Sunday, July 20, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1929



এ শহর মেঘলা ভীষণ পর্ব – ১৭

0

এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ১৭
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

বউভাতের দিন বর কনেকে এক সাথে কনের বাড়িতে যাবার রীতি হলেও রাজিব যেতে পারলো না। রাজিবের মা মাঝে মাঝেই ঢাকায় এসে ছেলের সাথে থাকেন। তবে দীর্ঘ সময় নিয়ে কখনো থাকেন না। স্বামীর ভিটায় ফিরে যাবার জন্য পাগল হয়ে যান । তাই এবারও থাকতে রাজি না তিনি। ছেলে আর ছেলের বউকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করিয়েছেন যাতে তাকে গ্রামে দিয়ে আসে। মা কে গ্রামে দিয়ে আসতে হবে রাজিবের। এদিকে অফিসেও যেতে হবে। মাঝে অনেক দিন সৌরভের সাথে ছুটোছুটি করতে গিয়ে অফিস থেকে ছুটি নেয়া হয়েছিলো। এখন আবার এভাবে বার বার ছুটি নিলে চাকরীটাই থাকবে না। তাই সব দিক ম্যানেজ করতে গিয়ে সৌরভদের সাথে তোহাকে একাই পাঠালো রাজিব। সে গেলো গ্রামে মা কে দিয়ে আসতে।

বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে আসায় অন্যরকম একটা অনুভুতি কাজ করছে ভিতরে ভিতরে। শাড়ি পরে সারা বাড়িতে এ ঘর থেকে ও ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তোহা। কখনো সুবর্ণার ঘরে গিয়ে আড্ডায় মেতে উঠছে আবার কখনো বা মিলির সাথে।
সন্ধ্যায় বাড়ির সকলে মিলে ড্রইং রুমে বসে কথা বলছিলো। তখন সৌরভ আসে বাহির থেকে। সৌরভকে দেখে তোহা ডাকে,
– ‘ ভাইয়া এসো। বসো এখানে। ‘
তোহার ডাকে সৌরভ এগিয়ে এসে বসে বোনের পাশে। মিলি তাদের সোজা সামনের সোফায় বসে আছে। সৌরভের চুল গুলো এলোমেলো। গরমে নাকের ডগায় হালকা ঘাম জমেছে। সেদিকেই আনমনে তাকিয়ে আছে মিলি। তার বুকের ভেতর তখন ঢিপ ঢিপ শব্দ তুলে যাচ্ছে। মিলির এমন ভাবে তাকিয়া থাকাটা তোহাই প্রথমে লক্ষ্য করলো। সে সৌরভকে হাত দিয়ে আলতো করে খোঁচা দিলো। সৌরভ তোহার দিকে তাকাতেই তোহা চোখের ইশারায় মিলিকে দেখালো। তোহার ইশারা অনুসরণ করে তাকাতেই সৌরভের সাথে চোখে চোখ পরলো মিলির। মুখে দেখা গেলো এক রাশ লজ্জা। ঠোঁটের কোণে লুকানো হাসি। সৌরভ সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো অপ্রস্তুত হয়ে। মিলির সাথে সে যতটা সহজ ছিলো ইদানিং ততোটা সহজ নেই সে। আরো বেশি জটিল হয়ে গেছে তাদের মাঝের সম্পর্কটা। আজ কাল মিলিকে দেখলে সে এড়িয়ে যেতে চায়। নিজের ভিতরে কেমন একটা সংকোচ বোধ করে। কিছুটা অস্বস্তিও হয়। কিন্তু এমনটা কেনো হয় সে কারণ সৌরভ বুঝতে পারে না। তার আর মিলির সম্পর্কটা তো মজা করার, হাসি তামাশা করার। তবে এখন সেটা না হয়ে বিপরীত কিছু কেনো হচ্ছে! মিলিরও কি এমনটাই হচ্ছে ?

– ‘ আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি। তোমরা বসে কথা বলো। ‘ বলেই উঠে চলে গেলো সৌরভ। মিলি হাসলো। ঠোঁট টিপে লুকানো হাসি।

রাতে ডিনার শেষ করে যে যার রুমে চলে গেছে। তোহা নিজের রুমে এসে দেখলো মিলি ফোনে কিছু একটা দেখছে। সে খুব সাবধানে এগিয়ে এলো মিলির দিকে। সতর্ক ভাবে এসে দাঁড়ালো মিলির পেছনে। তারপর মুখে ফুটে উঠলো তার রাজ্যের খুশির ঝিলিক। মিলির হাতে থাকা ফোনে সৌরভের একটা ছবি। তোহার বিয়ের দিন তোলা ছবিটা। মিলি সৌরভের ছবি দেখছে আর তখন ড্রইং রুমে সেভাবে তাকিয়ে ছিলো সৌরভের দিকে। এসব কিছু মিলিয়ে তোহা বুঝতে পারলো বিষয়টা। সে পেছন থেকে মিলির গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
– ‘ লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ভাইয়ের ছবি দেখা হচ্ছে ! ‘
মিলি চমকে উঠলো। ফোনটা দ্রুত পাশে উল্টে রেখে দিলো। তবে ততোক্ষণে যা বুঝার বুঝে গেছে তোহা। মিলি একটু কাঁচুমাচু করে বললো,
– ‘ কই না তো । ‘
তোহা হেসে বললো,
– ‘ দেখলাম তো আমার ভাইয়ের ছবিই দেখছিলে। তাছাড়া সন্ধ্যায় ড্রইং রুমে সেভাবে  তাকিয়ে ছিলে সেটাও দেখেছি। ‘
ধরা পরে লজ্জায় ভেঙে পরলো মিলি। কী বলবে বুঝতে পারছিলো না। মাথা নিচু করে লজ্জা আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে সে।

– ‘ ভালোবাসো আমার ভাইটাকে ? ‘
তোহার কথায় মিলি চোখ মেলে তাকালো তার দিকে। সে কী সৌরভকে ভালোবাসে ? এই অল্পদিনে কী কারো প্রতি ভালোবাসা হয়ে যায় ? উত্তর জানা নেই মিলির। সে শুধু জানে মানুষটার প্রতি এখন অন্যরকম অনুভুতি কাজ করে। মানুষটাকে দেখলে বুকের মাঝে শান্তির জোয়ার বয়ে যায়। এক ঝাক প্রজাপতি উড়ে যায় গা ঘেঁষে।

দুদিন ভাইয়ের কাছে থেকেই তোহা আবার চলে গেলো। রাজিব এসে নিয়ে গেছে ওকে। সংসার সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে তোহা। নিজের মতো গুছিয়ে নিচ্ছে সব কিছু। ভালো লাগা কাজ করছে মনের মাঝে। অদ্ভুত ভালোলাগা। নিজের হাতে সংসারের সব হাল ধরাতে কী এক অবিশ্বাস্য আনন্দ! তা সে উপভোগ করছে।

সুবর্ণা আর মায়াকে নিয়ে মোহন কুমিল্লা চলে গেছে। মিলিকে একা রেখে যদিও তার বাবা মা যায়নি। তারা ঢাকায়ই আছেন। সৌরভের সাথে রোজ অফিস যাচ্ছে মিলি। আবার এক সাথে ফিরছে। বাসায় এসে রাতে সকলের সাথে এক টেবিলে বসে খাচ্ছে । মায়ের কোলে মাথা রেখে রাতে খুব করে গল্প করছে। ঘুমুতে যাবার আগে রয়েছে সৌরভের দেয়া দৈনন্দিন অজস্র স্মৃতি। বেশ আছে মিলি। রূপকথার রাজকুমারীর মতো করে রাজকুমার কে দূর থেকে দিন কে দিন শুধু ভালোবেসেই যাচ্ছে। নিজের ভালোবাসার কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারছে না। সে চায় সৌরভ তার ভালোবাসা উপলব্ধি করুক। নিজ থেকে বুঝুক মিলি তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। তবে সেটা কী কখনো বুঝবে সৌরভ ? না বুঝলেও ক্ষতি নেই। এই মানুষটাকে সে দূর থেকেও আজীবন ভালোবেসে যেতে পারবে।

সৌরভ ছায়ার ছবির সামনে এক মনে দাঁড়িয়ে ছিলো। মনটা আজ বড্ড খারাপ লাগছে। বার বার মনে পড়ছে ছায়ার সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো। অথচ ছায়ার মৃত্যুটা ধোঁয়াশাই রয়ে গেলো। কোন ভাবেই পারলো না খুনিকে খুঁজে বের করতে। বিষণ্ন মনে যখন সৌরভ বারান্দার দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। তখনই আমেনা বেগম সৌরভের রুমে প্রবেশ করলেন। সৌরভ শাশুড়ী কে দেখে হাতে রাখা সিগারেট টা নিভিয়ে ফেলে দিলো। রুমের ভিতর এসে যথাসম্ভব স্বাভাবিক ভাবে বললো,
– ‘ বসুন মা। আপনি কষ্ট করে এলেন কেনো! আমাকে ডেকে পাঠাতে পারতেন। ‘
– ‘ ছেলের ঘরে মা আসতে পারে না বুঝি ? ‘
– ‘ অবশ্যই পারে। ‘ হাসি মুখে বললো সৌরভ।

আমেনা বেগম চুপ করে রইলেন। তার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে মুখশ্রী। সৌরভ সেটা লক্ষ্য করে বললো,
– ‘ আপনাকে কেমন যেনো দেখাচ্ছে মা। কোন সমস্যা হয়েছে ? ‘
– ‘ তোমাকে একটা কথা বলতে এসেছি বাবা।’
– ‘ হ্যাঁ। বলুন। ‘
– ‘ ছায়া আমাদের ছেড়ে চলে গেছে অনেক দিন হলো। আমরা এখানে আছি। আমাদেরও বাড়ি ফিরে যেতে হবে। সারাজীবন তো এখানে থাকা সম্ভব না। তাছাড়া তোহার বিয়ে হয়ে গেছে। তুমিই বা একা বাড়িতে থাকবে কী ভাবে ? আর কতদিনই বা এভাবে একা জীবন পার করবে ? তুমি আমার ছেলের মতো বলবো না। তুমি আমার আরেকটা ছেলে। মোহন যতটা, ঠিক ততোটাই তুমি। তাই একজন মা হিসেবে আমি চাই তুমি নিজের জীবন আবার নতুন ভাবে শুরু করো। বিয়ে করো। জীবন শুধু কারোর মায়া নিয়ে পার করা যায় না। জীবনে চলতে হলে এক জন সঙ্গীর খুব বেশি প্রয়োজন আছে। ‘

– ‘ আমি সবই বুঝতে পেরেছি মা। তবে এখন এসব সম্ভব না। ছায়াকে ভুলে অন্য কাওকে বিয়ে করে জীবন পার করা আমার পক্ষে সম্ভব না। যদি বিয়ে করতেও হয় সেটা পরে দেখা যাবে। এখন এ সব নিয়ে ভাবছি না আমি। ‘ খুব শান্ত ভাবে বললো সৌরভ।

– ‘ কত দিন এভাবে পার করবে ? একা বাঁচা যায় না। জীবনে চলার পথে অনেক বাধা আসে। অনেক খারাপ পরিস্থিতি আসে। তখন আবেগ দিয়ে বাঁচা যাবে না। আর কারোর স্মৃতি নিয়ে জীবন পার করে দেয়াটা আবেগ ছাড়া কিছু না। আবেগ কে প্রশ্রয় দিলে চলে না। আমি তোমার বিয়ে দিয়ে তারপর নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে চাই। ‘
সৌরভ কিছুই বললো না। তাকে চুপ থাকতে দেখে আমেনা বেগম আবার বললেন,
– ‘ মিলিরও বিয়ের বয়স হয়েছে। এবার তার বিয়ের কথাটাও ভাবছি আমরা। তাই আমি চাই আমার ঘরের ছেলে ঘরে মায়ের কোলেই থাকুক। তোমার আর মিলির বিয়ে দিতে চাই আমি। যদি তোমার কোন আপত্তি না থাকে। ‘

সৌরভ অবাক হয়ে তাকালো শাশুড়ীর মুখের দিকে। বিস্ময় খেলা করছে তার চোখে মুখে।
– ‘ কী বলছেন মা। মিলি! আমি ওকে সে ভাবে দেখিইনি কখনো। মিলির বিয়ে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমরা সবাই মিলে ওর জন্য অনেক ভালো ছেলে খুঁজে আনবো। তবে আমার সাথে না। মিলি নিজেও এটা মানতে পারবে না। আর আমিও না। ‘

আমেনা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
– ‘ মিলি যে তোমাকে ভালোবাসে তা জানো ?’

সৌরভের মুখটা যেনো শুকিয়ে মিইয়ে গেলো। এরকম কিছুই হয়তো তার অবচেতন মন বুঝতে পারছিলো। কিন্তু সবটাই ছিলো ঝাপসা। সে একবারও ভাবেনি এমন কিছু হতে পারে। মিলি তাকে ভালোবাসে এটা তার জন্য চরম বিব্রতকর বিষয়। সত্যি মিলি তাকে ভালোবাসতে পারে এটা তার মাথায়ও আসেনি। সে শুধুই মিলির পাগলামো গুলো দেখে অবাক হয়েছে, চমকেছে। তবে কখনোই এই বিষয়টাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি।

চলবে…

এ শহর মেঘলা ভীষণ পর্ব – ১৬

0

এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ১৬
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

রাজিবের কিছু বন্ধুরা এসেছে বাসায়। তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো তোহাকে। সব সময় বন্ধুরা এক সাথে হলে সেখানে সৌরভও থাকতো। কিন্তু এখন এটা যেহেতু বোনের শ্বশুর বাড়ি তাই সে যখন তখন আসতে পারে না বলে আসেনি। তোহাকে নিতে বউভাতে একদম আসবে বলেছে। এতো গুলো ছেলের মাঝে বসে কথা বলতে তোহার অস্বস্তি লাগছিলো। তবে রাজিবের কারণে থাকতে হচ্ছে তাকে। যদিও রাজিব তোহার পাশে বসে আছে তার হাত ধরে। তাই সাহস পাচ্ছে তোহা। বন্ধুরা সবাই বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললেও তোহা চুপচাপই রয়েছে। লম্বা করে একটা ছেলে বললো,
– মাশাল্লাহ রাজিব! তোর চয়েজ আছে বলতে হবে। ভাবি দেখতে খুব মিষ্টি।

ছেলেটির কথার মাঝে একটা মাধুর্য আছে। তোহার ভালো লাগলো। সে হালকা হেসে মাথা নিচু করে রইলো। পাশ থেকে কথার পিঠে অন্য একটি ছেলে বলে উঠলো,

– ‘ মিষ্টি কি খেয়ে দেখবি না কি ? ‘
কথাটি শেষ করে ছেলেটি তোহার দিকে একটু নেশাতুর দৃষ্টিতে তাকালো। ঘেন্নায় গা গুলিয়ে উঠলো তোহার। তবে অন্য বন্ধুরা হয়তো জানে ওই ছেলেটার কথাবার্তাই এমন। তাই তাদের মাঝে একজন বললো,
– ‘ আরে বাদল!  তোর কথার ধরন আর ঠিক হলো না। সব জায়গায় শয়তানি করতে নেই। ভাবি তো জানে না তুই মজা করছিস। বেচারি বিব্রত বোধ করবে। ‘
রাজিবও ভ্রু কুঁচকে তাকালো বন্ধুর দিকে। স্ত্রীর সামনে বন্ধুর এমন ধরনের কথায় বেশ বিরক্ত সে।
বাদল নামের ছেলেটা অদ্ভুত হাসলো। তখন তোহার রুম থেকে ফোন বাজার শব্দ কানে আসতেই তোহা উঠে চলে গেলো রুমে। পেছন পেছন রাজিবও এলো।

তোহা ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মিলির কন্ঠস্বর ভেসে আসলো।
– ‘ কী করা হচ্ছিলো তোহা রাণী ? ‘
তোহা হাসলো। প্রাণ জুড়ানো হাসি।
– ‘ ওর বন্ধুরা এসেছে। তাদের সাথেই কথা বলছিলাম। ‘
– ‘ তাহলে কথা বলো। পরে কল দিবো না হয় আমি। ‘
– ‘ আরে না না। ওরা আছে থাকুক। এখন বলো তোমরা কাল আসছো তো ? ‘
– ‘ হুম আসছি। ‘
তোহা আর মিলির কথার মাঝে রাজিব তোহার ঘাড়ে নাক ঘঁষতে শুরু করেছে। পেছন  থেকে জড়িয়ে ধরে আছে সে তোহাকে। তোহা হাসি চেপে রেখে কথা বলছিলো। কথা শেষ হতেই ফোন রেখে পাশ ফিরে তাকালো। রাজিবের গলা জড়িয়ে ধরে ভ্রু উঁচিয়ে যখন তাকিয়ে ছিলো তখন রাজিব তোহার কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে নিয়ে এলো। এমন সময় দরজার পাশ থেকে বাদল কেঁশে উঠলো।  তোহা দ্রুত সরে দাঁড়িয়ে কাপড় ঠিক করে নিয়ে মাথায় দিলো। বাদল হালকা হেসে বললো,
– ‘ নতুন বউ পেয়ে নরছিসই না যে। আমাদেরও সময় দে। ‘ 
রাজিব কটমট করে তাকালো বাদলের দিকে। এই ছেলে সব সময় এমন। তবে তোহা এই পরিবারে নতুন বলে তার সামনে ঝামেলা করতে চাচ্ছে না রাজিব। বাদল কথা শেষ করে চলে যেতেই সে তোহাকে বললো,
– ‘ ওদের সামনে আর যেতে হবে না তোমাকে। বেশি শয়তানি করছে। তুমি বরং থাকো রুমে। ‘
তারপর রাজিব বেড়িয়ে গেলো ড্রইং রুমে। তোহা মাথা থেকে কাপড় টা সরিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে এসে বিছানায় বসলো । এতো গুলো ভালো বন্ধুর মাঝে এমন দু একটা না থাকলে কি চলে না? কেমন বিশ্রী স্বভাব এদের!

সৌরভ সন্ধ্যায় বাসায় ফিরার পর ড্রইং রুমে সকলকে এক সাথে ডাকা হলো। সবাই এসে দেখলো সৌরভের সামনে রাখা অনেক গুলো শপিং ব্যাগ। মিলি অবাক হয়ে বললো,
– ‘ এতো শপিং ? ‘
– ‘ হ্যাঁ। কাল তো তোহার শ্বশুর বাড়ি যাবো তাই তাদের জন্য কিছু শপিং করলাম। ‘
– ‘ বেশ ভালো করেছেন। ‘

সৌরভ এগিয়ে গিয়ে আমেনা বেগমের হাতে একটা শপিং ব্যাগ দিয়ে বললো,
– ‘ এটা আপনার জন্য মা। কাল পরবেন। ‘
আমেনা বেগম হাসি মুখে বললেন,
– ‘ আমাদের জন্য কেনো আবার! তাছাড়া কাল তো আমি বাসায়ই থাকবো। তোমরা গিয়ে তোহাকে নিয়ে আসবে। ‘
– ‘ না। আপনারা সবাই যাবেন। ‘
– না বাবা। বাসায় আমরা থাকি। তোমরা ছেলে মেয়েরা যাও। এদিকটায়ও তো কাওকে থাকতে হবে।
সৌরভ অনেক জোড়াজুড়ি করেও লাভ হলো না। আমেনা বেগম যেতে রাজি হলেন না। তারপর সৌরভ শপিং ব্যাগ গুলো একে একে সকলের হাতে দিলেন। বাড়ির সকলের জন্য সে শপিং করে নিয়ে এসেছে। মিলির হাতে শপিং ব্যাগটা দেয়ার সময় মিলি বললো,
– ‘ এটা নিয়ে যান আপনার সাথে। পরে এসে নিয়ে নিবো আমি। ‘

সৌরভ একবার উপস্থিত সকলের দিকে তাকালো। সবার সামনে মিলির এমন কথায় কে কী ভাবছে এটা ভেবেই সৌরভের অস্বস্তি লাগতে লাগলো। মিলির সাথে এখন কথা না বাড়ানোই ভালো। তাই সে মিলির শপিং ব্যাগটা হাতে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
সৌরভ রুমে যেতেই পেছন পেছন মিলিও গেলো। রুমে ঢুকেই বললো,
– ‘দেন তো শপিং ব্যাগটা।’
সৌরভ ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে দিলো শপিং ব্যাগ। বললো,
– ‘ সকলে কী ভাবলো তোমার এমন কান্ডে ?’

– ‘ কী ভাববে?  আপনার সাথে কী আমি প্রেম করছি নাকি যে কিছু মনে করবে !’ ব্যাগ থেকে ড্রেসটা বের করে দেখতে দেখতে আনমনে বললো মিলি।
সৌরভ বিষম খেলো। কথা ঘুরানোর জন্য বললো,
– ‘ ড্রেস পছন্দ হয়েছে ? ‘
মিলি সাদার মাঝে গোলাপি সুতোর কাজের জামাটা দেখে বললো,
– ‘ খুব। তবে আপনি আমার জামার সাইজ বুঝলেন কী ভাবে ? ‘
– ‘ তুমি আর ছায়া তো একরকমই। ছায়ার মাপ জানা ছিলো। সেই মাপেই এনেছি। ‘
মিলি কিছু বললো না। খুটিয়ে খুটিয়ে জামা দেখছে এমন ভাব নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো সে।

পরদিন সকালে সকলে মিলে তৈরী হয়ে নিলো রাজিবের বাসায় যাওয়ার জন্য। গাড়িতে সৌরভ আর মোহন সামনে বসলো। সুবর্ণা মায়া আর মিলি বসেছে পিছনের সিটে। সৌরভের কিনে আনা ড্রেস গুলো সকলে পরেছে। ড্রাইভিং সিটে বসে সৌরভ যখন ড্রাইভ করছিলো তখন তার চোখ গেলো গাড়ির লুকিং গ্লাসে। মিলি তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। গোলাপি ওষ্ঠদ্বয়ে তার মিষ্টি হাসি। গাড়ির জানালার কাচের ফাঁক গেলে হাওয়ার ঝাপটা এসে স্নিগ্ধ চুল গুলোকে এলোমেলো করে উড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে।  সৌরভের চোখে চোখ পড়তেই মিলি চোখ টিপলো । সাথে সাথে সৌরভ চোখ বন্ধ করে ঘাড় দুপাশে ঝাকিয়ে মনোযোগ সরিয়ে নিলো ড্রাইভিং করায়।

গাড়ি থেকে নেমে মোহন, সুবর্ণা আর মায়া আগে আগে গেইটের দিকে হাঁটতে লাগলো। মিলি নামলো সবার শেষে। সৌরভ নেমে এসে মিলিকে না দেখার ভান করেই যখন এগিয়ে যাচ্ছিলো তখন মিলি পেছন থেকে ডেকে বললো,
– ‘ এই যে শুনুন। ‘
না চাইতেও পেছন ফিরে তাকাতে হলো সৌরভকে। সে এগিয়ে এসে মিলিকে বললো,
– ‘ আরে এখনো দাঁড়িয়ে কেনো তুমি! চলো ভেতরে চলো। ‘
মিলি সৌরভ কে একবার উপর নিচ ভালো করে দেখে নিয়ে বললো,
– ‘ ভেতরে তো যাবোই। তার আগে বলুন আপনি আজও সাদা পাঞ্জাবী পরলেন কেনো!  সব সময়ই দেখি পাঞ্জাবী পরলে সাদা কালারটাই পরেন। ‘
তারপর কিছু একটা ভেবে আবারো বললো,
– ‘ও মা। আজ তো আমিও সাদা ড্রেস পরেছি। আপনি আমার ড্রেসের সাথে নিজের পোশাক ম্যাচিং করে পরেননি তো আবার ? ‘

সৌরভ চোখ বড় বড় করে তাকালো মিলির দিকে। ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,
– ‘ আমার সাদা রঙ ভালো লাগে বেশি। তোমার সাথে ম্যাচিং করে পরতে যাবো কেনো! ‘
– ‘ কেনো! আমার সাথে ম্যাচিং করে পরা যাবে না নাকি! হুহ ‘ সৌরভের দিকে দু পা এগিয়ে এসে কথাটি বলেই মিলি চলে গেলো গেইটের ভেতর। সৌরভ কিছু বুঝতে না পেরে মুখ বাঁকা করে তাকিয়ে রইলো মিলির যাবার পানে। তার চোখে মুখে বিস্ময় খেলা করছে। মিলির এমন অদ্ভুত ব্যাবহার তাকে খুব ভাবাচ্ছে। অথচ সে বুঝতেও পারছে না মিলি তাকে নিয়ে মনে মনে হাজারো স্বপ্ন বুনে ফেলেছে।

চলবে…

এ শহর মেঘলা ভীষণ পর্ব – ১৫

0

এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ১৫
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

রাজিবের কিছু কাজিনরা তোহাকে রুমে বসিয়ে রেখে গেছে। সম্পূর্ণ রুমটা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। বিছানার মাঝে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে তোহা। দরজার এদিক দিয়ে কারোর পায়ের আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে তাকালো সে। রাজিবের মা এসেছেন। তিনি ছেলের বউ এর পাশে এসে বসলেন। চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। গায়ের চামড়া অনেকটা কুঁচকে গেছে। তবুও শক্তপোক্ত আছেন এখনো। তোহার হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিয়ে তিনি বললেন,
– ‘ আমার ছেলেটাকে এখন তোমার হাতেই দিলাম মা। ওকে নিজের মতো গুছিয়ে নিও। ‘
শাশুড়ীর কথায় তোহা হালকা হাসলো। যাবার আগে এক জোড়া বালা তিনি ছেলের বউয়ের হাতে পড়িয়ে দিয়ে গেলেন। তোহা বুঝতে পারলো মানুষটা অনেক সরল মনের। আগে থেকেই সে রাজিবের মা কে চিনতো। কিন্তু এখন চিনলো সম্পূর্ণ নতুন এক পরিচয়ে। এখন এই মানুষ গুলো তার নিজের লোক। নিজের পরিবার। কিছুক্ষণ পরই রাজিব রুমে এলো। দরজা লাগিয়ে এসে বসলো তোহার পাশে। তোহা তখন লজ্জায় বুকের সাথে চিবুক মিশিয়ে ফেলেছে। তোহার লজ্জামাখা মুখ দেখে রাজিব বাঁকা হাসে। তোহার মুখটা দুহাত দিয়ে উপরে তুলে ধরলো সে। আলতো করে নিজের ঠোঁট ছোয়ালো তোহার কপালে। ভালোবাসার মানুষের স্পর্শে তোহা তখন জগতের শ্রেষ্ঠ অনুভূতি টের পাচ্ছে। দুটো মানুষ পরস্পরকে ভালোবেসে এক হবার পরে এতোটা কাছে এসে নিজেদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। নিয়ন্ত্রণ করার কোন প্রয়োজনও বোধ করছে না। এখন মানুষটা তার। সহজেই বিলিন হওয়া যায় এই মানুষটার মাঝে। তোহা আর রাজিবও তাই করলো। ওকে ওপরের কাছে নিজেকে স্বপে দিলো।

সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাড়ির সকলে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। চারপাশে এখনো বিয়ে বাড়ির আলো জ্বল জ্বল করছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাহিরের দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে সৌরভ। নিজেকে ভীষণ একা লাগছে। ছায়া চলে যাবার পর আজ তোহাও চলে গেলো অন্যের ঘরে। এখন নিজের মানুষ বলতে কে আছে তার ?
সৌরভের এলোমেলো ভাবনার ঘোর ভাঙলো কারোর হাসির শব্দে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো মিলি দাঁড়িয়ে আছে। হাতে থাকা ফোনের দিকে তাকিয়ে অনর্গল হাসছে সে। কিছু একটা দেখে যে হাসছে বুঝা যাচ্ছে। বিয়ের সাজগোছ কিছুই এখন নেই। একটা লং স্কার্ট এর সাথে সাদা টি শার্ট পড়া। চুল গুলো মাথায় খোঁপা করে রেখেছে। আজ কাল মিলির মাঝে ছায়াকে দেখতে পায় সৌরভ। কিন্তু তার এমন ভাবনাকে সে একদম প্রশ্রয় দিতে চায় না। এটা ঠিক না। অন্যায়। অথচ মিলি তার সাথে ইদানিং কী পাগলামোটাই না করছে! এখনই বা রুমে এসে হাসছে কেনো!

সৌরভ এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো মিলির সামনে। ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মিলি খুব সহজ ভাবে আগের মতোই হেসে বিছানায় গিয়ে বসে বললো,
– ‘ দেখুন তো ছবি গুলো। ‘ 
সৌরভ মিলির পাশে গিয়ে বসলো। মিলির ফোনের দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখতে পেলো বিয়ের অনুষ্ঠানে তার একার কিছু ছবি। ছবি গুলো অদ্ভুত। সৌরভ এক এক কাজ করছিলো সময় কেউ তুলেছে। একটা ছবিতেও সৌরভের চোখ মুখের ঠিক নেই। কে তুলেছে এই ছবি গুলো! রাগ উঠে গেলো সৌরভের। মিলি এক চোখ তুলে তাকালো সৌরভের মুখের দিকে। তারপর ফিক করে আবারো হেসে দিলো। বেশ গম্ভীর গলায় সৌরভ প্রশ্ন করলো,
– ‘ কে তুলেছে এগুলো! ‘
মিলি ঠোঁট চেপে হাসলো।
– ‘ আমি। ‘
– ‘ তুমি ?’ সৌরভ অবাক হলো।
– ‘ হুম। আপনাকে যা সুন্দর লাগছিলো ! তাই তুলে নিয়ে ছিলাম। কিন্তু আপনি ঠিক ভাবে দাঁড়াচ্ছিলেনই না। তাই এমন হয়েছে। ‘

মিলির মুখের হাসিটা প্রশস্ত হলো। সৌরভ কিছু বললো না। গম্ভীর মুখে বসে রইলো মিলির পাশে। বেশ কিছু সময় নিরবে, স্তব্ধতায় কেটে গেলো। মিলি বললো,
– ‘ কাল আপনার অফিস আছে ? ‘
সৌরভ ছোট করে উত্তর দিলো,
– ‘ হুম। ‘
– ‘ ওমা! বোনের বিয়ে আর আপনি ছুটি নেননি ? কাল কিসের অফিস আবার! ‘
– ‘ অযথা ছুটি নিবো কেনো?  আজ তো ছুটি নিয়েছিলাম। বিয়ে শেষ। কাল থেকে আবার অফিস করবো। ‘
মিলি সৌরভের উত্তরে বিরক্ত হলো। নাক মুখ খিঁচে বললো,
– ‘ আমি ছুটি নিয়েছি। বিয়ের রেশ কাটটে সময় লাগবে আমার। ‘
এবারে সৌরভ হেসে দিলো।
– ‘ তোমার বিয়ে নাকি! রেশ কিসের আবার ? ‘
– ‘ ওই একই কথা। ‘
সৌরভ আর ঘাটালো না মিলিকে। এই মেয়ের কিছুদিন যাবত হলোটা কী সে বুঝতে পারছে না। কেমন অপরিচিত লাগছে।

বিছানার উপর সকালের মিষ্টি আলো এসে পড়েছে। হালকা হিম বাতাস এসে লাগছে গায়ে। ঠান্ডার প্রকোপ আসতে চলেছে তার আগাম বার্তা জানান দিচ্ছে প্রকৃতি। কিন্তু এখন তো শীতকাল না! তবুও এমন হিম শীতল  আবহাওয়া গায়ে কাঁটা লাগিয়ে যাচ্ছে কেনো! আকাশ কিছুটা মেঘলা। আষাঢ় মাস পড়েছে। এখন ঠান্ডা লাগার কারণটা বুঝতে পারলো তোহা। আষাঢ়ের বৃষ্টি নেমে আসার সময় হয়েছে। এখন প্রকৃতি মেতে উঠবে তার প্রিয় খেলায়। যখন তখন হুড়মুড় করে বৃষ্টি ছাপিয়ে নেমে আসবে। ভিজিয়ে দিয়ে যাবে গাছ পালা, রাস্তাঘাট, চারপাশকে। ঠান্ডা হাওয়ার মাঝেও গায়ের উপর কারো উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করে তোহা নড়ে উঠলো। রাজিব তার গায়ের উপর লেপ্টে আছে। হালকা হাসলো তোহা। রাতের কথা মনে হতেই সে লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিলো। এখন উঠবে কী ভাবে!  রাজিবের মুখোমুখি হতে হবে। ভাবতেই কেমন লাগছে। তোহা হালকা ধাক্কা দিয়ে রাজিবকে সরাতে নিলেই রাজিবের ঘুমটা ভেঙে গেলো। সে ঘুম জড়ানো অবস্থাতেই তোহার গলায় মুখ গুজে দিলো। তোহা আবারো শিউড়ে উঠলো। রাজিবকে সরানোর বৃথা চেষ্টা করায় কোন লাভ হলো না। রাজিব আবারো তোহার সবটা দখল করে নিলো। আবারো মজে উঠলো ভালেবাসার এক অন্ধকার আদিম খেলায়।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

– ‘এই যে আমাকে একটু ঘুরতে নিয়ে যাবেন ? ‘
মিলির কথায় ঘুরে দাঁড়ালো সৌরভ। অফিস যাবার সময় হয়ে গেছে। এ সময় কথা বলার ইচ্ছে না থাকলেও রাগতে পারলো না সে। নিজের মানুষদের উপর হুট হাট রাগ করা যায় আবার কখনো বিরক্ত হলেও রাগা যায় না। খুব অদ্ভুত নিয়ম কানুন সৃষ্টি করে নিয়েছে মানুষ নিজেরাই। সৌরভ একটা ব্যস্ততা দেখিয়েই বললো,
– ‘ ঘুরতে যাবে ?’
-‘ হু। ‘ উপর নিচ ঘাড় নাড়িয়ে বললো মিলি।
– ‘ কোথায় ?’
– ‘ আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন। তবে এখন না। এখন তো আপনি অফিস যাচ্ছেন। পরে নিয়ে গেলেও চলবে। ‘
পরে নিলেও চলবে তাহলে এখন ডাকলে কেনো! কথাটা বলতে ইচ্ছে করলেও বললো না সৌরভ। এই মুহূর্তে অফিসের লেট হয়ে যাচ্ছে। সে দ্রুত জায়গাটা থেকে প্রস্থান করলো।

সৌরভ বেরিয়ে যেতেই মিলি ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো। মায়া ডাইনিং এ বসে নাস্তা করছিলো। মিলি সেদিকে এগিয়ে গিয়ে নিচু স্বরে বললো,
– ‘ এই মায়া শুন। ‘
মায়া গাল ভর্তি খাবার মুখে নিয়ে তাকালো মিলির দিকে। মিলি চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সতর্ক হয়ে বললো,
– ‘ তোর সৌরভ চাচ্চুকে কেমন লাগেরে ? ‘
মায়া এবার খাবার চিবুতে চিবুতে বললো,
– ‘ ভালো। ‘
– ‘ কেমন ভালো? ‘
– ‘ খুব ভালো। ‘
– ‘ আমার সাথে মানাবে ? ‘
মায়া আবারো মিলির মুখের দিকে তাকালো। কী বুঝলো কে জানে। কিছু একটা ভেবে বললো,
– ‘ খুব মানাবে। ‘
মিলির মুখে সাথে সাথে রাজ্যের হাসি ফুটে উঠলো। মায়ার গাল গুলো আলতো করে টিপে দিয়ে বললো,
– ‘ ইশশ। কবে যে হবে উনার সাথে বিয়েটা। ‘
তারপর দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলো। মায়া কিছুই না বুঝে আবারো খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। আমেনা বেগম ডাইনিং রুমে আসছিলেন। আড়াল থেকে মেয়ের এমন কথাবার্তা শুনে তিনি তাজ্জব বনে গেলেন! তারপর হুট করে নিজেও মুচকি হাসলেন। মনের মাঝে যেন এক প্রশান্তি ছেয়ে গেলো তার। সৌরভকে তাহলে মিলি মন থেকে মেনে নিতে পেরেছে। পছন্দ হয়েছে মেয়ের। সৌরভ এবার তাদেরই থাকবে। ছেলে মেয়ে দুটো সুখী হবে খুব। একদিন সব ভুলে ভালো থাকবে ওরা। ভাবতেই মনটা শান্ত হয়ে গেলো আমেনা বেগমের।

চলবে…

এ শহর মেঘলা ভীষণ পর্ব – ১৪

0

এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ১৪
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

তোহাকে নিয়ে মিলি আর সুবর্ণা পার্লারে গিয়েছিলো। বিয়ের আগে বউকে নিয়মিত পার্লারে না গেলে নাকি মেকআপে সুন্দর লাগবে না। আর তোহা তো আগে থেকে পার্লারে যায়নি। এখন যদি বিয়ের আগের একটা দিনও না যায় তাহলে বিয়ের কনেকে দেখে লোকজন হাসবে। দেখতে লাগবে বিচ্ছিরি। আর বাসর ঘরে ঢুকে যদি রাজিব দেখে তোহার মুখের সব মেকআপ নষ্ট হয়ে আছে তখন সেও মজা নিবে। এসব হাবিজাবি বুঝিয়েই সুবর্ণা তোহাকে রাজি করিয়েছিলো পার্লারে যেতে। ফেসিয়াল, ভ্রু প্লাগ করে দুটো মেয়ে ঠিক করে এলো তাকে বিয়ের দিন আর গায়ে হলুদের দিন বাসায় গিয়ে সাজিয়ে আসার জন্য। পার্লার থেকে তাদের নিয়ে আসতে গেলো মোহন। বড় রাস্তা থেকে যখন বাসার গলিটা দিয়ে ঢুকছিলো গাড়ি তখন তোহার চোখ যায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলের দিকে। তোহা উৎকণ্ঠা হয়ে বলে,
– ‘ গাড়িটা একটু থামাও তো মোহন ভাইয়া।’
মিলি ভ্রু কু্ঁচকে জানতে চায়,
– ‘ কোথায় যাবে ? ‘
– ‘আমার একটু কাজ আছে। চলেই তো এসেছি। তোমরা যাও আমি দু মিনিটে আসছি। ‘

মিলি আর কিছু জানতে চায় না। মোহন গাড়ি থামায়। তোহা নেমে যাবার পর তারা চলে যায় বাসায়। রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে দিপু। তোহাকে দেখতে পেয়েই সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। এক হাতে নিজের চশমা ঠিক করতে থাকে। তোহা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
–  ‘ হাতে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যে ? ‘
দিপু চোখ নামিয়ে নেয়। পিচ ঢালা রাস্তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলে,
– ‘ হ্যাঁ। রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছি। ‘
– ‘ কোথাও যাচ্ছেন ?’
– ‘ হুম। হোস্টেলে যাচ্ছি। সেখানে থাকবো কিছুদিন। ‘

তোহা অবাক হয়ে বললো,
– ‘ ওমা! আপনি না বাসায় থেকে ক্লাস করতেন ? তাহলে হোস্টেল কেনো ? ‘
– ‘ হোস্টেলে সিট রাখা আছে আমার। মাঝে মাঝেই গিয়ে থাকতাম। এখন আবার যাচ্ছি।’

তোহার মনটা কেনো যেনো খারাপ হলো। সে একটু মিইয়ে গিয়ে বললো,
– ‘ আমার বিয়েতে থাকবেন না ? ভাইয়া তো বলেছিলো আপনাকে থাকতে। ‘

দিপুকে একটু অন্যরকম দেখালো। তার চোখ মুখ শুকনা। গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। সে বরাবরের মতো চশমা ঠিক করতে লাগলো।
– ‘ আসলে আমার এক্সাম আছে তো। চাইলেও মিস দেয়া যাবে না। যাওয়াটা জরুরি। ‘ বলেই একটা রিক্সা পেতেই সেটাতে উঠে পরলো দিপু। বললো,
– ‘ আসি তাহলে। শুভ কামনা আপনার জন্য।’

রিক্সা চলে গেলো। তোহা তাকিয়ে আছে রিক্সা ছুটে যাওয়ার দিকে। তার মনটা হঠাৎ করেই কেনো যেনো খারাপ হয়ে গেলো। দিপু ছেলেটা কি তার থেকে পালিয়ে গেলো ? তোহার মনে হলো পরীক্ষার কথাটা নেহাতই একটা অজুহাত। দিপু থাকতে চাচ্ছে না তার বিয়েতে। কিন্তু কেনো ? আর তারই বা খারাপ লাগছে কেনো এই মুহূর্তে ?

পুরো বাড়ি লাইটিং করা হয়েছে। ড্রইং রুমের দরজার উপর ঝোলানো হয়েছে গাদা গুলের মালা। এক পাশে সাজানো হয়েছে স্টেজ। গায়ে হলুদ মেখে সেখানে বসে আছে তোহা। তার হাতে, গলায়, মাথায় ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। কাঁচা হলুদ আর কলা পাতা  রঙের শাড়ি পরে মাথায় হালকা ঘোমটা টেনে দিয়ে রেখেছে সে। দেখতে বেশ লাগছে। মিলি আর সুবর্ণা তোহার মতোই শাড়ি পরেছে। শুধু তাদের সাজটা আলাদা। ছেলেরা পরেছে সবুজ পাঞ্জাবী। মায়া তোহার পাশেই একটা হলুদ স্কাট পরে বসে আছে। আশে পাশের বাসার সকলকে দাওয়াত করা হয়েছে। তাদের কেউ কেউ এসেছে তোহাকে হলুদ দিতে। মুরুব্বী কিছু মহিলা তোহার গালে, হাতে হলুদ ছুঁয়ে দিচ্ছে।

সৌরভ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। বাহিরের অন্ধকারের মাঝেও আজ সব কিছু জ্বল জ্বল করছে। চারপাশ মুখরিত হয়ে আছে হাজারো ফুলের সৌরভে। মানুষের কোলাহলে আর গানের মিষ্টি সুরে বাড়িটা মেতে উঠেছে বিয়ের উৎসবে। ছায়া থাকলে খুব মজা করতো। মিষ্টি করে সাজতো। সৌরভও নিশ্চই ছায়ার পিছন পিছন ঘুর ঘুর করতো তখন। ছায়ার কথা মনে হতেই মনের মাঝে মেঘের আস্তরন পরে গেলো। তবে মেঘটাকে ভারী হয়ে আসতে দিলো না সে। তোহার গায়ে হলুদ আজ। তার আদরের ছোট বোনটা নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছে চলে যাবে। খুব সুখী হবে সে। এসব ভেবেই মনকে শান্ত করে ফেললো সৌরভ।

পেছন থেকে কেউ একজন দুহাত বাড়িয়ে সৌরভের গালে আলতো করে হলুদ লাগিয়ে দিলো। তারপর খিল খিল করে হাসতে লাগলো। সৌরভ পেছন ফিরে দেখলো মিলি। তবে এটা কি মিলি ? নাকি ছায়া ? মিলিকে একদম ছায়ার মতো লাগছে। চুল গুলো খোপা করে রাখায় আর ভারী সাজে দুবোনের মাঝে পার্থক্য খুঁজে বের করা খুব কঠিন হয়ে পরেছে। কাছের মানুষ না হলে বাহিরের যে কেউ আজ ভাবতো এটা ছায়া। সৌরভ হালকা হাসলো। হলুদ মাখা গালে তার হাসিটা দেখে মিলির ভেতরে কেমন একটা কাঁপন সৃষ্টি হলো। অদ্ভুত এক ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো ভেতরটা। এমনটা আগে হতো না। সে সব সময় সৌরভকে শ্রদ্ধা করতো। সৌরভের আচরণ, তার কর্তব্যবোধ সব কিছু ভালো লাগতো মিলির। তবে কখনো অন্য কিছু কল্পনাতেও ছিলো না সৌরভকে নিয়ে তার মনে। অথচ আমেনা বেগম সেদিন মিলির সাথে সৌরভের বিয়ের কথা বলাতে মিলি হুট করেই রাজি হয়ে গেলো। কেনো রাজি হয়েছে সেটা সে নিজেও জানে না। কোন এক অদ্ভুত কারণে তার ভেতরের সত্ত্বাটা চাইছিলো যেনো সৌরভকে। আর তারপর থেকেই এই হুটহাট অন্যরকম ভালো লাগা। অন্যরকম শিহরণ অনুভব করতে পারছে মিলি।

– ‘কিছু বলবে ?’
সৌরভের কথায় ঘোর ভাঙলো মিলির। সে মুচকি হেসে দু’পাশে মাথা নাড়ালো। তারপর দৌড়ে চলে গেলো নিচে। মিলির এই উদ্ভট কান্ডের কিছুই বুঝতে পারলো না সৌরভ।

স্টেজে বরের জন্য রাখা আসনে বসে আছে রাজিব। তার পড়নে সাদা শেরোয়ানি। মাথায় খয়েরি রঙের পাগড়ি । রাজিবের পাশে বসা মোহন, সৌরভ আর বিয়ের কাজী। তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তোহা আর রাজিবের কিছু বন্ধুদের দল। একটু পর উপর থেকে নেমে আসতে লাগলো তোহাকে নিয়ে মিলি আর সুবর্ণা। তাদের পাশে সাদা গাউন পরে সিঁড়ি ধরে ধরে নামছে মায়া। তোহার পড়নে খয়েরি রঙের বেনারসি। গলায়, হাতে, কানে ভারী গহনা। বিয়ের কনে হলেও হালকা একটা সাজ দেয়া হয়েছে তোহাকে। গয়নার জন্য এই অল্প সাজটাই ফুটে উঠেছে খুব করে। ড্রইং রুমের সকলের দৃষ্টি তখন এই নব বধূর দিকে। রাজিব মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো তোহাকে। আর তখন তোহার পাশে দাঁড়ানো মিলির চোখ জোড়া খুঁজে নিলো সৌরভকে। সে আজ সাদার মাঝে ছাই রঙা সুতার কাজের  একটা পাঞ্জাবী পরেছে। মিলি সৌরভের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেই তোহাকে নিয়ে এগিয়ে এলো। বরের পাশে বসানো হলো কনেকে। সকলে বর কনের সাথে এসে কথা বলছে। রাজিবের কিছু বন্ধু তোহার সাথে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। সুবর্ণা আর মায়াও তাদের সাথে জোগ দিয়ে ছবি তুলছে। মিলিকে যখন বলা হলো পাশে দাঁড়াতে তখন  মিলি হালকা হাসলো। ক্যামেরা ম্যান ছেলেটাকে কানে কানে কিছু একটা বলে তার সাথে নিয়ে গেলো। সৌরভ তখন পাশেই একটা ছেলের সাথে কথা বলছিলো। মিলি হঠাৎ গিয়ে সৌরভের হাতটা ধরে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে এক গাল হেসে ক্যামেরা ম্যানকে বললো,
– ‘ আমাদের একটা ছবি তুলুন তো। ‘
আকস্মিক ঘটনায় সৌরভ কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকালো মিলির মুখের দিকে। মিলির হাত জোড়া তার একটা হাত আকড়ে ধরে আছে। সে অবস্থায়ই ক্যামেরা ম্যান চটাচট কয়েকটা ছবি ক্লিক করে নিলো। সৌরভ কিছু বলতে যাবে সে সুযোগ পেলো না। তার আগেই আবার মিলি ছুটে পালালো।

তোহা আর রাজিব পাশাপাশি বসে থাকলেও কোন কথা বলতে পারছিলো না। সকলেই তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। রাজিব তোহার কানের কাছে মুখ নিয়ে হালকা স্বরে বললো,
– ‘ কখন যে বউটাকে একটু একা পাবো! মুখটাই তো দেখতে পাচ্ছি না ভালো করে। এই মানুষ গুলোকে রেখে চলো দৌড়ে পালাই।’
রাজিবের কথায় তোহা ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো। সৌরভ এসে তখন বসলো পাশে। নরম গলায় বললো,
– ‘ কাজী সাহেব। বিয়ে পড়ানো শুরু করুন। ‘
সাথে সাথেই অল্প বয়সী ছেলে মেয়ে গুলো গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে পরলো স্টেজটার চারপাশে। সকলে উৎসুক হয়ে বিয়ে পড়ানো দেখছে। তোহার তখন বেশ লজ্জা লাগছিলো। সেই সাথে অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করছিলো ভেতরটায়। সে মুখ নিচু করে কাজী সাহেবের থেকে এগিয়ে দেয়া রেজিস্ট্রি পেপারটায় সাইন করলো।

চলবে….

এ শহর মেঘলা ভীষণ পর্ব – ১৩

0

এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ১৩
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

মিলি ঢাকায় চলে এসে আলাদা রুমে না গিয়ে তোহার সাথে রুম শেয়ার করে থাকে। দুজন মিলে খুনশুটি করে দিন পার করছিলো। সৌরভ মিলিকে চাকরীর জন্য বেশ কিছু বই কিনে দেয়। সেগুলোই প্রেক্টিস করতে থাকে সে। এদিকে তোহা নিয়মিত ক্লাসে মন দেয়। ক্লাস শেষে রাজিবের সাথে একটু ঘুরেফিরে তারপর ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে। সৌরভ অফিসে জয়েন করেছে। শুরু হয়েছে আবারো সেই ব্যস্ত জীবন। ব্যস্ততার মাঝে ছায়ার কেসটা চাপা পরে গেছে। সবাই নিজেদের মতো জীবন গুছিয়ে নিতে কর্মশীল। তবে দিন শেষে একটা সময় সৌরভ শুধু ছায়ার। সেই সময়টা ছায়ার জন্যই রাখা। ছায়ার কথা ভেবে ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি চলে আসা, ছায়ার কথা ভেবে মন খারাপ আবার ছায়ার কথা ভেবেই ঘুমিয়ে যাওয়া। এভাবেই কাটছে সময়। এর মাঝে মিলির ফাইনালের রেজাল্ট হয়ে যায়। একাউন্টিং থেকে ফার্স্ট ক্লাস আসে। জবের জন্যও সব প্রিপারেশন নিয়ে নেয়। তখন সৌরভ নিজেই মিলিকে তার ব্যাংকে জয়েন করতে বলে। মিলি যদিও এভাবে কারোর সুপারিশে ঢুকতে নারাজ হয়। তাই সে ইন্টারভিউ দিয়েই কাজটা নেয়। কিন্তু মিলি জানতে পারে না, সে না করার পরও তার জবটা সৌরভের কারণেই হয়েছে। সৌরভ চাচ্ছিলো না অন্য কোথাও জব করে মিলির জীবনেও কোন রিস্ক চলে আসুক। তাই আগে থেকেই যাতে মিলির জবটা হয়ে যায় সেজন্য সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলো সৌরভ।

মিলি অফিসে জয়েন করার পর সৌরভের সাথেই যাতায়াত শুরু করে। নিয়মিত অফিস করে এক সাথে বাসায় ফিরে তারা। মাঝে মাঝে তোহা আর মিলিকে নিয়ে বাহিরে ঘুরতে বের হয় সৌরভ। জীবনটা আবারো হাসিখুশি হয়ে উঠতে শুরু করে। সৌরভ ঠিক করে এবারে রাজিব আর তোহার বিয়েটা দিয়ে দিবে। তাই সে আর অপেক্ষা করে না। এ বিষয়ে একবার আমেনা বেগম আর আশরাফ আহমেদের সাথে কথা বলে নিতে চায় সে। যেহেতু তার নিজের বাবা মা বেঁচে নেই। উনাদেরকেই সৌরভ নিজের বাবা মায়ের জায়গাটা দিয়েছে। মোহনকে ফোন দিয়ে বলে দেয় সকলকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসতে। তোহার বিয়ের কথাও জানায় তাদের। এটাও বলে তারা আসলেই সব ঠিক করা হবে। সৌরভের এই এতো ভালোবাসা দেখলেই মোহন মুগ্ধ হয়। ছেলেটা তাদের সাথে কতটা গভীর ভাবে জড়িয়ে আছে ! তাই মোহনও দেরি করে না। সকলকে নিয়ে পরের দিনই চলে আসে ঢাকায়।

সন্ধ্যায় বাড়ির সকলে ড্রইং রুমে হাজির হয়। সৌরভ বিনয়ের সাথে বলে,
– ‘ আমার নিজের পরিবারের লোকজন বলতে আপনারাই। তাই আমার এখানে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমি আপনাদের জানানো সব থেকে জরুরি মনে করি। তোহার বিষয়ে তো আগেই বলেছিলাম। রাজিবের সাথে ওর বিয়েটা এবারে ঠিক করতে চাচ্ছি। তাই রাজিবের পরিবারের সাথে কথা বলার আগে আপনাদের সাথে আলোচনা করে নিতে চাচ্ছিলাম আমি। ‘

আমেনা বেগম অল্পতেই আবেগ প্রবণ হয়ে যান সৌরভের কথা শুনলে। এতো শ্রদ্ধা, ভালোবাসা মেয়ের জামাই থেকে ক’জনই বা পায়! তিনি আপ্লুত হয়ে বলেন,
– ‘ রাজিব অত্যন্ত ভালো ছেলে। ওরা দুজন দুজনকে যখন এতো পছন্দ করে তখন আর দেরি করা আসলেই ঠিক হবে না। তুমি রাজিবকে জানিয়ে দাও ওর পরিবারের সাথে কথা বলে বিয়ের দিন ক্ষণ ঠিক করতে। ‘

আমেনা বেগমের সাথে বাকিরাও একই মত পোষণ করে। সৌরভ বেশ খুশি। তার এক মাত্র বোনের বিয়ে হবে নিজের প্রাণ প্রিয় বন্ধুর সাথে। সে ফোন করে রাজিবকে বলে দেয় দুপক্ষ এক সাথে বসে একটা তারিখ ঠিক করা হবে।

রাজিবের পরিবার বলতে আছে শুধু তার মা। পরেরদিন রাজিব  তার মাকে নিয়ে সৌরভের বাসায় এসে বিয়ের তারিখ ঠিক করে যায়। যেহেতু রাজিবের আত্মীয়স্বজন বলতে তেমন কেউ নেই। সেই সাথে সৌরভেরও আলাদা করে বলার মতো কেউ নেই তাই বিয়েটা হবে অল্প কিছু পরিচিত লোকজনদের নিয়ে নিজের বাড়িতেই। বিয়ের তারিখ ঠিক হবার সাথে সাথেই সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মিলি, তোহা আর সুবর্ণা মিলে সারাদিন এদিক সেদিক শপিং করে বেড়ায়। তুহিন আর সৌরভ ডেকোরেশনের লোকজনদের সব দেখিয়ে দেয়া, মেহমানদের নিমন্ত্রণ কার্ড দেয়ার বিষয় গুলো দেখছে। তাছাড়া খাবারের আয়োজনের দিকটাও দেখতে হচ্ছে সৌরভকে।

বিয়ের যখন আর দুদিন বাকি তখনও সৌরভ অফিস থেকে ছুটি নেয়নি। সে অফিস শেষ করে তারপর অন্যান্য কাজে সময় দিচ্ছে। তবে এতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। বাড়িতে এখন মিলি, মোহন, সুবর্ণা থাকায় তোহার মন সব সময় ফুরফুরে। আজ ওরা বের হয়েছিলো বিয়ের শাড়ি কিনতে। বাসায় ফিরতে রাত হয়। এসে জানতে পারে আমেনা বেগম মাথা ঘুরে পরে গিয়েছিলো। আশরাফ আহমেদ গিয়ে ছিলেন মাগরিবের নামাজ পড়তে। সে সময় সৌরভ বাসায় আসে। সৌরভ এসে দেখে আমেনা বেগম ড্রইং রুমে পরে আছে। রহিমা, আমেনা বেগমের মাথা কোলে নিয়ে বসে কাঁদছে। সে একা একটা কম বয়সি মহিলা হয়ে আমেনা বেগমের ভারী শরীর নিয়ে উঠে বসাতে পারেনি। সৌরভ শাশুড়ীকে এ অবস্থায় দেখে দ্রুত গিয়ে কোলে তুলে সোফায় শুইয়ে দেয়। তারপর ডাক্তার ডাকা হয়। ডাক্তার জানায় প্রেশার আপ ডাউনের কারণে এমন হয়েছে। তিনি অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করেন আর কিছু মেডিসিন লিখে দেন।  সৌরভ ডাক্তার যাবার পর ওষুধ আনিয়ে খাইয়ে দেয় আমেনা বেগমকে। তারপর নিজ হাতে রাতের খাবার খাইয়ে রুমে নিয়ে যায়।  আমেনা বেগম ঘুমিয়ে গেলে রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে যায় সৌরভ।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

রাত দশটার দিকে আশরাফ আহমেদ, তুহিন আর মিলিকে নিজের রুমে ডেকে নিয়ে আসেন। বাবার সাথে তার রুমে এসে দেখতে পায় তাদের মা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। মিলি আর মোহন মায়ের পাশে গিয়ে বসে। মোহন বলে,
– ‘ এখন কেমন লাগছে মা ? ‘
আমেনা বেগম হালকা হেসে বলেন,
– ‘ ভালো আছি বাবা। ‘

আশরাফ আহমেদ স্ত্রীর পাশে একটা চেয়ার টেনে বসেন। আমেনা বেগম ছেলে মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলেন,
– ‘ আমি তোদের একটা কথা বলার জন্য ডেকেছি। ‘
– ‘ হ্যাঁ বলো। ‘ মোহন উৎসুক হয়ে জানতে চায়।
– ‘ আমি আর তোর বাবা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করি তোদের কোন আপত্তি থাকবে না। ‘

মোহন আর মিলি দুজনই ভ্রু উচিয়ে জানতে চায় কী সিদ্ধান্ত ? আমেনা বেগম নিজের মুখে একটা গাম্ভীর্য ভাব ফুটিয়ে শান্ত স্বরে গলার আওয়াজ নামিয়ে বলেন,
– ‘ মিলি বলেছিলো চাকরী করবে তারপর বিয়ে। তখন বোনকে তুই সাপোর্ট দিয়েছিলি মোহন। এখন সে নিজে ইনকাম করে। তার পড়াশুনা শেষ। এখন আমি তার বিয়ে দিতে চাই। আর আমি যার সাথে বিয়ে দিবো মিলির তাকেই বিয়ে করতে হবে। ‘

মায়ের কথায় মিলি আর মোহন দুজনই বেশ অবাক হয়। মোহন বুঝতে পারে তার মা নিশ্চয় পাত্র দেখে ফেলেছে। কারণ তিনি ছেলে ঠিক না করলে কখনোই এতো জোড় দিয়ে বলতেন না, তিনি যাকে বলবেন তাকেই মিলির বিয়ে করতে হবে। তাদের মা কিছু ঠিক করে ফেললে তখনই ছেলে মেয়েদের এভাবে বলেন।  মোহন তাই সরাসরি জানতে চায়,
– ‘ ছেলেটা কে মা ?’

আমেনা বেগম আগের মতোই মুখের ভারী রেশ নিয়ে বলেন,
– ‘ সৌরভ। আমি আর তোর বাবা চাই সৌরভের সাথেই মিলির বিয়ে হোক। ‘

মিলি চমকে যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছুই বলে না। চুপচাপ শুনতে থাকে সে। মোহন অবাক হয়ে বলে,
– ‘ সৌরভ ! ‘
আমেনা বেগম চোখ পাঁকিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
– ‘ হ্যাঁ সৌরভ। কেনো সৌরভের থেকে কোন ভালো ছেলে পাবি বলে তুই আশা করছিস ? আর পেলেও তো আমি দিবো না। সৌরভ কেমন ছেলে আমরা সকলে জানি। ছেলেটা আমাদের নিজের পরিবারের সাথে জড়িয়ে আছে। ছায়া চলে গেলেও সে আমাদের প্রতি কোন অবহেলা দেখায়নি। আমি চাই ঘরের ছেলেকে ঘরেই রেখে দিতে। ওকে তো আজ না হয় কাল বিয়ে করতেই হবে। সারাজীবন তো ছেলেটার নষ্ট হতে দিতে পারি না। তাই আমার মেয়ের সাথেই তার আবার বিয়ে দিবো। ‘

মোহন কিছু একটা ভেবে বললো,
– ‘ আমারও সৌরভকে পছন্দ মা। তোমরা ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছো। তবে সৌরভ কি রাজি হবে ? ‘
– ‘ সেটা আমি দেখবো। আমি বললে সৌরভ মানবেই। তবে তাড়াহুড়া নেই। সময় হলে দেখা যাবে। তোহার বিয়েটা আগে সম্পূর্ণ হোক। এখনই এসব কথা বাহিরে যাতে না যায়। বিশেষ করে তোর স্ত্রীর কানে তো নয়ই।’ মোহনকে ইঙ্গিত করে কথাটি বলেন আমেনা বেগম।

মোহন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে স্পষ্ট ভাবে বলে,
– ‘ মিলি কী চায় সেটাও দেখতে হবে। মিলির মতটাকে আমি সব সময় গুরুত্ব দিবো। কোন চাপ সৃষ্টি যাতে না হয় তার উপর। ‘

– ‘আমার কোন আপত্তি নেই ভাইয়া। ‘ মাথা নিচু করেই উত্তর দেয় মিলি। তারপর উঠে দ্রুত মায়ের রুম ছেড়ে চলে যায়।

চলবে….

এ শহর মেঘলা ভীষণ পর্ব – ১২

0

এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ১২
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

কি সাহায্যের জন্য ছায়া তুহিনের সাথে দেখা করেছে জানতে চাইলে তুহিন বলে,
– ‘ ছায়া প্রেগন্যান্ট ছিলো আপনি তো জানতেন। ‘

সৌরভের মুখটা মলিন হয়ে গেলো। ছায়া চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলো। তাদের প্রথম সন্তান আসতে চলেছিলো পৃথিবীতে। সৌরভ যেদিন প্রথম জানলো ছায়া মা হবে সেদিন যে সে কী খুশি হয়েছিলো ! ছায়াকে নিয়ে বাহিরে খেতে গিয়েছিলো। সিনেমা দেখেছে। সারাদিন ঘুরেছে ওরা। সৌরভ সব সময় বলতো ছায়ার মতোই মিষ্টি একটা মেয়ে চাই তার। ছায়া সে কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যেতো। সন্তানকে নিয়ে হাজারো জল্পনা কল্পনা চলতো রাত ভোর। কিন্তু সবই এখন ধোঁয়াশা। সৌরভ একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে বললো,
– ‘ হুম। ‘
– ‘ কিন্তু ছায়া বাচ্চাটি এখনই চায়নি। সে তার ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতো সব সময়। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারতো না। যেমন তার বাবার কথায় বিয়ে করে ফেলে প্রতিবাদ করতে পারেনি, অফিসে নাকি তার কোন এক বস ডিস্টার্ব করতো তাকে। সেটারও প্রতিবাদ করতে পারেনি। নিরবে সরে গেছে অফিস থেকে। তেমনই আপনাদের বাচ্চা যাতে এখন না হয়, ক্যারিয়ার গোছাতে চায় সে সেটাও মুখ ফুটে বলতে পারেনি। সে এই সব নিয়ে ডিপ্রেশনে ভুগছিলো। এমনকি নিজের সন্তানকেও সে নষ্ট করে ফেলতে চাচ্ছিলো। সে কারণেই আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলো। কোন ভাবে এবর্শন করতে চাচ্ছিলো সে। ‘

তুহিনের কথায় সৌরভ স্তব্ধ হয়ে গেলো। এসির ঠান্ডায় ও সে ঘামতে শুরু করেছে। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। চার পাশের সব মিথ্যে মনে হচ্ছে। যে মানুষটার সাথে সে এতোদিন থেকেছে সে কী না তাদের সন্তান কে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো ! কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না সৌরভ। দিপু সৌরভের কাঁধে নিজের একটা হাত রেখে বৃথা সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলো। মোহন নিজেও অবাক। তার বোন এতো কিছু ভাবতো যেটা তারা টেরই পায়নি। ফোনের ওপাশ থেকে তুহিন বলতে লাগলো,
– ‘ ছায়াকে আমি তখন বলি, তার চার মাস চলছে। এ অবস্থায় এবর্শন করতে চাইবে না কোন ডাক্তার। তাছাড়া এটা খুব ঝুঁকি হয়ে যাবে। আর আপনি আছেন, তার ফ্যামিলি আছে। সবাইকে সে কি জবাব দিবে ? এতো গুলো মানুষ তো কষ্ট পাবে। তখন তাকে অনেক বুঝাই আমি। তবে ছায়া বুঝেছে বলে মনে হয়নি। তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো, ডিপ্রেশনে ভুগতে ভুগতে সে এমন একটা পর্যায়ে গিয়েছে যে নিজেকে শেষ করতেও পিছুপা হবে না। ‘

সৌরভের চোখে পানি।সে ভেজা, ভরাট কন্ঠে বললো,
– ‘ আপনি বলতে চাচ্ছেন ছায়ার মৃত্যুটা তার নিজের কারণেও হতে পারে ?  ডিপ্রেশনে থেকে সে সুইসাইড করেছে ? ‘

– ‘দেখুন আমি তো দেশে নেই। জানি না কী কী হয়েছে সেখানে। তাই কিছু বলতে পারছি না। হতে পারে খুন আবার হতে পারে সুইসাইড। ‘
তুহিনকে থামিয়ে দিয়ে সৌরভ বললো,
– ‘ না। সুইসাইড না। ছায়ার লাশটা বস্তায় করে ব্রিজের নিচে পাওয়া গেছে। পুলিশের ধারনা হত্যার পর তাকে নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছিলো। ‘

তুহিন কথা বাড়ালো না। সে টপিক চেঞ্জ করে বললো,
– ‘ যাই হোক। পুলিশ কি কোন সন্ধান পেলো ? ‘
– ‘ না। আচ্ছা আমি রাখছি। কোন প্রয়োজন পরলে আবারো ফোন করবো। ‘ আনমনা হয়ে কথাটি বললো সৌরভ।
– ‘ হ্যাঁ অবশ্যই। যে কোন প্রয়োজনে বলবেন। আমি সব রকম সাহায্য করবো এ বিষয়ে। ‘

তুহিনের কথা আর শুনার প্রয়োজন মনে করলো না সৌরভ। সে চট করে ফোন কেটে দিলো। ভালো লাগছিলো না ছেলেটার কথা শুনতে। ছায়ার প্রতি যে তার অধীর আগ্রহ তা কথা শুনেই বুঝতে পেরেছে । এই মুহূর্তে আবারো সব ঘোলা হয়ে গেলো। এই হত্যাকান্ডের কোন কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না সে। নিজেকে কূল হারা নাবিকের মতো মনে হচ্ছে। যে গহীন সমুদ্রে ভেসে আছে অথচ তীরের সন্ধান পাচ্ছে না।

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
মিলি ঠিক করেছে এবারে ঢাকায় একটা চাকরী খুঁজবে। আমেনা বেগম অবশ্য এতে আপত্তি করেছেন। তিনি মেয়েকে বলে দিয়েছেন, এসব চাকরী বাকরীর কোন দরকার নেই। পড়াশুনার জন্য এতোদিন বিয়ে করতে চায়নি মেয়ে। সেই সাথে পেয়েছে ভাইয়ের সাপোর্ট। আশকারা পেয়ে মাথায় উঠেছিলো। মেয়ে মানুষের চাকরী করে কী হবে। মেয়ে মানুষ হবে সংসারী। তবে এখন মেয়ের পড়াশুনা শেষ। ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট কবে না কবে দিবে সেই আশায় তিনি থাকবেন না। তিনি মেয়ের বিয়ে দিবেন। এ নিয়ে মায়ের সাথে মিলির শুরু হয়েছে তান্ডব কান্ড। সে এখন কিছুতেই বিয়ে করবে না। বিয়ে নিয়ে কোন কিছু ভাবতে চায় না সে। আগে ক্যারিয়ার গুছাবে তারপর বিয়ে। তবে আমেনা বেগমকে বুঝায় কে ? মোহন ঢাকা থেকে বাড়ি যাবার পরই তিনি ছেলেকে ডেকে এনেছেন নিজের রুমে। ডেকেছেন মিলিকেও।

মোহন আর মিলি মায়ের সামনে চুপটি করে বসে আছে। আমেনা বেগম বললেন,
– ‘তোমার বোনের কাহিনী শুনছো ?  তিনি নাকি এখন বিয়ে করবে না। এতো দিন পড়াশুনার অজুহাত দিছে এখন দিতেছে চাকরীর অজুহাত। তার নাকি ক্যারিয়ার লাগবে আগে! ‘

মায়ের কথা শুনে মোহন বোনের মুখের দিকে তাকালো। মিলি গাল ফুলিয়ে রেখেছে। মোহন গম্ভীর ভাবে বললো,
– ‘ মিলি যা চাইছে তাই হবে মা। ‘  

ছেলের কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন আমেনা বেগম। চোখ রাঙিয়ে বললেন,
– ‘ বলি তোমরা যা বলবা তাই হবে নাকি ? আমার পেট থেকে তোমরা হইছো ? নাকি তোমাদের পেট থেকে আমি হইছি ? ‘

মা যে বেশ রেগে গেছে এটা তার কথা শুনেই বুঝতে পেলো মিলি। সে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো। নিচু স্বরে বললো,

– ‘থাক ভাইয়া। আমি জব করবো না। ‘

মোহন ধমকে উঠে গলা চড়িয়ে বললো,
– ‘ থাম তুই। তুই ক্যারিয়ার গুছাতে চাস এটা ভালো সিদ্ধান্ত। ছায়ার মতো ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার করে সংসার নষ্ট করার থেকে আগে ক্যারিয়ার গুছিয়ে তার পর বিয়ে করাই ভালো। অন্তত মনের ইচ্ছা পূরণ হোক তোর। আগে জব কর। নিজেকে গুছিয়ে নে তারপর বিয়ে হবে। ‘

কথা শেষ করে মোহন মায়ের দিকে তাকালো। আমেনা বেগম আর মিলি দুজনই চুপ হয়ে গেছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন মোহনের রাগটা এখন কোথায়। ছায়া মুখ ফুটে যে কথা বলেনি মিলি তা বলেছে। এবারে মিলি যেন ছায়ার মত অভিমান পুষে না রাখে সেটাই চায় মোহন। তার বোন সুখে থাকুক।

তোহা ফোনে রাজিবের সাথে কথা বলছিলো। মায়া এসে মিলির রুমে পড়তে বসেছে। মিলি তাকে পড়াচ্ছে। আজ কাল মায়া তার মায়ের থেকে ফুপির সাথেই থাকে বেশি সময়। মায়াকে স্কুলে ভর্তি করা হবে। সেজন্যই মিলি তাকে প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ের পড়াশুনা করিয়ে যাচ্ছে। তোহা কথা শেষ করে এসে বসলো মিলির পাশে। তার মুখটা বেশ হাসিখুশি। মিলি খুঁচিয়ে বললো,
– ‘ কী ব্যাপার ?  কেমন চলছে প্রেম ? ‘
তোহা হেসে বললো,
– ‘ ধুর আপু। কি যে বলো! ‘

তোহা মিলির থেকে ছোট হলেও তাদের বন্ডিংটা বেশ ভালো। বন্ধুর মতো একে অপরের সাথে মিশে থাকে। তাছাড়া ছায়া যেমন প্রয়োজন ছাড়া বেশি কথা বলতো না মিলি তেমনটা না। মিলি একটু বেশিই মিশুক। তার সাথে কথা বললে মন ভালো হয়ে যায়।
– ‘আচ্ছা আপু , তোমার তো আজ পরীক্ষা শেষ হলো। এখন কি করবে ভেবেছো ? ‘

তোহার কথায় মিলি অদ্ভুত হাসলো। বললো,
– ‘ ভাবছি তোমাদের সাথে চলে যাবো। ‘

তোহা ভ্যাবলার মতো তাকালো মিলির দিকে। বুঝতে পারলো না কিছু।  মিলি হেসে বললো,
– ‘ মানে ঢাকায় যাবো। একটা ভালো চাকরী খুঁজে সেটা করবো। ‘

– ‘ সত্যিইইই …? তুমি ঢাকায় থাকলে তো অবশ্যই আমাদের সাথে থাকবে। থাকতেই হবে। উফফ তারপর কত মজা করবো আমরা। ‘ খুশিতে তোহার চোখ চিকচিক করছে। সে মিলির গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
– ‘ আমরা কবে যাবো ? ‘
– ‘ এতো তাড়া কেনো ? যাবো তো। ‘
– ‘ উহু তুমি আমার সাথেই চলে যাবে ঢাকা। একা বাসায় ভালো লাগে না। তোমরাও যাবে আমার সাথে। ‘ মিলি গাল ফুলিয়ে আবদার করলো।

মায়া বই থেকে মুখ তুলে বললো,
– ‘ আমি যাবো না ? ‘
– ‘ তুমিও যাবে তো। ‘ মায়ার গাল দুটো টেনে দিয়ে বললো তোহা।

চলবে…

এ শহর মেঘলা ভীষণ পর্ব – ১১

0

এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ১১
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

সৌরভ আর তোহা কুমিল্লা আসাতে সব থেকে বেশি খুশি হয়েছেন আমেনা বেগম। তিনি মেয়ে জামাইকে দেখেই আনন্দে কেঁদে দিয়েছেন। এই ছেলেটা তার নিজের পরিবারের একজন। নিজের সন্তানের মতো। আজ কাল ছেলেটাকে দেখলেই মেয়েটার কথা মনে পরে। তবে খুব একটা কষ্ট হয় না। তার কাছে মনে হয় তার থেকে বেশি কষ্ট হয়তো সৌরভের হচ্ছে। আমেনা বেগম সৌরভ আসাতে বিভিন্ন রান্না করতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। সচরাচর তিনি এখন রান্না ঘরে যান না। বয়স হওয়াতে বাড়ির কাজ লোক জনকে ভাগ করে দিয়েছেন। কিন্তু মেয়ের জামাই এসেছে। তার আরেকটা ছেলে। সেজন্য তিনি আজ রান্না ঘর ছাড়ছেনই না। একটু পর পর এটা সেটা বানিয়ে সৌরভ তোহার সামনে নিয়ে দিচ্ছে। কথা বলার জন্য বাড়িতে যেন এখন একমাত্র সৌরভই আছে তার। মেয়ে জামাই এর সাথে সারাক্ষণ এটা সেটা নিয়ে কথা চলছেই। সৌরভের নিজের কাছেও ভালো লাগছে। কিছু সময়ের জন্য মানুষ গুলোর পাশে এসে যেন নিজের দুঃখ কষ্ট আড়াল হয়ে গেলো। প্রিয় মানুষ গুলোর সান্নিধ্যে থাকার চেয়ে বড় সুখ বুঝি আর কিছুতে নেই! তোহা পেয়েছে মিলির সঙ্গ। বেশ জমিয়ে আড্ডা দেয় তারা। দুজন বন্ধুর মতো। তাদের সাথে যোগ দেয় মায়া। মায়ের কাছে আজ কাল থাকতে ভালো লাগে না তার। মা সারাক্ষণ বাবার সাথে লেগেই থাকে। বিষয়টা খারাপ লাগে মায়ার। সে ফুপির সাথেই বেশ আছে।

সন্ধ্যায় সকলে মিলে ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছিলো। আমেনা বেগম প্রফুল্লতার সাথে সৌরভের প্লেটে বিভিন্ন পিঠা সাজিয়ে দিয়েছেন। সামনে রাখা আছে চা। সৌরভ সে সব আয়েশ করে খাচ্ছে। তোহা চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,
– ‘ ভাইয়া কাল আমরা ঘুরতে বের হবো। আশপাশটা দেখবো। তুমিও যাবে আমাদের সাথে। ‘
সৌরভ বললো,
– ‘ আমি যেতে পারবো না রে। আমার কালই ঢাকায় ফেরত যেতে হবে। ‘
আমেনা বেগম বিস্ময় নিয়ে বললেন,
– ‘ কাল ! তুমি কিছুদিন থাকবে বাবা। ‘
– ‘ তোহা থাকবে মা। আমি আবার আসবো ওকে নিয়ে যেতে। কিন্তু কাল যেতেই হবে। দিপু ছেলেটাকে একটা কাজ দিয়েছিলাম। সেটা হয়ে গেছে। আমাকে গিয়ে দেখতে হবে সবটা। ‘ সৌরভ ইচ্ছে করেই তুহিনের বিষয়টা আমেনা বেগমকে বললো না। ছায়ার মা এসব জানুক সেটা সৌরভ চায় না। তবে এ বিষয়ে সে মিলি আর মোহনের সাথে আলোচনা করেছে।

আমেনা বেগমের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। তিনি আর কিছু বললেন না। মোহন বললেন,
– ‘ আমিও তোমার সাথে যাবো সৌরভ। এদিকটায় আমার কোন কাজ নেই আপাতত।’

– ‘ ঠিক আছে ভাইয়া। ‘

সৌরভ আর মোহন রাতে বসে ছায়ার কেইসটা নিয়ে আলোচনা করলো। মোহনের বেশ বড় বড় কিছু জানা শোনা লোক আছে। রাজনৈতিক দলের সাথেও খাতির রয়েছে তার। দেশ বিদেশে ব্যবসার জন্য খাতির রাখতে হয়। পরদিন সকালেই তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। তোহা রইলো মিলিদের সাথে কুমিল্লা। সৌরভ আর তুহিন প্রথমেই গেলো পুলিশ স্টেশন। সেখানে গিয়ে পুলিশের সাথে কথা বললো। তদন্ত আগানোর দিকে পুলিশের আর কোন আগ্রহ দেখতে পেলো না তারা। দেলোয়ার হোসেনের কথা,
– ‘ থানায় আরো অনেক মামলা আছে। সেসব আমাদের দেখতে হয়। যে মামলার কোন ক্লু নেই সেটার পিছনে পরে থাকলে তো আর থানা চলবে না। তাছাড়া উপর মহল থেকে চাপ থাকলে বা আসামী পক্ষের কোন সন্দেহজনক লোক থাকলে তখন মামলা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু মোজাম্মেল শিকদার উপর মহলকে টাকা খাইয়ে তাদের চুপ করিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া আপনাদের ও সন্দেহজনক আর কেউ নেই। এ হত্যার পিছনে কে আছে তা জানা যায়নি। এখন পুলিশের আর কিছু করার নেই। মামলা করা আছে। কখনো কোন ক্লু পেলে কেইস ফাইল আবার ওপেন হবে। ‘

সৌরভের রাগ হলো। কিন্তু সে রাগটা নিয়ন্ত্রণ করে নিলো। পুলিশের কোন কর্মকর্তার সাথে রাগ দেখিয়ে কোন লাভ হবে না। বরং হিতে বিপরীত হতে পারে।

মতিঝিলে তুহিনের বাসাটি খুঁজে পেতে কষ্ট হলো না তাদের। দিপুর বন্ধু বাসাটির ডিটেইলস নিয়ে দিয়েছে তাদের। সৌরভের সাথে দিপু আর মোহনও এসেছে। বিশাল বড় একটা অ্যাপার্টমেন্টের তিন তালার ডান দিকটায় থাকে তুহিনের ফ্যামিলি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল চাপতেই ভেতর থেকে একজন বয়স্ক মহিলা এসে দরজা খুলে দিলো। মোহন উনাকে চিনে। তুহিনের মা। তাদের পাশের এলাকায় বাসা। তুহিনকেও ছোট থাকতে দেখেছে সে। তারপর অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ায কারো সাথে আর যোগাযোগ নেই । তুহিনের মা মোহনকে দেখে শুরুতে হয়তো চিনতে পারেননি। খানিক সময় তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন,
-‘ তুমি মোহন না ? ‘
মোহন হালকা হেসে বললো,
– ‘ জি চাচী। এখানে একটা কাজে এসেছিলাম। শুনেছি আপনারা এখানেই থাকেন। ভাবলাম আপনাদের সাথে দেখা করে যাই। ‘
– ‘ আসো বাবা ভিতরে আসো। ‘ নিজের গ্রামের লোকদের দেখে তিনি বেশ উত্তেজিত হয়ে পরলেন।

মোহন ভিতরে গিয়ে বসে। দিপু আর সৌরভের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো তুহিনের মায়ের। তারপর বেশ কৌশল করে বললো,
– ‘ চাচী তুহিন কোথায় আছে ? তাকে দেখছি না যে! কত দিন হলো ছেলেটাকে দেখি না। সেই স্কুলে পড়তো সময় দেখেছিলাম। ‘
– ‘ তুহিন তো ডাক্তার হইছে বাবা। বিদেশ গেছে কি সব ডিগ্রি আনতে। আমি তো এসব বুঝি না। ‘ তুহিনের মা খুব গর্বের সাথে কথাগুলো বললেন। কথা বলার সময় তার চোখ জোড়াও হাসছিলো। ছেলের সাফল্যে তিনি যে কতটা খুশি তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। পৃথিবীর সব বাবা মা’ই তো এমন।

– ‘ তুহিনের নাম্বার দিয়েন চাচী। ছেলেটার সাথে কথা বলবো একটা সময় ফোন দিয়ে। ‘

মোহনের টোপ টা কাজে লাগলো। তুহিনের মা বেশ খুশি খুশি মনে ফোন নিয়ে এলেন। ছেলে তাকে ফোন চালানো শিখিয়েছে। একা থাকার কারণে একটা মেয়েকেও রেখে দিয়েছে। সে মেয়ে সব দেখিয়ে দেয় তাকে। মেয়েটি এসেই তুহিনের নাম্বার বের করে দিলো তাদের। মোহন নাম্বারটা চট করে নিজের ফোনে সেভ করে নিলো। তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলে, নাস্তা করে চলে এলো তারা। বাসায় ফেরার পথে সৌরভ বাজার করে নিলো। রহিমা তাদের বাসায় কাজ করে। কুমিল্লা যাওয়ার সময় তাকে বলা হয়েছিলো কয়েকদিন পর আসবে।  সে ক’দিন ছুটি তার। এখন হুট করে সৌরভের চলে আসাতে মুশকিল হলো। খবর পাঠানো হলো রহিমাকে। রাতে এক সাথে খাওয়া দাওয়া হবে। সৌরভ দিপুকে বললো,

– ‘ দিপু। রাতে কিন্তু তুমিও আমাদের সাথে থাকছো। রাজিব কে বলবো ভেবেছিলাম। সে অফিসের কাজে চট্টগ্রাম গেছে। সেখানে থাকতে হবে দিন কয়েক। তুমি বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে চট করে চলে এসো। ‘

দিপু হেসে মাথা নাড়ালো।

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ঠিক করা হলো তুহিনের নাম্বারে কল দেয়া হবে। সৌরভ, দিপু আর মোহন একসাথে বসে ফোনটা লাউড স্পিকারে দিয়ে কল দিলো। দুবার কল হবার পর ওপাশ থেকে বললো,
– ‘ হ্যালো। ‘
সৌরভ গলা খাকারি দিয়ে বললো,
– ‘ রাশেদুল রহমান তুহিন বলছিলেন ? ‘
– ‘ জি। আপনি কে ? ‘

সৌরভ একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লো। এতো খোঁজা খুঁজির পর তাহলে তুহিন কে পাওয়া গেলো! সে শান্ত ভাবে বললো,
– ‘ আমি ছায়ার হাজব্যান্ড। সৌরভ। ‘

তুহিন বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
– ‘ হেই। কেমন আছেন ? ‘
– ‘ ছায়া খুন হয়েছে। আপনি জানেন ? ‘
– ‘ কিহ! ‘ বেশ অবাক হলো তুহিন। বেশ খানিকটা সময় সে চুপ করে রইলো। তারপর বললো,
– ‘ কিভাবে কি হলো ! এখানে আসার আগেও তো তার সাথে আমার দেখা হলো। ‘ বিস্ময় যেন কাটছে না তুহিনের।
– ‘ হ্যাঁ। আমরা সেটা জেনেছি। তাই আপনাকে ফোন করা। ছায়াকে কেউ হত্যা করেছে। পুলিশ এখনো আসামী খুঁজে পায়নি। এ বিষয়ে আপনার একটু সাহায্য লাগবে। ‘

তুহিনকে খুব বিচলিত মনে হলো। বুঝা যাচ্ছে সে বেশ বড় একটা শকড পেয়েছে। নিজেকে সামলাতে পারছে না। কোন রকমে বললো,
– ‘ আমি আমার সব ধরনের চেষ্টা করবো। যদি আপনাদের উপকারে আসতে পারি। ‘

সৌরভ বললো,
– ‘ ছায়াকে আপনি কিভাবে চিনেন ? ‘
– ‘ আমাদের পাশের এলাকায় ছায়াদের বাসা। ‘
– ‘ শুধু পাশের এলাকায় বাসা বলে তার সাথে খাতির ছিলো? এক সাথে কফি শপে বসতেন ? আমার জানা মতে আপনারা তো বন্ধু ছিলেন না। ‘
সৌরভের খুঁচাটা তুহিন বুঝতে পারলো। সে খুব সতর্কভাবে বললো,
– ‘ আমি ছায়াকে পছন্দ করতাম। ‘
উপস্থিত সকলে একে ওপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। সৌরভের কথা গুলো শুনতে খারাপ লাগছিলো তবুও সে চুপ করে শুনতে লাগলো তুহিনের কথা। ছায়া তো আর নেই। এখন যত কঠিন কাজই হোক, যত কষ্টের কথাই হোক সব শুনতে হবে তাকে।  তুহিন আবারো বললো,
– ‘ ছায়া আর আমার মাঝে কোন সম্পর্ক ছিলো না। ওকে খারাপ ভাববেন না প্লিজ। ছায়া খুব ভালো মেয়ে ছিলো। তবে আমি বুঝতাম আমার জন্য তার মনে একটু হলেও জায়গা ছিলো। কিন্তু সে আবেগের বসে সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো মেয়ে ছিলো না। আবেগ কে প্রশ্রয় দিয়ে রিলেশনে জড়ায়নি। বরং বাবা মায়ের পছন্দ করা ছেলে আপনাকেই বিয়ে করে নিয়েছে। ভালোবেসে সংসার করেছে। ‘
– ‘ তাহলে সেদিন রেস্টুরেন্টে দেখা করলেন কেনো আপনারা ? কি কারণে দেখা করা যদি কোন সম্পর্ক না থাকে। ? ‘ সৌরভ ভারী কন্ঠে বললো।
তুহিন বেশ নরম সুরে বললো,
– ‘ ছায়ার একটা হেল্প দরকার ছিলো আমার থেকে। সে কারণেই সে দু’বছর পর যোগাযোগ করে দেখা করতে বলেছিলো আমাকে।  ‘

চলবে…..

এ শহর মেঘলা ভীষণ পর্ব – ১০

0

এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ১০
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

‘ না ভাইয়া আমি তো চিনতে পারলাম না। তাছাড়া আমি শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজে আছি। আপনি বলছেন উনি ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার। তবুও নতুন। তাই না চিনারই কথা। ‘ সৌরভের দেয়া ফুটেজে ছায়ার পাশের লোকটিকে দেখে দিপু বললো।

সৌরভ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। লোকটির সন্ধান পাওয়া তার জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। ছায়ার মামলাটা কিভাবে যেন ঝুলে আছে। কেউ কিছু করতে পারছে না। সৌরভের মনে হলো এ দেশের পুলিশরা আসলেই কোন কাজের না। একটা মানুষ কিভাবে খুন হলো তার কোন সন্ধান তারা বের করতে পারছে না।  অদ্ভুত!

– ‘ তুমি কি কোনভাবে এই লোকটির খোঁজ পেতে পারো ? ‘ বললো সৌরভ। তার মুখে ক্লান্তির ছাপ। চোখে ব্যার্থতার গ্লানি।

সৌরভের অবস্থা দেখে দিপু বললো,
– ‘ আমি চেষ্টা করবো ভাইয়া। ঢাকা মেডিকেলে আমার কিছু ফ্রেন্ড আছে। আমি নিজে গিয়ে খোঁজ নিবো। ‘
– ‘ অনেক ধন্যবাদ ভাই। প্লিজ একটু দেখো তুমি। ‘
– ‘ অবশ্যই ভাইয়া। ‘
তারপর দিপু সৌরভের থেকে ফুটেজটা নিজের ফোনে নিয়ে নিলো। উঠে দাঁড়িয়ে একবার উপরের দিকে তাকালো। নাহ, তোহা নেই আশেপাশে। চোখের চশমাটা ঠিক করে বের হয়ে গেলো দিপু।

সুবর্ণার মা আর ভাই চলে গেছে। সেই সাথে বন্ধ হয়েছে সুবর্ণার কথা বলা। বাড়ির কারো সাথে সে কথা বলছে না। এমনকি নিজের মেয়ের দিকেও তার খেয়াল নেই। গাল ফুলিয়ে সারাক্ষণ নিজের রুমে বসে থাকে। বাড়ির সকলে তার এই ব্যবহারে কষ্ট পাচ্ছে। এক মাত্র ছেলের বউকে এভাবে দেখে আমেনা বেগম হতাশ। কিন্তু মোহন এতে বিরক্ত। সে মায়ের রুমে এসেছিলো। আমেনা বেগম তাকে বলেছে,
– ‘ মিলির সাথে কথা বলে দেখ। বউমার ভাইকে তার পছন্দ হয় কি না। বাড়ির বউ এভাবে থাকলে সংসারে অলক্ষ্মী ঢুকবে তো। ছেলে মেয়ে খুশি থাকলে আমি বাধা দিবো না এ বিয়েতে। ‘

মায়ের কথায় মোহন বিরক্ত হয়ে বলে,
– ‘ সুবর্ণার সাথে তুমিও পাগল হলে ? ওর মন খারাপ না। ও এভাবে নাটক করছে। যাতে করে তোমরা রাজি হয়ে যাও। আমার বোন কি পানি ভাত নাকি! যে, বললেই তার ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবো! থাকুক এভাবে কত দিন থাকতে পারে। মিলির ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেবার আমি নিবো। আর সেটা অবশ্যই মিলির মত থাকলেই নিবো। যার তার সাথে তো আমি আমার বোনের বিয়ে হতে দিবো না। ‘

কথা শেষ করেই মোহন মায়ের রুম থেকে বের হয়ে গেলো। নিজের রুমে ঢুকেই দেখতে পেলো সুবর্ণা বিছানার উপর চুপ করে বসে আছে। তার মুখ গম্ভীর। মায়া টেবিলে বসে আঁকিবুঁকি করছে। মোহন ঝেঁজে উঠে বললো,

– ‘ কী শুরু করেছো তুমি ?  কি সমস্যা তোমার।? ‘
মোহনের কন্ঠে চমকে উঠলো সুবর্ণা। হালকা স্বরে বললো,
– ‘ কী শুরু করেছি বুঝো না ? ‘
– ‘ না বুঝি না। কি সমস্যা বলো। ‘
– ‘ তোমার কাছে তোমার বোনই সব। আমার ভাই কি ফেলনা নাকি! তোমাদের জন্য আজ আমার মা ভাই চলে গেলো। ‘ সুবর্ণার কন্ঠ কাঁদো কাঁদো। যেন এখনি কেঁদে দিবে সে। সবই নাটক! বুঝতে পারে মোহন।

– ‘ তোমার ভাই ফেলনা তা তো বলিনি আমি। আর তোমার মা ভাই চলে গেছে তাদের ইচ্ছায়। তাদের কেউ চলে যেতে বলেনি। ‘ গলার স্বর আরো বাড়িয়ে কথাটি বললো মোহন।

– ‘ ঠিক আছে। কোন লাটসাহেবের কাছে তোমার বোনের বিয়ে দাও সেটাও আমি দেখবো। ‘তাচ্ছিল্যের সাথে বলে সুবর্ণা।

মোহনের ম্যাজাজ আরো বিগড়ে যায়। সে মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়ে চোখ বড় বড় করে তাদের কথা শুনছে। বাবা মায়ের এ দৃশ্য তার কাছে অবাক লাগছে। মোহন হালকা স্বরে মেয়েকে বললো,
– ‘ মায়া। যাও তোমার ফুপির রুমে গিয়ে ঘুমাও আজ। ‘

মায়া বুঝতে পারে বাবা মায়ের মধ্যে কী চলবে এখন। সে চুপচাপ রুম থেকে বের হয়ে যায়। রুমের বাহিরে এসে দেখে মিলি দাঁড়িয়ে আছে সামনে। মায়াকে দেখেই মিলি তার কাছে টেনে নিয়ে আসে। তারপর নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। মোহন আর সুবর্ণা এতো জোড়ে জোড়ে চেঁচিয়ে কথা বলছিলো যে অন্য সকলের রুমেই আওয়াজ যাচ্ছে। মিলি সব শুনতে পেয়েছে এতোক্ষণ। তার খারাপ লাগলো এটা ভেবে যে, তার জন্য ভাই আর ভাবির মাঝে ঝগড়া হচ্ছে।

মিলিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো মায়া। মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মিলি বললো,
– ‘ মায়া সোনা। তুই তো আমার সাথেই প্রতিদিন এসে ঘুমাতে পারিস। ‘
– ‘ এখন থেকে তোমার সাথে ঘুমাবো আমি। মা বাবা প্রতিদিন ঝগড়া করে। ভালো লাগে না আমার। ‘ মিলিকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে মায়া।

– ‘ প্রতিদিন ঝগড়া করে কে বললো! ‘ মিলি ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে।
– ‘ কালও করেছে। আজও করছে। ‘
– ‘ আগে কখনো করেছে? ‘
মায়া আলতো করে মাথা নাড়ায়, ‘ উহু। ‘
– ‘ তোর বাবা মা দুজন দুজনকে অনেক ভালোবাসে। কখনো ঝগড়া করে না তো। এখন যেটা করছে এটা ঝগড়া না। বাবার মাথা গরম তো তাই রেগে কথা বলছে। এরকম সবাই করে। তোর দাদা দাদুও করে। এটা ঝগড়া না। বুঝলি ?’

মায়া হালকা করে মাথা নাড়ায়। সে বুঝেছে। মিলিকে ভালোভাবে জড়িয়ে ধরে বলে,
– ‘ তবুও তোমার সাথে ঘুমাবো আমি। তুমি সুন্দর করে কথা বলতে পারো।  ‘
মায়ার কথায় মিলি হাসে।

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
দিপুর ফোন আসে পরদিন বিকেলে। সৌরভ ফোন রিসিভ করে বলে,
– ‘ হ্যাঁ দিপু বলো। কোন খোঁজ পেলে ? ‘
– ‘ জি ভাইয়া । আমার এক বন্ধু চিনে উনাকে। তাদের মেডিকেলের সার্জারি বিশেষজ্ঞ।  রাশেদুল রহমান তুহিন। ‘
সৌরভ উত্তেজিত হয়ে বলে,
– ‘ হ্যাঁ। তুহিন নাম। মিলি বলেছিলো। ‘
– ‘ তবে ভাইয়া সমস্যা আছে একটা। ‘
– ‘ কী সমস্যা ? ‘
– ‘ উনি দেশে নেই। কিছুদিন আগে মালয়েশিয়া গেছেন। যে ফোন নাম্বারটা ছিলো সেটাও চেঞ্জ। বাহিরে গিয়ে তো দেশের নাম্বার চলবে না। আর সেখানকার কোনো নাম্বার কারো কাছে নেই। ‘

সৌরভ হতাশ হয়ে বলে,
– ‘ তাহলে এখন কী উপায় ? উনার সাথে কথা বলতে না পারলে তো হবে না। ‘

– ‘ উপায় একটা আছে। আমি আমার ফ্রেন্ডকে বলেছি কোন ভাবে লোকটার বাসার ঠিকানা ম্যানেজ করে দিতে। তার বাসায় গিয়ে ফোন নাম্বার পেতে পারি আমরা। ‘ আনন্দের সাথে বলে দিপু। যেন সে বেশ বড় কোন কাজ করতে পেরেছে।

– ‘ ঠিক আছে। বাসার ঠিকানা পাওয়া গেলে সেখানেই যাবো আমরা। ‘

তোহার মন খারাপ। মন খারাপ ভাইয়ের জন্য। পুলিশ মোজাম্মেল শিকদার কে ছেড়ে দিয়েছে। তার পক্ষের উকিল উপর মহলকে ম্যানেজ করে নিয়েছে। এখন তদন্ত চলছে ধীর গতিতে। সৌরভ অফিস বন্ধ দিয়ে বাসায় বসে আছে। বোনের সামনে স্বাভাবিক থাকলেও তার মনের মাঝে যে সুখ নেই সেটা তোহা বুঝতে পারে। তোহাকে এভাবে দেখে সৌরভের কাছেও ভালো লাগছে না। বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে সারাক্ষণ। লাগবেই বা না কেন ! এতো বড় বাড়িতে মাত্র দুজন মানুষ। নিজের লোক বলতে কেউ তো নেই তাদের সাথে থাকার। আমেনা বেগম মাঝে মধ্যে ফোন দিয়ে কান্না কাটি করেন। কষ্ট হয় সৌরভের। মেয়ে হারানোর শোকে মায়ের মন যে ঠিক নেই সৌরভ বুঝে। মানুষ গুলোকে সে সম্মান করে। সব সময় তাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবেসেছে তারা। মানুষ গুলোকে খুশি রাখতে চায় সৌরভ। এই ভালোবাসার দাম দিতে চায় সে। আগলে রাখতে চায় ভালোবাসার মানুষ গুলোকে। ছায়ার মতো আর কেউ তাকে ছেড়ে চলে যাক এটা সে চায় না। নিজের হাজার খারাপ লাগার মাঝেও সে এই মানুষ গুলোর জন্য বাঁচবে, এই মানুষ গুলোর মুখে হাসি ফোটাবে। মন খারাপ নিয়েই সৌরভ বোনের রুমে যায়।  তোহার পাশে বসে বলে,
– ‘ তুই না বলেছিলি ঘুরতে যাবি ? যাবি কুমিল্লা ? ‘
তোহা খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলে,
– ‘ ভাবির বাসায় ?’
সৌরভ মাথা নাড়ায়। বুঝায়, ‘ হ্যাঁ। ‘
– ‘ কখন যাবো ? ‘
– ‘ কাল। ‘
তোহা আনন্দে আত্মহারা। রাতেই সে গোছগাছ করে নেয়। রাত জেগে কথা বলে রাজিবের সাথে। বাহিরে যেতে চায় শুধু নিজের জন্য না। ভাইকে স্বাভাবিক রাখার জন্য। দুজনের মন ভালো করার জন্য। এ শহরের দম বন্ধ করা প্রকৃতি থেকে একটু স্বস্থির জন্য। পরদিন সকালে তারা রওনা হয় কুমিল্লার উদ্দেশ্যে।

চলবে….

এ শহর মেঘলা ভীষণ পর্ব – ৯

0

এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ৯
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

– ‘ সবার সামনে আমাকে আর আমার মা কে এভাবে অপমান না করলেও পারতে তুমি ‘ ক্ষিপ্ত হয়ে বললো সুবর্ণা। তার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে আক্রোশে।

মোহন বিছানায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। সুবর্ণার কথায় তাকে গুরুত্ব দিতে দেখা গেলো না। সে কাজে মনোযোগ রেখেই বললো,
– ‘ আমি কাওকে অপমান করিনি। ‘

সুবর্ণা আগের মতোই ঝাঝালো কন্ঠে বললো,
-‘ অবশ্যই অপমান করেছো। শাশুড়ীর সামনে মা কে ছোট করে দিয়েছো। তাছাড়া আমার ভাই কোন দিক দিয়ে কম যে তুমি মিলির সাথে  বিয়ে দিতে রাজি না ! ‘

এবারে মোহন চোখ তুলে তাকালো সুবর্ণার দিকে। তার চোখের দৃষ্টি শীতল।
– ‘ আমার বোনের বিয়ের সিদ্ধান্ত আমি নিবো। সেটা তোমার থেকে শুনবো না। তোমার মা একটা প্রোপোজাল দিয়েছে আমরা না করে দিয়েছি। এটাতে যদি নিজেকে ছোট লাগে তোমাদের কাছে তাহলে আমার কিছু করার নেই। ‘
– ‘ কিহ!  এতো বড় কথাটা তুমি বলতে পারলে! ‘ সুবর্ণা যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছে।

– ‘ হ্যাঁ পারলাম। এই নিয়ে আর কোন কথা শুনতে চাই না আমি। ‘ কথা শেষ করে মোহন আবারও কাজে মনোযোগ দিলো।  সুবর্ণা আহত স্বরে বললো,
– ‘ ওহ। তাহলে আমি তো তোমাদের পরিবারের কেউ না। আমার কথার দাম নেই এখানে। ‘

সুবর্ণার কথার ধরনে মোহনের খারাপ লাগলো। সে একটা হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
– ‘ তোমার কথার দাম অবশ্যই আছে। তবে তুমি যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে তবে আমি মেনে নিতাম। ‘ 
সুবর্ণা আর কিছু বললো না। গট গট করে রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলো।

সৌরভ রাতের খাবার খায়নি। তোহা ভাইয়ের খাবারটা রুমে নিয়ে এসেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল সৌরভ। তার দৃষ্টি দূরের কোন এক প্রান্তে। চোখ জোড়া বিষণ্ন। উদাস মন। কত গুলো দিন হয়ে গেলো ছায়া তাকে ছেড়ে চলে গেছে । পুলিশ এখনো আসামীর কোন সন্ধান পায়নি। এখনো মোজাম্মেল শিকদার থানায় আছে। পুলিশের ধারনা তাকে এবার ছেড়ে দিতে হবে। মোজাম্মেল শিকদার ক্ষমতাধারী লোক। খুনের প্রমান ছাড়া শুধু একটা ম্যাসেজের উপর ভিত্তি করে তাদের মতো লোকদের থানায় আটকে রাখা যায় না। শক্ত উকিল ধরেছেন তিনি। এদিকে অন্য কোন ক্লু পুলিশ এখনো খুঁজে পায়নি। তদন্ত চলছে তাদের মতো। হাজারটা তদন্তের ভিড়ে ছায়ার মামলাটা কোন এক ফাইলে পড়ে আছে। কী হবে ভেবে পাচ্ছে না সৌরভ। তার শরীর, মন ক্লান্ত। ছায়াহীন সব কিছু যেন নেতিয়ে পড়েছে। রেস্টুরেন্ট থেকে আনা ফুটেজটা মিলিকে দেয়া হয়েছে। ছেলেটা নাকি তাদের পাশের এলাকার। মিলি কয়েকবার দেখেছে ছেলেটাকে। তেমন ভাবে পরিচয় নেই। তাহলে ছায়ার সাথে কিভাবে থাকে সেই ছেলে! মাথার ভেতর সব কিছু কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে সৌরভের। মিলি বলেছে ছেলের ফোন নাম্বার জোগার করে দিবে। ছেলেটার সাথে দেখা করে কথা বলতে হবে।

কাঁধে কারোর স্পর্শ পেয়ে সৌরভ পেছন ফিরে তাকালো।
– ‘ কিরে তুই ! ‘
তোহা হালকা ভাবে বললো,
– ‘ খাবে চলো। ‘
সৌরভ কথা বাড়ায় না। বোনের সাথে চুপচাপ গিয়ে খেতে বসে। তোহার খুব কষ্ট হয় ভাইকে এভাবে দেখতে। সে নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। খুব কান্না পায়। খুব ইচ্ছে করে, ভাইয়ের দুঃখ গুলো যদি ভুলিয়ে দিতে পারতো।
– ‘ ভাইয়া চলো কোথাও গিয়ে ঘুরে আসি।  দুদিনের জন্য। ‘

– ‘ কোথায় যাবি ?’ খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়েই বলে কথাটা সৌরভ। চোখ তুলে না। তোহা বুঝতে পারে সৌরভের কন্ঠ ধরে গেছে। হয়তো চোখ দুটোও ভিজে উঠেছে। বোনের কাছ থেকে লুকানোর জন্য মাথা নত করে রেখেছে।

– ‘ জানি না। ‘ তোহার কষ্ট হয়। সে দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে চলে যায়।  সৌরভ মাথা তুলে তাকায় বোনের যাবার পানে। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আছে। জমেছে হাজারো অশ্রু বিন্দু।

মিলি ভার্সিটি থেকে পরীক্ষা শেষ করে বাসায় এসে ফোন দেয় সৌরভকে। কল দেয়ার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে রিসিভ করে সৌরভ। যেন সে ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিলো। কখন মিলি ফোন দিবে সে অপেক্ষায়।
– ‘ হ্যাঁ মিলি বলো। কোন খবর পেলে ?’

– ‘ আমার এক বন্ধু সে এলাকায় থাকে। তাদের  বাসার পাশেই ছেলেটার বাসা। তার থেকেই জানতে পারি ছেলেটার নাম তুহিন।  বাবা মারা গেছে অনেকদিন হলো। ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার। মা কে নিয়ে এক বছর হলো ঢাকায়ই থাকে। এখানে আসে না অনেক দিন । ‘

– ‘ কোন নাম্বার নেই ? বা বাসার অ্যাড্রেস ? ‘
– ‘ না। আর কিছুই নাকি সে জানে না। ‘
– ‘ তাহলে কিভাবে সম্ভব ! এত বড় শহরে খুঁজে পাবো কিভাবে ? ‘ হতাশ হয়ে বললো সৌরভ।
মিলি নিজেও বুঝতে পারছে না কী বলবে। তার কাছেও খারাপ লাগছে। সৌরভ কত কিছু করে যাচ্ছে তার বোনের জন্য। অথচ সে কিছুই করতে পারছে না। ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। তা না হলে সে ঢাকায় চলে যেতো। অন্তত কিছু করতে না পারলেও তো বোনের হত্যাকারীকে খোঁজার সময় সৌরভের পাশে থাকতে পারতো। এতেই মনকে কিছুটা শান্ত রাখা যেত। মিলি ঠিক করলো পরীক্ষা শেষ করেই সে মা কে নিয়ে ঢাকায় চলে যাবে। থাকবে কিছুদিন সেখানে।

মিলিকে চুপ থাকতে দেখে সৌরভ আবারো বললো,
– ‘ থাক আমি দেখছি কী করা যায়। তোমরা চিন্তা করো না। বাসার সবার খেয়াল রেখো। ‘
– ‘ ঠিক আছে। ‘

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
তোহা আজ ক্লাসে এসেছে। ক্লাস শেষ করে বের হয়েছে রাজিবের সাথে। রাজিব অফিস শেষ করেই চলে এসেছে টিএসসি তে। দুজন মিলে এক পাশে বসেছে তারা। চারপাশে আরো অনেক অনেক মানুষ। এই জায়গাটা মানুষে গম গম করে সব সময়। রাজিবের একদম ভালো লাগে না। সে চায় তোহাকে নিয়ে নিরিবিলি কোন জায়গায় গিয়ে বসতে। একান্তে নিজেদের মাঝে কিছু সময় পার করতে। কিন্তু তোহাকে কিছু বলার সাহস হয়ে উঠে না। যদি সে রেগে যায় ! তোহাকে রাগাতে চায় না রাজিব। সব সময় তোহার মতামত কে সে প্রাধান্য দেয়। তাদের সম্পর্কটা অল্প দিনের। তবে তোহা রাজিবকে পছন্দ করতো সেই অনেক আগে থেকে। রাজিব জানতো না। জানলো কিছুদিন আগে। আর যখন জানতে পারলো তোহা তাকে এতো পছন্দ করে তখন কাছে টেনে নিলো তোহাকে। মেয়েটাকে তার বেশ লাগে। কি মিষ্টি করে কথা বলে, তাকে ভালোবাসে। অল্প দিনের এই সম্পর্কে খুব বেশি ঘুরতে বের হয়নি তারা। হাতে গোনা কয়েকদিন। সময় হয়ে উঠে না সেভাবে কারোর। তারা দুজনই চায় সম্পর্কটা পূর্ণতা পাক। আর এই পূর্ণতা পাবার জন্য তোহার ভূমিকা হয়তো অনেকাংশে। তোহাই তার ভাই সৌরভকে রাজি করিয়েছে। সৌরভ তোহাকে এতোই পছন্দ করে যে যখন জানলো তোহা রাজিবকে পছন্দ করে তখন আর অমত করেনি। বোন আর বন্ধুর সুখেই যেন তার সুখ! এদিকে রাজিব কখনোই রাজি হতো না যদি সৌরভের অমত থাকতো। বন্ধুর মতের বাহিরে গিয়ে এ সম্পর্ক গড়ার কোন সাধ্য তার ছিলো না। সে জানতো সৌরভ রাজি হবে। সে কঠোর নয়। ছেলেটা যে তাদের অনেক ভালোবাসে।

রাজিবের সাথে দেখা করে তোহা বাসায় ফিরলো সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে। দরজা পেরিয়ে ড্রইং রুমে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো সোফায় কেউ একজন বসে আছে। দিপু। তাদের পাশের বাসায় থাকে। শাহাবুদ্দিন  মেডিকেলে ইন্টার্নি করছে। লম্বা, ফর্সা, সুঠাম দেহ। চোখে চশমা আর সেই চশমার আড়ালে চোখটায় কেমন অস্বস্তি। সেই সাথে লাজুক একটা মুখ। ছেলেরা লাজুক হয় নাকি ? জানা নেই তোহার। এই ছেলেকে সে যতদিন দেখেছে এভাবে লাজুক ভাবেই দেখেছে। তোহাকে দেখেই দিপু উঠে দাঁড়ালো। চশমা ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তোহার খুব হাসি পাচ্ছিলো। সে নিজের হাসিটা ঠোঁট চেপে আটকে বললো,
– ‘ কেমন আছেন ? ‘
দিপু আবারো চশমা ঠিক করলো। তোতলাতে তোতলাতে কোন রকমে বললো,
– ‘ ভ..ভভালো। ‘

ছেলেটা তোতলাচ্ছে ! তাকে ভয় পায় নাকি?  তোহা নিজের হাসিটা লুকিয়ে গম্ভীর মুখ করে বললো,
– ‘ এখানে হঠাৎ ! ‘

দিপু মুখ নিচের দিকে নামিয়ে নিলো। এই মেয়ের চোখের দিকে তাকানো তার সম্ভব না। দুনিয়া কেমন ওলট পালট লাগে। হার্টবিট বেড়ে যায়। তবুও এক নজর দেখতে ভালো লাগে। মনে হয় তৃষ্ণার্ত চোখ জোড়া তার তৃষ্ণা কাটাতে পেরেছে। দিপু হালকা স্বরে বললো,
– ‘ ভাইয়া আসতে বলেছিলো। ‘
– ‘ দাঁড়িয়ে কেনো! তাহলে বসুন। ‘ বলেই তোহা আর সেখানে দাঁড়ালো না। উপরে চলে গেলো।

চলবে….

এ শহর মেঘলা ভীষণ পর্ব – ৮

0

এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ৮
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

-‘ তুমি কি বলতে পারবে ছেলেটা দেখতে কেমন ছিলো?’  উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো সৌরভ। সে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে রাজিব বললো,
– ‘ তুই শান্ত হ আমি কথা বলছি। ‘

রাজিব ছেলেটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। খুব বিনয়ের সাথে বললো,
– ‘ ভাই আপনি যার কথা বলছেন তিনি খুন হয়েছেন। তাকে হত্যা করা হয়েছে। ‘

রাজিবের কথা শুনে ছেলেটা চমকে গেলো। রাজিব শান্ত স্বরে বললো,
– ‘ এখন তো বুঝতেই পারছেন আমরা কেমন ঝামেলায় আছি। পুলিশ এখনো আসামী খুঁজে পায়নি। এদিকে আমাদের মনের অবস্থাও ভালো না। আপনি কি আমাদের এ বিষয়ে একটু হেল্প করতে পারবেন ? ‘

ছেলেটা ভয় পেয়েছে বুঝা গেলো। সে ঢোক গিলে বললো,
– ‘ এসব ঝামেলায় না জড়ানোই ভালো। তাছাড়া আমিই বা আপনাদের কিভাবে সাহায্য করবো ? ‘

রাজিব রেস্টুরেন্ট এর চারপাশে ভালো ভাবে চোখ বুলালো। বললো,
– ‘ আপনাদের এখানে সিসি ক্যামেরা আছে তো তাই না ? ‘
– ‘ জি আছে। ‘

– ‘ তাহলে তো হলোই। আমাদের সেদিনের ফুটেজটা দেখাতে পারবেন? ‘

ছেলেটা যেন ছায়ার কথা বলেই ভুল করেছে। এখন এসব ঝামেলায় পরতে হলো তাকে। বিরক্ত নিয়ে বললো,
– ‘ সমস্যা আছে। ‘
– ‘ কি সমস্যা ? ‘ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো সৌরভ।
– ‘ আগের মাসের ফুটেজ আছে বলে মনে হয় না। প্রতি মাস শেষে সাধারনত সব রিফ্রেশ করা হয়। ‘

যে আশার আলোটা পেয়ে ছিলো সেটাও যেন ধপ করে নিভে গেলো। তবুও মনের মাঝে কিছুটা আশা নিয়ে সৌরভ বললো,
– ‘ একবার চেক করবে প্লিজ ? ‘

বিরক্তি নিয়েই ছেলেটা বললো,
– ‘ আসুন আমার সাথে। ‘
সৌরভ আর রাজিব পিছু পিছু গেলো। ম্যানেজারের কাছে গিয়ে জানতে পারলো ফুটেজ আছে। তিনি খুঁজতে লাগলেন দু সপ্তাহ আগের ফুটেজটা। পেয়েও গেলেন।

রেস্টুরেন্টে এর ভিতর এক পাশের একটা টেবিলে বসা ছায়া। পরনে কালো সুতি শাড়ি। সুন্দর করে সেজেছে। তবে মুখে হাসির কোন রেখা নেই। তার উল্টো পাশে মুখোমুখি বসেছে একটা ছেলে। ছেলেটা দেখতে বেশ সুন্দর। তারা গম্ভীর মুখে কিছু নিয়ে কথা বলছে। তারপর ওয়েটার খাবার নিয়ে এলো। দুজন খেতে খেতেও অনেক আলোচনা করলো। ব্যাস এটুকুই শুধু দেখলো ফুটেজে। রাজিব ছেলেটিকে আগে কখনো দেখেনি। এমনকি সৌরভ ও এই ছেলেকে চিনে না। কি আশ্চর্য! কে এই ছেলে ? সৌরভ অনেক ভেবেও বের করতে পেলো না এ কে। তবুও কোন একটা জায়গায় খটকা লাগছে। মনে হচ্ছে একে খুঁজে বের করতে পারলে এ হত্যা কান্ডের বিষয়ে কিছু অন্ততো জানা যাবে। সৌরভ রেস্টুরেন্ট এর ম্যানেজারকে বললো,
– ‘ আপনি কি আমাদের এই ফুটেজটা একটু দিতে পারবেন ? ‘

ওয়েটার ছেলেটি ম্যানেজারকে ইতোমধ্যে সব বুঝিয়ে বলেছে। তিনি মুখে সৌজন্যতা বজায় রেখে বললেন,
– হ্যাঁ, অবশ্যই।

সৌরভ আর রাজিব ফুটেজ নিয়ে সেদিনের মতো চলে আসে। সৌরভের কেনো যেন সেই জায়গাটিতে তখন আর ভালো লাগছিলো না। ছায়া তাকে ছায়ার মতোই আকড়ে ধরেছে। যেখানে যাচ্ছে সেখানেই যেন পিছু নিচ্ছে। সৌরভের মাথাটা কেমন যন্ত্রণা করে ইদানিং। দেলোয়ার হোসেনকে ছায়ার সাথে রেস্টুরেন্টে যাওয়া ছেলেটির কথা বলেনি সৌরভ। তার ধারনা, ছায়া কোন ছেলের সাথে রেস্টুরেন্টে যেতেই পারে। এ নিয়ে পুলিশকে জানালে তারা তেমন কিছুই করবে না বরং একটা রসালো গল্প সাজাবে । আর সেটা শুনতে মোটেও সৌরভের ভালো লাগবে না।

অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে এসে সুবর্ণা যেন বেজায় রাগ করেছে। নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে থাকে। কারো সাথে তেমন কথা বলে না। মোহনকে প্রায়ই খোটা শুনতে হয়, তোমার তো মা, বোন আর দেশই সব। এদিকে স্ত্রী, সন্তান না খেয়ে মরুক। মোহন সে কথা শুনে বলে,
– ‘ তোমরা না খেয়ে মরছো ? কই জানতাম না তো! ‘

সুবর্ণা আরো রেগে যায়। ‘ মজা করবে না বলছি।
– ‘ সব কিছু সে দেশে ফেলে এখানে চলে এসেছো। দুদিন পর না খেয়েই থাকতে হবে। ‘
– থাকতে হলে সবাইকেই থাকতে হবে। তুমি একা তো থাকবে না। আমি না খেয়ে থাকলে তুমি থাকতে পারবে না ?
– ‘ না পারবো না। আমার একটা মেয়ে আছে। তার ভবিষ্যৎ আমাকে দেখতে হবে। ‘

তারপর মোহন আর কিছু বলে না। এভাবেই চলছে দিন। সুবর্ণা থাকে তার নিজের মতো। সকলকে নিয়ে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু সেই মাথা ব্যাথাটা হঠাৎ করেই পেয়ে বসলো তাকে। মিলির অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়েছে। আরো চারটা বাকি। এর মাঝে হুট করে একদিন সুবর্ণার মা আর তার ভাই চলে আসে বাসায়। সুবর্ণার ভাই শামিম নিজের বাবার ব্যাবসা দেখাশুনা করে। সুবর্ণার পরিবারের অবস্থা খুব একটা ভালো না। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি। বাবার ব্যাবসা বলতে বাজারে কিছু দোকান সেগুলোর দেখভালের দায়িত্বে আছে শামিম। পড়াশুনা বলতে মাধ্যমিকেরর গন্ডি টপকেছিলো। তারপর আর হয়নি। পান খেয়ে মুখ ভর্তি করে রাখা তার সব থেকে পছন্দের কাজ। দেখলেই যে কারোর গা ঘিনঘিন করবে। সুবর্ণার ফ্যামিলির অবস্থা নিয়ে কারোর কোন মাথা ব্যাথা নেই। মোহরের পরিবার সুবর্ণাকে মিলি ছায়ার থেকে আলাদা করে দেখেনি কখনো।

সন্ধ্যায় মিলি পড়তে বসে। ড্রইং রুমে সুবর্ণা তার মা আর আমেনা বেগম বসে কথা বলছিলো। সুবর্ণাকে আজ বেশ খুশি খুশি দেখা যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরার পর থেকে তাকে এমনটা দেখা যায়নি। আমেনা বেগমের মনটাও তাই বেশ ভালো। বাড়িতে কেউ মনমরা হয়ে থাকে সেটা দেখতে একদম ভালো লাগছিলো না। আজ যেন বহুদিন পর সকলে হাসি মজায় মেতে আছে। তবে আমেনা বেগমের হাসিটা মিলিয়ে গেলো কিছুক্ষণ পরই। সুবর্ণা প্রফুল্লতার সাথে শাশুড়ীর কাছে এসে বললো,
– ‘ মা আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ‘
এমন সময় মোহন ড্রইং রুমে উপস্থিত হলো। আমেনা বেগমের আগে সে নিজেই বললো,
– ‘ কি সিদ্ধান্ত নিলে ? ‘

মোহনের এই মুহূর্তে উপস্থিতি সুবর্ণার ভালো লাগলো না। মোহনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,
– ‘ আমি চাই মিলির বিয়েটা নিজেদের মধ্যেই হোক। ওর তো কিছুদিন পরই পরীক্ষা শেষ। শামিম ভালো ছেলে। সে মিলিকে পছন্দ করে। মা ও চায় ওর সাথে বিয়েটা হলে আত্মীতা আরো গভীর হোক। ‘

সুবর্ণার কথার সাথে তাল মিলিয়ে তার মা বললেন,
– হ্যাঁ। আমিই চাচ্ছিলাম। মিলি মা কে ঘরের বউ করে নিয়ে যেতে।

আমেনা বেগম স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তিনি কি বলবেন বুঝতে পাচ্ছেন না। শামিমের মতো ছেলের সাথে কিছুতেই মিলির বিয়ে সম্ভব না। মিলির বাবা শুনলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে। তিনি কিছু বলার আগেই মোহন বলে উঠলো,

– ‘ আত্মীয়তা যথেষ্ট গভীর আছে। এর বেশি দরকার নেই। তাছাড়া সুবর্ণা তুমি আমার বোনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া বন্ধ করো। ‘

মোহনের চোখে মুখে আগুনের তেজ দেখা যাচ্ছে। সুবর্ণার আজ হঠাৎ এতো হাসিখুশি থাকার কারণটা এবারে সে বুঝতে পারলো। মনে মনে তাহলে এ কদিনে এসব ভেবে বের করেছে। এ মেয়ে সব সময় চিন্তা করেছে নিজের ফ্যামিলির আখের গোছানোর কথা। শ্বশুড় বাড়ির কথা মন থেকে কখনো ভাবেনি। মোহন আর সেখানে এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। হন হন করে নিজের রুমে চলে গেলো।  সুবর্ণার মুখে পড়েছে অপমানের তীব্র রেখা। শাশুড়ীর সামনে তাকে আর তার মাকে এভাবে অপমান করলো মোহন এটা তার হজম করতে সময় লাগলো।

বিছানায় ফোনটা বাঁজছে। মিলি টেবিল ছেড়ে উঠে ফোন হাতে নিলো। সৌরভ ফোন দিয়েছে।
– ‘ হ্যাঁ দুলাভাই। বলেন। ‘
– ‘ শুনো মিলি জরুরী বিষয়ে কথা আছে। ‘
– ‘ কি হয়েছে ? কোন সমস্যা ? ‘
সৌরভ একটু থামলো। সময় নিয়ে বললো,
– ‘ কিছুদিন আগে আমি আর রাজিব একটা রেস্টুরেন্টে যাই। শহর থেকে দূরে একটা জায়গা। সেখানটায় আমি আর ছায়া মাঝে মাঝে যেতাম। আমি কোনোভাবে জানতে পারি সেখানে ছায়ার সাথে একটা লোক একদিন দেখা করতে যায়। আমি তাদের থেকে সিসি টিভির ফুটেজটা নিয়েছি। তোমাকে পাঠাচ্ছি এখনই। তুমি দেখে বলো লোকটা কে তুমি চিনো কী না। ‘

সৌরভের কথার আগ পিছ কিছুই বুঝতে পারলো না মিলি। তার বোনের সাথে অন্য ছেলে! বিষটা কেমন লাগলো মিলির কাছে।

– ‘ আচ্ছা দুলাভাই। পাঠান। ‘ মিলির কন্ঠে উদ্দীপনা। সে অপেক্ষা করতে লাগলো ফুটেজ আসার।

চলবে….