প্রিয়ার আজ দুদিন হলো সর্দি, জ্বর। প্রথমদিন কাজে যেতে পারলেও পরের দিন ফোন করে নিজের অপারগতা জানাল। ভেবেছিল একটা দিন বিশ্রাম নিলেই সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু হলো উলটো। সর্দি, জ্বরের সঙ্গে এবার যুক্ত হলো কাশি। কিন্তু আজ আর বাড়িতে বসে থাকা যাবে না। সে সকাল সকাল উঠে আগেভাগে রান্না সেড়ে নিল। মায়ের অসুস্থতা তাকে অল্পবয়সেই অনেকটা সাবলম্বী হতে শিখিয়েছে। তবে রান্না মোটামুটি জানলেও মাটির চুলায় হাত পুড়িয়ে রান্নার অভ্যাস প্রিয়ার ছিল না। আর না কখনো ভাবতে পেরেছে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! গত তিনটে মাসে এমন অনেক অনভ্যস্ত কাজ সে করতে শিখেছে৷ রুটিন করে খাবার খেয়ে অভ্যস্ত দেহের এখন খাওয়ার কথা মনে থাকে না। নিজের বাথরুমে বাইরের মানুষকে এলাও না করা মেয়েটা এখন লাইন ধরে গোসল, পানি তোলা সব করে।
প্রিয়ার মা মুনিরা হাঁটা-চলা করতে পারেন না। তিনি দীর্ঘদিন যাবত প্যারালাইজড রোগী। আগে উন্নত চিকিৎসা পেয়েছিলেন বলে দ্রুত রিকোভার করলেও এখন জীবনের পালাবদলে ডাক্তার দেখানোর ক্ষমতাও নেই। ফলে কোমড়ের নিচ থেকে অবস পা দুটো নিয়ে মেয়ের ঘাড়ে পড়ে আছেন। ঘরের কাজ মাকে যেন করতে না হয় সেই চেষ্টাই করে যায় প্রিয়া ও তার দশ বছর বয়সী বালিকা বোন দিয়া। বিশাল অট্টালিকা ছেড়ে ঘিঞ্জি, খোপের মতো টিনের ঘরে এখন তাদের বসবাস। বিশাল ঘরে শৌখিন আসবাবে হাত-পা ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলো এখন স্থান সংকুলান মুশকিল একটি ঘরে গাদাগাদি করে থাকে। ঘরে একটা চৌকি ঠাঁই দেওয়ার পর যতসামান্য স্থানই অবশিষ্ট আছে হাঁটাচলার জন্য। সেই স্থানেই খাওয়া ও সমস্ত দরকারি জিনিসপত্রের ঠাঁই হয়েছে। আসবাব বলতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ব্যতীত কিছুই নেই অবশ্য। কাপড় ঝুলিয়ে রাখা হয় টিনের দেয়ালে বাঁধা রশিতে। হাড়ি-পাতিল কাঠের শক্ত তক্তায় তুলে রাখা। ইঁদুর, তেলাপোকা, ছারপোকা তাদের নিত্য সঙ্গী। বস্তির পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে তিন মা-মেয়ে প্রাণান্ত চেষ্টায় মত্ত।
মুনিরা বেগম মেয়েকে পরিপাটি হতে দেখে বললেন,
“সকাল থেকেই খুকখুক করে কাশছিস। আজ যাওয়ার দরকার নেই। ফোন করে বলে দে।”
প্রিয়া চুলে বিনুনি গাঁথতে গাঁথতে বলল,
“প্রথম মাসেই যদি এত কামাই করি তবে ওরা আমায় রাখবে?”
“না রাখলে না রাখবে।”
“তখন খাবে কী?”
“মেয়ে অসুখ নিয়ে কাজ করবে আর আমি বসে বসে গিলব? তারচেয়ে না খেয়ে ম’রব।”
প্রিয়া করুণ চোখে তাকায়। মা আবার কাঁদতে বসেছে। সে ভেবে পায় না একটা মানুষ কী করে এত কাঁদতে পারে। এতগুলো দিনে তো চোখের পানি শুকিয়ে যাওয়াত কথা। প্রিয়া মুখে ওড়না চেপে কেশে বলল,
“তোমার মেয়ে না খেতে পেয়ে ম’রছে তুমি সহ্য করতে পারবে। কিন্তু আমার মা-বোন না খেতে পেয়ে ম’রছে আমি মানতে পারব না। তাই আমাকে যেতেই হবে।”
প্রিয়া তার বাটন ফোনটা ব্যাগে ভরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। মুনিরা বেগমের কান্না ততক্ষণে আবার থেমে গেছে। পিছু ডেকে বললেন,
“একবার থানায় যাবি? তোর বাবার কোনো খোঁজ আনতে পারিস কি-না…”
প্রিয়া কোনো প্রত্যুত্তর না করে পায়ে জুতো গলিয়ে বেরিয়ে গেল।
গলির মোড়ে যথারীতি রঞ্জুকে দেখা যায়। আজ রঞ্জুর বেশভূষা চমকপ্রদ। চোখে লাগার মতো রঙিন শার্ট পরে, বুকের দুটি বোতাম খুলে রেখেছে। পরনের প্যান্ট হাঁটু থেকে ওপরের দিকে প্রায় ছয় ইঞ্চি ছেঁড়া। চোখে রোদচশমা লাগানো, যদিও আজ রোদের দেখা নেই। প্রিয়া পাশ কেটে চলে যাচ্ছিল। রঞ্জু ওকে দেখতে পেয়ে ডাকল,
“এই প্রিয়া!”
প্রিয়া বিরক্তি আড়াল করে দাঁড়ায়। বলে,
“কিছু বলবেন, রঞ্জু ভাই?”
রঞ্জু ছুটে এসে প্রিয়ার সামনে দাঁড়িয়েছে। ঠোঁটে অনাবিল হাসি। বলল,
“মুখ ফিরাইয়ো না। আজকে কোনো গন্ধ পাইবা না। ক্লোজআপ দিয়া দাঁত মাজছি।”
“এটা বলতে ডেকেছেন?”
“আরে না। সব সময় মুখটারে ওইরকম চৈত্র মাসের দুপুরের মতো খরখরা কইরা রাখো ক্যান? হাসতে পারো না?”
“শুধু শুধু হাসব কেন?”
“তোমার টিকটিক আইডি আছে? টিকটক দেখলে মন ভালো থাকে। বেশি বেশি টিকটক দেখবা। আর আমার আইডিতে একটা ফলো দিয়ো।”
প্রিয়া এতক্ষণে বুঝল রঞ্জু ভাই এই বেশভূষায় এখানে টিকটক ভিডিও বানাচ্ছিল। বলল,
“আমার টিকটক আইডি নেই, রঞ্জু ভাই। স্মার্ট ফোনও নেই। আপনাকে ফলো দিতে পারলাম না।”
“তাতে কী? চাইলে আমার ফোনে দেখতে পারবা।”
প্রিয়া সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“আপনি দিয়াকে আপনার ফোনে টিকটক দেখতে দেন, তাই না?”
রঞ্জু হেসে বলল,
“হ, তোমার বইন তো টিকটক পছন্দ করে। ভালো নাচও পারে। কইছি ওরে একটা আইডি খুইলা দিমু যেন সবাইরে নিজের প্রতিভা দেখাইতে পারে।”
প্রিয়া এতক্ষণে নিশ্চিত হলো দিয়া কেন একটা স্মার্ট ফোনের জন্য আফসোস করে। তার ইচ্ছে হলো এই মুহূর্তে রঞ্জুকে কিছু কড়া কথা শোনায়৷ ইচ্ছেটাকে বুকের ভেতর পিষে ফেলল নিভৃতে। একটু নরম স্বরে বলল,
“আপনি আমাদের সিনিয়র, রঞ্জু ভাই। পাড়ার একজন অবিভাবক আপনি। আপনার উচিত পাড়ার উন্নয়ন, অবক্ষয়ের দিকে খেয়াল রাখা। মানুষের উপকার করাই তো আপনার স্বভাব। অথচ আপনিই যদি বাচ্চা ছেলেমেয়েদের টিকটক করতে, টিকটক দেখতে উৎসাহিত করেন তবে ওরা কী শিখবে? সবাই টিকটক নিয়ে হাসি-মজায় ডুবে থাকলে উপকার কে করবে? আপনার জৌলুশ তো হারিয়েই যাবে।”
রঞ্জুকে বিভ্রান্তিতে ফেলে প্রিয়া চলে গেল।
_____________
জাইমকে একটা গোটা দিন সামলাতে অন্তরার মায়ের বেশ ধকল গেছে। তিনি এখন কিছুটা সুস্থ। কিন্তু আলসে স্বভাবের জন্য শুধু আরাম খোঁজেন। মুখ অবশ্য আরাম খোঁজে না। উনার খবরদারিতে এ বাড়িতে কাজ করতে এসে কেউ বেশিদিন টিকতে পারে না৷ সে ক্ষেত্রে প্রিয়া আলাদা। দরকারের বাইরে তেমন কথা বলেও না, গায়েও মাখে না। হুট করে গতকাল না আসায় ভাবলেন এ-ও চলে গেল কিনা! মনে মনে আফসোস করলেন বেশ। মেয়েটা ভালো ছিল। এমন শিক্ষিত, নম্র মেয়ে হাতছাড়া হওয়া ঠিক না। যার তার হাতে তো আর একমাত্র নাতিকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এই সময় বাচ্চারা থাকে কাদামাটির মতো। যার সঙ্গে থাকবে তারই বৈশিষ্ট্য আহরণ করবে।
প্রিয়াকে নিয়ে আফসোস করার সময়ই তাকে ঢুকতে দেখা গেল বাড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে জয়নব অবাক হয়ে বললেন,
“তুমি তাহলে পালাওনি?”
প্রিয়া খুকখুক করে কাশতে কাশতে দরজা আটকে দিল। বৃদ্ধার কথার মানে বুঝতে না পেরে বলল,
“পালাব কেন?”
এতক্ষণ বৃথা আফসোস করেছেন বলে জয়নব স্বাভাবিক হয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। বললেন,
“কাশছো কেন? যক্ষা টক্ষা বাঁধিয়েছ নাকি?”
“ভাইরাল ফিভারের প্রভাব, আন্টি।”
জয়নব মুখ বেঁকিয়ে বললেন,
“সবই কাজে ফাঁকি দেওয়ার ধান্দা। এইসব টেকনিক আমার খুব ভালো করে জানা।”
অনুভব বাড়িতেই ছিল। ভাবীর মায়ের কথা শুনতে পেয়ে সে রুম থেকে গলা উঁচিয়ে মশকরার সুরে বলল,
“জানবেনই তো, আন্টি। আপনি আবার এইসব টেকনিকে পিএইচডিধারী কিনা।”
জয়নব কটমট করে উঠলেন। মেয়ের সংসারে বেকার দেবরের উপদ্রব উনার মোটেও পছন্দ না। অন্তরাকে বেশ কয়েকবার আলাদা হতে বলেছেন। কিন্তু অনুভবদের দুই ভাইয়ের বন্ধন দৃঢ়। জাভেদ তার পরিবারহীন একমাত্র ছোটো ভাইয়ের সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছে। সেখানে টাকার চিন্তার চেয়েও ভাইয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ে তোলাটাই মূখ্য।
অনুভব রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। প্রিয়ার মুখটা জ্বরের প্রভাবে শুকিয়ে আছে দেখে বলল,
“তোমার জ্বর কী সারেনি, হাসু?”
প্রিয়া শুধু আস্তে করে না বোধক মাথা নাড়ল। অনুভব আবার বলল,
“মেডিসিন নিয়েছিলে?”
“নিয়েছি। জ্বর কিছুটা কমেছে কিন্তু ঠান্ডা আর কাশির প্রকোপটা বেড়েছে।”
রোগা-পাতলা, বাচ্চা দেখতে একটি মেয়ে অসুখ নিয়েও কাজে চলে এসেছে দেখে অনুভবের না চাইতেও একটু মায়া হলো। বলল,
“আজ ছুটি নিতে। আন্টি তো এখন অনেকটাই সুস্থ। জাইমকে রাখতে পারত।”
কথাটা পছন্দ হলো না বৃদ্ধার। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন,
“নিজে কিছু করোনা বলে অন্যকেও বলবে? মাস গেলে বেতনটা তো তুমি দাও না।”
“আপনি দেন বেতন?” প্রশ্নটা করতে গিয়েও নিজেকে সংযত করল অনুভব। নয়তো শুরু হয়ে যাবে গৃহযুদ্ধ। তাকে নিয়ে বৃদ্ধার মনোভাব ঠিক কী বুঝতে অসুবিধা হয় না ওর।
প্রিয়া জাইমকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে বলল,
“আমার অসুবিধা হবে না, আন্টি।”
অনুভব আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। সেই সুযোগে জয়নব প্রিয়াকে কাছে ডেকে সতর্ক করে বললেন,
“বাড়ির পুরুষ মানুষদের থেকে দূরে থাকবে। অত কথা বলার দরকার নেই।”
কথাটায় প্রিয়া বিব্রত হলেও জবাব দিল না।
দুপুর নাগাদ জাভেদ এলো বাড়িতে। সে পেশায় একজন ডাক্তার। প্রিয়ার কাশি ও নাক টানা শুনে বলল,
“ডাক্তারের বাড়িতে অসুস্থ রোগী! এ তো মানা যায় না। কোনো ডাক্তার দেখিয়েছ?”
প্রিয়া সামনে তাকাল। ডাইনিং টেবিলে বসে অনুভব নির্বিকার ভঙ্গিকে ওকে দেখতে দেখতে কলা খাচ্ছিল। প্রিয়া হুট করে বলে ফেলল,
“একদম পাকা কলার মতো।”
অনুভব বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল। সদ্য কামড় দেওয়া কলাটা হাত ছুটে পড়ে গেল। প্রিয়াও একটু ভ্যাবাচেকা খেল অবশ্য৷ কাঁচা-পাকা বলতে গিয়ে তার মুখ দিয়ে এমন উদ্ভট শব্দ বের হবে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি। মুখ ফসকে বিব্রতকর কথা বলে ফেলার অভ্যাসটা তার কেন যে যায় না! কি লজ্জা! কি লজ্জা!
অনুভব দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“হাসুরে, জন্মের মতো আমার কলা খাওয়ার সাধ মিটিয়ে দিলি!”
সকাল প্রায় নয়টার কাছাকাছি। প্রিয়া বস্তির ঘিঞ্জি পথ মাড়িয়ে বড়ো রাস্তায় উঠতেই আচানক রঞ্জুর সামনে পড়ে গেল। রঞ্জুর হলদেটে চোখদুটি চকচক করে উঠল। সেই চোখের ভাষা যেন বলছে সকাল সকাল প্রিয়ার দর্শনে সে মুগ্ধ, কৃতার্থ। চলার পথে বাঁধা পেয়েও প্রিয়ার গতি সামান্যতম রোধ হলো না। চোখ তুলে এক পলক রঞ্জুকে দেখে আবারো পাশ কাটিয়ে চলতে লাগল। রঞ্জুও পিছু ধরল। গলা খাকারি টেনে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে বলল,
“প্রিয়া, ভালো আছো?”
প্রিয়া ভেতরে ভেতরে যেন এই আশঙ্কাই করছিল। এই এলাকায় আসার পর থেকেই রঞ্জু ছুঁকছুঁক করছে। রাস্তায় পেলেই খোশগল্প করার চেষ্টা চালাচ্ছে। যদিও প্রিয়ার হিমশীতল নির্বিকারত্ব ভাব জমানোর চেষ্টাকে নিরাশ করছে। তবে রঞ্জু দমে যাওয়ার পাত্র নয়। মান-অপমান বোধ খুবই ক্ষীণ ছেলেটার। প্রিয়া তা বুঝেই চলার গতি বৃদ্ধি করে। কিন্তু প্রশ্নের জবাবে কিছু না বললেও হচ্ছে না। একই এলাকায় থেকে এলাকার সুপরিচিত, সাহায্য পরায়ণ ব্যক্তিটুকে পাত্তা না দিয়ে চলাও যাবে না। যদিও রঞ্জু গায়ে পড়া, কিন্তু সকলের সমস্যায় তাকেই আগে পাওয়া যায়। তাছাড়া প্রিয়ার পরিবার বলতে মা আর ছোটো বোন। ওদের একা রেখেই কাজে যেতে হয়। সর্বদিক বিবেচনায় প্রিয়া কথার উত্তর দেবে বলে মনস্থির করল। মুখ না ফিরিয়েই আস্তে করে বলল,
“জি, ভালো আছি।”
রঞ্জু একটু থতমত খেয়ে গেল। পরক্ষণেই হেসে বলল,
“তাও ঠিক। আমি কেমন আছি তা দিয়া তোমার কী? তা আন্টি ভালো আছে? ছোটো বইন?”
“সবাই ভালো আছে।”
রঞ্জু এবার কণ্ঠে অভিভাবকত্ব ফুটিয়ে বলল,
“নতুন পরিবেশে মানাইয়া নিতে কষ্ট হইতাছে নাতো? কোনো ঝামেলা হইলে জানাইতে পারো।”
“কেন?” প্রিয়া সরল মনেই প্রশ্ন করল।
রঞ্জু আবারো হেসে বলল,
“আমরা তো এখন প্রতিবেশী। আর প্রতিবেশীরাই প্রতিবেশীর খোঁজ নেয়। আমি তোমাগো খোঁজ নিমু, তুমি আমার।”
“ওহহ!”
“তুমি অনুভব ভাইগো বাড়িত কাম নিছো শুনলাম। তুমি নিজেই তো একটা বাচ্চা আবার আরেক বাচ্চা সামলাইবা কেমনে?”
প্রিয়া বিরক্তি চেপে জবাব দেয়,
“রঞ্জু ভাই, যদি ভুল না হই তবে আমার চেয়েও কম বয়সে আপনার মায়ের কোলে আপনি ছিলেন।”
“তুমি ঠিক। তবে যুগ বদলাইছে না! আগের দিনে মাইয়ারা হাঁটা শিখলেই শাড়ি পরত। ডাঙর হইলেই বিয়া। এখন তো আর সেই যুগ নাই। সেই হিসাবে তুমি ছোটোই আছো।”
বলে রঞ্জু আবারও হাসল। হাসিটা তার বাতিক। বিপরীতের মানুষটা যতই ধরাশায়ী, বিব্রতকর উত্তর দিক না কেন সে সর্বদাই হাসবে। রঞ্জু খেয়াল করল প্রিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে তার সঙ্গে কথা বলছে। হাঁটতে হাঁটতে একবারও তার দিকে ফেরায়নি। রঞ্জু আফসোসের সুরে বলল,
“মুখ ফিরাইয়া রাখলা ক্যান? আমি অশিক্ষিত, কালা মানুষ বইলা কি চাইয়াও দেখা যায় না?”
“সে জন্য না।”
“তাইলে? শরম পাও?” উৎসুক শোনায় রঞ্জুর কণ্ঠ।
“উহু, আপনার মুখে দুর্গন্ধ।”
রঞ্জুর পা থেমে গেল। চিরস্থায়ী হাসিও হুট করে মিলিয়ে গেল। কালচে, মোটা ঠোঁট দুখানি একে অপরকে চেপে ধরে মুখের কবাট আটকে দিল। প্রিয়া বেফাসে কথাটা বলে নিজেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। সে রঞ্জুর দিকে ফিরে দেখার সাহস পেল না। প্রায় ছুটে চলে গেল।
_____________
অনুভব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র৷ একটু বাদেই তার গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্লাস অনলাইনে এটেন্ড করতে হবে। অথচ আদরের ভাতিজা জাইমকে কোলে নিয়ে সে শূন্য ঘরে অসহায়ের মতো বসে আছে। ইতিমধ্যে জাইমের ছোটো অথচ পাতলা ও ধারালো নখের দ্বারা অনুভবের ফরসা নাকে বেশ কিছু সুচারু নকশা ফুটে উঠেছে। জ্বালা করছে সেখানটায়। এই ছটফটে, দুষ্টুকে নিয়ে ক্লাস এটেন্ড করাও অসম্ভব। এদিকে বাচ্চার ডাক্তার বাবা তার শাশুড়িকে নিয়ে গেছে মেডিকেল চেকআপে। অন্তরা ভাবীও একটু আগে অফিসে বেরিয়ে গেছে। অনুভবের নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয়। একটা মেয়েকে না রাখা হয়েছিল জাইমের কেয়ারটেকার হিসেবে! তারও কোনো খবর নেই। নাকি চাকরি ছেড়ে দিল! অবশ্য বৃদ্ধা জয়নব বানুর বদৌলতে এ বাড়িতে কেউই বেশিদিন টিকতে পারে না। ভাবনার মাঝেই কলিংবেল বাজল। দরজা খুলতেই দেখল বাঁশের কঞ্চির মতো পাতলা অথচ সতেজ দেহটির মতো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়া। অনুভবকে দেখে তার চোখে অপ্রস্তুতভাব ফুটে উঠেছে। চোখের তারা টিমটিমে প্রদীপের মতো পিটপিট করে ওঠে। প্রথমদিনের বিব্রতকর সাক্ষাতের পর প্রিয়া চেষ্টা করেছে এই চোখ ধাঁধানো রূপবান ছেলের ছায়াও এড়িয়ে চলতে। স্বস্তির বিষয় অনুভব বাইরেই থাকে সারাদিন। তাই দেখা হয় না।কিন্তু আজ ঢুকতেই দেখা! যাকে বলে বিড়ালে পথ কেটেছে। দিনটা শুভ গেলে হয়।
অনুভব অতিশয় রুক্ষমূর্তি রূপ ধারন করে আছে। গমগমে স্বরে বলে উঠল,
“দুদিন কাজে আসতে না আসতেই শুরু হয়ে গেছে ফাঁকিবাজি?”
অনুভবের দৃষ্টি পাখির সরু চঞ্চুর মতো হয়। দেহের সমস্ত রাগ চুইয়ে এসে নাকের ডগায় জমেছে যেন। এই মেয়ের মাঝে নিজের দোষ স্বীকারের কোনো অভ্যাসই নেই দেখা যাচ্ছে! ধমকটা প্রায় দিতে গিয়েও ভাতিজার সরল মুখপানে চেয়ে গিলে ফেলল সে। বাচ্চাটা ভয় পাবে। কণ্ঠ খোঁড়া করে চাপা ক্রোধে ফুঁসতে ফুসতে বলল,
“এক মিনিট লেট হলেও সেটা লেট-ই। জাইমকে নাও। নয়তো এবার আমার ক্লাসে লেট হবে।”
প্রিয়া হাত বাড়িয়ে দিতেই জাইম নিচের পাটির দাঁত দুখানি দেখিয়ে হাসে। সরল, অপাপবিদ্ধ সেই হাসিতে আপনাতেই বুকের ভেতর শিশিরের মতো টিপ টিপ করে মায়া ঝরে। জাইম লাফিয়ে চাচুর শক্ত দেহ থেকে প্রিয়ার নরম কোলে চলে আসে। বাচ্চাটা ইতিমধ্যে তাকে ভালোমতো চিনে ফেলেছে। প্রিয়া এদিক ওদিক চেয়ে প্রশ্ন করল,
“বাড়িতে কেউ নেই?”
“কেন আমাকে দেখা যায় না?” তেরছা স্বরে পালটা প্রশ্ন করে অনুভব।
প্রিয়া হতাশ হলো। এই ছেলেটা কি সারাদিন উত্তপ্ত কড়াই হয়ে থাকে নাকি! কিছু বললেই ছ্যাঁত করে ওঠে। প্রিয়া বিরস বদনে বলল,
“আপনি ছাড়া আর কেউ? আন্টি?”
“বুড়ি হাসপাতালে গেছে। বাড়িতে আপাতত তুমি আমি আর জাইম। আমাকে ভয় লাগলে ঘরে গিয়ে দরজা আটকে থাকো।”
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে অনুভব প্রস্থান করে। প্রিয়া ছোটো ছোটো চোখে চেয়ে থাকে।
অনুভব ক্লাস শেষে বেরিয়ে এসে এক গ্লাস পানি খেল। রহমান স্যারের ক্লাসে একেবারে ঘাম ছুটে যায়। ভাইয়া-ভাবির ঘরের দরজা খোলা। ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা হেঁটে হেঁটে জাইমকে ঘুম পাড়াচ্ছে প্রিয়া। অনুভব আস্তে করে ডেকে বলল,
“এই হাসু, শুনে যাও।”
নামটা কর্ণকুহর ভেদ করতেই প্রিয়ার মুখে ঝুপ করে আঁধার নামল। মনে মনে বিড়বিড় করল,
“বাজে, সবচেয়ে বাজে নাম।”
জাইমকে শুয়িয়ে দিয়ে গুটি গুটি পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে আসতেই অনুভব আবার বলল,
“জাইমের নখগুলো কেটে দিয়ো তো। আমার নাকের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।”
“আচ্ছা। কিন্তু বাবুর নেইল কাটার কোথায় সেটা আমার জানা নেই। না বলে কোথাও খোঁজাটা ঠিক হবে না। আপনি কী একটু খুঁজে দেবেন, অনু ভাইয়া?”
অনু ভাইয়া! মুহূর্তেই ছোটোখাটো একটা বজ্রপাত হলো সুদর্শন পুরুষটির মাথায়। অনুভবের মনে হলো তার নামটাকে কেউ ঢোলের ওপর ফেলে দুমদাম বাজিয়ে দিল। মেয়েটা কী নামের প্রতিশোধ নিচ্ছে? অনুভব এবার স্থান, কাল ভুলে ধমকে উঠল,
“এই মেয়ে, ফাজলামি পেয়েছো? কাজে লাগা অবধি তোমার বেয়াদবি সহ্য করছি।”
প্রিয়া বুঝতে পেরে ঠোঁট টিপল। কথার স্রোতে শব্দটা বলে ফেলেছে। মেয়েটার হাসি লুকানোর চেষ্টা দেখে আরেকদফা ক্রোধের উত্তাপ উঠল অনুভবের দেহে।
“এই মেয়ে, আবার হাসছো? আমার নামটাকে কী তোমার কোনো জোক মনে হয় যে পোক করবে?”
“আমি অতকিছু ভেবে বলিনি।”
“ইচ্ছে করেই বলেছো।”
আচ্ছা মুশকিল তো! এই ছেলে দেখি পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করে। পাড়ার কুচুটে মহিলাদের মতো কিছুটা স্বভাব বোধহয় আছে। কিন্তু প্রিয়া তর্ক করা পছন্দ করে না। তাই অত কথায় না গিয়ে সরাসরি বলল,
“তাহলে কী বলে ডাকব বলে দিন।”
অনুভব হাত দুটি বুকে বেঁধে ভাবের সঙ্গে বলল,
“স্যার বলবে। ওসব ভাইয়া ডাকা যাবে না। এই বয়সী মেয়েদের খুব ভালো করে জানা আছে। আজ ভাইয়া, কাল সাইয়া। ওসব চলবে না। কাজ করতে এসেছো, মন দিয়ে কাজ করবে। কোনোরকম ফ্যান্টাসিতে ভোগা যাবে না।”
প্রিয়ার মুখটা তখন অস্বস্তিতে লাল হয়ে উঠেছে। ছেলেটা নিজেকে একটু বেশিই প্রাধান্য দেয়। প্রথমে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলে নামটাই বদলে দিল আর এখন তো সম্বোধনেও ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ। ছেলেটার মাথায় কী সারাক্ষণ এসবই ঘোরে? মেয়েরা তার প্রেমে পড়তে মরে যাচ্ছে সব! প্রিয়া সে কথা আর মুখে আনল না।
অনুভব বড়ো ভাইয়ার ঘরে ঢুকল বাবুর নেইল কাটার খুঁজতে। খুঁজতে খুঁজতেই তার মনে হলো মেয়েটা ফাজিল হলেও এই দিকটা ভালো আছে। অনুমতি ছাড়া নিজে কোনোকিছুতে হাত দেয় না। তাছাড়া মেয়েটা দরকার ছাড়া কথাও খুব একটা বলে না। আরো কিছু ভালো দিক আছে তবে অনুভব তা নিয়ে ভাবতে চাইল না। এদের যত কম পাত্তা দেওয়া যায় ততই মঙ্গল। অনুভব চেস্ট ড্রয়ার থেকে নেইল কাটার বের করে প্রিয়ার হাতে দিতেই প্রিয়া কৌতুহলে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি কোথায় পড়েন?”
“তা জেনে তুমি কী করবে?”
“নাহ, অনলাইন ক্লাস করলেন তাই জানতে ইচ্ছে হলো।”
অনুভব সে কথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কতদূর পড়েছো? ভাষা তো ঝরঝরে শোনায়।”
অনুভবের চোখ বড়ো হয়। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নির্লিপ্ত গোছের মেয়েটির দিকে। হলুদ রঙা সালোয়ার কামিজ পরনে উজ্জ্বল ত্বকের মেয়েটাকে দেখতে সদা পরিপাটি লাগে। আচার-আচরণেও ভদ্র ঘরেরই মনে হয়। অনুভবের ইচ্ছে হলো বয়স জিজ্ঞেস করে। যদিও তা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারে না। একটু ভেবে জিজ্ঞেস করেই বসে,
“তোমার বয়স কত?”
“আঠারো। বয়সটাতেও আপনার সমস্যা থাকলে বাড়িয়ে নিতে পারেন, স্যার। ওটাতে আমার সমস্যা নেই।”
“পড়াশোনা করো তাহলে এই বয়সে তুমি এই কাজ কেন করছো? টিউশনি করাতে পারতে।”
“কখনো করাইনি তো। অভিজ্ঞতা নেই। হাত গুটিয়ে বসে থাকলে সংসার চলবে না। তাই বাবু সামলানোর কাজটা আগে পেয়ে বেতন বেশি বলে নিয়ে নিলাম।”
“সংসার চলবে না কেন? তোমার ফ্যামিলিতে আর্নিং মেম্বার কেউ নেই? এতদিন কীভাবে সংসার চলেছে?”
অনুভবের কৌতুহল ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সেটাকে থামিয়ে দিতেই প্রিয়া বলল,
“চলেছে একভাবে। এখন আর চলছিল না বলে কাজে লাগা। আপনি আওয়াজ করবেন না স্যার, জাইমের ঘুম ভেঙে গেলে কান্না থামানো মুশকিল হবে।”
অনুভব বুঝতে পারল মেয়েটি এড়িয়ে গেল তাকে। তাই আর কথা বাড়াল না।
সদ্য ঘুম থেকে উঠে অপরিচিত এক মেয়ের সামনে নিজের নামের বেইজ্জতি হতে দেখা ঠিক কতটা হৃদয়বিদারক ঘটনা তা অনুভবের চেয়ে এই মুহূর্তে কেউ ভালো বুঝবে না৷ দিনের শুরুটাই মেজাজ বিগড়ে দিল তার। একেই পর্যাপ্ত ঘুম হলো না তারওপর কোত্থেকে এসে জুটল এই মেয়ে! চিড়বিড় করা মেজাজে সম্মুখের মেয়েটিকে আগাগোড়া দেখে নেয় সে। ছিমছিমে দেহের এক কিশোরী পিটপিট করে চেয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে সামান্যতম ভয়-ডর নেই! তবে কোমল মুখশ্রীতে কিঞ্চিৎ বিব্রতভাব বোধহয় জিইয়ে আছে। অনুভব জরীপ শেষে কড়া গলায় বলল,
“তুমিই তাহলে নতুন কাজের লোক?”
এ পর্যায়ে প্রিয়ার মুখটা শুকনো হয়ে আসে। দৃষ্টিটা আপনাআপনি নত হয়ে যায়। কাজের লোক! শব্দটা তার কানে বড়োই শ্রুতিকটূ শোনায়। সে কী সত্যিই কাজের লোক হয়ে গেল? ভেবে ভেবে মনের অঞ্চলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবার আগেই অনুভব পুনরায় একই ভঙ্গিতে নির্দেশ করল,
“ভেতরে এসো।”
কথা শেষ করা মাত্রই অনুভব দরজার আড়ালে মিলিয়ে গেল। প্রিয়া একটু দ্বিধান্বিত হয়। ঘরে কেন ডাকল! অপমান করবে নাতো! তেমন হলে প্রিয়ার এ বাড়িতে আজই প্রথম ও শেষ দিন হতে চলেছে। প্রিয়া গুটি গুটি পায়ে দরজার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ায়। ভেতরে আর যায় না।
জানালার ফাঁক গলে সূর্যকিরণ এসে গড়াগড়ি করছে ফ্লোরে। সাদা টাইলসের ঝলকানিতে চোখ ঝলকে ওঠে। প্রিয়ার ভেতরে কিছুটা অস্বস্তি থাকলেও দৃষ্টি সবল। অনুভব বিছানায় হেলে বসেছে। পরনে কালো ট্রাউজার, কালো শার্টের সবগুলো বোতাম খোলা। তাতে গৌড় দেহের রংটা বেশ চোখে লাগছে। প্রিয়াকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো আঙুল দ্বারা ব্যাকব্রাশ করতে করতে অনুভব আত্মদম্ভের সাথে বলে উঠল,
“ওভাবে কী দেখছো? জীবনে হ্যান্ডসাম ছেলে দেখোনি?”
“দেখেছি।” প্রিয়ার গলা স্বাভাবিক।
উত্তরে অনুভবের মসৃণ কপাল কুঞ্চিত হয়। কণ্ঠ হয় ক্ষুরধার,
“কিন্তু আমার মতো হ্যান্ডসাম দেখোনি, তাইতো?”
প্রিয়া সরল ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। তা দেখে অনুভবের ঠোঁটের কোণে দাম্ভিক, গৌরবান্বিত হাসি ঠাঁই পায়। পরক্ষণেই তা ঝুলে পড়ে মেয়েটির অপকট বাক্যদ্বয় শুনে। প্রিয়া সরল গলায়-ই বলল,
“কিছু সুন্দর পুরুষ দেখলে মনে হয় ওরা কেন মেয়ে হলো না। আপনি সে রকম সুন্দর।”
বিস্ময়ে, রাগে সুদর্শনের মুখ থমথমে হয়ে ওঠে। হেলে বসা বাঁকা দেহটি সোজা করে গলা চড়িয়ে বলে,
“এই মেয়ে এই, বলতে কী চাইছো তুমি?”
প্রিয়া অতি মনোযোগী ছাত্রীর ন্যায় অনুভবের দিকে চোখ বুলিয়ে বলল,
“আপনার গালে যদি দাড়ি না গজাতো, চুলগুলো যদি লম্বা হতো আর মেয়েদের জামাকাপড় পরতেন তাহলে অপরূপা লাগত।”
নিজের নিখুঁত সৌন্দর্যের অপব্যাখ্যা শ্রবণ হতেই অনুভব খ্যাঁকিয়ে ওঠে,
“সে তো তোমার গালে যদি দাড়ি গজাতো, চুলগুলো কদমছাঁট হতো, ছেঁড়া ফাটা শার্ট-প্যান্ট পরতে, গলায় কতগুলো মালা আর হাতের পাঁচ আঙুলে আংটি ঝুলিয়ে ক্যারাম খেলতে তাহলে তোমাকেও পাড়ার মোড়ের বখাটে রঞ্জুর মতো লাগত।”
প্রিয়ার মুখে জবাব এলো না। দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় মেঝেতে। মনে মনে নিজেকে অনুভবের বর্ণনায় কল্পনা করার চেষ্টা করে। ছেলেরূপে কী তাকে খুব বেশি জঘন্য লাগত? একদম বখাটে রঞ্জুর মতো! ছিঃ! প্রিয়ার গা গুলিয়ে ওঠে। রঞ্জুকে সে চিনেছে কলোনির বস্তিতে ওঠার পর। ময়লা, তেলচিটে জামা-কাপড় পরে, মাথায় একটা রুমাল বেধে ঘুরে বেড়ায়। মধ্যমা ও অনামিকার ভাজে গোজা থাকে সস্তার বিড়ি। দাঁতে মাখা থাকে মোটা স্তরের গুল। কথা বললে ভকভক করে গন্ধ ছোটে ঠোঁটের ফাঁক গলে। তল্লাটের এমন কোনো মেয়ে নেই যে তার দৃষ্টির অগোচরে আছে। রঞ্জু আবার নারীদের বেলায় ধর্ম, গায়ের রঙ, জাত কিছু মানে না। মেথর কন্যা থেকে প’তি’তা পল্লীর লাস্যময়ী, সবাইকেই সদা বিনয়ী নজরে দেখে। জেন্ডার ফিমেল হওয়া নিয়েই কথা। রঞ্জুকে এক শব্দে ব্যাখ্যা করতে হলে বলা যায় নারী অন্তপ্রাণ। নারীর সেবায় চব্বিশ ঘন্টা নিয়োজিত। তার নজর প্রিয়ার ওপরও পড়েছে বটে। সে প্রসঙ্গ আলাদা। অনুভবের কথায় প্রিয়া সচকিত হলো।
“তুমি কী জানো তুমি একটা বেয়াদব গোছের মেয়ে?”
“জি না।”
“আবার বেয়াদবি? তামাশা করো? এই মুহূর্তে তোমার চাকরি নট করে দিতে পারি জানো?”
এ পর্যায়ে প্রিয়া জবাব দিল না৷ সে ঠিক কোথায়, কীভাবে বেয়াদবি করল ধরতে পারছে না। মেয়েটির নত মুখ অনুভবকে তৃপ্তি দিল। যেই না চাকরি যাওয়ার কথা বলল অমনি জোকের মুখে নুন পড়েছে। এইসব পাকা মেয়েদের অনুভবের হাড়ে হাড়ে চেনা। সে জিজ্ঞেস করল,
“পরিচয়ই তো জানা হলো না। তোমার নাম কী মেয়ে?”
প্রিয়া মৃদু স্বরে জবাব দিল,
“প্রিয়া।”
অনুভব ভ্রু কুচকে মেয়েটির মাথা থেকে পা অবধি চোখ বোলায়। খানিক সুর টেনে ব্যঙ্গ করে বলল,
“কাজের মেয়ের নাম প্রিয়া! আসল নাম তো?”
“জন্ম নিবন্ধন দেখাতে হবে?”
প্রিয়ার আত্মবিশ্বাস দেখে অনুভব কিছুটা দমে গেল। তবে তা প্রকাশ না করে বলল,
“আজকাল পয়সা দিয়েই সেসব বানানো যায়।”
প্রিয়া চুপ করে রইল। নাম নিয়ে জীবনে এই প্রথম বিড়ম্বনায় পড়ল বোধহয়। অনুভব আবার বলল,
“উহু উহু, এ ধরনের নাম এই বাড়িতে এলাও না।”
“কেন?” প্রিয়া অবাক হয়ে তাকায়। কাজ করতে হলে নামও যে ভাবনার বিষয় তা জানা ছিল না।
অনুভব বলল,
“কাজের লোকের নাম হবে সখীনা, জরিনা, ফরিদা, মতির মা, হাসুর মা…”
“আমি বিবাহিত নই।” প্রিয়ার তড়িৎ উত্তর।
“ও! তাহলেও প্রিয়া নাম চলবে না। একেই আমি এলিজিবল ব্যাচেলর, বেশিরভাগ সময় বাড়িতে একা থাকি। তারওপর তুমিও যুবতী। লোকে উল্টোপাল্টা ভাবতে পারে। উম… তোমার নাম দিলাম হাসু। হা…সুউউ। রান্নাঘরে যাও হাসু। পানি গরম দাও। গোসল করব।”
প্রিয়া করুণ চোখে তার নামের মৃ-ত্যু দেখতে পেল যেন। কোনো বাক্য খরচ না করে প্রস্থান করল। খানিক বাদে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আবার ফিরেও এলো। অনুভব তখন পা নাচিয়ে ফোন স্ক্রল করছিল। প্রিয়াকে দেখে চোখ সরিয়ে অসন্তোষের সঙ্গে বলল,
“কী ব্যাপার?”
“আমি ছুটা বুয়া নই। অন্তরা আপা আমাকে বাবুর টেক কেয়ার করতে এনেছেন। তবুও আমি পানি গরম দিয়ে দিচ্ছি। আপনি একটু বাবুকে রাখুন।”
প্রিয়া অনুভবের কোলে তার ভাতিজাকে রেখে চলে গেল। অনুভব হতভম্ব হয়ে রইল। সেকেন্ড কয়েক বাদেই টের পেল তার ট্রাউজার ভিজে গেছে। আদরের ভাতিজা চাচার কোলে হিসু করে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে অনুভব চ্যাঁচিয়ে উঠল,
“অ্যাই হাসু? বাবুকে ডায়পার পরাওনি কেন?”
প্রিয়া ছুটে এসে বলল,
“আপনাকে আনতে বলেছিল তো।”
অনুভব দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে। বাবুকে প্রিয়ার কোলে ধরিয়ে দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“দূর হও চোখের সামনে থেকে। তৃ-সীমানায় দেখলে খু’ন করে দেব।”
প্রিয়া ভীত পায়ে বেরিয়ে গেল। প্রথমদিনের যা অভিজ্ঞতা হলো তাতে এই বিচিত্র স্বভাবের মানুষগুলোর সঙ্গে সে টিকতে পারবে বলে মনে হয় না।
অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চমকে উঠল প্রিয়া। ওর সামনে একজন বয়স্ক ভিখারি থালা পেতে দিয়েছে। ঠোঁটে সরল, বিগলিত হাসি। প্রিয়া পার্স খুলে দেখল একবার৷ সঙ্গে সঙ্গে মুখ কালো হয়ে গেল তার। মুখ তুলে বলল,
“দান করতে না পারলে দোয়া করবেন না, চাচা?”
ভিখারি লোকটি বোধহয় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। বোধহয় ইতোপূর্বে কেউ এধরনের কথা তাকে বলেনি। বলল,
“সবার লইগ্যাই দোয়া করি, আম্মা। দোয়া করতে তো টেকা লাগে না। তয় দান করলে আল্লাহ তার বান্দারে আরো বেশি ফেরত দেয়।”
“মাফ করবেন, চাচা। আমার কাছে টাকা নেই।”
লোকটির আচরণ বদলে গেল হঠাৎ। কর্কশ স্বরে বলল, “দিতে পারবেন না তো দেরি করাইলেন ক্যা? হুদাই সময় নষ্ট।”
লোকটি রুষ্টভাবে চলে গেল। প্রিয়ার মন খারাপ হলো। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় হাঁটা ধরে। পরিবারের আদরের বলয় থেকে বের হবার পর থেকেই মানুষ চিনতে শুরু করেছে সে। বুঝতে শিখছে স্বার্থ ছাড়া এ জগতে কেউ কারো নয়। সেখানে ভিখারি লোকটার আচরণে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই।
সকালের নরম রোদ মাথায় নিয়ে একটি ছয়তলা বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় প্রিয়া। অনেকটা পথ হেঁটে আসার ফলে তার দেহ পরিশ্রান্ত। ঘাড়, গলা ঘামে জবজব করছে। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ। অনবরত ঢোক গিলে ঘাড় উঁচিয়ে বিল্ডিংটা দেখল সে। এই বিল্ডিংয়ের চারতলার একটি ফ্ল্যাটে কর্মজীবী দম্পতি বাস করে। তাদেরই পাঁচ মাসের বাচ্চার কেয়ারটেকার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছে অষ্টাদশী প্রিয়া। জীবনে যাকে জল গড়িয়ে খেতে হয়নি আজ সে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে এসেছে। নিয়তিতে এ-ও ছিল তার জন্য! তীব্র বেদনা, সংকোচ ও অস্বস্তি বুদ করে ফেলেছে নাজুক মেয়েটিকে।
প্রিয়া একটু জড়োসড়ো হয়ে পা বাড়ায় ভেতরে। লিফটে করে পৌঁছে যায় থার্ড ফ্লোরে। লিফট থেকে বেরিয়ে যত সামনে এগোয় খেয়াল করে অদ্ভুত জড়তা তাকে গ্রাস করে ফেলছে। কান্না চাপে গলায়। কলিং বেলে চাপ দিতে গিয়েও হাত কেঁপে উঠল। কোনোদিন কী দুঃস্বপ্নেও ভেবছিল এভাবে অন্যের দ্বারে কাজের জন্য আসবে? হায় নিয়তি! প্রিয়া একবার ভাবে ফিরে যায়, পরক্ষণেই মা-বোনের কথা চিন্তা করে দমে যায় মন। ইচ্ছের চেয়েও প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিতে হবে তাকে। প্রিয়া মুখ ফুলিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে। এরপর দৃঢ় হাতে কলিংবেল চাপে। দরজা খুলতে মিনিটখানেক সময় লাগল। পরিচিত মুখটাই দেখতে পেল সে। অন্তরা মিষ্টি হেসে বলল,
“তুমি এসেছো?”
প্রিয়া এ ধরনের কথায় বিরক্তবোধ করে। চোখের সামনে একজনকে দেখেও জিজ্ঞেস করে এসেছে কিনা! তবে এখন তার বিরক্তির ধার কেউ ধারবে না। তাকেই অন্যের বিরক্তি সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। নম্র ও ক্ষীণ স্বরে বলল,
“এলাম।”
“ভেতরে এসো।”
বোঝা গেল বাড়ির কর্ত্রী ভীষণ ব্যস্ত। ভেতরে আসতে বলেই ছুট দিয়ে কোথাও চলে গেল। প্রিয়া আড়ষ্টভাবে চারিদিকে তাকায়। তিন কামড়ার বিশাল ফ্ল্যাট। দেয়ালে দেয়ালে আধুনিকতার ছোঁয়া। প্রিয়ার মনটা হঠাৎ অতীতের টানে ভার হয়ে আসে। তবে দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অন্তরা চুল বাঁধতে বাঁধতে ফিরে এসে বলল,
“এ বাড়িতে সংকোচ কোরো না। তুমি ভালো ফ্যামিলির জেনেই আমার ছেলেকে তোমার জিম্মায় রাখতে চেয়েছি। ও বেশি জ্বা’লাতন করে না। শুধু একটু টাইমলি খাইয়ে দেবে। চোখে চোখে রাখবে। তুমিও হাত-পা ছড়িয়ে থাকতে পারবে। এসো, তোমাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে যাই। আজ থেকে কাজে লাগতে পারবে?”
“পারব।”
“খুব উপকার হলো।”
বলে অন্তরা প্রিয়াকে মাস্টার বেডরুমে নিয়ে গেল। বিছানায় ঘুমিয়ে আছে পাঁচ মাসের একটি শিশু। প্রিয়ার কাজ তাকে টেককেয়ার করা। অন্তরা একটি প্রাইভেট ব্যাংকে জব করে। বাচ্চাকে এতদিন অন্তরার মা দেখে রেখেছিল। তিনি অসুস্থ হওয়ায় বেকায়দায় পড়তে হয়েছে চাকরিজীবী দম্পতিকে৷ অতঃপর পরিচিতের মারফতে এই ফুটফুটে মেয়েটিকে ভাগ্যক্রমে পেয়ে গেল। খুবই সরল স্বভাবের মেয়ে। সিসিটিভি ফুটেজও লাগানো আছে পুরো বাড়িতে। কাজেই ভয়ের কোনো কারণ নেই। অন্তরা বাচ্চার সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে বলল,
“কোনোকিছু না বুঝলে মায়ের থেকে জেনে নিয়ো। মা তো অসুস্থ, যদি ঘুমিয়ে থাকে তাহলে আমাকে ফোন কোরো। তাছাড়া অনু থাকলে তোমার ঝামেলা কম। বাচ্চাটা অনুর খুব ন্যাওটা। দক্ষিণের রুমটা অনুর। ইমারজেন্সি দরকারে ওকে ডাকবে যদি বাসায় থাকে, কেমন? আমি আসি। তোমার ওপর ভরসা করে গেলাম কিন্তু।”
অন্তরা যাওয়ার আগে প্রিয়ার দুই হাত চেপে ধরে ভরসার স্থানটা বুঝিয়ে দিয়ে গেল।
প্রিয়া সদর দরজা আটকে দিতেই ভেতরের ঘর থেকে ডাক ভেসে এলো। জীর্ণ, ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠ। প্রিয়া অনুমান করে নিল অন্তরা আপার আম্মা ডাকছে। গিয়ে দেখল সত্যিই তাই। বৃদ্ধা জয়নব পা ভাজ করে বিছানায় আধশোয়া হয়ে ছিলেন। প্রিয়া যেতেই তাকে আপাদমস্তক জহুরির চোখে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“হায় হায়! অন্তরা এমন আনকোরা মেয়ে ধরে এনেছে? এই মেয়ে তোমার বিয়ে হয়েছে?”
প্রিয়া দুদিকে ঘাড় হেলায়, “জি না।”
“তাহলে বাচ্চার যত্নের তুমি কী বুঝবে? হায় কপাল!”
“জি, আমি পারব। আমার ছোটো বোনকে আমিই নিজের হাতে বড়ো করেছি।”
জয়নব ভীষণ অসন্তুষ্টির সঙ্গে ধমক দিলেন। সদ্য কাজে যোগ দেওয়া প্রিয়ার আঠারো বছরের স্বল্পদৈর্ঘ্য জীবনে অপরিচিতের কাছ থেকে পাওয়া প্রথম ধমক। জয়নব বললেন,
“অত জি জি করো কেন? জি হুজুরি করা চো’রের লক্ষণ। তারওপর কাজের লোকেদের মাঝে একটু চো’র চো’র ব্যাপার থাকে। এরা ছোটো থাকতেই হাত সাফাই শিখে যায়। এরপর বড়োলোকের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে করতে লোভের বশবর্তী হয়ে সেই সাফাই বিদ্যা কাজে লাগায়। তা তুমি বোনকে বড়ো করেছো কেন? মা নেই?”
প্রিয়া উত্তর দেওয়ার আগে তিনিই আবার বললেন,
“ওহহ তোমাদের মায়েরাও তো বাচ্চা নাড়ি থেকে আলাদা হওয়া মাত্রই তাকে ফেলে কাজে ছুটে যায়। আর বাচ্চা মাটিতে গড়াগড়ি করে বড়ো হয়।”
“জি না। আমার মা আপনার মতোই অসুস্থ মানুষ। হাটাচলা করতে পারেন না।”
“ওহহ আচ্ছা। তাহলে সংসার কে চালিয়েছে?”
“আমার বাবা।”
“তোমার বাবাও আছে? আমি তো জানি এই জাতের সংসার বাচ্চা পেটে ঢোকা অবধিই টিকে থাকে। এরপর জামাই লাপাত্তা। সংসার টানে মায়েরা। এজন্যই দেখো না কাজের লোক বেশিরভাগ জামাই খেদানো বাচ্চাওয়ালা হয়। হা হা!”
প্রিয়া চুপ রইল। অন্তরা আপার মা তাকে অপমান করছে কিনা নিশ্চিত না হলেও মহিলা যে বাচাল এ নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না। প্রিয়া স্বল্পভাষী। কাজেই বেশি কথা তার মুখ থেকে বের হলো না। অবশেষে বৃদ্ধা একঝুড়ি আলাপ খান্ত দিয়ে বললেন,
“যাইহোক, তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। কথা যত কম বলবে ততই ভালো। আজকাল তো মেয়েরা কাজ করতে এসে এমন চোপা করে যেন আমরা নয় ওরাই আমাদের কাজ করে দয়া করে দিচ্ছে। আরো ভালো লেগেছে তুমি কামের বেটিদের মতো আঞ্চলিক টোনে কথা বলো না। নাহলে আমার নাতিও ওইসব টোন শিখে ফেলত।”
তখনই বাচ্চাটার কান্নার শব্দ কানে বিঁ’ধল। কারো কান্নার শব্দ এত মধুর হয় তা এই মাত্র প্রিয়া অনুধাবন করতে পারল। বৃদ্ধার কবল থেকে ছাড়া পাওয়ার সুযোগ মিলতেই সে পাতলা দেহটিকে নিয়ে পাখির মতো ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল।
____________
ছোটো পুতুলের মতো বাচ্চাটাকে সামলানো প্রথম প্রথম প্রিয়ার কাছে সহজ মনে হলেও একটু সময় যেতে বুঝল আদতে তা সহজ নয়। বাচ্চা নতুন মুখ ও নতুন কোলে খাপ খাইয়ে নিতে না পেরে একটু পর পরই অস্থির হয়ে কেঁদে উঠছে। বাচ্চার ডায়পার বদলাতে গিয়ে পড়ল আরেক বিপদে। ডায়পার শেষ। নতুন কোনো প্যাকেট তোলা আছে কিনা প্রিয়াকে বলা হয়নি। সে অন্তরার মায়ের কাছে জানতে গিয়ে দেখল তিনি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন। প্রিয়া অবশেষে অন্তরাকে কল দিল। অন্তরা ব্যস্ত স্বরে কোনোমতে বলল,
“ডায়পার শেষ আমার খেয়াল ছিল নাগো। অনু তো বাড়িতেই আছে আজ। ওকে বলো বাইরে থেকে এনে দিতে।”
ফোন কেটে গেল। প্রিয়া গেল সেই দক্ষিণের বন্ধ দরজার সামনে। ঠক ঠক শব্দ তুলল বেশ কয়েকবার। প্রায় পাঁচ মিনিট পর এক অতিশয় সুদর্শন যুবককে দরজা খুলতে দেখে প্রিয়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল। যুবকের চোখে ঘুম, কপালে বিছিয়ে থাকা চুলের আড়ালে বিরক্তির গাঢ় ভাজ। ঢুলুঢুলু চোখে চেয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
“কী চাই?”
প্রিয়া নিজেকে সামলে বলল,
“অনু আপুকে ডেকে দিন না একটু। বাচ্চার ডায়পার কিনতে যেতে বলেছে অন্তরা আপা।”
আচমকা যুবকের মুখের রঙ বদলাতে দেখা গেল। ঘুম ঘুম চোখের রক্তাভ আভাটা রাগ নাকি নিদ্রার রেশ ঠিক ঠাহর করা গেল না। গমগমে স্বরে বলল,
“অন্তরা ভাবী পাঠিয়েছে তোমায়?”
“হ্যাঁ।”
“উনাকে গিয়ে বলো অনু ম’রে গেছে। এখন তার অন্তিম সংস্কার চলছে।”
ধরাম করে দরজা আটকে গেল। প্রিয়া কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে এরপর যুবকটির কথা মতোই কাজ করল। অন্তরাকে পুনরায় ফোন দিয়ে বলল,
“আপা, একটা লোক দরজা খুলে বলল অনু আপু নাকি ম’রে গেছে। এখন অন্তিম সংস্কার চলছে।”
অন্তরা কপাল চাপড়ে হেসে বলল,
“অনু আপু হতে যাবে কেন মেয়ে? আরে ওই ছেলেই তো অনু, মানে অনুভব। আমার দেবর। আমি আদর করে অনু ডাকি।”
প্রিয়া থ বনে গেল। প্রত্যুত্তরে কী বলা উচিৎ বুঝে পেল না। বুঝল না দোষটা অন্তরার বলার ধরনে নাকি তার বোঝার। অন্তরা বলল,
“আচ্ছা, তুমি বাবুর কাছে থাকো আমি ওর সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি।”
‘ মুখটা এমন ছোটো হয়ে আছে কেন! খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই? নাও উঠো। ঝটপট শাওয়ার নিয়ে নিই। তারপর নিচে গিয়ে খাবার গরম করে খাই দুজন। ‘
ত্বরিত লজ্জার ঘরে তালা মারে সিমরান। উঠতে উদ্যত হয় ঝটপট। নিমেষে আবার চুপসে যায়৷ মুখটা কাচুমাচু করে কম্বলের নিচে হাতাহাতি করে। সৌধ পাশফিরে শুয়ে মিটিমিটি হাসছে। সিমরান বেশকিছুক্ষণ হাতাহাতি করেও যখন প্রয়োজনীয় বস্ত্র পেল না। কপট রেগে গেল। বা হাত বাড়িয়ে সৌধর ঘাড়ে দিল আলতো করে এক খামচি। এরপর লজ্জা মিশ্রিত মিহি স্বরে বলল,
‘ ভালো হচ্ছে না কিন্তু। ‘
খামচি খেয়ে সৌধ প্রায় ফুঁসে উঠার মতো ফিরে তাকাল। চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে উঠে বসল। এরপর আলগোছে পিছন ঘুরে বলল,
‘লুক! এত সুন্দর সুন্দর আর্ট করার পরও মন ভরেনি? ক্লান্তি হয়নি হাত দুটো?’
সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল সিমরানের। বিস্ময়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে মরার মতো থমকে রইল সে। সৌধর ফর্সা পিঠ। প্রায় পুরোটা জুড়েই আঁচড়! লাল টকটকে একেকটা আঁচড় দেখে ওর বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল৷ লজ্জা সব জলাঞ্জলিতে দিয়ে ভাবতে লাগল, এত সুন্দর পিঠটা সে এভাবে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে? ইশ! কিন্তু কখন কীভাবে হয়ে গেল? সৌধ ফিরে বসে সিমরানের পানে তাকাতেই দেখতে পেল, অপরাধীর ন্যায় তাকিয়ে আছে সে৷ মুখটা এত বেশি ছোটো হয়ে আছে বলার মতো না। যা দেখে শব্দ করে হেসে ফেলল ও। সিমরান মিনমিনে গলায় বলল,
‘ আমি এটা কীভাবে করলাম! এত ব্যথা দিলাম তোমায়? সরি, ভীষণ সরি। ‘
সৌধর হাসি বিস্তৃত হলো। হাত বাড়িয়ে গাল টিপে দিল সিমরানের। চেয়েছিল লজ্জায় আরো নাস্তানাবুদ করতে। কিন্তু হয়ে গেল উল্টো। মেয়েটা এত বেশি ভালোবাসে তাকে! তার প্রতি দুর্বলতার সীমানা পেড়িয়ে গেছে একদম। অজান্তে একটু ব্যথা দিয়েছে বুঝলেই মুখটা অন্ধকার করে ফেলে। বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেলল সৌধ। হাত বাড়িয়ে সিমরানের গা থেকে কম্বল সরালো। মুহুর্তেই চোখ, মুখ খিঁচে ফেলল সে। সৌধ আর কোনোকিছু না ভেবে ওকে কোলে তুলে নিল। পা বাড়াল ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে নাজুকরূপী বউটাকে মোহনীয় স্বরে বলল,
‘ তোমার ভালোবাসার কাছে এই আঁচড় গুলো ফিঁকে বউপাখি৷ ‘
কথাটা বলেই থামল একটু। পরোক্ষণেই আবার গাঢ় স্বরে বলল,
‘ তুমি যতটা সহ্য করো তার কাছে এটুকুনি অতি নগণ্য ডিয়ার৷ ‘
.
.
মধ্যরাতে আচমকা ঘুম ভেঙে যায় ফারাহর। হাঁসফাঁস চিত্তে উঠে বসে ত্বরিত। এত্ত পিপাসা লেগেছে! এদিকওদিক মাথা ঘুরিয়ে বুঝতে পারে সে কোথায় আছে। পাশে তাকিয়ে দেখে আইয়াজ ঘুমাচ্ছে। ঘড়িতে সময় কত? সকাল হয়ে গেছে কী? মোবাইল খুঁজে সময় দেখে। সে কী! সবে দুটো বাজে? পাশেই ওয়াটার বোতল রাখা। আইয়াজই রেখেছে। সে অর্ধেক বোতল পানি খেয়ে নেয়। এরপর আলগোছে শুয়ে পড়ে আবার৷ কিন্তু ঘুম আর আসে না৷ চোখ বন্ধ করে থাকতেও ইচ্ছে করছে না। একটু পর অনুভব করল, বাবুরা নড়ছে। নিমেষে হাত চলে গেল তলপেটে। তবে কী বাচ্চারা জেগে আছে বলেই তার ঘুম ছুটে গেছে? এটাই কি মায়ের সঙ্গে বাচ্চাদের কানেকশন? অজান্তেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেল। আবেগে টইটম্বুর হয়ে রইল তার মাতৃহৃদয়। দীর্ঘক্ষণ পর তাকাল আইয়াজের পানে। এই শ্যামলাটে মায়াবী চেহেরা দেখলেই বুকজুড়ে প্রশান্তি বয়ে যায় তার। এই ছেলেটা কত ভালোবাসে তাকে! যত্নটুকু দেখলেই শতসহস্রবার ওর বুকে মরতে ইচ্ছে করে। স্বামীর পানে অপলকভাবে তাকিয়ে ছিল ফারাহ৷ পাশাপাশি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকলেও ফারাহর স্পর্শ অনুভব করতে পারল আইয়াজ। তাই ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই হাসল মৃদু। ফারাহ সেই মৃদু হাসি দেখে হাতটা সরিয়ে নিল। একটু হাঁটতে ইচ্ছে করছে। আইয়াজ ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। বেচারাকে বিরক্ত করবে না৷ সে বরং উঠে রুমেই হাঁটাহাঁটি করবে কিছুক্ষণ। যেই ভাবা সেই কাজ। সে উঠে হাঁটতে লাগল। সময় গড়াল মিনিট পাঁচেক। টুকটুক শব্দ শুনতে পেল ড্রয়িংরুম থেকে। এত রাতে কেউ কি উঠেছে? নাহ কে উঠবে? খিদের ভাব হচ্ছিল। নামী ফলমূল সহ আরো কিছু খাবার দিয়ে গেছে৷ কিন্তু তার এসব খেতে ইচ্ছে করছে না। দুপুরের ঝালঝাল খিচুড়ির কথা মনে পড়ল। আশ্চর্য! তখন খেতে ইচ্ছে করেনি অথচ এখন খেতে ইচ্ছে করছে। কী পাগলাটে ইচ্ছে সব। আচ্ছা এগুলো কি তার টুইন বেবিদের ইচ্ছে নাকি তার? নিশ্চয়ই টুইনদের৷ তার ইচ্ছে মোটেও এমন দুষ্টু নয়৷ সে খুব ভালো মেয়ে। টুইনরা নিশ্চয়ই খুব দুষ্টু হবে৷ নয়তো তখন তার খেতে ইচ্ছে করল না। আর এই মাঝরাতে খেতে ইচ্ছে করছে কেন? আপনমনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হেসে ফেলল ফারাহ। বিড়বিড় করে বলল,
‘ তুই দুষ্টু না কে বলল ফারাহ? এই তো দিব্যি নিজের দোষ বাচ্চাদের ওপর চাপিয়ে দুষ্টুমি করছিস। ‘
ঘুমন্ত আইয়াজের পানে তাকাল সে। বাইরে কেউ উঠেছে নিশ্চিত। হয়তো তার মতোই কারো খিদে পেয়েছে। নামীকে ফ্রিজে খিচুড়ি উঠিয়ে রাখতে দেখেছে সন্ধ্যায়। সে কি বেরোবে? গিয়ে খিচুড়ি গরম করে খেয়ে নিবে? দোনোমোনো করতে করতে বেরোতে উদ্যত হলো। আইয়াজের ঘুম গভীর হলেও সে টের পেয়েছিল ফারাহ উঠেছে। এরপর অনেকক্ষণ তার পাশে নেই এও বুঝেছে। তাই আচমকা চোখ খুলে যখন বাইরে যেতে দেখল, তড়াক করে উঠে বসে প্রশ্ন করল,
লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া সিমরান যেন হুঁশে ফিরল। গুটিগুটি পায়ে এসে হাতের খাবার গুলো টেবিলে রেখে আমতা আমতা করে বলল,
‘ আমি গরম করে আনছি। তুমি বসো ভাইয়া। ‘
আইয়াজ মাথা দুলিয়ে এসে বসল। ফারাহর মুখ থেকে মুচকি মুচকি হাসি সরছেই না৷ সিমরান প্রায় দৌড়ে পালালো ওখান থেকে। ত্বরিত মাথা থেকে তোয়ালে খুলে রান্নাঘরের একটি চেয়ারে রেখে দিল। এরপর চুলগুলো হাতে আঁচড়ে নিল যথাসম্ভব। দুরুদুরু বুকে ভাবতে লাগল, কী সর্বনাশটাই ঘটল। এমন অবস্থায় কখনো পড়তে হবে কস্মিনকালেও ভাবেনি৷ ইশ!
ফারাহ, আইয়াজ উভয়ের জন্যও খাবার গরম করল সিমরান। সৌধ এসে হাতে হাতে নিয়ে দিল সব। এরপর ওরা গল্প করতে করতে খেয়ে নিল। এদিকে চুল ভালোভাবে শুকায়নি বলে সিমরানের চুলের পানিতে পরনের সোয়েটার ভিজে একাকার। থেকে থেকে হাঁচিও দিচ্ছে। একটু চিন্তা চাপল সৌধর মনে।
জ্বর ঠান্ডা না লেগে যায়৷ সিমরানের হাঁচিতে আইয়াজ, ফারাহর দম ফাটা হাসি পাচ্ছে। বেচারি সিমরান হাঁচি গুলো আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। আর বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়ছে। সৌধ অবশ্য বিব্রত হচ্ছে না৷ তার যত চিন্তা বউয়ের শরীর খারাপ হওয়া নিয়ে। খাওয়ার পাশাপাশি ভেজা চুলে বউকে লক্ষ্য করতে করতে ওর নজর পড়ল সিনুর গ্রীবাদেশে। লাভবাইটে একাকার অবস্থা। এমনিতেই আজ যথেষ্ট লজ্জায় পড়েছে। আর পড়তে চায় না৷ তাই আইয়াজ, ফারাহর অগোচরে ওড়নায় ঘাড় ঢেকে দিল। খাওয়া শেষে সিমরান পুনরায় উঠে গেল রান্নাঘরে। ফারাহও একটু হাঁটতে ড্রয়িংরুমে চলে গেছে। এই সুযোগে আইয়াজ সৌধর মুখোমুখি বসে ভ্রু জোড়া নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
শব্দ করে হেসে উঠল আইয়াজ। সৌধর কাঁধে চাপড় মেরে বলল,
‘ ওরে আমার রোমান্সের গুরুরে। ‘
.
.
সকাল থেকেই মন আকাশে মেঘ জমল ভাইবোনের। আজ পথশিশু, অনাথ, গরিবদুঃখীদের খাওয়ানো হবে। এরপরই চলে যাবে আত্মীয় স্বজনরা। ফারাহ আর আইয়াজ আরো কয়েকদিন থাকবে অবশ্য।
নামীর ব্যস্ততা বেড়েছে খুব। ছেলেটাকেও সময় দিতে পারছে না। শুধু খাওয়ানোর সময় আর ঘুমানোর সময়ই কাছে নিচ্ছে। বাকি সময় সুহাস আর অন্যান্য সদস্যদের কাছে থাকে সুহৃদ। সারাদিন সকলেরই খুব ব্যস্ততায় কাটল। দুপুরে সবাইকে খাইয়ে ছেলে সদস্যরা চলে গেল সোহান খন্দকারের গ্রামের বাড়ি৷ গোরস্তানে গিয়ে কবর জিয়ারত করে ওদের ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। এরপর রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়িই ঘুমাতে গেল সবাই৷ সারাদিন বেশ ধকল গেছে বলা যায়। ক্লান্ত শরীরে বিশ্রাম প্রয়োজন। বেশকিছু রাত ধরেই। উহুম বেশ কিছু নয়। বলা যায়, জেনেভা থেকে ফেরার পর এ বাড়িতে যতগুলো দিন গেছে ততগুলো রাতই নামী লক্ষ্য করেছে, মধ্যরাতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায় সুহাস। আর ফেরে না৷ সকালবেলা হয় বারান্দা বা ড্রয়িংরুমে দেখা পায়। তাহলে আগরাতে কিছু সময় ঘরে কী করে? নিজেকে খুব চালাক মনে করে সুহাস৷ হয়তো ভাবে এই যে সে রোজ মাঝরাতে বেরিয়ে যাচ্ছে এটা টের পায় না নামী। অথচ প্রথমদিন থেকেই টের পাচ্ছে সে। এভাবে আর কতদিন চলবে? নাহ আর চলতে দেওয়া যাবে না৷ তাই ভাবল, সরাসরি প্রশ্ন করবে আজ। আবার ভাবল, নাহ এক্ষুনি প্রশ্ন নয়। আগে বিষয়টা পরোখ করে দেখতে হবে। আসলে সুহাস কোথায় যায় রোজ রোজ? আর ঘরে ফিরেই বা আসে না কেন? মনে মনে পরিকল্পনা করে নিয়েই আজ চোখের পাতা এক করল নামী। ঠিক সময় অনুযায়ী সুহাসও বিছানার ওপাশ থেকে উঠে বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে। সুহৃদ ঘুমুচ্ছে। এখন আর জাগার চান্স নেই। তাই আলগোছে ছেলের পাশ থেকে উঠে পা টিপে টিপে বেরোলো সেও। পিছু নিল সুহাসের!
|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
প্রিয় পাঠক, আমরা উপন্যাসের একদম শেষ পথে…। সবাই রেসপন্স করবেন। আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতেও ভুলবেন না।
-“ এই রাফি সমস্যা কি তোর? আমার পেছনে লাগছিস কেনো? আমার বিয়েতে যদি তো জন্য কোনো প্রবলেম ক্রিয়েট হয় তাহলে তোর একদিন কি আমার একদিন।
রাফি বসার রুমে বসেছিল। তুষারের ফোন কল পেয়ে ফোন রিসিভ করতেই তুষার এই কথা বলে উঠে। রাফি তার ফুপি কে বলেছিল তুষার ব্রো এর বিয়ে দিলে তার ও দিতে হবে। আর যদি না দেয় তাহলে তৃষ্ণা দের বাসায় গিয়ে পড়ে থাকবে।
-“আরে ব্রো এতো রেগে যাচ্ছো কেনো?
তুষার নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। একটু আগেই তানিয়া বেগম বাসায় ফিরে জানিয়েছেন তুষার কে যে- তুষারের বিয়ে হলে রাফি কে বিয়ে দিতে হবে। এদিকে তামিম খান ডিরেক্ট না করে দিয়েছে এতো তাড়াতাড়ি মেয়ে বিয়ে দিবে না। মেয়ের সামনে এক্সাম এক্সাম শেষে বিয়ে। তানিয়া বেগম তুষারের দিকো তাকিয়ে বলে-
-“ তুষার বিয়ে টা কয়েক মাস পড়ে হোক। দুই ভাইয়ের বিয়ো টা না হয় একই দিনে দিবো।
তুষার ভ্রু কুঁচকালো।
-“ আশ্চর্য আমার বিয়ে কেনো পিছাতে চাইছো?
-“ দেখছিস না রাফি কেমন করছে। তোর আব্বা তো তৃষ্ণা কে এখন দিবে না রাফির হাতে।
-“ রাফির ইচ্ছে মতো হবে নাকি? আমি সামনের মাসেই বিয়ে করবো।
-“ আজব তো তুই আবার রাফির মতো শুরু করলি। চিত্রা তো পালিয়ে যাচ্ছে না। কয়েক মাস অপেক্ষা করলে কি হয়?
-“ অপেক্ষা জিনিস টাই করা যায় না মা।
-“ বেহায়া ছেলেপেলে কোথাকার। আগের দিনে আমাদের বিয়ের কথা হলে লজ্জায় ঘর থেকে বের হতাম না আর এখন তরা আমাদের উপর দিয়ে নিজেদের বিয়ের কথা বলিস।
-“ এসব বলে লাভ নেই মা, শুনলাম সামনের মাসে ১৫ তারিখ বিয়ের ডেট ফিক্সড করছো।তাহলে ১৫ তারিখ ই হচ্ছে আমার বিয়ে।
-“ না হচ্ছে না,রাফি হতচ্ছাড়া হতে দিচ্ছে না।
-“ রাফি কে আমি সামলে নিবো টেনশন করো না। আমার বিয়ে ১৫ তারিখই হচ্ছে।
কথাটা বলে তুষার বসা থেকে উঠে নিজের রুমে চলে আসে। পকেট থেকে ফোন বের করে রাফিকে ফোন লাগায়।
-“ রাগবো না মানে। তুই আমার বিয়ে বানচাল করছিস কেনো?
-“ কোথায় বানচাল করলাম?
-“ এই যে আমি বিয়ে করলে তোর ও করতে হবে।
-“ হ্যাঁ ঠিকই তো বলেছি,তুমি আমার বোন কে বিয়ে করলে আমি ও তোমার বোন কে বিয়ে করবো।
-“ আমি কি না করছি গাধা তোকে যে আমার বোন কে বিয়ে করিস না। বাসা থেকে দিচ্ছে না তাহলে পালিয়ে বিয়ে কর গিয়ে তবুও আমার বিয়েতে ব্যাঘাত দিস না।
মুহূর্তে রাফির চোখ মুখ জুড়ে হাসি ফুটে উঠলো।
-“ দারুন আইডিয়া দিলে তো ব্রো।
তুষার হুঁশে ফিরে। কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলছে বুঝতে পারে নি।
-“ রাফি শোন ভুলেও এ কাজ করিস না। আমার মুখ ফস্কে এ কথাটা বের হয়ে গেছে।
-“না ব্রো মুখ ফস্কে সবসময় সত্যি কথাই বের হয়। আচ্ছা ব্রো তৃষ্ণা আর আমি লুকিয়ে বিয়ে করলে কি এক সাথে থাকতে পারবো?
-“ এক সাথে মানে?
-“ ঐ যে বিয়ের পর চিত্রা যেভাবে তোমার বাড়ি তোমার রুমে থাকবে সেভাবে কি তৃ…..
-“ এই চুপ কর ফাজিল। তোর বিয়ের এতো ইচ্ছে তোর শ্বশুর কে গিয়ে রাজি করা।
-“ ফুপা তো তোমার বাবা তুমি কি একটু পারো না তোমার হবু শালা+ভাই টার জন্য তোমার বাবাকে রাজি করাতে?
-“ আচ্ছা আমি দেখছি। তুই যে এমন বিয়ে পাগল আমি ভাবতেও পারি নি।
-“ এহ তুমি এমন ভাবে বলছো যে মনে হয় তুমি বিয়ে বিদ্বেষ পুরুষ! তুমিও বিয়ে পাগল।
-“ তোর বড় ভাই আমি, কিছুতো শরম রাখ।
-“ ভরা লোকের সামনে দাঁড়িয়ে চিতা কে যখন চাইলে তখন কি শরমের কথা মাথায় আনছিলা?
তুষার তপ্ত শ্বাস ফেললো। রাফি তার থেকেও এক ধাপ আগানো। কথা না বাড়িয়ে ফোন কেটে দেয়। কোথায় ভাবলো রিলাক্স মুডে বিয়ে করবে তা না এখন রাফির বিয়ের জন্য বাবা কে রাজি করাতে হবে।
চিত্রা কানে হেডফোন লাগিয়ে বসে আছে বেলকনিতে, পাশেই রিয়া বসে আছে। সামনে গরম কফির দুই মগ থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। চিত্রা একটা কফির মগ নিয়ে সেটায় চুমুক দেয়। রিয়া চিত্রার পানে চেয়ে বলে-
-“ জানিস রাফি ভাইয়া কিভাবে সবার সামনে তৃষ্ণা কে বিয়ে করার জন্য বায়না ধরলো।
চিত্রা কফির মগ টা সামনে রেখে বলল-
-“ এ বংশের ছেলে গুলো এমনই,অবাক হওয়ার কিছু নেই।
-“ তাই বলে গুরুজন দের সামনে ওভাবে বলবে!
-“ তাড় ছেঁড়া যে সেজন্য।
-“ দেখ তোর আর তুষার ভাইয়ের বিয়ে সুস্থ ভাবে হয় কি না।
চিত্রা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে-
-“ বিয়ে হলে হবে না হলে নেই।
-“ তুষার ভাই বিয়ে মেনে নিবে না।
-“ জানি, সে জন্য প্যারা নাই।
-“ আচ্ছা থাক আসি বাবু কে মায়ের কাছে দিয়ে আসছি।
রিয়া চলে যায়। চিত্রা কফির মগ টা নিয়ে রুমে এসে পড়ে।
তৃষ্ণা চিত্রা কে ফোন দেয়। চিত্রা তৃষ্ণার ফোন কল রিসিভ করতেই তৃষ্ণা গড়গড় করে বলে-
-“ এই চিত্রা তোর ভাই আমার ফোন ধরছে না কেনো?
চিত্রা অবাক হয়।
-“ কোন ভাই ফোন ধরছে না?
-“ রাফি ভাইয়া।
-“ সেটা আমি কিভাবে জানবো কেনো সে তোর ফোন ধরছে না।
-“ তোর ফোন টা গিয়ে ওরে দে তো।
চিত্রা আচ্ছা বলে ফোন টা নিয়ে রাফির রুমের দিকে যায়। রাফির রুমের দরজায় কড়া নাড়তেই রাফি দরজার সামনে আসে। চিত্রা কে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে-
-“ কিছু বলবে?
চিত্রা ফোনটা রাফির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে-
-“ তুমি তৃষ্ণার ফোন ধরছো না কেনো। তৃষ্ণা ফোন দিয়েছে কথা বলো।
রাফি ফোন টা চিত্রার হাত থেকে নেয়। চিত্রা নিজের রুমে চলে আসে। রাফি ফোন টা কানে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
-“ এই আপনি এসব কি শুরু করেছেন।
তৃষ্ণা কথাটা রেগে বললো।
-“ কি শুরু করছি?
-“ এই যে বিয়ে বিয়ে করে।
-“ তাতে তোমার সমস্যা কি?
-“ আপনার জন্য যে ভাই আর বাবার মধ্যে এক প্রকার তর্কাতর্কি হয়ে গেলো।
-“ হতে দাও। তোমার আব্বা কে তো ভালো মনে করেছিলাম সে এতো ঠেটা কেনো? রাফি কি তার মেয়েকে দিয়ে কাজ করাতো নাকি বাসায় নাকি না খাইয়ে রাখতো? মেয়ে দিতে সমস্যা কি।
-“ আপনি তো এসে বাবার সাথে কথা বলতে পারতেন,ঠান্ডা মাথায় বুঝাতেন।
-“ আসবো বলছো তাহলে?
-“ এখন এসে কি করবেন? যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।
-“ কি হইছে?
-“ কি আবার বাবা রাজি হয়ে গেছে,এটা বলার জন্য সেই কখন থেকে আপনায় ফোন দিচ্ছি ফোন রিসিভ করছেন না।
রাফি শোয়া থেকো এক লাফে উঠে বসে। উৎফুল্ল হয়ে বলে-
-“ সত্যি রাজি হয়েছে?
-“ হ্যাঁ।
-“ বিয়ে কবে আমার?
-“ আপাতত ভাইয়ের বিয়ের দিন আমাদের কাবিন হবে তারপর কয়েক দিন পর উঠিয়ে দিবে।
-“ তা কয় দিন পর উঠিয়ে দিবে?
-“ আশ্চর্য সেটা আমি কিভাবে জানবো?
রাফি বিরক্ত নিয়ে বলল-
-“ সবটাই জানতে পারলে আর এই টুকু জানতে পারলে না ইডিয়ট।
-“ আপনার দরকার আপনি জানেন।
-“ বিয়ে মনে হয় আমি একাই করছি,তোমার মনে হয় বিয়েতে মত নেই।
-“ মত আছে থাকবে না কেনো।
-“ বিয়ের জন্য আমি কত স্ট্রাগল করছি,আর তুমি।
-“ আর আমি কি?
-“ কিছু না ফোন রাখি। এবার নিশ্চিন্তে একটা ঘুম দিবো।
কথাটা বলে ফোন কেটে দেয় রাফি। চিত্রা কে তার ফোন টা তার রুমে গিয়ো দিয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়ে।
ছাঁদে পায়চারি করছে অধরা। মন কে কিছুতেই বশে আনতে পারছে না। আশরাফুল রহমান মেয়েকে এতো রাতে ছাঁদে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। তার নিজের ও ঘুম আসছিলো না দেখে ছাঁদে এসেছে। কিন্তু মেয়েকে দেখে মেয়ের দিকে এগিয়ে যায়। মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ কি হয়েছে অধরা এতো রাতে ছাঁদে কেনো তুমি?
অধরা ভরকে যায়। তার বাবাকে এইখানে এই মুহূর্তে একটু ও আশা করে নি। নিজেকে সামাল দিয়ে বলে-
-“ এমনি একটু হাঁটাহাটি করতে এসেছি।
-“ ওহ্ একটা কথা বলতে চাই।
-“ হু বলো।
-“ তোমাকে কয়েক দিন ধরে খুব অচেনা অচেনা লাগছে।
-“ যেমন?
-“ তোমার মাঝে কিছু পরিবর্তন এসেছে,সেটা কি জানো তুমি?
-“ জ্বি বাবা সত্যি বলতে গেলে পরিবর্তন গুলো আমিও লক্ষ্য করেছি।
-“ এমন পরিবর্তনের কারন কি?
-“ আমি নিজেও বুঝতে পারছি না।
-“ কথাটা বাজে ভাবে নিয়ো না মা,কাউকে কি ভালোবেসে ফেলছো?
অধরা থতমত খেয়ে গেলো।
-“ না না বাবা অধরা দ্বিতীয় বার কাউকে ভালোবাসতে পারে না। তার জীবনে এক মাত্র শাফিন এর ই দ্বিতীয় কোনো পুরুষ কে অধরা তার জীবনে আসতে দিবে না।
-“ এভাবে জীবন চলে না অধরা। আমাদের বয়স হচ্ছে তোমাকে একটা ভরসাযোগ্য হাতে তুলে দিতে পারলে শান্তি পাবো তোমার মা আর আমি।
-“ সরি বাবা আমি আর দ্বিতীয় বার এসবে জড়াতে চাই না।আমি ডিসাইড করেছি আমি আবার ইতালি ব্যাক করবো।
-“ কেনো?
-“ কারন এখানে থাকলে নিজের উপর কন্ট্রোল থাকবে না আমার। জমি টা বিক্রি করতে চেয়েছিলাম না কিন্তু দেখলাম সত্যি জমিটা জন্য আহমেদ দের সমস্যা হচ্ছে তাই বিক্রি করেছি চড়া দামে।
-“ কবে যাচ্ছো?
-“ এই তো পরশু ফ্লাইট। তোমরা কি যাবে?
-“ হ্যাঁ আমরা আর এখানে থেকে কি করবো,তোমার মা যেতে চাইছে বারবার।
-“ তাহলে আমি পরশু যাচ্ছি তোমার না হয় আমার পরে যেয়ো।
-“ আচ্ছা।
অধরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে নিজের রুমে চলে যায়। রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে করতে বলে-
-“ দ্বিতীয় বার কাউকে ভালো লেগেছে কিন্তু ভুল মানুষ সে। অধরা তুই আর মানুষ খুঁজে পেলি না ঐ ছেলে কেই ভালো লাগতে হলো তোর? ছেলেটার বিয়ে সামনে, তোর চয়েস দেখে আমার তোকেই থাপড়াতে ইচ্ছে করছে। এখনই লাগাম টেনে ধর, তুই ভিলেন নস যে থার্ড পার্সন হয়ে যাবি। যেটা মনে আছে সেটা মনের ভেতরই কবর দে। নিজেও ভালো থাকবি অন্যরাও ভালো থাকবে।
#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৮৬|
ঠিক যেন সন্ধ্যাদ্বীপ জ্বলছে৷ পাশাপাশি বসে আছে সৌধ, নিধি৷ নিধির গায়ে কাশ্মীরি শাল জড়ানো। হাত দু’টো হিম ধরে যাচ্ছিল বলে আগুনের তাপ নিল। সৌধর পরনে জিন্স প্যান্ট আর চকোলেট কালার ফুল স্লিভ টি-শার্ট। দৃষ্টি নত। ওরা কেউ একে অপরের দিকে তাকিয়ে নেই। নিধির দৃষ্টি সম্মুখে পুড়তে থাকা কাঠগুলোতে। সৌধর দৃষ্টি নত। গভীর কিছু ভাবছে সে। প্রকৃতির এই সময়টা কী অভিশপ্ত? কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরকে যতটা স্নিগ্ধ, পুতঃপবিত্র লাগে। পূর্ণ সন্ধ্যাকে তেমন লাগে না কেন? দিনরাত্রির সন্ধিক্ষণ একটু নয় অনেক বেশিই রহস্যময়। যেন এক টুকরো কলঙ্ক লেগেছে সন্ধ্যার গায়ে। একটা চাপা আর্তনাদ দুলে বেড়ায় এই প্রকৃতিতে। অনেকটা সময় নীরবতা পালন করল ওরা৷ নীরবতাটুকু ভাঙল সৌধ নিজেই। শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল নিধির পানে। এরপর খুব সহজ, স্বাভাবিক স্বরে প্রশ্ন করল,
‘ সুখে আছিস? ‘
‘ ডেফিনিটলি সৌধ, তুই এটা জিজ্ঞেস করার জন্য ডেকেছিস? ‘
কপাল কুঁচকে গেল সৌধর। কিঞ্চিৎ বিরক্তি স্বরে বলল,
‘ ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান বানে। সব সময় বাড়িয়ে বলা লাগবে? কেন ডেকেছি কারণটা অবশ্যই বলব। সেটার জন্য ধৈর্য্য লাগবে। তোর যদি আমার কথা শোনার ধৈর্য্য না থাকে, চলে যা। ‘
আচমকা হেসে ফেলল নিধি। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর বৃথা চেষ্টা করে বলল,
‘ আহ হা রাগ করছিস কেন? সব মেয়ে তো আর তোর বউয়ের মতো ধৈর্য্যশীল হবে না তাই না। ‘
‘ কথাটা মন্দ বা মিথ্যে নয়। হোয়াটেভার, মূল প্রসঙ্গে আসি৷ ‘
‘ তোরও কি মনে হয় রূপের বাবার কাছে আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত? ‘
সহসা সৌধর পানে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল নিধি। ওর বাদামি মণির স্বচ্ছ চোখ দু’টোয় একরাশ দ্বিধাদ্বন্দ্ব এসে ভর করেছে। নিমেষে চোখ সরিয়ে নিল সৌধ। জ্বলন্ত আগুনে নির্নিমেষে তাকিয়ে হাসল একপেশে। বলল,
‘ ক্ষমা আমি চাইব না নিধি। আমার হয়ে, আমাদের হয়ে তুই নিশ্চয়ই অসংখ্যবার ক্ষমা চেয়েছিস রাইট? ঘটনা চুকে গেছে বহু আগেই৷ সেই চুকানো বিষয় আর সামনে না আনাই ভালো। পৃথিবী, জীবন, ভালোবাসা, অনুভূতি এসবের কোনোটাই সুহাস, আইয়াজ আমার মতো করে ভাবে না। আমার মতো করে ধাক্কা খায়নি বলেই হয়তো ভাবে না। বা তোর প্রতি আমার যে অনুভূতিটা ছিল তা ওদের ছিল না বলেই বুঝতে পারে না। ওরা শুধু তোকে বন্ধুর নজরে দেখেছে। তাই সেদিনের করা কাজটার জন্য খুব সহজে তোর স্বামীকে সরি বলেও দিয়েছে। কিন্তু আমি? ‘
এক মুহুর্ত থামল সৌধ। এক পলক তাকাল নিধির পানে। এরপর এক ঢোক গিলে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
‘ অতীতে তোর প্রতি আমার যে অনুভূতি ছিল। তা আজ নেই৷ এটা যেমন সত্যি ঠিক তেমনি এক বড়ো সত্যি হলো। অতীতের ওই অনুভূতি মিথ্যা ছিল না। আমি আজো মাথা উঁচু করে তীব্র বিশ্বাসী গলায় বলতে পারি ওই অনুভূতি মিথ্যা ছিল না। সেদিন অর্পণ স্যার হয়তো অল্প সময়ের জন্য অসম্মানিত হয়েছে। ক্ষণিকের জন্য শরীরে ক্ষত পেয়েছে। কিন্তু আমি? আমার প্রথম অনুভূতি আর ভালোবাসার মৃত্যু তো ওইদিনই ঘটেছে। এই ক্ষত কি কোনোদিন সেরে উঠবে? কোনোদিন ভুলতে পারব? আজ তুই যুক্তি দাঁড় করাতে পারিস তুই কোনোদিন আমাকে একসেপ্টই করিসনি৷ কিন্তু দূর্ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার আগের কিছু মুহুর্ত কি আমি ভুলতে পারি? তুই নিজেও কি অস্বীকার করতে পারবি শেষদিকে তুই মুখে স্বীকার না করলেও আমাকে আশকারা দিস নি। আশা, ভরসার ইঙ্গিত তো অবশ্যই পেয়েছিলাম। তবে কেন আমি অর্পণ স্যারকে সরি বলব? এ পৃথিবীতে কোন পুরুষ সহ্য করবে তার প্রিয় নারীতে অন্য পুরুষের স্পর্শ? তোরা ম্যারেড ছিলি জানতাম না তো আমি। তোর প্রতি বন্ধুত্ব, ভালোবাসার প্রগাঢ়তায় মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করেও তোকে একফোঁটা আঘাত করতে পারিনি৷ কিন্তু আমার ওই বিভীষিকাময় অনুভূতিটুকু তুই বা তোরা কেউ বুঝবি না, কেউ না। আজ অবশ্য বোঝার দরকারও নেই। শুধু তোদের কাছে আমার রিকোয়েস্ট, কখনো ভুলেও আর কেউ উচ্চারণ করবি না, অর্পণ স্যারকে সরি বল। তুই আমার বন্ধু নিধি। কিছু অনুভূতিতে যে বন্ধুত্বে ফাটল ধরেছিল আজ অনুভূতির সাথে সাথে সেই ফাটলও ফিঁকে হয়ে গেছে। তাই বলব, আমার ওই অনুভূতি গ্রহণ করিসনি ইট’স ওকে। তোর হাজব্যন্ডকে সরি বলিয়ে অসম্মান বা অপমান করিস না। হতে পারে আমার প্রথম প্রেম ভুল মানুষকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল। তাই সৃষ্টিকর্তা আমার কপালে তাকে রাখেনি। এর মানে এই না ওই সময়ের অনুভূতি, ওই সৌধ মিথ্যা ছিল। আমি আমার সব অনুভূতিকে রেসপেক্ট করি। শুধু তাই নয় আমি আমার পুরো ব্যক্তিজীবনটাকেই প্রচণ্ড রেসপেক্ট করি। এই রেসপেক্টের জায়গাকে তোরা ডিসরেসপেক্ট করিস না। আশা করি তুই আইয়াজ আর সুহাসকে এ ব্যাপারে এলার্ট করে দিবি৷ আমি করতে গেলে ওরা ভুল বুঝতে পারে৷ স্পেশালি সুহাস। ও ভাববে আমি আজো তোর প্রতি দুর্বল৷ কিন্তু না, তোর প্রতি এখন বন্ধুত্বের বাইরে বাকিসব অনুভূতি ফিঁকে হয়ে গেছে। বিস্ময়কর এই ঘটনাটি কীভাবে সম্ভব হয়েছে নিশ্চয়ই এতদিনে বুঝতে পেরেছিস? ‘
.
ছাদে সবাই মিলে গল্প করবে। আড্ডা জমাবে। তাই প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হঠাৎ করেই নামী শাড়ি পরে সিমরানকেও জোর করে ল্যাভেন্ডার রঙের একটি শাড়ি পরিয়ে দিল। আর কোনো সাজগোজ নয়। শাড়ির সঙ্গে শুধু গায়ে চাদর জড়িয়ে নিল। আজিজ আর আইয়াজ বাইরে গিয়েছিল। দু-হাত ভর্তি ফাস্টফুড নিয়ে ফিরেছে। হাঁকডাক করে ডাকছে সুহাস আর সৌধকে। শাড়ি পরার পর সিমরান নিজেও সৌধকে খুঁজছিল। স্বামীকে খুঁজতে গিয়েই আচমকা খেয়াল করল আশপাশে নিধি আপুও নেই। নিমেষে বুকের ভেতর মুচড়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে আবার নিজের মাথায় নিজেই একটা টোকা দিয়ে ভাবল,
‘ ধুরর! অযথা ভয় পেয়ে যাই। ‘
মনকে সান্ত্বনা দিলেও ভেতরে একটা খচখচ অনুভূতি হচ্ছিল। শত হোক নারী মন বলে কথা! আনমনে সবাইকে রেখে সে একা একাই ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। যেন অদৃশ্য এক সুতো টানছিল তাকে। সিঁড়ি পেরিয়ে যখন ছাদের দরজা পর্যন্ত গেল পা দু’টো থমকে গেল। স্পষ্ট দেখতে পেল সৌধ আর নিধি পাশাপাশি বসে আছে। আচমকা মস্তিষ্কে এসে হানা দিল সেদিনের সেই মুহুর্তটুকু। স্মৃতি আপুর বিয়ের আগের রাত৷ যেদিন সে প্রথম জানতে পারে সৌধভাই নিধি আপুকে ভালোবাসে। আহ, কী নিদারুণ এক যন্ত্রণাময় মুহুর্ত। শ্বাস বন্ধ করে দেওয়া সেই দৃশ্য। আর ভাবতে পারল না সিমরান। দরজাটা শক্ত করে ধরে দুচোখ বন্ধ করে নিল। শ্বাস নিল বড়ো বড়ো করে। নিজেকে বুঝাল,
‘ শান্ত হো সিনু। জাস্ট শান্ত থাক। সৌধ বা নিধি আপু কেউই তোর শত্রু নয়। একজন অর্ধাঙ্গ অপরজন বড়ো আপু এবং শুভাকাঙ্ক্ষী। ‘
মনকে কথাগুলো বুঝিয়ে কানটা সজাগ রাখল। শুনতে পেল নিধির বলা কঠিন কঠিন কথা আর সৌধর বলা আবেগঘন কথা।
.
বিস্ময়কর ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছে জানে নিধি৷ সিমরানের নিঃস্বার্থ, নিগূঢ় ভালোবাসা আর যত্নে। তাই বলল,
‘ সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্য বেস্টটাই দেয় সৌধ। আমি কখনো সিনুর মতো স্বার্থহীনভাবে তোকে ভালোবাসতে পারতাম না। এ পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে। যারা বাস্তবতার ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজের সবটুকু দিয়ে মানুষকে ভালোবাসতে জানে। সিনু হলো ওই ধরনের মানুষ, মেয়ে৷ দেখ, আমার জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল পড়াশোনা করে ডাক্তার হওয়া৷ এরজন্য বাবা, মায়ের সাথে লড়াই করেছি। আমি তোকে ইগনোর করেছি আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে। আবার আমি যে বিয়েটা করলাম। এটাও আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে যারা আমাকে সাহায্য করল তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে। এরপর নানারকম দ্বন্দ্ব, জটিলতার শেষে আমি স্যারকে ভালোবেসেছি৷ কেন বল তো? কারণ ওই মানুষটা আমার স্বপ্ন পূরণের সাথী হয়েছে। আমার সব ভুল, খারাপ আচরণ, অবাধ্যতা সহ্য করেও ওই মানুষটা এত বেশি সাপোর্ট দিয়েছে। পাশে থেকে ভালোবেসে যত্ন নিয়েছে যে শেষ পর্যন্ত আমি ভালো না বেসে থাকতে পারিনি। আমার মনে হয়, আমার পেছনে সময় ব্যয় করে জীবনে আঘাত ছাড়া কিছু তো পাসনি। আর সিনুর পেছনে কোনোকিছু ব্যয় না করেই পেয়েছিস নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। আমাদের হৃদয় খুব চতুর হয় বুঝলি? একটু দেরি হলেও তারা ঠিক তাদেরটা বুঝে নিতে পারে। তোর হৃদয়ও বুঝে নিয়েছে সিনুর হৃদয়কে৷ আর সিনুও পৌঁছে গেছে তার লক্ষ্যতে। ‘
বাঁকা হাসল সৌধ। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ ভালোবাসা ব্যাপারটা একেকজন আসলে একেকরকম ভাবে এক্সপ্লেইন করে। আর সবাই স্ব স্ব জায়গায় একদম সঠিকটাই ব্যাখ্যা দেয়৷ এই যেমন তুই তোর অভিজ্ঞতা থেকে দিচ্ছিস। আর আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে দিব৷ ‘
স্মিত হাসল নিধি। সৌধ ফের বলল,
‘ আমার দেখা পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী নারী ছিল আম্মা৷ এরপর এই জায়গাতে আরো একজন দখল নিল। কে জানিস? যে আমার জীবনে বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটাল। অনেক সময় আমাদের সঙ্গে এমন কিছু ঘটে যায়, যেগুলোতে আমাদের হাত থাকে না৷ এমনই ঘটনা পরপর ঘটে গেল আমার সাথে। এক. তোকে হারালাম, দুই. সিনুকে পেলাম। আমার প্রথম প্রেম আমার হৃদয়ে ঠিক কতটুকু শক্তি নিয়ে ঘাঁটি গেড়েছিল আমি তো জানি? সেই ঘাঁটিটা নড়বড়ে করে করে একদম উপড়ে ফেলল মানুষটা। অবশ্য তার একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমিও চেয়েছিলাম৷ আমি আসলে হার মানতে বাধ্য হয়েছিলাম ওর ভালোবাসার শক্তির কাছে। এ জেনারেশনে এসে সিনুর মতো আধুনিকা মেয়ে এভাবেও ভালোবাসতে পারে? এই যে প্রশ্ন, এটাই মুগ্ধতা এনে দিল। সেই মুগ্ধতার রেশ আজ বিয়ের এতদিন পরও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ‘
নিধির দৃষ্টি নিষ্পলকে দেখছে সৌধর মুগ্ধ দৃষ্টিজোড়া। ওই মুগ্ধতা সিনুর জন্য৷ বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেলল সে। এই দিনটার বোধহয় খুব বেশি প্রয়োজন ছিল খুব৷ অন্তত তাদের বন্ধুত্বে স্বাভাবিকতা আনার ক্ষেত্রে ভীষণ প্রয়োজন ছিল। মৃদু হাসল নিধি। সহসা সৌধ রহস্যময় এক হাসি দিল। বুকের বা পাশে হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,
‘ নিধি, তুই প্রুফ চাস সিনুকে আমি কতটা ভালোবাসি? ‘
অদ্ভুত করে হাসে নিধি৷ বলে,
‘ প্রমাণে কী আসে যায়? তুই মুখ দিয়ে বলেছিস, তোর চোখে আমি যা দেখেছি এটাই তো যথেষ্ট। ‘
সৌধ এবার গলা উঁচু করে বলল,
‘ আই রিয়েলি লাভ হার। যে এখন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছে! ‘
চমকে উঠল নিধি। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল দরজার ওখানে৷ একটা আবছা ছায়া নিমেষে সরে গেল৷ পরমুহূর্তেই হৈচৈ করতে করতে ছাদে এলো আজিজ, সুহাস, নামী আর আইয়াজ, ফারাহ। ওদের ফাঁকি দিয়ে নিধি ফিসফিস করে বলল,
‘ আমাদের তো আর চক্কর চলার চান্স নেই ভাই। তাই সৌধকে পরামর্শ দিচ্ছিলাম তাড়াতাড়ি মেয়ের বাপ হওয়ার ব্যবস্থা কর৷ ছেলে, মেয়েদের চক্করের ব্যবস্থা করে দিই। ‘
সবাই সবার মতো জায়গা দখল করে বসছিল। নিধির কথা শুনে আচমকা আজিজ বলল,
‘ এই নিধি সাবধান, বাঁশ খাবি। সৌধর মাইয়া জীবনেও তোর পোলারে বিয়ে করব না৷ মেয়ে মানুষ যে কী জিনিস ভাই। অগো প্রতিশোধে মাথা টলে আমার। দেখা গেল বাপের হইয়া মেয়ে প্রতিশোধ নিল। মাঝখান থিকা তোর চান্দের টুকরা পোলাডা ফাঁসব। ‘
আজিজের এহেন কথায় চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল নিধির৷ সৌধ মোটেই পছন্দ করল না নিধির বলা কথাটি। আজিজের কথা তো ওর কোনোকালেই পছন্দ না৷ তবে বাকিরা বেশ মজা পেল। হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেল ফারাহ নামী৷ সুহাস তখন বলে উঠল,
‘ আমার ভাগ্না হলে তো হলোই। কিন্তু ভাগ্নি হলে ওকে স্পেশাল গার্ড দিব আমি৷ তোদের কারো ছেলেরই চান্স নেই। ‘
এবারে মুচকি হাসল সৌধ। নামী বলল,
‘ আচ্ছা, আচ্ছা যার ভবিষ্যত ছানাপোনা নিয়ে কথা হচ্ছে। সেই রাজকুমারীটি কোথায়? ‘
সবারই যেন সংবিৎ ফিরল। কেবল সৌধ ছাড়া। মন বলছে, তার বউপাখি এই আয়োজনে আসবে না। হলোও তাই৷ নামী নিচে গিয়ে সিনুকে ডাকল ছাদে আসার জন্য৷ শরীর খারাপ লাগছে বলে সে আসবে না জানালো। এই যে না করল সে না আর হ্যাঁ হলো না। সুহাস বলল,
সৌধ গেল না। অতএব সবাই ধারণা করে নিল সৌধ, সিমরানের মধ্যে মনোমালিন্য চলছে। মাঝেমধ্যে অবশ্য স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য হওয়া দরকার। এতে সম্পর্ক আরো মিষ্টি এণ্ড মজবুত হয়৷
বন্ধুরা মিলে জমিয়ে আড্ডা দিল। পুরোনো কিছু স্মৃতিচারণ আর ভবিষ্যত পরিকল্পনা শেয়ার। সবমিলিয়ে মিষ্টি, বিষণ্ন সুন্দর একটা মুহুর্ত। হঠাৎ আজিজ বলল,
‘ একটা গান ধর তো সৌধ। ‘
আজিজকে প্রশ্রয় দিল সবাই৷ এরপর শীত শীত নির্মল, আর জ্বলন্ত আগুনের উষ্ণ তাপে বসে কোনো প্রকার বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই গান ধরল সৌধ। ওর সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে গাইল সুহাস, আইয়াজ এবং সবাই। সঙ্গে ছিল মৃদু মৃদু হাতে তালির শব্দ। যা গানের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে রইল।
” পুরো পৃথিবী এক দিকে আর আমি অন্য দিক,
সবাই বলে করছ ভুল আর তোরা বলিস ঠিক
তোরা ছিলি, তোরা আছিস, জানি তোরাই থাকবি
বন্ধু…. বোঝে আমাকে,
বন্ধু আছে… আর কি লাগে?
সুসম্পর্ক দুঃসম্পর্ক আত্মিয় অনাত্মিয়
শ্ত্রু মিত্র রক্ত
সম্পর্কে কেউ বা দ্বিতীয়
শর্ত সব দূরে কাছে বৈধ অবৈধ
হাজারো এসব সম্পর্ক ভাঙ্গে থাকে বন্ধুত্ব
তোরা ছিলি তোরা আছিস জানি তোরাই থাকবি
বন্ধু বোঝে আমাকে, বন্ধু আছে আর কি লাগে?
কিছু কথা যা যায় না বলা কাউকে
কিছু কাজ যা যায় না করা সহজে
কিছু আচরন মানে না কেউ সামনে
কিছু জায়গা যায় না যাওয়া চাইলেই
সবই হয় যদি তোরা থাকিস সেখানে
বন্ধু…. বোঝে আমাকে,
বন্ধু আছে…. আর কি লাগে?”
.
.
বিছানার একপাশে নিভৃতে শুয়ে আছে সিমরান। সে ভেবেছিল সৌধ তাকে ডাকতে আসবে। এরপরই যাবে ছাদে। এতে সবাই বুঝবে সৌধর লাইফে তার গুরুত্ব। অবচেতন মন বুঝি একটু চেয়েছিল নিধি আপু সৌধর মুখে আজ যে ভালোবাসার স্বীকারোক্তি পেল। তার প্রমাণও মিলুক। কিন্তু মিলল না। সৌধ এলো না। এতক্ষণ অভিমান না হলেও এবার তীব্র অভিমানে বুক ভার হয়ে রইল। কান্না পেল খুব৷ চোখ গলে অশ্রুপাত হতে শুরু করল৷ এদিকে ওরা আড্ডা দিয়ে ক্লান্ত তখন৷ নিচ থেকে সেলিনা আপাও খবর দিল বাচ্চারা উঠে পড়েছে৷ নিধি, নামী দু’জনই নিচে নেমে গেল৷ ফারাহরও বিশ্রাম প্রয়োজন। আইয়াজ ওকে নিয়ে ধীরেসুস্থে নিচে গেল। এরপর আজিজ সিগারেট খাওয়ার বায়না করলে, বকাঝকা করল সৌধ। শেষে অনুমতিও দিয়ে দিল। আজিজ সাধল ওদের। সৌধ একবার ভাবল একটা ধরানো যাক। পরোক্ষণেই মত পাল্টালো। কারণ তার উদ্দেশ্য আজ অন্যরকম।
এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল সৌধ। মিটিমিটি হাসতে হাসতে বউকে ফেরাল নিজের দিকে। গাল বেয়ে পড়া অশ্রুটুকু মুছে দিয়ে বলল,
‘ এটা খুব খারাপ হলো সিনু। আমি ইচ্ছে করে তোমাকে ডাকিনি৷ তাই বলে কান্না করার কিছু হয়নি। ‘
নিমেষে নিঃশ্বাসের বেগ বাড়ল সিমরানের। সৌধ থেকে সরে গিয়ে নেমে দাঁড়াল। ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল,
‘ ডাকোনি বলে কাঁদছি না৷ আমার আব্বুর কথা মনে পড়েছে তাই কাঁদছি। ‘
উত্তেজিত হয়ে পড়েছে সিমরান। দ্রুত কন্ট্রোলে আনতে হবে৷ যদিও সৌধর সামনে কখনো সে বিশৃঙ্খলা করে না৷ তবু সিচুয়েশন সব সময় এক রকম থাকে না। তাছাড়া নারীরা ঈর্ষান্বিতা হলে ভয়ংকর হয়ে যায়। ত্বরিত উঠে দাঁড়াল সৌধ। সিমরানের কাছে এসে আপাদমস্তক তাকিয়ে বলল,
‘ গ্রেট! শাড়ি পড়েছ? ‘
এ যেন কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিঁটা! সেই কখন শাড়ি পরেছে সে। ভেবেছিল বরকে দেখাবে৷ নাহ সে বান্ধবী নিয়ে ছাদে বসে গল্প করছে৷ তার এই ঈর্ষা ভাব অবশ্যই প্রাইভেট। শুধু বর ছাড়া কাউকে দেখানো যায় না৷ তাই বরকেই দেখাল। জ্বলে উঠার মতো করে বলল,
‘ না কিচ্ছু পরিনি। ‘
চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল সৌধর। বলল,
‘ হোয়াট! আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তুমি শাড়ি পড়েছ! ‘
রাগে দুঃখে সিমরান ধপাধপ্ পা ফেলে জামা, পাজামা বের করে বাথরুমে যেতে উদ্যত হলো। আচমকা ওর হাত টেনে ধরল সৌধ। শান্ত গলায় বলল,
‘ এত রাগ করছ কেন সিনু? আমার কথা শোনো, রাখো এসব। ‘
বলেই কাপড়গুলো নিয়ে রেখে দিল সে। এরপর ওর গাল দু’টোয় আলতো হাত রেখে গভীর চাউনিতে বলল,
‘ কী মারাত্মক লাগছে এই শাড়িতে! পরে থাকো। আমি দেখি কিছুক্ষণ। ‘
সিমরান ওর হাত সরিয়ে বলল,
‘ আমি শাড়িটা খুলবই সৌধ। পরব না শাড়ি আমি। আর কক্ষনো শাড়ি পরব না৷ ‘
কোর্ট কাচারির চক্কর কাটছে সাখাওয়াত আজ প্রায় দু মাসের মত। বড় দাদা প্রায়ই বাড়ি বয়ে এসে অর্ণবকে হাজারো ছলাকলা বুঝিয়ে কেস উঠিয়ে নিতে বলে৷ সে বরাবরই সহজ মুখে জবাব না দিয়ে এড়িয়ে যায়। এই কেস চলবে ঠিক ততদিন যতদিন না অর্ণব নিজের পরিকল্পনা মত সব গুছিয়ে নিতে পারছে। তাইতো নুপুরকে এক রাতে খুব যত্ন করে বুকে টেনে নিলো। স্নেহমাখা সুরে খুব করে বোঝালো তারা অন্য এক জগতে চলে যাবে ছোট্ট এক সংসার গড়তে তাতে কি নুপুর খুব কষ্ট পাবে?
এরই মাঝে অর্নির জীবন পরিবর্তন হয়েছে অনেক। সে ফিনল্যান্ড পৌঁছে ক্লাস করেছে মাত্র এক সপ্তাহ এরই মধ্যে এক ক্লাসফিলোর সাথে ভাব হতেই পার্ট টাইম জব পেয়ে গেল। রিদওয়ান প্রথমে একটু দোনোমোনো করলেও পরে মেনে নিলো। উন্নত বিশ্বে নিজ অর্থায়নে চলাটাই যেন সুন্দর, সহজ বাস্তবতা তদুপরি রিদওয়ান চেষ্টায় আছে এদিকে শিফট হওয়ার। অর্নি রিদওয়ান দুজনেই অধীর আগ্রহে দিন কাটাচ্ছে কবে তাদের একসাথে হওয়ার সুযোগ মিলবে! এক আব্বু ছাড়া বাকি সবার সাথেই যোগাযোগ এখন স্বাভাবিক৷ বৃষ্টি চেষ্টায় আছে স্কলারশিপের সুযোগ হলেই সেও চলে যাবে ইউরোপের কোন এক দেশে। রিমনও চট্টগ্রামের ব্যবসাতে স্যাটেল হওয়ার জন্য নিদারুণ পরিশ্রম করছে। অন্তত সেখানকার ব্যবসায় নিজের একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারলে নাজনীনকে বিয়ের কথাটা জানাতে পারবে৷ ততদিনে নাজনীনেরও পড়াশোনা শেষ হবে আব্বুও তার ওপর যথেষ্ট ডিপেন্ডেবল হবে। রিমন প্রায়ই ভাবে সে তার বাবার যথার্থই যোগ্য সন্তান নইলে এতোটা স্বার্থ সিদ্ধি করেও সকলের মন রক্ষা করতে পারতো না অথচ ভাইয়া মানুষটা আগাগোড়াই আবেগি ঠিক তাদের আম্মুর মত।
_____
আজ শুনানির তারিখ এবং আশা করা যাচ্ছে আজই কেসের ইতি ঘটবে। সকাল নয়টা নাগাদ কোর্টে এসে পৌঁছেছে অর্ণব সাথে তার উকিল এবং তার একান্ত শুভাকাঙ্ক্ষী ম্যানেজার আঙ্কেল। কোম্পানি বিক্রির পর মোটা অঙ্কের একটা এমাউন্ট দিয়ে ভদ্রলোককে মার্কেটে পুঁজিসহ দোকান করে দিয়েছে সে। নুপুরের বাবাও একবার জামাইর সঙ্গে কোর্টে আসতে চাইলে বলে অর্ণব বারণ করেছে। খুব সকালে খালামনিও ফোন করে দোয়া করলেন যেন সব ভালোয় ভালোয় মিটে যায়। অর্ণব অবশ্য মন থেকে চাইলো ভালো কিছু না হোক যা হয় সবটা তার মনের চাওয়া মতোই হোক। শেষটা সুন্দর হোক ভয়ংকর সুন্দর! ঠিক বারোটায় শুরু হলো অর্ণব চৌধুরীর কেসের শুনানি আসামিপক্ষ সাখাওয়াত চৌধুরী দাড়িয়ে আছে কাঠগড়ায়। দু পক্ষের উকিলের মৌখিক সংঘর্ষ খুব বেশিক্ষণ চলেনি। বলা চলে, চলতে দেয়নি অর্ণব। আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার উকিলকে কেস হালকার ওপর ছেড়ে দেবে এতে সাখাওয়াতের যদি জেল নাও হয় চলবে। এমন কথা শুনে উকিল সাহেব বোকার মত চেয়ে রইলেন অর্ণবের দিকে। এ কেমন মক্কেল তার! জিতের কোন আগ্রহই নেই। তবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই কেসে টাকা তিনি জেতার জন্য পাচ্ছেন না এই কেসের উদ্দেশ্য কিছু মূল্যবান সময় নষ্ট করা। ফলাফল তাই হলো। সাখাওয়াত চৌধুরীর নামে জরিমানা হলো যা টাকায় উসুল হলো৷ কেস শেষ! দীর্ঘ দু মাসের কোর্টে আসা-যাওয়া নিছকই খেল! সাখাওয়াত চৌধুরী বুঝতেই পারলেন না অর্ণব এত বোকা কেমন করে? তাকে আরো বিশ্রিরকম ফাঁসানোর সুযোগ তো ছিল তার কাছে। আর অর্ণব তার স্ত্রীর ধর্ষণের মামলাটা থামিয়ে দিলো কেন? অর্ণব তো এতদিনে সবই জেনে গিয়েছে নিশ্চয়ই তাইতো তিনি ছেলেকে ট্যুরের নামে দু মাস আগেই মালদ্বীপ পাঠিয়ে দিয়েছেন। কত কত টাকা নষ্ট করে ফেলল হারামজাদা এই দু মাসেই। ওর নামে তো কোন কেসই আগালো না উল্টো অর্ণব নাকি সেই কেস ক্লোজ করিয়ে দিয়েছে। অযথাই বদমাশটাকে বাঁচানোর নামে লাখ লাখ টাকার জলাঞ্জলি দিলো! আজই বলতে হবে ওটাকে ফিরে আসতে বরং তিনিই ফিরতি টিকেট কনফার্ম করাবেন। করা হলো টিকেট কনফার্ম। মিনার দেশে ফিরলো তিন দিনের মাথায় তারপর থেকেই সে স্বাভাবিকভাবে এদিক সেদিক ঘুরতে ফিরতে লাগলো।
________
দীর্ঘ দু মাস বাপের বাড়ি থাকার পর আজ নুপুর ফিরে যাচ্ছে নিজের বাড়িতে৷ যে বাড়িতে তার বিয়ের পর থাকার মেয়াদকাল ছিল দেড় মাস। অর্ণব মাস দুই আগে যখন বলল, তাদের ছোট্ট এক সংসার হবে ছোট্ট এক বাড়িতে নুপুর ভেবেছিল অর্ণব হয়তো ছোট একটা ফ্ল্যাট কিনে নিয়ে যাবে তাকে। আর তাইতো রুজিনা খালাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো, দারোয়ান চাচাও নাকি এ মাসে চলে যাবে অন্যকোথাও। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো এ দু মাসে অর্ণব সপ্তাহে দু তিন বার করে এসেছে কিন্তু প্রত্যেকবারই সে থেকেছে মাত্র কয়েকঘন্টা। সন্ধ্যে থেকে রাত দশটা এরপর আর তার টিকিটিও খুঁজে পায়নি নুপুর। মাঝেমাঝেই তার ইচ্ছে হতো লোকটা থাকুক আজ থাকুক রাতটা। এত অল্প সময়ে এলে দেখেও তৃপ্তি হয় না। সরাসরি কিছু না বললেও প্রায়ই ইঙ্গিত দিয়েছে সে থাকার। লোকটা বুঝেও না বোঝার ভান করে চলে গেছে। আর আজ কিছু না জানিয়েই এসে বলছে চলো নুপুর বাড়ি যাবে। হুট করে এ কেমন আবদার। বাবা বললেন রাতটা থাকো তাও শুনলো না। যাওয়ার আগে কিছু সময় আলাদা করে কোন বিষয়ে আলাপও করে গেল সে। বাড়ি ফিরতেই অর্ণব বলল, “ওয়েলকাম ফর দ্য লাস্ট নাইট ইন ইউর প্যারাডাইস! উমম… হেল।”
নুপুর অবাক হয় খুব তবুও প্রশ্ন করে না। অর্ণব বাড়ির খোলামেলা সকল দরজা, জানালা লক করতে করতে নুপুরকে ডেকে বলে এক মগ কফি করো তো। মিনিট দশেকের মাঝেই সে দু মগ কফি নিয়ে ডাইনিংয়ে আসতেই অর্ণবকে দেখতে পায় স্টোর রুম থেকে বের হচ্ছে।
-কফি
-বেডরুমে নিয়ে যাও।
-হাতে ওটা কি?
-কোরবানির গরু কাটার হাতিয়ার।
চমকে যায় নুপুর। এমন রহস্যজনক লাগছে কেন অর্ণবের কথা আজ! তখন কি বলল শেষ রাতের জন্য এ বাড়িতে!
-আমার আপনাকে ভয় লাগছে।
অর্ণব এগিয়ে এসে হাতের পেঁচানো হাতিয়ারটা টেবিলের ওপর রাখে৷ নুপুরে চিবুক ছুঁয়ে মুখটা উঁচু করে নরম স্পর্শ আঁকে তার কপালটাতে।
-তুমি আমায় ভয় পেলে জীবনটাই যে বৃথা যাবে সোনা। ভালোবাসার চোখে শুধু ভালোবাসাই দেখতে চাই। ভয় নেই এসব হাতিয়ার শুধু জন্তুদের জন্য ব্যবহার হয় আর বউয়ের জন্য তো শুধু এটা।
কথাটা বলেই অর্ণব ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় আলতো করে। নুপুরের তবুও ভালো লাগছিলো না। এতোটা ভিন্ন আচরণ আগে তো কখনো দেখেনি সে৷ নুপুরের হাতের দুটো মগই তুলে নিয়ে তাকে জানিয়ে দেয়, তোমার ঘুম প্রয়োজন কফি খেতে হবে না। আমি একটু কাজ করব নিচে বসেই। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো গিয়ে।
নুপুর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে যায় ঘুমুতে। ঘুমিয়েও পড়ে অল্প সময়ে। মধ্যরাতে হঠাৎই তার কানে বাজে অর্ণবের ডাক।
-কি হয়েছে?
-উঠতে হবে।
-এখন!
-হু
-কয়টা বাজে?
-রাত দুইটা বারো।
-এতরাতে উঠব কেন?
-আমাদের যেতে হবে।
-কোথায়!
চোখ মুখ কুঁচকে আছে নুপুরের। গাঢ় ঘুম তার ওপর মধ্যরাত। কিছুতেই তার বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করলো না আবার শুয়েও থাকতে পারলো না অর্ণবের ডাকে। ভালো করে চোখ মেলে তাকাতেই অর্ণব আবারও বলল, “চলো।”
-কোথায় যাব? বাতি জ্বালান।
-হুশশশশশ,,, চুপচাপ এসো আমার সাথে।
কোন কথারই জবাব দিলো না অর্ণব। চুপচাপ তাকে অনুসরণ করে নুপুর নেমে গেল নিচে। তার এক হাত অর্ণবের মুঠোয় বন্দী। তারা মোবাইলের ফ্ল্যাশের সাহায্যে ঢুকে পড়লো স্টোর রুমে। না ভুল, স্টোরের দেয়াল ভেদ করে তারা চলে গেল অন্য আরেকটা রুমে যার ভেতরের অংশটা খুব ছোট। নুপুর আলোছায়াময় জায়গাটাতে খেয়াল করলো কেউ একজন পড়ে আছে হাত, পা আর মুখ বাঁধা অবস্থায়। অর্ণব হাতের ফোনটা তাক করলো মানুষটার মুখে। আলো পড়া মুখটা দেখেই আঁতকে উঠলো নুপুর।
-এই ছেলেটা….
-ছেলে নয় বলো জন্তুটা। এটা কোন মানুষের বাচ্চা নয় ও হলো পিশাচের বাচ্চা ইবলিশ। ওই ছুঁয়েছিল না তোমায় ওর এই হাত দুটো দিয়ে! কেমন হবে এ হাত দুটোকে এখন জ্বালিয়ে দিলে?
কোঁক করে কাতরানোর আওয়াজ এলো বাঁধা মানুষটা থেকে। হয়তো বাঁচার জন্য আকুতি জানাচ্ছে কিন্তু অর্ণব অত দয়ামায়া দেখাতে জানে না৷ নুপুর ভীত চোখে তাকায় অর্ণবের দিকে। অর্ণব বিশ্রী হেসে আবারও বলে, কি যেন বলেছিলি বাক্যটা? রঙ যেমন তেমন ফিগার মাইরি….. এগুলোই তো বলেছিলি ওকে আটকে রেখে!
নুপুর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অর্ণবের মুখের দিকে। এ কথা তো তাকে সত্যিই বলেছিল এই ছেলেটা কিন্তু সে জানলো কেমন করে? ওই বীভৎস সময়গুলোর একটুও তো বলেনি সে অর্ণবকে কি যন্ত্রণা বয়ে গেছে তার বুক জুড়ে। অর্ণব হাতে সেই ধারালো রামদা তুলে নিলো যেটা নুপুর দেখেছিল সন্ধ্যায়।
-তুমি কি ভয় পাবে খুব?
ছলছল চোখে তাকায় নুপুর। কি বলছে লোকটা! সে কি এখন খু’ন করবে ছেলেটাকে?
-প্লিজ আপনি খুনখারাবি করবেন না প্লিজ। ওকে পুলিশের কাছে দিন আপনার কিছু হয়ে যাবে।
-রিল্যাক্স নুপুর। আমার কিছু হবে না। আমি তো শুধু শাস্তি দিব ওকে।
অর্ণব কোন কথাই শোনেনি তবে খুনখারাবির নামে রামদা’টাও কাজে লাগায়নি৷ সে করেছে অন্যকিছুৃ। আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল মিনারকে কেটে টুকরো করবে নুপুরের সামনে। তা আর শেষ পর্যন্ত করে উঠেনি। আগে থেকেই বাগানে মাটি খুঁড়ে রেখেছিলো একপাশে। হাত পা বাঁধা মিনারকে সেখনেই জীবন্ত মাটিচাপা দিলো। নুপুর অবাক হয়ে পুরোটা সময় শুধু অর্ণবকে দেখে গেল। এ মানুষটা কি আদৌও সুস্থ মস্তিষ্কে আছে! সুস্থ কোন মানুষ কি পারে অন্য একজন মানুষকে জ্যান্ত পুতে ফেলতে! হোক সে অপরাধী তার অপরাধে শাস্তি দিতে আইন আদালত আছে ওপারে আল্লাহর কাঠগড়া আছে তবুও সে কেন নিজ হাতে তুলে নিলো আইন! অর্ণব যখন মিনারকে পুরোদমে মাটির নিচে দাবিয়ে দিলো তখন রাতের প্রহর শেষ হয়েছে। চারপাশ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসছে। সদ্য চাপা দেয়া মাটির ওপর পাশেই অনেকদিন আগের কেটে রাখা গাছের শুকনো ডাল পাতা ছড়িয়ে দিল দ্রুততার সাথে। নুপুর দাঁড়িয়ে আছে শক্ত হয়ে। সে যেন আর নিজের ভেতরে নেই৷ অর্ণব তড়িঘড়ি বাড়ির ভেতর ঢুকে দু মিনিটের মাঝেই মূল দরজায় তালা লাগিয়ে ফিরে এলো একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে। কি আছে ও ব্যাগে নুপুর জানে না। অল্প সময়ের মাঝেই অর্ণব তার হাত টেনে ছুটে চলল বাড়ির পেছনের ছোট্ট পুরনো পকেট গেইট দিয়ে।
_____
মাস তিনেক পর, সাখাওয়াত চৌধুরীর ছেলের কঙ্কাল খুঁজে পেলেন অর্ণব চৌধুরীর বাগানে মাটি খুঁড়ে। লাগাতার তিনটি মাস ছেলের খোঁজে পুলিশ, ডিবি পুলিশকে জ্বালিয়ে গেছেন৷ তিনটি মাস ধরেই নিখোঁজ অর্ণব চৌধুরী আর তার স্ত্রী নুপুর। সবরকম তদন্ত চালিয়েও খুঁজে পায়নি তারা অর্ণব চৌধুরীকে। আত্মীয়স্বজন এমনকি তার একমাত্র বোনের মাধ্যমেও তার খোঁজ মেলেনি। তিনটি মানুষ একেবারেই হাওয়া হয়ে গেল! সাখাওয়াত চৌধুরী কিছুতেই থেমে নেই অর্ণবের বাড়িটিতে বহুবার তল্লাশি চালিয়েছেন। এবারও তাই করিয়েছেন তবে এবার বাদ পড়েনি বাড়ির একটি কোণাও। মাটি, পুকুরের পানি সবই তল্লাশি করিয়ে বাগান থেকে উদ্ধার করতে পেরেছে কঙ্কালটা। কিন্তু অপরাধী অর্ণব কোথায়!
_______
কুয়াশা মাখা ভোর; শীতের সকালে ধানের কচি চারাগুলোতে শিশির জমে আছে হীরের মত। মতিন বড্ড আনন্দে তাকিয়ে আছে সেদিকে। পরনে তার ফুলহাতা একটা উলের সুয়েটার আর লুঙ্গি অথচ পা দুটি নগ্ন। এই শীতের ভেজা কাদা মাটি পায়ে লাগিয়ে সে হেঁটে হেঁটে দেখছে তার সবুজ কচি ধানের চারাগুলো। বড় ক্ষেতটা পুরোপুরি প্রস্তুত চারা লাগানোর জন্য, অপেক্ষা ছিল শুধুই এই চারাগুলোর বড় হওয়ার। এখন দেখে মনে হচ্ছে আজই কাজটা করা যায় কিন্তু তার আগে এগুলোকে তুলতে হবে। ভোর বেলাতেই সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ছিল ক্ষেত দেখতে। ধান ফেলার পর থেকে তার প্রত্যেক ভোরে এইতো কাজ এরপরই সে বাড়ি ফিরে নাশতা করে। কিছুটা বেলা করে বের হয় বাজারে তার ছোট্টো দোকানটা খুলতে। পাহাড় ঘেঁষা এই ছোট গ্রামটিতে মতিনের দোকান তিনটি মাসেই খুব পরিচিত। ক্ষেতের আইলে দাঁড়িয়ে আশপাশের প্রত্যেকটি ক্ষেত দেখছে মতিন। সরিষা আর ধানের ক্ষেতে চমৎকার লাগছে হলদে সবুজের নকশিকাঁথা। গ্রামের সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেড়ে যায় এই ফসলের রঙে। হঠাৎ চোখে পড়লো পাশের বাড়ির বাচ্চা ছেলেটা আসছে এদিকটাতেই।
-এ্যাই ঔরব শোন তো এদিকে।
-কি কাকাবাবু?
-তোর শ্যামা কাকিকে বলতো গিয়ে আমি ডাকছি তাকে৷
-আচ্ছা।
আট বছর বয়সী ঔরব যেমনটা এসেছিল তেমনটাই আবার ছুটে গেল বাড়ির দিকে। মতিনের কথামত কাকিকে ডেকে নয় শুধু একপ্রকার টেনে হিঁচড়ে সঙ্গে করে নিয়ে এলো শ্যামাকে। মতিন তাকিয়ে থাকে তার বউটির দিকে। আজ সকালে কি তাকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে? কেন রাতেও তো সবসময়কার মত ছিল এখন কেন এত মিষ্টি লাগছে! খুব মনোযোগে দেখতে দেখতে খেয়াল হলো এই মুহূর্তে তার মিষ্টি বউটি লাজুক লাজুক হাসছে। এই লাজুক হাসির কারণ কি!
ঔরব শ্যামা কাকিকে মতিন কাকার সামনে আইলে দাঁড় করিয়ে আবার ছুটে চলল নিজ গন্তব্যে। সে তো বেরিয়েছে তার ও পাড়ার বন্ধুর সাথে বরই পাড়বে বলে। ঔরব চলে যেতেই মতিন বলল,
– ধানের চারা দেখো কেমন বড় হয়েছে।
-হু
ক্ষীণ স্বরে জবাব দেয় শ্যামা।
-আজকে, কালকের মধ্যেই লাগিয়ে ফেলতে হবে চারাগুলো।
– নাশতা করবেন না, বাড়ি চলেন।
-করব, তুমি এখানটায় এসো
মতিন বসে থাকা কাঁদা মাটিতেই হাত টেনে বসিয়ে দেয় তার শ্যামাস্নিগ্ধা বউটিকে৷ ভোরের কুয়াশামাখা শীতল হাওয়া, বরফ ঠান্ডা কাঁদায় গা কেঁপে উঠে শ্যামার। মতিন হাসতে হাসতে বলতে থকে,
-এবার বলো তুমি সকাল সকাল এত সেজেছো কেন?
শ্যামা তাকায় না বরের মুখে। লজ্জায় রাঙা মুখটি নামিয়ে সে উঠতে চায় কাঁদা থেকে। তার হাতটি ধরে আটকে দেয় মতিন।
-আমার বড্ড আনন্দ হচ্ছে সোনাবউ। আমার নিজের করা ফসল হবে দু দিন পরে।নিজ পরিশ্রমে অন্ন জুটবে আমার। এ হাতে তৈরি সব কাজের ফসল।
শ্যামা চোখে চোখ রাখে তার অর্ধাঙ্গের। ঘন গলায় বলে দেয়, “যদি শোনেন আপনার সন্তানের আগমনবার্তা তবে কি এ আনন্দ দ্বিগুণ হবে!”
থমকে দাঁড়ালো মতিন। চমকে তাকায় স্ত্রীর পানে। শ্যামলা মুখে লাজুক হাসি, টানা দুটো চোখে গাঢ় করে কাজলটানা পরনে কচি ধানের চারার রঙের আটপৌরে শাড়িকোথাও যেন কমতি নেই। মতিনের হৃৎপিন্ড বিকল হলো কি একটুর জন্য!
-কি বললে তুমি?
– শুনতে পাননি?
চোখ ফিরিয়ে নেয় শ্যামা। লজ্জায় তার গা শিরশির করছে।
-এ্যাই বউ আবার বলো কি বললে তুমি? আমার সন্তান আসবে! সত্যি বলছো?
ব্যাকুল শোনায় মতিনের কণ্ঠস্বর। সে কাদা মাখা দু হাতের আজলায় মুখটি ধরে শ্যামার। কোনদিক না তাকিয়েই চুমু বসিয়ে দেয় শ্যামার ঠোঁটে।
-কেউ দেখবে।
-দেখলে দেখুক।
– বাড়ি চলুন
-ভালোবাসি আমার শ্যামাঙ্গিনী।
-আমিও ভালোবাসি আমার জল্লাদমুখো।
-গোঁফ এখন নেই।
-তবুও আপনি আমার জল্লাদমুখো।
পুনশ্চঃ অর্নব নুপুর মাস তিনেক আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বসতি গেঁড়েছে পাহাড় ঘেঁষা এক ছোট্ট গ্রামে। পরিকল্পনা তো অনেক আগেই করেছিল অর্ণব একদিন হারিয়ে যাবে হয় তার শ্যামাঙ্গিনীকে নিয়ে নয় সে একাই। ভাগ্য বুঝি সদয় ছিল তার প্রতি তাইতো সেদিন নুপুরকে নিয়ে পালিয়ে এসেছে শহর ছেড়ে। এখানটায় তার আছে ছোট্ট একটি টিনের চালার মাটির ঘর, ছোট্ট একটি আঙিনা, রসুইঘরের চালায় লতানো লাউ ডগা , আর মাচায় বেয়ে উঠা শিমের লতা। এক টুকরো ধানি জমি আর ছোট্ট একটি দোকান। সবমিলিয়ে তার সাজানো এক রঙিন সংসার। প্রজাপতির ডানায় ভর করা হাজারটা স্বপ্ন। তবুও সুখের দিনের দুঃখ হয়ে প্রায়ই তাকে আঁকড়ে ধরে ভয়ংকর স্বপ্ন৷ সে বুঝতে পারে তার করা পাপ তাকে এই টানাপোড়েনের স্বপ্ন দেখায়। কথায় আছে পাপ ছাড়ে না বাপকেও। মাস তিনেক আগে করা সেই পাপ বোধহয় তাকেও ছাড়ছে না এই রঙিন সংসারে। সত্য হয়েছে তার কোথাও হারিয়ে যাবার ইচ্ছে যুক্ত হয়েছে পাপের ভয়।
চায়ের পাতিলে টবগব করে ফুটছে পানি সেই সাথে ফুটছে মনটাও। এইতো ক’দিন আগেও সে চায়ের জন্য রান্নাঘরে ঢুকলে ছোট মা কত কটুকথাই না শোনাতো! তার গায়ের রঙ কালো আবার চা খেয়ে নাকি পাতিলের তলা হয়ে যাচ্ছে। কোন ছেলে ফিরেও তাকাবে না তার দিকে। আর সে মেয়ে আজ এত বড় এক বাড়ির মালকিন তাও কিনা যে মেয়ে তিনজন ছেলে দ্বারা ধর্ষিত। এত মূল্যবান এই কালো বর্ণের মেয়েটি এ জগতে! আর যে তাকে মূল্যবান করে তুলতে চাইছে সেই মানুষটাই কেমন? মনে পড়ে দিন চারেক আগের রাতের কথা। মৃত্যুশয্যায়ই পড়ে ছিল দাদী তার কথা রাখতেই নুপুর সায় দিলো সে চলে আসবে এ বাড়িতে। পরেরদিন সত্যিই চলো এলো। কেন এলো! ওই ব্যক্তিত্বহীন পুরুষটার একলা জীবনে আজীবনের সঙ্গী হতে। এবার মনে পড়লো ওই পুরুষটার ঘরের প্রথম রাত। হাতের তালুতে একটা হীরের আংটি মেলে ধরে কি বলেছিলো যেন লোকটা?
” আমার শূন্য কুটিরে স্বাগতম আমার জীবনের শ্যামাঙ্গিনীকে। আমার নিঃসঙ্গ জীবনটাতে জড়ানোর জন্য লাখো শুকরিয়া। অসহায় আমার আমিকে বৈধ এক সম্পর্কের একটি সুযোগ দেয়ার জন্য তোমার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। ভালোবেসে প্রত্যেকটা মুহূর্ত তোমাকে আগলে রাখব। ভরসা রেখো আমি কখনো তোমায় একলা করব না আর কোনদিন।”
-সত্যিই!
হুট করেই তিরস্কারের সুরে বলে ওঠে নুপুর। “সত্যিই কৃতজ্ঞ! এত কৃতজ্ঞতা ঠিক সেদিন কোথায় ছিল যেদিন যেচে আমি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করেছিলাম আর আপনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন? সেদিন কোথায় ছিলো এই আগলে রাখা যখন আমায় ফেলে বৃষ্টিকে বিয়ে করতে চলে গেলেন! কোথায় ছিল এই ভালোবাসা যেদিন আমার বাবা ফিরিয়ে দিল বলেই ফিরে এলেন? সেদিন মনে হয়নি যে মেয়েটা বেহায়ার মত আপনাকে ভালোবেসে আপন করার দাবী জানাতো সেই মেয়েটা অন্যের বাগদত্তা কেমন করে হয়ে গেল জেনে নেই সে খবরটা? সেদিন মনে হয়নি আরেকটু ধৈর্য্য রেখে নিজের করে নেয়া হোক মেয়েটিকে? ঠিক তো সেদিন দুলহা সেজে চলে গিয়েছিলেন অন্যকারো আঙিনায়। আজ সেই আঙিনা শূন্য করে আমায় ভালোবাসা বোঝাচ্ছেন? আমাকে কৃতজ্ঞতা দেখাচ্ছেন! অথচ আপনার মিথ্যে ইগোর স্বীকার হয়ে আপনার ভুলের মাশুল দিতে অন্যকারো জীবনে একাকীত্ব নেমে এসেছে টের পান না!”
থেমে গেল নুপুর। দূর্বল, অসুস্থ শরীরে ক্রোধের প্রতাপ অসহনীয় ঠেকছে এবার। চেঁচিয়ে বলা কথাগুলো দরজার ওপারে না পৌঁছুলেও এপারে বিধ্বস্ত করে দিলো অর্ণবকে, হাঁপিয়ে দিলো খোদ নুপুরকেও। তবুও ফুরায়নি এ গঞ্জনা এখনো যে অনেকটা বাকি তাই বোধহয় এবার পিঠের পেছনে বালিশ রেখে হেলান দিলো নুপুর খাটের মাথায়। অর্ণব তখনোও ঠায় দাঁড়িয়ে খাটের পাশে নুপুরের কাছাকাছি। আংটি রাখা হাতের তালুটা ততক্ষণে গুটিয়ে নিয়েছে সে। নুপুর কিছুটা সময় নিয়ে আবারও মুখ খুলল, ” আপনার আপন বোনটিকে আপনি নিজের অহংয়ের খেলায় মেতে শ্বশুরঘর ছাড়া করলেন, রিদওয়ান ভাইকে করলেন পরিবারছাড়া। আমি না হয় মা’হীন সৎমায়ের সংসারে বড় হতে গিয়ে জগতের হাজারটা নিয়ম শিখে বেঁচে আছি অথচ বৃষ্টি আপুর মত নিরেট আহ্লাদে বড় হওয়া মেয়েটার জীবনে দাগ বসিয়ে দিলেন। কেন দিলেন? জেদ হয়েছিল আপনার, নুপুরের বাবা ফিরিয়ে দিয়েছে বলে আপনিও দেখিয়ে দিবেন বিয়ে করা আপনার জন্য চুটকির ব্যাপার। আবার সেই আপনিই বিয়ের আসরে হবু বউকে ফেলে চলে গেলেন ধর্ষিতা মেয়েকে উদ্ধার করতে। সমাজের চোখে আঁচড় কাঁটা মেয়েটাকে রঙিন কাগজে মুড়িয়ে তার দাগ ঢাকতে হাজির হলেন কাজীসমেত৷ বাহ্ কি দয়ার শরীর আপনার। আমায় উদ্ধার করে এই প্রাসাদে এনে মুখোশে ঢেকে দিলেন। এখন কেউ আমায় ধর্ষিতা ভাববে না। বলবে না আমি এ জগতে উচ্ছিষ্ট হয়ে গেছি ঠিক তেমন করেই সাজিয়ে রাখবেন অধিকার পেয়ে।”
আবারও থেমে গেল নুপুর। কথা শেষ হয়নি অথচ শরীরটা ক্লান্ত হয়ে গেছে। দু চোখের পাতা বুঁজে আসতে চাইছে কিন্তু আরও যে অনেকটা বলার ছিল! নাহ, এবার আর তার সুযোগ নেই কিছু বলার মত। অর্ণব দিলো না বলতে সে স্বভাবসুলভ গম্ভীর গলায় বলে দিলো, “কথা শেষ হয়েছে?”
-কেন আর শুনতে চাচ্ছেন না?
-রাত বাড়ছে।
-ওহহো ভুলেই গেছি রাত বাড়ছে আর এটাই তো উত্তম সময় শরীর পাওয়ার! শরীর জাগছে তো আসুন বিছানায় আসুন৷ বাতি নেভাবেন না না থাক আপনার অসুবিধা হলে এভাবেই না হয় শুরু করুন….
-নুপুর! চুপ একদম চুপ। আমার ধৈর্য্যশক্তি অনেক তার মানে এই না সেটা কখনোই ফুরাবে না।
প্রচণ্ড আক্রোশে বেড সাইড টেবিলে থাকা ল্যাম্পটাতে ঘুষি মেরে বসল অর্ণব। নুপুর তাতে দমে গেল না বরং সে আবারও কটাক্ষ করল,
– ফুরিয়ে গেলে কি হবে?
অর্ণব এবার মুখ খুলল না শুধুই ধূর্ত চোখ দুটো মেলে তাকালো নুপুরের দিকে। সেই সময় চোখদুটো কি পরিমাণ হিংস্র ছিল তা জানে না নুপুর। তার শুধু মনে পড়ে সে সময় ওই চোখ দুটো তার বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটাকে রক্তশূণ্য করে দিয়েছিলো ক্ষণিকের জন্য আর হাত পা কেমন বরফ হয়ে গেল। অর্ণব মিনিট কয়েক নীরব থেকে একটা বক্স আর এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো নুপুরকে।
-চুপচাপ ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো আর একটি শব্দও যেন না শুনতে পাই।
কথা শেষ করে অর্ণব ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ভোর রাত অব্দি বাড়িটা শুনশানই ছিল। চুপচাপ শুয়ে থেকে এক সময় চোখ লেগে গেলে সে আর জানে না ঘরের মানুুষটা কোথায় আছে। তার ঘুম ভাঙে ভোর রাতে রুজিনা খালার আহাজারিতে৷ প্রথমে কান্নার আওয়াজটা ভ্রম বলে ভুল হলেও পরক্ষণেই মস্তিষ্ক সজাগ হলো৷ কান্নাটা নিচ থেকে আসছে বুঝতে পেরেই নুপুর হন্তদন্ত হয়ে বিছানা ছাড়লো। চোখ জুড়ে ঘুম, রেশ কাটেনি এখনো। দূর্বল পায়ে ছুটে গেল সিঁড়ি বেয়ে। সিঁড়ি থেকে নিচ তলার প্রতিটি কোণায় কোণায় বাতি জ্বলছে। হল ঘরটায় সোফার আশেপাশে পায়চারী করতে করতে অর্ণব কাউকে অনবরত কল করে যাচ্ছে। খুব সম্ভব ওপাশ থেকে কেউ তুলছে না ফোনটা। দাদীর ঘর থেকে কান্নার আওয়াজটা আসছে তা বুঝতে মাত্র সেকেন্ড কয়েক সময় লাগল। এবার একরকম দৌঁড়েই ঢুকলো সে ঘরে। যে মানুষটার ইচ্ছে পূরণে সে এ বাড়িতে পা রেখেছে সে মানুষটা পা থেকে মাথা পর্যন্ত আপদমস্তক সাদা একটি চাদরে ঢাকা। নুপুর বাকরুদ্ধ, নিঃসাড় হয়ে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ চাদরে মোড়া দেহটার দিকে। কত বড় একটা বাড়ি অথচ এই বাড়িটাতে উপস্থিত মাত্র পাঁচজন যার মধ্যে একজনের শরীরটা পড়ে আছে আত্মাশূন্য। অর্ণব অনেকবার কল করার পর ফোনটা তুলেছে খালুজানের ডাক্তার বন্ধু। খালুজানের সুবাদেই ঘনিষ্ঠতা উনার সাথে। দাদী প্রাণহীন তা মানতে নারাজ অর্ণব ডাক্তার আঙ্কেল দ্রুত তার বাড়িতে আসতে বলায় ডাক্তার সাহেব ভড়কেছেন খুব। সময়টা তখন ফজরের পূর্বমুহূর্ত। আঙ্কেল কিছুটা দোনোমোনা করেও চলে এলেন অর্ণবদের বাড়িতে। দাদীকে এসেই চাদর মোড়া দেখে বুঝলেন মানুষটা আর নেই। অর্ণব মানতে চাইছে না সে কথা। রুজিনা খালা মুখ ঢাকলেও অর্ণব তা সরিয়ে রাখতে চাইছে বারংবার। নুপুর হতবাক হয়ে চেয়ে দেখে গম্ভীর মানুষটাকে ঠিক যেন ছোট বাচ্চা যে কিনা মাকে খুঁজে না পেয়ে কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে উঠছে। ফজরের আজান হতেই দারোয়ান খবর দেয় বড় দাদার বাড়িতে এবং তিনি নিজেই খবর দেন রিদওয়ানদের বাড়িতে। ডাক্তার সাহেব নিজেও জানান বাশার শেখকে। মাত্রই দিন কয়েক আগে নিজের মেয়ের হতে হতে না হওয়া বাড়ির কারো সাথেই তিনি হৃদ্যতা দেখাতে প্রস্তুত নন৷ নিজে তাই এদিকে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন না তবে মনুষত্ব্য বোধহয় একটুখানি জেগেছিলো তাই রিমনকে বললেন, এয়ারে চট্টগ্রাম যাও এবং যতদ্রুত সম্ভব অর্নিকে নিয়ে আসো। রিমন নিয়ে আসে অর্নিকে, সংবাদ জানায় রিদওয়ানকেও। সুদূর প্রবাসী ছেলেটা ছটফট করে অর্নিতার মানসিক হাল ভেবে ভেবে। চাইলেও তখন সম্ভব নয় তার পক্ষে ছুটে আসা, সম্ভব নয় অর্নির মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে সান্ত্বনা দেয়া। অর্ণবের প্রতি যা আংশিক ক্ষোভ ছিলো সেটাও এ মুহূর্তে তার দুঃখ ভেবে দূর করে দেয়। অর্নির তো কাছের মানুষ বলতে শুধু দাদী নয় রিদওয়ানের পরিবারই ছিলো কিন্তু অর্ণব! ছেলেটা যে এবার অতল শূন্যতায় ডুবে গেল। দাদীর হাতে মানুষ হওয়া ছেলেটা এতদিনে হলো সত্যিকারের এতিম। রিদওয়ান রিমনকে সারাটাদিন কলের ওপরই রাখলো। আর অর্ণব….. সে খুব একটা কাঁদেনি। শুধু থেমে থেমে দাদীর লাশের পাশে বসে একটি কথাই আওড়ে গেছে, “আমাকে এতিম না করলে চলছিলো না তোমার?”
বাদ আসর জানাজা আর দাফন সম্পন্ন হলে বড় দাদা আর সাখাওয়াত ভাই মিলে কবরস্থান থেকে অর্ণবকে নিয়ে ফিরলো বাড়িতে। সারাদিনে কেউ একটি দানাও দাঁতে কাটেনি তাই সাখাওয়াতের বউ নিজেই কাজের লোকদের মাধ্যমে হালকা খাবারের ব্যবস্থা করলো। নুপুর পুরোটা সময় বসে ছিলো অর্নির পাশে। মেয়েটা কান্নাকাটি করে একেবারে ভেঙে পড়েছে। রায়না বেগম আর বৃষ্টিও খেয়াল রাখছে অর্নিতার। সন্ধ্যের পর মাগরিবের নামাজ শেষে অর্ণব বসেছিলো বসার ঘরের মেঝেতে। তার আশপাশ জুড়েই বসা ছিল বড় দাদার নাতী আর অন্যান্য পুরুষ আত্মীয়রাও। সাখাওয়াত ভাই চলে গেছেন একটু আগেই কিন্তু ভাবীরা ছিল দোতলায়। বড় ভাবী হঠাৎ মনে পড়লো এমন করেই নুপুরকে বললেন, অর্ণব তো মুখে কিচ্ছুটি দেয়নি। তুমি এক কাজ করো ওকে ডেকে ঘরে নিয়ে আসো আমি দুটো রসগোল্লা আর বাখরখানি নিয়ে আসছি।
নুপুর দ্বিধাগ্রস্ত; বসারঘর লোকপূর্ণ সে কি বলে ডাকবে অর্ণবকে! এদিকে ভাবীও চলে গেছেন নিচেই মিষ্টি বাখরখানি আনতে। অসীম জড়তা নিয়েই সে চলে গেল নিচে। ধীরপায়ে গিয়ে থামলো ঠিক অর্ণবের পিঠ ঘেঁষে বড়দাদার কাছাকাছি। কোন দিক না তাকিয়েই সে ডাকলো, একটু উপরে আসবেন ভাবী ডাকছে।
নুপুরের ক্ষীণ আওয়াজে বলা কথাটা স্পষ্ট শুনতে পায় অর্ণব। তৎক্ষনাৎ ফিরে তাকায় নুপুরের দৃষ্টি অনুসরণ করে তার সেকেন্ড কয়েক বাদই ধপাস করে পড়ার শব্দ হয়। নুপুর জ্ঞান হারিয়েছে কিন্তু কেন! কি দেখলো সে ওখানটাতে? দরজায় কি দেখেছে সে, মিনার ছিল না সেখানে?
চলবে
#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৩৭(শেষাংশ)
নুপুর কেন জ্ঞান হারালো তার সঠিক কারণ উদঘাটন করতে পারছিলো না কেউ। মোটামুটি সহজ ধারণা ছিল, মেয়েটা অতিরিক্ত দূর্বল তাই জ্ঞান হারিয়েছে। শুধুমাত্র অর্ণবের মন মানলো না সে কথা। নুপুর ভয় পেয়ে সেন্স হারিয়েছে এটুকু সে বুঝতে পেরেছে। জ্ঞান ফেরার পরও এ নিয়ে কিছু জানতে চায়নি অর্ণব। দু দিন পরই বাড়িতে লোকের আনাগোনা কমে গেল। সারাদিন অর্ণব বাইরে বাইরেই থাকে বাড়িতে থাকে নুপুর, অর্নি। রুজিনা খালা নিজেও শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি বলেই হাত পা গুটিয়ে পড়ে থাকে এক কোণে। জীবনের অর্ধেকটাই তো তিনি ছিলেন দাদীর পাশে এমতাবস্থায় তার মনে কষ্টও বেশি। তবুও জীবন তো থেমে থাকার নয়। আজ দাদী নেই চারদিন হয়ে গেল। কাল ভোরে অর্নি চলে যাবে হলে। তারপর থেকে এই মহল সমান বাড়িটাতে নুপুরকে থাকতে হবে একা। চা ফুটে ছলকে পড়তেই নুপুর বেরিয়ে এলো ভাবনা থেকে। তিনটি কাপে চা ঢেলে সে চলে গেল দোতলায় অর্নির ঘরে। আধশোয়া হয়ে ফোনে কথা বলছে অর্নি। ফোনের ওপাশে রিদওয়ান আছে। খুব সম্ভবত তাকে বোঝাচ্ছে শক্ত হতে। চট্টগ্রামে গেলে একা একা থাকবে পড়াশোনায় মন দিতে হবে নিজেকে সুস্থ থাকতে হবে। নুপুর পাশে বসতে বসতেই অর্নির কথা শেষ হয়েছে। সে এক কাপ চা এগিয়ে দিলো অর্নিকে ততক্ষণে রুজিনা খালাও চলে এসেছেন এ ঘরে। দ্বিতীয় কাপটা খালাকে ধরিয়ে দিয়ে নুপুর নিজের কাপে একটি চুমুক দিলো। অর্নি জিজ্ঞেস করলো, ভাইয়া কোথায়?
-জানি ন….
নুপুরের কথা শেষ হওয়ার আগেই দ্রুতপায়ে অর্ণব ঢুকলো ঘরে।
-তোর কি কিছু গোছানোর আছে?
প্রশ্নটা বোনের উদ্দেশ্যে করেই নুপুরের সামনে থেকে চায়ের কাপ তুলে চুমুক দিলো। রুজিনা খালা খেয়াল করেছেন বিষয়টা তিনি তাই বলতে যাচ্ছিলেন, ওইডা তো বউয়ের কাপ। তা আর বলা হলো না নুপুর হাত ধরে থামতে ইঙ্গিত দিলো। তিনজনের চা পান মুহূর্ত শেষ হওয়ার পর নুপুর বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।নিজের জন্য পুনরায় চা বানিয়ে খইয়ে নিলো। নিচ তলায় চা শেষ করে উপরে উঠতেই চোখে পড়লো, অর্নি পরনের জামা বদলে ফেলেছে।
-কোথাও যাচ্ছিস?
-চলে যাচ্ছি। রিমন ভাইয়া চট্টগ্রামের অফিসে বসবে কাল তাই এক্ষুনি যাবে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে সকালে ক্লাস ধরতে হবে।
-ওহ!
নিস্তেজ গলায় ‘ওহ’ বলে নুপুর আবারও নিচে নেমে এলো অর্নির সাথে। বাড়ির গেইটে দাঁড়িয়ে আছে রিমনের গাড়িটা নুপুর সে অব্ধি এলো। অর্নি এবার মুখোমুখি দাঁড়ালো নুপুরের। ভীষণ জরুরি গলায় বলল, “তোকে কিছু কথা বলা দরকার সময়ের অভাবে বলা হয়নি। আমি আজ চট্টগ্রামে চলে যাচ্ছি মাত্র কিছুদিনের জন্য এরপরই বাড়ি ফিরব হয়ত সপ্তাহ খানেকের সময় নিয়ে। আমার কাগজপত্র প্রায় সবই হয়ে গেছে দু দিন আগেই ইমেইল চেক করেছি। পর্তুগাল রিদওয়ানের কাছে যাওয়া সম্ভব নয় এখন সোজা ফিনল্যান্ড যেতে হবে। পড়াশোনা ওখানেই চলবে আর রিদওয়ান চেষ্টা করবে ওখানে মুভ করার। আমি নিঃসঙ্গ ছিলাম না কখনো। মা-বাবার জায়গায় খালা-খালু ছিল। ভাই বোনের জায়গায় বৃষ্টি আপু রিমন ভাইরা ছিলো স্কুল, কলেজে বান্ধবীও ছিলো কিন্তু আমার ভাইয়ের বরাবরই কেউ ছিল না। দাদীই একমাত্র কাছের মানুষ ছিলেন যিনি এখন আর নেই। তোর সাথে খুব একটা অন্যায় করেনি ভাইয়া যা করেছিল আঙ্কেল মানে তোর বাবার কথার দাম দিতেই করেছিল। আমাদের মা-বাবা নিয়ে তিনি কথা তুলেছিলেন, আমাদের বড় হওয়া, অর্থবিত্ত নিশেও অসামাঞ্জ্যসতা দেখিয়ে ভাইয়াকে সরতে বলেছিলেন বলেই পিছু হটেছিল সে। আর রইলো বৃষ্টি আপুকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত সেখানেও তার ভুল ছিলো নগন্য তবুও সে অপরাধী তোদের চোখে।
নুপুর চুপচাপ শুনতে শুনতেই খেয়াল করলো ড্রাইভারের পাশে বসা রিমনও সব কথা শুনছে অথচ সে প্রতিক্রিয়াহীন।
অর্নি তার দৃষ্টি খেয়াল করে বলল, তুই ছাড়া আমরা সবাই এসব ব্যাপারে জানি। নিজের ভাইকে একা ছেড়ে যেতে আমার কেমন লাগছে তা এ দুনিয়ার কাউকে আমি বলতে পারবো না বোঝাতে পারব নস। আমি যা পারব সেটা হলো তোর অজ্ঞাতে হওয়া ঘটনাগুলি তোকে জানিয়ে তোর মনের আঁধার সরানোর চেষ্টা। আমার অনুরোধ তোর কাছে দুনিয়ায় মানুষ কত কিছুতে দয়া দেখায় তুই একটু আমার ভাইকে দয়া দেখাস একটু তাকে আপন করিস আমি আজীবন তোর কাছে ঋণী থাকব।
কথাটুকু বলতে বলতেই গড়িয়ে পড়া অশ্রুটুকু মুছে নিয়েছে অর্নি। অর্ণবকে আসতে দেখে প্রসঙ্গ বদলে অল্প হেসে বলল, যাই আমি ভালো থাকিস তুই… তোরা।
-দাঁড়া অর্নি।
অর্ণব এগিয়ে এলো সামনে। হাতে তার ছোট্ট একটা ব্যাগ সেটা বোনের দিকে বাড়িয়ে ধরলো।
-এটা সাথে নিয়ে যা এখন খোলার দরকার নেই। কাল বিকেলে ফ্রী হয়ে খুলবি তারপর আমাকে কল দিবি।
________
অফিসের কিছু কাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিয়ে বসে আছে অর্ণব বসার ঘরে। অর্নি কখন পৌঁছাবে তা না জেনে সে হয়তো বিছানায় যাবে না। এমনিতেও গত কয়েক রাত তার কাটছে দু’এক ঘন্টা ঘুমিয়ে তাও সেটা গেস্টরুমে। নুপুর রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে রুজিনা খালার পাশে৷ তিনি কিছুটা ধোয়া-মোছার কাজ করছেন যেন সকালে উঠেই পরিচ্ছন্ন রান্নাঘরে রাঁধতে পারেন। নুপুর একবার দেখছে রুজিনা খালাকে তো একবার ঘাড় ফিরিয়ে অর্ণবকেও দেখছে। দুজনের কাজের মধ্যে একটা জিনিস খুব মিলে৷ তারা নিঃশব্দে, গুছিয়ে মনোযোগে করে প্রতিটা কাজ। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় রুজিনা খালাই বুঝি জল্লাদমুখোর অভিভাবক। দাদীকেও যথেষ্ট পরিপাটি দেখেছে সে তবে তিনি প্রাণোচ্ছলও ছিলেন৷ অর্নি চুলার কাছে গিয়ে কফি বানানোর প্রস্তুতি নিলো।
-কি করবা এখন?
-কফি বানাব খালা।
-এখন কফি খাইলে ঘুমাইবা কখন?
-আমি খাব না।
রুজিনা এবার বসার ঘরের দিকে তাকালো। অর্ণবের জন্য কফি বানাচ্ছে মেয়েটা! খুশি হলেন রুজিনা খালা যাক, এ বাড়িতে আসার পর এই প্রথম কিছু করছে ছেলেটার জন্য। তিনি কাজ শেষ করে বলে গেলেন, আমি ঘুমাইতে যাইতাছি তুমি ওরে কফি দিয়া ঘুমাইয়া পইড়ো। আর….
থেমে গেলেন রুজিনা খালা।
-আর!
-পারলে টুকটাক কথা কইয়ো অর্ণব বাবার লগে। অনেক কষ্ট অর মনে আগে খালাম্মার কাছে কইতো। এখন তো তুমি ছাড়া আর কেউ নাই।
ইতস্তত করেও মনের কথাটা মুখে বলেই ফেললেন রুজিনা খালা। তিনি দেখেছেন নুপুর একদিনও যেচে কথা বলেনি অর্ণবের সাথে। তাদের মধ্যে কি ছিল বা কিছু হয়েছে কিনা ঠিকঠাক জানেন না তিনি। আন্দাজ করতে পেরেছেন দুটিতে ভাব ভালোবাসা নেই বলে মনে হচ্ছে বলেই এখন এইটুকু বলে গেলেন। নুপুর কফি বানিয়ে নিয়ে গেল অর্ণবের কাছে৷ সোফা, টি টেবিল সবেতেই কাগজপত্রের ছড়াছাড়ি। ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে নুপুরকে একবার দেখে নিলো অর্ণব।
-কিছু বলবে?
নুপুর জবাব না দিয়ে কিছু কাগজ সরিয়ে কফির মগটা রেখে চলে যাচ্ছিলো। তার এই নিঃশব্দে চলে যাওয়া দেখে অর্ণব মগটা উঠিয়ে ছুঁড়ে মারলো ফ্লোরে। আওয়াজটা শুনতে পেয়েছেন রুজিনা খালা তবুও বের হননি ঘর থেকে। নুপুর ফিরে এসে টুকরো হওয়া মগটা তুলে নিয়ে আবারও ঢুকলো রান্নাঘরে৷ নতুন করে কফি বানিয়ে আবারও গেল অর্ণবের সামনে।
-রাত জাগবেন তো! কফিটা খেয়ে নিন ভালো লাগবে।
এবার অর্ণব হাত থেকেই নিলো মগটা। চুপচাপ তাতে চুমুক লাগিয়ে কাজে মন দিলো। নুপুর চলে গেল দোতলায়। রাত তখন তিনটা কি সাড়ে তিনটা৷ অর্ণব অন্ধকার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। আন্দাজ করেই উঠে বসলো বিছানায় নুপুরের বিপরীত পাশে। হাতের ফোন আর ওয়ালেটটা বালিশের পাশে রেখেই ঝুঁকে এলো নুপুরের মুখের ওপর। বড্ড হালকা করে চুমু খেলো নুপুরের কপালে। ঘুমন্ত মেয়েটা একটুখানি নড়েচড়ে উঠলো বোধহয় ভেজা চুমুর পরশে। অর্ণব আবারও চুমু খেল এবার নুপুরের ঠোঁটে। মাত্র সেকেন্ড কয়েকের চুমুটাতে গাঢ় ঘুমটাও নিরবে টুটে গেল। নুপুর এবার আর নড়চড় করলো না ভেবেছিলো লোকটা হয়তো আরও কয়েকটা দেবে। তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে অর্ণব শুয়ে পড়লো চুপচাপ। সকালে ঘুমটা ভাঙলো অর্ণবের ফোনের কর্কশ আওয়াজে৷৷ অর্ণব ঘরেই নেই ফোন বেজে চলছে অনবরত। নুপুর চেক করলো কে কল দিচ্ছে। ‘শরাফত’ নামটা দেখে বুঝতে পারলো থানা থেকে কল। মনে ভয় জাগলো আবার কেন কল করছে পুলিশ! কলটা বেজে কেটে গেলেও নুপুর সেটা রিসিভ করলো না।
_________
“রাতে কখন পৌঁছেছিস তোরা?” রিদওয়ান জানতে চাইলো।
– পৌনে তিনটায় এসেছি তোমাদের ওই বাড়িটায়। সকালে রিমন ভাই ভার্সিটিতে দিয়ে গেল। ক্লাস শেষে এখন হলে এসে ঢুকলাম সবে। তুমি কি করছো?
-নাশতা রেডি করছি।
-এখনই!
-আজ ছুটির দিন তাই এক জায়গায় যাব বলে ভোরেই উঠেছি।
-ঘুরতে যাবে?
-না, একজন পরিচিত লোক আজ দেশে চলে যাচ্ছে। তার কাছে কিছু জিনিস দিব তোর আর বৃষ্টির জন্য।
সহজ স্বাভাবিক উত্তর রিদওয়ানের। অর্নি এবার ঝটপট জবাব দিলো, আমার কিছু লাগবে না। কিছু পাঠাতে হবে না এখন।
-বিয়ের পর তোর ন্যাচারাল স্বভাবটা নষ্ট হয়ে গেছে অর্নি। আমি যে অর্নিকে দেখতাম ভালোবাসতাম সেই মেয়েটা চঞ্চলভাবে জবাব দিতে পারতো না। সেই মেয়েটা আস্তে আস্তে রয়েসয়ে কথা বলতো। দশটা কথার জবাব সে এক বাক্যেই শেষ করতো আর তুই বড্ড বেশি কথা বলিস।
-এখন কি তাহলে আর ভালোবাসো না?
-বাসি। কিন্তু আমি আমার আগের অর্নিকে চাই। তোর এমন স্বকীয়তা হারানো আমায় কষ্ট দেয়। কে কবে বলেছিলো কথা কম বললে বর পালাবে সে কথা ধরে তুই এমন বদলে যাচ্ছিস তা কষ্ট দেয় আমাকে। আমি কোথাও পালাব না। তোর জন্যই তো সন্ন্যাস হতে বসেছিলাম সেই তোকে ছেড়ে যাব ভাবিস কেমন করে!
অর্নি আর কথা বাড়ায় না। আসলেই সে অন্যের কথাকে প্রায়োরিটি দিয়ে নিজেকে বদলাতে চেষ্টা করছিল অনেকদিন ধরে। এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছে। অর্নির মৌনতা কাটাতে রিদওয়ান হেসে উঠলো।
-আমি তোকে অন্নেক ভালোবাসি বউ মন খারাপ করতে হবে না। তুই যেমন ছিলি তেমন থাক আমার জন্য নিজেকে বদলানোর দরকার নেই৷ তোর আগে আমি তোকে ভালোবেসেছি তোর সকল স্বভাব জেনেই।
_______
অর্ণবকে থানায় ডাকা হয়েছে আজ। সে ভেবেছিল তৃতীয় আসামীর খোঁজ মিলেছে। থানায় যাওয়ার পর ঘটনা বের হলো অন্যকিছু। গত বছর থেকে ছোট দাদার যে সম্পাত অরিজিনাল দলিলপত্র নিখোঁজ ছিল তা নিয়েই সামনে এলো গোপন রহস্য। ছোট দাদার দলিলপত্রে একমাত্র উত্তরাধিকার হিসেবে আছে অর্ণবের নাম যা নতুন করে লেখা হয়েছে সাখাওয়াত চৌধুরীর নামে। জাল সেই দলিলে মূল বক্তব্য ছিলো, আমি সজ্ঞানে সকল সম্পত্তি সাখাওয়াত চৌধুরীকে দান করছি। দাদার করা উইলের সময়সূচি ছিল বছর পনেরো আগের আর নতুন উইল হয়েছে দিন দশেক আগে। নতুন উইলে অর্ণবের স্বাক্ষরের জায়গাটা ফাঁকা। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে আসল সাপটাই যে বেরিয়ে আসবে তা অর্ণব আগে থেকেই জানতো নুপুরের সাথে হওয়া ঘটনার পর থেকে। নুপুরকে তুলে নেয়ার যে বর্ণনা সে জেনেছে তাতে স্পষ্ট ছিলো তারা নুপুর নয় অর্নিকে তুলে নিতে চেয়েছিল। তাকে এবং নুপুরকে যারা ফলো করতো তারা একজনেরই লোক। পুলিশের সাথে কথা বলে অর্ণব মামলা করে গেছে সাখাওয়াতের নামে।
____
দিন এগুচ্ছে বাড়িতে পরিবর্তন এসেছে দিনের সাথে পাল্লা দিয়েই৷ দাদীর মৃত্যুর চল্লিশ দিন আজ তাই অর্ণব এবারও মসজিদ মাদ্রাসায় মিলাদ রাখলো। অনেকেই বলেছিলো বাড়িতে আয়োজন করো। সে শোনেনি সে কথা। যেখানে আত্মীয় নামের অনাত্মীয়ে ভরপুর জীবনে সেখানে বাড়িতে খাইয়ে দোয়া পাওয়া মুশকিল ব্যাপার। অর্নিও পড়াশোনার পাশাপাশি দেশ ত্যাগের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। এরই মাঝে সে ভিসা সংক্রান্ত কাজে ইন্ডিয়া থেকেও ঘুরে এসেছে। এই প্রথম অর্নি অনেক বড় একটা কাজ করেছিলো একদম একা। এমব্যাসির লোকেরাই সব বুঝিয়ে করিয়ে নিয়েছে তবুও হোটেল থেকে ঘোরাঘুরিটুকু নিজে নিজেই করেছে নির্ভয়ে। রিদওয়ান অবশ্য দূর থেকেই প্রতিমুহূর্তে ডিরেকশন দিয়ে গেছে। অর্নির হাতে আছে আর সপ্তাহ খানেক সময়৷ খালামনি অর্ণবকে মাফ না করলেও অর্নির সাথে স্বাভাবিক হয়ে গেছেন। রিদওয়ান যেদিন দেশ ছাড়ছিলো সেদিন শেষ মুহূর্তে এসে প্রচণ্ড রকম কথার আঘাত দিয়েছিলেন রায়না ছেলেকে। রিদওয়ান আজো জানে না সেদিনের সেই কথাগুলো উচ্চারিত আম্মুর মুখ থেকে হলেও প্রতিটা শব্দ ছিলো আব্বুর বলা। রায়না লুকিয়েছিলেন সেসব কথা কিন্তু অর্নি জেনেছে রিমনের কাছে। অর্নি তাই আশ্বাস দিলো খালামনিকে খুব শিগ্রই রিদওয়ান আবার কথা বলবে তার আম্মুর সাথে। তার সব ভুল ভাঙ্গিয়ে আবারও দেশে নিয়ে আসবে।
একটা সপ্তাহ হাতে আছে বলে অর্নি চলে এসেছে বাড়িতে। নুপুরকে সঙ্গে নিয়ে কিছু কেনাকাটা করলো। চলে যাবার একদিন আগে অর্নি এলো ভাইয়ের ঘরে।
-ভাইয়া ফ্রী আছো?
-আয়।
অর্ণব বসে ফোন স্ক্রল করছিল তখন। নুপুর ঘরে নেই হয়তো নিচে কিছু করছে। অর্নির হাতে একটা ব্যাগ সেটা অর্নি ভাইয়ের সামনে রেখে বসলো পাশেই।
-ওটা কি?
-আমারও একই প্রশ্ন ভাইয়া, “এটা কি?”
অর্ণব অবাক হয়ে তুলে নেয় ব্যাগটা। ভেতরটা চেক করে বুঝতে পারে অর্নি কেন এতদিন এই ব্যাগটা নিয়ে প্রশ্ন করেনি। কথা ছিলো সেদিন চট্টগ্রাম পৌঁছেই যেন কল করে তাকে ব্যাগটার কথা জানার জন্য। অর্নি কথা বললেও এ প্রসঙ্গে কোন প্রশ্ন করেনি অর্ণবও যেচে বলেনি কিছু।
-বলো এটা কি?
-রেগে যাচ্ছিস নাকি! দ্যাখ এখানে যা ট্রান্সফার হয়েছে সবটা তোর নিজের। আমি চাইছিলাম তোর সিম কানেকশনটাও দিতে যেন সকল প্রকার নোটিফিকেশন ফোনেই পাস কিন্তু তোর নতুন সিমটার রেজিষ্ট্রেশন তোর নামে নেই। আর হ্যাঁ এটা নিয়ে রাগ দেখানোর কিছু নেই আমি পুরো কোম্পানি বেচে যা পেয়েছি তার দশ ভাগের একভাগ এখানে বাকি নয় ভাগ আমার কাছেই। এত হাইপার হওয়ার কিছু নেই। বিদেশ বিভূঁইয়ে তোর এর থেকেও বেশি লাগবে।
-কোম্পানি বেচে দিয়েছো মানে কি ভাইয়া?
-আমি আর ব্যাবসা বানিজ্য করতে চাচ্ছি না।
-কি করবে তাহলে?
কান্নার ডেলা আটকে আছে অর্নির গলায়। সে যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। যে মানুষটা সেই কৈশোর থেকে ব্যবসায় ডুবে গিয়েছিল আজ সে তার সাফল্যকে বিক্রি করে দিয়েছে বলছে! তাও কত স্বাভাবিক স্বরে। অর্ণব বুঝে গেল বোনটি এবার কেঁদে ভাসাবে তাই এগিয়ে এসে বাহু জড়িয়ে ধরলো।একবার দরজায় তাকালো বোধহয় দেখতে চাইলো নুপুর আছে কিনা আশেপাশে তারপর সতর্ক গলায় বলল, “তুই বড্ড দূর্বল রে বোন তাই তোকে আগেই জানাতে চাইনি কিছু।”
ভাইয়ের এমন সাবধানী গলা শুনে মুখ তুলে চাইলো অর্নি।
-এই যে আমরা এই বাড়ি এই ঘরে পড়ে আছি এগুলো সব অভিশপ্ত আমাদেরও জন্য। এগুলো শকুনের নজর লেগে আছে বহু বছর ধরে। আমাদের ছোট দাদা আমার মাথার ছায়া মানুষটা মারা যাওয়ার পর থেকেই ওঁৎ পেতে আছে তারা। জানিস আমার আর তোর ওপরের আঘাতগুলো কার গায়ে লেগেছে?
এ পর্যায়ে অর্ণবের কণ্ঠস্বর ভেজা শোনালো। অর্নিতার প্রশ্নবোধক চাহনি দেখে অর্ণব আবার বলতে লাগলো, ” আমার পেছনে অনেকদিন ধরে দএকজন লোক লেগেছিলো। সবসময় নজরে রাখতো আমায় ঠিক তেমন করেই আরেকজন ছিলো নুপুরের পেছনে। অবশ্যই সেটা তোকে মনে করে।”
– কি বলছো ভাইয়া!
-হ্যাঁ। পুলিশের কাছে নুপুরের বাবা আরো আগেই জানিয়েছিলেন এ কথা। নুপুর সুস্থ হওয়ার পর তার জবানিতেও সেম ঘটনা জানা গেছে আর কিডন্যাপ হওয়ার দিন মনে আছে তোর ফোনটা ওর কাছে ছিল?
-হ্যাঁ। ওর কাছে ছিল সেজন্য তো পুলিশ আমাকেও জেরা করেছিলো।
-হু, ওই ফলোকারী কোনভাবে তোকে আর ওকে গুলিয়ে ফেলেই একটা বছরের বেশি ওকে ফলো করে গেছে। সুযোগমতো সেদিন ওকে তুলে নিয়ে গেল আর….
থেমে গেছে অর্ণব। এরপর আর একটা শব্দও কণ্ঠধ্বনি পেরোতে পারলো।
-এগুলো কে করিয়েছে ভাইয়া? জানা যায়নি?
-হু। এই যে একটা মাস ধরে নিয়মিত পুলিশের সাথে সাক্ষাৎ করে চলছি তা শুধু ওই মানুষগুলোর জন্যই। সকল ষড়যন্ত্রের মূলহোতা আমদেরই কাছের মানুষ বড় দাদার বড় নাতি।
-সাখাওয়াত ভাই!
প্রচণ্ডরকম অবাক অর্নি এবার কথা বলতেও ভুলে গেল। এগুলো বিশ্বাস করা যায়!
-তিনি সব করিয়েছেন? তাদেরকে পুলিশে দাও ভাইয়া এক্ষুনি।
– যা হওয়ার তা অলরেডি হচ্ছে কিন্তু কি বলতো নুপুরের অপরাধীরা যে কেউ শাস্তি পেলো না ঠিকঠাক।
-সাখাওয়াত ভাই নুপুরকে…..
-উহুম এখানে আরেকটু বাকি। ওটা সাখাওয়াত নয় তার ছেলে ।
-মিনার!
অর্নি আর কিছু বলার শক্তি পাচ্ছে না। ফুঁপিয়ে উঠলো সে আবারও। নুপুর কত যন্ত্রণা ভোগ করলো শুধু মাত্র তাদের ভালোবাসার মানুষ বলে। আর আপন মানুষগুলোর এই পিশাচরুপ গুলো কেমন করে বেরিয়ে আসছে সামনে।
-অপরাধীরা শাস্তি পাবে। প্রতারণা, জাল দলিলের জন্য সাখাওয়াত চৌধুরী খুব শিগ্রই গরাদের ওপারে থাকবে সেই সাথে তার ছেলেও..
______
অর্নির ফ্লাইট সন্ধ্যা সাতটার। তাকে এয়ারপোর্টে অর্ণব নিয়ে এলেও শেষ মুহূর্তে রায়না বেগম আর বৃষ্টিকে নিয়ে হাজির হলো রিমন। অর্নি ইমিগ্রেশনের জন্য চলে যেতেই রায়না চলে যেতে পা বাড়ায়।
-খালামনি দাঁড়াও।
অর্ণব ডাকতেই থমকে দাঁড়ায় রায়না।
-কথা বলবে না আমার সাথে?
রায়না জবাব দেয় না। অর্ণবই আবার বলে, “একটু কথা বলে যাও খালামনি হয়তো এটাই হবে আমাদের শেষ কথা বলা।”
রায়না ফিরে তাকায় ভাগ্নের দিকে। মমতায় পূর্ণ মায়ের মন কতক্ষণ কঠোর থাকতে পারে! যে সন্তানদের মায়া কাটিয়ে ময়না নতুন জীবনে যেতে পেরেছিলো রায়না সেই সন্তানদুটিকে অপরাধ করলেও ভুলে থাকতে পারবেন না। আকাশপাতাল তফাৎ দু’বোনের মাঝে আর তাই হয়ত, অর্ণব, অর্নি মাকে ভুলে গেলেও খালামনিকে ভুলে থাকতে পারে না৷ বৃষ্টি আর বেশিক্ষণ দাঁড়াতে চাইলো না এখানটায় তাই মা’কে বলল, আমি গাড়িতে আছি। রিমনও গেল সেদিকে।
-কেন কথা বলতে চাচ্ছিস? কষ্ট দিয়ে মন ভরেনি?
-মাফ করে দাও না। বৃষ্টি দেখবে আমার চেয়েও ভাল কাউকে পাবে।
-তুই ভাল সে কথা কে বলল?
-আচ্ছা আমি খারাপ ও অনেক ভালো কাউকে পাবে তুমি কষ্ট পেয়ো না। আমি একটু জড়িয়ে ধরি তোমায়?
বাচ্চাদের মত শোনালো অর্ণবের এই আবদারটুকু। রায়না নিজেই জড়িয়ে ধরলেন ছেলেটাকে। নিজের সংসারে কত যুদ্ধ, ঝড় বইছে অর্ণব অর্নিকে ঘিরে। তিনি এক মুহূর্তের জন্য সব ভুলে গিয়ে মমতা মিশিয়ে বুকে টেনে নিলেন বোনপোকে। সেই ছোট্ট বেলাকার অর্ণবের মত এই অর্ণব মিশে গেল খালামনির বুকে। সল্প আওয়াজে বলে বসলো, “তোমাকে বড্ড ভালোবাসি খালামনি৷ তুমিই আমার আর অর্নির মা ছিলে তুমিই থাকবে। সবসময় নিজের খেয়াল রেখো তুমি মনে রেখো তুমি ভাল থাকলে আমরাও ভালো থাকব। যতদূরে যাই যতই আড়ালে যাই তোমার দোয়ার মত তুমিও থাকবে আমাদের পাশে। ভালো থেকো।”
_____
অর্নি ফিনল্যান্ড পৌঁছে গেছে আজ দু দিন। সারাদিন কোন কাজ না করে শুয়ে বসেই কাটাচ্ছে অর্ণব এখন। নুপুর জড়তা নিয়েই আজ প্রশ্ন করে বসল, অফিস নেই আপনার?
জবাবে অর্ণব মুচকি হাসলো। নুপুর বোকার মত কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে চলে গেল রান্নাঘরে৷ রুজিনা খালা কাল তাঁর গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। কেন গেলেন নুপুর জানে না। সে বার কয়েক প্রশ্ন করেছিলো অর্ণবকে। সে কেমন হালকাভাবে বলল, খালার বয়স হয়েছে তাই আর কাজ করবেন না। এ জবাবটা নুপুরের একটুও বিশ্বাস হয়নি৷ যে মানুষটার গোটা জীবন কাটলো এ বাড়িতে। যে কিনা সন্তানের চোখে অর্ণবকে দেখতো তাকে একলা করে সে কিনা চলে যাবে! যদি মানুষটার গ্রামে নিজের কোন সংসার থাকতো তবে না হয় মানা যেত। রাতের জন্য ইলিশ ভাজা আর ভাত রান্না করেছে নুপুর সাথে শুকনো মরিচ টালা। বাড়িতে তিনজন মাত্র মানুষ এখন তাও কিনা দারোয়ান চাচা খান নিজ বাড়িতে। এ বাড়িতে একটি মাসের মধ্যেই কত যে পরিবর্তন হয়েছে তা ভাবতে গেলেও ভয় হয় নুপুরের৷ গোটা বাড়িতে দু জন মানুষ বাস করছে আজ সকাল থেকে। বিরাট এই বাড়িটার শুনশান নীরবতা গা ছমছমে ভীষণ অর্ণব অবশ্য সারাক্ষণই আশপাশে থাকছে তবুও কেমন যেন লাগে৷ রাতের খাবার টেবিলে সাজিয়ে অর্ণবকে ডাকলো নুপুর৷ সেও ভদ্র ছেলের মত তৎক্ষনাৎ এসে খাবার খেয়ে উপরে চলে গেল। থালাবাটি পরিষ্কার করে নুপুর যখন উপরে গেল তখন কানে এলো ক্ষীণ এক সুর। চেনা স্বরে এই সুরটা সে আগেও শুনেছিলো হাসপাতালের বেডে শুয়ে। নিঃশব্দে সে ঘরে ঢুকতেই খেয়াল করলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে অর্ণব গাইছে গানটা। নুপুর এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো অর্ণবের পেছনে। অর্ণব কেমন করে যেন টের পেল শ্যামাঙ্গিনীর উপস্থিতি। পেছন ফিরে এক ঝটকায় হাতটা টেনে নুপুরকে বুকের ওপর ফেলে গেয়ে উঠলো,
রিদওয়ানের সাথে মনোমালিন্যতা দূর হয়েছে এবার বাকি দাদী। এ দুজনের সাথে সব ঠিক থাকলেই চলবে বাকি আত্মীয় স্বজনকে তার আর দরকার নেই। এবার তার ভাবনা চিন্তা সবই যেন স্বার্থপরের মত। তাতে একটুও আফসোস নেই । কাল রাতে রিদওয়ানের কেক কাটার সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত কলটা এলো শরাফত সাহেবের পক্ষ থেকে । তিনি জানালেন তৃতীয় আসামি ধরা পড়েছে কাল সকালেই যেন নুপুরকে নিয়ে একবার থানায় আসে। রাতটা আর থাকা হয়নি অর্ণবের। রাত দুটোতেই সে রওনা দিয়েছে ঢাকার পথে। গাড়িতেই একটু ঘুমিয়ে নিয়েছিলো ভোরে এসে সরাসরি উপস্থিত হয় শ্বশুর বাড়িতে। নুপুর তখনও গভীর ঘুমে তলিয়ে থাকায় টের পেল না নিজ কক্ষে আপন মানুষটির অস্তিত্ব। রাতে আধো ঘুমের দরুণ অর্ণবের চোখদুটো রক্তরাঙা। নাজিম সাহেব তাকে দেখতেই বুঝলেন ছেলেটা রাতে ঘুমায়নি ঠিকঠাক। অর্ণবকে নুপুরের ঘরে পাঠিয়ে বললেন, একটুখানি ঘুমিয়ে নিতে। অর্ণব ঘুমায়নি, নিষ্পলক তাকিয়ে শুধু দেখতে থাকলো প্রাণপ্রিয়াকে। শ্যামা ত্বক কয়েকদিনের অসুস্থতায় ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কাঁধের কাছটায় ওড়না না থাকায় খামচির আঁচড়গুলো শুকিয়ে গিয়ে দাগ হয়ে আছে। জমে থাকা ক্ষোভ আচমকাই কেমন রক্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করলো তার। নুপুরকে হসপিটালে দেখার পর থেকেই তার মাথায় শীতল এক দুর্বোধ্য জেদ চেপে আছে এক কথায় বলা যায় খু*ন চেপে আছে। বড্ড কঠোর মনটাকে তার কত মুশকিলে সে চুপ করিয়ে রেখেছে তা শুধু তার অন্তরাত্মাই জানে। তার শীতল চিন্তাধারা অনেক আগেই আন্দাজ করে নিয়েছে নুপুরের এ অবস্থার জন্য একমাত্র সে-ই দায়ী আর তা সহজ সমীকরণ মিলে গেছে নুপুরের বাবার একটি বয়ানেই। সেদিন পুলিশ যখন জিজ্ঞাসাবাদে নাজিম সাহেবকে প্রশ্ন করলেন, আপনার কোন শত্রু আছে বা সন্দেহজনক কেউ আছে আপনার দৃষ্টিতে! জবাবে তিনি জানালেন, জানামতে শত্রু তো নেই তবে মেয়ে কয়েকদিন আগেই জানিয়েছিলো কেউ তার পিছু নিতো। দু চার দিন সে দেখেছে এরপর থেকে তো বাড়ির বাইরে যাওয়া প্রায় বন্ধই ছিলো অনেকগুলো দিন। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর সেদিনই বাইরে গেল তারপর…..
নুপুরকে কেউ ফলো করছে আর অর্ণবকে কেউ ফলো করতো দুটো ঘটনাই সংযুক্ত তা বুঝতে একটুও দেরি হয়নি এবং দ্বিতীয় হিন্ট ছিলো অর্নির ফোনে কিডন্যাপারের কল যা নুপুরের হাতে ছিল। অর্ণব এইটুকুতেই নিজের মত সাজিয়ে নিলো পুরো ঘটনা। তার কোন শত্রুপক্ষ গুপ্তচর লাগিয়েছে তার ওপর এবং অর্নির ওপর নজর রাখার জন্য সেই গুপ্তচর তাকে ঠিকঠাক চিহ্নিত করতে পারলেও ভুল করলো অর্নির বেলায়। অর্নিকে হয়তো কলেজেই প্রথম দেখেছে অৎবা দেখতে গিয়েছে আর সেখানেই বিভ্রান্তিতে পড়েছে নুপুরকে অর্নি ভেবে! কিন্তু কেন? অর্ণবের পাশে দেখেছে নুপুরকে আর ভাই-বোন ভেবে নিয়েছে? তাই বলে লম্বা সময় ধরে এই ভুল চলতে থাকলো আর শত্রুপক্ষ টেরও পেল না! মাথা কাজ করছে না ঠিকঠাক এই একটা জায়গাতেই৷ নিষ্পলক তাকিয়ে ভাবনাটা গড়ালো অনেক সময় তখনো নুপুরের ঘুম ভাঙেনি। বাইরে থেকে তুতুনের গলার আওয়াজ পেতে অর্ণবের যেন হুশ ফিরলো। বসা থেকে উঠে দরজা খুলতেই তুতুন বলল, স্যরি ভাইয়া জাগিয়ে দিলাম? বাবা তো আপুকে জাগাতে বলেছে৷
তুতুন চলে গেলে অর্ণব আবারও গিয়ে বসলো চেয়ার টেনে৷ নিচু স্বরে নুপুরকে ডাকলো বার দুয়েক তাতেই উঠে গেল নুপুর। বোধহয় অবাকও হলো সামনেই অর্ণবকে দেখে তবুও মুখ ফুটে কিছু বলল না। বিছানা ছে্রে নেমেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তার ঘরে লাগোয়া বাথরুম না থাকায় কমন বাথরুমটাই ভরসা। শারীরিক সকল ক্ষত মিলিয়ে না গেলেও হাঁটুর ওপরের আঘাতটা অনেকটাই মিলিয়েছে বলে চলতে ফিরতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না এখন। অর্ণবও আর বসে থাকলো না ঘরে। নুপুর মুখ হাত ধুয়ে বের হতেই অর্ণবও গেল ওয়াশরুমে। ফ্রেশ হয়ে নিজেই যেচে নুপুরের ছোট মাকে জিজ্ঞেস করলো, নাশতা কিছু কি হবে আন্টি?
-জ্বী বাবা বসো টেবিলে আমি এহনই দিতেছি।
অর্ণবের বাজার করার দিন থেকেই মহিলা তাকে বেশ সমাদর করে চলছেন। এই যে নুপুরকে এ বাড়িতে আনার পর থেকেই অর্ণব সন্ধ্যেটা এ বাড়িতে কাটায়, মহিলা রোজই তার জন্য হরেক রকম নাশতার আয়োজন করেন। আজও তাকে আসতে দেখে দ্রুত হাতে নাশতা তৈরি করেছিলেন। টেবিলে সব খাবার সাজিয়ে নিজেই ডাকলেন অর্ণব, নুপুরকে৷ অর্ণব এলেও নুপুর বলল, পরে খাব। এ কথার মূল্য বিন্দু পরিমাণও না দিয়ে অর্ণব একই প্লেটে দুজনের নাশতা নিয়ে নুপুরের ঘরে ঢুকলো। দরজাটা হালকা ভেজিয়ে রেখে বসলো বিছানাতে। পরোটার এক টুকরো ছিঁড়ে তাতে একটুখানি সবজি নিয়ে সে হুট করেই নুপুরের গাল চেপে মুখে ঠুসে দিল৷ আকস্মিক, এমন আচরণে নুপুর অবাক হতেও ভুলে গেল খানিকটা সময়৷ তারপরই কিছুটা চেঁচিয়ে বলে উঠলো, এ কেমন আচরণ!
-যেমনটা আপনি চাইছেন…
বাঁকা হেসে বাঁকা উত্তর৷ নুপুর বসে ছিলো খাটের মাথাশ হেলান দিয়ে এখন আর স্থির থাকা হলো না৷ সোজা হয়ে বসে সে ধাক্কা মেরে বসলো অর্ণবের বুকে। বড় শান্ত গলায় বলতে লাগল,
-কেন করছেন এসব? এত দয়া কেন দেখাতে চাইছেন আমায়? আমি রাস্তার কোন মেয়ে নই যার জন্য আপনার দয়া অতীব জরুরি বলে মনে হবে? আ’ম ফাইন টোট্যালি প্লিজ লিভ মি অন মাই কন্ডিশন….
একটা কথাও অর্ণব কানে তুললো বলে মনে হলো না। সে নির্বিকার পরোটা ছিঁড়ছে, নিজের মুখে পুরছে৷ তার বোধহয় খাওয়া শেষ হলো এবার সে খুব আঁটসাঁট বেঁধে ফিরে বসলো নুপুরের দিকে। আবারও পরোটা ছিঁড়ে ঠিক আগেরই মতন নুপুরের গাল চেপে তা মুখে পুরে দিলো। এবার পরোটার সাথে ছোট্ট একটি হুমকিও দিলো, একটা টুকরো মুখ থেকে ফেলবে তো ভুলে যাব শ্বশুর বাড়িতে আছি আর বাইরে শ্বশুর শ্বাশুড়ি সজাগ কান নিয়ে বসে আছে। বিয়ে করে এখনো উপোস করছি সেই উপোস আজ এখনই ভাঙব বাকিটা তোমার সিদ্ধান্ত।
অর্ণবের অসভ্য হুমকি শুনে ভঙ্গুর দৃষ্টিতে তাকালো নুপুর। এ কেমন হুমকি ছিহ! সামান্য নাশতার জন্য কি কি বলে দিচ্ছে এই লোক! এ কাকে ভালোবেসেছিলো সে?
-যা ভাবার পরে ভেবো আপাতত নাশতা ফিনিশ করো থানায় যেতে হবে আগে।
_______
বাবার সাথে বরাবরই দূরত্ব রিদওয়ানের কিন্তু মা ছিলো তার বুকের ভেতর একেবারে হৃৎপিণ্ডের মধ্যস্থানে৷ তার জীবনে দুটি নারী তার সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে কাছের তার মধ্যে প্রৎম জনই ছিলো তার মা আর দ্বিতীয় স্থানে অর্নিতার জায়গা। কিন্তু আজ বুঝি সে জায়গাটাও নিমেষে খালি হয়ে গেল যখন সে শেষবার দেশের মাটিতে থেকে মায়ের সাথে কথা বলতে চাইলো। এয়ারপোর্টে বসে শেষ কলটা সে মাকেই করেছিলো। ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হতেই সে শুধু আম্মু বলে ডাকতে পারলো। এরপর আর সুযোগ মেলেনি কিছু বলার তার আগেই ওপাশ থেকে আম্মু বলে গেলেন, “দেশ ছাড়ছিস এটা সঠিক সিদ্ধান্ত তোর। কাল বলা হয়নি আজ বলছি আজকের পর কখনো কল করবি না আমার পরিবারের কাউকে। তোর সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। তোর আব্বুর সাথে আমিও তোকে ত্যাজ্য ঘোষণা করছি। আমার ছেলে-মেয়ের থেকেও দূরে থাকবি৷ আর হ্যাঁ এ বাড়িতে তোর কোন ভাগও নেই তোর বউ যেন কখনো পা না দেয় এ বাড়িতে।”
বুকের একটা পাশ খালি নিয়েই দেশ ছেড়েছে রিদওয়ান। বাড়িতে কি হলো কি হয়নি জানে না শুধু জানে আজ তার এই জন্মদিনে সে নিজেকে এতিম বলে মেনে নিলো আজীবনের জন্য। কিছু মানুষ জীবনে ভুল না করেও আজীবন মিথ্যে ভুলের মাশুল গোনে। সে নিজেও তা গুনছে বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে বহুদূর।
_________
থানায় পৌঁছে জানা গেল পুলিশ সন্দেহ করে যাকে এনেছে সে আসামী নয়। পুলিশ যাকে ধরেছে তার বয়সটা চল্লিশের ঘরে। অথচ নুপুরের বর্ণনানুযায়ী আসামী তার সময়বয়সী কিংবা বড় বা ছোট হবে কলেজ, ভার্সিটি স্টুডেন্ট হওয়ার কথা। কথাবার্তায় সে বুঝতে পেরেছিলো ছেলেটা তাকে আরও আগে থেকেই অন্যরকম নজরে রেখেছে হয়তোবা তার কলেজের আশেপাশে থেকেই তাকে দেখতো। আধঘন্টার মধ্যেই হতাশ হয়ে ফিরে এলো অর্ণব-নুপুর। এরপর কেটে গেল আরও একটি সপ্তাহ। প্রকৃতিতে তখন ভীষণ খরা অর্ণব তৃষ্ণায় ধুঁকছে। তার তৃষ্ণা জলপিপাসা না তার তৃষিত হৃদয়ের খোঁজ শ্যামাঙ্গীনি। এরই মাঝে দাদীর শরীরটা আরও ভেঙে পড়ায় দাদীকে হাসপাতালে নেয়া হলো। দিন দুই ডাক্তার অবজারভেশনে থেকেও কোন পরিবর্তন হয়নি। ডাক্তার জানালেন, অবস্থার আর উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না তারা। চাইলে শেষ সময়ের জন্য নিজেদের কাছে রাখুন। অর্ণবেরও তাই মনে হচ্ছিলো কিন্তু বাড়িতে মানুষটার কাছে থাকার মত তো কেউ নেই। অর্নির পরীক্ষা চলছে, রুজিনা খালা একা মানুষ কতক্ষণ নজরে রাখবেন! এই সময়টায় আশেপাশে কারো থাকাটা জরুরি, সবসময় দোয়া, জিকির চলাটাই উত্তম হতো। অর্ণবের ভাবনাটা দাদী নিজেই দূর করে দিলেন নুপুরকে দেখে। দাদীর অবস্থার অবনতি জেনেই নাজিম সাহেব জোর করে মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে এলেন। দাদী তখনও বাঁধো বাঁধো আওয়াজে কথা দু একটা বলতে পারেন৷ নিজেই নুপুরকে ইশারা করলেন পাশে বসতে। মানসিক দিক থেকে বিধ্বস্ত নুপুর একটুও অবহেলা না করে এগিয়ে গেল দাদীর শিথানের কাছে। বৃদ্ধা তখন একটু একটু করে বলতে লাগলেন, “বাড়ি.. চল.. আমার সাথে। আমার অর্ণবের… নাই…. কেউ নাই…. যাবি?” থেমে থেমে বলা নিরুচ্চারিত বাক্যটার অর্থ প্রথমে কেউ বুঝতে না পারলেও পরে নুপুরই কেমন করে যেন বৃদ্ধার হাতের ইশারাটুকু বুঝলো। না চাইতেও সে মাথা নেড়ে সায় দিলো সে যাবে। নুপুরের বাবাও সান্ত্বনা দিলেন, চাচী মেয়ে যাবে তো নিশ্চয়ই যাবে আপনে যখন বলবেন। সত্যিই গেল নুপুর অর্ণবের বাড়িতে যেদিন দাদী চাইলো। যাওয়ার আগে পুনরায় তাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি হলো, কবুল বলা হলো এমনকি অল্প করে বাসরঘরটাও সাজিয়ে দিলো রুজিনা খালা। যে রাতে নুপুরকে বাড়িতে তোলা হলো তার পরেরদিনই দাদী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। যেন অপেক্ষায় ছিলেন আদরের নাতিটির পাশে সঙ্গীনি দেখার তারপরই হয়তো নিজ দায়িত্ব শেষ বলে মেনে নিয়ে চলে গেলেন পরকালের পথে। কে জানে ভাগয বিধাতা আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন অর্ণবকে কখনো নিঃস্ব করবেন না। তার একলা জীবনে কেউ এলেই কেউ চলে যাবে! প্রকৃতির নিয়ম বড়ই আজব বড়ই চমৎকার তাইতো দাদীর লাশ কবরে নামানোর আগেই সনাক্ত হয়ে গেল নুপুরের জীবনের চরম দূর্দশা নামানো মানুষগুলো। প্রত্যেকেই অর্ণবের জীবনে রক্তের বন্ধনে জড়িত। আর অর্ণব! নুপুরের জল্লাদমুখো মানুষটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুধু দেখে গেল ধর্ষককে, কিডন্যাপ করার পরিকল্পনাকারীকে আর তার পিঠ পিছে চাকু নিয়ে ঘুরতে থাকা মানুষগুলোকে। রক্তে তেজস্বী স্রোতকে কেমন করে সে সরলরেখায় ভীষণ শান্ত রেখে কেমন করে যে বইয়ে দিলো সে সময়টাতে তা শুধু অর্ণবই জানে। জীবনে প্রায় প্রতিটা পদক্ষেপই সে সচেতনতার রেখেছে তাই হয়তো এ বেলাতেও নিজেকে সফল করতে মস্তিষ্কে বরফ ঢেলে হিম শীতলপরিকল্পনাগুলো করে নিলো। দাদীর লাশ দাফন করেই সে রিদওয়ানকে ফোন করে বলল, যত টাকা লাগে লাগুক যেভাবেই হোক একটা ব্যবস্থা কর অর্নিকে তোর কাছে নিয়ে যাওয়ার।