Monday, July 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1608



গুমোট অনুভুতি পর্ব-২৫+২৬+২৭

0

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_২৫

রুশি ছাদে পা ঝুলিয়ে বসে আছে, পাশেই মস্ত বড় তুলো গাছটার ঢাল পড়ে আছে ছাদে। যদিও তুলো গাছের শাখা এমনভাবে পড়ে থাকে কিন্তু অদ্ভুতভাবে এই ছাদে গাছের ঢালটা। কেমন যেনো ওর জীবনের মতো অদ্ভুত! বড্ড অদ্ভুত। এইতো কিছুক্ষণ পুর্বেই ও নিজের রুমে ছিলো, হ্যা কিছুক্ষণ পুর্ব অবদি ওই রুমটা ওর নিজেরই ছিলো তবে এখনো আছে কিনা জানা নেই।

নিজের উপর যেনো নিজেরই হাসি পাচ্ছে, কিছুক্ষণ পুর্বেও সায়ানকে বড্ড আপন মনে হচ্ছিলো! মনে হচ্ছিলো ওর স্বামী সে কিন্তু এখন!

রুশি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে, এই দোতলার ছাদ থেকে নিচটা কতো ছোট দেখা যাচ্ছে। বড়লোকদের কাছে মধ্যবিত্তদের ঠিক যেমন দেখায়। ও নীচ থেকে চোখ সরিয়ে আনমনে ভাবতে লাগলো কিছুক্ষণ পুর্বের ঘটনা,,,

সবেমাত্র ব্রেকফাস্ট করে ও এসেছিলো। ইদানীং বমি বেশি হয়, কোন কিছুর স্মেলই যেনো সহ্য হয়না তাই এসেই বমি করে দিলো।সায়ানও পিছু এসে ওকে ধরলো তারপর আস্তে ওর মুখ মুছিয়ে ঘরে নিয়ে আসলো। কয়েক পা এগুতেই সায়ান থমকে দাঁড়ালো, রুশি এতোক্ষন দুর্বল থাকায় চোখ বন্ধ করে ছিলো কিন্তু সায়ানের থেমে যাওয়া থেকে চোখ মেললো আর দেখে সায়ান সামনে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই দেখে চন্দ্রিকা বিছানায় বসা অবস্থায় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। রুশির বুকটা কেঁপে উঠলো, ইদানীং চন্দ্রিকার কথা মনে হলেই অজানা ভয় খেলে যায়। মনে হয় খুব কাছের কিছু হারিয়ে ফেলবে!

কিন্তু যা ওর না তাতো জোর করে নিজের বলে দাবি করতে পারেনা,এই তিক্ত সত্যিটা ওকে মেনে নিতেই হবে। ও আলতো করে সায়ানের হাত সরিয়ে দিতে নেয় কিন্তু সায়ান ওকে শক্ত করে ধরে রাখে আর রুশির দিকে ভ্রু কুচকে বলে

“কি সমস্যা? এমন ছুটাছুটি করছো কেনো? এমনিতেই শরীর দুর্বল তার উপর আবার নড়াচড়া করে এনার্জি নষ্ট করছো কেনো?”

রুশি খানিকটা অবাক হয়, এই লোকটির কি আদোও জ্ঞান নেই যে সে কি সিচুয়েশনে আছে?তার প্রেমিকার সামনে অন্য একটা মেয়েকে ধরে আছে এটা কি সে বুঝতে পারছে না!এতোটা নর্মাল কি করে আছে যেনো কিছুই হয়নি, যা হচ্ছে সব স্বাভাবিক!রুশির চাহনি দেখে সায়ান বলে উঠলো

“কি এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?চলো ঔষুধ খাবে”

কি স্বাভাবিক লাইন অথচ রুশি হজম করতে পারছেনা আর চন্দ্রিকাও পারছে বলে মনে হচ্ছে না। বেচারি হয়তো শকে আছে এই ভেবে যে ও উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও সায়ান ওকে ইনভিজিবল মি.ইন্ডিয়া ভাবছে।রুশি সায়ানের কথা মতো চুপচাপ মেডিসিন খেয়ে নিলো, এই মুহুর্তে ওর সন্তান থেকে বড় আর কিছুই নয় ওর থেকে। তখনি চন্দ্রিকা হুট করে সায়ানের হাত চেপে ধরলো আর বলে উঠলো

“আম স্যরি সায়ান, এইটুকু একটা ব্যাপার নিয়ে তুমি এভাবে ইগনোর করবে আমাকে?আমি জানি তুমি আমাকে শাহেদের সাথে দেখে রেগে আছো কিন্তু বিশ্বাস করো আমরা জাস্ট বন্ধু ছাড়া আর কিছুই নই। এইটুকুর কারণে তুমি আমাকে ইগনোর করোনা প্লিজ! তুমি আমাকে ইগনোর করলে আমার খুব কষ্ট হয়”

কথাগুলো বলতেই চন্দ্রিকার টলমলে চোখজোড়া থেকে জল গড়িয়ে পড়লো, রুশির খুব খারাপ লাগলো এই দৃশ্য দেখে। ওর মনে হলো ওর জন্য কারো সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে! আসলেই তো এটা খুব কষ্টকর যখন তুমি কাউকে ভালোবাসো আর সে তোমাকে ইগনোর করে।রুশি মাত্র কয়েকমাসের সম্পর্কেই যেনো সায়ানকে ছাড়া ভাবা যেনো দুষ্কর হয়ে গিয়েছে সেখানে এই মেয়েটি সায়ানকে এতোবছর ধরে ভালোবাসে তাহলে সে কি করে মেনে নিতে পারবে?

রুশির ভাবনার মাঝেই চন্দ্রিকা ওকে বলে উঠলো

“আমি সায়ানের সাথে আলাদা কথা বলতে চাই”

রুশি বুঝলো যে ওকে চলে যেতে বলছে, রুশি কিছু বলার পুর্বেই সায়ান বললো

“ও কোথাও যাবে না,ওর শরীর অনেক দুর্বল। তুমি যা বলার বলো”

“সায়ান আমি প্রাইভেট কথা বলতে চাই তোমার সাথে, এখানে ও থেকে কি করবে?”

“চন্দ্রিকা ও বাইরের কেউ নয়!তুমি যা বলার ওর সামনে বলতে পারো”

“সায়ান প্লিজ…”

চন্দ্রিকার দিকে তাকিয়ে রুশি উঠে দাঁড়ালো, ওর এই মুহুর্তে সায়ানকে প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে। অন্য সময় হলে হয়তো ভাবতো সায়ান ওর কেয়ার করছে, ও হয়তো অনেক খুশি হতো কিন্তু এই জিনিসটা ওর তিক্ত লাগছে এখন। সায়ান শুধুমাত্র চন্দ্রিকাকে জেলাস ফিল করানোর জন্য রুশিকে ব্যাবহার করছে কারণ চন্দ্রিকাকে অন্য কারো সাথে দেখে সে জেলাস ছিলো। এই জন্যই হয়তো ওইদিন ওই কথাগুলো বলেছে আর ও কিনা ভেবেছে যে সায়ানের ওর প্রতি ফিলিংস আছে?এতো বোকা কি করে হতে পারে ও?

রুশি দাঁড়াতেই সায়ান বলে উঠলো

“তুমি উঠছো কেনো?শুয়ে থাকো”

রুশি প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না বরং চন্দ্রিকার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো

“আমি বাইরে যাচ্ছি,ইউ গাইজ কেরি অন”

বলেই একমুহুর্তও দাঁড়ালো না, ও জানে সায়ান হয়তো ওর দিকে কয়েককদম আসতে চাইবে কিন্তু তার ভালোবাসা নামক মানুষটা তাকে থামিয়ে দিবে। আর তার আর ওর দিকে আসা হবে না। ঠিকই আসা হয়নি। এইযে এতোক্ষন বসে আছে ছাঁদে তাতে কার কিইবা যায় আসে। রুশির ভাবনার মাঝেই কারো পায়ের শব্দ পেলো তাই কি ভেবে উঠে দাঁড়ালো আর দেখে সামনে চন্দ্রিকা দাঁড়িয়ে। ওর এই মুহুর্তে তার সাথে কথা বলার এক ফোঁটাও ইচ্ছে নেই তাই ও পাশ কাটিয়ে চলে আসতে চাইলো কিন্তু চন্দ্রিকার কথায় থেমে গেলো

“ছেলেদের ভালোই বশে করতে পারো দেখছি!কাউকে প্রেমের ফাঁদে ফেলো আবার কাউকে বাচ্চার ফাঁদে ফেলে জবরদস্তি তার জীবনে ঢুকে পড়েছো!অথচ সাজো এমন যেনো ভাজা মাছটা উল্টে খেতে পারোনা”

“মানুষকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে শিখুন। আমি কিছু বলছিনা তার মানে এই না যে আমি বলতে পারিনা। আগেও বলেছি আর এখনো বলছি আমি আর সায়ান দুজনেই পরিস্থিতির স্বিকার এর বেশি কোন সম্পর্ক নেই আমাদের মাঝে। আপনার এতো বড় মস্তিষ্কে যদি এই ছোট্ট কথা না ঢুকে তাহলে সেটা আপনার ব্যর্থতা!”

রুশির কথা শুনে চন্দ্রিকা প্রচণ্ড রেগে গেলো আর দ্রুত পায়ে রুশির দিকে এগিয়ে আসলো কিন্তু ছাঁদে থাকা পাইপের সাথে বেঁধে ছাদের নিচে পড়ে ছাঁদের নিচের দিকে পড়ে গেলো। রুশি ভয়ে বসে পড়লো,মুহুর্তের মাঝে কি হলো বুঝতে পারছেনা। ঠিক তখনি দেখলো দৌঁড়ে আসছে এদিকে, আচ্ছা সায়ান কি ওকে ভুল বুঝবে? কিন্তু ওতো চন্দ্রিকাকে ধাক্কা দেয়নি ও নিজেই পড়ে গিয়েছে।

এদিকে সায়ান দৌঁড়ে গিয়ে চন্দ্রির হাত চেপে ধরলো তারপর টেনে উঠালো, ভাগ্য ভালো ছিলো যে চন্দ্রিকা যে পাশে পড়েছে সে পাশে সেই তুলো গাছটার শাখা ছিলো আর চন্দ্রিকা সেটাই চেপে ধরে ছিলো। চন্দ্রিকাকে টেনে উঠিয়েই রুশির দিকে এগিয়ে আসলো আর রুশি ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে বললো

“আ্ আমি কিছু করিনি…”

পিছন থেকে চন্দ্রিকা বলে উঠলো

“সায়ান আমি জাস্ট কয়েকটা কথা বলতে এসেছিলাম ওর সাথে, মানছি আমি একটু কঠোর ভাবে বলেছি কিন্তু এই জন্য রেগে ও আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।আমি…”

“ইনাফ চন্দ্রি! রুশি এমন মেয়েই না যে রেগে তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে। আমি সবটা দেখেছি, ড্রাইভারকে বলেছি সে তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিবে ”

“সায়ান আমি আসলে…”

“প্লিজ গো”

চন্দ্রিকা সায়ানের কঠোর ভাষা দেখে উপায়ন্তর না দেখে সিঁড়ির দিকে হাটা ধরলো, যাওয়ার সময় রুশির দিলে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো তারপর চলে গেলো। রুশি তখন সেদিকে তাকিয়ে তখনি গালে কারো হাতের স্পর্শ পেলো, তাকিয়ে দেখে সায়ান বেশ চিন্তিত স্বরে বলছে

“তুমি ঠিক আছো?তোমার কোথাও লাগেনি তো?আমি বুঝতে পারিনি যে চন্দ্রি এখানে আসবে,বুঝতে পারার সাথে সাথেই দৌঁড়ে এখানে এসেছি, আরেকটু দেরি হলে কি হতো?আজ চন্দ্রির জায়াগায় যদি তুমি থাকতে আমি… আম স্যরি রুশি!”

সায়ানের চোখে এই মুহুর্তে রুশি ভয়ের ছাপ দেখছে কাউকে হারানোর ভয় কিন্তু কেনো? কাকে হারানোর ভয়?ওকে নাকি ওর গর্ভে থাকা তার বাচ্চাকে হারানোর ভয়!রুশি সায়ানকে ঠিক বুঝতে পারেনা, এক মুহুর্তে মনে হয় তার চেয়ে আপন কেউ নেই, এতো কিছুর পরেও তার উপর রাগ করে থাকতে পারেনা ও কিন্তু পর মুহুর্তেই মনে হয় এই মানুষটি ওর না। কেনো এতো কেয়ার করে ওর, সে কি বুঝেনা ও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে তার প্রতি?এই দুর্বলতা আরো গভীর হয়ে গেলে ছেড়ে যেতে যে বড্ড কষ্ট হবে ওর। এই মায়া জিনিসটা বড্ড খারাপ, হুট করে জড়িয়ে গেলেও হুট করে ছাড়ানো যায়না!

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_২৬

চন্দ্রিকা হনহন করে নিজের এপার্টমেন্টে ঢুকলো আর হাতে থাকা নিজের ব্যাগ ছুড়ে মারলো। এতোক্ষন জমে থাকা সকল রাগ যেনো এখন বেরিয়ে এলো যা সায়ানের সামনে খুব কষ্টে সামলে রেখেছিলো। সায়ানের হঠাৎ এতোটা বদলে যাওয়া ও মেনে নিতে পারছে না, ওই দুইদিনের মেয়ের জন্য সায়ানের এতো দরদ দেখে চন্দ্রিকা রাগে থরথর করে কাঁপছে। সায়ান রুশিকে এতোটা বিশ্বাস কবে থেকে করে! আগে সায়ানের চোখে যে ভরসা ওর জন্য দেখতে পেতো আজকাল সেটা আর দেখতে পায়না, মনে হয় শুধুমাত্র দায় সারাতে সায়ান ওকে নিজের কাছে রাখছে নাহয় এতদিনেও সায়ান ওর খোঁজ নিলো না আর না ফোন দিলে ফোন ধরেছে।

তারউপর আজ ওকে নিজের এপার্টমেন্টে দিয়ে গেছে!কিছুক্ষণ পুর্বে ড্রাইভারকে যখন জিজ্ঞেস করলো ওকে এখানে কেনো নিয়ে এসেছে? সায়ানের বাড়িতে কেনো নিয়ে যায়নি।তখন ড্রাইভার বলেছে যে সায়ান নাকি তাকে এখানে নিয়ে আসতে বলেছে এবং এটাও বলেছে যে চন্দ্রিকা যাতে এখন থেকে এখানেই থাকে। বিষয়টি চন্দ্রিকার আত্মসম্মানে লেগেছে, এর পুর্বে কখনোই সায়ান ও বাড়িতে যেতে না করেনি বরং বলেছে তুমি এখানে থাকতে চাইলে থাকতে পারো!

চন্দ্রিকার রাগের বশে চাদর খামচে ধরলো খুব জোরে, সায়ানের জীবনে রুশির আসাটা সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো আর সে ভুলটা ও নিজে হতে দিয়েছে। রুশির চেহারা দেখে সায়ান প্রেমে পড়েছে যেটা ও ভেবেছিলো পড়বে না। চন্দ্রিকার পাশে থাকা বালিশ ছুড়ে মারলো ও, রাগে ও থরথর করে কাঁপছে আর বলছে!

“সব জেনে গেছে সায়ান সব! যা এতোদিন লুকিয়ে রেখেছি সব জেনে গেছে”

চন্দ্রিকা কিছুক্ষণ পুর্বে সায়ানের সাথের কথোপকথন নিয়ে ভাবছে, রুশি যেতেই চন্দ্রিকা ইচ্ছে করেই শব্দ করে দরজা লাগিয়েছে যাতে রুশি বুঝতে পারে এই ঘরের মালকিন ও, রুশি শুধুমাত্র কয়েকদিনের মেহমান ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রয়োজন শেষে তাকে ফিরে যেতে হবে!চন্দ্রিকা সায়ানের দিকে তাকিয়ে বলে

“আমি জানি না রুশি মেয়েটা কেমন তবে আমার তাকে ভালো লাগে না, আমি তাকে তোমার সাথে একসাথে দেখতে পারিনা আমার বড্ড কষ্ট হয়, হিংসে হয় আমার। তোমাকে বড্ড ভালোবাসি সায়ান আমি, আমি জানি ও শুধুমাত্র তোমার দায়িত্ব কিন্তু আমি যে সহ্য করতে পারিনা ওকে, কোন নারিই পারবে না তার ভালোবাসার ভাগ কাউকে দিতে। আমি তারপরও ওকে মেনে নিয়েছি তোমার জন্য তবে তিনবছর পর্যন্ত তুমি ওকে রাখতে পারবে না আর তোমার বাচ্চা যদি তোমাকে বাবা বলে তাহলে আমি চাই সে মা আমাকে বলবে। তুমি বেবি হওয়ার পর সে বেবি আমাকে দিয়ে দিয়ো, আমি তাকে নিজের সন্তানের মতো বড় করে তুলবো। রুশি নামক মেয়েটার কোন প্রয়োজন নেই, আমি ভাববো সে শুধুমাত্র সারোগেট ছিলো এর বেশি কিছু না। তুমি কথা দাও আমায়”

চন্দ্রিকা করুণ চাহনিতে তাকিয়ে বললো, কতোটা অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে চেহারায়! সায়ান তার দিকেই তাকিয়ে আছে, আদোও এর কতোটুকু সত্যি? সায়ান গম্ভীর গলায় বললো

“আমি পারবো না, এটা কখনোই সম্ভব নয়। এই সন্তানের বাবা যেমন আমি তেমনি রুশি তার মা আর তার সন্তান থেকে তাকে আলাদা করার অধিকার আমার নেই।আমার সন্তানের মা রুশিই থাকবে আর কেউ না যেমন তার সন্তানের বাবা আমি। এই অন্যায় আবদার করার পুর্বে তোমার ভাবা উচিৎ ছিলো চন্দ্রি!”

“সেই কখন থেকে রুশি রুশি করে যাচ্ছো তুমি,সেই মেয়েটা তোমার লাইফে এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো?তাহলে আমি কে তোমার লাইফে? আমার কোন গুরুত্ব নেই তোমার কাছে?তার প্রতি তোমার এতো দরদ আর আমার প্রতি?তুমি ভুলে গেছো সায়ান যে তুমি আমাকে ওয়াদা করেছো তুমি শুধু আমার থাকবে?আমাকে ভালোবাসবে!তুমি নিজের দেয়া কথা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে?”

“আমি তা কখনোই বলিনি”

“কিন্তু আমি তো অন্য কিছু দেখতে পাচ্ছি সায়ান! তুমি ওই মেয়েটার সাইড নিচ্ছো তার সাথে একই রুমে থাকছো আমি এগুলো কেনো মেনে নিবো বলতে পারো?তারউপর তুমি বলেছো তুমি নাকি এ বাড়িতে আর কখনো পা রাখবে অথচ গত একমাস এখানেই আছো, মিসেস খানের সাথে তোমার ভালো সম্পর্ক আর তাতে আমার কোন আপত্তিও নেই। কিন্তু তুমি ওই মেয়েটির সাথে জড়াচ্ছো কেনো?আমার বিশ্বাসের কি কোন মুল্যেই নেই তোমার কাছে?”

“আমার বিশ্বাসের মুল্য আছে তোমার কাছে?”

“মানে কি বলতে চাইছো তুমি?আমি কখন তোমার বিশ্বাস ভেঙেছি?”

সায়ান জবাবে কিছু বললো না, সরাসরি নিজের সাইডের ড্রায়ার খুলে তার থেকে কিছু ছবি বের করলো আর চন্দ্রিকার সামনে খাটে ছুড়ে মারলো।চন্দ্রিকা বুঝতে না পেরে সেগুলো দেখতে থাকলো,আর ওর আত্মা কেঁপে উঠলো। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সায়ানের দিকে তাকালো, তা দেখে সায়ান বললো

“এটা ওইদিনের ছবি যেদিন রুশি আর আমি একসাথে ওই হোটেল রুমে ছিলাম আর সেই একই হোটেলে, একই দিনে এবং কাছাকাছি সময়ে তুমি সেখানে ছিলে তাও এই ছেলে গুলোর সাথে যারা উইমেন ট্রাফিকিং এর সাথে জড়িত। কেন ইউ এক্সপ্লেইন হোয়াট অয়ার ইউ ডুইং দেয়ার?”

“সায়ান আই কেন এক্সপ্লেইন! তুমি যা ভাবছো এমন কিছুই নয়। আমি জাস্ট তাদের সাথে কথা বলছিলাম, আমি তো চিনিও তাদেরকে!”

“কিন্তু ওরা তো অন্য কিছু বলেছে চন্দ্রি!ওরা বলেছে তুমি তাদের টাকা দিয়েছো একটা মেয়ে দেয়ার জন্য যাতে তাকে আমার ঘরে পাঠাতে পারো। আরোও বলেছো যে মেয়েটি যাতে সুন্দর না হয় কিন্তু সেই ছেলেগুলোর কাছে ওই মুহুর্তে অন্য কোন মেয়ে ছিলো না বরং রুশি ছিলো যাকে তারা রুশির ফেন্ড থেকে কিনে নিয়েছে। তারা অনেক বেশি টাকা দেখে লোভ সামলাতে না পেরে লাকিলি রুশিকে আমার রুমে পাঠিয়ে দেয়। এদিকে তুমি কৌশলে তাদের দিয়ে আমার ড্রিংকয়ে ড্রাগস মিশাও যাতে সেই মেয়েটার সাথে আমি…”

সায়ান হাত মুঠো করে ফেলে, রাগে ওর মুখ হয়ে আছে। সায়ান চন্দ্রির দিকে আবার তাকিয়ে বলে

“তারপর তুমি নিজে গিয়ে সেই মেয়েকে চেক করেছো আর যখন দেখেছো রুশি দেখতে বেশ সুন্দরি তুমি তখন রেগে গিয়েছিলে কিন্তু তোমার হাতে পর্যাপ্ত সময় না থাকায় তুমি আর রুশিকে রিপ্লেস করতে পারোনি। কারণ এমন সুবর্ণ সুযোগ দ্বিতীয়বার নাও পেতে পারো।তাই তুমি রুশিকে চেক করে সেই রুম থেকে বেরিয়ে পড়ো, আর ওই রুম আমার নামে বুক করা ছিলো। খারাপ লাগায় আমি সেখানে রেস্ট নিতে যাই আর তোমার কথায় কেউ একজন দরজা বাইরে থেকে লক করে দিয়ে চলে যায়।সব ঠিকঠাক মতো বলেছি তো?”

সায়ানের চাহনিতে চন্দ্রিকা ভয় পাচ্ছে, কারো শান্ত চাহনি এতোটা ভয়ংকর হতে পারে ওর জানা ছিলো না, চন্দ্রিকা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ও ভাবতে পারেনি সায়ান এভাবে সব জেনে যাবে। ওই ছেলেগুলোকে তো…

“কি আমি সত্য বলায় তোমার রাগ হচ্ছে?তাহলে আমার কেমন লাগছে বলোতো!এখন তুমি আমায় এটা বলো কেনো করেছো এমনটা, রুশির মতো নিষ্পাপ মেয়ের জীবন নিয়ে কেনো খেলেছো?তুমি তো আমায় ভালোবাসো তাই না?তাহলে ভালোবাসার মানুষকে অন্যের হাতে তুলে দিতে তোমার বাধলো না?নাকি শুধু মুখেই বলো!তোমার ধারণা আছে কতোটা গিল্টি ফিল করছিলাম আমি, বারবার মনে হচ্ছিলো আমি তোমায় ঠকাচ্ছি, জানলে তুমি বড্ড কষ্ট পাবে কিন্তু ঠকেছি তো আমি!তুমি জানতে আমি ধোকা সহ্য করতে পারিনা তবুও তুমি আমায় ধোঁকা দিলে। বলো কেনো করেছো এমন?”

সায়ান শেষ কথাটা এতোটাই জোরে ছিলো যে পুরো ঘর যেনো কেঁপে উঠেছে, চন্দ্রিকা ভয়ে আঁটসাঁট হয়ে আছে। সায়ানের এই ভয়ংকর রুপ আগে কোনদিন দেখেনি। চন্দ্রিকে কিছু না বলতে দেখে সায়ান তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো! তারপর বললো

“এটার জবাবও আমি দিচ্ছি, কারণ তোমার একজন সারোগেট মাদার প্রয়োজন ছিলো কিন্তু আমাকে বললে আমি রাজি হতাম না তাই এতো সুন্দর প্ল্যান সাজিয়েছো আর আমাকে বোকা বানিয়েছো! একদিকে আমি গিল্টি ফিল করছিলাম অন্যদিকে তুমি সারোগেট মাদার পেয়ে গেলে নিজের জন্য।মানে এক ঢিলে দুই পাখি মারলে, মানতে হবে তোমার এক্টিং স্কিল দুর্দান্ত ছিলো। এক মুহুর্তের জন্যও আমার মনে হয়নি এই নিষ্পাপ চেহারার পেছনে এই রুপটা লুকিয়ে ছিলো”

সায়ানের কথা শুনে চন্দ্রিকা কেঁদে দিলো, তার ফুঁফাতে ফুঁফাতে বললো

“আমি কখনো মা হতে পারবো না সায়ান!আবার তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার ক্ষমতাও আমার নেই কিন্তু তোমাকে বাবা হওয়ার সুখ থেকে কি করে বঞ্চিত করি আমি?আমি চেয়েছি তুমি বাবা ডাক শুনো আর আমাকেও কেউ মা বলে ডাকুক।কিন্তু তোমাকে বললে তুমি রাজি হতে না আর যদি আমাকে ছেড়ে দাও!তাই এইভাবে এইসব কিছু করতে বাধ্য হয়েছি।আমি মা ডাক শোনার লোভ সামলাতে পারিনি সায়ান আর না তোমাকে অপুর্ণ রাখতে চেয়েছি। আমার অপুর্ণতার জন্য তোমাকে বাবা ডাক থেকে বঞ্চিত করতে চাইনি। আমি জানি আমি ভুল তবে আমার নিয়ত ভুল ছিলো না, আম স্যরি সায়ান ”

সায়ান চন্দ্রিকার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো তারপর শান্ত স্বরে বললো

“তুমি যদি আমায় বলতে যে তুমি মা হতে পারবে আমি খুশি খুশি মেনে নিতাম, দরকার হয় আমরা এতিমখানা থেকে বাচ্চা এডপ্ট নিতাম, অনেক বাচ্চা আছে যাদের বাবা মা দরকার। আমরা তাদের একজনকে নিয়ে সুখে থাকতাম কিন্তু এই সবের মাঝে রুশিকে জড়িয়েছো! ওর এতোসুন্দর জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছো, বিয়ের পুর্বে একটা মেয়ের মা হওয়াকে এই সমাজ কিভাবে দেখে তুমি জানো?একজন নারী হয়ে আরেকজনের সাথে কি করে এমন জঘন্য কাজ করলে?এখন আমার জীবনের সাথে রুশি জড়িয়ে আছে চন্দ্রি, সে আমার স্ত্রী, আমার সন্তানের মা! তার সম্পুর্ণ অধিকার আছে আমার সবকিছুর উপর আর সেই অধিকারের সুযোগ তুমি দিয়েছো তাকে। তোমার ভালোবাসায় তুমি অন্যকে স্বেচ্ছায় ভাগ দিয়েছো তাহলে এখন কেনো সহ্য করতে পারছো না?তুমি বড্ড অন্যায় করেছো।”

“আম স্যরি সায়ান, ওই মুহুর্তে আমার মাথায় আর কিছু আসেনি। আর রুশিতো এখানে ভালোই আছে,তুমি ভবিষ্যৎ ঠিক করে দিবে আর কি চাই ওর?ওর আমার ভালোবাসায় ভাগ বসানোর কি দরকার?”

“তোমার স্যরি সত্য বদলে যাবে না, তুমি যা করেছো তা ভুল করেছো তাই তার মাশুল তোমায় দিতে হবে। রুশি আমার জীবনের সাথে জড়িত, অন্য সব যদি বাদও দেই অন্তত আমার সন্তানের জন্য আমার ওকে চাই। ও আমার স্ত্রী আর এই সত্যিটা তোমাকে মেনে নিতে হবে,তোমার প্রতি আমার আর কিছু থাকুক আর না থাকুক সম্মান টা বড্ড বেশি ছিলো। আমি ভাবতেই পারছিনা তুমি এমন জঘন্য একটা কাজ করেছো। আমি তোমায় কোনদিন ক্ষমা করতে পারবো না চন্দ্রি, কোনদিন না”

“সায়ান প্লিজ আমি…”

“প্লিজ তুমি এখান চলে এখন, আমি এমন কিছুই এখন বলতে চাচ্ছি না যা শুনে তুমি কষ্ট পাবে কিন্তু নিজের প্রতি বেশিক্ষণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবো না।আই বেগ ইউ প্লিজ গো!”

বলেই সায়ান বারান্দায় চলে গেলো, চন্দ্রিকার দিকে এক মুহুর্ত তাকায়নি। চন্দ্রিকা কতোক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। এই মুহুর্তে বুঝতে পারছে ও কতো বড় ভুল করেছে, নিজের হাতে নিজের অধিকার হারিয়েছে।সায়ান কি তবে আর ওর দিকে ফিরে তাকাবে না? ওদের কাটানো সকল মুহুর্ত এক নিমিষেই ভুলে যাবে!

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_২৭

শীতের দুপুরের রোদ খুব মৃদু হয়,শরীরে আলাদা আরাম দেয়। গ্রাম বাংলার বাচ্চা থেকে বুড়ো মানুষগুলো গোসল সেরে সারি বেঁধে রোদ শুকাতে বসে পড়ে, কেউ বা সদ্য গোসল করে আসাতে রোদের মাঝেও কাঁপতে থাকে, চাদর মুড়িয়ে শীত কমানোর প্রচেষ্টায় থাকে। শহরের মানুষ শীতকাল সঠিকভাবে উপভোগ করতে পারে না, তারা হাড় কাঁপানো শীতের আনন্দ বা কষ্ট কোনটিই উপলব্ধি করতে পারে না। চারপাশে জনসমাগম এতোই বেশি যে প্রকৃত শীত ধরা যায়না, তবে কিছু ভেতরের দিকে গ্রামের মতো এলাকার দিকে এলে আর বাইরে থাকলে শীতের উপলব্ধি করা যায় কিছুটা হলেও।

এই যেমন এই মুহুর্তে সায়ান বুঝতে পারছে, পরনে কালো শার্ট খুব বেশি মোটা নয়, তাই পৌষ মাসের শীতের কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে ও। দুহাত দিয়ে নিজেকেই যেনো জড়িয়ে ধরার ব্যার্থ প্রচেষ্টা করলো তবে নিজের স্থান থেকে এক চুলও নড়লো না, আশেপাশে মিইয়ে যাওয়া কিছু কাশফুল গাছ দেখা যাচ্ছে, এখন কাশফুলের সময় নয় তবে এখানে কিছু অংশ দেখে সায়ান অবাক না হয়ে পাড়লো। এছাড়া পুরো মাঠটাই ফাঁকা, দূর দুরান্তে কিছুই চোখে পড়ছে না তবে কানে গাড়ির শব্দ ভেসে আসছে। সায়ান চুপচাপ বসে রইলো, নিজের জীবনের হিসাব মিলাচ্ছে।

ও কিছুতেই ভাবতে পারছে না চন্দ্রিকা এমন একটা কাজ করবে। ধীরেধীরে যেনো চন্দ্রিকা নামক মেয়েটির আসল চেহারা ওর সামনে ফুটে উঠছে! কতোগুলো জঘন্য কাজ ও করে ফেললো বিনা দ্বিধায়,এই চন্দ্রিকাকে ও চেনে না। ছয়বছর পুর্বে যখন সেই বাচ্চা মেয়েটাকে দেখেছিলো তখন সত্যি বলতে ওর খুব মায়া কাজ করেছিলো, জীর্ণশীর্ণ দেহ আর মলিন চেহারা দেখে ওর খুব দুঃখ হয়ে ছিলো। ওর খারাপ লেগেছিলো যে ওর প্রান বাঁচিয়েছে সে এতোটা শোচনীয় অবস্থায়! নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হচ্ছিলো যে ও আগে কেনো খুজে পায়নি এই মেয়েটিকে?প্রায় সাথে সাথেই নিজের সাথে নিয়ে আসতে চেয়েছিলো কিন্তু সেই আশ্রমের প্রধান বেঁকে বসলেন, প্রশ্ন করে বসলেন যে কি পরিচয়ে তাকে নিয়ে যাচ্ছে!

সায়ান থমকে ছিলো কয়েক মুহুর্তের জন্য, কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। এটা নিশ্চই বলতে পারবে না যে ও চন্দ্রিকাকে এডপ্ট করে নিয়ে যাবে কারণ ওদের বয়সের পার্থক্য ছিলো মাত্র ছয় বছর। সায়ান ভেবে পাচ্ছিলো না যে কি বলে সে তার ছোট্ট পরিকে এখান থেকে নিয়ে যাবে যে তার জীবন বাঁচিয়েছে। ও বড্ড কৃতজ্ঞ ছিলো তার প্রতি, হুট করে বলে ফেললো যে ও মেয়েটিকে বিয়ে করবে যখন মেয়েটি প্রাপ্ত বয়স্ক হবে। বিশ বছর বয়সে বেশ সাহসিকতার সাথে জবাব দিয়েছিলো সেদিন, তারপর চন্দ্রিকাকে নিজের সাথে নিয়ে আসে। মেয়েটাকে সাথে করে নিজের বাসায় নিয়ে আসে, প্রায় অনেকদিন পর্যন্ত ভালোই ছিলো খান বাড়িতে। চন্দ্রিকার সাথে ঠিক মতো দেখা হতো না ওর, সে নিজের মতো থাকতো আর ও ওর মতো। কিন্তু বাঁধ সাধল মিসেস খান, হুট করেই চন্দ্রিকাকে মারার প্ল্যান করে যাতে সায়ান খুব কষ্ট পায় আর চন্দ্রিকাও খুব ভয় পেয়েছিলো সাথে হসপিটালে ছিলো অনেকদিন। নিজের যে জীবন বাঁচিয়ে তার শোচনীয় অবস্থা মেনে নিতে পারেনি ও তাই রাগের বসে ঘর ছেড়ে দেয়।চন্দ্রি সেদিন ভয়ে আঁটসাঁট হয়ে বলেছিলো

“আমি ভয়ে আছি সায়ান, ঠিক মতো ঘুমাতে পারছিনা। মনে হচ্ছে চোখ বন্ধ করলে কেউ মেরে ফেলবে, প্লিজ সেভ মি। আমার মতো অনাথকে সাহায্য করো।”

“আমি তোমার পাশে আছি চন্দ্রিকা, তুমি পেয়ো না। আমি থাকতে কেউ তোমার কিছু করতে পারবে না”

“কিন্তু আমি আপনার পাশে কি পরিচয়ে থাকবো? সবাই তো দিনশেষে আমার দিকে আঙুল তুলবে আর কোথাও আমি সেফ থাকবো না”

সায়ান চুপ হয়ে গেলো তারপর কিছুক্ষণ ভেবে বললো

“ইউ আর মাই ফিয়ন্সি ফ্রম নাউ অন। আমার বাগদত্তার গায়ে হাত দেয়ার সাহস কারো নেই। তুমি যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হবে এবং গ্রেজুয়েশন কম্পলিট করবে তখন আমরা বিয়ে করবো।”

সায়ান আর চন্দ্রিকার সম্পর্কের কথা পুরো দুনিয়া জানতো তাই এরপর কেউ চন্দ্রিকার দিকে আঙুল তুলে নি। তবে চন্দ্রিকা নিজেকে প্রাপ্তবয়স্ক অনেকবার দাবি করলেও সায়ান এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায়নি, ও নিজেকে এবং চন্দ্রিকাকে সময় দিতে চেয়েছিলো কিন্তু তার মাঝেই হঠাৎ রুশি চলে ওর জীবনে। নাহ রুশি চলে আসেনি বরং চন্দ্রিকা ওকে ইচ্ছে করে নিয়ে এসেছে ওর লাইফে।আর সত্যি বলতে সায়ান খুব খুশি যে রুশি ওর লাইফে আছে, ও খুব খুশি যে ও বাবা হতে চলেছে আর তার থেকেও অনেক বেশি খুশি যে ওর বাচ্চার মা অন্য কেউ নয় বরং রুশি!

সায়ান চোখ বন্ধ করে নিলো,চন্দ্রিকার এই রুপটা ও কখনো আশা করে নি। সেই ছোট পিচ্ছি মেয়েটি যার একটা নিষ্পাপ চেহারা ছিলো তার সাথে এর যেনো কোন মিল নেই। এতোদিন যে চেহারা দেখে ওর মায়া হতো আজ সেই চেহারা দেখে শুধুমাত্র মনে হয়েছে ‘কি নিখুঁত অভিনয়!”
তাহলে আগের সেই কান্না,বারবার ভালোবাসা জাহির করা সব অভিনয় ছিলো না?

নারী সত্যিই রহস্যময়ী! এদের চেনা বড় দায়, সহজ সরল চেহারার পেছনে কতো শত রহস্য লুকিয়ে।আর রহস্যের মায়াজালে নিজেকে বোকা ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। আচ্ছা রুশিও তো নারী কিন্তু তার মাঝে এতো জটিলতার কোন আঁচ নেই নাকি ও সেই জটিলতা দেখতেই পায়না। রুশির মাঝেও কি এরুপ রহস্য বিরাজ করে?আর যদিও করেও তবে সায়ান খুঁজতে চায় কিন্তু বুঝতে চায়না কারণ রহস্য উদঘাটন হয়ে গেলে আগ্রহ নিতান্তই কমে যায় আর ও চায়না রুশিকে জানার, বোঝার ওর কাছে থাকার বিন্দুমাত্র আগ্রহ কমুক। ও আজীবন এই রহস্যে নিজেকে হারাতে চায়।

রুশির কথা ভাবতেই সায়ানের ঠোঁটের কোন হাসি ফুটে উঠলো,মেয়েটা বড্ড অদ্ভুত! সবার থেকে আলাদা, এই এতোদিন বিয়ের বয়স হলো ওদের কিন্তু কখনো সায়ানের প্রতি আগ্রহ দেখায়নি। নিজ থেকে সায়ানের সাথে থাকতে চায়নি, সায়ান খুব করে চায় রুশি ওর উপর অধিকার দেখাক। ওর কলার চেপে জোর করে বলুক

“ইউ আর মাই ম্যান!ওই সব চন্দ্রিকাকে যতো তাড়াতাড়ি ভুলে যাবেন ততই মঙ্গল”

সায়ান আলতো হাসলো, রুশির বাঘিনী রুপ দেখতে ইচ্ছে করছে ওর। রাগলে রুশিকে ঠিক কেমন লাগে তা দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে, নিশ্চই সরু নাকটা লাল হয়ে যাবে! চোখগুলো বড় বড় হয়ে যাবে আর কপাল কুচকে যাবে। অসম্ভব সুন্দর লাগবে হয়তো!সায়ানের ভাবনার মাঝেই কেউ একজন ধপ করে পাশে বসলো তারপর সায়ানের গায়ে চাদর দিয়ে দিলো। সায়ান পাশে তাকিয়ে দেখলো ইনান, ও খানিকটা অবাক হলো। তা দেখে ইনান বললো

“অবাক হওয়ার কিছু নেই, আদিকাল থেকেই জানা যদি সায়ান জামিল খান হুট করে হারিয়ে যায় তাহলে তাকে এখানেই পাওয়া যাবে। কারণ তার মন খারাপ হলে তিনি দুনিয়াদারি ছেড়ে এখানে এসে দুঃখ বিলাশ করেন।কিন্তু দুঃখবিলাস করছেন ভালো কথা, আই এপ্রিশিয়েট ইট বাট ফোন কেনো অফ রাখেন? বাড়ির সবাই টেনশন করছে সেদিকে কি আপনার খেয়াল আছে? আন্টির টেনশনে বিপি হাই হয়ে গেছে আর সামু তাকে সামলাচ্ছে। এদিকে রুশি নাকি না খেয়ে…”

ইনানের কথার মাঝ পথেই থামিয়ে দিলো সায়ান আর শান্ত স্বরে বললো

“ভাবি! রুশি ভাবি হবে তোর। আমার বউ তো ভাবিই হবে তাইনা?”

উত্তরে ইনান কিছু বললো না,শুরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কাউকে চাইলে এতো সহজেই ভোলা যায়না আর সে যদি হয় চার বছরের ভালোবাসা! শত চেষ্টা করলেও মনের কোন এক কোনে থেকেই যায় কিন্তুর সামুর সাথে খুব থাকলে খুব একটা মনে পড়ে না। ওর বিশ্বাস একসময় ও ভুলেই যাবে ওই পাগলির পাল্লায় পড়ে হয়তো ও নিজেও তাই চায়!ভুলে যেতে নিজের ফেলে আসা অতীতকে যার থেকে ও কিছুও পায়নি শুধুমাত্র অপুর্ণতা ছাড়া!

ইনান সায়ানের দিকে তাকালো, চেহারায় সিরিয়াস ভঙ্গি। ইনানের মনে হলো সায়ানকে কিছু কথা বলা উচিৎ, এটা হয়তো সবার ভবিষ্যতের জন্যই ভালো কারণ এতে তিন তিনটি মানুষের জীবন জড়িয়ে। এই বিষয়ে কথা বলা হয়তো আগেই প্রয়োজন ছিলো তবে এখনো বেশি দেরি হয়নি।ও শান্ত স্বরে বললো

“সায়ান! আমার কিছু বলার ছিলো তোকে অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম তোকে বলবো কিন্তু বলা হয়নি আজ সুযোগ যেহেতু পেয়েছি তাই বলেই দেই।”

#চলবে

গুমোট অনুভুতি পর্ব-২২+২৩+২৪

0

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_২২

সায়ানের পুরাতন বাড়িতে সায়ান সোফায় বসে আছে, চোখমুখ শক্ত করে কতক্ষণ পর পর মেইন দরজার দিকে তাকাচ্ছে ও। প্রায় আধ ঘন্টা ধরে বসে আছে ওখানে কিন্তু চন্দ্রিকার আসার কোন খবর নেই!হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো আর সায়ান মেইডকে ইশারায় দরজা খুলে দিতে বললো। মেইড দরজা খুলতেই চন্দ্রিকা ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলো আর ফোনে কারো সাথে কথা বলছিলো!

“চিন্তা করোনা আমি ঠিক আছি আর বাসার ভেতরে পৌঁছে গেছি। তুমি…”

সায়ানের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রিকা থমকে গেলো, আমি রাখছি বলে ফোনটা খট করে কেটে দিলো। প্রথমে চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে উঠলেও পরে তা হাসিতে পরিণত হলো। সায়ানের দিকে এগিয়ে এসে বললো

“তুমি কখন এসেছো?আমাকে বলোনি কেনো যে তুমি আসছো? তুমি এতোদিন ঠিক করে আমার সাথে কথা বলোনি আর না এখানে এসেছো আমি কতো রাগ করেছি জানো?স্যরি না বলা পর্যন্ত তোমার সাথে আড়ি”

সায়ান চন্দ্রিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কতোক্ষণ! কতো নিষ্পাপ চেহারা তার, চোখে মুখে মুহুর্তেই যেনো সরলতা ফুটে উঠেছে কিন্তু…
সায়ান নিজের চোখ মুখ শক্ত করে ফেললো আর বললো

“ফোনে কে ছিলো?”

সায়ানের শক্ত কন্ঠ শুনে চন্দ্রিকা হচকিয়ে গেলো, আমতাআমতা করে বললো

“তেমন কে্ কেউ না, ওইতো ফ্রে্ ফ্রেন্ড”

“ফ্রেন্ড? আমার জানা মতে তোমার কোন ফ্রেন্ড ছিলো না এতোকাল যাবৎ। সবসময় বলো আমি তোমার ফ্রেন্ড, ভালোবাসা সবকিছু আর কারো দরকার নেই তোমার। হঠাৎ তোমার ফ্রেন্ডের দরকার হয়ে গেলো?কোথা থেকে পেলে এই ফ্রেন্ড?”

চন্দ্রিকা কিছুটা ভয় পেয়ে সায়ানের হাত চেপে ধরলো তারপর বললো

“তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো সায়ান?”

“আমি শুধু প্রশ্ন করেছি!সন্দেহের কথা কোথা থেকে আসছে এখানে?”

“আমি আসলে… তুমি তো এখানে আসো না আর আমিও খুব লোনলি ফিল করছিলাম তাই সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে পরিচয় হয় ওর সাথে। অনেক ভালো মানুষ ও”

“আসলেই অনেক ভালো ছেলে তাই নিজ দায়িত্বে তোমায় নামিয়ে দিয়ে গেলো আবার কপালে কিস করে গেলো। ইটস কমন ইন ফ্রেন্ডস! যাইহোক কোথায় ছিলে এতোক্ষন?”

চন্দ্রিকা সায়ানের কথা শুনে ওর হাত ছেড়ে দিলো তারপর ভয়ার্ত চোখে সায়ানের দিকে তাকালো। চন্দ্রিকার চাহনি দেখে সায়ান বলে উঠলো

“মেইড থেকে শুনলাম হসপিটালে গিয়েছিলে তাইতো? কেনো গিয়েছিলে?”

“রেগুলার চেক আপ এর জন্য, তুমি বিজি ছিলে তাই জানাইনি।আম স্যরি এরপর থেকে জানিয়ে যাবো!”

“হুম টেক কেয়ার”

বলেই সায়ান উঠে দাঁড়ালো তারপর বেরিয়ে পড়লো ঘর থেকে, চন্দ্রিকা কয়েকবার ডাকলেও সাড়া দিলো না সায়ান। চন্দ্রিকা হতাশ হয়ে বসে রইলো সেখানে, ও বুঝতে পারেনি শাহেদ মানে ওর ছেলে হুট করে ওর কপালে কিস করবে তাও এখানে!আর সায়ান তা দেখেও ফেলেছে, কি ভাবছে সায়ান?

___________________________

সামু আয়নার সামনে বসে চুল আচড়াচ্ছে, ছোট থেকেই ওর বড় চুল রাখার শখ ছিলো তাই লম্বা চুলগুলো হাটু অবদি ঠেকেছে!কোন একদিন ইনানকে বলতে শুনেছিলো যে ওর লম্বা চুল ওয়ালা মেয়েদের দেখতে ভালো লাগে, ব্যাস এরপর থেকে আর কখনো চুলে কাঁচি চালায় নি। খুব যত্নসহকারে বড় করেছে এগুলোকে। ভাবতেই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো, সেই মানুষটি এখন আর ওর জীবনে নেই তাই তার সাথে জড়িত সকল কিছু ও নিজের থেকে আলাদা করে ফেলবে!

আজ তিনদিন হলো ইনানের সাথে ওর দেখা হয়েছে, সেদিন ও অনেক জায়াগায় ঘুরেছে। রোলার কোস্টারে উঠেছে, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেয়েছে,রমনার বড় গাছটায় নিজের আর ইনানের নাম লিখে এসেছে আর কতোকি!সেই এখন অতীত, বর্তমানে এর কোনকিছুই অবশিষ্ট নেই। ও ওর জীবনের বেশিরভাগ সময় ইনানকে নিয়ে ভেবেছে, কিন্তু আর ভাববে না। জীবনটাকে নিজের মতো করে সাজাবে আর কারো জন্য অপেক্ষা করবে না আর কারো জন্য কাঁদবে!মানুষ ভালোবেসে মরে যায়না,তাই ও মরবে না। হয়তো একটু কষ্ট হবে কিন্তু ঠিক নিজেকে সামলে নিতে পারবে ও। এখন থেকে একটু একটু করে নিজেকে ভালোবাসা শিখবে, নিজের আর তাদের জন্য বাঁঁচবে যারা ওকে ভালোবাসে। ও ওই সবকিছু করবে যা ওর ভালোলাগে, অন্যের ভালোলাগায় নিজের জীবন সাজাবে না!

কথাগুলো ভাবতেই সামুর চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো ধীর পায়ে ড্রয়ার থেকে কাঁচি বের করলো তারপর চুলগুলো ধরে কোমর অবদি কেটে ফেললো, অন্যের ইচ্ছায় থাকা কোন জিনিস ও নিজের কাছে রাখবে সেটা যতো শখেরি হোক না কেনো?চুলগুলো গুছিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে একটা লম্বা শাওয়ার নিলো তারপর ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিচে নেমে এলো। কয়েক সিঁড়ি বাকি থাকতেই সোফায় নজর গেলো, ইনানের আম্মু আন্টি বসে আছে। সামু ছোট থেকেই মিসেস চৌধুরীর সাথে খুব ফ্রি তাই তার পাশে গিয়ে তার সাথে গল্প করা শুরু করলো। ওর মনটা এখন বড্ড হাল্কা লাগছে, মনে হচ্ছে অনেকদিন পর প্রান খুলে হাসছে। এতো সব জঞ্জালের মাঝে নিজেকে খুজে পেয়েছে, হ্যা ও নিজেকে খুজে পেয়েছে!ও বিড়বিড় করে বললো

“আই নিডেড টু লুজ ইউ টু ফাইন্ড মি”

সামু মাথা তুলে সামনে তাকাতেই দেখে ইনান খাবারের ডিশ হাতে রান্নাঘর থেকে বের হচ্ছে আর মিসেস খান বারবার তার হাতে দিতে বলছে। এই দৃশ্য আগে প্রায়ই দেখা যেতো ওদের বাসায় কিন্তু হঠাৎ করেই ইনানের আনাগোনা কমে যায় খান বাড়িতে। ঠিক হঠাৎ করে নয়, সামু নিজের মনের কথা বলার পর। সামু সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো, আর পেছমে ফিরে তাকাবে না ও। হুট করে উঠে ঘরে চলে এলো, দরজা চাপাতে যেতেই বাঁধা পেলো। তাকিয়ে দেখে ইনান দাঁড়িয়ে আছে, ও চেষ্টা করেও দরজা লাগাতে গিয়েও যখন লাগাতে পারলো না তখন হাল ছেড়ে দিলো আর সরে দাঁড়ালো। ইনান কি চায়? কেনো এসেছে এখানে? কোন কিছুই ওর কাছে স্পষ্ট নয় এখনো।

সামু সরে দাঁড়াতেই ইনান ঢুকলো ভেতরে আর ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। হুট করেই সামুকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো

“তোর চুলের এই অবস্থা কেনো? এতো বড় বড় চুল এইটুকু করে ফেলেছিস কেনো তুই?”

সামু তাচ্ছিল্য নিয়ে বললো

“আমার চুলের দিকে আবার তোমার নজর গিয়েছিলো নাকি?নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে আমার, দ্যি গ্রেট ইনান চৌধুরী আমার চুল নোটিস করেছে!”

“আমার উপর রাগ করে নিজের চুল কেটে ফেলেছিস? মায়া হয়নি তোর?”

“নিজেকে এতোটাও ইম্পর্টেন্স দিবেন না প্লিজ। আমি আমার জন্য কেটেছি অন্য কারো জন্য নয়!আমার চুল আমি যা ইচ্ছে করবো তাতে অন্যকারো যায় আসার কথা না”

ইনান সামুকে ছেড়ে দাঁড়ালো, এমন কঠিন কঠিন কথা কেনো যেনো অবিশ্বাস্য লাগছে ওর কাছে। সামু ইনানের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো

“কেনো এসেছেন এখানে? বলেতো দিয়েছে বিয়ে করতে হবে না আপনাকে”

“আম্মুকে নিয়ে এসেছি যাতে আমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করে আজকে। আমি যথাসম্ভব দ্রুত বিয়ে করতে চাই”

“হঠাৎ?”

“আমি বাস্তবতা কে মেনে নিতে চাই”

“রুশি ভাবিকে এখনো ভালোবাসেন তাইনা?”

ইনান সামুর হাত নিজের হাতে নিলো তারপর শান্ত স্বরে বললো

“আমি জানি রুশির প্রতি আমার ফিলিংস ছিলো, এখনো আছে।অনেক বছরের সম্পর্ক এক দিনে ভুলা আমার পক্ষে সম্ভব নয় এটা যেমন সত্যি, তেমন এটাও সত্যি যে ও এখন অন্যকারো বউ আর তারউপর আমার কোন অধিকার নেই। আমি চাই সে ভালো থাকুক। আমি ওকে ভুলতে চাই!”

“ওহ তারমানে তাকে ভুলার জন্য আমাকে সাবস্টিটিউট হিসেবে নিতে চান!আর তাই যথাসম্ভব আমাকে বিয়ে করতে চান”

“আমি সেটা বলিনি”

“তাহলে আমাকে ভালোবাসেন?”

ইনান চুপ করে আছে,সামুর প্রতি ওর মায়া কাজ করলেও ওকে ভালোবাসে না, এটা ও জানে! সামু সেদিকে তাকিয়ে হাসলো তারপর বলল

“যেদিন আমাকে ভালোবাসতে পারবেন সেদিন আমাকে বিয়ের কথা বলতেন আসবেন। আমার কি মনে হয় জানেন আপনি আমাকে ডিজার্ভ করেন না, আমি ভুল মানুষকে ভালোবেসেছি। অনেক কষ্ট করে আপনাকে ভুলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি,দয়া করে আমাকে আর বিরক্ত করবেন। আমি কারো রিপ্লেসমেন্ট হতে পারবো না স্যরি। আপনি আসতে পারেন!”

ইনান কিছু বললো না, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে পড়লো। সামু তার জায়াগায় হয়তো সঠিক, এই কয়দিন ও অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ও আর রুশিকে নিয়ে ভাববে না, ওকে যথাসাধ্য ভুলার চেষ্টা করবে কারণ সে এখন অন্যের স্ত্রী আর সেই মানুষটি ওর বেস্টফ্রেন্ড! ও তাকে ঠকাতে পারবে না তবে সায়ানের সাথে কথা বলে বুঝাবে যে ওর রুশিকে মেনে নেয়া উচিৎ। কিন্তু সামু ভুল ভাবছে ও সামুকে কারো পরিবর্তে বিয়ে করতে চায়নি বরং ওর সাথে নতুন জীবন শুরু করতে চেয়েছে। কথায় আছে না

“আমাদের তার সাথেই থাকা উচিৎ যে আমাদের ভালোবাসে, তার সাথে নয় যাকে আমরা ভালোবাসি!”

যেখানে একটু একটু করে ওকে ভালোবাসার চেষ্টা করবে ও!ওর পুরো দুনিয়া জুড়ে সামু থাকবে। ও জানে সামু রাগ করেছে তাই বলে ও হার মেনে নিবে না বরং সামুর করা অভিমান ভাঙিয়ে ছাড়বে। এতোদিন সামু ওর জন্য অপেক্ষা করেছে এখন ওর অপেক্ষা করার পালা!

ইনান চলে যেতেই সামু ফিরে তাকালো,আবারও চলে গেছে সে! একটু তো থাকতে পারতো! নিশ্চই এখন গিয়েই সব কেন্সেল করে চলে যাবে। সেই যে যেতে চায় তাকে যেতে দেয়া উচিৎ,বেঁধে রেখে কি লাভ। দিনশেষে সে তোমার কখনোই নয়, তার চেয়ে নিজেকে ভালোবাসা উচিৎ। কেউ না থাকলেও তোমার সত্ত্বা তোমার সাথে থাকবে!

ও আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু আওয়াজে গাইতে শুরু করলো

We’d always go into it blindly
I needed to lose you to find me
This dancing was killing me softly
I needed to hate you to love me, yeah
To love, love, yeah
To love, love, yeah
To love, yeah
I needed to lose you to love me…

“আমি আর তোমার দ্বারে যাবো না,
তুমি ফিরে আসলেই সই
নয়তো তোমার অপেক্ষায় দিন গুজার
আমার আর হবে না”

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_২৩

দোতলার কর্ণারের কামরাটা মিসেস খানের, খুব শখ করে একসময় সাজিয়েছিলেন কামরার প্রত্যেকটা জিনিস। কামরা জুড়ে যৌবনের কতো ছবি তার আর প্রয়াত স্বামীর! এগুলো দেখলে যেনো সেই সোনালি দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়! ভালোবাসায় কতই না পাগলামো ছিলো তার কিন্তু হুট করেই চলে গেলো,,,তার মৃত্যু আজও যেনো মেনে নিতে পারেনি সাবিনা খান, আজও মনে এইতো সেদিনই তো পাশে ছিলো তার প্রান প্রিয় স্বামী জামিল খান।খুব আদুরে গলায় ডেকে বলছে সাবু এককাপ কড়া লিকারের চা করে দিবে?মাথাটা একটু ধরেছে! কিংবা বর্ষার দিনে দুজনের বৃষ্টি বিলাশের স্মৃতি,বারান্দায় একসাথে সুর্যের নিজ গৃহে ফিরে যাওয়া। সবই যেনো চোখের সামনে ভাসছে, আজ অনেকবছর মানুষটি নেই কিন্তু তার স্মৃতি হাতড়ে বেঁচে আছে সাবিনা খান।

জীবনের প্রথম প্রেম তার কি করে ভুলে যায়?খুব যত্নে মনের খাঁচায় সবকিছু বন্দি করে রেখেছে, কোন একদিন ওপারে গিয়ে সব জমানো কথা বলবে। রোজ সময়করে এই ফ্রেমেবন্দি ছবিগুলো মুছেন সে তারপর নিয়ম করে জানালার পাশটায় বসে উপন্যাস পড়েন, সাথে এক কাপ চা! আগে সামনে তার স্বামী উৎসুক হয়ে তার পড়া লাইনগুলো শুনতেন কিন্তু একসময় বিজনেসের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ায় শুনানো হয়নি। কিন্তু একা একা পড়তেন, বহুদিনের অভ্যস হুট করে বদলানো যায় নাকি?আবার তা যদি হয় ভালোলাগার অভ্যস! এই স্মৃতি গুলো নিয়েই তো বেঁচে থাকে এখন। বয়সের ভারে এখন নয়ন যুগল ঝাপসা হয়ে এসেছে, খালি চোখে অক্ষর গুলো ঠাউরে উঠেন না তবে চশমা পরে ঠিকই পড়তে বসেন। আজকে ” এবং হিমু ” পড়তে বসেছেন, এটা জামিলের প্রিয় উপন্যাস ছিলো! অনেকদিন যাবৎ পড়া হয়না, আজ ভাবলো আরো একবার পড়বে।

মিসেস খান যত্ন সহকারে বইটির পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পড়তে লাগলেন, সম্পুর্ণ মনোযোগ বইয়ের ভেতরি ছিলো কিন্তু হঠাৎ তিনি চমকে উঠলেন! হাতের বইটা পাশে রেখে অবাক চোখে নিজের কোলের দিকে চেয়ে আছে!বহুদিন হয়েছে তার ছেলে এইভাবে তার কোলে মাথা রেখেছে। আগে প্রায়ই এসে বলতো

“মাম্মা! মাথায় হাত বুলিয়ে দাও তো। ঘুম আসছে না আমার।”

মিসেস খান পরম যত্নে তখন ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন কিন্তু বহুদিনের ব্যবধানে সেই অভ্যস যেনো ভুলতেই বসেছিলেন। সায়ান মায়ের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে তার হাত নিজের মাথায় রাখলো তারপর বললো

“মাথা প্রচণ্ড ব্যাথা করছে মাম্মা!একটু হাত বুলিয়ে দিবে?”

সাবিনা খান বেশ অবাকই হলেন, যে ছেলে তার সাথে ঠিকমতো কথাই বলতো না সে আজ এভাবে থাকবে ভাবতে পারেনি।ছেলের এই পরিবর্তনে তিনি বেশ খুশি হয়েছেন, সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়াও জানিয়েছেন মনে মনে। উনি ছেলের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন, সায়ান চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলো। এতোক্ষন মনের মাঝে চলতে থাকা ঝড় নিমিষেই যেনো শান্ত হয়ে এলো,ও চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাই জিজ্ঞেস করলো

“কি করছিলে মাম্মা?আজ ছাদে যাওনি যে!”

“আজ যেতে ইচ্ছে করেছিলো না, অনেকদিন উপন্যাস পড়া হয়না তাই ভাবলাম আজ একটু পড়ি।বসে পড়ছিলাম আর তুই এলি!”

“রুশিও তোমার মতো উপন্যাস পড়ে, ঘরে দেখলাম কতোগুলো উপন্যাসের বই। এই উপন্যাস পড়ে তোমরা কি মজা পাও বুঝি না, আমার তো দেখলেই বিরক্ত লাগে।”

“তোর বাবাও ঠিক তোর মতো ছিলো বুঝলি, আমার উপন্যাস পড়া দেখলেই নাক ছিটকাতো। পরে যখন একদিন ধরে বেধে বসিয়ে পড়ে শুনাইলাম ওমনি জনাবের ভালো লেগে গেলো। আজ তোর বাবার প্রিয় উপন্যাসই পড়ছিলাম বুঝলি!”

সায়ান চোখ মুখ শক্ত করে বললো

“আমি তার মতো নই মা, আমি তার থেকে আলাদা”

বাবার কথা শুনতেই সায়ানের মুখের রঙ পাল্টে গেলো, ওই মানুষটিকে ওর বিশ্বাসঘাতক ছাড়া আর কিছু মনে হয়না।সায়ান নিজের মাকে যতো বেশি ভালোবাসে তার বাবাকে ঠিক ততো বেশিই ঘৃণা করে।লোকটি কারো বাবা হওয়ার যোগ্য নয় আর না কারো স্বামী হওয়ার কিন্তু ওর মাকে ও কিছু বলতে পারে না। কি করে বলবে যাকে তিনি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে, সেই মানুষটি পরকিয়ায় লিপ্ত ছিলো তা স্ত্রী হিসেবে কি করে মেনে নিবে উনি। প্রচণ্ড ভালোবাসেন তিনি সেই লোকটিকে, তাই তাকে ঘৃণা করে বেঁচে থাকতে পারবেন না। এরচেয়ে ভালো তাকে ভালোবেসেই বেঁচে থাকুক, যদিও লোকটি তার যোগ্য না কিন্তু তার মায়ের ভালোবাসা তো মিথ্যে ছিলো না। তাহলে সে কেনো কষ্ট পাবে?

মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বরাবরের মতই সত্যিটা চেপে গেলো সায়ান, থাকনা ওর মা ওই জঘন্য লোকটিকেই ভালোবেসে বেঁচে থাকুক। যদিও মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় কিন্তু নিজেকে সামলে নেয় কারণ এতে ওর মা ভালো থাকবে আর ও চায় তিনি ভালো থাকুক!

তাই সায়ান প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো

“বাবাকে অনেক ভালোবাসতে তুমি তাইনা?”

মায়ের সামনে না চাইতেও বাবা বলেই ডাকে ওই লোকটিকে সায়ান, নাহয় মায়ের প্রশ্নের জবাব দিতে হবে যে বাবাকে কেনো বাবা বলে না সায়ান?আর মাকে মিথ্যে কি করে বলবে?
সায়ানের মা ছেলেকে সরাসরি জবাব দিলেন না, কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো

“জামিল চলে যাওয়ার পর ভেবেছিলাম বেঁচে থাকতে পারবো না কিন্তু তোদের জন্য আমি বেঁচে আছি। তোরা আছিস বলেই আমি আছি বুঝলি!”

সায়ান মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, এখনো কতো সুন্দর দেখতে ওর মা অথচ ওই লোকটি কাচের টুকরোর জন্য খাঁটি হিরেকে চিনলো না!সায়ান মনে মনে আওড়াতে থাকলো

“তোমার এতো সম্মান আর ভালোবাসা ওই লোকটি ডিসার্ভ করে না, ভালো হয়েছে সে মরে গিয়েছে নাহয় সে বেঁচে থাকলে সত্যিটা জেনে তুমি বড্ড কষ্ট পেতে মাম্মা!”

সায়ান কাছে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো, আজ অনেক হাল্কা লাগছে নিজেকে। আসলেই প্রিয় জনের সাথে কথা বলতে বেশি কিছু করতে হয়না বরং সামান্য কিছু কথায় তারা অনেক খুশি হয়ে যায়। ঘটা করে স্যরি বলতে হয়না বরং আগ বাড়িয়ে সামান্য কথা বললেই সম্পর্ক ঠিক হয়ে যায়, এটাই হয়তো পরিবার! এই সব কিছু রুশির জন্য সম্ভব হয়েছে, আসলেই বেঁচে থাকতেই সব অভিমান ভাঙিয়ে সম্পর্ক ঠিক করে নেয়া উচিৎ নাহয় একবার হারিয়ে গেলে হাজার খুজেও পাওয়া যায়না।

সায়ান রুমে আসতেই দেখে রুশি আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, সায়ান কি ভেবে যেনো ছুটে গিয়ে রুশিকে জড়িয়ে ধরলো আর কোন ভনিতা ছাড়াই বললো

“থ্যাংক ইউ!থ্যাংক ইউ সো মাচ। তোমার জন্যই আজকে মাম্মা আর সম্পর্ক ঠিক হয়ে গিয়েছে। ডু ইউ নো রুশি! ইটস আ ব্লেসিং টু হ্যাভ ইউ ইন মাই লাইফ। তুমি আমার লাইফে অনেকগুলো খুশি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছো, তুমি জানো আমি কতো খুশি?যখনই মনে পড়ে আমি বাবা হতে চলেছি, আমাকে কেউ একজন বাবাই ডাকবে! ছোট ছোট হাতে আমার হাত ধরবে!আমি তাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরবো। থ্যাংক ইউ ফর বিং ইন মাই লাইফ!”

রুশি কিছু বললো না, বিনিময়ে হাসলো। আজকাল এই মানুষটির আনন্দ দেখবে নিজেরই আনন্দ হয়, ভালো লাগে। মনে হয় সারাক্ষণ তার হাসিমাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকুক, আচ্ছা ওকি সায়ানের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে?

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_২৪

অনেকদিন ধরে সামুর পড়াশুনা তেমন একটা হয়নি তাই ভাবলো ওর ফ্রেন্ড সুপ্তির কাছে গিয়ে ওর সাথে গ্রুপ স্টাডি করবে।গাড়ি থেকে নেমে সুপ্তির ফ্লাটে ঢুকলো, ও আরেকটা মেয়ের সাথে এখানে শেয়ারে থাকতো কিন্তু মেয়েটা গ্রামে গিয়েছে তাই আপাদত সুপ্তি একাই আছে। সামু ঘরে ঢুকে দেখে সুপ্তি বইপত্র টেবিলে সাজিয়ে বসে বসে ফোন দেখছে আর হাসছে। সামু নিজের পার্স দিয়ে হুট করে সুপ্তির মাথায় বাড়ি দিলো তারপর পাশে বসে বললো

“কিরে কি দেখে এমন ফাটা বাশের মতো হাসছিস?মাই গড তোর হাসি দেখি আগের থেকেও ভয়ংকর হয়ে গেছে, ভবিষ্যতে পেত্নীদের ট্রেনিং দিতে পারবি!”

“সেই পেত্নীদের একজন তো তুই, চিন্তা করিস না ফ্রিতে ট্রেন্ডিং দিয়ে দিবো”

জবাবে সামুর সুপ্তির পিঠে কয়েকটা কিল বসালো তারপর মুক বাকিয়ে বললো

“যখন পড়বিই না তাইলে এমন বইগুলোকে সং সাজিয়ে রেখে দিয়েছিস কেনো টেবিলে?গুছিয়ে রাখতে পারিস না?”

সুপ্তি সেদিকে তোয়াক্কা না সামুকে টেনে নিজের মোবাইলের দিকে মুখ করালো তারপর বললো

“আচ্ছা ওইসব বাদ দে তুই এটা দেখ। নিউ কোরিয়ান ড্রামা “ট্রু বিউটি”। ইশ দেখ ছেলেরা কতো কিউট! আই লাভ হিম ইয়ার!”

“এখন একে দেখে ফিদা হয়ে গেছিস? তাহলে তোর সিওজুন ওপ্পার কি হবে?আহারে বেচারাকে বিয়ের আগেই ডিভোর্স দিয়ে দিলি?”

“আরে ধুর, সে তো আমার পার্মানেন্ট ক্রাশ কিন্তু এদের উপর হুট হাট ক্রাশ খাই আরকি। তুই বল এতো সুন্দর ছেলেদের না দেখে থাকা যায়?”

সামু বিড়বিড় করে বললো “লুচু মাইয়া” তারপর ওর সাথে ড্রামা দেখায় মনোযোগ দিলো। এই রমক কেড্রামা পাগলির সাথে কি আর পড়াশোনা হয়? তবুও সামুর খুব হাল্কা লাগছে এখানে এসে, মনে হচ্ছে প্রান খুলে নিশ্বাস নিতে পারছে। ওই বদ্ধ ঘরে থাকতে থাকতে ওর দম যেনো ফুরিয়ে আসছিলো, এখন বেশ ভালো লাগছে।

সামু আর সুপ্তি সেই বিকাল থেকে ড্রামা দেখেই কাটিয়েছে,এখন প্রায় রাত নয়টার মতো বাজে। দুজন বসে বসে “হোটেল দেললুনা” দেখছে, যেহেতু হরর সিন আছে তাই লাইট অফ করে দেখছে যাতে মজা পাওয়া যায়। খুব গুরুত্বপূর্ণ সিন চলছিলো যেখানে সেই মেয়ে ভুতটা হুট করে সামনে আসে ঠিক এমন সময় সামুর সামনে একটা কাগজের টুকরো এসে পড়লো! আকস্মিক ঘটনায় সামুর আর সুপ্তি চিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেললো, এমন একটা মুহুর্তে এমন কিছু ঘটবে যেনো কল্পনাও করতে পারেনি। সামু দৌড়ে উঠে গিয়ে লাইট জালিয়ে দিলো তারপর ধীরেধীরে কাগজের টুকরো হাতে উঠালো! তাতে বড় অক্ষরে লিখা

“বারান্দায় আস যলদি!”

সামু যেনো অবাক হলো তারপর সুপ্তির দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে বললো

“তোর বয়ফ্রেন্ড ঠিক তোর মতো ভুত! সহজ ভাবে কিছু করতে পারেনা, এভাবে কাগজ ছূড়ে মারার কি ছিলো? ফোন করে বলতে পারতো না!আরেকটু হলে হার্ট এটাক হতো আমার।”

সামুর কথা শুনে সুপ্তি অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো তারপর বললো

“আসতাগফিরুল্লাহ! আমার আবার বয়ফ্রেন্ড আসলো কই থেকে?তোর কি আমারে চিটার মনে হয় যে আমি আমার সিওজুন ওপ্পারে চিট করমু!”

সুপ্তির কথা শুনে সামু চুপ হয়ে গেলো, সুপ্তির বয়ফ্রেন্ড নেই সেটা ও নিজেই জানে কারণ সুপ্তির এংগেজমেন্ট হয়ে আছে। আর যার সাথে হয়েছে তিনি একজন কলেজের প্রফেসর তাই এমন অশালীন কাজ কর্ম তিনি করবে না।কিন্তু ওর নিজেরও তো তেমন কেউ নেই, হঠাৎ কি মনে করে কাগজের লিখাটা আবার দেখলো আর সবকিছু জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো। এমন তুই করে ওকে একজনই বলে, সামু রাগে বারান্দার দিকে ছুটলো। মন চাচ্ছে আস্তো পাথর ছুড়ে মারতে ইনানের উপর কিন্তু তাকে দেখেই মনটা শীতল হয়ে গেলো। সোডিয়ামের আলোতে কতোটা স্নিগ্ধ লাগছে তাকে?একটা টিশার্ট আর টাউজার পরা, চুলগুলো কপালে লেপ্টে আছে হয়তো শাওয়ার নিয়েই এখানে এসেছে!

সামু আরো বেশি অবাক হলো যখন দেখলো ইনানের হাতে একটা ইয়া বড় টেডিবিয়ার তাও ব্রাউন কালার। ওর মনে পড়ে গেলো দুবছর আগের কথা, সেদিন ওরা শপিংয়ে গিয়েছিলো আর এইরকম একটা টেডিবিয়ার দেখে ইনানকে কিনে দিতে বলেছিলো কিন্তু ইনান মাথা টোকা মেরে বলেছিলো

“এই বুড়ি বয়সে এতো বড় টেডিবিয়ার দিয়ে কি করবি?নিজেকে কি এখনো গুলুগুলু বাবু ভাবিস!”

সামু রাগে দুঃখে আর কিছু না কিনেই চলে এসেছিলো, তখন ইনানকে নিজের মনের কথা জানায়নি তাই তাদের সম্পর্ক ভালো ছিলো তাই প্রায়ই তাকে বাইরে ঘুরাতে নিয়ে যাওয়ার বায়না ধরতো আর ইনান নিয়ে যেতো। সামু ভাবতেই পারেনি ইনানের এই টেডির কথা মনে থাকবে। সামু চুপ করে তাকিয়ে আছে ইনানের দিকে সেইসময় ইনান ওর হাতের দিকে ইশারা করলো, প্রথমে না বুঝলেও পরে বুঝলো যে ফোন ধরতে বলছে। এই কয়দিন ইনান ফোন দিলেও ও ফোন ধরেনি বরং সাইলেন্ট করে রেখেছিলো। ও দেখতে চেয়েছিলো ইনান ঠিক কতোবার ফোন দিতে পারে, ভেবেছিলো দিতে দিতে বিরক্ত হতে থেমে যাবে কিন্তু ইনান সময়ে সময়ে ফোন দিয়েছে যদিও ও ধরেনি।

কিন্তু এখন কথা বলা দরকার তাই ফোন উঠালো তারপর ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো

“কি সমস্যা! এতো রাতে কি নাটক শুরু করেছেন?”

ইনান সামুর কন্ঠের তোয়াক্কা করেনি বরং মুচকি হেসে বললো

“এই টেডিবিয়ারটার কথা মনে আছে?আজ মার্কেটে দেখে কিনে এনেছি আর এখন নিয়ে আসলাম তোর জন্য”

“আমি কোন বাচ্চা নই যে টেডিবিয়ার দেখলেই মন গলে যাবে, আপনার এই বৃথা চেষ্টা বন্ধ করুন।রাত বিরাতে তামাশা না করে চলে যান প্লিজ।”

বলেই সামু বারান্দার দরজা লাগিয়ে সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বললো

“তুই রুমে গিয়ে সুয়ে পড়, এটা আমাদের জন্য না। রং ঘরে চলে এসেছে”

সুপ্তি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রুমে চলে গেলো, যা ভয় পেয়েছে তাতে আর দেখা সম্ভব নয়। সুপ্তি যেতেই সামু সোফায় বসে বসে প্রহর গুনতে থাকলো আর ঠিক মিনিট দশেক পর বারান্দার দরজায় টোকা পড়লো। সামু মুখে হাসি ফুটে উঠলো, ও জানতো ইনান এতোসহজে চলে যাবে না।চেহারায় কঠোরতা ফুটিয়ে দরজা খুলে বললো

“কি সমস্যা?”

“তুই জানতি আমি আসবো তাই টোকা দেয়ার সাথে সাথেই খুলেছিস তাইনা?”

“কে বলেছে আপনাকে? আমি শুতে যাচ্ছিলাম মাত্র কিন্তু আপনি টোকা দিলেন তাই খুললাম”

“তুই কি করে জানলি আমিই আসবো? অন্যকেউও তো হতে পারতো!”

“এতো রাতে চোরের মতো আপনি ছাড়া আর কে আসবে? এতোটুকু কমনসেন্স আছে আমার”

“সেই আমি ছাড়া আর কারো সাহস আছে নাকি?মেরে হাত পা ভেঙে দিবো বুঝলি! যাইহোক এই নে তোর টেডিবিয়ার”

বলেই কাঁধে ঝুলানো টেডিবিয়ারটা সামুর হাতে দিতে দিতে বললো

“আমি মন গলাতে আসিনি বুঝলি, মনে হলো একবার চেয়েছিলি তাই তাই আবদার পুরণ করি। এটার নাম কি জানিস?’গুলুগুলু বাবু’!”

বলেই ইনান হেসে দিলো, সামু রেগে গিয়ে টেডিবিয়ারটা ফেলেদিলো তারপর বললো

“লাগবে না আমার। আপনি এখন আসতে পারেন”

ইনান কিছু বললো না, হুট করে সামু আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। সামু ছাড়াতে চাইলে আরেকটু শক্ত করে ধরে বললো

“নড়িস না, এভাবে একটু থাকতে দে। আমি তোকে কামড়াবো না বুঝলি!”

ইনান আস্তে সামু ছেড়ে দিয়ে বারান্দার দিকে এগুলো, সামু ইনানকে মেইন দরজা দিয়ে যাওয়ার কথা বলবে ভাবছে কারণ তিনতলা থেকে নামছে যদি কিছু হয়?বলার আগেই ইনান নেমে গেলো অনেকটুকু। হঠাৎ করেই কিছুটা আওয়াজ হলো, নিচে তাকিয়ে দেখে ইনান চিৎ হয়ে পড়ে আছে। সামুর কষ্ট লাগলো আবার হাসিও পেলো। ইনান উঠে চুলে হাত দিয়ে বোকা হেসে হাটা শুরু করলো। নিশ্চিত কোমরে ব্যাথা পেয়েছে!

“ঠিক আছে, কে বলেছিলো তিনতলায় উঠতে? হিরো হওয়ার শখ হয়েছে!”

সামু ঘরে ঢুকে টেডিবিয়ার টা উঠিয়ে নিলো তারপর জড়িয়ে ধরে বললো

“নাম কি রাখলো! গুলুগুলু বাবু,এটা কোন নাম?”

বলেই দিলো এক ঘুষি তারপর নিজেই হেসে দিলো। ও সবসময় এমন একটা সম্পর্কই চেয়েছে যেখানে পাগলামি থাকবে সাথে অনেক ভালোবাসা কিন্তু পায়নি। আর যখন হাল ছেড়ে দিলো তখন সেটা আবার ফিরে এলো! এতো সহজে ইনানকে মেনে নিবে ও, ছোট বেলা থেকে তার পেছনে ঘুরেছে কিন্তু পাত্তা পায়নি তাই এতো সহজে তাকে কি করে মেনে নিবে? আগে নাকানিচোবানি খাওয়াবে তারপর মেনে নেয়ার কথা ভাববে। ইনানকে সামুর মুল্য বুঝতে হবে আর সবচেয়ে বড় কথা রুশিকে ভুলতে হবে। ও জানে এটা এতো সহজ নয় কিন্তু সর্বক্ষণ যদি ওর কথাই ভাবে তাহলে রুশি ভাবির কথা ভাবার টাইম কই পাবে?

সামু খুশি মনে টেডিবিয়ার কোলে জড়িয়ে রুমে চলে এলো। আজকে একটা শান্তির ঘুম হবে ওর,মনের উপর থেকে অনেক বড় বোঝা নেমে গেছে। কেউ আসলে ঠিকই বলে

“যা তোমার তা তোমারই থাকবে, সে যেখানে থাকুক না কেনো দিনশেষে তোমার হবে”

তাই ইনান যদি ওর হয় তবে ওরই থাকবে, অন্যকারো হবে না বরং ওর জন্য অপেক্ষা করবে।আর যদি এতোটুকু সহ্য না হয় তবে ধরে নিবে সে কখনো ওর ছিলোই না।

#চলবে

গুমোট অনুভুতি পর্ব-১৯+২০+২১

0

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১৯

“রুশি! কাউকে কখনো ভালোবেসেছো তুমি?”

সায়ানের প্রশ্নে রুশি প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও পরে নিজেকে সামলে দিলো,তারপর বাইরের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো

“নাহ”

রুশির জবাবে সায়ান ওর দিকে তাকিয়ে রইলো, রুশির মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ও সত্যি কথা বলছে তবে উনিশবছর জীবনে কখনো কাউকে ভালোবাসে নি?সায়ান কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়ে করতে পারলো না তার পুর্বেই রুশি হতাশ গলায় বললো

“তবে কারো মায়ায় পড়েছিলাম ছিলাম ভয়ংকরভাবে যা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছিনা।”

সায়ান রুশির দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো, রুশি অন্য কারো মায়ায় পড়েছিলো এটা যেনো ভাবতেই পারছে না ও, কেমন চিনচিন ব্যাথা করছে। তবুও সাহস জুগিয়ে প্রশ্ন করলো

“তোমার কাছে ভালোবাসা মানে কি?”

রুশি তাচ্ছিল্যের সাথে বিড়বিড় করে বললো

“ভালোবাসা!”

তারপর সায়ানের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো

“ভালোবাসা মানে হচ্ছে সহস্র অনুভুতির সংমিশ্রনে সৃষ্ট এক ‘মায়া’ যে মায়া কখনো কাটিয়ে উঠা যায়না”

“তোমার কাছে ভালোবাসা মানে হচ্ছে মায়া! তাহলে তুমিও কাউকে ভালোবাসতে?কে সেই মানুষটি?”

রুশি সায়ানের চোখে একরাশ কৌতুহল দেখতে পেলো আর মনে হলো খানিকটা রেগে আছে। কিন্তু রাগার মতো কথা বলেছে বলে মনে পড়ছে না। রুশি খানিকটা মুচকি হেসে বললো

“প্রথমেই বলেছি যে আমি কাউকে ভালোবাসি নি বরং কোন একজনের মায়ায় পড়েছিলাম। তার মানে এই না আমি তাকে ভালোবাসি! সকল ভালোবাসাই মায়া তবে সব মায়া ভালোবাসা নয় অন্তত আমার জন্য নয়। সেই মানুষটির মায়ায় আমি পড়েছি ঠিকি তবে সে বন্ধু ছাড়া অন্য কেউ ছিলো না। তাই যেই ভালোবাসার কথা আপনি শুনতে চাচ্ছেন তা কারো প্রতি জন্মায়নি এখনো”

রুশি জানে না কেনো সায়ানের কাছে এক্সপ্লেইন করলো যে ওর ভালোবাসার নেই,ও আজ পর্যন্ত অন্য কারো প্রেমে পড়েনি। ও চাইলেও সায়ানকে ভুল বুঝাতে পারতো কিন্তু কেনো ক্লিয়ার করলো তাতে যেনো নিজেই হতাশ। তারপর সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো

“আপনি কাউকে ভালোবসেছেন?”

কথাটা বলে নিজেই থতমত খেয়ে গেলো, অবশ্যই সে ভালোবাসে অন্যকাউকে আর সেই অন্যকেউটা চন্দ্রিকা। চন্দ্রিকার জন্য সে নিজের মায়ের এগেইন্সট চলে গিয়েছে, এতোবছর এই বাড়িতে পা রাখেনি। তাই ও বাইরের মানুষ হয়েই ভালোবাসার গভীরত্ব মাপতে পারছে, হয়তো প্রচণ্ড ভালোবাসে চন্দ্রিকাকে। রুশি সায়ানকে জবাব দেয়ার সুযোগ না দিয়েই বললো

“অবশ্যই ভালোবাসেন আমিও বা কি প্রশ্ন করছি! আচ্ছা আপনি চন্দ্রিকাকে কেনো ভালোবাসেন? মানে আপনাদের প্রেম কাহিনী শুনতে চাচ্ছি যদি মাইন্ড না করেন”

রুশির কথা বলার ভংগি দেখে সায়ান হাল্কা মুচকি হাসলো, কেমন প্রশ্ন করেই নিজেই যেনো থতমত খেয়ে ফেলেছিলো। ও রুশির দিকে তাকিয়ে বললো

“আমাদের তেমন কোন কাহিনী নেই তবে এটা বলতে পারি আমার বয়স তখন খুব একটা বেশি ছিলো না, একদিন বাড়ি ফেরার পথে আমি হঠাৎ কিডন্যাপ হয়ে যাই। পুরো একদিন তারা আমায় বন্দি করে রাখে কিন্তু সুযোগ বুঝে আমি সেখান থেকে পালিয়ে যাই। রাস্তায় হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়, আমার শরীর ধীরেধীরে অশাড় হয়ে আসে তাই কোথাও একটা বসে পড়ি। ওই সময় একেকটা মিনিট যেনো ঘন্টার মতো ছিলো, মনে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখছিলাম।সবাই নিজেদের নিয়ে এতোটাই মগ্ন যে আমায় খেয়াল করেনি, পাশ দিয়ে হেটে হেটে চলে গিয়েছে। কতোটা অসহায় ছিলাম বলে বুঝাতে পারবো না, ঠিক তখনি কোন একটা আলো আমার অন্ধকার সময়ে আমার কাছে আসছিলো। আমার পাশে এসে আমাকে ডাকছিলো কিন্তু ততক্ষণে হুশ হারিয়ে ফেলেছিলাম। যখন হুশ আসে তখন পাশে ছোট্ট একটা মেয়েকে আমার হাত ধরে বসে থাকতে দেখি,পরে জানতে পারি এই মেয়েটি আমাকে নোটিস করেছে বলেই আমি বেচে আছি। দীর্ঘ তিনদিন পর আমার হুশ এসেছে, গায়ে তীব্র জ্বর তখনো ছিলো।জ্বরের ঘোরে শুধু একটা নামই মাথায় ছিলো যে সে মেয়েটির নাম পরি, আমার ছোট্ট পরি!তারপর সেখান থেকে যখন চোখ খুলে তখন নিজেকে নিজের ঘরের বেডে আবিষ্কার করি, এরপর আর অনেক বছর তার খোঁজ নিতে পারিনি।তারপর সেই মেয়েটিকে ছয়বছর পুর্বে খুজে পাই, আমার ছোট্ট পরি থেকে এখন সে অনেক বড় হয়ে গিয়েছিলো আর তার নাম পরি থেকে চন্দ্রিকা হয়ে গিয়েছিলো!”

সায়ান এতোটুকু বলে দম নিলো,সে যেনো ওইসব ঘটনা নিজের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলো। রুশির ফুঁফিয়ে কান্নায় ওর ধ্যান ভাঙল, চোখের পানি মুছে রুশিকে বলে উঠলো

“কাঁদছো কেন?”

“আপনাদের প্রেমকাহিনী এতো কষ্টের কেনো?মনে হচ্ছিলো সিনেমা দেখছি। আচ্ছা তারপর কি হয়েছিলো?”

“তারপর আর কি হবে চন্দ্রিকে আমার কাছে নিয়ে আসি এই বাড়িতে কিন্তু মা কেনো যেনো ওকে দেখতে পারতো না। আর একসময় মা ওকে আমার জীবন থেকে সরাতে চায় তাই সেদিন আমি ওকে ওয়াদা করি যাই হয়ে যাক না কেনো আমি ওর পাশে থাকবো আর ও আমাকে শুধু ওকে ভালোবাসার ওয়াদা করিয়ে নিয়েছিলো কারণ ওর ভয় হতো যে ও আমাকে হারিয়ে ফেলবে।আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ, ওর জন্যই বেঁচে আছি আমি! ও না থাকলে হয়তো আজ আমি তোমার সামলে দাঁড়িয়ে থাকতাম না।আমি তাকে ভালোবাসতে বাধ্য!”

সায়ানের দিকে রুশি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো হয়তো কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করলো কিন্তু পেলো না। তাই অন্যদিকে ফিরে বললো

“আপনি সত্যিই চন্দ্রিকাকে ভালোবাসেন নাকি সেটা শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা?কারণ ভালোবাসা তো কখনো বাধ্য কিছু হতে পারেনা বরং তা মুক্ত এবং স্বাধীন! কাউকে বাধ্য হয়ে ভালোবাসা আদোও ভালোবাসা? নাকি শুধুমাত্র বাধ্যতা?”

“সেটা জানিনা তবে সেই ওয়াদা আমি স্বেচ্ছায় করেছি, আমি জানি তোমার কাছে নিতান্তই খারাপ একজন মানুষ হয়তো তুমি ভাবছো আমি দুই নৌকায় পা দিয়ে চলছি কিন্তু তোমার আর বাবুর সাথে যেমন থাকতে চাই, তোমাদের খেয়াল রাখতে চাই তেমনি আমি আমার ওয়াদা ভুলে যেতে পারবো না।আমি…”

সায়ান থামলো তারপর জোরে জোরে শ্বাস নিলো, চোখে পানি টলমল করছে। কিছুটা ধরা গলায় আবার বললো

“আমি আমার বাবাকে ঘৃণা করি! প্রচণ্ড ঘৃণা করি তাইতো তার মৃত্যুর সময় তার জন্য এটুকু মায়া হয়নি আমার, তার লাশ দেখে আমার চোখে এটুকু জল গড়ায়নি বরং মনে হয়েছিলো ভালোই হয়েছে সে চলে গিয়েছে”

রুশি সায়ানের চোখের দিকে তাকালো, এই চোখে কিছুক্ষণ পুর্বেও অসহায়ত্ব ছিলো কিন্তু এখন তীব্র ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কারো বাবার জন্য এতো ঘৃণা এই প্রথম দেখলো, বুঝতে পারলো হয়তো কোন সিরিয়াস ব্যাপার আছে। ও সায়ানের দিকে শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে হয়তো ভাবছে সায়ান এরপর কি বলবে?সায়ান হুট করেই ওর বাহু চেপে ধরলো তারপর আহত কন্ঠে বললো

“জানো কেনো তাকে ঘৃণা করি?কারো সে তার কথা রাখেনি। সে আমার মাকে আজীবন ভালোবাসার ওয়াদা করেছিলো অথচ পর নারীতে আসক্ত হয়ে গেলো!সে আমার মাকে ধোকা দিয়েছে আর সেটা আমি সেদিন স্বচক্ষে দেখেছি, অফিসের কেবিনে ছিহ!তাই সেখান থেকে গাড়ি না নিয়ে বেরিয়ে পড়ি আর পরে কিডন্যাপ হয়ে যাই। বাসায় ফিরার পর তার সাথে আর কখনো কথা বলিনি,কিন্তু মাকে তার ধোঁকার কথাও বলতে পারিনি। প্রচণ্ড ভালোবাসতো আমার মা তাকে আর এখনো বাসে, তার এই ভালোবাসা হারিয়ে গেলে সে বাঁচতে পারবে না আর আমি মরতে দিবো না। তাই আমার কাছে ওয়াদার অনেক মুল্য কারণ আমি আমার বাবার মতো হতে চাইনা যাকে আমি প্রচণ্ড ঘৃণা করি!

সায়ান কয়েকবার শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো তারপর আবার বললো

“রুশি আমি জানি অনেক অন্যায় করছি তোমার সাথে, তোমার প্রাপ্য অধিকার তোমাকে দিতে পারছিনা। আমি নিজেও এটা মানি যে আমি তোমার সাথে থাকতে চাই, আমাদের বেবিকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে চাই আবার আমি চন্দ্রকাকে করা ওয়াদাও ভুলতে পারবো না তাহলে আমার ওই লোকটির মাঝে কোন পার্থক্য থাকবে না, আমি তাকে যতোটা এখন ঘৃণা করি তার থেকেও বেশি নিজেকে ঘৃণা করবো।”

রুশি কিছু বললো না, কিছু বলার ভাষা নেই। এই পরিস্থিতিতে একটা মানুষের কিই বা বলার থাকতে পারে?বিষয়টি খুবই জটিল। সায়ানের মেন্টাল প্রেশারের পরিমাণ বুঝতে পারছে তবে হুট করেই ওয়াদা করার পুর্বে ভাবা উচিৎ সে সেই ওয়াদা রাখতে পারবে কিনা যেখানে ওয়াদা শব্দটি এতো গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে!রুশি কিছু একটা ভেবে হঠাৎ করে প্রশ্ন করলো

“আচ্ছা আপনি কাকে ভালোবাসেন আপনার ছোট্ট পরিকে নাকি চন্দ্রিকাকে?”

সায়ান হচকিয়ে গেলো কিছুটা তারপর সামলে গিয়ে বললো

“দুজন তো একই মানুষ তাহলে যাকেই বাসিনা কেনো একই তো হলো তাইনা!”

“নাহ এক না। ধরুন চন্দ্রিকা আর পরি একই ব্যাক্তি না হলো তাহলে যদি আপনাকে যেকোন একজনকে চুজ করতে হতো তাহলে কাকে চুজ করতেন?”

সায়ান রুশির প্রশ্ন ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না তবুও কিছুটা ভেবে বললো

“চন্দ্রিকা আমার সেই ছোট্ট পরি বলেই সে আমার সাথে আছে আর আমি পরির কাছে ওয়াদাবদ্ধ! আই ও মাই লাইফ টু হার”

“তার মানে বাই এনি চান্স ধরুন যদি চন্দ্রিকা আপনার ছোট্ট পরি না হয় আর আপনাকে যদি একজনকে চুজ করতে হয় তাহলে পরিকেই করতেন তাইনা?”

সায়ান হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো, চন্দ্রিকা ওর ছোট্ট পরি তাইতো চন্দ্রিকা ওর সাথে আছে।

“তারমানে আপনি ছোট্ট পরিকে ভালোবাসেন আর চন্দ্রিকা পরি বলে তাকে ভালোবাসেন যদি চন্দ্রিকা পরি না হতো তাহলে কি ওকে ভালোবাসতেন না?ধরুন হঠাৎ একদিন পরি অন্যকেউ হলো তাহলে চন্দ্রিকাকে কি করবেন?”

সায়ান চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকিয়ে বললো

“বলেছিই তো চন্দ্রিকা আমার ছোট্ট পরি বলেই আমার সাথে আছে!”

“আর যদি না হতো তবে কি আপনার সাথে থাকতো না?”

সায়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে রুশি থেমে গেলো, রুশি একটু বেশিই জিজ্ঞেস করে ফেললো?আসলে ওর খুব কৌতুহল জাগছিলো সায়ানের কাছে পুরো কাহিনী শুনে, নিজেকে কেমন জানি এসিপি প্রাতিউমান মনে হচ্ছে। মনের ভিতর কেউ জেনো বলেছিলো “কুছ তো গাড়বার হ্যায় দায়া থুরি রুশি!” তাইতো রহস্য উদঘাটনে লেগে পড়লো যে সায়ান আসলে কাকে ভালোবাসে ‘ছোট্ট পরি’ নাকি চন্দ্রিকা? সায়ান যখন বললো যে চন্দ্রিকা ছোট্ট পরি বলে তার কাছে তখন মনে হলো চন্দ্রিকা ছোট্ট পরি না হলেই পারতো, জেলাসি কিনা জানেনা তবে আজকাল চন্দ্রিকাকে ওর ভালো লাগে না। যেখানে নিজেকে তৃতীয় ব্যাক্তি মনে হতো চন্দ্রিকাকে তা মনে হচ্ছে এখন,মনে হচ্ছে চন্দ্রিকা ওদের জীবনে না থাকলেই পারতো হয়তো সায়ান,ও আর ওদের অনাগত বেবির একটা ছোট্ট সংসার হতো!

কিন্তু পরক্ষনেই নিজেকে নিজে সামাল দেয় এই ভেবে যে যা ওর নয় তা ওর নয় আর যা ওর তা ওরই থাকবে। এতটুকু ও বলতে পারে যে সায়ান চন্দ্রিকাকে ভালোবাসে না বরং সে কৃতজ্ঞ তার ছোট্ট পরির প্রতি!রুশি সায়ানের দিকে তাকিয়ে জোর পুর্বক হাসলো তারপর বললো

“আম জাস্ট আস্কিং,ডোন্ট মাইন্ড! আপনি এখানে থাকেন আমি কাউকে বলছি আপনার কফি দিয়ে যেতে”

সায়ান দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো, রুশিকে কথাগুলো বলতে পেরে নিজেকে খুব হাল্কা লাগছে। ও আর কথা বাড়াতে চায়না, সবকিছু ভাগ্যের ছেড়ে দিয়েছে যা হবার তাই হবে। আচ্ছা খুব বেশি কি ক্ষতি হতো যদি রুশিই ছোট্ট পরি হতো!তাহলে হয়তো ওকে চুজ করতে হতো না। নিজের ভাবনায় নিজেই যেনো অবাক হলো,কি ভাবছে এসব ও?

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_২০

রুশি সায়ানের দিকে তাকিয়ে দেখে ও কিছু ভাবছে তাই ও ফটাফট বলে দিলো

“আরে এটা তেমন কিছুনা, মনে করেন আমি কিছু জিজ্ঞেসই করিনি আপনাকে। হিহিহি! আর আপনার বাবা যা করেছে তা আমি আপনাকে ভুলতে বলছিনা, এসব ভুলার কথাও না তবে একজন মৃত মানুষের জন্য ঘৃণা পুষে রেখে কি লাভ বলেন?তার থেকে ভালো আপনি সেই ঘটনা ভুলে যান অথবা তাকেই ভুলে যান! এতে না আপনি কষ্ট পাচ্ছেন আর আপনার মন খারাপের কারণে আশেপাশের মানুষের মন খারাপ হচ্ছে। আপনি শুধুমাত্র একজনের জন্য বাকি সবাইকে শাস্তি দিয়েছেন আর দিয়ে যাচ্ছেন, এ বাড়িতে আসার পর শুনেছি আপনি খুব চঞ্চল আর হাসিখুশি ছিলেন কিন্তু হঠাৎ ই আপনি গম্ভীর হয়ে গেছেন আর এই প্রভাবটা কিন্তু আপনার আশেপাশের সবার উপরে পড়েছে। এখানে থাকা সবাই আগে আপনাকে ভালোবাসতো, এখনো বাসে তবে তার সাথে ভয় পায় আপনাকে কারণ আপনি এখন কঠোর!আর কেউ আপনাকে ভয় পাক এটা নিশ্চই আপনার কাম্য নয়?”

রুশি সায়ানের দিকে তাকালো খুব মনোযোগ সহকারে, সায়ান ওর কথার কোন জবাব দেয়নি তাই ও ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলা শুরু করলো

“যারা আছে আশেপাশে তাদের বেঁচে থাকতেই কদর করতে শিখেন, এক সময় হারিয়ে গেলে হাজার চেষ্টায়ও ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। আমি জানি আপনার পরিবারের বিষয়ে নাক গলানোর অধিকার আমার নেই তবুও একজন মানুষ হিসেবে বলছি আপনার মা আপনাকে ভালোবাসে, পৃথিবীর সকল মা যেভাবে ভালোবাসে ঠিক সেই রকম। কোন মা তার সন্তানের খারাপ চায়না,সে যদি কোন ভুল করেও থাকে তবে সে ঘৃণার যোগ্য নয় নিশ্চই?”

সায়ান এবার রুশির দিকে তাকালো আর থমথমে গলায় বললো

“আমি তাকে ঘৃণা করিনা আর কখনো করা সম্ভব ও নয়”

“তাহলে নিশ্চই ভালোবাসেন তবে তার উপর রেগে আছে। আচ্ছা এই রাগ কয়দিন পুষে রাখবেন?মানুষের হায়াত মউত সব আল্লাহর হাতে, হঠাৎ একদিন যদি হারিয়ে যায় নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন?পারবেন এই বোঝা নিয়ে সারাজীবন থাকতে যে আপনি তাকে শেষবারের মতো বলতে পারেননি…
‘মা তোমাকে আমি ঘৃণা করিনা বরং ভালোবাসি বড্ড ভালোবাসি!’
ভালোবাসার মানুষ বেঁচে থাকতেই তার কদর করা শিখুন, বেশি কিছুনা তার সাথে আগের মতো কথা বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে। সে আপনার অপেক্ষায় আছে অনেকদিন ধরে যে তার ছেলে তাকে মা বলে ডাকবে,আগের মতো কোলে মাথা রেখে কথা বলবে।তার সেই অপেক্ষার পরিমাণ আর দীর্ঘ করবেন না।বর্তমান নিয়ে বাঁচতে শিখুন অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে না নিজে সুখে থাকবেন না অন্যকেউ! এনিওয়ে বাকিটা আপনার ইচ্ছা, আমার বলার ইচ্ছে ছিলো বলেছি।”

রুশি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো, সায়ান এখনো নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও জানেনা ওর কথা কতটুকু কাজে দিয়েছে, তবে ও চায় ওর সব ঠিক হয়ে যাক তাদের মাঝে। কারণ বাবা মা ছাড়া একজন সন্তান কতোটা অসহায় তা ওর থেকে ভালো আর কে জানে?ও চায়না সায়ানের সেটা থেকেও ও একই দহনে পুড়ুক! রুশি বারান্দা থেকে বেরিয়ে এলো তারপর স্বাভাবিক গলায় বললো

“আপনি কফি খাবেন?আমি কাউকে বলে পাঠিয়ে দিচ্ছি!”

রুশি আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না সেখানে, এখন ওর নিজের স্পেস দরকার। কিছুক্ষণ একা থাকতে চায়, আজ মনটা বড্ড খারাপ ওর কোন এক অজানা কারণে!খুব ইচ্ছে করছে কারো কাঁধে মাথা রেখে দুঃখবিলাস করতে কিন্তু সেই মানুষটি কই?বাগানের খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো

“আমাকে কি আজোও মনে রেখেছো তুমি নাকি সময়ের শ্রোতে ভুলে গেছো? আমি কিন্তু তোমায় ভুলিনি এক মুহুর্তের জন্যও না,স্মৃতি যতই ঝাপসা থাকুক না কেনো!”

_____________________

ইনান প্রায় আধঘণ্টা ধরে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে বেঞ্চে বসে আছে, কতোক্ষণ পর পর ঘড়ি দেখছে আর লেকের পানির উথালপাতাল দেখছে।লেকের জলগুলো সুর্যের আলোয় ঝলঝল করছে আর হাল্কা ঢেউয়ের তালে তালে এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছে ঠিক ওর জীবনের মতো।কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না।

এই কয়দিন ও একবারের জন্যও রুশির সম্মুখীন হয়নি। আর যাইহোক ভালোবাসার মানুষের চোখে ঘৃণা ও কখনোই সহ্য করতে পারবে না, রুশি নিজেও চায় ইনান ওর সামনে না যাক আর ও চায় রুশি ভালো থাকুক। সব মিলিয়ে সুখে থাকুক,ও নিজে থেকে যদি সায়ানের সাথে থাকতে চায় তবে থাকুক।ও তাদের বিরক্ত করবে না আর না তাদের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে থাকবে!কিন্তু কোন একদিন যদি সায়ান ওকে আগলে রাখতে না পারে তবে রুশি না চাইলেও ও রুশিকে নিজের কাছে নিয়ে আসবে!

ইনানের ভাবনার মাঝে কেউ একজন এসে ওর পাশে বসলো, ইনান পাশের মানুষটির দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো কিন্তু সামনের মানুষটির চোখ অনুভুতি শুন্য! তার দৃষ্টি দেখে বুঝার উপায় তার মনে বা মস্তিষ্কে কি চলছে। ইনানের দৃষ্টি তার উপর থাকলেও সে মানুষটি লেকের জলের দিকে তাকিয়ে আছে। ইনান মৃদু কন্ঠে বললো

“ডেকেছিলে?”

সামু সেই পানির দিকে তাকিয়ে বললো

“হুম বসিয়ে রাখার জন্য স্যরি!বেশি সময় নেবো শুধু একটা কথা জানাতে এসেছি এই বিয়েটা তোমায় করতে হবে না ইনান ভাই”

ইনান সামুর দিকে অবাক চোখে তাকালো, এই বিয়েটা করার জন্য সামু কতইনা পাগলামি করেছে অথচ আজ বলছে যে সে বিয়ে করবে না? সামুর এই এক মাসের ব্যাবহারে খুব অবাক হয়েছে ইনান,আগে প্রতিনিয়ত সামু তার খোঁজ নিতো। সময়ে অসময়ে ফোন দিতো কিন্তু এই এক মাস তা করেনি। ফোন দিলেও শুধু শরীর কেমন আছে এতটুকু বলে রেখে দিতো, কন্ঠস্বর কেমন যেনো থাকতো।ইনান কয়েকটা কথা বেশি বলতে চাইলে বাহানা দিয়ে রেখে দিতো। আজ সামুকে দেখে ও যেনো চিনতেই পারছেনা, আগের থেকে অনেক শুকিয়ে গেছে। সুন্দর সেই চোখজোড়ার নিচে কালি পড়েছে, মুখটা মলিন হয়ে আছে। ইনানের মুহুর্তেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো, সামুর প্রতি ছোট থেকেই ওর বড্ড মায়া কাজ করে তবে সেটা অন্যকিছু হিসেবে নয়। সামুর কষ্টে তাই ওরও বুক পুড়ে! বড্ড অন্যায় হয়ে যাচ্ছে মেয়েটির উপর! ও জানেনা কি বলবে, কি বলা উচিৎ এই মুহুর্তে?ইনানের চুপ করে থাকা দেখে সামু নিজেই বললো

“কোন বাধ্য হয়ে করা সম্পর্কে তোমাকে বেঁধে রাখতে চাইনা আমি, তুমি আজ থেকে আমার থেকে মুক্ত। আর কোনদিন সামু তোমায় ফোন করবে না ইনান ভাই আর না বিরক্ত করবে।তোমার এই জোরজবরদস্তি মুলক বন্ধনে আর থাকতে হবে না। আমি মাকে বলে দিয়েছি আমি এই বিয়ে করবো না, তোমাকে জানানো বাকি ছিলো আজ জানিয়ে দিলাম”

“হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিলে?”

“হঠাৎ নয় আজ অনেকদিন ধরে ভেবেছি তারপর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আমি বড্ড স্বার্থপর ইনান ভাই, তোমার ভালোবাসা পাওয়ার লোভে এটা ভুলেই গিয়েছিলাম যে ভালোবাসা জোর করে হয়না। সব কিছু জোর করে পাওয়া গেলেও মনের উপর জোর খাটানো যায়না। এই একমাস সব জেনে বুঝেও চুপ ছিলাম মনে হচ্ছিলো একবার বিয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু বিয়ে হয়ে গেলেই মানুষটা আমার হয়ে যাবে না কারণ সে অন্যকারো! এই যে দেখো সায়ান ভাই আর রুশি আপুর বিয়ে হয়েছে প্রায় একমাস অথচ সায়ান ভাই এখনো চন্দ্রিকা আপুকেই চায়। তোমার ক্ষেত্রেও তো একই তাই না ইনান ভাই!”

ইনান সামুর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো, ওই চোখে তাকিয়ে থাকার সাধ্য ওর নেই। সামুর সেই দৃষ্টি ওকে বড্ড কষ্ট দিচ্ছে, ঠিক সামু এই মুহুর্তে কতোটা অসহায় তা ওর থেকে ভালো কে বুঝবে? সামুর একই অবস্থানে এই মুহুর্তে ও তো আছে। ও নিজেই তো কাউকে ভালোবাসে বিবশ হয়ে আছে, সে কাছে থেকেও তাকে কখনো পাবে না। এই এক তরফা ভালোবাসায় কতো কষ্ট তা ওর থেকে ভালো কে বুঝবে?এতোগুলো বছরের প্রেম এক মুহুর্ত ভুলা তো সম্ভব নয়, সামুর কষ্ট আর ওর কষ্ট একই তবে কার গভীরতা কতোটুকু ওর জানা নেই। সামু চাইলেই কাঁদতে পারবে কিন্তু ও তো তা করতে পারবে কারণ ও ছেলে মানুষ আর ছেলেদের তো কাঁদতে নেই!

ইনান লেকের দিকে তাকিয়ে বললো

“তুমি সবটা জানতে?”

জবাব দিলো না সামু, স্মৃতির পাতায় ডুব দিলো সেই দিনের ঘটনায়…
সেদিন ইনান বিদায় নিয়ে বের হলে ও ইনানের জন্য তৈরি করা খাবারের বক্স নিয়ে তার পেছনে ছুটলো। ডাক দিতে গিয়েও দিলো না যখন দেখলো ইনান গেটের দিকে না যেয়ে বাগানের দিকে গেলো তাই ও কিছু না বলে তার পিছু নিলো!বাগানের একপাশের মোটা আম গাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়লো আর সবকিছু স্পষ্ট শুনতে পেলো। ইনান রুশিকে ভালোবাসে তাও অনেক বছর ধরে, প্রথমে রুশির উপর বড্ড রাগ উঠেছিলো।

ও নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না, একজন ওর হবু স্বামী আর আরেকজন ওর ভাবি! কি করে পারলো ওর সাথে এমন করতে? পরে বুঝতে পারলো রুশির কোন দোষ নেই আর হয়তো ইনানেরও নেই। যেহেতু রুশি ইনানকে তার জীবনে চায়না তাই ও সবটা চেপে গেলো, ভেবেছিলো একবার বিয়ে হয়ে সবটা ঠিক হয়ে যাবে ওই যে তার ভালোবাসা পাওয়ার বড্ড লোভ! কিন্তু আজ ভাবিকে ডাকতে গিয়ে তাদের কথা শুনে বুঝতে পারলো বিয়ে হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যায়না। ও মরীচিকার পেছনে দৌড়াচ্ছে যেটা আসলে তার হবার নয় তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইনানকে মুক্ত করে দিবে। একটা সম্পর্কে একজনকে বাধ্য করে কি লাভ এতে কষ্ট আরোও বাড়বে! যেটা তার ছিলো না সেটা তার কখনো হবে না তাই উপর মিথ্যে মায়া বাড়িয়ে কি লাভ?

সামু নিচের দিকে তাকিয়ে বললো

“জানো এতোদিন মনে হতো আমি ভালোবেসে ভুল করেছি কিন্তু এখন মনে না ভালোবাসায় কোন ভুল নেই বরং আমি ভুল মানুষকে ভালোবেসে ভুল করেছি। তুমি তো আমার কখনো ছিলেই না তাহলে তোমাকে আমি কি করে পেতে পারি বলো?”

সামু উঠে দাঁড়ালো আর একমুহুর্তও থাকবে না এখানে কিন্তু কিছুদুর যেতেই থেমে গেলো। তাকে আরেকটু দেখার লোভ সামলাতে পারলো না, ছুটে চলে এলো তার কাছে তারপর ধরা গলায় বললো

“আমাকে আজকের দিনটা দিবে ইনান ভাই?প্রমিস করছি কাল থেকে আর বিরক্ত করবো না তোমায়। আজকেই আমার সকল ইচ্ছে পুরণ করে নিবো যা তোমার সাথে পুরণ করতে চেয়েছিলাম। কাল থেকে তো…”

সামু চুপ হয়ে গেলো, আরেকটু কথা বললে কান্না চেপে রাখতে পারবে না ও। গলায় সব কথা জড়িয়ে গেলো যেনো। ইনান সেই টলমলে চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, সামুর মাঝে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছে, ভালোবাসা ঠিক এতোটাই অসহায় হয়! সকল কিছুর উর্ধে গিয়েই যেনো একটা মানুষকে চায়, খুব করে চায়!ইনানের জবাব না পেয়ে সামু হাটা ধরলো কিন্তু কেউ হাত চেপে ধরতেই থমকে গেলো, ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি খেলে গেলো।

ইনান সামুর হাত ধরে হেটে যাচ্ছে আর সামু ইনানের দিকে তাকিয়ে আছে। আর কোনদিন হয়তো এভাবে দেখা হবে না তাকে আর না তার কাছে ভালোবাসার আবদার করা হবে! সামু মনে মনে আওড়াতে থাকলো

“আমি আর তোমার সামনে আসবো না,আমাকে তোমায় ভুলতে হবে ইনান ভাই।তোমার জন্য হলেও তোমায় ভুলতে হবে। তবে মনে রেখো তুমি আমার কৈশর জীবন প্রেম তাই তোমায় চাইলেও ভুলতে পারবো না কিন্তু ভুলার অভিনয় তো করতে পারবো। প্রেমে পড়ে মানুষ কত কি করে,আমি নাহয় অভিনয়ে পারদর্শী হলাম!”

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_২১

রুশি আজ প্রায় এক মাস পর খান বাড়ির বাইরে পা রাখলো, এতোদিন শরীরটা খুব একটা ভালো ছিলো না তাই আর বের হয়নি। বাড়িতে এতোদিন নিজেকে কেমন যেনো ভারী ভারী লাগতো, কোন কাজ ছাড়া সারাদিন শুয়ে বসে থাকা বড় কষ্টকর তাছাড়া ছোট থেকে ওর কাজ করার অভ্যস, তবে রান্নাটা খুব একটা করা হয়নি। পালক মায়ের চাপে মাঝেমাঝে করলেও বেশ ভয়েই থাকতো, কারণ ও আগুনকে ভয় পায় মারাত্মক ভয় পায়!

রুশি রিক্সা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওনা হলো,খোলা বাতাসে প্রাণখুলে যেনো নিঃশ্বাস নিতে পারছে।রুশি সাবধানে বসে আশেপাশের প্রকৃতি দেখতে লাগলো,শীতে ঢাকা শহরের চিত্রই যেনো আলাদা। সবাই শীতের চাঁদর কিংবা জেকেটে নিজেদের মুড়িয়ে রেখেছে,ছোট ছোট বাচ্চারা বাবা-মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছে।আর কয়েকবছর পর ওর বাচ্চাও এভাবে ওর হাত ধরে স্কুলে যাবে। রুশি একটা বাচ্চার দিকে তাকিয়ে আছে, স্কুল ড্রেস পরা বাচ্চাটি বাবার কাঁধে করে রাস্তা আর হচ্ছে আর পাশে মা ব্যাগ নিয়ে তাদের সাথে সমানতালে হেঁটে যাচ্ছে! রুশির রিক্সা ক্রস করে চলে গেলেও ফাঁকা দিয়ে ও তাকিয়ে রইলো সে দিকে,এই বাচ্চাটি একটা সম্পুর্ণ পরিবার পেয়েছে যেখানে বাবা অফিস থেকে এসে হয়তো বাচ্চাটির সাথে খেলবে আর মায়ের সাথে রোজ সন্ধ্যায় বাচ্চাটি পড়তে বসবে!

কিন্তু ওর বেবি!সেতো এইরকম সম্পুর্ণ পরিবার পাবে না, কারণ তিনবছর পর তো রুশিকে এই সব ছেড়ে চলে যেতে হবে। রুশি এতোদিন এটা ভেবেছে ও চলে যাবে অনেক দুরে এসব ছেড়ে কিন্তু এখন ও ছেড়ে যেতে চায়না। বারবার মনে এইসব কিছু তো ওর তাহলে ও কেনো সরে যাবে?ওর মা, ওর বোন, ওর পরিবার আর ওর…

নাহ সবকিছু ওর হলেও স্বামী ওর নয়, সে অন্যকারো হবু স্বামী তাকে নিয়ে ভাবাই হয়তো পাপ। কোন সম্পর্ক তো কাগজের টুকরো দিয়ে মাপা যায়না, সবচেয়ে বড় সম্পর্ক গড়ে উঠে আত্মার মিলনের মাধ্যমে আর রুশি তো সায়ানের মনের কোন এক কোনা জুড়েও নেই!

রুশি এসব কথা ভাবতেই সামনের দিকে তাকালো, ওর কাছাকাছি বয়সের একটা মেয়ে ব্যাগ কাঁধে হেঁটে যাচ্ছে। রুশি দ্রুত রিক্সা থামিয়ে সেটা থেকে নেমে পড়লো তারপর ওই মেয়েটির হাত ধরে ফেললো আর টেনে কর্নারে নিয়ে গেলো। ওকে দেখে মেয়েটি বড্ড বিরক্ত তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে, রুশি আর কথা বাড়ালো না। চোখ মুখ শক্ত করে রাগি কন্ঠে বললো

“কেনো করলি আমার সাথে এমন? তুই তো বেস্টফ্রেন্ড ছিলি তাইনা?কি করে পারলি এমন করতে? আমাকে তুই একটা অপরিচিত ছেলের ঘরে অনায়াসে রেখে আসলি!”

রুশির হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলো মেয়েটি তারপর ঝাঝলো কন্ঠে বললো

“তুই আমার ফ্রেন্ড কখনো ছিলিই না বরং তোকে দেখে আমার হিংসা হতো।কলেজে একেতো তুই টপ ছিলি তারউপর সব ছেলেরা তোর পেছনে পড়ে থাকতো!আমি তোর থেকে বেশি স্মার্ট আর সুন্দর হয়েও আমি তোর কারণে ছেলেদের কাছে পাত্তা পাইনি, ছেলেরা তোকে লিখা লাভ লেটার আমাকে দিয়ে যেতো! তাই তোকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু সুযোগ পাইনি,আর তাছাড়া তুই ভালো ছাত্রী তোর হেল্প তো পড়াশোনায় লাগতোই। তবে কলেজ শেষে আমি তোকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম কিন্তু একদিন ক্লাবে ছেলেদের কাছে বাজি হেরে যাই আর তারা আমাকে বাজে অফার দেয়। ঠিক তখনি মনে পড়লো তোর কথা আর আমি তোর সাথে যোগাযোগ করি আর সুযোগ বুঝে তোকে সেই ক্লাবে নিয়ে যাই!কিন্তু তোর ভাগ্য ভালো যে ওই ছেলেগুলো তোকে অন্য একজনের কাছে ভালো দরে বেচে দিয়েছিলো নাহয় ভাব পাঁচ ছয়টা ছেলে একসাথে…”

কথাটা শেষ করার আগেই রুশি তিথিকে থাপ্পড় মারলো খুব জোরে, তারপর আরেকটা মারতে গিয়েও সামলে গেলো। এইরকম জঘন্য মানসিকতার মেয়ের গায়ে আর হাত তুলে নিজের হাত নোংরা করতে চায়না। শুধুমাত্র জেলাসির বশে এই মেয়েটি একটা নারী হয়ে অন্য নারীর পুরো জীবন নষ্ট করে দিলো? ওর একটুও বুক কাঁপলো না, রুশির প্রতি কি ওর এক ফোটাও দয়া হলো না। মানুষের তো অনেকদিন থাকলে কুকুরের প্রতিও মায়া জন্মায় আর ওর জলজ্যান্ত মানুষের প্রতি দয়া হলো না? এতোটা পাষান্ড হয় কি করে মানুষ?

ও নিজের রাগকে শান্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো

“তুই এতোটা জঘন্য আমি ভাবতেও পারিনি, সামান্য জেলাসির কারণে তুই আমার সবচেয়ে জিনিস আমার সম্মান তুই কেড়ে নিলি?আমার তো তোর সাথে কথা বলতেও বিবেকে বাঁধছে!মনে রাখিস উপরওয়ালা সব দেখছে,তিনি সবকিছুর বিচার করবেন। আমি তারউপর সব কিছু ছেড়ে দিলাম।”

বলেই রুশি উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলো তারপর দেখলো রিক্সাওয়ালা মামা এখনো দাঁড়িয়ে আছে, ও সেটাতে উঠে রওনা দিলো।ভার্সিটির দিকে নয় বরং সেই পার্কে! যেখানে ও মন খারাপ হলেই বসে থাকতো। ও সেখানে গিয়ে ধপ করে বসে পড়লো, চোখের সামনে যেনো তিথির সাথে কাটানো সকল স্মৃতি ঘুরছে।ওদের একসাথে চলা, কথা বলা, কাড়াকাড়ি করে ফুচকা খাওয়া! সব মিথ্যে ছিলো সব, সবকিছু অভিনয় ছিলো কি নিখুঁত অভিনয়! অথচ ও সব সত্যি ভেবেছে কিন্তু সবকিছু একপাক্ষিক ছিলো বরং সবাই ওকে ব্যাবহার করেছে।

ওর চোখদুটো লাল হয়ে আছে, কিন্তু ও কাঁদছে না বরং রাগে শরীর ফেটে যাচ্ছে। এতো বোকা কি করে হলো ও, ওদের করা অভিনয় ও বুঝতে পারলো না?রুশি মাথা চেপে বসে আছে, খুব অসহায় লাগছে নিজেকে! পাশে ফোন বেজে যাচ্ছে কিন্তু ও তুলছে না। এভাবে কতোক্ষণ বসে ছিলো ওর জানা নেই, হঠাৎ কারো ছোঁয়ায় চমকে উঠলো। পাশে তাকিয়ে সায়ানকে দেখে যেনো আরো অবাক হয়।সায়ান কি করে জানলো ও এখানে?আর তাকে এতো টেন্স দেখাচ্ছে কেনো। সায়ান রুশির গালে আলতো হাত রেখে বললো

“তুমি ঠিক আছো?এই সময়ে এখানে কি করছো?”

কথাটা শুনতেই রুশির গাল বেয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়লো, ও জানেনা কেনো কাঁদলো কিন্তু এখন কাঁদতে ইচ্ছে করছে বড্ড! রুশির চোখের পানিগুলো সায়ান সযত্নে মুছে দিলো তারপর গালে হাত রেখে বললো

“কাঁদছো কেনো? কি হয়েছে?কেউ কিছু বলেছে?”

রুশি মাথা নাড়ালেও ওর কান্নার বেগ বেড়ে গেলো, কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেছে। সায়ান রুশির এই অবস্থা দেখে ওকে নিজের বাহুডোরে নিয়ে গেলো আর রুশি সায়ানের বক্ষে মাথা রেখে হিচকি তুলা কন্ঠে বললো

“ও আমাকে শুধুমাত্র ব্যাবহার করেছে, আমার বেস্টফ্রেন্ড হয়েও আমাকে বিক্রি করে দিয়েছে অন্যছেলেদের কাছে। ওইদিন যদি আপনি ওইখানে না থেকে অন্য ছেলেরা থাকতো…”

রুশির জড়ানো কন্ঠে বলা শব্দগুলো শুনে সায়ানের বুক ছ্যাঁত করে উঠলো, ওইদিন শুধু ও না বরং রুশিও কারো বিশ্বাস ঘাতকতার স্বীকার হয়েছে। সায়ান হাত মুঠ করে ফেলেছে, সত্যি এমন ঘটনা ও কল্পনাও করতে পারছে না। অথচ রুশি একট অপরিচিত ছেলের হাতে পড়েছিলো সেদিন,এখন যতোই ওকে চিনুক না কেনো একসময় ওতো রুশির মনে হায়না থেকে কম ছিলো না! ও সত্যিই জঘন্য কাজ করেছে, প্রচণ্ড খারাপ কাজ। সায়ান মাথানিচু করে রুশির মাথায় আলতো হাত ভুলাতে থাকলো। এই ঘটনার পেছনে যারাই জড়িত তাদের কাউকে ছাড়বে না ও, কাউকে না।

রুশির কান্নার বেগ কমে আসলে সায়ান মৃদু স্বরে বললো

“কিচ্ছু হয়নি, সব ঠিক আছে দেখো! আমি তোমার কিছু হতে দিবো না, তুমি আর কান্না করো না প্লিজ”

সায়ানের কথায় রুশি বাস্তাবতায় ফিরে আসলো, আলতো করে সায়ানকে সরিয়ে দিয়ে ঠিক হয়ে বসলো। চোখের পানি মুছে সায়ান দিকে না তাকিয়ে বললো

“এভাবে আর আমাকে জড়িয়ে ধরবেন না আর না কেয়ার করবেন আমার।মাত্র তিনবছরের সম্পর্কে আমি কোন প্রকার মায়া জড়াতে চাইনা। এসব আপনার কাছে হয়তো স্বাভাবিক কিছু কিন্তু আমি মনের অজান্তেই এমন স্বপ্ন দেখে ফেলবো যা দেখার অধিকার আর যোগ্যতা আমার নেই। আশাকরি বুঝতে পেরেছেন!”

রুশি হুট করেই দাঁড়িয়েই হাটা শুরু করলো, সায়ান সেদিকে অধির আগ্রহে তাকিয়ে আছে হয়তো একবার হলেও ফিরে তাকাবে কিন্তু তাকায়নি, নিজের মতো করে চলে গেলো গাড়ির দিকে। সায়ান দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো,রুশি ফোন না ধরাতে ও কতোটা চিন্তিত ছিলো তা হয়তো ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না, তারপর ট্রেকার অন করে বুঝতে পারলো রুশি এখানে আছে। একা একা রুশি বেরিয়েছে তাও এই অবস্থায় তারউপর গাড়িও নেই। সত্যি বলতে সায়ান বড্ড ক্ষেপে গিয়েছিলো কিন্তু রুশির অবস্থা দেখে আর কিছু বলেনি। ও নিজেও উঠে দাঁড়ালো, ও কাউকে ছাড়বে না ও যার জন্য রুশি এতো কষ্ট পাচ্ছে! কাউকে না।

দুটো মানুষ পাশাপাশি বসে আছে কিন্তু তাদের মাঝে কোন কথা নেই। সায়ান কতোক্ষণ পর তাকালেও রুশি একবারের জন্যও তাকায়নি, যেনো পণ নিয়েছে দুনিয়ায় কেয়ামত হয়ে গেলেও পাশের মানুষটির দিকে তাকাবে না, ভুলেও না। কতো পাশাপাশি বসে আছে দুজন অথচ মনের দুরত্ব কতো বিশাল!

#চলবে

গুমোট অনুভুতি পর্ব-১৮ ( প্রথমাংশ ও শেষাংশ)

0

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১৮(প্রথমাংশ)

বাগানের পাশটায় বাহারি ধরনের ফুলের গাছ, ফলের গাছ এমনকি সবজি গাছ রয়েছে, চারদিকে যেনো সবুজের সমারোহ!তবে তার মাঝে লাল গোলাপ আর সাদা বেলিফুলগুলো যেনো বিশেষ দৃষ্টি কাড়ছে। এখানে অনেক নাম না জানা ফুলের গাছ রয়েছে যাদের কোনদিন হয়তো দেখাও হয়নি রুশির। তবে ওর দৃষ্টি শুধুমাত্র ওই বেলিফুলগুলোতে সীমাবদ্ধ, একসময় বেলিফুল খুব পছন্দের ছিলো ওর এখনো হয়তো পছন্দের তবে তার গভীরতা কম। প্রায় অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে, ওর বেলিফুল সেদিন থেকে আরো বেশি ভালো লাগতো যখন ওর কাছে আসা চিঠিগুলো থেকে বেলিফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে আসতো! ও প্রান খুলে নিশ্বাস নিতো সেই চিঠিগুলো থেকে, কিন্তু এখন সেই সম্পর্ক ফিকে হয়ে গেছে নেই বললেই চলে তাই এখন আর বেলিফুল তেমন একটা টানে না ওকে। কেমন জানি সেই সম্পর্কের মতো বেলিফুলের গন্ধটাও বাসি মনে আজকাল।

রুশি সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সদ্য ফোটা লাল গোলাপগুলোর দিকে তাকালো, কি সচ্ছ্ব আরা সতেজ! তবে তাতে কাটা আছে যা অনেক কষ্টদায়ক ঠিক ওর জীবনের মতো।বাহ্যিক দিক থেকে কতো সু সুন্দর দেখতে! বড়লোক স্বামী,আলিশান বাড়িতে থাকছে, ওঢেল টাকা, স্টেটাস।কি নেই ওর জীবনে? হাজারো মেয়ে হয়তো এমন একটা জীবনের রোজ স্বপ্ন দেখে কিন্তু ভেতরটা ঠিক কাটার মতো যন্ত্রণার। ওর স্বামী আছে কিন্তু সে অন্যকে ভালো বাসে অর্থাৎ থেকেও নেই আর টাকা!সেটাতো ও কোনদিন চায়নি। চেয়েছে একটা ছোট্ট সংসার যেটাকে ও নিজের ঘর বলতে পারবে, একজন মানুষকে নিজের বলে অধিকার বোধ দেখাতে পারবে।

কিন্তু সবার ভাগ্যে সবকিছু থাকে যেমন ওর ভাগ্যে নেই। কিন্তু ও ভালো আছে বেশ ভালো, এটলিস্ট এখানে ওর একজন মা আর বোন আছে যারা ওকে ভালোবাসে! রুশি দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে সেখান থেকে চলে আসতেই নিচ্ছিলো তখন কেউ একজন হাত টেনে ওকে বাগানের এক কোনে নিয়ে যায়, এদিকটায় খুব একটা কেউ আসেনা। রুশি তার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছে মানুষটি কে?নাকে বারবার বেলিফুলের মৃদু ঘ্রাণ বারি খাচ্ছে না চিনে কি করে সে?

রুশি কিছু রাফ ভাবে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো তারপর না তাকিয়েই বললো

“এভাবে একটা মেয়ের হাত হুট করে টেনে ধরা কোন ভদ্রতার মাঝে পড়ে মিস্টার ইনান!তাও তার হাত ধরা যে সম্পর্কে আপনার থেকে বড়। ভুলে যাবেন না আমি আপনার ভাবি হই, আপনার বন্ধু এবং আপনার সম্বন্ধীর স্ত্রী। আশাকরি সম্মান বজায় রাখবেন”

“তোমাদের বিয়ের সত্যিটা আমি জানি রুশি তাই আমার সামনে অন্তত ভাবি হওয়ার মিথ্যে নাটকটা করোনা।শুনো সায়ান তোমাকে ভালোবাসে না আর কোনদিন স্ত্রীর মর্যাদা দিবে না তাই তুমি ওকে যথাসম্ভব ডিভোর্স দিয়ে দাও। ওর সাথে তুমি সুখে থাকবে না, ও তোমাকে কোনদিন সম্মান করেনি আর করবেও না।ও তোমাকে জাস্ট নিজের রাখছে ওর সন্তানের জন্য, সন্তান হলেই তোমাকে ছুড়ে ফেলে দিতে এক সেকেন্ডও লাগবে না!”

রুশি এতোক্ষন চুপ করেই থাকলেও এখন আর চুপ করে থাকতে পারলো না, সায়ান ওকে মেনে নেয়নি সেটা ও জানে কিন্তু ওর দায়িত্ব তো ও পালন করছে,সায়ান অন্যকাউকে ভালোবাসে সেটা সেই প্রথম দিন থেকে ও জানে তবে ইনানের মুখ থেকে শুনে কেমনজানি অপমানবোধ করলো তাই কড়া গলায় বললো

“আমার আর সায়ানের মাঝে যা আছে তা সম্পুর্ণ আমাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার,এতে নাক গলানোর অধিকার আমি কাউকে দেইনি”

“আমি নাক গলাবো না কেনো যেখানে এটার সাথে আমার জীবন জড়িত, আমি আলবৎ জড়াবো এতে। তোমাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার মানে?”

“সায়ান আমার স্বামী তাই স্বামী স্ত্রীর ব্যাপার ব্যাক্তিগত ব্যাপারই হয়”

ইনান রুশির কথায় রেগে গেলো, তারমানে রুশি সায়ানকে স্বামী হিসেবে মানে! ওর মনে তাদের অতীতের কোন স্মৃতি নেই।সেদিন ও শুধুমাত্র আসেনি বলে আজ ও সায়ানের উপর বেশি ভরসা করছে যে কিনা ওকে ভালোই বাসেনা অথচ ও রুশিকে পাগলের মতো ভালোবাসে! ও রুশির বাহু চেপে ধরে বললো

“তুমি ওকে স্বামী মানো মানে কি?তুমি বুঝতে পারছো না যে তুমি ওদের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি!তাও কি করে তুমি তাদের মাঝে কি করে আছো?”

“একটু আগে আপনি বললেন আমার সায়ানকে ছেড়ে দেয়া উচিৎ কারণ সে আমায় সম্মান করেনা অথচ এখন আপনিও আমাকে সম্মান করছেন না। তাহলে সায়ান আর আপনার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? এটলিস্ট হি রেস্পেক্টস মি বাট ইউ ডোন্ট”

বলেই রুশি হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে ইনান ওকে জড়িয়ে ধরে আর শান্ত স্বরে বলে

“আমি তোমাকে ভালোবাসি রুশি আগের থেকে অনেক বেশি, তুমি জানো তোমাকে ছাড়া এতোদিন কত কষ্ট হয়েছে আমার?অনেক ভালোবাসি তোমায় রুশি, প্রচণ্ড বেশি। আমি জানি আমি সেদিন আসিনি কিন্তু তার কারণ ছিলো বিশ্বাস করো!এরপর আমি তোমায় অনেক খুজেছি, ফোন করেছি কিন্তু নাম্বার বন্ধ ছিলো তোমার। আমি এই বিয়ে নিজের ইচ্ছেতে করছিনা রুশি, সামু আমাকে ভালোবাসে! আমি ওকে কখনোই ভালোবাসিনি আর বাসতেও পারবো না। তুমি শুধু রাজি হয়ে যাও আমি এখনি সামুর সাথে নিজের এংগেজমেন্ট ভেংগে দিবো। প্লিজ তুমি সায়ানকে ছেড়ে দাও আর আমার কাছে চলে আসো”

রুশি এতোক্ষন স্ট্রাগল করেছিলো ছুটার জন্য, হঠাৎ কোথা থেকে এতো শক্তি এলো ও জানে কিন্তু ও এক ধাক্কায় ইনানকে নিজের থেকে আলাদা করে ফেলে। ইনান পড়ে যেতে নিয়েও সামলে নেয়। রুশি রাগে যেনো ফেঁটে পড়ে, গলার স্বর অনেকটা উঁচু করে বলে

“আপনি ভাবলেন কি করে আপনার মতো নীচ লোকের কাছে আমি ফিরে যাবো?কি ভাবেন কি নিজেকে আপনি। একসময় আমার মন ভেংগেছেন আর আজ আরেকটা মেয়ের মন ভাংতে চাইছেন?ন্যূনতম মনুষত্বো কি হারিয়ে ফেলেছেন?একটা মেয়ে এতোটা ভরসা করে আপনার হাত ধরতে চাইছে, সবকিছু ছেড়ে কয়েকদিন পর আপনার হয়ে যাবে অথচ আপনি আমার প্রতি নিজের পুরোনো ভালোবাসার দোহায় দিয়ে মাঝপথেই হাত ছেড়ে দিতে চাইছেন?তিলেতিলে গড়ে উঠা ওর স্বপ্ন ভেংগে চুরে শেষ করে দিতে চাইছেন?কাল তো অন্যের জন্য আমাকে ছুড়ে ফেলতে দুইমিনিট ভাববেন না। আপনার এই সস্তা ভালোবাসা আমার চাইনা।”

“খবরদার আমার ভালোবাসা কে তুচ্ছ করবে না,তুমি ধারণাও নেই কতোটা চাই আমি তোমাকে! আসলে কি বলোতো,সায়ানের টাকা অনেক বেশি তো!তাই তুমি ওর লাইফে তৃতীয় ব্যাক্তি হতেও দ্বীধাবোধ করছো না। আই অলসো হ্যাভ মানি সো কাম টু মি।”

ইনান কথা শেষ করার প্রায় সাথে সাথে গালে ব্যাথা অনুভুত হলো, ঠোঁট কেটে রক্ত বের হচ্ছে।কিন্তু ওর তাতে বিন্দুমাত্র আফসোস নেই কারণ ও নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না ও কি বলেছে!রাগের মাথায় হুশ হারিয়ে বসে আছে, এতো জঘন্য কথা ও রুশিকে বললো কি করে?ও জানে রুশির কাছে ওর আত্মসম্মান সবচেয়ে বড় আর ও কিনা সেই আত্মসম্মানে আঘাত করলো। ইনান যখন নিজেকে তিরস্কার দিচ্ছিলো ঠিক তখন রুশি ওর কলার চেপে ধরে বলে

“কি ভাবেন নিজেকে? টাকা দিয়ে সব কিনে নিতে পারবেন আপনারা? আপনার কি মনে সায়ান জামিল খানের অনেক টাকা আছে তাই আমি তাকে বিয়ে করেছি?নাহ আপনি ভুল! আমি বিয়ে করেছি আমার সম্মানের জন্য যাতে এই সমাজের মানুষ আমার দিকে আংগুল তুলতে না পারে যে আমি অসতি। আমার বাচ্চাকে যাতে বড় হয়ে শুনতে নাহয় যে সে অবৈধ তার কোন বাবা নেই।আমি কারো তৃতীয় ব্যাক্তি হিসেবে কখনোই ছিলাম না আর থাকবোও না। আপনার কি মনে হয়, একটা মেয়ের বেচে থাকতে হলে ছেলের প্রয়োজন হয়?নাহ আপনি ভুল ভাবছেন। আমার লাইফে কোন ছেলের প্রয়োজন নেই, আমি ঠিক সময়মত তার জীবন ছেড়ে চলে যাবো। তবে হ্যাঁ আমি তার সাথে থাকি আর না থাকি এটা নিশ্চিত থাকেন আমি আপনার জীবনে কখনো ফিরে যাবো না। আজ থেকে আমি আপনাকে চিনি না, আমি ভুলে যাবো আমার জীবনে এমন কোন মানুষ ছিলো যার প্রতি আমার মায়া কাজ করতো,যে আমার ভালো বন্ধু ছিলো।”

বলেই রুশি ইনানের কলার ছেড়ে দিলো আর উল্টোপথে হাটা শুরু করলো, কিন্তু ভেবে আবার থেমে গিয়ে ইনানের দিকে ফিরে বললো

“আপনার আর সায়ানের মাঝে সবচেয়ে বড় পার্থক্য কি জানেন?সে আমাকে সম্মান করে কিন্তু আপনি না। তাই আপনার সাথে থাকার থেকে আমি তার সাথে থাকা প্রিফার করি,আর যাইহোক আমাদের সম্পর্কটা সম্মানের!”

বলেই আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায়নি বরং উল্টোপথে হাটা ধরলো, এদিকে ইনান খুব জোরে দেয়ালে আঘাত করলো, হাত ফেটে রক্ত বের হচ্ছে কিন্তু তাতে যেনো কষ্ট হচ্ছে না। মনের কষ্ট তার চেয়ে অনেক বেশি, কি করে পারলো এমন কথা বলতে?এখন তো রুশি ওকে হেট করবে এটা বেঁচে থাকতে কি করে সহ্য করবে?ভালোবাসার মানুষের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখার চেয়ে মরে যাওয়াই তো শ্রেয়!ইনান হাটু গেড়ে বসে পড়লো সেখানে,তার চোখে একরাশ অনুতাপ ফুটে উঠেছে!

রুশি মেইন বাগানে আসতেই থমকে দাঁড়ালো,এতোক্ষন ও কাঁদছিলো কিন্তু এখন যেনো কান্নাও থেমে গেলো। সামনে সায়ান দাঁড়িয়ে আছে, নিশ্চিত সায়ান সব শুনেছে!ইনান আর ওর সম্পর্কে কি তাহলে সব জেনে গিয়েছে? কতোটুকু শুনেছে ও। এখন কি তাহলে ইনান আর সায়ানের সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে? আর সামু! সেতো ইনানকে প্রচণ্ড ভালোবাসে তাহলে নিজেকে কি করে সামলাবে সে। ওকি তাহলে এরপর থেকে রুশিকে ঘৃণা করবে?রুশি কি তাহলে ওর বোন হারিয়ে ফেলবে?রুশির চোখে যেনো একরাশ অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে!

#চলছে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১৮(শেষাংশ)

পুরো বাগান জুড়ে সাঁশাঁ শব্দ ব্যতীত অন্যকোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না, দুজন নর-নারী বাগানের ঠিক মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে। একজনের চোখে বিস্ময় ও রাগ আর আরেকজনের চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। সায়ানের এই শ্বাসরুদ্ধকর চাহনি দেখে রুশি জড়োশড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কোন শব্দ করার সাহস পাচ্ছে না। সায়ান ঠিক কতোটা রেগে আছে তা অনুমান করতে পারছে না, ক্রমাগত ও নিজের হাত মুচড়ে যাচ্ছে।

মনে মনে ভাবছে কি করে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায় আর সায়ানকে ঠান্ডা মাথায় সবটা বুঝিয়ে বলা যায়। কারণ এই মুহুর্তে সকল ছেলের রেগে যাওয়া স্বাভাবিক, নিজের বোনের প্রতি কোন অন্যায় ছেলেরা কখনোই সহ্য করতে পারেনা! সায়ানের চাহনিতে ও নিজের কষ্ট সেই কবে ভুলে গিয়েছে,চোখে জমে থাকা পানি গুলোও যেনো পড়ার সাহস পাচ্ছে না।

এমন না যে ও ভয় পাচ্ছে সায়ান ওকে কিছু বলবে বা কিছু করবে। বরং ওর ভয় লাগছে সায়ান এই মুহুর্তে ইনানের সাথে মারামারি বাধিয়ে দিবে, হয়তো দুজনেই ব্যাথা পাবে। বাড়ির সকল লোক এখানে জড়োশড় হবে আর কারণ জানতে পেরে রুশিকে ভুল বুঝবে, অর্থাৎ ওর হঠাৎ পাওয়া পরিবার আবার হারিয়ে যাবে। মা, বোন যাদের চোখে অনেক ভালোবাসা আর মায়া দেখতে পায় তাদের জন্য ঘৃণা আর বিরক্তি দেখতে পাবে যা ও সহ্য করতে পারবে না। রুশি সায়ানকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সায়ান কিছুটা চড়া কন্ঠে বলে উঠলো

“তুমি এখানে কি করছো তাও একা একা? কতো হাওয়া বইছে দেখছো! শেষে ঠান্ডা জ্বর বাধিয়ে বসে থাকবে, আর তোমার সাথে সাথে বাবুরও ক্ষতি হবে।চলো ভেতরে চলো, গরম কাপড় ছাড়া আর ঘর থেকে বের হবে না আর সাবধানে হাটাচলা করো”

বলেই সায়ান রুশির হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যাওয়া শুরু করলো, রুশি সায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। আশ্চর্য ভাবে সায়ান এভাবে অধিকারবোধ দেখিয়ে ওকে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু ওর এক বিন্দুও খারাপ লাগছে না বরং কোথাও একটা ভালো লাগা কাজ করছে। অথচ কিছুক্ষণ পুর্বেও ইনান থেকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেছিলো কিন্তু এখন ও তার কিছুই করছে না। নিজের এমন পরিবর্তনে নিজেই যেনো অবাক হলো রুশি! তবে কি সায়ান রুশির স্বামী বলে ও তাকে বাঁধা দিচ্ছেনা?কিন্তু ও তো সায়ানকে স্বামী হিসেবে মানে না তবে অনুভুতির কারণ কি?

রুশি কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বুঝতেই পারেনি যে ও কাঁদছে,ফুঁফিয়ে কাঁদছে। আসলে সায়ানকে হঠাৎ করেই যেনো আপন মনে হলো ওর, মনে হলো এই বাড়িতে আপন বলতে ওই আছে যার সামনে কাঁদা যায়। চিৎকার করে না হোক নিঃশব্দে হলেও যায়। রুশির ফোঁফানোর আওয়াজে থমকে দাঁড়ালো সায়ান,পেছনে ফিরে রুশিকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। গাল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে অথচ শব্দ বের হচ্ছে না। শুধু মাত্র কিছুক্ষণ পরপর নাক টেনে উঠছে, শরীর সেই সাথে মৃদু কাঁপছে। সায়ান রুশির মুখটা হাত দিয়ে টেনে উঁচু করলো,রুশির চোখ তখনো বন্ধ।সায়ানের চোখে মুখে চিন্তা ফুটে উঠেছে,ও রুশির চোখের পানি আলতো হাতে মুছে দিয়ে মৃদু স্বরে বললো

“কাঁদছো কেনো হুম?কেউ তোমাকে কিছু বলেছে!তোমার কি মন খারাপ রুশি?”

‘রুশি’ নামটা শুনতেই রুশি চমকে উঠলো, এই প্রথম সায়ান ওকে রুশি বলে ডেকেছে এর আগে রুশানি বলে ডাকতো। যাইহোক রুশি নিজের মুখ আবারও নিচু করে বললো

“নাহ তেমন কিছুনা আমি ঠিক আছি, আর আমি কান্না করছিলাম না, হঠাৎ কি যেনো এসে চোখে পড়ছে তাই চোখের পানি পড়ছে। আপনি ভুল ভাবছেন”

সায়ান রুশির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কতোক্ষণ, সায়ান জানে রুশি মিথ্যে বলছে কারণ ওর ঠোঁট কাঁপছে! ও কিছু একটা নিয়ে আপসেট তাই কান্না করেছে কিন্তু সায়ানকে সেটা বলতে চাচ্ছে না কিন্তু সায়ান বলার জন্য জোর করতে চাইলো না। হয়তো কোন একদিন নিজ থেকেই নাহয় বলবে এই ভেবে সায়ান চুপ মেরে গেলো। তারপর রুশিকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো, রুমে গিয়ে রুশি গরম সুয়্যেটার পরিয়ে দিলো তারপর হাল্কা কড়া স্বরে বললো

“আর যাতে সুয়্যেটার ছাড়া বের হতে না দেখি তাহলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে। এই শীতকাল পুরোটা সাবধানে থাকবে আর একদম ঠান্ডা জাতীয় কিছু ধরবে না”

“জি বুঝলাম!”

এদিকে ইনান একটা বিশাল খোলা পার্কে দাঁড়িয়ে আছে, হাতের আর ঠোঁটের কাটা স্থানে রক্ত জমাট বেঁধে আছে, বেন্ডেজ করা হয়নি। কিন্তু সেদিকে ইনানের খেয়াল নেই বরং ও তাকিয়ে আছে সামনের ছোট্ট সেই বেঞ্চটার দিকে। এই পার্কেই সেদিন রুশির সাথে দেখা করার কথা ছিলো ওর,খুব এক্সাইটেড ছিলো সেদিন ও। নিজের হাতে কার্ড বানিয়েছিলো,একঘণ্টা আগেই রেডি হয়ে গিয়েছিলো। ভেবেছিলো রুশির জন্য কিছু স্ন্যাকস কিনবে আর সাথে রুশির পছন্দের বেলিফুল!

ও ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো যখন দেখেছিলো তখন ওর মায়ের চিৎকার শুনতে পায়। দৌড়ে বাবার ঘরে যেতেই দেখে সে মেঝেতে পড়ে আছে, আর তার পাশে বসে ওর মা তাকে উঠানোর চেষ্টা করছে। দ্রুত ওর বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় ওরা, জানতে পারে যে ওর বাবা সিভিয়ার হার্ট এটাক করেছে।ও যেনো সম্পুর্ণ ভেংগে পড়ে, বাবার এই অবস্থা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না।এদিকে ওর মা বারবার সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছিলো। পরেরদিন ওর বাবার অপারেশন হয়। ডাক্তার বলেছে বাহাত্তর ঘন্টার পুর্বে জ্ঞান না ফিরলে কিছু করার নেই। দেখতে দেখতে ঘন্টা গুলো পার যাচ্ছিলো, একের টা ঘন্টা যেনো বছরের ন্যায় মনে হচ্ছিলো। ও কান্না করতেও পারছিলো না কারণ তাতে ওর মা আরো ভেংগে পড়বে। অবশেষে ডাক্তার ওর বাবাকে মৃত ঘোষণা করে, ওদের পুরো দুনিয়া যেনো তচনচ হয়ে গিয়েছিলো।

সেই ছোট্ট বয়সে ওকে কোম্পানির হাল ধরতে হয়েছিলো যদিও প্রধান দায়িত্বে ওর দুরসম্পর্কের একজন মামা ছিলো। একদিকে মাকে সামলানো অন্যদিকে কোম্পানি তারউপর ও নিজেই তখন ছাত্রজীবনে ছিলো। ওর মাকে সামলানো সবচেয়ে কঠিন ছিলো, মাত্র সতেরো বছর বয়সে ওর মার সাথে ওর বাবার বিয়ে হয়েছিলো। নিজের প্রাণপ্রিয় সাথির হঠাৎ মৃত্য তিনি সহ্য করতে পারেননি আর যাইহোক ওর মা সাবিনা আন্টির মতো শক্তমনের নয়, অনেক কোমলমতি সে!

তারউপর কোম্পানিতে চলছিলো সবচেয়ে বড় ঝামেলা। ওর বাবার হঠাৎ মৃত্যুর কারণ ছিলো এই কোম্পানি, তার বিজনেস পার্টানার অনেক টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে যার ফলে অনেক টাকা লস হয়েছে আর কোম্পানি প্রায় দেউলিয়া হতে যাচ্ছিলো। এজন্য সেই শকে আর প্রেশারে তিনি হার্ট এটাক করেছেন!সেই কোম্পানিকে তুলতে ওর অনেক সময় লেগেছে, এখনো সেই কোম্পানি সায়ানের কোম্পানির ন্যায় অত বড় নয়। ওর জীবনে এতোকিছু চলছিলো যে ও রুশির খোঁজ নেয়ার সময় পায়নি,তারপরও ও সেই স্কুলে গিয়েছিলো যেখানে রুশি পড়তো কিন্তু কিছুই জোগাড় করতে পারেনি, এমনকি রুশির এড্রেসও না। রুশির যেহেতু কোন বন্ধু ছিলো না তাই রুশিকে খোজাই অসম্ভব ছিলো,অথচ আজ ওর সাথে দেখা হয়েছে তাও সে এখন অন্যাকারো স্ত্রী আর সন্তানের মা!

ও রুশিকে প্রথম দেখেছিলো বাস স্ট্যন্ডে, গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিলো এক কোনে। ছোট্ট একটা মেয়ে হাতে মোটা গাইড আর কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ, স্কুল ড্রেসে কাউকে এতো সুন্দর লাগতে পারে ওর জানা ছিলাম না। উঁচু করে করা ঝুটি যেনো সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলো,সব মিলিয়ে ও মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছিলো। তারপর স্কুলের একটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে ওর নাম রুশি, সেই থেকে গোপনে চিঠি লিখতো তাকে!

সে হয়তো জানতোই না তার আশেপাশে কেউ একজন তার দিকে তাকিয়ে থাকতো! এতোটা বেখেয়ালি ছিলো সে। পরে পরে তার থেকেও চিঠি আসতো, তারপর ফোনে কথা বলা সবকিছুই ঠিক ছিলো। হুট করেই ওর জীবনে অজানা ঝড় এসে সব শেষ করে দিলো। ও রুশিকে প্রথম কয়েকদিন ফোন করতে পারেনি কিন্তু বাবার মৃত্যুর কয়েকদিন পর যখন ফোন করে তখন তা সুইচড অফ ছিলো, তার পর থেকে ওই নাম্বারে হাজারো বার কল করেছে কিন্তু অপরপাশ থেকে কেউ ধরেনি। ও বারবার হতাশ হয়েছে কিন্তু আশা ছাড়েনি আর আজ দেখো কোন আশাই যেনো। সে এখন অন্যকারো কথাটা ভাবতেই বুক চিরে যাচ্ছে, এতো কষ্ট কেনো ভালোবাসায়?যদি সে আমার ভাগ্যে নাই থাকে তবে তার প্রতি অনুভুতি কেনো সৃষ্টি হয়?কেনো এই অনুভুতি গুলো কষ্ট দেয় ওকে।

একেরপর এক সিগারেট শেষ করছে ও, এর আগে কখনো খায়নি তবে আজ খাচ্ছে। মনে হচ্ছে কয়েকমুহুর্তের জন্য হলেও সব ভুলে যাবে কিন্তু তা আর হলো কই?এই কষ্ট যে তাকে আজীবন বহন করতে হবে!

____________________

সায়ান খান বাড়িতে এসেছে প্রায় একমাস হতে চললো,ওর মায়ের সাথে সম্পর্কটা আগের মতো ওতো তিক্ত নেই বরং অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে যদিও দুজনের একজনও ঠিক মতো কথা বলে না তবে রুশির মতে সে দিনও খুব বেশি দেরি নেই। রুশি বেশ অবাক হয়েছে যে সায়ান এই একমাস প্রতিদিন এখানে এসেছে অফিস থেকে এবং নিজের বাড়িতে যায়নি। এমনকি কষ্ট করে সোফায় ঘুমায় রোজরোজ তবুও অন্যরুমে ঘুমায় না।সত্যি বলতে ছেলেটা কি চায় ও জানে না,এই কয় মাস ও ছায়ার মতো রুশির সাথে যতক্ষণ বাসায় ছিলো। আর প্রেগন্যান্সির কারণে রুশির মুডসুইং এতোবেশি ছিলো যে ও মাঝরাতে হঠাৎ বসে কাঁদতো আর সায়ান জেগে জেগে শান্তনা দিতো! কিছুই মুখে দিতে পারতো না বমির কারণে, সায়ানের শরীরে কতোবার বমি করেছে হিসাব নেই তবে সে টু শব্দ করেনি!
আরো ওকে শান্তনা দিয়েছে যে সব ঠিক হয়ে যাবে।

রুশি বারান্দায় দাঁড়িয়ে এসবই ভাবছিলো, এই একমাসে সায়ান প্রায় ওর বন্ধুর মতো হয়ে গেছে।রুশি না চাইতেও দিনদিন সায়ানের প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, ও জানে এটা ভুল তবুও সেই ভুলটাই করতে ইচ্ছে। খুব বেশি কি ক্ষতি হতো যদি ওদের সম্পর্ক আর পাঁচটা সম্পর্কের মতো নর্মাল হতো?রুশির ভাবনার মাঝেই সায়ান হঠাৎ বলে উঠলো

“তুমি কি কাউকে কখনো ভালোবসেছো রুশি?”

সায়ানের হঠাৎ এমন প্রশ্নে রুশি অবাক হলো তাকিয়ে দেখলো সায়ান অধীর আগ্রহে তাঁকিয়ে আছে ওর জবাব শোনার জন্য। রুশি ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছে না, আদোও কি ও কাউকে ভালোবেসেছে!

#চলবে

গুমোট অনুভুতি পর্ব-১৬+১৭

0

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১৬

রুশি ভ্রু কুচকে বসে আছে বিছানায়, রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। আজ হঠাৎ করেই কেনো এই মানুষটিকে বড্ড বিরক্ত লাগছে! ঠিক তার সাথে কি করলে শান্তি পেতো তা মাথায় ঢুকছে না, একবার মনে হচ্ছে ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে টুপ করে নিচে ফেলে দিক আবার মনে হচ্ছে ফুচকার মতো কটমট করে যদি ভাংতে পারতো তবে হয়তো শান্তি লাগতো। রাগে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে এলোমেলো ভাবে।

ওয়াশরুম থেকে ঝরঝর পানির আওয়াজ আসছে সাথে যেনো ওর মাথার বুদ্ধিগুলো ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দশমিনিট ধরে ভেবেই চলছে যে এই তীব্র অসহ্যকর মানুষটিকে কি করে এই রুম থেকে তাড়ানো যায় কিন্তু কিছুই আসছে না মাথায়। এদিকে নক কামড়াতে কামড়াতে কখন চামড়াতে কামড় দেয়া শুরু করেছে তাতে ওর খেয়ালই নেই।হঠাৎ ব্যাথা অনুভব হতেই “আহহ” শব্দ করে উঠলো, হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে হাত লাল হয়ে আছে। এতে যেনো রাগ তরতর করে আরো কয়েক ডিগ্রি বেড়ে গেলো

“ইশশ কি মনে পড়ছে না কেনো,এমনিতে তো তোর ভারী বুদ্ধি রুশি তাহলে আজ কি হলো। বুদ্ধির সাগর কি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো?নাহ এই লোকের সাথে এক রুমে থাকা অসম্ভব। ব্যাটা বিয়ে করে বউ মানবে না, বাইরে গার্লফ্রেন্ড রাখবে আবার এখন বউ বলে আদিক্ষেতা দেখানো হচ্ছে?হাহ এমন যেনো গাছের টাও খাবে তলার টাও কুড়াবে। নাহ বাপু এতো সহজে তোমার আশা তো পুরণ হতে দেয়া যাচ্ছে না। এই রুশি সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিসকে এক্সেপ্ট করেনা।ভাব রুশি ভাব কিছু তো একটা উপায় আছে যাতে একে জব্দ করা সম্ভব!”

রুশি ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে সায়ানের ফোনের দিকে নজর গেলো, খুশিতে ওর চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। এই ফোন দিয়ে নিশ্চই তাকে জব্দ করা যাবে!কিন্তু যতোটা খুশি হয়ে ফোনটা হাতে নিয়েছে তার থেকেও বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রেখে দিলো। পাসওয়ার্ড সেট করা! উফফফফ। হঠাৎ করেই রুশির মাথায় এলো যে চন্দ্রিকা রুশিকে পছন্দ করেনা আর সে যদি কোনভাবে জানতে পারে যে সায়ান ওর কাছে তাহলে সায়ানকে এখানে থাকতে কিছুতেই দিবে না। তাই কথাটা চন্দ্রিকার কান পর্যন্ত পৌছাতে হবে। রুশি শয়তানি হাসি দিয়ে ফোন হাতে নিয়ে ইমার্জেন্সি নাম্বার লিস্টে গেলো কিন্তু চন্দ্রিকার নাম্বার খুজে পেলো না, এমনকি লাভ, লাইফলাইন এমন কিছুও নাই। রুশি রেগে ফোনটা আগের জায়াগায় রেখে দিলো,বিড়বিড় করে বলতে লাগলো

“এই ছেলে কি ওই মেয়েকে ভালোবাসে না নাকি?নিজের ভালোবাসার মানুষের নাম্বার কেউ ইমার্জেন্সি লিস্টে রাখেনা!”

রুশি ফোন রাখতেই ফোনটা বেজে উঠলো আর হাতে নিয়ে দেখে সেটাতে লিখা “ছোট্ট পরী”। রুশি নামটার দিকে তাকিয়ে থাকলো, খুব আদর করে যদি কাউকে এমন নামে ডাকা হয়। রুশি জানে এটি চন্দ্রিকা তাই দেরি না করে ফোন তুলতে চাইলো কিন্তু তার আগেই ফোনটা হাত থেকে হাওয়া হয়ে গেলো। হাত মুঠ করে পেছনে তাকিয়ে দেখে সায়ান উদাম শরীরে দাঁড়িয়ে আছে, রুশি অন্যদিকে ফিরে দিলো এক চিৎকার।এই ভাবে কেউ খালি গায়ে শুধু একটা তোয়ালে পরে ঘুরে বেড়ায়?এর একটু হলে তো শক খেয়ে হার্ট এটাক করতো। সায়ান রুশির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ফোন তুললো আর অপরপাশ থেকে কেউ একজন কিছু একটা বললো যা রুশি শুনলো না।সায়ান হঠাৎ বলে উঠলো

“আমি ব্যাস্ত আছি তাই ফিরছিনা। তুমি জানো আমি বাড়ি ফিরিনা তাই অযথা আমার জন্য কেনো বসে থাকো? যাও ঘুমিয়ে পড়ো নাহয় অসুস্থ হয়ে পড়বে”

“……………”

রুশি বুঝতে পারলো যে চন্দ্রিকার সাথে কথা বলছে তাই ইচ্ছে করেই বলে উঠলো

“আপনি এই রুমে…”

কিন্তু পুরো কথা বলার পুর্বেই সায়ান মুখ চেপে ধরলো যা রুশি ছাড়াতে পারলো না।ওপাশ থেকে হয়তো কিছু একটা বলেছে তাই সায়ান ওর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো

“কেউ না! শুধু অফিসের কয়েকজন এমপ্লয়ি আছে। তুমি খেয়াল রেখো নিজের দিকে।”

বলেই খট করে কেটে দিলো আর রুশির মুখ চেপে ধরেই বললো

“কথা বলেছিলে কেনো?কারো কথার মাঝে কথা বলতে হয়না জানো না?”

রুশি সায়ানের হাতের বন্ধনী হাল্কা হতেই ঝাড়া মেরে ফেলে দিলো তারপর রাগি কন্ঠে বললো

“কেনো আপনার গার্লফ্রেন্ড এর সামনে সব কুকীর্তি ফাঁশ হয়ে যেতো?ভালোই হতো তাহলে, আপনার স্বভাব ভালো মতো জেনে যেতো সে”

“ওহ তারমানে তুমি প্ল্যান করে বলেছো তাইনা?তারমানে আমার সাথে থাকতে তোমার বড্ড অসুবিধা হচ্ছে?”

“হ্যা সেটাই আপনার মতো অসহ্যকর একটা মানুষের সাথে থাকা জাস্ট অসম্ভব! গার্লফ্রেন্ড থাকা সত্তেও আবার ছুকছুকানির স্বভাব”

“মুখ সামলে কথা বলো।ভেবেছিলাম সুন্দর মতো এখান থেকে ফ্রেশ হয়ে পাশের রুমে ঘুমাবো বাট গেস হোয়াট! আমি এখন এখানেই থাকবো বুঝলে। যা করার করতে পারো।”

বলেই কাবার্ড থেকে জামাকাপড় নিয়ে পরা শুরু করে দিলো যা দেখে রুশি চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে ফিরে বললো

“আর এইযে একটা মেয়ে ঘরে আছে জেনেও এইভাবে খালি গায়ে ঘুরা কোন ধরনের ম্যানার্স?তারউপর আবার জামাকাপড় চেঞ্জ করছেন। লজ্জাশরমের কি মাথা খেয়েছেন?”

“কারো পার্মিশন ছাড়া তার ফোন ধরা কোন ধরনের ম্যানার্স? তারউপর তুমি কথার মাঝখানে কথা বলেছো আবার ঝগড়াও করছো। আমি কি কিছু বলেছি?তারউপর তুমিই তো বললে আমার ছুকছুকানির স্বভাব তাই এমনটা করা তো আমার কেরেক্টার এর সাথে সম্পুর্ণ যায়”

“আপনার সাথে কথা বলাই বেকার,আমি এতোক্ষন এই রুমে আছিই কেনো উফফ।আপনার রুম আপনাকে মোবারক, থাকুন এখানে”

বলেই গটগট করে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল তারপর দরজা টানতে থাকলো কিন্তু দরজা খুলছে না। রুশি কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন খুললো না তখন বুঝতে পারলো বাইরে থেকে কেউ ইচ্ছে করে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। ও অসহায় দৃষ্টিতে সায়ানের দিকে তাকালো আর বুঝতে পারলো সায়ান ব্যাপারটায় বেশ মজা পাচ্ছে!ও রেগে দরজায় দিলো এক লাথি কিন্তু ব্যাথা পেয়ে দমে গেলো। ও বুঝলো রেগে কিছু বলে লাভ নেই তাই শান্ত স্বরে বললো

“প্লিজ দরজাটা খুলে দিতে বলুন”

“তোমার সমস্যা তুমি বলো খুলতে, ইটস নান অফ মাই বিজনেস।তবে আজ বেরুতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না, আমার মন বড় তাই তুমি এই রুমে থাকলে আমি মাইন্ড করবো না সত্যিই!”

বলেই বিছানায় উঠে ব্লাংকেটের ভেতরে ঢুকে পড়লো, রুশি এটা দেখে দেখে আকাশ থেকে পড়লো। এখন কি রুমের সাথে সাথে বেডও শেয়ার করতে হবে নাকি?রুশি তাই মেকি হাসি ঝুলিয়ে বললো

“আপনি যদি বেডে ঘুমান তবে আমি কোথায় ঘুমাবো? তাই যদি আপনি…”

“তুমি বেডে ঘুমাতে না চাইলে সেটা তোমার সমস্যা, আমার বেড শেয়ার করতে কোন সমস্যা নেই। তুমি চাইলেই ওইপাশটায় শুতে পারো। বেড যথেষ্ট বড় আছে”

সায়ান রুশির থেকে দ্বিগুণ হাসি মুখে ঝুলিয়ে বললো তারপর আবার ব্লাংকেট মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। রুশি সেদিকে তাকিয়ে রইলো, ওর পক্ষে সায়ানের সাথে একই বিছানায় ঘুমানো সম্ভব নয়। সায়ান যতোই ওর স্বামী হোক তবে সেটা নামের, তাই ও প্রচণ্ড অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা। রুশির কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে সায়ান মাথা বের করে দেখলো রুশি আগের জায়াগায় দাঁড়িয়ে আছে মাথানিচু করে। তাই সায়ান একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তারপর বালিশ নিয়ে সোফায় যেতে যেতে বললো

“আমার মনটা খুব বড়ো কিনা তাই ভাবলাম একটা অসহায় মেয়েকে বেডে শুতে দেই। আমি নাহয় আজ রাত সোফায় কাটিয়ে দিলাম তবে এরপরের বার কিন্তু বিছানা ছাড়বো না বলে দিলাম”

বলেই সায়ান চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো আর রুশি গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।ওর হঠাৎ মনে হলো নাহ মানুষটিকে ঠিক যতোটা অসহ্যকর মনে হয়েছে সে ততটা নয়!একটু কম অসহ্যকর যেমনটা সহ্য করা যায়।একজন ছেলের হিসেবে সায়ান প্রতি রুশির সম্মানটা বেড়ে গেলো, আর যাইহোক ওর অস্বস্তি বুঝতে পেরেও ওকে বিছানায় শুতে বাধ্য করেনি। চাইলেই সে সো কল্ড স্বামীর অধিকার দিয়ে অনেক কিছুই করতে পারতো তবে সে কিছুই করে নি।রুশির সায়ানকে সম্মান করে কারণ রুশির সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছে সে আবার অন্যের মতো নিজের ভালোবাসার মানুষের হাত ছেড়ে দেয়নি।নাহয় আজকাল কিছু মানুষ ভালোবাসার ওয়াদা করে তারপর মাঝপথেই হাত ছেড়ে দিয়ে চলে যায়, তার থেকে সায়ান অনেক ভালো,নিজের ভালোবাসার সম্মান করতে সে জানে!

রুশি কি মনে করে উঠে বসলো তারপর আলমারি থেকে অতিরিক্ত ব্লাংকেট বের করে সায়ানের গায়ে দিয়ে দিলো। সায়ান বাচ্চাদের মতো সেটাতে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো, রুশি নিজের জায়াগায় এসে শুয়ে পড়লো তারপর সায়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো। ঘুমন্ত অবস্থায়ও লোকটিকে অনেক সুন্দর লাগে। রুশির মাথায় হঠাৎ করেই একটা প্রশ্ন জাগলো

“আচ্ছা বাচ্চাটা কার মতো হবে? আমার মতো নাকি তার বাবার মতো?বাবার মতো হলে নিঃসন্দেহে অনেক সুদর্শন হবে!”

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১৭

রুশি পিটপিট করে নিজের চোখ মেললো,বিশাল আকাশে সুর্য মামা কিছুক্ষণ পুর্বেই পুর্ব দিকে উদিত হয়েছে তাই রোদ এখনো প্রখর হয়নি। কানে পাখির কিচিমিচির আওয়াজ শুনা যাচ্ছে, নাকে একটা অনেক মিষ্টি সকালের ঘ্রাণ আসছে। রুশি প্রাণখুলে নিঃশ্বাস নিলো, চারপাশে সবকিছু নিশ্চুপ! এ বাড়ির মানুষগুলো এতো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে না তাই হয়তো এতো নিস্তব্ধতা!ওর খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠার অভ্যস, বহুদিনের অভ্যস এতো তাড়াতাড়ি ত্যাগ করতে পারেনি। রুশি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তারপর আড়মোড়া ভেঙে মোবাইল নিতে গিয়ে দেখে খুব সুন্দর একটা পিকাচু মগে কফি রাখা আর তাতে ঝুলানো চিরকুট

“এক কাপ গরম কফি এই গরম মানুষটির জন্য”

রুশি চিরকুট হাতে নিয়ে হাসলো, সায়ানের উপর সত্যিই একটু বেশিই মেজাজ দেখিয়েছে ও। ভেবেছিলো সায়ান উল্টো মেজাজ দেখাবে আর এখান থেকে চলে যাবে কিন্তু তার পরিবর্তে সায়ান খুব অস্বাভাবিক ভাবে শান্ত! ওর এতোগুলো কটুকথা শুনানোর পরও সে কিছু বলেনি বরং ঠান্ডা মাথায় সবটা মেনে নিয়েছে। ইদানীং রুশি নিজেই বুঝতে পারছে যে ও খুব খিটখিটে মেজাজের হয়ে গেছে, অল্পতেই ভিষন ভাবে রেগে যায় আর এমন এমন কথা বলে ফেলে যাতে পরে ওর আফসোস করতে হয়।

সায়ানকে কথাগুলো ও ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলতে পারতো যে ও কোন ঝামেলা চায়না বরং শান্তিতে থাকতে চায়। কিন্তু ও নিতান্তই মেজাজ দেখিয়ে কথাগুলো বলেছে,সায়ান হয়তো এখানে নিজের বেবির জন্য চিন্তা থেকে আসছে আর আশাটাও স্বাভাবিক। রুশির উচিৎ সেই স্পেস করে দেয়া, এবং বেবির বর্তমান পরিস্থিতি কেমন বাবা হিসেবে তা সম্পুর্ণ জানার অধিকার আছে সায়ানের।আর যাইহোক ও যতোই ভালো মা হোক না কেনো কখনোই নিজের সন্তানের বাবার স্থান পুরণ করতে পারবে না, বাবা নামক মানুষটিকে ওর সন্তান আজীবন মিস করে যাবে। আর নিজেও চায়না ওর সন্তান বাবা নামক শীতল ছায়া থেকে বঞ্চিত হোক। ও ভেবেই নিয়েছে এরপর থেকে সায়ানের সাথে ভালোভাবে কথা বলবে, কারণ ভবিষ্যতে তারাই অনাগত সন্তানের বাবা-মা তাই একে অপরের সাথে বন্ধুত্বপুর্ণ সম্পর্ক থাকা জরুরি। সব স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক ভালোবাসা থাকে ওদের সম্পর্কে নাহয় বন্ধুত্ব থাকলো!তাতে আর যাই হোক ওর সন্তান সুখে থাকবে।

রুশি বারান্দার দিকে এগুলো, ভেতরে ঢুকতেই সায়ানকে কফির কাপ হাতে উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। তারমানে রুশির হাতের কাপ ও সায়ান বানিয়েছে! রুশি সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো, সামনে গিয়ে পাশে দাঁড়াবে নাকি ঘরে ফিরে যাবে সেটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। তখন সায়ান সেদিকে ফিরেই বলে উঠলো

“ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? পাশে এসে দাঁড়াও!”

রুশি বেশ অবাক হলো,ও সবসময় নিঃশব্দে চলাফেরা করে তাই কেউ বুঝতে পারে না কিন্তু সায়ান কি করে বুঝলো যে ও এখানে আছে?কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেললো

“আপনি কি করে বুঝলেন আমি এখানে আছি?আমি তো কোন শব্দ করিনি”

সায়ান রুশির দিকে ঘুরে ওর ওই চোখজোড়ায় তাকিয়ে থাকলো কতোক্ষণ,কালো লেন্সের এই টানাটানা চোখদুটোতে হাজারো মায়া ভীড় করেছে।রুশি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে চোখজোড়া স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড় হয়ে আছে যাতে ওকে আরো সুন্দর লাগছে। ও ঠোঁট কিছুতা প্রসারিত হলো, রুশি এখনো জবাবের আশায় অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। সায়ান ওর চোখে চোখে রেখেই বললো

“কি করে বুঝলাম তা জানিনা, তবে এটুকু জানি তুমি আশে পাশে থাকলেই অদ্ভুতভাবে বুঝে যাই আমি!”

সায়ানের এই ঘোরলাগা দৃষ্টি আর এই ধরনের কথা শুনে রুশি মাথা নিচু করে ফেললো। কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে কিন্তু কেনো লাগছে বুঝতে পারছেনা, লজ্জায় সায়ানের দিকে তাকাতে পারছে না। হয়তো প্রথম কোন পুরুষের মুখে এমন কথা শুনেছে তাই হয়তো এমন মনে হচ্ছে। ও টপিক বদলানোর জন্য বললো

“ভালো কফি বানান আপনি!”

“না খেয়েই বলছো ভালো হয়েছে! খেয়ে দেখো হয়তো সত্যিই ভালো লাগবে”

রুশি সায়ানের দিকে এমনভাবে তাকালো যেনো চোর ধরা পড়ে গেছে, এই লোক কি করে বুঝলো কফিতে চুমুক দেয়নি আমি?চোখ না সিসিকেমেরা! কিছুই এড়ায়না। রুশি আমতা আমতা করে বললো

“নাহ মানে দে্ দেখতে যেহেতু ভালো হয়েছে খে্ খেতেও ভালো হবে নিশ্চই!”

“দেখতে ভালো হলেই যে জিনিসটা ভালো তেমন কিন্তু নয় আবার দেখতে কিছুটা খারাপ বলে যে জিনিসটাই খারাপ তাও কিন্তু নয়। সবকিছু টেস্ট করার পর সিদ্ধান্তে পৌঁছানো উচিৎ! মানুষের ক্ষেত্রেও তাই। ডোন্ট জাজ আ বুক উইথ ইটস কাভার”

রুশির কাছে কথাগুলো যুক্তিযুক্ত মনে হলো, বাহ্যিক চাকচিক্য দেখে কোন কিছুকেই জাজ করা উচিৎ নয়। ও বেশ প্রাউড হয়েই বললো

“ইনডিড ইউ আর আ বিজনেসম্যান!”

জবাবে সায়ান হাসলো, নিঃশব্দে হাসলো তারপর আবার বাইরের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলো, রুশিও পাশে দাঁড়িয়ে কফিতে চুমুক দিতে লাগলো। চারপাশের গাছ গুলোর পাতা হাল্কা নড়ছে, বারান্দায় দুটো মানব-মানবী দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। তারা দুজনের কতোটা কাছে অথচ তাদের মনের দুরত্ব কতো বিশাল ঠিক পাহাড় সম!রুশি এসবই ভাবছিলো হঠাৎ ওর হাত থেকে সায়ান কফির মগ নিয়ে গেলো আর রুশি তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। বুঝার চেষ্টা করছে যে সায়ান কি করতে চাইছে তা বুঝতে পেরে সায়ান বললো

“আসলে সব ঠিকঠাক হয়েছে কিনা তা চেক করতে নিয়েছি”

বলেই কফি মগে চুমুক দিলো তারপর রুশির দিকে তাকিয়ে হেসে মগটা দিয়ে দিলো আর বললো

“সব ঠিক আছে, তুমি এবার খাও”

রুশি চোখ ছোট করে তাকিয়ে কফিতে চুমুক দিলো আর ভাবতে হঠাৎ এমন আজব ব্যাবহারের কারণ কি?তারপর কিছু একটা ভাবতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো! এটা কি ইনডিরেক্ট কিস ছিলো?ওই মাই আল্লাহ! সায়ানের তাকাতেই দেখে ও মুচকি হেসে ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিয়ে চলে গেলো। সেই এ ভালো হবে তা ভাবলো কি ও, এ লোক মোটেও সুবিধার না। রুশি বিড়বিড় করে বলতে লাগলো

“আস্ত বজ্জাত একটা!”

________________________

ডায়নিং টেবিলে সম্পুর্ণ ডেড সাইলেন্ট কাজ করছে, চামচের কটরমটর আওয়াজ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। রুশি বর্তমানের টেনশন ঢের বুঝতে পারলো,সবকিছু এনালাইসিস করে যা বুঝতে পারলো তা হলো এরা মায়ে ছেলে এক আরেকজনকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু তা স্বিকার করতে চায়না। একজন রেগে আছে আর আরেকজন অভিমান করে আছে বাট দুজনের মাঝেই কি একটা মিস আন্ডারস্টেন্ডিং চলছে। রুশির শাশুড়ি মা মানে মিসেস সাবিনা খান অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ। এখানে আসার পরে থেকে তিনি সামু আর ওকে একনজরে দেখেন যেনো রুশি তার নিজের মেয়ে। তাই মুলত রুশি এখান থেকে যেতে চায়না কারণ এ জীবনে মায়ের ভালোবাসা ও পায়নি তাই আল্লাহ যখন ওকে একটা মা দিয়েছে তাহলে ও কেনো সেই সুযোগ লুফে নিবে না?ও ইতোমধ্যেই তাকে মায়ের জায়গা দিয়ে ফেলেছে,ও খুব খুশি কারণ ও এখন মিসেস খানকে মা বলে ডাকে। ওরও এখন একটা মা আছে।

খাবার শেষে সায়ান সোফায় বসে সামুর সাথে কথা বলছিলো ঠিক তখনই ইনান আসে। তারা তিনজন কথা বলতে থাকে, সায়ান তো ইনানকে বলতে থাকে ও যদি সামুকে পছন্দ করতো তবে ওকে বলেনি কেনো?বিনিময়ে ইনান শুধু মলিন হাসলো কিন্তু কিছু বললো না। ঠিক তখনি রুশি ট্রে হাতে বসার ঘরে প্রবেশ করলো, রুশি আগের থেকে একটু মোটা হয়ে গেছে তাই দেখতে ওকে আরো আকর্ষণীয় লাগছে। পুর্বে ও মাত্রাতিরিক্ত চিকন ছিলো। ইনান রুশির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তখনি সায়ান বলে উঠে

“আরেহ তুমি এটা নিয়ে আসতে গেলো কেনো?বাড়িতে সার্ভেন্ট আছে তো! তারা এসব করবে তুমি এসব রেখে সামুর পাশে বসো।”

রুশি বাধ্য মেয়ের মতো ট্রে রেখে সামুর পাশে বসে রইলো আর ওর সাথে কথাতে মেতে উঠলো। ইনানের দিকে ও তাকায়নি একবারের জন্যও না। এমনভাবে বসে আছে যেনো সবকিছু স্বাভাবিক, ও ইনান কোনদিন চিনতো না। আদোও কি তাই! অতীত ভুলে যাওয়া কি এতোই সহজ?তবে ও ভুলতে পারছে না কেনো? বরং মনে দিনদিন রুশিকে ও আরো বেশি ভালোবাসে, অনেক বেশি।ও রুশির থেকে চোখ সরিয়ে সায়ানের দিকে তাকাতেই দেখে সায়ান রুশির দিকে তাকিয়ে আছে, নাহ স্বাভাবিকভাবে নয় ঘোরলাগা দৃষ্টিতে। কথায় আছে না

“একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষের মনের অবস্থা ঠিক তখনি বুঝতে পারে যদি তাদের মনে একই জিনিস চলতে থাকে”

রুশির প্রতি সায়ানের এই দৃষ্টি ইনানের সহ্য হলো না আর হবেই বা কি করে?নিজের ভালোবাসার মানুষেত উপর অন্যের দৃষ্টি কোন প্রেমিক পুরষেরই সহ্য হয়না, ওতো তার ব্যাতিক্রম নয়। ও আর চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্নই করে ফেললো

“মেয়েটি কে? আগে কোনদিন দেখিনি তো!”

“দেখার কথাও না। ও হচ্ছে রুশি আমার ওয়াইফ আর আমার অনাগত সন্তানের মা”

ইনান যেনো বিশ্বাসই করতে পারলো না, শক্ত করে হাত মুঠো করে ফেললো। রুশি সায়ানের বউ মানে ও বিবাহিত আর সবচেয়ে বড় কথা ও সায়ানের সন্তানের মা।মানেই রুশি সেই মেয়ে!
এর আগে যদি সায়ানের এই দৃষ্টি তার বউয়ের দিকে দিতো ও হয়তো বেশ খুশি হতো কারণ ওর মনে হচ্ছিলো মেয়েটি স্বামীর ভালোবাসা ডিজার্ভ করে। সায়ানের উচিৎ মেয়েটিকে মেনে নেয়া কিন্তু এখন ও মানতে পারছে না কারণ মেয়েটা অন্য কেউ নয় রুশি যাকে ও প্রচণ্ড ভালোবাসে,প্রতিনিয়ত তাকে চায় নিজের। ও মানতে পারছে না রুশি এখন অন্যকারো! ওর মাঝে ছোট্ট একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে যেটা অন্যকারো অংশ ওর নয়। ও মানতে পারছেনা যে সেই অন্যকেউটা ওর প্রাণ প্রিয় বন্ধু!

সায়ানতো চন্দ্রিকাকে ভালোবাসে তাহলে রুশির দিকে এভাবে তাকানোর মানে কি?ও কি তবে ঘরে একজন বাইরে আরেকজন রাখতে। যদিও ইনান নিজেও বুঝতে পারতো সায়ান চন্দ্রিকাকে ভালোবাসে না, চন্দ্রিকার প্রতি যা আছে তা শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সায়ানকে চন্দ্রিকাকেই ভালোবাসতে হবে!সায়ানের জন্য চন্দ্রিকাই সব, রুশির প্রতি তার কোন অনুভুতি কাজ করতে পারেনা। রুশি শুধুর তার এবং তার। আর কারো না!

#চলবে

গুমোট অনুভুতি পর্ব-১৩+১৪+১৫

0

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১৩

ঘড়ির কাটায় রাত আটটা বাজে,চারপাশে ঘন কালো অন্ধকার। দূরের রাস্তায় সোডিয়াম বাতির আলোয় আলোকিত রাস্তাঘাট,কিন্তু ছাদে ঠিক ততটাই অন্ধকার। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে নীল শাড়ি পরিহিতা একজন নারী দাঁড়িয়ে আছে, আচল উড়ছে কিছুটা দূর পর্যন্ত। ছেড়ে দেয়া চুলগুলো এলোমেলোভাবে মুখের উপর ঝাপটে পরছে তবে সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই।ও তাকিয়ে আছে দূর আকাশে! ঝলঝল করে উঠা তারার দিকে তাকিয়ে আছে। অন্যদিনের মতো আজ কথার ঝুড়ি খুলে বসেনি, বরং নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে!তবে এই নিস্তব্ধতা হাজারো কথা বলে দিচ্ছে।

আজ প্রায় অনেকদিন পর সেই মানুষটিকে ও দেখেছে।অনেকদিন নয় অনেক বছর পর। মানুষটি খুব সুদর্শন দেখতে ঠিক রুপকথার রাজপুত্রের মতো!তাই হয়তো ওকে ঠিক মনে ধরেনি!কিন্তু ওতো তার মায়া কাটিয়ে এখনো উঠতে পারেনি,খুব কাছের একজন মনে করতো তাকে।

ও তখন সদ্য নাইনে উঠেছিলো, গরীব হওয়ার কারণে খুব একটা বেশি মানুষ কথা বলতো না। আবার যারা কথা বলতো তারা ঠিক বন্ধু ছিলো না। তাই এতো এতো ভিড়ের মাঝে ও সম্পুর্ণ একা ছিলো, তাই স্কুলে খুব একটা যেতো না। একদিন ক্লাস শেষে বের হয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করেছিলো তখন হঠাৎ ওড়নায় টান খায়। পাশে তাকিয়ে দেখে একটা পিচ্ছি ছেলে হাতে ফুল আর একটা চিঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে,ছেলেটি ওর হাতে এগুলো গুজে চলে যায়। ও ভয়ে ফেলে দিতে চেয়েও ফেললো না,চিঠি খুলে দেখলো তাতে লিখা

“তোমার এতো সুন্দর মুখের গড়ন, আজকাল চাঁদ থেকেও বেশি তোমায় সুন্দর লাগে। আচল দিয়ে মুখখানি ঢেকে নাও তো!আমি চাইনা আমি ছাড়া অন্যকারো নজর লাগুক।আচ্ছা তুমি কি আমার প্রথম মেয়ে বন্ধু হবে?”

চিঠি পড়তেই আনমনে হাটছিলো, কখন রাস্তার মাঝখানে চলে এসেছিলো বুঝতে পারেনি, একটা বাস প্রায় যখন ওর কাছে চলে আসছিলো ঠিক তখনি কেউ একজন খুব শক্ত হাতে ওকে কিনারে নিয়ে আসে আর ধমক দিয়ে বলে

“দেখে চলতে পারোনা নাকি?যদি কিছু হয়ে যেতো!”

ও ছেলেটির চেহারা দেখতে পায়নি, ছেলেটি হেলমেট পরা ছিলো। তবে ছেলেটির কন্ঠস্বর ভুলেনি, ছেলেটি চলে যাওয়ার অনেকক্ষন পরও তাকিয়ে ছিলো সে দিকে।

এরপর প্রায়ই চিঠি পেতো আর মনে কেউ একজন ওকে ফলো করছে কিন্তু ঠিক খুজে পায়নি।প্রথম প্রথম চিঠির জবাব না দিলেও পরে দেয়া শুরু করলো। ওর কৈশরের প্রথম বন্ধু ছিলো সে,তাই তার প্রতি মায়া, আবেগ সবটাই বেশি ছিলো। চিঠিতে ছেলেটি প্রায়ই ভালোবাসার কথা বললেও ও তার জবাব দেয়নি। কারণ ভালোবাসা সম্পর্কে কোন ধারণা ছিলো না ওর। শুধু এটুকু বুঝতো মানুষটা খুব কাছের কেউ আর সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু যাকে চোখ বুঝে ভরসা করা যায়। দেখতে দেখতে ও বড়ো হতে লাগলো, স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রাখলো সাথে বন্ধুত্বটাও গাঢ় হতে লাগলো। এখন আর চিঠি আদানপ্রদান হয়না বরং ফোনে কথা হতো।

মানুষটি প্রতিদিন ওর খোজ নিতো,হঠাৎ একদিন সিদ্ধান্ত নিলো তার সাথে দেখা করবে। বেশ পরিপাটি হয়ে নির্দিষ্ট জায়াগায় বসে ছিলো,নিজের রান্না করস খাবার নিয়ে এসেছিলো তার জন্য।ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে গেলো কিন্তু সে মানুষটি এলোনা। ও তারপরো অপেক্ষা করেছে, বারবার ফোন করেছিলো কিন্তু তা বন্ধ ছিলো। তবুও বসে ছিলো ও এই আশায় যে সে আসবে কিন্তু সে আসেনি। রাত হয়ে যাওয়ার পর ও কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এসেছিলো, মারও খেয়েছিলো পালক মায়ের হাতে। কিন্তু তা বুকের কষ্ট থেকে বেশি ছিলো না। সেদিনের পর মানুষটি উধাও হয়ে গিয়েছিলো, আর কখনো ফোন করেনি তবে ও অপেক্ষা করে গেছে। কারণ কারো মায়ায় একবার জড়িয়ে গেলে সেটা আর ভুলা যায়না আর ও নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে কি করে ভুলবে?

আজ ও তাকে দেখেছে, প্রথমবারের মতো দেখেছে তাও অন্যকারোর নামের আংটি নিজের অনামিকা আংগুলে পরে ছিলো। তার কন্ঠস্বর শুনে থমকে গিয়েছিলো, ভেবেছিলো মনের ভুল কিন্তু তার লাল হয়ে চোখজোড়া আর অপরাধি চাহনি দেখে ঠিক বুঝতে পেরেছে এই মানুষটিই সেই। আজ সে অন্যকারো, তাতে ও খুশি বেশ খুশি যে সে তার জীবনের সাথি খুজে পেয়েছে, কিন্তু তাহলে ওর সাথে যা ছিলো তা কি ছিলো? প্রতিদিন নিয়ম করে যে ভালোবাসি বলতো তার কি কোনই মানে ছিলো না?শুধুমাত্র আবেগের বশে বলতো? তবে কি সে শুধু ওর মোহে পড়েছিলো যা দুদিনেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো!

তবে তাতে ওর বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই, ও বরং খুশি তার জন্য। তবে একটা প্রশ্নের উত্তর ও চায়! সে আসবে বলে কেনো আসেনি সে?আর যদি হারিয়ে যাওয়ার ছিলো তবে বিদায় কেনো জানায় নি?কেনো আজ পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হলো?এর জবাব চাই ওর।

চোখ গড়িয়ে দুফোটা জল গড়ালো গাল বেয়ে, ও এখনো নির্লিপ্ত ভাবে আকাশপানে চেয়ে আছে। পেছন থেকে হঠাৎ মৃদু আওয়াজে কেউ একজন ডেকে উঠলো

“রুশানি!”

কন্ঠ শুনে ও তিক্ত হাসি দিলো, যাকে নিয়ে ভাবছিলো সেই এখানে হাজির। ও তাকায়নি তার দিকে বরং আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ওর নেই। সেই কণ্ঠস্বর আরো প্রখর হয়ে বললো

“কথা বলবে না আমার সাথে?”

রুশি এবার আর চুপ থাকতে পারলো না, ধরা গলায় বললো

“দুলাভাই!আমাকে কিছু বলেছিলেন?”

রুশির কথার মাঝে লুকিয়ে থাকা অভিমান গুলো ঢের পেলো ইনান, সেই ছোট্ট রুশি অনেক বড় হয়ে গিয়েছে,সে শাড়ি পরতে শিখে গেছে! ও নির্লিপ্ত ভংগিতে বললো

“কেমন আছো?”

প্রত্যুত্তরে অপরপাশ থেকে কোন জবাব আসেনি, বরং রুশি আকাশের দিকে চেয়ে আছে।তাই প্রশ্ন করলো

“এখনো তারাদের সাথে কথা বলো?”

“আমি অন্যসবার মতো নই যে অভ্যস খুব তাড়াতাড়ি বদলাতে পারি,আমি আমার জীবনের কোন জিনিসই ছেড়ে দেইনা বরং আকড়ে ধরে বেঁচে থাকি”

বলেই রুশি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে থেমে গেলো আর ধীর কন্ঠে বললো

“একটা প্রশ্ন অনেক দিন যাবৎ জমা হয়েছিলো, আজ সুযোগ পেয়ে বলেই ফেললাম। সেদিন যদি আসার ইচ্ছেই ছিলো না তবে আমায় কেনো আসতে বলেছিলেন?কেনো মিথ্যে সম্পর্কের নাটক করে গেছেন আমার সাথে?”

অপরপাশ থেকে কোন জবাব না পেয়ে রুশি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো তারপর বললো

“জবাব নেই তাইনা?থাকারও কথা না, আসলে আমি নিতান্তই টাইম পাস ছিলাম কিনা!প্রয়োজন ফুরাতেই অচেনা হয়ে গিয়েছিলাম। যাইহোক কংগ্রাচুলেশনস মি.ইনান চৌধুরী ফর ইউর ওয়েডিং। আশাকরি আমার সাথে কথা বলতে গিয়ে নিজের মুল্যবান সময় আর নষ্ট করবেন না”

রুশি সেখানে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায়নি বরং দ্রুত পায়ে নিচে নেমে চলে এসেছে। যেটা তার কোনদিন হওয়ার নয় সেটার প্রতি অযথা মায়া বাড়িয়ে কি লাভ?তার চেয়ে সেটাকে ছাড়িয়ে সামনে পা বাড়ানোই উত্তম। রুশি তাই করছে, আজকের পর থেকে এই মানুষটির কথা ও ভাববে না। মরে গেলেও ভাববে না,যার কাছে ওর মুল্য নেই তাকে ভেবে কি লাভ?এখন ওর জীবনে শুধু ও আর ওর বেবি আর কারো জায়গা নেই।কারো না!

রুশির যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইনান, কিছু বলার নেই ওর। কি বলবে ও যে আসতে চেয়েও ও আসতে পারেনি!এটা আদোও বিশ্বাস যোগ্য?কি করে বলবে এই মেয়েটিকে যে সে তার টাইম পাস কখনোই ছিলো না বরং বেচে থাকার একটা কারণ ছিলো। কি করে বলবে তাকে যে ও তাকে অনেক ভালোবাসে, পুর্বের থেকেও অনেকগুন বেশি!কিন্তু তাহলে যে কিছুক্ষণ পুর্বে যে মেয়েটিকে বিয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছে তাকে ঠকানো হবে, তার স্বপ্ন ভেংগে চুরমার হয়ে যাবে এটা ও কি করে মেনে নিবে। ওর ভালোবাসা তো ও পায়নি আর কখনো ও পাবে না, তাই সামু নাহয় তার ভালোবাসা পাক। কিন্তু এই মনকে কি করে বুঝাবে? এই মনের রক্তক্ষরণ যে কেউ দেখতে পায়না।

কত সহজে রুশি ওর দিকে সব দোষ ঠেলে চলে গেলো কিন্তু আদোও কি ওর দোষ ছিলো!জীবন তো এতোটা জটিল না হলেও পারতো।ওর আর রুশির কি ছোট্ট একটা সংসার হতে পারতো না?তবে আজ তো তা ভাবাও পাপ কারণ সে ওয়াদাবদ্ধ! অন্যকারো মন ভাংগা যে সম্ভব নয়, মন ভাংগার কষ্ট কতটুকু তা ওর থেকে ভালো কে জানে?ও নাহয় এই বিরোহে জলে পুড়ে শেষ হয়ে যাক, তাতে কি বাকি সবাই তো ভালো থাকবে। ও নাহয় ভালো থাকার অভিনয় করে যাবে!

______________________

সায়ান রেগে ফোনটা আছাড়ি মেরে ফেলে দিলো, ওর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে! আজ প্রায় দুইদিন ও রুশির খোজ নেয়নি কিন্তু আজ আর থাকতে না পেরে কেয়ারটেকারকে ফোন দিলো, ইচ্ছে ছিলো রুশিকে একনজর দেখবে কিন্তু যা শুনলো তাতে ওর মাথা গরম হয়ে গেছে।

রুশি তার সবকিছু নিয়ে খান বাড়িতে চলে গেছে, এমনকি মিসেস খান এসে ওকে নিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় কেয়ারটেকার বলেও গেছে যে ও আর ফিরবে না ওইখানে। রুশি খান বাড়িতে আছে এটা শুনে যতোটা না মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার থেকে বেশি খারাপ হচ্ছে যে রুশি ওকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলো না বরং একা একা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো!স্বামী হিসেবে ওর কি জানার অধিকার নেই?সায়ান রাগে ক্ষোভে উঠে দাঁড়ালো তারপর সাহিলের দিকে তাকিয়ে বললো

“সাহিল গাড়ি বের করো! আমি খান বাড়িতে যাবো”

বলেই হনহন করে বেরিয়ে পড়লো,সাহিল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আজ প্রায় পাঁচবছর পর ও সায়ানকে খান বাড়ির দিকে যাওয়ার কথা বলতে দেখেছে। ও কি স্বপ্ন দেখছে?হাউ ইজ দিস পসিবল!

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১৪

চৌধুরী বাড়িতে আজ খুশির আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে,সবার চোখে মুখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ পাচ্ছে। আজ এতোবছর পর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে তাতে যেনো সবার খুশি আর ধরছে না,বংশের প্রথম সন্তান হওয়ায় সায়ানের প্রতি সবার ভালোবাসা একটু বেশিই! এই বাড়ির মালি, কেয়ারটেকার এমনকি রাঁধুনি পর্যন্ত সবাই ছোট সাহেব বলতে পাগল। সবার সাথেই সায়ানের সুসম্পর্ক ছিলো, সায়ান একটু চঞ্চল ছিলো বইকি তাই সবার সাথে সহজে মিশে যেতো! আনন্দ হই হুল্লোড়ে মেতে থাকতো খান বাড়ি।

কিন্তু হঠাৎ এতো কারো যেনো নজর লেগে যায়। হুট করেই সায়ান স্কুল থেকে ফেরার পথে গায়েব হয়ে যায় এরপর তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। প্রায় মাস খানেক কেটে যাওয়ার পর সায়ানের হদিশ মিলে,মিসেস খান গিয়ে নিজে নিয়ে আসে সায়ানকে সেখান থেকে তবে আগের সায়ানকে নয় সম্পুর্ণ এক নতুন সায়ানকে। যে গম্ভীর, চুপচাপ, রাগি আর প্রচণ্ড বদমেজাজি। কারো সাথে কথা বলতো না সায়ান তখন শুধুমাত্র একা একা ঘরে থাকতো আর কি যেনো বিড়বিড় করতো। তবে অদ্ভুত ভাবে নিজের বাবাকে সহ্য করতে পারতো না সায়ান!যে বাবাকে নিজের আইডল মানতো, বড় হয়ে তার মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখতো সেই বাবাই যেনো ওর দুচোখের বিষ ছিলো। কেমন রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো তার দিকে। এভাবে প্রায় বছর খানেক কেটে এর মাঝে সায়ান আর ওর বাবা জামিল খানের সম্পর্কের কোন উন্নতি ঘটেনি। কিন্তু খান বাড়িতে আরো খারাপ কিছু হওয়া বাকি ছিলো তখনো।

একদিকে সায়ানের হঠাৎ পরিবর্তন হওয়া অন্যদিকে সায়ানের বাবা হঠাৎ করেই সুইসাইড করে মারা যান আর মারা যাওয়ার পুর্বে তিনি তার রেখে যাওয়া চিরকুটে স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে ক্ষমা চান। খান বাড়িতে যেনো শোকের ছায়া নেমে আসে, তবে অদ্ভুত ভাবে বাবার মৃত্যুতে সায়ান একটুও কাঁদেনি শুধু স্থির হয়ে তাকিয়ে ছিলো তার দিকে!

সায়ানের মা সাবিনা খানের উপর সংসারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে তাই সামু আর সায়ানকে দেখাশুনো করার সময় উনি পেতেন না, দিনদিন সায়ানের অবনতি ঘটে তাই সায়ানকে ইনানের সাথে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেয়, তবে তাতে বেশ ভালোই হয়েছিলো। সায়ান পুর্বের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলো, মায়ের সাথে রিতিমতো যোগাযোগ হতো আর সামু তো ওর জান ছিলো।

হঠাৎ করেই একদিন সায়ান বাড়িতে চন্দ্রিকা একটা মেয়েকে নিয়ে আসে সাথে করে আর বলে ও যখন চাকরি পাবে তখন মেয়েটিকে বিয়ে করবে। সায়ানের মা বিষয়টিকে প্রথমে ওতোটা পাত্তা না দিলেও কোন এক কারণে তিনি চন্দ্রিকা পছন্দ করতে পারলেন না।তা সায়ান ঢের বুঝতে পেরেছিলো তাই নিজের মাকে শান্ত মাথায় বলেছিলো

“মাম্মা আমি জানি তুমি চন্দ্রিকে পছন্দ করো না, কিন্তু এই কারণেই আমি আজ এখানে তোমার সামনে জীবিত অবস্থায় আছি। আমি তাকে ওয়াদা করেছি সারাজীবন তার পাশে থাকবো আর এই ওয়াদা আমার পক্ষে ভাংগা সম্ভব নয়!আশাকরি তুমি বুঝতে পারছো”

মিসেস খান ভালোই বুঝতে পারলো যে এই মেয়ে তার ছেলের মাথা চিবিয়ে খেয়েছে, এখন তাকে যাই বলুক সায়ানের বোধগম্য হবে না। তিনি অন্য উপায়ের কথা ভাবলেন আর তাই তিনি কিছু গুণ্ডা হায়ার করলেন যাতে চন্দ্রিকা কলেজ থেকে আসার পথে ভয় দেখায় এবং চন্দ্রিকা নিজের থেকে সায়ানের জীবন থেকে চলে যায়।

তবে কি থেকে কি হয়ে গেলো তিনি ঠিক ঠাউরে উঠলেন না। সেই গুণ্ডাগুলো চন্দ্রিকাকে ভয় দেখানোর বদলে তাকে গুরুতর ভাবে আঘাত করে আর চন্দ্রিকা অলমোস্ট মুমুর্ষ্য অবস্থায় ছিলো আর তখন সায়ান খোঁজ নিয়ে জানতে পারে সেই গুন্ডাগুলো ওর নিজের মায়ের হায়ার করা, ও বিশ্বাসই করতে পারেনি যে ওর নিজের অন্যের জীবন নেয়ার মতো জঘন্য কাজ করতে চাইবে। মিসেস খান বলেছিলো যে তিনি ইচ্ছে করে এমনটি করননি শুধু মাত্র ভয় দেখাতে চেয়েছিলো কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো সায়ান নিজের চোখ আর কানকে কি করে অবিশ্বাস করবে। এরপর থেকে সায়ান খান বাড়ির সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয় আর নিজের কিনা বাড়িতে উঠে যদিও চন্দ্রিকার জন্য আলাদা থাকার ব্যাবস্থা করেছিলো। সায়ান নিজের বাবার কোম্পানিতে বসে নি বরং নিজের উদ্যোগে কোম্পানি শুরু করে ছিলো যা মাত্র পাঁচ বছরেই অনেক পরিচিতি লাভ করেছে আর এখন দেশের টপ কোম্পানির একটা!

সেই থেকে খান বাড়িতে সায়ানের পদাচরণ হয়নি। আজ প্রায় অনেক বছর পর সায়ান আবার এই বাড়িতে এসেছে এটা ভাবতেই যেনো সবাই প্রচণ্ড খুশি! সায়ানের পছন্দের খাবার ইতোমধ্যে কড়াইয়ে চড়ানো হয়ে গেছে, মেইড সার্ভেন্টরা সায়নকে নিয়ে ফিসফিস করেই যাচ্ছে। সেদিকে সায়ানের বিন্দুমাত্র মাথা নেই, ও আশেপাশে তাকিয়ে খুজে যাচ্ছে একজনকে!

এবাড়িতে আসার পরই জানতে পেরেছে কাল সামু আর ইনানের এংগেজমেন্ট কম্পলিট হয়েছে কিন্তু ও কোম্পানির কাজে ব্যস্ত থাকায় ফোন একদমি চেক করেনি আর তাই এই খবরও জানা হয়নি। নিজের বোনের এংগেজমেন্টে অংশগ্রহন করতে না পেরে ও বেশ লজ্জিত। সামুতো এক দফা রাগ ঝেড়ে গেলো ওর উপর কিন্তু অনেকদিন পর এই বাড়িতে এসেছে বলে তা ক্ষনিকের মাঝেই পানি হয়ে গেলো। ভাই-বোন অনেকক্ষণ ধরে বসে বসে গল্প করেছে, সায়ান বারবার এদিক ওইদিক তাকিয়েছে কিন্তু যার জন্য এখানে এসেছে তার দেখা মিলে নি।

সায়ানের এই চাহনি দেখে মিসেস খান বেশ খুশি! সে জানতো রুশিকে যদি এই বাড়িতে নিয়ে আসা হয় তবে সায়ান এ বাড়িতে আসবেই। আর যাইহোক তার ছেলের সাথে তার নাড়িরটান আছে, ছেলে মুখে কিছু না বললেও উনি সবকিছু বুঝে। ছেলে তার খাটি হিরের মুল্য বুঝতে পেরেও মিথ্যে মরীচিকার পেছনে দৌড়াচ্ছে তবে আর যাইহোক শুধুমাত্র ওয়াদা করেছে বলে সংসার করতে হবে এমনটা কোথায় আছে?সংসার করতে হলে ভালোবাসার প্রয়োজন, ভরসার প্রয়োজন! যা উনি নিজের ছেলের চোখে দেখেছে রুশানি নামক মেয়েটির জন্য যদিও তার ছেলে স্বিকার করতে চাইছেনা! কিন্তু তাকে যে আজ নয়তো কাল স্বীকার করতেই হবে কারণ মানুষ আর যাইহোক ভালোবাসার কষ্ট সহ্য করতে পারে না, তাই ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ওয়াদা ছুটে পালাবে জানালা দিয়ে। বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনের জোরই এটা যে দুটো মানুষকে তিনকবুল সাথেসাথেই একসুত্রে বেঁধে দেয়,সেখানে তৃতীয় ব্যাক্তির কোন জায়গা থাকে না। তাই চন্দ্রিকাকে আজ নয়তো কাল সরে দাঁড়াতে হবেই। আর যদি ওনার ছেলে নিতান্তই অবুঝ হয় তবে রুশির সাথে থাকার অধিকার সে চিরকালের মতো হারাবে সাথে হয়তো নিজের সন্তানকেও।

সত্যি বলতে উনি খুব খুশি যে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে!তাই ছেলের দিকে এগিয়ে গেলেন, উনি হয়তো ওইদিন বেশিই বলে ফেলেছিলো যে

“এ বাড়িতে হয়তো চন্দ্রিকা থাকবে নয়তো আমি”

তাইতো তার ছেলে ওই মেয়েটিকে নিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলো। রাগের বসে এমন ভুল স্টেপ না নিলেও পারতো, তাতে হয়তো তার ছেলের সাথে সম্পর্ক ঠিক আগের মতো থাকতো। উনি সায়ানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো

“কাউকে খুজছো বাবা!”

সায়ান অপর দিকে তাকিয়ে মুখ গোমরা করে বললো

“নাহ”

তাই মিসেস খান ছেলের মতিগতি বুঝতে পারলেন যে যদিও না বলেছে কিন্তু ছেলে ঠিকই কান খাড়া করে আছে উত্তর শোনার জন্য। তাই উনি আর দেরি না করে বলেই ফেললেন

“যাকে খুঁজছ সে দোতলার দ্বিতীয় কামরায় আছে যেটা পুর্বে তোমার রুম ছিলো”

বলে উনি আর দাঁড়ালেন না বরং অন্যদিকে হাটা শুরু করলেন। এদিকে সায়ান উত্তর শুনা মাত্রই উঠে দাঁড়াল আর দ্রুত পায়ে সিঁড়ির দিকে হাটা শুরু করলো। ছেলের এমন কান্ড দেখে সাবিনা খান হাসলেন, ছেলে তার ভালোই জব্দ হয়েছে। কথায় আছে না “প্রেম যে কাঁঠালের আঠা লাগলে পরে ছাড়ে না”

আর তাছাড়া সব ছেলেদের স্বভাবই হচ্ছে তারা সেসব নারীর প্রতি আকৃষ্ট হবে যারা তাদের পাত্তা দিবে না, তাদের এটেনশন পাওয়ার চেষ্টা করবে না। তাদেরই তারা ভালোবেসে ফেলে, তবে যারা ভালোবাসতে পারেনা তারা আবার হাসিল করার পরেই প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। তবে তার ছেলে যে রুশিকে হাসিল করতে চায়না তা উনি বেশ বুঝতে পারছেন বরং সে রুশির এটেনশন পেতে চায়, তাকে নিজের কাছে রাখতে আর তার খেয়াল রাখতে চায় অর্থাৎ নিজের অজান্তেই তাকে ভালোবেসে ফেলেছে।

সায়ানের বাবাও এমন ছিলো,এককথায় চোখে হারাতো তাকে কিন্তু হুট করেই তাকে একা করে দিয়ে চলে গেছেন!কথাটা ভাবতেই তার চোখজোড়া ভিজে আসলো, মাঝেমাঝে বড্ড অভিমান হয় তারউপর! কারণ দিনশেষে কারো বুকে মাথা রাখার সুযোগ হয়না আর, তাকে আজ কতোবছর দেখেনা! এই চোখ যে বড় তৃষ্ণার্ত তাকে দেখার জন্য।সত্যি বলতে ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে গেলে কেউ মরে যায়না বরং সে বেঁচে থাকে কিন্তু বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা থাকে না। সেও তো বেঁচে আছে তবে জীবন্ত লাশ হয়ে! মন যেনো আনমনে আওড়ায়

“তাহারেই পড়ে মনে
ভুলিতে পারিনা কোন মতে”

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১৫

সায়ান দোতলার দ্বিতীয় রুমের সামনে দাঁড়িয়ে, রুমটি সম্পুর্ণ অন্ধকার তা বাইরে থেকে বুঝা যাচ্ছে। রুমের দরজা ভিড়ানো, এই বিদঘুটে অন্ধকার রুমে রুশি আদোও আছে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান সায়ান। ও দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো,আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে দরজার এপাশটা এতো বিদঘুটে অন্ধকার অথচ বারান্দার পাশটায় কি সুন্দর জোছনার আলো!আজ পূর্ণিমা নয় তবে আকাশের ওই মাঝারি আকারের চাঁদটি যেন উজ্জ্বল আভা ছড়াচ্ছে। সায়ান ধীর পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো, মনের মাঝে কোথাও একটা জোর দিয়ে কেউ বলে উঠছে

“যাকে খুজছিস সে এখানেই আছে, তোর খুব নিকটে”

সায়ান নিশ্বাস ভারী হতে শুরু করলো, যখনই রুশি নামটা মনে পড়ে তখনি কেমন এক অদ্ভুত অনুভুতি কাজ করে ওর মাঝে। তাকে এক নজর দেখার প্রবল ইচ্ছে জাগে যা চেয়েও মন থেকে সরাতে পারেনা। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছাড়লো সায়ান, এই অনুভুতি বড্ড জটিল জিনিস! কখন কার প্রতি কেমন অনুভুতি কাজ করে যা বুঝা যায় না আর তার কোন নাম দেয়া যায়। শুধু অনুভব করা যায় তাকে আমার চাই যেকোন মুল্যেই চাই, আচ্ছা রুশিকে কি ওর সত্যিই চাই?

সায়ান নিজের চুল চেপে ধরলো, মনে হচ্ছে আর কয়দিন এভাবে চলতে থাকলে ও পাগল হয়ে যাবে। এই নারী জিনিসটা খুব ভয়ংকর! একবার মাথায় চেপে বসলে আর শান্তি দেয়না।ওর মাথায় রুশি আর মনে চন্দ্রিকা চেপে বসে আছে নাকি মাথায় চন্দ্রিকা আর মনে রুশি সেটাই বুঝতে পারছে না!

মাথার চুল ছেড়ে সামনে তাকাতেই একজন নারীকে দেখতে পেলো,লম্বা চুলগুলো বাতাসের তালে তালে দুলছে। চাঁদের আলোয় তার মুখখানি ঝলঝল করছে, একটা হলদে ভাব চেহারায় ফুটে উঠেছে। সায়ান সেদিকে এগিয়ে গেলো ধীর পায়ে, রুশির ঠিক কিছুটা দূরে থামলো তারপর বুঝতে ওই উজ্জ্বল মুখখানি বেয়ে দুফোটা জল গড়াচ্ছে।

রুশি কি তাহলে কাঁদছে! কিন্তু কেনো?ও কিছুটা ইতস্তত বোধ করলো তারপর রুশির কাঁধে হাত রাখলো! রুশি চমকে উঠে দ্রুত নিজের চোখের পানি মুছতে লাগলো তা দেখে সায়ান প্রশ্ন করলো

“তুমি ঠিক আছো?”

কথাটা রুশি খুব ভালোভাবে নিলো না, মুহুর্তেই ওর চেহারার রঙ বদলে গেলো। সায়ানের হাত ঝাড়া মেরে সরিয়ে বললো

“আমার ঠিক থাকা বা না থাকাতে কার কি যায় আসে?”

রুশির কথায় তীব্র অভিমান প্রকাশ পেলো যা দেখে সায়ান মনে মনে খুশি হলো, কারণ কাছের মানুষের প্রতিই মানুষের অভিমান জন্মায়! তবে কি ওর রুশির কাছের কেউ?সায়ান মুচকি হেসে আবারও কাঁধে হাত রাখলো, রুশি সরাতে চেয়েও সায়ানের সাথে পেরে উঠলো তাই রেগে গিয়ে হাল ছেড়ে দিলো! সায়ান নিঃশ্বব্দে হেসে বললো

“যখন জানো পারবে না আমার সাথে তখন এতো জিদ ধরে লড়তে আসো কেনো?আর এখন ঠান্ডা লাগতেছে আর তুমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছো? ঠান্ডা লাগবে তো! চলো ভিতরে চলো”

সায়ানের আচমকা এতো কেয়ারিং দেখে রুশি বেশ অবাক হলো! তার ঠান্ডা লাগলো বা না লাগলো তাতে সায়ানের কি যায় আসে?নিশ্চিয় দয়া দেখাতে আসছে!আমার কারো দয়া চাইনা। রুশি কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো

“বাই এনি চান্স দ্যি গ্রেট সায়ান জামিল খান আমার কেয়ার করছে? হাহ আই উইল বি ফ্লেটারড! ওহ আমি তো ভুলেই গিয়েছি আমার সন্তানের বাবা তো আপনি! তাই হয়তো নিজের সন্তানের জন্য চিন্তা হচ্ছে আপনার। ডোন্ট ওয়ারি বাচ্চাটা আমারো আর আমার মাঝেই বড় হচ্ছে। আপনার থেকে চিন্তাটা আমারই বেশি!আমার সন্তান হিসেবে এতটুকু ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষমতা ওর আছে ”

রুশির কথায় সায়ান দমে গেলো আর কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিলো, ও সত্যিই রুশির কথা ভেবেই কথাগুলো বলেছে। রুশি হাল্কা কাপড় পরে আছে আর যা শীত পড়েছে তাতে ঠান্ডা লাগার চান্স অনেক বেশি।তারউপর রুশি কাঁদছিলো তাই ভাবলো ওকে ওখান থেকে নিয়ে আসবে কিন্তু রুশির কথা শুনে ওর মনটা খারাপ হয়ে গেলো, ও তাড়াতাড়ি রুশিকে এক্সপ্লেইন করতে চাইলো

“তুমি যা ভাবছো ঠিক তা নয়, আমি সত্যিই তোমার…”

“থাক মি.সায়ান আমাকে আপনি আপনার দয়া আপনার কাছেই রাখুন, আমাকে কষ্ট করে তা দেখাতে হবে না। আপনি এখানে নিজের সময় নষ্ট করে আমার প্রতি দয়া দেখাচ্ছেন সেটা জানলে কেউ একজন বড্ড অখুশি হবে।আমি দ্বিতীয়বার কারো থাপ্পড় খেতে চাইনা আর না আপনাদের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে থাকবো!”

রুশি কথাগুলো শেষ করে রুমে এসে লাইট জালিয়ে দিলো তারপর সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো

“কারো রুমে আসতে হলে দরজায় নক করতে হয় তা কি কেউ আপনাকে শেখায়নি?যদিও এই ঘর বাড়ি সবই আপনাদের তবুও যেহেতু দয়া করে থাকতে দিয়েছেন তাই এতোটুকু প্রাইভেসি তো আশাই করতে পারি তাইনা?”

রুশির কথায় সায়ানের মুখের মাঝে ঝুলে থাকা হাসি নিমিষেই হারিয়ে গেলো, রুশি ঠান্ডা মাথায় ওকে অপমান করেছে এটা ও বেশ বুঝতে পারলো কিন্তু ও রিয়াক্ট করলো না। রুশি যা বলছে তার সবই সঠিক, ও তো সত্যিই ব্যার্থ রুশি যা চায় তা দিতে কিন্তু প্রচণ্ড খারাপ লাগা কাজ করছে।

রুশি সায়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো সায়ান কথাগুলো ভালো ভাবে নেয়নি। ওকি একটু বেশি বলে ফেলেছে? কিন্তু ওর তো সবটা ক্লিয়ার করার দরকার ছিলো যে ও তাদের মাঝে ইচ্ছে করে আসেনি আর না তাদের মাঝে থাকবে। বিয়ে হয়েছে বলেই যে নিজের আত্মসম্মানের জলাঞ্জলি দিয়ে সায়ানের গলায় ঝুলে থাকবে এমন মেয়ে ও নয়। আত্মসম্মান খোয়ানোর চেয়ে ওর কাছে মৃত্যু শ্রেয়! তাই মুখের ভাব ভংগি পরিবর্তন না করেই বললো

“যা বলতে এসেছেন তা বললে খুশি হবো!”

সায়ান রুশির দিকে তাকালো, এই মুহুর্তে রুশির মাথায় কি চলছে তা ওর বোধগম্য হচ্ছে না তাই ও শান্ত স্বরে বললো

“ফার্মহাউজ থেকে এখানে কেনো শিফট হয়েছো? আমি তো সেই দিনই না করে দিয়েছি মিসেস খানকে তবুও তুমি তার সাথে এখানে এসেছো কেনো?”

“ওহ তো আজ তিনদিন পরে মনে হলো আমি এখানে কেনো এসেছি তা জিজ্ঞেস করা দরকার আপনার?উপস আপনি তো জানেনই না যে এখানে আমি তিনদিন আগে এসেছি!সে যাইহোক আমার মনে হলো আপনার ওইখানে থাকলে আপনার প্রেমিকা আবারও এসে আমাকে মারতে চাইতে পারে কিংবা আমার সন্তানের কোন ক্ষতি করতে পারে তাই এখানে চলে আসা আমার কাছে সেফ মনে হলো”

“চন্দ্রিকা এমন কাজ করবে না, অন্তত কোন নিষ্পাপ প্রাণের ক্ষতি করবে না”

“আপনি তাকে ভালোবাসেন তাই আপনার তার প্রতি অগাধ বিশ্বাস কিন্তু সে আমার কেউ না তাই বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। মানুষ জেলাসির বসে অনেক কিছুই করতে পারে আর সেটার প্রভাব আমার বাচ্চার উপর পড়ুক আমি তা কখনোই চাইনা। আমি এখন থেকে এখানেই থাকবো!”

“আমি চাইনা তুমি এখানে থাকো,এই খান বাড়িতে থাকার কোন দরকার নেই তোমার। আমার বউকে রাখার মতো জায়গা আমার আছে”

রুশি সায়ান কথা শুনে বেশ অবাক হলো, তার বেশ তাচ্ছিল্য নিয়ে বললো

“বউ!হাহ ভালোই মজা করতে জানেন দেখছি। শুনুন আপনার এই বাড়ির সাথে যা সমস্যা সেটা নিতান্তই আপনার ব্যাক্তিগত ব্যাপার তা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই কিন্তু আমি কোথায় থাকবো সেটা আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার সেটাতে ইন্টারফেয়ার করার অধিকার আমি আপনাকে দেইনি।এখানে কিছু ভালো মানুষ আছে যাদের ছায়াতলে আমার সন্তান ভালো কিছু শিখবে। এনিওয়ে আপনি এখন আসতে পারেন! এসব ফালতু কথাবার্তায় সময় নষ্ট করার মতো অঢেন সময় আপনার থাকলেও আমার নেই”

রুশির এমন কথায় সায়ানের পিণ্ডি জ্বলে উঠলো, এই মেয়ে সেই তখন থেকে ওকে অপমান করে যাচ্ছে। আর ও মিথ্যে কি বলেছে ও কি ওর বউ না নাকি?নাকি ওর বউ হওয়া লজ্জার বিষয়?আর এটা ফাউল কথা! সায়ান নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মেকি হেসে বললো

“আসলে কি বলোতো আমি আমার বউ বাচ্চাকে ছেড়ে যেতে চাইনা, তাই ভাবছি আমিও এখানে থাকবো। আর বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী তো একরুমেই থাকে তাই আমিও এই রুমেই থাকছি”

“আরেহ মানে কি?এখানে থাকবেন মানে?আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”

সায়ান আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো, এই মুহুর্তে ওর মাথা ঠান্ডা করা প্রয়োজন। এই মেয়ে আস্ত ধানিলংকা! একে দেখে বুঝাই যায়না এতো সুন্দর করে সুন্দর ভাষায় কেউ অপমান করতে পারে! উফ রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে ওর।

#চলবে

গুমোট অনুভুতি পর্ব-১১+১২(প্রথমাংশ ও শেষাংশ)

0

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১১

মিসেস খান দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতেই সায়ান সোফায় মাথা এলিয়ে দেয়, মাথা প্রচণ্ড যন্ত্রণা করছে একজন। বিজনেসের কাজে এই তিনদিন দেশের বাইরে ছিলো, রাত তিনটায় বাংলাদেশে এসে পৌঁছায় ও।তাই নিজের অফিসের সাথে এডজাস্ট করা বেডরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে মাত্রই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখন সাহিল ফোন করে বলে যে “মিসেস খান গাজীপুরের খামার বাড়ির দিকে যাচ্ছেন”

কথাটা শুনে দ্রুত জেকেট পরে বেরিয়ে পড়ে, এই মুহুর্তে ওর ঘুমের প্রয়োজন ছিলো খুব তাই হয়তো মাথা এমন করছে!এ তিনদিন অপরাধ বোধ সায়ানকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে,ওর প্রত্যেকটা মুহুর্ত মনে হয়েছে ও চন্দ্রিকে ঠকাচ্ছে। সেটার অবশ্য যথেষ্ট কারণ রয়েছে!

সেদিন এখান থেকে যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ও এই মেয়েটির কথা ভেবেছে, কেনো ভেবেছে তার কারণ জানা নেই ওর কিন্তু ও ভেবেছে! কেয়ারটেকারের কাছ থেকে প্রতিমুহূর্ত এই মেয়েটির খোজ নিয়েছে ও। মেয়েটি কি করছে, ওর মুড এখন কেমন আর ওর শরীরের অবস্থা কেমন!যদি কখনো খুব বেশি মিস করেছে তবে ভিডিও কলের মাধ্যমে এক নজর মেয়েটিকে দেখে নিয়েছে। মেয়েটির হাসিমাখা মুখ,গম্ভীর মুখ, চিন্তিত মুখ বা অবাক চাহনি সব কিছুই যেনো দেখতে খুব সুন্দর লাগে! মনে শত ব্যস্ততার মাঝে একটু প্রশান্তি! কিন্তু কেনো এমনটি করেছে ওর জানা নেই,ও এই প্রথম নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করেছে!

আর যতোবার করেছে ততবার মনে হয়েছে ও চন্দ্রিকে ঠকাচ্ছে, ভীষণ ভাবে ঠকাচ্ছে।এভাবে কোনদিন ও চন্দ্রির খোজ নেয়নি,না কখনো ব্যস্ততার মাঝে ওকে দেখতে চেয়েছে। সবসময় চন্দ্রি ওকে কল করেছে, সত্যি বলতে ও কখনো নিজ থেকে খোজ নেয়নি ওর। তাই নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হচ্ছিলো! তাইতো গতকাল সারাদিন ও মেয়েটির খোজ নেয়নি, নিজেকে ব্যাস্ত রেখেছে হাজারো কাজের ভীরে! কিন্তু নিজের একাকিত্ব সময়ে সবার প্রথম এই মেয়েটির কথা মনে পড়েছে, শেষমেশ আর না পেরে মেয়েটিকে শুধু একটি নজর দেখে নিয়েছিলো! ওই ঘুমন্ত মুখ খানায় ছিলো হাজারো মায়ার ভীড়! অবাধ্য মন নিজের অজান্তেই প্রেমে পড়তে চেয়েছিলো কিন্তু ও তা হতে দেয়নি। ওযে ওয়াদাবদ্ধ! আজীবন কাউকে ভালোবাসার ওয়াদাবদ্ধ। কিন্তু কিছুতেই যেনো নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করতে পারছে না।

সত্যি বলতে ও দ্রুত পায়ে এখানে মিসেস খানকে ওদের বিয়ের সত্যিটা বলতে বাঁধা দিতে আসেনি। বরং ওর মনে হয়েছে মিসেস খান যদি মেয়েটিকে কিছু বলে?এই ছোট্ট মেয়েটি কিভাবে সামাল দিবে সেটা। আর যাইহোক ও মেয়েটিকে কোন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চায়নি। আর এখানে আসার পর ও তাদের কথা বার্তা প্রায় অনেকটাই শুনেছে! রুশি যখন বলেছে সে মিসেস খান ব্যাবস্থা করে দিলে ও চলে যাবে তখন ওর খুব রাগ হয়েছিলো। মেয়েটি কি ওকে ভরসা করে ওর সাথে থাকতে পারছেনা?আবার যখন খান বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছিলো তখন ও পারেনা ছুটে এসে মেয়েটিকে লুকিয়ে রেখে দেয়।ও ভাবতেই পারছিলো না যে ও মেয়েটিকে কারণে অকারণে দেখতে পারবে না! ওর মনে হচ্ছিলো

“ওর বউকে অন্য কেউ কেনো নিয়ে যাবে?ওর বউ ওর কাছে থাকবে”

তাইতো ওর বউয়ের হাজবেন্ড হিসেবে বলেছিলো

“ওর আপত্তি না থাকলেও আমার ঘোর আপত্তি আছে”

আর যাইহোক ওর বউকে ও কোথাও যেতে দিবে না, কিন্তু নিজের ভাবনায় নিজেই যেনো বোকা বনে গেলো। ওর হঠাৎ হাজবেন্ডের মতো কেনো আচরণ করছে যেখানে মেয়েটিকে কোন অধিকারই দিচ্ছেনা! শুধু মাত্র নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। ওকি তবে নিজের অবাধ্য আবদারের বেড়াজালে মেয়েটিকে জড়িয়ে ফেলছে না? তাকে কি মিথ্যে আশা দিচ্ছেনা?

সায়ান আর ভাবতে পারছেনা, সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এতোদিন তো খুব ভালোই ছিলো ও, নারী নামক সত্তা নিয়ে কোন ভাবনাই ছিলো না ওর। চন্দ্রিকা তার মতো ছিলো আর ও নিজের মতো। কথা ছিলো চন্দ্রিকার গ্র‍্যাজুয়েশন কমপ্লিট হলেই বিয়ে কিরে নিবে দুজন কিন্তু এখন এই মেয়েটির সাথে সাথে চন্দ্রিকে নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যদি চন্দ্রি জেনে যায় তবে কি হবে? বা এই মেয়েটি যদি হুট করে হারিয়ে যায় তবে কি করবে?
এসব অসংযত অনুভুতির কিছুই বুঝতে পারছে না ও!

মাথা যেনো প্রচণ্ড ভারী লাগছে তাই ভাবলো মেয়েটিকে একটু অনুরোধ করবে ওর মাথা টিপে দেয়ার জন্য!তাই চোখ খুলে মেয়েটির দিকে তাকালো, মেয়েটির মুখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে যেনো কিছু বুঝার চেষ্টা করছে! সায়ান ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকালো আর মুহুর্তেই দাঁড়িয়ে পড়লো। ওর সবচেয়ে বড় ভয় ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে!সায়ান যেনো বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

চন্দ্রিকা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, চোখ দুটোতে যেন হতাশা, অসহায়ত্ব আর কষ্ট সব একসাথে প্রকাশ পাচ্ছে।ওর দৃষ্টি যেনো বলে দিচ্ছে

“আমার এতোকালের ভালোবাসা, বিশ্বাসের এই প্রতিদান দিলে তুমি?কি দোষ করেছি যাতে তুমি এভাবে শেষ করে দিলে আমায়!”

“চন্দ্রি! আমি…আই কেন এক্সপ্লেইন!”

“কি বলবে কিভাবে আমাকে ধোঁকা দিয়েছো? কি ভাবে আমাকে আশা দিয়ে দিনের পর দিন অন্যের সাথে সংসার করে গেছো? এই জন্যই আমাকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাইছিলেনা তাইনা?কারণ বাইরে তো রঙলিলা বসিয়েছো!আমার এতো ভালোবাসার পরিবর্তে তুমি এই প্রতিদান দিলে?আমি কি এটা ডিজার্ভ করতাম?”

রুশি চন্দ্রি নামটা শুনেই মেয়েটির দিকে গভীর ভাবে তাকালো, তাহলে এই মেয়েটিই চন্দ্রিকা যাকে তার স্বামী ভালোবাসে! মিসেস খান যাওয়ার প্রায় কয়েকমিনিট পরেই এই মেয়েটি এখানে এসেছে তবে বিনাশব্দে দাঁড়িয়ে ছিলো। মেয়েটি খুব সুন্দর দেখতে যাকে বলে অপরুপা,গৌর মুখখানি যেকোন সাধু পুরুষকেও প্রেমে পড়তে বাধ্য করবে। অসম্ভব সুন্দর মেয়েটি! নো ডাউট সায়ান জামিল খান এই মেয়েটিকে ভালোবাসে। ভালোবাসারই কথা! খান বাড়ির বউ হওয়ার জন্য এর থেকে বেটার অপশন হতেই পারেনা। দে আর মেড ফর ইচ আদার!

রুশির মনে এখানে থেকে ওর কোন লাভ নেই,দুজন ভালোবাসার মানুষের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে কি লাভ! তাই দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে ও নিজের রুমের দিকে রওনা দিলো,বুকের বাঁ পাশে হাল্কা চিনচিন ব্যথা করলেও তা পাত্তা দিলো না। যতই তার স্বামী সে এখন অন্যকারো আমানত, আর অন্যের আমানতে রুশি কখনোই নজর দিবে না। কখনোই না!

রুশির কয়েকপা এগুতেই কেউ একজন ওর হাত চেপে ধরে তার দিকে ঘুরালো আর কিছু বুঝে ওঠার পুর্বেই থাপ্পড় মারলো। রুশি যেনো আকাশ থেকে পড়লো, এভাবে কারো কাছ থেকে কখনোই ও মার খায়নি। সামনের মেয়েটি আবার হাত উঠাতেই ও চোখ বন্ধ করে নিলো কিন্তু কোন কিছু অনুভুত না হওয়ায় চোখ খুললো আর দেখলো সায়ান হাত চেপে ধরে আছে তার। চন্দ্রি ওর দিকে তাকাতেই সায়ান চড়া গলায় বললো

“তোমার যা বলার যা করার আমার সাথে করো, এখানে রুশানির কোন দোষ নেই তাই ওর গায়ে তুমি কেনো হাত তুলেছো?সে স্যরি টু হার”

প্রায় সাথে সাথেই চন্দ্রিকা হাত নামিয়ে ফেললো আর বিস্ময় নিয়ে বললো

“তুমি আমার সাথে আগে কখনো এভাবে কথা বলোনি সায়ান! তুমি আমাকে বকা দিচ্ছো তাও এই মেয়ের জন্য?তুমি অনেক বদলে গেছো, অনেকটা!”

চন্দ্রিকার ফুঁফিয়ে কান্না দেখে রুশির বেশ মায়া হলো, মেয়েটির কোন দোষ নেই এখানে। নিজের ভালোবাসার মানুষকে কেউ কখনো কারো সাথে শেয়ার করতে পারে না আর যদি ভালোবাসা গভীর হয় তবে তো সেটা কল্পনাও করতে পারেনা। তবে এই পরিস্থিতিতে ওরও কোন দোষ নেই, ও না চাইতেও তাদের মাঝখানে চলে এসেছে। তাই রুশির মনে হলো ওর সবটা ক্লিয়ার করা দরকার তাই ও কিছুটা দম নিয়ে মেয়েটির টলমলে চোখের দিকে তাকিয়ে বললো

“দেখুন আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছুই না,আপনার ভালোবাসার মানুষ আর আমার মাঝে তেমন কোন সম্পর্ক নেই। যা আপনার তা আপনারি আছে!আমি আপনাদের মাঝে কখনোই…”

রুশি শেষ করার পুর্বেই মেয়েটা যেনো তেড়ে আসলো আর রাগি কন্ঠে বললো

“আমাদের মাঝে তোমাকে কে কথা বলতে বলেছে?তুমি আসোনি বলেও তো এসে গেছো আমাদের মাঝে। আমি সায়ানকে ভালোবাসি কিন্তু তুমি তার সাথে বিয়ে করেছো আর তার বাচ্চার মা হতে চলেছো তাহলে তুমি কি করে আমাদের মাঝে আসোনি বলো?”

কথাগুলো বলে চন্দিকা বসে পড়লো ফ্লোরে, যেনো সে নিঃস্ব হয়ে বসে আছে। একটা মেয়ের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার জীবনসঙ্গী, সে মানুষটিই তার না হলে জীবনটাই যেনো মুল্যহীন। সায়ান রুশির দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বললো

“আই এম স্যরি!আমি ভাবিনি এমন কিছু হবে।আমি…”

রুশির মাথা নাড়লো তারপর রুমের দিকে আগাতে শুরু করলো,মুখে ফুটে উঠলো তাচ্ছিল্যের হাসি। সেই তো এখানের তৃতীয় ব্যাক্তি হচ্ছে ও! তাই চলেতো ওকেই যেতে হবে। ওতো আর কারো প্রতি অধিকার দেখিয়ে বলতে পারবে যে এটা আমার। না নিজের স্বামীকে না নিজের অনাগত বাচ্চাকে। এর বড় অসহায়ত্ব আর কি হতে পারে?

“কেনো তোমাকে পেয়েও
আমার পাওয়া হলো না?
কেনো এতো অধিকার থাকা
সত্ত্বেও তা জমানো হলো না?
কেনো তুমি, আমি মিলে
আমরা হওয়া হলো না!”

রুশিকে রুমের দিকে এগোতে দেখে চন্দ্রিকাও দাঁড়িয়ে পড়লো,যে অধিকার পাওয়ার জন্য ও এতোদিন ধরে প্রহর গুনেছে। প্রতিনিয়ত স্বপ্ন বুনেছে সায়ানের বউ হওয়ার,সেটা আজ অন্য কেউ!সায়ানের জীবনে অন্যকেউ আছে সেটা মানা যে কতোটা যন্ত্রণার তা ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়। ও দৌড়ে বেরিয়ে পড়লো সেখান থেকে, এখানে আর এক মুহুর্তও নয়।

আর দুই নারীর দুদিকে চলে যাও নিশ্চুপে দেখলো। যেই মুহুর্তের সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছিলো তাই ঘটেছে আজ। সত্য লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয় তা নিজের স্বচক্ষে দেখলো। কোন দিকে যাবে ও?
এক দিকে এতোকালের ভালোবাসা অপরদিকে দায়িত্ব! দায়িত্ব আর ভালোবাসার বেড়াজালে ও ঝুলে আছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে,,,

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১২(প্রথমাংশ)

সায়ান ধীরস্থির ভাবে উঠে দাঁড়ালো, সদর দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে সেটা বন্ধ করে গেস্টরুমের দিকে এগুলো। এই বাড়িতে ওর রুমে বর্তমানে রুশি থাকে তাই গেস্টরুমের দরজার খুললো, রুশির রুমের দিকে একবার তাকিয়ে তারপর রুমে ঢুকে গেলো। এই মুহুর্তে ওর ঘুমের প্রয়োজন তারপর ঠান্ডা মাথায় ভাববে কি করা যায়, আপাদত নিজেকে শান্ত করা প্রয়োজন!

ও কখনোই চায়নি চন্দ্রিকা ওর বিয়ের সত্যিটা জানুক কারণ চন্দ্রিকা খুবই নরম মনের মানুষ তাই যেকোন ভুল করে ফেলতে পারে! সত্যি বলতে ওর কিছুটা চিন্তা হচ্ছে কিন্তু ও এখন চন্দ্রির কাছে গেলেও বিশেষ লাভ হবে না। এর থেকে ভালো ও কিছুটা সময় নিয়ে শান্ত হোক তারপর নাহয় ঠান্ডা মাথায় বুঝানো যাবে!

সায়ানের মাথায় চট করে কিছু একটা আসলো আর তাড়াহুড়া করে উঠে বসলো। আচ্ছা রুশানি ব্যাপারটাকে কিভাবে নিয়েছে?ওতো চন্দ্রিকার বিষয়ে জেনে গেছে,এবং এটাও জানে ও চন্দ্রিকাকে বিয়ে করবে তবে ওকে খারাপ ছেলে ভাবছে?ভাবছে অন্য ছেলেদের ও চরিত্রহীন যে কিনা দুটো মেয়েকে একসাথে রাখছে কিন্তু এমনটা তো চায়নি।মুহুর্তেই যেন সায়ানের মন গ্রাস করলো একরাশ বিষণ্ণতা,হঠাৎ করেই যেনো মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেলো! রুশি ওকে খারাপ ভাববে ব্যাপারটা যেনো ও মেনেই নিতে পারছেনা, এতোটা খারাপ লাগছে কেনো ওর।

তবে কি তাকে গিয়ে বলবে যে সে যা ভাবছে তা সত্য নয়?ও চন্দ্রিকার ততটা কাছে আজ অবদি যায়ই নি কিন্তু তাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। ও কাউকে ঠকায়নি শুধু পরিস্থিতির স্বীকার!কিন্তু এটাই বা কিভাবে নিবে রুশি?যদি ভাবে আমি একসাথে দুজনের মন জুগিয়ে চলছি!আচ্ছা আমরা নাহয় স্বামী স্ত্রী না হলাম তবে আমরা ভালো বন্ধু হতে পারিনা?আমি যদি তার বন্ধু হতে চাই তবে সে কি মেনে নিবে আমায়?

এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সায়ানের চোখে ঘুমেরা ভর করলো, তলিয়ে গেলো ঘুমের অতল রাজ্যে।

তার ঠিক পাশের কামরায় রুশি তাকিয়ে আছে দূরের ঐই বিশাল আকাশের দিকে, খণ্ড খণ্ড মেঘেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে সমস্ত আকাশ জুড়ে। সাদা-নীলের এই অদ্ভুত খেলা দেখতে মগ্ন সে,এখন রাত নয় তাই আকাশ জুড়ে তারাদের ভেলা নেই। যদি থাকতো তবে একা থাকতো না, খুব কাছের একজন এর সাথে কথা বলতো প্রাণ খুলে। নিজের জমানো সকল কথার ঝুড়ি খুলে বসতো, আর সে নিশ্চুপে সব শুনে যেতো। মাঝে মাঝে বড্ড ভাবে! আচ্ছা এই ও সেই মানুষটির সাথে এতোএতো কথা বলে, সে কি আদোও একবার হলেও তাকে ভেবে আকাশ পানে তাকায়? তার কথা মনে করে করে তারাদের সাথে কথা কয়?হয়তো না! কিন্তু ও বলে আর আজীবন বলে যাবে।

খুব মনে পড়ে ওই দিনের কথা যখন দুজন পাশাপাশি বসে ছিলো খোলা আকাশের নিচে হাজার তারার ভীড়ে। রুশি তখন খিলখিল করে হেসে হাত বাড়িয়ে বলেছিলো

“ওই যে ওই ছোট্ট তারাটা সেটা হচ্ছি আমি আর পাশের যে একটু বড় তারা সেটা হচ্ছো তুমি। যখন আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হবে তখন ওই তারার সাথে বলবে আর আমি সব শুনতে পাবো”

তখন সে মাথায় হাল্কা গাট্টা মেরে বলেছিলো

“কেনো রে আকাশের সাথে কি তোর কান ফিট করা যে ওই তারাকে কিছু বললেই তুই শুনতে পাবি?”

তখন ও রেগে বলেছিলো

“আরে তুমি বলেই দেখোনা! আমি ঠিক সব শুনতে পাবো”

কথাগুলো ভেবেই রুশির হাসি পেলো, কতোটা অবুঝ ছিলো ও!আচ্ছা সে কি এখন তারাদের সাথে কথা বলে? তবে ও শুনতে পায়না কেনো? বাকি সে বলেই না তাই হয়তো শুনতে পায়না ওর।চেহারা,জায়গা সবকিছুই অস্পষ্ট ওর তবে কথাগুলো আজোও মনে আছে যেনো এইতো সেইদিন ও তার সাথে বসে ছিলো।টাইম ফ্লাইস!এখন আর ও ছোট্টটি নেই বরং বড় হয়ে গেছে আর শিগ্রই মা হতে চলেছে। সে দেখলে হতে হাসি দিয়ে উড়িয়েই দিতো আর বলতো

“তুই মা হবি?এটুকু পেটে বাচ্চা কই রাখবি?হাহাহা”

আজ সবকিছু ঝাপসা ওর কাছে, সে মানুষটি, সে নাম আর সম্পর্ক। সবকিছু ঝাপিয়ে ও আজ অন্য কেউ,সম্পুর্ণ নতুন কেউ!

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বিছানায় এসে বসলো রুশি, এজীবনে অনেক মানুষকে হারিয়েছে ও,কাউকে হয়তো ইচ্ছে করে আর কাউকে অনিচ্ছাকৃত। কেনো যেনো সবাই ওকে ছেড়ে চলে যায়!

______________________

গাজীপুরে এখন রাত আর এই নির্জন এলাকার জন্য এটি প্রায় গভীর রাত। বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। দোতলা খামার বাড়িতে এই মুহুর্তে চামচ নড়াচড়ার শব্দ ব্যতীত অন্য কোন শব্দই শোনা যাচ্ছে না। সায়ান এই পর্যন্ত প্রায় তিনবার সিঁড়ির দিকে তাকিয়েছো কিন্তু হতাশ হয়েছে। খাবারের প্রতি কেমন যেনো একটা অনীহা জমে গেছে। সায়ানের দৃষ্টি অনুসরণ করে কেয়ারটেকারও সিঁড়ির দিকে তাকিয়েছো, প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বেশ বুঝতে পারলো বারবার ওইদিকে তাকানোর কারণ। তাই কিছুটা সাহস জোগাড় করে বলেই ফেললো

“স্যার আপনি কি রুশানি ম্যাডাম কে খুঁজছেন?”

সায়ান চামচ নড়াচড়া বন্ধ করে দিলো তারপর গলা পরিষ্কার করে বললো

“তেমন কিছু নয়, আমি জাস্ট ভাবছি এতোক্ষনে তো ডিনার করার কথা তার তাহলে এখনো আসছে না কেনো?”

“স্যার আসলে ম্যাম তো প্রেগন্যান্ট তাই এতোরাত পর্যন্ত না খেয়ে থাকেন না। উনি আগেই খেয়ে নিয়েছেন তাই এখন আর খাবেন না, হয়তো গভীর রাতে আবার কিছু খাবেন!”

কথাগুলো শেষ হতেই সায়ান নিজের ঘড়ির দিকে তাকালো,নয়টা বাজে এখন। তাই বলে এতো তাড়াতাড়ি খাবে?আগে তো এতো তাড়াতাড়ি খেতো না?তবে ওকে ইচ্ছে করে এভোয়েড করছে?সায়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো, তাহলে কি ও এখানে আছে বলেই আজ সারাদিন রুম থেকে বের হয়নি!
সায়ান না খেয়ে উঠে গেলো আর রুমের দিকে চলে গেলো, অজানা মন খারাপ ভর করলো ওর মন জুড়ে। যেটা ক্রমশ সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে যেতে লাগলো, বুকের বা পাশে চিনচিন ব্যাথা ক্রমশ বেড়েই চলছে। বুক কেমন ভারী ভারী লাগছে ওর!
.
.
.
রাত ১২তা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট, রুশি বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে। কিছুক্ষণ পুর্বেই ঘুমটা হঠাৎ ভেংগে গিয়েছে, এটা ওর নিত্য দিনের অভ্যস। এই সময়টায় কিছু না কিছু একটা খায়া ও, আজ তিনদিন ধরে টানা এই রেওয়াজই চলে আসছিলো তবে আজকের নিয়মটা ভিন্ন।

ও ভেবেছিলো সায়ান চন্দ্রিকার পিছু পিছু এখান থেকে চলে যাবে, কিন্তু ও যে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে এখানে তা ধারণার বাইরে ছিলো ওর। আজব প্রেমিকা মুখ ফুলিয়ে চলে গেছে কই তাকে গিয়ে মানাবে তা না করে এখানে বসে আছে কেনো? এই তিনদিনে বাড়িটাকে কেমন নিজের নিজের মনে হচ্ছিলো, হুট করেই আজ যখন সায়ান থেকে গেলো তখন মনে হচ্ছে বাড়িটা অন্য কারো। কেনো যেনো ওর বিরক্তি লাগছে আবার কোথাও না কোথাও ভালোও লাগছে। দুটো সম্পুর্ণ বিপরীত অনুভুতি একই সাথে কাজ করছে,,,

উফফ পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে মনে হচ্ছে, রুশি পেট চেপে ধরে উঠে বসলো। নাহ এখন কিছু না খেলে কিছুতেই ঘুম আসবে না, আর সায়ান নিশ্চই এতো রাতে জেগে বসে নেই। তাই তার সাথে দেখাও হবেনা। নিজেকে কোনরকম সান্ত্বনা দিয়ে নিচে নেমে আসলো, যা ভেবেছিলো ঠিক তাই। পুরো ডাইনিং রুম জুড়ে অন্ধকার আর পিনপিন নিরবতা মানে এখানে কেউ নেই। রুশি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সামনে এগোলো। ফোনের ফ্ল্যাশ অন করে ফ্রিজ আইস্ক্রিম বের করে এক কামড় খেলো তারপর ফ্রিজ অফ করে সামনে ফিরতেই একটা কালো অবয়ব দেখতে পেলো। ভয়ে রুশির আত্মা কেঁপে উঠলো, হাত থেকে ফোন, আইস্ক্রিম ফেলে দিয়ে দিলো এক চিৎকার তারপর ফ্লোরে বসে পড়লো। সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই মৃদু হাসির শব্দ পেলো সাথে মৃদু আলো চোখে এসে পড়লো।

সামনে তাকিয়ে দেখে সায়ান এক হাত কোমরে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর চোখে মুখে খুশি খেলে যাচ্ছে। রুশি চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিশ্বাস নিলো, কি ভয়টাই না পেয়েছিলো! আরেকটু পর হয়তো হার্ট অ্যাটাক করতো। নাক ফুলিয়ে সায়ানের দিকে তাকালো তারপর উঠে দাঁড়ালো তারপর চড়া গলায় বললো

“মারতে চান নাকি মানুষকে? এভাবে কেউ ভুতের মতো সামনে এসে দাঁড়ায়?”

“বাহ তুমি চোরের মতো মতো রাতবিরাতে ফ্রিজ থেকে আইস্ক্রিম চুরি করে খাচ্ছো তাতে কিছুনা আর আমি চোর ভেবে ধীর পায়ে পেছনে এসে দাঁড়ালেই সমস্যা?”

“আমি চোর? আপনি আমাকে চোর বললেন? আপনার খাবার খাচ্ছি বলে খোটা দিচ্ছেন?”

“তা কেনো দিবো? আমি তো বললাম চোরের মতো করে খাচ্ছো আর চোর রা তো চুরি করেই খায় তাইনা?লাইট অফ করে চুপিচুপি কেনো খেতে হবে তোমার? লাইট অন করে খেতে পারোনি!তোমার খাবার কি কেউ নিয়ে যাচ্ছে?”

রুশি মুখ ভেংচি দিয়ে বললো

“সেটা আমার ব্যাপার আমি কিভাবে খাবো না খাবো। আপনার নাক গলাতে হবে না”

“সে নাহয় বুঝলাম তোমার খাবার তোমার ইচ্ছে অনুযায়ী খাবে। তাই বলে আইস্ক্রিম কেনো খাচ্ছো? ঠান্ডা লেগে যাবে না?আর বেবির ক্ষতি হবে না?”

“আমার বেবি আমি বুঝবো। আপনার নাক গলানোর প্রয়োজন নেই”

সায়ান রুশির দিকে ঝুকে বললো

“বেবিটা তো তোমার একার না!আমি বেবির বাবা তাই নাক তো গলাতেই হয়”

“হুহ আমি বেবির বাবা! এই আপনি না কি সুন্দর আপনি আপনি বলতেন?ফুড়ুৎ করে তুমিতে নেমে এলেন কেনো?”

“আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই তোমাকে তুমি করেই বলবো কোন সমস্যা?”

রুশি সায়ানের কথা শুনে নাক ছিটকালো তারপর হাল্কা আওয়াজে মুখ বাকিয়ে বললো

“আমার ইচ্ছে হয়েছে আমি বলবো তোমার সমস্যা?হুহ ঢং দেখলে বাঁচিনা!পুরুষ গিরগিটির মতো খনে খনে কথা বদলায়”

পরের লাইনটুকু সায়ানের কানে এলোনা, ততক্ষণে রুশি সিঁড়ি অবদি চলে গিয়েছে। রুশির পাগলামি দেখে সায়ান নিঃশব্দে হাসলো, তারপর চিপস হাতে নিয়ে রুশির ঘরের দিকে এগোলো নাহয় মেডাম আবারও খাবারের খোজে নিচে আসবেন!

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১২(দ্বিতীয়াংশ)

সময়টা বিকাল!পশ্চিম আকাশে সূর্যের উত্তাপ কম। হাল্কা বাতাস বইছে চারদিকে। বিশাল দোতলা বাড়িতে জিনিসপত্র সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কাচ ভেংগে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সবকিছুর এই এলোমেলো অবস্থা চুপচাপ বসে দেখছে সায়ান। এই সবকিছুই গতোকালের দৃশ্য, চন্দ্রিকা কাল ফিরে এসে পুরো বাড়ি জুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছে, হয়তো রাগে, ক্ষোভে, বা ব্যাথায়!তারপর নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে আছে।অন্যকেউ হলে সায়ান হয়তো ভয় পেতো কিন্তু ও চন্দ্রিকে খুব ভালো করে চিনে। ও খুব দুর্বল মনের এবং ভীতু,তাই সাহস করে নিজের ক্ষতি কখনোই করবে না বরং তাকে যে কষ্ট দিয়েছে তাকে নিজের কষ্ট বুঝানোর চেষ্টা করবে। সায়ান দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো তারপর একজন মেইডকে ডেকে বললো

“এই সব কিছু ঠিক করোনি কেনো? আর সব নতুন করে আনা হয়নি কেনো?”

মেইড মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে,রীতিমত কাঁপছে।সায়ান কাউকেই বকা দেয়না কিন্তু এই বাড়ির প্রত্যকটা জীব তাকে অদ্ভুতভাবে খুব ভয় পায়।মেইড মিনমিনিয়ে বলে উঠলো

“স্যার চন্দ্রি ম্যাম নিষেধ করেছে, বলেছে এই বাড়ির পরিস্থিতি এমনি থাকবে নাহয় আমাদের সবাইকে ফায়ার করে দিবে”

সায়ান কিছু বললো না, এ বাড়িতে চন্দ্রি কর্তীর মতো। সায়ান কথার মতো চন্দ্রির কথাই এখানে শেষ কথা,যদিও চন্দ্রির জন্য সায়ান আলাদা জায়াগায় থাকার ব্যাবস্থা করেছে কিন্তু মাসের বেশিরভাগ সময় চন্দ্রি এখানেই থাকে। সায়ান চন্দ্রিকে এই বিষয়ে কখনো কিছু বলেনি তবে এই ছাদের নিচে প্রাপ্তবয়স্ক দুজন নারীপুরুষ থাকা ওর পছন্দের ছিলো না তাই ওর অফিসের এটাচড বেডরুমে থাকতো নাহয় খুব রাত করে বাড়ি ফিরতো যাতে চন্দ্রি ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝেমাঝে খুব বিরক্ত হতো যখন দেখতো চন্দ্রি ওর রুমে এসে ঘুমিয়ে আছে কিন্তু কিছু বলে নি। চুপচাপ গেস্টরুমে গিয়ে শুয়ে পড়তো!
ও জানে চন্দ্রিকে ও একটা সময় বিয়ে করবে কিন্তু বিয়ের আগে চায়নি কোন ভুল করতে, চায়নি কেউ চন্দ্রির নামে কিছু বলুক বা কোন অশালীন শব্দ জুড়ে দিক। কিন্তু চন্দ্রি এইসব বিষয়ে বড্ড উদাসীন! ওর একই কথা

“আমাদের তো বিয়ে হবেই তবে কেউ যদি এখন আমাকে রক্ষিতা বলে আই ডোন্ট কেয়ার। আমাদের বিয়ের খবরে সে এমনি জবাব পেয়ে যাবে”

তখন সায়ান কিছুটা ভেবে বললো

“ধরো যদি কোন কারণে আমাদের বিয়ে হলো না তখন তুমি কি করবে তাহলে। এই সমাজের মানুষ বড্ড খারাপ। আজ আমার উপর হয়তো তোমায় কিছু বলতে পারছে না কিন্তু আমি কোন একদিন না থাকলে তারা জঘন্য থেকে জঘন্যতম শব্দ ব্যাবহার করবে তোমায় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। আর নারী হিসেবে এর চেয়ে গ্লানির কি হতে পারে?তোমার আত্মসম্মান তোমার রক্ষা করতে হবে,তোমার আত্মসম্মানবোধ থাকতে হবে”

কিন্তু সায়ানের কথা চন্দ্রিকার মাথায় কতটুকু ঢুকেছে তা বোধগম্য হয়নি। চন্দ্রি হঠাৎ টলমলে চোখ নিয়ে বললো

“তাহলে তুমি বলতে চাইছো তুমি আমায় বিয়ে করবে না?আমার হাত মাঝ পথে ছেড়ে দিবে?তুমি তো হাত সারাজীবন ধরে রাখার ওয়াদা করেছিলে তা এতো তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে?তুমি কি অন্যকাউকে ভালোবাসো সায়ান?”

“আমি অন্যকাউকে ভালোবাসিনা আর বাসবোও না। আমি তোমার সাথে সারাজীবন থাকার ওয়াদা করেছি তা ঠিক তবে ভাগ্যের উপর কিন্তু আমার হাত নেই। আমি চাই আমাদের বিয়ে হওয়া পর্যন্ত তুমি আর আমি নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখি”

কিন্তু চন্দ্রি কখনোই তা শুনে নি বরং দিন দিন বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছিলো তাই সায়ান চেয়েছিলো সামনের বছর তারা বিয়ে করে নিবে কিন্তু তার মাঝেই ওদের জীবনে রুশি চলে এসেছে। মেয়েটার কোন দোষ নেই, ওর অত্যন্ত জটিল জীবনে না চাইতেও জড়িয়ে গেছে সে। তারউপর রুশির প্রতি এই কয়দিনের অবান্তর অনুভুতি! আচ্ছা একটা মানুষ কি একসাথে দুটো মানুষকে ভালোবাসতে পারে?এটা কি আদোও সম্ভব!আর যাইহোক এতটুকু বুঝদার তো হয়েছে সে যে এই অনুভুতি কোন প্রকার দয়ার নয় বরং অন্যকিছু। তাহলে রুশির প্রতি এই অনুভুতির মানে কি?এটা শুধুই ক্ষনিকের আবেগ নাকি মোহ।

যদি ওর জীবনে চন্দ্রিকা না থাকতো তবে ও হয়তো ভেবেই নিতো যে ও রুশির প্রেমে পড়ে গেছে যাকে বলে লাভ এট ফার্স্ট সাইড। তবে এই অবান্তর অনুভুতিকে নিছক মোহ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারছে না, হয়তো বিয়ে করেছে বলে নিজের ভাবতে শুরু করেছে তাই এমন অনুভুতি কাজ করছে। কিন্তু তিনবছরের সম্পর্কে মায়া না বাড়িয়ে কি লাভ? এতে চন্দ্রকার এতো বছরের ভালোবাসাকে অসম্মান করা হবে, ওকে মনে প্রাণে শুধুমাত্র চন্দ্রিকার হতে হবে। নিজের অবাধ্য মনকে বাধ্য করতে হবে, আর যাইহোক চন্দ্রিকাকে ঠকাতে পারবে না ও!বিড়বিড় করে বলতে লাগলো

“আমার তোমাকে ভুলতে হবে, অন্যকারো জন্য হলেও ভুলতে হবে যে আমায় নিজের চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসে”

সায়ান চন্দ্রির রুমের দিকে এগিয়ে গেলো, তারপর হাল্কা করে নক করলো সাথে সাথে দরজা খট করে খুলে গেলো।চন্দ্রিকা টলমলে চোখ নিয়ে আসলো তারপর হাল্কা কন্ঠে বললো

“মরে গেছি কিনা তাই দেখতে এসেছো?তুমি কি করে আমার স্থান এতো সহজে অন্যকে দিয়ে দিলে?সব ভুলে গেছো তুমি!এখন আমি তোমার কাছে পুরোনো হয়ে গিয়েছি তাইনা। তুমি কি ভুলে গেছো তোমার জীবনের সাথে তুমি আমাকে জড়িয়েছো, তুমি নিয়ে এসেছো তোমার কাছে আমায়। আমি কিন্তু আসিনি!তাহলে আজ সব ভুলে গেছো? ভুলে গেছো যে আমার জন্যই তুমি বেচে আছো?সেদিন যদি আমি তোমাকে না বাঁচাতাম তবে কি তুমি আজ এখানে থাকতে! তুমি ওয়াদা করেছো সারাজীবন আমাকে ভালোবাসার অথচ আজ অন্যকে পেয়ে সবটা ভুলে গেছো। তুমি খুব স্বার্থপর! বড্ড স্বার্থপর!আমি তোমাকে ছাড়া কি করে বাঁঁচবো সায়ান ভাই?”

‘সায়ান ভাই’ শুনে সায়ান চমকে উঠলো, আজ বহুদিন পর এই ডাকটা শুনেছে তবে ঠিক আগের মতো নয়। সেই প্রাণবন্ত হাসি মাখা মুখ নিয়ে বলেনি বরং কান্নায় জর্জরিত অবস্থায় বলেছে। সায়ানের খুব খারাপ লাগছে এখন। ওর ছোট্ট পরিকে ও বড্ড কষ্ট দিয়ে ফেলেছে,হাজারগুন অপরাধবোধ ঘিরে ধরলো ওকে। সায়ান হাটু গেড়ে বসে পড়লো তারপর দু হাতে কান ধরে বললো

“স্যরি পরি!এই ভুল আর হবে না। আমি সত্যিই কোন কিছু ইচ্ছে করে করিনি। ওই মেয়েটিকে আমি তিনবছরের জন্য বিয়ে করেছি, তারপর তার আর আমার রাস্তা আলাদা। কিন্তু ওই মেয়েটি বড্ড অসহায় আর এই পরিস্থিতিতে ও আমার জন্য পড়েছে তাই আমি তাকে সাহায্য করতে চাই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। সে যাতে সমাজে উঁচু করে বাঁচতে পারে, এর বেশি কিছুই আমাদের মাঝে নেই। আর যদি থেকেও থাকে তবে তাকে আমি প্রাধান্য দিবো না, আমার পরির থেকে বড়ো কিছুই হতে পারেনা!”

চন্দ্রিকা সায়ানকে হাত ধরে উঠালো তারপর বললো

“তাহলে আজকের পর থেকে আর ওই মেয়ের কাছে যাবে না, আমার বড্ড কষ্ট হয় তার সাথে তোমাকে দেখলে। প্লিজ যেওনা…”

“হুম! তুমি রেস্ট নাও আমি রুমে যাচ্ছি”

বলে সায়ান আর একমুহুর্তও দাঁড়ায় নি, মনটা এই মুহুর্তে কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কিছু হারানোর ভয় গ্রাস করে রেখেছে যেনো ওকে। খুব সহজে তো বলে আসলো নিজের অনুভুতিকে পাত্তা দিবে না কিন্তু আদোও কি পারবে ও!নাহ পারতে হবে ওকে, ওর ছোট্ট পরির জন্য হলেও ওকে পারতে হবে।

_________________

সামুর সাথে ইনানের কথা বার্তা পাকা নিয়ে ইনানের মা এসেছে মিসেস খানের সাথে কথা বলতে। মিসেস খান তো আজ বড্ড খুশি, উনার ইনানকে প্রথম থেকেই বেশ পছন্দ। নিজের ছেলের মতোই ভাবতেন ইনানকে,এমন ছেলের কাছে যে কেউ চোখ বন্ধ করে মেয়ে তুলে দিবে। সামুর সাথে ইনানের বিয়ের কথায় তিনি বেশ খুশি, ঘর ভর্তি আয়োজন করেছেন। আজই আংটি পরিয়ে যাওয়ার কথা।

ইনান আজ একটা কালো রঙের পাঞ্জাবি পরে এসেছে তাতেই যেনো রাজপুত্র লাগছে। সামু ইনানের সাথে ম্যাচিং করে কালো শাড়ি পরেছে। সামুতো বেশ খুশি, নিজের ভালোবাসার মানুষকে কয়জন নিজের করে পায়?পাশের মানুষটি ওর একথা ভাবতেই যেনো আনন্দ খেলে যাচ্ছে ওর সারা শরীর জুড়ে। ইনান মুচকি হেসে সবার সাথে কথা বলছে কিন্তু হাসির পেছনে মনের মাঝে কতোটা ঝড় বইছে সেটা শুধুমাত্র ও জানে। সামু ইনানের হাতে আংটি পরিয়ে দেয়ার পর ইনান সামুর হাতে আংটি পরিয়ে দিলো।তারপর মাথা নিচু করে প্রায় পরক্ষনেই মাথা উঁচু করে সামনে তাকালো।

নীল শাড়ি পরে আছে কেউ একজন, হাত ভর্তি নীল চুড়ি আর ঠোঁটের কোনের সেই হাসি। তার থেকে দৃষ্টি সরানোই যেনো কঠিন,পিচ্ছি বউ লাগছে তাকে। আগের থেকে অনেক সুন্দর হয়ে গিয়েছে সে,ঠোঁটের নিচের তিলটা আরো গাঢ়ো হয়ে গিয়েছে। ইনানের ঠোঁট কাঁপছে, বুকের চিনচিন ব্যথাটা বেশ বেড়েছে! মনে হচ্ছে শ্বাস নিতে পারছেনা, দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। হুট করেই দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো, আর তাকাতে পারছেনা তার দিকে। বড্ড কষ্ট হচ্ছে ওর। ভালোবাসায় এতো কষ্ট কেনো? আজ এতোদিন পর যখন ও জীবনে এগুতে চাইলো, অন্য কারো সাথে ঘর বাধতে চাইলো তখন কেনো সে সামনে এলো? কেনো আবারও তার সাথে দেখা হলো ওর?
মনে হচ্ছে ঘুরেফিরে সেই একই মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে ও, যেখানে আছে শুধু না পাওয়ার যন্ত্রণা! এখন কি করে বলবে যে সে এই মানুষটিকে ভালোবাসে?যার সাথে মাত্রই সম্পর্কে জড়িয়ে গেলো তাকে কি করে বলবে

“আমি ভালোবাসি!সামনের এই অপরুপাকে ভালোবাসি বড্ড বেশি যতটা বাসলে তাকে ছাড়া নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় ঠিক ততটা”

#চলবে

গুমোট অনুভুতি পর্ব-৯+১০

0

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৯

আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিব বাস
দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী,দীর্ঘ বরষ-মাস।
যদি আর-কারে ভালোবাস,
যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও,
আমি যত দুখ পাই গো
আমারো পরাণ যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাইগো॥

ক্ষীণ কন্ঠে গাওয়া রবিঠাকুরের প্রেমের গান কামরায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে,ফ্লোরে বসে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে একটি মেয়ে,পরনে খুব সুন্দর করে জড়ানো লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। দীর্ঘ আচল আশেপাশে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে। চোখে নিচে দেয়া কাজল হয়তো কোন ভারী বর্ষনে লেপ্টে আছে, চোখের জল শুকিয়ে আছে কপলে তবুও মোহনীয় লাগছে তাকে।

আজ আকাশটা বড্ড মেঘলা, খণ্ড খণ্ড মেঘের ভেলায় আকাশের ওই চাঁদটা হারিয়ে গেছে দূর অজানায়। আকাশ জুড়ে কালো মেঘের গম্ভীর এক নিস্তব্ধতা! চারপাশে সবকিছু অন্ধকার ঠিক সামুর জীবনের মতো! ছুরি হাতে বসে আছে ও, কিন্তু সাহস করে হাতে চালাতে পারছেনা। শুধু একটাই ভয় যদি ওর শেষ শ্বাসটুকু নেয়ার পুর্বে ইনানকে আরেকটি বার দেখা না হয়?তাকে দেখার এই প্রবল লোভ সে সামলাবে কি করে?

নিজেকে কেনো যেনো কাদম্বরী দেবি মনে হচ্ছে, যে রবিঠাকুরের প্রেমে বিলিন হয়ে আছে অথচ কোন এক অদৃশ্য দেয়ালের দোহায় দিয়ে তাদের এক হওয়া হলো না। তবে কি তার রবিঠাকুরের জীবনে কোন মৃণালিনীর আগমন ঘটেছে! নাকি তার পুর্বেই কেউ ছিলো যার ঘোরে সে এতোটাই মগ্ন যে ওর তীলে তীলে শেষ হয়ে যাওয়া তার চোখে পড়ছে না। খুব ইচ্ছে ছিলো তার লাল টুকটুকে বউটি হওয়ার তাইতো মৃত্যুর পুর্বে ও সেজেছে ঠিক সদ্য বিয়ে হওয়া বউয়ের মতো।খুব চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে

“ভালোবাসি! বড্ড ভালোবাসি ঠিক যতোটা বাসলে তোমায় ছাড়া শ্বাস নিতে কষ্ট হয় হয়তো তার চেয়েও বেশি বাসি ইনান ভাই!”

“আমি তোমার স্মৃতিপটে নাই বা এলাম
এ জীবনে তুমি নামক বস্তুটা নাই বা পেলাম,
তাতে কী?রেখে দিবো তোমায় হৃদ মাঝারে
কতোগুলো আবেগ আর অনুভুতি দিয়ে মুড়ে
তুমি রবে পুরো এই আমিটা জুড়ে!”
~~লিজা~~

দরজায় খুব বড়োশড় তোড়জোড় চলছে,কড়াঘাতে জর্জরিত দরজা হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলো! এটা নতুন কিছু নয় সামুর কাছে, আজ সারাদিন এই পরিস্থিতি অনেক বার হয়েছে কিন্তু ও এই দরজার সন্নিকটে একবারো আসেনি। নিজের স্থানে বসে আছে সেই কখন থেকে, এই মুহুর্তে কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বিছানায় মাথা হেলিয়ে দিয়ে বসে আছে, মস্তিষ্ক জুড়ে হাজারো ভাবনা আর তার সমাপ্তি ঘটে তিনটা মাত্র অক্ষরে ইনান!
এই ওয়ান সাইডেড ভালোবাসা বড্ড কষ্ট দেয়, তুমি যানো সে তোমায় কোনদিন ভালোবাসবে না তবুও তার আশায় বসে থাকা!

দরজার অপার থেকে হাল্কা শব্দ আসছে, কেউ খুব ধীরে ধীরে কড়াঘাত করছে,মৃদু আওয়াজ ভেসে আসলো দরজার ওপার থেকে।কেউ অতি সহানুভূতিশীল কন্ঠে বলছে

“সামু!”

কন্ঠটা কানে আসতেই সামুর চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো, দীর্ঘ এক বছর পর এই ডাকটা শুনেছে ও। আগে প্রায়ই এই মানুষটি সামু বলে ডাকতো, তার আশা যাওয়া এই বাড়িতে বেশ হতো!এক বছর পুর্বে নিজের বার্থডে তে নিজের মনের কথা বলেছিলো ইনানকে, সেদিন ইনান ওকে কিছু না বলে চলে গিয়েছিলো। যেখানে সামু অধীর আগ্রহে বসে ছিলো জবাবের আসায় সেখানে ওপাশ থেকে কেউ টু শব্দও করে নি। তাই নিজের থেকেই ফোন দিয়েছিলো,আর মিষ্টি হেসে বলে উঠেছিলো

“ইনান ভাই!আমার অনুভুতির আত্মপ্রকাশের জবাব পেলাম না। নিরবতাই সম্মতির লক্ষন তবে আমি হ্যা ধরে নিবো?”

কিন্তু ওপাশ থেকে খুব চড়া কন্ঠে বলে উঠলো ইনান

“জাস্ট শাট আপ, ভুলে যেওনা আমি কে?তোমার বড় ভাইয়ের বন্ধু মানে তোমার আরেক ভাই। তাই নিজের ভাইকে প্রেম নিবেদন করতে বিবেকে বাধলো না?আমি তোমার থেকে এমন আচরণ আশা করিনি সামায়রা!”

সেদিনের পর থেকে ইনান কন্ঠে সামু ডাকটা শোনা হয়নি বরং সামায়রা শুনেছে। সামু এই একটা বছর ইনানকে নিজের করার জন্য অনেক পাগলামি করেছে। কখনো শাড়ি পড়ে ইনানের এপার্টমেন্টে চলে গেছে তো কখনো খাবার নিয়ে সোজা অফিসে গিয়ে বলেছে ও ইনানের হবু বউ। এমনকি পাশে থাকা সুন্দরি মেয়ে কলিগকে হুমকিও দিয়ে এসেছে। তাতে অবশ্য কম বকা খায়নি ইনানের কাছ থেকে!

রাত বিরাতে ফোন দিয়ে বকা খেয়েছে কিন্তু তাতে কি তার কন্ঠতো শুনতে পেরেছে ও! হাজারো বাহানায় তার সামনে গিয়ে থাকতো যদি একটু হলেও তার প্রেমে পড়ে!অন্য ছেলেদের দিয়ে জেলাস ফিল করাতেও চেয়েছিলো কিন্তু ইনানের থেকে কোন রিয়াকশন আসেনি, পুরোটা সময় জুড়ে সে খুব নিস্তব্ধ ছিলো। আজ সারাদিন এই পুরো এক বছরের হিসেব মিলালো ও, ও অনেক চেষ্টা করেছে ইনানকে নিজের প্রেমে ফেলার কিন্তু সে ব্যার্থ! কারণ জীবন কোন সিনেমা নয় যে শেষ অংশে হিরো প্রেমে পড়ে যাবে। এটা বাস্তবতা যা কোন মানুষের লিখা স্ক্রিপ্ট নয়,এখানে জোর করে কাউকে ভালোবাসানো যায়না। আর যাইহোক কারো মনের উপর জোর করা সম্ভব নয়।

দরজায় ইনানের ধীর কড়াঘাত আর মৃদু কন্ঠে সামু একটুও নড়েনি, এই একবছরের অনেক অভিমান জমেছে। সামান্য সহানুভূতিতে তা গলবে না, আজ কেন এসেছে সে?মরে গেছে কিনা তা দেখতে?”

দরজার অপরপাশে ইনান বসে আছে ফ্লোরে, ওর মন বলছে সামুর কিছু হয়নি হয়তো সামু ওকে শুনতে পাচ্ছে কিন্তু দরজা খুলছে না। তাই আবারও বলে উঠলো

“সামু! আমি জানি তুমি শুনতে পাচ্ছ আমায়।প্লিজ দরজা খোলো। তোমার সাথে কথা আছে আমার”

অপরপাশ পাশ থেকে সামুর দুর্বল কন্ঠ ভেসে আসলো

“আমি মরে গেছি কিনা সেটা দেখতে এসেছেন? তাহলে আম স্যরি আমি এখনো বেচে আছি, আমার শ্বাস এখনো চলছে যদিও বুকের বাঁ পাশে বড্ড চিনচিন করছে। তবে চিন্তা করবেন না, আই সামু আপনাকে আর বিরক্ত করবে না। আর যদি ভুলে আবেগের বসে দিয়েও ফেলে তার নাম্বারটা আপনি ব্লক লিস্টে ফেলে দিয়েন”

সামুর অভিমাণি কন্ঠে বলা কথাগুলো শুনে ইনান চুপ করে রইলো,ছোট থেকে সামুকে বড্ড আদর করতো ও কিন্তু সামুকে অনন্যদৃষ্টিতে কখনো দেখা হয়নি।হয়তো ওর সামুর সাথে ফ্রি ভাবে মেলামেশা সে অন্যভাবে নিয়ে নিয়েছে। দোষ সম্পুর্ণ সামুর নয়, সামু অতীতে অনেক ভাবেই বুঝিয়েছিলো যে ও তাকে পছন্দ করে তবে ইনান পাত্তা দেয়নি। ভেবেছে হয়তো ও বেশি ভাবছে, কারণ ছেলেদের সিক্সথ সেন্স মেয়েদের মতো প্রখর নয়। তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়তো বুঝতেই পারেনা তাদের আশেপাশের মানুষ তাদের সম্পর্কে কি ভাবছে!ইনান মৃদু গলায় বললো

“স্যরি সামু!এতোদিন কষ্ট দেয়ার জন্য। আই প্রমিস আমি আর এমন কাজ কখনো করবো না। একটা সুযোগ দিবিনা আমাকে?আচ্ছা গত বছরের সেই প্রোপোসালের জবাব দেয়ার সুযোগ কি এখনো…”

ইনানের সামনের দরজা কট করে খুলে গেলো, সামু বেরিয়ে এলো রুম থেকে। লাল পাড়ের সাদা শাড়ির লম্বা আচল ফ্লোরে গড়াচ্ছে, মলিন মুখটা জুড়ে ফুটে উঠেছে একরাশ অভিমান। তাইতো এতো কাছে থেকেও কাছে আসছে না, অন্যসময়ের মতো হাত জড়িয়ে ধরছে না। ইনান এগিয়ে গেলো কিছুটা সামুর দিকে, যা দেখে সামু দৃষ্টি অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলো। ইনানের সাথে তার অভিমান হয়েছে কিন্তু তাকে এক নজর দেখার লোভও সামলাতে পারেনি। ইনান হঠাৎ করেই বলে উঠলো

“আই এম স্যরি”

বলেই সামুকে জড়িয়ে ধরলো,খুব শক্ত করে নয় আলতো হাতে। সামু প্রথমে অবাক হলেও পরে নিজেকে সামলে নেয় আর ইনানের পিঠে হাত রাখে আলতো হাতে।ইনান মৃদু কন্ঠে বলে উঠে

“আম্মুকে বলবো এই সপ্তাহে তোমাদের বাসায় আসতে,তারপর তারা কথা বলে নাহয় বিয়ের ডেট পাকা করবে”

সামু লজ্জায় ইনানের বুকে মুখ লুকালো,বিয়ের কথা শুনতেই বড্ড লজ্জা লাগছে ওর। এতোদিন বেহায়াপনা করে ইনানকে প্রেম নিবেদন করলেও তার মুখ থেকে বিয়ের কথা শুনে ভারী লজ্জা পেলো! তা দেখে ইনান মজার ছলে বললো

“বাহ যে কিনা পুরো এলাকাকে আমাকে ভালোবাসার কথা জানাচ্ছিলো সে আজ নিজেই লজ্জা পাচ্ছে?এতো লজ্জা হঠাৎ কই থেকে ইন্সট্রল হলো মেডাম!”

“ইনান ভাই! ভালো হচ্ছে না কিন্তু”

সামুর শাসনের স্বর শুনে ইনান মৃদু হাসলো তারপর আর কিছু কথা হয়নি ওদের মাঝে। হয়তো নিশ্বাসে নিশ্বাসে কথা হচ্ছিলো তাদের যা এক হৃদয় থেকে অন্য হৃদয় বুঝে নিচ্ছিলো। ইনান মনে মনে বলতে লাগলো

“আমি চাওয়াটা আমি নাই বা পেলাম, কেউ তো তার ভালোবাসা পাক!একজন তো সুখে থাকুক!আমি নাহয় আমার চাওয়াকে মনের গহীনে লুকিয়ে রাখবো চিরকাল”

_____________________

গাজীপুরের এই দোতলা বাড়িটিতে রুশি এসেছে আজ তিনদিন। চারপাশে বাগান, পুকুর, বিভিন্ন খামার আর তরুতরকারির বাগান। মুলত বাড়িটি একটি খামার বাড়ি। প্রকৃতির আসল রুপ যেনো দেখা যায় এখানে।আজ তিনদিনে সায়ানের সাথে একবারো কথা হয়নি ওর আর না দেখা হয়েছে।সেদিন সায়ান ওকে এখানে পৌঁছে দিয়ে সবাই বুঝিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলো। শুধু যাওয়ার সময় ছোট্ট করে বলেছে

“ভালো থাকবেন, কোন দরকার হলে আমাকে জানাবেন”

তবে তা নিয়ে রুশির বিশেষ মাথা ব্যাথা নেই বরং সে ভালোই আছে। এমন আলিশান জীবন ওর কল্পনাতীত ছিলো, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে এসব কথাই ভাবছিলো ও। বাগানের ঠিক মাঝখানে চেয়ার টেবিল পাতানো, চারপাশে নাম না জানা ফুলের থেকে মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে! সবমিলিয়ে প্রকৃতিকে পুরোদমে উপভোগ করছে ও।

এই মুহুর্তে বাবাইকে মিস করছে ও, না জানি কি অবস্থায় আছে সে!সকালের ঔষুধটা ঠিকমতো নিয়েছে কিনা কে জানে?রুশি ফোনটা হাতে নিয়ে বাবাকে ফোন করবে তার পুর্বেই এ বাড়ির কেয়ারটেকার এসে বললো

“ছোট মেডাম! আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। উনি হলরুমে অপেক্ষা করছে।”

রুশি বেশ অবাক হলো কথাটা শুনে, সায়ান আসেনি অবশ্যই নাহয় নিশ্চই বলতো

“ছোট সাহেব আপনাকে ডাকছে”

ওর পরিচিত বলতে এখানে কেউ নেই আর বাবাই এখানকার ঠিকানা জানে না।তবে কি সায়ানের পরিচিত কেউ ওর সাথে দেখা করতে এসেছে?কিন্তু সে কে হতে পারে?এমন কেউকি আছে যাকে ও চিনে!

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_১০

রুশি ধীর পায়ে বসার ঘরে এসে দাঁড়ালো, অদুরেই একজন নারী অবয়ব দেখা যাচ্ছে। শাড়ি পরিহিত, হাতে দামী ঘড়ি, চুল সুন্দর করে খোপা করা তবে কিছু চুল হাল্কা পাক ধরেছে। রুশি আন্দাজ করতে পারছে তিনি একজন মাঝবয়সী মহিলা বয়স হয়তো পঞ্চাশের কাছাকাছি।সেই ভদ্রমহিলার পোষাকে আভিজাত্যের ছোঁয়া, হয়তো বড় ঘরের কর্তী তিনি।
রুশি ধীর গলায় বলে উঠলো

“আপনি ডেকেছিলেন আমায়?”

মহিলাটি রুশির দিকে ফিরলো, বয়সের ছাপ একদমি পড়ে নি তার চেহারায়। চেহারায় যেনো এখনো তারুণ্য খেলে যায়, যৌবনে তিনি খুব সুন্দর ছিলেন তা তাকে এই বয়সে দেখলেই বুঝা যায়।চশমা পরিহিত এই নারীটির মুখে বিরাজ করছে একরাশ গাম্ভীর্য! তবে এতে যেনো তার সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটাও নষ্ট হয়নি বরং বেড়ে গেছে। তিনি চশমাটা ঠিক করে সোফায় বেশ মার্জিত ভাবে বসলেন তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললেন

“তুমিই তাহলে সেই মেয়ে?নামকি তোমার?”

“জি রুশানি আনাম”

প্রথম প্রশ্নের জবাব রুশির জানা নেই, তিনি কোন মেয়ের কথা বলছেন সেটা ওর জানা নেই।ভদ্র মহিলা কি ইংগিত করছে তাই বুঝতে পারছেনা ও। তাকে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ছেনা ওর।কিন্তু আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না, যদি কিছু মনে করে?তাই চুপ থাকা শ্রেয়! সেই মহিলা কিছুটা শীতল কন্ঠে বলে উঠলো

“ডাকনাম কি তোমার?”

“আলাদা ডাকনাম নেই তবে বাবাই রুশি বলে ডাকে”

“তো রুশি! তুমি আমাকে চিনতে পেরেছো?”

“স্যরি আন্টি! আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারিনি। আগে কখনো আমাদের কথা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না”

মহিলার মুখ নিমিষেই গম্ভীর হয়ে গেলো, হয়তো রুশির বলা কথা উনি পছন্দ করেননি।পুর্বের ন্যায় গম্ভীর কন্ঠে বললো

“আমি সাবিনা জামিল খান!”

কথাটা শুনে রুশি কিছুটা অবাক হলো,নামটার বড্ড মিল…

“তুমি যা ভাবছো ঠিক তাই। তুমি যার সাথে তিনদিন পুর্বে বিয়ে করেছো অর্থাৎ সায়ান জামিল খান সম্পর্কে আমার ছেলে”

কথাটা শুনে রুশি চুপটি মেরে গেলো,সায়ান রুশিকে তার পরিবার সম্পর্কে কিছুই বলেনি আর না রুশি জানতে চেয়েছে। যেখানে সম্পর্কটাই মনের অবাধ্যে করা সেখানে এসব জেনে কি করবে ও? আর যাইহোক ওর মতো অনাথকে খান বাড়ির লোকেরা বউ হিসেবে কিছুতেই মেনে নিবেনা। কারণ বড় লোকদের কাছে মানুষের জীবন থেকেও স্ট্যাটাস এর মুল্য অনেক বেশি! এসব জীবনে নিজেকে না জড়ানোই ভালো। কিন্তু এই মহিলা কি করে জানলো ওদের বিয়ের কথা যেখানে অন্য কেউ জানেই না!

“হয়তো ভাবছো আমি কি করে জানলাম তোমাদের বিয়ের কথা! যাকে বিয়ে করেছো সে আমার ছেলে হয় আর তার প্রত্যেকটা খবর সবার আগে আমার কাছে যায়।আমি সবটাই জানি! এখন বলো তুমি ওকে কেনো বিয়ে করেছো টাকার জন্য!তাহলে বলো কতো টাকা দরকার তোমার? কতো টাকা হলে আমার ছেলের লাইফ থেকে চলে যাবা!”

কথাগুলো শুনে রুশি তেতে উঠলো, ওর আত্মসম্মানে তীব্র আঘাত করা হয়েছে তাই চুপ করে থাকার প্রশ্নই আসেনা। ও কখনোই কারো ব্যাংক ব্যালেন্স দেখে বিয়ে করেনি, করেছে নিজের সম্মান রক্ষার্থে আর অনাগত সন্তানকে বাবার ছায়ায় বড় করতে। কখনো যাতে ওকে শুনতে না হয় যে সে বাবা ছাড়া পৃথিবীতে এসেছে!রুশি যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে বললো

“আপনি আমার থেকে বড় তাই আপনাকে আমি সম্মান করি কিন্তু আমি আপনার ছেলের টাকা দেখে বিয়ে করিনি। যেহেতু বিয়ের খবর জানেন সেহেতু এটাও নিশ্চই জানেন যে আমাদের বিয়েটা কেনো হয়েছে! আমি এই ততোকথিত সমাজে নিজের সম্মান রক্ষার্থে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি কারণ আমার চরিত্রে কেউ আংগুল তুলুক তা আমি চাইনা। হ্যা আপনার ছেলে আমাকে বলেছে সে আমার পড়াশোনার খরচ উঠাবে আর আমি রাজি হয়েছি। হয়তো বলতে পারেন আমি তার কিছুটা ফায়দা উঠাচ্ছি কিন্তু আমি যদি চাকরি পাই তবে তার সম্পুর্ণ টাকা আমি ফেরত দিয়ে দিবো। বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা তবে সত্যি বলছি যদি অন্য কোন উপায় থাকতো তবে এমন দাম্পত্য জীবনে আমি ঘুণাক্ষরেও আমি জড়াতাম না”

রুশি একটানা কথাগুলো বলে একটু থামলো তারপর আবার বলে উঠলো

“হয়তো আমি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বিলং করি, আমার আপনাদের মতো টাকা নেই কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমার আত্মসম্মান! তাই আমাকে টাকার লোভ দেখিয়ে লাভ নেই। হ্যা আমি জানি আমি স্বার্থপর হয়ে নিজের কথা ভেবে আপনার ছেলের শর্তে রাজি হয়েছি তবে তার ঘাড়া সারাজীবন বোঝা হয়ে থাকার কথা আমি কোন কালেই ভাবিনি। আমি সময়মত আপনার ছেলেকে মুক্ত করে দিবো তবে এখন সেটা সম্ভব নয়, আমার কাছে এই মুহুর্তে যাওয়ার মতো কোন জায়গা নেই”

রুশি কথাগুলো বলে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো, ও জানেনা মহিলার মুখভঙ্গি এখন কিরুপ তবে তাই বলে চুপ করে থেকে অপমান সহ্য করার মেয়ে ও কখনোই ছিলো না। তাতে যে যাই ভাবুক না কেনো! হয়তো মহিলা এখন রাগ দেখিয়ে চলে যাবে কিন্তু তাতে ওর কিছুই যায় আসেনা।

“যদি আমি তোমাকে থাকার ব্যাবস্থা করে দেই আর পড়াশোনার খরচ চালাই তবে তুমি সায়ানকে ছেড়ে দিবে?”

“যদি আমি একা হতাম তবে ছেড়ে দিতাম কিন্তু আমার সাথে আমার সন্তানের জীবন জড়িত আর আমি চাই সে তার বাবার পরিচয় জানুক তার ভালোবাসা পাক”

কথাগুলো মনে মনে আওড়ালেও মুখে বললো না রুশি,যেখানে কোন অনুভুতিই নেই সেখানে থেকে কি লাভ। আর তিনবছর পর নিজের সন্তানকে সায়ানের কাছে দিয়ে চলে যাবে এটা ও ভাবতেই পারছেনা। তাই ও নাহয় একা নিজের সন্তানকে নিয়ে থাকলো। ওর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওর সন্তান আর কিছুই চাইনা। পেটে হাত রেখে রুশি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো তারপর সায়ানের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো

“হুম! যদি আপনি আমার জীবনের নিশ্চয়তা নেন তবে আমি রাজি। আমি আপনার ঋণ শোধ করে দিবো নাহয় পরে”

মিসেস খানের চেহারায় এখন আর গাম্ভীর্যের ছোঁয়া নেই বরং ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে। সামনে থাকা মেয়েটির দিকে তাকালেন উনি। মেয়েটি অনেক বেশি সুন্দর নয় তবে মুখ জুড়ে একরাশ মায়া বিরাজ করছে। উজ্জ্বল শ্যামল বর্ণের গোলগাল মুখখানা দেখে যে কেউ বলবে “আস্ত এক মায়াবিনী”

তিনি মৃদু কন্ঠে বলে উঠলেন

“কেনো জানিনা তোমার থেকে এমন জবাবই আশা করছিলাম। তুমি ঠিক বলেছো একজন নারীর নিকট সবচেয়ে মুল্যবান বিষয় তার আত্মসম্মান যেটা কখনো খোয়াতে নেই। আমার ছেলের পছন্দ আছে বলতে হবে!”

ভদ্রমহিলার হঠাৎ সুর পরিবর্তনে রুশি কিছুটা অস্বস্তিতে পড়লো। ও ভেবেছিলো মহিলা রেগে চলে যাবে কিন্তু মহিলা উল্টো মিষ্টি ভাষায় কথা বলছে!

“আমি অনেক খুশি হয়েছি যে তুমি আমার ছেলের বউ, আমার ছোট্ট সায়ানের অর্ধাঙ্গিনী। সত্যি বলতে তোমার মাঝে আমি নিজেকে দেখতে পাই, আমিও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বিলং করি তবে কখনো নিজের আত্মসম্মান হারাই নি। তাই তোমার শশুর যখন প্রস্তাব দিয়েছিলো সোজা নাকচ করে দিয়েছিলাম। পরে যখন বুঝতে পেরেছি সে আসলেই আমার প্রতি সিন্সিয়ার তখন পারিবারিক ভাবে আমাদের বিয়েটা হয়। সে যাইহোক তুমি আজ থেকে আমার বউমা না বরং আমার মেয়ে। আর আমার মেয়েকে আমি আমার কাছে নিয়ে রাখতে চাই তাতে তোমার কোন আপত্তি আছে?”

রুশি কিছু বলতে যাবে তার পুর্বেই দরজার কাছ থেকে চড়া গলায় একজন বলে উঠে

“তার আপত্তি আছে কিনা জানিনা তবে আমার ঘোর আপত্তি আছে”

রুশি তাকিয়ে দেখে সায়ান দাঁড়িয়ে আছে, পুরো মুখ জুড়ে একরাশ ক্লান্তি।মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি উঠেছে হয়তো অবহেলার ফসল!রুশি চোখ সরিয়ে নিলো সায়ান থেকে, কেনো যেনো ওই বাদামি চোখ জোড়ায় বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা হয়ে উঠে না ওর। মনে হয় ওই চোখের মায়ায় ডুবে যাবে ও, যা ও চায়না!

সায়ান গম্ভীর চেহারায় ঘরে ঢুকে সোফায় বসলো তারপর বলে উঠলো

“মিসেস খান আপনি এখানে কি করছেন?আর আপনি ওর সাথে কেনো দেখা করতে এসেছেন?”

“সায়ান! ভুলে যেওনা আমি তোমার মা। তুমি আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছো তা আমি নাহয় মেনে নিলাম কিন্তু তুমি ভাবলে কি করে আমি খান বাড়ির বউকে এখানে থাকতে দিবো?তাছাড়া ও এখন একা নয় ওর মাঝে খান বংশের বংশধর বেড়ে উঠছে!ওর পাশে এখন মানুষ দরকার”

“সেটা নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না, ওর খেয়াল রাখার জন্য মেইড আর কেয়ারটেকার আছে”

“তুমি আর কতোকাল এরুপ থাকবে সায়ান?তুমি আমার সাথে এমন ব্যাবহার করে যাবে আজীবন? তাও আবার চন্দ্রিকা! ওই সেই দুদিনের মেয়ের জন্য?”

“ওই দুদিনের মেয়েটাকেই আপনি মারতে চেয়েছিলেন মিসেস খান যেখানে জানতেন আমি তাকে বিয়ে করতে চাই”

“আমি কতোবার বলবো আমি তাকে মারতে চাইনি, শুধুমাত্র ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম”

“আমি হয়তো বিশ্বাস করে নিতাম কিন্তু নিজের চোখকে তো অবিশ্বাস করা যায়না মিসেস খান। আমি স্বচক্ষে সবকিছু দেখেছি!”

সায়ান অন্যদিকে ফিরে বললো, চেহারায় ক্রোধ স্পষ্ট! মিসেস খান আর কথা বাড়ালেন না। সোজাসাপ্টা ভাবে বললেন

“এখনো সেই মেয়ের পক্ষেই আছো তবে রুশিকে কেনো বিয়ে করেছো?এতোই যদি তাকে ভালোবাসো তবে আরেকজনকে কেনো জড়ালে নিজের সাথে?”

“সেটা আমার ব্যাপার,আপনার মাথা ঘামানোর দরকার নেই।আপনি এখন আসতে পারেন”

মিসেস খান ছেলের জেদের সামনে ঠিকতে পারলো না, তিনি উঠে দাঁড়ালেন তারপর পা বাড়ালেন যাওয়ার জন্য কিন্তু কি মনে পেছনে তাকিয়ে বললেন

“তোমার চন্দ্রিকা জানে তুমি বাবা হতে চলেছো তাও সেই মেয়ের সন্তানের যাকে তুমি বিয়ে করেছো তিনদিন পুর্বে। নাকি সবার মতো তাকেও জানাও নি!”

রুশি সায়ানের চোখে স্পষ্ট ভয় দেখতে পেলো যেনো কিছু হারিয়ে ফেলার ভয়। রুশির মাথায় শুধু একটা জিনিসই ঘুরপাক খাচ্ছে ‘কে ওই চন্দ্রিকা?’
তবে এটা সেই যার কাছে সায়ান ওয়াদাবদ্ধ!

সায়ান চড়া কন্ঠে বললো

“ইউ কান্ট ডু দিস! চন্দ্রিকে এই ব্যাপারে কিছু জানাবেন না।ও যাতে জানতে না পারে আমি বিয়ে করেছি”

মিসেস বিনিময়ে কিছু না বলে সামনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন!সেই হাসি যেনো অনেককিছু বলে দিচ্ছিলো!

#চলবে

গুমোট অনুভুতি পর্ব-৭+৮

0

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৭

রুশিদের ছোট্ট বসার ঘরটায় এখন মানুষে ভর্তি, কিছুক্ষণ পুর্বেও গুটিকয়েক মানুষ ব্যতীত কেউ ছিলো না কিন্তু এখন ঘর ভর্তি মানুষ কিছু বাইরেও দাঁড়িয়ে। আশেপাশের প্রতিবেশিরাও উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে ঠিক কি হচ্ছে এখানে।রুশি এই কালো পোশাকে থাকা একজনকেও চিনে না কিন্তু ধারণা করতে পারছে এরা কারো বডিগার্ড, প্রত্যকটা বডিগার্ড হাতে বিভিন্ন কিছু নিয়ে দাঁড়িয়ে যেমন শাড়ি, গয়না আরো কত কি!

রুশির পালক মায়ের চোখ যেনো কপালে, একসাথে এতোকিছু কখনোই দেখেনি সে। অতি খুশিতে তিনি পাথর হয়ে বসে আছেন। রুশির বাবাই ঠিক রুশির মতই সবকিছু বুঝার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। কিছুক্ষনের মাঝেই সকল বডিগার্ড সরে গিয়ে রাস্তা করে দিলো আর একজন সুদর্শন যুবক ধীর পায়ে হেটে আসলো ঘরে। চোখে সানগ্লাস, খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর ফর্মাল ড্রেস পরা সায়ানকে রুশির কাছে এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলে মনে হলো। মনে কোন চিত্রকরের আঁকা শ্রেষ্ঠ চিত্র এটি যার দিক থেকে দৃষ্টি সরানো অসম্ভব। রুশির সেই ঘোরলাগা দৃষ্টির সাথে সায়ানের বাদামি চোখ জোড়ার মিলন ঘটলো, বিনিময়ে সায়ান হাল্কা মুচকি হেসে রুশির ঠিক পাশের খালি স্থানে বসে পড়লো।

রুশি এখনো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে, ওর আজকে বিয়ে এটা সায়ান জানলো কি করে?আর এতোকিছু নিয়ে আসারই বা মানে কি?পরে মনে পড়লো সায়ান কালকেই বুঝিয়েছিলো,,

“সায়ান জামিল খান পারেনা এমন কিছু নেই”

কিন্তু সায়ান সে দিকে তাকিয়ে নেই। সায়ান তাকিয়ে আছে সামনে থাকা মাঝবয়সী লোকটির দিকে, ঠিক মাঝবয়সী না তবে আবার নওজোয়ানও না। বয়স আনুমানিক চল্লিশের কাছাকাছি যা দেখে সায়ান ভারি খুশি, সারা রাস্তায় ভেবে এসেছিলো যদি ছেলেটি ওর থেকে বেশি হ্যান্ডসাম হয় তবে কি ওই মেয়েটি বিয়ে করে ফেলবে? তাইতো এতো আয়োজন যাতে যদি সুন্দর দেখতেও হয় ওর টাকা দেখে মেয়ের বাবা ওর হাতে তাদের মেয়েকে তুলে দেয়। কিন্তু ছেলেকে দেখে বুঝলো ছেলে ওর কাছাকাছি নেই তাই আরাম করে সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসলো। বিজনেস ডিল হোক মেয়ে নেয়ার ডিল হোক, হি উইল নেভার লুজ!

সায়ানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে লোকটি দাঁত কেলিয়ে হাসলো, লোকটি সায়ানকে চিনতে পারেনি এটাই স্বাভাবিক কারণ সায়ান জামিল খান নামটা সবার মুখস্থ থাকলেও মুখ দেখে অনেকেই চিনে না। লোকটি কিছুটা ক্যাবলাকান্তের মতো বললো

“আপনি কি এদের আত্মীয় হন?আপনি মেয়ের কি হন?”

সায়ান ঠিক একই অবস্থায় থেকে গম্ভীর স্বরে বললো

“এর পুর্বে আমাকে এরা কখনো দেখে নি আর মেয়ের এখনো কিছু হইনা তবে…”

রুশির দিকে তাকিয়ে বললো

“ভবিষ্যতে হতে পারি”

লোকটির মাথার উপর দিয়ে সবটা গিয়েছে তা চেহারা দেখে বেশ বুঝা যাচ্ছে, কিছুটা হচকিত গলায় বললো

“মানে?তাহলে কি করতে এসেছেন আপনি এখানে?”

সায়ান প্রশ্নের জবাবে কিছুটা হাসলো তারপর পাল্টা প্রশ্ন করলো

“আপনি কেনো এসেছেন এখানে?”

“অবশ্যই মেয়ে দেখতে!”

সায়ান চেহারায় গ্রেট ইন্টারেস্ট ঝুলিয়ে বললো

“ওহ হোয়াট আ কো ইন্সিডেন্ট! আমিও মেয়ে দেখতে এসেছে, শুধু দেখতে আসিনি, বিয়ে করে সাথে করে নিয়ে যেতেও এসেছি”

লোকটি অবাক চোখে তাকিয়ে বললো

“মানে?কি বলতে চাইছেন আপনি?”

“যা বলেছি খুব সোজাসাপ্টা ভাবে বলেছি, বাঙালি হিসেবে বাংলা ভাষা বুঝা উচিৎ। যাইহোক, ইউ হ্যাভ টু অপশনস। ওয়ান, নিজে সম্মানের সহিত এখান থেকে বেরিয়ে যাবে আর টু,আমার বডিগার্ড আপনাকে উঠিয়ে নিয়ে বাইরে ফেলে রেখে আসবে।তাড়াতাড়ি একটা চুজ করুন, আমার এতো বেশি সময় নেই”

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো সায়ান, লোকটি কিছু বলতে গিয়েও বিশালদেহি বডিগার্ডদের দিকে তাকিয়ে বলার সাহস পেলো না তাই উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। যাওয়ার পুর্বে রুশির ফেমিলিকে আচ্ছামতো শাশিয়ে গেলো যে সে মানহানির মামলা করবে। কিন্তু তাতে কারো বিশেষ মনোযোগ নেই, সবার কৌতুহল সামনে থাকা সুদর্শন ব্যাক্তিটিকে নিয়ে। রুশির পালক বোন নিহা এই নিয়ে তিনবার মেকাপ চেক করেছে, যদি একটু এটেনশন পাওয়া যায়!

সবার মাঝে সবচেয়ে স্বস্তি নিয়ে বসে আছে রুশি ঠিক নিরব দর্শকের মতো। যেনো এখানে কি হচ্ছে তা নিয়ে কোন মাথা ব্যাথাই নেই তার। বসার রুমের এই কঠিন স্তব্ধতা ভেঙে রুশির বাবাই কথা বলে উঠলেন

“তুমি কে বাবা? তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না!”

“আমাকে আপনার চিনার কথাও নয় আংকেল,তবে আমি আপনাকে খুব ভালো করে চিনি। আপনি খুব ভালো মানুষ আংকেল দেখেই বুঝা যায় তবে কেনো নিজের ঊনিশ বছর বয়সী বাচ্চা মেয়েটিকে এমন একজন লোকের হাতে তুলে দিচ্ছিলেন?”

“তুমি যখন বিয়ের কোন এক পর্যায় আমার অবস্থানে আসবে তখন আমার পরিস্থিতি বুঝতে পারবে বাবা”

সায়ান আর কথা বাড়াতে চায়নি বরং সোজা কথা বলে দিলো

“আংকেল আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে এসেছি,আর সেটা আজ এখনি করে ওকে সাথে নিয়ে যেতে চাই। আমি চাইনা এই একইভাবে দ্বিতীয়বার কারো সামনে বসুক, আশাকরি আপনি বুঝতে পারছেন”

সায়ানের কথা শুনে নাহার বেগম মনে মনে বেশ রেগে গেলেন, যেখানে নিজের মেয়ের জন্য এমন রাজপুত্র আসলো না সেখানে এই অনাথ মেয়ে নাকি রাজরানি হবে! ক্ষোভের বসে বলেই ফেললো

“আমি আমাগো মাইয়ার বিয়া ওহন দিমু না”

“একটু আগেই তো দিচ্ছিলেন”

নাহার বেগম মুখ বাকিয়ে বললো

“দেখতে আইলেই তো বিয়া হইয়া যায় না, আমরা বড়জনরে রাইখা ছোট জনরে দিতাম নাহি?”

“তাহলে বড় জনকে রেখে ছোট জনকে কেনো সং সাজিয়ে বসিয়ে রেখেছেন? এনিওয়ে আমি আপনার সাথে তর্কে জড়াতে আসিনি। কতো টাকা হলে রুশানিকে আমার সাথে যেতে দিবেন?”

নাহার বেগম যেনো চোখে সরষে ফুল দেখছেন, টাকার কথা শুনতেই তার চেহারার রঙ পালটে গেলো। খুশিতে গদগদ হয়ে বললো

“দশ লাক দিলেই হইবো, আমার আবার এতো টাহার লোভ নাইকা”

সায়ান মহিলাটির দিকে তাকালেন, আর যাইহোক এই মহিলার মাঝে মাতৃত্ব বলতে কিছু নেই, সামান্য কটা টাকার বিনিময়ে মেয়েকে অন্যের কাছে তুলে দিলো। নিজের মেয়ে না হোক এতোগুলা বছর এই মেয়েটিকে বেড়ে উঠতে দেখেছে, একসাথে থাকতে দেখেছে অথচ কখনো আপন ভাবতে পারেনি। সায়ান দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বডিগার্ডকে ইশারা করে টাকা নিয়ে আসতে বললো। সায়ান বডিগার্ডের নিয়ে আসা স্যুটকেস দেখিয়ে বললো

“এতে পঞ্চাশ লাখ টাকা আছে, আশাকরি এতেই চলবে আপনার!ভবিষ্যতে রুশানিকে বিরক্ত করবেন না দয়া করে”

নাহার বেগম মুখ বাকিয়ে হাতে টাকার স্যুটকেসটা নিলো তারপর বললো

“এতোবছর যে আমরা টাকা খরচ করেছি তা কি মাত্র পঞ্চাশ লাখ নাকি?নিহাত আমার মন বড় তাই এর বেশি দাবি করিনি”

রুশির বাবা চড়া গলায় চিৎকার করে বললো

“নাহার! টাকাগুলো ফেরত দিয়ে দাও। রুশি আমার মেয়ে ওকে বিয়ে দেয়ার জন্য আমি টাকা নিবো এটা তুমি ভাবলে কি করে?”

“তোমার মেয়ে হতে পারে কিন্তু আমার নয়”

বলেই টাকাগুলো নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো সাথে নিহাও। রুশির বাবা অসহায় দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছেন। বউকে খুব বেশিই ভালোবাসতেন তিনি তাই তার সকল অন্যায় আবদার মেনে নিতেন কিন্তু পরে বুঝতে পারেন উনি দুধকলা দিয়ে সাপ পুষেছেন, তবে ততদিনে তার গলার জোর এই ঘরে কমে গিয়েছে!
উনি সায়ানের দিকে তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ বউয়ের আচরণের জন্য ক্ষমা চাইলেন তারপর সায়ান আর রুশির বিয়ের সাক্ষী হিসেবে তিনি ছিলেন। আপাদত রেজিট্রির মাধ্যমে বিয়েটা হয়েছে,হুজুর ডেকে পরে বিয়ে করে নিবে বলে সায়ান কথা দিয়েছে। রুশি পুরোটা সময় চুপ ছিলো একটা কথাও বলেনি, হয়তো বলার মতো কিছুই নেই।

একে একে সবাই যখন ঘর ছাড়ছিলো তখন রুশি ওর পালক বাবাকে জড়িয়ে ধরলো, আর ধরে আসা কন্ঠে বললো

“তোমাকে খুব মিস করবো বাবাই! ভালো থেকো, বেচে থাকলে আবার দেখে হবে ”

বলেই ছেড়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো, রুশির বাবার খুব বলতে ইচ্ছে করেছিলো

“ধুর পাগলি, এমন কথা কেউ বলে নাকি!তুই চাইলেই আমি দেখা করে আসবো তোর সাথে”

কিন্তু বলা হয়নি, শব্দগুলো কেমন যেনো গলায় দলা পাকিয়ে গিয়েছে। চোখে টলমল জল নিয়ে রুশির যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার ছোট্ট রুশি যে কিনা প্রতিদিন সকালে হঠাৎ করে এসে জড়িয়ে ধরে বলতো “বাবাই কেমন আছো?” কাল সকাল থেকে নিজে হাতে কেউ আর চা বানিয়ে খাওয়াবে না আর বকার স্বরে বলবেও না

“বাবাই তুমি তোমার ঔষুধ খেয়েছো? নিশ্চই খাওনি! এতো ভুলে যাও কেনো তুমি?এই নাও খাও। আমি যদি না থাকি তবে এই রোজরোজ তোমাকে ঔষুধের মনে করিয়ে দিবে কে শুনি?বড্ড অবুঝ তুমি”

উনি কাঁপা পায়ে এগিয়ে গিয়ে সায়ানের হাত চেপে ধরলেন আর ধরা গলায় বললেন

“আমার মেয়েটা বড্ড কষ্টে এতোগুলা বছর পার করেছে ওকে কখনো কষ্ট দিওনা। খুব ভরসা করে তোমার হাতে তুলে দিয়েছি, আমাকে নিরাশ করো না। খেয়াল রেখো ওর”

সায়ান তার হাত চেপে ধরে আশ্বাস দিয়ে বললো

“আপনি চিন্তা করবেন না আমি সবসময় ওর পাশে থাকবো, ওর খেয়াল রাখবো। জরুরি নয় স্বামী হিসেবেই পাশে থাকতে হবে বরং বন্ধু হিসেবেও পাশে থাকা যায়!”

পরের কথাগুলো সায়ান মনে মনে আওড়ালো, আর যাইহোক এই মেয়েটিকে ও কষ্ট পেতে দিবে না। ও যাতে সমাজে মাথা উঁচু করে বাচতে পারে সেটার জন্য ও সবকিছু করবে। স্বামী হিসেবে না হোক বন্ধু হিসেবে হলেও করবে!

রুশি গাড়িতে চুপচাপ বসে আছে, সায়ান গাড়িতে চড়তেই গাড়ি নিজ গন্তব্যে চলা শুরু করলো। সায়ান রুশির দিকে তাকিয়ে গলা ঝেড়ে বললো

“মন খারাপ?”

রুশি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো

“আমার আর মন খারাপ!সেটাও সম্ভব নাকি?বরং আমার তো খুশি হওয়ার কথা। আমাকে কেউ পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে আর আরেকজন বিক্রি করে দিয়েছে। আমার জীবনের মুল্য পঞ্চাশ লাখ টাকা!এও বা কম কিসে?আমার তো খুশিতে ধেইধেই করে নাচতে ইচ্ছে হচ্ছে। আই এম সো হ্যাপি রাইট নাউ”

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_ ৮

বাংলার মধ্যাঞ্চলের ঢাকা বিভাগের প্রশাসনিক জেলা গাজীপুর,প্রাচীন যুগে এটি ঘন বনাঞ্চলে আবৃত ছিলো যার কিছু নিদর্শন বর্তমানেও দেখা যায়। চারদিকে সারি সারি গাছপালা,কিছু কিছু পুকুর,সকাল হলেই পাখির কিচিমিচির আওয়াজ! নগর জীবন থেকে একটু দূরে একটা শান্তির আবাস বলা চলে।

এখানে এখনো অনেক টিনের ঘর দেখা যায় সাথে কিছু দরিদ্র মানুষের আর্তনাদ। সমাজের উপস্তরের এবং নিম্নস্তরের মানুষগুলো একসাথে বাস করে এখানে। দেখা যায় পাশে কতোগুলো হাই প্রোফাইল বিল্ডিং এর পাশেই দোচালা টিনের ঘর যেন মাঝখানে একটা লাইন টেনে দেয়া হয়েছে হতদ্ররিদ্র আর সমাজের ততোকথিত উচ্চজাতের মানুষের মাঝে!যে লাইনটা ঠিক পাশাপাশি হলেও তাদের মধ্যকার দুরত্ব বিশাল। যেখানে কেউ হয়তো কেউ খেতে পায়না অথচ তার পাশেই ধনীদের বাস্কেট ভর্তি খাবারে ডাস্টবিন পুরে টইটুম্বুর!

এ অঞ্চলের এই বিস্তর ফারাকগুলো রুশির মন বড্ড নাড়া দিয়ে গেলো, জানালার কাচের বাইরে সারি সারি গাছপালার মোহনীয় দৃশ্যের সাথে সমাজের করুণ বাস্তবতা ওর চোখ এড়ায়নি।দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো রুশি,গাড়িতে ও সায়ান পাশাপাশি বসে আছে মাঝে সামান্য ফাঁকা জায়গা। তবে মনের দুরত্ব আকাশ সমান হয়তো যোগ্যতারও! কারণ এপারের নিচুজাতের মানুষগুলোর মধ্যে ও একজন, তাই ওপারের মানুষের সাথে যতই দিন পান করুক তাদের একজন হওয়া সম্ভব নয়। কারণ কাক যতই ময়ুর সাজুক, তার কখনোই ময়ুর হয়ে উঠা হয় না।

তাই রুশি যতই চেষ্টা সায়ানের মন অবদি পৌঁছানো সম্ভব নয়। নিজেকে পাতালপুরীর কোন কুৎসিত রাজকন্যা মনে হচ্ছে যার আকাশের ওই চাঁদ ধরার স্বপ্ন! কিন্তু চাঁদ এমন একটা সুদর্শন বস্তু যা রোজ দেখা যায়, তাকে নিয়ে হাজারো কাব্য, কলি আর রুপকথার গল্প সাজানো যায় কিন্তু সেটা ছোঁয়ার ক্ষমতা কারোই থাকে না,ওরো নেই!

কিন্তু মনের কোথাও একটা খুব মনোবল দিয়ে কেউ একজন বলছে পাশে বসে থাকা স্বল্প দুরত্বের মানুষটি ওর যাকে রেজিট্রির মাধ্যমে নিজের নামে লিখে নিয়েছে, সম্পুর্ণ তার নামে। এমন অদ্ভুত ভাবনা মাথায় চাপতেই রুশি চোখ বন্ধ করে ফেললো, গাড়ির কাচ কিছুটা নামানো থাকায় অবাধ্য চুলগুলো মুখের উপর ঝাপটে পড়ছে। রুশি অলস ভংগিতে ভ্রু কুচকে মাথা নেড়ে সেগুলো সরানোর ব্যার্থ চেষ্টা করছে। মাথার ঘোমটা সেই কবেই পড়ে গিয়েছে তার খেয়াল নেই তার।

লম্বা দীঘল চুলের সাথে রুশির খুনসুটি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে সায়ান, মেয়েটির মুখে মেকাপের লেশমাত্র নেই বললে চলে। হরিণির ন্যায় টানা চোখদুটিতে বেখেয়ালি ভাবে দেয়া কাজল লেপ্টে আছে, সাথে ঠোঁটের নিচের সেই তিল!সদ্য যৌবনে পদার্পণ করা এক আঠারো পেরিয়ে যাওয়া বাঙালি নারী, যেনো সদ্য ফোটা কোন গোলাপ যাতে শিশির বিন্দু জমে আছে! এই নারীকে ঘিরেই যেন হাজারো কবির লিখা কবিতা,লেখকের লেখা উপন্যাস আর চিত্রকরের হাতের চিত্রশিল্প! যেনো জীবন্ত কোন শ্যামল বর্ণের অপরুপা,,,

সায়ানের খুব ভয়ংকর একটা ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহুর্তে, নিজের হাতে অবাধ্য চুলগুলো গুজে দেয়ার। হাত বাড়িয়ে রুশির অবদি নিয়ে গিয়েও ফিরিয়ে আনলো। কি করতে যাচ্ছিলো ও?চন্দ্রিকাকেও এমন গভীর ভাবে কখনো দেখেনি ও আর না কখনো ইচ্ছে জেগেছে তার দিকে তাকিয়ে থাকার! তবে কেনো এই মেয়ের মেয়ের দিকে তাকালে মনে হয় যুগ যুগ তাকিয়ে থাকলেও চোখের তৃষ্ণা মিটবে না! তবে কি ও মেয়েটিকে দেখে এট্রাকটেড হচ্ছে?নিজেকে জঘন্য পুরুষের কাতারে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে, তবে কি এক সাথে দুটো মেয়েকে ব্যবহার করছে?

নিজের দৃষ্টিতে সংযত করে বাইরে তাকালো, রুশির মুখের দিকে আরো একবার তাকানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগলেও সেদিকে আর তাকালো না। কোন একজনের কাছে ওয়াদাবদ্ধ ও, আর যাইহোক সেই ওয়াদার বরখেলাপ ও কখনোই করবে না। নিজেকে কয়েকদফা শাশিয়ে চুপটি মেরে বসে রইলো। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো

“একটা মেয়ে এতো সুন্দর কি করে হতে পারে?হাউ?মাথাই পুরো বিগড়ে দিবে আমার!মেয়েটি কি আসলেই সুন্দর নাকি আজ কালো শাড়ি পরেছে বলে সুন্দর লাগছে! আচ্ছা লাল শাড়িতে কেমন লাগতো তাকে?ঠিক এতোটাই সুন্দর নাকি তার থেকেও বেশি!”

নিজের উদ্ভট চিন্তায় নিজেই যেনো বোকা বনে গেলো সায়ান। ও এতো কেনো ভাবছে মেয়েটাকে নিয়ে?তবে কি মেয়েটির উপর বড়োশড় ক্রাশ খেয়েছে ও? কথাটা ভাবতেই হালকা কেশে উঠলো সায়ান। নিজের কলার ঠিক করতে করতে নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বিড়বিড় করে বললো

“সেটা কি করে সম্ভব? সায়ান জামিল খান কারো উপর ক্রাশ খাবে! ইম্পসিবল”

রুশি সায়ানের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে, কিছুক্ষণ পুর্বে চোখ বুঝে থেকে মৃদু আওয়াজ শুনতে পেলো। পাশে তাকাতেই দেখে সায়ান কিছু একটা বলছে আবার নিজেকেই যেনো বুঝাচ্ছে! কিন্তু তা স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে না। এই ভর দুপুরে লোকটিকে জিনে ধরলো নাতো??

রুশি হাল্কা স্বরে বলে উঠলো

“আপনি কি কিছু বলছেন?”

সায়ান চমকে উঠে ধরা খাওয়ার মতো মুখভঙ্গি করে বললো

“কই না্ নাতো! আপনি ভুল শুনেছেন”

“নাহ দেখলাম ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু একটা বলছেন,তাই ভাবলাম আমাকে কিছু বলেছিলেন কিনা!”

“নাহ নাহ তেমন কিছু না।এনিওয়ে আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে, নাহ অনেক না একটু সুন্দর লাগছে। আই মিন শাড়ি পড়লে সকল নারীকেই সুন্দর লাগে”

বলেই ভ্রু চুলকিয়ে বাইরে তাকিয়ে গেলো যেনো কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। কান দুটো লাল হয়ে আছে,হয়তো লজ্জা পাচ্ছে! রুশি মুচকি হাসলো, হয়তো সচারাচর কারো প্রশংসা করার অভ্যস নেই তার তাই অস্বস্তিতে পড়েছে। রুশি গলা খাঁকারি দিয়ে বললো

“ধন্যবাদ”

এই ছোট্ট শব্দটি যেনো সায়ানের হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিলো,পাশে ফিরে রুশির মুখটা প্রবল ইচ্ছে দমিয়ে রাখলো। আচ্ছা মেয়েটি কি লাজুক হেসে আচলে মুখ ঢেকে রেখেছে!এদিকে রুশির মনটা যেনো নিমিষেই ভালো হয়ে গেলো, এতো এতো খারাপ লাগার মাঝে এই সামান্য ভালো লাগার অনুভুতিকে প্রাধান্য দিতে ইচ্ছে করছে। সরাসরি ওকে আজ পর্যন্ত কেউ বলেনি যে ও সুন্দর তাই এই মুহুর্তে খুব আনন্দ লাগছে ওর, যেনো চারপাশে ফুলের পাপড়ি উড়ে বেড়াচ্ছে, গিটারের সুর তুলে কেউ মৃদু স্বরে গাইছে

“তুমসে মিলনা, বাতে কারনা
বাড়া আচ্ছা লাগতাহে”

জীবন কোথা থেকে কোথায় চলে যায় কেউ বলতে পারে না, হয়তো পরের মুহুর্তে জীবনের শেষ প্রহর গুনতে হতে পারে বা কোন এক ঝড় এসে সবটা ছারখার করে দিবে। কিন্তু এই মুহুর্তটা সম্পুর্ণ বাচঁতে ইচ্ছে করছে, প্রতিটা অনুভুতির সমারোহ ঘটিয়ে নিজের মনের খাচায় বন্ধি করে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে। কেয়া পাতা কাল হো না হো!
_____________________

খান বাড়িতে এই মুহুর্তে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে, যেনো জাঁকজমক পুর্ণ বাড়িটি মুহুর্তেই মৃত্য পুরিতে পরিণত হয়েছে। আজ প্রায় দুদিন ধরে সামু নিজেকে ঘর বন্দি করে রেখেছে। মিসেস খান বিজনেস ট্যুরে দেশের বাইরে ছিলেন কিন্তু মেয়ের অবস্থা শুনে সাথেসাথেই দেশে ফিরে এসেছেন। অনেক চেষ্টা করেও সায়ানের সাথে কন্টাক্ট করতে পারেননি তিনি, ফোন বেজে বেজে ক্ষান্ত হয়ে গেলেও ওপাশ থেকে থেকে কেউ ফোন তুলে নি, আর তিনি হয়তো আশাও করেননা যে সায়ান ফোন তুলবে। যে ছেলে তার কথা ব্যতীত একপাও এদিক সেদিক হতো না সে আজ এতোদিন হয়ে যাওয়ার পরেও মায়ের খোজ নেয় না,ফোন করে বলে না

“মাম্মা কেমন আছো তুমি?”

কারণ তার কাছে সে মাম্মা নয় বরং মিসেস সাবিনা জামিল খান।তার ছোট্ট সায়ান সত্যিই বড় হয়ে গেছে, মাকে ছাড়া চলতে শিখে গেছে। তিনি দ্রুত হাতে ইনানকে ফোন দিলেন, এই মুহুর্তে এই নামটি ব্যতীত কারো কথা মাথায় আসেনি। একটা রিং হয়ে কেটে গিয়ে দ্বিতীয়বারের সময় ফোন তুললো ইনান। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো

“হেলো আন্টি! কেমন আছেন? এতো রাতে হঠাৎ!”

“ইনান! তুমি একটু আমাদের বাসায় আসবে?”

“এতো রাতে?কিছু হয়েছি কি?”

“সামু আজ দুদিন ধরে দরজা খুলছে না, ভিতর থেকে সাড়া শব্দও পাচ্ছিনা। সায়ানকে ফোন করেছি কিন্তু ধরেনি তাই বাধ্য হয়ে তোমায় ফোন করলাম। তোমার কথাতো সামু খুব মানে, একটু কষ্ট করে আসবে?”

ইনান এতোক্ষন ঘুমের জড়ানো কন্ঠে কথা বললেও এবার ওর ঘুম পুরো ছুটে গেলো। দ্রুত উঠে বসলো

“আন্টি আমি আসছি, আপনি চিন্তা করবেন না”

ইনান দ্রুত বেরিয়ে পড়লো, সামায়রাকে ও হারে হারে চিনে। প্রচণ্ড জেদি আর এক ঘেয়ো টাইপ মেয়ে। ওর যা চাই তা ওকে পেতেই হবে আর না পেলে নিজের ক্ষতি করতে একবারো ভাবে না। ইনান রিতীমত ঘামছে, যদি এবারো উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেলে?ওর কিছু হলে ইনান নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না, কক্ষনো না!

“সামু! ফর গড সেক ডোন্ট ডু এনিথিং রাবিশ।”

#চলবে

গুমোট অনুভুতি পর্ব-৫+৬

0

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৫

হৃদয় সিঁথির লাল সিঁদুরে অসমাপ্ত প্রেমকাব্য, চোখের দু ফোঁটা অশ্রু মিশ্রিত কাজল করে
রেখে দিলাম আমি হীনা তোমার ডায়েরির শেষ পাতায়…
(সংগ্রহীত)

লাইনগুলো মনে মনে আওড়াচ্ছে রুশি, ঠোঁটের কোনে একরাশ তাচ্ছিল্যের হাসি।কিচ্ছুক্ষণ পুর্বেই সায়ানের অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছে,কথা ঠিক হয়েছে সায়ান তাদের বাড়ি গিয়ে রুশির হাত চাইবে ওর বাবার কাছে তারপর ঘরোয়া ভাবে বিয়ে সম্পন্ন হবে। রুশি তাতে সম্মতি দিয়েছে। আসার সময় সায়ান নিজের ড্রাইভারকে দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার কথা বললেও রুশি না করে দিয়ে সোজা চলে এসেছে। মাত্র তিনবছরের সম্পর্কে এতো মায়া বাড়িয়ে কি লাভ! এই মায়া জিনিসটা বড্ড খারাপ। কারো মায়ায় একবার জড়িয়ে গেলে আর সেখান থেকে বেরুনো যায়না। তাইতো এতোগুলো দিন চলে যাওয়ার পরেও তাকে ভুলতে পারেনি। কিন্তু এটাও সত্যি যে তার ডায়রির পাতায় আর ওর বিচরণ নেই। না সেই মানুষটিকে ও ভালো বাসে নি আর না প্রেমে পড়েছে, শুধুমাত্র তার মায়া জড়িয়েছে, ভয়ংকরভাবে!

ও জানেনা জীবন কোন দিকে মোড় নিচ্ছে, কি হতে চলেছে কিছুই জানেনা। শুধু এতোটুকু আশা করতে পারে যে ওর সন্তান ওর মতো পরিস্থিতিতে পড়বে না। আর যাই বেঁচে থাকতে তার উপর একটুও আচড়ও আসতে দিবে না। সায়ান যেহেতু বলেছে ওর কেরিয়ার গড়ে দিবে তাই আর ওকে এটলিস্ট কারো পুশওভার হয়ে থাকতে হবে না!

রিক্সা এসে ওদের কলোনিতে থামতেই ও ভাড়া মিটিয়ে হাটা শুরু করলো বাসার দিকে।ঘড়িতে রাত প্রায় আটটা বাজে, আজকে ঘরে ঢুকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সাথে পুরোনো সেই কথাগুলো! নিজেকে প্রস্তুত করেই ঘরে প্রবেশ করলো রুশি। আশায় ছিলো কিছু একটা ছুড়ে মারবে গায়ের উপর কিন্তু তেমন কিছুই হলো বরং পরিস্থিতি বড্ড শীতল। ওর বাবাই সোফায় চিন্তিত ভংগিতে বসে আছে, আর পালক মা বসে পান চিবুচ্ছে। পালক ভাই-বোন দুজনই উপস্থিত হয়তো ওকে কিছু একটা বলবে বলেই বসে আছে!

পালক মা পানের ফিকনি ফেলে ওর দিকে তাকালেন তারপর তামাটে দাঁতে হেসে বলে উঠলেন

“সেকি মা তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? এদিকে এসে বসো”

তার এরুপ তেল মিশ্রিত কথার সাথে কখনোই পরিচিত নয় রুশি তাই কিছুটা হচকিয়ে বলে উঠলো

“কোন কিছু কি দরকার?মানে কিছু করা লাগলে বলতে পারেন”

“নাহ তেমন কিছু নয় আসলে তোর জন্য একটা প্রস্তাব এসেছে তাই ভাবলাম তোর বিয়ের বয়স হয়েছে বসিয়ে রেখে তো লাভ নেই। সবাইকেই বিয়ে করতে হবে তাইনা?যতো তাড়াতাড়ি করবি তত সামলে নিতে পারবি”

রুশি এবার আসল কাহিনী বুঝতে পারলো,

“কিন্তু আম্মু নিহা আপু তো আমার থেকে বড় তাহলে তো তার আগে বিয়ে হওয়া উচিৎ। আমার মনে এই বিয়েটা নিহা আপু করলেই ভালো হবে”

“সেকি বলিস নিহা করবে মানে?”

উনি চেঁচিয়েয় কথাটা বলে উঠলেন তারপর কিছুটা সামলে বললেন

“নিহাতো এখনো পড়াশুনা করছে ও এখন বিয়ে করে কি করবে?”

“আমিও তো পড়াশুনা করছি আম্মু!তাছাড়া আমার আগে বিয়ে হয়ে গেলে নিহা আপির সমস্যা হবে। তুমি বরং নিহা আপিকে বিয়েটা করতে বলো।আমি এখন বিয়ে করতে চাইনা”

কথাটা শুনেই নাহার বেগম যেনো তেলে বেগুনে জলে উঠলো

“আমার মেয়ে কোন দুঃখে ওই পঁয়ত্রিশ বছরের বুড়োকে বিয়ে করবে?ওকে জেনে শুনে আমি সেখানে দিবো নাকি?”

রুশির বাবাই তখন কিছুটা শক্ত কন্ঠে বললেন

“তাহলে রুশিকে কেনো দিবে,রুশি কি তোমার মেয়ে নয়?”

“শোন ও তোমার মেয়ে হতে পারে কিন্তু আমার নয়। এই আপদ আর কতকাল ঘাড়ে রাখবো?আর ভাসিয়ে তো দিচ্ছিনা বরং সসম্মানে বিয়ে দিচ্ছি। আর তুমি শুনো এই যে এতোকাল আমার খেয়েছো পরেছো তাই আমাদের এই ঋণ পরিশোধের কথা ভেবেও তুমি বিয়েটা করে নাও বুঝেছো!আর আমার শেষ কথা বিয়েটা হচ্ছে”

শেষের কথাটা স্বামীকে শুনিয়ে কিছুটা জোরেই বললেন,এই পালক মেয়ের প্রতি তার স্বামীর আদিক্ষেতা কোন কালেই সহ্য হয়না তার। সেই তেরো বছর পুর্বে একটা আশ্রম থেকে মেয়েটিকে নিয়ে চলে এসেছিলো তার স্বামী। কেন এনেছে জিজ্ঞেস করতেই বলে

“আশ্রমে সমস্যা হয়েছে, বিশাল আগুনে ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে তাই সব বাচ্চাদের বিভিন্ন ফেমিলিতে দিয়ে দিচ্ছে। এই মেয়েটিকে দেখে খুব মায়া হয়েছে ওর তাই নিয়ে এসেছে। ওরা যেভাবে থাকে মেয়েটিও নাহয় সেভাবে থাকবে”

কিন্তু এই সহজ কথাই হজম হলোনা তার,নিজের ছেলে মেয়েকে চালাতেই হিমশিম খায় তারউপর নতুন আরেকজন জুটেছে তবে সেটা মুখে প্রকাশ করেনি। নিজের কাজে সাহায্য করার একজনের দরকার ছিলো তাই আর আপত্তি করেনি। কিন্তু সমস্যা তখন থেকে শুরু হয়েছে যখন থেকে আশেপাশের মানুষ এইটুকুন মেয়ের রুপের আর গুনের প্রশংসা শুরু করলো। আর এখনতো ভালো ভালো ঘর থেকে প্রস্তাব আসে এই মেয়ের যা দেখে নাহারের পিত্তি জলে উঠে। নিজের মেয়ের বিয়ে নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত তিনি তাইতো আগেই একে বিদায় করতে চায়। ছেলের বয়স একটু বেশি হলে কি হবে?ছেলে সরকারি চাকরি করে ওখানে গেলে এই মেয়েতো সুখেই থাকবে। আর যাইহোক গাংগে ভাসিয়ে দিচ্ছেনা তো!

নাহার বেগমের চোখের ভাষা হয়তো রুশি কিছুটা বুঝতে পেরেছে তাই কিছু না বলে রুমে চলে গেলো। এখানে দাঁড়িয়ে আরো কিছু কথা শুনার ইচ্ছে নেই। আর তাছাড়া নিহাল মানে ওর পালক ভাইয়ের চাহনি সহ্য হচ্ছে না ওর। এই লোকটিকে ও একমুহুর্তও সহ্য করতে পারে না, সম্পর্কে নিজের বোন হয় এমন মেয়ের এরুপ আচরণ?পালক হোক আর যাই হোক বোনতো বোনই হয় তাইনা!

_______________________

সায়ান সবে মাত্র অফিস থেকে ফিরেছে, টাইটা খুলে সোফায় চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলো। হঠাৎ কেয়ারটেকার এসে বললো

“স্যার চন্দ্রিকা মেডাম এসেছে!আপনার জন্য ওয়েট করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে”

সায়ান হুট করে চোখ খুলে ফেললো, মনের ভেতর অজানা ভয় খেলে গেলো, তাহলে কি ও কিছু জেনে গেছে?কিন্তু সেটাতো সম্ভব নয়। সায়ান দ্রুত পায়ে রুমের দিকে এগুলো আর বিছানায় একজন নারীকে শুয়ে থাকতে দেখলো, বয়স আনুমানিক বিশ বছরের কাছাকাছি। চেহারায় অসম্ভব মায়া আর টানা টানা সেই চোখ দুটো যে কাউকে প্রেমে পড়তে বাধ্য করবে। এই মেয়েটাকে সায়ান ভালোবাসে যে কিনা একসময় ওর জীবন বাচিয়েছে, আজ ও না থাকলে হয়তো ও বেচে থাকতো আর সায়ান জামিল খান হতো না।তাইতো তার কাছে ও ওয়াদাবদ্ধ! সারাজীবন ভালোবাসার ওয়াদাবদ্ধ যে স্থান অন্যকাউকে দিবে না বলে প্রমিস করেছিলো কোন এক কালে। তাইতো রুশানি নামের মেয়েটিকে মেনে নেয়া সম্ভব নয়, নয়তো আর যাইহোক মেয়েটিকে ছেড়ে দিতো না কখনোই।

সায়ান দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বারান্দায় গিয়ে বসলো, ওর সাথে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। একসাথে দুটো মেয়ের জীবন নিয়ে খেলছে ও। একজনকে ও ভালোবাসে আর অন্যজন ওর বাচ্চার মা হতে চলেছে। আর দুইজনকেই ঠকাচ্ছে ও কিন্তু কাউকেই ফেলতে পারছেনা। সায়ান মাথার চুল টেনে ধরলো শক্ত করে,অপরাধবোধ ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।বারবার ভয় হচ্ছে যদি চন্দ্রি কখনো জানতে পারে আমি ওর অজান্তে এতোবড় অপরাধ করে ফেলেছি ওকি আমার ক্ষমা করবে?হয়তো করবে না কারণ কোন নারীই তার সবচেয়ে মুল্যবান মানুষকে কারো সাথে শেয়ার করতে পারে না সেখানে চন্দ্রি কি করে করবে??আর ওই মেয়েটা! ওরও তো কোন দোষ নেই, ওর জন্য শুধুমাত্র ওর জন্য ওই মেয়েটার জীবন আজ এই মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে!

ফোনের আওয়াজে ধ্যান ভাঙল সায়ানের, রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে সাহিল বলে উঠলো

“বস! ওই মেয়েটাকে কাল দেখতে আসবে।আজ বিকালে মেয়েটির পালক এটা নিয়েই প্রতিবেশির সাথে আলোচনা করেছেন।আর সম্ভবত কালই কাবিন হয়ে যেতে পারে। কি করবেন এখন?”

“তুমি সবকিছু রেডি করো, আমরা কাল ছেলেপক্ষ যাওয়ার আগে সেখানে যাবো আর যে করেই হোক ওকে বিয়ে করে একবারে নিয়ে আসবো।আর যাইহোক হাত গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না”

সায়ান ফোন রেখে দিলো,ওই মেয়েটিকে যা প্রমিস করেছে তার সবকটা পুরণ করবে ও। তখনি মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসে

“কার বিয়ের কথা বলছো সায়ান?”

পেছনে চন্দ্রিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সায়ান দাঁড়িয়ে গেলো, তবে কি সব শুনে ফেলেছে?এখন কি করবে ও!

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৬

গুলশান লেকের পানিগুলো লাইটের আলোতে চিকচিক করছে, আশেপাশে জনমানবের কোন চিহ্ন নেই।কিন্তু দূর থেকে গানের মৃদু আওয়াজ আসছে, গুলশান লেকের পাশেই “নরডিক নাইট ক্লাব”।খুব সুন্দর পরিবেশ তাতে, ডান্স ফ্লোর, পুল পার্টি, স্পোর্ট চেলেঞ্জ, লাইব্রেরি সবমিলিয়ে পরিদর্শকদের জন্য আনন্দের জায়গা।

ক্লাবের সেকেন্ড ফ্লোরে বসে সায়ান, কিছুক্ষণ পুর্বেই এখানে এসেছে বলতে এক প্রকার পালিয়ে এসেছে। কতক্ষণ পুর্বে যখন চন্দ্রিকা প্রশ্ন করেছিলো বিয়ে সম্পর্কে তখন ও কি বলবে খুজে পাচ্ছিলো, কোনরকম আমতা আমতা করে বললো

“সাহিলের জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছি, যদি পছন্দ হয় তবে বিয়ে করিয়ে নিয়ে আসবো”

সম্পুর্ণ কথা নিচের দিকে তাকিয়ে বলেছে সায়ান, আর যাইহোক চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলার সাহস ওর হয়ে উঠেনি আর না সত্য বলার সাহস।সবমিলিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাঝে সাহিলের নাম বলে দিলো।কথাটা শেষ করে চন্দ্রিকার দিকে তাকালো, সায়ানের কথা বিশ্বাস হয়েছে কিনা চেহারা দেখে ঠিক বোধগম্য হলো না। আচমকাই চন্দ্রিকা সায়ানকে জড়িয়ে ধরলো যাতে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে সায়ান, আর যাইহোক চন্দ্রিকে কখনো জড়িয়ে ধরেনি ও। সবসময় একটা দুরত্ব বজায় ছিলো দুজনার মাঝে, সায়ান চন্দ্রিকে খুব রেসপেক্ট করে তাই চন্দ্রি বেপরোয়া ভাবে ওর কাছাকাছি থাকলেও কখনো চোখ তুলে তাকানো হয়নি। এমনকি এই বাড়িতে তার জন্য আলাদা একটা কামরাও বিদ্যমান রয়েছে। একদিন চন্দ্রি প্রশ্নও করেছিলো

“আমি নিজ থেকে তোমার কাছে আসতে চাই তবে দূরে সরিয়ে দাও কেনো আমায়?তবে কি আমায় ভালোবাসো না!”

চন্দ্রির কথায় সায়ান কিছুটা হচকিয়ে গিয়েছিলো তারপর শান্ত স্বরে বললো

“আমার জীবন বাঁচানোর জন্য আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ আর তোমাকে সারাজীবন ভালোবাসার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ভালোবাসার সংজ্ঞা আমার জানা নেই তবে এতোটুকু জানি তোমায় ছেড়ে যাবো না কোনদিন”

কিন্তু তার জবাবে চন্দ্রি খুব একটা খুশি হয়নি কারণ তার যে ভালোবাসার মানুষ চাই, সারাজীবন সাথে থাকার চুক্তি নয়। তার পর থেকে মন থেকে বলেছে না শুনানোর জন্য তা জানা নেই তবে নিয়ম করে একবার বলেছে “ভালোবাসি”
তাতেই চন্দ্রি বড্ড খুশি ছিলো আর এই মেয়েটির খুশির জন্য সায়ান সবকিছু করতে পারে সব!

চন্দ্রিকা সায়ানকে জড়িয়ে ধরে থাকা অবস্থায় ফোন ফোন বেজে উঠে সায়ানের, সেই সুযোগে ও আলতো করে চন্দ্রিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ফোন রিসিভ করলো। ওর বেস্টফ্রেন্ড ইনান ফোন করেছে, ওদের নির্ধারিত ক্লাবে যেতে বলেছে। তাই সায়ান ‘আসছি’ বলে বেরিয়ে যেতে নিলেই চন্দ্রি ওর হাত চেপে ধরে আর বলে

“আমি তোমাকে খুব ভরসা করি সায়ান, আশা করি ভবিষ্যতেও করতে পারবো। তুমি সারাজীবন ভালোবাসবে বলে ওয়াদা করেছো, মনে রেখো তোমার জীবনে আমার স্থান আমি কাউকে দিবো না, তুমি চাইলেও না”

কথাগুলো বলার সময় চন্দ্রির চোখগুলো টলমল করেছিলো যাতে সায়ানের অপরাধবোধ দ্বিগুণ হয়ে যায়, এক মাত্র এই মেয়েটার চোখের জল ওর কখনো সহ্য হয়না কারণ ও এই পৃথিবীতে আছে শুধুমাত্র তার ছোট্ট পরির জন্য, তাকে কি করে কাঁদাবে ও!এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে ওর সিদ্ধান্তই ঠিক, ও ভালো করেছে রুশানির কথা না জানিয়ে নাহয় চন্দ্রি কি করতো! আর যাইহোক চন্দ্রি ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে, ওর কষ্ট সহ্য করার মতো শক্তি সায়ানের নেই। তাই ওকে সুখে রাখার জন্য ও সবকিছু করবে তাতে যদি অন্যের প্রতি অন্যায় হয় তবে জঘন্য কাজটিও ও করবে!

চন্দ্রিকার কথায় মাথা নাড়িয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো,ওর চারপাশ কেমন যেনো ধোঁয়াশা। কিছুই দেখতে পারছেনা!ক্লাবে এসে এতোক্ষন পর্যন্ত বসে ছিলো তবে এলকোহল ধরার সাহস হয়নি। এই এলকোহলের জন্যই ও দুটো মানুষের জীবন নষ্ট হতে চলেছে! ওর সবচেয়ে বড় ভয় হচ্ছে সেই সময়ের জন্য, যদি চন্দ্রি ভুল করে সব জেনে যায় আর ওকে দায়িত্ব আর ভালোবাসার মধ্যে যেকনো একটা বেছে নিতে হয়, কাকে বেছে নিবে ও??
মস্তিষ্ক বারবার চন্দ্রির কথা বললেও মনের কোন এক কোনে কেউ একজন যেনো চিৎকার করে বলছে “তবে কি রুশানি নামের মেয়েটির প্রতি অন্যায় করা হবে না?”

মাথা চেপে ধরে বসে আছে সায়ান, তখনি কাধে একজন হাত রাখলো কেউ একজন। পাশে তাকিয়ে ইনানকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো তারপর মলিন হাসি দিয়ে বললো

“কিছু বলবি?”

“বাইরে চল কথা আছে”

সায়ান আর ইনান বাইরে বেরিয়ে এলো, ইনান ড্রাইভ করছে আর সায়ান পাশে বসে সিগারেট টানছে। এমনিতে তেমন একটা সিগারেট টানা হয়না তবে ডিপ্রেসড থাকলে কতোগুলো শেষ করে জানা নেই। ইনান সায়ানের অবস্থা দেখে শান্ত কন্ঠে বললো

“কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?কি করবি এখন?”

“কালকে গিয়ে ওই মেয়েটিকে নিয়ে আসবো, দরকার হলে তাদের সামনে নাহয় বিয়ে পড়ানো হবে”

“তাহলে মাত্র তিনবছরের জন্যই বিয়ে করছিস?”

“এছাড়া কি করার আছে আমার? সারাজীবনের জন্য তো আর করা সম্ভব নয় কিন্তু আমি আমার দায়িত্ব পালন করে যাবো”

“দায়িত্ব! একটা মেয়ের কাছে সবচেয়ে গৌরভের বিষয় হচ্ছে তার স্বামী, তোর মনে হয়না মেয়েটির প্রতি খুব বেশি অন্যায় হয়ে যাচ্ছে। সব মেয়ে টাকা পয়সা চায়না,অনেক মেয়েই সুখের একটা সংসার চায় যেখানে দিনশেষে একটা মানুষকে সম্পুর্ণ নিজের বলে দাবি করতে পারবে। আচ্ছা মেয়েটির কথা নাহয় বাদই দিলাম, চন্দ্রিকা! তাকে কি ঠকাচ্ছিস না?তুই তাকে কিছুই বলছিস না কেনো?”

“আমি বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু ও কতোটা নরম মনের সেটাতো তুই জানিস। যদি উল্টো পাল্টা কিছু করে বসে?আমি বেচে থাকতে ওর কিছু হতে দিবো না সেটা তুই খুব ভালো করেই জানিস”

“তুই ওকে নিজ থেকে বললে ও যতোটা না কষ্ট পাবে তার অনেকগুন বেশি পাবে অন্যের থেকে শুনে।”

“আমি কোনদিন শুনতে দিবো না ওকে,ও কোনদিন এই ব্যাপারে জানবে না।”

সায়ানের কঠোর প্রতিজ্ঞা দেখে ইনান হাসলো, ঠিক হাসা নয় কিছুটা উপহাস করলো বলা চলে।মনে মনে বলে উঠলো

“মিথ্যের শক্তি যতোই বেশি থাকুক না তা লুকিয়ে রাখা যায় না। সত্য তার নিজ সময়ে ঠিক বেরিয়ে আসবে সেটা আজ হোক,কাল হোক অথবা পরশু!”

ইনান ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিলো, আজকাল হাসতে ভুলে গেছে ও। প্রাণবন্ত যে ছেলেটি পুরো ফ্রেন্ডসার্কেল মাতিয়ে রাখতো, প্রতিদিন নতুন নতুন জোকস শুনিয়ে সবাইকে হাসাতো! সে আজ বড় নিশ্চুপ, নির্দয়, স্বার্থপর তাইতো নিজের কথাই শুধু ভাবে অন্যের কষ্ট চোখে পড়ে না তার।

সায়ান নিজের সকল চিন্তা কিছুক্ষনের জন্য ভুলে গেলো, নিজের প্রাণপ্রিয় বন্ধুর মলিন মুখের দিকে তাকালো। সায়ান বরাবরই খুব গম্ভীর ছিলো, কম কথা বলতো আর ইনান ছিলো তার সম্পুর্ণ বিপরীত। তবে আজ অনেকদিন হলো সেই রুপটা দেখতে পায়না,ইনান কেমন যেনো মিইয়ে গিয়েছে। আজকাল বড্ড অচেনা লাগে ওকে, শেষকবে প্রানখুলে হাসতে দেখেছে ওর মনে পড়েনা তবে সবসময় মুখে মলিন হাসি ঝুলে থাকে। নিজের কোম্পানি আর ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত যে ইনানের এই মলিন চেহারা নজরে আসেনি। সায়ান শান্তস্বরে বললো

“আজকাল নাকি খান বাড়িতে যাওয়া হয়না তোর?মিসেস খানের সাথে তোর তো ভালই জমতো!”

ইনান হাসলো তারপর বললো

“আজকাল সেই বাড়িতে তোর পদাচরণও তো নেই!আর সাবিনা আন্টির সাথে শেষ কবে কথা বলেছিস মনে আছে?”

“মিসেস খানের সাথে আমার কোন কথা বলার নেই, উনি ওনার মতো ভালো আছেন আর আমি আমার মতো। আমি ওই বাড়িতে থাকা না থাকাতে কারো কিছু যায় আসে না বরং না থাকলেই সবাই খুশি। আর রইলো সামায়রার কথা! ওর সাথে আমার বাইরে দেখা হয় তাই ওই বাড়ি যাওয়ার কারণ নেই”

সামায়রা! নামটা শুনতেই ইনানের চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেলো, ঠিক অনুভুতিহীন! সম্পর্কে মেয়েটি সায়ানের বোন অনেকটা ওর বোনের মতো কিন্তু…

ইনানকে কিছু না বলতে দেখে সায়ান চুপ হয়ে গেলো, হয়তো কিছু কিছু সময় চুপ থাকাই শ্রেয়। সায়ান গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে এগুতে গিয়েও ফিরে আসে তারপর ইনানকে উদ্দেশ্য করে বলে

“যদি মনের কোন কথা জমিয়ে না রেখে শেয়ার করা উচিৎ তবে আমাকে শুধু একটা ফোন করিস। যত ব্যাস্তই থাকি না কেনো তোর কথা মনোযোগ সহকারে সবটা শুনবো! তোর ফোনের অপেক্ষায় রইলাম”

ইনান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো, বিনিময়ে সায়ান মুচকি হেসে ভেতরে চলে গেলো। ইনান বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলো,কিছু কিছু কথা থাকে যা মানুষ নিজের সাথে শেয়ার করতেই ভয় পায়, অন্যকে বলার ইচ্ছে থাকলেও বলা যায়না। হয়তো ইনানও বলতে পারছেনা! মোবাইলের নোটিফিকেশনের সাউন্ড যেনো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে সাথে ওর বিরক্তির মাত্রাও। কিছুটা বিরক্তি নিয়েই ফোনটা তুলে কানে দিলো আর ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠলো

“কি সমস্যা? কতোবার বলেছি আমাকে ফোন করবে না তবুও কেনো ফোন করো?তোমার ফেমিলিকে জানাতে বাধ্য করবে না আমায়”

অপরপাশ থেকে কোন শব্দ না আসাতে রেখে দিতে নিবে তার পুর্বেই একজন নারীর মিষ্টি কন্ঠ ভেসে উঠলো

“ইনান ভাই!আমি অনেক অসুস্থ,তুমি কি আমায় দেখতে আসবে?”

ইনান আর চড়া কন্ঠে কথা বলতে পারলো না আর যাইহোক সামুর দুর্বল কন্ঠ উপেক্ষা করতে পারেনা ও কিন্তু তাই বলে ওর সব অন্যায় আবদার গুলো মেনে নেয়া সম্ভব নয়! ইনান কিছুটা শিথিল স্বরে বললো

“পারবো না”

বলেই কট করে ফোন কেটে দিলো, আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো দুর্বল হয়ে যেতো কিন্তু ওর দুর্বল হওয়া চলবে না। ওর একটা সিদ্ধান্তের সাথে অনেকগুলো সম্পর্ক জড়িত!

ইনানের ফোন কেটে যাওয়ার পরও এখনো ফোন কানে ধরে আছে ওপাশের ব্যাক্তিটি, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো দুফোটা মুক্তোদানা। এতো কষ্ট কেনো ভালোবাসায়? যেখানে তাকে ছাড়া একমুহুর্তও কল্পনা করা দুষ্কর সেখানে সেই ব্যাক্তির প্রতিনিয়ত অবহেলা যে এই হৃদয়ে যে দহন হয় তা কি দেখে না?
সামুর চিৎকার করে তার কলার চেপে বলতে ইচ্ছে করছে

“আমার ভালোবাসা তুমি কেনো বুঝোনা ইনান ভাই, কেনো?তুমি কি বুঝোনা এই বিচ্ছেদ বেদনা আমায় শেষ করে দিচ্ছে, জালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে!আমি তৃষ্ণার্ত পাখির ন্যায় তোমার ভালোবাসা পাবো বলে তোমার পানে চেয়ে আছি। তোমার প্রেম প্রেম অসুখে আমি বড্ড আক্রান্ত, তুমি নামক ঔষুধের বড্ড প্রয়োজন আমার!”

আজ আরো একটা রাত হয়তো নির্ঘুম কাটবে সামায়রার, তাকে ভেবে এমন কতো রাত জেগে পার করেছে তার হিসাব নেই। প্রতিদিন রাতে সামু প্রতিজ্ঞা করে কাল থেকে আর মানুষটিকে বিরক্ত করবে না কিন্তু ঠিক সকালে উঠে ভুলে যায়, ঠিকই বেহায়ার মতো “গুড মর্নিং” মেসেজটা পাঠাতে ভুলে না।আজ রাতের অবহেলার পর কাল সকালে হয়তো আবারও পাঠাবে!

ভালোবাসা শব্দটির সাথে যবে থেকে পরিচয় ঘটেছে তবে থেকেই জেনেছে এই মানুষটিকে ও ভালোবাসে। যে ওর ছোটবেলার ক্রাশ, কৈশরের আবেগ আর যৌবনের প্রেম! কিন্তু মানুষটা বড্ড অবুঝ কিছুতেই বুঝে না তাকে, হয়তো বুঝতেই চায়না। আচ্ছা! কোন একদিন যদি হারিয়ে যায় ও তবে কি মানুষটি তাকে খুঁজবে?নাকি তার কিছুই যায় আসবে না?হয়তো তার জন্য ভালোই হবে, বিরক্ত করার কেউ থাকবে না।

____________________

বসার ঘরের সোফায় রুশি চুপচাপ বসে আছে, পরনে কালো রঙের শাড়ি, হাত ভর্তি চুড়ি আর টানা চোখে মোটা করে দেয়া কাজল। এইটুকু সাজেই যেনো অপরুপ লাগছে,গোলাপি ঠোঁট জোড়া থেকে কেঁপে উঠছে। সামনে বসে থাকা মাঝবয়সী লোকটি চোখ দিয়ে যেনো গিলে খাচ্ছে ওকে, হয়তো এই জন্মে মেয়ে দেখা হয়ে উঠেনি তার।। লোকটি নিজের বয়স পঁয়ত্রিশ বললেও তার থেকে আরো বেশি বয়স্ক লাগে, নো ওন্ডার ওর পালক মা নিজের মেয়ে বিয়ে দিতে চায়নি। কথা ছিলো পছন্দ হলে একেবারে বিয়ে করিয়ে নিয়ে যাবে রুশিকে তবে রুশি শংকিত নয়।
ও অপেক্ষায় আছে ওই সময়ের জন্য যখন বলা হবে পাত্র পাত্রী আলাদা কথা বলুক।

আর যাইহোক কোন লোক বাচ্চাসহ কোন মেয়েকে বিয়ে করবে না। রুশি প্রথমে চেয়েছিলো সায়ানকে ফোন দিতে কিন্তু সায়ানের নাম্বার ওর কাছে নেই। আর কাল থেকে বাড়ির বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। ওর এখন একটাই পথ খোলা আছে, পাত্রকে সরাসরি বলে দিবে ও অন্যের বাচ্চার মা হতে চলেছে। এতে বড় জোর ওর পালক মা ওকে বের করে দিবে, তারপর নাহয় ও সায়ানের কাছে চলে যাবে। কালকের পর থেকে এই ভরসাটুকু হয়েছে যে এই বাড়ি ছাড়াও অন্যত্র যাওয়ার জায়গা আছে ওর তাই আর যাইহোক এদের আর ভয় পাবেনা ও।

রুশি এসব ভেবেই বসে আছে ঠিক তখনি সদর দরজা খুলে গেলো, রুশি সেদিকে হা করে তাকিয়ে আছে।

#চলবে