অতন্দ্রিলার রোদ
পর্ব: ১০(ইরাবতীর ইশকুল)
লেখা : শঙ্খিনী
ঢাকার অদূরে সাভার এলাকায় রোদের বাবা ইউসুফ সাহেবের বিশাল জমি। মৃত্যুর আগে উনি জায়গাটি রোদের নামে লিখে দিয়ে গেছেন। এখানেই শুরু হবে ইরাবতীর ইশকুলের কাজ।
আজ সকাল থেকেই অতন্দ্রিলা এখানে। ফাঁকা জমিতে দাঁড়িয়েও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে, গান গাইছে, লেখাপড়া করছে।
অতন্দ্রিলা আঙ্গুল উচিয়ে রোদকে বলল, “ওখানে, ওখানে হবে স্কুলের মূল বিল্ডিং। পাঁচতলা বিল্ডিংয়ে থাকবে ৫২ টা ক্লাসরুম, ১২ টা টিচার্স রুম, ৪ টা সাইন্স ল্যাব, ২ টা সিক রুম এবং এক সুবিশাল হলরুম।”
রোদ বলল,“বিল্ডিংয়ের ডিজাইন তুমি করবে নাকি?”
“আমি যদি আর্কিটেক্ট হতাম, তাহলে অবশ্যই করতাম। এখন আমি শুধু আপনাকে ধারনা দিচ্ছি।”
“ভালো। এখন বলো হোস্টেলটা কোথায় হবে?”
“স্কুল বিল্ডিংয়ের মুখোমুখি থাকবে আবাসিক হোষ্টেল। আমার অবশ্য ইচ্ছা আছে ছেলে এবং মেয়েদের জন্যে আলাদা আলাদা হোস্টেল করার। কারণ একটা ছেলে একটা মেয়েকে প্রাইভেসি দিতে পারে না, কিন্তু একটা মেয়েকে অন্য আরেকটা মেয়েকে প্রাইভেসি দিতে পারে।”
“তুমি কি কোনো ভাবে বোঝাতে চাইছো যে আমি তোমাকে প্রাইভেসি দেই না?”
“আপনার ব্যাপারটা আলাদা। কথা হচ্ছে স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের প্রসঙ্গে। যাইহোক, যেটা বলছিলাম। হোস্টেলের ঠিক পাশেই থাকবে অবসর কেন্দ্র।”
“অবসর কেন্দ্রটা আবার কি?”
“বাচ্চারা লেখাপড়া করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে আসবে অবসর কেন্দ্রে। এখানে থাকবে লাইব্রেরী, গান এবং বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র শেখার ব্যাবস্থা, ছবি আঁকার ব্যাবস্থা, নাচ শেখার ব্যাবস্থা। এই তিনটা বিল্ডিং ছাড়া যে ফাঁকা জায়গা অবশিষ্ট থাকবে, সেটাকে দুই অংশে ভাগ করা হবে। প্রথম অংশ হবে খেলার মাঠের। মাঠের একদিকে পিচ বানানো হবে, বাচ্চারা ক্রিকেট খেলবে। অন্যদিকে গোলপোস্ট টানিয়ে বাচ্চারা ফুটবল খেলবে।
দ্বিতীয় অংশটা হবে বাচ্চাদের ক্যাম্পাস। সেখানে থাকবে এক ভাস্কর্য।”
“কার ভাস্কর্য?”
“ইরাবতীর।”
রোদ মনে মনে স্বীকার করল, অতন্দ্রিলা মেয়েটার চিন্তাভাবনা অত্যন্ত গোছানো।
রোদ শীতল গলায় বলল, “আচ্ছা ভালো কথা, স্কুলের অধ্যক্ষ হবে কে?”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “আমি।”
“তুমি শিক্ষকতা জানো?”
“অধ্যক্ষ হতে শিক্ষকতা জানতে হয় না। একজন অধ্যক্ষের তিনটা বিশেষত্ব থাকে। সেগুলো হলো – চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান, তীক্ষ্ম নজর এবং নেতৃত্বে পারদর্শিতা। তিনটাই আমার মধ্যে কমবেশি আছে। আমার ধারনা আমি পারবো।”
“আমারও ধারনা তুমি পারবে। কারন তুমি যেকোনো কাজই অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে করো।”
“জানি। একটা মজার কথা শুনবেন?”
“হুঁ।”
“স্কুলের উপাধ্যক্ষ হতে আবার দুটি গুণ লাগে। সেগুলো হলো – সকল ঘটনা তদারকি করতে পারা এবং যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে পারা। এই দুটি গুন আছে আমার আপার। তাই আমার আপা হবে এই স্কুলের উপাধ্যক্ষ।”
“কিন্তু তোমার আপা তো তোমার পছন্দের মানুষদের তালিকায় নেই।”
“তাতে কি হয়েছে? আপার মধ্যে এই দুটো গুন আছে। এছাড়া তিনি অতিরিক্ত কথা বলেন এবং মানুষকে অতিরিক্ত জ্ঞান দেন। এগুলোও একজন উপাধ্যক্ষের বৈশিষ্ট।”
রোদ ক্লান্ত গলায় বলল, “আকাশের অবস্থা কিন্তু ভালো না, যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে। ফিরে যাবে তন্দ্রি?”
“চলুন।”
রোদ অতন্দ্রিলাকে পৌঁছে দিয়ে অফিসে চলে গেল। দুপুরের দিকে নামল ঝুম বৃষ্টি।
অতন্দ্রিলা চিন্তা করছে, এখন বৃষ্টিতে ভিজলে কি সেটা শিশুসুলভ কাজ হবে? নাহ্, বৃষ্টিতে অযথা নাচানাচি করা শিশুসুলভ কাজ। কিন্তু বৃষ্টিতে পাটি পেতে বসে থাকাটা শিশুসুলভ কাজ নয়।
অতন্দ্রিলা তা-ই করল। বৃষ্টির মধ্যে ছাদে পাটি পেতে বসে পরল। একদৃষ্টিতে বৃষ্টি দেখছে সে।
একদৃষ্টিতে জানালার ভিতর থেকেও বৃষ্টি দেখা যেত। কিন্তু সেটা অনুভূত হত না।
এখন অতন্দ্রিলা একইসঙ্গে বৃষ্টি দেখছে এবং অনুভব করছে।
বৃষ্টিতে ভিজে অতন্দ্রিলার বেশ ভালো ঝামেলা হয়েছে। জ্বর এসেছে, মাথা ঝিমঝিম করছে, চোখ কটকট করছে।
জ্বর এসেছে, আসতেই পারে। এটা হৈচৈ করে বাড়ির লোকদের জানানোর কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাই অতন্দ্রিলা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলো।
সন্ধ্যা সাতটা। অতন্দ্রিলা চাদরের নিচে। সে বুঝতে পারছে না জেগে আছে নাকি স্বপ্ন দেখছে। হঠাৎ, কপালে এক হিমবাহের মত ঠান্ডা হাত অনুভব করল। তাকিয়ে দেখল, হাতটা রোদের। অতন্দ্রিলা বুঝতে পারলো, তার ঘুম ভেঙেছে।
অতন্দ্রিলা এখনো শুয়ে আছে।
রোদ নিচু গলায় বলল, “জ্বর আসল কিভাবে?”
“বৃষ্টির মধ্যে বসে ছিলাম।”
“বৃষ্টির মধ্যে কেউ বসে থাকে?”
অতন্দ্রিলা ক্লান্ত গলায় বলল, “আমি থাকি। কেন থাকি সেটা এখন বলতে ইচ্ছা করছে না।”
“বলতে হবেও না। একটু উঠে বসো তো তন্দ্রি।”
অতন্দ্রিলা উঠে বসল। রোদ সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে থার্মোমিটার দিয়ে দিল। কয়েক মিনিট পর ব্যস্ত ভঙ্গিমায় থার্মোমিটার হাতে নিল রোদ।
অতন্দ্রিলা বলল, “কত জ্বর?”
“একশ দুই পয়েন্ট পাঁচ। তুমি ওষুধ খেয়ে আবার শুয়ে পরো।”
“খালি পেটে ওষুধ খাবো?”
রোদ অতন্দ্রিলার দিকে প্যারাসিটামল এবং পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বলল, “অ্যাসপিরিন জাতীয় ট্যাবলেট খালি পেটে খাওয়া যায় না। প্যারাসিটামল খাওয়া যায়।”
অতন্দ্রিলা বাধ্য মেয়ের মতো ওষুধ খেয়ে শুয়ে পরল।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
রাত একটা। জ্বর কমার কোনো নামগন্ধ নেই।
রোদ অতন্দ্রিলা কপালে জলপট্টি দিতে ব্যস্ত।
অতন্দ্রিলা বিড়বিড় করে বলল, “কেন করছেন আমার জন্যে এসব?”
রোদ হতাশ গলায় বলল, “অসুখ নামের দানবটা খুবই ভয়ংকর। এই দানবের থাবায় আমি আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষগুলোর একজনকে হারিয়েছি। দ্বিতীয়বার সেই দানবকে আমার আর কোনো প্রিয় মানুষকে কেড়ে নিতে দেব না।”
অতন্দ্রিলার গা বেয়ে শীতল হওয়া বয়ে গেল। রোদ কি বলল? “আর কোনো প্রিয় মানুষকে কেড়ে নিতে দেব না।”
এর মানে কি? অতন্দ্রিলা রোদের প্রিয় মানুষগুলোর একজন? তাহলে তো মন্দ হয় না।
আজ ১৪ই মার্চ, অতন্দ্রিলার জম্মদিন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ১৫ কিংবা ১৬ই মার্চে পালিত হয়ে আসছে তার জন্মদিন। এর কারন হলো অতন্দ্রিলার পরিবারের প্রায় সকলে তার জন্মদিন মনে রাখতে পারে না।
একবার হলো কি, জন্মদিনের পরের দিন অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় হামিদ সাহেবকে বলে, “বাবা জানো কাল না আমার জন্মদিন ছিল।”
হামিদ সাহেব এক দারুন অপরাধবোধে ভোগেন। সেই দিনই বাড়িতে ধুমধাম করে জন্মদিনের আয়োজন করা হয়।
গত বছর হামিদ সাহেব ঘোষনা দিয়েছিলেন, “এবার কিছুতেই অতর জন্মদিন ভুলে যাবো না।”
ঘোষণা অনুযায়ী তিনি ঠিক রাত বারোটায় ফুলের তোড়া নিয়ে অতন্দ্রিলার ঘরের দরজার সামনে উপস্থিত হন,জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। সময়টা একদম ঠিক থাকলেও, তারিখটা ছিল ভুল।
অতন্দ্রিলা ফুলের তোড়া গ্রহণ করে স্বাভাবিক গলায় বলে, “ধন্যবাদ বাবা। কিন্তু আজ আমার জন্মদিন না। আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসা দিবস। আমার জন্ম দিবস সামনের মাসে।”
অতন্দ্রিলার ধারনা, “জন্মদিন নিজস্ব আনন্দের দিন। এই দিনে নিজে নিজে আনন্দ করা উচিত।”
জন্মদিনে অতন্দ্রিলা সারারাত বই পড়ে। সকালে উঠে রান্না করে, ছাদে বসে গান গায়, নিজের সঙ্গে কথা বলে।
অতন্দ্রিলা বুঝে গেছে রোদ জন্মদিন উপলক্ষে কোনো আয়োজন করেছে। সে নিচে নেমে গেল।
নাহ্, নিচে কোথাও রোদ নেই। অতন্দ্রিলা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দেখে রোদ গাড়িতে বসা।
রোদ বলল, “তন্দ্রি গাড়িতে উঠে এসো।”
অতন্দ্রিলা কোনো প্রশ্ন না করে গাড়িতে উঠল।
রোদ উৎসাহিত গলায় বলল, “শুভ জন্মদিন।”
“জানলেন কি করে?”
“চাইলেই জানা যায়। চলো তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই!”
অতন্দ্রিলা বিস্মিত গলায় বলল,“কোথায়?”
“গেলেই দেখতে পাবে।”
রোদ অতন্দ্রিলাকে নিয়ে গেল ফাঁকা এক ব্রিজের ওপর। গাড়ি থেকে নেমে রোদ গাড়ির পেছন থেকে একটা খাঁচা বের করল।
খাঁচাভর্তি পাখি।
অতন্দ্রিলা কিছুটা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “এসব কি?”
“আজ তোমার জন্মদিন উপলক্ষে আমরা এই চব্বিশটা পাখিদেরকে বন্দী জীবন থেকে মুক্তি দিব।”
“চব্বিশ বছর বয়স হয়ে গেল বলে চব্বিশটা পাখি?”
“হুঁ!”
অতন্দ্রিলা মহা আনন্দে পাখিদের খাঁচা থেকে মুক্ত করছে। এভাবে কোনো মানুষকে যদি বন্দী জীবন থেকে মুক্তি দিতে পারতো, তাহলে আরও বেশি আনন্দ হতো।
অতন্দ্রিলার রোদ
পর্ব: ৯(বন্ধু হবে বলে যাও)
লেখা : শঙ্খিনী
শীতের সকাল। চারিদিকে বইছে দমকা হাওয়া। সমুদ্রের তীরে থাকা সাত-আট জন মানুষ ঠকঠক করে কাঁপছে।
কিন্তু অতন্দ্রিলা কাঁপছে না। কফির মত রঙের একটি চাদর গায়ে জড়িয়ে বসে আছে সমুদ্রের তীরে। অতন্দ্রিলা চিন্তা করছে, এই সুবিশাল সমুদ্রে ভয়ংকর এক পাপীকে যদি চুবিয়ে আনা হয় তাহলে কি হবে? তার সব পাপ ধুয়ে যাবে? নাহ্! ত্বকে এসিডের দাগ আর মনের পাপ কখনই সম্পুর্নভাবে ধোয়া যায় না। কিছু না কিছু চিহ্ন থেকেই যায়।
অতন্দ্রিলার পাশে বসে চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে রোদ, চাটা বেশ ভালোই লাগছে তার।
রোদ উৎসাহিত গলায় বলল, “অতন্দ্রিলা, তুমি কি গুগলপ্লেক্স সম্পর্কে জানো?”
অতন্দ্রিলা ভ্রু সামান্য কুঁচকে বলল, “কি সম্পর্কে?”
“গুগলপ্লেক্স।”
“সেটা কি? গুগলের নতুন কোনো অ্যাপ?”
রোদ ঠোঁটের কোনো হাসি নিয়ে বলল, “না। গুগলপ্লেক্স হলো একটা সংখ্যা।”
“সংখ্যা? সংখ্যার এমন নাম কেন?”
“এই সংখ্যাটি এত বড় যে, তা লিখে রাখার মতো জায়গা এই মহাবিশ্বে নেই। ১০ হিসাবে ১০ এর শক্তি হিসাবে ১০০ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। 10(¹⁰^¹⁰⁰)।”
“আসলেই কি এই সংখ্যা লিখতে গেলে মহাবিশ্ব সমান জায়গা লাগবে?”
“কিছুটা সেরকমই। গুগলপ্লেক্স সংখ্যাটি শুনতে তোমার ৩১,০০০ বছর সময় লাগবে।”
“অসাধারন ব্যাপার তো! ভালোবাসার পরিমাণ বোঝাতে,গুগলপ্লেক্স উদাহরন হিসেবে ব্যাবহার করা যেতে পারে। যেমন, আমি তোমাকে গুগলপ্লেক্সের সমান ভালোবাসি।”
রোদ কোনো জবাব দিলো না। এতে অতন্দ্রিলা কিছুটা বিব্রত বোধ করল। ভালোবাসার প্রসঙ্গ তোলাটা বোধ হয় ঠিক হয়নি।
অতন্দ্রিলা অস্পষ্ট গলায় বলল, “আবার ঘৃণার কথাও বলা যায়। আমি তোমাকে গুগলপ্লেক্সের সমান ঘৃণা করি।”
“গুগলপ্লেক্স অনেক বৃহৎ, অনেক। একটা মানুষের প্রতি আরেকটা মানুষের এতটা ঘৃণা থাকতে পারে না।”
“ভালোবাসা থাকতে পারে?”
“পারে।”
“কেন?”
“কারন ভালোবাসা মানুষকে আনন্দ দেয়। মানুষ ভালোবাসতে ভালোবাসে, তাই ভালোবেসে যায়। কিন্তু ঘৃণা মানুষকে আনন্দ দেয়, বরং তার দুঃখকে কয়েক গুন বাড়িয়ে দেয়। তাই একপর্যায়ে ঘৃণা ফুরিয়ে যায়। কিন্তু ভালোবাসা ফুরোয় না।”
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
মূল কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে ইনানী বীচ। এই বীচ অন্যান্য বীচের থেকে যে আলাদা তা নয়। তবুও মানুষ কক্সবাজারে বেড়াতে এলে সেখানেই যাবেই।
অতন্দ্রিলা এবং রোদও যাচ্ছে।
অতন্দ্রিলার ধারনা, মানুষ ইনানীতে যায় বীচটাকে উপভোগ করার জন্যে নয়। বরং সেখানে যাওয়ার রাস্তাটাকে উপভোগ করার জন্যে।
রাস্তার ডানদিকে সমুদ্র এবং বামদিকে পাহাড়। প্রকৃতির দুই আশ্চর্যজনক সৌন্দর্য মুখোমুখী। তবে প্রকৃতির এই দুই সৌন্দর্যকে মুখোমুখি দেখা যাচ্ছে মানুষের কারনেই। মানুষ যদি বুদ্ধি করে পাহাড় ও সমুদ্রের মাঝে রাস্তা তৈরি না করতো, তবে এত সুন্দর দৃশ্য দেখতে হতো না।
সেই রাস্তা দিয়ে চলছে অতন্দ্রিলাদের জিপ গাড়ি। অতন্দ্রিলা বসেছে রোদের সামনে।
অতন্দ্রিলা আগ্রহ নিয়ে বলল, “আপনার কোনটা পছন্দ, পাহাড় নাকি সমুদ্র?”
“যখন যেটার কাছাকাছি থাকি, তখন সেটাই প্রিয়।”
“এখন তো দুটোরই কাছাকাছি আছেন!”
“তাহলে এখন দুটোই প্রিয়। তোমার পছন্দের কোনটা?”
“সমুদ্র।”
“কেন?”
“কারন ঢাকায় সমুদ্র নেই। সমুদ্র দেখতে আসতে হয় কক্সবাজারে। তাই সমুদ্রের প্রতি অন্যরকম একটা টান আছে।”
“ঢাকায় পাহাড়ও তো নেই!”
“পাহাড় নেই কিন্তু আপনাদের বাগান আছে। সবুজে ঘেরা ওই বাগানটা আমাকে পাহাড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।”
রোদ অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, “ইরাও একই কথা বলত।”
“আপনার এই ব্যাপারটা না আমার অনেক ভালো লাগে।”
“কোন ব্যাপারটা?”
“এইযে বারবার ইরাবতীর কথা বলা এবং আমাকে মনে করিয়ে দেওয়া যে আপনি তাকে ভোলেননি, এখনো তার জন্যে অফুরন্ত ভালোবাসা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যাতে আমি আপনার মনের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা না করি।”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “রোদ সাহেব?”
“হুঁ।”
“আপানার ধারনা ভুল, সম্পূর্ণ ভুল। আমি ইরাবতীর জায়গা নিতে চাই না।”
“আমার এমন কোনো ধারনা নেই।”
“আমি আপনার স্ত্রী হতে চাই না। আমি আপনার বন্ধু হতে চাই।”
রোদ নিশ্চুপ। অতন্দ্রিলাও কথা বলছে না।
নীরবতার সঙ্গে পা ভেজাচ্ছে।
সূর্যাস্ত হয়েছে। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এল।
রোদ স্বাভাবিক গলায় বলল, “চল এবার যাই।”
“যাচ্ছি। তার আগে একটা প্রশ্নের জবাব দেবেন?”
“কি প্রশ্ন?”
“বন্ধু হতে পারি?”
রোদ সঙ্গে সঙ্গে বলল, “পারো, চাইলেই পারো।
“ধন্যবাদ।”
“তাহলে আমিও কি তোমাকে আমার বন্ধু ভাবতে পারি?”
“ভাবতে পারেন না। আপনি আমার বন্ধু, আমিও আপনার বন্ধু। এর মধ্যে ভাবাভাবির কি আছে?”
ফাইভ স্টার হোটেলগুলোর নাস্তা তেমন একটা ভালো লাগে না অতন্দ্রিলার। নাস্তায় এত আয়োজন অসহ্য লাগে। তার মতে, “দিনের প্রথম আহারটি হওয়া উচিত সাদামাটা ধরনের। যা দেখে চোখ শান্তি পাবে, যা খেয়ে মন শান্তি পাবে।”
আজ অতন্দ্রিলাকে একাই নাস্তা করতে হচ্ছে। রোদ গেছে ক্যাম্প ফায়ারের আয়োজন করতে।
সন্ধ্যা ফোন করেছে, অতন্দ্রিলা নিতান্ত অনিচ্ছায় টেলিফোন তুলল।
সন্ধ্যা উৎসাহিত গলায় বলল, “কিরে তোদের হানিমুন কেমন চলে?”
অতন্দ্রিলা বিরক্ত গলায় বলল,“কি কেমন চলে?
“হানিমুন! আরে শোন না আমাদের হানিমুনের সময়ে কি হয়েছে। আমরা গিয়েছিলাম সিলেটে। কনকনে ঠান্ডা! তোর জাভেদ ভাইয়ের মাথায় সারাক্ষণ কমলা রঙের মাফলার পেছানো। ছবি তোলার সময়ও মাথায় ঘোমটা দিয়ে রেখেছিল। তাই রাগে, দুঃখে হানিমুনের ছবিগুলো আর প্রিন্টই করিনি। রোদ আবার সেরকম কিছু করছে না তো?”
“তোমার কি মনে হয় আপা?”
“আমার তো মনে হয় করছে না।”
“তাহলে করছে না!”
“আচ্ছা তোকে একটা কাজের কথা বলি! শোন সবসময় রোদের কাছাকাছি থাকবি, বিশেষ করে বিয়ের প্রথম বছরটা। কখনো ওকে চোখের আড়াল করবি না। পারলে ওর কাছে ঘেঁষে থাকবি। এতে হবে কি, ও আর অন্য মেয়েদের দিকে তাকানোর সুযোগ পাবে না।”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “আপা তোমার তো খেয়েদেয়ে কোনো কাজ নেই, তুমি গিয়ে জাভেদ ভাইয়ের কাছে ঘেঁষে থাকো। আমি রাখলাম।”
সন্ধ্যাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অতন্দ্রিলা টেলিফোন রেখে দিল।
রাতে সমুদ্রের তীরে ক্যাম্প ফায়ার করা হয়েছে, তাবু খাটানো হয়েছে। তাবুর পাশে আবার রয়েছে বারবিকিউয়ের ব্যাবস্থা।
তাবু খাটানোর কোনো অর্থ নেই, রোদ অতন্দ্রিলা কেউই রাতে সেখানে থাকবে না।
তবুও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যে খাটানো।
অতন্দ্রিলা সেখানে বসে আছে। রাতের সমুদ্রে এক অন্যরকম রহস্য রয়েছে। সমুদ্রের জলকে জল মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে পারদ। পারদ দেখতে চকচকে তবে সে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাকে ধরতে গেলেই ছুটে পালায়।
সমুদ্রের জলও কি এখন ধরতে গেলে ছুটে পালাবে? ব্যাপারটা পরীক্ষা করা দরকার।
রোদ এসে অতন্দ্রিলার পাশে বসল।
আনন্দিত গলায় বলল, “আয়োজন কেমন হয়েছে অতন্দ্রিলা?”
“এই অর্থহীন তাবুটাকে বাদ দিলে, ভালো।”
“আচ্ছা তোমার নামটা কে রেখেছে?”
“আমার বাবা। আমাদের তিন ভাইবোনের নামই উদ্ভট। আমার বাবা মনে করেন, উদ্ভট নামের অধিকারীকে মানুষ মনে রাখে। সাধারন নামের অধিকারীদের মানুষ অন্য কারও সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে।”
“অতন্দ্রিলা নামের অর্থ কি?”
“যাকে তন্দ্রা স্পর্শ করতে পারে না।”
“তোমাকে তন্দ্রা স্পর্শ করতে পারে না?”
“এখন পারে কিন্তু হয়তো আমার জন্মের পরপর পারতো না। তাই এমন নাম রাখা হয়েছে আমার। তা, হঠাৎ এই নামের প্রসঙ্গ?”
“না মানে, বারবার তোমার নামটা উচ্চারন করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার।”
“কষ্টসাধ্য ব্যাপার হলেও কিছু করার নেই। অতন্দ্রিলা বলেই ডাকতে হবে।”
রোদ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আচ্ছা তুমি তো আমাকে অত ডাকতে মানা করেছো। কিন্তু অ-তন্দ্রি-লা থেকে যদি শুধু ‘তন্দ্রি’ ডাকি, তাহলে কি তোমার কোনো আপত্তি আছে?”
অতন্দ্রিলা ঠোঁটভর্তি হাসি নিয়ে বলল, “আপত্তি থাকবে কেন? আমার নামের ভেতরেই যে এত সুন্দর একটা নাম লুকিয়ে আছে, তা আগে খেয়ালই করিনি!”
রোদ আজ প্রথম অতন্দ্রিলাকে হাসতে দেখছে। বেশির ভাগ মানুষ যখন হাসে, তখন কেবল তাদের ঠোঁট হাসে। চোখ হাসে না। অতন্দ্রিলার চোখ এবং ঠোঁট একসঙ্গে হাসছে।
অতন্দ্রিলা বলল, “আপনার দেওয়া নামটা আমার অস্বাভাবিক পছন্দ হয়েছে। এই পৃথিবীতে আমাকে ‘অত’ নামে ডাকার অধিকার আছে ছয়জন মানুষের। তারা হলেন আমার বাবা, মা, দাদি, আপনার মা, শহর এবং জরিনা। কিন্তু আমাকে ‘তন্দ্রি’ নামে ডাকার অধিকার শুধুমাত্র আপনার। কারন এই নামটা আপনি দিয়েছেন।”
“তাহলে তো আমি ধন্য, তন্দ্রি।”
“বেশিবেশি তন্দ্রি ডাকবেন। যতবার শব্দটা শুনি, আমার ভালো লাগে।
আমি এতটাই আনন্দিত যে এখন আপনাকে গান শোনানো হবে। আমি যখন কারও ওপর অনেক বেশি খুশি হই, তখন তাকে গান শোনাই।”
“গান পারো নাকি?”
“যে মানুষ কথা বলতে পারে, সে গানও গাইতে পারে। গুনুন তো এখন।”
এতদিন যে বসেছিলেম
পথ চেয়ে আর কাল গুনে,
দেখা পেলেম ফাল্গুনে।
স্বর্গে মানুষের মতো দেহবিশিষ্ট সুকন্ঠী গায়িকাদের বলা হয় কিন্নর। এদের থাকে ত্রিকাল ভুলানি কণ্ঠ। অতন্দ্রিলা জন্মেছে কিন্নর কণ্ঠ নিয়ে।
রোদ আজ দেখল অন্য এক অতন্দ্রিলাকে। খুশি হলে যে একটা মানুষ এতটা বদলে যেতে পারে তা রোদের জানা ছিল না।
রোদের খুব ইচ্ছে হচ্ছে অতন্দ্রিলাকে বলতে, “তুমি কি সারাক্ষণ এভাবে হেসে গেয়ে থাকবে?”
অতন্দ্রিলা মুখের ওপর “না” বলে দিবে অথবা সঙ্গে সঙ্গে মুখটা আবার গোমড়া করে ফেলবে ভেবে, রোদ আর বলল না।
“শুনুন!”, অন্যরকম গলায় অতন্দ্রিলা বলল।
রোদ বলল, “হুঁ, বলো।”
“আমাকে বলা হয়েছে এ বাড়িতে আমার কিছু প্রয়োজন হলে আপনাকে জানাতে। আমি কি জানাতে পারি?”
“অবশ্যই পারো।”
“আমার একটা নকশিকাঁথা প্রয়োজন?”
রোদ ভ্রু সামান্য কুঁচকে বলল, “কি প্রয়োজন?”
“নকশিকাঁথা! নকশিকাঁথার সূক্ষ্ম সেলাইয়ের স্পর্শ ছাড়া ছোটবেলা থেকেই আমার ঘুম আসেনা। ছোটবেলায় অবশ্য দাদি আমার জন্যে নকশিকাঁথা সেলাই করতেন। কিন্তু এখন তার বয়স হয়েছে, চোখে ভালো দেখেন না। তাই সেলাইও করতে পারেন না। সেজন্যে এখন বাইরে থেকে কিনতে হয়।
তো! জোগাড় করতে পারবেন তো?”
রোদ মুগ্ধ হয়ে অতন্দ্রিলার কথাগুলো শুনছিল। বেশ সুন্দর করেই একটা বিষয় বর্ণনা করতে পারে মেয়েটা। ইরা এটা পারতো না। কথা বলার মাঝে বারবার থেমে যেত সে।
রোদ বলল, “অবশ্যই পারবো অত।”
অতন্দ্রিলা বেশ অবাক হলো। লোকটা এত সহজে তাকে অত ডাকল কি করে!
অতন্দ্রিলা কঠিন গলায় বলল, “শুনুন, আপনি আমাকে অত ডাকবেন না। আমার পুরো নাম অতন্দ্রিলা। হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ আছেন যাদের আমি পছন্দ করি। শুধু তারাই পারবে আমাকে অত ডাকতে। কখনো সুযোগ হলে খেয়াল করে দেখবেন, আমার নিজের বড় বোনও আমাকে অত ডাকে না। কারন আমি তাকে পছন্দ করি না।”
“তো কি বলে ডাকে?”
“আপা চেষ্টা করে আমাকে কিছু না ডাকতে। বেশির ভাগ সময় তিনি আমাকে ‘এই শোন’ বলে সম্বোধন করে।”
রোদ আহত গলায় বলল, “ঠিকাছে। তোমার নকশিকাঁথার ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।”
“অনেক ধন্যবাদ।”
আজ শুক্রবার, ছুটির দিন। রোদের ইচ্ছা ছিল সারাটাদিন ঘরে বসেই কাটিয়ে দেবে। কিন্তু যেই ইচ্ছা ভঙ্গ করে রোদ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরল।
বেশ রাগ হচ্ছে তার। রাগ হওয়ার কারনটা অতন্দ্রিলা।
এত রূপবতী মেয়ে, কি মিষ্টি গলার স্বর, সে কি করে বলে, “আমাকে অত ডাকবেন না। আমার পছন্দের মানুষেরাই আমাকে অত ডাকতে পারে।” সে কি ভেবেছে, অত ডাকতে পছন্দের মানুষ হতে হয়।
তাকে অত ডাকার অনেকগুলো কারণ আছে।
অতন্দ্রিলা নামটা বেশ বড়, উচ্চারণটাও কঠিন। তাই রোদ তাকে ‘অত’ বলে সম্বোধন করেছে। এটা একটা কারণ হতে পারে।
আবার অতন্দ্রিলা এখন তার স্ত্রী। প্রায় এক সপ্তাহ হলো রোদ তাকে বিয়ে করেছে। তাই স্বামী হিসেবে ডাকনাম ধরে ডাকতেই পারে রোদ।
রোদ বাড়ি থেকে যাওয়ার পর পরই ফিরোজা অতন্দ্রিলার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দেন।
চিঠিটা বেশ পুরনো। চার বছর আগে লেখা হয়েছে। চিঠির প্রেরক ইরা।
অতন্দ্রিলা বেশ আন্দাজ করতে পারছে চিঠিতে কি লেখা। শাশুড়ির সামনে ইরার চিঠি পড়ার কোনো অর্থ নেই। তাই অতন্দ্রিলা সেটা নিয়ে বারান্দায় এল। চিঠিটা এমন –
প্রিয়তমেষু,
তুমি অতি হৃদয়বতী একটি মেয়ে। হৃদয়বতী বলছি কারন, তুমি রোদের অতীত জানার পরেও তাকে বিয়ে করেছ। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি ইরাবতী। বর্তমানে বসে আছি হসপিটালের বেডে। আমার কাছে বেশি সময় নেই আমি বুঝতে পারছি। আর কয়েকদিন পর আমার অপারেশন হবে। তাই আগেভাগেই তোমাকে এই চিঠি লিখে রাখছি।
আমি জানিনা আজ থেকে কত দিন, কত মাস কিংবা কত বছর পর তুমি আমার এই চিঠি পড়ছ। আমি এও জানিনা, তুমি কোন পরিস্থিতিতে রোদকে বিয়ে করে। নিজের ইচ্ছায় নাকি চাপের মুখে পরে। যে সময়ে, যে পরিস্থিতিই থাকো না কেন তোমাকে কয়েকটা কথা বলা দরকার। সেগুলোই বলছি।
আমি চলে যাওয়ার পর হয়তো রোদ আমাকে কখনোই ভুলতে পারবে না। সারাটা জীবন হয়তো আমার চলে যাওয়ার কষ্টটা বয়ে বেড়াবে। কিন্তু আমার বিশ্বাস তুমি পারবে ওকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে। দয়া করে ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না। দেখবে একদিন ও তোমাকে অনেক ভালোবাসবে। তুমিই একদিন হবে ওর পৃথিবী। শুধু একটু সবুর করো।
আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, একদিন তোমাদের ফুটফুটে একটা মেয়ে হবে। তোমাদের মেয়ের নাম দিলাম ‘রাত্রি’। নামটা পছন্দ না হলে রাখার দরকার নেই। কিন্তু ও সবসময় আমার কাছে রাত্রি হয়ে থাকবে, ইরার রাত্রি।
আরও একটা কথা, জীবনে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নগুলো পূরণ না করেই মরে যেতে হচ্ছে। রোদ আমার সেই স্বপ্নগুলোও পূরণ করতে পারবে না। কিন্তু তুমি যদি পারো, তাহলে দয়া করে আমার স্বপ্নগুলো পূরণ কোরো। কি সেই স্বপ্নগুলো , তা তোমাকে এ বাড়ির প্রকৃতিই বলে দেবে। আমি আর না-ই বললাম।
ভালো থেকো, রোদকে ভালো রেখো। তাহলে আমিও ভালো থাকবো।
ইতি,
ইরাবতী।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
পড়া শেষ করে অতন্দ্রিলা চিঠিটা ভাঁজ করে যত্নসহকারে আলমারিতে তুলে রাখল।
ইরার ছবিটার সামনে এসে দাড়িয়ে বলল, “তুমি যদি এখন এখানে থাকতে, তাহলে নিশ্চই আমাকে ধমক দিয়ে বলতে তোমাকে ‘তুমি’ করে ডাকতে। তাই আমি এখন থেকে তোমাকে তুমি করেই ডাকবো। তোমার কথার মধ্যে একটা অস্পষ্টতা ছিল। তোমার স্বপ্নের কথা এ বাড়ির প্রকৃতি আমাকে বলবে কি করে? প্রকৃতির কান আছে না মুখ? যাইহোক ব্যাপার না, আমি ঠিকই খুঁজে বের করবো তোমার স্বপ্নগুলো। তুমি চিন্তা কোরো না বুবু।”
ইরার হাতের লেখা গোটা গোটা, লেখার ধরনও সুন্দর। এই মানুষটার নির্ঘাত ডাইরী লেখার অভ্যাস ছিল। আর সেই ডায়রীতেই হয়তো ইরা তার স্বপ্নগুলো লিপিবদ্ধ করে রেখেছে।
অতন্দ্রিলা জরিনাকে খরব দিল। জরিনা আজকাল আনন্দেই আছে। এ বাড়িতে আসার পর আফার জন্যে কফি বানানো ছাড়া তেমন কোনো কাজই করতে হয়নি তাকে।
জরিনা ব্যাস্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে বলল, “আফা, ডাকছেন আমারে?”
“হুঁ। একটা কাজ করবো, তোমার সাহায্য লাগবে।”
“সাহাইয্য আবার কি আফা? কামে আপনের হাতই দেওন লাগবো না, সব আমার ওপরে ছাইরা দেন!”
“সব কাজ তোমার ওপরে ছেড়ে দিতে পারতাম যদি তুমি শিক্ষিত হতে। আমরা এখন এই বুকসেলফের সমস্ত বইগুলো নামাবো। একটা ডায়রী খুঁজতে হবে।”
“কি কন আফা! এতডি বই নামাইবেন কেমনে? ডায়রী লাগবো, খালাম্মারে কইলেই তো হয়!”
“ওনাকে বলতে হবে না। চলো তো জরিনা কাজ শুরু করি। রোদ সাহেব চলে এলে তো আর পারবো না।”
“আফা! এত আয়োজন কইরা ভাইজান আপনেরে বিয়া করছে, আফনে তারে সাহেব ডাকেন কেন? আফনে কি তার অপিসে কাম নিসেন?”
অতন্দ্রিলা বিরক্ত গলায় বলল,“ইচ্ছা হয়েছে, তাই ডাকি। তুমি চাইলে তুমিও ডাকতে পারো। ডাকবে?”
জরিনা এবং অতন্দ্রিলার কাজ খুব একটা কঠিন হলো না। প্রথম তাকের বইগুলো সরাতেই পেছনের দিকে পেয়ে গেল একটা ডাইরি। ডাইরির কভারে লেখা ‘২০১৬’।
অতন্দ্রিলা ডাইরিটা খুলল। বেশির ভাগ মানুষ ডাইরি লেখা শুরু করলেও কিছুদিন পর তা বন্ধ করে দেয়। ইরাও তার ব্যতিক্রম নয়।
ডাইরির প্রথম কয়েকটা পাতা ছাড়া সম্পূর্ণ ডায়রি ফাঁকা।
ইরার লেখার ধরন একটু ভিন্ন। প্রতিটা পাতায় সে দিনে কি কি করেছে তা তিন-চার লাইনে লেখা।
ডায়রির প্রথম পাতা এরকম –
৩।২।১৬
আজ ঘুম থেকে দেরিতে উঠেছি।
আবহাওয়া ভালো ছিল।
রান্না করেছি কাঁচা টমেটো দিয়ে কৈ মাছ।
ঠিক করেছি বাগানে গোলাপ ফুলের গাছ লাগাবো।
রোদ বাড়িতে তাড়াতাড়ি ফিরেছিল।
প্রথম পাতা থেকেই বোঝা যায় এই মানুষটার জীবনের মুখ্য বিষয়গুলো ছিল সময়মতো ঘুম থেকে উঠা, রান্না করা এবং রোদ। এছাড়াও তিনি হয়তো প্রচুর স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন।
অতন্দ্রিলা পাতা উল্টায়, পরের পাতাটা এমন –
৪।২।১৬
রাতে ভাঙা ভাঙা স্বপ্ন দেখেছি।
বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল।
ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি।
সারাদিন আকাশে মেঘ ছিল, রাতের দিকে বৃষ্টি হয়।
রোদ আজ আবারো সিগারেট খেয়েছে, ওর এই ব্যাপারটা এখনো ঠিক করতে পারলাম না।
রান্না করিনি, বিরক্ত লাগছিল।
অতন্দ্রিলার ধারনা রোদের সিগারেট খাওয়াটা ইরার বিরক্তির কারণ ছিল না। বিরক্তির কারন ছিল ঠিকমতো ঘুম না হওয়া।
পরের পাতা –
আজকে সকাল জুড়ে একটা প্ল্যান করলাম। প্ল্যানটা হলো, একটা স্কুল করবো। শান্তিনিকতনের মতো আবাসিক স্কুল। সেখানে থাকবে না কোনো বাঁধা-ধরা সিলেবাস, না থাকবে পড়ার চাপ। বাচ্চারা খেলতে খেলতে পড়বে, খেলতে খেলতে শিখবে। পরীক্ষায় বাচ্চারা যদি নিউটনের তৃতীয় সূত্রকে একটি রাজারানীর গল্পের মাধ্যমেও ব্যাখ্যা করে তাও তারা নম্বর পাবে। পরীক্ষায় বাচ্চাদের উপস্থাপনের ভঙ্গি মুখ্য ব্যাপার নয়। বাচ্চারা আসলেই পড়ার বিষয় বুঝতে পরলো কিনা, সেটা মুখ্য বিষয়। আমার স্কুলের নাম হবে ‘ইরাবতীর ইশকুল’। নামটা সুন্দর না, কিন্তু আমার পছন্দ হয়েছে।
অদ্ভুত তো! এই পাতায় কোনো তারিখ নেই, দিনে কি কি করলো তাও নেই। আছে শুধু একটি সুন্দর পরিকল্পনার কথা।
রোদ বাড়িতে ফিরল বেলা চারটায়।
হাসিখুশি ভঙ্গিতে অতন্দ্রিলার দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে বলল, “এই নাও তোমার নকশিকাঁথা।”
অতন্দ্রিলা হাত বাড়িয়ে বলল, “ধন্যবাদ আপনাকে। তখন এমন হুট করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন কেন? আমার কথায় রাগ করে?”
“তেমন কিছু না।”
“কেউ আমার ওপর রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে আমি কিন্তু বুঝতে পারি। এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা আছে।”
“কেমন অভিজ্ঞতা?”
“বাবা আমার ওপর রাগ করে মাসে দুই থেকে তিনবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার ফিরে আসতেন। এখন আমি নেই, মা আছে। তাই বাবা নির্ঘাত মায়ের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধিয়ে বেরিয়ে যাবেন।”
“১×২×৩=৬ আবার ১+২+৩=৬। গুণফল এবং যোগফল এক মানেই যে দুটো এক জিনিস তা কিন্তু নয়, কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে। তেমনি তোমার বাবার বেরিয়ে যাওয়ার এবং আমার বেরিয়ে যাওয়ার কারনও কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে।”
“বাহ্! অংকের মাধ্যমে কঠিন ব্যাপারকে সহজ করে বলাটা ভালো লাগলো তো। আচ্ছা যাইহোক, এখন আপনি খেতে আসুন। প্রচণ্ড ক্ষুদা পেয়েছে, আপনার জন্যে না খেয়ে বসে আছি।”
“কেন? তুমি খেয়ে নিলেই পারতে।”
“আমি খাইনি তার কারন আছে। আপনি আমার ওপর রাগ করে বাসা থেকে চলে গিয়েছিলেন। আমার নিশ্চই উচিৎ হবে না এই পরিস্থিতিতে আপনাকে রেখে খেয়ে ফেলা। আমার উচিৎ হবে আপনার রাগ ভাঙিয়ে আপনাকে সঙ্গে নিয়ে খেতে বসা। এবং আমি তাই করলাম।”
অতন্দ্রিলার রান্না ভালো, বেশ ভালো। তবে ইরার মত ভালো নয়। কিন্তু ভালোমত শিখতে পারলে ইরাকেও ছড়িয়ে যেতে পারে সে।
আজ রান্না করেছে সরিষা বাটা দিয়ে মুরগি। রেসিপিটা অতন্দ্রিলার জানা ছিল না। তাই রান্নার সময় অসংখ্য বার ফোন করতে হয় শায়লাকে।
শায়লা এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বলেন, “মেয়েরা বিয়ের আগে মায়ের কাছ থেকে রান্না শুনে শুনে খাতায় লিখে রাখে। অবশ্য তোর সেটা করার সময় কোথায়? রেসিপিগুলো লিখে রাখলে আলতুফালতু প্রতিবেদন লিখবে কে?”
অতন্দ্রিলা শীতল গলায় বলে, “বিয়ের আগে মায়ের আছ থেকে শুনে শুনে খাতায় রান্না লিখে রাখে সেইসব মেয়েরা, যারা সর্বক্ষণ মাকে কাছে পায়।”
রোদ নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছে। অতন্দ্রিলার ইচ্ছা করছে তার সঙ্গে গল্প করতে। তাও আবার গাণিতিক গল্প, কিন্তু গল্প করার মত ঘনিষ্ঠতা বোধ হয় তাদের মধ্যে নেই।
রোদদের বাড়ির সামনের বাগানটা প্রকাণ্ড। বাগান বললে ভুল হবে, সেটা আসলে বাজার। বিশাল বাগানের একদিকে শাক সবজির গাছ, অন্যদিকে চৌবাচ্চায় চাষিত মাছ। অতন্দ্রিলার কথা, “বাগান হলো ঘুরে বেড়াবার জায়গা, মন খারাপ থাকলে একা বসে কিছুটা সময় কাটাবার জায়গা। এখানে বাজার খুলে রাখবার কোনো অর্থ হয় না।”
তিন জন মালি এবং দুজন মালিনী দল বেঁধে সকাল সকাল চলে আসে গাছগুলোর পরিচর্যা করতে।
আজ ভোরে অতন্দ্রিলা একজন মালিনীকে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়ে গোলাপের চারা কিনতে।
লাল, হলুদ, সাদা এবং কালো গোলাপ মিলিয়ে ২৭টি চারা কেনা হয়েছে, টব কেনা হয়েছে, জৈব সার কেনা হয়েছে।
চারাগুলো রোপন করার সময় একজন মালিনী এল অতন্দ্রিলাকে সাহায্য করতে।
মালিনী চিন্তিত গলায় বলল, “ম্যাডাম আপনি এগুলো লাগাতে পারবেন না। আমাকে দিন আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।”
অতন্দ্রিলা বলল, “অনেক ধন্যবাদ। আমি একাই পারবো।”
“কিন্তু ম্যাডাম এতগুলো চারা লাগাতে আপনার অনেক কষ্ট হবে।”
“ম্যাডাম ম্যাডাম করছো কেন? আমি তোমাকে চাকরি দেইনি, আবার তোমার চাকরি কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতাও আমার নেই। কাজেই আমাকে আপা ডাকলেই চলবে। আর এই চারাগুলো রোপন করার দায়িত্ব একজন আমাকে দিয়েছেন, শুধুমাত্র আমাকে। তাই কাজটা আমাকেই করতে দাও।”
মালিনী হতাশ মুখে চলে গেল।
অতন্দ্রিলা সাবধানে চারাগুলো রোপন করছে।
টবে প্রথমে কিছুটা গাছের মাটি দিতে হয়, এরপর সেই গাছের মাটির ওপর কিছুটা সার মাটি।
২৭ টা টবের জন্যে এভাবে মাটি প্রস্তুত করা ধৈর্য্যের ব্যাপার, অতন্দ্রিলা যথেষ্ট ধৈর্য্যশীল মানুষ।
রোদ অতন্দ্রিলার পাশে এসে দাড়িয়েছে। অতন্দ্রিলা তাকে খেয়াল করেনি। তাই অতন্দ্রিলার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে রোদ কাশল।
কাশির শব্দ শুনে অতন্দ্রিলা তার দিকে একনজর তাকিয়ে আবার কাজ শুরু করল।
অতন্দ্রিলা ক্ষীণ গলায় বলল, “আচ্ছা আপনি কেমন মানুষ? আপনার স্ত্রীর ইচ্ছা ছিল এই বাগানে গোলাপ ফুলের গাছ লাগানোর। কিন্তু সেটা তিনি করে যেতে পারেননি। তাই বলে আপনিও এতগুলো বছরে গোলাপ গাছ লাগাননি কেন?”
রোদ আহত গলায় বলল, “আমি জানি না ইরার এই অসম্পূর্ণ ইচ্ছা সম্পূর্ণ করে তুমি কি প্রমাণ করতে চাইছ। কিন্তু একটা বিষয় মাথায় রেখো, তুমি কিন্তু কখনোই ওর জায়গাটা নিতে পারবে না।”
“ইরাবতীর অসম্পূর্ণ ইচ্ছাগুলো আমার সম্পূর্ণ করার উদেশ্য আপনাকে খুশি করা বা তার জায়গা দখল করা, এই চিন্তাচেতনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারন আমি ইরাবতীর অন্যান্য সকল স্বপ্নগুলোও পূরণ করবো।
“কেন জানতে পারি?”
“আমি প্রকৃতির প্রতিনিধি। আমাকে প্রকৃতি পাঠিয়েছে ইরাবতীর ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে।”
পৃথিবীর বড় বড় নাট্যমঞ্চের মধ্যে অন্যতম বিয়ে বাড়ি। বিয়ে বাড়িতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর এবং বৃহৎ থেকে বৃহত্তর সকল বিষয় নিয়ে নাটক হয়।
বিয়ে বাড়ির সবথেকে কমন নাটক হলো বর বা কনের পালিয়ে যাওয়া। কনে পালায় প্রেমিকের হাত ধরে, বর পালায় স্বপ্নের হাত ধরে। অতন্দ্রিলার কোনো প্রেমিক নেই, রোদের স্বপ্নগুলোও পূরণ হয়ে গেছে। তাই তাদের বিয়েতে এই নাটকটি হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই।
বিয়ে বাড়িতে আরও একটি কমন নাটক – এক মেয়েকে দেখিয়ে অন্য মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া। এই অন্য মেয়েটি হয় যাকে প্রথমে দেখানো হয়েছে তার জমজ বোন। অতন্দ্রিলার বিয়েতে এই নাটকেরও সম্ভবনা নেই।
বিয়ে বাড়িতে আরেক ধরনের মজার নাটক ঘটে ঠিক বিয়ে পড়ানোর পর পর। হঠাৎ পরিবারের মধ্য থেকে গুপ্ত প্রেমিক প্রেমিকার উত্থান ঘটে। প্রেমিক প্রেমিকার হাত ধরে কাজী সাহেবকে বলে, “কাজী সাহেব! আরেকটা বিয়ে পড়াতে হবে।”
অতন্দ্রিলার বিয়েতে এই নাটকটি হওয়ার কিঞ্চিৎ সম্ভবনা রয়েছে। মামাতো বোন টিকলি এবং খালাতো ভাই তিশানের ভাবভঙ্গি ভালো মনে হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর পরই এরা কানাকানি করছে।
অতন্দ্রিলা ভেবে রেখেছে, যদি সত্যিই এরা এই নাটকটি করে তাহলে সে কঠিন গলায় বলবে, “তোদেরকে ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়া হবে। দয়া করে আমার বিয়েটা নষ্ট করিস না!”
আজ অতন্দ্রিলা এবং রোদের বিয়ে। বাড়িতে বিরাট আয়োজন। আত্মীয় স্বজনেরা সবাই বিভিন্ন আজ নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। শহর হল থেকে বাড়িতে এসেছে। সেও ছোটাছুটি করছে, তবে সেটা কোনো কারন ছাড়াই।
শায়লা দুদিন আগেই এ বাড়িতে এসেছেন। রান্নাবান্নার দায়িত্বটা তিনি এবং তার বোনেরা নিয়েছেন।
বাড়িতে অন্যরকম একটা খুশির বাতাস বইছে। এমন বাতাস অতন্দ্রিলার বাবা মায়ের ডিভোর্সের পর আর এ বাড়িতে বয়নি।
অতন্দ্রিলা ঠিক করেছে আজ সেও এক নাটক করবে, ভয়ংকর নাটক। তবে সেই ভয়ংকর নাটকের ফলাফল হবে অসাধারন।
নাটকের পরিচালক অতন্দ্রিলা, মুখ্য চরিত্র শায়লা এবং হামিদ সাহেব।
বিয়ের সময়ে “নইলে আমি কিন্তু বিয়ে করবোনা” এই বাক্যটি জাদুর মন্ত্রের মতো কাজ করে। বর কনে সুলভ থেকে দুর্লভ যেকোনো বস্তু পাওয়ার জন্যে এই বাক্যটি ব্যাবহার করে থাকে।
অতন্দ্রিলার নাটকে এ বাক্যটা প্রধান সংলাপ।
ভোর ৬ টা। বিয়ের বাড়ির সকলে ঘুম থেকে উঠে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। শায়লা রান্নাঘরে, হামিদ সাহেব বাগানে।
অতন্দ্রিলা দুজনকে ধরে নিজের ঘরে নিয়ে এল।
শায়লা বিরক্ত গলায় বললেন, “কি আশ্চর্য! রান্নাঘরে আমার হাজারটা কাজ, এখানে নিয়ে এলি কেন?”
হামিদ সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, “আমারও তো সেই একই কথা! কি ভেবেছিস কি হ্যাঁ? তোর কোনো কাজ নেই বলে অন্য কারোরই কোনো কাজ নেই?”
অতন্দ্রিলা বলল, “তোমরা একটু শান্ত হয়ে বসবে প্লিজ!”
শায়লা বসলেন। তার থেকে একটু দূরে বসলেন হামিদ সাহেব।
হামিদ সাহেব বললেন, “বসলাম! এখন বল তোর জরুরি কথা!”
অতন্দ্রিলা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বাবা মা দেখো, তোমাদের মধ্যে কি ঘটেছিল তা আমি জানি না। জানতেও চাই না। তবে আমার ধারনা তোমরা নিতান্তই কোনো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে অভিমান করে আছো। আপার বিয়ে হয়ে গেছে। আমিও আজ চলে যাচ্ছি। শহর থাকে হলে। তোমরা এখন কি নিয়ে বাঁচবে? একা একা বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে?
শায়লা বললেন, “কি বলতে চাচ্ছিস অত?”
“বলতে চাচ্ছি যে এখন তোমরা দুজনেই দুজনের বেঁচে থাকার সম্বল। তাই তোমরা সবকিছু ভুলে আবার এক হও, নইলে কিন্তু আমি বিয়ে করবো না।”
কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যে। তারা এক হলেও অতন্দ্রিলা বিয়ে করবে, এক না হলেও বিয়ে করবে। কিন্তু বাবা মাকে এক করতে কথাটা বলতে তো কোনো ক্ষতি নেই।
শায়লা বুঝতে পারছেন না কি প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিৎ, হাসা উচিৎ নাকি রাগ করা উচিৎ।
চোখে দু এক ফোঁটা অশ্রু নিয়ে বললেন, “সত্যিই করবিনা?”
“অবশ্যই করবোনা।”
শায়লা হামিদ সাহেবের দিকে তাকালেন। হামিদ সাহেব কাঁদছেন। তার দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরছে খুশির অশ্রু।
শায়লা কন্নামাখা কণ্ঠে বললেন, “তোমার মেয়ে কিন্তু তোমার মতই জেদী।”
“কিন্তু তুমি কি করবে আমাকে ক্ষমা?”
“করবো।”
অতন্দ্রিলা দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
চিৎকার করে বলল, “আপা! আমরা আর ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে নই!”
অতন্দ্রিলা হাসছে। দু গালে টোল পরেছে। হাসলে তার সৌন্দর্য কয়েক গুন বেড়ে যায়। কিন্তু খুব কম হাসে বলে এই সৌন্দর্য আড়ালে ঢাকা পরে যায়।
দুপুরের দিকে সন্ধ্যা অতন্দ্রিলার ঘরে এল।
গম্ভীর গলায় বলল, “তার মানে এই কাজটা তুই আগেও করতে পারতিস?”
“কোন কাজটা?”
“এইযে বাবা মায়ের মিল করিয়ে দেওয়ার কাজটা!”
“হ্যাঁ পারতাম তো।”
“তাহলে করিসনি কেন? আজ করলি কেন?”
“কারন হলো আজ আমি বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি। আজকের পর বাবা মায়ের ঝগড়া আমাকে আর সহ্য করতে হবে না।”
“তোর ধারনা তারা এক হওয়ার পর আবার ঝগড়া করবে?”
“অবশ্যই করবে।”
সন্ধ্যা কিছুক্ষণ চুপ থেকে উৎসাহ নিয়ে বলল, “এই এখন তো আর তাহলে তুই ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে না?”
“না।”
“তার মানে এখন আর এই ছেলেটাকে তোর বিয়েও করতে হবে না।”
“আপা বাজে কথা বোলো না তো। যাও নিজের কাজ করো!”
বিকেলের দিকে ঘটলো আরেক নাটক।
অতন্দ্রিলাকে সাজাতে এসেছেন পার্লার থেকে।
হঠাৎ ঘরের সমস্ত লাইট ফ্যান বন্ধ হয়ে গেল!
শহর দৌড়ে এসে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মেইন সুইচ নষ্ট হয়ে গেছে, আজকে ঠিক হবে না!”
হামিদ সাহেব চিন্তায় অস্থির হয়ে গেছেন। একটু পরে অন্ধকার হয়ে আসবে, বাড়িতে এক ফোঁটাও আলো না থাকলে বিয়েই বা হবে কি করে আর মেহমানরা খাবেই বা কি করে।
শায়লা অন্ধকার নামার আগে রান্না শেষ করতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন।
অতন্দ্রিলা সাজগোজ বাদ দিয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আমি কি কিছু সহৃদয়বান ব্যক্তিবর্গের সাহায্য পেতে পারি?”
অতন্দ্রিলার খালাতো বোন নীলা বলল, “কি বিষয়ে আপা?”
“বাড়িটাকে নতুন করে সাজানো হবে, আলো দিয়ে। ছাদে নতুন করে প্যান্ডেল করা হবে। কাজগুলো আমি একা করতে পারবোনা যে তা নয়, কিন্তু কাজগুলো একা করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। কেউ আমাকে সাহায্য করবে?”
অতন্দ্রিলাকে সাহায্য করতে পারে এমন সাতজন মানুষ পাওয়া গেল। শহর, সন্ধ্যা, নীলা, তিশান, টিকলি, হামিদ সাহেব এবং জরিনা।
প্রায় পাঁচ ছয়’শ মোমবাতি কিনে আনা হয়েছে। বাড়ির প্রতিটি কোণায় মোমবাতি জ্বালানো হচ্ছে। ডেকোরেটরের লোকজন ছাদে নতুন করে প্যান্ডেল করছেন।
ছাদটা সাজানো হয়েছে প্রদীপ দিয়ে। সাথে বেলি ফুল। বেলির ফুলের সুগন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পরেছে।
মেহমানরা হতভম্ব। কনে সাজগোজ বাদ দিয়ে সজ্জাছে ঘর! তাও আবার মোমবাতি দিয়ে।
আলোর সমস্যা মিটে গেলেই আরেক সমস্যা হাজির। সেটা হলো গরম। ব্যাটারি চালিত টেবিল ফ্যান দিয়ে আপাতত কাজ চালান হচ্ছে। কিন্তু ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে গেলে কি হবে তা নিয়ে বেশ চিন্তায় আছেন হামিদ সাহেব।
যখনই ফ্যান চলতে দেখছেন তখনি বলছেন, “আহ্ ফ্যান চালাচ্ছো কেন? বরপক্ষ আসলে কি করবে? বিয়ে পড়ানোর সময় চার্জ ফুরিয়ে গেলে?”
তিন’শ মেহমান দাওয়াত করা হয়েছিল, কিন্তু ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে এর চেয়ে বেশি মানুষ চলে এসেছে। খাবার কম পরে গেলে ঝামেলা হয়ে যাবে। হোটেলে খবর দিয়ে রেখেছেন যাতে প্রয়োজনে খাবার দিয়ে যায়।
বর এল সাতটার দিকে। এবার মেহেমানরা খাওয়া দাওয়া শুরু করতে পারবেন।
বরযাত্রী তো বাড়ির সাজসজ্জা দেখে অবাক। তাদের ছাদে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। বরকে দেখার জন্যে সকলের উৎসাহের সীমা নেই।
রোদের মনটা বিপর্যস্ত। ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে। তবে তার মুখ দেখে ব্যাপারটা বোঝার উপায় নেই। বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে, সকলকে সালাম দিচ্ছে, সবার সঙ্গে কথা বলছে।
কিছুক্ষণ পর বর কনে একসঙ্গে করা হলো।
অতন্দ্রিলাকে দেখাচ্ছে পুরনো দিনের কনেদের মত। যখন সাজ নয়, সৌন্দর্য ছিল কনেদের মুখ্য বিষয়।
রাত প্রায় একটা। বিয়ে বাড়ি এখন শান্ত। মেহেমানরা চলে গেছেন। অতন্দ্রিলা এখন যাবে রোদের বাড়িতে। শুরু হবে তার জীবনের নতুন অধ্যায়।
বিয়ে বাড়ির প্রচলিত নাটক – বিদায়ের সময় মা মেয়ের জড়িয়ে ধরে কান্না। কিন্তু শায়লা কাঁদছেন না। আর অতন্দ্রিলার কাঁদার অভ্যেস নেই। “এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
পর্ব : ৭ (বাসর)
বাসর হবে রোদের বাড়িতে। বাসর নিয়ে কম বয়সী মেয়েদের উৎসাহের সীমা নেই। এগার-বারো বছর বয়সী একটা মেয়ে বাসর ঘরের খুঁটিনাটি সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
অবশেষে অতন্দ্রিলাকে বাসর ঘরে রেখে যাওয়া হলো। ঘরটা বেশ সুন্দর করে সাজানো। খাটে গাঢ় নীল রঙের চাদর বিছানো, গোলাপ এবং বেলি ফুল দিয়ে সাজানো।
খাটের ডান পাশের টেবিলে ফুলদানি, ফুলদানিতেও গোলাপের গুচ্ছ। লাল রঙের গোলাপ অতন্দ্রিলার পছন্দ নয়। তার পছন্দ কালো গোলাপ।
খাটের বাম পাশে আরেক টেবিল। সেখানে, পেস্তা বাদাম দেওয়া দুধের এক অদ্ভুত শরবত। শরবতটা যে রেখেছে তাকে এখন অতন্দ্রিলার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, “এক গ্লাস শরবত রেখেছেন কেন? জানেন যে ঘরে দুজন মানুষ থাকবে! দু গ্লাস রাখলে কি ক্ষতি হতো?”
অতন্দ্রিলার প্রচন্ড তৃষ্ণা পেয়েছে, কিন্তু শরবতটা কার জন্যে রাখা ব্যাপারটা নিশ্চিত না হয়ে খাওয়া যাচ্ছে না।
শরবতের পাশে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি। এই জিনিসটাও অতন্দ্রিলার ভীষন অপছন্দের।
যে মিষ্টি রেখেছে তার উচিত ছিল মিষ্টির পাশাপাশি ঝাল কিছুও রাখা।
অতন্দ্রিলার তৃষ্ণা বেড়ে গেল। তাই সে এবার খাট থেকে উঠলো। ঘরের কোনায় প্রকাণ্ড এক উঁচু ধরনের টেবিল। এই টেবিলে অবশেষে পাওয়া গেল পানির জগ। অতন্দ্রিলা পানি খেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেল।
অতন্দ্রিলার চোখ পড়ল এক বিশাল বুকশেলফের দিকে। এত বই এক জীবনে পড়ে শেষ করা যাবে কিনা এ ব্যাপারে কিঞ্চিৎ সন্দেহ হচ্ছে তার।
বুকশেলফের বইগুলো সুন্দর করে সাজানো। হুমায়ূন আহমেদের বইগুলো একদিকে, রবীন্দ্রনাথের বইগুলো একদিকে এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বইগুলো একদিকে। মজার ব্যাপার হলো বুকফেলফে এই তিনজন লেখক ছাড়া আর কারো বই নেই।
হয়তো এনারা রোদের প্রিয় লেখক। ইরার প্রিয় লেখকও হতে পারে।
বুকফেলফটা খোলাই ছিল। অতন্দ্রিলা একটা বই নিল, হুমায়ূন আহমেদের ‘আজ হিমুর বিয়ে’। বইটি অতন্দ্রিলা সারা জীবনে ২৩ বার পড়েছে। কিন্তু প্রতিবারই পড়ার সময় নতুন মনে হয়।
অতন্দ্রিলা বইটা খাটে রাখল।
হঠাৎ চোখ পরল খাটের পেছনের দেয়ালে। ইনিই তাহলে ইরাবতী! তিনি দেখতে কিছুটা রাজারানীদের মত। অতন্দ্রিলা আরো ভালো করে দেখল। কে ইনি? বাংলা সিনেমার নায়িকা নন তো? না, না। বাংলা সিনেমার নায়িকারা এত রূপবতী হয় না!
এ বাড়িতে অতন্দ্রিলার বন্ধু হতে পারে এমন মানুষ নেই। ফিরোজা সুন্দর মনের মানুষ, তবে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে কিনা এ বিষয়ে ক্ষীণ সন্দেহ আছে অতন্দ্রিলার। আর রোদ! রোদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে বলে মনে হয় না।
বন্ধুত্ব হতে পারে এমন একজন মানুষকেই খুঁজে পেল অতন্দ্রিলা, সে হলো ইরা।
অতন্দ্রিলা ইরার ছবিটার সামনে দাড়িয়ে বলল, “বুবু, এতদিনে আমার নাম নিশ্চই শুনেছেন। তারপরও আবার বলছি, আমার নাম অতন্দ্রিলা। আমার সঙ্গে আপনার রোদের বিয়ে হয়েছে। তবে আপনি কিন্তু একদম চিন্তা করবেন না! আপনার রোদ আজীবন আপনারই থাকবে। তাকে আপনার থেকে কেড়ে নেওয়ার কোনো শখ আমার নেই। আর আমি কিন্তু আপনাকে বুবু ডাকবো। সিনেমায় দেখেছি, নায়কের দ্বিতীয় স্ত্রীরা প্রথম স্ত্রীকে বুবু বলে সম্বোধন করে।”
রোদ অতন্দ্রিলাকে বিয়ে করেছে অনিচ্ছায়, মায়ের কথা রাখতে। তাই বাসর ঘরেও খানিকটা দেরি করে আসবে। প্রথমে সে চাইবে অন্য ঘরে ঘুমাতে, পরে ফিরোজা অনেকক্ষণ ধরে অনুরোধ করবেন। প্রথমে রাজি না থাকলেও পরে রাজি হয়ে আসবে বাসর ঘরে।
অনেকটা সময়ের মামলা। অতন্দ্রিলার ইচ্ছে করছে ঘুমিয়ে পরতে, কিন্তু সেটা অভদ্রতা হবে। তাই ঘাপটি মেরে বসে বইটা পরছে। বইয়ের প্রথম পাতায় কলম দিয়ে গোটা গোটা করে লেখা, “রোদের মত ঝলমল রোদকে, ইরা”।
তারমানে বই পড়ার নেশাটা রোদের।
ঘন্টাখানেক পর দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। অতন্দ্রিলার নাকে এলো এক পারফিউমের গন্ধ। গন্ধটা পরিচিত মনে হচ্ছে।
এই একই গন্ধটা পেয়েছিল যখন রোদকে তার পাশে বসানো হয়েছিল। তাহলে অবশেষে মহাশয় এলেন।
রোদ কিছু বলতে যাবে, তার আগেই
অতন্দ্রিলা বইয়ের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, “আপনি কিছু বলার আগে জানিয়ে রাখি, এ ঘরে কিন্তু গোপন ক্যামেরা লাগানো আছে!”
রোদ হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “গোপন ক্যামেরা?”
“শুধু ক্যামেরাই না সাউন্ড রেকর্ডারও আছে।”
“তুমি জানলে কি করে?”
“ওইযে একটা বাচ্চা মেয়ে ছোটাছুটি করতে, ওর মুখে শুনেছি। ক্যামেরা খাটের পেছনে, ফুলের আড়ালে। আর সাউন্ড রেকর্ডার খাটের নিচে। আপনি প্লিজ এগুলো বন্ধ করে দেবেন? আমি এখন বইটা রেখে উঠতে পারবো না।”
রোদ ক্যামেরা, সাউন্ড রেকর্ডার বন্ধ করতে করতে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে অতন্দ্রিলাকে বলল, “তুমি যখন আগে থেকেই জানতে তখন বন্ধ করলে না কেন?”
“ইচ্ছে করেই বন্ধ করিনি। আপনাকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে আপনার বোনেরা কতটা অভদ্র।”
রোদ খানিকটা অবাক হলো। বাহ্! মেয়েটা তো বেশ ভালোই সত্য কথা বলতে পারে।
রোদ অতন্দ্রিলার সামনে এসে বসল। অতন্দ্রিলা মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে।
রোদ শান্ত গলায় বলল, “তোমাকে একটা জরুরী কথা বলার আছে।”
“বলুন শুনছি।”
“দেখো, আমাকে আমার মা জোড় করে বিয়ে দিয়েছেন। আমি নিজের ইচ্ছায় তোমাকে বিয়ে করিনি। তোমাকে কোনো রকম আশায় রাখতে চাই না বলে আগেই বলে দিচ্ছি, আমি কিন্তু তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না।”
অতন্দ্রিলা বইয়ের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, “আমি কি আপনাকে বলেছি যে আপনার ভালোবাসা না পেলে আমি অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবো?”
রোদ চেয়েছিল অতন্দ্রিলাকে চমকে দিতে। অতন্দ্রিলা বেশ ভালোই চমকে ওঠে। কিন্তু ১ ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যেই নিজেকে সামলে রোদের সামনে চমকে না ওঠার অভিনয় করে। এটা অতন্দ্রিলার এক ধরনের খেলা।
চমকে ওঠার পাশাপাশি অতন্দ্রিলার বেশ রাগও হয়েছে। রাগ হওয়ার পেছনে যুক্তি আছে। অতন্দ্রিলা তার বাবার বাড়ি ছেড়ে, আজ প্রথম এ বাড়িতে এসেছ। প্রথম দিনেই রোদের উচিৎ হয়নি এত বড় একটা কথা তাকে বলা। দু তিন দিন সময় নিয়ে বলতে পারতো। এটা সাধারন ভদ্রতা।
অতন্দ্রিলার এত বড় একটা কথা স্বাভাবিক ভাবে গ্রহন করা মেনে নিতে পারছে না রোদ।
রোদ আশা করেছিল অতন্দ্রিলা কাঁদবে কিংবা হয়তো ভাঙচুর করবে।
রোদ অস্পষ্ট গলায় বলল, “না বলোনি।”
“তাহলে?”
“তাহলে কি?
অতন্দ্রিলা বলল, “তাহলে আপনি এত চিন্তিত হচ্ছেন কেন? আমি জানি আপনি আপনার স্ত্রীকে কতটা ভালোবাসেন। আপনি তাকে আজীবন ভালো বেসে যাবেন। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই কিংবা আপত্তি থাকা উচিত নয়।”
রোদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “উচিত নয়? তুমি আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছো তো?”
“বুঝতে না পারার কি আছে? বাংলাতেই তো বললেন! আপনি ঘুমিয়ে পরতে পারেন, আমার জন্যে অপেক্ষা করে লাভ হবে না। আমি বইটা শেষ করেই ঘুমাবো।”
রোদ হতভম্ব হয়ে গেল। একটা মেয়ের বাসর ঘরে এমন কথা শুনে, এত সহজে কি করে তা মেনে নিলো! ইরা হলে তো এতক্ষণে কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে পড়ত।
“কাজটা কিন্তু তুমি মোটেও ঠিক করলে না মা।”
হতাশ গলায় বলল রোদ।
ফিরোজা বললেন, “কেন? কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক তা কি তোর কাছ থেকে শিখতে হবে নাকি?”
“পৃথিবীর অন্য যেকোনো ব্যাপারে শিখতে হবে না। কিন্তু আমার ব্যাপারে শিখতে হবে।”
“বেশ তো, বল না কি শেখাবি আমায়?”
“মা তুমি কিন্তু বলেছিলে শুধু দেখতে গেলেই চলবে। এখন এই বিয়ের কথা আসলো কোত্থেকে?”
“একটা মেয়েকে দেখে আসলাম, তাকে খুব পছন্দও করলাম। এখন তার সাথে তোর বিয়ের কথা আগাবো না?”
“না আগাবে না। তুমি খুব ভালো করে জানো আমি বিয়ে করতে পারবো না।”
“কেন পারবি না? বাবা একটু বোঝার চেষ্টা কর, তুই যার কথা ভেবে বিয়ে করতে চাচ্ছিস না সে তোর আর নেই এ পৃথিবীতে।”
“মা প্লিজ! ভালো লাগছে না আর এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলতে ভালো লাগছে না।”
আহত গলায় কথাগুলো বলে নিজের ঘরে চলে এল রোদ।
কাছের মানুষের মৃত্যুতে হ্যালুসিনেশন ব্যাপারটা স্বাভাবিক। কারো ক্ষেত্রে এর মাত্রা হয় বেশি, আবার কারো ক্ষেত্রে কম।
রোদের ক্ষেত্রে এই হ্যালুসিনেশনের মাত্রাটা তীব্র। শুধু তীব্র বললে ভুল হবে,ভয়ংকর তীব্র।
চার বছর হয়েছে ইরার মৃত্যুর, কিন্তু আজও রোদ বাড়ির প্রতিটি কোণায়, প্রতিটি কনায় অনুভব করে ইরাকে। ইরার হাসির শব্দ, কান্নায় শব্দ, নূপুরের শব্দ, গুনগুন করে গাওয়া গানের শব্দ এখনো কানে আসে রোদের।
এই ব্যাপারটা রোদের ভালোই লাগে। রোদ মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ভুলতে চায় না ইরাকে।
ঘরে আসতেই মনে হলো ইরা যেন কথা বলছে। কঠিন গলায় ইরা বলছে, “এই তুমি কেমন মানুষ বলো তো! আমি চলে যাওয়ার আগে না তোমাকে বলে গেলাম, চমৎকার একটা মেয়েকে বিয়ে করতে। তুমি বিয়ে করতে রাজি না কেন সত্যি করে বলতো? আমার কথার কোনোই মূল্য নেই না?”
রোদ ভড়কে উঠে আশেপাশে তাকায়। না, ইরা তো কোথায় নেই!
কথাগুলো তাহলে কে বলল? ইরা নাকি রোদের অবচেতন মন?
রোদকে বেশ বিপর্যস্ত মনে হচ্ছে।
কিছুক্ষণ কাটতেই রোদ আবার মায়ের কাছে গেল। তার চোখভর্তি পানি। মনে হচ্ছে কয়েক মুহূর্ত আগে প্রচুর কান্নাকাটি করেছে।
রোদ ফিরোজার কোলে মাথা রাখতে রাখতে বলল, “ইরা যাওয়ার আগে তোমাকে আমার আবার বিয়ে করা নিয়ে কি বলেছে মা?”
ফিরোজা আহত গলায় বললেন, “বলেছে, অনেক কথাই বলেছে। সেগুলো আমি তোকে বলবো না। তুই কষ্ট পাবি।”
“আমার জীবনের সব কষ্ট আমি সেদিনই পেয়ে গেছি মা।”
“তোর কষ্ট আর বাড়াতে চাই না বাবা। শুধু এতটুকু বলতে পারি ইরা আমার বৌমা ছিল না ও ছিল আমার মেয়ে। অপারেশনের কয়েক ঘণ্টা আগে ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে মেয়েটা আমাকে বলেছিল তোকে আবার বিয়ে দিতে। আমি শুধু ইরার ওই কথাগুলো ভেবেই তোকে বিয়ে দিতে চাচ্ছি।”
রোদ এবার উঠে বসল।
মাকে জড়িয়ে ধরে, কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ইরা আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেল মা? কেন?”
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত কোনো ভাষা ফিরোজার জানা নেই। তিনি কেবল অসহায়ের মতো ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন।
আজ বুধবার।
অতন্দ্রিলাদের বাড়িতে আসবেন ফিরোজা ও রোদের চাচা, বিয়ের কথা পাকা করতে। সকাল থেকেই মহা উৎসাহের সঙ্গে রান্না বান্না সহ বাড়ির যাবতীয় কাজ করছেন শায়লা।
কেউ তাকে দেখলে ধারনাই করতে পারবে না, দুদিন আগে বাড়ি থেকে ঝগড়া করে চলে গিয়েছিলেন।
শায়লার একটা বিশেষত্ব হল, যখন তার কারো উপর রাগ হয় তখন সেই রাগের পরিমাণটা ক্রমেই বাড়তে থাকে। তবে যত দ্রুত রাগটা বাড়ে, তত দ্রুতই আবার কমে যায়। উনি বেশি দিন কারো উপর রাগ করে থাকতে পারেন না।
হামিদ সাহেবের উপর রাগটা ১৯ বছর ধরেও কমেনি। কিন্তু অতন্দ্রিলার বিশ্বাস, এই রাগ একদিন কমবে। কমতেই হবে।
নিচে বসার ঘরে চলছে অতিথি আপ্যায়নের দীর্ঘ পর্ব। বিয়ের দিন ক্ষণ ঠিক করার সময় অতন্দ্রিলাকে সেখানে ডাকা হবে। আপাতত
সে নিজ ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছে।
তখনি সন্ধ্যা অতন্দ্রিলার ঘরে এলো।
হতাশ গলায় বলল, “আমার কিন্তু এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে তুই এ বিয়েতে রাজি!”
অতন্দ্রিলা বলল, “আর আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে তুমি এ বিয়েতে রাজি নও! বাবা, মা, দাদি সবাই যখন রাজি তখন তোমার এত আপত্তির কি হলো আপা?”
সন্ধ্যা বসতে বসতে বলল, “যাই বল না কেন, তুই কিন্তু অস্বীকার করতে পারবি না যে তোর বিয়ে হয়েছে একজন ত্রুটিপূর্ণ মানুষের সাথে!”
“আপা দেখো, আমি একজন ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। সেই অর্থে আমিও ত্রুটিপূর্ণ। তো ত্রুটিতে ত্রুটিতে কাটাকাটি!”
“আচ্ছা, তুই ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে হলে আমি কি? মধুর হাড়ি? আমার কি ভালো ঘরে বিয়ে হয়নি?”
“আপা তুমি তো প্রেম করে বিয়ে করেছো!”
“তাহলে তুইও প্রেম কর!”
“আপা আমি প্রেম করতে পারি না আর পারবোও না। তাইতো বাবার পছন্দের পাত্রের সাথে খুশি মনে বিয়ে করতে যাচ্ছি!
আর আপা শোনো, পৃথিবীর সব মানুষের মধ্যেই কম বেশি ত্রুটি আছে। এটা কোনো বিষয় না।”
“আচ্ছা? তোর জাভেদ ভাইয়ের মধ্যে কি ত্রুটি আছে শুনি?”
“আপা জাভেদ ভাইয়ের ত্রুটির খাতা একবার খুললে তা বন্ধ করতে করতে রাত বারোটা বেজে যাবে।”
“বাজুক বারোটা! আমি শুনতে চাই, খোল তোর খাতা!”
“তাহলে শোনো। জাভেদ ভাইয়ের ত্রুটিগুলোর মধ্যে প্রধান এবং বিরক্তিকর ত্রুটিটি হলো, সে প্রতিটা কথা দুবার করে বলে। যেটা একটা সুস্থ মানুষকে মানসিক অসস্তিতে ফেলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
এছাড়া তিনি ভয়ংকর অগোছালো। একটা টুথপেস্ট জায়গা মত রাখতে পারেন না।”
“এগুলো তোর কাছে ত্রুটি?”
“অবশ্যই ত্রুটি! মানুষের স্বভাবগত ত্রুটিগুলো সমাজগত ত্রুটির থেকে বড়।”
সন্ধ্যা রাগে অভিভূত হয়ে বলল, “যা খুশি ভাব!”
ঘন্টাখানেক পর নিচে অতন্দ্রিলার ডাক পরল। বিয়ে ঠিক করা হয়েছে, দেড় মাস পর। ১৮ অক্টোবর। অতন্দ্রিলা কিছুটা শান্তির নিশ্বাস ফেলল, তার ধারনা ছিল হয়তো আগামী সপ্তাহেই বিয়ে ঠিক করা হবে।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
ফিরোজা হাসি মুখে এত অতন্দ্রিলাকে বললেন, “মা, তুমি কিছু বলতে চাও?”
অতন্দ্রিলা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আপনাদের বাড়িতে কয়জন কাজের লোক?”
শায়লা ইতস্তত হয়ে বললেন, “আহ্ অত! কি বলছিস এসব?”
ফিরোজা বললেন, “না, না ঠিক আছে। আ আমাদের বাড়িতে আটজন কাজের লোক আছে। কেন বলো তো মা?”
“বিয়ে হওয়ার পর সেই আটজনের মধ্যে থেকে একজন যদি আমাদের বাড়িতে আসে এবং আমাদের জরিনা যদি আমার সাথে আপনাদের বাড়িতে যায় তাহলে কি আপনাদের কোনো অসুবিধা আছে?
“না, না মা কোনো অসুবিধা নেই। একজন কেন, প্রয়োজন হলে আরও আটজন পাঠিয়ে দেব এ বাড়িতে!”
“আমার বাবা এবং দাদীর জন্যে একজনই যথেষ্ট, আটজন এসে পরলে তারা নিজেদের আত্মনির্ভরশীলতা হারিয়ে ফেলবেন।”
বিকেলের দিকে অতিথি চলে গেলে, জরিনা অতন্দ্রিলার ঘরে যায়।
গম্ভীর গলায় অতন্দ্রিলাকে বলল, “আফা আমি আপনের লগে ওই বাড়িতে যামু না!”
“কেন?”
“ওইটা মরা বাড়ি আফা! মরা বাড়িতে ভূত থাকবো না তা কি হয়?”
“ভূত থাকবে ভূতের মতো, আর তুমি থাকবে তোমার মত! অসুবিধাটা কোথায়?”
“আফা কম বয়সী মাইয়ার ভূত! ভোর রাইতে আমার চুল ছিরা নিয়া যাইবে।”
“তুমি খালি ক্ষতিটাই দেখলে, সেখানে গেলে যে তোমার কত লাভ তা আর দেখলে না?”
জরিনা চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, “কি লাভ আফা?”
“দেখো, এখানে তোমাকে সব কাজ করতে হয়। ঘর মোছা, ঘর গোছানো, বাসন পরিষ্কার করা, কাপড় ধোয়া, রান্না করা – সব!
আমি চলে যাওয়ার পর তুমি পরবে আরেক বিপদে। সেটা হলো দাদীকে ওষুধ খাওয়ানো, দাদীর উদ্ভট সব শখ মেটানো।
কিন্তু ভেবে দেখো, আমার সাথে যদি তুমি ওই বাড়িতে যাও তাহলে কিন্তু তোমাকে তেমন কোনো কাজই করতে হবে না। তোমার প্রধান কাজ হবে আমার কাজে আমাকে হাতে হাতে সাহায্য করা।
আমি তোমাকে জোর করছি না, কিন্তু সিন্ধান্ত তোমার। ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমাকে ওই বাড়িতে নিয়ে যাবো না আমি।”
জরিনা কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আফা আফনে না অনেক ভালা মানুষ। সত্যই তো আমি এই কথা ভাইবা দেখি নাই!”
“এখন তো ভাবলে! এবার যাও বেশি কথা না বাড়িয়ে আমার জন্য কফি বানিয়ে আনো।”
“অক্ষণি আনতেসি আফা!”
ঘর থেকে হড়বড় করে বেরিয়ে গেল জরিনা।
মানুষকে এমন ছোটখাটো লোভ দেখাতে ভালোই লাগে অতন্দ্রিলার।
অতন্দ্রিলার কোনো বন্ধু নেই। স্কুল কলেজে অসংখ্য বন্ধু-বান্ধবী থাকেলও তাদেরকে কখনোই ভরসাযোগ্য বন্ধু বলে মনে করেনি সে।
অতন্দ্রিলার দরকার এমন একজন বন্ধু, যাকে সে নির্বিকারে সকল সমস্যার কথা বলতে পারবে।
জরিনাকে অতন্দ্রিলা বন্ধু মনে করে না। কিন্তু জরিনার অযৌক্তিক কথাগুলো মন ভালো করে দেয় তার। তাই জরিনাকে সাথে নিয়ে যাওয়া।
কিছুদিন পরের ঘটনা।
সন্ধ্যা এবং শায়লা অতন্দ্রিলাকে নিয়ে বিয়ের শপিং করতে এসেছেন। হামিদ সাহেব তাদের সঙ্গে আসেননি। তার কথা, “শপিং-টপিং হচ্ছে মেয়েলি কর্মকাণ্ড। এর মধ্যে আমি জড়িয়ে নিজের সময় নষ্ট করতে চাই না।”
ওদিকে ফিরোজাও রোদকে এসেছেন বিয়ের শপিং করতে।
দুই পরিবার একসঙ্গে বিয়ের শাড়ি পছন্দ করছে। এসব কেনাকাটা অতন্দ্রিলার তেমন একটা পছন্দের না হলেও, আজ সে আগ্রহের সঙ্গে অংশগ্রহন করছে।
কেনাকাটার পুরো সময়টায় রোদ সকলকে একটু এড়িয়ে চলে। অতন্দ্রিলার দিকে একবার তাকিয়েছিল, তাও আবার তিন সেকেন্ডের জন্যে।
রোদ চাইছে অতন্দ্রিলাকে রাগাতে। রোদের ধারনা এই মুহুর্তে মেয়েটাকে এড়িয়ে চললে, সে ভীষন রেগে যেতে পারে। রাগটা এতটাই তীব্র হবে যে মেয়েটা বিয়ে পর্যন্ত ভেঙে দিতে পারে।
এতে অতন্দ্রিলা মোটেও রাগ করেছে না। স্বাভাবিক ভাবেই দেখছে বিষয়টাকে।
কারন রোদের এই ধারনার কথাটা বুঝে গেছে অতন্দ্রিলা।
তাই আর যাই হোক, রাগ করা যাবে না।
অতন্দ্রিলা মানুষটাই নিখুঁত। তার দীর্ঘ পল্লব যুক্ত চোখ দুটো নিখুঁত, লম্বা চুলগুলো নিখুঁত, হাসিটাও নিখুঁত। তবে অতন্দ্রিলা খুব একটা হাসে না আবার কাঁদেও না।
হামিদ সাহেব শেষ বার অতন্দ্রিলাকে কাঁদতে দেখেছিলেন যখন তার বয়স ১৩।
অতন্দ্রিলার কথা, “যুক্তিযুক্ত কারন ছাড়া কোনো মানুষের সামনে হাসি বা কান্নার মত শক্তিশালী অনুভূতি প্রকাশ করার কোনো অর্থ নেই।”
অতন্দ্রিলার হাতে গোণা দু একটা বাজে অভ্যাসের মধ্যে অন্যতম হলো, নিজের লেখা প্রতিবেদন বারবার পড়া।
আজ সকালে তার ভালোবাসা সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। এবারের প্রতিবেদনটা তুমলামুলকভাবে গুছিয়েই লিখেছে অতন্দ্রিলা। প্রতিবেদনটা এমন –
ভালোবাসা কারে কয়?
অতন্দ্রিলা আশরাফ
৩ জুলাই, ২০২০ | ১১:৫০ পূর্বাহ্ন
‘ভালোবাসা’ শব্দটির সাথে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। নাটক-সিনেমা দেখতে বসলে অহরহ শব্দটা শুনতে পাই । ছোটবেলায় সমাজ বইতে আমরা জেনেছি, পৃথিবীতে সব মানুষ একই পরিবেশে বাস করে না। সকলেরই বসবাসের পরিবেশ ভিন্ন, তাই ভালোবাসার উপলক্ষটাও ভিন্ন।
পৃথিবীতে জন্মগ্রহণকারী মহামানবদের সকলে
একই পরিবেশে বসবাস করেননি। তাই ভালোবাসা সম্পর্কে তাদের মতামতও ভিন্ন।
চলুন জেনে নেই বিখ্যাত ব্যাক্তিদের ভালোবাসা সম্পর্কিত কিছু উক্তি –
১। ডেভিড রস – “ভালোবাসা এবং যত্ন দিয়ে মরুভূমিতেও ফুল ফোটানো যায়।”
২। লা রচেফউকোল্ড – “সত্যিকারের ভালোবাসা হল অনেকটা প্রেতআত্মার মতো। এ নিয়ে সবাই কথা বলে,কিন্তু শুধুমাত্র কয়েকজনই এর দেখা পায়।”
৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – “পৃথিবীতে বালিকার প্রথম প্রেমেরমত সর্বগ্রাসী প্রেম আর কিছুই নাই। প্রথমযৌবনে বালিকা যাকে ভালোবাসে তাহার মত সৌভাগ্যবানও আর কেহই নাই। যদিও সে প্রেম অধিকাংশ সময় অপ্রকাশিত থেকে যায়, কিন্তু সে প্রেমের আগুন সব বালিকাকে সারাজীবন পোড়ায়।”
৪। হুমায়ূন আহমেদ – “কাউকে প্রচন্ডভাবে ভালবাসার মধ্যে এক ধরনের দুর্বলতা আছে। নিজেকে তখন তুচ্ছ এবং সামান্য মনে হয়। এই ব্যাপারটা নিজেকে ছোট করে দেয়।”
৫। কীটস্ – “যে ভালোবাসা পেলো না, যে কাউকে ভালোবাসতে পারলো না সংসারে তার মতো হতভাগা কেউ নেই।”
৬। টেনিসন – “ভালবাসা যা দেয় তার চেয়ে বেশী কেড়ে নেয়।”
অনেক তো হলো বিখ্যাত ব্যাক্তিদের উক্তি, চলুন জেনে আসা যাক ভালোবাসা নিয়ে সাধারন মানুষদের মতামত।
১। হামিদ চৌধুরী, রিটেয়ারপ্রাপ্ত উকিল।
বয়স ৬০ এর কাছাকাছি, ১৯ বছর আগে স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। ওনার মতে, “ভালোবাসার মত ন্যাকামি জাতীয় জিনিস পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
২। শায়লা হোসেন, পেশায় অধ্যাপক।
বয়স ৫২-৫৪, হামিদ চৌধুরীর প্রাক্তন স্ত্রী।
তার মতে, “একটা মানুষকে যথাযথ সময় দিতে পারলেই তাকে ভালোবাসা উচিত। যে সময় দিতে পারে না, তার ভালোবাসা উচিত নয়।”
৩। রওশন আরা, হামিদ চৌধুরীর মাতা।
বয়স ৭৫। তিনি মনে করেন, “স্বামী-স্ত্রী মধ্যে যাহা বিদ্যমান, তাহাই ভালোবাসা।”
৪। জরিনা, হামিদ চৌধুরীদের বাড়ির কাজের মেয়ে। বয়স ২১। ভালোবাসা সম্পর্কে তার মতামত কিছুটা এরকম – “এইসব বদ মাইয়া-পোলার করবার। যেগুলি এইসব ভালোবাসাবাসি করে, হেগুলি বদের বদ।”
ভ্রু সামান্য কুঁচকে বারবার প্রতিবেদনটি পরছে অতন্দ্রিলা, কিছুটা চিন্তিত সে। চিন্তার প্রধান কারন তার বাবা, মা এবং দাদীর মতামতগুলো আসল নয়। অতন্দ্রিলার বানিয়ে লেখা।
এই তিনজন মানুষকে ‘ভালোবাসা কি?’ – প্রশ্নটা করে মনের মতো কোনো জবাব পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তাই অতন্দ্রিলা সেই বৃথা চেষ্টা করে আর সময় নষ্ট করেনি।
দরজায় টোকা পরলো।
অতন্দ্রিলা ভেতর থেকে বলল, “কে?”
“আফা আমি জরিনা!”
“ভেতরে এসো জরিনা।”
জরিনা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় ঘরে ঢুকে বলল, “আফা ঘটনা তো একখান ঘইটা গেছে! শিগগির নিচে আসেন!”
“কি ঘটনা?”
“ওইযে ওইদিন আপনারে দেইখ্যা গেলো যারা! তারা মেলা জিনিস পাঠাইছে। বাসার ঘরে ভাইসা যাইতেসে জিনিসপত্রে!”
“মেলা জিনিস পাঠাবে কেন?”
“অতো কথা বলার টাইম নাই! আফনে নিচে আসেন।”
অতন্দ্রিলা যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে উঠল। প্রতিবেদনটা আর কমপক্ষে দু থেকে তিনশ বার পড়ে উঠতে পারলে এই বিরক্তিটা কাজ করতো না।
জরিনার স্বভাবগত দোষ, সে যেকোনো বিষয়কেই বাড়িয়ে বলে।
কিন্তু আজ জরিনা সত্য কথাই বলেছে। বসার ঘর প্রায় ভেসেই যাচ্ছে উপহারে। ঝুড়ি ভর্তি শাক-সবজি, ফলমূল। মাটির হাঁড়িতে বিভিন্ন ধরনের মাছ। আদা, রসুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি নানা প্রকারের মসলা। আম, জলপাই ইত্যাদির আচার। সেগুলো অতি আগ্রহ নিয়ে ঘটাঘাটি করছেন হামিদ সাহেব।
অতন্দ্রিলা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলল, “এসব কি বাবা?”
“ফিরোজা আপা পাঠালো!”
“ফিরোজা আপাটা কে?”
“এরমধ্যে ভুলে গেলি? ওইযে সেদিন
তোকে দেখতে এলো, ছেলের মা!”
“ওহ আচ্ছা! তা এরমধ্যে আপা বাঁধিয়ে ফেলেছো?”
“হ্যাঁ ফেলেছি। তোর কোনো সমস্যা আছে?”
“একদম না, আমার সমস্যা থাকতে যাবে কেন? আচ্ছা হঠাৎ তোমার ফিরোজা আপা এত কিছু পাঠালো কেন?”
“ওদের নাকি তোকে খুব পছন্দ হয়েছে। আমাদের যদি কোনো সমস্যা না থাকে, তাহলে আগামী বুধবারই বিয়ের কথা পাকা করতে আসবে।”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “বাহ্! চমৎকার খবর।”
“তুই বিয়েতে রাজি তো?”
“অবশ্যই রাজি বাবা।”
“আমি মুগ্ধ! আমি আনন্দিত!”
“বাবা আমার ধারনা, আমার রাজি হওয়াটা তোমার আনন্দের প্রধান কারন না। আনন্দের প্রধান কারন এতগুলো উপহার। তাইনা?”
“আমার আনন্দের কারন যাই হোক, তাতে তোর কি? কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং কিসব প্রতিবেদন লিখিস, সেগুলো লেখ গিয়ে যা!”
“অনেক ধন্যবাদ বাবা।”
দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে হামিদ সাহেব ব্যাংকে যান। সামনে মেয়ের বিয়ে। আর বিয়ের ওপর নামই যেন খরচ।
অতন্দ্রিলার জন্মের পর পরই তার বিয়ের জন্য কয়েক লক্ষ টাকা ব্যাংকে রেখে দেন তিনি। এত বছর ব্যাংকে থেকে থেকে সেই টাকা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
অতন্দ্রিলা প্রতিদিন দুপুরে ছাদে হাঁটাহাঁটি করে, গুনগুন করে গান গায়। এই সময়টায় কেউ তার আশেপাশে থাকলে নাকি খুব অসহ্য লাগে। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলো না।
হঠাৎ জরিনা দৌড়ে ছাদে এলো।
“আফা!”
“জরিনা, তোমাকে না মানা করেছি আমি ছাদে হাঁটাহাঁটি করার সময় বিরক্ত করতে!”
“দুনিয়া উল্টায় যাইতেছে আর আফনে হাঁটতেছেন?”
“দুনিয়া উল্টানোর মত কি ঘটেছে?”
“খালাম্মা আসছে, সাথে বড় আফা! দুইজনেই খেইপ্পা আছে। আমারে বলে, যাও অতরে ডাইককা আনো। আমি বলছি, আফা ডিস্টাব করতে মানা করছে। আমারে ধমক দিয়া কয়, চাকরি বাঁচাইতে চাইলে অতরে ডাকো!”
“এত বেশি কথা বলো কেন জরিনা? বেশি কথা বললে তো তুমি বিপদে পরবে!”
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
অতন্দ্রিলা নিচে নেমে এলো। শায়লা ও তার বড় মেয়ে সন্ধ্যা দুজন বসার ঘরের দুই সোফায় বসে আছেন।
শায়লা প্রচন্ড রেগে আছেন। অতন্দ্রিলাকে দেখা মাত্র এমন একটা ভাব যেন এখনি তাকে আস্ত গিলে খাবেন।
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “কি ব্যাপার মা?”
শায়লা কঠিন গলায় বললেন, “কি ব্যাপার মানে? তুই কি ভদ্রতা বলতে কিছুই শিখিসনি? এত দিন পর দেখা, না সালাম দিলি, না হাই হ্যালো বললি। সোজা, কি ব্যাপার!”
অতন্দ্রিলা বসতে বসতে বলল,“সালাম দিতাম যদি তুমি আমার কোনো দূরসম্পর্কের আত্মীয় হতে। কিন্তু তুমি তো আমার দূরসম্পর্কের মা, তোমার সঙ্গে প্রতিদিনই আমার টেলিফোনে কথা হচ্ছে। তোমাকে আবার সালাম দেওয়ার কি হলো?”
“জ্ঞান দিবি না। তোর এসব জ্ঞান আমার একদম অপছন্দের।
বাড়িতে এত কিছু ঘটে গেলো, আর আমরা কিছুই জানতে পারলাম না!”
“কি ঘটেছে?”
“তোকে নাকি গত সপ্তাহে দেখতে এসেছিলো? বিয়েও নাকি ঠিক হয়ে গেছে?
এত বড় একটা কথা আমাদের না জানিয়ে কিভাবে পারলি তুই? আচ্ছা, তোর বাবা আর দাদি না হয় কোনো দিনও আমাদের বলবে না, কিন্তু তুই তো বলতে পারতিস? নাকি আমাদের জানানোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করিসনি? আমরা কি এতটাই পর হয়ে গেছি তোর কাছে?”
সন্ধ্যা আহত গলায় বলল, “পরই তো ভাবে মা। মনে নেই, ও এইচএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছিলো আর আমাদের জানিয়েছিল এক মাস পর। আজকে যদি জরিনা ওর বিয়ের কথাটা না বলতো, তাহলে তো ওর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও আমরা জানতে পারতাম না।”
অতন্দ্রিলা বলল, “আপা দুটো ঘটনা পুরোপুরি ভিন্ন। এইচএসসির রেজাল্ট যখন বের হয়েছিল তখন দাদি ভীষন অসুস্থ, হসপিটালে ছিলো। ওই অবস্থায় আমি নিজের রেজাল্টে নিজেই খুশি হতে পারিনি। একমাস পর যখন দাদি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলেন, তখন আমি খুশি হয়েছি। এবং খুশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের টেলিফোন করে জানিয়েছি।
আর এই ব্যাপারটা কেন এখনো জানাইনি তার গঠনমূলক ব্যাখ্যা তোমাদের দিতে পারি।”
শায়লা কিছুটা শান্ত গলায় বললেন, “দে, দে তোর গঠনমূলক ব্যাখ্যা!”
“গত বৃস্পতিবার রাতে বাবা হঠাৎই আমার ঘরে এসে বললেন, কাল বিকেলে তোকে দেখতে আসবে।
বিনা নোটিশে দেখতে আসার কথা শুনে আমিও খানিকটা ধাক্কা খাই। কিন্তু কিছুই করার ছিলো না। এক বেলার মধ্যে তোমাদের খবর দেওয়াটাও বোকামি হতো।
তারা দেখে যাওয়ার পরও আমি তোমাদের কিছু বলিনি তার কারণ হলো তখনো বিয়ে হবে কি হবে না সেই ব্যাপারে অনিশ্চয়তা ছিলো। কিন্তু আজ সকালেই সে অনিশ্চয়তা দূর হয়। তারা আজ আমাদের বাড়িতে এক সমুদ্র উপহার পাঠান এবং বলেন আগামী বুধবার বিয়ে ফাইনাল করতে আসবে। আমি আজ বিকেলে আমি নিজে তোমাদের বাড়িতে এই খবরটা নিয়ে যেতাম।”
শায়লাকে দেখে এখন বেশ স্বাভাবিক লাগছে।
তিনি একটা মৃদু্ হাসি নিয়ে বললেন, “তুই তাহলে রাজি এই বিয়েতে।”
“রাজি না হওয়ার কোনো কারন যেহেতু নেই, সেহেতু আমি রাজি।”
“ছেলের নাম কি?”
“রোদ। রোদ আহসান।”
“দেখতে কেমন?”
“রাজপুত্রের মতো।”
“পড়াশুনা?”
“গণিতে এম এ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।”
“করে কি?”
“বাবার বিজনেস দেখাশুনা করে। কিন্তু তার বাবা বেঁচে নেই, তাই বলা যায় নিজের বিজনেস দেখাশুনা করে।”
“গণিতে পড়াশুনা করে আবার বিজনেস সামলায় কিভাবে?”
“সেটা আমি কিভাবে বলতে পারি? তোমার সঙ্গে যখন সামনাসামনি দেখা হবে তখন তুমি নিজেই জিজ্ঞেস করো।”
“তোর বাবা ঠিকই বলে, তোর সঙ্গে কথা বলাটাই বিপদ! আচ্ছা, এখন বল ছেলের কোনো খুঁত আছে?”
“অবশ্যই আছে। খুঁত ছাড়া আবার মানুষ হয় নাকি?”
“কি খুঁত? একটু ঝেরে কাঁশ তো!”
অতন্দ্রিলা কাঁশল।
“কি ব্যাপার কাঁশছিস কেন?”
“তুমিই তো বললে কাঁশতে!”
“ফাজলামো করবি না! ফাজলামো জিনিসটা আমার একদম পছন্দ না। সত্যি করে বল ছেলের খুঁতটা কি?”
“তার আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। আমার চোখে ব্যাপারটা খুঁত না হলেও সমাজের চোখে খুঁত।”
শায়লা হতভম্ব হয়ে বললেন, “একবার বিয়ে হয়েছে এমন একটা ছেলের সঙ্গে তোর বাবা তোর বিয়ে ঠিক করেছে?”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “হ্যাঁ মা। আমি তো ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। সমাজের চোখে নিখুঁত কোনো ছেলের পরিবার আমাকে পছন্দ করবে না। তারা ভাববে আমিও হয়তো আমার বাবা-মায়ের ঝগড়া করার গুন পেয়েছি, বিয়ের পর তাদের ছেলের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করবো। এজন্য বাবা একটা খুঁতসম্পন্ন ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছে।”
“কেন আমার মেয়ে কি ভেসে এসেছে নাকি যে ওকে এমন একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে? তোর বাবা কি ভেবেছে? তোর বাবা আসুক আজকে, তার সঙ্গে এর একটা শেষ দেখে ছাড়বো। আমি কিছুতেই ডিভোর্সি একটা ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে হতে দেব না।”
“আহ্ মা, এভাবে বলছো কেন? তুমি নিজেও তো একজন ডিভোর্সি। তাছাড়া ছেলেটা ডিভোর্সি…”
অতন্দ্রিলাকে থামিয়ে দিয়ে শায়লা বললেন, “তোকে আর জ্ঞান দিতে হবে না। থাম তুই!”
“ঠিক আছে থামলাম। বাবা হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। ততক্ষণ তোমরা বসে থাকো, আমি আমার ঘরে যাচ্ছি। আমার কিছু কাজ আছে।”
অতন্দ্রিলা উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।
সন্ধ্যাতারা, অতন্দ্রিলার বড় বোন। অতন্দ্রিলার সাথে তার বয়সের পার্থক্য আট বছর। তাই বোধহয় দুজনের চিন্তাচেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি কোনো কিছুরই মিল নেই।
পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর মানুষগুলোর একজন হলো সন্ধ্যা। যেকোনো বিষয়েই সে মানুষকে জ্ঞান দিতে চেষ্টা করে, এমন একটা ভাব যেন পৃথিবীর সবকিছু তার জানা। কিন্তু এটা বিরক্ত করার মত কোনো বিষয় নয়। বিরক্তিকর বিষয়টা হলো সন্ধ্যার দেওয়ার জ্ঞানের কোনোই যুক্তি নেই।
অতন্দ্রিলা ঘরে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় ঝড়ের গতিতে সন্ধ্যা তার ঘরে ঢুকে।
“কি ব্যাপার আপা দৌড়াচ্ছো কেন?”
সন্ধ্যা অতন্দ্রিলার পাশে বসতে বসতে বলল, “আমার কথা বাদ দে। আগে বল তো, কয় বছর আগে ছেলেটার ডিভোর্স হয়েছে?”
“ডিভোর্স? না, না আপা। তার ডিভোর্স হয়নি তো!”
“ডিভোর্স হয়নি? হায় আল্লাহ! তার মানে তুই এ যুগে সতীনের সংসার করবি?”
“আপা কি যাতা বলছো বলতো? সতীনের সংসার আবার কি? উনার আগের স্ত্রী চার বছর আগে মারা গেছেন।”
সন্ধ্যা হতভম্ব গলায় বলল,“মারা গেছে? সর্বনাশ! তাহলে তো তুই শেষ!”
“শেষ মানে?”
“শেষ মানে ফিনিসড!”
“আহ্ আপা! তোমার কাছে বঙ্গানুবাদ চাইনি। পরিষ্কার করে বলো কি বলতে চাচ্ছ!”
“দেখ ডিভোর্সি হলেও একটা কথা ছিল। আগের স্ত্রীর উপর ছেলেটার ঘৃণা থাকতো আর তাকে ভুলে তোর সাথে সুখে শান্তিতে সংসার করার চেষ্টা করতো। কিন্তু যেহেতু আগের স্ত্রী মারা গেছে, তার মানে ছেলেটা তাকে এখনো ভুলতে পারেনি। তাই তোর সাথে সুখে সংসারও করতে পারবে না। বারবার আগের স্ত্রীর সাথে তোর তুলনা করবে, তোকে ভালোবাসবে না। তুই বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা কতো ভয়ংকর?”
“আর আপা তুমি কি বুঝতে পারছো যে তোমার কথার কোনো যুক্তি নেই?”
সন্ধ্যা কিছু একটা বলতে যাবে তখনি নিচ থেকে আসা চেঁচামেচির শব্দ শুনে থেমে গেল।
বসার ঘরে চলছে শায়লা এবং হামিদ সাহেবের মধ্যে তুমুল ঝগড়া।
শায়লা উত্তেজিত গলায় বললেন, “তুমি আমার মেয়েকে ভেবেছোটা কি হ্যাঁ? আমার মেয়ে জলে ভেসে এসেছে? ওর কি একটা হাত বা পা নেই? নাকি ও চোখে দেখতে পারে না? আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়েটার সাথে এমন একটা ছেলের বিয়ের দেবার কথা ভাবলে কিভাবে?”
“আমার মেয়ে আমার মেয়ে করছো কেন? উনিশ বছর আগে যখন জ্বরের মধ্যে মেয়েটাকে ফেলে চলে গিয়েছিলে, তখন কোথায় ছিল তোমার এই মাতৃত্ব?”
“বাজে কথা বলবে না। একদম বাজে কথা বলবে না। আমি কিছুতেই ডিভোর্সি একটা ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দেব না!”
অতন্দ্রিলা দৌড়ে নিচে এসে বলল, “আহ্ মা,বাবা! কি শুরু করলে তোমরা?”
শায়লা উত্তেজিত গলায় বললেন, “অত তুই চল তো! আজকেই আমি তোকে আমার সাথে নিয়ে যাবো! ওই ডিভোর্সি ছেলেটাকে তোর বিয়ে করতে হবে না। আমি অনেক ভালো একটা ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব!”
“মা তুমি শান্ত হয়। প্রথমত, আমি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছি না। দ্বিতীয়ত, যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে সেও অনেক ভালো একটা ছেলে। আর ছেলেটা ডিভোর্সি না, তার স্ত্রী চার বছর আগে মারা গেছে। বিপত্নীক হওয়ার পিছনে তার কোনো দোষ নেই।”
“সে রসগোল্লা পন্তুয়া যাই হোক, আমি তার সঙ্গে তোকে বিয়ে দেব না!”
“এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন মা? বিয়েটা তো আমি করবো নাকি? আমারই যখন কোনো আপত্তি নেই তখন তুমি এত রাগ করছো কেন?”
শায়লা কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুকনো গলায় বললেন,“তোর কোনো আপত্তি নেই?”
অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল,“না নেই মা।”
রৌদ্র বা রোদ শব্দটার আলাদা কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই। রোদ হচ্ছে একই সাথে সানশাইন এবং মুনশাইন।
নির্দিষ্ট কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ না থাকায়, বিদেশি কেউ যখন রোদের নামের অর্থ জিজ্ঞেস করে তখন বেশ ভালোই ঝামেলায় পড়তে হয় তাকে। রোদের এই ঝামেলা দেখে ইরা হাসতে হাসতে বলেছিল, “আচ্ছা যাও! আমি যখন বিখ্যাত ভাষাবিদ হয়ে যাবো, তখন রোদ শব্দের সুন্দর একটা ইংরেজি প্রতিশব্দ আবিষ্কার করে দেব।”
কিন্তু ইরা কথা রাখেনি।
বছর ছয়েক আগের কথা। রোদ তখন পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। আর ইরা ইংরেজি বিভাগে।
রোদের সঙ্গে ইরার পরিচয় হয় তানহার মাধ্যমে। তানহা রোদের মামাতো বোন এবং ইরার বান্ধবী।
ইরার একটা গুন হলো, সে খুব সহজেই একটা মানুষকে আপন করে নিতে পারে।
প্রথম দর্শনেই ইরা উৎসাহিত গলায় রোদকে বলেছিল, “এমা, অংক নিয়ে পড়েন কিভাবে? স্কুল-কলেজে অংকের নাম শুনলেই জ্বর আসতো!”
রোদ শুকনো গলায় বলে, “আর আমার জ্বর আসতো ইংরেজির নাম শুনলে।”
এমন কোনো হাসির কথা না হলেও ইরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে যায়।
ইরার এই হাসিটাই আকর্ষিত করেছিল রোদকে।
রোদ ভালোবাসা নিয়ে নিজের মতো করে একটা থিওরি দাঁড় করিয়েছে। সেই থিওরি অনুযায়ী, একটা মানুষের প্রতি আরেকটা মানুষের ভালোবাসা সৃষ্টি হয় তিনটি ধাপে।
একটা মানুষ তার হাসি, চোখ অথবা কথা বলার ভঙ্গি দিয়ে অন্য একটা মানুষকে আকর্ষণ করে। অন্য একটা মানুষের যদি সেই
আকর্ষণে আকর্ষিত হয়, তবেই ভালোবাসা প্রকিয়ার প্রথম ধাপ সম্পন্ন।
মানুষটার প্রতি আকর্ষিত হওয়ার পর তার পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে জানার আগ্রহ, তার হাসিতে নিজস্ব একটা সুখ খুঁজে পাওয়া, তার কান্নায় নিজস্ব একটা ব্যাথা খুঁজে পাওয়াই তার প্রতি এক ধরনের অনুভূতি। মানুষটার প্রতি এই অনুভূতি সৃষ্টি হলেই সে পৌঁছে যাবে ভালোবাসা প্রকিয়ার দ্বিতীয় ধাপে।
এর পরের ধাপ একটা মানুষকে পাগল করে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট।
মানুষটার প্রতি অনুভূতি সৃষ্টি হওয়ার পর যখন সেই মানুষটাকে নিয়ে দিবা-নিশী, আনন্দে-দুঃখে, শয়নে-সপনে তার কথা ভাবাই হলো আসক্তি।
এই ধাপ পর্যন্ত আশা মানেই একটা মানুষ অন্য আরেকটা মানুষকে গভীর ভাবে ভালোবাসে।
ইরাকে ভালোবাসার প্রথম ধাপে আছে রোদ।
হঠাৎই এক দুপুরে রাস্তায় রিকশার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে, ইরার সাথে দেখা রোদের।
ইরা রোদকে দেখে উৎসাহিত গলায় বলে, “আরে আপনি? কেমন আছেন?”
রোদ অন্যরকম গলায় বলে, “ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
“এইতো চলছে। তা আজ হঠাৎ এখানে?”
“একটা কাজে এসেছিলাম। আপনি?”
“আমাদের বাসা এখানেই।”
“ওহ্ আচ্ছা। কোথায় যাচ্ছেন?”
“পাবলিক লাইব্রেরির দিকে।”
“তাই নাকি? আমিও তো সেদিকেই যাচ্ছি।”
কথাটা নিতান্তই মিথ্যা। রোদ বাসায় যাচ্ছিল। মেয়েরা নিজেদের সঙ্গে মিল আছে এমন ছেলে পছন্দ করে। তাই বোধ হয় এই ছোট্ট মিথ্যাটি বলে সে।
ইরা ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলে, “বাহ্ ভালোই তো হলো, একসাথে যাওয়া যাবে। তবে যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে।”
“না, না। আমার আপত্তি থাকবে কেনো?”
“তাহলে চলুন, যাওয়া যাক।”
ইরা ও রোদ একটা রিকশায় উঠে যায়।
রিকশায় উঠে আনন্দিত গলায় ইরা বলে, “আচ্ছা, আপনার কতো ঘর পর্যন্ত নামতা মুখস্ত?”
“এটা কেমন প্রশ্ন?”
“না মানে, আপনি গণিত নিয়ে পড়াশুনা করেন তো, তাই ভাবলাম আপনার বোধ হয় একশ ঘর পর্যন্ত নামতা মুখস্ত!”
“একশ ঘর পর্যন্ত নামতা মুখস্ত রাখাটা একটু কঠিন। আমার কুড়ি ঘর পর্যন্তই মুখস্ত। তবে এই ক্যালকুলেটরের যুগে কুড়ি ঘরও মুখস্ত রাখার প্রয়োজন হয় না।”
“তাও বা কম কিসে? আমার তো নয় ঘর পর্যন্তই মুখস্ত!”
“দশ-এগার?”
“ওগুলো তো পানির মতো সহজ। ওগুলো তো আর মুখস্ত করার কিছু নেই। মুখস্ত নয় ঘর পর্যন্তই।”
“নয়ের ঘরের নামতার কিন্তু মজার একটা দিক আছে। কখনো খেয়াল করেছেন?”
“কি মজার দিক?”
“এই যেমন ধরুন, ৯×২=১৮। এখানে ডানপাশের দুটি সংখ্যা মানে ১ এবং ৮ কে যোগ করলে কিন্তু ৯ হয়। আবার, ৯×৩=২৭। এখানেও ২ এবং ৭ কে যোগ করলে ৯ হয়।
পুরো ৯ এর ঘরের নামতার ডানপাশের সংখ্যাকে যোগ করলে যোগফল ৯ হয়।”
“ওমা তাইতো! কখনো খেয়ালই করিনি। অন্য ঘরের নামতায় এমন হয় না?”
“না শুধু ৯ এর ঘরেই হয়। গণিত আসলে একটা বোঝার বিষয়। যে বুঝতে পারে, তার কাছে গণিত পৃথিবীর সবথেকে মজার বিষয়। আবার যে বুঝতে পারে না, তার কাছে এর থেকে জটিল বিষয় আর নেই।”
রোদের এই সুন্দর কথা,গাণিতিক জ্ঞান ইরার বেশ ভালো লাগে।
এরপরও বেশ কয়েকবার কাকতালীয়ভাবেই তাদের দেখা হয়। এই দেখা হওয়ার মাঝেই একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে।
একদিন বিকেলে ইরা রোদকে ফোন করে বলে, “আপনি কি ফ্রি আছেন?”
রোদ শান্ত গলায় বলে, “হ্যাঁ আছি। কেন বলুন তো?”
“আমার সাথে একটু দেখা করতে পারবেন?”
“অবশ্যই পারবো। কোথায় দেখা করতে হবে?”
“শপিং মলে, আই উইল টেক্সট ইউ দ্য অ্যাড্রেস এন্ড টাইম। আসলে আমি একজনের জন্যে একটা উপহার কিনবো, আপনার সাহায্য দরকার।”
“নিশ্চই সাহায্য পাবেন। দেখা হচ্ছে তাহলে!”
সময়মতো শপিং মলে পৌঁছে রোদ দেখে, ইরা একটা পাঞ্জাবির দোকানে। কয়েকটা পাঞ্জাবি নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে।
রোদ ইরার কাছে গিয়ে চিন্তিত গলায় বলে, “ইরা?”
ইরা তাকাল।
রোদকে দেখে কিছু খুশি গলায় বলে, “আপনার অপেক্ষাই করছিলাম।”
“বেশি দেরি করে ফেললাম নাকি?”
“না, না! আচ্ছা, এখন এই পাঞ্জাবিগুলোর মধ্যে একটা বাছাই করুন।”
“আমি?”
“হ্যাঁ। আসলে ছেলেদের জিনিস, আমি অতো ভালো বুঝি না। তাই আপনাকে আসতে বলেছি।”
রোদ পাঞ্জাবি বাছাই করতে করতে বলে, “আচ্ছা আপনি তো বলেছিলেন একজনের জন্যে উপহার কিনবেন। এটাই কি সেই উপহার?”
ইরা অস্পষ্ট গলায় বলে, “হুঁ।”
“তা, উপহারটা কার জন্যে?”
“আমি আসলে একজন পছন্দ করি। পছন্দ বললে ভুল হবে। আমি আসলে তার প্রেমে পড়েছি। শুনেছি, বাঙালি মেয়েরা নাকি কারো প্রেমে পড়লে তাকে মুখ ফুটে বলতে পারে না। উপহার দিয়ে বুঝিয়ে দেয়।”
রোদ চমকে উঠে, তার মুখটা রক্তশূন্য হয়ে যায়। রোদ যে চমকে উঠছে এটা ইরাকে বুঝতে দেয়নি, খুব সহজেই নিজেকে সামলে নেয়।
কিছুক্ষণের মধ্যে রোদ সুন্দর একটা পাঞ্জাবি বেছে দেয়। ইরা সেই পাঞ্জাবি নিয়ে কাউন্টারের দিকে পা বাড়ায়।
পাঞ্জাবিটা কেনা হয়ে গেলে ইরা ও রোদ দোকানের বাইরে বের হয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে পায়চারি করে।
অবশেষে ইরা মুখ খুলে, “রোদ?”
“হুঁ?”
ইরা পাঞ্জাবির প্যাকেটটা রোদের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, “আসলে এটা কিনেছি আপনার জন্যে। কারণটা আপনাকে বলেছি। তাই আবার জানতে চাইবেন না প্লিজ।”
রোদ হাত বাড়াল। রোদ প্যাকেটটা হাতে নেওয়ার সাথে সাথে ইরা প্রায় দৌড়ে সেখান থেকে চলে যায়।
শুরু হয় রোদ ও ইরার গভীর প্রণয়।
প্রণয়ের কয়েক মাস যেতে না যেতেই তারা নিজের নিজের বাড়িতে পছন্দের কথা বলে।
রোদের মা এবং মামা বেশ আগ্রহের সঙ্গেই ইরাদের বাড়িতে তাকে দেখতে যান। মেয়ে সুন্দরী, শিক্ষিত,গুছিয়ে করে কথা বলতে পারে, রান্নাবান্নাও করতে পারে – তাদের ইরাকে খুবই পছন্দ হয়।
ইরার বাবা-মাও রোদকে পছন্দ করেন। করাটাই স্বাভাবিক।
মাস তিনেক পর বেশ ধুমধাম করে বিয়ে হয় রোদ এবং ইরার।
বিয়ের পর তাদের প্রথম সকালটা শুরু হয় একটু অন্যরকম ভাবে।
“এই ইরা! ওঠো না!”, বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় কথাটি বলে রোদ।
ইরা ঘুমের মধ্যেই বলে, “কি হয়েছে?”
“আহ্ উঠো না!”
“কয়টা বাজে?”
“সাতটা।”
“উফফ, আরেকটু ঘুমাই না!”
“উঠো না প্লিজ! খুবই জরুরি একটা কাজ আছে!”
রোদ অসাধারন সুন্দর ছবি আঁকে। কোনো সুন্দর কিছু তার চোখে পরলেই সেটার ছবি আঁকা শুরু করে। ঘুমন্ত অবস্থায় ইরাকে দেখে তার ছবি আঁকতে খুব ইচ্ছে করছিল। তাই তো এত সকালে তাকে জাগিয়ে তোলা।
ইরা ফ্রেশ হয়ে এসে ক্ষীণ গলায় বলে, “এখন বলো, কি তোমার জরুরি কাজ?”
“ক্যানভাসটার ঠিক মুখোমুখি বসো।”
“রোদ! তুমি ফাজলামো করছো না? একে তো এই সাত-সকালে আমার ঘুমটা ভাঙালে, এখন আবার বলছো ক্যানভাসের সামনে বসতে?”
“হুঁ। তোমার ছবি আঁকবো।”
“সেটা কি পরে আঁকা যেত না?”
“যেত, কিন্তু আমার এখনি আঁকতে ইচ্ছে করছে।”
ইরার খুব রাগ করতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার ওপর রাগ করা তার পক্ষে অসম্ভব। তাই হাসিমুখেই ক্যানভাসের সামনে বসে গেল সে।
ছয় ঘন্টা ধরে বিশাল এক ক্যানভাসে আঁকা হচ্ছে ইরার ছবি। ইরাকে অবশ্য পুরোটা সময় বসে থাকতে হয়নি।
ছবিটা অসাধারন হয়েছে। আঁকা শেষ করে রোদ ছবিটাকে খাটের পেছনের দেয়ালে টানিয়ে দিলো।
এভাবেই সূচনা ঘটে রোদ ও ইরার সুখের সংসার।
রোদের বাড়ির সামনে এক বিশাল বাগান।
বাগানের একদিকে চৌবাচ্চায় বিভিন্ন ধরনের দেশীয় মাছ চাষ করেন রোদের মা ফিরোজা।
কিন্তু তার একটাই আক্ষেপ, মাছগুলোর কোনোটাই বেশি দিন বাঁচে না।
বাগানের আরেক দিকে দেশীয় ফলমূল এবং তরি-তরকারির গাছের সমাহার। গ্রীষ্মকালীন আম-কাঠাঁল থেকে শুরু করে শীতকালীন বরই-আমলকি, সবই আছে ফিরোজার বাগানে।
বাগানের একটা কোণা এখনো ফাঁকা পরে আছে। রোদের বাবার ইচ্ছা ছিল সেখানে ছোট্ট একটা গলফ কোর্ট করার। তিনি মারা যাওয়ার পর সেই কোণাটা ওভাবেই পরে আছে।
ফিরোজার ইচ্ছা সেখানে মুরগির খামার করার। একটা খামার হলেই বাগানটা মাছ-মাংস এবং ফল-মূলে পরিপূর্ণ হবে।
কিন্তু বাগানে খামার করা নিয়ে রোদের ঘোর আপত্তি রয়েছে।
রোদের কথা, “বাগান ঘুরে বেড়ানোর জায়গা। এখানে খামার বানিয়ে সুন্দর জায়টাকে বাজার বানিয়ে ফেলার কোনো অর্থ নেই।”
সেই বাগানে বসেই এক ভোরে, সূর্যোদয় উপভোগ করছে ইরা।
রোদ তখন দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “তুমি এখানে? আর আমি তোমাকে সারা বাড়ি খুঁজছি!”
ইরা ইশারায় রোদকে বসতে বলে। রোদ কথা না বাড়িয়ে ইরার পাশে বসে পড়ে।
ইরা রোদের কাঁধে মাথা রেখে বলে, “আমাদের বাগানটা না, অনেক সুন্দর।”
“হুঁ! মায়ের শখের জায়গা, সুন্দর তো হবেই।”
“আমি ঠিক করে এখন থেকে আমি গাছ লাগাবো। গোলাপ গাছ। লাল, গোলাপী, হলুদ,কমলা সব রঙের গোলাপ গাছ থাকবে এখানে!”
রোদ গম্ভীর গলায় বলে, “এখন তুমিও?”
“তুমিও মানে?”
“না মানে, মা এত দিন এই গাছ-গাছ করে আমার মাথাটা খেয়েছে! এখন তুমিও সেই দলে যোগ দিবে?”
“আম্মা যা করেন একদম ঠিক করেন।তাছাড়া আমরা যে পরিমাণে অক্সিজেন ব্যাবহার করি এবং যে পরিমাণে গাছ কাটি, সে অনুযায়ী সারা জীবনে আমাদের ৭ লক্ষ গাছ লাগানো উচিত। তুমি সারা জীবনে ৭ টা গাছও লাগিয়েছো?”
“ইরা, তোমার এই জ্ঞানের কথাগুলো একটা বই আকারে লিখে ফেলো! আমি নিজ খরচে ছাপিয়ে দেব।”
ইরা হাসতে হাসতে বলে, “অবশ্যই লিখবো। অসংখ্য ধন্যবাদ!”
পরেরদিন খুব গভীর রাতে ইরার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙার পেছনের কারণ হলো একটা শব্দ। শব্দটা নির্ঘাত আসছে রান্নাঘর থেকে।
ইরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বিছানা থেকে উঠে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো।
“রোদ?”
“হুঁ?”
“এই রাতে রান্নাঘরে কি করছো তুমি?”
“ ঘুম ভেঙে গেল। এখন কিছু না খেলে ঘুমও আসবে না। তাই ভাবলাম রান্নাঘরে এসে কিছু বানাই!”
“ভাবলেই হলো! তুমি আবার কিছু বানাতে পারবে নাকি?”
“চেষ্টা করলেই পারবো।”
“তুমি ঘরে যাও আমি বানাচ্ছি!”
রোদ বাধ্য ছেলের মতো ঘরে চলে যায়। মধ্যরাতে সবথেকে কম সময়ে, কম পরিশ্রমে যে খাবার বানানো যায় তা হলো মাইক্রোওয়েভ পাস্তা।
একটা মগে কাঁচা পাস্তা, দুধ এবং চিজ দিয়ে তিন মিনিট মাইক্রোওয়েভ করলেই তৈরি হয়ে যায় খাবারটি। খেতে অতটা আহামরি ধরনের না হলেও রাতের ক্ষুধা মেটাতে কার্যকরী।
ইরা ৫ মিনিটের মধ্যেই এটা বানিয়ে ঘরে চলে যায়।
রোদ হতভম্ব গলায় বলে, “এটা তুমি এখন বানালে!”
“হ্যাঁ!”
“কিভাবে সম্ভব?”
“চাইলেই সম্ভব! এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো আর আমাকেও ঘুমাতে দাও!”
ইরা অন্য মেয়েদের মত খুব ছোট ছোট বিষয় নিয়ে রাগ করেনা। কিন্তু ইরা যখন রেগে যায়, তখন বুঝতে হবে কেউ কোনো বিরাট অপরাধ করেছে।
ইরা এখন বেশ রেগে আছে, রাগ করার পেছনের কারনটা হলো সিগারেট।
একটা মানুষ ও তার পরিবারকে বিপর্যস্ত করে তোলার জন্য সিগারেট যথেষ্ট। তাই বিয়ের আগেই ইরা রোদকে সিগারেট খেতে নিষেধ করেছিল।
কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই রোদের শার্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট পায় ইরা।
রোদ তখন বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছে।
ইরা প্রায় ছুটতে ছুটতে বারান্দায় যায়।
“রোদ?”
“হুঁ?”
ইরা সেই সিগারেটের প্যাকেট রোদ দেখিয়ে বলে, “এটা কি?”
রোদ স্বাভাবিক গলায় বলে, “সিগারেটের প্যাকেট!”
“এটা তোমার পকেটে কি করছিলো?”
“কাল সন্ধ্যায় কিনেছিলাম।”
“কেন জানতে পারি?”
“অবশ্যই পারো। আসলে কাল আমার অফিসে খুব কাজের চাপ ছিল তো, তাই স্ট্রেস কমানোর জন্যে সিগারেট খেতে ইচ্ছে হলো।”
“স্ট্রেস কমাতে সিগারেট খেতে হবে এটা কোন দেশী লজিক? তাছাড়া আমি তো তোমাকে একদিন না হাজার দিন মানা করেছি সিগারেট খেতে! আমার কথার তো দেখছি কোনো মূল্যই নেই তোমার কাছে!”
“ইরা, তুমি এখন খুবই উত্তেজিত অবস্থায় আছো। একজন উত্তেজিত মানুষকে কোনো কিছু বোঝানো যায় না। তাই আমি এখন তোমাকে কিছু বোঝাবো না।”
“ফড়ফড় করা বন্ধ করো। তুমি খুব ভালো করেই জানো যে তুমি দোষ করেছো!”
“হ্যাঁ জানি। জানি এবং স্বীকারও করে নিচ্ছি।”
ইরা উত্তেজিত অবস্থায় বারান্দা থেকে বের হয়ে যায়।
ঘন্টা দুয়েক পর ইরার রাগ কমলে, বান্দায় গিয়ে দেখে রোদ মন খারাপ করে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে আছে।
ইরা কোনো কিছু না ভেবে দৌড়ে গিয়ে রোদকে জড়িয়ে ধরে।
“আই এম স্যরি।”
“তুমি স্যরি হতে যাবে কেন? আমি স্যরি। আমিই তো তোমার কথা শুনিনি।”
ইরা কাঁদতে কাঁদতে বলে, “রোদ, বিশ্বাস কর আমি কখনোই চাই না তোমার কোনো ক্ষতি হোক। তোমার কোনো ক্ষতি হলে আমি বাঁচতে পারবো না। তাই আমি তোমাকে সিগারেট খেতে নিষেধ করেছিল।”
রোদ ইরাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে বলে, “তোমাকে কথা দিচ্ছি, আর কোনো দিনও সিগারেট স্পর্শ করবো না!”
ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর যেকোনো বিষয় নিয়ে ফিরোজা একটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে না হওয়া পর্যন্ত তার শান্তি হয় না।
বাড়িভর্তি কাজের লোক। ফিরোজা যখনই যা চাচ্ছেন, হাতের নাগালে পেয়ে যাচ্ছেন। তাই ওনার বাড়াবাড়ি করাটা শোভনীয়।
কিন্তু এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের বাড়িতে কাজের লোকের নাম-গন্ধ পর্যন্ত নেই। তাদের ছোট ছোট বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়।
নাস্তা করা নিয়ে ফিরোজার বাড়াবাড়ি কিছুটা এমন – টেবিলে ইন্ডিয়ান, ইটালিয়ান, ইংলিশ, জাপানিজ এবং বাংলাদেশী সব ধরনের নাস্তা থাকতে হবে। যদিও তিনি বাংলাদেশী নাস্তা খাবেন, তারপরেও চোখের শান্তির জন্যে অন্যান্য দেশের নাস্তাগুলো থাকতে হবে।
বাসার সবাই যে যেখানে থাকুক না কেন, নাস্তার টেবিলে সময়মতো আসতে হবে।
রোদ ইরাকে নিয়ে নাস্তায় টেবিলে এসেছে।
ইরাকে দেখে ফিরোজা চিন্তিত গলায় বলেন, “কি ব্যাপার ইরা? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
ইরা বলে, “কেমন দেখাচ্ছে আম্মা?”
“মনে হচ্ছে তুমি যেন অনেক ক্লান্ত, সারা রাত ঘুম হয়নি!”
“না, না আম্মা। ঘুম হয়েছে। কিন্তু কাল দেরিতে ঘুমিয়েছিলাম তো তাই কম ঘুম হয়েছে।”
ইরা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় নাস্তা খেয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু চেয়ার থেকে উঠতেই ইরা মাথা ঘুরে পড়ে যায়।
রোদ ইরাকে কোলে করে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়।
মিনিট দশেকের মধ্যে ইরার জ্ঞান ফেরে।
“কি হয়েছে রোদ?”
“তুমি সেন্সলেস হয়ে পরেছিল।”
“সে কি!”
“দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরেই তোমাকে নিয়ে হসপিটালে যাবো।”
“একটু মাথা ঘুরে পড়ে গেছি, এজন্য আবার হসপিটালে যেতে হবে নাকি?”
“হ্যাঁ যেতে হবে। তুমি বেশি কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে থাকো!”
বিকেলের দিকে রোদ ইরাকে নিয়ে হসপিটালে চলে যায়।
ড.হাফিজ, গাইনোকলোজিস্ট। ওনার চেম্বারটা বেশ সুন্দর করেই গোছানো।
দেয়ালে মা ও শিশুর যত্ন সম্পর্কিত বেশ কয়েকটা পোস্টার টানানো। পোস্টারগুলো পাশেই একজন বৃদ্ধার ছবি, সম্ভবত ওনার মায়ের ছবি।
কিছুটা দূরে একটা দেয়াল ঘড়ি। ইরা সেই ঘড়ি দেখে অবাক না হয়ে পারলো না, কারন ঘড়িটার কোনো কাঁটা নেই। একজন ডাক্তারের চেম্বারের ঘড়ি বন্ধ! হতে পারে তিনি বিষয়টা খেয়াল করেননি, কিংবা হতে পারে উনি সময়কে তোয়াক্কা করেন না। সময় চলবে সময়ের মতো, আমি চলবো আমার মত – টাইপ মানুষ তিনি।
ডাক্তাররা স্বভাবতই বেশি কথা বলেন। ড. হাফিজও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি অনবরত কথা বলছেন, শ্রোতা রোদ। ইরা কিছুই শুনছে না, শোনার চেষ্টাও করছে না। মনোযোগ দিয়ে দেখছে ঘরটার সাজসজ্জা।
চেম্বার থেকে বেরিয়ে ইরা আগ্রহ নিয়ে বলে, “কি বললেন উনি?”
“তুমি তো ভিতরেই ছিলে!”
“শুনিনি। ডাক্তারদের কঠিন কঠিন কথাগুলো আমার মাথায় ঢোকে না। উনি এতক্ষণ যা যা বলেছেন, তুমি সহজ বাংলায় আমাকে বুঝিয়ে বলো।”
“বলার মত অনেক কিছুই বলেছেন। কিন্তু সারমর্ম হলো উনি কতগুলো টেস্ট দিয়েছেন, যেগুলোর রেজাল্ট আজকের মধ্যেই ওনাকে দেখাতে পারলে ভালো হয়।”
“ডাক্তারদের এই একটা বিষয় আমার অসহ্য লাগে। সামান্য একটা সমস্যার জন্যেও টেস্ট!”
“কিছু করার নেই, নিজের ভালো চাইলে ডাক্তারদের কথা মানতে হবে।”
“আচ্ছা আজকে টেস্ট করালে, রিপোর্ট আজকেই দিবে?”
“অবশ্যই দিবে, কারন উনি প্রেসক্রিপশনে ‘ইমারজেন্সি’ কথাটা লিখে দিয়েছেন।”
ইরা বিরক্ত হয়ে টেস্টগুলো করাতে চলে গেল।
টেস্টগুলো করা শেষ হলে রোদ এবং ইরা রিপোর্টের জন্যে বসে আছে।
রোদ ক্লান্ত গলায় ইরাকে বলে, “ইরা? তোমাকে বাসায় দিয়ে আসবো?”
“নাহ্! কয়েক ঘণ্টার ব্যাপারই তো।”
“আমার কি ধারনা জানো?”
“কি?”
“আমাদের মাঝে জুনিয়র ইরা আসছে।”
ইরা হাসতে হাসতে বলে, “যদি তাই হয়, তাহলে আমার থেকে বেশি খুশি, আর কেউ হবে না।”
“তাই হবে দেখো!”
১ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট চলে এলো। রিপোর্ট হাতে পেয়ে রোদ সাথে সাথে ড.হাফিজের চেম্বারে চলে গেল।
ড. হাফিজ অনেক্ষণ যাবত ইরার রিপোর্টটা নাড়াচাড়া করে দেখছেন।
তিনি ভ্রু সামান্য কুঁচকে বলেন, “মি.রোদ, আপনি ড.নাহিদের চেম্বারে চলে যান। আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি যাতে আপনাদের অপেক্ষা করতে না হয়।”
ড. নাহিদের চেম্বারের সামনে এসে রোদ চমকে ওঠে। কারণটা হলো, ড. নাহিদ একজন নিউরোলজিস্ট।
নাহিদের চেম্বারে ঢুকে রোদ ইরার রিপোর্টের ফাইলটা নাহিদকে এগিয়ে দেয়।
ড. নাহিদ রিপোর্টগুলো ভালোমত দেখে ইরাকে বলেন, “আপনার নামই তাহলে ইরাবতী! এই রিপোর্টগুলো আপনার তাইতো?”
ইরা ঠোঁটে মুচকি একটা হাসি নিয়ে বলে, “জ্বী।”
“দেখুন কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে আপনাদের মনোবল রাখতে হবে।”
রোদ শুকনো গলায় বলে, “সব কিছু ঠিক আছে তো ডক্টর?”
“দেখুন এমন কিছু বলার সময় আমাদেরও খারাপ লাগে। কিন্তু কিছুই করার নেই, বিষয়টা এই মুহূর্তে আপনাদের জানা খুবই জরুরি।
ইরাবতীর ব্রেইন টিউমার, বেশ অনেক দিন ধরেই। লক্ষণগুলো কখনো প্রকাশ পায়নি, তাই এত দেরিতে ধরা পরেছে।”
রোদ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। তার গা বেয়ে শীতল হওয়া বয়ে গেল।
অবশেষে রোদ মুখ খুলে আহত গলায় বলে, “এটা কিভাবে বলতে পারেন আপনি? মাত্র কয়েকটা টেস্টের ভিত্তিতে আপনি এত বড় একটা কথা কিভাবে বললেন আপনি?”
“একজন মানুষ হয়ে অন্য আরেকজন মানুষকে এত কষ্টদায়ক কথা বলতে আমারও খারাপ লাগে।”
ইরার মধ্যে কোনো রকমের প্রতিক্রিয়া কাজ করছে না। চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে সে ভাবছে, ব্রেইন টিউমার মানে কি? মরে যাওয়া? মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়া? নাকি সারাজীবন মৃতের মত বিছানায় পরে থাকা?
রোদ ইরা নিয়ে নাহিদের চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল। তারা দুজনে চুপচাপ বসে আছে।
রোদ কিছুক্ষণ পর শুকনো গলায় বলে, “ইরা শোনো, কাল সকালে অন্য আরেক ডাক্তারের কাছে যাবো। দেখো তিনি বলবেন যে এরা উল্টোপাল্টা কথা বলেছে, তোমার কিছুই হয়নি।”
ইরা চুপ করে বসে থাকে।
পরেরদিন রোদ ইরাকে নিয়ে অন্য এক হসপিটালে যায়।
সেখানকার ডক্টর ইরার রিপোর্টগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলেন, “ওনারা ঠিকই বলেছেন। এটা ব্রেইন টিউমারই।”
রোদ অনেক্ষণ চুপ করে থাকে। তার সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে।
নিজেকে সামলে রোদ বলে, “আমরা এখন কি করবো ডক্টর?”
“দেখুন ওনার টিউমারটা একবার অপারেশন করলে আর দ্বিতীয়বার হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। উনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবেন। কিন্তু ব্রেইনের যে জায়গায় টিউমার রয়েছে সেই জায়গায় অপারেশন করাটা বেশ রিস্কি।”
ইরা কাঁপা গলায় বলে, “যদি অপারেশন না করাই তাহলে কি হবে?”
“তাহলে আপনার অসুস্থতা বেড়ে যাবে। বমি বমি ভাব, মাথা ব্যাথা, চোখে ঝাপসা দেখা এসব মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে যাবে।
আর অপারেশনটা করলেই আপনি পুরোপুরি সুস্থ!”
“আপনি যে রিস্কের কথাটা বললেন, সেটা কি ধরনের রিস্ক?”
“টিউমারটি আপনার ব্রেইনের খুব সেনসেটিভ অঞ্চলে। তাই অপারেশনের সময়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে পারে।”
ইরা হতাশ গলায় বলে, “প্রচুর রক্তক্ষরণ হলে কি আমি মারা যাবো?”
রোদ ইরাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “ইরা! একদম বাজে কথা বলবে না। কিচ্ছু হবে না তোমার। ডক্টর, আমরা অপারেশন করাবো।”
“তাহলে যত দ্রুত পারেন ওনাকে অ্যাডমিট করে ফেলুন। আমরা ৭ দিন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে অপারেশনে যাবো।”
পরেরদিন ইরাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়। ওষুধ, সেলাইন, ইনজেকশন এসব নিয়ে ছোটাছুটি করছে।
মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত। মাত্র দুদিন আগে ইরা জানতে পেরেছে তার ব্রেইন টিউমার সম্পর্কে। খবরটা জানার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার মাথায় যন্ত্রণা করছিল না।
কিন্তু জানার পর থেকেই মাথায় একটা সুক্ষ্ম যন্ত্রণা অনুভব করছে।
সকালে ইরার বাবা মা এসেছিলেন। ঘন্টাখানেক কান্নাকাটি করে বাইরে গিয়ে বসেন তারা। পরের শিফটে কান্নাকাটি করেন ফিরোজা।
একটা অসুস্থ মানুষের সামনে কান্নাকাটি করে তাকে আরো অসুস্থ করে দেওয়ার কোনো অর্থ নেই। অসুস্থ মানুষটার চারপাশের সকলের উচিত তাকে সাহস জোগানো, বেঁচে থাকতে অনুপ্রেরণা দেওয়া।
ইরা চোখদুটো বুজে শুয়ে আছে। রোদ তখন কেবিনে ঢুকলো। ইরার পাশে বসে, তার ডান হাতটা ধরে।
ইরা স্বাভাবিক গলায় বলে, “কি রোদ? ভয় লাগছে?”
রোদ কোনো জবাব দেয় না।
ইরা আবার বলতে শুরু করে, “ভয় পেওনা। আমি তোমাকে ছেড়ে এত সহজে যাচ্ছি না! দেখো, আমার কিচ্ছু হবে না।”
রোদ অনেক কষ্টে স্বাভাবিক গলায় বলে, “আমি জানি তুমি কোথায় যাচ্ছ না। তোমার সাথে এখনো অনেক হিসেব-নিকেশ বাকি আমার।”
“কান্না চেপে রেখেছ কেন রোদ? কান্না চেপে রাখলে কিন্তু কষ্ট বেড়ে যায়। যাও, বাইরে গিয়ে মন খুলে কাঁদো। আমার সামনে আবার কেঁদো না। তোমাকে কাঁদতে দেখলে আমার কষ্ট হবে।”
রোদ বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ চিৎকার করে কাঁদে। ইরা ঠিকই বলেছে, কান্না চেপে রাখলে কষ্টের ভার বেড়ে যায়।
ইরার কেবিনটা খুব সুন্দর করে সাজানো। চারিদিকে ফুলদানিতে গোলাপের গুচ্ছ, ঝুড়িতে ফলমূল। কেবিনে বড় বড় দুটো জানালা আছে। সেই জানালা দিয়ে ভরপুর আলো বাতাস আসে।
ইরা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশটা যেন তাকেই ডাকছে।
রোদ তখন এসে ইরার হাতটা ধরল।
ইরা হতাশ গলায় বলে, “জানো আমার না অনেক শখ শান্তিনিকতনের মত আমিও নিজের একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করবো। নাম দিব, ইরাবতীর ইশকুল। নামটা সুন্দর না?
“অনেক সুন্দর। অবশ্যই তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করবে। আগে সুস্থ হয়ে ওঠো! তোমার কথা বলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। আর কথা বলোনা তো।”
“তোমার সাথে কথা বলতে অনেক ইচ্ছে করছে রোদ। আর তো কোনো দিনও বলতে পারবো না।”
“কে বলেছে বলতে পারবে না? অবশ্যই পারবে!”
ইরা রোদের কপালে হাত রেখে বলে, “তোমার তো জ্বর! ওষুধ খেয়েছ?”
“না না আমার কিছু হয় নি। আমি ঠিক আছি।”
“নিজের দিকে একটুও খেয়াল রাখছো না। তাই না?”
“আমি ভালো মতোই নিজের যত্ন নিচ্ছি।”
“তোমাকে দেখে বেশ বুঝতে পারছি, তুমি খাওয়া দাওয়া, ঘুম সব বাদ দিয়ে আমার কাছে পরে আছো!”
“আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না! তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো।”
ইরা সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রোদকে দেখতে পাচ্ছে না। হয়তো রোদ আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।
ইরা বিড়বিড় করে তার মাকে বলে, “রোদ কোথায় মা?”
“এই তো, বাইরেই আছে।”
“ওকে একটু ডেকে দাও তো।”
ইরার মা বাইরে গিয়ে রোদকে বলে, “বাবা ইরা ডাকছে!”
রোদ চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে ইরার কাছে যায়। ইরার কথা বলার শক্তি নেই। তারপরও কথাগুলো রোদকে বলা দরকার। কাল ইরার অপারেশন করা হবে। এই কথাগুলো হয়তো কখনো রোদকে বলা হবে না।
ইরা লক্ষ করল রোদের চোখভর্তি পানি। মনে হচ্ছে অনেক্ষণ কান্নাকাটি করছে।
ইরা বিড়বিড় করে রোদকে বলে, “রোদ? আমার কাছে বেশি সময় নেই।”
“তুমি এসব আজেবাজে চিন্তা বন্ধ করো তো ইরা।”
“আজেবাজে কথা নয়, সত্যি কথা। একজন মানুষ কিন্তু তার মৃত্যুর আগে বুঝতে পারে যে, সে মারা যাচ্ছে। আমিও পারছি।”
রোদ শক্ত করে ইরার হাত চেপে ধরে।
ইরা বলে, “তোমার অনেক কষ্ট হবে আমি চলে যাওয়ার পর। কিন্তু তাই বলে জীবনে থেমে যেও না কিন্তু।
তুমি কিন্তু অবশ্যই চমৎকার একটা মেয়েকে বিয়ে করবে, তার সঙ্গে সুখে শান্তি জীবন কাটাবে!”
“আহ্ ইরা! থামো তো এবার। তোমার কিচ্ছু হবে না। আমি তোমার সঙ্গেই সুখে শান্তিতে জীবন কাটাবো।”
“রোদ, আমার আয়ু আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো।
একদম ভেঙে পরবে না কিন্তু, নিজের খেয়াল রাখবে। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবে, সিগারেট একদম খাবে না! আর দিন অন্তত একবার আমাকে মনে করবে।”
রোদ থমকে যায়। এসব কথার কোনো উত্তর তার জানা নেই। তার কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।
সকাল থেকেই নার্সরা বেশ ছোটাছুটি করছে। কিছুক্ষণ পরেই ইরার অপারেশন।
অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে ইরা শেষ বারের মতো রোদকে দেখে নিল। রোদকে এর আগে এত বিপর্যস্ত কোনো দিন বোধ হয় দেখেনি ইরা।
ইরা রোদকে জড়িয়ে ধরে বলে, “রোদ, তোমাকে একটা কথা কখনো বলা হয়নি। তোমর হাসিটা অনেক সুন্দর। তুমি না কখনো কাঁদবে না। কাঁদলে তোমাকে বিশ্রী দেখায়।”
অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো ইরাকে। রোদের বারবার মনে হচ্ছে এইতো কিছুক্ষণ পর ইরা হাসতে হাসতে বলবে,“কি বোকার মত কথা বলেছিলাম দেখেছো? আমার তো কিছুই হলো না! আমাকে তাড়াতাড়ি বাসায় নিয়ে চলো। ঢেঁড়স দিয়ে রুই মাছের একটা ক্লাসিক ঝোল রাঁধবো!”
কিন্তু তা হলো না।
১২ ঘন্টা পর রোদ ইরার সামনে বসে আছে। কিন্তু ইরার শরীরে নাকি প্রাণ নেই। সে নাকি আর তাকাবে না, আর কথা বলবে না।
প্রকৃতি খুব নিষ্ঠুর, খুব। ইরা তো সারাজীবন শুধু রোদের পাশে থেকে তাকে ভালোবাসতে চেয়েছিল। ইরার সেই একমাত্র ইচ্ছেটাও পূরণ হতে দিলো না প্রকৃতি।
রোদ দুহাতে ইরার ডান হাতটা চেপে ধরেছে।
অস্পষ্ট গলায় বলল, “ইরা তাকাও তো! তোমাকে বাসায় যেতে হবে, ইরাবতীর ইশকুলের কাজ শুরু করতে হবে। ইরা উঠো!
তোমাকে না নিয়ে আমি যাবো না।”
এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব-২০( শেষ পর্ব )
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম
বৃষ্টির প্রকোপ বেড়েছে। সন্ধ্যার অন্ধকারটা যেন বৃষ্টির কারণে আরো জেঁকে বসেছে। চার দিকে শুধু বাসা বাড়িতে জ্বলতে থাকা হলুদ সাদা আলো ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার পাশের টং দোকান গুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে। দোকানের সামনে কয়েকটা ভেজা কুকুর দাঁড়িয়ে আশ্রয় নিয়েছে। মিলির মনটা খুব ফুরফুরে। সৌরভ তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে সোজা ফুলের দোকানে গেছে। কালই নাকি তাদের বিয়ে হবে। এই বৃষ্টির মাঝে ভিজে এসব কোন পাগল ছাড়া কেউ করতে পারে! “এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
সৌরভের সাথে আজ এক সাথে ভিজেছে সে। গায়ে মেখেছে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা। তার জীবন সার্থক। আর কী চাই জীবনে ! প্রিয় মানুষের থেকে এটুকু পাওয়াই অনেক।
বারান্দায় বসে বাহিরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছিলো মিলি। আজ মনটা বড্ড ভালো। সৌরভ এভাবে তাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে, বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে সেটা সে ভাবতেও পারেনি। সব যেন কল্পনা!
কিছুক্ষণ পর রহিমা ঘরে ঢুকলো। মিলির পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
– ‘ আফা বৃষ্টি কমছে। এখন আমি যাই তাইলে।’
– ‘ আজ থেকে যাও। আকাশের অবস্থা ভালো না। যে ভাবে মেঘ ডাকছে একটু পর পর সারা রাতই বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে।’
– ‘ আচ্ছা আফা। ‘
রহিমা চলে যেতে নিচ্ছিলো তখন মিলির ফোনটা বেজে উঠলো। বিছানা থেকে ফোনটা নিয়ে এসে মিলিকে দিলো রহিমা। রাজিবের নাম্বার থেকে কল এসেছে দেখে কিছুটা অবাক হলো মিলি। সে সাধারণত মিলিকে ফোন দেয় না। তেমন কথাও হয়নি তাদের মাঝে। সব সময় তোহাই ফোন করে খোঁজ নিতো। তাহলে কোন বিপদ হয়নি তো আবার! বুকের মাঝে হঠাৎ ভয় ঢুকে গেলো। দ্রুত ফোন রিসিভ করলো মিলি। ওপাশ থেকে শোনা গেলো রাজিবের ভীত কন্ঠ,
– ‘ হ্যালো। মিলি ?’
– ‘ হ্যাঁ। কিছু হয়েছে ভাইয়া ? ‘
– ‘ তোহার শরীরটা হঠাৎ খারাপ করেছে। কী হয়েছে বুঝতে পারছি না। বৃষ্টির কারণে ডাক্তারও আসতে পারছে না। এখন কী যে করবো ভেবে পাচ্ছি না আমি। ‘
মিলি আঁতকে উঠলো,
– ‘ হঠাৎ কী হলো ?’
– ‘ বুঝতে পারছি না। আমার খুব ভয় করছে।’
– ‘ আপনি চিন্তা করবেন না। আমি এখনই আসছি।’
বলেই ফোন রেখে দিলো মিলি। তখন খেয়াল করে দেখলো ফোনের চার্জ একদম শেষ। মিলি রহিমাকে বললো,
– ‘ আমার ফোনটা চার্জ দিয়ে রাখো। আমি একটু বের হচ্ছি।’
– ‘ এতো রাইতে কই যাইবেন ? ‘
– ‘তোহার শরীর ভালো না। ওর বাসায় যাবো।’
– ‘ভাইজান আসুক। একলা কেমনে যাইবেন ?’
– ‘চিন্তা করো না। আমি যাচ্ছি। তুমি বাসায় থাকো।’
তারপর দ্রুত বের হয়ে গেলো মিলি। বাহিরে গিয়ে একটা রিক্সা ডেকে উঠে পরলো। ঠান্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। আকাশ এখনো মেঘাচ্ছন্ন। তবে বৃষ্টি কমেছে। রিক্সা ছুটে চলছে তোহার বাসার দিকে। অথচ মিলি নিজেও বুঝতে পারছে না সে কত বড় ফাঁদে পরতে যাচ্ছে !
মিলিকে বলা রাজিবের সব গুলো কথাই দরজার ওপাশ থেকে তোহা শুনেছে। সে খুব অস্থির হয়ে পরেছে আসন্ন বিপদের কথা চিন্তা করে। তার জন্য মিলির জীবনে নেমে আসতে যাচ্ছে এক ভয়ানক রাত্রি। মিলিকে ফোন করার পর আরো একজনকে কল করলো রাজিব। তাদের কথা স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে না। রাজিব কী বলছে সেটা শুনার জন্য উঠে এসে দরজার সাথে কান ঘেঁষে দাঁড়ালো তোহা। রাজিব বেশ ঠান্ডা গলায় বলছে,
– ‘ মিলির ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আমি যাচ্ছি বাসায়। এদিকটা তুই সামলে নে বন্ধু। ‘
উল্টো পাশ থেকে কিছু শুনে রাজিব আবারো বললো,
– ‘ না। কোন ঝামেলা হবে না। ‘
তারপর ফোন রেখে রুমের দিকে রাজিব আসছে বুঝে দ্রুত দরজার পাশ ছেড়ে বিছানায় গিয়ে আবারো বসে পরলো তোহা। রাজিব তোহার সামনে এসে তার সব ক’টা দাঁত বের করে হাসলো। কাঁটা কাঁটা স্বরে বললো,
– ‘ আমার বউটার জন্য মায়া হচ্ছে। ইশ আর কেঁদো না। তৈরী হয়ে নাও।’
– ‘ কী করতে চাচ্ছো তুমি ? ‘ চোখ মুখ খিঁচে প্রশ্ন করলো তোহা।
– ‘ তোমার কাছে একজন মেহমান আসছে। তাকে আদর যত্ন করে খুশি করার দায়িত্ব তোমার। কে আসছে বলো তো?’
তোহা কপাল কুঁচকে তাকালো রাজিবের দিকে।
– ‘ বাদল আসছে। তার আবার তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। ‘
তোহা স্তব্ধ হয়ে গেলো। রাজিব তার সাথে এটা করবে সে ভাবতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত নিজের সেই নোংরা বন্ধুর কাছে স্ত্রীকে তুলে দিচ্ছে! তার একটুও বিবেকে বাধছে না! এখন কী করবে এখন সে ? কিভাবে বাঁচাবে নিজেকে এদের হাত থেকে ? কিচ্ছু মাথায় আসছে না। রাজিব বেরিয়ে যেতেই রুমের এক কোণায় বসে কাঁদতে লাগলো তোহা।
তোহার ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দিলো রাজিব। বাসায় এসে সে চেঞ্জ করে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী পরেছে। একদম ফ্রেশ লাগছে। এদিকে টেনশনে মিলির এই ঠান্ডার মাঝেও চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। শরীর হালকা ঘামছে। রাজিব দরজা ছেড়ে দাঁড়াতেই মিলি ওড়না দিয়ে মুখ মুছে ভেতরে প্রবেশ করলো। রুমের ভেতর শুনশান নিরবতা। কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। যদিও এ বাসায় রাজিব আর তোহা ছাড়া কেউ নেই। তাই বাসা নিরব থাকারই কথা। মিলি ড্রইং রুমে প্রবেশ করে বললো,
– ‘ তোহা কোথায় ? ‘
– ‘ ওর রুমে আছে। ‘
মিলি আর কথা না বাড়িয়ে ভেতরের রুমে চলে গেলো। রাজিবও গেল তার পেছন পেছন। তোহার রুমে এসে কাওকে দেখতে না পেয়ে মিলি একটু বিরক্ত হলো। সেই সাথে এক অজানা ভয় তাকে পেয়ে বসলো। বাহিরে তখন শব্দ তুলে মেঘ ডাকছে। মিলির বুঁকের ভেতরটা খচখচ করতে লাগলো। সে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো রাজিব দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। মিলির শরীরের উপর থেকে নিচ বরাবর চোখ বুলাচ্ছে সে। মিলি চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো,
– ‘ এসব তামাশার মানে কী ? ‘
রাজিব মিলির দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
– ‘মানে কী তা এখনই বুঝবে। ‘
রাজিব বের হবার পরই কাওসার এসে দরজা খুলে দিলো। তোহা দ্রুত রুম থেকে বের হতেই সে বললো,
– ‘ আপনাকে এখনি পালাতে হবে। আমি সব শুনেছি তারা কি বলছিলো। তাড়াতাড়ি যান। ‘
– ‘ তুমিও চলো আমার সাথে। তুমি এখানে থাকলে বিপদে পরবে। ‘
কাওসার ছেলেটা কিছু একটা ভেবে দ্রুত তোহাকে নিয়ে বের হয়ে গেলো রিসোর্ট থেকে।
বৃষ্টির কারণে কোন যানবাহন নেই রাস্তায়। এক রকম দৌড়ে ছুটছিলো ওরা দুজন। এখান থেকে তোহাদের বাসায় যেতে হলে অনেকটা পথ যেতে হবে। ততোক্ষণে না কোন বিপদ হয়ে যায় ! সৌরভকে যে করেই হোক সব জানাতে হবে। তোহা শুধু আল্লাহর নাম নিয়ে দৌড়াচ্ছিলো। হঠাৎ একটা গাড়ির সামনে এসে পরে ওরা দুজন। গাড়িটা দ্রুত ব্রেক কষে থেমে যায়। অদ্ভুত ভাবে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসে সৌরভ। তোহা মাটিতে লুটিয়ে পরে। ভয়ে তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে আছে। কোন কথা বলতে পারছে না। সৌরভ তোহাকে এ অবস্থায় দেখে আঁতকে ওঠে। এগিয়ে এসে কোলে তুলে নেয়। গাড়িতে উঠিয়ে মুখে পানি দেয়। বেশ কিছুক্ষণ তোহা সৌরভের কোলেই শুয়ে থাকে। কাওসার সৌরভকে সব খুলে বলে। সব শুনে সৌরভের ভিতরে এক অদৃশ্য কম্পন শুরু হয়েছে। যে ভয়টা মন থেকে সরে গিয়েছিলো হুট করেই আবারো মিলির বিপদের কথা চিন্তা করে শরীর মন ভয়ের ঠান্ডা স্রোতে ভেসে যেতে লাগলো। তোহাকে পেছনের সিটে বসিয়ে তার পাশে বসলো কাওসার। সৌরভ দ্রুত ড্রাইভ করে যেতে লাগলো রাজিবের বাড়ির দিকে। ইতোমধ্যে অফিসার দেলোয়ার হোসেনকে টেক্সট করে সব জানিয়ে দিয়েছে সে।
রাজিব মিলির সামনে এসে দাঁড়িয়ে একটা হাত মিলির গালে আলতো করে স্পর্শ করলো। রাজিবের স্পর্শে মিলির শিরা উপশিরা পর্যন্ত ঝেঁজে উঠলো। মিলি বা হাত দিয়ে পেছনের সেলফে থাকা কাঠের একটা শো-পিস নিয়ে জোড়ে আঘাত করলো রাজিবের মাথায়। প্রথম বারেই রাজিব কোঁকিয়ে উঠলো। মাথায় হাত চেপে ধরে ব্যাথায় সে মাটিতে লুটিয়ে পরলো। মিলি তখন দ্বিতীয় বারের মতো আঘাত করলো। নিস্তেজ হয়ে পরে গেলো রাজিব। তার সাদা পাঞ্জাবী তে টপ টপ করে রক্ত ঝরে পরতে লাগলো। দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে গেলো মিলি। ড্রইং রুম থেকে সদর দরজা দিয়ে বের হতেই সে ধাক্কা খেলো সৌরভের সাথে। নিজের দেহে যেন প্রাণ ফিরে পেলো। সৌরভকে নিজের সাথে জাপটে ধরে কাঁদতে লাগলো মিলি।
দেলোয়ার হোসেন দুজন ফোর্স নিয়ে চলে এসেছে। রাজিবের মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে দেখে সকলেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। পাছে না কোন ঝামেলা হয়ে যায় ! তবে অফিসার চেক করে জানায় এখনো বেঁচে আছে। মারা যাবার মতো আঘাত লাগেনি। তবে এক জায়গায় দুবার আঘাত করায় প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
রাজিবকে দ্রুত হাসপাতে নেয়া হলো। বাকি সব দায়িত্ব দেলোয়ার হোসেন নিজের কাঁধেই নিলেন। ছায়ার খুনের বিষয়ে তোহা আর কাওসারের স্টেটমেন্ট নিয়ে নিলেন তিনি । যাক এবার একটা বড় কেইসের তদন্ত করতে পেরেছেন বলে উপর মহল থেকে বেশ সুনাম কামানো যাবে ভেবে শান্তি পেলেন তিনি।
আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হবার নাম নেই। এ শহরের মেঘ গুলো আজ তোহার মতোই কাঁদতে চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। তোহা কাঁদার জন্য একটা ভরসার কাঁধ চায়। যেখানে মাথা রেখে সে সব দুঃখ ভুলে যেতে পারবে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে সে। তার চোখ নির্জীব, নিষ্প্রাণ। মিলি তোহার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে ডাকলো তোহাকে,
– ‘ তোহা সোনা। একটু তাকাও এদিকে। ‘
তোহা তাকালো না। কোন কথাও বললো না। মিলি আবারো বললো,
– ‘ তোমার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। ‘
তোহা কোন উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করলো না। সে আজকাল পাথরের মূর্তির মতো থাকে। কারো সাথে কথা বলার কোন দায় যেন তার নেই। তোহাকে এভাবে দেখতে বাড়ির সকলের কষ্ট হয়। মিলির চোখ ভারী হয়ে আসছিলো। সে তোহার সামনে কাঁদতে চায় না বলে দ্রুত রুম ছেড়ে চলে গেলো।
কিছু সময় পর কারো উপস্থিতি টের পেয়ে তোহার বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করা শব্দটা বাড়তে লাগলো। পেছন ফিরে তাকালো তোহা। দিপু দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ জোড়া টকটকে লাল । কেঁদেছে কী ? তোহার হঠাৎ করে কী যেন হলো। চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পরলো দু ফোঁটা অশ্রু । ঝাপিয়ে পরলো সে দিপুর বুকের উপর। নিজের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে কাঁদতে লাগলো । দিপু কোন কথা বললো না। তোহার মাথায় আলতো করে হাত রেখে পরম যত্নে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। বাহিরের মেঘ গুলো ততোক্ষণে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। সে দিকে তোহার কোন খেয়াল নেই। খেয়াল করতেও চায় না। সে এখন কাঁদবে। ভীষণ ভাবে কাঁদবে। কাঁদার জন্য যে ভরসার একটা কাঁধ পেয়েছে।
তোহার কান্নার তোর বেড়েই যাচ্ছে। রাজিব রুমে এসে তোহাকে এভাবে কাঁদতে দেখে দ্রুত এগিয়ে এলো তার দিকে। তোহার পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বললো,
– ‘ কী হয়েছে তোহা ! কাঁদছো কেনো তুমি।’
কাওসার ছেলেটা ততক্ষণে রুম থেকে বের হয়ে গেছে। রাজিব তাকে দেখতে পায়নি। কাঁধে রাজিবের হাতের স্পর্শ পেয়ে তোহার শরীর জ্বলে উঠলো। এতো দিনের পরিচিত সেই ভালোলাগার, সুখের স্পর্শ এই মুহূর্তের বিষের মতো লাগছে। যা শরীরে লাগতেই সমস্ত শরীরে যেন বিষ ছড়িয়ে পরতে লাগলো। তোহা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো রাজিবকে। টাল সামলাতে না পেরে রাজিব কিছুদূর সরে গিয়ে পরে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। তোহার এমন ব্যবহারে সে স্তব্ধ। তোহা হাঁটু মুড়ে বসে কাছে। রাজিব আবারো এগিয়ে এলো। তোহার পাশে বসে তাকে নিজের বাহুডোরে নিয়ে আসতে চাইলে তোহা চেঁচিয়ে উঠে বললো,
– ‘ ধরবে না তুমি আমাকে। একদম ধরবে না।’
– ‘কী হয়েছে বলবে তো ? এমন করছো কেনো ?’
– ‘ কী হয়েছে এখনো বুঝতে পারছো না ? খুনি তুমি। খুন করেছো আমার ভাবীকে। প্রতারণা করেছো আমাদের সাথে। সকলের বিশ্বাস ভেঙেছো। ‘
কান্নার কারণে কথা বলতে পারছিলো না তোহা। রাজিবের দিকে সে রক্তবর্ণ চোখে তাকালো। এই মুহূর্তে চোখের সামনে রাজিবকে দেখতেও ঘেন্নায় তার গা গুলিয়ে উঠছে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ রাজিব অদ্ভুত হাসলো। তার হাসি ক্রমশ প্রশস্ত হয়ে উচ্চ আওয়াজ ধারন করলো। কেমন বিচ্ছিরি হাসি ! এই মানুষটাকে তোহা চিনে না। এটা তার রাজিব না। হুট করে রূপ বদলে ফেলা যেন অন্য কেউ। রাজিবের হাসি দেখলে তার প্রাণ জুড়িয়ে যেত। কিন্তু এখন এই হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে কুৎসিত একটা চরিত্র।
– ‘ তাহলে আমার প্রিয়তমা সব জেনেই গেছো ? ‘ বলেই আবার উচ্চ শব্দে হাসতে লাগলো রাজিব।
– ‘ কেনো করেছো তুমি এটা ? কি করেছিলাম আমরা তোমার সাথে ? ‘ ঝেঁজে উঠে বললো তোহা।
রাজিব অদ্ভুত হাসতে লাগলো। উত্তর না পেয়ে তোহা এগিয়ে গিয়ে রাজিবের শার্টের কলার চেপে ধরে বললো,
– ‘ বলো কেনো করেছো ? আমার ভাই তোমাকে সব থেকে ভালো বন্ধু ভাবে। নিজের ভাইয়ের মত দেখে তোমাকে। অথচ তুমিই তার পিঠে ছুড়ি বসালে! কিভাবে পারলে তুমি ? ‘
– ‘ বন্ধু মাই ফুট। তোমার ভাই একটা কাপুরুষ। তাই তার সাথে এমন হয়েছে। ‘
তোহা রক্তশুন্য চোখে তাকিয়ে আছে রাজিবের দিকে। কোন কথা তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। রাজিব আবার বললো,
– ‘ আমিও সৌরভকে নিজের বন্ধু ভাবতাম। এখনো ভাবি। তবে সে যে একটা কাপুরুষ তা সবাই জানে। ছায়াও জানতো। তাই সে সৌরভকে পছন্দ করেনি করেছে আমাকে। তাছাড়া তোমার ভাইয়ের থেকে বেশি মজা সে আমার সাথে থেকে পেয়েছে। ‘
রাজিবের বিদ্রুপ মাখা কথায় তোহা গর্জে উঠলো,
– ‘ রাজিইইব! মুখ সামলে কথা বলো। ‘
– ‘ বা রে। সত্য বললেও এভাবে রেগে যায় কেনো আমার প্রিয়তমা! ‘
– ‘ ছায়া কখনো এমন করার মেয়ে না। তুমি তার সাথে অন্যায় করেছো। তাকে নিশ্চই তুমি কোন কারণে ফোর্স করেছো। ‘
– ‘ আমি কেনো ফোর্স করবো! তোমার কাপুরুষ ভাই সুখ দিতে পারেনি তোমার ভাবিকে। তাই সে আমার কাছে এসেছে। ‘
রাজিবের দৃষ্টিতে এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ দেখতে পাচ্ছিলো তোহা। আর সেই দৃষ্টি এতো বেশি নিচ যে তোহা তাকিয়ে থাকতে পারলো না।! সে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
– ‘ তারমানে তোমরা একটা অবৈধ সম্পর্ক চালাচ্ছিলে?’
– ‘ হ্যাঁ। বলতে গেলে আমি নিজেই ছায়ার প্রেমে পরেছিলেম। ঠিক প্রেম বলা যায় না তোমার ভাবির শরীরের প্রেমে পরেছিলাম আমি। সৌরভ এতো সুন্দরী একটা মেয়েকে বিয়ে করেছিলো যাকে দেখার পরই আমার মাথা নষ্ট হয়ে যায়। একটা রাত হলেও তার সাথে কাটানোর ইচ্ছা ছিলো আমার। ‘
কথাগুলো বলার সময় রাজিবের ঠোঁটের কোণে সেই বিচ্ছিরি হাসিটা দেখতে পাচ্ছিলো তোহা। রাজিব বলতে লাগলো,
– ‘ সৌরভ নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারতো না। ছায়াকে তার ক্যারিয়ার গড়ার আগেই বিয়ে দেয়াতে সে বিয়েটা ঠিক ভাবে মানতে পারেনি তবুও মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিলো। তারপর আবার যখন ছায়ার অফিসের বস তাকে বিভিন্ন ভাবে বিরক্ত করতে শুরু করে তখন সৌরভ তেমন কোন স্টেপ নেয়নি এ বিয়ষে। প্রথমে সামান্য শান্তনা তারপর চাকরী টাই ছেড়ে দিতে বলে কাপুরুষের মতো। কিন্তু জানোই তো। এখনকার মেয়েরা কোন কাপুরুষ স্বামী চায় না। সৌরভের এমন আচরণে ছায়া মনে মনে কষ্ট পায় আর সেই সুযোগটাই আমি নেই। সে সময় আমি গিয়ে দাঁড়াই তার পাশে। আস্তে আস্তে আমাদের মাঝে ঘনিষ্ঠতা হয়। ছায়া বিশ্বাস করতে শুরু করে আমাকে। ভালোবেসে ফেলে। ‘
– ‘ এতোই যখন দুজন দুজনকে চাইতে তাহলে মারলে কেনো তাকে ? ‘
রাজিব হাসছিলো। হেসে হেসে বললো,
– ‘কারণ তোমার ভাবিটাও ছিলো বোকা। বোকার মতো আমার প্রেমে পরে আমার বিছানায় চলে এসেছিলো। ‘
তোহা আর শুনতে পাচ্ছিলো না। সে দুহাত দিয়ে নিজের কান চেপে ধরে বিছানায় বসে কাঁদছে। রাজিব বললো,
– ‘ সমস্যাটা হলো এর পরই। ছায়া প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলো। তখন আমি তাকে বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলতে বলি। কিন্তু সে রাজি হয় না। সে আমার কাছে বাচ্চাটার অধিকার চায়। বলে এই সম্পর্কের কথা সকলকে জানিয়ে দিতে। আর তখনি তোমার ভাই আমাকে জানায় তুমি নিজেও আমার প্রেমে পরে হাবুডুবু খাচ্ছো। সৌরভ বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমিও সুযোগটা লুফে নেই। তোমাকে বিয়ে করলে তোমার ভাইয়ের সব কিছু আমাদেরই হবে। সেই সাথে নতুন কাওকে টেস্ট করা হবে আমার। তবে ঝামেলা ছিলো ছায়া। সে না থাকলে সব সুন্দর ভাবে গুছিয়ে নেয়া যাবে। সেজন্যই রাস্তা থেকে ছায়া নামের কাঁটাটা সরিয়ে দেই আমি। ছায়াকে সেদিন দেখা করতে বলে অফিস ব্রেক টাইমে এখানে নিয়ে আসি। তোমার ভাবিটা তখনো আমার সাথে বিছানায় মজা পেতো। তাই তাকে নিয়ে রোমান্স শেষে যখন সে ওয়াশরুমে যায় তার আগে ছয়াকে বলি তার ফোনের লক খুলে দিতে । বোকা মেয়ে সেটাই করে। তারপর ছায়ার ফোন থেকে সৌরভকে আমি ম্যাসেজ দিয়ে বলি বস ডিস্টার্ব করার কথাটা। আর ছায়া ফিরে আসতে আসতে ফোনটা আবারো লক হয়ে যায়। ফিঙ্গারপ্রিন্ট হবার কারণে পরবর্তীতে সেটা আর কেউ খুলতে পারেনি। ছায়া আসলে তাকে নিজের পাশে শুইয়ে দিয়ে খুব সাবধানে বালিশ চেপে মারি তাকে। তারপর সতর্ক ভাবে সব প্রমান মুছে ফেলি। ‘
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
তোহা এসে রাজিবের গালে একটা স্ব- জোড়ে থাপ্পড় মারে। তার কলার চেপে বলে, ‘খুনি তুমি। সকলের সাথে বেইমানি করেছো। আমি ছাড়বো না তোমাকে।’
– ‘ কী করবে ? পুলিশ ডাকবে? যাও যাও ডাকো।’ ব্যাঙ্গ করতে করতে বলে রাজিব।
তোহা দরজার দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই তাকে আটকে ধরে। বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলে,
– ‘ বেশি কথা বললে তোর অবস্থাও ছায়ার মতো হবে। চুপচাপ এখানে বসে থাকবি। ‘
– ‘ রাজিব! আমি ছাড়বো না তোমাকে। ‘
– ‘ এখান থেকে বের হতে পারলে তবে তো ছাড়বি! ‘
তোহা বিছানায় পরে কাঁদছিলো। ততোক্ষণে রাত হয়ে গেছে। একটা সুন্দর দিন কাটাতে এসেছিলো তারা। দুজন ভালোবাসার মানুষ। আর এখন সব ওলট পালট হয়ে গেছে। তার এতো দিনের চেনা মানুষটা হুট করে অচেনা হয়ে গেছে। এতোদিনের বিশ্বাস, ভালোবাসা সব মিথ্যা প্রমান হয়েছে। রাজিবের ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো। সৌরভ ফোন করেছে। রাজিব একটা বাঁকা হাসি দিলো। গলা খাকারি দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যেতে যেতে ফোন রিসিভ করে বললো,
– ‘ হ্যাঁ দোস্ত বল। ‘
মিনিট পাঁচেক পর ফিরে এলো রাজিব। তার চোয়াল শক্ত। চোখ গুলো লাল হয়ে আছে। রাগে ফেটে পরছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। রুমে এসে রাজিব সরাসরি তোহার চুলের মুঠি ধরে বললো,
– ‘ তুই আমার সব প্ল্যান নষ্ট করে দিয়েছিস। এখানে তোকে নিয়ে আসাই ভুল ছিলো। ‘
ব্যাথায় তোহা কোঁকিয়ে উঠলো। রাজিবের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে বৃথা চেষ্টা করছে সে। রাজিব আরো জোড়ে তোহার চুল টেনে ধরে বললো,
– ‘ তোর ভাই আবারো বিয়ে করতে চাচ্ছে। কাল তোকে নিয়ে যেতে বলেছে বাড়িতে। কাকে বিয়ে করবে জানিস ? মিলিকে। সব সুন্দরী মেয়েরা তোর ভাইকে কি দেখে পছন্দ করে বলতো ? ‘
তোহা ব্যাথায় কিছু বলতে পারছে না। সে নড়েচড়ে কোন ভাবে বললো,
– ‘ লাগছে আমার। ছাড়ো। ‘
– ‘ লাগুক। এবার তোদের লাগারই সময়। এ বিয়ে তো হতে দিবো না আমি। ‘
– ‘ কী করবে তুমি! ‘
– ‘ তোর ভাই একা সব ভোগ করবে তা তো হতে দিবো না আমি। আচ্ছা আমার বিছানায় মিলিকে কেমন লাগবে বলতো ? ‘
তোহা চমকে উঠলো। অবাক হয়ে তাকালো সে রাজিবের মুখের দিকে। রাজিব তার নেশাতুর চোখ নিয়ে তাকিয়ে বিশ্রী ভাবে হাসছে। তোহার চোখে মুখে ভয়। সে কাঁপা কাঁপা হাত নিয়ে রাজিবের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
– ‘ তুমি এটা করবে না রাজিব। আমি কাওকে কিছু বলবো না। তবুও তুমি আর কোন ক্ষতি করো না প্লিজ। ‘
রাজিব তোহাকে তুলে আবার বিছানায় ছুড়ে ফেলে দিলো।
– ‘ তোর সাথে থেকে আর মজা পাচ্ছি না। এবার আর তোর দরকার নেই আমার। এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করবি না। তাহলে খুব খারাপ হবে। ‘ বলেই চলে যেতে লাগলো রাজিব। তোহা নিজের ফোনটা আশেপাশে পাগলের মতো খুঁজতে লাগলো। তারপর লক্ষ্য করলো তার ফোনটা হাতে নিয়েই রাজিব বের হয়ে যাচ্ছে। যাবার আগে পেছন ঘুরে বললো,
– ‘ ওওও, ছায়াকে নদীকে নিয়ে গিয়ে ফেলার সময় আমার সাথে আরো একজন ছিলো। কে বলতো ? ‘
তোহা শূন্য চোখে অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইলো রাজিবের দিকে। রাজিব ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বললো,
– ‘ বাদল। ‘
রাজিব বেরিয়ে যেতেই তোহা পাগলের মতো বিছানায় পরে কাঁদতে লাগলো। বাহির থেকে রাজিব দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। রুম থেকে বের হবার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না তোহা। সে উঠে আবারো এদিক সেদিক দৌড়ে খুঁজতে লাগলো কোন পথ পাওয়া যায় কী না। কিন্তু কোন লাভ হলো না। রুম থেকে বের হবার অন্য কোন রাস্তা নেই। নিজেকে অসহায় লাগছে। শরীর অসাড় হয়ে ঢলে পরলো মেঝেতে। সেখানে পরেই তোহা কাঁদতে লাগলো।
আজ কাল তোহার সকালটা শুরু হয় রাজিবের বুকের উষ্ণ স্পর্শে। দিনের শুরুতে মিহি রোদের আলোয় সে রাজিবের মুখটা দেখতে পায়। সমস্ত ক্লান্তি শেষ করে রাতটা পার হয় দুজনার ভালোবাসায়। রাজিব অফিসে চলে যাবার পর বাসায় একাই বসে থাকে তোহা। মাঝে মাঝে ক্লাসে যায়। তা না হলে টুকটাক কাজে নিজেকে মগ্ন রাখে। বিয়ের পর রাজিব আর তার এক সঙ্গে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। অফিসের কাজের জন্য সব সময় বিজি থাকতে হয়। বাসায় ফিরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে। তোহাও রাজিবকে অভিযোগ করে না কোন বিষয়ে। অনেক বেশি সময় চায় না সে রাজিবের থেকে। রাতে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে যখন রাজিব তাকে বুকে জড়িয়ে নেয় তখন পরম আবেশে সে চোখ বুজে। শান্তি খুঁজে পায় এসব ছোট ছোট মুহূর্তের মাঝে।
শুক্রবার দিন রাজিবের অফিস বন্ধ হওয়ায় সে বাসায়ই ছিলো। দুজনের খুনশুটিতে সময় কাটছিলো। রাজিব সুযোগ পেলেই তোহাকে কাছে টেনে নিতে ব্যস্ত হয় পরে। তোহা মাঝে মাঝে বিরক্ত হয় রাজিবের এমন কান্ডে আবার ভালোও লাগে। তার প্রতি রাজিবের এমন আকর্ষণ তার মনকে ভালো করে তুলে। প্রতিটি স্ত্রীই তো চায় তাদের স্বামী স্ত্রীর মোহে ডুবে থাকুক। শুধু স্ত্রীকে ভালোবাসুক। তোহাও এর ব্যতিক্রম নয়। রাজিবের সান্নিধ্য সে সব সময় উপভোগ করে।
তোহা সকালে যখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছিলো রাজিব তখন পেছন থেকে তোহাকে জড়িয়ে ধরে। তার ঘাড়ে মুখ ঘঁষতে ঘঁষতে বলে,
– ‘ বিকেলে তৈরী থেকো। বের হবো। ‘
– ‘ কোথায় যাবো ? ‘
– ‘ বিয়ের পর তো আমার বউটাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতে পারিনি। তাই ভাবছিলাম একটু বাহির থেকে ঘুরে আসি। দূরে কোথাও না কাছেই। ‘
তোহার চোখ জোড়া খুশিতে নেচে উঠলো। সে হাসি মুখে বললো,
– ‘ শাড়ি পড়ে যাবো ? ‘
– ‘ তোমার ইচ্ছা। ‘
ভারী ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ। একটু পর পর দমকা হাওয়া এসে গাছের পাতা গুলোকে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মেঘের ডাকও শুনা যাচ্ছে। প্রচন্ড বৃষ্টি হবে হয়তো। মিলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। সৌরভ তার সামনে এখন কম আসে। সে যে ইচ্ছে করেই এমনটা করছে তা বুঝতে পারে মিলি। কিন্তু সৌরভকে দেখা ছাড়া এখন মিলি একটা দিনও কাটাতে পারে না। সকাল কিংবা রাত যে কোন একটা সময় হলেও গিয়ে দেখা করে আসে সে সৌরভের সাথে। তবে সৌরভ তাকে এড়িয়ে চলে। বিষয়টা মিলির ভেতরে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। রোজ এই ক্ষত একটু একটু করে বাড়ছেই। আকাশের মেঘের মতো তার মনের মাঝেও জমেছে ঘুটঘুটে মেঘের আস্তরণ। সেই মেঘ গুলো শুধু ছড়িয়ে যাচ্ছে ভেতরে। তবে উধাও হবার নাম নেই।
ধীর পায়ে সৌরভ মিলির রুমে এলো। ঘরে আলো নেই কোন। এদিকে মেঘের কারণে দিনের মাঝেও বাহিরে কোন আলো নেই। অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারপাশ। হালকা আবছা আলোয় সৌরভ দেখতে পেলো বারান্দায় মিলি দাঁড়িয়ে আছে। সে নিশব্দে মিলির পাশে দাঁড়িলো। ততোক্ষণে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে মিলির চোখে মুখে। ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে মিলির গোলাপি ওষ্ঠ জোড়া। তবে তার কোন ভাবান্তর নেই। সে যেন বৃষ্টির ছাঁটে নিজের দুঃখ গুলো মুছে ফেলতে চাচ্ছে। কাঁধে কারোর স্পর্শ অনুভব করার পর মিলির ঘোর কাটলো। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো সৌরভকে। কি যেন একটা হলো! মিলি হঠাৎ করেই সৌরভের বুকের উপর ঝাপিয়ে পরলো। ঢুকরে কেঁদে উঠলো সৌরভের শার্ট খামচে ধরে। আকস্মিক ঘটনায় চমকালো সৌরভ। মিলি কাঁদছে কেনো সে বুঝতে পারছে না। তবে কী তার থেকে দূরে বলেই মিলি অবুঝের মতো করছে ? তার থেকে কষ্ট পেয়েছে সে? সৌরভ কী বলবে বুঝতে না পেরে আলতো হাতে মিলিকে জড়িয়ে ধরলো।
বেশ কিছুক্ষণ সৌরভের বাহুডোরে থাকার পর মিলি হাত আলগা করে সৌরভকে ছেড়ে দাঁড়ালো। কিছুটা সরে গিয়ে মুখ নিচু করে রইলো। সৌরভ এগিয়ে এসে দুহাত দিয়ে মিলির মুখটা উপরে তুলে ধরলো। শান্ত স্বরে বললো,
– ‘ বাহিরে যাবে ? ‘
মিলি চোখ মেলে তাকালো সৌরভের চোখের দিকে। হালকা ভাবে বললো,
– ‘ এখন ? ‘
– ‘ হুম। ‘
– ‘ কিন্তু বাহিরে তো বৃষ্টি! ‘
– ‘ বৃষ্টিতে ভিজতে পারবে না ? ‘ সৌরভের ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির মৃদু হাসি।
মিলি অবাক হলো। বিষয়টা বুঝতে পেরে কিছুটা লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। হালকা ভাবে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বললো,
– ‘ পারবো। ‘
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
বৃষ্টির কারণে বাহিরে ঘুরতে যাওয়া হলো না তোহা আর রাজিবের। গাড়ি নিয়ে বের হবার একটু পরই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গাড়িতে বসেই তাই শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা। তোহা গাড়ির জানালা খুলে বৃষ্টিতে হাত ভেজাচ্ছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাহিরের দিকে। রাজিব সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতে বললো,
– ‘ ধুর বৃষ্টির জন্য সব প্ল্যান নষ্ট হয়ে গেলো। ভেবে ছিলাম বাহিরে ঘুরবে। খেতে যাবো কোন রেস্টুরেন্টে। কিছুই হলো না। ‘
তোহা মিষ্টি করে হেসে বললো,
– ‘ তাতে কী ? বৃষ্টির মাঝে গাড়িতে করে দুজন ঘুরছি বিষয়টাও কিন্তু খুব উপভোগ করার মতো। আমার তো খুব ভালো লাগছে।’
কথা শেষ করে তোহা গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাহিরে বের করলো। বৃষ্টির পানি মেখে নিলো নিজের শরীরের সাথে। চোখ বন্ধ করে সে বৃষ্টি দিয়ে সাজাচ্ছে তার মুখমন্ডল। রাজিব লক্ষ্য করতেই বললো,
– ‘ আরে কী করছো ? ভিজে গেছো তো একদম। ‘
তোহা হাসলো। কিছু না বলে সে আগের মতোই বৃষ্টি ছুয়ে দেখতে লাগলো। রাজিব আবারও বললো,
– ‘ কাছেই আমার এক বন্ধুর রিসোর্ট আছে। সখ করে বানিয়েছে। ভাড়া টারা কিচ্ছু দেয় না। মাঝে মাঝে গিয়ে আমরা আড্ডা দিয়ে আসি। চলো সেখানে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিবে। ‘
তোহা আর অমত পোষণ করলো না। দুজন মিলে গেলো রিসোর্টে। রিসোর্টের গেইট দিয়ে গাড়ি ঢুকে কয়েকটা এক তলা কর্টেজের সামনে গিয়ে থামলো। গাড়ি থামতেই একজন কম বয়সি ছেলে ছাতা নিয়ে এগিয়ে এলো তাদের দিকে। রাজিব ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– ‘ তোর ভাবী। রুমে নিয়ে যা। ‘
তোহা ছেলেটার সাথে ভেতরে চলে গেলো। তোহাকে একটা রুম দেখিয়ে দিলো ছেলেটা। তোহা রুমে গিয়ে বসার পর একটা টাওয়েল এনে দেয়া হলো তাকে। তোহা মুখটা মুছে ছেলেটাকে বললো,
– ‘ তোমার নাম কী ? ‘
ছেলেটার চোখ মুখ শুকনা। সে কিছুটা থমথমে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তোহার দিকে। তার দৃষ্টিতে ভয় লুকানো। সেই সাথে কিছুটা সংকোচ। সে ঢোক গিলে বললো,
– ‘ কাওসার। ‘
তোহা ছেলেটাকে এভাবে দেখে তীক্ষ্ণ ভাবে তাকালো তার দিকে। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
– ‘ তুমি ভয় পাচ্ছো আমাকে ? ‘
ছেলেটা দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না করলো। তারপর দ্রুত চলে গেলো রুম থেকে। তার এমন কান্ডে তোহা কিছুটা অবাক হলো। তারপর ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো ফ্রেশ হতে।
সৌরভের গাড়ি এসে থামলো একশ ফিট ব্রিজের উপর। এদিকটায় এ সময় এমনিতেই গাড়ি কম থাকে। তার মাঝে এখন আবার বৃষ্টি। একটা লোককেও রাস্তায় দেখা যাচ্ছে না। একটু দূরে দোকান আছে। সেখানে কিছু লোক বসে চা খাচ্ছে আর গল্পে মজে আছে। তাছাড়া তেমন কাওকে দেখা যাচ্ছে না এদিকটায়। সৌরভ গাড়ি সাইড করে থামালো। মিলি আর সে নেমে এলো। মিলি নীল শাড়ি পরেছে। কপালে তার ছোট একটা কালো টিপ। গাড়ি থেকে নেমেই সে দৌড়ে পুলের উপর গিয়ে দাঁড়ালো। পেছন পেছন গেলো সৌরভ। বৃষ্টির পানিতে দুটো মানুষ কাক ভেজা হয়ে আছে। নদীতে বৃষ্টির ফোঁটা টুপ টুপ করে পরছে। হালকা করে একটা ঢেউ বয়ে যাচ্ছে সেই পানিতে। চারদিক সতেজতায় পূর্ণ। পিচ ঢালা রাস্তায় কোন ধুলো নেই। সব নোংরা বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেছে। যেন প্রকৃতির প্রতিটি সৃষ্টি নিজেদের ধৌত করে পবিত্র হয়ে নিলো।
হাতে কফির মগ নিয়ে তোহা কাওসারের সাথে কটেজটা ঘুরে দেখছে। বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে। কর্টেজের লম্বা বারান্দা ধরে হাঁটছে তারা। কিছুটা দূরে রাজিব একটা ছেলের সাথে কথা বলছে। উল্টোদিকে ফিরে থাকায় তোহা দেখতে পাচ্ছে না তাদের তেমন ভাবে। তবে রাজিবের সাথের ছেলেটা কিছুক্ষণ পর পর উঁকি দিয়ে তোহাকে তীক্ষ্ণ ভাবে দেখছে। তোহার কাছে বিষয়টা অদ্ভুত লাগছে। তাছাড়া তার পাশের কাওসার ছেলেটাও কেমন ভয়ে ভয়ে কথা বলছে। যেন কিছু লুকাচ্ছে তার থেকে। ছেলেটা কথা যে জোড় করে বলছে তা তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তোহা ঘুরে দাঁড়িয়ে কাওসার কে বললো,
– চলো আমরা রুমে গিয়ে গল্প করি।
কাওসার শুধু উপর নিচ মাথা ঝাকালো। ওরা দুজন রুমে গিয়ে বসার পর তোহা বললো,
– ‘ তুমি কী ভয় পাচ্ছো আমাকে?’
কাওসার মাথা নিচু করে বললো,
– ‘ না। ‘
– ‘ তাহলে ঠিক ভাবে কথা বলছো না কেনো ? আমার থেকে অনেক ছোট তুমি। তোমার বড় বোনের মতো আমি। আমার সাথে সংকোচ থাকার তো কথা না। ‘
তোহাকে অবাক করে দিয়ে কাওসার বললো,
– ‘ আপনি কি সত্যি স্যারের বউ ? ‘
তোহা কপাল কুঁচকে বললো,
– ‘ হ্যাঁ। তবে এই কথা কেনো ? ‘
কাওসারের চোখ মুখে অস্থিরতা। সে ঢোক গিলে বললো,
– ‘ এমনি। ‘
– ‘ কি লুকাচ্ছো বলো তো। তোমাদের ব্যবহার অদ্ভুত লাগছে আমার। ‘
– ‘ আপনি যদি স্যারের বউ হন তাহলে সমস্যা নেই। আর যদি গার্লফ্রেন্ড হন তাহলে একটু সাবধানে থাকবেন। ‘ কথা শেষ করেই কাওসার দৌড়ে চলে যেতে নিচ্ছিলো। কিন্তু তোহা দ্রুত উঠে তার হাত ধরে ফেললো। চোখ পাঁকিয়ে বললো,
– ‘ কী হয়েছে বলো আমাকে। ‘
– ‘ কিছু না ম্যাডাম। ‘
তোহা ধমকে উঠে বললো,
– ‘ বলো বলছি। না বললে এখনই রাজিবকে গিয়ে বলে দিবো তুমি কি বলেছো আমাকে। তারপর কী হবে বুঝতে পারছো তো ?’
কাওসার ছেলেটা ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে গেছে। নিজেকে যেন গুটিয়ে ফেলতে চাচ্ছে। তোহা ছেলেটাকে আশস্ত করে বললো,
– ‘ আমাকে নির্ভয়ে বলতে পারো। ‘
কাওসার দরজার দিকে গিয়ে একবার দেখে নিলো আশেপাশে কেউ আছে কী না। তারপর ধীর পায়ে তোহার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গলার স্বর নামিয়ে বললো,
– ‘ স্যারের সাথে আগেও একজন এখানে বহু বার এসেছে।’
তোহা চমকে গিয়ে তাকালো কাওসারের দিকে। রাজিব এমন কিছু করতে পারে তা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। তোহা রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– ‘ তুমি কী বলছো বুঝে বলছো তো ? ‘
– ‘ আমি যা দেখেছি তাই বলছি। তার থেকে খারাপ খবর যেটা সেটা হলো মেয়েটা যেদিন শেষ স্যারের সাথে এখানে এসেছিলো সেদিন সে মারা যায়। ‘
– ‘ কী বলছো তুমি! ‘ গর্জন করে বলে তোহা।
– ‘ আমার ধারনা সেদিন ওরাই মেয়েটাকে মেরে ফেলেছে। লাশ কী করেছে কিচ্ছু জানি না। তখনই সাথে সাথেই স্যার আমাকে কিছু টাকা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় ক দিনের জন্য। আমি আর জানি না কিছু। ‘
তোহা ধুম করে বসে পরে বিছানায়। তার মাথার উপর ফ্যান টা খুব দ্রুত গতিতে ঘুরছে। ভন ভন করে শব্দ তুলছে। বৃষ্টির দিনে ঠান্ডা পরিবেশেও তর তর করে ঘামছে তোহা। কিছু সময় এভাবেই সে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার পর বললো,
– ‘ এটা কতদিন আগের কথা ? ‘
– ‘ বেশি দিন না। কয়েক মাস হবে। ‘
– ‘ মেয়েটাকে চিনো তুমি ? বা তার বাড়ির ঠিকানা? ‘
– ‘ আমি জানি না কিছুই। তবে সেই আপুটা অনেক ভালো ছিলো। আমার সাথে সুন্দর করে কথা বলতো। তবে কিছুটা গম্ভির ছিলো। প্রয়োজন ছাড়া বেশি কথা বলতে দেখিনি। লাস্ট কিছুদিন তাদের মাঝে অনেক ঝগড়াও হয়েছে। ‘
তোহা ম্লান চোখে তাকালো কাওসারের দিকে। তার চোখ থেকে অবিরত পানি ঝরছে। মনের মাঝে এখন আরো কিছু প্রশ্ন চলে এসেছে। দুয়ে দুয়ে চার মেলানো শুধু বাকি। তোহা চায় না এটা যেন সত্যি হয়। সে নিজেকে খুব শক্ত করে রাখার চেষ্টা করে বললো,
– ‘ মেয়েটা কী লাস্ট দিন শাড়ি পরে এসেছিলো ? ‘
কাওসার নিজেও একটু অবাক হলো। সে শূন্য চোখে তাকিয়ে বললো,
– ‘ হ্যাঁ। নীল শাড়ি। ‘
নিজের মাথা চেপে ধরে বসে কাঁদতে লাগলো তোহা। মেঝেতে তার চোখের অশ্রু ঝরে পরছে। সে রাজিবকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতো। আর সেই রাজিব কী না তার নিজের বন্ধুর স্ত্রীকে খুন করেছে ! তাকে ঠকিয়েছে! এতো দিনের এতো গুলো মানুষের বিশ্বাস সব ভেঙে দিয়েছে। কী করবে এখন তোহা ? নিজেকে তার ভাইয়ের সামনে নিয়ে দাঁড়া করাবে কিভাবে ? কিচ্ছু বুঝতে পারছে না তোহা। নিজের মাথা চেপে ধরে কান্না করে যাচ্ছে শুধু।