর থেকেই বার কয়েক বলে গেছেন আজ যেন ছোট মাকে সাথে নিয়ে মার্কেটে যায়। আর ফোনটা কেন বাড়িতে রেখে গেছে! হঠাৎই মনটা কু ডাকতে লাগল নাজিম সাহেবের। প্রথম দফাতেই মাথায় এলো অর্ণবের কথা৷ নুপুর কি ওই ছেলেটার কাছে গেল! সেদিন ওভাবে ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিয়ে মনে মনে তিনিও অশান্তিতে ভুগছিলেন। যতই হোক তার মেয়ে যে ওই ছেলেকে ভালোবাসে সে ব্যাপারে আগেই বুঝেছেন কিন্তু অমন বাবা মায়ের ছেলের কাছে মেয়ে দিতে মন সায় দেয়নি। উপরন্তু, ছেলের টাকা পয়সাও অনেক বেশি। তিনি বরাবরই অসম সম্পর্কে ভয় পান হোক বয়সের কিংবা সেটা অর্থের অসমতা। অবশ্য চার কূল মিলিয়ে পাওয়া মুশকিল তাই পাত্র ঠিক করেছেন বয়সে মেয়ের চেয়ে অনেকটা বড়। কিন্তু নুপুর কোথায় গেল?

________

খাবার কারোই পেটে না পড়লেও অর্ণবের কঠিন মনোভাবের তোপে পড়ে সবাইকে যেতে হলো শপিংমলে। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় নুপুর বিদায় নিতে অর্নিকে বলল, যাই আমি ভালো থাকিস।

অর্ণব তা শুনতেই দাঁতে দাঁত চেপে বলে বসলো, “তোর বান্ধবীকেও বল শপিংয়ে যেতে আমাদের সাথে। শুধু কি লাঞ্চ করতে এসেছে নাকি! আমার বউয়ের শাড়ি, গয়না দেখবে না? দেখবে কি পছন্দও তো করে দিবে।”

রিদওয়ানের রাগ হলো খুব এ পর্যয়ে এসে। চাপা ক্রোধের সাথে ধমকে উঠল সে।

-কি শুরু করলি তুই? নিব্বি পোলাপান সাজতে চাইছিস, প্রেমিকাকে হারানোর জ্বালায় উন্মাদ হইছিস তা বোঝাতে চাচ্ছিস!

অর্ণব পাত্তা দেওয়ার মুডে নেই৷ সে নিজের মত রোখ চেপে আছে নুপুরকে সঙ্গে নিয়েই শপিংয়ে যাবে। নুপুর নির্বাক অর্নিও বাড়াবাড়ি টের পেয়ে চুপসে গেছে। কথা তো অনেক ছিল নুপুরের সাথে বলার মত কিন্তু হলো কই! তার ভাইয়ের যে এই মেয়েটাকে মনে গেঁথে রাখার মত অন্যায় হয়ে গেছে সে খবর জানে সে। তাই চাইছিলো ভাইয়ের জীবনে এই একটা সুখ আমরণ আপন হোক৷ দুটো মানুষ একে অপরকে ভালোবাসে অথচ তারা এক হতে পারবে না এমন নিয়তি এ ভবে শত্রুরও না হোক৷ কিন্তু এখন তো সে চাইলেও সম্ভব না ভাইয়ের জীবনে নুপুরকে জুড়ে দেয়া। কিন্তু পরিস্থিতি আর ঘোলা না হোক তা ভেবে সে রিদওয়ানকে বলল, ওকে একটা ট্যাক্সি করে দিন তো এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।

অর্ণব জেদ আঁকড়ে রইলো। সে যেতে দিলো না নুপুরকে। বাধ্য হয়ে নুপুর গেল শপিংমলে। প্রথমেই বিয়ের জন্য লাল রঙের লেহেঙ্গা পছন্দ করা হলো বৃষ্টির জন্য। নুপুরের বরাবরই শাড়ি পছন্দ বউদের জন্য অথচ অর্ণব যখন খুঁচিয়ে বলল, আমার বউয়ের জন্য লেহেঙ্গা তো তোর বান্ধবী পছন্দ করবে অর্নি। ব্যস, সে কথা কানে যেতেই খুব দামী আর কারুকাজ শোভিত লেহেঙ্গা পছন্দ করল নুপুর। অর্ণবও ঠিক সেটাই কিনলো আর তা দেখে প্রচণ্ড রেগে গেল সে। এ কথা ঠিক, বোনের ওপর রাগ আছে রিদওয়ানের তাই বলে যা হবেই সেটাকে অন্তত বোনের জন্য সুখকর করতে চায় সে৷ দু দিন পার হলেই যে ছেলেটার অর্ধাঙ্গিনী হবে তার বোন সে ছেলের অন্যকোন মেয়ের প্রতি একরোখা আচরণ আর অনুভূতি দেখানোটা মোটেই সহ্য হচ্ছে না। সে একরকম রেগেই অর্নিকে বলল, আমি কোন ড্রামা দেখতে চাইছি না থাক তোরা।

রিদওয়ান শাড়ির শপ থেকে বেরিয়ে যেতেই অর্নিও গেল তার পেছনে। গ্যাড়াকলে ফেঁসে গেছে বলে মনে হচ্ছে অর্নির। ভাই, স্বামী, বান্ধবী কার দিকটা ভববে! তারপরই মনে হলো দাদী তাকে সবসময় বলেন, স্বামী তোমার অর্ধেক অঙ্গ। সব কিছুর আগে তোমার তার মন বুঝতে হইব। অর্নিও তাই করলো আগে রিদওয়ানকে থামানো দরকার। নুপুর আর ভাইয়ার হোক শেষদফা লড়াই কিংবা সন্ধি। আপাতত সে আর এগুবে না সেদিকে। অর্নি প্রস্থান করতেই অর্ণবেরও জেদ নেমে গেল যেন। নিজের ভেতরের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা যে তাকে বিশ্রীরকম যন্ত্রণা দিচ্ছে তা উপলব্ধি হচ্ছে এখন। নিজের যন্ত্রণায় সে নুপুরকে জ্বালাতে চাইছে। কত নিষ্ঠুর আচরণ এই! সদ্য কেনা শাড়ির ব্যাগটাতে দৃষ্টি রেখে ধীর গলায় নুপুরকে উদ্দেশ্য করে বলল, চলে যাও। আর কখনও আমার দৃষ্টি সীমানায় এসো না।

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-২৮

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২৮ (ক)

ভাগ্য পরিবর্তন হয় এ কথাটা বরাবরই অর্ণব মন থেকে মানতো, মানে। বাবার ডুবতে থাকা ব্যবসার ভাসমান রূপ,অর্নির সাথে শিবলীর জায়গায় রিদওয়ানের বিয়ে এগুলোই তো চমৎকার প্রমাণ। তার আর নুপুরেরও ভাগ্য নিশ্চয়ই পরিবর্তন হবে কোন একভাবে কোন এক রকম করে। দাদীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে সে কিছু সময় বসেছিলো বাড়ির পেছনের খোলা জায়গায়। নিজের সাথে বোঝাপড়ার নিমিত্তে বসে থাকলেও কিছুই বুঝতে পারলো না শেষ অবধি। মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগলো তারপর মনে হলো এত ভেবে কি করবে! নুপুরের তো বাগদান হয়ে গেছে। অন্যকারো হবু বউকে নিয়ে এত ভাবার মত কচি বয়স কি তার এখনও আছে? নেই তো! আসলেই মন তার অপরিপক্ক নয় তাই রাতটা সে দিব্যি কাটিয়ে দিলো অফিসের টুকরো কাজ করে। পরেরদিন নিয়মমাফিক জীবন শুরু অফিস বাড়ি। সারাদিনে দু বার দাদীর খোঁজ, অর্নির সাথে কথা কেটে গেল আরও একটা দিন। অপরদিকে নুপুরেরও কেটে গেছে সময় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। সে ঘুম তার এমনি এমনি আসেনি। বাবার ঔষধের বক্সে থাকা বহু পুরাতন পাতায় পড়ে থাকা দুটো ঘুমের ট্যাবলেট গিলে নিয়েছিলো সকালের নাশতার পর। কে জানে সে দুটোর ডেট আছে কি নেই? তার তো শুধু জানার কথা ওগুলো হলো ঘুমের বড়ি ব্যস গলায় দিয়ে দিলো। তারপর থেকেই দিনটা কখন ফুরিয়ে গেল টের পায়নি নুপুর। এরই মাঝে সৎ মা বুঝি ডেকেছিলেন বার কয়েক দুপুর বেলায়, ফোন বেজেছিলো, তুতুন বসেছিলো কানের কাছে কিছু বলেছিলোও তাকে। কোন কিছুই ঠিকঠাক যেন কানে পৌঁছায়নি। এই সন্ধ্যে লগ্নে ঘুম ভাঙলেও মাথাটা হয়ে আছে ভার। মনে হচ্ছে কেউ বুঝি এক মণ পাথর চাপিয়ে দিয়েছে মাথার ওপর। ঘুমের রেশ কিছুতেই কাটছে না। গোসল করা দরকার কথাটা ভাবতেই কাপড়চোপড় নিয়ে ঢুকলো গোসলখানায়। শাওয়ার ছেড়ে নিচে দাঁড়াতেই গা কেঁপে উঠলো ঠান্ডা পানির ঝাপটায়। ধীরে ধীরে মস্তিস্কও সচল হতে লাগলো এবার। নজরে পড়লো হাতের আঙ্গুলে থাকা আংটিতে। চকচকে সোনার কারুকার্য শোভিত পাঁচ আনার সুন্দর এই আংটি তো শুধু আংটি নয়। এক নতুন জগতের সাথে তৈরি হওয়ার সন্ধিপথ এই আংটি, খুব কাছের হৃদয়ের ঠিক গভীরে বসবাস করা এক গোমরামুখো মানবের উচ্ছেদকারী এই আংটি। ঠান্ডা পানিতে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল মনে হতেই কাপড় পাল্টে বেরিয়ে এলো নুপুর। গামছাতে চুল পেঁচিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের পানি বসিয়ে তুতুনকে দেখছিলো কোথায় আছে ভাইটা৷ তখনই সামনে পড়লো ছোট মা৷ আজকাল তিনি নামাজি হয়েছেন খুব৷ মাত্রই মাগরিবের নামাজ শেষ করেছেন বোধহয় তাই মাথায় এখনো হিজাব পেচানো। তাকে এড়িয়ে নুপুর রান্নাঘর ছাড়তে চাইছিলো তা আর হলো না। মহিলা পেছন থেকেই বলে বসলেন, এই চেহারায় এইবার চা পাতি খাওয়া বাদ দেও। পোলার মায় যাইতে যাইতে কইয়া গেছে বিয়ার আগেই গায়ের রঙডা আরেকটু ফিরাইতে।

নুপুর ঘাড় ফিরিয়ে জানতে চাইলো, রঙ ফিরাতে বলতে কি বোঝাইছে?

-আরেকটু পরিষ্কার হইতে কইছে। চিন্তা করন লাগতো না মার্কেটে ফর্সা হওনের ক্রিম পাওয়া যায় দুইটা আনাইয়া দিমুনে।

-রঙ ফেরানোর সাথে চা খাওয়ার কি সম্পর্ক?

-চা খাইলে রাইত জাগবা না ঘুমাইলে কাইল্লা চেহারা আরো কাইল…..

নুপুর আর কথা শেষ করতে দিলো না ছোট মাকে। সে ততক্ষণে রান্নাঘরে ঢুকে চুলো নিভিয়ে পুনরায় ফিরে গেছে নিজের ঘরে। তা দেখেই মুখ বাঁকালেন ছোট মা… হু, আজাইরা দেমাগ দেখানের জায়গা পায় না ছেড়ি। যেই না চেহারা!

____

আবেগ, অনুভূতিতে জীবন চলে না এই সহজ বাক্য অর্ণবকে ছোট থেকেই বুঝতে হয়েছে। এখনো এর থেকে পিছপা হওয়ার কারণ ছিলো না বলেই সে মনে করে সামনে এগিয়েছে। নুপুরের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তবে তাই হোক নুপুর অন্যকারো ঘরণী হয়েই থাক। অর্ণব আর যেচে যোগাযোগ করেনি তার সাথে। মনের সাথে যুদ্ধে বরাবরই সে সিংহপুরুষ এবারেও তাতে পিছিয়ে পড়বে কেন! ব্যবসায়িক কাজে মনোনিবেশ মুশকিল লাগলেও চেষ্টায় কমতি নেই ঠিক সে মুহূর্তেই এলো খালুজানের ফোনকলটা। সালাম,কুশলাদির বিনিময় শেষে বড্ড শীতল গলায় তিনি প্রশ্ন করলেন, আমার মেয়েটাকে বিয়ে করতে কি সমস্যা অর্ণব?

-বেয়াদবি নেবেন না খালু, আমি অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসি সে কথা জেনেও আপনি বৃষ্টিকে আমার হাতে দিতে চাইছেন? আপনার কি মনে হয় না আমি তাকে অসুখী করব?

– এই যে তোমার উপলব্ধিটা আছে এটাই যথেষ্ট তোমাদের সুখের একটা সংসার হতে। তুমি শুধু হ্যা বলো অর্ণব বাকিটা উপরওয়ালা ঠিক করে দেবেন।

নিজের প্রেমকে পাওয়ার আগে হারিয়ে ফেলার দুঃখটা অর্ণবকে কতটুকু ছুলো সে ব্যাপারে কেউই অবগত রইলো না। নুপুরদের বাড়ি থেকে ফেরার দিন চারেক বাদেই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেল অর্ণব, বৃষ্টির। কিভাবে কি হলো সে কথার ধার দিয়ে গেল না কেউ বলা ভালো, অর্ণবই যেতে দেয়নি। খালুজানের সাথে কথা শেষ করে বাড়ি ফিরে দাদীকে জানালো, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে আমার বিয়ে অর্নিকে বলে দিও ছুটি নিয়ে বাড়ি আসতে।

দাদী কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিলেনই তখন আবার বলল, বৃষ্টির সাথে বিয়ে৷ এ নিয়ে কোন আপত্তি বা বাড়তি কথা না হোক । বড় দাদার বাড়িতে দাওয়াত করে দিও দাদী আমি অফিসে দু’জনকে বলব।

সপ্তাহ খানেকের ব্যবধানে বিয়ের তারিখ! অর্নিতা অবাক হয়ে তাকায় রিদওয়ানের দিকে। তার একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে অথচ সে দাওয়াত পেল এই মাত্র। অবাক হয়েছে রিদওয়ানও যখন দাদী ফোন করে বলল, আগামী মঙ্গলবার বউ নিয়া আইসো ভাই আমার নাতির বিয়া।

-কি বলছেন দাদী।

– তোর বাপ জিতছে ভাই। বৃষ্টির লগে আমার নাতির বিয়া হইবো দাওয়াত রইলো।

রিদওয়ান ঢাকা থেকে আজই ফিরেছিল চট্টগ্রামে। অর্নি তখনো হলে। হাতের ছুটি ফুরিয়ে আসছে অথচ নিজেরা ইচ্ছেমত সময় কাটানো তো দূর পারিবারিক অশান্তি কাটিয়ে একত্রে একটু সময় কাটানোর সুযোগ পাচ্ছে না। রায়না টের পাচ্ছিলো ছেলেটা মানসিক বিপর্যস্ততা তাই আজ ভোরে জোরেই পাঠিয়ে দিলেন চট্টগ্রামে। অর্নিকেও জানিয়ে দিলেন প্রস্তুত থাকতে রিদওয়ান এলেই যেন কোন হোটেলে ওঠে তারা। দুজনে সবেই এসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলো হোটেল রুমে। অমনি দাদীর কল এলোমেলো করে দিলো আবারও মুহূর্ত তাদের। কোথাও কি একটু শান্তির দেখা মিলবে না? রাতে কথা হলো অর্ণবের সাথে। এবার আর তর্কবিতর্ক নয় ; মুখের ওপর দু চার প্রশ্নে অর্নি জেনে নিলো ভাইয়ের হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের কারণ। অর্ণবও ভণিতা ছাড়াই বলে দিলো, বয়স হয়েছে বিয়ে করতেই হবে। নুপুরকে করতাম গিয়েছিলাম প্রস্তাব নিয়ে তার বাবা আগেই কোথাও কথা দিয়ে ফেলেছেন।

-তাই বলে বৃষ্টি আপুকে করবে?

-সমস্যা কি? সব তো জানে সে। এডজাস্ট করতে অসুবিধা কম হবে।

-আমি একবার কথা বলি নুপুরের সাথে?

-বিয়ের দাওয়াত দিতে চাইলে অবশ্যই করবি। খবরদার… এর বাইরে অন্য কিছু না।

শেষ বাক্যের কাঠিন্যতায় চমকে উঠেছিল অর্নিতা। ভাইয়ার কণ্ঠস্বর যেন ধারালো তলোয়ার। একটুও আর বুঝতে বাকি নেই ভাইটার অন্তরে ঠিক কতোটা আঘাত লেগেছে। অর্নি আর এক মুহূর্তও থাকতে চাইলো এ শহরে। এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল নিজের স্বপ্নের পড়াশোনার কথা। রিদওয়ান মানতে না চাইলেও পরের দিন ঠিক জোর করেই সে ঢাকায় ফেরার বন্দোবস্ত করিয়ে নিলো। একটা ক্লাস মিস না দেওয়া মেয়েটা একটা সপ্তাহের জন্য তৈরি হয়ে গেল ঢাকায় ফিরবে। রিদওয়ান অনেক বুঝিয়ে একটাদিন রেখে পরেরদিন সত্যিই ফিরে গেল ঢাকায়। পরপর লম্বা জার্নি এবার অসুস্থ করে দিলো তাকে। ঢাকায় ফিরে অর্নি শ্বশুর বাড়ি গিয়ে রাতটা থাকলো। পরের দিন সকালের নাশতা নিজেই তৈরি করলো সে। খেতে বসে বাশার শেখ আজ বেশ আনন্দিত গলায় কথা বললেন সকলের সাথে। অর্নির বিয়ের পর থেকে তাকে এক প্রকার উচ্ছিষ্টের মত এড়িয়ে চলছিলেন আজ আর তা করলেন না বরং নিজ থেকেই বললেন, খুশি হলাম তোমরা আগেই বাড়ি এসেছো বলে। ও হ্যা তোমাদের রিসেপশনের ব্যাপারটার করা হলো না তাড়াহুড়ায়। অর্ণব হুট করেই প্রস্তাব গ্রহণ করলো তাই আপাতত অল্পতে বিয়েটা সেরে ফেলছি তোমরা আবার এ নিয়ে মনে রাগ পুষে রেখো না।

অর্নি মাথা নিচু রেখে শুনলো পুরো কথা। ভাবছিলো সে যা বলতে চায় তা এখনই বলবে কি বলবে না! বাশার শেখ তার আগেই আবার বললেন, তোমাদেরটাও করব। রিমনের বিয়ের সময় একসাথেই করে ফেলব রিসেপশনটা।

-আমার বিয়ে আসছে কোথা থেকে আব্বু?

বাবার কথা শুনে খাওয়ার মাঝেই কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলো রিমন। অর্নি বুঝলো তার যা বলার সে এখন কিছুতেই বলতে পারবে না। বাবা ছেলের কথার মাঝে থাকার তার প্রয়োজনও দেখছে না সে তাই ডাইনিং স্পেস ছেড়ে চলে গেল দোতলায় রিদওয়ানের ঘরে। এ বাড়িতে পা রাখার ইচ্ছেটা তার অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল বাবা সমতূল্য খালুজানের অপমানজনক কথাগুলোর পর থেকেই। তবুও এলো মনে মনে কিছু পরিকল্পনা করে ঠিক ছেলের বউ হয়েই। ঘরে ঢুকে বিছানায় তাকাতেই চোখে পড়লো ঘুমন্ত রিদওয়ানকে। বিছানায় ঠিক পাশ ঘেঁষে বসে আলতো হাতে রিদওয়ানের চুল টেনে দিলো। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই ঘুম হালকা হয়ে গেলো তার। একটু সময় নিয়ে ডেকে উঠলো, অর্নি!

-হু বলো।

-উঠে গেছিস?

-অনেক আগেই।

-গোসলও করে ফেলেছিস?

– সেই কখন?

-এটা তো ভারী অন্যায়।

উপুর হয়ে শুয়ে ভারী স্বরে থেমে থেমে বলছে রিদওয়ান। অর্নি মুচকি হাসলো।

– অন্যায় কেন?

-নতুন বউরা বরকে ছাড়া গোসলে যায় না।

-আমি নতুন বউ?

– পুরনো হয়েছিস নাকি!

-বিয়ের তো বছর হলো।

-সংসার তো হয়নি।

– ভুল হয়ে গেছে মশাই।

-তা এত জলদি কেন উঠেছিস?

-শ্বশুরবাড়িতে বেলা করে ঘুমানো যায় বুঝি!

-তোর শ্বাশুড়ি তো মহৎ প্রাণ দেরি করলে কিছুই বলবে না।

-তবুও উঠলাম একদিনের সংসারের জন্য।

এ পিঠ হয়ে শুলো রিদওয়ান। চোখের ঘুম কেটে গেছে তার। চোখ ঘষে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ।

-একদিনের সংসার বলতে!

-কাল আমি চলে যচ্ছি বাপের বাড়িতে।

শোয়া থেকে এবার উঠেই বসলো রিদওয়ান। কি বলছে তার বউটা এসব!

-মানে!

-আমার ভাইয়ের বিয়ে। বাড়িতে আয়োজন করার মত কেউ নেই তাই আমি ওখানেই থাকব। তোমারও তো বোনের বিয়ে তুমি এখানেই থেকো।

-এই সিদ্ধান্ত কখন নিলি?

-কাল রাতেই।

হতাশ চোখে তাকালো রিদওয়ান। এ কি বলছে অর্নিতা। অবিশ্বাস্য লাগছে কথাগুলো। অর্নিতা বলছে এসব!

-খালামনিকে এখনো বলিনি। রাতে খালু এলে জানিয়ে দেব।আর…

-আর কিছু বলিস না।

-নুপুরের সাথে একটিবার দেখা করব কাল। তুমি কি যাবে সাথে?

এ পর্যায়ে ভীত হলো রিদওয়ান। অর্নিতা কি রেগে আছে কারো ওপর? নুপুরের ওপর! দেখা করে কি ঝগড়া করবে মেয়েটার সাথে? এজন্যই কি চাইছে সেও সাথে যাক। অসম্ভব! এই মেয়ে তো ঝগড়া করতেই জানে না। উফ, রাতটা যত মধুর কেটেছিল সকালটা ঠিক ততোটাই এখন তিক্ত ঠেকছে। এত বিতৃষ্ণা কেন তার জীবন ভর্তি!
_____

-ওই লম্বা ভাইয়াটা কি আবার আসবে আম্মু?

-কোন ভাইয়া?

-ওই যে স্ট্রবেরি আর দামী সব ফল নিয়া আসছিলো যেই ভাইয়াটা।

আইসক্রিম চাটতে চাটতে মাকে প্রশ্ন করছে তুতুন। পাশেই বসে আইসক্রিম খাচ্ছে নুপুর। একটু আগেই গলির মাথায় পাঁচ টাকা করে কুলফি, মালাই দেখে নুপুরের কাছ থেকে টাকা নিলো তুতুন। নিজের জন্য কিনতে গিয়ে বোনের জন্যও আনতে ভোলেনি। সেই আইসক্রিম নিয়েই দু ভাই বোন সোফায় বসেছে পা গুটিয়ে। ছোট মা তাদেরই পাশে কুরুশ-কাঁটায় ব্লাউজের হাতা বুনছিলেন। তুতুনের কথা শুনে কৌতূহলী হয়ে তাকায় নুপুর। বাড়িতে সেদিন মেহমান এলো মিষ্টি নিয়ে সাথে ছিলো কয়েক পদের ফল। তুতুন বোধহয় সেগুলোর কথাই বলছে কিন্তু ভাইয়াটা কে? যে পাত্র এসেছে ওই ব্যাটা তো দেখতেই বুইড়া। তুতুন মায়ের জবাবের অপেক্ষায় না থেকে আবার বলল, ওই ভাইয়ার গোঁফ না পুরাই তামিল নায়কের মত।

গোঁফ! ছ্যাৎ করে যেন উঠলো অন্তরটা। কি বলল তুতুন? ওই লোকের তো গোঁফ ছিল না। কে এসেছিলো সেদিন বাড়িতে?

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২৮(খ)

রাতে ঘুমানোর আগেই কলটা এলো অর্নিতার। নিজের আংটিবদলের খবরটা তো প্রিয় বান্ধবীর জানার অধিকার আছে ভেবেই সকল মন খারাপকে পাশে সরিয়ে কলটা ধরলো নুপুর।

-কি খবর বান্ধবী কেমন আছো?

-আমি যেমনই হোক তুই নিশ্চয়ই খুব ভালো আছিস তাই নারে!

অর্নিতার কথার ধরণেই বোঝা গেল রেগে আছে মেয়েটা।

-হ্যাঁ, এই তো ভালো…

-এজন্যই আর খোঁজ নিচ্ছিস না আমাদের।

-নিতাম। একটু ব্যস্ত ছিলাম।

-হু তাতো অবশ্যই। সকাল বিকাল হবু বরকেও নিশ্চয়ই সময় দিতে হয়!

-তেমন কিছু না।

-কাল একটু দেখা করতে পারবি? বাইরে।

একটু সময় নিয়ে তারপর নুপুর জবাব দিলো ‘হ্যা’। তাতেই যেন অর্নিতার রাগ চড়া হলো। সে এবার দাঁতে দাঁত চেপে বলে বসলো, সমস্যা হলে তোর হবু বরের কাছেও না হয় অনুমতি চেয়ে নেব কি বলিস?
এ পর্যায়ে এসে চমকে গেল নুপুর। এত রাগ! কি করেছে নুপুর? পরমুহূর্তেই মনে পড়লো তুতুনের কাছ থেকে একটু আগেই জানতে পারা ঘটনা। অর্ণব এসেছিলো সাথে ছিলো বৃদ্ধা তারমানে দাদী! নুপুর নিজের ফোন থেকে অর্ণবের একটি ফটো দেখাতেই তুতুন জানালো, হ্যা এই ভাইয়াটাই এসেছিলো৷ তবে কি তারা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল আর বাবা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন! ঠিক সেকারণেই বোধহয় অর্নিতার এত ক্ষোভ, এত রাগ তার ওপর। হতাশামিশ্রিত নিঃশ্বাস ফেলে নুপুর জানিয়ে দিলো কাল সে আসছে দেখা করতে৷ কাল নুপুর নিজেদের ভেতরকার সকল অভিমানের পলেস্তরা খসিয়ে নতুন প্রলেপে বন্ধুত্বটা রাঙিয়ে আসবে। অর্ণবকে তার পাওয়া হবে না এ জীবনে তাই বলে কি বোনের মত বান্ধবীকে হারাতে দেবে! কক্ষনো না।

_______

যেমনটা অর্নি ভেবেছিলো তেমন কিছুই হয়নি। সকালে নিজের মত কথাগুলোও সবাইকে বলতে পারেনি রিমন আর খালুর বিয়ে নিয়ে আলাপ শুরু হওয়ায়। অর্নি আজ নাশতার টেবিলে বসেও যখন দেখলো খালুজান আর রিমন ভাই বিয়ে নিয়ে প্রায় তর্কযুদ্ধে লিপ্ত তখন বৃষ্টি আপুও পিছিয়ে নেই। তবে তাদের কথাবার্তার এক পর্যায়ে এসে অর্নির মনে হলো এ পরিবারে তিনটে মানুষ বড্ড জেদি আর আপন স্বার্থে তৎপর। তারা কিছুতেই এক চুলও স্বার্থহীন আপোষ করতে রাজি নয় তবে রিমন ভাইকে যতটা অর্নি চিনতে পেরেছে তাতে স্পষ্ট রিমন ভাই বিবেচক এবং যথেষ্ট দায়িত্ববান মানুষ। বাড়ির বাকি দুই সদস্য খালামনি আর তার একান্ত ব্যক্তিটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এরা দুজন ভীষণ কোমল হৃদয়ের আর আপনজনদের প্রতি অনুগত। এতোটাই যে তারা আপনজনদের জন্য নিজের নিঃশ্বাসটাকেও আটকে রাখতে প্রস্তুত। অথচ দিনশেষে এই দুজনই ভোগে কাছের মানুষের অবহেলা,নিগ্রহ। এ বাড়িতে অর্নি তার বর্তমান অবস্থানের জন্য কিছুটা ভিন্ন আচরণ পাচ্ছে এখন তাই সেও কিছুটা পরিবর্তিত আচরণ করছে। আজও তার বাড়ি যাওয়া হলো না বলে রিদওয়ানকে বলল, কাল বাড়ি চলে যাব। তুমি নিশ্চয়ই এখানে থাকবে?

কথাটা প্রশ্ন কম যেন জবাবই শোনালো সে। অনলাইনেই কিছু জরুরি ইমেইল চেক করছিল রিদওয়ান। ছুটি তার শেষের দিকে। অর্নিকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি কাগজপত্রেই মূল ঝামেলা তা নিশ্চিত হয়ে এখন এক বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করছে। সে চাইছে অর্নি তার ডাক্তারি পড়া বিদেশেই কোথাও কমপ্লিট করুক। অর্নির একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলেই সেও মুভ করবে অর্নির কাছে। কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না। এদিকে অর্নির বলা কথাও তার কানে ঢুকেনি।

-কি হলো কিছু বলছো না যে!

-কিছু বললি? রিদওয়ান প্রশ্ন করলো।

“তুমি শুনতে পাওনি?”

– আবার বল।

” আমি কাল বাড়ি যাব তুমি এখানে থেকো।”

-কেন?

“বিয়ের আর দু দিন বাকি৷ বাড়িতে দাদী একা একা কি করবে?”

রিদওয়ান এবার ফোন ছেড়ে অর্নির মুখের দিকে তাকালো। ফর্সা মুখটাতে মেদুর ছায়া পড়েছে। চিন্তার রেখা তার কপাল জুড়ে স্পষ্ট। চশমার আড়ালে চোখদুটোও ভারী বিষন্ন। মায়া হলো খুব রিদওয়ানের। এতটুকু বয়সেই কত ঝঞ্জাট পোহাতে হচ্ছে কখনো তার কারণে কখনোবা তার বোনের কারণে। বৃষ্টির জেদ বাড়াবাড়ি হয়ে উঠেছে এবার আর অর্ণব সব জেনেবুঝে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে। নুপুরদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া থেকে বৃষ্টিকে বিয়ে করতে রাজী হওয়া পর্যন্ত সবটাই রিদওয়ানের জানা। অর্ণবের সাথে তার সম্পর্ক ভাই কম বন্ধুত্বটাই বেশি। সে ভেবেছিল কিছু একটা করে বৃষ্টিকে বোঝাবে অর্ণব তার জন্য সঠিক পাত্র নয়। বোনটা বড্ড গোঁয়ার শুনলোই না কিছু। এখন অর্নির কথা শুনে সে ভাবছে শেষ একবার বাবার সাথে কথা বলবে। বাবাই একমাত্র ব্যক্তি যে পারে বৃষ্টিকে বোঝাতে। অর্নিকে বলল, আমিও যাব তোর সাথে।

পরেরদিন সকালের নাশতায় বাবার পাশে রিদওয়ান বসে আছে। টেবিলে নাশতা সাজাচ্ছে অর্নিতা খালামনি তখন রান্নাঘরে। আজ নাশতায় রিমন আর বৃষ্টির দেখা মিলল না। বাশার শেখ নাশতার প্লেট সামনে নিতে নিতেই ছেলেকে প্রশ্ন করলেন, কি বলবে?

নাশতার টেবিলে উপস্থিত ছেলেকে উশখুশ করতে দেখেই বুঝতে পারলেন কিছু বলতে চায় ছেলেটা। রিদওয়ানও সময় নষ্ট না করে বলল, বৃষ্টির বিয়েটা অর্ণবের সাথে দেয়া ঠিক হচ্ছে না।

– কার সাথে দিলে ঠিক হতো ওই যে ওই ছেলে কি যেন নাম যে ক’বছর আগে তোমার বোনকে এড়িয়ে গেল?

-ওই ছেলেটার আর্থিক অবস্থার আমাদের চেয়ে খারাপ বলে ভয়ে এড়িয়েছিল বৃষ্টিকে। আর আব্বু ছেলেটাকে আপনি ভয় দেখিয়েছিলেন।

-আর সেও ভয় পেয়ে চলে গেল! অমন ছাগলের কলিজা নিয়ে আসা ছেলের কাছে মেয়ে তুলে দেব আমি?

-সে কথা বলছিনা আমি কিন্তু অর্ণবও বৃষ্টির জন্য সঠিক চয়েজ নয়।

অর্নি চুপচাপ পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। সে শুনছে খালু আর রিদওয়ানের কথা তার বলার কিছু নেই।

বাশার শেখ আবার বললেন, “তুমি দেশে এসেছো বোনের বিয়ে খেতে, ছুটি কাটাতে তাতেই মন দাও। আমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে না ভাবলেও চলবে।”

– ওকে, তাই হবে তবে বলে রাখছি যা করছেন মোটেই তা ভালো হচ্ছে না। মেয়ের চোখের জল আজীবন সয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন আব্বু।

কথাটা শেষ করেই রিদওয়ান উঠে পড়লো। নাশতা আর করা হলো না তার। সে নিজের ঘরে যেতে যেতে অর্নিকে বলে গেল, আধঘন্টার মধ্যে তৈরি থাকবি তোকে ও বাড়ি রেখে আসব।

বাশার শেখ কানেই নিলেন না ছেলের কোনো কথা। অর্নিকে বললেন, “তুমি কি আজ ও বাড়ি চলে যাচ্ছো?”

-জ্বি খালু, দাদীর পক্ষে একা বিয়ের আয়োজন করানোটা মুশকিল…

-ও আচ্ছা যাও তবে। আর কিছু কাজে সাহায্যের প্রয়োজন হলে আমাকে জানিয়ে দিও লোক পাঠিয়ে দেব। তুমি একা আর কি কি করতে পারবে!

________

সকাল সকাল যাবে বললেও খালামনির সাথে টুকটাক কাজ করতে গিয়ে দুপুর হয়ে গেল অর্নির। কথা ছিল নুপুরের সাথে দুপুরে দেখা করবে তাই বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগেই একটিবার কল করলো নুপুরকে। সে জানালো চলে আসছে অর্নির বলা লোকেশনে। রিদওয়ান সঙ্গে যেতে চাইলে অর্নিতা বলল, ” তুমি ভাইয়ার সাথে শপিংয়ে যাও। ভাইয়ার জন্য কেনাকাটা শেষ করো ততক্ষণে আমি নুপুরের সাথে কথা বলে চলে আসব।”

রিদওয়ান চমকে গেল অর্নিতার কথার ধরণে। স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠস্বরে বলে চলছে কথা। হুট করেই যেন ভারী গম্ভীর হয়ে গেল মেয়েটা। তার মনের অবস্থাটাও বোঝে রিদওয়ান তাইতো সেও সাপোর্টিভ আচরণ করছে। আলতো করে কাঁধ ছুলো অর্ধাঙ্গিনীর।

– তুই রেগে আছিস নুপুরের ওপর কিন্তু ভেবে দেখছিস না মেয়েটা কোন পরিস্থিতিতে আছে। একটিবার নিজেকে অর্ণবের বোন নয় শুধুমাত্র নুপুরের বান্ধবী হয়ে চিন্তা কর ওই মেয়েটার কথা। তার কতোটা কষ্ট হচ্ছে ভালোবাসার মানুষকে ফিরিয়ে দিতে।

অর্নিতা একেবারে চুপচাপ গাম্ভীর্যে ডুবে আছে যেন রিদওয়ানের কোন কথাই তার কর্ণগোচর হয়নি। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে রিদওয়ান আবারও বলল, তুই নিজেকে দিয়েই ভাব যখন তোর বিয়ে ঠিক হলো শিবলী ভাইয়ের সাথে….

-আমার মা-বাবা নেই সে কথা ভুলে যেওনা। আমরা বড় হয়েছি অন্যের ছায়ায় তাই মুখে জোর, মনে সাহস ছিল না।

চোখজোড়ায় উষ্ণ জলের আভাস অর্নিতার। তাকে আর ঘাটিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়তে দিতে চায় না রিদওয়ান তাই প্রসঙ্গ পাল্টে দিল।

-দুইটা বাজতে চলল, খিদেও পেয়েছে। জলদি চল আমি তোদের সাথে লাঞ্চ করব তারপর যাব অর্ণবের কাছে।

অর্নি শুনলো সে কথা। তৈরি হয়ে বের হলো দুজনে। তাদের একসাথে বের হতে দেখে বৃষ্টি উচ্ছ্বসিত হলো। যাক বাবা, অর্নিটা তবে এই বিয়ে নিয়ে আপত্তি তুলছে না নইলে বিয়ের শপিংয়ে যাবে কেন! যত শত্রু তার নিজের মায়ের পেটের ভাই দুটোই এমনই ভাবনা বৃষ্টির মনে।

_______

“শাড়ির আঁচল ছড়ায়া ধরো। নেও খোঁপায় ফুলডাও দেও” বলেই ছোট মা হাতে থাকা গাঢ় লাল গোলাপটা এগিয়ে দিলো। হবু বরের সাথে দেখা করবে আর সাজবে না তা কি করে হয় এমনটাই ছোট মায়ের কথা। সৎ মায়ের খেতাব পাওয়া মহিলাটি নুপুরকে ভালবেসে এমন কিছু বলছে না বরং ঘাড় থেকে বোঝা নামানোর চিন্তায় তার সাজ নিয়ে চিন্তিত। এমনেই গায়ের রঙের জন্য এই মেয়ের পেছনে যৌতুক লাগবে বলে শুনতেই মনে মনে ক্ষোভ পুষছে। নুপুরের মন মানছে না শাড়ি গায়ে নিতে। সেতো অন্য একজনের নামে নিজেকে সাজায় রোজ সেখানে অপরিচিত পুরুষের জন্য সাজটা তার সহ্য হচ্ছে না। তার গোঁফওয়ালা জল্লাদমুখো মানুষটা তাকে চাইতে এসেছি। আহ্ তার ভাগ্য! যাকে ভালোবেসে পাগলামিতে ডুবাতে চেয়েছিল তাকে পাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেল। ছোট মায়ের সাজ নিয়ে আদিখ্যেতা কাঁটার মত ফুটছে গায়ে। খোঁপায় দিতে চাওয়া ফুলটাকে সরিয়ে দিতে চাইলো নুপুর।

-ফুল লাগবে না।

-কইলেই হইলো নাকি! পোলা আসবো সাথে ভাবী, বোনরাও থাকব। পাগলের বেশে গেলে কথা হইবো খুব পরে তোমার বাপে খোঁটা আমারেই দিব। সৎ মা বইলা কথা।

মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে নুপুরের এদিকে সময়ও থেমে নেই। অর্নিতা নিশ্চয়ই চলে এসেছে এতক্ষণে। তারওপর ওই বুইড়া লোক সময় দিয়েছে তিনটার তাতে সময় কতটুকু পাবে অর্নির সাথে কথা বলার! ঘড়ির কাটা দুই পেরিয়ে গেছে ভাবতেই তাড়াহুড়োয় বের হলো নুপুর। একা একা হবু বরের সাথে দেখা করতে যাওয়াটা খারাপ দেখায়। বাবা বলেছে ছোট মাকে সঙ্গে নিতে। নুপুর সে কথার ধার ধারেনি, ছোট মাও বিশেষ পাত্তা দেয়নি এ বিষয়ে। তাতেই সুযোগটা মিলল অর্নির সাথে দেখা করার। বাড়ির গেইট পেরিয়ে রিকশা পেতেই তাতে চড়ে বসলো নুপুর। হাতের পার্সে ফোনটাও নিতে ভুলে গেছে সে। অর্নির বলা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে পৌঁছুতেই বেজে গেল দুইরা চল্লিশ। আর মাত্র বিশ মিনিট হাতে। এতটুকু সময়ে সব কথা বলা হবে তো অর্নিকে! গুছিয়ে বলতে হবে অনেক কথা, বোঝাতে হবে সে ফেরায়নি তার মনপুরুষটিকে। সেতো জানতোই না মানুষটা তার দোরে কড়া নেড়েছিলো তাকে আজন্মকালের সঙ্গী করতে। যার জন্য অন্তরকূপে ভালোবাসার তরল জমা তাকে ফেরাবে এমন সাধ্য নুপুরের আছে নাকি! অর্নি বিশ্বাস করবেতো তাকে? কে জানে তারা ভাই বোন তাকে ভুল বুঝে দূরেই না সরে যায়! আর ভাবতে ইচ্ছে হলো না নুপুরের। রিকশা থেকে নেমেই সে আঁচল টেনে পিঠ ঢেকে নিলো। খোঁপার চুলগুলোও এলোমেলো হয়ে গেছে বাতাসে, কাজলটাও বোধহয় ছড়িয়ে গেছে চোখের নিচে। হাতে ফোনটা নেই অর্নিকে কি করে জিজ্ঞেস করবে সে এসেছে কিনা! ভেতরে ঢুকেই দেখা যাক! কয়েক পা এগিয়ে রেস্টুরেন্টের কাঁচের দরজাটা টেনে ধরতেই থমকে গেল নুপুর। থমকে গেছে ওপাশেও একটি মানুষের পা। হঠাৎ শিরশিরে এক হাওয়া বয়ে গেল দুজনের মধ্যিখানে। তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে হঠাৎ ছলছলে জলের প্রাপ্তি টের পেল নুপুর। আজ কতকটা দিন সে তৃষিত ছিল এই মুখটা দেখার জন্য! ঠিক কতকটা দহন হয়েছিলো তার ভেতর-বাহিরে! সামনের মানুষটারও কি একই অনুভূতি! নাহ্ ভ্রম সব। এইতো সরে গেল সামনে থেকে মানুষটা। দু কদম পিছিয়ে ডেকে উঠলো অর্নিতাকে, “খাবার অর্ডার দে অর্নি খেয়ে আবার বিয়ের শপিংয়েও যেতে হবে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেল। রিদওয়ান এক কাজ কর তো বৃষ্টিকে কল দিয়ে বল চলে আসতে। হবু বউকে ছাড়া শপিং ভালো লাগে নাকি!”

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-২৭

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২৭(ক)

যাকে ভালোবেসে কখনো ছুঁয়ে দেখার অধিকার নেই তাকেই রাগে-ক্রোধে থাপ্পড় বসিয়েছে। বয়সের ফারাকটাও তখন মাথায় আসেনি এতোটাই ছিল রাগের মাত্রা অথচ বাড়ি ফেরার পর থেকেই মনটা পুড়ে যাচ্ছে। আচ্ছা ফোন করে একটি বার মাফ চেয়ে নেয়া উচিত না! পরক্ষণেই মনে হলো কিসের উচিত, ভালোবেসে যে ভালোবাসার মানুষকে আপন করতে জানে না তার মত কাপুরুষ, নির্বোধকে শুধু থাপ্পড় নয় ফাঁসিতে ঝোলানো উচিত। রাগের বশে এলোমেলো ভাবতে ভাবতেই রাতটা পার হলো নুপুরের। বাবা সে রাতে ব্যস্ততার জন্য বাড়ি ফিরেছেন অনেক রাতে তাই চেয়েও মেয়েকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি। সকাল হতেই নাশতা শেষে নুপুরের ঘরে এলেন। আজ ভার্সিটিতে যাবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সে।

-কাল কোথায় গিয়েছিলি?

ভারী গম্ভীর শোনালো বাবার কণ্ঠস্বর। এর আগে কখনো এমন স্বরে কথা বলেননি তিনি।

– একটা টিউশনি….

-একদম মিথ্যে বলবি না আমার সাথে। আমি নিজে দেখেছি তোকে কলেজ রোডে এক ছেলের বাইকে উঠতে।

চমকে গেল নুপুর বাবার কথা শুনে। বাবা দেখে ফেলেছে তাকে!

-সত্যি করে বল কোথায় গিয়েছিলি? ছেলেটা কে সেটাও আমার অজানা নয়। বান্ধবীর ভাইয়ের সাথে ভর দুপুরে বাইকে চেপে গেলি ফিরে এলি সন্ধ্যার পর। তোর কি মনে হয় তোকে কেউ চিনবে না, কিছু বলবে না!

বাবার কথাগুলো শুনেই হাত পা জমে যাচ্ছে নুপুরের। কি জবাব দেবে সে! তার জবাব বাবার পক্ষ থেকেই এলো, ‘আজকের পর কোনরকম যোগাযোগ যেন না থাকে ওই ছেলের সাথে। এমনকি তার বোনের সাথেও দরকার নেই। পড়ালেখা অনেক করেছিস আর লাগবে না। বাড়ির কাজকর্ম শিখে নে আমি শিগ্রই তোর বিয়ে দেব।’

নাজিম সাহেব নিজের বক্তব্য শুনিয়ে চলে গেলেন মেয়ের ঘর থেকে। মেয়েকে যখন দেখলেন ওই ছেলের বাইকের পেছনে বসতে তখন না চমকালেও এক মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন অতি শিগগিরই মেয়ের বিয়ে দেবেন। ছেলেটাকে চেনার পর থেকে যথেষ্ট ভালো লাগতো। তাদের পরিবারের খবর খুব বেশি না জানলেও মেয়ের সখ্যতার জন্যই কিছুটা খোঁজখবর রাখতেন সেই সুবাদেই কিছুটা জানা। এই ছেলের মা-বাবার সম্পর্ক ভালো ছিলো না মূলত বাবার পরনারী আসক্তি, নেশাপানি করা এসবেই মা বাবা আলাদা হলো৷ দুটো ভাইবোন তারা একজন বড় হলো খালার বাড়ি আবার বিয়ে হলো সেই খালারই ছেলের সাথে বিয়ে। কথা ছিল অন্য খালার ছেলের সাথে বিয়ে হবে। সব মিলিয়ে তাদের পরিবারে কিছুই ঠিক মনে হয়নি নাজিম সাহেবের তবুও মায়া হতো অর্নি মেয়েটার জন্য তাই নিজের মেয়েকে তেমন নিষেধাজ্ঞা দেননি মিশতে। নিজেই বরং স্নেহের চোখে দেখে এসেছেন তাদের ভাইবোনকে তাই বলে অমন পরিবার ছাড়া ঘরে মেয়ে দেবেন তাও আবার টাকার দিক থেকে নিজের চেয়ে অনেক উপরের ঘরে অসম্ভব! মনে মনে সাজিয়ে নিলেন কিছু কথা। কালই একবার ওই ছেলের সাথে কথা বলে মনের সংশয় দূর করবেন। পরের দিন সকাল বেলায় কড়া গলায় মেয়েকে আরেকবার বলে গেলেন বাড়ি থেকে বের না হতে এমনকি ফোনে ফোনেই টিউশনগুলোও ছাড়তে বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন নাজিম সাহেব। নুপুর খেয়াল করলো আজ বৃহস্পতিবার, বাবা আজ ঘরের রংমিস্ত্রি খবর দিয়েছিলেন বাড়ি রঙ করাবেন বলে৷ অথচ সকাল হতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন কাউকে কিছু না বলে। এমন সময় ছোট মা এলেন ঘরে।

-তোমার আব্বা কই গেলো সকাল সকাল?

নুপুর অবাক হলো ভীষণ। বাবা ওনাকেও বলেনি কোথায় যাচ্ছে!

-আমাকে তো কিছু বলেনি।

-মিছা কথা কও ক্যা! কালকা ঘরের ভিতর ফুসুরফাসুর তো শুনলাম বাপ মাইয়ার। তারপরই দেখলাম ঘটকরে ফোন দিলো আবার কয়েকদিন ধইরা বাড়ি রঙ করব বলতাছিলো। কি আকাম করছো সত্যি কইরা কও তো মাইয়া। হইছো কাইল্লা তারমধ্যে আকাম করলে বিয়া তো দূর মাইনষে থুতু দিতেও আইবো না। হুহ…

হঠাৎ বৃষ্টির মত কেমন ঝপাঝপ কতগুলো নোংরা ইঙ্গিতসহ বাক্য বাণ ছুঁড়ে দিলো ছোট মা। বাবা কি কালকের কথাগুলো উনাকেও বলেছে! ছিহ, এমনই কেন হতে হবে সৎমায়েদের। খায়, পরে বাবার তার অধিকার আছে তবুও এমন কেন বলতে হয় সৎমায়ের! অর্ণবের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোই কেমন বিষছোবল দিচ্ছিলো কাল সেই সাথে বাবার সন্দেহ। সবকিছুতেই এবার বিতৃষ্ণা এসে যাচ্ছে তার। চোখ মুখ বুঁজে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে পড়ে রইলো নুপুর। সব দোষ ওই জল্লাদমুখো মানুষটার। কি হতো যদি তাদের দেখা না হতো! পরমুহূর্তেই ভাবনায় এলো ওই মানুষটা একদমই দোষী নয়। অনাহূত দোষ চাপানো অন্যায় হচ্ছে তার। লোকটা কখনোই তাকে প্রশ্রয় দেয়নি এমনকি তার আগে কখনো তাকে নিয়ে ভাবতেই চায়নি৷ শুরুটা তো সে নিজেই করেছিলো দুনিয়ার সর্বোচ্চ বেহায়া মেয়েটি হয়ে। হ্যাঁ সে নিজেই বেহায়া হয়েছে উল্টো অর্ণব তাকে সতর্কতার সাথে এড়িয়ে গেছে অনেক অনেকটা দিন। দু চোখ ডুবলো এবার জলধারায়। সময় বোঝাবে তাকে বেহায়াপনার শাস্তি৷

_________

বরের আদুরে সান্নিধ্যে মেয়েরা হয় প্রস্ফুটিত পুষ্প। অর্নিতাও হয়েছিলো একরাতের অর্ধেকটা। এরপরের সকালেই সে আবার মূর্ছা গেল একমাত্র ভাইয়ের বিরহ ভাবনায়। সকাল হতেই আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো গত দিনের দূর্ভাবনা কোনো না কোনোভাবে তাকে ঘিরেই যা সংগঠিত হয়ে আছে। ভাই তার যতই অস্বীকার করুক সে তো জানে তার বিয়ে নিয়ে খালুজান কতোটা নাখোশ! সে এও জানে রিদওয়ানের সাথে তার বিয়ে হয়েছে বলেই কয়েক’শ কোটি টাকার অসীম এক লোকসান গুনতে হয়েছে খালুজানকে। দাদী বলতো যার যত আছে তার ততই চাই। খালুজান কতবড় ব্যবসায়ী, তাঁর টাকার পরিমাণ কেমন আর এ দেশের ঠিক কত বড় ধনীর কাতারে তিনি সে আন্দাজ অর্নিতার ছোট থেকেই আছে। যে মানুষটা দেশ ছেড়ে বিদেশেও সফল ব্যবসায় পরিচালনা করতে জানে, যিনি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অপ্রকাশিত রাজত্ব করতে পারছেন অর্থের জোরে তিনি অবশ্যই নিজের সন্তানের জন্যও সেই মাপের কোন পরিবার খুঁজবেন সেটাই স্বাভাবিক। অর্নিতা এও জেনেছে খালুজানের এই স্বাভাবিকতা শুধুমাত্র দুই ছেলের ক্ষেত্রেই, মেয়ের বেলায় তিনি সম্পূর্ণ আবেগী এক পিতা। কন্যাস্নেহে অন্ধত্বের শেষটায় আছেন খালু তাই রিদওয়ানের পছন্দে খুশি হননি। আগেই তো প্রস্তাব যেচে এসেছিলো রিদওয়ানের জন্য দেশের প্রথম সারির ধনাঢ্য পরিবারের পক্ষ থেকে। সেই প্রস্তাব পায়ে ঠেলে ছেলে যখন নিজের বাড়িতে আশ্রিতা খালাতো বোনকে বিয়ে করতে চায় বাবা হয়ে তিনি তা কি করে সহ্য করতেন! তাইতো একটি বছরের মাঝে একবারও পুত্রবধূ ঘরে তোলার মনোভাব ব্যক্ত করেননি। অথচ যেই জানতে পারলো মেয়ে পছন্দ করে বসে আছে অর্ণব ভাইকে অমনি মনে পড়ে গেল ছেলে আর তার বিয়ের কথা! আজব লাগলেও এটাই সত্যি অর্নিতা, রিদওয়ান এখন বাশার শেখের ছোট্ট প্রয়োজন এর বেশি কিছু নয়। ঘুম থেকেই উঠেই কান্নাকাটি শুরু করলেও হঠাৎই কান্না থেমে গেল অর্নিতার। কাতরমুখে তাকে জড়িয়ে পাশে বসে থাকা রিদওয়ান স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করতেই কানে এলো অস্বস্তিকর কথা,

-তুমি চলে যাও এখান থেকে। আজকের পর আমাদকোন সম্পর্ক থাকবে না আর।

-এসব কি বলছিস অর্নি!

হকচকিয়ে গেছে রিদওয়ান। অর্নিতার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?

-ঠিকই বলছি। সরো তুমি আমার কাছে আসার দরকার নেই আর। তুমি তোমার বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করো গে যাও৷ আমি আমার ভাইকে একটুও কষ্ট পেতে দেবো না।

বাকরুদ্ধ, স্তব্ধ আর মূক হয়ে গেছে রিদওয়ান। কি বলছে অর্নি! সর্বদা সল্পবাক থাকা অর্নি এক নাগাড়ে উদ্বাস্তুর মতো কি বলে চলছে এসব যেন কিছুই মাথায় ঢুকলো না রিদওয়ানের।

-আমার কথা শোন অর্নি। তুই ভয় পাচ্ছিস কেন বলতো আমি আছি তো…

কথাগুলো বলতে বলতে দু হাতের মাঝে রিদওয়ান জড়িয়ে নিতে চাইলো অর্নিকে। সেদিকে পাত্তা দিলো না অর্নি। সে রিদওয়ানকে ঠেলে সরিয়ে দিলো নিজের কাছ থেকে। রাতের বিবসনা দেহে ওড়না পেঁচিয়ে এগিয়ে গেল বেডসাইড টেবিলের সামনে। ওই তো ওখানেই আছে বার্থ কন্ট্রোল পিল ট্যাবলেট রিদওয়ানই কাল এনে দিয়েছিলো। সেটা হাতে নিয়ে ট্যাবলেটটা মুখে পুরে পাশেই রাখা বোতল থেকে পানি দিয়ে গিলো ফেলল। দ্রুত পায়ে ছুটে গেল বাথরুমে মুহূর্তেই আবার বেরিয়ে এলো। চঞ্চল হাতে ব্যাগ থেকে জামা বের করে আবারও ঢুকে গেল সে বাথরুমে। গোসল সেরে বেরিয়ে যাবে এখান থেকে আজ এক্ষুনি। রিদওয়ান তখনো হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে বাথরুমের দরজার দিকে। কি হচ্ছে এসব, কেন হচ্ছে কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না। মিনিট দশেকে বেরিয়ে এলো অর্নিতা৷ মাথা মোছা হয়নি চুল বেয়ে পানি পড়ছে, মুখে, চোখে কান্নার ছাপ স্পষ্ট। জামা পরেছে উল্টো আবার ওড়নাটাও নিয়েছে অন্য জামার। সে আর কোন দিকে না তাকিয়ে নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে দরজায় এগোলো। সেদিকে চলতি পথেই রিদওয়ানকে বলল, ‘আজকের পর আর কেউ নই আমরা দুজন দুজনার। তুমি বাড়ি ফিরে যাও তোমার বাবার কাছে। বিয়ে করে নিও ওই নাদিয়াকে।’

চমকে উঠলো রিদওয়ান। নাদিয়া! বিদ্যুৎ বেগে হুঁশ ফিরলো যেন তার। নাদিরার কথা অর্নিকে কে বলল৷ এবার খেয়াল হলো অর্নিতা বেরিয়ে যাচ্ছে৷ দুপদাপ পা ফেলে খপ করে ধরলো অর্নিতার হাত। জাপটে ধরলো বুকের মাঝে, এ্যাই অর্নি কি বলছিস এগুলো মাথা ঠিক আছে তোর! ওই মেয়েকে কেন বিয়ে করব আমি এসব কে বলেছে তোকে?

অর্নিতা জবাব দিলো না রিদওয়ানের কথার। সে রিদওয়ানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতেই আবার বলতে থাকলো, ‘আমি এতিম হয়েও সব পেয়েছি জীবনে। খালামনির কাছে মায়ের আদর, খালুজান দিয়েছিলো বাবার স্নেহ রিমন ভাই আর বৃষ্টি আপুর মাধ্যমে ভাই-বোনের সঙ্গ পেয়েছি তোমার কাছেও পেয়েছি জীবনসঙ্গির সর্বোচ্চ মুহূর্তগুলো৷ কিন্তু আমার ভাই….’

এ পর্যায়ে কান্নার দমক বেড়ে গেল অর্নির৷ নিজেকক ছাড়ানোর চেষ্টা বাদ দিয়ে রিদওয়ানকেই আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো৷ অস্পষ্ট উচ্চারণে বলে গেল সে, আমার ভাই পায়নি বাবা-মা আর একমাত্র বোনটাকে। নিজের জীবনের ক্রান্তিলগ্নে লড়াই করেছে একাকীত্বের সাথে তবুও শক্ত প্রাচীরের ন্যায় অটল দাঁড়িয়ে ছিল আমার দায়িত্ব, দাদাীর দায়িত্ব পালনের জন্য। মাত্র ষোলো বছর বয়সেই ব্যবসার পেছনে পরিশ্রম দিয়ে গেছে যেন এই আমাকে প্রয়োজনের সবটা নিজ অর্থে দিতে পারে। আজও আমার জন্যই নিজের খুশি বিসর্জনের জন্য পা বাড়াচ্ছে এটা আমি মেনে নেব? অসম্ভব। তুমি ফিরে যাও বাড়িতে। আমি বুঝতে পারছি খালুজান নিশ্চয়ই আমার নাম করেই জোর করছে ভাইয়াকে৷ বৃষ্টি আপু অনেক ভালো মেয়ে কিন্তু আমার ভাই তাকে ভালোবাসতে পারবে না।’

দম আঁটকে যেন উগরে দিচ্ছে সকল দুঃখ, যন্ত্রণা। রিদওয়ান চুপচাপ শুনে গেল অর্ধাঙ্গিনীর সকল ক্ষোভ, লুকানো কষ্টের ঢালি উল্টে দিলো সবটা ঢেলে। এই মেয়ে এত কথা কি করে বলছে! জীবনের সকল জমানো কথাই কি বলে দিচ্ছে অর্নি? মেয়েটাকে শান্ত করার কোনো উপায়ই যেন খুঁজে পাচ্ছে না রিদওয়ান। বাধ্য হয়েই অর্নিকে একহাতে জড়িয়ে বিছানায় বসিয়ে দেয় অন্যহাতে ডায়াল করে অর্ণবের নম্বর। কয়েক সেকেন্ডেই তা রিসিভ হয় ওপাশ থেকে। অর্নি তখনও একাধারে বলে চলছে, আমার ভাইকে কষ্ট দিলে আমি এ জীবনে আর কখনোই খালুজানের সাথে কথা বলবো না। তুমি চলে যাও এখান থেকে আমি আমার ভাইকে এবার আর দুঃখে দেখতে চাই না। ছাড়ো আমাকে…..

অর্ণবের কানে পৌঁছে গেছে বোনের হাহাকার ভরা আর্তনাদ। বুকের ঠিক ভেতরটায় গিয়ে লাগলো সে আঘাত। ওর খুশির জন্য জীবন দিতে ভাববে না অর্ণব সেখানে বৃষ্টিকে বিয়ে করা তো দুধভাত। অথচ বোনটাই দেখো কি অস্থির হয়ে কেঁদে ভাসাচ্ছে তার কথা শুনে। কে বলেছে তার জীবনে কারো আদর,স্নেহের কমতি আছে। তার জীবন তো পরিপূর্ণ বোন আর দাদীর ভালোবাসায়। কল কেটে আবার কল দিলো অর্ণব। রিদওয়ান ধরতেই অর্ণব বলল, ফোনটা অর্নির কানে ধর। তাই করলো রিদওয়ান। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল নিশ্চুপ কিছু শুনছে ভাইয়ের কাছ থেকে তারপরই কান্না থামিয়ে চুপ হয়ে গেল। রিদওয়ান জানে না কি এমন বলল তার ভাই যা শুনে সব কান্না মিলিয়ে গেল এমন করে।

_____________
অর্ণবের সাথে নুপুরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আগেও খুব ছিল তেমন নয় তবুও কিছু ছোট বার্তা, কিছু আবেগ প্রকাশিত হতো ফোনকলেও। আজ এক সপ্তাহ হয় সেই ছোট্ট যোগাযোগটাও নেই। হয়তো হয়ে যেত কিছুটা তা একেবারেই বন্ধ হলো দু দিন আগে নুপুরের বাবার কথা শুনে। অর্ণব তখন অফিসের জন্যই বের হচ্ছিলো। বাইকে স্টার্ট করে গলির মোড়ে যেতেই চোখের কোণে ভেসে এলো কারো হাতের ইশারা। ততক্ষণে বাইক টেনে চলে গেছে অনেকটাই দূর। চেনা প্রতিচ্ছবি দেখেছে মনে হতেই সে বাইক থামায় পুনরায় ফিরে আসে পেছনে৷ দেখতে পায় দু বার দেখা মুখটা। সালাম জানিয়ে সামনে দাঁড়াতেই মানুষটা জানায় কিছু কথা আছে তার সাথে। অর্ণব সম্মতি জানিয়ে বাইকে বসতে বলে। দুজন এসে বসে বাড়ি থেকে অনেকটাই দূর নির্জন এক জায়গায়। ঘনবসতিপূর্ণ এ শহরে খুঁজলে এখনো পাওয়া যায় একটু আধটু কোলাহলমুক্ত পরিবেশ। তা অতিসামান্যই বটে; তেমনই এক জায়গায় মুখোমুখি দাঁড়ানো দুজন মানুষ৷ সময় ক্ষণ ব্যয় না করে নাজিম সাহেবই মুখ খুললেন প্রথমে।

-আমি বাবা কিছু কথা বলতে ও জানতে এসেছি তোমার কাছে।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় অর্ণব৷ নাজিম সাহেব তা বুঝতে পেরে আবার বললেন, আমার মেয়ে আর তোমার মধ্যে কি কোনরকম সম্প……

আর বলার দরকার পড়লো না অর্ণব নিজেই এবার জবাব দিলো, না আঙ্কেল। কিছু নেই হয়তো হতো কিন্তু হয়নি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আপনার মেয়েকে নিয়ে।

-গত সপ্তাহে ভর দুপুরে তোমার বাইকে করে গেল।

-কিছু কথার বলার ছিল তাকে। বলে দিয়েছি আমি স্পষ্ট করে সেও নিশ্চয়ই বুঝে গেছে। এখন আর ভয় নেই যা নিয়ে আপনি অস্থির হবেন।

মুখে কিছুটা হাসি টানার বৃথা চেষ্টা করেই জবাব দিলো অর্ণব। নাজিম সাহেব তাতে আশ্বস্ত হলেন কিনা বোঝা গেল না৷ তিনি যেন আরেকটু দৃঢ়ভাবে কোন কিছু শোনায় অপেক্ষায় ছিলেন৷ শেষমুহুর্তে চলে যাবেন ভেবে পা বাড়াতে গিয়েও আবার থামলেন। জানানোর উদ্দেশ্যেই যেন আবার বললেন, ‘আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক করছি আমি৷ পাত্র দেখা হয়ে গেছে মেয়েও পছন্দ তাদের শুক্রবারে এলেই হয়তো আংটি পরাবে৷ তাই বলছিলাম কি যদি কোন যোগাযোগ থেকেও থাকে তার সমাপ্তি টেনো।’

কথাটা বলে আর একটুও দাঁড়াননি নুপুরের বাবা। অর্ণব মাথা নিচু করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো৷ একটা বাবা মেয়ের সুখের কথা ভেবে এসেছেন তাকে মেয়ের থেকে তাকে দূরে থাকার অনুরোধ করতে। আরেকজন বাবা মেয়ের সুখে তাকে সকাল দুপুর হুমকি, ধমকি দেয় মেয়ের সাথে তাকে জুড়ে দিতে। কি আশ্চর্য! দুজনেই মেয়ের বাবা অথচ দুজনের চাওয়ায় আকাশ-পাতাল ব্যবধান। আচ্ছা তার নিজের বাবা বেঁচে থাকলে কি অর্নির সুখ নিয়ে আগে ভাবতো না! অবশ্যই, তার বাবাও নিশ্চয়ই অর্নির সুখের কথা ভাবতো কিন্তু তার বাবা নেই। হঠাৎই মনে হলো বাবা নেই তো কি হয়েছে অর্নির ভাই তো আছে। সে করবে সব বাবার মত করেই। খালুজানের হুমকি ধমকিকে ঠিক পায়ে মাড়িয়ে দিয়েই যেন সে খালুকে ফোন করে মুখের ওপর বিয়ের প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করলো। অর্নির সুখ রিদওয়ানের পাশে থাকা। জীবনসঙ্গীর চেয়ে বেশি সুখ আর কেউ দিতে পারবে না তার বোনকে। মনে মনে ছক কষে নিলো সে। অর্নিকে এ দেশেই রাখবে না৷ ডাক্তারি পড়া সে দেশের বাইরে থেকেও পড়তে পারবে৷ চট্টগ্রাম যাবে সে দ্রুতই তারপর খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করতে পারবে। রিদওয়ানও তো বিদেশেই থাকছে, দুজনে না হয় নিজেদের সেদিকেই গুছিয়ে নেবে৷ আর রইলো তার বিয়ে নিয়ে কথা! নুপুরের বাবাকে আজই ফোন করে প্রস্তাব রাখবে সে। জীবন তো একটাই, এক জীবনে সুখটাই যদি না পায় তবে বেঁচে থাকা কিসের আশায়!

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২৭(খ)

মহাকালের গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া প্রাণ কি কখনো পুন:স্পন্দিত হয়! অর্ণব এমন এক প্রাণের পরিচয় যার জন্মই হয়েছে অতলে হারিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ে। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তার গুছিয়ে রাখা পরিকল্পনা উল্টে গেল হাওয়ার মত। ইচ্ছাকৃত নয় তবুও একটা কথা আছে, লাইফ ইজ সো আনপ্রেডিক্টেবল। তা-ই যেন প্রতিদিন একটু একটু করে জেনে আসছে অর্ণব। গতরাতের মধ্যেই সে বোনকে, রিদওয়ানকে এমনকি খালুজানকেও জানিয়ে দিয়েছিল বৃষ্টিকে বিয়েটা সে করছে না। বৃষ্টি আর অর্নির মাঝে পার্থক্যটা সে কখনোই করেনি তাই তার প্রতি তেমন কোন অনুভূতি নেই যা নিয়ে একটা সংসার সাজানো যায়। আর তারপরও যদি তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে নিতে আরও কোন গভীর কারণ চাই তবে সহজ ভাষায় বলা যায় সে একজনকে ভালোবাসে। বিয়ে যদি করতেই হয় সেই মেয়েটিকেই করবে এবং কালই মেয়েটির বাড়িতে সে বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে যাবে। মেয়েটি ‘কে’ সে কথা অর্ণবের বলতে হয় না বৃষ্টি নিজেই সর্বসম্মুখে জানিয়ে দিয়েছিল, মেয়েটি নিশ্চয়ই অর্নিতার সেই কালো করে বান্ধবীটি! অর্ণব সায় জানিয়ে বৃষ্টিকে বলেছিল, ‘ভুল বুঝিস না বোন আমি চাই তুই সুখী থাক। সেই সুখ তুই আমার কাছে পাবি না বিশ্বাস কর।

-বিশ্বাসের আশ্বাস তোমায় দিতে হবে না অর্ণব ভাই। আমি জানি আমি কিসে সুখী হব। তুমি ছাড়া আমি আর কাউকে বিয়ে করবো না কক্ষনোও না।

এরপর আর মুখ খোলেনি বৃষ্টি৷ সে উঠে চলে গেল বাবা আর অর্ণব ভাইয়ের আলোচনার থেকে। সেখানে উপস্থিত ছিল রিমন আর তার মা রায়নাও। আলোচনা বলতে অর্ণব চেয়েছিল নিজের দিক পরিষ্কার করে বৃষ্টিকে মানিয়ে বুঝিয়ে নিতে। তা আর হলো না তখন। তবুও অর্ণব দায় কাটাতেই অত বিস্তারিত বলে খালার বাড়ি থেকে বিদায় নিয়েছিল৷ মনে মনে ঠিক পণ করেই বেরিয়ছিল বোঝাপড়ার সময় এখানেই সমাপ্তি৷ এরপর যা ঘটবে সবটাই তার ইচ্ছানুরূপ আর শ্যামাঙ্গীনির মতাদর্শে। রাতটা সে জোরপূর্বকই ভালো ঘুমে কাটাতে চাইলো। ঘুম কি কারো ইচ্ছের ধার ধারে! এক্ষেত্রে জবাব হবে অবশ্যই না। অর্ণবেরও ইচ্ছে কাজে দিলো না। রাতভর অফিসের টুকরো কিছু কাজ করেই কাটিয়ে ভোরে উঠে দাদীর ঘরে গেল সে। ফজরের ওয়াক্ত শুরু হয়েছে আরও আধঘন্টা আগে। দাদীরও সালাত আদায় শেষে এখন চলছে দোয়া-জিকিরের সময়। তিনি তসবীহ হাতে সবেই কাৎ হয়ে শুয়েছিলেন বিছানায় তখনই দরজায় করাঘাত।

-অর্ণব!

-হ্যাঁ, আসবো?

-আয়।

মুখে ‘আয়’ বললেও মনে মনে বলছিলেন আসিস না ভাই৷ তোর মনে যা চলছে তা নিয়ে কথা বলতে ভয় হয় পাছে অর্নির সংসারটা না ভেসে যায়!

অর্ণব ঘরে প্রবেশ করেই তাকালো জানালার দিকে। রুজিনা খালা ঘরে নেই তাি হয়তো জানা খোলা হয়নি। নামাজ শেষে রান্নাঘরে যাওয়ার আগে রোজ জানালা খুলে দেয় খালা। দাদীর নাকি এ সময়টা বাইরে থেকে আসা ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস ভালো লাগে খুব৷ দাদা বেঁচে থাকার সময়টায় তারা স্বামী-স্ত্রীতে নামাজ শেষে বাইরে বাগানের একপাশে চেয়ার বিছিয়ে সময় কাটাতেন। দাদী নিশ্চয়ই মিস করেন সেই সময় আর সঙ্গীকে! বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। এ জীবনে একাকীত্ব ঘুচাতে জীবনসঙ্গীর বিকল্প আসলেই আর কিছুই নেই। দাদীর পায়ের কাছে খাটের ওপর বসতে বসতেই অর্ণব পকেট থেকে ফোন বের করলো।

-অর্নির সাথে কবে থেকে কথা হয় না তোমার?

-তোকে না বলছিলাম আপনি কইরা বলবি আমায়।

-বলি তো মাঝেমধ্যে।

-সবসময় বলবি।

-হুটহাট কি যে হয় তোমার! হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল অর্ণব। দাদী মাঝেমাঝেই এমন করে। কোন ব্যাপারে আপসেট থাকলে অর্ণবের সম্মোধন নিয়ে কথা শোনাবে। কারণে, অকারণে রুজিনা খালাকে বকাঝকা করবে এমনকি গেইটের দারোয়ানকে ডেকেও বকাবকি করতে ভোলে না। আজও বোধহয় তেমনই কিছু হবে কিন্তু অর্ণবকে দমে গেলে চলবে না। সে তুমি,আপনির সম্মোধন এড়িয়ে সরাসরি বলল, ‘আজ নুপুরদের বাড়ি যাব দাদী বিকেলে তৈরি থেকো।’

_______
বিকেল বললেও অর্ণবরা রওনা হলো দুপুরের খাবারের পরপরই। দাদী নিজেই তাড়া দিলেন তাড়াতাড়ি যাবেন বলে। অর্ণবও আর দেরি না করে তৈরি হলো। আজ বাইক নয় দাদী যাবেন তাই উবার কল করেছে সে। আজ হঠাৎই মনে হলো গাড়ি এবার একটা কেনা দরকার। প্রায় দু তিন বছর ধরেই ম্যানেজার আঙ্কেল জোর করছিলেন একটা গাড়ির জন্য। একটা কোম্পানির মালিক বাইকে করে বিভিন্ন মিটিং, পার্টিতে উপস্থিত হয় এটা নাকি দৃষ্টিকটু। ইমেজ রক্ষা করে চলা জরুরি তাই কেনা প্রয়োজন। দাদী আর অর্নি অবশ্য এ ব্যাপারে তাকে ডিমোটিভেট করে গেছে সর্বদা। তাদের গাড়ি লাগে না, অর্ণবও বাইকে কমফোর্ট বেশি সে হিসেবে গাড়ি আর ড্রাইভার খরচটা অযথাই৷ কিন্তু আজ হুট করেই মাথায় এলো বিয়ের দিন বউ আনতে কি ভাড়ার গাড়ি নিয়ে যাবে! দ্যা ইংয়গেস্ট বিজনেসম্যান অর্ণব চৌধুরীর নিজের একটা গাড়ি নেই? হাস্যকর! উবার এলেই ভাবনা থেকে বেরিয়ে দাদীকে নিয়ে রওনা হলো শ্যামাঙ্গিনীর বাড়িরতে। পথে অবশ্য দাদী তাকে দিয়ে মিষ্টি আর পান সুপারি কিনিয়েছিল। মনমতো কথাবার্তা যদি এগিয়ে যায় তখন একেবারে সময় নিয়ে আকদ করে তবেই বাড়ি ফিরবেন বৃদ্ধা এমনই মনস্তাপে পা বাড়িয়েছেন পাত্রীর বাড়িতে। এ খবরটা অর্ণবেরও অজানা৷ আপনজনদের সাথে সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে আজ তিনি ঘটা করে নাতির জন্য পাত্রী দেখতে আসতেন। বড় ভাসুর আর তার ছেলে,পুলে, বউ আর অর্ণবের খালা, মামাদেরও ডেকে নিতেন। কিন্তু আফসোস, দু দিককার কোন আত্মীয়ই তাদের জন্য মঙ্গলকর হয়ে পাশে নেই তাই আজ শুধু নাতিকে নিয়েই চলে এলেন। গাড়ি এসে থামলো নাজিম সাহেবের বাড়ির সামনে। সদ্য রঙে ঝলমলে বাড়ির সামনে লোহার গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলো অর্ণব তার দাদীকে নিয়ে। বাড়ির সামনে খানিকটা আঙিনা একপাশে বড় একটা বরই গাছ, পাশাপাশি কতগুলো আম গাছ। কিছুটা সামনেই একতলা রঙিন দালান। দালানের মূল দরজায় লোহার কেঁচি গেইট আধখোলা।চোখে পড়ছে সেখানটায় অনেকগুলো নতুন জুতোজোড়া। বাড়িতে পরার মত নয় সেই জুতোগুলো দেখেই আন্দাজ করা যায় বাড়িতে হয়তো মেহমান এসেছে। অর্ণবের এবার অস্বস্তি হচ্ছে খুব। ভুল সময়ে এলো নাতো! একহাতে পান, মিষ্টির অনেকগুলো প্যাকেট অন্যহাতে দাদীকে আগলে রাখা। আচমকাই অর্ণবের বেশ ওজন অনুভূত হলো হাতের প্যাকেট আর দাদীকে ধরে রাখাটা। ধীর পায়ে দরজার কাছটায় দাঁড়ায় সে৷ দাদী এবার আওয়াজ তুলে ডেকে উঠলেন, নুপুর! দিদিভাই বাড়িতে আছো?

প্রথম ডাকে কারো সাড়া পাওয়া গেল না। দ্বিতীয়বার আওয়াজ তুলতেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন নাজিম সাহেব। পেছন পেছন এলো তার স্ত্রী আর ছোট্ট ছেলে তুতনও। দরজায় দাঁড়ানো অর্ণবকে দেখেই ভড়কে গেলেন নাজিম সাহেব। মুখ খুলে কিছু বলার আগেই দাদী আবার বলে বসলেন, ‘অসময়ে এসে পড়লাম বাবা কিছু মনে করো না বাবা। এটা কি বউমা? মা একটু ধরোতো আমাকে।’

বৃদ্ধা আপনমনে একেকজনকে একেক কথা বলে চলছেন অথচ একটিবার ভালো করে তাকালে দেখতে পেতেন নাজিম সাহেবের মুখটা কেমন থমথমে। নাজিমের স্ত্রী বৃদ্ধাকে না চিনলেও কথা শুনে আগে বৃদ্ধাকে ধরে ঘরে আনলেন। লম্বাটে ঘরগুলোর ঠিক মাঝখানের ঘরটাই বসারঘর আর সেখানটায় বসে আছে কিছু মেহমান। তাদের পাশেই মাথায় ওড়না টেনে বসে আছে নুপুর। সদর দরজা থেকেই তা চোখে পড়েছে অর্ণবের। সে এক মুহূর্তের জন্যও পলক ফেলেনি নতজানু হওয়া মুখটা থেকে কিন্তু নাজিম সাহেব কিছুটা তাড়া দিয়ে অর্ণব আর দাদীকে পাঠিয়ে দিলেন নুপুরের ঘরটাতে। তাদের শোবার ঘরটাতেও মেহমান দুজন মহিলা বসেছে বিধায় নুপুরের খালি ঘরটাতেই তাদের বসাতে হলো। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও যখন কারো হদিশ মিললো না তখন দাদীই মুখ খুললেন, ‘কিরে দাদাভাই কেউ তো আর এলোনা এখানে। মনে হলো সামনের ঘরে কিছু মানুষ দেখছি৷ ভুল সময় আসলাম নাতো!’

দাদীর মনোভাব যা অর্ণবেরও ঠিক তেমনই হতো যদি না কাল নুপুরের বাবার সাথে সাক্ষাতে নেতিবাচক কথা হতো৷ কিন্তু এই মুহূর্তে মন বলছে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে অপমান করছে। আর নুপুর! সে ওখানে ওভাবে কেন বসে আছে?
ভাবনার প্রসার ঘটার আগেই এ ঘরে উপস্থিত হলেন নুপুরের মা৷ অর্ণব জানে নুপুরের সৎ মা আছেন। মহিলাটির আচরণ কেমন তা ন জানলে এ মুহূর্তে তার হাতের ট্রে দেখে মনে হলো আন্তরিকই হবেন।

-বসেন চাচী, পরিচয় তো এখনো ঠিকঠাক পাইলাম না তবুও এট্টু শরবত খান।

দাদী আর অর্ণব দুজনেই যেন অবাক হলো মহিলার কথায়। মুখের ওপর কেউ এভাবে বলতে পারে! তারা অবশ্য প্রতিক্রিয়া দেখানোর পূর্বেই মহিলা আবার বললেন, বাড়িতে এমনিতেই মেহোমানে ভরা। পাত্রপক্ষ না গেলে এদিকে নজর দিতে পারতাছি না। তা আপনেরা কি দুপুরে খাইয়া আসছেন?

মুখের ওপর কথাগুলো বেশ লাগছে দাদীর। অর্ণবের শীতল দৃষ্টি প্রচণ্ড ক্রুর হয়ে উঠেছে ততক্ষণে। নাতিকে ভালো করেই জানেন বলে দ্রুত হাত চেপে ধরলেন দাদী। যার অর্থ সামলে যাও ভাই।

-না না খাওয়ার চিন্তা করতে হবে না তোমার। তুমি শুধু এইটুক কও পাত্রপক্ষ কার জন্য আসছে?

-কার আবার আমার সৎ মাইয়ার বিয়ে ঠিক করতাছে৷

-দিন তারিখ পাকা হইছে?

-না সবে তো আংটি দিল। আগামী সপ্তায় আমরা যাইয়া ঠিক করব।

‘আংটি দিল! আংটি বদল হয়ে গেল নুপুরের? এত তাড়া! কই অর্ণব তো কত বিগ্রহ এড়িয়ে এখনো নিজেকে একান্ত তার করবে বলে এত দূর এলো।’ আচমকা রাগের উত্তরণ হয়ে গেল। এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে নজর আটকালো রিডিং টেবিলের ওপর মোটা একটি বইয়ে। বইয়ের সামনের দিকে আচর কেটে বাঁকা করে ‘N’ তার সাথে সংযুক্ত ‘A’ লেখা। স্পষ্ট চোখে পড়ার মত যুক্ত সে অক্ষর। তার কোন কথাতেই কান নেই যেন সব মনোযোগ আটকে আছে বইয়ের সেই অংশে। মেয়েটা কেমন ভালোবাসতো তাকে? পাগলের মত! নাহ পাগলকেও হার মানায় তো। অর্ণবের ইচ্ছে করলো বইটা একটু ছুঁয়ে দেখতে৷ সে সত্যিই এগিয়ে গেল টেবিলের সামনে। দাদী আর নুপুরের সৎ মায়ের কোন কথাই আর প্রবেশ করলো না তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে। হাত বাড়িয়ে ছু্ঁয়ে দিল বইটা পরমুহূর্তেই দৃষ্টিতে কাড়লো খোলা বইয়ের পাতা যেন, তার জন্যই খুলে রেখেছিল কেউ। নজর বুলিয়ে আরও যেন হতবিহ্বল হয়ে পড়লো অর্ণব৷ কি চমৎকার হাতের লেখায় বইয়ের পাতার ওপর স্পষ্ট করে লেখা, আমার জল্লাদমশাই। পাশেই আঁকা গোঁফসহ একটি অবয়ব। কেমন পাগল মেয়ে একাডেমিক বইয়ের পাতায় এসব লেখা! নুপুর কি জানতো সে আসবে আর তা জেনেই কি এভাবে বইটা খুলে রেখেছে! সদা সতর্ক, চৌকশ মানব অর্ণব আজ কতোটা বেখেয়ালি সে নিজেই জানে না। দাদীর অনবরত ডাক তাকে ঘোর থেকে টেনে আনলো বাস্তবে।

– অর্ণব.. দাদাভাই আমার, ফিরা যাওয়া দরকার।

দাদী খুব থেমে থেমে রুদ্ধশ্বাসে বাক্য সম্পন্ন করলো। অর্ণব শুনলো তবুও বুঝলো না যেন দাদীর কথা৷ সে কেমন বোকার মত চেয়ে রইলো শুধু। দাদী এবার এগিয়ে এসে নাতির হাত ধরলেন৷

-চলো ভাই। আর এইখানে কাম নাই আমাগো।

-নাহ দাদী। আমি একটু কথা বলে যেতে চাই আঙ্কেলের সাথে৷

-দেখো ভাই মাইয়া মানুষের দোষ অনেক হয়৷ আজকা যা পরিস্থিতি তাতে কারো দোষ নাই কিন্তু আমরা যদি এহন নুপুরের বাপেরে ডাকি, কথা কই পাশেই যেই মেহমান আইছে তাদের মনে সন্দেহ হইতে পারে। আর কোন কথা বাজলে মাইয়াটা বদনাম হইবো।

অর্ণব যেন বুঝলো দাদীর কথা সে চুপ রইলো কিন্তু কথা না বলে ফিরে যেতে নারাজ। হলোও তাই, বিকেল অব্দি তারা বসে রইলো নুপুরের ঘরে। এরই মাঝে নুপুরের আংটি বদল হলো, মিষ্টি মুখ হলো তারপর যখন নুপুরকে বসার ঘর থেকে বের করা হলো তার বাবা তাকে নিজের ঘরে আসতে বাঁধা দিয়ে পাঠিয়ে দিলো ছাদে।ঘুণাক্ষরে সে জানতে পারলো না তার একান্ত কামরাটিতে ঘন্টার পর ঘন্টা তারই মনপুরুষটি বসে আছে। নিয়তির ঘটা করে ছড়িয়ে দেওয়া বিষাদ সে পায়ে মাড়িয়ে উদাস বেলা কাটিয়ে দিলো ছাদের কার্নিশে বসে।

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-২৬

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২৬ (ক)

রাত বাড়ছে সাথে বাড়ছে প্রকৃতির চাপা গর্জনরূপী ঝড়ো হাওয়া। সন্ধ্যের আকাশটা পরিষ্কারই ছিলো রাত বাড়তেই কোথা থেকে ওড়ে এলো দলছুট মেঘের ভেলা। প্রকৃতি যেন আগেই প্রস্তুত ছিলো গর্জে ওঠার সেই সাথে তুমুল বর্ষণের। অর্নিতার কান্না থেমে গেলেও থমথমে ভাবমূর্তি কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। রিদওয়ানও চাইছিলো কিছুটা সময় দিতে তাই একটু আগেই সে রুম ছেড়ে বেরিয়েছে বাইরে। মিনিট বিশেক হোটেলের পুল সাইডে বসে নিরিবিলিতে ভেবেছে অনেক কথা, ভেবেছে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েও। অর্ণব ছোট বাচ্চা নয়, বৃষ্টিও যথেষ্ট বুঝদার। তারা তাদের ভবিষ্যতের চিন্তা নিজেরাই করার ক্ষমতা রাখে তবুও তারা যা করছে আপাতদৃষ্টিতে ভুল বলেই মনে হয়। কিন্তু এরপরও কথা থাকে, তারা দুজন দুজনকে চেনে ছোট থেকেই আর নুপুরের সাথে পরিচয়টা সল্প সময়ের। আবার হতে পারে নুপুরের সাথে অর্ণবের এতোটাও আবেগ জড়ায়নি যতোটা সে কিংবা রিমন ভাবছে। হতে পারে বিয়েটা হয়ে গেলেই অর্ণব ভুলে যাবে ওই মেয়েটাকে! হতে অনেক কিছুই পারে তা নিয়ে নিজেরা বাড়াবাড়ি করা বোধহয় ঠিক হবে না। রিদওয়ান ফিরে এলো রুমে৷ অর্নি মন খারাপ করে এখনো বসে আছে বারান্দায় তা দেখে রিদওয়ান ডাকলো, অর্নি রুমে আয়।

এক ডাকেই উঠে এলো অর্নিতা। বাথরুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি দিয়ে চুল গুলো হাত খোঁপা করতে করতে বসলো এসে বিছানায়। রিদওয়ান অর্নিতার ব্যাগ খুঁজে চিরুনি বের করে তার চুল আঁচড়াতে লাগলো। ঘর জুড়ে নিরবতা ;দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যাচ্ছে যেন৷ শোনা যাচ্ছে এসির এক ধরনের ভোঁতা আওয়াজ। কিছু সময় চুপচাপ কেটে যেতেই রিদওয়ান চিরুনি রেখে ঘরের বাতি নেভালো। ঠায় বসে থাকা অর্নিতার হাত ধরে টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলো কিছুক্ষণ। বাইরে বৃষ্টি চলছে অবিরত সেই সাথে আবহাওয়ার শীতলতা ঘরটাকে আরও বেশি শীতল করতেই রিদওয়ান এক হাতে অর্নিকে জড়িয়ে অন্য হাতে এসির রিমোট চেপে অফ করে দিলো। ভুল হয়েছে জানালা আর বেলকোনির দরজাটা খোলা রাখা উচিত ছিল।

-ঘুম পাচ্ছে?

অর্নিতার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল রিদওয়ান।

-না।

-আমারও পাচ্ছে না তবে অন্য কিছু পাচ্ছে।

রিদওয়ানের বুক থেকে মাথা তুলে কৌতূহলী চোখে তাকালো অর্নি। গাঢ় অন্ধকারে ডোবা ঘরটাতে দেখা গেল না মানুষটার মুখ৷ রিদওয়ান আবার বলল, বিয়ের পর এই প্রথম আমরা এতো কাছে তাই না!

লজ্জা লাগছে অর্নির। সত্যিই এত কাছে এতো আবেশে বুকে মিশে থাকা এই প্রথম তাদের। লজ্জাতেই এবার একটু নড়াচড়া করতে লাগলো অর্নি। রিদওয়ান তাকে ছেড়ে উঠে গিয়ে জানালা খুলে পর্দা সরালো, বারান্দার দরজা খুলতেই দমকা বাতাস জায়গা করে নিলো ঘরের ভেতর। বৃষ্টির ছাঁটও ছুয়ে গেল রিদওয়ানের চোখ, মুখ, হালকা ভিজিয়ে দিলো শার্টটা। ভেজা শার্ট গা থেকে খুলে ছড়িয়ে দিলো লাগেজের ওপর। পুনরায় গিয়ে বসলো বিছানায় অর্নিতার সামনে। আলতো হাতে চিবুক তুলে ঠোঁটে স্পর্শ করতেই পেলব ঠোঁটের মদির নেশায় পেয়ে গেছে রিদওয়ানকে। রিদওয়ান একটু ঝুঁকে স্ত্রীর মুখ, চোখে স্পর্শ এঁকে ধীরলয়ে নেমে এলো পুরু ঠোঁটের ভাজে। বহুকালের তৃষিত হৃদয় কবে থেকে অপেক্ষায় ছিল এই তুলো কোমল ছোঁয়ায় ডুবে যাওয়ার। এত কাছে এই ক্ষণে নিজেকে আর যে ধরে রাখা দায়। অর্নিতাও ভুলে গেল কিয়ৎপল আগের বিষাদ হারাতে লাগলো নতুন অনুভূতির জোয়ারে। নিবিড় আলিঙ্গনে মিলে গেল দয়িতের বাহুডোরে।

__________

পড়াশোনায় আর মন বসছে না একদমই। টিউশন আর বাড়ির কাজকর্মই যেন নুপুরের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠছে আজ চারদিন ধরে। তার বাবা প্রথম দুদিন বিষয়টা আমলে না নিলেও কাল থেকে চিন্তিত আছেন৷ কোন কারণ ছাড়া একটানা চারটা দিন ক্লাশ না করার মত মেয়ে তার নয় ভেবেই আজ তিনি সন্ধ্যের পর বাড়ি ফিরে মেয়েকে ডাকলেন। রান্নাঘরে তখন সকালের রান্নার জন্য সবজি কাটতে ব্যস্ত নুপুর। বাবার ডাক শুনতে পেয়ে তরকারি, বটি একপাশে সরিয়ে চলে গেল বাবার ঘরে। সন্ধ্যেক্ষণে আজকাল ছোট মা পান সাজিয়ে বসেন দেখা গেল বাবাও আজ সঙ্গ দিচ্ছেন। এ বাড়িতে পানের আয়োজন খুব বেশিদিন পুরনো নয় তবুও কেন জানি নুপুরের বিষয়টা ভালো লাগে। হতে পারে বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী এই পানের জন্যই ইদানীং সন্ধ্যের পর রসুইঘর খালি করে চলে আসেন আর নুপুর তার চায়ের কাপটা উচ্চবাচ্চ্য না শুনে পূর্ণ করতে পারে বলে। আজ অবশ্য চায়ের পাতিল উনুনে চড়েনি। তরকারি কাটতে কাটতে সে ভাবছিলো গত কয়েকদিনের একটা সমস্যা নিয়ে। বাবা তাকে দেখেই একবার তাকালো ভালো করে।

-তোর কি শরীর খারাপ?

-না তো বাবা।

-তোর কি পরীক্ষা চলে?

– নাতো। পরীক্ষায় আরও মাস তিন বাকি।

-ইউনিভার্সিটিতে যাস না কেন?

বাবার এই প্রশ্নে তৎক্ষনাৎ কোন জবাব এলো না মুখে। এরই মাঝে ছোট মা ঘর ছেড়ে গেলেন তুতুনকে দেখতে। কি করছে ছেলেটা এখনো পড়তে বসলো কিনা কে জানে৷ নুপুরও যেন এটাই চাচ্ছিলো তাই সুযোগ পেয়ে সত্যিটাই প্রকাশ করলো।

-বাবা, আমি বাড়ি থেকে বসে হলে প্রায়ই দেখি একটা বাইক আসে পেছনে পেছনে৷

-কি বলিস এটা!
চমকে উঠলেন নাজিম সাহেব।তার মেয়েকে কেউ নজরে কেন রাখবে। চিন্তিত মন এবার অস্থিরতায় ঘামতে লাগলো।

-হ্যাঁ বাবা। বাইকওয়ালা সবসময় কলেজের সামনে আর উত্তরপাড়া টিউশনি করি সে এলাকায় অনেকদিন চোখে পড়েছে। প্রথম প্রথম কাকতালীয় মনে হতো পরে দেখলাম একই রঙের শার্টে একই বাইকে অনেকদিন পেছনে আসছে।

-কবে থেকে এমন হচ্ছে তুই আমাকে বলিস নাই ক্যান?

– প্রায় বছরখানেক আগে অনেক দিন একটানা এমন হওয়ার পর হঠাৎ আর চোখে পড়েনি লোকটাকে। এখন আবার দিন পনেরো আগে দেখেছি তখন থেকেই ভয় লাগছিলো।

এবার কথাটা বলতে বলতে মাথা নুইয়ে ফেলল নুপুর। বাবাকে আরও আগে না জানানোর জন্যই এখন খারাপ লাগছে।

– এতদিন জানানো দরকার ছিল না!

এবার ধমকে উঠলেন নাজিম সাহেব। মূলত কন্যার কোন বিপদ যদি হয়ে যেত এই ভয়েই এই ধমক৷ উত্তেজনা আর ভয়টাও যেন প্রকাশ পেলো ধমকের সাথে।

-কাল থেকে তুই আর টিউশনিতে যাবি না৷ বাড়ি থেকেই একা বের হবি না। যতদিন না আমি খোঁজ নিতে পারছি কিছু ততদিন বাড়ির বাইরে পাও ফেলবি না বলে দিলাম।

-টিউশনিতে যাই না চারদিন ধরেই৷ কিন্তু ছাত্রের পরীক্ষা কালকে যেতেই হবে।

-দরকার নাই টিউশনি করার৷ আমি আলহামদুলিল্লাহ যা কামাই তোকে পড়াইতে পারব।

মেয়েকে আর কিছু বলতে দিলেন না নাজিম সাহেব। আদরের কন্যাটির মাথার ওপর কেমন বিপদ ঘুরছে তা ভেবেই তিনি ভয়েই ঘেমে উঠছেন বুকটাও ধড়ফড় করছে।

___________

জীবন নিয়ে হেলাফেলা করার মত মানুষ অর্ণব নয়। সারাজীবন একাকীত্বের যন্ত্রণা সয়ে নিজেকে বড় করেছে এ বেলায় এসে সঙ্গী পাওয়া মুহূর্তে মনের মতন কাউকে না পেলে চলবে কেন! অথচ দু হাত দু পায়ে শিকল পরাতে ওঁৎ পেতে আছে কতজন শিকারী যেন সে ছোট্ট এক শাবকছানা। প্রভু হয়প শিকারীরা তাকে নিজের প্রভূত্ব ফলাতে উঠে পড়ে লেগেছে তার দূর্বল দিক চেপে ধরে। প্রত্যেকেই তার খুব কাছের মানুষ না ঠিক হলো না তারা প্রত্যেকেই আপন নামের পর মানুষ। একটু আগেই সে খালুজানের অফিস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে৷ সন্ধ্যের নাশতার জন্য ডেকেছেন তা ছিল কথার কথা। নাশতার জন্য কেন অফিসে ডাকতে হবে! আপন মানুষকে তো বাড়িতেই ডাকা বাঞ্ছনীয়। অফিসে ডাকার পেছনের রহস্য হলো একাকী গোপন এক ডিল করা। ব্যবসায়ে উঁচু থেকে উঁচুতে উঠতে দুটো জিনিস থাকা জরুরি পুঁজি, দক্ষতা। খালুজান অতিমাত্রায় দক্ষ বলেই হয়তো আজ সফল ব্যবসায়ী। এতটাই দক্ষ যে সম্পর্ককেও ব্যবসায়িক রূপে বদলে নিতে জানেন। আজ বোনের সুখ কিনতে তাকে খালুজানের সাথে ব্যবসায়িক ভাষায় কথা বলতে হলো। হয় বৃষ্টিকে নিয়ে সুখের সংসার করো নয় বোনকে ডিভোর্সে তকমা দাও। ছোট থেকে কন্যার মত স্নেহে বড় করা অর্নিকে নিয়ে খালুর এমন কথায় অর্ণবের মনে হয়েছিল সেখানেই সে বাশার শেখকে খুন করে আসবে। পরক্ষণেই কেমন তার টগবগে ফুটতে থাকা রক্ত বরফসমান গাঢ়, কঠোর হয়ে গেল। কত শান্ত, আদ্র গলায় বলে দিলেন, রিদওয়ানের সাথে অর্নিতার সংসার টিকবে শুধুই তোমার সিদ্ধান্তের ওপর। আমার মেয়ে দুঃখ পেলে তোমার বোন আমার ছেলের সাথে সুখে থাকবে সে কথা ভুলে যেও বাবা আর হ্যাঁ ব্যবসা টিকিয়ে রাখার কথাও ভুলতে হবে। ছোট থেকে সন্তানের মত স্নেহ করে আগলে রেখেছি প্রয়োজন পড়লে তার শোধও নেব। তোমাদের বাপ-মা যা করতো তার প্রায় সবটা আমরাই করেছি এখন যদি তোমাদের জন্য আমার সন্তান দুঃখ পায় তাহলে কি করা উচিত বলো তো!

খালুর হুমকি একটুও গায়ে মাখেনি অর্ণব। যা তার লেগেছে তার একটা খালামনির আঁচলের ছায়ায় থাকার প্রতিদান আর বোনের সুখ। অর্নিতা কখনোই রিদওয়ানকে পরিবারহীন দেখে সহ্য করতে পারবে না। রিদওয়ান, অর্নিতা আর বড় খালামনি এই তিনটি মানুষ বড়ই সরল। এ ধরায় তাদের থাকা বড্ড মুশকিল এ পৃথিবী শুধুমাত্র কুটিল, চতুর আর ধূর্ত প্রাণীর বসবাসযোগ্য স্থান। অর্ণবও তেমন, বাশার শেখ আর সাখাওয়াত চৌধুরীও তেমনই। তাই সর্বান্তকরণে এবার তার চেষ্টা কুটিল মানুষগুলোর মতো করেই এগিয়ে চলা। ভাবতে ভাবতে ভুলেই গেল এ জগতে আরও একটি সরল মানুষের কথা যে মানুষটা তার পথে দৃষ্টি ফেলে অপেক্ষায় আছে। নুপুর! আহ্ বড় ভুল তার এ জনমটা। ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষগুলোকে কাছে পাওয়ার ভাগ্য বোধহয় অর্ণব চৌধুরীর আর কখনোই হবে না।
___________

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২৬(খ) (১৮+ এলার্ট)

ভোরের আলোয় চকচক করছে ঘরের ভেতরটা সাথে বুকের মাঝে মিশে থাকা নরম কোমল দেহটির নগ্ন কাঁধ। রিদওয়ান আধখোলা চোখে সেদিকে তাকাতেই তার চোখ দুটো যেন ঝলসে উঠলো। রাতের আঁধারে ছুঁয়ে আদর করা তুলোর মত নরম এই তনু দিনের আলোয় আরও ভয়ানকভাবে মোহিতো করছে তাকে। ঘুমন্ত অর্নির মুখে দৃষ্টি ফেলতেই চমকে উঠলো এবার। ইশ, নিচের ঠোঁটটা কেটে গেছে, লেগে আছে রক্তের ছাপ। ধীরে ধীরে সরে গেল অর্নির বুক থেকে দেখতে পেল নগ্ন বক্ষোজে দাঁতের চিহ্ন। এতোটা এগ্রেসিভ সে কি করে হয়েছিল কাল। প্রথম রাতেই ঠিক কতোটা কষ্ট দিলো সে অর্নিকে ভেবেই এখন খারাপ লাগছে। একটু ঝুঁকে আলতো করেই চুমু খেল অর্নির ঠোঁট, গাল, গলা আর বুকের নরম কোমল মাংসপিন্ডে। অর্নির গাঢ় ঘুম ভেঙে গেল উষ্ণ ছোঁয়ায়। শরীর বাঁকিয়ে হাত মেলে জড়িয়ে ধরলো রিদওয়ানকে। প্রেমের সুখ শরীর নাকি মনে! রিদওয়ানের উপলব্ধি হয় প্রেম এক নাম মাত্র সুখ তো দেহ, মন দুইয়েই থাকে। ভালোবাসলে না ছুঁয়ে থাকা যায় না। ভালোবাসাই টেনে নেয় মধুর আলিঙ্গনে। যারা বলে ভালোবাসা শুধুই মনের তারা ভন্ডামি করে ভেতরে ভেতরে তাদেরও থাকে ছাই চাপা আগুন। হাওয়া পেলে উস্কে উঠবে জলন্ত অগ্নিলাভা আর না পেলেই তা লুকিয়ে রয়। বহুদিনের প্রণয় প্রলয়ে ভেসে গিয়ে অর্নি রিদওয়ান ঠিক জ্বলে উঠলো। অর্ধাঙ্গীনির চোখ মেলার আগ্রহ শূন্য টের পেতেই রিদওয়ানও আদরে জড়িয়ে পুনরায় শুয়ে পড়লো আরেকটু ঘুমের আশায়।

_________
অর্ণবের আজকের সকাল এলো আরও একধাপ বিষন্নতা নিয়ে। ঘুম থেকে উঠেই সে কল দিলো নুপুরকে। একবার, দুবার করে অনেকবার দেওয়ার পরও যখন ওপাশ থেকে ধরা হলো না তখন অধৈর্য্য হয়েই সে মেসেজ দিলো, কল ধরো নইলে তোমার বাড়িতে আসছি, মাত্র দুটো কথা বলব।
নুপুর নিজেই এবার কল দিলো অথচ অর্ণব কিছুই বলতে পারলো না যা বলতে চাইলো। সময় লাগবে কিছুটা তাই বলে বসলো আজকে দেখা করো দুপুরে। নুপুর বাড়ি থেকে বের হতে পারবে না কথাটা বলতে গিয়েও বলল না। মন মানলোই না অর্ণবের কথার বিপরীত জবাব দিতে৷ কাল পর্যন্তও সে কষ্টে, রাগে পণ করেছিল এ জীবনে আর এই মানুষটার মুখদর্শন করবে না। কোন নাম দেয়া সম্পর্ক নেই তবুও অদৃশ্য এক বাঁধন ছিল দুজনাতে। অর্ণবের তাকে এড়িয়ে চলার দায়ে সে বাঁধন মনে মনেই আবার ছিন্ন করতে চাইছিল নুপুর। পারলো কই! ঠিক তো সেই অর্ণবের কথা মেনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল বারোটা নাগাদ৷ নুপুরের বাবা তখন বাড়ি ছিলেন না ছোট মাও কিছু জিজ্ঞেস করেননি৷ অর্ণবের কথা মত নুপুর এসে হাজির হলো ইউনিভার্সিটির খুব কাছেই রাস্তার ধারে। অর্ণব এলো তার ঠিক পাঁচ মিনিট পরই। বাইকে বসা কালো শার্ট, কালো প্যান্ট হাতে সিলভার শেডের বড় ডায়ালের ঘড়ি। মাথার চুলগুলো বাতাসে এলোমেলো হয়ে আছে মুখটাও তার মলিন লাগছিলো। নুপুর ভেবেছিলো আশেপাশেই কোথাও বসবে তারা। তাকে অবাক করে দিয়ে অর্ণব বলল, বসো। তার ইশারা বাইকে নিজেরই পেছনে তা দেখেই নুপুরের বিষ্ময় আকাশ ছুঁলো। হাত পা’ও মুহূর্তেই শীত শীত অনুভূতিতে ঠান্ডা হয়ে এলো। যে মানুষটা কখনো বাড়ি থেকে পৌঁছে দিতে এক রিকশায় বসতে চায় না সে মানুষ আজ বাইকে নিজের পেছনে বসতে বলছে! নুপুর বোধহয় ভাবনায় তলিয়েই যাচ্ছিলো সেই অতল ডুবকি থেকে অর্ণব কেমন হিঁচড়ে তুলে দিলো ডাঙায়।

-দেরি করছো কেন? বসো।

আর সময় নেই বিষ্ময় আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকার। অতি আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থলকে এত কাছে পেয়ে ঝুরঝুর করে ভেঙে গেল নুপুর। বাইকের পেছনে বসতেই বাহু ছুঁলো অর্ণবের পিঠ আর তাতেই সবটা গুঁড়িয়ে গেল। সামনের মানুষটা কি টের পেল পেছনে তার শ্যামাঙ্গিনী আড়ষ্টতায় ঋজু হয়ে আছে! পাক্কা দেড় ঘন্টার পথ পেরিয়ে অর্ণব এলো সাভারের সেই গ্রামটিতে যেখানে এর আগে সে উদাসচিত্তে এসে ভিড়েছিল একদিন। আজ আনমনে নয় বরং ইচ্ছাকৃতই প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে এসেছে মনের আগল খুলে সবটা জানিয়ে দিতে। হতে পারে এই তাদের শেষ সাক্ষাৎ! লম্বা পথ বলেই মাঝ রাস্তায় নুপুর বার কয়েক জানতে চেয়েছে কোথায় যাচ্ছে তারা? বাড়িতে বাবা চিন্তা করবে তার ফেরা উচিত। অর্ণব জবাবে শুধুই বলেছে, ভয় পেয়ো না আমি তোমার জন্য ক্ষতিকারক নেই। আজ একটু মিথ্যে বলে নিও বাবার কাছে।

এরপর আর কথা জোগায়নি নুপুরের মুখে। এ দুনিয়ায় পরিবর্তনশীল হাজারটা জিনিসের মাঝে একটা বোধহয় মানবজাতির অন্তর। প্রথম দেখায় যে মানুষটাকে নুপুর ইস্পাতের মত শক্ত ভাবতো আজ সেই মানুষটাকেই লাগছে মোমের মত। একটুখানি উত্তাপ পেলেই গলে যাবে সে। কি এমন কথা বলতে তাকে আজ এতো কাছে বসিয়েছিল! নুপুর চলতি পথে অনেকবার ছুঁতে চেয়েছিল অর্ণবের কাঁধ, বেহায়া হয়ে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল তাকে। অনুভব করতে চেয়েছিল প্রিয় মানুষের পিঠের পরে মাথা এলিয়ে কেমন লাগে। সাহস হয়নি তেমন কিছুর। এখন এই খোলা প্রান্তরে প্রখর রোদ গায়ে মেখে তার মনে হলো এ রোদে তাপ নয় আছে অর্ণবের গোপন আলিঙ্গন যা অর্ণবকে ছুঁয়ে পিছলে পড়ছে তার গায়ে। তারা এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক সেই জায়গায় যেখানটায় মাস কয়েক অথবা বছর আগে অর্ণব এসে বসেছিল বিধ্বস্ত নিজেকে নিয়ে। আজও সে বিধ্বস্ত আর ক্ষণকাল পেরুতেই ভেঙে যাবে তার পাশে থাকা মেয়েটিও৷

-এখানে কেন এসেছি আমরা?

-কথা বলতে।

– ঢাকায় কি কোথাও বলা যেত না?

-যেত। চাইলেই বসা যেত কোন কফিশপ, কোন হোটেল, পার্ক অথবা আমার অফিসেও। কিন্তু সেখানে থাকতো হাজারো কৌতূহলী দৃষ্টি৷ এখানে চেয়ে দেখো কেউ নেই আশেপাশে।

-এত শূন্য কেন এই জায়গাটা?

-শূন্য জায়গা! আওড়ালো অর্ণব শব্দ দুটো।

-ভালো বলেছো। জায়গাটা আসলেই শূন্য। শূন্য মানুষের জায়গা তো শূন্যই হবে।

চকিতে তাকালো নুপুর।
‘শূন্য মানুষের শূন্য জায়গা মানে!’

-” এই যে সামনের খোলা মাঠ আর ডানদিকের ক্ষেত এই জায়গাটুকু আমার। কোন একদিন ভগ্ন হৃদয় আর বিধ্বংসী রূপ নিয়ে আনমনেই এসে ভিড়েছিলাম এই জায়গায়। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে হঠাৎ মনে হলো এখানে আমার একটা ছোট্ট ঘর হলে ভালো হতো। ওই যে দেখো কলঘরটা ঠিক ওটার মত ছোট্ট। ইট পাথর নয় মাটির তৈরি হবে সে ঘর। জানালার গরাদের ফাঁক গলে পূর্নিমার রাতে আলোয় ভেসে যাবে সে ঘরের মেঝে। মাটির ওপর হবে আমাদের বিছানা।”

চমকে উঠলো নুপুর ‘আমাদের বিছানা!’

অর্ণব বলতে থাকলো, ‘সে বিছানায় পূর্নিমা আর অমাবস্যা মিলেমিশে লুটোপুটি খাবে আমার বুক জুড়ে। অমাবস্যা, পূর্ণিমা একসাথে কি করে তাই ভাবছো না!’

নুপুর ভাবেনি কিছুই। সে তো আমাদের বিছানা ওই এক বাক্যেই এখনো হুঁশ হারা। কি বলছে অর্ণব তা আর বোধগম্য হচ্ছে না। তবুও অর্ণব বিস্তর বলে চলল, অমাবস্যা শুধুই অসুন্দরই নয় আমার অমাবস্যা এ জগতসংসারে সুন্দরের প্রতীক হিসেবেই আমি ধরেছি। তুমিই আমার অমাবস্যা আর পূর্ণিমা ওই চাঁদের দ্যূতিকেই উল্লেখ করেছি।

নুপর আর কিছুই শুনতে চাইলো না। একসাথে এত কিছু তার আর সহ্য হচ্ছে না। যুগ যুগ অপেক্ষার পরও যদি এতটুকু জানতো তাতেও বোধহয় সে সহনক্ষমতা হারিয়ে ঢলে পড়তো এখনি।

-বাড়ি যাব।

-কথা শেষ করে নেই!

দিন ঢলেছে পশ্চিমে৷ সন্ধ্যের আর খুব দেরি নেই। বাবাও সেই দুপুর থেকে কয়েকবার কল করেছেন৷ প্রথমে মিথ্যে বলেছে সে আছে এক বান্ধবীর বাড়িতে। বাবা ঠিকানা চাইলো তাকে নিতে আসবে বলে সেখানেও মিথ্যে বলে কল কেটে দিলো। দিন ঘনিয়ে যেতেই এবার বাবা অস্থির হয়ে কল করেই যাচ্ছেন কিন্তু অর্ণবের সেদিকে খেয়াল নেই। সে বলে চলছে মনের জমানো সকল ভাবনা। নুপুর এবার আর কিছুই শুনতে চাইছে না। অর্ণব তাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনে এই জানতে পেরে গোটা এক জীবন ধন্য তার।

– উঠুন আমি বাড়ি যাব।

– শেষটুকু শুনবে না?

-কিসের শেষ শুনবো?

-আমার স্বপ্নের সমাপ্তি।

‘না’ বলেই নুপুর বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পা বাড়ালো বাইকের দিকে তখনি টান পেলো বা হাতে। অর্ণব টেনে ধরেছে তার হাত সে ফিরে চাইলো।

-আমার ঘরে অমাবস্যা নয় জায়গা নেবে বৃষ্টি৷ আমার জীবনে সাজানো স্বপ্ন কখনো বাস্তব হয় না। রিনিঝিনি নুপুর নিক্কন স্বপ্নেই রয়ে যাবে আজীবন রুমঝুম করবে অনাকাংখিত বর্ষণ। এটাই আমার জীবন।

কথাটুকু বলতে বলতেই উঠে দাঁড়িয়েছে অর্ণব। মুখোমুখি নুপুরকে একপলক দেখে আচমকাই সে জড়িয়ে ধরলো বুকের মাঝে অস্ফুটে উচ্চারণ করলো, ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়। বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি দেখো তোমায় ভালোবেসে আমি আবারও ধ্বংস হয়ে গেছি। আমার জীবন কখনোই পরিপাটি হয় না আজও তাই তুমি আমার হবে না। আমি হেরে গেছি জীবনের কাছে আরও একবার। তুমি ক্ষমা করে দিও আমায়…….

কোমল হাতে নুপুর ঠেলে দিলো অর্ণবকে। অবিশ্বাস্য নজরে তাকিয়ে দেখলো একবার সামনের মানুষটাকে। কি দেখলো কে জানে প্রচণ্ড জোরে অর্ণবের গালে থাপ্পড় মেরে বসলো। অর্ণব হতবাক হয়ে তাকাতেই নুপুর বলল, ‘বাইক স্টার্ট দিন আমি বাড়ি ফিরবো।’

এরপর আর কোন কথা হয়নি দুজনে। নুপুরকে একেবারে তাদের এলাকার বাজার থেকে একটু দূরেই নামিয়ে রিকশায় বসিয়ে দিলো। তবুও বাইক নিয়ে ছুটলো পেছন পেছন ঠিক নুপুরদের গেইট অব্দি। নুপুর বাড়ির ভেতর চলে যেতেই অর্ণব সোজা গেল খালুজানের অফিসে। আজ শেষবার কথা বলে নেবে। খালুজানের মত না বদলালে সে কথা বলবে বৃষ্টির সাথেও এরপরও যদি কাজ না হয় তবে! এ পর্যায়ে স্বগোতক্তির মত বিড়বিড় করলো, হারিয়ে যাব কোথাও নুপুর তোমায় সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু পিছুটান! মস্তিষ্ক তাকে সজাগ করে দিলো, তোমার দাদীর কি হবে, বোনটার জীবন কেমন হবে?

______________

-স্যার, আজকে তো অর্ণব চৌধুরীর বোনরে দেখলাম কলেজের গেইটের সামনে।

……….

-আপনে না করার পর থাইকা আমি তো তারে ফলো করি না। আজকা ওই পথে যাইতে সময় চোখে পড়লো।

…..
-আইচ্ছা। অর্ণব চৌধুরীরে তো নয়ন নজরে রাখে আমি শুধু তার বোনরেই রাখতাম।

ওপাশ থেকে আরও কিছু হলো। গুপ্তচর এই লোকটি অর্নিতা ভেবে আগেও নুপুরকে নজরে রাখতো৷ ভুলটা সে আরও বছর দেড়েক আগেই করেছিল যখন অর্নিতা আর নুপুর কলেজে পড়তো একসাথে। কারো আদেশ পেয়েই সে অর্ণবের বোনের পেছনে লাগলেও একটা ভুলে অর্নিতার জায়গায় নজরবন্দী হয়েছিল নুপুর। আদেশক্রমে লোকটি ফলো করা বন্ধ করলেও পুনরায় অন্য একজনের আদেশেই সে আবারও নুপুরকে নজরবন্দী রেখেছে পার্থক্য শুধু এই এবারের আদেশকারী অন্য কেউ।

চলবে

কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-২৫

0

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-২৫

রাত আটটায় অর্ণব আবারও গেল বড় দাদার বাড়িতে। সন্ধ্যার পরই সাখাওয়াত ভাই বাড়ি ফেরে তা সে জানে বলেই আর দেরি করতে চাইছে না। গেইটের দারোয়ান কোন প্রশ্ন ছাড়াই অর্ণবকে ঢুকতে দিলেও বিপত্তি বাঁধলো ঘরের দরজায়। কলিংবেল বাজালো দু বার কিন্তু ওপাশ থেকে খোলার নামগন্ধ নেই। অফিস থেকে ফেরায় পরনে শার্ট, কোট। গরম লাগছে আজ ভীষণ তারওপর ক্লান্ত শরীরে দাঁড়িয়ে থাকতে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কোট খুলে হাতে নিয়ে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতেই আরও একবার বেল বাজালো। দরজাটা খুলল বড় ভাই সাখাওয়াতের বউ। অর্ণব কোনমতে সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। বড় ভাবী সালামের জবাব দিয়ে প্রশ্ন করলো, মেজাজ চড়েছে মনে হচ্ছে কি ব্যাপার?

-এ বাড়িতে আজকাল একবার বেল বাজালো ঢোকা যায় না মনে হচ্ছে বিল গেটসের চেয়েও বেশি সিকিউরিটি একানে বসেছে৷

-ওমা এ কথা কেন! এই রিমি এক গ্লাস শরবত কর তো।

বড় ভাবী কাজের মেয়েটাকে শরবতের কথা বলে অর্ণবকে বসতে বললেন। সে বসলো না জানতে চাইলো সাখাওয়াত বাড়ি আছে কিনা? ভাবী জানালেন, আছে।

-আমি দাদার ঘরে যাচ্ছি ভাইকে বলবেন আমি এসেছি।

-এখানে বসো শরবত খেয়ে একটু জিরিয়ে নাও দেখে মনে হচ্ছে অফিস থেকে ফিরেছো।

-হু।

-শুনলাম বিয়ে ঠিক হয়ে যায় মিষ্টি ছাড়াই সংবাদ পেলাম এটা তো ঠিক না।

অর্ণব দাদার ঘরের দিকে এগুতে এগুতে শুনলো ভাবীর কথা জবাব দিলো না। রিমি ততক্ষণে শরবতের গ্লাস হাতে ভাবীর সামনে দাঁড়িয়েছে।

-যা ও ঘরে দিয়ে আয় আর এখানে থেকেও তখন গেট খুললি না কেন?

-তওবা কাটছি না সকালে এই বেডায় আইলে জীবনেও দরজা খুলমু না আমি।

-ওহ সকালে ওর কথাই বলছিলি?

-হ ছোট ভাবীরেও কইছিলাম তো।

-ও একটু রাগী তবে মানুষ ভালো। যা শরবত দিয়ে আয়।

-আমি যামু না বেডার সামনে। দেখলেই মনে হয় সিনেমার গুন্ডা বাস্তবে আইয়া পড়ছে।

সত্যিই আর কাজের মেয়েটি শরবত নিয়ে গেলো না। ভাবী নিজেই শরবত দিয়ে সাখাওয়াতকে জানিয়ে এলেন অর্ণব এসেছে।
___________

সকালে বাড়ি এসেই রিদওয়ান মা আর বৃষ্টির সাথে টুকটাক আলাপ সেরে ব্যাগ আনপ্যাক করে গিফটগুলো বের করলো। বৃষ্টি প্রায়ই তার শখের কিছু জিনিসের লিস্ট দিতো। রিদওয়ান বোনের লিস্টের প্রায় অধিকাংশ জিনিসই প্রতি মাসে কিনে রাখতো সেই সাথে আসার সময় অর্নি, বাবা-মা, রিমন, অর্ণবের জন্যও কিনেছে। কিন্তু আসার সময় ওজনের বেশি হওয়ায় অনেক কিছুই প্যাক করেনি তার মধ্যে অর্নি আর তার নিজের জন্য কেনা প্লাটিনামের কাপল ব্রেসলেট। ছোট্ট জিনিস ছিলো তবুও সেটা রেখে বোনের পছন্দের পেন্ডেন্ট আর রিংটা নিয়ে এসেছে। ব্রেসলেটটা আসলে জায়গার অভাবে না মূলত অর্নিকে নিজের কাছে নিয়ে কোন এক বরফ ঝরা রাতে পরানোর ইচ্ছে বলেই রেখে এসেছে। এ দেশে বরফকুচির বর্ষণ কোথায় পাবে তাই প্ল্যান কষেছে খুব শিগ্রই অর্নিকে নেওয়ার আয়োজন করবে। ব্যাগের সকল জিনিস বের করে বৃষ্টিকে দেখাতেই সে বেশ উচ্ছ্বসিত হলো। মাও খুশি হলেন তবে তিনি অপেক্ষা করছিলেন ছেলের কাছ থেকে কিছু শোনার জন্য। প্রায় একটা বছর পর দেশে এলো রিদওয়ান মায়ের মন ভীষণ আগ্রহে চেয়ে দেখছে ছেলেকে। চেহারায় বদল এসেছে ছেলের অনেকটা। স্বাস্থ্যে খুব পরিবর্তন নেই তবে গায়ের রঙটা যেন আগের চেয়ে ফর্সা হয়েছে আর মাথার চুলগুলো আগের চেয়েও ছোট লাগছে। এইতো এইটুকুই তো পরিবর্তন আর কি দেখতে চাইছে মা! মায়ের দৃষ্টি লক্ষ্য করে অপ্রস্তুত হলো রিদওয়ান। বলতে চাইলো, কি দেখছো আম্মু? করলো না এই প্রশ্নটা উল্টো বলতে লাগল, তোমায় ভীষণ মিস করেছি আম্মু। প্রতি বেলায় খেতে বসে আর ক্লান্তির সময়টুকুতে শুধু মনে হতো তুমি যদি একটু মাথায় হাত রাখতে!

হ্যাঁ, ঠিক এটাই যেন শোনার আগ্রহে উতলা হয়েছিল রায়নার কান, হৃদয়। অন্তর শীতল করতে এই বাক্যগুলোরই দরকার ছিল মায়ের। মা জাতি বড় অদ্ভুত। লক্ষ, কোটি টাকার সম্পদের চেয়েও বড় তাদের কাছে বরাবরই সন্তানের আকুলতায় নিজেকে খুঁজে পাওয়া। মা সত্তায় বুঝি সর্বাত্মক পাওয়া সন্তানের ভালোবাসাই। রিদওয়ানের মুখ নিঃসৃত মাকে অনুভব করা বাক্যগুলোই সুখের সর্বোচ্চটা দিয়ে দিলো রায়নাকে। রিদওয়ানও মায়ের অন্তর শীতল করে চলে গেল আব্বুর কাছে। অফিসে গিয়ে রিমনকে পেলেও আব্বুকে পাওয়া গেল না। লাঞ্চের পুরো সময়টা রিমনের সাথে কাটিয়ে বাড়ি ফিরলো কঠিন মন নিয়ে। আজ রাতটাই সে বাড়িতে কাটাবে আর বোনকে বুঝিয়ে বলবে অর্ণবকে বিয়ে না করতে। যে পুরুষের মনে আগে থেকেই কেউ আছে সে পুরুষের সাথে বোনের সুখ ভাবাটা বড্ড বোকামি। রাত হলো আব্বুও ফিরলো আজ তাড়াতাড়ি। পুরো পরিবারের একত্রে দেখা হলো রাতের খাবারে। খেতে বসে বাবার স্বাস্থ্যের খোঁজ নিয়ে ধীরে সুস্থে খেতে লাগলো রিদওয়ান। পাশ থেকে রিমন বারংবার ইশারা করছে কিছু একটা তা বাবার চোখে পড়তেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কিছু বলবে?

-আমি না আব্বু; ভাই বলতে চায়।

-কি?

-খাওয়া শেষ করো সবাই ড্রয়িংরুমে বোসো তারপর।

রিদওয়ান কথাটা বলে খাওয়ায় মনোযগী হলো। বাশার শেখ কৌতূহলী হলেও খাওয়া শেষ করলেন ধীরেই। বৃষ্টির হঠাৎ গলা শুকিয়ে এলো খাবার খেতে পারলো না একদমই। কিছু সময় পর যখন সবাই একত্রে বসলো বসার ঘরে বৃষ্টি তখন চিন্তিত মুখে দেখতে লাগলো ভাই দুজনকে। তার আগেই ভয় হচ্ছে ভাইয়ারা কি অর্ণব ভাইকে নিয়েই কিছু বলবে! দুরু দুরু ভয় বুকে চোখেও জল থৈ থৈ তার। রিদওয়ান খেয়াল করেছে বোনের সজল নয়ন। বুকটা এবার তারও শুকিয়ে এলো মুখ খোলার আগেই। মন বলল থাক না কথাগুলো বোনটা যাকে চায় তাকেই পাক। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা না পাক তার ছোট্ট পুতুলটা। সে তো জানো হারানোর আতঙ্ক ঠিক কতোটা ভয়ানক। রিমন তাকিয়ে ছিল ভাইয়ের দিকেই। কখন তুলবে কথাটা আগ্রহে উতলা হচ্ছে। সেও তো ভালোবাসে বোনকে সে কি খারাপ চায় বোনের! কিন্তু রিদওয়ানের চোখ মুখ বলছে অন্যকথা। ছন্নছাড়া ভাইরা বিয়ের পর খুব বেশিই আবেগী হয়ে গেছে বলে মনে হলো। ভয় হলো ভাই না আবার আব্বুর মতোই হঠকারী সিদ্ধান্তটিকে প্রাধান্য দেয়।

-আমিই কথা শুরু করছি।

রিদওয়ান শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলে এই ভয়ে রিমনই মুখ খুলল।

-কি কথা?

-বৃষ্টির বিয়ের কথা।

রিদওয়ান কথা বলল। বাশার শেখ কি করে যেন বুঝে গেল ছেলেরা দুজনই অর্ণবের সাথে বৃষ্টির বিয়ের বিপক্ষে তাই আগে ভাগে তিনি জায়গাটা থেকে বৃষ্টিকে সরিয়ে দিলেন পড়াশোনার নাম করে। রায়না বসেছিলেন তাকেও পাঠালেন কফির বাহানায়। বসার ঘরটিতে তখন রইলো শুধু রিদওয়ান, রিমন আর তাদের বাবা। রিদওয়ানই বলল এবার, ‘হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত কেন নিলে আব্বু?’

-বয়স হয়েছে মেয়েকে বিয়ে দেবো না?

– সামনে ফাইনাল পরীক্ষা বৃষ্টির আর তো কয়েকটা মাস তাছাড়া অর্ণবের সাথে কেন?

রিদওয়ান কথাটা শেষ করতেই বাশার শেখ ধমকে উঠলেন ছেলেকে।

-সেই কৈফিয়ত কি তোমাকে দিতে হবে? আর তুমি কি ভেবেছো ভাইকে এনে আমার সামনে দাঁড় করালেই আমি তার কথা শুনবো?

শেষের কথাটা রিমনকে উদ্দেশ্য করে বললেন তিনি। রিমন জবাব দিতে চাইলে রিদওয়ান থমিয়ে দিলো তাকে।

-ও কিছুই বলেনি। আমি নিজেই তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি আব্বু। অর্ণব অন্য একটি মেয়েকে পছন্দ করে আজ নয়তো কাল সে মেয়েটিকে জানাবেও সে কথা আর বিয়েও……

-চুপ করো তুমি বেয়াদব ছেলে। নিজে যা ইচ্ছে করে পার পেয়ে গেছো বলে খুব বড় ভাবছো নিজেকে? আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি হবে সেটাই। অর্ণবকে নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। আর হ্যা, দেশে যেহেতু এসেই গেছো বোনের বিয়ে খেয়ে তবে যেয়ো। এ মাসের শেষেই তারিখ ঠিক করবো। আমার মেয়ের ভালো মন্দ নিয়ে তোমরা কোন কথা না বললেই আমি খুশি হব।

নিজের বক্তব্যটুকু শেষ করেই বাশার শেখ স্থান ত্যাগ করলেন। রায়না কফি হাতে উপস্থিত হতেই ছেলেদের বিমর্ষ মুখ দেখলেন। স্বামী মানুষটাও এখানে নেই তবে কি তাদের মধ্যে কোন ঝামেলা তৈরি হলো! সকাল থেকেই তো মনটা কু ডাকছিলো তারওপর রিমন কয়েকদিন ধরে রেগে আছে তার বাবার ওপর। সব মিলিয়ে ভয় পাচ্ছেন রায়না। ছেলেদের সামনে কফি রেখে কি হয়েছে জানতে চাইলেন। রিদওয়ান অস্থির হয়ে মায়ের হাত দুটো ধরলো, আব্বুকে বোঝাও আম্মু এভাবে বিয়ে দিয়ে বৃষ্টি সুখী হবে না। একটিমাত্র বোন আমাদের তার জন্য হাজারটা খুঁজে ব্যাটার মানুষটাকেই আমরা আনবো।

রায়না শুনলেন ছেলের কথা জবাবে চুপ রইলেন। তিনি রিমনের মুখে যেদিন শুনলেন অর্ণব কাউকে পছন্দ করে সেদিন থেকেই মেয়েকে বুঝিয়ে চলছেন। বৃষ্টি কান্নাকাটি করছে তবুও কথা মানতে চাইছে না। কাল রাতে তো নির্লজ্জের মত বলেই বসলো, বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে আম্মু৷ পুরুষ মানুষ এক রাত কাটলেই সব ভুলে যাবে।

মেয়ের মুখের কথা শুনে তিনি কান চেপে সরে এসেছেন লজ্জায়। এরপর আর কিছু বলার নেই মেয়েকে। কিন্তু অর্ণব কেন চুপচাপ সেটাই তিনি বুঝতে পারছেন না।

___________

-অবহেলা করলে তা ফিরে আসবেই সে কথা জানেন তো!

স্পষ্ট রূঢ় আর গাঢ় অভিমানী স্বর শোনা গেল নুপুরের কণ্ঠে।

-ভুল ভাবছো। কাউকে অবহেলা করার ক্ষমতা আমার এখনো হয়নি৷ আগেই ক্ষমা চেয়ে নেওয়া উচিত বলে চাইছি। ক্ষমা করে দিও যদি আমার কথাবার্তাতে কোন প্রকার প্রশ্রয় পেয়ে থাকো তো!

– আরেহ না না…. আপনি আর প্রশ্রয়! আমারই ভুল। অবহেলা, প্রশ্রয় কোনটাই আপনি করেননি আমি ভুল বুঝে এসেছি। আজকের পর আর বুঝবো না। ভালো থাকবেন।

কথার সমাপ্তি টেনে কল কেটে দিলো নুপুর। অর্ণব ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো গলির অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তার কিনারায়। চোখ সওয়া আঁধারে বিষন্নতা সবেই গা ছুঁয়ে দিচ্ছিলো কি আবার মনে পড়ে গেল বড় দাদার ঘরের বাইরে হওয়া সাখাওয়াতের প্রচ্ছন্ন হুমকিটা। সাথে সাথেই পা বাড়ালো থানায়। যার জন্য গেল তাকেই পাওয়া গেল না। ফোন করে জানতে পারলো লোকটা নিজ বাড়িতেই আছে৷ অর্নব আবার গেল সেদিকে। পরিচিত পুলিশ সুপার আনোয়ারের সাথে কথা বলে একটা জিডি করতে চেয়েও শেষ মুহূর্তে মত পাল্টালো। বংশের লোকের সাথে এভাবে সরাসরি বোধহয় লড়াই করা যায় না। বড় দাদার সাথে কথা হলো খুব স্বাভাবিক আর কথা হলো ছোট দাদার গ্রামের পুরো বাইশ বিঘা কৃষি জমি নিয়ে৷ এই জমির কথা অর্ণব বহুবার শুনেছে দাদার মুখে, দাদীর মুখে কিন্তু নিজ চোখে সবটা দেখা হয়নি। অনেক বছর হয়েছে মনেও পড়তো না সেগুলোর কথা। গত বছর লোনের জন্য যখন প্রথম আবেদন করলো সে তখন দাদী এই জমির কথা বললেও আসল কাগজপত্রের হদিশ করতে পারেননি৷ অর্ণবও সে জমি বাদ রেখেই শুধু শহুরে জমিগুলোর পেছনে পড়েছিল যেহেতু এই জমিগুলোর আইনানুসারে অর্ণবের নাম করা। অথচ এখানেও পিঠ পিছে গুটি চালছিলো আপন রক্ত। সাখাওয়াত ভাইয়ের শীতল ধমকিটা তাই যেন বুঝিয়ে দিলো তাকে। এরপর আর মাথায় এলো না আবেগতাড়িত কোন কথা তাই নুপুরের ফোন কল পেয়ে মুখের ওপর বলে দিলো ক্ষমা করে দিও আমার মাধ্যমে কোন রূপ আঘাত পেয়ে থাকলে। তার কথার প্রেক্ষিতেই দু চার কথা বেড়ে গেল। নুপুরও ভেবে বসলো অর্ণব কোন কারণে তাকে অবহেলা করছে।

___________

গত রাতেই আব্বুর সাথে বাক বিতন্ডা শেষ করে রিদওয়ান বৃষ্টির সাথে কথা বলেছিলো। নিভৃতে বড় স্নেহের সাথে বুঝিয়েছে বোনকে যেন বাবাকে বোঝায় বিয়েটা ক্যান্সেল করতে। বৃষ্টিও চুপচাপ ভাইয়ের হ্যাঁ তে হ্যাঁ ভাইয়ের না তে না মিলিয়েছে। সকাল হতেই সেই হ্যাঁ না’তে বড় গোলযোগ বাঁধিয়ে বাবার সামনে উপস্থাপন করতেই শেখ বাড়িতে শুরু হলো ঝড়। মানসিক ঝড়ের সামনে প্রকৃতি যেন নগন্য তেমনটাই মনে হলো বাবা আর দুই ছেলের মধ্যকার ঝগড়ায়।রিমন বরাবরই কঠিন স্বভাবের। নিজেরটা আদায় করে নিতে সে সর্বাত্মক লড়াই চালাতে সক্ষম কিন্তু রিদওয়ান এ ব্যাপারে বড্ড আনাড়ি৷ বহু মুশকিল পথ পেরিয়ে না সে পেরোয়নি বরং রিমন পথ সুগম করে দেওয়ায় সে পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছে অর্নির কাছে। আজ কি করে জিতে যেতো বাবার সাথে! আজও ঢাল হলো রিমন তলোয়ার হলো রিদওয়ান। বাবার সাথে প্রথম এবং বোধকরি, শেষ বারের বেয়াদবি করে বাড়ি ছাড়লো সে। কিন্তু এভাবে কতদূর….।রাতের মধ্যে ফিরে গেল চট্টগ্রামে। হোটেলে রুম বুক করা না থাকায় রাতটা হোটেলের লবিতে চেয়ারে বসে কাটিয়ে পরের দিন রুম বুক করলো। জরুরি তলবে অর্নিকে নিয়ে এলো দুপুর নাগাদ। ভেবেছিল নিজেই সবটা সামলে নেবে তা আর হলো না বলে অর্নিকে জানিয়ে দিলো সবটা। একদফা কান্নাকাটি করে অর্নি ফোন দিলো ভাইকে৷ রিদওয়ানের শিখিয়ে দেয়া অনেকগুলো বাক্য একসাথে আওড়াতেই ধমক খেলো ভাইয়ের কাছে৷ অর্ণব মুখের ওপর বলে দিলো, ‘আমি কাকে বিয়ে করবো সেটা কি তুই আর তোর জামাই ঠিক করে দিবি?’

ফোন স্পিকার লাউড থাকায় সবটা শুনলো রিদওয়ান। অর্ণবের ধমকে অর্নির মত সেও প্রথমে থমকে গেল পরমুহূর্তেই বোকার মত প্রশ্ন করলো, বয়সে তুই বড় না আমি?

-দ্যাখ রিদওয়ান মাথা খারাপ করাবি না অফিসে আছি।

-তুই কোথায় আছিস তা শুনে আমি কি করবো? আমার এক কথা বৃষ্টির বিয়ে দেব না তোর সাথে।

-তুই বললেই হবে?

-অবশ্যই। আমি তার বড় ভাই।

-আমি অর্নির বড় ভাই।

অর্ণবের গম্ভীর স্বরের এই একটা বাক্য কেমন যেন বুকটা চেপে ধরলো রিদওয়ানের৷ না চাইতেও বুঝি একটুক্ষণের জন্য ভয় পেয়ে গেল সে তাই ভীত গলায় বলল, ‘তো! এ্যা এ্যাই অর্ণব আমার বিয়ে হয়ে গেছে থ্রেট দিবি না একদম বলে দিলাম।’

-আমি কিছু বলেছি? হেসে ফেলল অর্ণব।

চলবে