Sunday, July 20, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 381



প্রিয়ানুভব পর্ব-১৪

0

#প্রিয়ানুভব [১৪]
লেখা: প্রভা আফরিন

অনেকদিন পর ভাইয়ার ফ্ল্যাটে এলো অনুভব। চেনা চেনা গন্ধে মনটা আকুল হয়ে উঠল। তিনটে মাস পর স্বাচ্ছন্দ্যের গণ্ডিতে পা পড়ল। বুকের ভেতর স্মৃতির চোরাস্রোত বয়ে গেল অজান্তেই। এই ফ্ল্যাট, দেয়াল, মানুষগুলোই একটা সময় ওর কত আপন ছিল। আর এখন শুধুই দূরত্ব আর অস্বস্তি। আজকেও বোধহয় বিনা ডাকে যেচে আসা হতো না। কিন্তু প্রিয়ার জন্য, অনাগত ভবিষ্যতের জন্য আসতেই হলো। পাষাণী মেয়েটিকে এতভাবে বুঝিয়েও সে বিয়েতে রাজি করাতে পারল না। অনুভবের নাহয় অভিভাবক নেই। কিন্তু প্রিয়ার তো আছে। মনের সম্মতি থাকলেও মায়ের মত ছাড়া সে সম্মতি দিতে পারবে না। অনুভব ব্যথিত হলেও ভেবে দেখল কথাটা যৌক্তিক। তার যদি কোনো বোন থাকত তাহলে কী এমন পরিবারহীন, গৃহহীন একটি বাউণ্ডুলে ছেলের হাতে সমর্পণ করত! নিশ্চয়ই নয়। প্রিয়ার মা-ই বা এমন জামাই চাইবেন কেন? বিশেষ করে পারিবারিক নিশ্চয়তা না থাকলে পাত্র বা পাত্রী কারো ব্যাপারেই বিপরীত পক্ষ এগোতে সাহস পায় না। তাই অনুভব জড়তা নিয়ে হাজির হয়েছে ভাইয়ের কাছে। একমাত্র অভিভাবক হিসেবে ভাইয়া যদি ওর হয়ে প্রিয়ার মায়ের কাছে প্রস্তাব রাখে তবে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে।

জাইম এখন হামাগুড়ি দিয়ে পুরো বাড়ি ছুটে বেড়ায়। দাঁড়াতেও পারে সোজা হয়ে। সামনের গুটিকয়েক দাঁত বের করে কতসব নতুন শব্দ আবিষ্কার করে চলেছে। অনুভবকে দেখে প্রথমে সে কাছে আসতে চায়নি। তিন মাসেই চাচাকে ভুলে বসেছে একদম। অনুভবের বেশ খানিকটা সময় লেগেছে ওর সঙ্গে মিশতে। এরপর তাকে বুকে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দলাইমলাই করল।

জয়নব বসেন আছেন অনুভবের সম্মুখে। ভাবখানা এমন যে বাইরের লোকের কোলে নাতিকে ছেড়ে দিয়েছেন। চোখের আড়াল করলেই বিপদ। বৃদ্ধার কুচকানো চামড়ার মধ্যে স্থাপিত হলদেটে চোখ অনুভবের ওপর থেকে সরছেই না। যেন বুঝে নিতে চাইছেন বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর কী কী উন্নতি ও অবনতি ঘটেছে। পর্যবেক্ষণ শেষে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন,

“দম শেষ? খুব তো বেরিয়ে গিয়েছিলে নিজের দায়িত্ব নিজে নিয়ে। তেল মজেছে?”

অনুভব ক্রুর চোখে চাইল। পরের সংসারে ছড়ি ঘোরানো মহিলাটির এই অহংপূর্ণ দাপট তার কাছে যথেষ্ট অবাঞ্ছিত মনে হয়। বহির্বিশ্বে পুরুষের কূটনীতি আর সংসারে নারীর কূটনীতি দুটোই ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে সক্ষম। সে মেকি হেসে বলল,
“আমার জোয়ান বয়স, এত সহজে দম শেষ হওয়ার নয়। আপনার তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। কখন না জানি দম শেষ হয়ে যায়। তাছাড়া তেল স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। আমি তেল দেইও না, নেইও না। আপনিই নাহয় তা গায়ের মধ্যে জমা করুন। তেলের এখন মেলা দাম। বাই দ্যা ওয়ে, মেহমানকে শরবত-পানীয় কিছু দেন না নাকি?”

জয়নব ফুঁসে উঠলেন। আগে যতটা সমীহ করে কথাবার্তা বলত এখন সেটার ছিটেফোঁটা লক্ষণও নেই ছেলেটার মাঝে। বস্তির মেয়েটার পাল্লায় পড়ে বখে গেছে একদম! তিনি কটমট করে বললেন,
“তোমার ব্যবহার অত্যন্ত অসংলগ্ন হয়ে গেছে ইদানীং। হবেই তো। না আছে লাগাম আর না শাসন। চেহারার অবস্থা দেখি বাজে হচ্ছে দিন দিন। নে’শাপানিও করো নাকি?”

“হ্যাঁ, আপনি করবেন? খুব মজা কিন্তু। একেবারে এই দুনিয়া ছেড়ে অন্য দুনিয়ায় চলে যাওয়ার ফিলিং পাবেন।”

জয়নব হতচকিত হয়ে গেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
“ব’খা’টেপনা শুরু করেছ? ওই বস্তির মেয়েটা এইসব শিখিয়ে ছেড়েছে! এখন কী এখানে টাকা চাইতে এসেছ?”

অনুভব বিরক্তি লুকিয়ে বাঁকা হাসে। এদিক ওদিক অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে বলল,
“আপনি তো বাড়িতে একা আছেন, তাইনা?”

“তো?”

“ধরুন আপনাকে যদি গুম করে দেই, এরপর ডাকাতি করে চলে যাই, কেমন হবে বিষয়টা? খুব ইন্টারেস্টিং না? নে’শাপানির টাকা জুটছে না আজকাল। শেষে এই পথটাই খোলা আছে।”

জয়নব ভয়ে লাফিয়ে উঠলেন। অশ্রাব্য গা’লাগা’ল দিতে দিতে ছুটে গেলেন বেডরুমের দিকে। দরজা আটকে দিয়ে ফোন করলেন মেয়ের কাছে। অনুভব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুড়ি ভয়ে দৌড়ে তো গেল, ছোট্টো নাতিটাকে নিতে ভুলে গেল। অনুভব জাইমের কানে কানে বলল,
“শোন বাচ্চা, বড়ো হয়ে চাচার মতো হবি। ভুলেও নানির মতো হবি না। মেনিমুখো বাপের মতোও না৷ দেখলি তো বুড়ি বিপদে পড়ে নিজেকে ছাড়া সবাইকে ভুলে যায়। যখন কান্নাকাটি করবি হাত-পা ছুঁড়ে বুড়ির নাক ফাটিয়ে দিবি। চিকিৎসার জন্য তোর বাপ তো আছেই। একদম ভয় পাবি না।”

জাইম কিছু না বুঝে দুই হাতে অনুভবের চুল নিয়ে খেলতে লাগল। অন্তরা এলো সন্ধ্যা নাগাদ। অনুভবকে বসার ঘরে ভাবলেশহীন বসে থাকতে দেখে বলল,
“মাকে ভয় দেখিয়েছ কেন?”

অনুভব হেসে বলল,
“মজা করেছি, ভাবি। আন্টি বলছিলেন আমাকে নাকি ব’খাটে দেখায়, নে’শাপানি করি, তাই আমিও মজা করলাম।”

অন্তরা অসন্তুষ্ট হয়ে বলল,
“মোটেও ঠিক করোনি। বুড়ো মানুষ, প্যানিক এ্যাটাক হয়ে গেলে? যাইহোক, এতদিন পর হঠাৎ?”

“ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলার ছিল।”

“কোন বিষয়ে?”

অনুভব একটু সময়ক্ষেপণ করে বলল,
“বিয়ের ব্যাপারে। ভাইয়া-ই তো আমার একমাত্র অবিভাবক। তাই…”

“তুমি বিয়ে করছ? কাকে? বলো না যে সেই ক্রি’মি’নালের মেয়েটিকে!”

অনুভব ফোস করে একটা নিশ্বাস ত্যাগ করে। কেন জানি মনে হচ্ছে আসাটাই বৃথা। উলটো প্রিয়াকে অপমানিত হতে হবে। আগের দিনগুলোতে ভাবী ও তার মা জাভেদকে সমীহ করে অনুভবের সঙ্গে যে নরম ব্যবহার করত, এখন তা উবে গিয়ে আসল মনোভাব বেরিয়ে এসেছে। ইদানীং ওর মনে হয়, পৃথিবীতে সবচেয়ে জটিল কর্ম হলো মানুষ চেনা। এমনকি এক জীবনে মানুষ নিজেকেও চিনে উঠতে পারে না।
___________________

নিস্তব্ধ রাতের বুকে একাকী হেঁটে চলেছে অনুভব। চারপাশ সুনসান৷ থেকে থেকে ভেসে আসছে নিশীপোকাদের কলরব। গাছপালায় ঘেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাত নামতেই নামে শীতলতা। কোমল হাওয়ার তালে দোলে মন, জুড়ায় অঙ্গ। অনুভব কিছুদূর এগিয়ে বসে পড়ল লেকের পাশে। জলের বুকে তারকাদের ঝিলিমিলি অস্ফুট প্রতিচ্ছবি। সেদিকে তাকিয়ে অনুভবের চোখে ভেসে ওঠে সন্ধ্যার ঘটনা।
জাভেদ হসপিটালের ডিউটি শেষে বাড়ি এসে অনুভবকে দেখে প্রথমে ভেবেছিল সে নতমস্তকে আবারো ঠাঁই চাইতে এসেছে। কিন্তু যখন জানল প্রিয়াকে বিয়ে করতে এই আগমন, ভাইয়া সঙ্গে সঙ্গে ক্ষে’পে গেল। অনুভবকে জীবন সম্পর্কে নানান উপদেশ, পরামর্শ দিল। কিন্তু কোনোটাই অনুভবকে সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারল না। উলটে ভাবি জানাল তার হাতে একজন ভালো পাত্রী আছে। অন্তরার মামাতো বোন। বংশ ভালো, মেয়ের কোনো বাজে রেকর্ড নেই। সংসারীও। তাকে বিয়ে করে এনে একই বাড়িতে আবার আগের মতো সবাই একত্রে থাকবে। অনুভব ভাবীর মনের কথা বুঝে ফেলেছিল চট করে। তার বউ আনার সঙ্গে সঙ্গে ভাবী চাইছিল বৃদ্ধা মা ও শিশু জাইমের একজন পার্মানেন্ট দেখাশোনার লোক। দেবরের বউ ও নিজের আত্মীয় সম্পর্কের বোন সংসারে এলে তা আরো সহজ হয়ে যেত। বিতৃষ্ণায় অনুভবের মনটা ছেয়ে গেছিল। সকলে নিজের স্বার্থটাই দেখে চলেছে। সেই স্বার্থে অন্যের মনঃক্ষুণ্ন হবে কিনা তা দেখছে না।
অনুভব হাল ছেড়ে ফিরে এসেছে। বুঝে গেছে সম্পর্কটা আরেকদফা বিগড়ে গেল। ভাইয়া আরো দূরের মানুষ হয়ে গেল। এখন মনে মনে সে প্রিয়াকে ধন্যবাদ দেয়। মাথার ছাদ সরে গেলেও তার উছিলায় মানুষ চেনা গেল। বুকের ভেতর অসহ্য য’ন্ত্র’ণা উদ্বেলিত হয়। ভাইয়াকে, ভাইয়ার পরিবারকে সে মন থেকে ভালোবেসেছে। সেই ভালোবাসায় স্বার্থ নেই, নির্ভেজাল, নির্লোভী। তারাও কী একই রকম বেসেছিল? বোধহয় না।

অনুভব মাটির দলা হাতরে নিয়ে জলে ছুঁড়ে দেয়। টুপ করে একটা শব্দ হয়ে তা জলের বুকে তরঙ্গ তুলে মিলিয়ে যায়৷ ফোন বের করে সময় দেখে ও। রাত বারোটা বাজে। প্রিয়া কি ঘুমিয়ে গেছে এখন? হয়তো। সারাদিন খাটুনির পর মেয়েটা নিশ্চয়ই বেশ ক্লান্তিতে ঘুমাতে যায়। কোনোদিন যদি প্রিয়াও এভাবে ভাইয়ার মতো মুখ ফিরিয়ে নেয়? অনুভবের এই পৃথিবীতে আর কে থাকবে ভালোবাসার? সেদিন সে পৃথিবীকে নিষ্ঠুর আখ্যা দিতে দুবার ভাববে না। ও এখনো পর্যন্ত প্রিয়াকে বিব্রত করতে চায়নি বলে অতীতের কোনো বিষয়ে প্রশ্ন তোলে না। প্রিয়া নিজেই অস্বস্তি কাটিয়ে মাঝেমাঝে টুকটাক সব বলে। প্রিয়ার ভয়টাও তারই মতোন। যদি বাবার সত্যিটা না মানতে পেরে অনুভব ভুল বুঝে চলে যায়! অনুভব অবশ্য তাকে আশ্বাস দিয়েছে। যে হাত সে একবার ধরেছে তার দখল আমৃ’ত্যু ছাড়বে না। তাহলে প্রিয়াকে পাওয়া কেন এত কঠিন হয়ে উঠছে! সমগ্র পৃথিবী একজোট হয়ে তার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, নাকি সেই পৃথিবীর নিয়মের বাইরে চলে যাচ্ছে! সেই হিসেব করতে গিয়ে মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়ে আছে। নির্জন রাতের মমতাময়ী বুকে আশ্রয় চেয়ে ঘাসের ওপর গা এলিয়ে দিল অনুভব। মশার কামড় তার ঘোরগ্রস্ত মনের সীমাহীন ক্লান্তির কাছে পাত্তা পেল না।

পরদিন ভোরে নন্দিনী ওরফে সিসিমপুর দলের অন্যতম সদস্য ইকরি-মিকরি অনুভবকে খুঁজে বের করল। হাতের ওপর মাথা দিয়ে মাটিতে শুয়ে থাকতে দেখে প্রথমে ভেবেই বসল অজ্ঞান হয়ে গেছে কিনা। ছুটে এসে পাশে বসতেই শুনল মৃদু নাক ডাকার শব্দ। সারা গায়ে মশাদের রক্তিম চুম্বনের ছাপ। ফর্সা ত্বকে তা অস্বাভাবিক প্রকট হয়ে আছে। ভোরের সূর্যটি তখনও উঁকি দেয়নি। সদ্য আলো ফোটা প্রকৃতি এখনো ঝিমিয়ে। পথে লোক চলাচল শুরু হয়নি। নন্দিনী আচম্বিতে অনুভবকে ঝাকি দিয়ে উচ্চস্বরে বলে,
“মইরে গেছিস, হারামীর ছাও।”

শব্দটা যেন লেকের জলে হাবুডুবু খেয়ে বিকট হয়ে ওঠে। দেহে প্রবল কম্পন উঠতেই অনুভব লাফিয়ে উঠল। বিভ্রান্তির স্বরে বলল,
“আল্লাহ! ভূমিকম্প!”

নন্দিনী বুকে দু-হাত গুজে বলল,
“মোর দ্যান আর্থকুয়েক। দিস ইজ ইকরি-মিকরি।”

অনুভব ধাতস্থ হয়ে বুকে থুতু দেয়। কঠিন গলায় বলে,
“বজ্জাত মেয়ে, সকাল সকাল আমাকেই পাইছিস জ্বালাতন করতে?”

“আর তুই কী করছিস? কোনো খবর নাই, রাইতে হলে ফিরিস নাই, ফোন বন্ধ। এদিকে আমরা হগলে খুঁইজে ম’রি।”

অনুভব চোখ রগড়ে ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“হলে ফিরিনি বলল কে?”

“হালুম গেছিল তোর কাছে। দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা কইরে খবর না পাইয়া আমারে জ্বালানো শুরু করছে। আমি আছিলাম ইভেন্টের অফিসে। কোনোমতে দৌড়ায় আইছি। এদিকে তুমি লাপাত্তা। ভাবলাম হাসুর প্রত্যাখান পাইয়া টপকায় গেলা নাকি। তোমরা যেই সেন্টিমেন্টাল রে বাবা… আর ওইদিকে হাবা টুকটুকি কাইন্দা রাইন্ধা আন্ধা হওয়ার জোগাড়।”

ফোনটা বন্ধ রাখায় অনুভবের অনুশোচনা হলো। টুকটুকি মাত্রাতিরিক্ত আবেগী। কেঁদেকুটে নাজেহাল হয়ে গেছে বোধহয়। বলল,
“ওই হাবারে ফোন লাগা। বল ম’রি নাই।”

“তোমার কওয়ার অপেক্ষায় বইসে রই নাই। মাডিত লেটকি মা’ইরে পইড়া থাকতে দেইখাই ছবিসহ গ্রুপে ম্যাসেজ কইরে দিছি।”

“ভালো করছিস।”

অনুভব নির্বিকার চিত্তে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে যেতে নেয়। নন্দিনী ওর বুকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় পুনরায়। কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“আমাগের সাথে ভাব লও? দেবদাস হইয়া গেছো? ম’দ আইনে দেব? সিগারেট?”

“খাব, মা’তাল হয়ে দুনিয়া ভুলে থাকব। হু’ইস্কি, টা’কিলা কিছু জোগাড় করে দে।”

“সমস্যা কী? ভাইয়া মানে নাই?”

অনুভব নতমুখে ঘাসের দিকে চেয়ে থাকে। তার দেহের ভারে সবুজ ঘাসগুলো নেতিয়ে পড়েছে। নন্দিনী মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ বুঝে বলল,
“না মানলে না মানবে। তার জন্যি বিয়া আটকাবে? আমরা আছি না! সব ব্যবস্থা কইরে দেবানি। তুই খালি ডেট ঠিক কর।”

“মিয়া কাজি থাকলে তো হবে না। বিবিকেও রাজি হতে হবে।”

নন্দিনী অবাক হয়ে তাকায়,
“হাসু মানে না ক্যান? তুই আবার উল্টাপাল্টা কিছু করিস নাই তো?”

“আরে নাহ। ওইটুকুনি মেয়ে মা-বোনদের জন্য জান দিয়ে খাটছে। তুই জানিস বস্তিতে ওরা কতটা অনিরাপদ! আন্টি হাঁটতে পারেন না। হাসুর একটা টিউশনির ওপর পরিবারটা টিকে আছে। আমি কিচ্ছু করতে পারছি না। আত্মসম্মান এতটাই বেশি যে না খেয়ে মরবে তাও সাহায্য নেবে না। ওর ধারণা আমি ওর ওপর দয়া করছি, ওর জন্যই আমি পরিবার ছাড়া, হ্যানত্যান অনেককিছু।”

নন্দিনী ঠোঁট টিপে চুপ রইল। দুটি ছেলে-মেয়েকে সাত-সকালে লেকের পাশে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বসে থাকতে দেখে ক্যাম্পাসের জুনিয়র ছেলে-মেয়েরা কৌতুহলে দৃষ্টি দিচ্ছে। সেদিকে ওদের খেয়াল নেই। নন্দিনী একটু ভেবে বলল,
“তোর হাসুরে আমার সাথে যোগাযোগ করা। আমার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের অফিসে নিয়োগ দেই। প্রথমে ভলান্টিয়ার হোক, হাত পাকলেই পার্মানেন্ট নেবেনে। শুধু রাইতে বাড়ি ফিরতে লেইট হইতে পারে। তার জন্যি তো তুই আছিস। প্রেমের উপরে একটা জোর আছে না? ডিরেক্ট বাড়িত গিয়ে কবি হাসু দ্য ফাসু, তুমি আমারে বিয়া না করলেও আমি তোমারে বিয়া করব। তুমি সংসার না করলেও আমি সংসার করব, তুমি বাচ্চা পয়দা না করলেও আমি… নাহ, ব্যাটা ছাওয়াল সেইটা পারবি না। যাইহোক, এরপরেও কাজ না হইলে আমরা আছি তো, তুইলে আইনে মা’মলা ডিসমিস কইরে দেব। বুকে দম রাখ।”

নন্দিনীর কথায় অনুভব হেসে ফেলল। উঠতে গিয়ে সারা গা টনটন করে উঠল ব্যথায়। কী আশ্চর্য! রাতে তার মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে সে একা। কেউ নেই তার জন্য দুঃখ করার। অথচ সকালটা সেই আক্ষেপের জবাব দিয়ে দিল। এই বিচিত্র, পা’গ’লাটে মানুষগুলোর সঙ্গে মানসিক বন্ধনের জোর তার র’ক্তের বন্ধনকেও হারিয়ে দিল।

বেলা বারোটা নাগাদ অনুভব প্রিয়াকে ফোন করে বলল,
“ভাত রেঁধেছো?”

প্রিয়া হুট করে এমন প্রশ্নের মানে বুঝতে না পেরে বলল,
“এইতো সবে বসাব। কেন?”

“দুই মুঠ চাল বেশি দিয়ো। মেহমান আসবে।”

অনুভব প্রিয়ার কোনো কথা না শুনেই ফোন রেখে দিল। প্রিয়া পড়ল মহা চিন্তায়। কে আসবে, কেন আসবে কিছুই না বলে এই টেনশন দেওয়ার মানে কী? একবার ভাবল রাঁধবে না বেশি। কী মনে করে আবার বেশি চাল দিল। মুনিরা বেগম খেয়াল করে বললেন,
“রাতের সহ রাঁধবি?”

প্রিয়া সে কথার জবাব না দিয়ে এড়িয়ে যায়। কেউ আসবে কিনা সে জানে না, এলেও কেমন পরিস্থিতি তৈরি হবে তাও অজানা। অথবা ফা’জ’লামিও করতে পারে। লোকটা যে কী য’ন্ত্র’ণা দেয় মাঝে মাঝে!
প্রিয়া মাকে এখনো অনুভবের কথা বলে উঠতে পারেনি। তবে মুনিরা অনুভবের ব্যাপারে জানেন। প্রিয়ার চাকরি চলে যাওয়া থেকে টিউশনি পাইয়ে দেওয়া, এইসব প্রিয়া মাকে জানাত। কিন্তু তার প্রতি অনুভবের মনোভাব কখনো জানাতে পারেনি। সংকোচে জিভ আড়ষ্ট হয়ে আসে। সেখানে বিয়ের কথা বলবে কীভাবে সেই ভেবেই হাত-পা অসাড় হয়ে যায়।

জোহরের পর পাঞ্জাবী-পাজামা পরে, হাতে মিষ্টি, চিপস, জুস ও ফলমূল নিয়ে অত্যন্ত সুপুরুষ এক যুবক পা দিল দরজায়। যেন গরীবের দুয়ারে এক রাজপুত্র এসে দাঁড়িয়েছে। সেই রাজপুত্র বিনম্র স্বরে মুনিরাকে বলল,

“আসসালামু আলাইকুম, আন্টি। আসতে পারি?”

প্রিয়া ছোটো বোনকে খাইয়ে দিয়ে সবেই বাসন গোছাচ্ছিল। অনুভবকে মিষ্টি হেসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার চোয়াল ঝুলে যাওয়ার অবস্থা। পেছনে আবার বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জু। বোঝা গেল সেই পথ চিনিয়ে এনেছে অনুভবকে। মুনিরা চিনলেন না ছেলেটিকে। ভ্রু কুচকে গম্ভীর গলায় বললেন,

“তোমার পরিচয়?”

অনুভবের ঠোঁটে মুচকি হাসি থাকলেও ভেতরে ভেতরে সে চূড়ান্ত ভড়কে আছে। প্রেমিকার মায়ের সামনে নিজেকে ঠিক কেমন করে উপস্থাপন করা উচিত বুঝতে পারছে না। কিন্তু বাইরে সেসব জড়তা প্রদর্শিত না করে দৃঢ় স্বরে বলল,
“আমি অনুভব হাসান। হাসু না মানে প্রিয়া আপনাকে আমার কথা কিছু জানায়নি?”

অনুভব সরল চোখে প্রিয়ার দিকে চায়৷ প্রিয়া চোখ নামিয়ে কাচুমাচু করে। একবার ওড়না ঠিক করে তো আরেকবার জামা। সে যে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেছে তা আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। রঞ্জু গলা বাড়িয়ে বলল,
“অনুভব ভাইয়াগো বাড়িতেই প্রিয়া প্রথম কাজ নিছিল, চাচি। ভাইয়ার ভাইস্তারে টেককেয়ার করছে।”

মুনিরা চিনলেন। ছেলেটিকে আগে না দেখলেও তার সাহায্যপরায়ণতায় মনে মনে তিনি কৃতজ্ঞ ছিলেন। তবে আজ সামনে থেকে দেখে হঠাৎই চমকালেন। নিগূঢ় দৃষ্টিতে চাইলেন মেয়ের দিকে। প্রিয়া অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করছে। মুনিরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর গলায় বললেন,
“শুনেছি তোমার কথা। তবে আজ হঠাৎ এখানে আসার কারণ?”

অনুভব হুট করে সবাইকে ভড়কে দিয়ে মুনিরার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। উনার একটা হাত ধরে বাচ্চাদের মতো আহ্লাদী ও আর্ত স্বরে বলে উঠল,
“আমি একটা মা চাইতে এসেছি। একটা পরিবার চাইতে এসেছি আপনার কাছে। এই ছেলেটিকে নিরাশ করবেন না, মা।”

চলবে…

প্রিয়ানুভব পর্ব-১৩

0

#প্রিয়ানুভব [১৩]
লেখা: প্রভা আফরিন

খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি কথাটার যথার্থতা দিগন্ত খুঁজে পেল মাথার ওপর ঘূর্ণায়মান ফ্যানটা দেখে। বাতাস যতটা না ধীর শব্দ ততটাই উচ্চ। তবে ফ্যানের চেয়েও দিগন্ত ওরফে হালুমের কৌতুহল বন্ধু অনুভবের দিকে। বাড়ি ছাড়া হয়ে, ভার্সিটির হলে এসে ছেলেটার লাইফস্টাইল একদম বদলে গেছে। মেয়েদের নজরবিলাসী অনুভব এখন দিনরাত চাকরির পড়া পড়ছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে নিশ্চিত করার ভাবনায় তার অবস্থাটা এমন হয়েছে যে দাড়ি-গোঁফ গজিয়ে সুন্দর মুখটা চেনা যাচ্ছে না। পরিশ্রম তার চোখেমুখে উপচে পড়ছে। ওদের ফাইনাল সেমিস্টার শেষ হয়ে গেছে। এখন আর আগের মতো আড্ডাবাজি, ঘোরাঘুরি হয় না। সবাই এখন ভবিষ্যত গুছিয়ে নিতে তৎপর। ওরা বুঝতে পারছে জীবনটা ক্রমশ স্বস্তির গণ্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে। নির্ঝঞ্ঝাট, নির্ভাবনার জীবনটা বাস্তবতার বেড়াজালে আটকে যাচ্ছে ক্রমশ। দিগন্তের বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয়।

মেহগনি গাছের ফাঁক গলে বিকেলের কোমল ছঁটা এসে উঁকি দিচ্ছে জানালায়। দিগন্ত পা ঝুলিয়ে শুয়ে আছে অনুভবের বিছানায়। অনুভব তার পাশেই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। বন্ধুর উদ্দেশ্যে বলল,
“তুই সত্যিই ইউএস চলে যাবি?”

দিগন্ত বিরস গলায় উত্তর দেয়,
“একদমই যেতে চাই না, দোস্ত।”

“সুযোগ আছে, যাবি না কেন?”

“তুইও চল। আমি একলা বনবাসে যাব কেন? তোকে নিয়ে যাই।”

অনুভব হেসে ফেলল,
“আমার সুযোগও নেই, ইচ্ছেও নেই। কারণ আমার পিছুটান আছে। শুধু একটা চাকরি দরকার। তাহলেই পত্নীনিষ্ঠ সংসারী হয়ে যাব। কিন্তু তোর সুযোগ আছে। পিছুটানও নেই। বোকামো করে কেন হারাবি?”

দিগন্ত উঠে বসে অনুভবের হাঁটুতে ঘু’ষি দেয়।
“এখনই পর করে দিয়েছিস? তোরা আমার পিছুটান নয়?”

অনুভব ব্যথায় কুঁকড়ে যায়। দিগন্তের বাহুতে পাল্টা আঘা’ত করে বলে,
“হা’রা’মী হালুম, এটা পিছুটানের নমুনা ছিল?”

“বেশ করেছি। তুই আছিস পড়ায় ডুবে, ইকরির কোনো খবর নেই। টুকটুকি বোকাটার কথা তো বাদই দিলাম। আমার মনে হচ্ছে সবাই এক সমুদ্র দূরে দূরে অবস্থান করছি। আমি চলে গেলে তোরা কেউ মনে রাখবি না।”

দিগন্তকে দেখাচ্ছে গাল ফোলানো বাচ্চাদের মতো। ছেলেটির মাঝে সরলতার গাঢ় প্রলেপ আছে বলেই বালকের ন্যায় নিষ্পাপ দেখায় চোখদুটি৷ অনুভব হেসে ওর গালে টেনে দিয়ে বলল,
“তুই কিন্তু ন্যাকা হয়ে যাচ্ছিস, হালুম। কার সঙ্গে মিশতেছিস আল্লাহ মালুম।”

দিগন্ত ওর হাত সরিয়ে দিয়ে সন্দেহি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“তুই কি কোনো কারণে আপসেট?”

অনুভব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার হৃদয়ের রানী আবারো তাকে উপেক্ষা করতে শুরু করেছে। বেশ কয়েকদিন হলো তাদের ঠিকঠাক যোগাযোগ নেই। না টিউশনিতে গেলে দেখা হয়, আর না তার এলাকায় গেলে। নিজের দোষটা কোথায় অনুভব খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা যে জটিল তা নিয়ে সংশয় নেই। উদাসী গলায় বলল,

“প্রেমানল বুঝিস, বন্ধু? তুষের আ’গুনের চেয়েও জ্বা’লাময়ী যার শিখা। অন্তর পু’ড়ে খাঁক করে দেওয়ার বিনিময়েও এক আনা প্রেম মেলে না।”

দিগন্ত বিজ্ঞের ন্যায় ঘাড় হেলিয়ে বলল, “হুম, বুঝলাম।”

“কী বুঝলি?”

“বন্ধু আমার দেবদাস হয়ে গেছে। তোর হাসু আবার টাইট দিয়েছে?”

অনুভব প্রলম্বিত শ্বাসখানি কণ্ঠে চেপে বলে, “মেয়ে মানেই প্যারা। কোনোদিন কোনো মেয়ের মায়ায় পড়বি না।”
________________

আলো যখন আঁধারিয়া অম্বরের দ্বারপ্রান্তে অনুভব প্রিয়ার এলাকায় গিয়ে হাজির হলো। প্রিয়ার বাড়িটা কোথায় নির্দিষ্টভাবে সে জানে না। কাজেই গলির মাথায় দাঁড়িয়ে কল করল ওকে। প্রথমবার বেজে বেজে কেটে গেল। অনুভব ধৈর্য ধরে আরো দুবার কল করল। প্রতিটা রিং হওয়ার সাথে সাথে ওর মাথা দপদপ করছিল রাগে৷ কত্ত বড়ো সাহস! সেদিনের মেয়ে তাকে ইগনোর করা শেখায়! প্রেমে পড়ে একটু পাত্তা দিচ্ছে বলে কী তার দাপট কমে গেছে ভেবেছে! তৃতীয়বার বেজে বেজে কেটে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কল তুলল প্রিয়া। অনুভব কিছু জিজ্ঞেস করল না, কুশল বিনিময়ের ধারও ধারল না। রোষাগ্নি স্বরে বলল,
“এক্ষুণি যদি গলির মাথায় না আসো আমি তোমার বাড়ি ঢুকে যাব। এরপর যা হবে দেখা যাবে।”

অনুভব উত্তরের অপেক্ষা না করেই কল কাটে। প্রিয়া এলো ঠিক পাঁচ মিনিট পর। মাথায় ওড়না জড়িয়ে জুবুথুবু চলনে সে হাঁটছে। একটি দর্শনেই অনুভবের চৈত্রদগ্ধ হৃদয়ের আঙিনা দক্ষিণা হাওয়ায় দুলে উঠল। কিন্তু অভিব্যক্তিতে গোপন রাখল। আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ফিরবে। প্রিয়া কাছাকাছি এসে সাবধানী গলায় বলল,
“সন্ধ্যাবেলা এখানে কেন আসতে গেলেন?”

“তোমায় কিডন্যাপ করতে।”

প্রিয়া কথাটা বুঝে ওঠার আগেই অনুভব ওর হাত চেপে ধরে রিকশায় তুলে নিল।
________________

রাতের সঙ্গী আঁধার। আর সেই আঁধারের অঘোষিত নিয়ম নিঝুম নিস্তব্ধতা। রাতের দুটো নিয়মই ভেঙে প্রজ্জ্বলিত হয়েছে চোখ ধাধানো কৃত্রিম আলো। কোলাহলে মুখোরিত চারপাশ। তেমনই এক আলোকোজ্জ্বল শব্দমুখর স্থানে মুখোমুখি বসে আছে অনুভব ও প্রিয়া। গুমোট অনুভূতি চক্রাকারে পাক দিচ্ছে উভয়কে। মুখে নেই কোনো শব্দ। অনুভবের চোখে বেদনা, প্রশ্ন, রাগ। প্রিয়া নির্লিপ্ত। নিরবতা ভেঙে বলল,

“এখানে কেন এনেছেন?”

“রেস্টুরেন্টে মানুষ কেন আসে? নিশ্চয়ই সিনেমা দেখতে নয়।”

“আমি খাব না।”

“ফাইন, আমার খাওয়া দেখো।”

“আপনার খাওয়া বুঝি এতটাই দর্শনীয় কিছু?”

“তোমার উপেক্ষাও বুঝি এতটাই সহনীয় কিছু?”

অনুভব স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটির নত মুখশ্রীতে। পালটা জবাবে ধরাশায়ী প্রিয়া। ক্ষীণ গলায় উত্তর দেয়,
“আমার কাজ আছে, ফিরতে হবে।”

অনুভব সবল হাতে প্রিয়ার হাত চেপে ধরে। রাগ চেপে খাটো সুরে বলে,
“ড্যাম! সমস্যা কী তোমার? দুদিনের মেয়ে আমাকে ভাব দেখাও।”

প্রিয়া ঝারা দিয়ে হাত সরিয়ে নেয়। নিজেকে শান্ত রেখে শক্ত গলায় বলে,
“আপনি দেখতে কেন আসছেন?”

“হাসু… নাও ইউ আর রিয়েলি হার্টিং মি। আমি কী এতটা ডিজার্ভ করি?”

প্রিয়া দুহাতে মুখ ঢাকল। অস্থির লাগছে। কী ধরনের আচরণ করা উচিত আসলেই বুঝতে পারছে না। অনুভব বোধহয় মেয়েটির মনের অবস্থা টের পেল। ওর মুখ থেকে জোর করে হাত সরিয়ে আশ্বাসের সাথে আঁকড়ে ধরল। রুক্ষতাকে ভেঙে কোমল গলায় বলল,
“আমাকে একটুও ভরসা করো না তুমি? আমি এতটাই অবিশ্বাসের মানুষ?”

প্রিয়া চোখ তুলে তাকায়। বলে,
“বিশ্বাস করি তো।”

“তাহলে কি মনের কথা শোনার মতো মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি? আমি তাহলে সব দিক দিয়েই ব্যর্থ বলো? না পাচ্ছি ভালো একটা চাকরি, না হতে পারছি কারো মনের মানুষ। আই এম টোটালি আ লুজার।”

কী বলবে প্রিয়া? এই লোকটা তার জন্য ন্যায় চাইতে গিয়ে পরিবার হারিয়েছে। আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য, বিলাস হারিয়েছে। কতগুলো মাস ক্রমাগত স্ট্রাগল করে চলেছে জীবনের সঙ্গে। প্রিয়ার জীবনের জটিলতা কেন তাকে শুনিয়ে উদ্বিগ্ন করবে? বরং মানুষটাকে দেখলে প্রিয়ার অন্তরে খারাপ লাগা বাড়ে। নিজেকে সর্বদা সেরা হিসেবে উপস্থাপন করা নিখুঁত মানুষটার দিকে তাকানো যায় না। সুদর্শন মুখটায় মলিনতার ছাপ। চোখের নিচে ক্লান্তিকর সন্ধ্যার মতো লেপ্টে আছে কালি। দাড়ি-গোঁফে মুখ ঢেকে গেছে। মাথার চুলগুলোও বোধহয় কাটেনি মাসকয়েক। কপালে অবিন্যস্ত পড়ে আছে তা। কী বেহাল দশা! প্রিয়ার বুকটা হু হু করে ওঠে। শক্ত করে ধরে অনুভবের হাত। বলে,
“আমার জন্য নিজেকে কেন ভুল বুঝছেন?”

অনুভব ক্ষণকাল বিলম্ব না করে উত্তর দেয়,
“কারণ দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রার মাঝে আমার বিশ্রাম তুমি। সকল দুঃখের মাঝে এক চিলতে স্বস্তি তুমি। অথচ আমি স্বস্তি হতে বঞ্চিত।”

প্রিয়ার অন্তরে শীতল বাতাস বয়। দীর্ঘদিন কান্না, অভিযোগ, ধিক্কার, পরিহাস শোনা কান যেন ব্যতিক্রম কিছু শুনতে পেয়ে আরামবোধ করছে। অনুভব বলল,
“আমার দোষটা কোথায়? এই অবহেলার কারণ? এটা নিশ্চয়ই বলবে না যে আমার মনের কথা তুমি বোঝো না।”

“বুঝি, বুঝি বলেই ভয় করে।”

“নির্ভয়ে একবার মনের কথাগুলো বলা যায় না? নিজেকে যতটা গুটিয়ে রাখবে ততটাই কষ্ট পাবে। মনের ওপর এত চাপ দেওয়ার কোনো দরকার আছে? কাউকে বলো, নিজেকে হালকা করো একটু। এই বয়সে আমি বন্ধুদের সঙ্গে হেসে খেলে বেড়িয়েছি। জীবন সম্বন্ধে কোনো ভাবনাই ছিল না। আর তুমি কতটা মানসিক য’ন্ত্র’ণা বয়ে বেড়াও। এমন করে থাকলে পাগল হয়ে যাবে একদিন। একজন সৎ পরামর্শদাতা হিসেবে তো তোমার কথাগুলো শুনতেই পারি। পারি না?”

প্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে কোনো উত্তর দিল না। অনুভব ওর হাত ছেড়ে দিয়ে খাবার অর্ডার করল দুজনের জন্য। অনেকটা সময় পর প্রিয়া কথা বলল,
“জানেন, জীবনেরও যে একটা ভার আছে সেটা কখনো উপলব্ধি করিনি। গত একটা বছরে বুঝেছি জীবনের চেয়ে ভারী বস্তু পৃথিবীতে কিছু নেই। অর্থ-সম্পদ যত কমে জীবনের ভার তত বাড়ে। আমার জীবনটা এখন টিকে থাকার মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। দিনরাত মা-বোনকে নিয়ে চিন্তা। মাকে নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শে রাখতে পারলে অবস্থার উন্নতি হতো। তা সম্ভব নয়। দিয়া বড়ো হচ্ছে। এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়। আমি তো সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে পারি না। মাও পারে না। আশেপাশে বহু মুখোশ পরা মানুষ দেখি আজকাল। আমাদের দুর্বলতা বুঝে গেলেই তাদের নোংরা মুখোশ খসে যাবে। সুরক্ষা নিশ্চিত করাটা এখন আমার এক ও প্রধান লক্ষ্য। তারওপর অন্যান্য ঝামেলা তো আছেই।”

“যেমন?”

প্রিয়া ছোটো করে শ্বাস ফেলে বলল,
“বাড়ি ভাড়া জমে গেছে। বাড়িওয়ালা বলে দিয়েছেন এই মাসে ভাড়া না দিতে পারলে যেন বাড়ি ছেড়ে দেই। আমার টিউশনিতে তিন জনের খাওয়ার খরচই কুলোচ্ছে না। সঙ্গে দিয়ার পড়াশোনার খরচ বাড়ছে। আমি পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারব না। ভাবছি ফুলটাইম কোনো জবে ঢুকব। কিন্তু সেটাও খুঁজে পেতে সময় লাগবে। টিউশনির বাইরে যতটা সময় পাই, সে সময়টায় এখন কাপড়ে হ্যান্ড পেইন্টের কাজ করি। আমাদের বস্তিতে এক আপা কাজগুলো এনে দেয়। সামান্যই অর্থ। তবুও কিছু প্রয়োজন মেটানো যায়। এই দুর্দিনে এক বেলার খাবারটাই বা কে দেয়!”

প্রিয়ার চোখ ছলছল করছে। কণ্ঠস্বর কাঁপে। ঢোক গিলে পুনরায় বলে,
“আচ্ছা… আপনি আমায় একটা সোনার চেইন বিক্রির ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? বাইশ ক্যারেট আছে, মাত্র পাঁচ আনা। ওটা দিয়ে ভাড়াসহ খরচটা একটু গুছিয়ে নিতে পারতাম।”

অনুভব বেদনাহত চোখে চেয়ে থাকে। অনেকক্ষণ কোনো উত্তর দিতে পারল না। প্রিয়ার দিকে খাবার এগিয়ে দিয়ে বলল,
“খেয়ে নাও। পরে কথা বলি।”

প্রিয়া নিঃশব্দে খেতে শুরু করে। সত্যিই ক্ষুদাতুর ছিল সে। দুজন খাওয়া-দাওয়া শেষে রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে। অনুভব প্রিয়ার আঙুলের ভাজে আঙুল ডোবায়। প্রিয়া কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাল না। রাতের আকাশে অগণিত তারকারাজি ফুটে আছে। কাস্তের মতো সরু একফালি চাঁদ বুঝি ওদের দেখে মিটিমিটি হাসছে। অনুভব নির্জন স্থানে প্রিয়ার হাত টেনে ধরে পায়ের গতি রোধ করে। প্রিয়া প্রশ্নোক্ত চোখে তাকাতেই দুর্বোধ্য হেসে অতি নিকটে চলে আসে। প্রিয়া ভড়কে যায়। পিছিয়ে যেতে চাইলে অনুভব সরু চোখে চায়। যেন দৃষ্টি দিয়ে বোঝাতে চাইল,
“আমাকে ভয়!”

প্রিয়া অজান্তেই থেমে গেল। দৃষ্টি নিবদ্ধ করল অনুভবের সম্মোহিত চোখে। অনুভব গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। চন্দ্রালোকিত আকাশ ও গোপনীয়তা রক্ষাকারী রাতকে সাক্ষী রেখে প্রিয়তমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল,
“ম্যারি মি, হাসু।”

প্রিয়া ঝটকায় দূরে সরে গেল। বিস্ময়বিমূঢ় চোখে চেয়ে দেখল সোডিয়ামের হলদেটে আলোয় অনুভবের মুখের পেশি দৃঢ়। কৌতুকের হাসি সেখানে অনুপস্থিত। প্রিয়া কম্পিত গলায় বলল,
“মজা করছেন?”

“আমি মজা করার মুডে নেই।”

“এ হয় না।”

“কেন? আমাকে তোমার স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে আপত্তি? এতটা অযোগ্য ভেবো না। বাচ্চা তো পেট থেকে পড়েই হাঁটা শেখে না। প্রথম বসা শেখে, এরপর হামাগুড়ি। তারপর আধো আধো হাঁটতে গিয়ে আছার খাওয়া৷ পরে না দৌড়াতে জানা। আমিও স্বামীর দায়িত্ব-কর্তব্য শিখে নেব।”

“তা নয়, আমাকে আমার মা-বোনদের জন্য বাঁচতে হবে। ওদের আমি ছাড়া পৃথিবীতে কেউ নেই। বিয়ে করার কথা ভাবতেই পারি না।”

অনুভব ওর দুই কাঁধে হাত রেখে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল,
“সবদিক চিন্তা করেই বলছি আমি। মা আর দিয়াকে বাদ দিয়ে তো ভাবছি না। তুমি একটু আগে যা বললে এখন তোমার সেফটি নিয়েই আমার চিন্তা হচ্ছে। ছোটো বোনের সুরক্ষা নিয়েও তো ভাববে। ওই পরিবেশটা থেকে বেরিয়ে এসে একটা সেইফ বাড়ি দরকার। আমরা বিয়ে করে একটা ভালো দেখে বাড়ি ভাড়া করে নেব। চাকরি না হওয়া অবধি আরো দুটো টিউশন বাড়িয়ে নেব। একটু কষ্ট হলেও আমাদের চলে যাবে। কিন্তু তোমাদের সেফটি নিয়ে আমি কোনো দ্বিধা রাখব না। আমাকে আর যন্ত্রণা দিয়ো না, পাষাণী।”

প্রিয়া বোঝে লোকটার কথা। কিন্তু তার আত্মসম্মানবোধ ঝুকতে রাজি নয়। ভালোবাসার বিনিময়ে অনুভবকে সে ব্যবহার করতে চায় না। দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে চায় না৷ বলল,
“তা হয় না। আমার মা-বোনের দায়িত্ব আমারই। আপনি নিজেই কত স্ট্রাগল করছেন। আমার বাড়তি বোঝা চাপানোর কথা ভাবতেও পারি না।”

অনুভব অসহায় কণ্ঠে বলে,
“আমার মা গত হয়েছেন আজ প্রায় আট বছর। বাবাও তার একবছর বাদে ছেড়ে চলে গেলেন। এরপর আর কেউ স্নেহের হাত রাখেনি মাথায়। আমারও একটা মা প্রয়োজন, হাসু। একটা ফ্যামিলি প্রয়োজন। আমি ফ্যামিলি পারসোন। ব্যাচেলর লাইফ আমার কাছে অসহনীয়। হলের প্রতিটা রাত কী দুঃসহ কাটে তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। একাকিত্ব গলা টিপে ধরে৷ আমি বুঝতে পারছি তোমার অসুবিধা। তোমাকে টিউশনি কিংবা পড়াশোনা কিছুই ছাড়তে হবে না। আমরা নাহয় মিলেমিশে ঘর বাঁধব। দুইজন আলাদা আলাদা বোঝা টানার চেয়ে হালালভাবে একসঙ্গে থেকে একটা বোঝা ভাগ করে নেব। ভার কম লাগবে। পারবে না এই নিঃস্ব মানুষটার হাত ধরতে? একটা শূন্য সংসারকে ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করতে? প্লিইজ!”

অনুভব হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রিয়া শূন্য দৃষ্টিতে সেই হাতের দিকে চেয়ে থাকে। শক্ত খোলসের ভারে ন্যুব্জ আবেগী মনটা কেঁদে বলে, রেখেই দেখ না হাতটা। দিনশেষে প্রিয় মানুষটার সান্নিধ্যও কম কী? কীসের আশায় মানুষের ছুটে চলা? সুখের জন্যই তো। অনুভব ওকে সুখ ভেবে আঁকড়ে ধরতে চায়৷ প্রিয়ার সুখটাও তো অবিচ্ছেদ্য নয়৷

চলবে…

প্রিয়ানুভব পর্ব-১২

0

#প্রিয়ানুভব [১২]
লেখা: প্রভা আফরিন

মাথার ওপর ধুসর ছায়াময় ম্লান আকাশ। সন্ধ্যা নামা পিচঢালা পথে প্রিয়া দ্রুত পায়ে হাঁটছে। কাঁধে ঝোলানো চিকন ফিতের ব্যাগটা চেপে ধরেছে শক্ত হাতে। এদিক ওদিকে তাকিয়ে মাথা নত করে চলেছে ও। আজকাল অল্পতেই বুক কাঁপে প্রিয়ার। হেঁটে যাওয়া-আসা করে বলে বাড়ি ফিরতে রোজ সন্ধ্যা পেরোয়। একা একটা মেয়ে রোজ সন্ধ্যার পর ফেরে বিষয়টা অনেকের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বস্তির গলির মাথার চায়ের দোকানি গরম পানিতে চায়ের কাপ ধুতে ধুতে কেমন একটা বিদঘুটে দৃষ্টিতে তাকায়। চোখ নয় যেন শরীর মাপার ফিতে। প্রিয়ার গা গুলিয়ে ওঠে। দিয়া কিছুদিন আগে একবার কথার ছলে বলেছিল শেষ ঘরের আবুল চাচা নাকি তাকে দেখলে ডেকে জিজ্ঞেস করে বাবার কথা, পরিবারের কথা। হাত ধরে টানাটানিও করে। শুনে প্রিয়া যারপরনাই চমকে উঠেছে। দিয়া অত বুঝে বলেনি, কিন্তু প্রিয়ার মনে শঙ্কা উঁকি দেয়। মেয়েটা যে বড়ো হচ্ছে। কোনো কালো হাত ওকে স্পর্শ করুক সে চায়।

আজকাল বস্তির পুরুষগুলোর দৃষ্টিও প্রিয়ার নজরে আসছে। শিরশিরে একটা ভয় মেরুদণ্ড বেয়ে ঘোরাঘুরি করে সর্বাঙ্গে। এইসব অনিরাপত্তা কি এখনই তৈরি হচ্ছে নাকি আগেও ছিল! প্রিয়াই হয়তো খেয়াল করেনি এতদিন। দিয়াটার গায়ে কৈশোরের ছটা লাগতেই চারিদিকে শুধু অনিরাপত্তাই দেখছে সে। প্রিয়া আরো একটা জিনিস খেয়াল করেছে। মা কেমন চুপসে থাকেন ইদানীং। সেদিন টিউশনি গিয়ে জানতে পারে স্টুডেন্ট অসুস্থ। কাজেই না পড়িয়েই ফিরে আসতে হয়েছিল প্রিয়াকে। বাড়ি ফিরে দেখল মা প্রতিবেশী এক মহিলার সঙ্গে বসে গল্প করছেন। মহিলাটি পেশায় ঘটক। পান খেয়ে রাঙানো ঠোঁটে তিনি মুনিরাকে বলছেন,

“দেহো দিয়ার মা, তোমার জামাই নাই। মাইয়া একখান ডাঙ্গর, আরেকখানও হইলো বইলা। তুমি পারো না একলা চলতে। আবার মাইয়ারে দিছো ছাইড়া। রাইত-বিরাইতে বাড়িত ফিরে। যদি কেউ কিছু কইরা বয়? কিছু করতে পারবা? পারবা না। সময় থাকতে বিয়াডা দিয়া দেও। মাইয়ার চেহারা সুরুত দেখতে ভালা আছে। দেনাপাওনা লাগব না।”

মুনিরা হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলেছিলেন,
“বিয়ে আল্লাহর হাতে, আপা। তিনি ইশারা করলে আমি আটকানোর কে?”

“আল্লাহর হাতে সব। কিন্তু বান্দার চেষ্টা থাকন লাগে। তোমার মাঝে তো তেমন দেখি না। কতগুলান পাত্র আনছি একটারেও দেখলা না। মাইয়া সংসার চালায়, বিয়া দিলে সংসার চলব না হেই ডরে আগাও না।”

মুনিরা বেগমের তখন মাটিতে মিশে যাওয়ার জোগাড়। প্রিয়া দৃশ্যপটে হাজির হলো তীক্ষ্ণ মেজাজে।
“আমি বিয়ে করে নিলে আমার সংসার আপনি দেখবেন, আন্টি?”

“আমি না দেখলেও পয়সাওয়ালা জামাই থাকলে তো দেখবই। আমি কোনো ছুডুমুডু বিয়ার ঘর আনি না।”

“বড়ো বিয়ের ঘর তো অনেকেরই এনেছেন। ও বাড়ির সামিরার বিয়েটা তো আপনিই দিলেন। মাস ঘুরতেই স্বামী মা’রধো’র করে রেখে চলে গেল। আর খোঁজও নিল না। আপনার কথায় নিরাপত্তার কথা ভেবে বিয়ের পিঁড়িতে বসে গেলাম নাহয়। কিন্তু স্বামীর ঘরে যে আমি নিরাপদে থাকব তার নিশ্চয়তা কী?”

মুনিরা তর্ক করতে বাঁধা দিচ্ছিলেন বারবার। মহিলা থমথমে মুখে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন,
“বস্তির মাইয়াগো এই আমিই ঘটকালি কইরা পার করছি। আর দুইদিনের মাইয়া আমার ভুল ধরে! মনে রাইখো, বিয়া দিতে আমার কাছেই আহন লাগব। আর যদি নাগর জুটাইয়া ভাইগ্যা যায় তাইলে কথাই নাই।”

প্রিয়া মায়ের ওপর ধমকে উঠেছিল,
“কতদিন ধরে এসব হচ্ছে?”

মুনিরা উত্তর দিতে পারেননি। প্রিয়া বুঝেছিল তার আড়ালে মা-ও একটা যু’দ্ধ করে চলেছে বস্তির মানুষগুলোর তেরছা বাক্যের সঙ্গে। ঘরভাড়া দেওয়া হয়নি দুমাসের। বই কিনতে টাকা গিয়েছে। ফলে অল্প টাকায় ভাড়া দিতে সংকুলান হয়নি। বাড়িওয়ালা ঘুরে গেছেন দুবার। প্রিয়ার আজকাল দিশেহারা লাগে। কোনোদিকে আলো নেই। শুধু আঁধারের হাতছানি। আরেকটা টিউশন খুঁজছে প্রাণপনে। চেষ্টা করেও মিলছে না। সকল ভাবনার ভার মাথায় নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বাড়ি পৌঁছাল প্রিয়া। চমকে দেখল মামা বসে আছেন মায়ের পাশে। বিছানায় ছড়ানো ছিটানো চিপস, জুস, বিস্কুট, পাউরুটি। মামা তাকে দেখেই কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,

“সন্ধ্যার পর বাড়ি ফেরা কেন?”

“টিউশনি ছিল, মামা।”

“দিনে করা যায় না? মেয়েরা আজকাল ঘরেই নিরাপদ না। আর তুমি আসো গোটা কতক বাজার পেরিয়ে!”

প্রিয়া কোনো জবাব দিল না। তার দেরিতে বাড়ি ফেরা নিয়ে সকলের কত চিন্তা। অথচ তারা খেয়েছে কিনা, বাড়িতে বাজারটা ঠিকঠাক হয় কিনা সে নিয়ে চিন্তা তো দূরে থাক জিজ্ঞেস করতেও কুণ্ঠা। প্রিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। আশেপাশে অভাব দেখলে আপন মানুষগুলোই আগে পিঠ দেখিয়ে বেড়ায়। মামা অবশ্য প্রিয়ার উত্তরের ধার ধারলেন না। বোনকে বললেন,
“শোন মুনিরা, ভালো একজন লইয়্যার আছে হাতে। তুই বললেই আমি এগোবো।”

“কীসের জন্য?” প্রিয়া উৎসুক হয়ে জানতে চায়।

“তোর বাবার ভাগের সম্পত্তি কি ছেড়ে দিবি নাকি? পৈত্রিক সূত্রে তোরা দুবোন যা পাবি তা দিয়ে নিজেদের বাড়িও হবে, ভবিষ্যতও নিশ্চিত থাকবে। তুই এখন প্রাপ্তবয়স্ক। দাদার বাড়ির সম্পত্তির দাবিদার। এটা তো মগের মুল্লুক না যে কেড়েকুড়ে তোদের চাচারা সব ভোগ করবে। দেশে আইনকানুন বলে কিছু আছে। আমি লড়ব তোদের হয়ে।”

প্রিয়া দেখল মামার চোখদুটো চকচক করছে। ভাগ্নীদের হয়ে নিজের দায়িত্ববোধ দেখাতে তিনি মরিয়া। নাকি সম্পত্তির লভ্যাংশ পেতে? মুনিরা বেগম ভাইয়ের বাসনা ধরে ফেলেছেন আরো আগেই৷ ইদানীং প্রায়ই ফোন দিয়ে ভাইজান এইসব কথা বলেন। আজ একেবারে চলেই এসেছেন। স্বার্থ ছাড়া কেউ কেন যে তাদের দিকে তাকায় না! মুনিরা বেগম জ্ব’ল’ন্ত দীর্ঘশ্বাসটা বুকের মাঝে চেপে বললেন,

“ভাইজান, আপনাকে তো আগেও বলেছি আমি আইনের জটিলতায় যাব না।”

“কেন যাবি না? তোর মেয়েদের কি কোনো ভবিষ্যত নাই? তোর ভবিষ্যত নাই? এই স্যাঁতস্যাঁতে টিনের ঘরে পড়ে পড়ে জীবন কাটাবি? তোর জামাই জেল থেকে বেরিয়ে তোদের উদ্ধার করবে সেই আশায় থাকবি কেন? তুই তো হাত পেতে নিতে যাচ্ছিস না। নিজেদের অধিকার নিবি।”

“অধিকার নিতে গিয়ে যদি তারা ক্ষু’ব্ধ হয়ে আমার ফুটফুটে দুই মেয়ের ক্ষতি করতে আসে তখন কে দেখবে, ভাইজান? আইন যেমন আছে আইনের ফাঁক ফোকরও আছে। মনে রাখবেন আইন অন্ধ। যা দেখানো হবে তাই দেখবে। প্রিয়ার চাচারা নিজেদের স্বার্থে ভাস্তিদের চেয়েও দেখবে না। তাদের টাকার মায়ার কাছে সম্পর্কের মায়া তুচ্ছ। দুটো মেয়েই আমার জীবন। তাদের সুস্থতার চেয়ে বড়ো সম্পদ কিছু নাই।”

প্রিয়া মায়ের পায়ের কাছে এসে চুপচাপ বসে। আলতো হাতে পায়ের অসাড় আঙুলগুলো টিপে দেয়। এই মানুষটা স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে না পারলেও বুদ্ধির হাঁটাচলা সুদূরপ্রসারী। লোভে পড়ে হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। আগে পারিপার্শ্বিক অবস্থাও খেয়াল করেন।
প্রিয়া দেখে ফোনটা কাঁপছে। অনুভবের ফোন। নানান মানসিক চাপে আজকাল অনুভবের সঙ্গেও কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। কিন্তু সেই ছেলে কী কম ত্যাদড়! না ধরা পর্যন্ত একটানা কল দিয়েই যাবে। প্রিয়া ফোন নিয়ে উঠে গেল। বাইরে গিয়ে ফোন রিসিভ করে বলল,
“বলুন?”

কথোপকথনের শুরুতেই আকাঙ্ক্ষিত রমনী বিরস গলার স্বর শুনে অনুভব বলল,
“কী ব্যাপার? কণ্ঠ এতটা নিস্পৃহ কেন? আমার ফোনে তুমি বিরক্ত?”

“এত ঘন ঘন ফোন করার জন্য কী উচ্ছ্বসিত হওয়ার কথা?” প্রিয়া সোজাসাপটা জবাব দিল।

অনুভব আহ’ত হয়। বলে,
“ঘন ঘন মানে? সেই সকালে একবার ফোন দিয়েছিলাম, আর মাত্র দিলাম।”

“অকাজের ফোন আমার কাছে ঘন ঘনই মনে হয়।”

“এত নিরামিষ কেন তুমি? তোমার তো উল্লাসে ফেটে পড়া উচিৎ যে সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটা এত এত সুন্দরীদের পাত্তা না দিয়ে তোমায় যেচে ফোন করছে।”

বিপরীত ব্যক্তিটি দেখবে না জেনেও প্রিয়া ঠোঁট বাঁকায়। বলে “রূপ নিয়ে খুব গর্ব আপনার?”

অনুভব ভাবের সঙ্গে বলল, “প্রতিপক্ষ যখন নিজেকে মুরুব্বি হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করে তখন আমারও জাহির করার মতো কিছু থাকা উচিত। ঠিক কিনা?”

প্রিয়া ঠোঁট টিপে হাসে। অনুভব পুনরায় বলল,
“রাতে খেয়েছো, হাসু?”

“খেয়েছি, অনু ভাইয়া?”

“হোয়াট ননসেন্স! অনু ভাইয়া আবার কী?”

“আমারও একই প্রশ্ন, হাসু আবার কী?”

অনুভব দুষ্টু হাসে, “আচ্ছা! শোধ নিচ্ছেন আপনি! কান খুলে শুনুন, আপনি আমার হাঁসমার্কা হাসু হয়েই থাকবেন চিরজীবন।”

“চিরজীবন!” স্বগোতক্তি করে প্রিয়া। বিহ্বল হয় তার চিত্ত। রাতের ভারী বাতাস হঠাৎ পূবালী দমকা হাওয়ায় লীন হয়ে ফুরফুরে হয়ে যায়৷ মনের অলিন্দে সুদর্শন কেউ এসে চুপি চুপি আসর বসায়। প্রিয়া ভেবে পায় না এই ছেলেটা তাকে এত চায় কেন? কী এমন আছে তার মাঝে? অসুন্দরী প্রিয়া নয়, এটুকু ধারণা তার নিজের সম্পর্কে আছে। গড়পড়তা বাঙালির চোখে সে রূপবতী তরুণী। কিন্তু অনুভবের সুদর্শনতার কাছে তা নিতান্তই ফিকে। সে কী ওই নিখুঁত পুরুষটির আগ্রাসী প্লাবনে ভাসা প্রণয়ের যোগ্য! প্রিয়া ম্লান স্বরে বলে,
“পান থেকে চুন খসলে গায়ে ফোসকা পড়ে আপনার। পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করেন। অথচ এত যে অবহেলা করি, সে বেলায় আপনার গায়ে লাগে না!”

“কারণ আমি জানি, সব বিষয়ে মুরুব্বি হলেও দ্য গ্রেট হিটলার লেডি এই একটা বিষয়েই নির্বোধ আর ভীতু। তাকে আমাকেই শিখিয়ে পড়িয়ে প্রেমিকা বানাতে হবে। মাস্টার হিসেবে আমি খুবই স্ট্রিক্ট। ছাত্রী পড়া না শেখা অবধি হাল ছাড়ব না।”

প্রিয়ার পক্ষ থেকে জবাব না পেয়ে অনুভব ব্যগ্র স্বরে বলে, “এই মেয়ে! কথা বলো না কেন?”

“কী বলব?

অনুভব দাম্ভিক কণ্ঠে বলল, “দ্য মোস্ট হ্যান্ডসাম গায় ইউ হ্যাভ এভার সিন, সে তোমায় হাসু বলে ডাকবে তার অন্তিম শ্বাস অবধি। তোমার তো গর্ব হওয়া উচিত।”

প্রিয়া নিঃশব্দে হাসে৷ প্রকাশ করে না সে অভিব্যক্তি। গম্ভীর স্বরে বলে,
“গর্বে বুক ফেটে যাচ্ছে আমার। এখন রাখি।”

“আরেকটা কথা…”

“আবার কী?”

“প্রিয়া জানলে হিংসে করবে যে, হাসু ইজ দ্য মোস্ট বিউটিফুল লেডি আই হ্যাভ এভার সিন ইন মাই লাইফ।”

কণ্ঠের নিরবতায় নিশ্বাসেরা সরব হয়। ছড়ায় মা’দ’কতা। ঘনিয়ে আসা তমসায় মৃদু পূবালী হাওয়ায় মন এলিয়ে অনুভব ফিসফিস করে বলল,
“হাসু লজ্জা পাচ্ছে? নাকি প্রিয়া হিংসে করছে?”

প্রিয়া তড়িঘড়ি করে ফোন কাটে। অনুভব ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসে। এই মেয়ে আজ আর তার ফোন ধরবে না।

চলবে….

প্রিয়ানুভব পর্ব-১১

0

#প্রিয়ানুভব [১১]
প্রভা আফরিন

চাকরি যাওয়ার পর প্রায় দিন পনেরো বেকার ছিল প্রিয়া। এরপর অনুভবের মারফতেই মাসখানেক হলো ওর টিউশনি জুটেছে ঝিগাতলায়। মাস গেলে ছয় হাজার টাকা বেতন। দুই ঘন্টা পড়াতে হয়। প্রিয়া রোজ বিকেলে পড়িয়ে আসে। স্টুডেন্ট-এর বাবা একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। মা হাউজ ওয়াইফ। প্রিয়াকে কোনো নাশতা দেন না তারা। ভাড়া বাঁচাতে রোজ হেঁটে হেঁটে পড়াতে গিয়ে প্রিয়া বেশ ক্লান্ত হয়ে যায়। প্রথম দুদিন চেয়ে নিয়ে পানি খেয়েছিল। পরে চক্ষুলজ্জায় সেটুকুও হয়ে ওঠেনি বলে ব্যাগে করে পানি নিয়ে যায়।
আজ একটা বিপত্তি ঘটে গেল। ফেরার পথে জুতোর তলি ছুটে গেছে। ফেলে দিয়ে চলে যেতে চাইল না ও। এমনিতেই টাকার সংকট। ছয় হাজারে বাড়ি ভাড়া দিয়ে খাওয়ার টাকাই মিলবে না। নতুন জুতো সেখানে অলীক কল্পনা। বরং অল্প টাকায় সেলাই করে পরা যাবে আরো কিছুদিন। প্রিয়া আরেকটা টিউশনি খুঁজছে। নয়তো খেয়ে-পরে বাঁচা কষ্টের হয়ে যাবে। অনুভবও যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। বিপদে ছেলেটি এভাবে শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে সাহায্য করে চলেছে বলেই কিনা প্রিয়া তার প্রতি সীমাহীন কৃতজ্ঞ। এদিকে অনুভবের নিজেরই টিউশনি করিয়ে চলতে হবে চাকরি না পাওয়া অবধি। তবে সে স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং অভিজ্ঞ হওয়ায় টাকার অংকটা একটু বেশি। সেই হিসেবে প্রিয়ার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা দুই-ই কম। এলোমেলো ভাবতে ভাবতে পা ঘষটে হাঁটছিল প্রিয়া। হুট করে কেউ বাহু ধরে টান দিল। প্রিয়া আকস্মিক ভড়কে গেলেও বিপরীত ব্যক্তির দেহ নির্গত নিজস্ব গন্ধটা পরিচিত ঠেকল। কানে বাজল এক ঝগড়ুটে পুরুষের কর্কশ সুর,

“এই মেয়ে, চোখ কি পকেটে নিয়ে ঘোরো? রাস্তায় হাঁটার সময় সামনে-পেছনে গাড়ি আছে কিনা খেয়াল করবে না?”

প্রিয়া নিজের ভারসাম্য সামলে তড়িৎ সরে দাঁড়ায়। একে তো হেঁটে অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া, তারওপর জুতো ছিঁড়ে সকলের সামনে ছ্যাঁচড়ে হাঁটা। প্রিয়ার মনটা এমনিতেই খারাপ ছিল। অনুভবের ধমক শুনে ওর রাগ হলো। ইদানীং তার অল্পতেই রাগ হচ্ছে। বলল,
“খেয়াল করলে কি এখানে দাঁড়িয়ে আপনার বকা শুনি?”

“আমি তোমাকে বকেছি?”

“তো কী রাস্তা ভর্তি লোকের সামনে আদর করছেন?”

মুখ ফসকে বলে প্রিয়া ঠোঁট টিপে থেমে যায়। রাগটা উবে গিয়ে ধরা দেয় সংকোচ। অনুভব চোখ ছোটো করে তাকায়। উচ্চতায় প্রিয়া তার কাঁধসম। একটু ঝুঁকে এসে দুষ্টু হেসে বলে উঠল,

“তুমি কি রাস্তা ভর্তি লোকের সামনে তাই চাইছিলে, হাসু?”

প্রিয়া সেই দৃষ্টির প্রগাঢ়তার সামনে বিমূঢ় হয়ে যায়। যেন জ্ব’লন্ত আ’গুনে পানি পড়েছে এমন ভাবে চুপসে যায়। অনুভব চুলে আঙুল চালিয়ে বলে,
“অবশ্য হ্যান্ডসাম ছেলেদের থেকে মেয়েরা শাসন আশা করে না। তার বদলে একটু আকটু আদর, আশকারা, যত্নই কামনা করে। বুঝি আমি।”

“কচু বোঝেন।”

প্রিয়ার অতিশয় অপ্রতিভ। এ ধরনের কথা তার সংকোচ বাড়িয়ে দেয়। স্বাচ্ছন্দ্য পায় না। অনুভব তা খেয়াল করে ঠোঁটের কোণের উষ্ণ হাসিটা আরেকটু চওড়া করে। ক্ষীণ স্বরে বলে,
“লজ্জা পাচ্ছো কেন?”

প্রিয়া ত্যক্ত স্বরে বলল,
“ধুর, আপনি ভালো না।”

অনুভব অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল,
“দুষ্টুমি তোমার মনে আর আমি ভালো না?”

প্রিয়া উত্তর না দিয়ে পাশ কাটাতে চাইল। অনুভব মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, কানের কাছে ঝুঁকে এসে আবেগমথিত স্বরে বলল,
“তুমি চাইলে কিন্তু রাস্তার মাঝে সেটাও পারব।”

ব্যস্ত রাস্তা ধরে ছুটে চলেছে একের পর যান। গাড়ির হর্ন, হকারদের ডাক, রিক্সার ক্রিং ক্রিং কিংবা পথচারীদের হইচই কোনোটাই প্রিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে না। একটু আগের গাঢ় স্বরের শব্দতরঙ্গ প্রিয়ার সর্বাঙ্গে শিহরণের ঢল নামিয়েছে। গা ঘেঁষে দাঁড়ানো স্বঘোষিত সুন্দর পুরুষটির স্পৃহা জাগানো দৃষ্টিতে চোখ রেখে প্রিয়ার বুকটা ধ্বক করে ওঠে। অষ্টাদশী হৃদয়ে ছড়ায় অচেনা বার্তা। ব্যস্ত রাস্তার বিরক্তিকর পরিবেশে মুখোমুখি, কাছাকাছি দাঁড়িয়ে যা হওয়ার কথা ছিল না, যা কল্পনাতেও ঠাঁই পায়নি ঠিক তাই হয়ে গেছে। ধুলো ওড়ানো গরম, অস্বস্তিকর, কোলাহলময় পরিবেশে সবচেয়ে সুন্দরতম দৃষ্টিবদল ঘটে গেছে। পরিবারের চিন্তা, অর্থের ভাবনা, সম্মান বাঁচিয়ে চলা তটস্থ মস্তিষ্কের এক ফাঁকে উঁকি দিয়েছে সাতরঙা কিরণ। যাতে লেগে আছে নতুন অনুভূতির আবেশ। সেই প্রথম প্রিয়ার উপলব্ধি হলো পুরুষের অনুরাগ আক্রান্ত দৃষ্টি ছু’রির চেয়েও ধা’রালো হয়। যা হৃদয়কে এফোঁ’ড়’ওফোঁ’ড় করে দিতে সক্ষম। এটাকে যে অনুরাগ আক্রান্ত দৃষ্টি বলে তা ওকে কেউ বলে দেয়নি, শিখিয়ে দেয়নি। তবুও প্রিয়ার মন বুঝে গেল। কী অবাক করা কান্ড! তার অগোচরেই মনটা সব শিখে যাচ্ছে! প্রিয়া চোখ নামিয়ে নেয়। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে কণ্ঠে শব্দ জুগিয়ে বলে,
“পথ ছাড়ুন।”

প্রিয়ার কাজ করে খসখসে হয়ে যাওয়া সরু আঙুলগুলো তখন অনুভবের বলশালী আঙুলের ভাজে বন্দী হয়েছে। মেয়েটির হাত অস্বাভাবিক ঘামছে। ছাড়িয়ে নিতে চাইছে। অনুভব হাত ছাড়ল না। বরং শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। আগের মতোই গাঢ় ও তীব্র স্বরে বলল,
“ছাড়ার জন্য ধরেছি নাকি!”

হুট করে একজন রিকশাওয়ালা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তেরছা স্বরে বলে উঠল,
“রাস্তাও আজকাল পার্ক হইয়া গেছে!”

প্রিয়া লজ্জায় মুখ লুকানোর স্থান খোঁজে। সরে যেতে চায়। কিন্তু পুরুষালি হাতের ভাজ থেকে নিস্তার মেলে না। অনুভব রিকশাওয়ালার কথাটা লুফে নিয়ে সহাস্য উত্তর দিল,
“শোনেন মামা, প্রেম যু’দ্ধক্ষেত্রকেও নন্দনকানন বানাতে পারে। আর এটা তো সামান্য রাস্তা। প্রেমিকের চোখে গুলিস্তানও গুলশান।”

উচ্চস্বরের রসিকতার ফলেই আশেপাশের উৎসুক মানুষ নজর ঘুরিয়ে দেখল ওদের। কেউ ঠোঁট টিপে হাসল, কেউ বিরক্ত হলো যুব সমাজের অবক্ষয়ে, কারো আবার কিছুই এলো গেল না। এতক্ষণে অনুভবের খেয়াল হলো ওর পায়ের দিকে। ঘন সুন্দর দুটি ভ্রুর মাঝে ভাজ ফেলে বলল,
“আচ্ছা, এই কারণে পা ছ্যাঁচড়ে হাঁটছিলে!”

প্রিয়া ইতস্তত করে বলল,
“হুট করে ছুটে গেল। আপনি এখানে হঠাৎ?” কথা ঘোরানোর চেষ্টা।

অনুভব বলল,
“সাইন্সল্যাব এসেছিলাম। এই সময় তোমার টিউশন শেষ হওয়ার কথা তাই ভাবলাম দেখা করে যাই। এসে দেখি গাড়ির নিচে চাপা পড়তে মহানন্দে রাস্তা ধরে হাঁটছো। মানে দুনিয়ার সমস্ত দুশ্চিন্তা রাস্তায় বের হলেই কেন করতে হবে? বাসায় একটু ফেলে আসা যায় না?”

প্রিয়া ধমক খেয়ে গোমড়া মুখে বলল, “দুশ্চিন্তা যদি ধরার মতো কিংবা ছাড়ানোর মতো বস্তু হতো তাহলে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসতাম।”

অনুভব হেসে ফেলল, “ধরা, ছোঁড়া না গেলেও কন্ট্রোল করা যায়। ইউ নিড সামথিং স্পেশাল ফর থিংক।”

“মানে?”

অনুভব জাদরেল হাসিটা ঠোঁটে এঁটে নিচু গলায় বলল,
“নতুন কিছু ভাবো, নতুন অনুভূতিকে ভাবো। সবচেয়ে সুন্দর পুরুষকে মনে ঢুকতে দাও। দেখবে সুন্দর পুরুষটা মন থেকে সব দুশ্চিন্তাদের ঝেটিয়ে বিদায় করে দিয়েছে।”

প্রিয়া মুখ কুচকে ফেলল, “ফালতু কথা।”

“আরে একবার এপ্লাই তো করে দেখো। কার্যকর না হলে সুন্দর পুরুষটাকে তুমিও ঝেটিয়ে বিদায় করবে। যে অনুরাগী তার অনুরাগিনীর মন দখল করতে পারে না তার কোনো অধিকার নেই সেই মনে থাকার।”

প্রিয়া থুতনিতে হাত রাখে। ঠোঁট উলটে ভাবুক স্বরে বলে, “এখন সুন্দর পুরুষ কোথায় পাই?”

অনুভবের মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল সে কথায়। ভীষণ রেগে গমগমে স্বরে বলল, “ফকফকা আলোতে দাঁড়িয়ে তুমি সুন্দর পুরুষ দেখতে পাও না? চোখটা গেছে, চশমা লাগবে মনে হচ্ছে।”

“আলোও ফকফকা, আমার চোখও ঠিক আছে।”

“তাহলে কি বলতে চাও আমি সুন্দর নই তোমার চোখে?” অনুভব একই সঙ্গে আহত ও বিস্মিত হয়।

“ওহহ আচ্ছা, আপনি তাহলে এতক্ষণ নিজের জন্য বলছিলেন?”

প্রিয়ার ঠোঁটে চাপা হাসি। অনুভব চোখ ছোটো করে তাকায়। কতটা বদ এই মেয়ে! মুখ থেকে কথা স্বীকার করিয়ে নিল! অনুভব ওর কপালে ঠুকে দিয়ে হতাশ গলায় বলল,
“বুঝেছি, আমাকেই নতি স্বীকার করতে হবে। সারাজীবন মেয়েরা আমাকে পটাতে ছুটেছে, আর এখন আমাকেই কিনা এইটুকুনি মেয়ের চোখ রাঙানি দেখতে হচ্ছে! কী অধঃপতন আমার! এ জন্যই বলে সব ভালো, প্রেম ভালো না।”

প্রিয়া অসহিষ্ণু হয়। প্রেম, ভালোবাসা কিংবা এ ধরনের হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক নিয়ে সে কখনোই বিশেষ ভাবেনি। আর এখন তো ভাবতে ইচ্ছেও করে না। কিন্তু এই পাগল গোছের লোকের পাল্লায় পড়ে আজকাল মনের ভেতর কিছু বুদবুদ সৃষ্টি হয়। প্রিয়া তা দমিয়ে রাখতে চায়। তার জীবনটা এখন আর আবেগের পাল্লায় ভেসে বেড়ানোর নয়। না শাড়ি, চুড়ি, সাজগোজ কিংবা বয়ফ্রেন্ড নিয়ে মেতে থাকার। পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ করাই তার উদ্দেশ্য। অনুভবের জীবনে কেউ নেই, তাই সে দায়িত্বের গুরুত্ব হয়তো তেমন বোঝেও না। না ভেবেই দুমদাম কথা বলে ফেলে, কাজ করে ফেলে। পাগলের পাল্লায় পড়ে প্রিয়ারও পাগল হলে চলবে না। সে বিরক্ত হয়ে বলল,

“এসব কথা শুনতে ভালো লাগছে না আমার।”

“তা লাগবে কেন? আস্ত রসকষহীন মেয়ে। এখন এই স্লিপার ফেলে দাও। চলো নতুন কিনি।”

প্রিয়া এবার নিজের স্বভাবসুলভ গম্ভীরতায় ফিরে গেল। এই ভয়টাই করছিল এতক্ষণ। স্পষ্ট গলায় বলল,
“নতুন কেনার ইচ্ছে নেই। এটাকে সেলাই করে নেব। আপনি যদি একান্তই সাহায্য করতে চান তাহলে আমাকে মুচি মামার কাছে নিয়ে চলুন।”

ইচ্ছে নেই কথাটার অর্থ যে কেনার অপারগতা অনুভবের বুঝতে অসুবিধা হয় না। জোর করে কিনে দেওয়া যায়, তবে এতে আত্মসম্মানী প্রিয়া তার সামনে সংকুচিত হয়ে পড়বে। সমস্যার কথা খুলে বলতে পারবে না। তার চেয়ে প্রিয়ার মতো এগোলে মেয়েটা সহজ হবে। অনুভব ওর কথা মেনে মুচির খোঁজে এগোয়।
অবশ্য আরেকটা গোপন সত্যি হলো ভাইয়ার সাহায্য থেকে বেরিয়ে আসার পর অনুভবের পকেটের অবস্থাও আহামরি ভালো নয়। ভাবীর মাকে অপমান করার দায়ে ভাবী তার ওপর নারাজ হয়েছে। পিতা-মাতাহীন বখে যাওয়া সন্তান রূপে তাকে চরম ভর্ৎসনা করা হয়েছে। ভাইয়া সামনাসামনি কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু অনুভবের কেন জানি রুচি হয়নি। সে টের পেয়েছে ভাইয়ার কণ্ঠেও অসন্তোষের ছায়া। অনুভবকে বোঝানোর সময় ভাইয়া বারংবার মনে করাতে ভোলে না ছোটো ভাইকে সব ভরনপোষণ দিচ্ছে, কতটা পরিশ্রম আছে সেই ভরনপোষণ জোগাড়ে। তাই ছোটো ভাইয়ের উচিত কৃতজ্ঞ থাকা।

অকৃতজ্ঞ অনুভব হয়নি। ভাইয়া-ভাবীর সংসারে মাথা নত করে থেকে তাদের মন জুগিয়ে চলে, বাড়ির কাজ যতটা সম্ভব কমিয়ে নিজের তরফ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে সে কার্পণ্য করেনি। অথচ একটা ঘটনায় পারিবারিক, সাংসারিক ছেলেটা এক লহমায় বখে গেল! কারণ অ’প’রাধীর মেয়ের জন্য ভাবীর মাকে খোঁটা দিয়ে উচিত কথা শুনিয়েছে।
অনুভব বুঝে গেছে, অনেক তো হলো অন্যের ছায়ায় বাঁচা। এবার নিজের জন্য ছায়া তৈরি করতে হবে। পথ মসৃণ নয়। কিন্তু হাল ছাড়া যাবে বা। ছায়া তৈরি হোক বা না হোক অনুভব তার ভাইয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাতে কখনোই ভুলবে না। সত্যিই তো বাবা-মায়ের পরলোক গমনের পর ভাই না দেখলে সে ভেসে যেত। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা তার আত্মার কাছে দায়বদ্ধতা। ভবিষ্যতে তাদের কোনো সাহায্যে লাগতে পারলে অনুভব হাসিমুখেই তা করবে।

ভাইয়ার ছায়া থেকে বেরিয়ে অনুভব যে শুধু নিজের ছায়া গড়তে চাইছে বিষয়টা একমাত্র তাই নয়। সে উপলব্ধি করতে শুরু করেছে অধিকার নিয়ে আরেকজনের ছায়াও হতে হবে, অভিভাবক হতে হবে। সেটা যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল। কী অদ্ভুত! দু-মাস আগের অনুভবও কী এভাবে দায়িত্বের কথা ভাবত! কিন্তু এখন তাই ভাবছে। পরিস্থিতি তাকে ধীরে ধীরে বাস্তবতা চেনাচ্ছে। খামখেয়ালিপনা, নির্ভার চলাফেরা হ্রাস পেয়ে দুষ্টু ছেলেটির মাঝে একটি দায়িত্বশীল পুরুষের সৃষ্টি হচ্ছে। প্রিয়ার সব হারিয়ে তার বাড়িতে চাকরি নিতে আসা, বিশ্রী পরিস্থিতিতে পড়ে আবার সেই চাকরিটা চলে যাওয়া এক অর্থে অনুভবের জীবনকেও প্রভাবিত করেছে। কী অদ্ভুতভাবে দুটো অচেনা, অজানা মানুষের পথ এক গলিতে এসে মিলেছে! ওরা দুজন পাশাপাশি হাঁটছিল। নিরবতা ভেঙে অনুভব বলল,

“তুমি আমার জীবনের গতিপথ বদলের নিমিত্ত। সুতরাং অদূর, অচেনা ভবিষ্যতের অক্লান্ত যাত্রায় তোমাকে আমি ছাড়ছি না। যতবার হোঁচট খেয়ে পড়ব, তুমি সেবা করবে।”

প্রিয়া জবাব দিল রয়েসয়ে। স্বভাবসুলভ নির্লিপ্ত স্বরেই বলল,
“এই নীতি মানলে আপনার বাড়িতে আমি যার নিমিত্তে চাকরি পেয়েছি তাকে গিয়ে ধরুন। কারণ সে চাকরির হদিস না দিলে আমি যেতাম না, আপনিও অনিশ্চিত জীবনে পড়তেন না।”

একটা আবেগঘন কথার বিপরীতে এহেন জবাবে অনুভব মর্মাহত। কটমট করে বলল,
“তাহলে তো যে তোমাকে বাড়ি ছাড়া করেছে তাকে আগে ধরা উচিত। না সে তোমায় বাড়ি ছাড়া করত, না তুমি কাজের খোঁজ করতে, আর না আমাদের বাড়িতে এসে আমার মনে সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরুতে।”

“গুড আইডিয়া, আপনি প্লিজ আমার চাচিকে গিয়ে ধরুন। আপনি যে মানুষ, আমার বিশ্বাস চাচি দুইদিনেই পাগল হয়ে যাবে।”

অনুভব ফোঁস ফোঁস করে ওঠে। তার মতো মোস্ট ডিজায়ার এক পুরুষকে এভাবে অপমান! নারী জাতি শুনলে ওর মান থাকবে! অনুভব দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “হাঁসের বাচ্চা হাসু, তুমি একদিন আমার হাতে মা র্ডা র হয়ে যাবে শিওর। পারব না মুচি খুঁজে দিতে। নিজে খুঁজে নাও গিয়ে, বদ মেয়ে।”

প্রিয়া বাধ্য মেয়ের মতো চলে যাচ্ছিল। অনুভব তা দেখে আরো ক্ষেপল,
“আজব! এরপরেও আমায় সরি বলবে না?”

“সত্যি কথা বললে সরি বলতে হয় বুঝি?” প্রিয়া পাত্তা না দেওয়ার সুরে বলে।

অনুভব মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে বলে, “তুমি সরি বলবে কেন? দোষ তো আমার। আমিই সরি। তোমার পাশে থাকতে চাওয়ায় সরি, তোমাকে ভালোবাসতে চাওয়ায় সরি, তোমাকে পাশে পাওয়ার বাসনা করায় সরি। আর কিছুর জন্য সরি বলা বাদ পড়ল, মাননীয়া?”

“হু, এই ওভারএক্টিংয়ের জন্য আরেকটা সরি।”

“হাসুরে…”

প্রিয়া হাসি চেপে জুতো হাতে নিয়ে ছুট দিল। বাড়ি ফিরে সে কল করল অনুভবের ফোনে। অনুভব রিসিভ করে গম্ভীর গলায় বলল,
“কী? সরি বলবে?”

“বলছিলাম যে, আমি সরি বলতে না পারলেও ধন্যবাদ দিতে জানি৷ আপনাকে ধন্যবাদ আমার পাশে থাকার জন্য। কঠিন দিনগুলো একটু সহজ হতে সাহায্য করার জন্য।”

চলবে…

প্রিয়ানুভব পর্ব-১০

0

#প্রিয়ানুভব [১০]
লেখা: প্রভা আফরিন

বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেকটা দূর এসে প্রিয়ার হাতের টানে থামতে হলো অনুভবকে। সময় দুপুরের দ্বারপ্রান্তে। সূর্যের তেজ মিঠে। নিরাক পথে জনসমাগম স্বল্পতায় কিছু শালিক নেমে হাঁটাহাঁটি করছি। অনুভব পথের ধারে গতি রোধ করে হঠাৎ প্রিয়ার হাত উঁচু করে ধরে দেখতে দেখতে বলল,
“কেমন লাল হয়ে আছে হাতটা! জ্বলুনি কমেছে?”

প্রিয়া সে কথার জবাব দিল না। তার দুচোখে জল টলমল। দেহের ক্ষতের চেয়েও সম্মানের ক্ষত তাকে আহত করেছে বেশি। অনুভবের কর্তৃত্বপূর্ণ বন্ধন থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আমার জন্য আপনি কেন ঝামেলা করতে গেলেন?”

অনুভবের রাগ তখনো তুঙ্গে। চকচকে ফরসা মুখটা লাল হয়ে আছে। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল,
“তো কি বুড়ির সামনে কাপড় খুলে প্রমাণ দেবে? চলো দিয়ে আসি।”

“ছি!” লজ্জায় প্রিয়ার দু-হাতে মুখ ঢাকে। দিনটা যদি মুছে দেওয়া যেত কিংবা ভুলে যাওয়া যেত! ছোটো জীবনে এহেন নিম্নমানের অপদস্ততার শিকার তাকে কখনো হতে হয়নি।

কিছুটা সময় কেউ কোনো কথাই বলল না। তীব্র অস্বস্তি কাটিয়ে নিজের স্থানটুকু পরিষ্কার করতেই প্রিয়া বলল,
“বিশ্বাস করুন, আমি শুধু নিজের ভাগের খাবারটুকু বোনের জন্য নিয়েছি কয়েকবার। এছাড়া আর একটা দানাও না বলে নিইনি আপনাদের বাড়ি থেকে।”

“তোমার উচিত ছিল আগেই আমায় জানানো। আমার ভাইয়া যথেষ্ট বাস্তববাদী। বুড়ির গার্বেজ ব্রেইনের মতো বাপের দোষে মেয়েকে দোষী করত না। আগে যদি বুঝিয়ে রাখতাম এমন পরিস্থিতি হতো না।”

প্রিয়া কিঞ্চিৎ বিস্ময়ে বলল, “আপনি বিশ্বাস করেন আমায়?”

“একদমই না। তুমি আমায় সত্যিটা বলোনি।” একটু অভিমানী ঝংকার ওঠে তার কণ্ঠে।

প্রিয়া মিনমিনে স্বরে বলে, “এটা তো গর্ব করে বলার মতো কিছু না। তাছাড়া আপনি তো জিজ্ঞেস করেননি।”

অনুভব হাত উঁচিয়ে ইশারা করে বলল,
“ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বললে চড়িয়ে গাল লাল করে দেব।”

“আপনি আমায় মা’রার অধিকার রাখেন না।” প্রিয়া শিরদাঁড়া সোজা করে চায় অনুভবের দিকে। তার দুচোখে ক্ষোভ ভাসে।

“অবশ্যই রাখি।”

বলে অনুভব সত্যি সত্যিই প্রিয়ার গালে চড় বসিয়ে দিল। যদিও তা দেহের সর্বনিম্ন শক্তির পর্যায়ে পড়ে। কিংবা একটু ঘুরিয়ে বলা যায় থাবা দিয়ে মেয়েটির গালের কোমলত্ব কতটুকু তা যাচাই করে নিল। প্রিয়া কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে কেঁদে ফেলে। তা দেখে অনুভবের রাগ পড়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। হাত টেনে ধরে বলে,
“এই মেয়ে, মোটেও ব্যথা দিইনি আমি।”

“কিন্তু মে’রেছেন। আমায় কেউ কখনো মা’রেনি।” ভাঙা স্বরে জবাব দেয় প্রিয়া।

অনুভব ব্যস্ত হয়ে প্রিয়ার পোড়া হাতটা সযত্নে পুনরায় আগলে ধরে। অনুশোচিত স্বরে বলে,
“সরি! সরি!”
________________

অনুভব প্রিয়াকে নিয়ে একটি জুস কর্ণারের বাইরের দিককার বেঞ্চিতে বসেছে। উদ্দেশ্য প্রিয়াকে একটু সুস্থির করা। মাথার ওপর খোলা আকাশ, নীলচে আঁচল যেন একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বিছিয়ে আছে। মেঘেরা সেই আঁচলের গন্ধে মেখে উড়ছে। সংকোচে এখনো প্রিয়ার চোখের কোণ ভেজা। স্বাভাবিক গলায় কথা বললেও তাতে অপমানের আ’ঘা’ত লুকাতে পারছে না। ভান না জানা মানুষগুলো খোলা বইয়ের মতো হয়। অনুভূতি স্পষ্ট ভাসে চোখের তারায়। এদিক থেকে প্রিয়া ব্যতীক্রম। সে ভান না জানলেও খোলা বইয়ের মতো অতটা সহজপাঠ্য নয়। নিজের আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে পটু। কিন্তু শক্ত ইমারতও ভূমিকম্পের কবলে ভেঙে যায়, মজবুত বাধেও স্রোতের ধাক্কায় ফাঁটল ধরে। যেমনটা একজন নারী নিজের সম্মানের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। আজ প্রিয়ার পটুত্বে ছেঁদ পড়ছে বারবার। কিশোরীসুলভ প্রগলভতা লুকানো যাচ্ছে না কিছুতেই। মনের ভেতর অনেকদিন যাবত শে’কলব’ন্দী থেকে আজ কোমলতারা বিদ্রোহ করছে। ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসছে। অনুভবের স্নেহের সান্নিধ্য হয়তো আরেকটু উশকে দিচ্ছে।

অনুভব বলল,
সিরিয়াসলি! কখনো মা’র খাওনি? নাকি আমার সামনে ভাব খাচ্ছো?”

“উহু, আমি কখনো দুষ্টুমি করিনি। তাই মা’রার প্রশ্নও আসেনি।”

“গুড গার্ল! আমার মা তো উঠতে বসতে উত্তম-মধ্যম দিতেন। অন্যদের সঙ্গে ঝ’গড়া লাগলে দোষ যদি পরের হতো পি’টু’নি আমিই খেতাম। বাবার সঙ্গে ঝ’গড়া হলেও আমাকে হাতের কাছে পেয়েই ঝাঁঝ মেটাতেন। খেতে না চাইলে শলার ঝাড়ু সামনে নিয়ে ভাত গেলাতেন, খেলতে গিয়ে দেরিতে ফিরলে পি’টু’নি, দুপুরে ঘুমাতে না চাইলে পি’টু’নি, বিনা দোষে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলেও পি’টু’নি। বুঝতে পারছ, কী পরিমাণ স্ট্রাগলের ছিল আমার লাইফটা!”

প্রিয়া কপাল কুচকে তাকায়। বলে,
“আমার তো মনে হচ্ছে আপনার মায়ের লাইফটা স্ট্রাগলের ছিল। উঠতে বসতে পি’টু’নি তারাই খায় যারা মারাত্মক দুষ্টু।”

অনুভব মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে বলল,
“হয়তো ঠিকই বলেছ। মাকে দু-দণ্ড শান্তি দেইনি। দিন থেকে রাত সংসারের পেছনে খেটেছেন। মৃ’ত্যুর পরই বোধহয় প্রথম হাঁপ ছেড়েছেন। আচ্ছা সেসব বাদ দাও। গলা শুকিয়ে গেছে। আমি বানানা শেক নেব। তুমি কোন ফ্লেভার নেবে?”

প্রিয়া শুকনো গলায় বলল,
“খাব না।”

“ফর্মালিটি ছাড়ো। বড়োরা আদর করে কিছু দিলে ফেরাতে হয় না। নাকি আমি অপতিচিত কেউ?”

তেষ্টায় প্রিয়া ঢোক গিলছে বারবার। সকালে খাওয়াও হয়নি। সে আর সংকোচ করল না। মাথা নুইয়ে বলল,
“শুধু লাচ্ছি।”

অনুভব লাচ্ছির সঙ্গে বড়ো এক কাপ ফালুদা আনল। প্রিয়া নিষেধ করার আগেই বলল, “চুপচাপ খেয়ে নেবে, হাসু।”

আবারো সেই নাম! প্রিয়া বিরক্ত গলায় বলল,
“আপনি আমায় প্রিয়া ডেকেছেন। তাহলে আবার এই হাঁসমার্কা নাম কেন?”

“হাঁসমার্কা!” অনুভব যেন মজা পেল শব্দটা শুনে। বলল,
“হাঁস খুব কিউট একটা প্রাণী। তুমিও কিউট। তাই নাম এটাই থাকবে।”

“কেন? এখন তো লোকের উলটোপালটা ভাবার কারণ নেই। চাকরি গেছে আমার।”

অনুভব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে,
“আমার ঠাঁইও গেছে। বুড়ি নিশ্চয়ই রঙ মাখিয়ে মেয়ে-জামাইয়ের ব্রেইন ওয়াশ করে ফেলেছে এতক্ষণে। নিজের দায়িত্ব এখন থেকে নিজেকেই বইতে হবে।”

“কিছু বলছেন?”

“বলছি এখন কী করবে? কাজ-বাজ কিছু লাগবে তো। তোমার এ মাসের বেতন এনে দেব। কিন্তু পরে?”

“আপাতত টিউশন খুঁজব। ফুল টাইম জব করলে পড়াশোনা হবে না।”

“গ্রেইট! আমি খোঁজ নিয়ে জানাব তোমায়।”

প্রিয়া চুপচাপ ছিপ নেয় গ্লাসে। শুষ্ক দেহটি গতরাত থেকে খাদ্যবিনা দুর্বল। এক পশলা বৃষ্টি পেয়ে মরুভূমি যেমন খলবলিয়ে ওঠে, গলা দিয়ে তরলটুকু নামতেই প্রিয়ার শরীরটাও বুভুক্ষের মতো শুষে নিল। সামনের দিনগুলো কেমন কাটবে সেই আশঙ্কায় চিত্ত অস্থির। হয়তো এমনই অনেক না খাওয়া কিংবা আধপেটা দিন যাবে। কিন্তু দিয়া? বাচ্চা মেয়েটার বাড়ন্ত বয়স। আগের সেই স্বাস্থ্যসবল, গোলগাল দেহটা শুকিয়ে গেছে। সঙ্গে অসুস্থ মা। ওদের মুখের দিকে চেয়েও প্রিয়াকে শক্ত থাকতে হবে। সহ্যক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। কিন্তু যখনই মনে পড়ছে আজকের এই পরিস্থিতিটার পেছনে তার নিজের মানুষই দায়ী তখন ভেতরটা তেতো হয়ে যাচ্ছে।

অনুভব একদৃষ্টে দেখছে প্রিয়াকে। এই নির্ভীক মুখের দিকে তাকিয়ে ওর এক মুহূর্তের জন্যও মনে সন্দেহ জাগেনি প্রিয়ার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে। বরং মেয়েটির দৃঢ় ব্যক্তিত্ব সেই প্রথম থেকেই ওকে আকর্ষণ করে। দিনের পর দিন সেই আকর্ষণ হয়েছে দুর্বার। এবং আজ, সমস্ত দ্বিধা কেটে গেছে। মানব-মানবীর মধ্যাকার প্রেম-ভালোবাসা, মানসিক আবেগঘন সম্পর্ক বোঝার পর থেকেই অনুভব নিজ মনে প্রেমের প্রতিচ্ছবি তৈরি করেছে। সেই প্রতিচ্ছবিতে খাপ খাইয়ে নিতে জুড়েছে নানান বৈশিষ্ট্য, জেগেছে আকাঙ্খা। আজ অবধি সেই প্রতিচ্ছবির অনুরূপ বাস্তব কোনো নারী সে পায়নি। ভালো মেয়ে কি জোটেনি? অবশ্যই জুটেছে। রূপবতী, গুণবতী, নম্র-ভদ্র কত মেয়েই এসেছে। অনুভব একদিন কিংবা দুইদিন ডেটও করেছে তাদের সঙ্গে। এরপরই হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিছু না কিছু নিয়ে খুঁতখুঁত করেছে সর্বদা। আর আজ এই অখ্যাত জুস কর্ণারের সামনে মুক্ত আকাশের নিচে বসে অনুভব উপলব্ধি করল, ভালোবাসার মানুষটিকে আসলে দেখতে হয় মনের চোখ দিয়ে। যেই চোখ ত্রুটি বিচার করে না। যেই চোখ নিশ্চিত করে অপর মানুষটি তার হৃদয়ের সবচেয়ে কোমল স্থানটিকে আন্দোলিত করে। আসলে সে চর্মচক্ষু দিয়ে বাকিদের দিকে তাকিয়েছে বলেই জাজমেন্টাল হয়ে খুঁত খুঁজে বের করেছে।

প্রিয়া-ই একমাত্র মেয়ে যার প্রতি অনুভব কোনোদিন প্রেম হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে এমন দৃষ্টিতে দেখেনি। কোনোরূপ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাকায়নি। আর না খুঁত খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। বরং বয়সে প্রায় ছয় বছরের ছোটো অষ্টাদশী কন্যা তার অক্ষুণ্ণ স্বভাবের জৌলুশে অনুভবকে আকৃষ্ট করেছে, ভাবিয়েছে, ভড়কে দিয়েছে। মনের চোখটা কখন জাগ্রত হয়েছে টেরই পায়নি। আজকের দিনটা না এলে বোধহয় পেতোও না। তার জন্য কী এই দুঃসময়কে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত! নাকি মেয়েটিকে কাঁদানোর জন্য তিরস্কার করা উচিত! উচিত-অনুচিত যাই হোক অনুভব এখন নিজেকে সময় দিতে চায়। সম্ভাবনা শতভাগ কিনা নিশ্চিত হতে চায়। আশ্চর্য! বাড়ি ছাড়া হয়ে তার এখন চিন্তায় পড়া উচিত, চাকরির পড়া, ফাইনাল সেমিস্টারের পড়ার চাপে দিন-রাত ডুবে থাকা উচিত। বিষন্নতায় চোখ ডেবে গিয়ে চোখের নিচে এক ইঞ্চি পরিমান জায়গা জুড়ে কালি পড়া উচিত। অথচ অনুভবের ফুরফুরে লাগছে। মনের দ্বারে ফাগুনের অবিরাম বর্ষণ হচ্ছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে সকল অনুভূতিকে।

প্রিয়া খেতে খেতে আবারো কাঁদছে। চোখের পানি আটকাতে মাথা নুইয়ে এদিকে-ওদিক চাইছে। হঠাৎ অনুভব ওর চোখের কার্নিশে আঙুল ছুঁইয়ে বলল,
“দিনটা মুছে ফেলার ক্ষমতা আমার নেই। তবে এমন জঘন্যতম পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হতে দেব না। তোমার অশ্রু ছুঁয়ে বলছি।”

প্রিয়া কান্না গিলে সিক্ত গলায় উচ্চারণ করে,
“আপনি তো সব সময় থাকবেন না।”

“দূরে ঠেলে দিচ্ছো?”

“পাশে রাখার কথা?”

“ক্ষতি কী?”

“লড়াইটা আমার একার।” প্রিয়া মুখভঙ্গি শক্ত করে।

অনুভব ওর হাতটা শক্ত করে ধরে মুচকি হাসল,
“আই নো ইউ আর আ ব্রেইভ ফাইটার। আমি নাহয় পাশে রইলাম। আমার সঙ্গ এতটাও খারাপ নয়। ইউ নো, সুন্দরীরা আমার সঙ্গ পেতে কতটা মরিয়া।”

অনুভব ইশারায় অপর এক বেঞ্চির সুন্দরী রমনীদের দিকে ইশারা করে। মেয়েগুলোর সঙ্গে অনুভবের চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে না চাইতেও। প্রিয়া হাত ছাড়িয়ে নিয়ে খানিক ঝাঁঝের সঙ্গেই বলল,
“আমি মরিয়া নই, বাঁচিয়া থাকতে চাই। যারা মরিয়া তাদেরকেই সঙ্গটা দিন।”

“আর ইউ জেলাস, হাসু?”

প্রিয়া বিচলিত চোখে তাকিয়ে থাকে। অনুভব ওর মনটাকে ভিন্নদিকে ঘোরাতে পেরে সফলতার হাসি হাসে।

চলবে…

প্রিয়ানুভব পর্ব-০৯

0

#প্রিয়ানুভব [৯]
লেখা: প্রভা আফরিন

ক্যাম্পাসে অনুভবের একটি বন্ধুদল আছে। দলের নাম ‘সিসিমপুর’। যার সদস্য সংখ্যা চারজন। টুকটুকি, ইকরি, হালুম ও শিকু। অনুভব আছে সেই দলের শিকুর ভূমিকায়, যে নিজেকে অতিশয় চালাক, সুদর্শন ও স্মার্ট ভাবে এবং তার ভাবনা আসলে মিথ্যাও নয়। নারী মহলে তার কদর অতি উচ্চতায়। যাকে এককথায় বলে ক্রাশবয়। কিন্তু স্বভাবে অতি মাত্রায় খুঁতখুঁতে হওয়ায় কোনো প্রেম হয় না।
ওর বন্ধু হালুম বিত্তশালী পিতার মেধাবী পুত্র। যে কিনা পড়াশোনায় টপ করে, মায়াভরা মন, যত্নশীল এক পুরুষ। হ্যাংলা-পাতলা হলেও ভীষণ ভোজনরসিক। প্রেমে তার বিশেষ টান নেই।
দলের আরেক সদস্য টুকটুকি একটি স্বপ্নবিলাসী মেয়ে। স্বভাবে অতিশয় ছিঁচকাদুনে, চঞ্চল ও নরম মনের। আদর-আহ্লাদে ডুবে থাকতেই ভালোবাসে।
এবং শেষ ও ফুলস্টপ সদস্য হলো ইকরি, যে সকলের বোধগম্যতার বাইরে। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গুণ হলো পুরুষকে সম্মোহন করতে পারা৷ প্রেমে টইটম্বুর তার জীবন। এক্সের সংখ্যা অগণিত। ইকরির খেয়ালিপনা ও আচরণের বৈচিত্রতার ফলে বাকি বন্ধুরা তটস্থ হয়ে থাকে। তবে এ গল্পে ওদের উপস্থিতি অতি সামান্যই। ওদের নিয়ে অন্য কোনো সময় জানবেন। কেননা এ গল্প অনুভবের বন্ধুপরায়ণ শিকু সত্ত্বাটির নয়। এ গল্প প্রিয়ার জীবনের সঙ্গে জড়িত অনুভবের। এক অনুরাগিনীর অনুরাগমথিত পুরুষের।

সকালে প্রিয়ার হাতে মলম লাগিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাওয়ার ঘন্টাখানেক পর অনুভব ফিরে এলো। অর্ধেক পথ যাওয়ার পরই জানতে পেরেছে সকালের ক্লাসটা ক্যান্সেল হয়েছে। বন্ধুরাও কেউ ক্যাম্পাসে নেই। অনুভবেরও আর ইচ্ছে হলো না যাওয়ার। মাথায় ঘুরেফিরে ভাসছিল প্রিয়ার ম্লান মুখটা। মাঝপথ থেকে সে বাড়ির পথ ধরল আবার। নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে ভ্রু কুচকে যায় ওর। দরজাটা খোলা, সামনে একজন প্রতিবেশী আন্টি এবং ছুটা বুয়া দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে যেতেই ভেতর থেকে বুড়ির ভাঙা গলার কর্কশ স্বর শোনা গেল। তিনি প্রিয়াকে ধমকে বলছেন,

“কাপড় খোলো। কিছু যদি নাই নিয়ে থাকো তাহলে কাপড় খুলতে অসুবিধা কই?”

অনুভব হতবিহ্বল হয়ে ভেতরে ঢোকে। প্রিয়া নতমুখে নিরবে কাঁদছে। সামনে মূর্তিমান হয়ে জেরা করছেন জয়নব। গতকাল রাতেও মেয়ে-জামাইয়ের সামনে যিনি ঠিকমতো উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছিলেন না, আজ কোমড়ে আঁচল গুজে সটান দাঁড়িয়ে আছেন। অবশ্য অনুভব খেয়াল করেছে ভাইয়া-ভাবী বাড়িতে উপস্থিত থাকলেই উনার অসুস্থতা, বাতের ব্যথা, হাঁটুর ব্যথা, শ্বাসকষ্ট এবং বার্ধক্যজনিত সকল রোগের উৎপাত হয়। তা দেখে মেয়ে-জামাইয়ের উৎকণ্ঠার শেষ থাকে না। বাকি সময় তিনি ফুরফুরে মেজাজেই থাকেন। অনুভব কাশি দিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করে জানতে চাইল,

“এখানে কী হচ্ছে?”

প্রিয়া চোখ তুলে চেয়ে সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে নেয়। লজ্জার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়। আরও অপমান বাকি ছিল তার! ঠোঁট ভেঙে চিৎকার করে কান্না আসতে চাইছে। কিন্তু পরিস্থিতি গলা চেপে ধরেছে। ঠোঁট চেপে চুপচাপ দেখছে নিজের দুরবস্থা। ওর সমস্ত প্রতিবাদী সত্ত্বা মুষড়ে পড়ে বাবার কলঙ্কে।

জয়নব অনুভবকে দেখে দমলেন না। উৎসাহে বললেন,
“দেখো অনুভব, দুধ-কলা দিয়া কালসাপ পুষতাছি বাড়িতে। জেল খাটা আ’সা’মীর ঘরের মেয়ে বাড়িতে ঢুকিয়েছি। কে জানে কতকিছু সাফাই করেছে বাড়ি থেকে।”

অনুভব বিস্ময়ে তাকায় প্রিয়ার দিকে। সেই দৃষ্টির সামনে প্রিয়ার অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে অলৌকিক কিছু হোক, সে এই পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাক। আচ্ছা, অনুভব এসব বিশ্বাস করবে? সবার মতো বাবার দোষের ভাগ সন্তানের ওপর চাপিয়ে তাকে খারাপ ভাববে?

অনুভব বলল,
“আমি কিছু বুঝতে পারছি না। প্রিয়া, তুমি কী একটু সরাসরি বলবে ঘটনা কী?”

অনুভবের মুখে নিজের সঠিক নামটা শোনার ভীষণ ইচ্ছে ছিল প্রিয়ার। শোনা হলো, কিন্তু বড্ড অসময়ে। যখন সমস্ত পৃথিবী চাইছে সে কাঁদুক, মুখ লুকিয়ে বাঁচুক। অ’প’রাধীর পরিবারের নিষ্পাপ সদস্যদের ভালোমতো বাঁচার অধিকার নেই। আশেপাশের মানুষ তাদের ভালো থাকা দেখতে পারে না।

জয়নব বললেন,
“ও কী বলবে? আমি বলতেছি শুনো। এই মেয়ের বাপ বছরখানিক আগে কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের দায়ে জেলে গেছে। এদেরও স্বভাব চরিত্র ভালো না দেখে দাদার বাড়িতে টিকতে পারে নাই। বের করে দিছে। পরিচয় গোপন করে আমাদের জাইমের কেয়ারটেকারের কাজ নিছে। কত্ত বড়ো ধা’ন্দা’বাজ চিন্তা করছো!”

অনুভব প্রিয়ার দিকে তাকায়। প্রিয়া প্রতিবাদ করল, “আমি কখনোই পরিচয় গোপন করিনি।”

“চুপ, বে’য়া’দব মেয়ে। আমার অন্তরাকে ভোলাভালা পেয়ে সুযোগ বুঝে ঢুকে গেছো বাড়িতে। আল্লাহ জানে এতদিনে কত কত জিনিস বাড়ি থেকে পাচার করছো। সেদিনই খেয়াল করছিলাম ওড়নার তলে পোটলা করে কী জানি নিতাছে। আমার তখনই এই মেয়েরে সন্দেহ হইছে।”

প্রিয়ার দিশেহারা লাগে। বোনের জন্য সে এ বাড়ি থেকে খাবার নিয়েছে কয়েকবার। কিন্তু সেটা নিজের ভাগেরটুকু। এছাড়া আর একটা দানাও এদিক থেকে ওদিক করেনি। আর সেটাই আজ তার বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে! প্রিয়া জোর কণ্ঠে বলল,
“জাইমের প্রতি নিজের দায়িত্ব পালনে কোনো ত্রুটি রাখিনি। আপনি নিজেই সব সময় চোখে চোখে রেখেছেন আমায়। কখনো দোষ ধরতে পারেননি। আজ শুধু বাবার পরিচয়ে আমার সকল নিষ্ঠা কলুষিত হলো, আন্টি?”

“পরিচয়েই মানুষের চেনা যায়। হারাম খেয়ে বড়ো হইছ বলেই তো মায়ের চলাফেরার শক্তি নাই। মাথার উপরে ছাদ নাই।”

কথাটা প্রিয়াকে সজোরে ধাক্কা দেয়৷ সত্যিই কি তাই! বাবার হারাম টাকা পেটে গেছে বলেই এমন দুরবস্থা ওদের! অনুভব এক দৃষ্টে প্রিয়ার পরাজিত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সে আগেই বুঝেছিল প্রিয়া উচ্চবংশীয় পরিবারের। কিন্তু পরিচয়টা এতটা রূঢ় হবে ভাবেনি। দ্বিধা নেই অনুভবের সত্যিটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। আবার এটাও সঠিক বাবার পরিচয়ের জন্য প্রিয়াকে সে খারাপ ভাবতে পারছে না। মেয়েটির মার্জিত রুচিবোধ, স্পষ্টভাষী ও দৃঢ় আচরণ অনুভবের চেনা। স্বভাবে কোনো ধোয়াশা, ভণ্ডামি, কপটতা নেই। বিগত মাসগুলোতে একবারও তাকে স্বভাবের বিচ্যুতি ঘটাতে দেখেনি। বরং বিষন্ন মুখটায় অব্যক্ত য’ন্ত্র’ণা লেপ্টে থাকে সর্বদা। অল্প বয়সে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে কৈশোরের কোমলতা ভুলে নিজেকে চরম বাস্তবতায় ঠেলে দিয়েছে। শুধু বাবার পরিচয়টাকে মূখ্য করে দেখে মেয়েটির নিজস্বতাকে উপেক্ষা করতে পারে না অনুভব। হতে পারে প্রিয়া পরিস্থিতির শিকার।

প্রতিবেশীরা উৎসুক হয়ে বিনোদন দেখছিল। জয়নব আবারো চ্যাঁচিয়ে বলতে লেগেছেন,
“এখনো দাঁড়ায় আছো কোন সাহসে? কাপড় খুলতে বলছি না।”

“আপনি অহেতুক সন্দেহে এমনটা করতে পারেন না।” প্রিয়া দুর্বল কন্ঠে শেষ চেষ্টা করে। তাতে বৃদ্ধার গলার তেজ আরো বাড়ে,

“আমিও দেখি কাপড় চেক না করিয়ে কেমনে বাড়ির বাইরে পাও রাখো।”

নানির চিৎকারেই বোধহয় জাইমের ঘুম ভেঙে গেছে। বাচ্চাটা তারস্বরে কাঁদছে। প্রিয়া ওকে নিতে যেতে চাইল। বুড়ি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বলল,
“খবরদার তোমার নোংরা ছায়া আমার নাতির উপরে ফেলবা না।”

অনুভবের মেজাজ খারাপ হলো এবার। বলল,
“তো আপনার শুভ ছায়া কেন ফেলছেন না? ছেলেটা কী কেঁদেই যাবে?”

“বাচ্চা মানুষ কাঁদবেই। দুই এক মিনিটে কোনো ক্ষতি হয় না। আগে এই মেয়ের বিহিত করি।”

অনুভব বিরক্ত হয়ে প্রথমে সপাটে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করল। এরপর জাইমকে কোলে করে এনে বলল,
“কোনো রকম ইম্বেরেসিং ঘটনা ঘটবে না। ভাইয়া-ভাবী আসুক। তাদের সামনে ঠান্ডা মাথায় খোলাখুলি কথা হবে।”

“খোলাখুলির কিছু নাই। অন্তরাই একটু আগে আমায় ফোন করে সব জানিয়েছে। এই মেয়ের বড়ো চাচি নেহাৎ ভালো মানুষ। তাই আগেভাগে সাবধান করে দিছে। এখন আমি যা করব তাই।”

প্রিয়া বিস্ময়ে নির্বাক। বড়ো চাচি! শায়লা চাচি এতটা নিচে নামতে পারলেন! শুধুমাত্র উনার ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে সম্বন্ধ করতে রাজি না হওয়ায় এভাবে শোধ তুলল! চেনা মানুষের আর কত অচেনা রূপ দেখা বাকি আছে!

অনুভব ঠান্ডা স্বরে বলল,
“আপনি কী সিদ্ধান্ত নিতে চান?”

“ওকে এই মুহূর্তে কাজ ছাড়া করব।”

“এত অপমানের পর প্রিয়া এমনিতেও এই বাড়িতে কাজ করতে আসবে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। প্রিয়া, তুমি চলো।”

জয়নব অবাক হয়ে বললেন, “চলো মানে? আমি ওরে চেক না করে বাড়ির বাইরে যাইতে দিব না।”

অনুভবও শক্ত কণ্ঠে বলল, “আপনার কোন জিনিস হারিয়েছে?”

“কী হারিয়েছে সেইটা তো ওকে চেক করেই বুঝব।”

“আমিও ওকে চেক করতে দেব না। যদি কিছু হারিয়েই থাকে তো বলুন। এরপরে সিদ্ধান্ত নেব।”

জাইম অনুভবের কোল থেকে বারবার প্রিয়ার দিকে হাত বাড়াচ্ছে। আধো বুলিতে আতি আতি বু-বু-বু করে ডাকছে। বাচ্চাটা পুরোপুরি ওর ন্যাওটা হয়ে গেছে। শত অপমানের মাঝেও প্রিয়ার বুকে মমতা জাগে। কিন্তু সেই মমতাকে আশকারা দিয়ে অবুঝ শিশুটির ডাকে সাড়া দিতে পারে না।

জয়নব অনুভবের কথায় বেজায় চটেছেন। বাজখাঁই গলায় বললেন,
“সব জেনেও তুমি এমন কথা কি করে কও। এই মেয়ের প্রতি কীসের এত টান তোমার? কী দিয়ে বশ করছে?”

“বশ যে প্রিয়া করতে পারে না আপনিই তো তার জ্ব’লন্ত প্রমাণ। নয়তো এভাবে একজনকে শুধু বাবার পরিচয়ের জন্য হ্যারাস করেন!”

“তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করতেছো, অনুভব। থাকো তো আমার মাইয়ার সংসারে। পরের কান্ধে পাও দিয়ে চলো। সংসারের ভালোমন্দ তুমি কী বুঝবা?”

অনুভবের মেজাজ আরো চড়ে গেল। ভাইয়ের সংসারে থাকা নিয়ে এই মহিলা তাকে উঠতে বসতে ইশারা-ইঙ্গিতে খোঁটা দেয়। নিরবে হজম করতে করতে তারও দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। ভদ্রতা ভুলে সেও পাল্টা বলল,
“আমাকে নিয়ে তো আপনার মহা সমস্যা। আমি কি আপনার এক টাকা খসিয়েছি কখনো? আপনি কার কাঁধে পা দিয়ে চলেন বলুন তো? সংসারটা তো আপনারও না।”

জয়নব মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়েন। বলেন,
“দুই দিনের পোলা, রাস্তার মেয়ের জন্য তুমি আমারে খোঁটা দেও?”

“আপনি মনে হয় ফুল ছুঁড়তেছিলেন! আর রাস্তার মেয়ে কাকে বলছেন? এই যে এতক্ষণ নিজের আসল কদর্য চেহারাটা দেখালেন মেয়েটা কিন্তু বিপরীতে আপনাকে একটা কটূ কথাও বলেনি। এখানেই পার্থক্য কে কোন স্ট্যাটাসে বিলং করে।”

অনুভব বৃদ্ধাকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে আবার বলল,
“আর কী যেন বলছিলেন শুরুতে? দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পুষছেন? আপনি মনে হয় ভুলে গেছেন এই মেয়েটা শ্রমের বিনিময়ে খেটেছে। হাত পেতে কারো দয়া নেয়নি। আপনার মতোও জামাইয়ের সংসারে এসে পায়ের ওপর পা তুলে খায়না।”

অনুভবের এমন রাগ, উদ্ধত স্বভাব প্রিয়া বা জয়নব কেউ আগে দেখেনি। ফলে দুজনেই হতচকিত। অনুভব কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে জাইমকে বৃদ্ধার কোলে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“আপনার মান্ধাতা আমলের অলস, মরচে ধরা, কূটিল ব্রেইনটার বুদ্ধি মেয়ে-জামাইয়ের সামনে নাটুকে অসুখ করাতেই ভালো মানায়। অনেক তো আরাম করে খেয়ে ঝুলে পড়া চামড়ায় চর্বি ধরাইলেন। এখন নেন আপনার নাতি, গতর খাটিয়ে লালন-পালন করেন। আর আপনার মেয়ের সংসার গলায় ঝুলায় রাখেন।”

প্রিয়ার হাত ধরে বেরিয়ে এলো অনুভব। মনে মনে বদ্ধপরিকর এই বাড়িতে আর সে থাকবে না।

চলবে…

প্রিয়ানুভব পর্ব-০৮

0

#প্রিয়ানুভব [৮]
প্রভা আফরিন

এক মেদুর দিনের আদুরে বিকেলের কথা। কিশোরী প্রিয়া তখন সবে ক্লাস সেভেনে পড়ে। বাবা রেজাউল করীমের প্রতিদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরে চা খাওয়ার অভ্যাস। তিনি বাড়িতে থাকলে প্রতি দু’ঘন্টা অন্তর এক কাপ চা খেতেন। যার ফলে রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সিলেট থেকে আনা স্পেশাল চা পাতার সুঘ্রাণ নাকে সুড়সুড়ি দিতো সব সময়। একদিন প্রিয়ার ইচ্ছে হলো বাবাকে চা বানিয়ে খাওয়াবে। ভাবনার বাস্তবায়ন ঘটাতেই বাবার অফিস থেকে ফেরার সময়ে চুপিচুপি রান্নাঘরে ঢুকে চা বানাতে লেগে যায় সে। প্রথমবার নিজ হাতে চুলা জ্বালানোর উত্তেজনায় প্রিয়া ভীষণ খুশি ছিল। অভিজ্ঞতা ও পরিমানের আন্দাজ না থাকায় লিকার এবং চিনি হয়েছিল অতিরিক্ত। তিতকুটে মিষ্টি শরবতের অনুরূপ সেই চা খেয়ে বাবা ভীষণ খুশি হলেন। মেয়ের হাতের প্রথম চা বলে কথা! সেই সঙ্গে সাবধানও করলেন কাউকে পাশে না রেখে যেন দ্বিতীয়বার রান্নাঘরে না যায়। অপটু হাতে পাছে কোনো অঘটন ঘটে! বাবা কী জানেন তার মেয়ে এখন রোজ দুবেলা হাত পুড়িয়ে রাঁধে? জেলে দেখা করতে গিয়ে প্রিয়া বাবার সঙ্গে কোনো কথাই বলতে পারে না। বাবাও নতমস্তকে থাকেন। একসময় দেখা হওয়াটা যতটা প্রশান্তির ছিল এখন ততটাই মানসিক অশান্তির, বিব্রতকর। অনুভূতি বদলাতে সময় লাগে না, গতানুগতিক জীবনের স্বাভাবিকতার ছন্দপতন হলেই অনুভূতির ছন্দপতন হয়।

প্রিয়া এলোমেলো ভাবতে ভাবতেই ভাতের মাড় গালছিল। ঢাকনা ফসকে গরম ফ্যান পড়ে গেল হাতে। প্রবল উত্তাপের ফলে সৃষ্ট জ্ব’লুনিতে চৈতন্য ফিরল ওর। কণ্ঠ নিংড়ে বেরিয়ে আসে আর্তনাদ। মুনিরা বেগম পাশেই বসে রান্নার সরঞ্জাম গোছাচ্ছিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি বিমূঢ় হয়ে গেলেন কয়েক পলের জন্য। এরপর মেয়ের হাত জগের ভেতর চেপে ধরলেন। গজগজ করে বললেন,

“কাজের সময় মনোযোগ কই থাকে? পুড়ল তো হাতটা। এখন বরফ কই পাই?”

প্রিয়া ঠোঁট চেপে ধরে, বুজে আসে চোখ। পানির সান্নিধ্যে একটু আরাম লাগছে। কিন্তু হাত বের করলেই আবার জ্ব’লছে। বরফের কথা শুনে দিয়া ছুটে বেরিয়ে গেছে। রঞ্জু তাকে ছুটতে দেখে পিছু ডেকে বলল,
“ও দিয়া, ভাগ মিলখা ভাগ কইরা কই যাও?”

“আপুর হাত পুড়ে গেছে। বরফ লাগবে, রঞ্জু ভাইয়া।”

রঞ্জু চমকে উঠল। ফুরফুরে মেজাজ মিলিয়ে গেল নিমিষেই। ব্যস্ত গলায় বলল,
“কী কও! চলো আমার সাথে।”

রঞ্জু দুটো কাঠি আইসক্রিম কিনে নিয়ে এলো প্রিয়ার জন্য। মুনিরাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“খালাম্মা, এইটা হাতে লাগান। আরাম পাইব।”

মুনিরা আইসক্রিমের প্যাকেট খুলে প্রিয়ার ভেজা হাতের কব্জিতে চেপে ধরে। প্রিয়া বলল,
“এটার দরকার ছিল না রঞ্জু ভাই। অল্পই পু’ড়েছে।”

রঞ্জু স্মিত হেসে বলল,
“তুমি সংসারের একমাত্র কাজের মানুষ। অসুস্থ হইলে ক্ষতি। আমার দেওয়া দেইখ্যা সংকোচ কইরো না। অন্যকেউ হইলেও তো দিতাম। দিতাম না?”

প্রিয়ার আর কিছু বলার রইল না। রঞ্জুর নারীপ্রীতি স্বভাবের ফলেই প্রিয়া তাকে এড়িয়ে চলে ঠিক। কিন্তু ছেলেটা কিছুটা উ’শৃংখল, ব’খাটে গোছের হলেও সেবাপরায়ণ। রঞ্জু অবশ্য দাঁড়াল না। সে বস্তির অঘোষিত মুশকিল আসান ধরনের মানুষ। এক জায়গায় বেশি সময় থাকতে পারে না। কোনো কাজের দরকারে ছুটে চলে গেল।

দিয়া বোনের পাশে বসে একদৃষ্টিতে আইসক্রিম গলে গলে পড়া দেখছিল। প্রিয়া তা খেয়াল করল। মেয়েটা আগে আইসক্রিম, চকলেটের জন্য কত পাগলই না ছিল। এখন তিনবেলা পেট ভরে খেলেই হলো। প্রিয়া অপর আইসক্রিমটা দিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আমার আর লাগবে না। খেয়ে নে।”

দিয়া বোনের লাল হয়ে যাওয়া হাতের কব্জিতে সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে বলল,
“না, তোমার হাত লাল হয়ে গেছে। এটাও লাগবে।”

“গলে যাচ্ছে তো। শুধু শুধু নষ্ট হওয়ার চেয়ে তুই খেয়ে নে।”

ভাতের মাড় অসাবধানে পড়ে গিয়ে অনেকগুলো ভাতও পড়েছে। প্রিয়া হাড়ির ভাত দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এখন পুনরায় রাঁধার সময় নেই। ও খেয়ে গেলে মা-বোনের কম পড়বে। মাকে আবার চুলার কাছে আসতে হবে যেটা ভীষণ কষ্টসাধ্য মানুষটার জন্য। এরপর নিজের অপারগতায় মা সারাদিন গুমরে থাকবে। কী দরকার! ঘড়িতে সময় দেখল প্রিয়া। কাজে যাওয়ার সময় হয়েছে।

মেয়েকে পোড়া হাতে না খেয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে মুনিরা আঁতকে উঠলেন। নিষেধ করে বললেন,
“আজকে না গেলি। ফোনে বলে দে।”

“মানবে না, মা। এমনিতেই পরীক্ষার সময় বন্ধ করেছি।”

“খেয়ে যা, হাতে মলম লাগাতে হবে।”

“ও বাড়ি গিয়ে খেয়ে নেব। মলম পথে যেতে কিনে নেব, তুমি চিন্তা করবে না একদম।”

প্রিয়া অনুভবদের বাড়ি পৌঁছাতেই লিফটের কাছে অনুভবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। অনুভব ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে তখন। ওকে দেখে মুচকি হেসে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“কেমন আছো, হাসুউউ?”

হাসির বিপরীতে প্রিয়া মুখটা ম্লান করে বলল,
“হাসু কেমন আছে জানি না, প্রিয়া ভালো আছে।”

“আমার তো তা মনে হচ্ছে না। মুখটা শুকনো কেন?”

“ভেজা কবে ছিল?”

প্রিয়া স্বাভাবিক সুরেই বলল। অনুভব ওর ত্যাড়া জবাবে মুখ কুচকাতে গিয়েও হেসে ফেলল। এই মেয়েটার এমন গম্ভীর সুরের কথাগুলো আজকাল তার ভালো লাগে। বিপরীত স্বভাবের মানুষকে বোঝার চেষ্টা করতে মন্দ লাগে না। অনুভব বলল,

“তুমি খুব ভদ্রভাবে ত্যাড়া জবাব দিতে জানো। অপরপক্ষকে অপ্রস্তুত করতে যা অব্যর্থ।”

“আমি যাই।”

প্রিয়া হাতের চিনচিনে ব্যথা সামলে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। অনুভব হাত ধরে ওকে আটকাতে গেলে মুখ থেকে ক্ষীণ আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। অনুভব খেয়াল করে বলল,
“কী হয়েছে হাতে?”

প্রিয়া হাত সরিয়ে নিতে চাইলে সে ছাড়ল না। তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। প্রিয়া বলল,
“ভাতের মাড় গালতে গিয়ে গরম ফ্যান পড়েছে।”

“মেডিসিন লাগাওনি?”

“লাগিয়ে নেব পরে।”

অনুভব ধমকে বলল,
“তোমার পরের জন্য ক্ষতের জ্বা’লা থেমে থাকবে? সবকিছুতে বেশি বোঝার ভাব দেখানো বন্ধ করো।”

অনুভব ওকে টেনে নিয়ে লিফটে উঠে গেল। বাড়িতে নিওবার্নিয়া ছিল। অনুভব নিজের হাতে সেটা ওর আহত স্থানে লাগিয়ে দিল। সাবধানী স্বরে বলল,
“পাকামো করবে না একদম। জাইমকে কোলে কম রাখবে। দোলনায় বসিয়ে খেলা কোরো। আর বেশি খারাপ লাগলে বুড়ি তো আছেই সুস্থসবল। তার কাছে রেখে বাড়ি চলে যেয়ো।”

প্রিয়া কোনো জবাব দিল না। তাচ্ছিল্য ভরা দুনিয়াতে একটুখানি যত্ন পেয়ে ওর চোখজোড়া আড়ালে ভিজে উঠল বোধহয়। অনুভব প্রিয়ার মাথায় আলতো হাত রেখে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে ছুটে এসে ওর ওপর হামলে পড়লেন জয়নব। বাজখাঁই সুরে বললেন,
“তোমার আব্বা নাকি অ’প’রাধী? কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের দায়ে জে’লে গেছে?”

কথাগুলো কর্ণগোচর হতেই প্রিয়ার সর্বাঙ্গে কাঁপুনি ছুটে গেল। আব্বা অপ’রা’ধী! এমন জঘন্য শব্দ ইহজগতে দুটি হয়? প্রিয়ার কেমন দমবন্ধ লাগে। মানসপটে ভেসে ওঠে বাবার ভারী মুখখানা।

রেজাউল করীম সারাজীবন কন্যাদের কাছে ছিলেন এক আদর্শ পিতা, স্ত্রীর নিকট আদর্শ স্বামী, পরিবারের নিকট একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব। স্ত্রী যখন প্যারালাইজড হলেন রেজাউল করীম যথেষ্ট সেবা করেছেন বলতে দ্বিধা নেই। মেয়েদুটোকেও আগলে রেখেছেন৷ কখনো গায়ে হাত তোলা তো দূর অন্যকেউও কন্যাদের দিকে বক্র চোখে তাকালেও বরদাশত করতেন না। স্বল্পভাষী প্রিয়া সারাক্ষণ চুপচাপ থাকলেও বাবার সামনে তার গল্পের অন্ত ছিল না। ছিল না জীবনে কোনো বিষাদের হাতছানি। দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে রোজ রাতে তারা ঘুমাতে যেত। এরপর হুট করেই একদিন স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। লোভের ঝকঝকে মোহে পড়ে রেজাউল হক ভুল করলেন, অথবা পাপ। প্রিয়া দেখতে পেল বাবাকে কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের দায়ে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। নিয়ে যাচ্ছে বাকি তিনটি মানুষের ভাগের সকল সুখ। চেনা পৃথিবীটা সেদিন থেকেই আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল।

বড়ো চাচি অ’প’রাধীর মেয়ে-বউকে বাড়িতে রাখতে চাইলেন না। একই রক্তের ধারা, তাদের দ্বারাও অন্যায় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। নিজের সন্তানদের সঙ্গে ওদের দুই বোনকে রাখা বিপদজনক। বড়ো চাচির দুটি মেয়ে বিবাহযোগ্যা। এসব রটনা ছড়ানোর পর তাদের বিয়ে দিতেও ঝামেলা হবে। সুতরাং সব সমস্যার সমাধান অ’প’রাধী রেজাউল করীমের অস্তিত্বদের বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলা। বড়ো চাচি নিজের সন্তানদের প্রতি সচেতনতা প্রকাশের সাথে সাথে অন্যের সন্তানের প্রতি নি’র্ম’মতার পরিচয় দিলেন।

শূন্য হস্তে বিতাড়িত হয়ে ঠাঁই পাওয়ার আশায় প্রিয়ারা ছুটল মামা বাড়িতে। সেখানে থেকে এইচএসসি পরীক্ষাটা দিতে পেরেছিল প্রিয়া। কিন্তু তিনটি মানুষকে ঘাড়ে বসিয়ে খাওয়ানোর ঝামেলা কে নিতে চায়? তার ওপর একটি মেয়ে সমাজের চোখে প্রায় বিবাহযোগ্য। মামার আর্থিক অবস্থাও আহামরি নয়। মামীর মিষ্টভাষী স্বরটা অল্প কয়দিনেই নিমের মতো তেতো হতে থাকল। আশেপাশের মানুষের কটুক্তি তো ছিলই। মামা চাইলেন ভাগ্নীকে বিয়ে দিয়ে দেবেন। জোগাড় করলেন একজন মুদি দোকানওয়ালাকে। প্রিয়া বুঝে গেছিল বিয়েটা করে নিলে নিজে কেমন থাকবে আর মামার বাড়িতে মা-বোনও কেমন থাকবে। মুনিরা বিয়েতে আপত্তি তুললেন। উনার নিজেরই বিয়ে হয়েছিল একুশ বছর বয়সে। মেয়েকে আঠারোতে দেবেন তাও আবার অশিক্ষিত ছেলের কাছে! মামা-মামী রূঢ় হতে শুরু করলেন। স্বামী জেলে গেছে, অর্থ আত্মসাতের মা’মলায় তিন বছরের জে’ল-জরিমানা হয়েছে। তার পরিবারের এত দে’মাগ কোত্থেকে আসে? কোনো উচ্চশিক্ষিত, সম্রান্ত ঘর এই পরিবারে আত্মীয়তা করবে না। ওরা বুঝল মামা বাড়িতেও দিন ফুরিয়েছে। আর কেউ নেই মাথার ওপর ছায়া হওয়ার। পায়ের নিচে জমি দেওয়ার। এবার নিজেকেই নিজের ছায়া হতে হবে।

সকলের হীন দৃষ্টি থেকে বাঁচতে, একটা ভালো বাড়ির ভাড়া বহন করার ক্ষমতাটুকুও কপালে নেই বলেই বাধ্য হয়েই বস্তিতে উঠতে হয়েছে ওদের। প্রিয়ার মন ভেতর থেকে তাগিদ দিয়েছে বড়ো হতে হবে। আশ্রয়হীন সংসারের ছায়া হতে হবে। সেই থেকেই তার কৈশোরের কোমলতা ধীরে ধীরে গম্ভীরতায় ঢেকে গেছে।

বস্তিতে ওরা কাউকেই বাবার অ’প’রাধের কথা জানায়নি। এ নিয়ে খুব সচেতন থেকেছে। তারপরেও অন্তরা আপার মা কী করে জেনে গেল প্রিয়ার মাথা কাজ করছে না। তবে উনি যে প্রশ্নটা করেছেন তার উত্তরে প্রিয়া বলতে পারে তার বাবা অপ’রাধী নয়। বাবা সত্ত্বাটা কখনো তাদের সঙ্গে অ’ন্যায় করেনি। ব্যক্তি রেজাউল করীম অপ’রা’ধী হতে পারেন। যাকে প্রিয়া অস্বীকার করে। স্মৃতিতে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় বাবা সত্ত্বাটাকেই।

প্রিয়ার জবাব না পেয়ে জয়নব চ্যাঁচিয়ে বলতে লাগলেন,
“কী অবাক কান্ড! জেল খাটা আ’সামীর মেয়ে হয়ে ছদ্মবেশে চাকরি নিয়েছো? তোমার মতলব তো ভালো না। চু’রি, ডা’কাতি করতে ঢুকেছো? প্রথমে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করবে এরপর সব নিয়ে ভেগে যাবে।”

“আমি ছদ্মবেশ নেইনি।” প্রিয়া ভাঙা সুরে কোনোমতে উচ্চারণ করে।

“আবার মুখে মুখে কথা! এখন তো সন্দেহ হচ্ছে বাড়ির সবকিছু সহিসালামত আছে কিনা। আল্লাহ গো আল্লাহ, দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পুষছিলাম ঘরে! বাড়ির ছেলের দিকেও তো হাত বাড়িয়েছ। দিনে-দুপুরে ফাঁকা বাড়িতে লটকা-লটকি করে বেড়াচ্ছ। ভেবেছ বুড়ো মানুষ চোখে কিছু দেখি না? আর কী কী ধান্দা জানো? তাই তো বলি, এই মেয়ে এমন ভেজা বেড়াল হয়ে থাকে কেন?”

প্রিয়ার কানে কেউ গরম সিসা ঢালছে বোধহয়। মনে হচ্ছে অদৃশ্য এক হাত গলা চেপে ধরেছে। মুখ ফুটে একটা প্রতিবাদও করতে পারছে না। এরপরের বাকিটা সময় প্রিয়া ঘোরগ্রস্তের মতো রইল। হাজারটা নোংরা বাক্য তার কান ছুঁয়ে গেলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে পারল না। শুধু মনে মনে হিসেব করতে লাগল এই চাকরিটা যাওয়ার পর কত বড়ো ধাক্কাটা আসবে? কতদিন আধপেটা খেয়ে থাকবে? নতুন কাজ আদৌ জুটবে তো? আর পড়াশোনা?

একসময় জয়নব ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার আগে পোশাক খুলে শরীর চেক করে দেখতে চাইলেন বাড়ি থেকে কোনোকিছু সরিয়ে নিয়েছে কিনা। প্রিয়া লজ্জায় অপমানে মাটিতে মিশে যাচ্ছে প্রতিক্ষণে। সেই লজ্জার কাছে পো’ড়া স্থানের ব্যথা নস্যি হয়ে গেল। বন্ধ চোখের কবাট হতে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল বিরামহীন। অবস কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল,

“আল্লাহ, ধৈর্য দাও। শক্তি দাও।”

চলবে…

প্রিয়ানুভব পর্ব-০৭

0

#প্রিয়ানুভব [৭]
প্রভা আফরিন

প্রিয়ার এডমিশন টেস্ট শেষ হয়েছে কিছুদিন হলো। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে আহামরি ফলাফল করার কথা না, আকাঙ্ক্ষাও করেনি। ঢাবি, জাবি কোথাও সিরিয়াল না আসায় প্রিয়া পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছিল। কারণ এবার পাবলিকে ভর্তি পরীক্ষার আগেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এডমিশন প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেছে। হিসেবি প্রিয়া জাতীয়তে ভর্তি না হয়ে সেই টাকায় পাবলিকের ফর্মের টাকা ভরেছিল। নিজের ওপর দয়াও কম হচ্ছিল না তখন। ভবিষ্যতের একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হলো এই এডমিশন টাইম। যখন একজন শিক্ষার্থী লম্বা সময় ধরে একটা বিষয় নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য। কেউ ডাক্তারির পেছনে ছোটে, কেউ বা ইঞ্জিনিয়ারিং, ফ্যাশন ডিজাইনার, আর্টিস্টসহ কতশত স্বপ্ন তাদের দুচোখে রাতদিন খেলা করে। যে স্বপ্নের তাড়নায় উঠতি তরুণরা সুস্থির হতে পারে না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছেলেমেয়েরা ছুটে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিমুখে। কেউ নিজের স্বপ্ন পূরণে একাগ্র কেউ বা পরিবারের।

এমন নাজুক সময় প্রিয়া ভাবে চাল-ডাল কিংবা ডিমের দাম বেড়ে গেলে কোনদিকে খরচ কমাবে, মাছ-মাংসের দিকে তো হাতই দেওয়া যায় না। দিয়াটা আমিষ খেতে খুবই ভালোবাসে। শুক্রবারের দিন পাশের বাড়ি থেকে মাংসের তরকারির ঘ্রাণ পেলে মুখ শুকিয়ে থাকে মেয়েটা।

মেয়েরা মানসিক দিকে থেকে পুরুষের তুলনায় আবেগপ্রবণ হলেও তাদের সহনশীলতা পর্বতের ন্যায় বিশাল ও দৃঢ়। প্রসব বেদনার সঙ্গে প্রাণ দিয়ে লড়াই করে হলেও সন্তানকে আলোর মুখ দেখায়। সংসারের জন্য নিরবে ক্ষয়ে যায়। মুনিরা বেগম অনেকটা চাপা স্বভাবের। নিজের খারাপ লাগা কিংবা অসুবিধাটুকু না ঠেকলে স্পষ্টত মুখে আনতে পারেন না। মেয়ে দুটোও হয়েছে মায়েরই মতো। কপটতা, ভ ণ্ডা মি কিংবা স্বার্থপরতা কোনোটাই পায়নি। পাশের বাড়ির মাংসের ঘ্রাণ পেয়ে দিয়া একদিন আক্ষেপ করে বলেছিল,
“অনেকদিন মাংস ভাত খাই না, আম্মু।”

মুনিরা সেদিন অসহায়ের মতো মেয়েকে আগলে নিয়ে কেঁদেছেন। অদৃষ্টকে উপহাস করেছেন। সেই দৃশ্যের পর দিয়া কখনোই মাংস খাওয়ার কথা মুখে আনে না। শুক্রবারে যখন অন্যের ঘর থেকে গরম গরম মাংসের তরকারির সুঘ্রাণ ছোটে সেই ঘ্রাণ শুকে শুকে ডাল দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়ে নেয়। প্রিয়া সবই দেখে, সবই বোঝে। শুধু অভাব তার জবান বন্ধ করে রাখে। জাইমের কেয়ারটেকারের কাজটা পাওয়ার পর বোনের মুখ চেয়ে প্রিয়া জীবনে যা কল্পনা করতে পারেনি তাই করেছে। যেদিন অন্তরা ভাবীদের বাড়িতে ভালো রান্না হয় প্রিয়ার জন্যও তার কিছু বরাদ্দ থাকে। প্রিয়া নিজেরটুকু লুকিয়ে আনে বোনের জন্য। ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জায় তার হাত কাঁপে। সেদিনগুলোতে সারাটা পথ আসার সময় চোখ বারবার ঝাপসা হয়। অভাবের কাছে পরাস্ত হয়ে, বাড়ন্ত বোনের শুকনো, মায়ামাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেকে বোঝায়, সে তো চু রি করেনি। নিজের ভাগেরটা বোনের জন্য আনে।

মাসের অন্তে এই স্থানসংকুলান সংকটাপন্ন রুমটার ভাড়া গুনতে হয় প্রিয়াকে। দিয়া একটি আধা-সরকারী স্কুলে পড়ছে। মাসে মাসে বেতন দিতে হয়। আগে অবশ্য নামকরা কেজিতে ছিল। তখনকার পরিস্থিতিও ভিন্ন ছিল। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বাবা সাধ্যের মধ্যে মেয়েদের বিলাসিতা দিয়েছেন। আমিষের কোনো সংকট ছিল না। সপ্তাহান্তে সপরিবারে অভিজাত রেস্তোরাঁয় ডিনার করেছে। খেতে ইচ্ছে না করলে প্লেট ভর্তি দামী দামী খাবার এঁটো করেছে। এখন সেসব অতীত। সেই অতীত সোনালি নাকি অমাবস্যার ন্যায় কলুষিত এখন ভাবতে আর ইচ্ছে হয় না। প্রিয়া ভাবছে দিয়াকে এবার সরকারি স্কুলে দেবে। দুর্মূল্যের বাজারে খরচটা যদি আরেকটু আয়ত্ত্বে আসে।

উচ্চতর ডিগ্রি পাওয়ার সমস্ত স্বপ্ন যখন প্রায় নিভু নিভু তখনই অন্ধকারে আলোর বিচ্ছুরণের মতো প্রিয়ার সিরিয়াল পাওয়া গেল আজিমপুরের স্বনামধন্য ইডেন মহিলা কলেজে। সমাজবিজ্ঞান সাবজেক্ট এসেছে তার। অনেকদিন বাদে প্রিয়া বুঝি হাসল সেই সংবাদে। কাঁদলও। নিঃশেষিত স্বপ্নের আগুন যখন ছাইয়ের স্তুপ হতে ফিনিক্স পাখির মতো ধরা দেয় সেই মুহূর্তে শত শত মন্দভাগ্যের মাঝেও নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়।

অনুভব প্রিয়ার এডমিশন টেস্টের বইপত্র, নোটস যোগাড় করে দিয়েছিল। স্বপ্ন হারানো মেয়েটিকে পুনরায় স্বপ্ন দেখার সাহস দিয়েছিল। অদৃষ্টে যা ছিল, প্রিয়ার পরিশ্রম যেটুকু ছিল তাই পেয়েছে। কিন্তু অনুভবের অবদান সে কোনোদিন অস্বীকার করতে পারবে না। ইডেন মহিলা কলেজে সিট পেয়েছে শুনে অনুভবও খুশি হয়েছে। উৎসাহ দিয়ে বলল,
“মন্দ না। পড়াশোনা শেষে পাবলিক, প্রাইভেট কিংবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই সেই সরকারি চাকরির পেছনেই ছুটবে যদি না আলাদা প্যাশন থাকে। তুমিও ছুটবে। পরিবারের ভবিষ্যত ভেবে হলেও তোমাকে পড়াশোনা আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। হাজার হাজার গ্রেজুয়েট বেকার বসে আছে। সেখানে এইচএসসি পাশের যোগ্যতায় তুমি বেশিদূর এগোতে পারবে না।”

কথা সত্যি। প্রিয়া বস্তিতে ওঠার দিন কয়েক বাদের প্রতিবেশী মেয়েদের সঙ্গে মিলে গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছিল। কিন্তু পুরুষ সহকর্মীর অপ্রীতিকর আচরণে দুদিন গিয়েই হাল ছাড়তে হয়েছে। সেই সঙ্গে অনুধাবন করতে পেরেছে দুনিয়াটা তার জন্য কতটা লড়াইয়ের। এখানে টিকে থাকা শারীরিক অ-স্ত্র যু-দ্ধের মতো না হলেও মানসিক যু-দ্ধটা নিরব বিধ্বং-সী।
প্রিয়া অনুভবকে শুরুতে যতটা উদ্ভট ও জেদি ভেবেছিল ধীরে ধীরে মিশে বুঝল সে মনের দিক থেকে খুবই ভালো একজন মানুষ। আশেপাশের মানুষদের প্রতি সাহায্য পরায়ণ ও যত্নশীলও বটে। প্রিয়ার বিকারহীন, সোজাসাপটা কথায় মাঝে মাঝে রেগে গেলেও পরে আবার ভুলে যায়। তবে এই মুহূর্তে প্রিয়ার মাথায় নতুন চিন্তা চেপে বসেছে। ক্লাস সামলে এই চাকরিটা করা বোধহয় তার পক্ষে অসম্ভব হবে। এই সুযোগ সুবিধা, ঘরোয়া পরিবেশ, নিরাপত্তা ছেড়ে ভালো চাকরি সে আদৌ কি জোটাতে পারবে?

অনুভব ভার্সিটিতে বেরোচ্ছিল। প্রিয়াকে অন্যমনস্ক দেখে প্রশ্ন করল,
“এই বয়স্ক মহিলা, এনি প্রবলেম?”

প্রিয়া অসন্তুষ্ট চোখে চায়। এই ছেলে তাকে কীসব নাম যে দেয়! ক্ষুণ্ণ স্বরে বলে,
“আমি বয়স্ক মহিলা?”

“ভাবখানা তো তেমনই।”

“তাহলে আপনিও বাচ্চা পুরুষ।”

অনুভব ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে,
“আমি বাচ্চা পুরুষ! এই পাকা মেয়ে, আমাকে কোনদিক থেকে বাচ্চা দেখায়? কল মি ইয়াং ম্যান। এটা ডিসেন্ট শোনায়।”

প্রিয়া ঠোঁট টিপে হাসে৷ বলে, “আপনি ডিসেন্ট! আপনি হচ্ছেন ভায়োলেন্টলি ডিসেন্ট। কিছুটা টিনেজ টাইপ ইমম্যাচিওরিটি আছে।”

অনুভব এ কথায় অপমানিত বোধ করে। এইটুকুনি মেয়ে তাকে ম্যাচিওরিটির কথা শোনায়! সে নিজেই তো টিনেজ। অনুভব নিকটে এসে নাক ফুলিয়ে বলে, “ইউ নো, আমি ভার্সিটি, পাড়া, মহল্লার টিনেজ থেকে মিডেল এজ সবার ক্রাশ!”

“হু, তাতে আমার কী?” প্রিয়া নির্বিকার।

অনুভব দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে৷ থেমে থেমে বলে, “তুমি যাকে অবজ্ঞা করছো তার ডিমান্ড বোঝো?”

“বুঝলে বেতন বাড়িয়ে দেবেন?”

“না, বরং এই অবজ্ঞার জন্য বেতন কেটে রাখব।”

প্রিয়া হতাশ শ্বাস ফেলে বলে, “চাকরিটা এবার থাকলে হয়।”

অনুভব একদৃষ্টে দেখছিল প্রিয়ার দিশেহারা মুখখানা। এর কারণ জানতে গিয়েই কথা বলতে এসেছিল। কিন্তু এই মেয়ের সঙ্গে তার জীবনেও দুদণ্ড ভালোমতো কথা হলে তো! অনুভব মূল প্রসঙ্গে ফিরে বলল, “কোনো বাড়তি কথা না বলে, আমাকে না খ্যাপিয়ে বলবে ঘটনা কী? সময় নেই হাতে।”

প্রিয়া ইতস্তত করে নিজের দোনোমনার কথা জানায়। অনুভব গম্ভীর মেয়েটিকে এখন অল্প অল্প বোঝে। বোঝে বলেই সে হাসু তথা প্রিয়ার ওপর মনে মনে রীতিমতো মুগ্ধ। আত্মসম্মানের তেজ নাকের ডগায় নিয়ে ঘোরে যেন কোনো সম্রান্ত পরিবারের মেয়ে। অনুভবের মনে হয় তেমনই হওয়ার কথা। বিব্রত না করতে ব্যক্তিগত প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে হয়। তবে প্রিয়া যতই গম্ভীরতা অবলম্বন করুক শীতোষ্ণ মিঠে রোদের পরশে প্রকটিত কৈশোরের স্নিগ্ধতা লুকানো যায় না। অনুভব হঠাৎ প্রিয়ার গালে আলতো হাতে টোকা দিয়ে বলল,
“সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে। শুধু ঠাণ্ডা মাথায় পন্থা খুঁজে বের করতে হবে। পড়াশোনা, কাজ দুটোই ব্যালেন্স করতে হবে। একটার জন্য আরেকটা ছাড়া যাবে না। এসব না ভেবে মাথা ঠাণ্ডা রাখো। জাইমের কাপড় বদলাও গিয়ে, হাসুউউউ!”

প্রিয়ার গালে অনুভবের ছোট্টো টোকা দেওয়ার দৃশ্যটা খোলা দরজার ওপারে অন্তরা ভাবীর মায়ের ঘোলাটে চোখের পর্দায় স্পষ্ট ফুটে উঠল।

চলবে

প্রিয়ানুভব পর্ব-০৬

0

#প্রিয়ানুভব [৬]
প্রভা আফরিন

গাট্টাগোট্টা, আভিজাত্যপূর্ণ মহিলাটির নাম শায়লা। সম্পর্কে প্রিয়ার চাচি হয়। মধ্যবয়স্ক হলেও শরীরের গাঁথুনি মজবুত। চেহারা ক্ষুরধার। তিনি ছোটো জা মুনিরা বেগমের শিয়রে বসে আছেন। অবজ্ঞার চোখে দেখছেন চারিদিক। মুখভঙ্গি বলে দিচ্ছে এমন স্থানে তিনি জীবনেও পা রাখেন না। আজ চারমাস পর হুট করে ছোটোজায়ের সংসার দেখতে ইচ্ছে হলো। তাই সাতসকালে চলে আসা।
সাড়হীন দুটি পা নিয়েই মুনিরা উনার বড়ো জাকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন করার চেষ্টায় মত্ত। প্রিয়াকে নির্দেশ দিলেন বড়ো চাচিকে সকালের নাশতা দিতে। প্রিয়া সকালের রান্না ইতিমধ্যে করে ফেলেছে। ভাত, আলুভর্তা, ডাল। বিলাসী বড়ো চাচির মুখে তা রুচবে না জানা সত্ত্বেও সাধল। শায়লা বললেন,

“খাব না, বউ। বাড়ি থেকে খেয়ে বের হয়েছিলাম। তোমাগো টানাটানির সংসার। আমার জন্য খরচ করার দরকার নাই। হাবিবটা যে লোভে পইড়া কী ভুল করল। চাঁন্দের মতো দুই মেয়ের ঠাঁই হলো বস্তিতে! গুষ্টির মাঝে জীবনে যা না হইছে।”

কথাগুলো শুনে মুনিরা অধোবদন হলেন। ক্ষীণ স্বরে প্রতিবাদ করে বললেন,
“ভাবী, আপনি তো জানেন উনি এমন না।”

“থাক বউ, তুমি আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা কইরো না। পুলিশ তো আর ঘাসে মুখ দিয়া চলে না। দোষ করছে বলেই ধরে নিয়ে গেছে। আসলে দোষটা হইল লোভের। এই রিপু মানুষরে ধরলে আশেপাশের মানুষেরও নিস্তার নাই।”

প্রিয়া তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিল। মায়ের মিনমিনে স্বভাবটা তার বিরক্ত লাগছে। চাচি সম্পর্কের এই জাদরেল মহিলাটি সারাটা জীবন সংসারে একা ছড়ি ঘুরিয়েছে। তার মাকে দমিয়ে রেখেছে। এই মহিলার কূটকৌশলেই আজ তারা বাড়ি ছাড়া। বাবার কর্মকাণ্ড ছিল বাহানামাত্র। কোটি টাকার সম্পত্তি একা গলাধঃকরণ করতে ছোটো জা’কে মেয়েসহ বাড়ি ছাড়া করেছেন। একটা আসবাব পর্যন্ত সঙ্গে দেয়নি। এখন এসেছেন লোভের ফিরিস্তি দিতে! মানুষ অন্যের দিকে একটা আঙুল তোলার সময় নিজের দিকের চারটে আঙুলের কথা বেমালুম ভুলে যায়। অন্যের দোষত্রুটির ব্যাপারে তারা জ্ঞান রাখলেও নিজের বেলায় সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকতেই ভালোবাসে।

প্রিয়া কিছুক্ষণ আগেই গোসল করেছে। ভেজা চুল মুছতে মুছতে ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“ঠিকই বলেছেন চাচি, লোভ যে কখন কাছের মানুষের কদর্য চেহারা দেখিয়ে দেয় ভাবা যায় না। ভাগ্যিস আমাদের লোভ নেই। তাই স্বার্থপরতা করতে পারি না। আবার শত্রুকেও সৌজন্যতা দেখাতে ভুলি না।”

মুনিরা মেয়ের কথা শুনে ধমকে উঠলেন,
“এত কথা কীসের? দিয়া কই গেছে দেখ গিয়ে। স্কুলে যাওয়ার সময় হলো।”

শায়লা প্রিয়ার কথায় যেন দেশলাইয়ের মতো দপ করে জ্বলে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলেও নিলেন। বললেন,
“সকাল সকাল গোসল দিছিস কেন? কোনোখানে যাবি?”

“আমার তো আর বাবার কামাই নেই, শ্বশুরের কোটি টাকার সম্পত্তিও নেই যে সবাইকে বঞ্চিত করে জীবনভর ভোগ করব। তাই সংসারের হাল নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে।” কথাটা বলতে গিয়েও গিলে ফেলল প্রিয়া। মুখে মুখে তর্ক করাটা সে এখনো শেখেনি। ছোটো করে বলল,
“কাজে যাব, চাচি।”

শায়লা ঠেস দিয়ে বললেন,
“তা কী কাজ করিস? গার্মেন্টসে যাস? নাকি অন্যকাজ?”

প্রিয়ার বলতে ইচ্ছে হয়, “খোঁজও তো নেন না। কী করি তা জেনেই বা কোন কার্য উদ্ধার হবে?” মায়ের মুখ চেয়ে এ কথাটাও তার মুখ থেকে বের হয় না। নয়তো মুনিরা বেগম এই ভেবে কাঁদতে বসবেন সন্তানকে তিনি সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি। তাই বিরস বদনে বলল,
“হালাল উপার্জন করি, হালাল খাই।”

“কয়দিন বস্তিতে থেকেই ত্যাড়া সুরে কথা বলা শিখে গেছিস?” শায়লা কটাক্ষ করেন।

মুনিরা বেগম মেয়ের ওপর আরেকদফা বিরক্ত হয়ে জা-কে কাজের ফিরিস্তি দিলেন। শুনে শায়লা হায় হায় করে উঠলেন,
“এত উঁচু বংশের মেয়ে কিনা বাবুর কেয়ারটেকারের কাজ করে! গুষ্টির গৌরব সম্মান আর রইল নারে, বউ।”

প্রিয়ার ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি উঁকি দিয়েও সংবরণ হয়ে যায়। বলল,
“গৌরব তো আমাদের খেয়ে-পড়ে বাঁচতে দেয়না, চাচি। তাই সম্মানটা ধরে রেখে বেঁচে থাকার তাগিদে ছুটছি।”

প্রিয়া বুঝে গেল এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চাচির খোঁচামারা কথা শুনতে শুনতে সে বেয়াদবি করে ফেলতে পারে৷ স্বভাবের অশিষ্টতা সংবরণ করে ঘর ত্যাগ করে কাজে রওনা হলো। ওকে চলে যেতে দেখে শায়লা যেন আরাম পেলেন। প্রথমে একটু শঙ্কিত ছিলেন এরা উনাকে সহজভাবে মেনে নেবে কিনা। মুনিরা তাকে এখনো আগের মতোই মান্য করে এটা বুঝতে অসুবিধা নেই। তিনি মুনিরার হাত ধরে বললেন,
“শুনো বউ, ভাগ্যের লিখন কেউ খণ্ডাইতে পারে না। তোমার ভাগ্যে এই বস্তির বাস লেখা ছিল, তাই এখানে আইসা পড়ছো। কিন্তু তোমার দুইখান মেয়ে আছে। একজন যুবতী। আরেকজনও প্রায় ডাঙ্গর হইয়া সারল। বস্তির অজাতকুজাত মানুষের বিশ্বাস নাই। তারওপর তোমাগো উপরে পুরুষের ছায়াও নাই। বিপদ হইতে সময় লাগব না। তাই সম্মান থাকতে পদক্ষেপ নেও। আমার ভাইস্তা বদরুল তোমার মেয়েরে পছন্দ করছে। চাহিদা থাকতে বিয়াটা দিয়ে দাও।”

মুনিরা অবাক হয়ে বললেন,
“বদরুল? ওর না আগে একটা বিয়ে আছে।”

“তালাক হইছে, তাতে কী? বাপ জেল খাটা জানলে কেউ তোমার মেয়ে ঘরে তুলব মনে হয়? কানা খোঁড়াও জুটব না। বদরুল প্রিয়ারে ছোটোকাল থেকে পছন্দ করে দেখেই বিয়া করতে চাইছে। বনেদি বাড়িঘর। বাপের মাছের খামার আছে, দুইটা ধানের মিল আছে। প্রিয়ার সাথে বিয়া হইলে তোমাগোও আর বস্তিতে পইড়া থাকা লাগব না। ভাইবা দেখ বউ।”

শায়লার কথা শেষ হলেও মুনিরা কোনো শব্দ উচ্চারণ করলেন না। একটু সময় নিয়ে বললেন,
“ভেবে দেখি।”
________________

প্রিয়া ফুটন্ত তেলে জলের ছিঁটে পড়ার মতো ছ্যাঁত করে উঠল। দুঃখে কান্না পাচ্ছে। তার চেয়েও বেশি রাগ হচ্ছে মায়ের ওপর। বড়ো চাচির এহেন প্রস্তাব তিনি কী করে আশকারা দিলেন ওর বুঝে আসছে না। প্রিয়ার নধর দেহে যখন সদ্য কৈশোরের স্পর্শ লেগেছে তখন থেকেই ল ম্প ট বদরুলের নজর তার ওপর। লোকটির চারিত্রিক বৈশিষ্টের জন্য তার উপস্থিতিতে মেয়েদের তিন নম্বর অদৃশ্য চক্ষু সর্বদাই সচেষ্ট থাকে। বড়ো বংশে বিয়ে দিয়ে বউ এনেছিল। কিন্তু দু’শ্চ’রিত্রতায় সংসার টেকেনি। এখন চাচি বলির পাঠা হিসেবে তাড়িয়ে দেওয়া দেবরের মেয়েকেই আগে পেয়েছে। প্রিয়া আগেই বুঝেছিল স্বার্থবিনা যিনি এক গ্লাস পানি কাউকে এগিয়ে দেন না তিনি বিনা মতলবে এই স্যাঁতসেঁতে, চিপাগলি মাড়ায়নি।
দিনের সূর্য ডুবুডুবু হতেই প্রিয়া ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরে গায়ের জামাটাও ছাড়েনি, এসব শুনে মেজাজ স্থির রাখতে পারল না। উষ্ণ কণ্ঠে বলল,
“ভেবে দেখবে মানে? ওই মহিলা সমানে বাজে কথা বলে গেল আর তুমি জি হুজুর জি হুজুর করে গেলে?”

মুনিরা বেগম অসহায়। সারাজীবন সংসারে যে জায়ের মতামতকে তিনি শিরোধার্য মনে করে এসেছেন আজ হুট করে তার মুখে মুখে কথা বলার সাহসটা তিনি করে উঠতে পারেননি। চিত্ত গুড়িয়ে দেওয়া মর্মর আ’ঘা’ত সহসাই অভ্যাসকে ভাঙতে পারে না। তাই বড়ো জায়ের অন্যায়ের পরও মুনিরা পারেননি কঠোরতা প্রদর্শন করতে। এ নিজের ব্যর্থতা হিসেবেই মানলেন তিনি। বললেন,

“বে’য়া’দবি করলে আমার আর উনার মাঝে ফারাক কোথায়, প্রিয়া? নাকি অকথ্য গা লি গালাজ করলে আমাদের আগের দিন ফেরত আসবে? তোর বাবা সুযোগ দিয়েছে বলেই উনি আমাদের ওপর অন্যায় করতে পেরেছে। আল্লাহ পা’পের শা’স্তি কিংবা ধৈর্যের পরীক্ষা কখন কোন দিক থেকে নেয় আমরা জানি না। শায়লা ভাবী অন্যায় করেছেন, সৃষ্টিকর্তা দেখেছেন। বিচার নাহয় উনিই করুক। আমাদের সেই ক্ষমতা যখন নেই শুধু শুধু অন্যকে ক্ষে’পিয়ে দিয়ে নাজুক সময়ে নিজের বিপদ না ডাকাই মঙ্গলজনক। আমি কোনো মহীয়সী বলবান নারী নই যে নিজের সন্তানদের রক্ষা করতে পারব। নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতাও আমার নেই।”

সারাজীবন মুনিরা আদর্শ গৃহিনী হওয়ার চেষ্টা করেছেন। সন্তানদেরও আদর্শবান বানাতে চেয়েছেন। অথচ উনার সংসারেই আদর্শের চরম ঘাটতি দেখা দিল। তাছাড়া বছর চারেক আগে কোমড় হতে পা অবদি প্যারালাইজড হওয়ার পর মুনিরা নিজেকে অসহায় ভাবেন। প্রিয়া ঠাণ্ডা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কী এই অসহায়ত্ব থেকে মুক্তি পেতে আমাকে ওখানে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছ?”

“এতটাও অসহায় নই যে নিজের মেয়েকে দোজখে ঠেলে দেব। হারাম মাং স-পোলাউয়ের চেয়ে হালাল নুনভাতেও শান্তি। সামনাসামনি মানা করলে তোর চাচি চ্যাঁচামেচি করত। প্রতিবেশীর সামনে লজ্জার আবরণ খুলে দিতো। আমি নাহয় ঘর থেকে বের হই না। আমার সন্তানের দিকে কেউ খারাপ নজরে তাকাক তাও চাই না। দিয়ার বালিকা বয়স। সারাদিন এদিক সেদিক ঘোরে। এইটুকু বয়সে এমনিতেই যা দেখল… মানুষের বিদ্রুপ হজম করার মানসিকতা এখনো হয়নি। তারচেয়ে ফোনে কথা বলা উত্তম। তুই আজদিন বাদে ওই বাড়ি ফোন করিস। আমি মানা করে দেব।”

প্রিয়ার নাসারন্ধ্র পিছলে প্রলম্বিত এক স্বস্তির শ্বাস নির্গত হয়। অনুশোচনা হয় একটু আগে মানুষটাকে ভুল বোঝার জন্য। ছলছল চোখ লুকাতে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের বুকে।

চলবে…

প্রিয়ানুভব পর্ব-০৫

0

#প্রিয়ানুভব [৫]
প্রভা আফরিন

জাভেদ সাধারণত দুপুরের পর বাড়ি থাকে না। হসপিটালের ডিউটি ও চেম্বার মিলিয়ে সপ্তাহের সাতটা দিনই তাকে ছোটাছুটির ওপর থাকতে হয়। আজ হসপিটালের কাজে গাজিপুর যাওয়ার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে ক্যান্সেল হওয়ায় ফুরসত পেয়ে বাড়ি ফিরল। ধরাবাঁধা ব্যস্ত জীবনে অনেকদিন পর একটা অনাকাঙ্ক্ষিত অবসর মিলল যেন। সবটুকু সময় জাভেদ একমাত্র চোখের মনি জাইমের পেছনে খরচ করতে চাইল। বিনিময়ে খরিদ করতে চাইল অম্লান ভালোবাসার শুদ্ধতম আনন্দ। তাই প্রিয়ার অসুস্থতা দেখে বলল,
“তুমি আজ বাড়ি চলে যাও। নিয়ম করে মেডিসিন নেবে। জাইম আমার সঙ্গে থাকুক।”

প্রিয়া খুশি হলো। সত্যিই তার আজ সময় দরকার ছিল। সে তড়িঘড়ি করে বের হতে নিয়ে দরজার সামনে থমকে গেল। চক্ষুদ্বয়ে আচমকা অন্ধকার নেমে এলো। দেহের শক্তি কর্পূরের ন্যায় উবে গেল। প্রিয়া দরজার হাতল ধরে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে নিজেকে পড়ে যাওয়া থেকে সামলায়।

“এই হাসু, তুমি ঠিক আছ?”

অনুভবের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরে প্রিয়া নিভু নিভু চোখে চাইল। ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জিভ দ্বারা শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“ঠিক আছি, স্যার।”

অনুভব তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েটির চোখমুখ পর্যবেক্ষণ করে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি। ভেতরে এসে বসো।”

“আমাকে যেতে হবে।”

“তোমারও কি বাড়িতে বাচ্চা আছে?”

প্রশ্নটা শুনে প্রিয়া অবাক চোখে তাকাল। বুঝতে না পেরে বলল,
“বাচ্চা থাকবে কেন?”

“তাহলে তাড়া কীসের? যাও বসো।”

ধমকটা এমনই আদেশ পরায়ণ ছিল যে প্রিয়া এড়াতে পারল না। সে চুপসানো মুখে গিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিল। অনুভব পাশের সোফায় বসে জহুরীর চোখে পরখ করতে লাগল ওকে। শ্বেত চন্দনের মতো মুখখানায় বিন্দু বিন্দু ঘামের রেশ। নাকের ওপর দৃশ্যমান কুচকুচে কালো তিলটা যেন অবগাহন করছে সেই জলবিন্দুতে। মুখশ্রীর কোমলতায় কেমন অযত্নের ছাপ। অনুভবের কেন জানি মনে হলো মেয়েটা মানসিক চাপের মাঝে থাকে সব সময়। চোখে রাজ্যের বিষন্নতা। এইটুকু বয়সে কীসের এত দুঃখ তার?
অনুভবকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রিয়া একটু অপ্রস্তুত হলো। পরনের জামাকাপড় গুছিয়ে নিল ভালো করে। বলল,
“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

“দুপুরে খেয়েছিলে?”

“গিয়ে খাব।”

“এ বাড়িতে তোমার দুইবেলা খাবারের ব্যবস্থা করা আছে। সেই বাড়তি খাবার কে খাবে?”

“ইচ্ছে করছে না। তেতো লাগছে।”

অনুভব গম্ভীরমুখে উঠে গেল। সেকেন্ড কয়েকের মাঝে ফিরে এলো সেই কলার ছড়াটা নিয়ে যা সে ইহজীবনের মতো ত্যাজ্য করেছে। প্রিয়ার কোলের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
“এমনিতেও এটা আমার গলা দিয়ে আর জীবনে নামবে না। ভাইয়ারও বোধহয় হবে না। আজকে না খেলে পুরোটাই নষ্ট হয়ে ডাস্টবিনে যাবে। সুতরাং সবগুলো তোমাকেই খেতে হবে। এন্ড রাইট নাও।”

প্রিয়া অসহায় চোখে কলাগুলোর দিকে তাকায়। গুনে দেখে সাতটা কলা আছে। এতগুলো সে খেতে পারবে! তারচেয়েও বড়ো কথা মুখ ফসকে যে উদাহরণ দিয়েছে তাতে নিজেরই গা গুলিয়ে উঠছে। অনুভব কঠিন চোখে চেয়ে আছে। চোখ দিয়েই বুঝিয়ে দিচ্ছে না খেয়ে তার নিস্তার নেই। প্রিয়া পাঁচটা কলা গলাধঃকরণ করে হাঁপিয়ে উঠল। অসহায় চোখে চেয়ে বলল,
“আর অর্ধেকও খেলে বমি হয়ে যাবে।”

অনুভব আর জোর করল না। তবে ওকে একা ছেড়েও দিল না। পৌঁছে দিতে নিজেও এলো সঙ্গে। প্রিয়া বারণ করে বলল,
“আপনাকে আসতে হবে না। আমি চলে যেতে পারব।”

“ব্যাপার নাহ, চলো এগিয়ে দেই। রাস্তায় বেহুশ হয়ে পড়লে তো আবার কাজে ফাঁকি দেবে।”

প্রিয়া পড়ল বিপদে। এই মুহূর্তে সে বাড়িতে যাবে না। তাকে থানায় যেতে হবে একবার। মা নিশ্চয়ই আশায় থাকবে। কিন্তু অনুভবকে কী করে সরায়? মনে মনে ফন্দি ফিকির করতে করতে লম্বাটে যুবকটির পাছে পাছে হাঁটতে লাগল সে। পথে বেরিয়ে রোদের মুখে পড়তেই অনুভব কপাল কুচকে মুখ আড়াল করে। বলে,
“ছাতাটা না এনে ভুল হলো।”

প্রিয়া তা শুনে আড়ালে কপাল কুচকায়। রূপের এত চিন্তা তো সে মেয়ে হয়েও করে না। কিন্তু মুখে বলল,
“আপনি তো রোদে কালো হয়ে যাবেন। বাড়ি ফিরে যান নাহয়। আমার এইটুকু তো পথ।”

অনুভব ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের এক কদম পেছনের মেয়েটিকে দেখে নিয়ে বলল,
“আমার চিন্তা করার জন্য থ্যাংকিউ। বাট ছাতা তোমারও প্রয়োজন ছিল। জ্বর গায়ে রোদে হেঁটে গেলে মাঝপথেই আবার সেন্সলেস হয়ে পড়বে।”

প্রিয়া চোখ তুলে সুদর্শন পুরুষটির দিকে চাইল একপলক। দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল সঙ্গে সঙ্গে। এরই মাঝে অনুভব ফার্মেসির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বলল,
“ভাইয়ার দেওয়া প্রেস্ক্রিপশনটা এনেছ তো? চলো মেডিসিনগুলো নিয়ে নেই।”

প্রিয়া তড়িঘড়ি করে নিষেধ করে,
“পরে কিনে নেব।”

অনুভব ওর জড়তা খেয়াল করে কিছু একটা আন্দাজ করে নিল। এরপর ফার্মেসির দিকে পা বাড়িয়ে কৌতুক করে বলল,
“অসুখ তোমার কর্মচারী নাকি যে তোমার খামখেয়ালির জন্য সেও একটু খামখেয়ালি করে জিড়িয়ে নেবে?”

প্রিয়ার নিষেধ সত্ত্বেও অনুভব সবগুলো মেডিসিন কিনল। দামও নিজেই দিল। সব মিলিয়ে পাঁচশ ত্রিশ টাকা হয়েছে। প্রিয়াকে মাথা নুইয়ে থাকতে দেখে অনুভব তেজের সঙ্গে বলল,
“ভেবো না মাগনা দিলাম। এ মাসের বেতন পেয়েই শোধ দেবে।”

প্রিয়া শুধু মাথা কাত করল। রাস্তায় উঠে পাশাপাশি হাঁটা শুরু করলে অনুভব পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
“তারপর? ভার্সিটি এডমিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছ না?”

“লালমাটিয়া মহিলা কলেজে অনার্সে ভর্তি হবো ভাবছি।”

“সেকি! পাবলিকে এক্সাম দেবে না?”

“বইপত্র নেই, কোচিং করিনি, গাইডলাইন নেই। প্রিপারেশন ছাড়া সাহস করি না। তাছাড়া এক্সামের জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফর্ম কেনা, এক্সাম ফি, যাতায়াত ইত্যাদির পেছনে বাড়তি খরচ করার ইচ্ছেও নেই।”

অনুভব বুঝল মেয়েটির অবস্থা। একটু ভেবে বলল,
“তোমার ব্যাগ্রাউন্ড কী?”

“হিউম্যানিটিস।”

“গ্রেইট, আমি তোমাকে হ্যাল্প করতে পারব।”

প্রিয়া হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“এইটুকু সময়ে কিছুই হবে না। কয়েকদিন বাদেই রেজাল্ট। তারপরই ইউনিভার্সিটিগুলো ফর্ম ছাড়বে।”

“চেষ্টা করলে কিছুই অসাধ্য না। তোমাকে পরিশ্রম করতে হবে।”

প্রিয়ার এখন অন্য বিষয়ে কথা বলতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছে না। সে বেখেয়ালে বলল,
“আচ্ছা দেখি। আপনি এবার আসুন। আমি একটু অন্য কোথাও যাব।”

অনুভব থেমে গেল। বুঝল মেয়েটা কিছু একটা নিয়ে সংকোচবোধ করছে। অনুভব চুটকি বাজিয়ে বলল,
“ওহহো! বয়ফ্রেন্ডের সাথে মিট করতে যাবে, রাইট? আমার সঙ্গে দেখে ফেললে বয়ফ্রেন্ড মাইন্ড করতে পারে ভেবে ভয় পাচ্ছো?”

প্রিয়া আকাশ থেকে পড়ল। একটু ঝাঝাল গলায় বলল,
“আপনার মাথায় কী এইসব বিষয় ছাড়া অন্যকিছু ঘোরে না?”

অনুভব দুষ্টু হেসে হাতের আঙুল দ্বারা চুল আচড়ে বলে,
“কী করব বলো, মেয়েরা আমাকে যেভাবে চোখ দিয়ে ঘিরে রাখে তাতে অন্যকিছু ভাবার উপায় আছে?”

“মনে হচ্ছে আপনি খোলা মিষ্টি। তাই গায়ে মাছি বসে।” প্রিয়া ঠোঁট টিপে হাসল।

অনুভব অপমানিত বোধ করল। কটমট করে বলল,
“কী বোঝাতে চাইলে তুমি?”

“কিছু না।”

“অবশ্য তোমার মাথায় এরচেয়ে ভালো উদাহরণ আসবেই বা কী করে। স্ট্যান্ডার্ড যেমন ভাবনাও তেমন। যাও যেখানে যাওয়ার।”
অনুভব হনহন করে উলটোপথে চলে গেল।

চলবে…