Sunday, July 20, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1607



গুমোট অনুভুতি পর্ব-৪৯+৫০+৫১

0

গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_ ৪৯

সবকিছু জানার পর সবাই যেনো স্তব্ধ হয়ে আছে! কতোগুলো সত্যের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের, সবাই নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে, সায়ান মাথা নিচু করে বসে আছে। ঠিক এমন সময় কেউ একজন দৌঁড়ে সেখানে আসলো আর চন্দ্রিকাকে জড়িয়ে ধরলো। সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, সায়ান দেখেই বুঝতে পারলো এটা শাহেদ। ও তাকিয়ে দেখলো শাহেদের হাত থেকে রক্ত পড়ছে, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত,এরমানে চন্দ্রিকার গায়ে লেগে থাকা রক্ত শাহেদের! সায়ান প্রশ্ন করে উঠলো

“এই অবস্থা কেনো তোমাদের?এতো আহত কি করে হলে তুমি?”

চন্দ্রিকা মুখ খুলে বললো

“শাহেদ এই এন্টিডোরের কথা প্রথম শুনে, তারপর আমাকে বলে এই ব্যাপারে। আমি বুঝতে পারি যেহেতু এই এক্সপেরিমেন্টাল ড্রাগ আর এন্টিডোর সামাদ খানের কাছে এরমানে সে তোমাদের কোন ক্ষতি করবে। আমার দ্বারা তোমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে তাই আর ক্ষতি করতে চাইনা আর না চাই অন্যকেউ করুক। তাই ওকে বলি এন্টিডোর কোন ভাবে নিয়ে আসতে আর ও তাই করে কিন্তু শেষমুহুর্তে ধরা পড়ে যায়। আমি তখন সেই বাড়ির সামনেই ছিলাম, তাই দুজনে মিলে পালিয়ে আসি। তারপর আমরা লুকিয়ে পড়ি, যেখানে লুকিয়ে ছিলাম তা মেইন রোড থেকে অনেক দূরে ছিলো। তাই তাদের ডিস্ট্রেক্ট করার জন্য ও তাদের সামনে যায় আর আমি এন্টিডোর নিয়ে চলে আসি।সেখানেই ও এইভাবে ইঞ্জুরড হয়”

সায়ান ওদের দিকে তাকিয়ে বুঝলো ওরা মিথ্যে বলছে না, সত্যি বলতে সায়ান এই মুহুর্তে ওদের প্রতি কৃতজ্ঞ!কিন্তু সামাদ খানের সাথে শাহেদের সম্পর্ক বুঝতে পারছে না, ও বলেই ফেললো

“সামাদ খান কি হয় তোমার? তুমি তার বাড়িতে ছিলে কেনো? ”

“আমার বাবা হয় তাই ছেলে হিসেবে তার বাড়িতে থাকা অস্বাভাবিক নয়!”

তারপর চন্দ্রিকার দিকে তাকিয়ে বললো

“আর ইউ ওকে?কোথাও লাগে নি তো?”

চন্দ্রিকা মাথা নাড়িয়ে না বললো,ও শাহেদকে নিয়ে হাটা ধরলে সায়ান পেছন থেকে বললো

“সামাদ খান তো চন্দ্রিকার বাবা তাহলে তোমার বাবা কি করে?”

“চন্দ্রির বায়োলজিক্যাল ফাদার আর আমার নামমাত্র! তার তখনি আমার কথা মনে পড়ে যখন দরকার হয়, বলতে পারো আমি তার পোষা কুকুর। ছোট থেকে পেলে বড় করেছে বলে বহুদিন তার খারাপ কাজে জড়িত ছিলাম কিন্তু আপাদত নেই। সে হয়তো জানেই না আমি বেঁচে আছি তা! এনিওয়ে সে তোমাকে মারার জন্য উঠে পড়ে লেগে আছে, সে নিজের স্ত্রী মানে চন্দ্রির সৎমাকে মেরেই ফেলেছিলো প্রায় একদিন। অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন তিনি, সাবধানে থেকো তার থেকে”

” তুমি তার মানে তার বায়োলজিক্যাল সন্তান নও, ওয়েট…তোমার নাম শাহেদ! তুমি…”

সায়ান দ্রুত এগিয়ে গিয়ে শাহেদের কলার চেপে ধরলো আর সেটা সরিয়ে দেখতে লাগলো। হ্যা একটা চেইন আছে কিন্তু রুপোর! ও সেটা টেনে বের করে আনলো আর প্লাটিনামের লকেট দেখতে পেলো যাতে লিখা “শাহেদ জামান”।সায়ান দুইকদম পিছিয়ে গেলো আর কাঁপা স্বরে বললো

“ত্ তুমি…তুমি শাহেদ জামান! শাহিন আঙ্কেলের ছেলে!আমার খালাতো ভাই!”

“হোয়াট ননসেন্স!তোমার আমার মাঝে একটাই সম্পর্ক ছিলো তা হলো শত্রুতার যদিও এখন তোমাকে আমি আর শত্রু ভাবিনা।সেদিন রুশির সাথে ইচ্ছে করেই ওমনটা করেছি যাতে বুঝতে পারো নিজের ভালোবাসাকে অন্যের কাছে দেখলে কেমন লাগে! আর আমি শাহেদ জামান নই, শাহেদ নওয়াজ। এটা জাস্ট আমার সাথে ছোট বেলা থেকে ছিলো তাই খুলিনি।”

“আম নট লায়িং, তুমি আমার খালাত ভাই সম্পর্কে আর রুশির ভাই!তোমার বয়স বিশ বছর তাইনা?”

“তুমি কি করে জানলে?”

“কারণ রুশির বয়সও বিশ বছর এন্ড ইউ গাইজ আর টুইন। এই ওদের দেখতে পাচ্ছো! তারা তোমার বাবা মা সাথে রুশিরও। তোমাদের জন্মের পর সামাদ খান তোমাদের নিয়ে যায়, তোমাকে স্বার্থের জন্য রেখে দেয় কিন্তু রুশিকে মেরে ফেলতে বলে কিন্তু ও ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে। তোমাদের বাবা মা অনেক খুঁজেছে দুজনকে, এই জন্যই তুমি আর রুশি অনেকটা একই রকম দেখতে! আমি সেদিন এটা বুঝতে পারলেও চোখের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলাম”

সায়ান শাহেদেকে একে একে সব বললো। শাহেদ এই সবকিছু বিশ্বাস করতে পারছেনা, কিন্তু সায়ানের এভাবে বানিয়ে বলারও কোন কারণ নেই। এরমানে সামনের এই দুজন ওর বাবা মা আর ওই রুশি নামক মেয়েটি ওর আপন বোন?শাহেদের ভাবনার মাঝেই কেউ একজন ওর গালে হাত দিলো, অশ্রু সিক্ত নয়নে প্রিয়ানা তাকিয়ে আছে তার ছেলের দিকে,দুটো ছেলে মেয়েকে বিশ বছর পর খুঁজে পেয়েছে কিন্তু এভাবে? একজন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে আর আরেকজন আহত!উনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো

“তুই আসলেই আমার ছেলে? আমার শাহেদ?”

সায়ান মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলতে বললো, শাহেদও তাই করলো! এই নারী ওর মা?আর উনি ওর বাবা। ওরও বাবা-মা আছে!সত্যিকারের বাবা-মা!ও হুট করে জড়িয়ে ধরলো তাকে,ও কোন অনাথ নয় আর না কারো দয়া বেঁচে থাকবে আর। ওর বাবা-মা আছে এখন!ওর নিজের বাবা-মা!

প্রিয়ানা পরম যত্নে শাহেদের বেন্ডেজ করতে লাগলো, আর শাহেদ চুপচাপ বসে রইলো। সবাই যেনো অনেকগুলো সত্য গ্রহন করার চেষ্টা মশগুল!

________________________

প্রায় তিনঘণ্টা পর অপারেশন থিয়েটরের দরজা খুললো, এতোক্ষন রুশির চিৎকার আর কান্না সায়ান নিতে পারছিলো না। মা হওয়া বড্ড কষ্টের তেমন প্রাপ্তিরও।রুশি হয়তো সব ভুলে যাবে একসময় যখন নিজের বাচ্চাকে প্রথম কোলে নিবে! সায়ান দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই নার্স একটা বাচ্চাকে নিয়ে বের হলো আর মুচকি হেসে বললো

“কনগ্রাজুলেশন মিস্টার খান! আপনার ঘরে জান্নাত এসেছে। আপনি কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছেন!”

সায়ান স্থির দৃষ্টিতে তাকালো ওর সন্তানের দিকে,ও বাবা হয়ে গেছে!আজ থেকে কেউ আধো আধো শব্দে ওকে বাবাই বলবে,ওর হাত ধরে হাটবে ওর সাথে খেলবে! নার্স ওর কোলে বাচ্চা দিতে গেলে ও নিতে যেয়েও নিলো না,ওর ভয় করছে, এতো ছোট আর নরম শরীর। সায়ান না নেওয়াতে সামু জলদি করে নিয়ে নিলো। অদ্ভুত ভাবে বাচ্চাটি শান্ত ভাবে চেয়ে আছে সায়ানের দিকে, কি মায়া এই মুখখানিতে!রুশি হয়তো ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে নাহয় এই ছোট্ট প্রাণ পৃথিবীর মুখ দেখতো না, সায়ান নিজের সুখের কথা ভেবে নিজের সন্তানকেই হয়তো হারাতো। ও বাচ্চাটির কপালে চুমো খেয়ে বললো

“আম স্যরি!তোমার বাবাইটা বড্ড পচা মা”

তারপর ডক্টর বেরুতেই সায়ান তার কাছে চুটে গেলো,ওর বুক কাঁপছে!কি বলবে ডাক্তার?ও কাঁপা গলায় বলে উঠলো

“মিস্টার খান আপনার ওয়াইফের অবস্থা ভালো না,আমরা যতোটা না ভেবেছি সিচুয়েশন তার থেকেও ক্রিটিকাল! যে এন্টিডোর এনেছে তাতে আমরা ব্লিডিং বন্ধ করতে পেরেছে কিন্তু এতে কিছু সাইড ইফেক্ট ছিলো! আমরা বাহাত্তর ঘন্টার আগে কিছু বলতে পারছি না, আপাদত উনি ঠিক আছেন কিন্তু কতক্ষন ঠিক থাকবেন তার নিশ্চয়তা আমি দিতে পারছিনা। অনেকগুলো সম্ভাবনা হতে পারে,এন্টিডোর স্পেশিয়ালি ব্রেইনে ইফেক্ট করেছে তাই সে কোমায় চলে যেতে পারে, বা তার সকল স্মৃতি মুছে যেতে পারে কিংবা আংশিক!আর যদি ব্রেইন এই চাপ সহ্য করতে না পারে তবে…”

সায়ান রেগে ডাক্তারের কলার চেপে ধরলো

“কি বলতে চাইছেন আপনি?আমার রুশির কিছু এই হসপিটালের সবকিছু জালিয়ে দিবো আমি। আই ওয়ান্ট হার সেফ এট এনি কস্ট!আপনার যা দরকার আমি তা দিবো জাস্ট কিউর হার প্লিজ”

“কিছু কিছু জিনিস ডাক্তারদের হাতে থাকে না,আগেই বলেছি ড্রাগটা এনিমেল ড্রাগ ছিলো তাই তার সন্তানকে বাঁচাতে আমরা এনিমেল এন্টিডোর ইউজ করেছে এবং পরে আপনাদের আনা এন্টিডোর যার সাইড ইফেক্ট রয়েছে।আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, বাকিটা আল্লাহর হাতে!”

সায়ান দৌঁড়ে ঢুকে গেলো কেবিনে আর রুশির দিকে তাকিয়ে দেখলো ও অজ্ঞান অবস্থায় আছে। ও সেখানে গিয়ে নিচে বসে রুশির হাত চেপে ধরে বললো

“প্লিজ কাম ব্যাক!আমি শ্বাস নিতে পারছিনা তোমাকে ছাড়া,প্লিজ এভাবে মেরো না আমায়। আমি পারবো না তোমায় ছাড়া থাকতে!”

#চলবে

গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৫০

সায়ান রুশির হাত ধরে বিড়বিড় করতে লাগলো, বারবার রুশিকে ওকে ছেড়ে না যাওয়ার অনুরোধ করতে লাগলো!হঠাৎ করে সায়ান নিজের হাতে শক্ত কিছু অনুভব করলো, ওর হাতের বন্ধনী শক্ত হয়ে উঠেছে। ও দ্রুত অশ্রুসিক্ত চোখে সেদিকে তাকালো, রুশির হাত ওর হাতকে খুব শক্ত করে ধরে আছে!ও রুশির মুখের দিকে তাকাতেই দেখলো রুশি ওর দিকে তাকিয়ে আছে, ও উঠে দ্রুত রুশিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো আর বলতে লাগলো

“আমি জানতাম তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না, তুমি ফিরে আসবে আমি জানতাম!আমি কখনো তোমাকে চোখের আড়াল করতে চাইনা,তুমি আমাকে ফেলে চলে যাওয়ার চিন্তাও করবে না আর। মনে রেখো আজকের এই অনুরোধই শেষ ছিলো তোমার।এরপর আর আমি কিছুই শুনবো না!”

সায়ানের কথা রুশির কানে গিয়েছি কিনা সায়ান বুঝতে পারলো না, রুশি ওকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে, হাতের বন্ধন ধীরেধীরে শক্ত করছে। এর মানে রুশি কিছুতে ভয় পাচ্ছে, সায়ান রুশির মাথায় হাত রেখে ওকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলো, রুশি দুর্বল কন্ঠে বললো

“ডাক্তারের কথা আমি শুনেছি সায়ান! আমি যদি কোমায় না যাই তবে সবচেয়ে বেশি চান্স আমি তোমাকে ভুলে যাবো! আমি তোমাকে ভুলতে চাইনা,আমাদের কাটানো প্রতিটি মুহুর্ত আমার কাছে স্পেশাল! আমি সেই মুহুর্তগুলো ভুলতে চাইনা,আমি তোমাকে ভুলে গিয়ে কি করে থাকবো?আমি তোমাকে ছাড়া কি করে থাকবো, তুমি কিছু করোনা সায়ান! কিছু একটা করো, তুমিতো সব ঠিক করে দাও। এটাও ঠিক করে দাওনা প্লিজ!আমি তোমাকে ভুলতে চাইনা!এর চেয়ে তো আমার মরে যাওয়াই ভালো ছিলো!”

“সব ঠিক হয়ে যাবে রুশি!প্লিজ রিলাক্স,তুমি শান্ত হও। আমি ডাক্তার ডাকছি, সব ঠিক হয়ে যাবে”

সায়ানের কথায় রুশি হাতের বন্ধন আরো শক্ত করে ফেললো যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। সায়ানও জড়িয়ে ধরে রাখছে। দুজনেই কাঁদছে,রুশি সায়ানকে ভুলে যাবে এটা সায়ান নিজেও মানতে পারবে না। অনেক কষ্ট রুশিকে নিজের করে পেয়েছে, ওর সাথে সময় কাটানোর পুর্বেই ওদের সকল স্মৃতিগুলো রুশি ভুলে যাবে, এটা মানবে কি করে ও। রুশি ওকে ভুলে যাবে!রুশির কাছে ও একদম অপরিচিত হয়ে যাবে?সায়ান আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রুশিকে কিন্তু রুশির বন্ধন ধীরেধীরে আলগা হয়ে গেলো। সায়ান বুঝতে পেরে আলতো করে ডাকলো

“রুশি! রুশি!প্লিজ কথা বলো আমার সাথে।আমার খুব ভয় করছে প্লিজ”

কিন্তু রুশির পক্ষ থেকে কোন সাড়াশব্দ এলো, সায়ান রুশিকে ছেড়ে দিয়ে ওর দিকে তাকালো।রুশি চোখ বন্ধ করে আছে, সায়ান কয়েকবার ডেকেও যখন কোন সাড়া পেলো না তখন ডাক্তার ডাকতে শুরু করলো। মুহুর্তেই কেবিনে সবাই এলো সাথে ডাক্তারও!
ইনান সায়ানকে কোন মত সরালো সেখান থেকে কিন্তু সামলাতে পারছে না ওকে। সায়ান পাগলামো শুরু করে দিয়েছে, বিড়বিড় করে বলছে

“ও ক্ কথা বলছে না, ওকে উঠতে বল না প্লিজ!আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ওকে ছাড়া।কিছু তো কর প্লিজ!”

ইনান বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না,কিভাবে শান্তনা দেবে তার ভাষা নেই। মনের কোথাও একটা এখনো আছে রুশি তাই ওর হৃদয়ও পুড়ছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। কি অধিকারে রুশির জন্য কিছু বলবে?সায়ানের মতো হয়তো না তবে খারাপ তো ওরও লাগছে,চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে ‘রুশি প্লিজ উঠো, তুমি এভাবে ছেড়ে যেও না। অন্তত তোমায় ছাড়া আমাদের এই পাগলটা বাঁচবে না’
কিন্তু ওইযে অধিকার! সেটাই তো নেই, বলবে কি করে?সায়ানকে শক্ত করে ধরে বাইরে নিয়ে এসেছে ইনান,ওকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। সায়ান ছুটে গিয়ে ওটির দরজায় লাথি মারা শুরু করলো,আর চিল্লাতে থাকতো। একসময় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লো, সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। প্রিয়ানা মাঝেমাঝে কেঁদে উঠছে, শাহেদ মাথা নিচু করে বসে আছে।সামু ছোট বাচ্চাটিকে নিয়ে বাইরে আছে হসপিটালের পরিবেশ পুরো থমথমে!

প্রায় আধঘণ্টা পর ডাক্তার বের হলো,সায়ান দুর্বল শরীরে উঠে দাঁড়ালো আর ডাক্তারের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, ডাক্তার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো

“পেইশেন্ট এখন আউট অফ ডেঞ্জার!তার ফিজিক্যাল কোন ইঞ্জুরি নেই আর মৃত্যুর ঝুঁকিও নেই।”

ডাক্তারের কথা সায়ান যেনো প্রান ফিরে পেলো সবাই, যাক রুশির আর কোন ঝুঁকি নেই। শি ইজ ফাইন।কিন্তু বলে না খুব তাড়াতাড়ি খুশি হয়ে গেলে খুশিটা খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়।ডাক্তারের পরের কথা শুনে সায়ান স্তব্ধ হয়ে গেলো

“কিন্তু ওনার মাথায় খুব বেশি চাপ পড়েছে,আমি এইটারই ভয় পাচ্ছিলাম আর তাই হলো। পেইশেন্টকে এইসময় স্ট্রেসফ্রি রাখতে হয় কিন্তু উনি প্রচণ্ড স্ট্রেসে ছিলো তাই সেটার ইফেক্ট মাথায় পড়েছে। আমি আপাদত কিছু বলতে পারছিনা তবে উনি কিছুদিন বেজিটেবল অবস্থায় থাকবেন। তবে যখন নিজের হুশে ফিরে আসবেন তখন সবেচেয়ে বড় সম্ভাবনা হচ্ছে এমনিজায় ইফেক্ট হওয়ার। হয়তো উনি উনার স্মৃতির কিছু অংশ হারিয়ে ফেলবে কিংবা পুরোটা!মনে রাখবেন তাকে কিছুতেই স্ট্রেস দেয়া যাবে না কিংবা আগের কিছু মনে করানোর ট্রাই করানো যাবে না।এতে পেইশেন্টের অনেক ক্ষতি হতে পারে এমনকি মস্তিষ্কের কার্যক্রম বন্ধও হয়ে যেতে পারে মানে তাকে বাঁচানো সম্ভব হবে না”

সায়ান নিচে বসে পড়লো, ওর সাথে কেনো এমন হয়?এই পৃথিবীতে এতো মানুষ থাকতে কেনো ওর আর রুশির সাথে এমন হতে হবে?কেনো ওরা এতো চেষ্টা করেও সুখে থাকতে পারলো না?হোয়াই?
সায়ানের পাশে এসে সামু দাঁড়ালো তারপর ওকে বললো

“ভাই তুই এভাবে ভেঙে পড়লে কি চলবে?তুই এখন একা নস,তোমার একটা মেয়ে আছে!তুই এমন হলে ওকে কে সামলাবে?আর রুশি একদম ঠিক আছে, সব ঠিক হয়ে যাবে!তোর বাচ্চাকে একটু কোলে নে, ও কাঁদছে ভাই!”

সায়ান বাচ্চার কান্নার শব্দে উঠে দাঁড়ায় আর আলতো করে ওকে কোলে নেয়!তারপর কান্না থামানোর জন্য হাটতে থাকে,এটা ওটা বলতে শুরু করে কান্না থামানোর জন্য। আর বাচ্চাটি খুব দ্রুত থেমেও যায়!সবাই অবাক হয়ে সায়ানকে দেখছে, এতো তাড়াতাড়ি পরিবর্তন! সায়ান সবার দিকে তাকিয়ে বললো

“এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? বাবা হিসেবে আমার মেয়েকে তো আমাকেই সামলাতে হবে তাইনা?আমার রুশি বেঁচে আছে!এটাই যথেষ্ট আমার জন্য!তাই সবাই এভাবে মুখ ফুলিয়ে থাকবে না বলে দিলাম”

সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো, সায়ান নিজে থেকে বুঝে গেছে মানে ভালো হয়েছে। যাইহোক না কেনো সায়ানের স্বাভাবিক থাকা জরুরী,তাহলে রুশিও হয়তো একদিন ঠিক হয়ে যাবে। আশা করা ছাড়া এখন আর কোন উপায় নেই,আশায় আশায় আজীবন কাটানো যায় কিন্তু আশা ছাড়া বাঁচা যায়না। সায়ানের জন্য হয়তো এটাই যথেষ্ট যে রুশি নিঃশ্বাস নিচ্ছে, বেঁচে আছে!আর সায়ান এই আশায় বেঁচে আছে রুশি একদিন উঠবে, কথা বলবে, হাসবে আর সবকিছু আগের মতো হয়ে যাবে!

#চলবে

গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৫১

হসপিটালের ছোট্ট কেবিনে ছোট্ট একটা পরিবারের বসবাস, বাবা-মা আর সাথে থাকে ছোট্ট রাজকন্যা! হসপিটালের কেবিনে প্রয়োজনীয় সকল কিছু রয়েছে, মোটকথা একটা পরিবার থাকতে যা যা প্রয়োজন। ছোট্ট মেয়েটি বর্তমানে কান্না করছে আর তার বাবা কিছুতেই তাকে চুপ করাতে পারছে না। অন্যদিন কান্না না থাকলে মায়ের কাছে নিলেই থেমে যায় কিন্তু আজ কিছুতেই যেনো কিছু হচ্ছে না! অনেকক্ষণ চেষ্টার পর বাবাটি বুঝতে পারলো বাচ্চার ডায়পার্ড চেঞ্জ করতে হবে, আর এইজন্যই বাচ্চাটি কান্না করছে! বাবা অসহায় চোখে বাচ্চার দিকে তাকালো! এই ডায়পার্ড চেঞ্জ করা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাগজগুলোর একটি, ডায়পার্ড যদিও খুলে ফেলা যায় তবে নতুন করে পরাতে কি মেয়ের সাথে একদফা যুদ্ধ হয়ে যায় বাবার। আজোও তার ব্যাতিক্রম কিছু নয়,বাবা এই পরিস্থিতিতে পড়লেই তার স্ত্রীর দিকে তাকায় আর ভাবে নিশ্চই সে তাকে এই অবস্থায় দেখে বেশ মজা পাচ্ছে!তাইতো আজ আড়াই মাস ধরে এই কাহিনী দেখেও তার দয়া হচ্ছে না আর উঠছেও না সে।

সায়ান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে নিজের মেয়েকে শান্ত করতে লাগলো,মেয়েটির নাম এখনো ঠিক করা হয়নি কিন্তু সায়ান আদর করে পাখি বলে ডাকে,ওর পরীর পাখি!সায়ান উপর দিয়ে বেশ শক্ত, নিজের মেয়েকে একাই বড় করছে। কোম্পানিও সামলাচ্ছে যদিও সাহিলের সহযোগীতায় এটা সম্ভব হচ্ছে, সাহিলের মতো বিশ্বস্ত লোক এযুগে পাওয়া যায় না! আর সবচেয়ে বড় কথা নিজেকে সামলাচ্ছে ও, নিজের সাথে প্রতিনিয়ত কিভাবে লড়ছে তা নিজেই জানে! প্রতিমুহুর্তে মনে করে নিজেকে এটা মনে করিয়ে দেয় যে ‘সায়ান ইউ আর অলরাইট!’
কিন্তু আসলেই কি ও ঠিক আছে?প্রতিনিয়ত ওর হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা কি করে দেখাবে সবাইকে?পাখি ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ওকে আলতো করে দোলনায় শুইয়ে দিলো তারপর রুশির সামনে এসে বসলো।

আজ প্রায় আড়াইমাস ধরে রুশির এভাবে শুয়ে আছে, কোন সাড়াশব্দ নেই!চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে থাকার পরও সায়ানের ওকে ভালো লাগছে। ডাক্তার বলেছে যদিও রুশি ভেজিটেবল অবস্থায় আছে কিন্তু ও সবকিছু শুনতে পায় কারণ ওর বাঁচার তীব্র ইচ্ছে আছে! আর রুশি খুব দ্রুত রিকোভার করছে তারমানে রুশির জ্ঞান খুব দ্রুত ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে আর রুশির মৃত্যুর কোন আশংকা নেই। তবে স্মৃতি ফিরবে কিনা তার কোন গেরান্টি দিতে পারছে না, না ফেরার সম্ভাবনা বেশি!সায়ানের কাছে রুশির শ্বাস চলছে এতোটুকু খবরই অনেক,রুশি যদি ওকে ভুলে যায় তবে ও খুব কষ্ট পাবে ঠিক আছে কিন্তু ও রুশিকে আবার ভালোবাসতে বাধ্য করবে, এই দুনিয়ায় রুশি শুধুমাত্র তার। সেটা রুশি চাইলেও, না চাইলেও!

সায়ান রুশির হাতের পিঠে আলতো করে চুমু খেলো তারপর বললো

“আমি তোমার জন্য ওয়েট করছি মিসেস খান!আর কতো চুপ করে থাকবে?এবার তো উঠো! আমি পুরো দুনিয়ার কাছে শক্তিশালী হলেও আমি ভেতরে ভেতরে কত দুর্বল হয়ে পড়ছি তা শুধু আমি জানি। এই আমিকে সামলানোর জন্য তুমি নামক নারীর বড্ড প্রয়োজন!তুমি প্লিজ তাড়াতাড়ি উঠো, আমি আর আমাদের মেয়ে তোমার কন্ঠ শোনার জন্য অধীর আগ্রহে আছি। আমাদের বেবির জন্য হলেও প্লিজ কাম ব্যাক!”

সায়ান ওই অবস্থায় হাত রেখে ঘুমিয়ে পড়লো, প্রতিদিন এভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে ও। আর সকালে ঘাড়ের ব্যাথায় কাবু হয়ে যায় কিন্তু তবুও পরম এক শান্তি পায়। রুশি আজ আড়াই মাস ধরে হাসপাতালে আছে বলে এই স্থানই এখন ওর বাড়ি হয়ে গেছে!রুশির কাছে অন্যরা এসে থাকতে চাইলেও সায়ান সম্পুর্ণ না করে দিয়েছে, কড়া কন্ঠে বলেছে ওর বউয়ের জন্য ও একাই যথেষ্ট। মাঝেমাঝে পাখির স্বাস্থ্যের জন্য বাইরের পার্ক থেকে ঘুরে আসে, প্রতি উইক্যান্ডে সায়ানের পরিবার ওদের সাথে এসে দেখা করে যায় তারপর চলে যায়।

মেয়েকে খুব সুন্দর করে ড্রেস পরিয়ে খাইয়ে বেরিয়ে পড়লো সায়ান,মেয়েটি বড্ড শান্তশিষ্ট ওর। প্রয়োজন ছাড়া কান্না করেনা, আবার রাতও জাগেনা। হয়তো বুঝে বাবার কষ্ট তাই তাকে জালাতন করে না!পার্কে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরির পর যখন ফিরছিলো তখন ওর ফোনে ফোন আসে, তুলে দেখে সামু কল করেছে!ও তুলে বললো

“কিরে সামু কি অবস্থা…”

সামু ওর কথা শুনেছে কিনা তা বুঝলো না কিন্তু সে তাড়াহুড়া করে বললো

“ভাই তুই কই?দ্রুত কেবিনে আয়, ভাবির জ্ঞান ফিরেছে!”

সায়ান হুট করে বসে পড়লো মেয়েকে নিয়ে, আজ আড়াইমাস পর রুশির জ্ঞান ফিরেছে। খুশিতে ওর চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো। ও দ্রুত দৌঁড়ে আসতে চাইলেও মেয়ের কারণে সাবধানে পা ফেলে আসলো, কেবিনের সামনে আসতে সবার হতাশ চাহনি দেখতে পেলো, ও জিজ্ঞেস করলো

“কি হয়েছে?সবাই এভাবে উদাস হয়ে আছো কেনো?”

“ভাই!ভাবি আমাদের কাউকে চিনতে পারছে না, শুধু তার পালক বাবাকে ছাড়া। উনি এখন ভেতরে তার সাথে কথা বলছে!ও হ্যা ইনানকেও চিনতে পারছে!”

সায়ান ঠিক যেই ভয়টা পেয়েছিলো ঠিক সেটাই হলো, রুশির স্মৃতি হারিয়ে গেছে। ওর মনে হচ্ছে কেউ ওর বুকে ছুরি চালাচ্ছে এতোটা যন্ত্রণা হচ্ছে। ও দ্রুত কেবিনে ঢুকতেই ইনান আর রুশির বাবাকে দেখতে পেলো!রুশির বাবা রুশিকে তার আসল বাবা মা সম্পর্কে বলছে!তারা ওকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেলেন তারপর আস্তে বেরিয়ে পড়লেন!সায়ান কাছে যেতেই রুশি ভ্রু কুচকে তাকালো আর প্রশ্ন করলো

“কে আপনি?আমি কি কোথাও আপনাকে দেখেছি?আমার মনে পড়ছে না কেনো আপনি কে!”

“রুশি ভালো করে তাকিয়ে দেখো! আমি সায়ান তোমার হাজবেন্ড! আর এইযে দেখো এটা আমাদের মেয়ে, আমি ওর নাম রাখিনি তবে পাখি বলে ডাকি। তুমি ওর নাম রেখে দিও হ্যা?তোমার মনে পড়ছে কিছু?আমাদের কিভাবে দেখা হয়েছিলো বা কি!তুমি কি আমাকে পুরোটাই ভুলে গেছো রুশি!”

“আ্ আমি কিছু মনে করতে পারছিনা কেনো?আ্ আমি আপনাকে চিনি কিন্তু কিভাবে চিনি?আমার কিছুই মনে নেই কেনো?আমার বুকে খুব ব্যাথা করছে! আমার মনে হচ্ছে আমি কিছু হারিয়ে ফেলছি কিন্তু আমি হারাতে চাইনা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে! কিচ্ছু মনে পড়ছে না, কিচ্ছুনা! আমি মনে করতে চাই সব!”

রুশি কান্না জড়িত কন্ঠে বলতে লাগলো, তারপর মাথা চেপে ধরে বসে রইলো। সায়ান সেই কতোক্ষণ ধরে ডাকছে কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই। একসময় রুশি জ্ঞান হারালো!

কেবিনে ডাক্তার রুশির চেকয়াপ করছে আর সায়ান বাইরে মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রুশি ওকে ভুলে গেছে এটা এতো চেয়েও মানতে পারছে না,কিছুতেই না। এতোদিনের সকল ধৈর্য রুশির ওই অবাক চাহনিতে যেনো গলে গেছে, রুশির ওর দিকে এমনভাবে চেয়ে আছে যেনো কোন বাইরের মানুষ ও! ভালোবাসার মানুষের এই চাহনি সহ্য করা বড্ড কষ্টের!ও পারেনি সে কষ্ট সহ্য করতে!ডাক্তার বেরিয়ে এসে হতাশার স্বরে বললো

“পেইশেন্টের মাত্র জ্ঞান ফিরেছে, এই মুহুর্তে তাকে পুরোনো স্মৃতি মনে করানোর চেষ্টা করা একদম ঠিক হয়নি!যদিও পেইশেন্টের আপাদত তেমন ক্ষতি হয়নি তবে নেক্সটাইম এমন হলে তাকে হয়তো বাঁচান যাবে না। আমি রিকোয়েস্ট করছি আপনাদের, এই ভুল আর করবেন না, নাহয় পেইশেন্টকে আর বাঁচানো যাবে না”

ডাক্তার চলে যাওয়ার পর সায়ান বাইরে থেকে রুশির দিকে তাকিয়ে আছে,নিজেকে কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে! ও বড় একটা বোকামি করে ফেলেছে যাতে রুশির অনেক ক্ষতি হতে পারতো!সায়ানের ভাবনার মাঝেই ওর প্রিয় আন্টি ওর কলার চেপে ধরে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো

“আমি জানি সায়ান তুই রুশিকে অনেক ভালোবাসিস!সবার থেকেই বেশি হয়তো কিন্তু তাই বলে মা হিসেবে নিজের মেয়ের ক্ষতি মেনে নিবো না। তোর জন্য অনেক বড় কিছু হয়ে যেতো সায়ান, তুই রুশিকে ঠিকভাবে প্রোটেক্ট করতে পারবিনা। তাই আমি চাই তুই তার থেকে দূরে থাক!”

তারপর সে মিসেস খানের দিকে তাকিয়ে বললেন

“আমি জানি আপা আমি নিষ্ঠুরের মতো কাজ করছি! কিন্তু মা হিসেবে আমার কিছু করার নেই।আমি চাই রুশিকে নিয়ে দেশের বাইরে চলে যেতে চাইছি, রুশির অবস্থার উন্নতি হলে নিজে তাকে আবার ফিরিয়ে আনবো। কারণ আমরা জানি ও সায়ানের আমানত, খান বাড়ির বউ। দরকার হয় আবার বিয়ে দিবো আর প্রোটেক্টও করবো যাতে অন্যকোন কিছুতে না জড়ায় কিন্তু এখন ওকে এখানে রাখা সেফ মনে হচ্ছে না। সায়ানের নিজের উপর কন্ট্রোল নেই তাই ও চাইতেও কিছু করে ফেলতে পারে!আমার এটা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।”

“নাহ! তুমি কি বলছো তা বুঝতে পারছো আন্টি! এর থেকে ভালো আমায় মেরে ফেলো আমি কিছু বলবো না। তবুও রুশিকে নিওনা, আমি এমন কিচ্ছু করবো না আর সত্যি বলছি!”

সেদিন সায়ানের সকল পাগলামোও রুশিকে নিজের কাছে রাখতে পারে নি, রুশির বাবা-মা জোর করে তাকে নিয়ে চলে গেছে আর কোথায় নিয়ে গেছে তা কেউ জানেনা। যদিও সায়ানের ধারণা তারা লন্ডনে আছে! সায়ান সাথে সাথেই হয়তো যেতে পারতো সেখানে কিন্তু মেয়ের কথা ভেবে যায়নি,মেয়ে কয়েকবছরের হোক তবেই ও যাবে রুশিকে খুঁজতে আর বাবা মেয়ে মিলে তাদের মাকে মানিয়ে দেশে নিয়ে আসবে!মেয়ের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে সায়ান বললো

“তুমি তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে যাও পাখি!তারপর আমরা তোমার মাকে তোমার নানা-নানির থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসবো তারপর নিজেদের কাছে রেখে দিবো!কোথাও যেতে দিবো না”

মেয়েটি বুঝলো কিনা কে জানে?কিন্তু বাবার কথা শুনে খিলখিল করে হেসে দিলো যেনো সব বুঝতে পেরেছে। সায়ান মেয়েকে কোলে নিয়ে হাটতে লাগলো আর ভাবতে লাগলো কবে ওর পাখিটা পড়ে হবে আর কবে ওর ছোট্ট পরীর কাছে যেতে পারবে!

এইটুকু পরে কুঞ্জন থামলো, কান্না করতে করতে ওর হিচকি উঠে গেছে! ও এই মানুষগুলোকে না চিনলেও তাদের কষ্টে যেনো নিজেই কষ্ট পাচ্ছে!এতো কষ্ট এই অনুভুতির ভেড়াজালে?ও পরের পেজ উল্টাতেই দেখে আর কিছু নেই, শেষপর্যন্ত দেখেও কিছু খুঁজে পেলো না। ও থম মেরে বসে রইলো, এরপর কি হয়েছিলো? সায়ান কি রুশিকে খুঁজে পেয়েছিলো? আর ওদের মেয়েটা? সে কেমন আছে এখন?কতো বয়স তার?কি করে জানবে ও এরপর কি হয়েছে?

রুম থেকে বেরিয়ে ও নিজের ঘরে গিয়ে মন বসাতে পারলো। কিভাবে জানবে এরপরে কি হয়েছিলো?ও বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে পড়লো।লন্ডন! বলেছিলো লন্ডন থাকতে পারে!এরমানে লন্ডনে ও জবাব পেতে পারে সব কিছুর!আর বাবাতো লন্ডনেই গিয়েছিলো তাহলে তো আরো সহজ হয়ে যাবে! ও ভেবেই বাঁকা হাসি দিলো।বিড়বিড় করে বললো

“লান্ডান! আম কামিং দেয়ার!”

#চলবে

গুমোট অনুভুতি পর্ব-৪৮ + রহস্যউম্মোচন পর্ব

0

গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_ ৪৮

সায়ান নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হাতের ফসকে ফোন পড়ে গিয়েছে কতোক্ষণ হলো।ও সারা শরীর যেনো অসাড় হয়ে আছে,বেলেন্স রাখতে না পেরে বসে গিয়েছে।মিটিং রুমের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে,সায়ান জামিল খানের অসহায় অবস্থা আগে কোনদিন দেখেনি।সায়ান থরথর করে কাঁপছে, রুশি কি বললো ওগুলো! কি হয়েছে ওর? কোথায় ও?সায়ানের অবস্থা দেখে সাহিল দৌঁড়ে এলো,কোনমতে সায়ানকে দাঁড় করালো। সায়ান অস্ফুট স্বরে বলতে লাগলো

“র্ রুশি!রুশির কাছে যাবো”

এটা বলেই সায়ান ছুটা শুরু করলো, লিফটের বাটন ক্লিক করার পর তা কাজ করছে না। সায়ান সিঁড়ি দিয়ে নামা শুরু করলো, বিশতলা ওর কাছে যেনো কষ্টের মনে হচ্ছে না। সাহিলও বসের পিছু ছুটলো, কয়েকমুহুর্ত পুর্বে ড্রাইভার ফোন করে রুশির ক্রিটিকাল অবস্থার কথা বলেছে আর তাকে এপোলো হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার কথাও । ও সায়ানকে এই খবর দিতেই মিটিং রুমে ঢুকেছিলো কিন্তু ঢুকে বুঝতে পারে সায়ান অলরেডি জেনে গেছে তাই দেরি না করে ড্রাইভারকে ফোন করে বললো গাড়ি রেডি করতে। সায়ান অফিস থেকে বেরিয়েই দ্রুত গাড়িতে উঠলো, ভয়ে শরীর ঘামছে! ও কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছেনা,হসপিটালের সামনে আসতেই সায়ান দৌড়াতে শুরু করলো তারপর রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করলো কিছুক্ষণ পুর্বে কোন ক্রিটিকাল রোগি ভর্তি হয়েছে কিনা! রিসেপশনিস্ট ইমার্জেন্সি সেক্টরের কথা বলতেই সায়ান দৌঁড়ে গেলো সেদিকে আর গিয়েই অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার বের হতে দেখলো। ও তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো

“হাউ ইজ মাই ওয়াইফ?কি হয়েছে ওর!ও ঠিক আছে তো?”

“মিস্টার খান প্লিজ কাম ডাউন!”

সায়ান হুট করেই এগ্রেসিভ হয়ে পড়লো, ডাক্তারের কলার চেপে ধরে বললো

“আপনি আমাকে শান্ত হতে বলছেন?কি করে শান্ত হবো আমি?আমার ওয়াইফ ওইখানে আছে!”

সাহিল দ্রুত সায়ানকে ছাড়িয়ে ডাক্তারের কাছে ক্ষমা চাইলো। ডাক্তার ধীর স্বরে বললো

“আমি আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি!কিন্তু এতো উত্তেজিত হয়ে কোন কিছুর সমাধান সম্ভব নয়। এই মুহুর্তে আমার কথা আপনার শোনা খুব জরুরী! আপনার স্ত্রীর জন্য হলেও আপনাকে শান্ত মাথায় সবটা শুনতে হবে। আপনি নিজেকে প্রস্তুত করুন”

সায়ান হুট করেই শান্ত হয়ে গেলো, মাথা গরম করে কোন কিছুর সমাধান হবে না। ওকে ডাক্তারের কথা মানতে হবে, সাহেল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ও ডাক্তারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো

“আপনি বলতে পারেন যা বলার, আমি প্রস্তুত!”

ডাক্তার অবাকই হলো পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো

“আপনার ওয়াইফের শরীরে পয়জন পাওয়া গেছে আর সেটা সেবন করার মাধ্যমে ওনার শরীরে যায়নি বরং সেটা তার শরীরে লাগার কারণে এমন হয়েছে!এটা খুব রেয়ার একটা ড্রাগ যেটা আমাদের দেশে লিগাল নয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এটা হিউমেন ড্রাগ নয় বরং এনিমেল ড্রাগ। এই ড্রাগ প্রানীদের মিস ক্যারেজে ভুমিকা রাখে,কিন্তু এটা হিউমেন বডিতে গেলে ইন্টারনাল ব্লিডিং ক্রিয়েট করে আর তাতে মিস ক্যারেজের সম্ভাবনা থাকে। আপনার ভাগ্য ভালো যে তার শরীরে কম পরিমাণ ড্রাগ পড়েছে কিন্তু তা ইফেক্টিভ! এইজন্য আপনার ওয়াইফের হাল্কা ব্লিডিং হয়েছে আর মিস ক্যারেজ আপাদত হয়নি তবে আপনাদের কাছে মাত্র কয়েকঘন্টা আছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই ড্রাগটাই আরো কিছু আননোন কেমিক্যাল ইউজ করা হয়েছে যা আমাদের জানা নেই, ল্যাবে পরীক্ষা করার সময়ও আপাদত আমাদের নেই”

সায়ান ডাক্তারের কথা শুনেই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে পড়লো, ঢুকেই রুশিকে অচেতন অবস্থায় দেখতে পেলো। চোখে মুখ কেমন যেনো সাদা হয়ে আছে,যেনো শরীর রক্তশুন্য!ও আৎকে উঠলো আর ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললো

“ওর এই অবস্থা কেনো?কি হয়েছে ওর?”

“ওনার শরীরে ব্লাড ট্রান্সফিউশন হচ্ছে,ওই ড্রাগের কারণে রক্ত বিষাক্ত হয়ে গেছে বিভিন্ন অংশে, তা যাতে পুরো শরীরে না ছড়ায় তাই সেটা ধীরে ধীরে শরীর থেকে সরিয়ে নতুন করে ব্লাড দেয়া হচ্ছে। এতে করে পয়জন একসময় শরীর থেকে চলে যাবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সাইড ইফেক্ট, সেটা শরীরের যা ক্ষতি করার করে ফেলেছে!আমাদের কাছে এই ড্রাগের সঠিক এন্টিডোর নেই কিন্তু যেটা আছে তাতে আমরা যেকোন একজনকে বাঁচাতে পারবো”

“আপনি রুশিকে বাঁচান, আমার সন্তান দরকার নেই। ভবিষ্যতে বেঁচে থাকলে সন্তানের অভাব হবে না। আর যদি নাহয় তবুও কোন সমস্যা নেই, আমরা বেবি এডপ্ট করে নিবো। আপনি জাস্ট আমার ওয়াইফকে বাঁচান ”

“যদি আপনার ওয়াইফকে বাঁচান তবে তার ভবিষ্যতে মা হওয়ার চান্স মাত্র ৩০% যেটা অনেক কম।আমরা তাহলে…”

“স্ সায়ান!”

রুশির কান্নাজড়িত কন্ঠ শুনে সায়ান ফিরে তাকালো আর রুশির পাশে গিয়ে বললো

“তুমি ঠিক আছো?চিন্তা করোনা সব ঠিক হয়ে যাবে আমি আছিতো!”

সায়ান রুশির হাত চেপে ধরতে নিলে রুশি তা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো আর কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো

“আপনি আমার সন্তানকে মেরে ফেলতে চান?দয়া হলো না একটু ওর উপর? কেমন বাবা আপনি?”

“আমি আমাদের বেবিকে অনেক ভালোবাসি রুশি কিন্তু তার থেকে অনেকগুন বেশি তোমাকে!কোন কিছুর বিনিময়ে তোমাকে হারাতে পারবো না,প্লিজ এমন কিছুনা বলোনা”

“আমি এই বেবিটাকে পৃথিবীতে আনতে চাই সায়ান, ওকে আমি সাড়া আটমাস ধরর গর্ভে ধারণ করছি!ধীরেধীরে নিজের মাঝে ওকে বেড়ে উঠতে দেখেছি, আমি কি করে ওকে ছেড়ে দিবো তাও নিজে বাঁচার লোভে?আমি পারবো না, কক্ষনো না। আমি মরে যাবো সায়ান, দয়া করে আমার বাচ্চাকে বাঁচতে দিন। এটা আমার শেষ ইচ্ছে ধরে নেন!”

“তুমি আমাকে এভাবে শাস্তি দিচ্ছো কেনো?মরে যাবো তোমাকে ছাড়া, এরচেয়ে ভালো আমাকে মেরেই ফেলো। জিন্দা লাশ হয়ে থাকার চেয়ে এটাই ভালো! আমি তোমাকে ছাড়া বড্ড অসহায় রুশি, এই অন্যায় আমার প্রতি করোনা”

সায়ানের চোখ দিয়ে পানি পড়া শুরু করলো, বুকের বাঁ পাশে তীব্র ব্যাথা হচ্ছে। রুশি এই অসহায় অবস্থা মেনে নিতে পারলো না তাই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো! তারপর চোখ মুখে খিঁচে বললো

“আমার সন্তান আমার কাছে বেশি ইম্পর্টেন্ট, ও আমার জীবনে প্রথম এসেছে তারপর আপনি। আমি কোনকিছুর মুল্যে ওকে হারাতে পারবো না, আপনার জন্যও না। আমি ওকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসতে চাই, সায়ান আমার আর আপনার মাঝের সম্পর্কের মুল ভিত্তি আমাদের সন্তান! ওকে কি করে হারাতে পারি আমি, আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন ও! আমি বেঁচে যদি নাও থাকি আমাদের সন্তান তাও বেঁচে থাকবে!আমি জানি আপনি অনেক ভালো বাবা হবেন,আমাদের সন্তানকে আমি ছাড়াও বড়ো করতে পারবেন!”

“আমি সন্তান চাইনা রুশি, শুধু তোমাকে চাই তুমি কি বুঝতে পারছোনা?আমার শুধু তোমাকে লাগবে আর কাউকে না, আমার মনের ভিতর জমিয়ে রাখা #গুমোট_অনুভুতি তুমি,আমার প্রথম ভালোবাসা!আমি তোমাকে হারাতে পারবো, তুমি আমার জীবনটা চাইলেও আমি তোমাকে দিয়ে দিবো কিন্তু তার বিনিময়ে তোমাকে দিয়ে দাও প্লিজ!আই বেগ ইউ রুশি ডোন্ট লিভ মি!আমি তোমাকে ছাড়া মরে যাবো সত্যি বলছি, ডোন্ট লিভ মি!”

সায়ানের কান্নাজড়িত কন্ঠ শুনে রুশি নিজেকে ধরে রাখতে পারছেনা, সায়ানের ওর কাছে যেনো নিজের জীবন ভিক্ষা চাইছে! এতো ভালোবাসে কেনো ওকে?ও যে কঠোর হতে পারছে না, ও নিজেও যেতে চায়না কিন্তু এটাই ওর নিয়তি। ও সায়ান হয়তো একসাথে বাঁচার ভাগ্য নিয়ে আসেনি,ও বাঁচতে চায় খুব করে বাঁচতে চায়। সায়ানের জন্য হলেও কিন্তু ওর হাতে সময় নেই। ও কঠোর গলায় বললো

“আপনাকে আমার কসম সায়ান আমার বেবিকে বাঁচিয়ে দেন!প্লিজ”

সায়ান কিছু বলতে পারছেনা, সকল শব্দ গলায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে! ও বুঝতে পারছেনা কি বলবে, রুশির হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে!বিড়বিড় করে বলতে লাগলো

“আমি পারবো না,কিছুতেই পারবো না”

“আমার শেষ ইচ্ছে সায়ান রাখবে না?”

রুশির মুখে তুমি শুনে সায়ান ওর দিকে তাকালো, রুশি মলিন হেসে বললো

“তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো সায়ান! তোমার ছোট্ট পরীর খোঁজ পেয়েছি আমি কিন্তু আফসোস তার হাতে বেশি সময় নেই তাই তোমাকে বলার সুযোগ পাচ্ছে না।সে খুব করে চেয়েছিলো তোমাকে বলতে কিন্তু বলতে পারেনি। জানতে ইচ্ছে করছে না সে কে?”

“না করছে না, আমার কোন কিছুর দরকার নেই শুধু তোমাকে চাই”

“তুমি অনেক বদলে গেছো মিস্টার খান!,পরীকে এতো সহজে ভুলে গেলে?সে তোমার জীবন বাঁচিয়েছে, তার মানে তোমার জীবনটা তোমার নয় বরং তার।”

বলেই রুশি নিজের গলার ভেতরের চেইনসহ লকেট বের করে দেখালো,এটা হসপিটাল থেকে বেরিয়েই পরে নিয়েছিলো। সায়ান এটা দেখে চমকে গেলো, ও জানেনা কিভাবে কি হয়েছে শুধু রুশির কথা শুনে এইটুকু বুঝতে পারছে ওর ছোট্ট পরী আর কেউনা রুশি!ওর মাথায় যেনো সব হিসাব মিলাতে শুরু করলো, রুশি অনাথ আর ও মাধবপুর ছিলো। ওকে ছয়বছর থাকতে সেখান থেকে এডপ্ট করা হয়। আর সবচেয়ে বড় কথা ওর তারাদের সাথে কথা বলা মানে ইন্ডিরেক্টলি ওর সাথে কথা বলা, ওর আগুনে ভয় পাওয়া যার সবচেয়ে বেশি পসিবিলিটিস সেই মেয়ের যে ওর প্রান বাঁচিয়েছিলো। এতো ক্লু সামনে থাকা সত্ত্বেও ও বুঝতে পারেনি যে রুশি ওর ছোট্ট পরী!ও এতোটা কেয়ারলেস কি করে ছিলো?ও বলতে শুরু করলো

“রুশি আমি সত্যিই স্যরি, আমাকে তোমাকে খুঁজে পাইনি। সব আমার জন্য হয়েছে, আজ আমি কোম্পানিতে না গেলেই এমন হতোনা। আমি অনেক বাজে একজন স্বামী!”

“আপনার জন্য কিছু হয়নি বরং আমার বোকামির জন্য হয়েছে! আমার আপনাকে জানিয়ে বডিগার্ড সহ যাওয়া উচিৎ ছিলো! বা আপনার সাথে।না আমি বাইরে যেতাম আর না এমনটা হতো আমার সাথে।”

“তোমার কোন দোষ নেই, আমারই দোষ আমি আগে তোমায় খুঁজে পাইনি।”

“আমাদের বাবুটার খেয়াল রাখবেন আর বিয়ে করবেন না। আমি আমার স্থান কাউকে দিতে পারবো না,সায়ান জামিল খানের ওয়াইফ একমাত্র আমিই থাকবো আর কেউনা।রুশি তার জিনিসে কারো ভাগ দেয়না!বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে মিস্টার খান!”

এরপর রুশির ইশারায় ডাক্তার সায়ানকে বের করে দিলো আর ওটির রুমের দরজা বন্ধ করার আগে বললো

“চিন্তা করবেন না দোয়া করেন, আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো দুজনকে বাঁচানোর।আমার মনে হয় আপনার স্ত্রী বেঁচে থাকবে, সিচুয়েশন অতো ক্রিটিকাল না”

এই কথাটি সায়ানকে আশ্বাস দিলো কিছুটা, রুশি মরবে না, ও বেঁচে থাকবে!ও দেয়ালে ঘুষি মারা শুরু করলো, হাত ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই। ও বিড়বিড় করে বলতে থাকে

“তোমাকে ফিরতে হবে রুশি, ফিরতে হবে তোমাকে!”

সায়ান স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলো ওই মুহুর্তে ওর পরিবারের সবাই আসে সাথে ওর খালা খালুও এমনকি রুশির বাবাও সাথে ছিলো আর ওকে প্রশ্ন করা শুরু করে কিন্তু ও ঠাঁয় হয়ে বসে থাকে! কারো কথা ওর কানে যাচ্ছে না, শুধু ওটির দরজার দিকে চেয়ে আছে! এমন সময় সায়ানের ফোন বেঁজে উঠে, সায়ান পিক না করাতে সাহিল তুলে আর কিছুক্ষণ পর বলে উঠে

“স্যার আপনাকে চাইছে”

“বলো আমি এখন কথা বলতে পারবো না”

“স্যার মেডামের ব্যাপারে কিছু বলবে বলছে!”

সায়ান দ্রুত ফোন তুলে আর বলে উঠে,,,

“কে তুমি?রুশির ব্যাপারে কি বলতে চাও”

“সায়ান আমার কাছে বেশি সময় নেই, রুশির এন্টিডোর আমার কাছে। বহুকষ্টে নিয়েছে তুমি তাড়াতাড়ি হসপিটাল থেকে দুই কিলোমিটার দূরে কাউকে পাঠাও। আমি লুকিয়ে আছি কোন মতো!আর মনে রেখো এই সব কিছুর পেছনে সামাদ খান দায়ী!তুমি সাবধানে থাকো আর রুশিকে সাবধানে রাখো!”

“সামাদ খান?কে সে?”

এটা শুনেই সবার মুখে যেনো আতঙ্ক দেখা দিলো বিশেষত রুশির বাবার চেহারায়!

#চলবে

গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#রহস্যউম্মোচন_পর্ব

রুশির বাবার মুখে আতঙ্কের ছাপ দেখে সায়ান অবাক হলো না, ওর আগে থেকেই সন্দেহ ছিলো রুশির বাবা রুশির অনেক কিছু জানে কিন্তু প্রকাশ করছে না। তবে নিজের পরিবারের বড় সদস্যদের ভয় দেখে ও চমকে গেলো, বিশেষত প্রিয় আন্টির চেহারায় অন্যরকম ভয় ফুটে উঠেছে!তারমানে এটা শুধু রুশির সাথে জড়িত না বরং ওর সাথেও জড়িত। ও সবার দিকে তাকিয়ে বললো

“কি হচ্ছে সবাই কি আমাকে বলবেন প্লিজ?আমি বুঝতে পারছিনা এই সামাদ খান কে আর তার সাথে আমার কি সম্পর্ক!”

রুশির বাবা হুট করেই চেঁচিয়ে উঠলো আর বললো

“আমি এই জন্যই সত্যটা বলতে চাইনি আর না চেয়েছি কেউ সত্য জানুক। কিন্তু নিয়তির থেকে কেউ ফিরতে পারেনা। আমি এই খান পরিবার থেকে রুশিকে দূরে রাখতে চেয়েছিলাম কিন্তু ও সেই পরিবারেই আছে এখন। আমি যদি জানতাম তুমি এই খান পরিবারের সন্তান তাহলে কখনোই রুশিকে তোমার কাছে বিয়ে দিতাম না আর না এই পরিবারের ছায়া পড়তে দিতাম ওর উপর! রুশি আমার আপন মেয়ে না হলেও আমি ওকে নিজের মেয়ে হিসেবে দেখি, যদি তোমার সাথে ওর বিয়ে না হতো তবে না সামাদ খানের নজরে আসতো আর না ওর আজকে মুমুর্ষ্য অবস্থায় থাকতো!”

“কে এই সামাদ খান?আর আমাদের সাথে তার কিসের সম্পর্ক!”

সায়ানের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে ওর মা বলে উঠলো

“সামাদ খান তোমার বাবার ভাই, মানে তোমার আপন চাচা!”

“আমার চাচা?তাহলে আমি কেনো তার সম্পর্কে জানিনা আর আমাদের সাথে তার কিসের শত্রুতা?”

“সামাদ খান জামিলের ছোট ভাই হলেও সে জামিলের বিপরীত ছিলো সম্পুর্ণ। মানুষের ক্ষতি করে সে পৈশাচিক আনন্দ পেতো সবসময়, বিনা কারণে ক্ষতি করতো সবার। তোমার দাদা সেটা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন আর কোম্পানির কথা চিন্তা করে তোমার বাবাকে কোম্পানির সিইও বানান। এটা তার সহ্য হয়নি তাই নানা ভাবে তোমার বাবা আর আমার ক্ষতি করতে চাইতো কিন্তু আমরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই। এরপর তার নজর পড়ে প্রিয়ানার উপর কিন্তু ততদিনে প্রিয় আর শাহিন একে অপরকে পছন্দ করতো তাই আমরা তাদের বিয়ে ঠিক করি। এটা সে সহ্য করতে পারেনি তাই প্রিয়কে রেপ করতে চায় কিন্তু আমরা বুঝে গিয়ে বাঁচিয়ে ফেলি। তোমার দাদা তখনো বেঁচে ছিলো, তিনি সামাদকে কিছু সম্পদ দিয়ে তাকে ত্যাজ্যপুত্র করে দেয় কিন্তু সামাদ আমাদের পেছনে পড়েই ছিলো।আর তোমার বাবাকে ড্রাগস দিয়ে এক নারীর সাথে মিথ্যে স্ক্যান্ডালে ফাঁসিয়ে দেয়, ওই মেয়ে তোমার বাবাকে ব্ল্যাকমেইল করতো আর তোমার বাবা কিছুই করতে পারতো না”

“তুমি বিষয়টি জানতে?”

“হুম জানতাম! সেই ছবির সবার আগে আমার ফোনেই এসেছিলো আর আমাদের মাঝে ঝামেলা হয় এটা নিয়ে খুব বেশি। আমি তাকে ভুল বুঝি আর এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দেইনি। তার মধ্যে তুমি হঠাৎ হারিয়ে গেলে, সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে সেদিন তারা সেই আশ্রমে তোমাকে মারতে চেয়েছিলো কিন্তু একটা মেয়ে তোমাকে বাঁচায়!তোমাকে বাঁচানোর জন্য মেয়েটিকে সাথে নিয়ে আসতে পারিনি কিন্তু মেয়েটির জন্যই তুমি বেঁচে আছো!”

“আর ওই মেয়েটি হচ্ছে রুশি!ওই আশ্রমে ওই ছিলো সেদিন যে আমাকে বাঁচিয়েছে!”

“সেটা রুশি ছিলো?যাক এতো বছর আমরা তাকে খুঁজে পেয়েছি! তোমার বাবা শুনলে খুব খুশি হতেন। আমি তার প্রতি বড্ড অন্যায় করেছি সায়ান, সামাদ আমাদের মাঝে ভুলবুঝাবুঝি সৃষ্টি করতে চেয়েছে আর আমি সেই সুযোগ তাকে দিয়েছি। তোমার বাবা সব প্রেশার নিতে না পেরেই ওপারে চলে গেছে! আমি বড্ড অন্যায় করেছি তার সাথে”

সায়ান মাথানিচু করে ফেললো, ওর বাবার আসলে কোন দোষ ছিলো না। সে পরিস্থিতির স্বিকার ছিলো আর আমি তাকে ভুল বুঝেছি!আমি আমার বাবাকে অসম্মান করেছি, তাকে ঘৃণা করেছি। বড্ড অন্যায় করে ফেলেছি তার সাথে! আমি সত্যিই স্যরি বাবাই!”

সায়ানের ভাবনার মাঝেই ওর প্রিয় আন্টির ধরা কণ্ঠে বললো

“ওই সামাদ খান শুধু এইটুকু করে ক্ষান্ত হয়নি!বিশবছর পুর্বে ও আমার সন্তান কেড়ে নিয়েছে আমার থেকে। আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে, নাহয় আজ আমার সন্তান বেঁচে থাকতো আর কতো বড় হয়ে যেতো!”

প্রিয়ানা ঢুকরে কেঁদে উঠলো আর শাহিন জামান তাকে সামলে নিলো। রুশির বাবা এতোক্ষন সব শুনার পর মুখ খুললো আর বললো

“আপনি সামাদ খানের ভাইয়ের শালিকা তাহলে!আমাকে ক্ষমা করবেন, আপনার সন্তান আপনার থেকে দূরে যাওয়ার একটা কারণ আমি!রুশি সায়ানের বউ,ওর পরী এইসব বাদেও আরেকটা পরিচয় আছে তার!সে সামাদ খানের ভাইয়ের বন্ধুর মেয়ে মানে আপনাদের মেয়ে। পরী জামান!”

সবাই যেনো শকের মধ্যে চলে গেছে! রুশি ওর খালাতো বোন!সায়ান কি করবে বুঝতে পারছেনা, এতোগুলো সম্পর্ক ওর সাথে রুশির!ও হঠাৎ করেই রুশির বাবার দিকে তাকিয়ে বললো

“আপনি এতোকিছু কি করে জানেন আর সামাদ খানকে কি করে চিনেন?”

“আমি তার অফিসের এমপ্লয়ি ছিলাম একসময় কিন্তু স্বল্প বেতনে। আমার বউ বড্ড বিলাসিতা করতো কিন্তু তা মেনেজ করতে আমি হিমশিম খেতাম! তাই সামাদ খানের ইল্লিগাল কাজে জড়িয়ে পড়ি। যখন বুঝতে পারি তখন বের হওয়ার রাস্তা ছিলো না, একদিন সে আমাকে ফোন করে হসপিটালের সামনে যেতে বলে আর আমি গেলে একটা বাচ্চা ধরিয়ে দেয় আর বলে মেরে ফেলতে। আমি চমকে উঠি, নিজেকে সামলে বলি যে কে এই বাচ্চাটি? তখন সে বলে তার ভাইয়ের বন্ধুর মেয়ে, আমি আর জিজ্ঞেস করার সাহস পাইনি। কিন্তু বাচ্চাটিকে মারার ক্ষমতা আমার ছিলো না, আমি তাকে শহর থেকে দূরে মাধবপুর চাইল্ড কেয়ারে রেখে আসি তার গলায় থাকা লকেট সহ যাতে লিখা ছিলো ছিলো পরী!আমি প্রায়ই খোঁজ নিতাম সেখানে গিয়ে, একসময় সেই আশ্রমের সংকট দেখে পরীকে নিজের মেয়ে রুশি বানিয়ে নিয়ে আসি!তারপর ও আমার মেয়ের পরিচয় বড় হয়।আমি চেষ্টা করেছি সামাদ খানের ছায়াও যেনো ওর উপর না পড়ে কিন্তু সেই না চাওয়া ঘটনাই ঘটলো!

প্রিয় আন্টি তখন কাঁপা গলায় বলে

“তাহলে আমার ছেলে?আমার ছেলে কোথায়?”

“আপনার ছেলে কে?আমি এই ব্যাপারে কিছু শুনিনি”

“আমার সেদিন জমজ বেবি হয়েছিলো আর তখনি সামাদ খান হসপিটালে এটাক করে আর দুটো বেবিকেই নিয়ে যায়।ওর গলায়ও একটা লকেট ছিলো যাতে ওর নাম লিখা ছিলো শাহেদ জামান।ও কোথায় তাহলে? ওকেও কি মেরে ফেলেছে?”

সায়ানের কথার মাঝেই চন্দ্রিকা ঢুকলো, ওর গায়ে রক্ত লেগে আছে।ও তাড়াহুড়া করে সায়ানের দিকে এগিয়ে এসে বললো

“সায়ান এটা হচ্ছে এন্টিডোর, জানিনা কতোটুকু কাজ করবে এখন কিন্তু তাও ডাক্তারদের দাও। ”

সাহিল দ্রুত সেটা নিয়ে সেখানে ছুটলো এদিকে সায়ান চন্দ্রিকার দিকে তাকিয়ে বললো

“তুমিও সামাদ খানকে চিনো”

“নিজের জন্মদাতাকে কি করে না চিনবো বলো?”

“তুমি সামাদ খানের মেয়ে?”

“হুম! আমার মাকে বিয়ে করে তাকে ছেড়ে চলে যায় আর আমাকে অনাথ বানিয়ে দিয়েছে। আমার বয়স যখন সাড়ে চার তখন সে আমাকে এসে ভুলভাল বুঝায় আর নিজের সাথে নিয়ে যায়। আমিও অন্ধ ছিলাম তার কথা বিশ্বাস করি! এরপর তোমাকে ফাঁদে ফেলে আর আমাকে মিথ্যে পরী বানিয়ে তোমার কাছে পাঠায় যা আমি নিজেও জানতাম না। নিজের কাজের জন্য প্রতিনিয়ত ব্যাবহার করে, যখন বুঝতে পেরে ফিরে আসতে চাই তখন অন্ধকার রুমে আমাকে কুকুরের মতো আচরণ করে রাখে। আর ব্লেকমেইল করে আমার সেই ছবি ভাইরাল করে দিবে, আমি ভয় সে যা করতে বলে তাই করি। তুমি আমার খোঁজ কখনোই নিতে না তাই তুমি জানো না কিছুই! এরপর আমি যখন প্রেগন্যান্ট থাকি তখন আমার বেবিকে মেরে ফেলেছে, আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে ওই জঘন্য লোকটা। কিন্তু রুশির সাথে একই কাজ হোক আমি তা চাইনি, অন্তত এইটুকু করেও যদি নিজের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি!”

#চলবে

গুমোট অনুভুতি পর্ব-৪৫+৪৬+৪৭

0

গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_ ৪৫

ভার্সিটির লাস্ট সেমিস্টার পরিক্ষার শেষ দিন ছিলো আজ,পরিক্ষা শেষে সবাই নিজ নিজভাবে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে। রুশি ধীর পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো, প্রেগন্যান্সির ছয় মাস চলে বর্তমানে কিন্তু এক্সাম মিস করতে চায়নি তাই এসেছে ভার্সিটিতে! সায়ানকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে, এমনকি সায়ান নিজে ওকে ভার্সিটি পৌঁছে দেয় আর গাড়িতে ওর জন্য ওয়েট করে! সায়ান ভেতরে সিটে বসিয়ে দিয়ে আসতে চেয়েছিলো কিন্তু রুশি কোন প্রকার সমালোচনা চায়না এমনকি এটাও শুনতে চায়না যে সায়ানের মাধ্যমে এক্সামে ভালো করেছে!

প্রেগন্যান্সির মাত্র ছয়মাস চলে বিদায় পেট বেশি উঁচু হয়নি এখনো তাই এখনো অতটা বুঝা যায় না আর শীতকালের গরম স্যুয়েটার পরার কারণেও আরো বুঝতে পারে না। সায়ান যদিও বডিগার্ড পাঠাতে চেয়েছিলো কিন্তু রুশি তাতেও রাজি হয়নি,খামোকা লাইমলাইট নিয়ে কি লাভ?সায়ান গাড়িতে বসে এসবই ভাবছিলো, এই মেয়েটা তার কোন কথা শুনেনা। ডক্টর বলেছে সাবধানে থাকতে আর ওর সেসব যেনো মাথায়ই নেই।সায়ান চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে গেটের দিকে, একে একে সবাই গেট দিয়ে বের হচ্ছে কিন্তু রুশির নাম নিশানা দেখছে না তাই সায়ান গাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো!

এদিকে রুশি চোখ মুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে,কিছুক্ষণ পুর্বে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় নিজের ড্রেসের সাথে বেঝে পড়ে যাচ্ছিলো কিন্তু একটা ছেলে ওর হাত ধরে ফেলে যাতে ও বেঁচে যায়। আজ পড়ে গেলে কি হতো তাই ভেবে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো ওর!আরো কয়েক সিঁড়ি বাকি ছিলো তাই ভয়টা আরো বেড়ে গেলো, সেইদিনের সিঁড়ির ঘটনা এখনো মনে পড়লে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায় ও। রুশি ঠিক হয়ে দাঁড়াতেই ছেলেটি কোন প্রকার কথা না বলে হাঁটা শুরু করলো, রুশি তার পেছনে ছুটলো। তার কিছুটা পেছনে থেকেই বললো

“একটু দাঁড়াবেন? আপনার সাথে ম্যাচ করে হাটতে পারছিনা”

ছেলেটি দাঁড়িয়ে পড়লো আর পেছনে ফিরে রুশির দিকে তাকালো। রুশি তার কাছে খুব দ্রুতই পৌঁছে গেলো তারপর হাপাতে হাপাতে বললো

“থ্যাংকস আজকে আমাকে বাঁচানোর জন্য, আপনি না থাকলে আসলে কি হতো আমি জানিনা”

ছেলেটি মাথা নেড়ে চলে যেতে নিয়েও কি মনে করে পেছনে ফিরে বললো

“এই অবস্থায় এভাবে চলাফেরা না করলেই তো পারেন। আপনার হাজবেন্ড কি কিছু বলে না আপনাকে?হাউ ইরেস্পন্সিবল!সবসময় আপনাকে বাচানোর কেউ থাকবে না তাই চলতে না পারলে বাসা থেকে বের হবেন না প্লিজ!”

রুশি মাথা নিচু করে ফেললো,আশ্চর্যের বিষয় হলো ছেলেটার টোনে কোন প্রকার তাচ্ছিল্য ছিলো না বরং কন্সার্ন ছিলো! রুশি মুচকি হেসে বললো

“ওকে!আপনি কি এখানেই পড়েন?”

“হুম এবার সেকেন্ড ইয়ারে উঠবো, আজ এক্সাম শেষ হলো।”

“ওহ আমরা একই ইয়ার! কোন ডিপার্টমেন্ট?”

“ভেটেনারি ডিপার্টমেন্ট যেটা আপনারও”

“আপনি মানে তুমি আমার ক্লাসের? আর আমি কখনো নোটিসই করিনি!”

“মেয়েদের নোটিস করোনা আর তো ছেলে!”

“ওহ হয়তো! তাহলে থ্যাংকস হিসেবে এক কাপ কফি তো খাওয়াই যায় তাও আমার ট্রিটে!”

“খেতে পারি তবে যদি আপনার হাজবেন্ড রাজি হয়!”

বলেই অন্যদিকে ইশারা করলো, রুশি সেদিকে তাকিয়ে সায়ানকে দেখতে পেলো। ওর মুখে হাসি ফুটে উঠলো কিন্তু সায়ান এসেই সেই ছেলেটিকে হুট করে ঘুষি মারলো। আচকমা ঘটনায় রুশি থমকে গেলো, সায়ানকে থামানোর কথা ভুলে গেলো মুহুর্তের জন্য। সায়ান ছেলেটিকে মারলেও ছেলেটি উল্টা মারলো না এমনকি ডিফেন্স পর্যন্ত করলো না। তার ঠোঁটের কোনে হাসি লেগেই আছে। রুশি গিয়ে সায়নকে থামাতে লাগলো কিন্তু থামাতে পারছে না। রুশি চিল্লিয়ে বললো

“সায়ান প্লিজ স্টপ!ও একটু আগে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছে সো প্লিজ স্টপ!”

সায়ান কিছু সময়ের জন্য থেমে গেলো তারপর আরো জোরে মারতে শুরু করলো আর বললো

“হাউ ডেয়ার ইউ!তুমি ওকে টাচ করলে কি করে?ওর দিকে নজর দিলে কি করে তুমি?ও শুধু আমার!তোমাকে ওই চন্দ্রিকা পাঠিয়েছে তাইনা?আবার নতুন করে কোন প্লট করছো তোমরা! এবার যদি ওর দিকে এতোটুকু আঁচ আসে না জিন্দা পুতে ফেলবো তোমাদের দুজনকে বলে দিলাম!”

রুশি এতোক্ষনে বুঝতে পারলো সায়ানের রেগে যাওয়ার মানে, এই ছেলের চন্দ্রিকার সাথে কোন কানেকশন আছে নিশ্চই! রুশি সায়ানকে ছাড়িয়ে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া ধরলো আর সেই ছেলেকে ঠোঁটের ইশারায় স্যরি বললো যা দেখে সে হাসলো তারপর চিল্লিয়ে বলতে লাগলো

“মিস.রুশি! কফির অফার মনে রাখবেন কিন্তু আর হ্যা আমার নাম শাহেদ… শাহেদ নওয়াজ!ডোন্ট ফরগেট দেট!”

সায়ান তেড়ে আসতে চাইলেও রুশি দিলো না, দ্রুত গাড়িতে নিয়ে বসালো। সায়ান জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো হয়তো রাগ থামানোর চেষ্টা করছে। সায়ানের যতই রাগ থাকুক সেটা রুশির সামনে কখনো ও প্রকাশ করেনা কারণ একসময় ওকে কেউ একজন বলেছিলো “নারীরা ফুলের মতো,তাদের উপর জোর প্রয়োগ করলে নষ্ট হয়ে যাবে”

তাই সায়ান নিজের জেন্টেল সাইড সমসময় রুশিকে দেখায়,সায়ান রুশির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো

“তুমি আর ওই ছেলের সাথে কখনো মিশবে না, চন্দ্রিকার ছায়াও তোমাদের উপর পড়ুক সেটা আমি চাইনা। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড!”

রুশি মাথা নাড়লো, যদিও ছেলেটিকে খারাপ মনে হয়নি তবুও সায়ানের কথায় যুক্তি আছে, আর যাইহোক চোখের দেখা ভুলও হতে পারে।

_______________________

হাই স্পিডে হাইওয়েতে গাড়ি চালাচ্ছে শাহেদ! ঠোঁটের কোনে রক্ত জমে আছে, শরীর এমনকি চেহারার অনেক জায়গাও জখম হয়ে আছে! ওর ঠোটের কোনে মৃদু হাসি!আজকে সায়ানের রিয়াকশন দেখে অনেক খুশি ও। সেই রাগ, সেই জেলাসি দেখেছে ও সায়ানের চোখে যেটা একদিন ওর চোখে বিরাজ করতো!গাড়ির স্টেয়ারিং চেপে ধরে বিড়বিড় করে বললো

“নিজের স্ত্রীর সাথে অন্যকেউকে দেখে জ্বলেছে তাইনা সায়ান? আমারো জলতো যখন আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটি তোমার কাছে থাকতো আর তোমাকে নিয়ে ভাবতো। তোমাকে পেতে চাইতো, আমি শুধু তোমাকে বুঝাতে চেয়েছি যাকে তুমি ভালোবাসো তাকে অন্য ছেলের সাথে হেসে কথা বলতে দেখলে কতোটা খারাপ লাগে!”

শাহেদ নিজের ফ্লাটে পৌঁছে চাবি দিয়ে দরজা খুললো আর চন্দ্রিকাকে সোফায় বসে টিভি দেখতে দেখলো।চন্দ্রিকা ওকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো তারপর এগিয়ে এসে বললো

“এই অবস্থা হলো কি করে?কোন এক্সিডেন্ট করেছেন নাকি?”

“নাহ তোমার সায়ান আমার এই হাল করেছে।”

“সায়ান হঠাৎ এমন করবে কেনো?কি হয়েছে আপনাদের মাঝে?সায়ান হুট করে এমন মারামারি করার মানুষ তো না!”

শাহেদ কথাটা হজম করতে পারলো না,চন্দ্রিকার হাত চেপে ধরে নিজের কাছে এনে বললো

“নিজের সায়ানের প্রতি এতো বিশ্বাস অথচ সে তোমাকে মাঝ রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে। আর শুনো আমি ডিফেন্স করিনি পর্যন্ত, নিজের বউয়ের সাথে কথা বলা দেখে সহ্য হয়নি তার!”

কথার মাঝেই চন্দ্রিকা হুট করে ঠোঁটের কাটা জায়গায় চাপ দিলো

“আহহহহ পাগল নাকি?”

“ওহ আপনি ব্যাথাও পান?”

“কেনো আমাকে মানুষ মনে হয়না?”

“তা না আসলে আপনি ডিফেন্স করেননি যেহেতু তার মানে ব্যাথা পাননা। যাইহোক আপনি এইটুকুন একটা ছেলে হয়ে সায়ানের সাথে পেরে উঠতেন না। ”

“ওহ হ্যালো! কারাঠে চ্যাম্পিয়ন আমি। তোমার আমার সাথে জীবনেও পারতো না যদি আমি লড়তাম। আর এইটুকুন ছেলে মানে কি?তোমার থেকে বড় আমি, হ্যাভ সাম রেস্পেক্ট!”

“হাহ আমাকে আপনার থেকে আর কতো বড়ো?দেখতে তো আমার ছোটই মনে হয়, বাইরে গেলে বলবে আপনি আমার ছোট ভাই!”

“আমি তোমার ছোট ভাই!এই তুমি সাইজ দেখছো তোমার?এইটুকুন মেয়ে!আবার আমাকে ছোট বলো, আমাকে মোটেও ছোট মনে হয় না বরং আমাকে বড়ই দেখা যায়।বাজে বকবা না”

“শুনুন যতই বড়ো দাবি করুন নিজেকে আমার কাছে ছোটই লাগে আপনাকে। তাইতো আপনার সাথে একই ফ্লাটে থাকতে হেজিটেশন ফিল হয়না কারণ আপনি ছোট ভা…”

চন্দ্রিকার কথার মাঝেই শাহেদ একদম কাছে এগিয়ে গেলো, ওদের ঠোঁটের মাঝে হয়তো কয়েক ইঞ্চি পার্থক্য। শাহেদ চন্দ্রিকার কানের সামনে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো

“আরেকটু কাছে আসলে কিন্তু আমাকে আর ছোট মনে হবে না, বেশি ছোট ছোট বললে বড়দের মতো কিছু করতে ইচ্ছে। তাই আমাকে অযথা ক্ষেপিও না, নাহয় আমি কিন্তু মানুষটা ভালো নই!”

বলেই চন্দ্রিকাকে ছেড়ে নিজের রুমে চলে গেলো আর চন্দ্রিকা জোরেজোরে শ্বাস নিতে লাগলো। নিজের হার্টবিট যেনো নিজেই শুনতে পাচ্ছে এমন অবস্থা, আগে যদিও শাহেদ ওকে জড়িয়ে ধরেছিলো কিন্তু আজকে অন্যরকম ছিলো! কেনো এমন লাগছে নিজেও বুঝতে পারছে না তবে আজকে শাহেদের কাছে আসা খারাপ লাগে নি ওর। ও হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নিলো!

#চলবে

গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_ ৪৬

“ আমি যার শিয়রে রোদ্দুর এনে দেবো
বলে কথা দিয়েছিলাম
সে আঁধার ভালোবেসে রাত্রি হয়েছে ।
এখন তার কৃষ্ণ পক্ষে ইচ্ছের মেঘ
জোনাকির আলোতে স্নান করে,
অথচ আমি তাকে তাজা
রোদ্দুর দিতে চেয়েছিলাম ”
~রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ~

আকাশ জুড়ে তারাদের বিশাল মেলা বসেছে, জ্বলজ্বল করে উঠছে সারা আকাশ জুড়ে যেনো আকাশের মনে কতো সুখ!হয়তো কাউকে পাওয়ার খুশিতে কিংবা কারো স্মরণে!রুশিও আজ হঠাৎ কারো স্মরণে মশগুল,আকাশের তারা গুনার বৃথা খেলায় মেতে আছে, একপাশ থেকে কিছু গুনে অপরপাশে গেলেই যেনো সব গুলিয়ে যায় তবুও বিরক্তির রেশ মাত্র নেই তার মাঝে যেনো অদ্ভুত এক মজার খেলায় মত্ত সে!

সায়ান ধীর পায়ে রুশির কাছে দাঁড়ালো, তারপর হুট করে কাঁধে হাত রাখলো। রুশি কিছুটা হচকিত হয়ে কেঁপে উঠলো কিন্তু পরক্ষনেই বুঝতে পেরে স্বাভাবিক হয়ে গেলো।সায়ান রুশির কাঁধে নিজের থুতনি রেখে নিজের শরীরের কিছুটা ভার ছেড়ে দিলো, কানের কাছে ফিসফিস করে বললো

“মিসেস খান এতো মনোযোগ সহকারে কি দেখে?”

সায়ানের এই মৃদু আওয়াজে রুশি কেঁপে উঠলো, সারা শরীর জুড়ে আলাদা শিহরণ বইছে। ও চোখমুখ খিচে বললো

“কিছুই করছিলাম না,ব্যাস আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম”

“তারা গুনছিলে?”

“ওই বৃথা চেষ্টা আরকি!তবে এতে বিশেষ মজা পাওয়া যায় জানেন।কারণ আপনি এর শেষ পরিণতি জানেন যে যতই চেষ্টা করুন না কেনো তারা গুনা সম্ভব নয় তবুও গুনা আরকি!”

“যেটা পারবে না তাতে বৃথা চেষ্টা করে কি লাভ?”

“ওইযে বললাম মজা পাওয়া যায়, অদ্ভুত এক শান্তি। নিজেকে বলা যায় আমি চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু! জানেন এই আকাশ দেখলে আমার একজনের কথা মনে পড়ে, খুব বেশি মনে পড়ে। আগে রোজ তার সাথে কথা বলতাম কিন্তু এখন বলি না তবে তারাদের দিকে তাকিয়ে থাকতেও ভালো লাগে। যেনো তাকে ফিল করি।তবে মজার বিষয় হচ্ছে আমার তার চেহারা পর্যন্ত মনে নাই, আর না তার সাথে কাটানোর কোন স্মৃতি! তবুও আমি তাকে যেনো ফিল করি, মনে হয় সে খুব কাছের কেউ।কিন্তু তাকে কিছুতেই মনে করতে পারিনা,কিছুতেই না!”

সায়ান রুশিকে ছেড়ে দিয়ে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, যদিও জানে সেই মানুষটি রুশির জীবনে নেই আর আসবেও না তবুও ও জেলাস না হয়ে পারছেনা, একটা মানুষ রুশির অনেক প্রিয় এটাই যেনো মানতে পারছে না। ও গম্ভীর গলায় বললো

“এখন তারাদের সাথে কথা বলো না কেনো?”

“আমি আসলে তারাদের সাথে কথা বলতাম না বরং তারাদের মাধ্যমে তার সাথে কথা বলতাম।নিজের প্রতিদিন করা সবকিছু শেয়ার করতাম। কিন্তু কেনো যেনো মনে হয় আমার কথাগুলো তার কাছে যায়না, তার কোন সময়ই নেই আমার পেছনে ব্যয় করার আর না আমার আছে আমার জমানো কথা শুনার সময়! আমিই শুধু মরীচিকার পেছনে ছুটছি। তাই আমার বড্ড অভিমান হয়েছে! আমি আর তার সাথে কথা বলতে চাইনা”

রুশির মুখ জুড়ে হঠাৎ করেই কালো ছায়া নেমে আসলো,খুব বেশি অভিমানে তারাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো যা সায়ানের চোখ এড়ালো না, ও শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো

“তাকে খুব বেশি মনে করতে চাও?”

“হুম অনেক বেশি করে চাই! আমক শুধু একটাবার দেখতে চাই সে কেমন দেখতে,তার কণ্ঠস্বর শুনতে চাই!”

সায়ান আর কিছু ভাবতে পারলো না, মনে হলো আজ যদি ও নিজের মনের কথা রুশিকে না বলে তাহলে তাকে হারিয়ে ফেলবে!রুশিকে নিজের দিকে ফিরালো তারপর ওর হাত নিজের বক্ষপিঞ্জরের বাঁ পাশে রেখে বললো

“এভাবে আমার সামনে অন্যের প্রতি নিজের অনুভুতি জাহির করোনা মিসেস খান, এই বাঁ পাশটায় বড্ড কষ্ট হয়। আমি জানি আমি হয়তো বড্ড অহেতুক কাজ করছি কিন্তু ওই অদৃশ্য মানবের প্রতি আমি জেলাস না হয়ে পারছিনা। আমি মেনে নিতে পারছিনা আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটি অন্যকাউকে এতোটা মিস করছে বা তাকে দেখতে চাইছে!আমি সত্যিই মানতে পারছেনা কারণ আমি তার মনের এইটুকু ভাগও অন্যকাউকে দিতে চাইনা, আমি কি বড্ড সেল্ফিশ হয়ে যাচ্ছি রুশি?”

“সায়ান আপনি ভুল ভাবছেন, আমি তাকে সেভাবে দেখি না জাস্ট…”

সায়ান রুশির ঠোঁটে আলতো করে আঙ্গুল দিয়ে বললো

“হুশশশ আমাকে শেষ করতে দাও! জানিনা আবার সাহস জুগিয়ে বলতে পারবো না তাই আজ বাঁধা দিও না। রুশির আমার জীবনে সামু আর মাম্মাম ব্যতীত আমি কোন নারীর সাথে ক্লোজ ছিলাম না, চন্দ্রিকার সাথেও না। ও আমার জীবনে নিতান্ত দায়িত্ব ছাড়া আর কিছুই ছিলো, আমি তোমার সাথে দেখা হওয়ার আগের দিন পর্যন্তও সেই দায়িত্ব পালনে মশগুল ছিলাম। কিন্তু তুমি এসে আমার জীবনের সবকিছু বদলে দিয়েছো, আমাকে বুঝিয়েছো ভালোবাসা আর দায়িত্বের মাঝে পার্থক্য কোথায়? আমি অন্যকাউকে কখনো এতোটা মিস করিনি যতোটা তোমাকে ওইসময় প্রতিটা দিন করতাম,বুকের ভিতরের চিনচিন ব্যাথা করতো তোমায় আশেপাশে না দেখলে। তাই তোমার থেকে দূরে থাকতে চেয়েছি কিন্তু এক সপ্তাহও পারিনি, ওই একসপ্তাহ আমার আমার কাছে একযুগ মনে হয়েছিলো! লাভ এট ফার্স সাইট এ বিশ্বাস করো? আমিও করতাম না যদিনা সেইদিন অফিসে তোমাকে দেখতাম, হুট করেই মনে হয়েছিলো আমার হার্টবিট বেড়ে গিয়েছে প্রচণ্ড! নিজের বুকের মাঝের থপথপ শব্দ নিজেই যেনো শুনছিলাম, তারপর প্রথম কোন নারীকে কোন হেজিটেশন ছাড়াই জড়িয়ে ধরেছিলাম সেদিন! নিজেকে যেনো নিজেই চিনতে পারছিলাম না। যদি তোমার ভাষায় বলি তবে বলবো প্রথম দেখায় তোমার মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম,বন্ধু হিসেবে নয় প্রেমিক হিসেবে!প্রচণ্ড ভালোবাসি তোমায়, বিনিময়ে বেশিনা এইটুকু ভালোবাসা কি পেতে পারি?”

রুশির চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো, ঠোঁটের কোনে যেনো বিশ্বজয়ের হাসি ঝুলছে। সায়ানের এগিয়ে এসে হুট করেই ওর বুকে কিল বসাতে শুরু করলো আর বলতে লাগলো

“না পেতে পারেন না, এতো দেরি করলেন কেনো বলতে?কতোদিন ধরে অপেক্ষা করছি জানেন?”

“স্যরি আসলে আগে বলার সাহস পাইনি,আমার কার এক্সিডেন্টের পুর্বে আমি এটাই বলতে এসেছিলাম যে আমি তোমাকে চাই, আমাদের বেবিকে একসাথে বড় হতে দেখতে চাই কিন্তু তার পুর্বেই তুমি ডিভোর্সের কথা বললে আর আমারও বলা হলো না তোমাকে!”

“ইশশশ মিস করে ফেললাম তাইনা?স্যরি!আচ্ছা ওয়েট এটা কি প্রোপোজ ছিলো?কেমন নিরামিষ আপনি!প্রোপোজ করার সময় একটা ফুলও দিলেন না?হুহ এক্সেপ্ট করতে কষ্ট হচ্ছে!”

সায়ান হুট করে বারান্দা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো আর রুশি থমকে গেলো। রুশি কি বেশি বলে ফেলেছে?সায়ান কি রাগ করেছে ওর কথা শুনে! ভাবনার মাঝেই সায়ান হুট করে এসে হাটু গেড়ে বসে পড়লো আর হাতে কতোগুলো তাজা বেলিফুল! হয়তো মাত্রই গাছ থেকে ছিড়ে এনেছে, রুশি হাল্কা হাসলো তা দেখে সায়ান বলে উঠলো

“আমাদের সন্তান আসার পর উইল ইউ মেরি মি এগেইন?”

রুশি মাথা নেড়ে বুঝালো ওর রাজি তাতেই সায়ান নিঃশব্দে হাসলো আর নিজের থাকা ফুলগুলো রুশির হাতে দিলো, রুশি সেগুলো নাকের কাছে ঘ্রাণ নিলো! একসময় বেলিফুল খুব পছন্দের ছিলো ওর কিন্তু সেটা কেমন যেনো বিলীন হয়ে গেছে! আজ আবার নতুন করে এই ফুলের প্রেমে পড়ে গেলো সাথে সামনের মানুষটির উপরও! রুশির ভাবনার মাঝে সায়ান আলতো করে ওর অনামিকা আঙ্গুলে একটা রিং পরিয়ে দিলো খুব সাবধানে যাতে ফুল গুলো না পড়ে যায়, রুশি অবাক হয়ে চেয়ে আছে। সায়ান তা দেখে কিছু বললো না বরং নিজের হাত এগিয়ে দিলো আর রুশি ফুলগুলো পাশের চেয়ারের উপর রেখে সেটা পরিয়ে দিলো আর নিজের হাতের রিং দেখতে লাগলো, এটা প্লাটিনামের রিং যাতে হার্ট খোদাই করা! রুশির জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে সায়ান বললো

“এই রিংটার নাম হচ্ছে ‘কিস এঞ্জেল’ যেটা লং লাস্টিং ভালোবাসার প্রতীক! লন্ডন থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছিলাম এটা তাও তোমাকে ভেবে কিন্তু কখনো দেয়া হয়নি। প্রোপোজ করার দিন ভেবেছিলাম দিবো কিন্তু হয়ে উঠেনি তাই আজ দিলাম। উই আর অফিশিয়ালি এংগেজড মিসেস খান!”

“এটা রিংটা অনেক দামী কিন্তু ভালোবাসার মানুষের উপহার তাই ফেরত দেয়া যাবে না। আমি এটা সবসময় পরে থাকবো কিন্তু আমার কাছে এই শুভ্র বেলিফুলগুলো এই রিং থেকেও অনেক দামী!আর বেলিফুল কিন্তু শুদ্ধ ভালোবাসার প্রতীক তাই এগুলো আমি ভালোবাসার শাক্ষি হিসেবে রেখে দিবো সবসময়!”

রুশির মাথায় হুট করে দুষ্টু বুদ্ধি আসলো, ও সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো

“এইযে আপনি যে আমার প্রতি কমিটেড হয়ে গেলেন এতে অন্যরা অনেক বেশি জ্বলবে না?মানে অন্য মেয়েরা যারা আপনার রুপের ফ্যান! কারণ কৃষ্ণা যেখানে থাকে গপিদের তো অভাব হয়না”

সায়ান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো

“গপিরা থাকলে কি হয়েছে কৃষ্ণা তো শুধু রাধাকে ভালোবাসতো তাইনা?”

“সেটাইতো সমস্যা মিস্টার খান!আমি তো আর রাধা নই রুকমানি”

“শুনো আমার লাইফের রাধা হচ্ছো তুমি আর আমি কৃষ্ণের মতো নই। আমি রাধাকে একদম বিয়ে করে ঘরে তুলেছি দরকার হয় আবার বিয়ে করবো!”

“কৃষ্ণা শুনলে হার্ট এটাক করতো তার প্রেমগাঁথার সাতয়ানাশ করে দিয়েছে কেউ!বেচারা প্রেমের মানে কতো সুন্দর করে বুঝালো আর আপনি কিনা কি ভুলভাল বকছেন!

“একজনকে ভালোবেসে আরেকজনকে বিয়ে করা ভারী অন্যায়,এতে রুকমানিকে অসম্মান করা হয়েছে কারণ সে স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও সম্মান পায়নি কারণ মানুষ রাধাকৃষ্ণ রাধাকৃষ্ণই করে,স্ত্রী হিসেবে এটা যেমন কষ্টের তেমনি অসম্মানের! হয় রাধা বিয়ে করে স্ত্রীর সম্মান দেয়া হতো নাহয় রুকমানিকে প্রেয়সী হিসেবে মেনে নিতো!এখানে দুজন নারী কিন্তু সমান কষ্টই পেয়েছে, কেউ সম্মান পায়নি আর কেউ সম্মান পেয়েও ভালোবাসা পায়নি।”

“আমি রাধা হলে আমার কৃষ্ণকে অন্যকাউকে বিয়ে করতে দিতাম না, বরং তাকে আচলে বেঁধে জোর করে বিয়ে করতাম”

সায়ান হাসলো রুশির কথা শুনে,ও হলেও হয়তো এমনটাই করতো!
রুশি সায়ানকে জড়িয়ে ধরতে নিয়ে পকেটে কিছু একটা অনুভুত হলো, ও ভেতরে হাত দিয়ে একটা চেইন পেলো সাথে লকেট। ও সেটার দিকে তাকিয়ে রইলো আর সায়ান বললো

“এটা পরীর চেইন! ছোটবেলায় নাকি ওর সাথে এটা ছিলো। মিনু খালা বলেছে!”

“মিনু খালা?”

“আরে মাধবপুর চাইল্ড কেয়ারের মেইন ছিলেন তিনি, পরীকে খুজতে গিয়ে তার সাথে পরিচয় হয়েছিলো।তারপর এটা এই শার্টের পকেটে রেকে দিয়েছিলাম, আজ এতো মাস পরও এটা এইশার্টে আছে। হয়তো ওয়াশ করার সময় কেউ খেয়াল করেনি আর আমিও তো এই শার্ট পরিনি আর”

রুশি মনোযোগ সহকারে এটা দেখছে, খুব সুন্দর একটা চেইন আর লকেটটাও খুব আকর্ষণীয়!ও ছোট্ট করে বললো

“আমি লকেটটা নিজের কাছে রাখি?পরীকে পেলে তখন দিয়ে দিবো”

“আচ্ছা রাখো, আমার থেকে বেশি এটা তোমার কাছে সাবধানে থাকবে!”

এইটুকু পরেই কুঞ্জন পরের পেজ উল্টালো আর তাতে পুরোনো হয়ে যাওয়া ফুল দেখতে পেলো যার পাশে সুন্দর করে লিখা “প্রিয় মানুষটির সেরা উপহার”।
হয়তো এটা সেই ফুল যা সায়ান রুশিকে দিয়েছিলো সেদিন, কুঞ্জন সেই ফুলের ঘ্রাণ যেনো এখনো পাচ্ছে!ও আলতো করে হাত বুলালো তাতে।

আরো পরার ইচ্ছে থাকলেও নিজের ইচ্ছেকে সায় দিলো না, রাত প্রায় দুটো বাজে!মায়ের কাছে ধরা পড়লে খবর আছে ওর বারোটা বেজে যাবে,কিন্তু ওর ছোট্ট মনে এই প্রশ্নটিই বারবার উঁকি দিচ্ছে রুশি কি তাহলে সায়ানের ছোট্ট পরী ছিলো? আর যদি ছিলোও তবে সায়ান কি জানতে পেরেছিলো সেটা!কি হয়েছিলো এরপর?

সাবধানে ডায়রীটি লুকিয়ে রেখে ও সেই রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো, এই রুমে সবার ঢুকা নিষেধ কিন্তু ওর তের বছরের কৌতুহলী মনকে দমাতে পারেনি। ঠিকই সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর এখানে ঢুকে পড়েছিলো আর ভাগ্যবশত এই ডায়রীটি পেয়েছে! প্রথম পাতাতেই অনেকটা গল্পের মতো করে লিখা ছিলো

“মিস রুশানি! আপনি মা হতে চলেছেন”

যাতে ও বেশ অবাক হয় আর সামনে পড়া শুরু করে, আর পড়তে পড়তে এডিক্টেড হয়ে গেছে। ওর মনে প্রত্যকটা দৃশ্য ও নিজের চোখের সামনে দেখছে!রাত বারোটায় এখানে আসে আর দুটোয় ফিরে যায় তাও সাবধানে!ও ধীর পায়ে নিজের রুমে যায়, এরপর কি হয়েছে তা জানার জন্য মন কেমন যেনো খুঁতখুঁত করছে!

#চলবে

গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_ ৪৭

খাবার টেবিলে মাথানিচু করে ব্রেকফাস্ট করছে কুঞ্জন, ওর ঠিক বরাবর ওর বাবা গম্ভীর মুখে আছে। বাবাকে ছোট থেকে প্রচণ্ড ভয় পায় ও আবার প্রচণ্ড ভালোও বাসে। বাবাকে গম্ভীর মুখে দেখা মানে ওর কাঁপাকাঁপি শুরু! কুঞ্জন কোনরকম ব্রেকফাস্ট শেষ করে উঠে যাবে এমন সময় ওর বাবা বলে উঠলো

“কুঞ্জন! সোফার রুমে অপেক্ষা করো আমার জন্য”

ব্যাস এতোটুকু কথাই যথেষ্ট ছিলো ওকে ভয় দেখানোর জন্য,নিজের মনের ভিতর নানা জল্পনা কল্পনা শুরু করে দিয়েছে ও। নিজের করা ভুল গুলো ইতোমধ্যে খুঁজতে শুরু করেছে, কিন্তু কিছুতেই বড়ো কোন দোষ খুঁজে পেলো না। তাতে যেনো বড্ড হতাশ হলো,ভাবতে শুরু করলো তাহলে ও নিজের অজান্তেই বড় কোন অপরাধ করে ফেলেছে?কুঞ্জনের ভাবনার মাঝেই ওর বাবা এসে সোফায় বসলো আর সামনের সোফায় বসতে ইশারা করলো।

ও কোন সময় নষ্ট না করেই বসে পড়লো, আর বাবার কথা শুনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে রইলো। ওর বাবা অবশেষে মুখ খুললো আর বললো

“আমি আজ দুপুরের ফ্লাইটে লন্ডন যাচ্ছি,দুদিন পর ফিরবো। তুমি বাসায় গুড বয় হয়ে থাকবে ঠিক আছে!আর আনবো তোমার জন্য?”

“কিছু লাগবে না পাপা! তুমি শুধু ঠিকমতো আমার কাছে ফেরত চলে এসো তাহলেই হবে”

কুঞ্জনের বাবা হাসলো তারপর বললো

“তুমি একদম তোমার মায়ের মতো হয়েছো, সেও এমনই। আচ্ছা যাইহোক তুমি নাকি আজকাল ক্লাসে ঘুমাও? টিচার কমপ্লেইন দিয়েছে!রাতে ঠিকমতো ঘুমোবে ঠিকাছে!”

“স্যরি পাপা আর হবে না এমনটা,আমি ঠিকমতো মনোযোগী হবো”

কুঞ্জনের বাবা মাথা নাড়লো আর নিজের খেয়াল রেখো বলে বেরিয়ে গেলো কোম্পানির উদ্দ্যেশ্যে!
কুঞ্জন স্বাভাবিক হয়ে বসলো,তারপর ধীর পায়ে উপরে গেলো। বাবা নেই মানে আর কোন ভয় নেই, চুপিচুপি সেই রুমে ঢুকলে কেউ খেয়াল করবে না। ও রুমে ঢুকেই কোন শব্দ ছাড়া সেই ডায়েরীটি বের করলো আর এরপর পড়া শুরু করলো!

সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার, আকাশটা হাল্কা মেঘলা থাকলেও ভ্যাবসা গরম ছিলো সেদিন। রুশির প্রেগন্যান্সির তখন সাড়ে আট মাস চলে, পেট বেশ উঁচু হয়ে গেছে আর হাটতেও কষ্ট হতো তখন। কিন্তু এই সবকিছু তার অদম্য ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, সত্যকে জানার ইচ্ছে! সায়ান খুব জরুরী কাজে অফিসে গিয়েছে, সেই ফাঁকে ও বেরিয়ে পড়েছে। বডিগার্ড বাঁধা দিতে গেলে বলেছে সায়ান ওকে যেতে অনুমতি দিয়েছে তাই তারা আর বাঁধা দেয়নি। সাথে আসতে চাইলেও রুশি নিয়ে আসেনি বরং গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে উদ্দেশ্য হাসপাতাল!

কাল রাতে সায়ান থেকে সেই কথা শুনার পর থেকেই মন উস্কোখুস্কো করছে, ওর মিনু খালার সাথে দেখা করা প্রয়োজন! খুব বেশি কারণ ওর সত্য জানতে হবে সাথে ওর বাবাকেও আসতে বলেছে যদিও ও বলেনি কেনো ডেকেছে। ও সত্যিটা খুব করে জানতে চায়। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর নিজের বাবাকে সেই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুশি এগিয়ে গেলো। ওর বাবা ওকে দেখেই জিজ্ঞাস করলো

“কোন দরকার ছিলো তোর মা?তোর কি শরীর খারাপ!সায়ান বাবা জানে? তাকে জানিয়েছিস?হঠাৎ এখানে ডেকেছিস কেনো আমায়?”

“বাবা আমি সম্পুর্ণ ঠিক আছি, আমার কিছুই হয়নি।তুমি আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও, আমাকে যখন চাইল্ড কেয়ার থেকে নিয়ে এসেছিলে তখন কি আমার নাম রুশিই ছিলো নাকি তুমি আমার নাম পাল্টিয়েছো?”

রুশির বাবা একটু ঘাবড়ে গেলো তারপর নিজেকে সামলে বললো

“হঠাৎ এই প্রশ্ন করলি যে মা?”

“কিছুনা বাবা, জাস্ট জিজ্ঞেস করলাম আরকি চেঞ্জ করেছো কিনা! চলো ভিতরে চলো”

রুশি অত:পর ভেতরে গেলো ওর বাবার সাথে আর ভিআইপি ওয়ার্ডে গেলো। সেখানে গিয়ে একজন নারীকে বেডে শুয়ে থাকতে দেখে ও ভেতরে ঢুকলো। যতোটুকু জানে তাতে এটা নিশ্চিত ইনিই মিনু খালা, মাধবপুর চাইল্ড কেয়ারের একসময়কার মালিক!রুশি আর কিছু না জানলেও এতটুকু জানে ও মাধবপুর চাইল্ড কেয়ারে বড় হয়েছে আর ওকে সেখান থেকেও ওর বর্তমান বাবা নিয়ে এসেছিলো। সাথে মিনু খালা নামটাও খুব পরিচিত ওর কাছে যদিও চেহারা বা কন্ঠ কিছুই মনে নেই ওর।

ও ধীর পায়ে সেইদিকে এগিয়ে গেলো সাথে ওর বাবাও! রুশির বাবা ভেতরে ঢুকেই থমকে গেলো, এতো সেই মহিলা।উনি হঠাৎ ভয় পেলো আর বেরিয়ে যেতে নিলে রুশি হাত চেপে ধরলো আর মাথা নেড়ে যেতে না করলো। উনি মাথা নিচু করে ভেতরে দাঁড়িয়ে রইলো আর কিছুই বললো না। তাদের দেখেই মিনু খালা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো আর তাকিয়েই থাকলো। হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললো

“আ্ আপনি তো সেই লোক! আপনি ওই যে ছোট মেয়েটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। ক্ কি যেনো নাম মেয়েটির উফফফ মনে পড়ছে না।”

উনি মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে শুরু করলেন, রুশি নিজের ব্যাগ থেকে সেই চেইনসহ লকেটটা বের করলো আর তাকে দেখিয়ে বললো

“এই চেইনের মালিক?যার এই চেইন সেই মেয়েটিকে নিয়ে গিয়েছিলো?”

“হ্ হ্যাঁ! তুমি কোথায় পেলে এই চেইন?এটা আমি সায়ান জামিল খানকে দিয়েছি!”

রুশি কোন জবাব দিলো না বরং নিজের বাবার দিকে তাকালো,ও ইতোমধ্যে কান্না করছে। কান্নার কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো

“বাবা তোমার মেয়ে হিসেবে জিজ্ঞেস করছি! প্লিজ বলো আমার নাম কি পরী ছিলো?আমি কি সায়ানের ছোট্ট পরী?আমার জন্য এটা জানা খুব জরুরি। প্লিজ বলো না বাবা!”

রুশির বাবা মেয়ের দিকে তাকালেন তারপর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। অনেক পাপ করেছেন জীবনে আরো পাপের ভাগিদার হতে চায়না ও। যা হবার হবে আপাদত রুশির সত্যি জানার অধিকার আছে, উনি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক জবাব দিলেন। আর রুশি কান্নার মাঝেও হেসে ফেললো তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো

“আগে বলোনি কেনো আমায়?কেনো বলোনি!”

“প্রয়োজন ছিলো তাই বলিনি, সব বলার সময় নেই শুধু এইটুকু মনে রেখো এই খবর যাতে বাইরে না যায়।”

রুশির কানে বাকি কথা পৌঁছালো কিনা কে জানে?ওর মাথায় শুধু এইটুকু খেলে যাচ্ছে ও সায়ানের ছোট্ট পরী!আজ সব ওর কাছে পরিষ্কার মনে হচ্ছে। ও যেই ছেলেটির স্বপ্ন দেখতো সেটা আর কেউ না সায়ান ছিলো আর তারাদের দিকে তাকিয়ে যার সাথে কথা বলতো সেও সায়ান ছিলো। ও আগুনকে ভয় পায় কারণ ওর জানা মতে ও আগুনে ঝাপ দিয়ে কাউকে বের করে আনার চেষ্টা করছিলো কিন্তু নিজে সেই আগুনের মাঝে পড়ে যায় যদিও সব ঝাপসা ছিলো। কিন্তু সেটাও সায়ান ছিলো, ওর কল্পনা জুড়ে শুধু সায়ানের বসবাস ছিলো অথচ এতো কাছে থেকেও ও বুঝতে পারেনি?এক মুহুর্তেই যেনো সকল স্মৃতি তাজা হয়ে গেলো!

ও খুব দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লো,কারো ডাক যেনো কানে যাচ্ছেনা ওর।হুট করেই ওর হাতে লেগে কিছু একটা জিনিস পড়ে যায়, গায়ে তরল জাতীয় কিছু ফিল হয় কিন্তু তাতে ওর মাথা ব্যাথা নেই। শুধু একটা জিনিসই মাথায় কাজ করছে সায়ানকে বলতে হবে, বলতে হবে এই চেইনের মালিককে আর খুঁজতে হবে না ওর বরং সে তার পাশেই আছে, তার স্ত্রী হিসেবে। তার ছোট্ট পরী!রুশি গাড়িতে উঠে দ্রুত গাড়ি চালাতে বললো, রাস্তায় যতো গাড়ি এগোচ্ছে রুশির উত্তেজনা তত বাড়ছে! ও যেনো আর সইতে পারছে না এই দুরত্ব। একেকটা মুহুর্ত ঘন্টার সমান মনে হচ্ছে, রাস্তা যেনো শেষই হচ্ছে না।

প্রায় আধঘণ্টা পর রুশি নিজের পায়ে তরল জাতীয় কিছু ফিল করলো, ও হাত দিয়ে সেটা ধরে বুঝতে পারলো এটা রক্ত।ও চমকে উঠলো, ড্রাইভারকে কোন মতো বললো আমাকে হসপিটাল নিয়ে চলো। ও দ্রুত সায়ানকে ফোন দিলো, চোখ যেনো বুঝে আসছে!সায়ান ধরতেই বলে উঠলো

“আ্ আমার মনে হচ্ছে আমি আর তোমায় দেখবো না সায়ান!আমাদের বেবিকে আমি বাঁচাতে পারিনি হয়তো, ত্ তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আ্ আমার তোমাকে কিছু ব্ বলার ছিলো, সায়ান আ্…”

আর কিছু বলার পুর্বেই রুশি সিটে হেলে পড়লো, শ্বাস যেনো নিতে পারছেনা এমন কষ্ট হচ্ছে। বারবার দোয়া করছে ও মরে গেলেও ওর বেবিটা যাতে বেঁচে যায়!সায়ান দেখার বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে ওর,ওকে বলাই হলো না ও যে সায়ানের ছোট্ট পরী!রুশি সেখানেই জ্ঞান হারালো,,,

#চলবে

গুমোট অনুভুতি পর্ব-৪২+৪৩+৪৪

0

গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_ ৪২

একজন মাঝবয়সী লোক সেই মাঝবয়সী মহিলাটিকে ধরে নিয়ে আসছে, মহিলার শরীর ততটা সুস্থ বলে মনে হচ্ছে না কিন্তু চোখেমুখে মোহনীয় হাসি!সায়ানের সেই হাসিটা খুব পরিচিত মনে হলো, কোথাও একটা যেনো খুব খুজে পাচ্ছে এই হাসির কিন্তু কার সাথে সেটাই মনে করতে পারছে না। সেই নারীর চোখগুলো খুশিতে চিকচিক করছে, সায়ান চোখেমুখেও খুশি খেলে গেলো!দৌঁড়ে সেই নারীর কাছে গেলো আর হুট করেই তাকে জড়িয়ে ধরলো। সেই নারীও পরম আদরে সায়ানের পিঠে হাত বুলালেন তারপর আলতো করে বললেন

“বাবু! কেমন আছিসরে তুই?”

“প্রিয় আন্টি আমি তো খুব ভালো আছি, তুমি কেমন আছো?”

“আমিও খুব ভালো আছি আর তোদের দেখে আরো ভালো হয়ে গেলাম”

সামু দ্রুতপায়ে নিচে নেমে আসলো,মায়ের রুমে যাওয়া উদ্দেশ্য ছিলো কিন্তু মাঝপথেই নিজের আন্টিকে দেখে থেমে গেলো। ওর মায়েরা দুইবোন ছিলো শুধুমাত্র তাই নানার অতি আদরের ছিলো, বড় মেয়ের নাম সাবিনা আর ছোট মেয়ের নাম প্রিয়ানা। বড় বোনের বিয়ে যখন খান বাড়িতে হলো তখন ছোটবোন মাত্র ইন্টার পরিক্ষার্থী ছিল!

দুবোনের বয়সের পার্থক্য খুব বেশি না হওয়ায় তারা বেস্টফ্রেন্ডের মতো ছিলো তাই বড়োবোনের বিয়ে হয়ে যাওয়াতে ছোটজন যেনো একদম একা হয়ে যায়!সে খান বাড়িতে ছোটজনের আনাগোনা খুব বেশি ছিলো, তখন সায়ানের বাবা জামিল খানের বন্ধু শাহিন জামান প্রায়ই আসতেন এবাড়িতে! প্রথমে কেউ বুঝতে না পারলেও পরে ঠিক বুঝতে পারলো যে প্রিয়ানা যখনি আসতো তখনি সে আসতো, মোটকথা শাহিন তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলো। প্রিয়ানাও মনে মনে পছন্দ করতো কিন্তু প্রকাশের সাহস পায়নি, একসময় পরিবারের সম্মতিতেই তাদের বিয়ে হয়।

সামু এইটুকুই শুনেছে তার মায়ের থেকে, ছোট থেকেই প্রিয় আন্টি খুব প্রিয় ওর কিন্তু তাকে সরাসরি দেখার সুযোগ হয়নি এতো বছর, শাহিন জামান আর তার স্ত্রী লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছেন প্রায় উনিশ বছর, আজ এতোবছর পর তাকে দেখে সামুতো বেশ খুশি! সেও এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে তারপর প্রিয় আন্টিকে সোফায় বসালো,তারপর সায়ান আর সামু দুজনই তার সামনে হাটু গেড়ে বসলো।প্রিয়ানা জামান ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে,চোখ ছলছল করছে! মনে হচ্ছে নিজের সন্তানদের দেখছে। সায়ানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো

“বাবু! তোর বউ কই রে?আমাকে দেখাবি না নাকি লুকিয়ে রাখার প্লেন করেছিস?”

“আরেহ না, কি বলছো তুমি? আমি এক্ষুনি রুশিকে নিয়ে আসছি!তুমি বসো।”

সায়ান উঠতেই সামুর মুখ ভেংচি দিয়ে বললো

“বুঝলে প্রিয় আন্টি! তোমার গুলুগুলু বাবু তার বউকে ছাড়া একমুহুর্তও থাকতে পারেনা। বউয়ের আচল ধরে ঘুরে বেড়ায়!”

“তবে রে!”

সায়ান তেড়ে আসতেই সামু তার আন্টির হাত চেপে ধরলো আর আন্টি সায়ানের দিকে তাকিয়ে বলে

“সব ছেলেরাই একসময় বউয়ের আচল ধরে ঘুরে, বিয়ের পর আমাদের সামুর বরও তার আচল ধরে ঘুরবে। তাইনা সায়ান!”

“সেকি বলছো তুমি? ইনান তো এখনি আচল ধরে ঘুরে বিয়ের অপেক্ষা কি করতে হবে নাকি!”

কথাটা শুনে সামুর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো, ও কপাট রাগ দেখাতে চেয়েও ব্যার্থ হলো তারপর আন্টির দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বললো

“তারমানে আঙ্কেল সেই অনেক আগে থেকেই আচল ধরে ঘুরছে তাইনা আন্টি। অনুভুতি কেমন!”

“অসভ্য কোথাকার! ঠাট্টা হচ্ছে আমার সাথে?”

বলেই সামুর কান চেপে ধরালো, আর সামু ছাড়াতে ছাড়াতে বললো

“আহহহহ আন্টি ছেড়ে দাও, বিয়ের দিনও কি কান মলে দিবে আমার?”

সায়ান সিঁড়ি থেকে চেঁচিয়ে বলল

“নাহ আন্টি একদম ছাড়বে না, বরং আরো জোরে ধরো। অল্প বয়সে পেকে গেছে ও!”

“ভাবির কাছে বিচার দিবো কিন্তু ভাই!”

“দে আমিকি তোর ভাবিকে ভয় পাই?”

“আচ্ছা দেখা যাবে!”

সায়ান রুমে ঢুকেই দেখে রুশি চেহারায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে বসে আছে আর একের পর এক চকোলেট খাচ্ছে। সায়ান রুশির সামনে গিয়ে বসলো তারপর রুশির হাত ধরে বললো

“আজকে তোমাকে একজনের সাথে দেখা করাবো! সে আমার খুব কাছের মানুষ, ছোট বেলায় আমি মায়ের থেকেও বেশি তার কাছে থাকতে পছন্দ করতাম। চলো দেখা করবে তারসাথে!”

রুশি সায়ানের কথা শুনে খুশিমনে উঠে দাঁড়ালো, সায়ানের প্রিয় মানুষ মানে ওরও প্রিয় মানুষ!ও কৌতুহল নিয়ে সায়ানের হাতে হাত রেখে সাবধানে হাটা শুরু করলো, কয়েক সিঁড়ি উপরেই থাকতেই একজন শাশুড়ি মায়ের সাথে একজন মাঝবয়সী নারীকে দেখতে পেলেন। গায়ের রং ফর্সা নয় বরং উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের, চৌখা নাক আর অমায়িক হাসি! হুট করেই যেনো রুশির তাকে ভালো লেগে গেলো, কি নির্মল দেখতে!তাকে দেখেই তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো, মনে সে যেনো কত বছরের চেনা ওর!

রুশিকে দেখেই ওর শাশুড়ি মা বলে উঠলো

“এইতো রুশি মা এসে গেছে! রুশি এ হচ্ছে আমার ছোট বোন প্রিয়ানা, তুমি ওকে প্রিয় আন্টি বলে ডাকতে পারো!”

রুশি কাছে যেতেই সেই প্রিয় আন্টি ওকে হাত ধরে পাশে বসালো! তারপর থুতনি ধরে বললো

“বাহ কি মিষ্টি দেখতে!বাবু এই পরী কই থেকে পেলি রে তুই?”

সায়ান এমন কথা শুনে হাসলো, রুশি লাল টুকটুকে শাড়ি পরাতে আসলেই পরী লাগছে!সায়ানের পিঠে হাত রেখে শাহিন জামান বললেন

“আমাদের ছেলেও তো লাখে এক, এমন পরীর মতো বউই তো আসতো তাইনা?”

“তা ঠিক! বাবু ছোট বেলায় এতো সুন্দর ছিলো দেখতে যে আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম যাতে আমাকে একটা মেয়ে দেয় আর আমি বাবুকে নিজের মেয়ের জামাই বানাই!”

“তাহলে আপনার মেয়ের সাথে তার বিয়ে দেননি কেন?”

রুশি হুট করেই প্রশ্ন করে বসলো, এতো ভেবে বলেনি মাথায় এসেছে আর বলে দিয়েছে। কিন্তু রুশির প্রশ্নে সবার যে হাসি মিলিয়ে গেছে তা বেশ বুঝতে পারলো। রুশি কিভাবে পরিস্থিতি সামাল দিবে বুঝতে পারছিলো না তাই মাথা নিচু করে রইলো তখনি সেই আন্টি ওর দিকে তাকিয়ে বললো

“সে সাথে থাকলে তো বিয়ে দিবো! জানো এতোদিনে হয়তো সে তোমার বা সামুর বয়সী হয়ে যেতো কিন্তু… সে যাইহোক তুমি তো আমার আরেক মেয়ের মতো তাহল্র সেই হিসেবে সায়ান তো আমার মেয়ের জামাই হলো তাইনা?আমার মেয়ের সাথে বিয়ে হলে সায়ান এতো মিষ্টি বউ কোথায় পেতো?”

বিনিময়ে রুশি হাসলো, যদিও মেয়ের ব্যাপারটি ক্লিয়ার হয়নি কিন্তু কারো ঘায়ে আঘাত দিয়ে কি লাভ?রুশি আর প্রিয় আন্টি কথায় মেতে রইলো। দুজনের চেহারায় কি অমায়িক হাসি!সায়ানের কোথাও একটা যেনো এই হাসি একই মনে হলো! দুজন হাসলে যেনো একইরকম লাগে খুব সুন্দর!

সন্ধ্যার পর সামু আর ইনানের বিয়ে পড়ানো শুরু হলো,কাছের আত্মীয় ব্যতীত অন্যকেউ এখানে উপস্থিত নেই। সামু নিজের বিয়ের রেজিস্ট্রিতে সাইন করার আগে রুশির দিকে তাকালো কিন্তু রুশিকে হাসিমাখা মুখে থাকতে দেখে ইনানের দিকে তাকালো, সে মাথা নিচু করে আছে।

ইনান সাইন করার সময় রুশির দিকে তাকিয়েছিলো এটা ও খেয়াল করেছে, কোথাও একটা খারাপ লেগেছে ওর কারণ ও জানে ইনান না বললেও সে এখনো রুশিকে ভালোবাসে! ভালোবাসা তো আর এতো সহজে ভুলা যায় না, কোথাও না কোথাও কিছু অনুভুতি থেকেই যায় আর সেটা যদি জীবনের প্রথম প্রেম হয় তবে তো ভোলা অসম্ভব! ইনান রুশিকে ভুলে নি আর হয়তো ভুলতেও পারবে না কিন্তু ও এটা ভেবেই খুশি যে ইনানের হৃদয়ে ওর স্থানও রয়েছে। ভালোবাসায় তো আর কম্পিটিশন হয়না, যে কাকে বেশি ভালোবাসে আর কাকে কম!ও ইনানের জীবনে রুশির স্থান কখনোই নিতে চায়না, ও চায় ইনান ওকে ওর মতো করে ভালোবাসুক আর তাতেই ওর চলবে!
কারো প্রথম ভালোবাসা হওয়া হয়তো ভাগ্যের ব্যাপার কিন্তু কারো শেষ ভালোবাসা হওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার! আর ও ইনানের শেষ ভালোবাসা আর সবচেয়ে বড় কথা আজকের পর থেকে ও ইনানের স্ত্রী তাই ওর থেকে বেশি অধিকার অন্য কারোই নেই আর হবেও না।

সামু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সাইন করে দিলো, আজ থেকে ওর জীবন ইনানের সাথে জুড়ে গিয়েছে। ছোট থেকে যাকে চেয়েছে আজ সেই মানুষটাকে পেয়েছে। সবার নসিবে ভালোবসার মানুষ থাকে না,ও অনেক সৌভাগ্যবান বলেই তাকে নিজের করে পেয়েছে!

__________________________

রাত প্রায় বারোটা বাজে, অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে প্রায় ঘন্টাখানেক। যেহেতু এটা শুধুমাত্র কাবিনের মতো তাই সামুকে শশুর বাড়ি পাঠানো হয়নি বরং ইনান এখানে থেকে গেছে। রুশি ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল আছড়াচ্ছিলো আর সায়ান খাটে বসে ইম্পর্টেন্ট মিটিং নিয়ে সাহিলের সাথে কথা বলছে। এমন সময় রুশি চিৎকার দিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। সায়ান দৌঁড়ে এসে রুশিকে ধরলো আর চিন্তিত গলায় বলছে

“রুশি কি হয়েছে?ব্যাথা পেয়েছো? কোথাও কষ্ট হচ্ছে?আমাকে বলো?”

“ইট জাস্ট কিকড!”

“হাহ!”

“আপনার বেবি কিক মেরেছে আমাকে! আহহ!আবার মেরেছে!”

“হোয়াট!ও নিশ্চই ফুটবল খেলতে চাইছে!আমিও ফিল করতে চাই, বাবাই আরেকটা কিক মারো তো!”

বলেই সায়ান রুশির পেটে হাত রাখলো কিন্তু অনেকক্ষন যাওয়ার পরও কোন কিছু ফিল হলো না। প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও বাবু আর কিক মারেনি তাই সায়ান হাল ছেড়ে দিলো আর রুশিকে উঠিয়ে আস্তে করে শুইয়ে দিলো। বিড়বিড় করে বললো

“নিশ্চিত দুষ্টের সেরা হবে”

তখনি সায়ানের ফোনে ফোন আসলো আর ও পিক আপ করলো। অপর পাশ থেকে একজন বলে উঠলো

“স্যার! মেডামের বাবার উপর নজর রেখেছি আমরা কিন্তু সন্দেহ করার মতো কিছু পাইনি। উনি স্বাভাবিকই আছেন আগের মতো তাই ওইদিনের আচরণের কারণ খুজে পাচ্ছিনা!”

“তুমি নজর রাখো তারউপর। সে নিশ্চই জানে কিছু যা প্রকাশ করতে চাইছে না।”

সায়ান ফোন রেখে বারান্দা থেকে রুমে আসলো, রুশি ইতোমধ্যে শুয়ে পড়েছে। ও আলতো করে কপালে ঠোঁট ছোয়ালো তারপর বললো

“গুড নাইট বউ!”

সায়ান কাউচে শুয়ে পড়লো গিয়ে, ও রুশির সাথে ইচ্ছে করেই বেড শেয়ার করেনা কারণ ও চায় রুশি নিজ থেকে বলুক সেখানে যেতে। এদিকে রুশি চায় সায়ান নিজে থেকে আসুক!এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে কেউ কাউকে কিছু বলতে পারে না আবার সইতেও পারেনা।সায়ান ঘুমানোর চেষ্টা করলো!

________________________

সামু ফ্রেশ হয়ে আসলো তারপর নিজের চুলগুলো শুকিয়ে বেঁধে নিলো। যদিও ভারী সাজ দেয়নি কিন্তু লেহেঙ্গা আর গয়নায় অস্বস্তি হচ্ছিলো। এখন অনেকটা হাল্কা লাগছে নিজেকে! ইনানকে শুয়ে থাকতে দেখে সামু বেশ কিছুটা জায়গা রেখে শুয়ে পড়লো। যদিও ইনান ওর হাজবেন্ড তবুও জড়তা কাজ করছে,বেশ কিছু সময় যাওয়ার পর ইনান মৃদু স্বরে বললো

“ঘুমিয়ে পড়েছো?”

“উঁহু!”

“অতো দূরে শুয়ে আছো যে?”

সামু জবাব দিলো না,কেনো যেনো বেশ লজ্জা লাগছে ওর!সামুর জবাব না পেয়ে ইনান ওর দিকে এগুলো আর সামু সরতেই নিতেই প্রায়ই পড়ে যাচ্ছিলো যেহেতু একদম কিনারে ছিলো কিন্তু ইনান ধরে ফেললো আর একটানে নিজের কাছে নিয়ে নিলো। সামু হচকিয়ে গিয়ে সরতে নিলে ইনান ওর মাথা নিজের বুকে চেপে ধরলো তারপর বললো

“চুপচাপ এখানে শুয়ে থাকো! নড়লে কিন্তু যা করিনি তা করবো”

“কি করেননি?”

সামু বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলো কিন্তু ইনান কর্মকাণ্ডে হতভম্ব হয়ে গেলো। ইনান খুব দ্রুত সামুর অধর ছুয়ে দিলো তারপর বললো

“আরো বাকি আছে,এইটুকুই চলবে নাকি বাকিগুলোও প্রেক্টিক্যালি বুঝাবো”

সামু দ্রুত ইনানের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললো, বুক এখনো ঢিপঢিপ করছে। ইনানের এমন উদ্ভট আচরণ ওর কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে,ও শার্ট খামচে ধরে চোখমুখ খিচে শুয়ে আছে। ইনান এই অবস্থা দেখে নিঃশব্দে হাসলো, এখন কেমন ভেজা বেড়াল হয়ে আছে অথচ এই নাকি একসময় সাহস করে প্রোপোজ করেছিলো ওকে! ইনান সামুর মাথায় বিলি কেটে দিতে লাগলো!

#চলবে

গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_ ৪৩

রুশির বাবা অতি স্বাভাবিক আচরণে সায়ান বেশ অবাক হচ্ছে, সেদিন রুশির বাবা কিচ্ছু লুকাচ্ছিলো তা সায়ান বেশ বুঝতে পেরেছিলো কিন্তু কি হতে পারে তা গেস করতে পারছে না!সেদিন সাহিল ফোন করে বলেছিলো যে রুশির বাবা মিসেস খানকে দেখে ভয়ার্ত অবস্থায় সেখান থেকে চলে যায় কিন্তু কেনো? রুশির বাবা সায়ানের মাকে চেনার ১% চান্সও দেখতে পাচ্ছে না, তাহলে তার ওইরকম রিয়াকশনের পেছনে কারণ কি ছিলো?সায়ানের আশেপাশে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু তার জবাব পাচ্ছে না, এসব প্রশ্নের জবাব কেবল মাত্র রুশির বাবা দিতে পারবেন! সায়ান ফোন বের করে তাকে কল করলো, কয়েকবার রিং হওয়ার পর অপর পাশ থেকে নারী কন্ঠ হ্যালো বলে উঠলো, সায়ান খুব নম্রতার সাথে জিজ্ঞেস করলো

“আফজাল সাহেব আছেন?”

“হ্যাঁ উনি আছেন! তাকে কি দরকার আপনার?”

“যদি উনাকে একটু দিতেন…”

“উনার জ্বর ছিলো সারা রাত,সকালে মেডিসিন নেয়ার পর এখন ঘুমোচ্ছে তাই এখন তাকে জাগানো যাবে না।আপনি কে?আমাকে বলে দিন, আমি তাকে বলে দিবো”

“আমি সায়ান জামিল খান! তার বড় মেয়ের হাজবেন্ড, উনাকে বললেই হবে”

“ওহ আপনি সায়ান?কেমন আছেন আপনি?আপুকে নিয়ে যাওয়ার পর আর একবারও তো আসলেন না”

সায়ান হঠাৎ কন্ঠের পরিবর্তন বুঝতে পারলো,সায়ান ভ্রু কুচকে বললো

“আপনি তাকে বলে দিবেন আমি ফোন করেছিলাম…”

সায়ান ফোন কানে রাখতেই অপর পাশ থেকে চিৎকার শুনা গেলো!সেই নারীকন্ঠ বলছে

“বাবা এমন করছো কেনো তুমি কি হয়েছে তোমার?সায়ান! আপনি কি একটু আসবেন? বাবা কেমন যেনো করছে!”

সায়ানের কেনো যেনো ভয় লাগলো! রুশি তার পালক বাবাকে খুব সম্মান করে আর ভালোবাসে। সেদিন না বলে চলে যাওয়াতে খুব আফসোস করেছিলো,তারপর ফোন করে কথা বলে ক্ষান্ত হয়েছে। তাই তার কিছু হলে রুশি খুব কষ্ট পাবে!তাই সায়ান কিছু না ভেবেই দ্রুত কোর্ট নিয়ে তা পরা শুরু করলো আর রুশি বলে উঠলো

“কোথাও যাচ্ছেন? কিছু কি হয়েছে?”

সায়ান বলতে চেয়েছিলো কিন্তু থেমে গেলো, এই মুহুর্তে রুশিকে কোন স্ট্রেস দেয়া ঠিক হবে না। তাই মুখে হাল্কা হাসি ফুটিয়ে বললো

“কিছুই হয়নি, কোম্পানিতে যেতে হবে আর অলরেডি লেট হয়ে গেছে তাই তাড়াহুড়ো করছি!”

রুশি এট শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো,মনটা সকাল থেকেই কেমন অস্থির অস্থির লাগছে!ও সায়ানকে হাল্কা জড়িয়ে ধরে বললো

“তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন!”

“হুম,সাবধানে থেকো আর অযথা নিচে যাবে না”

সায়ান যেতে নিলেই রুশি সায়ানকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো আর সায়ান থেমে গেলো।নিজের হাত রুশির হাতের উপর রেখে আলতো করে বললো

“কি ব্যাপার, অন্যদিন আমার বউ আমার বউ আমার আশেপাশেও ঘেষে না আর আজ সে আমাকে যেতেই দিচ্ছে। আমার প্রেমে পড়ে গেলেন নাকি মিসেস খান!”

“বাজে বকবেন নাতো!আমি কি ইচ্ছে করে ধরেছি নাকি আপনাকে?আপনার বেবি চাইছে আমি আপনাকে জড়িয়ে ধরি তাই ধরেছি!”

“আচ্ছা! বেবিটা তাহলে ভারী দুষ্ট হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। আমার বউকে দিয়ে কতো কিছু করাচ্ছে!”

সায়ান রুশির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রুশির সামনে হাটু গেড়ে বসলো তারপর পেটের থেকে আঁচল সরাতে গেলেই রুশি হাত চেপে ধরলো আর দাঁতে দাঁত চেপে বললো

“কি করছেন এসব?”

“আমি কি নিজে থেকে করছি নাকি?বেবিই তো বললো আমি যাতে তার সাথে কথা বলি তাকে কিস করি! আমার কি দোষ?”

“বেবি কিভাবে বলেছে আর কখন বলেছে?আমি তো শুনিনি!”

রুশি চোখ ছোট ছোট করে বললো, তা দেখে সায়ান হাসলো আর উঠে দাঁড়িয়ে বললো

“তোমাকে যেভাবে বলেছে আমাকেও সেভাবে বলেছে। এনিওয়ে টেক কেয়ার আর ঠিক মতো খাবার খাবে। আমি কাজ শেষ করে দ্রুত চলে আসবো”

রুশি মাথা নাড়ালো আর সায়ান দ্রুত পায়ে বেরিয়ে পড়লো।সাহিলকে ফোন করে বললো ডাক্তার নিয়ে সেখানে যেতে আর ও বডিগার্ড নিয়ে সেখানে গেলো। বাসার সামনে গিয়ে দরজায় নক করতেই রুশির পালক বাবার মেয়ে নিহা দরজা খুলে দিলো।পরনে টাইট ড্রেস তাও ক্লিভেজ রিভিল করা আর লাইট মেকাপ! সায়ানের নজর পড়তেই দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো,বাবার অসুস্থতায় এমন সাজুগুজুর মানে দেখলো না ও। ভেতরে ঢুকে রুশির বাবার রুমের দিকে গেলো,সেখানে গিয়ে তাকে অচেতন অবস্থায় দেখলো। সায়ান তার পাশে গিয়ে বসলো, ঘরে প্রচণ্ড গরম অনুভুত হচ্ছিলো। ফ্যান চলতে থাকা অবস্থায়ও সায়ান ঘামছিলো,সায়ান টিস্যু দিয়ে নিজের মুখ মুছছিলো।এমন সময় নিহা পানি এগিয়ে দিলে প্রথমে না করলেও পরে কি ভেবে খেয়ে নিলো। এমন সময় সাহিল ডাক্তার নিয়ে আসতেই সায়ান যেনো হাপ ছেড়ে বাঁচলো। ডাক্তার এসে রুশির বাবাকে দেখে বললো চিন্তার কোন কারণ নেই, ভাইরাল ফিভার তাই মেডিসিন নিলেই ঠিক হয়ে যাবে!তারপর তিনি বেরিয়ে পড়লেন সাহিলের সাথে আর সায়ান সেখানে বসে রইলো রুশির বাবার পাশে। উদ্দ্যেশ্য তার ঘুম ভাঙ্গলে তার থেকে প্রশ্নের উত্তরগুলো জেনে নেয়া যাবে, সায়ান কিছুক্ষণ বসে থাকার পর বুঝতে পারলো ওর মাথা ভারী হয়ে আছে,একসময় সেখানেই নেতিয়ে পড়লো। কিছু আওয়াজ কানে আসছে কিন্তু তা বুঝে উঠার মতো অবস্থায় ও ছিলো না।কখন ঘুমিয়ে পড়েছে ওর খেয়াল নেই!

মৃদু কান্নার শব্দে ওর ঘুম ভাঙ্গে, চোখ মেললেও মাথা ব্যাথায় মাথা ধরে বসে পড়ে। খুবই যন্ত্রণা করছে ওর মাথা,আলতো করে চোখ খুলে সামনে তাকাতেই রুশিকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখতে পায়,রুশি কেমন করে যেনো তাকিয়ে আছে ওর দিকে, নাহ ঠিক ওর দিকে নয় ওর পাশে তাকিয়ে। ও দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকাতেই দেখে নিহা গায়ে ব্লাংকেট জড়িয়ে বসে বসে কাঁদছে! সায়ান কয়েকমুহুর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো, কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না। ও দ্রুত পায়ে দাঁড়িয়ে রুশির দিকে এগুলো কিন্তু রুশি একটা কথাও বললো না, বরং আগের মতোই দৃষ্টি সেদিকে।সায়ান কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো

“তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই না, আমি কিছুই জানিনা কি হচ্ছে। ট্রাস্ট মি আমি নিজেই বুঝতে পারছি না, আমি কিছুই করিনি”

রুশি সায়ানের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো তারপর কড়া কন্ঠে বললো

“বাবার রুমে যান”

“রুশি আমি…”

“বাবার রুমে যান বলছি, গো নাউ!”

সায়ান দ্রুত নিজের শার্টের খুলে থাকা বাটনগুলো লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে পড়লো,ও বুঝতে পারছে ণ কি হচ্ছে! ওর জানা মতে ও রুশির বাবার রুমে ছিলো কিন্তু এখানে আসলো কি করে?আর ওর কিছু মনে নেই কেনো কি হয়েছে ওর সাথে! ও এখানে এসে কিছুই মুখে দেয়নি, ওয়েট! পানি নিয়েছিলো এর মানে তাতে কিছু ছিলো কিন্তু নিহার পক্ষে ওকে রুমে নিয়ে যাওয়া কি করে সম্ভব! এরমানে অন্যকেউ হেল্প করেছে তাকে কিন্তু কে সে?তবে কিছু যে হয়নি সেটা ও নিজেই বুঝতে পেরেছে কারণ ও ঘুমিয়ে পড়েছে এটা ওর মনে আছে, এখন রুশিকে বুঝাতে পারলেই হলো!

সায়ান রুশির বাবা রুমে আসতেই তাকে বসে থাকতে দেখলো, ও ধীর পায়ে তার কাছে গেলো। রুশির বাবা ওর দিকে না তাকিয়েই বললো

“তুমি খুব বুদ্ধিমান তাই হয়তো কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছো আর আমার উপর যে নজর রেখেছো তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমি তোমাকে কিছুই বলতে পারবো না আর না বলতে চাইছি। তাই অযথা আমার পেছনে সময় নষ্ট করো না, যা যেভাবে চলছে সেটাকে সেভাবেই চলতে দাও। সত্যিটা কারো মঙ্গল বয়ে আনবে না তাই সেটাকে গোপনই থাকতে দাও, সেটা প্রকাশিত হলে সবার পুর্বে নিজের আপনজন হারাবে মনে রেখো!নিজের কৌতুহল দমাতে শিখো, অনেককিছুই অস্বাভাবিক থাকতে পারে আশেপাশে সেগুলোর জবাব না খোঁজাই ভালো!”

সায়ান পাল্টা কিছু বলতে পারলো না, রুশির বাবা যে মুখ খুলবে না সেটা ও বুঝে গেছে। এতোদিন রুশির কাছু জানে এটা শুধু ওর সন্দেহ ছিলো কিন্তু সেটা সত্যি বলেই প্রমাণিত হলো। তিনি এমন কিছু জানেন যা জানা ওর প্রয়োজন কিন্তু সে কেনো বলতে চাইছে না?আর আপনজন বলতে কার কথা বলছে সে?কার জীবনের ঝুঁকি আছে?সায়ানের ভাবনার মাঝেই রুশির বাবা বলে উঠলো,

“আচ্ছা তোমাকে একটা প্রশ্ন করার ছিলো,স্বামী হিসেবে তোমার ভালো জানার কথা। রুশি কি এখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে?কারো সাথে কথা বলে?”

সায়ান অবাক হলো, এমনটা ও কখনো দেখেনি রুশিকে করতে। সায়ান অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো

“নাতো!এমন কিছু চোখে পড়েনি। কিন্তু আপনি হঠাৎ এমন প্রশ্ন করলেন কেন?”

“রুশিকে যখন চাইন্ড কেয়ার থেকে এখানে নিয়ে আসি তখন রুশির বয়স ছয় বছর!এখানে নিয়ে আসার প্রথমে চোখে না পড়লেও পরে বুঝতে পারতাম রুশি একা একা কথা বলতো, এমনভাবে বলতো যেনো ওর পাশে কেউ বসে আছে আর ও তার সাথে কথা বলছে।এমনকি রাত বিরাতে ওই পাশের মাঠটায় গিয়ে শুয়ে থাকতো আর একা একা কথা বলতো। আমি খুব ভয় পেয়ে যাই আর ভাবি জ্বীনে আসর করেছে তাই কবিরাজ দেখাই কিন্তু লাভ হয়না। পরে এক বন্ধুর পরামর্শে সাইক্রেটিস্ট দেখাই আর সে রুশির ট্রিটমেন্ট করে। সে বলে রুশি অনেকদিন একা ছিলো তারউপর সেই আগুন ওর ব্রেনে বড্ড চাপ সৃষ্টি করেছে। ও কাউকে বড্ড মিস করছে কিন্তু কাকে সেটা ও নিজেও জানেনা বাট ও কারো সাথে কথা বলে যাকে ওর ভালো লাগে! আর এই পরিস্থিতি থেকে ওকে বের করে আনা সম্ভব নয় তাহলে নিজের ক্ষতি করতে পারে তবে যদি একাকিত্ব কেটে যায় তবে এই অভ্যাসে আর থাকবেনা। বড় হওয়ার সাথে সাথে রুশির সেই স্বভাবটা হাল্কা হয়ে গেলেও পুরোপুরি যায়নি,মাঝেমাঝে রুশি আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেনো বলতো!তাই জিজ্ঞেস করেছি এখনো বলে কিনা!”

সায়ান মনোযোগ সহকারে সবটা শুনেছে আর সমস্যাটা বুঝতেও পেরেছে। রুশির অতীত হয়তো সম্পর্কিত এর সাথে কিন্তু রুশির বাবার ভাষ্যমতে আগুন লাগার কারণে সকল কিছু নষ্ট হয়ে গেছে এরমানে রুশির অতীত সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়। সায়ান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো তারপর রুশির বাবাকে বললো

“নাহ এমন কিছুই আমাদের চোখে পড়েনি, আর আমিতো ওর সাথে ছিলাম। এমন কিছুই ও করেনি”

“ডাক্তার তাহলে ঠিকই বলেছিলো! একাকিত্ব কেটে গেলে সবটা ভুলে যাবে”

সায়ান মাথা নাড়লো তারপর তারা দুজনেই চুপ হয়ে গেলো যেনো ভাষাহীনতায় ভুগছে। কিছুক্ষণ বাদে রুশি ঘরে ঢুকে বাবার কাছে গেলো তারপর তার খোঁজখবর নিলো। এরপর সায়ানের হাত ধরে বেরিয়ে পড়লো,গাড়িতে গিয়ে সায়ানের কোর্ট এগিয়ে দিলো ওর দিকে আর সায়ান সেটা পড়তে নিলে রুশি কড়া কন্ঠে বললো

“ওইটা ফেলে দাও!”

সায়ান কারণ জিজ্ঞেস করলো না বরং সাথে সাথে ফেলে দিলো। তারপর আমতাআমতা করে বললো

“বিশ্বাস করো আমাদের মাঝে কিছুই হয়নি আমিতো ঘুমিয়ে…তুমি কি রেগে আছো?”

“উহুম!”

সায়ান অবাক হলো না কারণ রুশি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী আর সায়ানের এতোটুকু ভরসা নিজের ভালোবাসার উপর আছে যে রুশি ওকে এক্সপ্লেইন করার চান্স দিবে আর ওকে বিশ্বাস করবে। সায়ান আবারও বললো

“আমাকে ওই রুম থেকে বের করে দিয়ে কি করেছো তুমি?”

“দ্যাটস আ সিক্রেট!শেয়ার করা যাবে না”

সায়ান মাথা নাড়লো রুশি বলতে না চাইলে জোর করবে না, এমনিতেও কি ঘটেছে তা ওর বডিগার্ড থেকে জানা যাবে। ও ওই বাড়িতে ঢুকার পুর্বেই তাদের বলে রেখেছিলো যদি ওর সাড়াশব্দ না পায় তবে নজর রাখতে আর কি হয়েছে তা ওকে বলতে। সায়ান রুশির দিকে তাকিয়ে বললো

“হসপিটাল থেকে চেকয়াপ করেই বাড়িতে যাই, ডাক্তার বলেছিলো গত সপ্তাহে যেতে কিন্তু বিয়ের কারণে যাওয়া হয়নি।একবারে ডাক্তার দেখিয়েই বাসায় যাবো”

রুশি মাথা নাড়লো,তারপর একটু আগের ঘটনার কথা ভেবেই বাঁকা হাসলো!হাতে থাকা ফোনটা নিয়ে খেলতে লাগলো ও!

এদিকে রুশি সায়ান যেতেই নিহা নিচে বসে পড়লো আর নিহার ভাই চিলেকোঠার ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো! নিহা ভাবতেই পারছে না কি থেকে কি হয়ে গেলো! ও ইচ্ছে করেই সায়ানকে আসতে বলেছিলো যেখানে ওর বাবার কিছু হয়নি।ও এটা মানতেই পারছিলো না যে রুশির এতো ভালো স্থানে বিয়ে হয়েছে যেখানে ওই পঁয়ত্রিশ বছরের লোককে ওকে বিয়ে করতে হয়েছে! ও রুশির সংসার ভেঙে ওর উপর রিভেঞ্জ নিতে চেয়েছিলো কিন্তু সব ভেস্তে গেলো!রাগে ওর শরীর ফেঁটে যাচ্ছে!

হসপিটালে পৌঁছে রুশিকে ডক্টরের চেম্বারে বসিয়ে সায়ান একটু আসি বলে বেরিয়ে পড়লো, রুশি ডাক্তারের সাথে কথা বলতে লাগলো এদিকে সায়ান কিছু একটা খুঁজতে লাগলো আর অবশেষে পেয়েও গেলো, ও কিছু না ভেবেই পর্দা ঠেলে সেই ভিতরে ঢুকে পড়লো!

#চলবে

গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_ ৪৪

নর্মাল ওয়ার্ডের বারান্দায় পর্দা দিয়ে কিছু সিট রাখা হয়েছে,কিছু মানুষ হসপিটালের নর্মাল ওয়ার্ডের ব্যয়ভারও বহন করতে না পারলে তাদের এই স্থানে রাখা হয় সম্পুর্ণ অনাদর আর অবহেলায়! যদি ভাগ্যক্রমে ডাক্তার এই রাস্তা দিয়ে যায় আর তাদের দিকে কিঞ্চিত নজর দেয় আরকি! চিকিৎসা বলতে এইটুকুই তারা পায় তারা। বেশিরভাগ রোগি এই অবস্থায় ওইপারে পাড়ি জমায়, কেউবা ভাগ্যের জোরে বেঁচে যায়!

সায়ান পর্দা সরিয়ে এইরকম একটা জায়াগায়ই এসেছে,সামনে প্রায় ষাটোর্ধ একজন নারী শুয়ে আছে ছোটখাটো সিটটিতে,জীর্ণশীর্ণ দেহ, চোখের নিচে কালশিটে পড়ে আছে! মৃত্যুর জন্য যেনো অপেক্ষা করছে! সায়ানের তাকে খুব পরিচিত মনে হয়েছিলো তখন তাই এসেছে এখানে, অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চিনতে পারলো। আজ প্রায় ছয়বছর পর তাকে দেখছে।মিনু খালা! মাধবপুর চাইল্ড কেয়ারের হেড ছিলেন উনি যদিও আগের সেই সবল নারী আর এখানের এই দুর্বল নারীর মাঝে কোন মিল নেই তবুও সায়ানের চিনতে ততটা কষ্ট হয়নি কিন্তু উনি এখানে তাও এই অবস্থায়!

আশেপাশে কাউকে দেখতে পেলো না,সায়ান আস্তে করে তার দিকে দিকে এগিয়ে গেলো তারপর তার মাথায় আস্তে করে হাত রাখলো। কাঁপা কাঁপা পল্লবগুলো নাড়িয়ে সে তাকালো,তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সায়ান দূর থেকে একটা চেয়ার টেনে পাশে বসলো তারপর তার হাত চেপে ধরলো বললো

“কেমন আছো মিনু খালা?আমাকে চিনতে পারছো? আমি সায়ান…সায়ান জামিল খান!”

“ত্ তুমি সায়ান!কোন সায়ান?”

“ওইযে যখন ছোট ছিলাম তখন আমাকে আপনার অরফানেজের একটা মেয়ে আমাকে বাঁচিয়েছিলো!তারপর আমি প্রায় আটবছর পরে আপনাদের সেখানে খোঁজ নিয়েছিলাম সেই মেয়ে সম্পর্কে আর প্রায় ছয়বছর আগে তাকে সেখান থেকে নিয়ে এসেছিলাম! ওর নাম পরী ছিলো মনে আছে?আপনিই তো খুঁজে দিয়েছিলেন।”

“তুমি স্ সেই ছেলে!আমি তো তোমাকেই খুজছিলাম”

মিনু খালা উঠে বসে পড়লো আর সায়ানের হাত ধরে বললো

“অবশেষে আমি তোমাকে পেলাম! এখন আমি মরেও শান্তি পাবো, তোমাকে কথাগুলো বলবো বলেই হয়তো আমি বেঁচে আছি।আমি যে পাপ করেছি তার শাস্তি আমি হারে হারে পাচ্ছি কিন্তু আমি আমার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই”

উনি প্রায় একনিঃশ্বাসে সবটা বললেন তারপর সায়ানের হাত ধরে ছলছল নয়নে তাকিয়ে বললেন

“আমি তোমাকে সেদিন মিথ্যে বলেছিলাম, সত্যি বলতে টাকার লোভে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি যাকে পরী ভেবে এসেছো সে পরী নয় বরং চন্দ্রিকা ছিলো। সম্পর্কে আমার দুঃসম্পর্কের ভাতিজি, জন্মের সময় মা মরে যাওয়াতে তার বাবা তাকে মেনে নেয়নি দ্বিতীয়পক্ষের সন্তান ছিলো কিনা!আমার মায়া হওয়ায় তাকে এখানে নিয়ে আসি কিন্তু একসময় কেউ একজন টাকার লোভ দেখিয়ে বলে চন্দ্রিকাকে ছোট্ট পরী হিসেবে বলতে আর আমি রাজি হয়ে যাই। টাকার লোভ যেমন ছিলো তেমন চেয়েছিলাম চন্দ্রিকা যাতে ভালো থাকে আর তাই আজ হয়তো আমার এই দশা!চন্দ্রিকা তোমার পরী থেকে পাক্কা দেড় বছরের ছোট, ও সে নয় যাকে তুমি খুঁজছিলে!”

সায়ান থমকে গেলো, এরমানে যাকে এতোদিন ওর জীবনের সেভিয়র ভাবতো সে আসলে চন্দ্রিকা নয় বরং অন্যকেউ। আসলে সায়ান অবাক হচ্ছে না, আর যাইহোক চন্দ্রিকার মতো মেয়ে কারো জীবন বাচাতে পারেনা।কিন্তু তাহলে আসল পরী কে?আর সে এখন কোথায়?সায়ান মিনু খালার দিকে তাকিয়ে দ্রুত প্রশ্ন করলো

“তাহলে সেই ছোট্ট পরী কোথায়?কোথায় পাবো আমি তাকে?”

“আমি নিজেও জানিনা সে কোথায় আছে আর কি অবস্থায় আছে আর এতোগুলো বছর হয়ে গেছে তাই সে ঠিক কেমন দেখতে তাও আমার মনে নেই। তুমি আসার প্রায় অনেক বছর আগে তাকে সেখান থেকে অন্যকেউ নিয়ে গিয়েছে হয়তো। কারণ তোমার মনে নেই হয়তো কিন্তু তুমি থাকা অবস্থাই আশ্রমে হঠাৎ ভয়ানক আগুন লাগে আর তুমি খুব অসুস্থ ছিলে সেই সময় আর সেই মেয়েটি তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে আগুনে পড়ে গিয়েছিলো! ততক্ষণে তোমার পরিবার তোমাকে এসে নিয়ে যায় আর ওই মেয়েটির কারণে তুমি অক্ষত অবস্থায় ছিলে।ওই মেয়েটির চিকিৎসার খরচ দিয়ে তোমার পরিবার সেখান থেকে চলে যায় আমরা ট্রিটমেন্ট করাই তাকে কিন্তু সে পুরোপুরি সুস্থ হয়না, এখনো হয়তো তার শরীরে পোড়ার দাগ আছে আর আমি যদি ভুল না হয়ে থাকি তবে পিঠে দাগ আছে হয়তো! যাইহোক আমাদের আশ্রমের অনেক ক্ষতি হওয়াতে আমরা সকল বাচ্চাকে এডপ্ট দিয়ে দিচ্ছিলাম তাই কে কাকে নিয়ে গেছে তা আমাদের জানা নেই শুধুমাত্র চন্দ্রিকা আর কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাইকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। পরী মেয়েটাকেও হয়তো কোন পরিবার নিয়ে গিয়েছিলো! যাইহোক তুমি যখন খোঁজ নিতে এসেছিলে তখন আগের কোন রেকর্ড আমাদের ছিলো না তাই না করে দিয়েছিলাম প্রথমে কিন্তু পরে টাকার লোভে পড়ে আমি মিথ্যের আশ্রয় নেই আর তাই হয়তো আজ আমার এই অবস্থা!”

সায়ান চুপ করে বসে রইলো,সেই ছোট্ট পরী ওকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রান পর্যন্ত সংকটে ফেলে দিয়েছিলো অথচ ও আজ পর্যন্ত তাকে খুঁজেই পায়নি। ওর জীবন বাঁচানোর জন্য তাকে ধন্যবাদ দেয়া হয়নি, তার দায়িত্ব নেয়া হয়নি এমনকি ও জানেও না সে কি অবস্থায় আছে। ওর এই মস্ত বড় ভুলের জন্য সে কি তাকে ক্ষমা করবে?কিন্তু তাকে খুঁজে তো বের করতে হবে!সায়ান ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলো

“তার কোন রেকর্ড!আমি তাকে কি করে খুঁজে বের করতে পারি?কিছু তো জানেন আপনি!”

“তার কোন রেকর্ডই নেই কারণ ওই আগুনে সব শেষ হয়ে গিয়েছিলো, আমার শুধু এইটুকু মনে আছে যে তাকে কেউ একজন আশ্রমের দরজায় ফেলে দিয়ে গিয়েছিলো। দামী তোয়ালে দিয়ে পেচানো ছিলো সে আর দেখে মনে হচ্ছিলো কয়েকঘন্টা পুর্বে সে হয়েছে! আর হ্যা…”

সায়ানের থেকে চোখ সরিয়ে উনি যেনো কিছু একটা খুজতে ছিলো আর পেয়েও গেলো।ছোট্ট একটা কৌটা থেকে একট চেইন বের করলো সাথে একটা লকেট! উনি এটা সায়ানের হাতে ধরিয়ে বললো

“এইটা সেই মেয়ের গলায় পরানো ছিলো আর আমি দামী হওয়ায় নিজের কাছে রেখেছিলাম। সেই সময় তোমাকে দেয়ার কথা মনে ছিলো না কিন্তু কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো তোমার সাথে দেখা হবে আর হয়েও গেলো। কোন দিন ওকে পেলে দিয়ে দিও এটা আর হ্যা বলো আমায় ক্ষমা করে দিতে!আমি এখন মরেও শান্তি পাবো।”

সায়ান চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো তারপর সাহিলকে ফোন করে বললো তাকে ভালো ওয়ার্ডে শিফট করতে, তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত অলরেডি হয়ে গেছে নতুন করে কিছু করার নেই। সায়ান আসতেই রুশি চিন্তিত মুখে উঠে দাঁড়ালো আর প্রশ্ন করলো

“কোথায় ছিলেন আপনি?সেই কখন থেকে ওয়েট করছি!”

“স্যরি বউ ওয়েট করানোর জন্য”

তারপর রুশিকে আস্তে করে হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগলো আর মৃদু গলায় প্রশ্ন করলো

“কি বলেছে ডক্টর?”

“বলেছে বাবু আর তার মা দুজনেই সুস্থ আছে!আচ্ছা আপনি কোথায় গিয়েছিলেন বললেন নাতো!”

“একজন পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিলো তার সাথেই কথা বলেছিলাম। আচ্ছা তুমি যদি জানতে পারো এতোদিন তুমি ভুল তথ্য জানতে, তুমি যাকে নিজের লাইফ সেভিয়র ভাবতে সে আসলে তোমার জীবন বাচায়নি বরং সে অন্যকেউ ছিলো আর তুমি তাকে খুঁজেই পাওনি এখন পর্যন্ত। কি করতে তুমি?”

“চন্দ্রিকা তাহলে আপনার জীবন বাঁচায়নি তাইনা?”

“উঁহু!ছোট্ট পরী অন্যকেউ ছিলো আর আমি এতোবছর তা জানতামই না”

রুশির কেনো যেনো খুব খারাপ লাগলো আর ভয় হতে শুরু করলো। অনেকটা ভয় নিয়ে প্রশ্ন করলো

“যদি ছোট্ট পরীকে একদিন খুঁজে পান তবে কি করবেন?তাকে বিয়ে করবেন?”

সায়ান রুশির থমকে গেলো আর রুশির দিকে তাকালো, রুশি তখনো নিচের দিকে তাকিয়ে। ও রুশির হাত চেপে ধরে বললো

“আমি অলরেডি বিবাহিত রুশি!নতুন করে বিয়ে করার প্রশ্নই আসেনা,আমার বউ আছে ঘরে। কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসার পার্থক্য আমি বুঝি যদিও তুমি আসার আগে ভালোবাসার মানে জানা ছিলো না কিন্তু এখন আমি এটা জানি তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না। আমার শ্বাসপ্রশ্বাসে মিশে গেছো তুমি! যদি তাকে কোনদিন খুঁজেও পাই তবে সে আমার দায়িত্ব থাকবে, যদি ভালো অবস্থায় থাকে তবে আমরা দুজন মিলে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো আর যদি না থাকে তবে তার দায়িত্ব নিবো। তুমি তোমার হাজবেন্ডের ঋণ পরিশোধ করতে পাশে থাকবে না?”

রুশি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো, সায়ান ওকে ছেড়ে যাবে এটা ও জানে তবুও কেনো যেনো প্রশ্ন করলো! রুশি মুচকি হেসে বললো

“আমি সবসময় আপনার পাশে থাকবো!”

“প্রমিস করেছেন কিন্তু মিসেস খান! এইযে এই হাত ধরেছেন আর ছাড়া যাবে না কিন্তু, আপনি চাইলেও আমি ছাড়তে দিবো না”

“ওকে!”

রুশি কারের ভেতরে বসলো এমন সময় মেসেজ আসলো ফোনে। ও বের করতেই সায়ান আর নিহার কিছু ছবি দেখতে পেলো যা দেখে মনে হচ্ছে তারা খুব ইনটিমেট!সাথে একটা মেসেজ

“আমি ফোন থেকে সব ডিলিট করে দিয়েছি,তুমিও সেটা ডিলিট করে দাও”

রুশি বাঁকা হাসলো আর মেসেজ করে বললো

“ওয়েল ডান, আমি ওই রেকর্ডিংটা আসলে ডিলিট করতে চাইছিনা। যখন মুড ভালো থাকবে তখন করে দিবো নাহয় কে জানে তুমি আবার কখন কি করো!”

অপরপাশ থেকে মেসেজ আসলো না বরং সোজা ব্লক মেরে দিলো ওকে যা দেখে রুশি জোরেই হেসে দিলো!সায়ান ভ্রু কুচকে বললো

“কি নিয়ে হাসছো?আমাকেও বলো!”

“উঁহু বলা যাবে না সিক্রেট।”

“আজকাল মিসেস খান বড্ড সিক্রেট রাখছে দেখছি! এমনকি কি যা নিজের হাজবেন্ডের সাথেও শেয়ার করা যায়না?আর দুপুরে তুমি কি করে জানলে আমি ওইখানে আছি?আর ওই রুমেই বা কি হয়েছে?”

“সিক্রেট তো বলা যাবে না, আচ্ছা কোন একদিন বলবো ওকে?বাট আজকে না”

সায়ান সায় দিলো আর রুশি ফোন নাড়তে লাগলো!ওর নিজের বুদ্ধিমত্তার জন্য খুব প্রাউড ফিল করছে,ভাবতেই যেনো খুশি খুশি লাগছে। আসলে আজ সকালে সায়ানের কনভারসেশন ও শুনেছিলো কিন্তু নিহার হুট করে ওইখানে সায়নকে যেতে বলার কথা শুনে খটকা লাগলো। ও ভেবেছিলো সায়ান বলবে কোথায় যাচ্ছে তাহলে ও সাথে যাবে কিন্তু সায়ান কিছু বলেনি হয়তো টেনশনে ফেলতে চায়নি তবে রুশি নিশ্চিত হতে পারলো না তাই ওইসময় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরার বাহানায় নিজের ফোনের রেকর্ডার অন করে সায়ানের কোর্টে রেখে দিয়েছিলো। সায়ান ওর সাথে কথায় ব্যাস্ত থাকায় বুঝতে পারেনি, তারপর অনেক্ষন পর সায়ান না আসায় ও টেনশনে পড়ে যায়। এমনসময় নিহা ওর ফোনে কিছু ছবি পাঠায় যা দেখে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। ও নিজে তাই সেখানে যায় আর বডিগার্ডদের বলে দরজা খুলতে, তারা সেটা বিনা আওয়াজে খুলতেই ও ভেতরে গিয়ে দেখে নিহা কাঁদছে। ও কিছু না বলে সায়ানের জ্ঞান ফিরতেই তাকে ওই রুম থেকে যেতে বলে আর রুমে ঢুকে সায়ানের কোর্ট থেকে নিজের ফোন বের করে সেই রেকর্ডিং অন করে।

সবটা শুনে বুঝতে পারে নিহা সব আগে থেকেই প্লেন করে রেখেছিলো। ও সায়ানকে ঘুমের মেডিসিন দেয় আর সায়ান ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর নিহালের সাহায্যে সায়ানকে রুমে এনে ওর কোর্ট খুলে পাশে রাখে আর ইচ্ছে করে বিভিন্ন এংগেলে ছবি তুলে ওকে পাঠায়। ওর ইচ্ছে ছিলো রুশি যাতে সায়ানকে ছেড়ে দেয় আর আবার এবাড়িতে ফিরে আসে তাহলে নিহালেরও একটা চান্স থাকবে। ওর পালক মাও এতে শামিল ছিলো তাই তিনি আগেই পাশের বাসায় চলে যান আর নিহাল চিলেকোঠায়!রুশি ওই রেকর্ডিং শুনাতেই নিহা ঘাবড়ে যায় কারণ এটা ওর স্বামীর কানে গেলে ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে যা ও এই মুহুর্তে চায়না আর তাই রুশি বলেছে সব ছবি, ভিডিও ওকে পাঠিয়ে তারপর ডিলিট করে দিতে নাহয় ও সব নিহার হাজবেন্ডকে দেখাবে!নিহা ভয় পেয়ে ও যা বলেছে তাই করেছে। আসলে কপাল বলে একটা জিনিস আছে, যেই পঁয়ত্রিশ বছরের লোকের সাথে রুশির বিয়ে দিতে চেয়েছিলো তারা সে এখন নিহার স্বামী! টাকা পয়সা দিক থেকে সুখে থাকলেও মানসিক দিকে থেকে ও সুখে নেই তা দেখেই বুঝা যায়!কথায় আছে না অন্যের জন্য কুয়া খুড়লে সেই কুয়াতে মানুষ নিজেই পড়ে! যা হয়েছে ভালোই হয়েছে এখন নিহা যদি শুধরায় আরকি নাহয় ও এখন আর ছেড়ে কথা বলবে না।

ওর স্বামী, ওর সংসার, সবকিছু ওর!তাতে অন্যকাউকে হস্তক্ষেপ করতে দিবে না আর একচুলও ভাগ দিবে। যা ওর তা নিজের করে কি করে রাখতে হয় তা ওর ভালো করে জানা আছে! অন্যসব দুর্বল নারীদের মতো ভুল বুঝে চলে যাবে না ও বরং সত্যের মোকাবিলা করবে!নিজের অধিকারে অন্যকাউকে ভাগ বসাতে ও দেবে না, কক্ষনো না!সায়ান যেহেতু ওকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছে এর মানে ও আর পিছু হটতে পারবে না, সারাজীবন ওর হয়েই থাকতে হবে সায়ানকে! এটা যদি পসেসিভনেস হয় তবে হ্যাঁ ও সায়ানের প্রতি পসেসিভ খুব বেশিই হয়তো কিন্তু যেটা ওর সেটা ওরই থাকবে!

#চলবে

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

গুমোট অনুভুতি পর্ব-৩৯+৪০+৪১

0

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৩৯

আকাশটা বড্ড মেঘলা! গুটিগুটি বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে পিচঢালা রাস্তা, মানুষজন দৌঁড়ে এদিক ওদিক যাচ্ছে আশ্রয়ের খোঁজে। শীতকালে বৃষ্টি হওয়া অমাবস্যায় চাঁদ দেখা, কেউ হয়তো কল্পনাও করেনি অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির! সেই গুটিগুটি বৃষ্টির ফোঁটা ভিজিয়ে দিচ্ছে চন্দ্রিকার, চুল, দেহ এমনকি মনও।আকাশে থাকা কালো মেঘ বৃষ্টিরুপে জমিন ছুলেও ওর মন খারাপের কালো মেঘগুলো বৃষ্টি হয়ে নামছে না। হয়তো কোন ভারী বর্ষনের অপেক্ষায়!

এই মুহুর্তে নিজেকে নিঃস্ব ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে, এতিমদের জন্য তো আশ্রয় হিসেবে এতিমখানা রয়েছে কিন্তু ওর জন্য তাও নেই। নিজের হাতের ফোনটাও শাহেদের গাড়িতে ফেলে এসেছে তাড়াহুড়ায় তাই কাউকে কন্টাক্ট করতে পাচ্ছেনা। যদিও কন্টাক্ট করার কেউ নেইও শাহেদ ছাড়া! ও আনমনে হাঁটছে, একদম গন্তব্যহীন ভাবে। এই চলার না আছে শুরু না আছে শেষ তবুও ও চলছে অজানা পথে! চন্দ্রিকা আনমনে হাটলেও বেশ কিছুক্ষণ ধরে হর্নের তীব্র আওয়াজ ওর কানে আসছে তাই ভাবলেশহীন ভাবে সেদিকে তাকালো আর একটা কালো কালার গাড়ি দেখতে যা কিছুটা পরিচিত মনে হলো কিন্তু পাত্তা না দিয়ে আবার হাটা শুরু করলো!

কিছুক্ষণ বাদে খেয়াল করলো গাড়িটা ওর সাথে স্লোলি চলছে আর অনবরত হর্ন দিয়ে যাচ্ছে। ও থেমে গেলো আর সেদিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো, গাড়ির সামনের কাঁচ নামাতেই একজন সুদর্শন ছেলেকে সানগ্লাস পরে বসে থাকতে দেখলো সিটে, তার দৃষ্টি সামনের দিকে যেনো ওর দিকে তাকালেই পান খসে চুন পড়ে যাবে।এটা দেখে ওর প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো কিন্তু ঝগড়া করার মুডে ও নেই তাই আবারও হাঁটা ধরলো। এতে যেনো হর্নের আওয়াজ আরো বেড়ে গেলো, চন্দ্রিকা বিরক্তি নিয়ে পেসেঞ্জার সিটে গিয়ে বসলো। কারণ এই ছেলেকে হারে হারে চিনে যা একবার করতে চাইবে তা করেই ছাড়বে তাই ঝামেলা করে বিশেষ লাভ নেই। চন্দ্রিকার এসব ভাবনার মাঝেই সে ওর দিকে ঝুকে গেলো আর সিটবেল্ট বেধে দিলো। চন্দ্রিকা নিজের অবস্থান থেকে একটুও নড়লো না যেনো এমনকিছু হবে আগে থেকেই জানতো! চন্দ্রিকাকে স্বাভাবিকভাবে বসে থাকতে দেখে সে বাঁকা হাসলো তারপর বললো

“এখন আর আমাকে ভয় পাওনা দেখছি!”

“তোমাকে আমার ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই শাহেদ,মানুষ ভয় তখনি পায় যখন তার হারানোর কিছু থাকে!আমার হারানোর কিছুই অবশিষ্ট নেই তাই আমার ভয় পাওয়ারও কোন কারণ নেই, না তোমাকে না অন্যকাউকে”

“বাহ বেশ কথা বলা শিখেছো দেখছি!আমি তো জানতাম তোমাকে যা শিখিয়ে দেয়া হয় তাই শুধু বলতে পারো তুমি, নিজের থেকে তো তোমার বলার মতো কিছু থাকেই না”

“মানুষের একটা বটম লাইন আছে সেটা জানেন?যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখন আর পেছনে যাওয়ার সুযোগ থাকে না বরং সামনের দিকেই এগুতে হয়। আমারও সামনে অগ্রসর হওয়া ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই!”

“কেনো?তোমার সায়ান তোমাকে নিজের কাছে রাখেনি?ছুড়ে ফেলে দিয়েছে?অথচ তোমার মতো মেয়েকে এর থেকে বেশি আর কি করা যায়?সায়ানের লাইফে যে তুমি ফার্স্ট প্রায়োরিটি নও সেটা তো বুঝেই গেছো তবে আমি তোমার জীবনের সেকেন্ড অপশন হয়েই রইলাম! যেমন তোমার কললিস্টের মতো, সবার আগে কলটা সায়ানের কাছেই দিয়েছিলে তুমি!”

চন্দ্রিকা জবাব দিলো না হয়তো বলার মতো কিছু নেই তা শাহেদ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো তারপর বললো

“আর আমাকে দেখো! এতোকিছুর পরও তোমাকে একা ফেলে যেতে পারিনি, তিনবার গাড়ি স্টার্ট দিয়েও যাইনি। বরং এভেবে বসে ছিলাম যে যদি সায়ান তোমাকে কোন ব্যাবস্থা না করে দেয় তাহলে তুনি কোথায় যাবে?হোয়াট ফুল আই এম!”

বলেই স্টেয়ারিংয়ে বারি দিলো, কিন্তু চন্দ্রিকার কোন ভাবান্তর হলো না। ও সেদিকে তাকিয়েই রইলো। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বললো

“প্রয়োজন আর প্রিয়জন পার্থক্য বুঝ? তুমি কারো প্রয়োজন মানে হচ্ছে লোহার মতো!ব্যাবহার শেষে ফেলে দেয় আর প্রিয়জন হচ্ছে স্বর্ণের মতো। মানুষ সেটাকে তুলে রাখে, রং চলে গেলে আবারও রং করায় বা সেভাবেই যত্ন করে রেখে দেয় কিন্তু কখনো ফেলে দেয়না। আমার আর ওই লোহার মাঝে বিশেষ পার্থক্য নেই, আমি সবার প্রয়োজনই ছিলাম আজীবন কিন্তু কারো প্রিয়জন হতে পারলাম না। হয়তো যোগ্যই না তাই!ভালোবাসা নামক বস্তুটা আমার কপালে নেই।আমার রুশির প্রতি খুব হিংসে হয়! ওতো আমার মতোই অনাথ কিন্তু ওকে কেউ প্রথমে একজন এডপ্ট করে নিয়েছে আর বাবার মতো ভালোবেসেছে। খান বাড়িতে আসার একজন মা পেয়েছে আর এখন সায়ানের মতো স্বামী! কিন্তু আমি কারো ভালোবাসাই পাইনি বরং সবার জীবনের ভ্যাম্প হয়ে আছি। আমার খারাপ দিকটা সবাই দেখেছে কিন্তু আমি কেনো খারাপ সেটা কেউ দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি। মাঝেমাঝে মনে সুইসাইড করলেই হয়তো সব মিটে যাবে কিন্তু পারিনা। বাঁচার বড্ড লোভ আমার!সুইসাইড করতেও সাহসের প্রয়োজন হয় সেইটুকু সাহসও নেই আমার মাঝে। আম জাস্ট আ পুশওভার!”

চন্দ্রিকার গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো কিন্তু ও স্থির হয়ে বসে আছে! কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো

“কিন্তু এইসব কিছুতে আমার কোন দুঃখ ছিলো না যদি আমি আমার বেবিকে বাঁচাতে পারতাম কিন্তু এতোকিছু করার পরও আমি কেনো ওকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি বলতে পারো?সায়ান বলেছে আমি নারী হিসেবে কি করে রুশিকে একটা ছেলের রুমে পাঠালাম! কিন্তু আমাকেও যে একই ভাবে পাঠানো হয়েছে তার বেলা?আমি কি কাউকে বলতে পেরেছি?রুশি তো জানে যে ওর সন্তানের বাবা সায়ান, সায়ান ওকে বিয়েও করেছে কিন্তু আমি?আমিতো জানিই না ওইদিন ওই বদ্ধঘরে কে ছিলো!সেই শিকলে বেঁধে রাখা অবস্থার কাটানো রাত সম্পর্কে আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করেছে?নাহ করেনি।কারণ আমিতো কারো প্রিয়জন নই প্রয়োজন যাকে প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়াতে অস্তিত্ব বিলিন করে দেয়ার চেষ্টায় আছে সবাই।”

শাহেদ চন্দ্রিকার দিকে তাকালো তারপর বললো

“তুমি নিজ থেকে এবর্শন করাও নি?”

“তোমার কি আমাকে এতোটাই জঘন্য মনে হয় যে মা হিসেবে নিজের সন্তানকে মেরে ফেলবো?এবর্শন করার থাকলে তো প্রথম মাসেই করিয়ে ফেলতাম, দীর্ঘ চারটি মাস লুকিয়ে রাখতাম না সবার থেকে!যাইহোক আমাকে নিজের সাথে নিচ্ছো?আমাকে দিয়ে তোমার কোন কাজে আসবে না, এর চেয়ে ভালো দূরে থাক আমার থেকে”

“আমি কি করবো না করবো তার জ্ঞান তোমার থেকে নিবো না। চুপচাপ বসে থাকো আর একটা কথাও বলবে না। পারলে একটু ঘুমাও ভালোলাগবে”

“এতো কেয়ার করে মনে মিথ্যে আশা জাগাবেন না মি.শাহেদ। ছুড়ে ফেলে দিলে বড্ড কষ্ট পাবো! যদিও কেউ মানুষ ভাবে না আমায়!”

“সবকিছু নিয়ে এতো মাথা ঘামাও কেনো তুমি?চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করো। ওকে…”

চন্দ্রিকা আর কথা বললো না, কথা বলার শক্তি আর নেই ওর। ধীরেধীরে কোনসময় ঘুমিয়ে পড়লো ওর জানা নেই।

______________________

রুশি আর সায়ান বাসায় ফিরে এসেছে,এমনভাবে এসেছে যাতে কেউ বুঝতে না পারে ও হসপিটালে ছিলো।গাড়িতে থাকা সময় ছাড়া বাকি রাস্তা সায়ান রুশিকে কোলে করেই এনেছে। প্রেগন্যান্সির কারণে রুশির ওজন তো কম হয়নি কিন্তু তবুও সায়ান কোলে করেই আনবে। রুশি অনেকবার না করেই বিশেষ ফল পায়নি তাই হাল ছেড়ে দিলো,সোফায় বসার কিছুক্ষণ পরই রুশির বাবা ওকে দেখতে এলো। প্রায় পাঁচমাস পর বাবাকে দেখলো! রুশিতো খুশিতে আটখানা, বাবার সাথে গল্প জুড়ে দিলো আর সায়ান অসহায় দৃষ্টিতে সে দিকে তাকিয়ে আছে। বাবাকে পেয়ে ওর ভুলেই গিয়েছে যে এখানে আরেকজন ব্যাক্তিও আছে যে ওর এটেনশন চাচ্ছে!

সায়ানের মন খারাপ হয়তো রুশির বাবা আন্দাজ করতে পেরেছে কিছুটা,তাই রুশিকে উপরে গিয়ে ফ্রেশ হতে বললো। রুশিও সায়ানের সাহায্যে উপরে গেলো আর ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে গেলো। সায়ানও চেঞ্জ করে বসে রইলো, রুশি বেরুতেই ওর কাছে এসে মাথার পানি মুছে দিতে লাগলো তোয়ালে দিয়ে আর রুশি বলে উঠলো

“আরে আরে আমি করতে পারবো দিন না!”

“তোমাকে করতে হবে না, ডাক্তার কি বলেছে মনে নেই?সম্পুর্ণ বেড রেস্টে থাকতে হবে সুস্থ হওয়া পর্যন্ত আর বেবি হওয়া পর্যন্ত কোন কাজ করা যাবে না। তাই আজ থেকে তোমার সব কাজ আমি করবো আর তুমি রেস্ট করবে!

“আর অফিস কে দেখবে?আপনার ভুত?”

“সবকিছুর জন্য এতো চিন্তা তোমার নিজের জন্যও তো করতে পারো তাইনা?আর অফিস ভুত চালাতে যাবে কেনো? অলরেডি সম্পুর্ণ অফিস আমার বাড়িতে শিফট হয়ে গেছে, এখন থেকে বেবির একবছর হওয়া পর্যন্ত আমি বাড়িতেই থাকবো”

“একবছর! আর ইউ মেড?লোকে কি বলবে আর এতোদিন গ্যাপ দিলে চাকরী থাকবে?”

“আমার চাকরী কে খাবে শুনি? যেখানে আমি সবার চাকরী খাই?আর আমাদের বেবির সাথে বেশি সময় কাটাতে চাই তোমার কোন সমস্যা?”

“নাহ!আমার কোন সমস্যা নেই কিন্তু মি.খান হঠাৎ এতো কেয়ার করার মানে কি?প্রেমে টেমে পড়ে গেলেন নাকি আমার?”

“স্যরি মিসেস খান!আমার বউ আছে তাই অন্যের প্রেমে পড়া বারণ আমার জন্য আর আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বউ!তার কেয়ার করবো নাতো কার কেয়ার করবো?”

“তা মনেপ্রাণে সেই বউটাকি চন্দ্রিকা?”

কথাটা শুনতেই সায়ানের মুখ কালো হয়ে গেলো, রুশির মুখ থেকে এমন কথা এই মুহুর্তে আশা করেনি যদিও বলাটা স্বাভাবিক। রুশি নিজেও বুঝতে পারলো ভুল জায়গার ভুল কথা বলে ফেলেছে কিন্তু সায়ানের মুখ থেকে তো ওর বের করতে হবে যে সে শুধু রুশিকে চায়। কিন্তু সায়ান তেমন কিছুই বললো না বরং তোয়ালে পাশে রেখে বললো

“টেক কেয়ার। আমি খাবার নিয়ে আসছি, খাট থেকে নামবে না”

সায়ান যেতেই রুশি ভেংচি দিলো,বিড়বিড় করে বললো

“হুহ ভাঙবে তবু মচকাবে না। আমিও দেখি কি করে নিজের মনের না বলে থাকতে পারে!আমাকে তো চিনেনা।

সায়ান নিচে এসে খাবার পাঠিয়ে দিলো উপরে আর রুশির বাবার সামনে বসলো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বললো

“আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই, জানিনা করা ঠিক হচ্ছে কিনা! তবে আমার জানা খুব জরুরী!রুশি আগুনে ভয় পায় কেনো?ও আগুন দেখলে এতোটা ডেস্পারেট হয়ে যায় কেনো?”

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_ ৪০

সায়ানের হঠাৎ প্রশ্নে রুশির বাবা হচকিয়ে গেলো তারপর নিজেকে সামলে বললো

“হঠাৎ এই প্রশ্ন? কিছু হয়েছে কি বাবা?”

“না তেমন কিছু হয়নি আব্বু! আসলে রুশির রান্নাঘরে যেতে ভয় পায় তাই কিউরিসিটি থেকে জিজ্ঞেস করলাম ও আগুন দেখলে কেমন যেনো করে। আমি ওকে ভয় জিজ্ঞেস করিনি যদি রিয়াক্ট করে তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি!”

“ওহ আচ্ছা, আসলে কিভাবে যে বলি। তুমি হয়তো জানোনা কিন্তু রুশি আমার মেয়ে না। ওর বয়স যখন ছয়বছর তখন আমি ওকে এতিমখানা থেকে নিয়ে আসি!খুব জীর্ণশীর্ণ দেহ ছিলো ওর আর আতংকিত অবস্থায় ছিলো। মানুষ দেখলেও ভয়ে গুটিয়ে যেতো!আমি পরে ওকে সেখান থেকে পালক নিয়ে আসি আর নিজের কাছে রাখি।তবে কর্তৃপক্ষের কাছে শুনেছি আমি যাওয়ার দুমাস পুর্বে সেখানে ভয়াবহ আগুন লেগেছিলো আর রুশি সেই আগুনের মাঝে পড়ে গিয়েছিলো। এরপর থেকেই ও ভয় পেতো আগুনকে হয়তো। আমি নিয়ে আসার পর ধীরেধীরে স্বাভাবিক হয়!”

“আচ্ছা আপনি কি জানেন রুশি সেখানে মানে সি অরফানেজ এ কিভাবে এসেছিলো, ওকে কোথা থেকে পেয়েছিলো?”

রুশির বাবার হঠাৎ করে কি হলো বুঝতে পারলো না সায়ান,এই নিয়ে কয়েকবার উনি কপালের ঘাম মুছেছেন কিন্তু এই প্রশ্নে এতো ভয় পাওয়ার কি আছে তাই বুঝলো না সায়ান। ও তার দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো, আন্দাজ করতে পারছে যে উনি কিছু লুকাচ্ছে কিন্তু কেনো?উনি কি তবে আরো কিছু জানে যা জানাতে চাচ্ছেন না?সায়ান পরিস্থিতি বুঝতে পেরে হাল্কা হেসে বললো

“আব্বু আসলে আমি কিউরিসিটি থেকে জানতে চাইছি,আপনি যদি বলতে না চান তাহলে কোন সমস্যা নেই!”

“নাহ স্ সমস্যা কেনো থাকবে?ওইখানের কয়েকজন বলেছে যে ওকে এতিমখানার দরজায় কেউ ফেলে গিয়েছিলো আর ওনারা তাকে ভেতরে নিয়ে যায়”

“ওহ আচ্ছা! সেই অরফানেজের নাম কি?”

“মাধবপুর চাইল্ড কেয়ার!”

“জি ধন্যবাদ। আব্বু আপনিতো কিছুই নিচ্ছেন না। আম্মু আসলে অফিসে গিয়েছিলো কিছুক্ষনের মাঝে চলে আসবে। আমি গিয়ে রুশিকে একবার দেখে আসি,এই সাহিল! তুমি আব্বুর সাথে বসে গল্প করো!”

“জ্বি বস!”

সায়ান রুমের দিকে এগুলো, ও রুশির বাবার কথা পুরোপুরি সত্য বলে মানতে পারলো না বরং ওর ভেতরে সন্দেহ থেকেই গেলো। আগুনের ব্যপারটা নাহয় আকস্মিক কিন্তু দরজায় ফেলে যাওয়াটা?যদি কেউ তার সন্তানকে ফেলে দেয়ার ইচ্ছে থেকে তবে ডাস্টবিন বা হাসপাতালে ফেলে যায়।তা না করে এতো ভিতরের একটা অরফানেজ সেখানে কেনো ফেলে যাবে আর আশ্চর্যজনক ভাবে এই অরফানেজ ও চিনে! খুব করে চিনে কিন্তু সেখানে রুশি কেনো থাকবে!ও সিদ্ধান্ত নিলো বিষয়টি ঘাটিয়ে দেখবে। রুমে ঢুকতেই ওর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো, খাবারের প্লেটের একটু খাবারও শেষ করা হয়নি তারউপর রুশি ফোনের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। ও ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে হুট করে হাত থেকে ফোন নিয়ে গেলো আর দেখলো রুশি একজনকে “আই লাভ ইউ” লিখে পাঠিয়েছে আবার সেটা একটা ছেলে!সায়ানের মাথা ধপ করে গরম হয়ে গেলো। ও রুশিকে ফোন দেখিয়ে বললো

“এসব কি?তুমি একটা ছেলেকে এসব বলে বেড়াচ্ছো?”

“তো!”

রুশির খাপছাড়া জবাবে সায়ানের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো, ও তুলে দিলো ফোনটাকে একটা আছাড়। সেটা দুইতিন টুকরো হয়ে পড়ে রইলো আর রুশি রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো

“এটা কি হলো? আপনি আমার ফোন ভাঙ্গলেন কেনো?”

“ভেঙ্গেছি বেশ করেছি, দরকার হলো আরো ভাঙ্গবো! তোমার সাহস কি করে হয় একটার ছেলের সাথে ওইসব লুতুপুতু কথা বলার?”

“মানে কি? আমার লাইফ আমার ডিসিশন! আমি যার ইচ্ছে তার সাথে কথা বলবো আপনার কি?শুধু আপনিই কি প্রেম করতে পারবে নাকি আমি পারবো না?”

“নাহ পারবে না,তুমি অন্যছেলের সাথে কথা বলবে মানে কি?তারউপর কিসব বলছো!”

“তো ভবিষ্যতে আমার লাইফ পার্টানারের দরকার পড়বে না?”

“কেনো আমাকে কি চোখে পড়ে না?আমি কি ইনভিসিবল?”

“চোখে তো পড়ে কিন্তু তাতে কি?কে আপনি আমার?”

“আমি তোমার হাজবেন্ড ডেমিট! তোমাকে কি এখন ভুলে যাওয়ার রোগে ধরেছে?”

“নাহ আমার সব মনে আছে, আর আপনি আমার হাজবেন্ড সেটা তো আমি মানলাম তবে সেটাতো তিনবছরের জন্য!তিনবছর পর তো আমার কাউকে লাগবে তাইনা?তাই আগে থেকেই জোগাড় করর রাখছি!”

“এর মানে এই ছেলে তোমার বয়ফ্রেন্ড?”

“হুম, যেমন চন্দ্রিকা আপনার গার্লফ্রেন্ড উপস স্যরি বাগদত্তা!”

“আজ শেষবারের মতো বলছি আমার সামনে ওইমেয়ের নাম নিবে না আর!”

“আহারে…কেনো? ছেঁকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে বসে আছেন?”

“হোয়াট দ্যা…আমি ছেঁকা খেয়েছি?সায়ান জামিল খান কখনো ছেঁকা খায়না বুঝলে!বরং আমি ছেঁকা দিয়েছি!”

“ওর তারমানে ব্রেকয়াপ হয়ে গেছে, আচ্ছা তাহলে আপনার ওই ওয়াদার কি হবে?গম্ভীর কন্ঠে যে বলতেন ‘আমি তোমার সকল দায়িত্ব নিতে পারবো কিন্তু তোমাকে কখনো স্ত্রী হিসেবে মানতে পারবো না কারণ আমি কারো কাছে ওয়াদাবদ্ধ’ তার কি হবে?”

“যে প্রমিসের শুরু ভুল মানুষ দিয়ে তা বেশিদূর এগোয় না আর আমাদের টাও এগোয় নি”

“ওহ তারমানে আপনি ছেঁকা মানে আপনাদের ব্রেকয়াপ হয়ে গেছে আরকি!”

“আমাদের মাঝে কোন সম্পর্কই ছিলো না তাহলে ব্রেকয়াপ হবে কোথা থেকে?”

“আসতাগফিরুল্লাহ! সম্পর্ক না থাকলে এমনি এমনি আপনার ফিয়ন্সি হয়ে গেলো?কি মিথ্যে বাদি রে বাবা!”

“আমি মিথ্যে বলিনা যদি বিশেষ দরকার না হয়। আর তোমাকে কে বলেছে সম্পর্ক ছাড়া বাগদত্তা হওয়া যায়না?যারা এরেঞ্জ মেরেজ করে তাদেরও তো সম্পর্ক ছাড়াই এংগেজমেন্ট হয় তাইনা?আমাদেরটাও তেমন ছিলো যেটা থেকে মুভ অন করা দরকার। এনিওয়ে এই ছেলের সাথে তুমি কোন সম্পর্ক রাখবে না”

“শুনুন আপনার নিজের গার্লফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকয়াপ হতে পারে কিন্তু আমাদের ভালো সম্পর্ক আছে। আমরাতো তিনবছর পরেই বিয়ে করবো! আর আপনি আমাদের সম্পর্কে না বলার কে?”

“ভুলে গেলে কি বলেছি?আমি তোমার হাজবেন্ড, তোমার সন্তানের বাবা!”

“জানি কিন্তু সেটা তিনবছরের জন্য!তিনবছর পরতো আর থাকবেন না”

“সেই কখন থেকে তিনবছর তিনবছর বলে যাচ্ছো! কে বলেছে আমাদের সম্পর্ক তিনবছরের?”

“ওমা ভুলে গেলেন?’তুমি আমার সন্তান দুবছর হওয়া পর্যন্ত থাকবে তারপর ইউ আর ফ্রি’ নিজে বলে আবার নিজেই খেয়ে ফেললেন!মনে নেই আমাদের তিনবছরের চুক্তির কথা?”

“কিসের চুক্তি আমার তো মনে পড়ছে না! কাগজ দেখাও তাহলে মেনে নিবো। তুমি কি এমন কোন কাগজে সাইন করেছো যাতে আমাদের চুক্তির কথা উল্লেখ আছে?”

“মানে কি?আপনি নিজের মুখের কথা ফিরিয়ে নিচ্ছেন?আপনি কি মিথ্যে বাদি!”

“ওই ছেলের সাথে যদি আর কথা বলতে দেখি তাহলে একদম সারাজীবনের জন্য তুমি আর ফোন ইউজ করতে পারবে না বলে দিলাম”

“আপনি আমাকে এসব বলার কে?”

“তোমার হাজবেন্ড, তোমার অর্ধাংশ! বুঝেছো?”

“হুহ মানে কে?”

“তুমি মানো আর না মানো আমি তোমার হাজবেন্ড এটা তুমি বদলাতে পারবে না তাই যতো তাড়াতাড়ি মাথায় ঢুকাতে পারবে ততই মঙ্গল”

“মি.খান! বাই এনি চান্স আর ইউ জেলাস?”

সায়ান থমকে গেলো তারপর রুশির দিকে কিছু ঝুঁকে বললো

“অফ কর্স আমি জেলাস! আমার বউ অন্য ছেলের সাথে প্রেম করছে আর আমি জেলাস ফিল করবো না?”

সায়ানের এই সহজ স্বিকারোক্তিতে রুশি অবাক হলো, আসলেই নিরামিষ একটা। কই বলবে ‘না আমি জেলাস না, তুমি ভুল ভাবছো’ তারপর ব্লাস করবে আর আমি এটা নিয়ে পচাবো যে ‘তাহলে আপনি টমেটোর মতো লাল কেনো হয়ে আছেন?’ কিন্তু না তাতে একবালতি জল ঢেলে দিলো!কিন্তু এতোসহজে তো তাকে জিততে দেয়া যাবে না তাই রুশি হুট করে বলে উঠলো

“কেনো এতো জেলাস কেনো হবেন? আমি অন্যকারো হলে আপনার কি যায় আসে?আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন?”

“যদি বলি হ্যা?তাহলে কি করবে?”

“তাহলে ভাববো আমি দিবাস্বপ্ন দেখছি। দ্যি গ্রেট সায়ান জামিল খান আমার মতো সাধারণ মেয়ের প্রেমে পড়বে তা কি করর সম্ভব? প্রকৃতি তো মেনে নিবে না”

“প্রকৃতি না মানলে কার বাপের কি?আর দিবাস্বপ্ন তো সত্যিই হবে তাইনা? কারণ সেটা সজ্ঞানে দেখা হয় তাই সেটা পুরণ হওয়ার চান্স বেশি যেখানে রাতের স্বপ্নে নিজের হাত থাকে না আর না সেটা সজ্ঞানে দেখা হয় তাহলে তা কি করে সত্যি হবে?আর আমি বরাবরই সাধারণতায় মুগ্ধ হই সেটা কোন জিনিস হোক কিংবা মানুষ! এটা অসম্ভব কিছু নয়!

“এটা কি ইন্ডিরেক্টলি আমাকে কিছু বুঝানো হচ্ছে?”

“থ্যাংক গড তুমি এইটুকু তো বুঝতে পেরেছো আমি তোমাকে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করছি! যাইহোক বাবার সাথে যদি দেখা করতে চাও তাহলে সব খেয়ে শেষ করো নাহয় এই রুম থেকে একপাও বের হতে পারবে না”

রুশি বুঝতে পারলো সায়ান যা বলেছে তা করে ছাড়বে!আচ্ছা সরাসরি বললে কি হয় ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি!’ তা না পেঁচিয়ে বলবে। তারউপর আমার স্বাদের ফোন ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেলো অথচ কাজের কাজ কিছু হলো না। ধ্যাৎ সামুকে আবার বলতে হবে অন্যকোন আইডিয়া দিতে।ও মুখ ফুলিয়ে খাবার চিবোতে লাগলো এদিকে সায়ান কিছুক্ষণ পুর্বে সাহিলকে মেসেজ করে বলেছিলো এই আইডির মালিককে খুঁজে বের করতে,আর এখন জানতে পারলো এটা সামুর ফেক আইডি! এরমানে রুশি ওকে টেস্ট করতে চাইছে, ঠিক আছে তুমি যখন খেলতে চাইছো আমিও নাহয় তোমার সাথে খেলবো!
সায়ান বাঁকা হাসি দিয়ে রুশির দিকে তাকালো,,,

______________________

রুশির বাবা বসে বসে সাহিলের সাথে কথা বলছিলো এমন সময় নারীকন্ঠ শুনতে পেলো

“আপনি নিশ্চই রুশিমার বাবা! কেমন আছেন ভাই সাহেব?”

রুশির বাবা তাকাতেই থমকে গেলো,উনি এখানে কি করছে? আর রুশিকে মা বলছে মানে রুশির শাশুড়ি? রুশির বাবা সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলো

“আপনি সায়ানের মা?মানে ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট জামিল খানের ওয়াইফ?”

“জি! আপনি জামিল কে চিনতেন?”

“নাহ নাহ ব্যাক্তিগত চিনতাম না কিন্তু টিভিতে তো দেখেছি আর কি!আসলে আমার কিছু কাজ বাকি আছে তাই আর থাকা সম্ভব হচ্ছেনা। আপনারা ভালো থাকবেন আর রুশির দিকে খেয়াল রাখবেন”

“সেকি রুশিকে না বলেই চলে যাবেন?”

“আরেকদিন আসবো ওকে দেখতে, আজ আসি আমি”

বলেই রুশির বাবা উঠে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে পড়লো, সাহিল কিছুটা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো। কেনো যেনো মনে হচ্ছে উনি সায়ানের মা কে আগে থেকে চিনে!সাহিল তার বসকে জানাবে বলে ঠিক করলো!

এদিকে রুশির বাবা গেট থেকে বেরিয়ে যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। যার থেকে পালাচ্ছিলো সেটা আজ তার সামনে! নিয়তি! বড্ড জটিল বিষয়। মানুষ আর যাইহোক নিয়তি থেকে পালাতে পারে না, যার ভাগ্যে যেখানে যাওয়ার থাকে দিনশেষে সে সেখানেই যায়। হাজার চেষ্টা করেও তাকে সেখান থেকে সরিয়ে রাখা যায়না।রুশির ভাগ্যে হয়তো এমনটাই হওয়ার ছিলো তাইতো ও এই খান বাড়িতেই এসেছে ঘুরেফিরে।

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_ ৪১

বদ্ধকামরার চেয়ারে একজন হেলান দিয়ে বসে আছে, পাশে থাকা লোকদুটো থরথর করে কাঁপছে। বন্দুক হাতে লোকটি এক ধ্যানে মনিটরের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে, বন্দুকে বুলেট লোড করা
যেকোন সময় এই গুলি ওদের দেহ বিদ্ধ করতে পারে,ওদের জীবন সম্পুর্ণ নির্ভর করছে সামনে থাকা ব্যাক্তিটির মনের ভাবের উপর। তাদের কাঁপাকাঁপি দেখে লোকটি বাঁকা হাসলো,ওদের এইরুপ ভয় পাওয়া যেনো ওকে পৈশাচিক আনন্দ দিচ্ছে!সে চায় তার আশেপাশের মানুষ তাকে ভয় পাক, তার কাছে নিজের প্রাণের ভিক্ষা করুক এমনকি স্ক্রিনে থাকা খান বাড়ির সন্তানও!

মুহুর্তেই হাসিমাখা মুখ মিলিয়ে গেলো, চোখমুখে প্রকাশ পেলো তীব্র ক্ষোভ,রাগ আর ঘৃণা! সামনে থাকা কি বোর্ড সজোরে আছাড় মারলো নিচে, সেটা ভেঙ্গে কয়েকভাগ হয়ে গেলো।তবুও রাগ যেনো এক অংশও কমে নি বরং বেড়েছে! কোনরুপ ওয়ার্নিং না দিয়েই হঠাৎ পাশে থাকা দুজনের মাথায় গুলি করে দিলো আর তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। এই দৃশ্য যেনো তার আনন্দ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিলো, সামনের লোকদুটোর মতোই একই অবস্থার কল্পনা করলো স্ক্রিনে থাকার সদ্য আর্লি টুয়েন্টিতে থাকা ছেলেটাকে নিয়ে। তাকে এই মুহুর্তে মেরে ফেলতে পারলেই যেনো শরীরের সকল ক্ষোভ মিটে যাবে!

বাইরে থেকে দৌঁড়ে আসলো কয়েকজন, গুলির আওয়াজ শুনে প্রথমেই ঢুকার সাহস পায়নি কিন্তু যখন দেখলো আর আওয়াজ শুনা যাচ্ছে না তখন বুঝতে পারলো আর গুলি চলবে না। তাই কয়েকজন মিলে ঢুকলো আর দেখলো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে দুইজনের লাশ! তারা আস্তে করে ঢুকতেই সেই লোকটা ইশারা করে লাশ বাইরে নিয়ে যেতে বললো।

লাশ নিয়ে ঘরে যেতেই প্রবেশ করলো এডম, বদ্ধঘরে থাকা লোকটির সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং শক্তিশালী মানুষ যাকে বলে বাঁ হাত! সবাইকে শেষ করে দিলেও এর গায়ে আঁচও লাগতে দেয়না লোকটি, যতো পাগলামির খেলায় মেতে থাকুক না কেনো এডমকে কখনো হাত ছাড়া করেনা। কথায় আছে না ‘জাতে মাতাল তালে ঠিক’ ঠিক তেমনি এও ঠিক আছে, পাগল হলেও নিজের ভালো বুঝে। যে খেলায় নেমেছে সে খেলায় এডমকে কতটা প্রয়োজন সেটা শুধু ওই জানে!

এডমকে দেখেই ইশারায় কাছে ডাকলো, নিরব ভক্তের মতো সেও কাছে গিয়ে দাঁড়ালো তারপর নিম্নস্বরে বললো

“বস তাহলে এখন আপনি কি করবেন?”

“যে পাখি আমি চুজ করে দিয়েছি সে পাখিতে তার মনোযোগ নেই বরং সে অন্যপাখিতে মজেছে।ঠিকাছে তবে তাই হোক,আমি এই চাল চেলেছি তার মনের অবস্থা জানার জন্য যে ও কাকে বেঁছে নেই স্ত্রী নাকি প্রেমিকা?একদিকে মৃত্যুশয্যায় থাকা স্ত্রী আর অন্যদিকে ছয়বছরের প্রেমিকা যেকিনা একসময় তার প্রান বাঁচিয়েছে অন্তত সায়ানের জন্য তো তাই। আমি ভেবেছি প্রেমিকার মুল্য বেশি হবে কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে নিজ স্ত্রীকে চুজ করলো আসলে রক্ত তো কথা বলে!তারমানে যদি তার স্ত্রীর কিছু হয় তবে সে তো বুমমমম!”

“বস তাহলে ওই মেয়েটিকে কি করবেন?সেতো আমাদের ব্যাপারে সব জানে!”

“যে পাখি কাজেই লাগেনি সে পাখিকে রেখে কি লাভ?বরং ওর অসংযত মুখ আমাদের কাল হতে পারে তাই ওকে শেষ করে দাও। ওর প্রয়োজন শেষ আমাদের!”

“জ্বি বস কিন্তু আমরা তার কোন খোঁজ পাচ্ছিনা, হসপিটাল থেকে বেরিয়ে ঠিক কোথায় গেছে জানা নেই। তবে এতটুকু জানি খান বাড়িতে যায়নি আর না সেই ফ্লাটে! আমরা খোঁজ চালাচ্ছি, যেখানেই পাবো সোজা উড়িয়ে দিবো। টেনশন করবেন না আপনি!”

“আচ্ছা!এইজন্যই আমি তোমায় এতো বিশ্বাস করি এডম! আমি না চাইতেও তুমি সব বুঝে যাও”

এডম কিছু না বলে কামরা থেকে বেরিয়ে পড়লো আর সে সেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো!চোখেমুখে হাসির ছোঁয়া। কারো দুর্বলতা খুজে পাওয়া একটা আর্ট আর সেই দুর্বলতায় আঘাত করে সাকসেসফুল হলে খুশির আর অন্ত থাকে না। ব্যাস সেই মুখখানা দেখার অপেক্ষায় আছে যখন তার সামনে নিজেকে মেরে ফেলার জন্য প্রাণ ভিক্ষা চাইবে তার সবচেয়ে বড় শত্রু তাও নিজ স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য!হাহাহা হোয়াট আ সিন দেট উইল বি!

_____________________________

গিটারের টুংটাং আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায় চন্দ্রিকার, মাথা ধরে উঠে বসে। কাল রাত বেশি কান্না করায় মাথা ভার হয়ে আছে, গিটারের সুমধুর এখনো কানে বাজছে। এই সুরের প্রেমে কোন একসময় পড়েছিলো আর এখন আর সেই মানসিকতা নেই। জীবন বড্ড বিষাদময় হয়ে গেছে, এসব প্রেম-ভালোবাসায় বিশ্বাস ভরসা কোনটিই নেই। মনে হয় এসব ভালোবাসা অনেক দামি যা ওর জন্য নয়, এসব চাওয়াও মহাপাপ!

ভাবনার মাঝেই মৃদু স্বরে গাওয়া গান ভেসে আসলো কানে, কি মধুর কন্ঠ!মৃদু পায়ে দাঁড়িয়ে সেই আওয়াজের পানে ছুটলো চন্দ্রিকা,পাশের ঘরের সামনে যেতেই আওয়াজ যেনো গাঢ় হলো। রুমের ভেতরে না যেয়েই দরজার কাছেই বসে পড়লো হাটু গেড়ে! দরজায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুনতে লাগলো প্রতিটি লাইন…

কেন রোদের মতো হাসলে না
আমায় ভালোবাসলে না,
আমার কাছে দিন ফুরালেও আসলে না।
এই মন কেমনের জন্মদিন
চুপ করে থাকা কঠিন,
তোমার কাছে খরস্রোতাও গতিহীন।

নতুন সকাল গুলো কপাল ছুঁলো তোমারই
দূরে গেলেও এটাই সত্যি তুমি আমারই,
শুধু আমারই…

পাতাভরা সব দু-টুকরোরা
কাল বৈশাখীর মতো মুখচোরা,
সব ভিজে যাক শুধু বেঁচে থাক অভিমান
নতুন সকালগুলো কপাল ছুঁলো তোমারই
বেঁধে রাখতে পারলে তুমিও হতে আমারই
শুধু আমারই …

প্রত্যকটা কথা যেনো ওকে ঘিরে কেউ বেশ আকুতি নিয়ে গাইছে আর সেই মানুষটি আর কেউ নয় বরং শাহেদ। এই লাইনগুলোর মাধ্যমে নিজের সুপ্ত ভালোবাসা আর না পাওয়ার বেদনা যেনো তুলে ধরছে। মানুষটিকে ও বুঝে না, কি চায় সে? কি তার উদ্দ্যেশ্য? মাঝেমাঝে মনে হয় সে খুব আপন কেউ আর পরক্ষনেই ওর ধারণা সম্পুর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়। কিছু বলার আগেই যেনো সব পেয়ে যায় তার কাছ থেকে তবুও মানুষটি এতো বুঝেও যেনো ওকে বুঝে না। ক্লাবের ফ্লোরে দেখা হওয়ার থেকেই খুব অদ্ভুত আচরণ করে সে, চন্দ্রিকার উপর তার আলাদা কর্তৃত্ববোধ! ও চেয়েও সেটার থেকে বেরুতে পারেনা। কেমন যেনো অদ্ভুত এক মায়াজালে বন্দি হয়ে আছে!

এই পর্যন্ত অনেক ছেলে ওর সুযোগ নিতে চেয়েছে। ড্রাংক অবস্থায় বেড টাচ করেছে কিন্তু শাহেদ ওকে সবচেয়ে মোক্ষম সময় পেয়েও ওর সাথে কিছু করেনি, বরং নিজের গায়ের কোর্ট পরিয়ে দিয়ে গাড়িতে সেফ ভাবে রেখেছিলো। শাহেদের কাছে থাকলে নিজেকে খুব নিরাপদ মনে হয়,খুব বেশি দেখা হতোনা শাহেদের সাথে ওর আর না ওর তেমন কোন ইচ্ছে থাকতো ওর দেখা করার। তবে যখনি কোন বিপদে পড়েছে তখনি সবার আগে ওকে পেয়েছে! প্রতিবার নিজ দায়িত্বে ফ্লাটে বা সায়ানের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলো আর যাওয়ার সময় কপালে দীর্ঘসময় ধরে চুমু খেয়েছে তার কিছু না বলেই চলে গেছে। মাঝেমাঝে কিছু কথা মনে লোকটি ওকে ভালোবাসে কিন্তু তার পর মুহুর্তেই মনে হয় সে তাকে ঘৃণা করে প্রচণ্ড ঘৃণা!

চন্দ্রিকার চোখ বেয়ে দুফোটা জল গড়ালো, কষ্টও নয় আবার সুখেও নয়। অদ্ভুত এক অনুভুতির বশে যেনো আটকা পড়ে আছে ও,কিছুক্ষণ পর নিজের সামনে আরেকজনের উপস্থিতি বুঝতে পারলো।চোখ মেলেই শাহেদকে দেখতে পেলো, সে পরম যত্নে ওর চোখের পানি মুছে দিচ্ছে তারপর আলতো স্বরে বললো

“এখনো মাথা ব্যাথা করছে? এখানে বসে আছো কেনো? ফ্লোর ঠান্ডা তাই দ্রুত সর্দিকাশি হতে পারে। চলো রুমে যাবে”

চন্দ্রিকা তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাঁকালো তারপর বললো

“আপনাকে আমি বুঝিনা,প্রতিমুহুর্তে যেনো নতুন গোলকধাঁধায় রুপান্ততিত হন। এমন কেনো আপন?”

চন্দ্রিকার এমন কথা শুনে শাহেদ হাল্কা হাসলো তারপর কপালের চুল সরাতে সরাতে বললো

“আমাকে তোমার বোঝার দরকার নেই, যতো বুঝার চেষ্টা করবে ততো অতলে হারিয়ে যাবে। শুধু শুধু বৃথা চেষ্টা করোনা, এটুকু খালি জেনে রাখো আমি তোমাকে বুঝি! তুমি নিজেকে যতোটুকু বুঝো তার থেকেও বেশি।”

চন্দ্রিকার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো আর চন্দ্রিকা আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো।

_________________________

খান বাড়িতে আজ খুশির আমেজ চলছে, ইনান আর সামুর আজ বিয়ে তাও খুব ঘরোয়া ভাবে। পরে অনুষ্ঠান করে তাকে উঠিয়ে নেয়া হবে আপাদত শুধু কাবিন পড়িয়ে রাখবে। যদিও প্রথমে এভাবে কেউ রাজি হয়নি কিন্তু ইনানের জোরাজুরিতে সবাই রাজি হলো। ইনানের ভাষ্যমতে সামুকে খুব কষ্টে মানাতে পেরেছে তাই আবার কখন মত ঘুরে যায় কে জানে? এর রিস্ক না নেয়াই ভালো! এটলিস্ট বউ হিসেবে অভিমান করলেও ছেড়ে যাবে সহজে। যেহেতু সায়ান আর রুশির বিয়েও সে ভাবে হয়নি তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেবি হওয়ার পর যখন সে একটু বড়ো হবে তখন দুইজোড়ার একসাথে রিসেপশন করা হবে আপাদত ঘরোয়া ভাবে এসের বিয়েটা হয়ে যাক।

রুশি কখন থেকে শাড়ি পড়ে সেজেগুজে বসে আছে কিন্তু তার নিচে যাওয়ার অনুমতি নেই। সায়ান নিজে এসে নাকি নিয়ে যাবে নিচে এর পুর্বে এক পা নড়লেও পা ভেঙ্গে ফেলবে। হুহ যত্তসব!
বলে যখন তোমার দরকার তখনি এসে নিয়ে যাবো,এখন যদি সব সাজানো না দেখে তাহলে কি আর বিয়ে বাড়ি ফিল আসে?
সেদিনের পর সায়ানের যেনো কি হয়েছে, যদি বলে আমি ছেলেদের সাথে প্রেম করছি! তার যেনো কোন ভাবান্তরই হয়না।

“আরো বলে যতগুলো পারো করো সমস্যা নেই, তোমার যতো ইচ্ছে প্রেম করতে পারো। দিনশেষে বউ তো আমারই থাকবা তাইনা?আমার থেকে সাজেশন নিও কিভাবে ছেলেদের মন রাখতে ঠিক আছে?ছেলে হিসেবে আমার থেকে ভালো আর কে জানবে তাইনা?”

রুশি অবাক হয়ে বসে ছিলো, কি বলে এই ছেলে? বেশি শকে কি পাগল হয়ে গেছে? এর কি জেলাসি নামক শব্দের সাথে কোন পরিচিতি ঘটে নি?
রুশি মুখ ফুলিয়ে বসে আছে, সেই কখন নিচে গিয়েছে!

এদিকে সায়ান সবাইকে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে সবকিছু করার, আগের সকল মেড চেঞ্জ করা হয়েছে এবং প্রত্যেকটা সার্ভেন্টের উপর বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে। রুশিকে নিয়ে কোন প্রকার রিস্ক নিতে চায়না ও,সায়ান সবকিছু দেখছিলোই এরমাঝেই সদর দরজা খুলে যায় আর দুজন পরিচিত মুখ ভেসে আসে। সায়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বিশেষত মাঝ বয়সী সেই নারীর দিকে! আজ এতোবছর পর এভাবে তাকে দেখবে ভাবতে পারেনি।

#চলবে

গুমোট অনুভুতি পর্ব-৩৮ + বোনাস পার্ট

0

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৩৮

চন্দ্রিকা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সায়ানের দিকে আর সায়ান এখনো রুশির দিকে তাকিয়ে!ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে,ঠোঁট জুড়ে বিরাজমান গোলাপি আভা অনেকটা হাল্কা হয়ে আছে। সায়ান নিজের বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে আলতো করে ছুয়ে দিলো তারপর শান্ত স্বরে বললো

“সেটা তো তোমার খুব ভালো করে জানার কথা চন্দ্রিকা! আমি কি বিষয়ে কথা বলছি তা তোমার থেকে ভালো আর কে জানে?”

“আমি জ্ জানি মানে কি?সায়ান তুমি যা শুনেছো তা ভুল শুনেছো, কেউ হয়তো আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে! সব মিথ্যে বিশ্বাস করো সব!”

“তুমি এখনো জানোই না আমি কি নিয়ে কথা বলছি কিন্তু তুমি বলছো সব মিথ্যে! আচ্ছা কোনটা মিথ্যে?সেদিন স্ক্যান্ডাল এর বিষয়টি নাকি সেখানে রিপোর্টার পাঠানোর বিষয়টি?নাকি আমার বাড়িতে আমার বউকে দিনের পর দিন ড্রাগস দেয়ার ঘটনাটি মিথ্যে? আর সবচেয়ে বড় কথা আমার স্ত্রী আর অনাগত সন্তানের ক্ষতি করার চেষ্টা সব মিথ্যে?”

“তুমি স্ সব জানতে তাইনা?”

“হাহ কি মনে হয় তোমার?তুমি আমার নাকের নিচে দিয়ে সব করে যাবে আর আমি জানবো না?ভুলে গেছো আমি কে?সায়ান জামিল খান! তুমি সব করে যাবে আর আমি কিছুই জানবো না সেটা তোমার বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে তুমি এমন কাজ করলে কি করে?একসময় আমার মনে হতো যে চন্দ্রিকা আর যাইহোক খারাপ কিছু করবে না বাট আই ওয়াজ রং! তোমার থেকে জঘন্য কাজ আর কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়। মাঝেমাঝে মনে হয় আমি তোমাকে চিনিনা, খুব অচেনা কেউ তুমি!তুমি আমার ছোট্ট পরী হতেই পারো না, তুমি অন্যকেউ!অপরিচিত কেউ!কারণ সেই মেয়েটি অবুঝ থাকা সত্ত্বেও অন্যকারো প্রাণ বাঁচানোর মতো পদক্ষেপ নিয়েছিলো কিন্তু তুমি?তুমিতো বুঝদার হয়েও মানুষের ক্ষতি ছাড়া অন্যকিছু করলে না, তুমি আর সে একই মানুষ কি করে হতে পারো। মাঝেমাঝে মনে হয় আমি হয়তো সঠিক জনকে খুঁজেই পায়নি আর যদিও পেয়েছি তবে সে আর আমার ছোট্ট পরী ছিলো না, ততদিনে সে অন্যকেউ হয়ে গিয়েছো!”

“কি বলতে চাইছো তুমি সায়ান আমি মিথ্যে বলছি?আমার সে নই যাকে তুমি খুঁজছিলে? এখন ওই মেয়েটিকে পেয়ে আমার অস্তিত্বকেও অস্বীকার করবে তুমি?ও আমার নামে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলেছে আর তুমি বিশ্বাস করেছো। সায়ান তুমি আমাকে বিশ্বাস করছো না কেনো? তোমার মনে হয় আমি এমন কিছু করতে পারি?”

“বিশ্বাস! এই শব্দটার সাথে আদোও তোমার কোন সম্পর্ক আছে চন্দ্রিকা?তুমি এই শব্দটার মানে বুঝ?তুমি জানো কখন একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে বিশ্বাস করে?জানোনা তাই এই শব্দটা তোমার মুখে মানায়না আর রুশির কথা বলছো তো!ও বানিয়ে মিথ্যে বলবে আমায়?হাসালে আমাকে যেখানে ও নিজেই নিজের হুশে ছিলো না এন্ড থ্যাংকস টু ইউ। তুমি কোনটাকে মিথ্যে বলবে?তুমি রুশির বিষয়ে স্ক্যান্ডাল ছড়াও নি?তাকে হেনস্তা করার জন্য ভার্সিটিতে রিপর্টার পাঠাওনি? আর সবথেকে বড় কথা হচ্ছে তুমি আমার আর রুশির ঘনিষ্ঠ ছবি দেয়ালে লাগিয়ে দিয়েছো যাতে সবাই ভাবে রুশি অন্যের সংসার ভাঙছে!”

সায়ান হাত মুঠ করে ফেললো তারপর উঠে দাঁড়িয়ে চন্দ্রিকাকে নিয়ে বারান্দায় চলে এলো, এই মুহুর্তে রুশির রেস্টের প্রয়োজন আর সায়ান যতোটা হাইপার হয়ে গেছে! ওইখানে থাকলে চেঁচামিচি হবে যা রুশির জন্য খারাপ। ও চন্দ্রিকার হাত ছেড়ে ওর দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাঁকালো কিন্তু ঠোঁটের কোনায় বাঁকা হাসি ঝুলছে যাতে ওকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। ও দাঁতে দাঁত চেপে বললো

“একজন নারী হয়ে আরেকজন নারীর সম্মানে আঘাত করতে তোমার এইটুকু বাধেনি? হাউ কুড ইউ?একটা মেয়ের জন্য মিস্ট্রেস শব্দটা শুনা কতোটা কষ্টের তা নারী হিসেবে তোমার থেকে ভালো আর কে জানবে?তোমাকে সাহস দিয়েছে কে এমনটা করার?”

“তুমি কি করে জানলে এসব?কে বলেছে তোমাকে?”

“যাদের তুমি টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিলে তারা বলেছে তাও খুবই অল্প সময়ের মাঝে। কি বলোতো পাওয়ার আর প্রপার্টি দুটোয় আমার বেশি তাই সায়ান জামিল খান পারেনা এমন কিছু নেই তা তুমিও জানো!”

“তারমানে তুমি সবই জানতে! তাইতো এতো হট নিউজ হওয়া সত্ত্বেও সেটা দুদিনের মাঝেই গায়েব হয়ে গেলো! নো ওন্ডার ইউ ডিড দেট”

“তো আর কি আশা করছিলে?আমার স্ত্রীর অপমান আমি মুখ বুঝে সহ্য করবো? ভাবলে কি করে তুমি?আনফর্চুনেটলি আমার এক্সিডেন্ট হয়েছে বলে ওই স্ক্যান্ডাল দুদিন পর্যন্ত ছিলো নাহয় ওইটা বের হওয়ায় আগেই শেষ হয়ে যেতো!আমার স্ত্রীর দিকে আঙুল তুলার সাহস পেতো না কেউ”

“স্ত্রী?বাহ সে তোমার স্ত্রী হয়ে গেলো এখন সায়ান?তবে আমি কি তোমার?ওই দুদিনের মেয়ের জন্য আমি এখন পর হয়ে গেলাম?ওই কেরেক্টারলেস মেয়ের জন্য এতো দরদ তোমার?যে কিনা নিজের পুরোনো প্রেমিকের সাথে এখনো সম্পর্ক রাখে!তুমি জানো পুরোনো প্রেমিক কে?তোমার বোনের হবু জামাই ইনান! এক ছাদের নিচে থেকেও কিভাবে মানুষ স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে?নিশ্চিত সম্পর্ক এখনো আছে আর তাইতো এমন ভান করতে পারছে যেনো চিনেই না।হাহ হোয়াট আ ট্যালেন্ট! ঘরের টাও ঠিক রাখছে আর বাইরের টাও সামলা…”

আচমকা শব্দে চন্দ্রিকা চমকে উঠে নিচে তাকালো আর দেখলো সায়ানের ফোন ভেঙে চৌচির হয়ে আছে আর সে চোখ বন্ধ করে হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে। ও বুঝতে পারছে যে ওই ফোনের স্থানে ও থাকতো হয়তো! চন্দ্রিকা চুপ হয়ে গেলো আর সায়ান চোখমুখ শক্ত করে বললো

“আমার মা আমাকে নারীদের অসম্মান করতে শিখায় নি নাহয় যে মুখ দিয়ে তুমি আমার স্ত্রীকে ইন্সাল্ট করেছো তা ছিড়ে ফেলতে আমার এক সেকেন্ড সময় লাগতো না, ট্রাস্ট মি একসেকেন্ডও না! তবে আর একটা শব্দ বললে আমি ভুলে যাবো তুমি একজন নারী! আর কেরেক্টার নিয়ে বলছো তো?কেরেক্টারের কি জানো তুমি?তোমার নিজের কেরেক্টার দেখেছো? আচ্ছা সেটা বাদ দাও এটা বলতো দুইমাস পুর্বে তুমি হসপিটালে কেনো গিয়েছিলে?”

“নর্মাল চেকয়াপ ক্ করানোর জন্য আর ক্ কি জন্য?”

“হাহ নর্মাল চেকয়াপ? নাকি অন্যকিছু! আমিই বলছি কেনো গিয়েছিলে,আচ্ছা তোমাকে একটা গল্প শুনাই! একটা মেয়ে একটা ছেলেকে বারবার ভালোবাসি ভালোবাসি বলতো আর ছেলেকে মেয়েটিকে ভালোবাসতে না পেরে খুব গিল্টি ফিল করতো! হঠাৎ একদিন সেই মেয়েটি প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলো আর চারমাস পর্যন্ত মেয়েটা বুঝতেই পারেনি! যখন বুঝতে পারলো তখন মেয়েটা ওই বাচ্চাটিকে মেরে ফেললো কিন্তু অপারেশন সাকসেসফুল না হওয়াতে মেয়েটি সারাজীবনের জন্য মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললো! ঘটনা চেনা চেনা মনে হচ্ছে না?জানতে চাইবে না মেয়েটা কে?সেই মেয়েটি হচ্ছো তুমি! এম আই রাইট?”

“তুমি ক্ কি বলছো আ্ আমি বুঝতে পারছিনা”

“বুঝতে ঠিকই পারছো কিন্তু মানতে পারছো না, ভাবছো আমি কি করে জানলাম এইসব! মনে আছে আমি একদিন বাসায় গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম হসপিটালে কেনো গিয়েছিলে?তুমি বলেছো নর্মাল চেকয়াপ কিন্তু আমি ওইদিনই সব জানতাম তবে কিছু বলিনি কারণ অপমান করতে চাইনি তোমায়। তবে আজ বলেছি কারণ আমার স্ত্রীর দিকে আঙুল তুলেছো! ইনান আর রুশির মাঝে যা সম্পর্ক ছিলো তা শুধু বন্ধুত্বের! আর যদি অন্যকিছু থেকেও থাকতো তবে সেটা অতীত আর অতীত নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই। আমি ওর বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ তাই ও যতোদিন আমার সাথে থাকতে চাইবে ততদিন শি ইজ মাইন!”

সায়ান এই টুকু বলে থামলো তারপর আবারও বলা শুরু করলো

“আর রইলো তোমার কথা! তুমি খুব বলো আমায় ভালোবাসো? তাহলে যখন অন্যের সাথে সম্পর্কে জড়াচ্ছিলে তখন সেই ভালোবাসার কথা মনে পড়েনি?মনে পড়েনি আমি চিট করছি?তারউপর কি করলে প্রেগন্যান্সির খবর জানার সাথে সাথে তুমি সেটা এবর্শন করাতে গেলে, ডাক্তার বললো এটা রিস্কি তবুও তুমি করালে নিজের স্বার্থের জন্য! আর অপারেশন সাকসেসফুল হলো না, তুমিও আর মা হতে পারবে না। তাই তুমি একটা গেম খেললে! তুমি একটা মেয়েকে আমার রুমে পাঠালে যাতে সে আমার বেবি ধারণ করে এজ আ সারোগেট মাদার! যাতে আমি সারাজীবন গিল্টি ফিল করি আর তুমি আমার জীবনে সারাজীবনের জন্য জায়গা করে নাও। আর শুরুতে তাই হয়েছিলো!আমি গিল্টি ফিল করেছি আর তাই রুশিকে ভালোবাসা সত্ত্বেও তাকে নিজের থেকে দূরে রেখেছি তোমার কথা ভেবে যে তোমাকে হয়তো ভালোবাসি না কিন্তু তাই বলে ঠকাতে পারবো না কিন্তু ওইযে ভালোবাসা এমন একটা জিনিস যার থেকে দূরে থাকা যায় আর আমিও থাকতে পারিনি। আই ফল ইন লাভ উইথ রুশি আর আমি তাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছি!”

সায়ান এবার চন্দ্রিকার দিকে ঝুকে বললো

“ভাগ্য ভালো আমি তোমার মতো মেয়েকে ভালোবাসিনি নাহয় তোমার এই রুপ দেখে বড্ড কষ্ট পেতাম। ভাগ্য ভালো যে আমার রুমে ওইদিন রুশি ছিলো যে তোমার মতো স্বার্থপর নয়। থ্যাংকস টু ইউ, আমি আমার লাইফে সত্যিকারের মানুষটাকে পেয়েছি!আম গ্ল্যড দেট শি ইজ মাই ওয়াইফ!”

“সে তোমার ওয়াইফ হলে আমি কি?তুমি তোমার ওয়াদার কথা ভুলে গেছো সায়ান?তুমি আমাকে এভাবে ধোঁকা দিতে পারো না”

“প্রথমত শুরু থেকেই তুমি আমার দায়িত্ব ছিলে আর কিছুই না আর ওয়াদার কথা বলছো তো? একটা ওয়াদার উপর ভিত্তি করে সারাজীবন থাকা যায়না। আমি আমার বাবা নই যে নিজের ঘরে স্ত্রী রেখে অন্যনারীর সাথে পরকিয়ায় লিপ্ত হবো!তাই এই ওয়াদার কোন মুল্যেই নেই যেখানে তুমি সেই মানুষই না যাকে আমি চিনতাম। আর ধোঁকা তো তুমি আমাকে দিয়েছো! আমি তো ঠিকই ছিলাম কিন্তু রুশিকে তুমি আমার জীবনে এনেছো আর আমি তার জন্য শুকরিয়া আদায় করি। আর তোমার প্রেগন্যান্সি?এটা তুমিও জানো আর আমিও জানি যে তোমাকে আমি কিস পর্যন্ত কোনদিন করিনি, ছোয়া তো অনেক দুরের কথা!তুমি জোর করে দুই একবার জড়িয়ে ধরলেও আমি ছাড়িয়ে নিয়েছি নিজেকে। তাই বেবিটা আমার তো নয়ই তাহলে বেবিটা কার?তোমার ওই প্রেমিকের নাকি অন্যকারো?”

চন্দ্রিকার মুখটা চুপসে গেলো, জবাব দেয়ার মতো কিছু নেই ওর! সায়ান যা বলেছে সব সত্যি! কিন্তু বেবির ব্যপারটা?ও নিজেও চাইনি বেবিটাকে মারতে কিন্তু এ ছাড়া কোন উপায় ছিলো না ওর কাছে! ও বাধ্য ছিলো সম্পুর্ণটা সময়!চন্দ্রিকার চোখদুটো টলমলে করে উঠলো তা দেখে সায়ান ওর দিকে ঝুঁকে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো

“এবার বলুন মিস চন্দ্রিকা! আসলে কেরেক্টারলেস কে?আমি তোমাকে এসব বলে অপমান করতে চাইনি কিন্তু বাধ্য করেছো আমাকে। আমি তারপরোও সবকিছু ক্ষমা করে দিতাম কিন্তু রুশি তখন আমার লাইফে ছিলো,তাই ওকে ছেড়ে আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিলো না তাই অনেকদিন দোটানায় ছিলাম!পরে যখন বুঝতে পারলাম রুশিকে ছাড়া আমার চলবে না তখন চেয়েছিলাম তোমার দায়িত্ব নিতে কিন্তু তুমি কি করলে আমার স্ত্রীকে ড্রাগস দেয়া শুরু করলে যাতে সবাই ওকে ভুল বুঝে আর আজকে? তুমি তাদের মেরে ফেলতে চেয়েছো?যদি আমি এটা আগে জানতাম তবে তোমাকে বাঁচাতে লোক পাঠানো তো দুরের কথা আই উইশড তুমি মরে যেতে!”

“আমি ম্ মরে গেলে তুমি খুশি হতে?”

“অবশ্যই খুশি হতাম!তুমি স্ত্রী আর অনাগত সন্তানকে মারতে চেয়েছো তোমাকে যে আমি এখনো মেরে ফেলিনি সেটাই অনেক!তুমি যে আমার সামনে স্বশরীরে দাঁড়িয়ে আছো তা নিয়ে শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ নয়?বাট নাউ উই আর ইভেন। তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলে আর তাই আমি এখন তোমার প্রাণ নিবোনা, কিন্তু আজকের পর থেকে তোমার আর আমার কোন সম্পর্ক নেই, দায়িত্বেরও না। আজকের পর যদি তোমাকে আমার সামনে দেখি তবে তোমাকে খুন করতে আমার হাত কাঁপবে না। ট্রাস্ট মি একটুও না! নাউ গেট আউট।”

পরের কথাটা চিল্লিয়ে বললো সায়ান যাতে চন্দ্রিকা কেঁপে উঠলো আর চোখের কোনে থাকা জল গড়িয়ে পড়লো। ও সায়ানকে ভালো বাসেনা এটা ও জানে কিন্তু এতোগুলো বছরে সায়ানের প্রতি মায়া জমে গেছে তাইতো সায়ানকে মরতে দেয়নি, সকল কিছু ভেস্তে দিয়েছিলো। সায়ান সবসময় ওর ভরসার জায়গা ছিলো তাইতো আজ ওই ফায়ারে আটকে পড়ার পর সবার আগে সায়ানকে কল দিয়েছিলো কিন্তু সে উঠায়নি। সায়ানের এই ব্যাবহারে অনেক কষ্ট লাগছে ওর, বুকের মাঝে তীব্র ব্যথা হচ্ছে। মায়া জিনিসটা হয়তো এমনি বড্ড কষ্ট দেয়, এইযে ও ভাবতেই পারছেনা সায়ানের সাথে আজকের পর থেকে আর দেখা হবে না! কিন্তু ও বুঝতে পারলো এখানে থেকে লাভ নেই, আগে হোক আর পরে হোক একসময় না একসময় সায়ানের জীবন থেকে ওর যেতেই হতো কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি হচ্ছে বলে হয়তো মানতে পারছে না। চন্দ্রিকা সায়ানের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো

“আমি জানিনা তুমি বিশ্বাস করবে কিনা তবে সকল ঘটনার সাথে আমি জড়িত থাকলেও আজকের ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না!আমি কখনোই রুশি বা তার সন্তানের ক্ষতি করতে চাইনি। সেই ড্রাগস শুধু ওকে খিটখিটে করে দিবে এ ছাড়া আর কিছুই না বাকি ওদের ক্ষতি করার ইচ্ছে আমার কোনদিনই ছিলো শুধু চেয়েছি তারা তোমার জীবন থেকে চলে যাক। আজকের ঘটনায় আমার কোন হাত নেই!”

“যে নিজের সন্তানকে মারতে পারে সে সব করতে পারে, তুমি নিজের সন্তানকেই রেহাই দিলে না অন্যের সন্তানের প্রতি তোমার দরদ কাজ করবে কি করে। এর আগে আমি আমার কথা ফিরিয়ে নেই আর তোমাকে এখানেই শেষ করে দেই প্লিজ গো ফ্রম হেয়ার!দ্বিতীয়বার দেখলে আমি সত্যিই তোমাকে বাঁচতে দিবো না এন্ড ট্রাস্ট মি এই উইল ডু ইট”

চন্দ্রিকা আর দাঁড়ালো না, পিছনে ফিরে চলে গেলো। খুব ইচ্ছে ছিলো শেষবারের মতো সায়ানকে আরো একবার দেখবে কিন্তু সাহস জুগিয়ে উঠতে পারে নি। সায়ান সেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে,ও নিজের রাগ থামানোর চেষ্টা করছে!

পাশেই দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুশি, চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি পড়ছে। ও অনেক আগেই উঠে গিয়েছিলো যখন চন্দ্রিকা দরজা বাড়ি দিয়েছিলো কিন্তু ও কিছু বলেনি বরং চোখ বন্ধ করে ছিলো। সায়ান বেরিয়ে আসাতে ও দরজার পাশে দাঁড়ায় আর সব শুনতে পেয়েছে কিন্তু তাতে ওর বিশেষ মাথা ব্যথা নেই। ও শুধু এইটুকু ভাবছে যে সায়ান! ওর আর ইনান সম্পর্কে সব জানতো কিন্তু ওকে কোনদিন প্রশ্ন করেনি বরং ওকে কাঁদতে দেখে সেদিন শান্তনা দিয়েছিলো আর এমন ভান করেছিলো যে কিছু শুনেই নেই।সায়ান ওর ব্যক্তিত্বকে সম্মান করেছিলো আর আজও করছে! রুশি সায়ানকে ভালোবাসে অনেক আগে থেকেই কিন্তু কোনদিন সাহস করেনি বুঝানোর কারণ ও ভাবতো সায়ান চন্দ্রিকাকে ভালোবাসে! আজ যখন জানতে পারলো যে সায়ান ওকে ভালোবাসে তখন ও ঠিক কতোটা খুশি ও বুঝাতে পারবে না, ও কারো জীবনে তৃতীয় ব্যাক্তি নয় বরং সায়ানের জীবনের ফার্স্ট প্রায়োরিটি!

রুশি আস্তে করে চোখ মুছে নিজের স্থানে গিয়ে শুয়ে পড়লো। সায়ানকে বুঝতেই দিবেনা ও সব শুনেছে, এতোদিন ভালোবেসেও প্রকাশ করেনি এর শাস্তিতো পেতেই হবে। যতোদিন না সায়ান নিজের অনুভুতি প্রকাশ করবে ততদিন ও সায়ানকে নিজের অনুভুতির জানান দিবে না। রুশি বিড়বিড় করে বলতে লাগলো

“দেখি জনাব কতোদিন না বলে থাকতে পারে!আমাকে তো চিনেনা?মনের কথা যদি মুখ পর্যন্ত না এনেছি তবে আমার নামও রুশানি আনাম নয়!”

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_Extra

সায়ান কেবিনে ঢুকে ঘুমন্ত রুশির দিকে তাকিয়ে,আঁখিপল্লব হাল্কা কাঁপছে। কিছুক্ষণ পুর্বেই ডাক্তারের সাথে কথা হয়েছে! তারা বলেছেন তেমন গুরুতর কিছু হয়নি বিধায় আজকেই বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে তবে সাবধানে থাকতে হবে। যেহেতু ব্লিডিং হয়েছে তাই সাবধানে চলাফেরা করতে হবে আর প্রায় বেবি হওয়া পর্যন্ত রেস্টে থাকতে হবে।রুশির সামনে পরিক্ষা কিন্তু সায়ান ওকে নিয়ে রিস্ক নিতে চায়না তাই অলরেডি ভেবে নিয়েছে রুশিকে বলবে এই সেমিস্টার ড্রপ দিতে। আর যাইহোক বেবির মুল্য বেশি আর এই বেবির কারণেই রুশির ওর জীবনে আসা নাহয় ও কোথায় খুজে পেতো রুশিকে?ওতো ভাবতেই পারছেনা রুশিকে ছাড়া থাকার কথা।

সায়ান রুশির কপালে হাল্কা ঠোঁট ছোয়ালো তারপর হাত চেপে ধরে বসলো হঠাৎ ওর মাথায় কিছু আসলো। ও ফোন বের করে বিভিন্ন এংগেলে ছবি তুলতে লাগলো, কখনো চোখে তাকিয়ে থেকে কখনো, কখনো হাতে হাল্কা ঠোঁট ছুইয়ে কখনো বা কপালে। যখন কেমেরার দিকে তাকিয়ে রুশির গালে কিস করার জন্য এগুচ্ছিলো ঠিক সেই মুহুর্তে রুশি চোখ মেললো আর সায়ান আঁৎকে উঠে হাত থেকে ফোন ফেলে দিলো আর রুশির দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইলো, অপরদিকে রুশি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললো

“কি করছিলেন আপনি?”

“ক্ কিছু না, হে হে আমিতো জাস্ট ফোনে ফেসবুক স্ক্রল করেছিলাম। আ্ আর কিছু না!”

“আপনার ব্যাবহার কেমন যেনো সুবিধার ঠেকছে না, মনে হচ্ছে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন!”

“হোয়াট! তুমি আমাকে চোর বলছো?কোন এংগেলে আমাকে চোর মনে হয়?এতো হ্যান্ডসাম ছেলে কখনো চোর হয়?”

“আমি কিন্তু আপনাকে চোর বলিনি শুধু বলেছি চোরের মতো করছেন কিন্তু আপনিতো দেখছি স্বিকার করে নিচ্ছেন। ব্যাপারটা হলো না “ঠাকুর ঘরে কে?আমিতো কলা খাইনি!” আর আপনার অবস্থা দেখে বর্তমানে সব এংগেল থেকেই আপনাকে চোর মনে হচ্ছে। আর রইলো হ্যান্ডসাম হওয়ার বিষয়!মশাই আপনি নিজের একটু ওভার প্রশংসা করছেন না?আপনি হ্যান্ডসাম এটা কে বলেছে আপনাকে?”

“আমি তাহলে হ্যান্ডসাম নই?তুমি বলতে চাইছো আমি বাজে দেখতে?”

“নাহ তাওতো বলিনি! আপনি হ্যান্ডসাম না আবার বাজেও দেখতে না। ওই মোটামুটি কিছুটা কিউট দেখতে এর বেশিনা”

সায়ান রুশির মুখভঙ্গি দেখে হাসলো, তারপর কিছু একটা ভেবে বললো

“তাহলে তোমার কেমন ছেলে পছন্দ? সামওয়ান হু ইজ হ্যান্ডসাম অর কিউট”

“ইট ডিপেন্ডস আমি তাকে আমার লাইফে কিভাবে চাই। ধরুন যারা হ্যান্ডসাম দেখতে তাদের দেখে সবাই ফিদা হয়ে আর তাদের প্রতি এট্রাকশন কাজ করাও স্বাভাবিক। আর যারা কিউট দেখতে তাদের দেখলে আদর পায় হয়তো মায়াও যাগে!দেখলেই মনে হয় গাল টেনে ধরে বলি ‘অওওও সো কিউট’!”

রুশি হাত নিজের গাল টেনেই দেখালো যাতে সায়ানের হাসি পেলেও সামলে নিলো তারপর মৃদু স্বরে বললো

“ওহ আচ্ছা তার মানে আমাকে দেখলে তোমার আদর পায়?”

কথাটা শুনে রুশির কাশি উঠে গেলো, আমতা আমতা করে বললো

“সেটা আমি কখন বললাম?”

“একটু আগেই বললে আমি হ্যান্ডসাম না কিউট দেখতে, আর কিউট ছেলেদের দেখলে তোমার আদর পায়। এর মানে তো এটাই দাঁড়ালো যে আমাকে দেখলে তোমার আদর পায়”

কথাগুলো বলতে বলতে সায়ান রুশির দুপাশে হাত রেখে ওর দিকে অনেকটা ঝুকে গেলো। রুশির হার্টবিট বেড়ে গেলো ইনহিউমেন স্পিডে, ও কয়েকটা ঢোক গিলে বললো

“আপনি একটু সরে বসুন, আমার অস্থির লাগছে!”

সায়ান আরেকটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো

“কেনো অস্থিরতা কেনো কাজ করে তোমার? এখন আদর পাচ্ছে না?”

“নাহ, কারণ এই মুহুর্তে আপনাকে কিউট লাগছেনা”

“তাহলে কি হ্যান্ডসাম লাগছে যা দেখে তুমি এট্রাকটেড ফিল করছো?”

“আমি ক্ কবে বললাম সেটা?”

“ও তাহলে কাজ করছে না?কিন্তু আমিতো বড্ড এট্রাকটেড ফিল করছি!”

বলেই রুশির দিকে ঝুঁকে পড়লো আর রুশি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। অনুভব করলো কেউ ওর চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিচ্ছে,হঠাৎ করে গরম নিশ্বাস না পড়াতে রুশি চোখ খুললো আর দেখে যে সায়ান ওর পেটে দিকে তাকিয়ে আছে, রুশি ভ্রু কুচকে তাকালো, কি ভেবেছিলো আর কি হলো?ছিছিছি কি ভাবছিলি তুই রুশি আবার কিছু না হওয়াতে ডিজেপয়েন্টেডো ফিল করতেছিস?শেম অন ইউ!

“আর ফিলিং হট বেবি? তোমার মাম্মামের শরীরের তাপমাত্রা যে হারে বাড়ছে তোমার গরম লাগারই কথা”

বলেই রুশির দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ মারলো আর রুশি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। কি বলছে এই ছেলে?ও নিজের মাথায় হাত দিয়ে দেখলো নাহ তাপমাত্রাতো ঠিকই আছে! রুশি সন্দিহান দৃষ্টিতে বললো

“কই শরীর তো গরম নয়?”

“আমি কি তোমাকে বলেছি? আমি বেবির সাথে কথা বলেছিলাম।ব্যাপারটা এমন না?’ঠাকুর ঘরে কে?আমিতো কলা খাইনি!”

“আমার কথা আমাকে ফেরত দিচ্ছেন?”

“যদি ভাবো তাহলে তাই!আমিতো…”

সায়ান কিছু বলার আগেই কেবিনের দরজা খুলে গেলো আর সাহিল খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাহিল থতমত খেয়ে বললো

“স্যরি বস আমি বুঝতে পারিনি,আমি আসছি ইউ গাইজ কেরি অন”

রুশির যেনো নাক কান সব কাটা যাচ্ছিলো কিন্তু সায়ানকে সরানোর চেষ্টা করেও সরাতে পারছে না। কেমন ভাবলেশহীন ভাবে ওর দিকে ঝুঁকে আছে। লজ্জায় ও কোথাও লুকিয়ে যেতে চাইছে। সায়ান সাহিলকে উদ্দেশ্য করে বললো

“সাহিল! আগামী একবছর তুমি ওভারটাইম করবে আর তিনমাসের বেতন কাটা হলো”

সাহিলের যেনো মাথায় হাত!কেনো যে এই সাইকো বসের রোমান্টিক মুমেন্ট ও স্পয়েল করতে গেলো? ও জানে বস বেতন কাটবে ঠিকই কিন্তু ওভারটাইম ঠিকই করাবে। ইশশ কি পোড়া কপাল আমার!

সাহিল যেতেই সায়ান রুশির দিকে তাকালো,তারপর বললো

“তো কি যেনো বলছিলাম আমি?

সায়ানের চেহারায় সে আগের মতো হাসি! অথচ মিনিট কয়েক পুর্বেও সেটাতে স্পষ্ট রাগ ছিলো। এই ছেলে দেখি গিরগিটির চেয়েও ফাস্ট রং বদলায়! রুশি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে।

#চলবে

গুমোট অনুভুতি পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭

0

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৩৫

দেখতে দেখতে কেটে গেলো পাঁচ মাস আর এই পাঁচ মাসে অনেক কিছু বদলে গেছে।সায়ান এখন সম্পুর্ণ সুস্থ হয়তো মানসিক ভাবে নয়। রুশি আর সায়ান স্বামী স্ত্রীর কম বন্ধু বেশি হয়ে উঠেছে, সায়ান অফিস শেষে বাসায় আসলে রুশি সারাদিনের ঘটে যাওয়া সবকিছু সায়ানকে বলে আর সায়ান মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনে। যদি কোনদিন রুশি কিছু না বলে তাহলে সায়ান বুঝে যায় যে রুশি ক্ষেপে আছে। সায়ান অনেক চেষ্টা করেও রুশিকে বলতে পারেনি যে ও রুশিকে ভালোবাসে, সত্যি বলতে রুশি বলার সুযোগই দেইনি। কিছু বলার পুর্বেই কথা ঘুরিয়ে ফেলে অথবা বলার সুযোগ দেয়না, সায়ান আজকাল খুব বিশ্বাস করে যে রুশির জীবনে ও বন্ধু ছাড়া আর কিছুই নয় যা ওকে বড্ড কষ্ট দেয়। আগের মতো রুশি আর আবেগি নেই কেমন যেনো অন্যরকম হয়ে গেছে, এই রুশি মেন্টালি খুব স্ট্রং!

সায়ান প্রথম প্রথম খুব চেষ্টা করেছে বলার কিন্তু রুশির মেজাজ কেমন যেনো খিটখিটে আজকাল। কিছু বলার পুর্বেই চড়ে যায়, এইতো সেইদিন কাজের মেয়ে ভুল করে ওর গায়ে পানি ফেলে দিয়েছিলো আর সেই কারণে রুশি ঠাস করে থাপ্পড় মেরে বসে। সায়ান খাবার ছেড়ে হতবাক হয়ে বসে ছিলো, এই রুশিকে ও চিনে না। এতোটা রুড আর এরোগেন্ট! নিজের মাকে জিজ্ঞেস করার পর জানতে পারলো আজকাল রুশি প্রায় এমন ব্যবহার করে এবং বেশিরভাগ সময় একা একা থাকতে চায়। তিনি আরো বললেন যে প্রেগন্যান্সির সময় এমন মুডসুইং হতেই পারে পরে ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু আজ প্রায় তিনমাস ধরে একই রকম চলতেছে।

রুশির প্রেগন্যান্সির বর্তমানে ছয়মাস চলে, পেট ফুলে উঁচু হয়ে গেছে। তবে হাটা চলায় তেমন কষ্ট হয়না তাই রুশি প্রায়ই বাইরে চলে যায় তাও আবার কাউকে না বলে। যদি সায়ান বলে যে কোথায় গিয়েছিলে একটাই জবাব দিবে

“প্রয়োজন বোধ করছিনা বলার”

ব্যাস আর যাই প্রশ্ন করুক অপরপাশ থেকে নিরবতা ছাড়া আর কোনকিছু পাওয়া যায়না।সায়ান তাই আর প্রশ্ন করেনা কারণ রুশির নিজের লাইফ নিজের অনুযায়ী লিড করার সম্পুর্ণ অধিকার আছে। সেখানে সায়ান হস্তক্ষেপ করতে পারবে না কিন্তু স্বামী হিসেবে জানার অধিকার তো অবশ্যই আছে তবে রুশির ইদানীং এর ব্যাবহারে মনে সায়ানকে স্বামী হিসেবে মানেই না, সায়ান রুশির কাছে সামান্য একজন বন্ধু ছাড়া আর কিছুই নয়। সায়ানের খুব কষ্ট হয়, বলতে ইচ্ছে করে কেনো করছো আমার সাথে? কিন্তু ভয় যদি কিছু বললে রুশির বা বাচ্চার ক্ষতি হয়!

এটলিস্ট বেবি আসা পর্যন্ত রুশিকে কিছু বলবে না বলে ভেবে নিয়েছে, বেবি আসার পর ঠান্ডা মাথায় সুস্থভাবে কথা বলা যাবে। তখন রুশির মুডও হয়তো ভালো হয়ে যাবে, কারণ সায়ান চায়না কোনকিছু বললে রুশি এখন যে ওর সাথে কথা বলে সেটাও বলা বন্ধ করে দিক। এটা তো আরো সহ্য করতে পারবে না,তাই যা যেভাবে চলছে আপাদত সেভাবে থাকুক। অনেক সময় আছে সবকিছু সলভ করার আপাদত কিছু না করাই বেটার। তাই একই ঘরে দুজন অপরিচিত ব্যাক্তির মতো আছে যেমন এই এখন এই মুহুর্তে আছে। এতোটা কাছে থেকে প্রাণখুলে কথা বলতে পারছে না বরং হিসেব করে কথা বলতে হয়। হঠাৎ কি বললে রুশি আবার চটে যায়!

এইতো সেইদিন সায়ান ঘরে বসে ল্যাপটপে কাজ করেছিলো, এখন খুব একটা দরকার ছাড়া কোম্পানিতে যায়না। ও ইম্পর্টেন্ট মিটিংয়ে ছিলো কিন্তু রুশি ডাক দিলো, ও কথার মাঝখানে থাকায় খেয়াল করেনি। রুশি হুট করে এসে ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয় যাতে সায়ান প্রচুর বিরক্ত হয়, তবুও তা চেহারায় প্রকাশ না করে শান্ত স্বরে বলে

“রুশি মিটিংয়ে ছিলাম, কি লাগবে একটু পরও তো বলা যেতো!”

তাতে রুশি বেশ চটে গেলো আর তিনদিন সায়ানের সাথে কথা বলেনি আর না ওকে এই রুমে থাকতে দিয়েছে। হাজার চেষ্টা করার পরও কথা বলেনি তারপর আবার নিজ থেকেই কথা বলেছে তাও কোম্পানিতে গিয়ে!মিটিং রুমে ঢুকে সবাইকে বের করে দিলো ধমক দিয়ে তারপর হুট করে এসে সায়ানের কোলের উপর বসে পড়লো। আর সায়ানের চুল নিয়ে খেলতে শুরু করলো এরপর কোম্পানির ত্রিশ এর নিচে থাকা সকল নারী এমপ্লয়িকে ফায়ার করে দিলো, যেহেতু রুশি নিজ থেকে এসে কথা বলেছে তাই সায়ান এ ব্যাপারে ওকে কিছু বলেনি বরং যা করতে চেয়েছে তা হতে দিয়েছে।

রুশির হঠাৎ ইন্সিকিউরিটি ওর মাথায় ঢুকে নি,রুশি কেমন যেনো সারাক্ষণ ওর সাথে লেপ্টে ছিলো সেইদিন আবার কতোক্ষণ পর পর ছবি তুলেছে আর কি যেনো করেছে! রুশির কড়া নির্দেশ সায়ান ব্লাক কিছু পড়তে পারবে না, এমনকি চন্দ্রিকার নাম্বার ব্লাক লিস্টে আছে প্রায় দুমাস হলো, ব্লুক করার রুশি শাসিয়েছে যদি এটা আনব্লক করলে সারাজীবন কাউচে ঘুমাতে হবে। সায়ান এমনিতেও আনব্লক করতো না তবে সেদিনের পর আবার আগের মতো হয়ে গেছে। ইদানীং সায়ানের বেশ সন্দেহ হয় হচ্ছেটা কি?

ওর মনে হচ্ছে সামথিং ইজ নট রাইট কিন্তু বুঝতে পারছে, কোনকিছু হওয়ার আশংকায় সায়ান এইপর্যন্ত অনেকগুলো মেইডকে ফায়ার করে নতুন করে হায়ার করেছে। বাড়ির সিকিউরিটি ব্যাবস্থা বাড়িয়ে দিয়েছে এমনকি ঘরে সিসিক্যামেরা ইন্সট্রল করেছে কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি। সায়ান এখন আগের থেকে আরো বেশি সাবধান থাকে আর প্রয়োজন ছাড়া বের হয়না রুশিকে রেখে। সিসিকেমেরা পর্যবেক্ষন করে প্রায়ই।

তবে আজ জরুরি মিটিং থাকায় বাইরে যাচ্ছে,বাসায় সার্ভেন্ট ছাড়া আর কেউ নেই। রুশিকে দেখলো বারান্দার গাছগুলোতে পানি দিচ্ছে। ও রুশির দিকে কতোক্ষণ তাকিয়ে রইলো, কতো বদলে গেছে এই কয়মাসে। ও গলা খাকারি দিতেই রুশি বললো

“এতোসকালে রেডি হচ্ছো যে কোথাও যাচ্ছো?”

“মিটিং আছে একটা জরুরি তাই যাচ্ছি! তুমি সাবধানে থেকো আর আমায় ফোন দিও ঠিকাছে!”

“মিটিংয়ে যাচ্ছো ভালো কথা এভাবে কেনো যেতে হবে?তোমার কোথাও যাওয়া লাগবে না। তুমি ঘরে বসে থাকো!”

“রুশি রিল্যাক্স জাস্ট মিটিংয়ে যাচ্ছি আর কোথাও না,বি আ গুড গার্ল আর ঘরেই থেকো। আমি দেড় ঘন্টার মাঝে ফিরে আসবো ঠিকাছে!”

বলেই রুশির কপালে ঠোঁট ছোয়ালো তারপর বেরিয়ে পড়লো রুম থেকে। যথাসাধ্য দ্রুত যেতে ওকে তাহলে দ্রুত ফিরে আসতে পারবে!

সায়ান মিটিং রুমে ক্লাইন্টদের সাথে কথা বলছিলো হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো কিন্তু ও এতোগুরুত্ব দিলো না। অনাবরত কয়েকবার বাজার পর ও তুললো আর যা শুনলো তা শুনার জন্য ও প্রস্তুত ছিলো না। দ্রুত বাসায় পথে রওনা দিলো, ওর হাত পা কাঁপছে। এটা কি করে হতে পারে??

বাসায় পৌঁছাতেই ও হদদন্ত হয়ে ঢুকলো আর রুশিকে নিচে পড়া অবস্থায় দেখলো। রুশি এখনো হুশে আছে কিন্তু ফ্লোরে রক্ত দেখা যাচ্ছে। সায়ান রুশির দিকে আগাবে তখনি একজন দ্রুত পায়ে এসে বললো

“স্যার চন্দ্রিকা মেম যে ফ্লাটে ছিলো সেইখানে আগুন লেগেছে। অবস্থা ভালো নয়, ফায়ার সার্ভিস আগুন কন্ট্রোলে আনতে পারছে না”

রুশি সায়ানকে থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হঠাৎ করে পেট ধরে বসে পড়লো, উঠতে পারছে না।আহহহ শব্দ করে উঠলো। সায়ান রুশির দিকে কয়েক কদম এগিয়ে আসলো,তারপর অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। হয়তো ভাবছে দায়িত্ব আর ভালোবাসার মাঝে কাকে বেছে নিবে কিন্তু হুট করে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। রুশি ভুল ছিলো সায়ান ওকে ভালোবাসে না তার ভালোবাসা চন্দ্রিকা! ও কি করে ভাবলো ছয়বছরের ভালোবাসা ছয়মাসের দায়িত্ব থেকে মুল্যবান হবে?চন্দ্রিকা ঠিক ছিলো! সায়ান শুধুমাত্র বেবির জন্য ওকে সাথে রেখেছে আর এখন বেবি থেকেও বড় হচ্ছে চন্দ্রিকা তাইতো ওকে এখানে ফেলে চলে গেলো! আর যাই হোক না কেনো দিনশেষে ভালোবসারই জয় হয়!

রুশি সায়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো, ও সায়ানকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু সায়ান তো ওকে চুজ করেনি তাই ও সায়ানকে ক্ষমা করতে পারবে না।কক্ষনো না! ও বহুকষ্টে উঠে দাঁড়ালো, আর যাইহোক ওর সন্তানকে ওকে বাঁচাতে হবে যেকোন মুল্যে হোক না কেনো!

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৩৬

রুশি অসহায় ভাবে সায়ানের চলে যাওয়া দেখলো, তারপর বহুকষ্টে উঠে দাঁড়ালো। পা জোড়া অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে, ফ্লোরে উপর হাল্কা রক্ত দেখে ওর মাথা ঘুরা শুরু করে দিয়েছে। সামনে এক কদম এগোতেই আর ব্যালেন্স রাখতে পারলো না, ও ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। এই বুঝি সব শেষ!কিন্তু একজোড়া বলিষ্ঠ হাত ওকে ধরে ফেললো তারপর হুট করেই কোলে তুলে নিলো। রুশি ভয়ে কাঁপা হাতে তাকে তার শার্ট চেপে ধরলো। এই অবস্থা দেখে সেই ব্যাক্তি কড়া গলায় বললো

“একটু অপেক্ষা করতে পারলে না?গাড়িটা তো বাড়ির ভেতর আনতে দিবে!যদি পড়ে যেতে আর কিছু হয়ে যেতো? আমাকে একটু বিশ্বাস করে অপেক্ষা করতে পারতে না?”

রুশি আলতো করে চোখ খুললো তারপর একজন সুদর্শন পুরুষকে দেখতে পেলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে! ভয়ে নাকি ওর ভারে ঠিক ঠাউরে উঠতে পারলো না। আর যাইহোক ওর বর্তমানে ছয়মাস চলে, অনেকটাই মুটিয়ে গেছে তাই ওকে কোলে নিয়ে হাটা চারটি খানি কথা নয় আর সে রিতীমত দৌড়াচ্ছে! রুশি নিজের মাথা তার বুকে এলিয়ে দিলো তারপর কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বললো

“সা্ সায়ান! তোমাকে বিশ্বাস করতে না পারার জন্য স্যরি তবে আমি খুব করে চেয়েছিলাম করতে!”

সায়ান পর্যন্তই রুশি উচ্চারণ করতে পেরেছে বাকিটুকু উচ্চারণ করার শক্তি ওর ছিলো না।সায়ান ওর কাঁপা কন্ঠে থমকে গেলো আর ওর গালে আলতো করে হাত রেখে বললো

“কিচ্ছু হবে না দেখো!আমি তোমাদের কিচ্ছু হতে দিবো,আমি আছিতো তুমি প্লিজ চোখ বন্ধ করোনা”

বলতে বলতেই সায়ান রুশিকে গাড়ির সিটে বসিয়ে সিট বেল্ট লাগিয়ে দিলো আর নিজে বসে গাড়ি চালাতে লাগলো। রুশির এক হাত সায়ানের হাতের মুঠোয়, সামনের দিকে তাকিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত ড্রাইভিং করলেও রুশিকে বারবার চোখ বন্ধ না করার জন্য বলছে। সায়ানের অজান্তেই ওর চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, রুশিকে এই অবস্থায় দেখে ওর কলিজা ফেটে যাচ্ছে!

হসপিটালে পৌঁছাতেই ও রুশিকে কোলে করে ঢুকে পড়লো আর ডক্টর নার্স বলে চিল্লাতে লাগলো। সবাই সায়ান জামিল খানকে এভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে ভয় পেয়ে গেলো, ওরা দ্রুত এগিয়ে আসলো তারপর রুশিকে বেডে শুইয়ে ওটির রুমে নিয়ে যাওয়া শুরু করলো। সায়ান রুশির চেপে রাখলো তারপর বেড থামিয়ে রুশির সামনে হাটু গেড়ে বসলো আর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো

“ইউ আর নট এলাউড টু লিভ! আমি তোমাকে সেই পার্মিশন দেইনি।তোমাকে ফিরে আসতে হবে আমার জন্য ফিরে আসতে হবে।”

রুশির তখনো আধখোলা চোখে সায়ানকে দেখেছিলো কিন্তু ওর সম্পুর্ণ হুশ নেই।সায়ানকে দেখতে পেলেও সায়ানের কথা ওর মাথায় ঢুকছেনা কিন্তু শব্দগুলো কানে আসছে ঠিকই। রুশিকে ওটির রুমে নিয়ে যেতেই সায়ান ধপ করে বসে পড়লো, দুইহাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে। ধীরেধীরে সময় যাচ্ছে কিন্তু ওটির দরজা খুলছে না। একেকটা সেকেন্ড ওর কাছে একযুগ মনে হচ্ছে, ও দম খিঁচে বসে আছে!বুকের বাঁ পাশে তীব্র ব্যাথা হচ্ছে, মনে মনে দোয়া করছে যেনো সব ঠিক হয়ে যায়। সায়ান মাথা নিচু করেই বসে ছিলো তখন কেউ একজন পাশে এসে দাঁড়ালো, সায়ান মাথা তুলে তাকাতেই সাহিল মানে ওর এসিসট্যন্ট দাঁড়িয়ে আছে। সায়ান শান্ত গলায় বললো

“এসবের পিছনেও সে দায়ী তাইনা?”

“জি স্যার আসলে…”

“কি হয়েছিলো বাড়িতে আজকে?”

“স্যার আমি সিসিকেমেরা চেক করেছি, প্রায় এগারোটা পর্যন্ত মেমে রুমে ছিলো কিন্তু এরপর হুট করেই প্রায় আধ ঘন্টার মতো সকল ক্যামেরা ডিএক্টিভেট ছিলো, আমি বুঝতে পারছিনা এতো হাই সিকিউরিটির মাঝে এটা কি করে হলো কিন্তু যখন খুলেছে তখন আমি দেখি যে মেম নিচে পড়ে যাচ্ছে তাই আমি আপনাকে দ্রুত বলেছি!আর আপনি গিয়ে তো তাকে নিচে পড়ে থাকা অবস্থায় দেখেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো কোন সার্ভেন্ট ওই মুহুর্তে বাসায় ছিলো না, সবাই বাগান বাড়িতে গিয়েছিলো কারণ সেখানে কিছুসংখ্যক বডিগার্ড পড়ে ছিলো অজ্ঞান রত অবস্থায় তাই তারা সেখানে ছিলো। কিন্তু এই কাজ কে করেছে তা সম্পর্কে কোন ধারণা পাওয়া যায়নি কারণ সিসিক্যামেরা অফ ছিলো।আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে সিঁড়িতে ওয়েল ছিলো যার কারণে মেম পড়ে গিয়েছিলো আর আশ্চর্যজনক ভাবে তার পুর্বেই মেমের ফোনে কল আসে আর এটা সেই ছিলো! আমার ধারণা এসবের পিছনে তার হাত আছে”

“ওয়েল! শুনো বাড়ির সকল সার্ভেন্টদের এক জায়গা জড়ো আর তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেও। তারা নিশ্চই ঘরের তেল ইউজ করেছে তারমানে তাতে আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে। আমি এক ঘন্টার মধ্যে কালপ্রিটকে দেখতে চাই। আমারো জানার দরকার কার এতো বড় কলিজা যে সায়ান জামিল খানের কলিজায় হাত দেয়!”

সাহিল মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো, এই এতোবছরেও নিজের বসকে এতো রাগতে দেখেনি। যদি আসল কালপ্রিটকে খুজে পাওয়া যায় তাহলে তার কতটা ভয়াবহ পরিণতি হবে তা ভেবেই ওর আত্মা কেঁপে উঠছে! সাহিল যেতেই সায়ান দুহাত দিয়ে চুল চেপে ধরলো আর বিড়বিড় করতে লাগলো

“আই স্যয়ার আমি তাকে জিন্দা পুতে রেখে দিবো শুধু পেয়ে নেই একবার”

দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর ডাক্তার ওটি থেকে বেরিয়ে আসে আর সায়ান শব্দ পেয়ে দ্রুত তার কাছে যায়। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে কাঁপাকাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো

“রুশির কি অবস্থা এখন?ইজ শি ওকে!”

“আমি ভেবেছিলাম তুমি বেবির কথা জিজ্ঞেস করবে আগে অন্তত অন্যরা এমনটাই করে।”

“কে কি করে জানিনা তবে আমার কাছে আমার বউ বেশি ইম্পর্টেন্ট। বেচে থাকলে আবারও বেবি নেয়া যাবে আর না নেয়া গেলেও সমস্যা নেই। শুধু আমার বউ বেঁচে থাকলেই হবে”

“সি ইজ লাকি টু হ্যাভ ইউ ইয়াং ম্যান”

“নো আম লাকি টু হ্যাভ হার! হাউ ইজ শি?”

“ওয়েল শি ইজ ফাইন, চিন্তার কোন কারণ নেই। তবে বেবিকে নিয়ে আমরা প্রথমে টেনশনে ছিলাম, ভেবেছিলাম হয়তো মিসক্যারেজ হয়ে গেছে কিন্তু আমরা ভুল ভেবেছিলাম। আল্টাসোনোগ্রাফিতে বেবিকে হেলদি দেখাচ্ছিলো পরে বুঝলাম প্লাসেন্টা বা সার্ভিক্সের সমস্যার কারণে এমনটা হয়েছে, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। নিশ্চিন্তে থাকুন মা এবং বেবি দুজনেই সুস্থ আছে, পায়ে কিছুটা কেটে গিয়েছিলো সেই স্থানে বেন্ডেজ করে দিয়ে। এখন ঘুমের মেডিসিনের কারণে ঘুমাচ্ছে।আশাকরি রাতে বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন।খেয়াল রাখবেন যাতে এরপর এমন ভাবে না পড়ে নাহয় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।”

বলেই ডাক্তার কয়েক কদম এগিয়ে গেলো তারপর থমকে গিয়ে পিছনে ফিরে তাকালো আর চিন্তিত গলায় সায়ানকে বললো

“আমি আসল কথাতো বলতে ভুলেই গেছি, আপনার ওয়াইফের পেটে ড্রাগস পাওয়া গেছে যা কয়েকটি কেমিকেলের মিশ্রণ ছিলো তবে বেশি পরিমাণ ছিলো না।তাকে বহুদিন ধরে দেয়া হচ্ছিলো খুবই স্বল্প পরিমাণে তাই ক্ষতি হয়নি তেমন একটা। তবে সেটার সাইড ইফেক্টে উনি অস্বাভাবিক আচরণ করার চান্স আছে, আমরা ওয়াশ করে দিয়েছি কিন্তু এটা যাতে আর না নেয়। বেবির জন্য অনেক ক্ষতিকর এটা, ধীরেধীরে এটি বেবিকে দুর্বল করে দিবে আর একসময় বেবি মারা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। প্লিজ বি কেয়ারফুল!”

বলেই ডক্টর চলে গেলো আর নার্স রুশিকে কেবিনে শিফট করার কাজ করছে কিন্তু সায়ান ঠাই হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ সকল কিছুর হিসাব মিলছে, রুশির এতোদিনের আচরণ মুড সুইং ছিলনা বরং এইসব কেমিকেলের সাইড ইফেক্ট ছিলো। ও যা করতো সব হুশে থাকা অবস্থায় করতো না বরং ও জানতই না ও কি করছে।একটা মানুষ কতটা নিকৃষ্ট হলে এমন জঘন্য খেলায় মেতে উঠতে পারে!ওর ভাবতে পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যাচ্ছে। একটা নিষ্পাপ প্রাণকে পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছেনা! সায়ান ধপ করে বসে পড়লো সেই স্থানে, বিড়বিড় করে বলতে লাগলো

“আম স্যরি রুশি!আমি স্বামী হিসেবে ব্যার্থ, তোমাকে আর বেবিকে প্রোটেক্ট করতে পারিনি!আমি চেয়েও তোমাদের এই হিংস্র খেলা থেকে বাচাতে পারিনি। আম সো স্যরি!”

সায়ান কেবিনে ঢুকে রুশির দিকে তাকিয়ে আছে,মুখ শুকিয়ে এইটুকুন হয়ে আছে রুশির।ও চুপচাপ বসে আছে মুখ গম্ভীর করে, বাসার সবাই বাসায় ফিরে জিজ্ঞেস করেছিলো ওরা কোথায়? ও বলেছে রুশিকে নিয়ে ঘুরতে এসেছে, কারণ এই মুহুর্তে সবাই টেনশনে ফেলতে চায়না। সামনে সামুর বিয়ে,ও এঞ্জয় করুক নিজের বিয়ে। সায়ান বসে থাকার মাঝেই ঠাস করে দরজা খুললো আর সায়ান সেদিকে চেয়ে আছে…সম্পুর্ণ অনুভুতি শুন্য হলে মানুষের দৃষ্টি যেমন হয় ঠিক তেমন!

#চলবে

গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৩৭

সায়ানের এই অনুভুতি শুন্য দৃষ্টি দেখে সামনের মানুষটি ক্ষেপে গেলো তারপর খুব জোরে দরজা ভেতর থেকে আটকালো। সায়ানের এবার মাথা গরম হয়ে গেলো,রুশির বর্তমানে হুশ নেই কিন্তু ভারী শব্দ আর চেঁচামেচি ওর শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তাই সায়ান দাঁতে দাঁত চেপে বললো

“এই রুমে যদি আর একটুও শব্দ হয় তবে আমি বাধ্য হবো তোমাকে এই রুম থেকে বের করে দিতে। সো প্লিজ বি কোয়াইট!”

সায়ান কঠোর শব্দ শুনে চন্দ্রিকা দমে গেলো, এতোটা কর্কশ ভাষায় সায়ান ওর সাথে কোনদিন কথা বলেনি অথচ আজ!চন্দ্রিকা না চাইতেও হচকিয়ে গেলো। সায়ানের মুখ দেখে বুঝাই যাচ্ছে যে ও যা বলছে তা করে ছাড়বে কিন্তু সায়ান ওর উপর ক্ষেপে আছে কেনো? যেখানে ওর রেগে যাওয়ার কথা!

সকালের ঘটনা!আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে ওর, তাই ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই আওয়াজ শুনতে পায়। কিসের আওয়াজ তা প্রথমে বুঝে উঠতে না পারলেও পরে বুঝতে পারে যে এই বিল্ডিং এ আগুন লেগেছে! কিছু সময়ের জন্য ও পুরা ব্ল্যাংক হয়ে যায় আর কি করবে বুঝে উঠতে পারেনা। দ্রুত দরজার কাছে গিয়ে তা খোলার চেষ্টা করলো কিন্তু অদ্ভুত ভাবে তা খুললো না। কয়েকবার চেষ্টা করতে বুঝতে পারলো কেউ ইচ্ছে করে ওর ফ্লাটের দরজা বাইরে থেকে লক করে দিয়েছে। ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে পড়লো, এখান থেকে হতে না পারলে ওর মৃত্যু নিশ্চিত! হাতের ফোন খোঁজা শুরু করলো আর একসময় পেয়েও গেলো, কাঁপা হাতে সায়ানকে ফোন দেয়া শুরু করলো কিন্তু যথারীতি নাম্বারটা ব্যস্ত দেখালো অর্থাৎ ব্লক লিস্টে আছে। এই কয়মাসে সায়ানকে ও ফোন করেনি কারণ দরকার পড়েনি, নিজের মতো ভালোই ছিলো! আজ এই সময়ে সায়ানকে পাশে পাবে না এটা ও ভাবতেই পারেনি, ওই মেয়েটার জন্য সায়ান ওকে ছেড়ে দিলো! ও আর উপায়ন্তর না দেখে শাহেদের ফোনে ফোন দিলো, যদিও শাহেদ ওর ফোন ধরেনা যখন নিজের দরকার হয় শুধু তখনি ফোন দেয়।তবুও একটা শেষ চেষ্টা করতে ক্ষতি কি?

ও কাঁপা হাতে শাহেদকে ফোন দেয়ার পর তা রিং হতে থাকলো, ঘরে ততক্ষণে ধোয়া ঢুকে পড়েছে। চন্দ্রিকা রিতীমত খুকখুক করে কাশছে।কিছু সময় রিং হওয়ার পর আশ্চর্যজনক ভাবে সে ফোন পিকাপ করলো! চন্দ্রিকা কাঁপা গলায় বললো

“শা্ শাহেদ আ্ আমি…”

“যেখানে আছো সেখানেই থাকো, রুম থেকে বের হয়োনা। ভরসা রাখো আমার উপর তোমার কিচ্ছু হবে না, আমি আসছি!”

চন্দ্রিকা না চাইতেও শাহেদের কথা দরজা আর নক করলো না, ধোয়ায় ওর দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। কোনরকম সেই অবস্থাতেই পড়ে রইলো সেখানে, ধীরেধীরে শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়াতে নুইয়ে পড়ে একদম! শরীরের সমস্ত শক্তি যেনো অসাড় হয়ে গেছে, ও নেতিয়ে পড়লো ফ্লোরে। আচমকা বুঝতে পারলো কেউ একজন ওকে টেনে তুলে নিজের কোলে নিয়ে নিলো আর কিছু একটা দিয়ে তার সাথে বেঁধে নিলো। ধোয়া থেকে দূরে সরতেই চন্দ্রিকা চোখ মেলে তাকালো আর দেখলো ও অলমোস্ট হাওয়ায় ভাসছে! নিচে নামিয়ে ওকে রাস্তার পাশে বসানো হলো, সবমিলিয়ে বুঝতে পারলো যে ওকে ফায়ার সার্ভিসের রেসকিউ গাড়ি দিয়ে জানালা দিয়ে বের করে আনা হয়েছে আর শাহেদ ওকে বের করে এনেছে।

ও কিছুক্ষণ সেখানে চুপচাপ বসে থাকলো তারপর শাহেদের দেয়া পানি খেলো, তারপর গাড়িতে এসে এলিয়ে দিলো। শাহেদ সম্পুর্ণটা সময় চুপ ছিলো, একটা টু শব্দও করেনি। ও ভাবতেই পারেনি এই কঠোর মনের ছেলেটি ওকে বাঁচাতে আসবে তাও নিজের জীবন রিস্কে ফেলে! সব থেকে বড়ো কথা শাহেদ এতো দ্রুত ওর কাছে পৌঁছালো কি করে?ওকি আগে থেকেই এই আগুনের খবর জানতো? আর এটাও জানতো যে চন্দ্রিকা ফ্লাটে ফেসে আছে?চন্দ্রিকা আর কিছু ভাবতে পারছেনা, প্রচণ্ড মাথায় যন্ত্রণা করছে! ও সেই অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়লো। যখন চোখ খুলে তখন নিজেকে গাড়িতে পায়, গায়ে একটা কোর্ট দেয়া। ও আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো যে ওরা একটা ব্রীজের উপর আছে। পাশে শাহেদকে না দেখে ও খুঁজতে লাগলো আর অদুরেই দেখতে পেলো। ব্রীজের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে আর চারপাশে ধোঁয়া উড়ছে হয়তো সিগারেট খাচ্ছে!

চন্দ্রিকা গাড়ি থেকে বেরিয়ে শাহেদের পাশে দাঁড়ালো কিন্তু ধোঁয়ায় আবারও খুকখুক কেশে উঠলো যা দেখে শাহেদ বিরক্ত হয়ে সিগারেট ফেলে দিলো নিচের পানিতে কিন্তু ভুলেও চন্দ্রিকার দিকে তাকায়নি!চন্দ্রিকা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো তারপর আলতো করে বললো

“আজকের জন্য থ্যাংকস! আমি ভাবতেও পারছিনা আপনি না থাকলে আজ আমার কি হতো!”

“থ্যাংকস দেয়ার মতো কিছু করিনি আমি, যা করেছি করার দরকার ছিলো তাই করেছি। এনিওয়ে কোথায় যাবে এখন?”

চন্দ্রিকা জবাব দিলো না, কোথায় যাবে এখন? সায়ান ব্যতীত ওর যাওয়ার কোন জায়গা নেই। ফ্লাটের সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে এমনকি পুরো বিল্ডিং হয়তো! তাই সায়ানের সাথে যোগাযোগ না হওয়া পর্যন্ত ওর যাওয়ার কোন স্থান নেই। চন্দ্রিকার স্তব্ধতা দেখে শাহেদ হাসলো তারপর বললো

“ওই ফ্লাটে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয় তোমার আর দেখে বুঝা যাচ্ছে আপাদত যাওয়ার জায়গা নেই। তাই কিছুসময়ের জন্য আমার ফ্লাটে আসতে পারো তারপর নাহয় তোমার সায়ান তোমার ব্যাবস্থা করে দিবে!”

চন্দ্রিকা প্রত্যকটা শব্দে তাচ্ছিল্য খুজে পেলেও রেগে গেলো না,যা বলেছে তাতে যে একদণ্ডও মিথ্যে নেই। ও আকাশের দিকে তাকালো, ওর জীবনে সায়ান ছাড়া আর কিছুই নেই যেনো চন্দ্রিকার জন্মই সায়ানের জন্য!সায়ানের জন্যই ওর বেঁচে থাকা আর সায়ানের সাথে থাকতে না পারলে মরে যাওয়া! যেমন আজকে…মৃত্যুর সাথে প্রায় সাক্ষাৎ হয়ে গিয়েছিলো ওর, শাহেদ না আসলে হয়তো…কিন্তু ওকে বেঁচে থাকতে হলে সায়ানের কাছে ফিরে যেতে হবে, তার সাথে থাকতে হবে এবং একসাথে বাঁচতে হবে!সায়ান ছাড়া ওর জীবনের আর কোন লক্ষ্য নেই, ওর শুরু সায়ানকে দিয়ে না হলেও শেষটায় সায়ানকে থাকা চাই!

চন্দ্রিকা মাথা নিচু করে বললো

“আমি আপাদত সায়ানের খোঁজ জানিনা, আপনি কি জানেন সে কোথায় থাকতে পারে?আমার তার সাথে কথা বলা প্রয়োজন”

শাহেদ এইবার চন্দ্রিকার দিকে তাকালো, চোখদুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে যেনো ভয়ংকর রেগে আছে তবে ঠোঁটের কোনায় অদ্ভুত হাসি। যে কেউ কনফিউজড হয়ে যাবে যে ওকি রেগে আছে নাকি নেই!শাহেদ চন্দ্রিকার দিকে কিছুটা ঝুঁকে বললো

“অবশ্যই,আমি জানি সে কোথায় আছে কারণ জানতাম কেউ একজন ঘুম থেকে উঠেই সবার আগে সায়ান জামিল খানের নাম নিবে। তোমার সায়ান বর্তমানে হসপিটালে আছে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর পাশে।গেস হোয়াট! তুমি ফায়ার প্লেসে আটকে পড়েছো জেনেও সে আসেনি তোমার কাছে কারণ প্রয়োজন বোধ করেনি, তার স্ত্রী আর তোমার মধ্যে সে কিন্তু তাকে চুজ করেছে!অবশ্য তাতে তোমার কি যায় আসে?সায়ানকে তো তোমার চাই!”

সায়ানের এমন আচরণে চন্দ্রিকার না চাইতেও খারাপ লাগলো,ওর প্রতি সায়ানের সিমপ্যাথিও কাজ করেনি?যেখানে ওর সবকিছুর খেয়াল রাখতো আজ মাঝপথেই ছেড়ে দিলো! অন্য কাউকে পেয়ে?এর জবাব তো ওর পাওয়া দরকার তাইনা?ও শাহেদকে বললো

“আমাকে একটু হসপিটালে দিয়ে আসুন, দরকার আছে খুব”

শাহেদ সেই আগের মতো তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো তারপর গাড়িতে উঠে বসলো। হসপিটালে আসা পর্যন্ত তাদের মাঝে কোন কথা হয়নি, চন্দ্রিকা গাড়ি থেকে নেমে ছোট্ট করে থ্যাংকস বলে চলে এলো। চেয়েছিলো একবার পিছনে তাকাবে কিন্তু সাহস হয়ে উঠেনি, কেবিনে এসেই সায়ানকে রুশির হাত ধরে বসে থাকলে দেখলো যাতে ওর মাথা গরম হয়ে গেলো, সায়ানকে ভালোবাসে কিনা ওর জানা নেই তবে শুরু থেকেই এতোটুকু জানতো সায়ান শুধু ওর আর কারো নয়। সময়ের সাথে সেই পসেসিভনেস বেড়েছে তাই আজ সায়ানের পাশে রুশিকে একদম সহ্য করতে পারছে না ও।

বর্তমানে ও সায়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে আর সায়ানের চোখের কঠোরতা বুঝার চেষ্টা করছে। ও সায়ানের দিকে কিছুটা এগিয়ে বললো

“আমাকে বেঁচে থাকতে খুশি হওনি মনে হচ্ছে!ভেবেছিলে মরে গিয়েছি তাইনা? আর তুমি ফ্রি হয়ে গেছো?আর কিছু না হোক তোমার যে জীবন বাঁচিয়েছি তার জন্য কি আমার জীবন বাঁচানোর কথা মাথায় আসেনি?”

“নাহ আসেনি, কারণ তুমি যা করেছো তা ক্ষমার যোগ্য নয়। প্রাণের বদলে প্রাণ কথাটা নিশ্চই জানা আছে?তুমি ঠিক ভাবতেও পারছো না এই মুহুর্তে আমার তোমাকে ঠিক কিভাবে মারতে ইচ্ছে করছে কিন্তু আমি মারবো না কারণ একসময় তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছো।আর তাছাড়া আমি তোমাকে বাঁচানোর জন্য লোক পাঠয়েছি তবে তার পুর্বেই তোমার প্রেমিক তোমাকে বাঁচিয়ে নিয়েছে। সো ইউ আর সেফ”

“বাহ লোক পাঠয়েই তোমার দায়িত্ব শেষ?নিজে এসেছো বাঁচাতে আমাকে?যে তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছে তার প্রাণের কোন মুল্য নেই তোমার? তুমি কি সেই সায়ান যার কাছে ওয়াদার মুল্য অনেক বেশি ছিলো অথচ নিজেই ওয়াদা রক্ষা করলে। কি বিচার তোমার!”

“যার কাছে আমার সন্তান আর অনাগত বাচ্চার জীবনের মুল্য নেই তার জীবনের মুল্য আমার কাছে থাকবে তুমি ভাবলে কি করে?আমার সন্তানের যে ক্ষতি করতে চেয়েছে তাকে যে আমি খুন করে ফেলিনি সেটাই তো অনেক মিস.চন্দ্রিকা!
বরং আমার জীবন বাচানোর জন্য তার উপর আমি বড্ড দয়া করেছি তাইনা?”

চন্দ্রিকা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো,ও ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো

“মা্ মানে?”

#চলছে

গুমোট অনুভুতি পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৩২

হসপিটালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে রুশি, আকাশে ছোট্ট একটা চাঁদ আর তার পাশে হাজার তারার মেলা।সমস্ত আকাশ জুড়ে নক্ষত্রগুলো জ্বলজ্বল করে উঠছে সাথে রুশির চোখগুলোও। অনেকদিন হয়ে গেলো তারাদের সাথে কথা হয়না, আর তারাদের মাধ্যমে তার সঙ্গে কথা হয়না।সে তো হয়তো তাকে ভুলেই গেছে! কই কথাতো বলে না ওর সাথে, বললে তো শুনতে পেতো তাইনা?

সেতো ভুলেই গেছে তাকে, তার অস্তিত্বকে তার কন্ঠ তার সবকিছুকে। মানুষের মন অন্যথায় মযে গেলে সে আর পুরোনো জিনিস নিয়ে কি ভাবে?কিন্তু ও তবুও ভাবে, পুরোনো সব স্মৃতিগুলো আকড়ে ধরে বেঁচে আছে। পিছুটান ওকে চেপে ধরে আছে, না সামনে এগুতে পারছে না পেছনে। পেছনে এতোদিন যাওয়ার খুব ইচ্ছে থাকলেও এখন আর সেই ইচ্ছেটা নেই বললেই চলে কিন্তু সামনের দিকে! সে দিকে ও এগুতে চায়না। আবেগ, অনুভুতি যদিও বলে ওকে সামনের দিকে যেতে কিন্তু মাঝে মাঝে নিজের অবাঞ্ছিত আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। নাহয় বড্ড ক্ষতি হয়ে যায়, নিজের নারীত্ব আর আত্মসম্মানের!

রুশি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো, তারাদের সাথে ও আর কথা বলবে না। বড্ড অভিমান হয়েছে তাদের সাথে আর সেই মানুষটির সাথেও। কি করে পারলো ভুলে যেতে ওকে?ওকি এতোই ফেলনা?রুশি আকাশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর সায়ানের কেবিনের দিকে হাটা ধরলো। হাল্কা শীতশীত লাগছে, বেশিক্ষণ থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে যা বেবির জন্য ক্ষতিকর। রুশির সায়ানের কেবিনে যাওয়ার উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে চন্দ্রিকাকে দেখা যে ও এখনো কেবিনে আছে কিনা! যদি থাকে তবে নিজের গায়ের চাদর নিয়ে বেরিয়ে পড়বে আর না থাকলে কেবিন থেকে যাবে।

কেবিনের দরজা আস্তে খুলে ভেতরে উঁকি মারলো রুশি, সারা কেবিনে চোখ বুলালো। নাহ কোন এক কোনেও চন্দ্রিকার দেখা মেলেনি, যদি মিলতো তাহলে ও একমুহুর্তও থাকতো না। রুশি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে কেবিনে ঢুকলো,সায়রাকে চুপচাপ ঘুমোতে দেখলো আর ঘুমোবেই না কেনো?ব্যাথা যাতে কম অনুভুত হয় সেজন্য যে হাই ডোজের মেডিসিন দেয়া হয়েছে!

রুশি কয়েকমুহুর্তের জন্য চিন্তা করলো যে ও কোথায় শুতে পারে, ছোটখাটো সোফায় শুলে সকালে নিজেকে নির্ঘাত নিচে পাবে! এসব ভাবতেই সায়ানের দিকে তাকালো আর দেখলো সায়ানের পাশে অনেকখানি জায়গা ফাঁকা। তাতে একজন আরামসে শুতে পারবে এবং এটা ইচ্ছেকৃত রাখা হয়েছে বুঝাই যাচ্ছে কিন্তু কেনো? সায়ান কি জানতো যে ও আবার ফিরে আসবে এই রুমে?নাকি এই স্থান চন্দ্রিকার জন্য ছিলো? কিন্তু চন্দ্রিকার হলেতো সে এখানে থাকতো তাইনা?

রুশির মাথা কনফিউশনের উপর কনফিউশন চলছে কিন্তু তার জবাব খুজতে ইচ্ছে না। যদি অপ্রিয় কিছু শুনে যেটা শুনার ক্ষমতা বা ইচ্ছে কোনটিই তার নেই। তার থেকে বরং থাকুক না কিছু অব্যাক্ত! যার স্থানই হোক না কেনো, এই মুহুর্তে এই স্থান ওর খুব দরকার। তাই সাত পাঁচ না ভেবে সুয়ে পড়লো সায়ানের পাশে খুব সাবধানে, একদম গায়ের সাথে ঘেঁষল না। সকালে নাহয় সায়ানের চোখ খোলার আগেই উঠে চলে যাবে!

এই প্রথম সায়ানের পাশে শোয়াতে কিছুটা অস্বস্তি লাগছে তবে যতোটা খারাপ লাগবে ভেবেছিলো ততটা লাগছে না একদম অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে। রুশি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো, এমনিতেই কান্না কাটি করে ভীষণ মাথা ব্যথা করছে। তাও সেই সময় যা একটু ঘুমাতে চেয়েছিলো কিন্তু সায়ানের জন্য হয়ে উঠেনি। এখন একটা প্রপার ঘুম দরকার যাতে সকল চিন্তা দূর হয়ে যায়। রুশি অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পর ধীরেধীরে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো,যাতে থাকে হাজারো স্বপ্ন আর কল্পনার বহিঃপ্রকাশ!



সকালে মৃদু আলো চোখে পড়ায় রুশি চোখ মেলে তাকালো,হঠাৎ আলো আসায় ভ্রু কুচকে তাকানোর চেষ্টা করলো। নিজের গায়ে কম্বল দেখে রুশি বেশ অবাক হলো, ওর স্পষ্ট মনে আছে রাতে ও সায়ানের গায়ে ছিলো এইটা আর ওর এটাকে ধরে পর্যন্ত নি তাহলে ঘুমের ঘরে টেনে নিলো? কি বিচ্ছিরি ব্যাপার! তার থেকে বড় কথা হলো ও সায়ানের বাম হাতের উপর শুয়ে ছিলো! রুশি সায়ানের দিকে তাকালো, নাহ সে এখনো চোখ বন্ধ করেই আছে মানে ঘুমোচ্ছে। রুশি আলতো করে কম্বল সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো, তারপর সায়ানের তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। ওর কপালে পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো আলতো করে ছুয়ে দিলো তারপর দ্রুত পায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়লো যেনো আর কিছুক্ষণ থাকলেই সায়ানের কাছে ধরা পড়ে যেতো।

রুশি যেতেই সায়ানের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো, ও আলতো করে চোখ মেললো তারপর বাম হাত নিজের ঠোঁটে বুলালো। রুশির কান্ড দেখে ওর খুব হাসি পাচ্ছিলো, বেচারি তাড়াহুড়ায় বেরিয়ে গেছে। সত্যি বলতে খুব কষ্টে হাসি আটকে রেখেছিলো সায়ান, সায়ানের হাতে শুয়ে আছে দেখে ওর এমন রিয়াকশন ছিলো যদি জানতে পারে সেই রাত থেকে সায়ানের বুকে ঘুমাচ্ছে তাহলে কি করবে তা ভেবেই সায়ানের হাসি পাচ্ছে।প্রায় ভোর রাতের দিকে সায়ানের হঠাৎ ঘুম ভেংগে যায়,পাশে তাকাতেই দেখে রুশি গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে হয়তো শীত লাগছে তাই! এমনকি কেবিনের বেড ল্যাম্পও অফ করা হয়নি। সায়ান আস্তে আলতো করে বাম হাত দিয়ে রুশিকে নিজের কাছে নিলো তারপর কম্বল দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিলো ওকে। ও পুরোটা সময় ভয় পাচ্ছিলো যে রুশি হয়তো জেগে যাবে আর ওকে কথা শুনাবে যে ও সুযোগের সৎ ব্যাবহার করেছে কিন্তু রুশি যা ঘুম কাতুরী! কাল বুঝতে পারলো ও, রুশিকে নাড়ানোর পরও ও ঘুমেই ছিলো। যেহেতু যথেষ্ট ঘুমিয়েছে তাই আর ঘুম আসছিলো না ওর, রুশির দিকে তাকিয়েই সারারাত কাটিয়ে দিলো।ভোর হওয়ার পর ওকে হাতের উপর শুইয়ে দিলো যাতে বুঝতে না পারে।রাতে কিছুক্ষণ পর পর রুশির কপালে নিজের ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছিলো আর ভাবছিলো
ওর জীবনে রুশির মুল্য কত! এইযে দুইমাস আগেও হয়তো ও রুশিকে চিনতো না, কখনো ভাবেও নি এই রুশি নামক মেয়েটি ওর জীবনে এতো গুরুত্বপুর্ন হয়ে উঠবে।ভাবতেই পারেনি ওকে ছাড়া একসময় নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ মনে হবে, ওকে নিজের কাছে রাখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগবে!

ওর মাথায় হঠাৎ একটা প্রশ্ন আসলো যে ওর রুশিকে দেখে কখন ভালোলাগা শুরু হয়েছিলো?সেইদিন গাড়িতে খোলাচুলে দেখে?নাকি প্রথম যেদিন দেখেছিলো! সায়ানের হুট করে মনে পড়লো রুশির সাথে যেদিন কোম্পানিতে দেখা হয়েছিলো সেদিন রুশি হঠাৎ ভয় পাওয়াতে ওকে ও জড়িয়ে ধরে ছিলো আর ওর তেমন অস্বস্তি হয়নি। সেটাই ছিলো মা-বোন ব্যতীত সজ্ঞানে থাকা অবস্থায় কোন নারীকে প্রথম জড়িয়ে ধরা, ও এতো সহজে কেনো ধরতে পেরেছিলো সেদিন তাও কারণ কোন প্রকার বিরক্তি ছাড়াই!কারণ ওর মন কোথাও একটা জানতো এই মেয়েটি সেই মেয়ে যাকে ও খুজছিলো মন উজাড় করে ভালোবাসবে বলে, এই সেই মেয়ে যাকে ছাড়া একসময় ওর বাঁচা অসম্ভব হয়ে যাবে!এতো অল্প সময়ে কারো প্রতি এতোটা আসক্ত হয়ে যাবে ও ভাবতে পারেনি।ভালোবাসা বোধহয় এমনি হয়! কোন কারণ ছাড়াই হুট করে হয়ে যায় যেটা নিজেও হয়তো টের পায়না। সায়ান আনমনে হাসতে লাগলো আর ইনান ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো!

এই পর্যন্ত কয়েকবার ডাকা হয়ে গেছে কিন্তু সায়ানের কোন সাড়াশব্দ নেই।গভীর মনযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছিলো, এখন আবার হাসছে! মাথায় আঘাত পেয়ে কি পাগল টাগল হয়ে গেলো নাকি?ইনান সায়ানকে আলতো করে ধাক্কা দিলো তাতে সায়ান বিরক্ত হয়ে তাকালো আর বললো

“কি সমস্যা ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিয়েছিস কেনো? নিরবে বলা যায় না?”

“সেই! নিরবে বললে তুই শুনোস কই শালা আবার বলিস ধাক্কা দিচ্ছি কেন? কি এমন ভাবছিলি যে তোর কান পর্যন্ত আমার আওয়াজ যায়নি?”

“ভাবছিলাম কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা তোর ওসব জেনে কাজ নেই।”

“আমার কাজ থাকবেই বা কেনো?আমি যা বলি তা শুন, কাল যে স্টেপ উঠিয়েছিস তা আর ভুলেও নিবিনা। তুই জানিস আন্টির কি অবস্থা হয়েছিলো?একে উনি নিজের হাজবেন্ডের শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারপর তোর শোক কি করে কাটিয়ে উঠবে বল?যদি তোর কিছু হয়ে যেতো?আর রুশি? ওর কথা ভেবেছিস? তোর কিছু হলে ওর কি…”

ইনান বুঝতে পারলো সায়ান ওর দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাই ঢোক গিলে হাসার চেষ্টা করে বললো

“মানে আমি বলেছিলাম রুশি ভাবির কি অবস্থা হতো আরকি। যদি তোর কিছু হয়ে যেতো তবে সে কি করে নিজেকে সামলাতো বল?তোর তো তার ব্যাপারে ভাবা উচিৎ!এর পর থেকে ভুলেও এমন কাজ করবি না, নাহয় আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না বলে দিলাম!”

ইনান প্রায় অনেকক্ষণ ধরে এটা সেটা বলে যাচ্ছে আর সায়ান হু হাঁ করছে।ইনানের কথার মাঝেই সায়ান উঁকিঝুঁকি মারলো দরজার দিকে কয়েকবার। ইনানের কথায় বিশেষ গুরুত্ব নেই ওর, ইনান ওর দৃষ্টি খেয়াল করে সেদিকে তাকাতেই কিছু একটা বুঝতে পারলো আর সায়ানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো

“যার জন্য বারবার দরজার দর্শন করছো সে এখানে নেই। আন্টি তাকে জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন আর কড়া নির্দেশ জারি করেছেন যাতে সে আজ আর হসপিটালের চৌকাঠে পা না রাখে। তাই আজ আর তার দর্শন হচ্ছে না আপনার!”

ইনানের কথা শুনে সায়ান যেনো আকাশ থেকে পড়লো, একটা দিন রুশিকে না দেখে থাকতে হবে?অসম্ভব! ও তাড়াহুড়া করে বললো

“আমি এখানে থাকবো না, তাড়াতাড়ি ডিসচার্জ এর ব্যাবস্থা কর।আমি এক্ষুনি বাড়ি যাবো”

“সায়ান! আর ইউ ম্যাড? মাথা ঠিক আছে তোর? ডাক্তার বলেছে কমপক্ষে পনেরো দিন থাকতে হবে সেখানে একদিন না হতেই যাবি মানে?এসব পাগলামো বন্ধ কর”

“তুই ব্যাবস্থা করবি নাকি আমি নিজেই উঠে চলে যাবো?”

বলেই সেলাইনের পাইপ ধরে টান শুরু করে দিলো, ইনান বুঝতে পারলো একে বুঝিয়ে লাভ হবে না,যা মাথায় এসেছে তা করেই ছাড়বে। ও “আচ্ছা ঠিক আছে ” বলে ডাক্তারের কাছে ছুটলো তারপর অনেক্ষন কথা বলার পর ডাক্তার বাসায় নিতে দিতে রাজি হলো। সাথে নার্স পাঠিয়ে দিলো আর প্রয়োজনীয় সব কিছু।শেষপর্যন্ত সায়ান খান বাড়িতেই এসেই ছাড়লো! এতো জেদি ছেলে ইনান আর দুটো দেখেনি, হঠাৎ বাড়ির জন্য এতো উতলা কেনো হলো সেটাই বুঝতে পারছে না ও,,,

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৩৩

রুশি বারান্দায় দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছিলো, মাত্রই ব্রেকফাস্ট করেছে। হাল্কা শীত শীত লাগছে তাই গরম কফি খেতে বেশ লাগছে ওর। সায়ানের এখন কি অঅবস্থায় আছে সেটাই ভাবছে ও, ওর শাশুড়ি মা জোর করে ওকে পাঠিয়ে দিয়েছে বাড়িতে আবার বলেও দিয়েছে যাতে আজ আর ফেরত না যায়। যদিও ও থাকতে চেয়েছিলো সেখানে কিন্তু শাশুড়ি মায়ের উপর না বলতে পারেনি তাই ও আর সামু বাসায় চলে এসেছে প্রায় ঘন্টা দুয়েক হয়েছে।রুশি একটা কথা ভেবে অবাক হচ্ছে যে আসার সময় চন্দ্রিকাকে কোথাও দেখেনি ও, নিজের ভালোবাসার মানুষকে এভাবে একা ফেলে চলে যাবে এটা রুশির কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে!

রুশি খুব মনোযোগ সহকারে কফি খাচ্ছিলো কিন্তু কিছু একটার আওয়াজ শুনে থেকে গেলো। ও স্পষ্ট এম্বুলেন্স এর আওয়াজ শুনছে কিন্তু এখানে এম্বুলেন্স আসবে কেনো?সায়ানদের বাড়ি রাস্তার পাশে নয় বরং ভেতরে তাহলে নিশ্চই এ বাড়িতেই এসেছে এম্বুলেন্স। রুশি নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারলো না,আদো খাওয়া কফি সেল্ফের উপর রেখে দ্রুত পায়ে নিচে নেমে আসলো। নিচে নামতেই শাশুড়িকে চিন্তিত চেহারা নিয়ে বাসায় ঢুকতে দেখলো, রুশি খানিকটা অবাক হলো সাথে ভয়ও পেলো। কার কি হলো আবার?

ও মিসেস খানকে প্রশ্ন করেই বসলো

“মা আপনি হঠাৎ চলে এলেন যে?আপনি বললেন যে আজ আপনি উনার কাছে থাকবেন তাহলে?আর এম্বুলেন্সের আওয়াজ শুনলাম! কে এসেছে?”

মিসেস খান দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো তারপর বললো

“আর বলো না আমার বুড়ো ছেলের ভিমরতি হয়েছে, এই বয়সে সে বাচ্চাদের মতো বায়না করা শুরু করে দিয়েছে। এতো সিভিয়ার একটা এক্সিডেন্ট হলো কই হসপিটালে থাকবে তা না করে বাসায় আসবে বলে জেদ দেখানো শুরু করে দিলো নাহয় নাকি ডাক্তারদের কোন ট্রিটমেন্ট সে গ্রহন করবে না। এই বয়সে এমন করলে চলে বলো! বাসায় কি মধু আছে কে জানে?”

রুশিদের কথার মাঝেই সায়ান আর ইনান এসে পৌঁছালো, সায়ানের ডান হাতে গুরুতর ব্যাথা পেয়েছে সাথে ডান পায়ে হাল্কা চাপ পড়েছে তাই হাটতে অসুবিধা হচ্ছে বলে ইনান ধরে ধরে ঘরে ঢুকাচ্ছে।সায়ানের চোখমুখ কুঁচকানো হয়তো ব্যাথা অনুভুত হচ্ছে তাই!রুশির বিষয়টি খারাপ লাগলো দেখতে, কে বলেছিলো একদিনের মাঝেই হসপিটাল ছেড়ে চলে আসতে! আসলেই বুড়ো হয়ে যাওয়ার পরেও বাচ্চা সাজার শখ হয়েছে।

রুশি দ্রুত পায়ে সায়ানকে দেখার জন্য ছুটে আসছিলো, প্রায় কাছাকাছি চলেও এসেছে কিন্তু রুশি এতো দ্রুতই হাটছিলো যে সামনে ফ্লোর হাল্কা ভিজা ছিলো ক্লিন করার কারণে তা খেয়াল করেনি, হুট করে পিছলা খেয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো। রুশি নিজের পেট চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনুভুত হলো যে ও ফ্লোরে পড়ে যায়নি। বরং কারো বুকে ও ঠেকে আছে আর একটা হাত ওকে চেপে ধরে আছে!

রুশি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো,কি করতে যাচ্ছিলো ও? যদি পড়ে যেতো তাহলে কি হতো,ভয় বাসা বেধে গেছে ওর শরীরে। ও সামনের মানুষটির শার্ট খামচে ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ালো আর তাকাতেই দেখলো সায়ান ওর দিকে তাকিয়ে মিশ্র চাহনিতে। তার চাহনিতে রাগ, চিন্তা, ভয় সব একসাথে দেখা যাচ্ছিলো আর একটা হাত এখনো রুশিকে চেপে ধরে আছে। সায়ান চিন্তিত গলায় বললো

“তুমি ঠিক আছো?কোথাও লেগেছে কি তোমার? এতো কেয়ারলেস কেনো হুম!দেখে শুনে হাটতে পারো না? যদি পড়ে যেতে তাহলে কি হতো একবার ভেবে দেখেছো?”

সায়ানের এতোগুলো প্রশ্নের জবাবে রুশির একটাই জবাব ছিলো, রুশি মাথা নিচু করে আস্তে করে বললো

“স্যরি!”

কথাটা শুনেই সায়ানের মাথা যেনো ধপ করে গরম হয়ে গেলো, দাঁতে দাঁত চেপে বললো

“লাইক সিরিয়াসলি! স্যরি!এটা বললেই সবকিছু সমাধান হয়ে যাবে? তুমি ভাবতে পারছো আজ কি হতে পারতো!”

“বললাম তো স্যরি! আর হবে নাতো!”

রুশি বেশ আদুরে গলায় বললো কথাগুলো, সায়ান রুশির আদুরে গলা শুনে থমকে গেলো। পুরো বাচ্চাদের মতো লাগছে এই মুহুর্তে রুশিকে, ওর রাগ নিমিষেই পানি হয়ে গেলো। রুশিকে আর কিছু বলতে পারলো না, ও গলা পরিষ্কার করে সার্ভেন্টদের উদ্দ্যেশ্যে বললো

“এরপর যদি ফ্লোর আর ভিজা থাকে তাহলে আপনাদের আর কাজে আসার দরকার নেই, আজকে অনেক বড় কিছু হতে পারতো। নেক্সট টাইম থেকে কেয়ারফুল্লি কাজ করবেন”

ইনান সায়ানকে আসতে করে সোফায় বসিয়ে দিলো, এতোক্ষন ধরে ও সায়ান আর রুশির সবগুলো কথাই শুনেছে। রুশির আদুরে কন্ঠ আর সায়ানের রিয়াকশন সবই দেখেছে, সত্যি বলতে সায়ান আগের থেকে অনেক শান্ত হয়েছে গিয়েছে। আগের মতো এখন কথায় কথায় রেগে যাওয়ার অভ্যাসটা কমে গিয়েছে হয়তো রুশির জন্য!কিন্তু এসব দেখে ওর যতোটা কষ্ট হবে ভেবেছিলো ততটা কষ্ট হচ্ছে না হয়তো এমন কিছু দেখবে আশা করে ছিলো তাই!রুশিকে ভুলা ওর জন্য এতো সহজ নয় আবার অসম্ভবও নয় তাই চেষ্টা করতে ক্ষতি কি?একসময় হয়তো আর বুকের চিনচিন ব্যথাটা করবে না, সব ঠিক হয়ে যাবে আগের মতো। জীবন তো আর থেমে থাকে কারো জন্য তাই বাস্তবতা যতো তাড়াতাড়ি মেনে নিবে ততই ভালো। তাছাড়া ওর জীবনের সাথে অন্যকেউ জড়িত আর ও তাকে হারাতে চায়না। রুশি হারিয়ে সেই ব্যথা সামলে উঠতে পারলেও আরেকজনকে হারানোর সামর্থ্য ওর নেই!

রুশি সায়ানের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো হঠাৎ সায়ানের ডান হাতের দিকে নজর গেলো। বেন্ডেজের উপর দিয়ে তাজা রক্ত দেখা যাচ্ছে, রুশি দ্রুত হাত ধরে বসলো। নিশ্চই ওকে ধরতে গিয়ে এই হাতে আবার ব্যথা পেয়েছে, রুশি দ্রুত নার্সকে এটা দেখালো আর সে বেন্ডেজ খুলে আবার বেন্ডেজ করে দিতে লাগলো।পুরোটা সময় সায়ান রুশির দিকে তাকিয়ে আছে আর রুশি সায়ানের হাতের দিকে তাও চিন্তিত ভঙ্গিতে। সামু নিচে এসে এমন দৃশ্যই দেখলো আর মুচকি হাসলো তারপর গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো

“ভাই তুই নাকি বাসায় আসার জন্য উতলা হয়ে যাচ্ছিলি?একদম সেলাইনের পাইপ টাইপ খুলে টুলে ব্যাপক অবস্থা!কেনো রে বাসায় কি মধু আছে যা হসপিটাল থেকে বাসায় চলে এসেছে বলে তোর আর সেখানে মন টিকছিলো না?”

“সামু মুখ সামলে কথা বল, বড় ভাই তোর আমি।
এসব কি কথা বলছিস তুই?”

“যা সত্যি তাইতো বললাম, বুঝি বুঝি সব বুঝি।প্রাণভোমরা যে বাসায় চলে এসেছে হসপিটালে কি আর মন টিকবে?”

বলেই সামু রুশির দিকে তাকালো তারপর গাওয়া শুরু করলো

“আমি একদিন তোমায় না দেখিলে
তোমার মুখের কথা না শুনিলে
পরান আমার রয়না পরানে।।
প্রেমের ধরণ কেন গো এমন
কাছে না পেলে তোমায় লাগে যে কেমন।।
বিরহে পুড়িয়া অন্তর খাঁটি করিয়া।।
পাবে যে সুখ মিলনে
তুমি আমার সুখগো জীবনে,,,”

সামুর ইঙ্গিত শুনে রুশির কেনো জানি লজ্জা লাগলো, যদিও জানে সায়ান ওর জন্য আসেনি তবুও এই মুহুর্তটা ওর কাছে বেশ লাগছে। লজ্জায় নিজের গালদুটোর গরম হয়ে যাওয়া নিজেই ফিল করতে পারছে। সামু সেই লাজুক চেহারা দেখে বললো

“কি প্রেম! কি প্রেম!ভাবিগো ভাবি এতো প্রেম কই রাখবা তুমি?”

সায়ান এবার খানিকটা লজ্জা পেলো, এতোক্ষন সামু ইন্ডিরেক্টলি বললেও এখন সরাসরি রুশিকে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে ও রুশির জন্যই চলে এসেছে। সায়ান রাগ করার ভান করে বললো

“একদম বাজে বকবি না, গেলি তুই এখান থেকে?”

সামু হিহি করে হেসে সেখান থেকে দৌঁড়ে চলে এলো। ভাই বেশ ক্ষেপেছে ওর!এখন আর ক্ষেপানো যাবে না।ও হাসতে হাসতে নিজের রুমের দিকে আসছে আর বলছে

“ইশ চারদিকে কি প্রেমগো!এমন একটা প্রেমে যদি করা যেতো!”

বলেই বুকের মাঝে দিলো আর খালি গলায় গান ধরলো

“এই বুকের মাঝে আগুন জ্বলে
নিভে নারে জ্বল ছিটালে
কবে দিমু গলায় মালারে
আরে কবে কবে কবে আইবে পালারে
আরে দিমু গলায় মালারে মালা…”

শেষ করার আগেই কেউ একজন ওকে টেনে রুমের ভেতরে ঢুকিয়ে নিলো আর পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে থুতনি রেখে বললো

“তুমি রাজি হলে তো এখনি গলায় মালা পরিয়ে দিতে পারি, তুমি রাজি হচ্ছোনা বলেই তো সব মাঝ পথে আটকে আছে। তুমি রাজি হয়ে যাও তাহলে এক্ষুনি কাজি ডেকে বিয়ে করে ফেলি আর তোমায় তোমার শশুর বাড়ি নিয়ে যাই”

বলেই গালে হুট করে কিস করে দিলো তারপর সামুকে নিজের দিকে ফিরিয়ে হাল্কা নাক টেনে দিয়ে গানের সুরে বললো

“যাবো তোমায় শশুর বাড়ি নিয়ে”

বলেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো আর সামু এখনো সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। গালে হাত দিয়ে ভাবছে ও কি স্বপ্ন দেখছে? মি.নিরামিষ ওকে কিস করে চলে গেলো?এটা কি সেই বোরিং ইনান যাকে ও এতো বছর ধরে চিনতো!

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৩৪

রুমে আসার পর থেকে সায়ান এক ধ্যানে রুশিকে দেখে যাচ্ছে কিন্তুর রুশির সেদিকে খেয়াল নেই। ও নার্সের সাথে আলোচনায় ব্যাস্ত, কখন কোন মেডিসিন নিতে হবে, কখন ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করবে আরো কতো কি!সায়ান রিতীমত মন খারাপ করে বসে আছে, ও অসুস্থ সেদিকে রুশির কোন খেয়ালই নেই অথচ মেডিসিনের দিকে কি মনোযোগ! এই মেডিসিন গুলোর দাম ওর থেকে বেশি,হিংসা হচ্ছে মেডিসিনগুলো কে দেখে। সায়ান ভ্রু কুচকে সেই মেডিসিন গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে এই মেডিসিনগুলোকে আছড়ে আছড়ে ফেলা কল্পনা করছে!

রুশির কথা শেষ হতেই নার্স বেরিয়ে গেলো আর রুশি মেডিসিন গুলো গুছিয়ে রাখতে লাগলো। এর মাঝে আড়চোখে সায়ানের দিকে তাকালো, সায়ানকে মনযোগ সহকারে তাকিয়ে থাকতে দেখে রুশি গম্ভীর গলায় বললো

“এখানে এতো বেশি মেডিসিন নাই তাই অমন মুখ বানানোর দরকার নাই। যদি হেলথের ইম্প্রুভ হয় তবে কমে যাবে এর থেকে কতোগুলো”

সায়ান এটাই চাচ্ছিলো যে রুশি ওর সাথে কথা বলুক নিজ থেকে, কারণ রুশির প্রতি এখনো কিছুটা হলেও অভিমান রয়ে গেছে। ও রুশির জীবনে নিজের ইম্পর্টেন্স খুজছিলো কিন্তু রুশির গম্ভীর কন্ঠ শুনে গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। রুশি মেডিসিন গুলো ছিড়ে সায়ানের সামনে ধরলো তারপর পানি এগিয়ে দিলো। সায়ান বাধ্য ছেলের মতো খেয়ে নিলো মেডিসিন গুলো তারপর আবারও নিরবতা। রুশি সায়ানকে রেখে বারান্দায় চলে যাওয়াতে সায়ানের মনটা যেনো আরো খারাপ হয়ে গেলো। মুখটা ভার করে বারান্দার দিকে তাকিয়ে রইলো কিন্তু অনেকক্ষণ পার হওয়ার পরও রুশি এলোনা। তখন সায়ান নিচে নামার চেষ্টা করলো উদ্দ্যেশ্যে রুশির পাশে গিয়ে দাঁড়াবে কিন্তু ব্যথায় ‘আহহহ’ করে উঠলো।

রুশি আওয়াজ শুনে দ্রুত পায়ে রুমে ঢুকে দেখে সায়ান ডান হাত ধরে চোখমুখ কুচকে বসে আছে ব্যথায়। রুশি কাছে এসে শান্ত গলায় বললো

“কি হয়েছে? চুপচাপ শুয়ে থাকতে পারেন না? নড়চড়া করছেন কেনো?”

“তো একাএকা শুয়ে থাকতে কারো ভালো লাগে বুঝি?”

“কাজই এমন করেছেন যে শুয়ে থাকা ছাড়া আপনার আর কোন কাজ নেই। যান না যান আরো গাড়ি চালাতে যান তাও ফুল স্পিডে। বিনা টিকিটে পুরো মহাকাশ ঘুরে আসতে পারবেন, চাইলে ওইখানে বাসা বাড়িও করে নিয়েন।”

“এই একটা সামান্য জিনিসের জন্য এতো কথা শুনাচ্ছ কেনো?আমি কি ইচ্ছে করে করেছি!”

“আপনার এটা সামন্য জিনিস মনে হচ্ছে?আপনি জানেন আপনি কি করেছেন? ইউ নো হোয়াট আমার আপনার সাথে কথা বলতেই ইচ্ছে হচ্ছে না। আপনি এখনো বুঝতেই পারছেন না আপনার ভুলটা ঠিক কোথায়!”

“তোমার কি আমার জন্য চিন্তা হয়?”

“নাহ হয়না, তবে এবাড়িতে অঅনেকেই আছে যারা আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে আছে বিশেষত আপনার মা”

“আমার কিছু হলে তোমার কি আসে যায় না?ওহ তুমি তো বলেছো তুমি নাকি আমার বউ না,তাইতো আমি সেটা ভুলে গেলাম কি করে!তাহলে আমার জন্য এসব করছো কেনো দয়া করে নাকি দায়িত্ব থেকে?”

“ঠিক তাই! আমি আপনার বউ না তবে সমাজের কাছে আমি আপনার স্ত্রী আর আইনের কাছেও। আর স্ত্রী হিসেবে আমার কিছু দায়িত্ব আছে যার থেকে আমি পিছপা হতে পারিনা”

রুশি গম্ভীর কন্ঠে বললো আর সায়ান ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। এরই মাঝে হুট করে চন্দ্রিকা রুমের ভিতরে ঢুকলো আর রুশি তাকে দেখতেই অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। এই মুহুর্তে সব বিষাদ লাগছে ওর, চন্দ্রিকাকে এক মুহুর্তের জন্যও সহ্য হয়না ওর। স্ত্রী হিসেবে স্বামীর প্রেমিকাকে সহ্য করার মতো মহান নারী ও হয়ে যায় নি, অন্যসব স্ত্রীদের মতো ও এই বিষয়টি মেনে নিতে পারছে না যদিও ও জানে ও রিয়েল ওয়াইফ নিয় তবুও নিজের ভেতরের জেলাসি ও দমিয়ে রাখতে পারেনা আজকাল। সায়ানের প্রতি কেমন যেনো পসেসিভ হয়ে যাচ্ছে যদিও প্রকাশ করে না। এদিকে চন্দ্রিকা কিছু বলার আগেই সায়ান বলে উঠলো

“দায়িত্ব! হাহ তাহলে তুমি মহান স্ত্রী প্রমাণ করার জন্য আমার প্রতি দায়িত্ব পালন করছো? দরকার নেই তোমার এই দয়ার। সায়ান জামিল খানের কারো দয়ার প্রয়োজন নেই, তুমি আসতে পারো। আমার এখনো এমন দুর্দিন আসেনি যে আমি অন্যের দয়ায় বেঁচে থাকবো। আই ডোন্ট নিড ইট মিস রুশানি আনাম। যেহেতু আপনি আমার বউ নন তাই আমার প্রতি আপনার দায়িত্ব পালনের কোন দরকার নেই”

বলেই মুখ ফিরিয়ে নিলো, রুশি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো তারপর রুম থেকে বেরিয়ে আলতো করে দরজা লাগিয়ে দিলো। চন্দ্রিকা এই দৃশ্য দেখে বেশ খুশি, ও খুশিমনে সায়ানকে বললো

“বাইরের কেউ তোমার সেবা করার দরকার নেই আমি আছিতো। তুমি ভালোই করেছো ওই মেয়েকে…”

“গেট আউট”

“সায়ান আমি…”

“ডিডেন্ট ইউ হেয়ার মি?আই সেইড গেট আউট।আমার মন মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ তাই এমন কোন বাজে বিহেভ করতে চাইনা যেটা তোমার খারাপ লাগবে। যদি রুশির দয়ার দরকার নাহয় এরমানে কারো দয়ারও দরকার নেই আমার।প্লিজ গো”

সায়ান রক্তচক্ষু নিয়ে কথাগুলো বলেছে, চন্দ্রিকা বুঝতে পারলো যে সায়ানকে আর কিছু বলে লাভ নেই তাই বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। আস্তে করে ‘টেক কেয়ার’ বলে বেরিয়ে পড়লো। রুশি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মুচকি হাসছে, রুমের বলা সবগুলো কথাই ও শুনেছে। ও দেখতে চেয়েছিলো সায়ান ওকে যেতে বলে চন্দ্রিকাকে কি বলে, কিন্তু সায়ানের ব্যবহারে রুশি বেশ সন্তুষ্ট। আর যাইহোক ওর থেকে চন্দ্রির প্রতি রুড ব্যাবহার বেশি ছিলো তাই সায়ানকে এমন ওতো খারাপ লাগছে না ওর কাছে। রুশি আরেকপা এগুতেই হাতে টান পড়লো, পিছনে ফিরে দেখে চন্দ্রিকা দাঁড়িয়ে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে বেশ রেগে আছে তাই রুশি মুচকি হাসলো আর এতেই চন্দ্রিকা আরো চটে গেলো

“ইউ…তোমার জন্য সব হয়েছে। তোমাকে তো আমি!”

বলেই রুশিকে থাপ্পড় মারতে নিলো কিন্তু রুশি হাত চেপে ধরে ফেললো। আর দিগুণ শক্তি দিয়ে হাত মুচড়ে ধরে বললো

“একবার সুযোগ পেয়েছেন বলে বারবার পাবেন এমন ভাবার কিন্তু কারণ নেই। আমি কোন অবলা নারী নই যে আপনি অত্যাচার করবেন আর আমি কিছু বলবোনা।হাত আমারো আছে আর সেটা আমিও উঠাতে পারি তাই পরেরবার কিন্তু ভেবেচিন্তে হাত চালানোর চেষ্টা করবেন নাহয় আপনার এতো সুন্দর হাত গুড়িয়ে দিতে দু সেকেন্ড লাগবেনা আমার”

“তুমি কি ভাবো নিজেকে? তুমি জানো আমি কে?সায়ানের বাগদত্তা যেটা পুরো দুনিয়া জানে। তুমি কি ওর?”

“আমি তার বিয়ে করা বউ আর তার আইনগত স্ত্রী। তাহলে আমার গুরুত্ব বেশি না আপনার? আপনি নিছক তার দুদিনের প্রেমিকা ছাড়া আর কিছু নন। যতোদিন আমি এই বাড়িতে বউ হিসেবে আছি ততদিন আপনি তার জীবনে কিছু না তাই নেক্সটাইম বুঝে শুনে হাত তুলতে আসবেন নাহয় আমি যদি এখন বলি আপনাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে সবাই হাজির হয়্র যাবে বের করে দেয়ার জন্য। খান বাড়ির বউ হিসেবে এতোটুকু পাওয়ার তো আছেই আমার! এন্ড নেক্সটাইম দিজ উইল ট্রুলি হেপেন”

“তোমাকে তো আমি দেখে নিবো, আজকের জন্য তুমি অনেক পস্তাবে”

“আমি অপেক্ষায় রইলাম পস্তানোর জন্য। বাই!”

চন্দ্রিকা রাগে যেনো বম হয়ে গেলো, হাত ছাড়িয়ে নিলো। নিচে নামতেই মিসেস খানের হাসিমাখা মুখ দেখতে পেলেন যা জানান দিচ্ছিলো যে ‘আমি জিতে গেছি আর তুমি হেরে গেছো’ চন্দ্রিকা বেরিয়ে সেখান থেকে কারণ সায়ানের কাছে যদি ওর দাম না থাকে এরমানে এ বাড়ির কারো কাছে ওর দাম নেই। রুশি খুশিমনে কিচেনে গেলো তারপর স্যুপের বাটি নিয়ে সায়ানের রুমে এলো, সায়ান চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় বুঝলো রুশি এসেছে কারণ ওর হাটার মৃদু শব্দ ও চিনে। ও সেই অবস্থায় বললো

“কেনো এসেছো আবার?ফেলে যাওয়া দায়িত্ব পালন করতে?”

“উহুম সেটা না”

“তাহলে কেনো দয়া দেখাতে এসেছো আমি অসুস্থ বলে?”

“সেটাও না”

সায়ান এবার চোখ খুললো তারপর রুশির দিকে তাকিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে বললো

“তাহলে কেনো এসেছো এখানে”

“আমার ভালো লাগে আসতে তাই এসেছি। আপনার কোন সমস্যা আছে?”

নিজের হাতের শাহাদাত আঙুল সায়ানের দিকে পয়েন্ট করে। সায়ান রুশির কথা শুনে মুচকি হাসলো তারপর মৃদু কন্ঠে বললো

“হঠাৎ ভালো লাগে কেনো?”

“উমম ভালোলাগা এমনিই কাজ করে, সকল ভালোলাগার পেছনে যে কারণ থাকতে হবে এমন কিন্তু নয় মিস্টার খান!কিছু ভালোলাগা কারণ ছাড়াই হুট করেই হয়ে যায়, মানুষ টেরই পায়ন”

সায়ান রুশির দিকে তাকালো, এই সামান্য ভালোলাগার কথাশুনেও ওর প্রশান্তি লাগছে। আসলেই সবকিছুর কারণ থাকে না, কিছু কিছু কারণ ছাড়াই হয়। যেমন এই যে এই মেয়েটিকে ও কারণ ছাড়াই ভালোবাসে যা শেষ হবার নয়!

#চলবে

গুমোট অনুভুতি পর্ব-২৯+৩০+৩১

0

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_২৯

সায়ান রুশির চোখের দিকে তাকালো, রুশির চোখজোড়া টলমল করে উঠছে। চোখমুখ শুকিয়ে আছে আর নাকের ডগা লাল হয়ে আছে, চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না রুশি রেগে আছে বরং অভিমানে ছেয়ে আছে চোখেমুখে! সায়ান রুশির দিকে সামান্য এগিয়ে এলো,রুশি নিজের স্থান থেকে একচুলও নড়ে নি বরং সায়ানের এগিয়ে আসা দেখে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো চোখের কার্নিশ বেয়ে তবুও সায়ানের থেকে দৃষ্টি সরায়নি। সায়ান আলতো করে চোখের পানি মুছে দিলো তারপর নরম স্বরে বললো

“কেউ কিছু বলেছে তোমায়?”

রুশি মুখ ঘুরিয়ে নিলো তারপর জড়ানো কন্ঠে বললো

“নাহ কেই কিছু বলেনি, এটা আমার নিজের সিদ্ধান্ত”

সায়ান নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলো, চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিয়ে আবার বলে উঠলো

“হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত মানুষ এমনিই তো নেয়না তার পেছনে যথেষ্ট কারণ থাকে। তোমাকে আমি খুব ভালো করে চিনি, কারণ হুট করে এমন কথা বলার মেয়ে তুমি না। আমাকে বলো কি হয়েছে!”

“আমি আপনার সাথে কোন কৈফিয়ত দিতে রাজি নই, আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই আমি বলেছি। আমার ডিভোর্স চাই আর আপনি আমাকে তা দিবেন।আমি আপনার সাথে থাকতে চাইনা”

সায়ান রুশির একদম কাছে এসে ওর বাহু চেপে ধরলো তারপর চড়া কন্ঠে বললো

“তখন থেকে ডিভোর্স ডিভোর্স করে যাচ্ছো! কি করেছি আমি তোমাকে যার জন্য হুট করে এমন কথা বলছো? ট্রাস্ট মি রুশি এই শব্দটা শুনতে আমার কতোটা খারাপ লাগছে!তুমি এই শব্দটা আমার সামনে আর কক্ষনো বলবে না”

“কেনো, আপনার কেনো খারাপ লাগছে?আপনার তো খুশি হওয়ার কথা, আপনার লাইফে আর কোন ঝামেলা থাকছে না। আপনাদের ভালোবাসার মাঝে আমি তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে থাকছি না,আপনার তো ভালোই হবে। এমনিতেও আপনার প্রেমিকার মনে হয় আমি আপনাকে বশ করে ফেলেছি, নিজের রুপ দেখিয়ে আপনাকে সিডিউস করেছি আর বাচ্চার দোহাই দিয়ে আপনাকে ট্রেপে ফেলে দিয়েছি। বিশ্বাস করুন এই শব্দগুলো আপনার জন্য স্বাভাবিক হলেও আমার জন্য অনেক কষ্টের। আই জাস্ট ওয়ান্ট ডিভোর্স, শুনতে পাচ্ছে আপনি? আমি মুক্তি চাই আপনার কাছে, জাস্ট লিভ মি এলোন!”

রুশি কথাগুলো বলে সায়ানের হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিয়েছে কিন্তু পুরোপুরি না ছাড়তেই সায়ান ওকে হাত টেনে চেপে ধরে নিজের কাছে নিয়ে যায়। রুশি কিছু বুঝে উঠার আগেই ওর অধর যুগল অন্যের অধীনে চলে যায়,নরম স্পর্শ গুলো আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে যেনো জমানো সব ক্ষোভ আর রাগ প্রকাশ পাচ্ছে স্পর্শে স্পর্শে। রুশি কিছুক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেয়, দেহ কেমন যেনো অসাড় হয়ে আসে, পা হাল্কা কাঁপতে থাকে। নিজের সম্পুর্ণ ভার ও সায়ানের উপর ছেড়ে দেয়, জীবনের এই অনুভুতিগুলো স্বজ্ঞানে উপভোগ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই,,,

সায়ান আলতো করে রুশিকে ছেড়ে দিয়ে রুশির গালে হাত রাখে তারপর ভারী শ্বাস নেয়া কন্ঠে বলে

“এরপর থেকে যদি তোমার মুখে ডিভোর্সের কথা শুনি তবে খবর আছে তোমার।তুমি চাইলেও আমি তোমাকে যেতে দিবো না আর আমাদের সন্তানের প্রপার পরিবার দরকার। তুমি কি চাও ও যেকোন একজনের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হোক!তুমি কিসব কথা শুরু করেছো বলোতো?রুশি…”

কিছু বলার পুর্বেই ঠাসস করে শব্দ হলো আর সায়ান রুশির দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রুশির চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট, ও রিতীমত রাগে ফুসছে। সায়ানকে ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো

“সাহস কি করে হয় আপনার আমাকে টাচ করার?আমি আপনাকে অনুমতি দিয়েছি আমাকে ছোঁয়ার?ভুলে যাবেন না আপনি শুধু আমার কাগজের স্বামী আর ইসলাম অনুযায়ী আমাদের বিয়ে জায়েজ নয়। প্রেগন্যান্ট থাকা অবস্থায় কোন নারীর বিয়ে হয়না, যদিও আমি জানতাম না তবে আজ জেনেছি তাই চেয়েছি কাগজের দিক থেকে আপনার থেকে মুক্ত হতে। কিন্তু আপনি আমার সম্মতি ছাড়া আমাকে টাচ করেছেন, হাউ ডেয়ার ইউ?আমার এতোদিন মনে হতো আপনি আর যাইহোক সম্মান করতে জানেন মেয়েদের কিন্তু না আমি ভুল ছিলাম। আই জাস্ট হেট ইউ!আপনি আমার জীবনে আসার পর থেকে আমার জীবনের কিছুই ঠিক নেই, কিচ্ছুনা। আমি এতোটা অপমানিত কখনো হইনি এর আগে যতোটা আপনার কারণে হতে যতোটা হয়েছি। আম জাস্ট ফেড আপ,প্লিজ জাস্ট লিভ মি এলোন!”

রুশি কথাগুলো বলতে বলতে নিচে বসে পড়লো, চোখ থেকে অথৈজল গড়িয়ে পড়ছে। মাথায় দুহাত দিয়ে চুল চেপে ধরে বসে আছে,সায়ান রুশির অবস্থা দেখে ওর সামনে এগিয়ে আসতে লাগলো আর বলতে লাগলো

“রুশি আমার কথাটা শুনো প্লিজ!”

রুশি সেটা লক্ষ্য করতে হাত দিয়ে থামিয়ে দিলো তারপর জোরে বলে উঠলো

“ডোন্ট ইউ ডেয়ার!আপনি জাস্ট আমার লাইফ থেকে চলে যান প্লিজ, আমি সহ্য করতে পারছিনা আপনাকে। জাস্ট লিভ মি এলোন!”

সায়ান শান্ত দৃষ্টিতে রুশির দিকে তাকালো, রুশির চোখে ও ঘৃণা দেখেছে। ওর সাথে থাকাতে রুশি কতোটা আনহেপি তা দেখেছে, সায়ান কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর বেরিয়ে পড়লো। সায়ান বেরিয়ে যেতেই রুশি হাটুর উপর থাকা রেখে বসে পড়লো, অনেক কষ্ট হচ্ছে এই মুহুর্তে!ও তো এমন জীবন চায়নি?থাহলে কেনো হচ্ছে এমন ওর সাথে?কেনো ওকেই বারবার ঠকতে হয়! কেনো বারবার আঙুল ওর দিকেই তোলা হয়?

আজ সকালে যখন ভার্সিটিতে যায় ও তখন দেখে সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে, হঠাৎ সবার দৃষ্টি ওর দিকে দেখে ও ঠিক বুঝতে পারেনা কেনো তাকিয়ে আছে সবাই। হুট করে একটা মেয়ে এসে ওর কানে কানে কিছু একটা বলে যাতে ও দ্রুতপায়ে নিজেদের ক্লাসরুমের সামনে যায় গিয়ে যা দেখে ও থমকে যায়। রুশি আর সায়ানের সেই হোটেলের কিছু ছবি এখানে আছে, কিন্তু সায়ানের মুখ এখানে সম্পুর্ণ স্পষ্ট না হলেও তবে রুশির মুখ স্পষ্ট। রুমের বাইরে এইরকম অনেকগুলো ছবি দেয়ালে আটকানো সাথে প্রত্যেকটা ছবির নিচে লিখা ‘মিস্ট্রেস’।রুশি রাগে ক্ষোভে সেই ছবিগুলোর অনেকগুলো ছবি ছিঁড়ে ফেললো তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লো। আশেপাশের মানুষের কানাঘুষা কানে আসছিলো বিশেষ করে ছেলেদের,অনেকে এক রাতের রেটও জিজ্ঞেস করা শুরু করে দিয়েছে।

লজ্জায় রুশি কেঁদে দিলো, ভার্সিটির গেটে আসতেই হঠাৎ করে কিছু লোক ক্যামেরা দিয়ে ওকে কেপচার করা শুরু করলো, সায়ান জামিল খান খুব ইয়াং একজন বিজনেস ম্যান আর ব্রেন্ডের মালিক হওয়ায় খুব পরিচিত মুখ দেশে, প্রায়ই তার বিভিন্ন ইন্টার্ভিউ নেয়া হয়। তাই দেশের সফল একজন ব্যাক্তির ঘটনায় সাংবাদিকরা আসবে এটাই স্বাভাবিক। সেই লোকগুলোর মাঝে কিছু লোক প্রশ্ন করা শুরু করলো

–আপনার সাথে সায়ান জামিল খানের কি সম্পর্ক?

–উনার অলরেডি একজন বাগদত্তা আছে কিন্তু তারপরেও আপনার সাথে ওনার এই ধরনের ছবি কি করে আসলো?

–তাহলে কি আপনার সাথে তার কোন অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে যা তার বাগদত্তা অবগত নয়?

–আপনাকে দেখলে যদিও তা মনে হয়না তবে কি এটাই সত্যি যে আপনি একজন মিস্ট্রেস?

এতোগুলা প্রশ্নের বিপক্ষে রুশি কিছু বলতে পারেনি, কি বলবে ও এই লোকগুলোকে?কি সম্পর্ক ওর সায়ানের সাথে? শুধুমাত্র কাগজের স্ত্রী! সায়ানের যদি সত্যিটা প্রকাশ করার থাকতো তবে অনেক আগেই প্রকাশ করে দিতো কিন্তু সে করেনি তারমানে সে স্বিকার করতে চায়না যে রুশি তার স্ত্রী!আদোও রুশির পরিচয় কি?সবার কাছে তো এইমুহুর্তে ও সায়ানের রক্ষিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। রুশি কিছু বুঝে উঠার পুর্বেই কয়েকজন বডিগার্ড এসে রুশিকে সেখান থেকে সেফলি বের করে নিয়ে আসলো আর একটা গাড়িতে বসিয়ে দিলো। গাড়িতে উঠেই ও সায়ানকে ফোন দিতে থাকলো, কিন্তু সায়ানের ফোন বন্ধ দেখাচ্ছিলো তবুও ও চেষ্টা করে গেছে। হয়তো এখন ধরবে কিন্তু ওইপাশ থেকে কোন রেস্পন্স পায়নি।রুশি সায়ানকে ফোন করাতে এতোই ব্যাস্ত ছিলো যে পাশে যে ইনান বসে ছিলো তা খেয়াল করেনি।

বাসায় আসার পর সবাই মিলে বসে ছিলো সায়ানের জন্য, রুশি কতোক্ষণ পর পর দরজার দিকে তাকিয়ে ছিলো কিন্তু সায়ান আসেনি। ও নিজের রুমে বসেছিলো হুট করে ফোন আসলো, রুশি নাম্বার না দেখেই বলে উঠলো

“সায়ান আপনি কই? কি অবস্থা আপনার? ফোন ধরছিলেন না কেনো?”

কিন্তু অপরপাশ থেকে একটা নারীকন্ঠ ভেসে আসলো

“এখনো সায়ানের অপেক্ষা করে আছো?তোমার মনে তোমার কিছু হওয়া না হওয়াতে সায়ানের কিছু যায় আসে?যদি আসতো তাহলে তোমার প্রয়োজনে নিজের ফোন অফ করে রাখতো না, ও চায়না বিরক্ত হতে তাই অফ করে রাখছে ফোন। আমি জানি একটা মেয়ে হিসেবে এটা তোমার জন্য কষ্টকর কিন্তু সায়ান তোমাকে তার কাছে রাখছে শুধুমাত্র তোমার গর্ভে থাকা ওর সন্তানের জন্য নাহয় কবে তোমাকে ছুড়ে ফেলে দিতো! ও তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করে যাতে তুমি মানসিক ভাবে ভালো থাকো আর বেবির কোন ক্ষতি না হয় বাট হি ডাসেন্ট কেয়ার এবাউট ইউ। আর মনে রেখো তিনবছর পর তোমার বাচ্চা কিন্তু আমার কাছে থাকবে আর সায়ান বলেছে সে তোমার সাথে তার কোন সম্পর্ক রাখবে না।মেয়ে হিসেবে একটা এডভাইজ দেই যদি এতোটুকুও আত্মসম্মান থাকে তবে নিজ থেকে সরে দাঁড়াও নাহয় সায়ান থেকে এই কথাগুলো শুনলে একসময় এরচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে।আর যাইহোক ও আমাকে ভালোবাসে তাই আমার উপর তোমাকে কখনোই চুজ করবে না”

কথাগুলো বলেই চন্দ্রিকা ফোন রেখে দিলো আর রুশি ঠায় হয়ে বসে রইলো,শেষ পর্যন্ত ওই তৃতীয় ব্যাক্তি হিসেবে রইলো। চন্দ্রিকা যা বলেছে তা সত্যি, শুরুতেই সায়ান বলেছিলো ওদের সম্পর্ক তিনবছরের কিন্তু সায়ান ওর সন্তানের সাথে ওকে দেখা করতে দিবে না এটা ভেবেই রাগ উঠে গেলো। এমনটাতো কথা ছিলো না, ও সবকিছু মেনে নিলেও নিজের সন্তানকে নিজের থেকে আলাদা হতে দিবে না, যেকোন মুল্যে না। ও সেটা ভেবেই কান্না করে দিলো আর ঠিক ওইসময়েই সায়ান ঘরে প্রবেশ করে। সারাদিনের জমে থাকা রাগ, ক্ষোভ সবকিছু ঝেড়ে দিলো সায়ানের উপর। কিন্তু এখন রিগ্রেট হচ্ছে, রাগের মাথায় এতোগুলো কথা শুনানো উচিৎ হয়নি। তাছাড়া সায়ান কিছু বলতে চাইছিলো ওকে কিন্তু কি?চন্দ্রিকার কথা বিশ্বাস করে কি ঠিক করলো ও!

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৩০

হাসপাতালের করিডোরে বসে আছে রুশি, চারপাশের ফিনাইলের গন্ধ নাকে এসে বাড়ি খাচ্ছে তবে সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ওর। ও নিজের মতো বেঞ্চে বসে আছে মাথা নিচু করে, এতোক্ষন কান্না করলেও এখন আর করছেনা তবে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে হয়তো কান্নার রেশটা এখনো যায়নি। ওর অদুরেই মিসেস খান অপারেশন থিয়েটারের সামনে এলোমেলো ভাবে বসে আছে, মাঝেমাঝে হয়তো বিলাপ করে উঠছেন আর বিড়বিড় করে জিজ্ঞেস করছেন তার ছেলে আসছে না কেনো? কবে খুলবে এই দরজা!তার পাশেই সামু তাকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা করেছেন।

স্বামীর মৃত্য বেশ দাগ কেটে গিয়েছে তার মনে, এখনো স্বামীর মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেন নি প্রায় সময় কেঁদে উঠেন হঠাৎ সেখানে ছেলের এই করুণ অবস্থা কি করে সহ্য করবেন?চোখ বন্ধ করলেই যেনো ছেলের রক্তাক্ত দেহ ভেসে উঠছে!ঘন্টাখানেক পুর্বে ছেলেকে নিজের চোখের সামনে দিয়ে সুস্থ অবস্থায় বেরিয়ে যেতে দেখেছেন, সায়ান তাড়াহুড়ায় বেরুতে দেখে ভেবেছিলেন কোম্পানিতে কিছু হয়েছে তাই ছেলের মনের অবস্থা চিন্তা করে কিছু জিজ্ঞেস করেন নি। কিছুক্ষণ পুর্বেই হঠাৎ কল আসে তার ফোনে আর বলে যে এই নাম্বারের মালিকের খুব বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে আর তাকে সিটি হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কথাটা শুনতেই তার হাত পা যেনো অসাড় হয়ে আসতে লাগলো, স্বামীর মৃত চেহারা ভেসে আসতে লাগলো। কোনরকম সামুকে বললো কথাগুলো, তারপর সামু গিয়ে রুশিকে রুম থেকে ডেকে আনে। ইনান সেই সন্ধ্যায় সায়ানের পরেই এসেছিলো তাই সে শুনেই তাদের ড্রাইভ করে নিয়ে আসে,,,

হসপিটালে আসার মিনিট দশেক পর এম্বুলেন্সে করে সায়ানকে নিয়ে আসা। সারা শরীর রক্তাক্ত অবস্থায় ছিলো! তাড়াতাড়ি করে তাকে অটিতে ঢুকানো হয়। যারা নিয়ে এসেছে তাদের জিজ্ঞেস করার পর জানতে পারে সায়ান ফুল স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিলো আর ট্রাফিক রুলস ব্রেক করে, এজন্য পুলিশের গাড়ি তাকে ফলো করা শুরু করে। হাইওয়ে থেকে সাধারণ রাস্তায় গাড়ি আসার কতোক্ষণ পরে একজন রাস্তা পার হচ্ছিলো কিন্তু ফুল স্পিডে থাকায় সায়ান ব্রেক করতে না পেরে গাড়ি ইউ টার্ন নিতে চায় কিন্তু রাস্তার পাশে থাকা পিলারের সাথে বাড়ি খেয়ে থেমে যায়। সেই পুলিশরা দ্রুত তাকে গাড়ি থেকে বের করে আর এম্বুলেন্স খবর দেয় আর তারা ওকে এখানে নিয়ে আসে।

ইনান রুশির অদুরেই দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রুশির এই অবস্থা দেখে সত্যি বলতে ওর খারাপ লাগছে কিন্তু ও যেতে পারছেনা কারণ সামু এখানে আছে আর সামুর মনে কোনপ্রকার ভুল ধারণা ও ক্রিয়েট করতে চায়না। কিছুক্ষণ পুর্বেও চন্দ্রিকা এখানে ছিলো, এসেই রুশিকে ব্লেম করা শুরু করে আর কান্না জুড়ে দেয়। মিসেস খান তো নিজেই চন্দ্রিকাকে কিছু বলার অবস্থায় ছিলেন না আর সামু তাকে সামলানোতে ব্যাস্ত ছিলেন। ইনান এগিয়ে এসে কিছু বলতে নিলে চন্দ্রিকা ওকে চুপ করিয়ে দেয়, হুট করেই বলে উঠে

“আমাদের ঘরের কথায় আমি কোন বাইরের মানুষ অপিনিয়ন চাইনি আর তাও তার থেকে যে কিনা এই মেয়েটির এক্স বয়ফ্রেন্ড। নিজের প্রেমিকার পক্ষে কথাতো বলবেনই আপনি, বুঝিনা সামুর পেছনে কেনো পড়ে আছেন?এই সাথে দুই জনকে চালাচ্ছেন! টেলেন্ট আছে বলতে হবে আপনার।”

ইনান দমে গেলো, ও বুঝতে পারলো না যে রুশি আর ওর সম্পর্কের কথা চন্দ্রিকা জানলো কি করে?সায়ান আর সামু জানে মানা গেলো কিন্তু চন্দ্রিকা সেখানে না থাকা সত্ত্বেও কি করে জানলো? আর সবচেয়ে বড় কথা সায়ান হাসপাতালে ভর্তি এই নিউজ ওকে কে দিয়েছে?এতো এতো কনফিউশন থাকলেও জবাব খোঁজার মানসিকতা আসলে এই মুহুর্তে ছিলো না ওর। ও রুশির দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েও গেলো না কারণ লক্ষ্য করলো রুশির চন্দ্রিকার কথায় কোন মনোযোগ নেই। ও নিজের মতো করে কেঁদে যাচ্ছে আর বসে আছে,বুঝতে পারলো চন্দ্রিকার কথার কোন ইফেক্ট নেই ওর মাঝে।

এটাকেই হয়তো ভালোবাসা বলে! এইযে চন্দ্রিকা চিল্লিয়ে ভালোবাসা জাহির করছে আদোও কি তা সত্যিই? অথচ রুশি চুপচাপ বসে আছে, চারপাশে কি হচ্ছে তা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই বরং সে হয়তো মনে মনে সায়ানের সুস্থতা কামনা করছে আর চোখের জল ফেলছে। তাই চিল্লিয়ে ভালোবাসি বলতে হয়না, অনেকসময় নিস্তব্ধতাও অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়! রুশির সম্মানের কথা চিন্তা করে ইনান আর ওর দিকে এগোয়নি, দূর থেকে চন্দ্রিকার কান্না দেখছে আর ভাবছে মিনিট কয়েক আগে যে ঝগড়া করেছিলো হঠাৎ তার চোখে ভরপুর পানি। অভিনয়ের জগতে হয়তো অনেক নাম করতে পারতো!একটা মানুষ এতো ফেক কি করে হতে পারে?

মাকে কোনরকম শান্ত করে সামু কেবিনে নিয়ে যেতে চাইলো কারণ তিনি বেশ দুর্বল হয়ে গেছেন কিন্তু মিসেস খান ক্ষনিকের জন্য থামলেও দরজা সামনের থেকে উঠলেন না বরং সেখানেই বসে পড়লেন। সামুর মনের অবস্থা ভালো নেই, ভাইকে এই অবস্থায় দেখে মেনে নিতে পারছেনা। ছোট থেকেই ওর ভাই হচ্ছে ওর সুপার ম্যান, যার সুপার স্ট্রং বডি কিন্তু এখন ওর সুপারম্যান সুয়ে আছে এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে, মনে মনে শুধু দোয়া করছে ওর ভাই যেনো সুস্থ হয়ে ফিরে।ভাইয়ের এখনো আরো কতোবছর বাঁচা বাকি, নিজের অনাগত সন্তানের মুখ দেখা বাকি, তাকে বেড়ে উঠতে দেখা বাকি। ও চায়না সেই সন্তান পুর্বেই তার বাবাকে হারাক, অন্তত সন্তানের কথা চিন্তা করে হলেও ভাইকে সুস্থ হতে হবে তারউপর রুশি ভাবির সাথে এখনো সব কিছু ঠিক হয়নি, রুশি ভাবি কি করে বাঁঁচবে তাকে ছাড়া?

কথাগুলো ভাবতেই সামু রুশির দিকে তাকালো, এই কয়েকঘন্টায় মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। ও রুশিকে নিজের বড়োবোন ভাবে, এই কয়েকদিনে সম্পর্ক অনেক গাঢ় হয়ে গিয়েছে। ও প্রায়ই ভাবতো রুশির সাথে আগে দেখা হলোনা কেনো ওদের?কতভালো হতো যদি রুশি ওদের জীবনে আরো আগে আসতো। ওর বড়োবোনের খুব শখ ছিলো যা রুশিকে দিয়ে পুরণ হয়ে গিয়েছে, রুশি এমন একটা মানুষ যাকে না ভালোবেসে থাকাই যায়না! ওর নিজের চোখ সরিয়ে কাঙ্খিত মানুষকে খুঁজতে লাগলো আর পেয়েও গেলো। এক কোনায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও বেশ অবাকই হলো যে ইনান রুশির পাশে যায়নি কেনো?এই মুহুর্তে তো রুশির কাউকে দরকার! সামু পরে বুঝতে পারলো ইনান হয়তো ওর অনুভুতির কথা ভেবেই যায়নি। ও ইনানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তারপর বললো

“আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কেনো? যান রুশি ভাবিকে গিয়ে সামলান তো!আমি একা দুজনকে কি করে সামলাবো?তাছাড়া রুশি ভাবি সেই কতক্ষণ ধরে না খেয়ে আছে, এটা বেবির জন্য ক্ষতিকর।যান তার কাছে প্লিজ”

“সামু আমি কি করে…”

“দেখুন এই মুহুর্তে ভাবির মনের অবস্থা খুব খারাপ, তার একজন বন্ধুর প্রয়োজন আর আপনার থেকে ভালো বন্ধু কেউ হতেই পারেনা ভাবির জন্য। তাই তাকে গিয়ে শান্তনা দিন আর বলুন কিছু খেতে নাহয় সে অসুস্থ হয়ে পড়বে”

সামুর কথা শুনে ইনান এগিয়ে গেলো, একসময় রুশির ভালো একজন বন্ধু ছিলো এখন আছে কিনা জানেনা। তবে আর কিছু না হোক একজন বন্ধুর পরিচয়ে তার পাশে দাঁড়াতেই পারে, আর অতীতের সবকিছু সবাই ভুলতে চায় ইনানও তার ব্যাতিক্রম নয়।ওর হুট করে রুশির পাশে বাসলো, রুশি মাথা তুলে তাকালো ওর দিকে একবার তারপর আবার নামিয়ে ফেললো। ইনান একটু ইতস্তত বোধ করলো তারপর শান্ত স্বরে বললো

“এভাবে একটানা এখানে বসে থাকলে শরীর খারাপ করবে আর সেটা বেবির জন্য ভালো নয়। চলো পাশের কেবিন বুক করা হয়েছে আমাদের জন্য, ওখানে চলো গিয়ে কতক্ষণ রেস্ট নিবে”

“আমি এখানেই ঠিক আছি”

রুশি মাথানিচু করে দুর্বল গলায় বললো, ওর কন্ঠস্বর এতোটাই ক্ষীণ ছিলো যে আরেকটু দূরে থাকলে ইনান হয়তো স্পষ্ট শুনতে পেতো না। ইনান বুঝতে পারলো রুশি ক্ষীণ গলায় না করলেও ও প্রচণ্ড জেদি। ওর সম্মতি ছাড়া ওকে এখান থেকে উঠানো সম্ভব নয় তাই বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই। ইনান আবারও বললো

“আচ্ছা কোথাও যেতে হবে না, অন্তত কিছু খাও। আমি অর্ডার দিয়েছি। যেকোন সময় আসবে হয়তো”

রুশি আবারও ক্ষীণ গলায় বললো

“আমার ক্ষুদা নেই,আমি খাবো না”

“রুশি এটা কোন জেদ করার বিষয় নয়। ভুলে যেওনা তুমি একা নয়, তোমার গর্ভে কেউ একজন বেড়ে উঠছে আর না খেয়ে থাকলে তার ক্ষতি হবে।তোমার সবার উপরে নিজের সন্তানের কথা ভাবতে হবে, তার জন্য হলেও খেতে হবে। তুমি কি চাও তার ক্ষতি হোক!”

ইনানের কড়া কথায় রুশি দমে গেলো, মাথা নেড়ে না বোধক উত্তর দিলো। ও কখনোই চায়না ওর সন্তানের খারাপ হোক, ওর সন্তানের জন্যই তো বেঁচে আছে তাহলে তার ক্ষতি কি করে চাইবে?ওর কষ্ট হলেও ওকে খেতে হবে। রুশির কথা শুনে ইনান স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো তারপর সেখান থেকে উঠে নিজে খাবার আনতে গেলো। সামু সেদিকেই তাকিয়ে ছিলো, আজকে ইনানের চোখে ও রুশির প্রতি অন্য কোন অনুভুতি দেখেনি বরং একজন বন্ধুর মতো বুঝিয়েছে। এই কয়দিন ইনান ওর পেছনে যথেষ্ট সময় ব্যয় করেছে, ইনানের মতো একটা ছেলে ওর পেছনে ঘুরবে এটা ওর বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিলো!এমনকি ইনান সামুকে কোন প্রকার ফোর্স করেনি বরং ওর কড়া কথা শুনার পরেও আবার ফোন করে খোঁজ নিয়েছে। ভার্সিটি শেষে নিজ দায়িত্বে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে, কোন দিন গাড়িতে না উঠলে সারা রাস্তা গাড়ি দিয়ে ফলো বাড়ি পর্যন্ত এসেছে, এমনকি ভার্সিটির গেটের সামনে গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। ইতিমধ্যে সবাইকে বলা হয়ে গেছে তার যে সে সামুর ফিয়ন্সি! সামু এমন এটেনশন সবসময় চেয়েছিলো ইনানের কাছ থেকে আর পেয়েও গিয়েছে। ও খুব খুশি সত্যি বলতে, ইনানের সিন্সিয়ারিটি দেখে ওর জমে থাকা অভিমান গলে গিয়েছে কিন্তু এতো সহজে ও হার মানবে না বরং ইনান যে ওকে এতোবছর ঘুরিয়েছে তাকেও তো ঘুরতে হবে ওর পেছনে তারপর গিয়ে মানবে।

ইনান খাবার নিয়ে আসার পর রুশি নিজে না খেয়ে থাকার হুমকি দিয়ে মিসেস খানকেও সাথে করে খাইয়েছে। ইনান আর সামু বাধ্য হয়ে খেয়েছে রুশির জন্য এমনকি চন্দ্রিকাকেও সামু জোর করে খাইয়েছে। এভাবে না খেয়ে থাকলে ভালো কিছু হবে না। দীর্ঘ দুইঘন্টা পর ডাক্তার বেরিয়ে আসে, সায়ানের অনেক ব্লাড লস হয়েছিলো তাই তাদের অনেক সময় লেগেছে, ভাগ্য ভালো হাসপাতালে এই গ্রুপের রক্ত আগে থেকেই ছিলো।ডাক্তার বেরুতেই সবাই তার কাছে গেলো, ইনান দ্রুত প্রশ্ন করলো

“ডক্টর এখন সায়ানের কি অবস্থা?”

“দেখুন পেইশেন্ট এখন আউট অফ ডেঞ্জার, উনি এখন ঘুমাচ্ছেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই তাকে বেডে শিফট করা হবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত তাকে বিরক্ত করবেন না, তাকে বাইরে থেকে দেখবেন প্লিজ!তার যথেষ্ট রেস্ট প্রয়োজন এখন”

বলেই ডাক্তার চলে গেলো, রুশি ধপ করে নিচে বসে পড়লো। সায়ান বেঁচে আছে এই সংবাদ ওর জন্য যথেষ্ট ছিলো খুশি হওয়ার। সায়ানের কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারতো না ও, সায়ানের এই অবস্থার জন্য শুধুমাত্র ও দায়ী। ও উচিৎ ছিলো সায়ানের কথা শুনা, অন্তত সায়ান কিভাবে এক্সপ্লেইন করতে চায় সেটা দেখা উচিৎ ছিলো। জেদের বসে শুধু নিজের কথাই বলে গেছে, সায়ানের কথা শুনার প্রয়োজন বোধ করেনি। আর যাইহোক চন্দ্রিকার মতো মেয়ে কখনো বিশ্বাসযোগ্য হতে পারেনা, কি করে বিশ্বাস করলো সত্য মিথ্যে যাচাই না করে?ওর উচিৎ ছিলো অন্তত একবার সায়ানকে নিজের পক্ষে কথা বলার সুযোগ দেয়া!

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_৩১

হসপিটালের ভিআইপি রুমে সুবিধা অন্যরুমের তুলনায় একটু বেশিই হয়, বড় বেড, বেড ল্যাম্প আরোও কত কি!কিন্তু যতই সুবিধা থাকুক না কেনো রোগীর কষ্ট কোন অংশে কম করা সম্ভব হয় না শারিরীকভাবে, ট্রিটমেন্টের পরও যতটুকু কষ্ট পাওয়ার তা পেতেই হয়। শরীরের অসহ্য ব্যাথা অনুভুত হতেই সায়ান চোখ মেলার চেষ্টা করলো কিন্তু চোখের পল্লবগুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেনো ব্যথা! খুব কষ্টে নিজের চোখ জোড়া খুললো, খুলতেই তীব্র আলো চোখে পড়াতে মুহুর্তেই বন্ধ করে ফেললো। কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর আবার চোখ খুলতে পারলো, সায়ান চারপাশে চোখ বুলাতে লাগলো।বুঝতে পারলো হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে, রুমটা খুব গুছানো। অদুরেই একটা সোফার মতো কিছু আছে কিন্তু তাতে কোন মানুষ নেই। হয়তো সবাই ওকে রেস্ট করতে দিয়ে আশেপাশে কোথাও আছে!

সায়ান নিজের হাত পা নাড়ানোর চেষ্টা করলো, প্রায় সাথেই তীব্র ব্যথা অনুভব হলো সারাশরীরে। ও কিছুক্ষনের জন্য দমে গেলো, বুঝতে পারলো ডান হাতে ক্যানেলা লাগানো তাই বাম হাত টান দিলো কিন্তু তা ভারী অনুভুত হতেই পাশে তাকালো আর একটা নারী অবয়ব কে দেখতে পেলো, শুয়ে থাকায় চেহারা স্পষ্ট না হলেও সায়ান জানে মেয়েটি কে! মুহুর্তেই নিজের হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া অনুভব করলো, খুব করে ইচ্ছে করলো মুখের সামনে এসে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিতে কিন্তু হাতের ব্যথায় সেটা পারলো না।শুধু তাকিয়ে রইলো!

অক্সিজেন মাস্ক পরে থাকায় সায়ানের খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো তাই সেটা খুলার চেষ্টা করলো সাবধানে কিন্তু নড়াচড়া করে উঠতেই রুশি ধড়ফড়িয়ে উঠলো। সায়ান থেমে গেলো, ও চায়নি রুশি ঘুম ভাঙুক তাই সাবধানে নড়াচড়া করেছিলো কিন্তু তারপরেও রুশি উঠে গেলো তাই ও অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুশির দিকে। রুশি উঠেই বলা শুরু করে দিলো

“আপনি ঠিক আছেন?কখন জ্ঞান এসেছে আপনার? আমায় ডাক দেননি কেনো? খুব খারাপ লাগছে!ডক্টরকে বলবো আসতে? কোথায় ব্যাথা লাগছে আপনার? বলুন না চুপ করে আছেন কেনো?”

রুশির একটানা কথাগুলো বলার পরেও সায়ানের থেকে কোন জবাব এলো না, বরং ও চোখ বড় বড় করে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু রুশি বুঝতে পারছে না। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর সায়ান হাল ছেড়ে দিয়ে সায়ান অন্যদিকে মুখ করে তাকালো। রুশি কিছু একটা ভাবলো তারপর হুট করে সায়ানের অক্সিজেন মাস্ক সরিয়ে দিলো আর সায়ান ওর দিকে তাকালো। রুশির চোখমুখ ফুলে আছে, আর রুশি ওর সামনে মাথানিচু করে বসে আছে। প্রায় অনেকক্ষণ কেটে গেলো কিন্তু রুশিও কিছু বললো না আর না সায়ান। কথায় আছে না,’শব্দসংকট খুবই জঘন্য একটি বিষয়, দুজন মানুষ কথা বলতে চাইছে অথচ বলার কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। এর থেকে করুণ দৃশ্য আর কি হতে পারে?’

কিন্তু ওইযে সকল নিস্তব্ধতা একসময় আওয়াজে পরিণত হয়, তাই সেই নিস্তব্ধতাকে যেকোন একজনকে ভাংতে হয় নাহয় সম্পর্কটাই স্তব্ধ হয়ে যায়। রুশি মাথা তুলে সায়ানের দিকে তাকালো তারপর আবার নামিয়ে ফেললো,সায়ান রুশির টলমলে চোখজোড়া দেখতে পেলো। রুশি ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলো,,

“আম স্যরি! আম রিয়ালি স্যরি! আমি রাগের মাথায় অনেকগুলো কথা শুনিয়ে ফেলেছি যা আমার বলা উচিৎ হয়নি। আমি আসলে একটু ডিপ্রেসড ছিলাম তাই রাগের মাথায় ওই কথাগুলো বলেছি, আমি ভাবতে পারেনি আমার কথার আপনার উপর এভাবে পড়বে। আপনার যদি কিছু হয়ে যেতো তাহলে আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারতাম না”

এতোক্ষন চোখের কোনে জমে থাকা কালো মেঘগুলো বৃষ্টি হয়ে নামতে শুরু করলো,চোখের কার্নিশ বেয়ে চোখের জল সায়ানের হাতের উপর পড়লো। সায়ান সেদিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো,রুশির চোখে ও অনুতাপ দেখতে পাচ্ছে। সায়ানকে কথাগুলো শুনিয়ে রুশি বেশ অনুতপ্ত! কিন্তু সায়ান এটা দেখতে চায়নি,ও রুশির চোখে শুধুমাত্র ওর জন্য ভালোবাসা দেখতে চায় তবে সেটা ও দেখতে পাচ্ছে না। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, সায়ান রুশিকে তো এখনো বলেইনি যে ও রুশিকে ভালোবাসে, ও রুশিকে আর নিজের সন্তান নিয়ে সুখে থাকতে চায়। ওর মনে শুধুমাত্র রুশি আছে চন্দ্রিকা নয় কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বলা ঠিক হবে না বরং ওকে আগে সুস্থ হতে হবে তারপর সুন্দর করে ও রুশিকে নিজের মনের খবর জানাবে আর রুশির মন জয় করবে। সায়ান আলতো করে রুশির মাথায় হাত রাখলো তারপর বললো

“তোমার জন্য কিছু হয়নি রুশি, শুধু শুধু নিজেকে দোষারোপ করোনা।আমার সামনে একজন মানুষ চলে আসায় হুট করে ব্রেক কাজ করেছিলো না তাই গাড়ি সরাতে হয়েছে আর গাছের সাথে বাড়ি খেয়েছি। এটা শুধুমাত্র একটা এক্সিডেন্ট এতে তোমার কোন হাত নেই। নিজেকে ব্লেম করবে না একদম, আমার এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী!”

রুশিকে সায়ানের কথা শুনে কিছুক্ষণ দমে গেলো তারপর নাক টেনে বললো

“আপনি মিথ্যে বলছেন আমি জানি, আমার জন্যই এই অবস্থা হয়েছে। না আমি আপনাকে ওই কথাগুলো বলতাম, না আপনি হাই স্পিডে গাড়ি চালাতেন আর না আপনার এই অবস্থা হতো। সব আমার দোষ, আমার ওভাবে বলা উচিৎ হয়নি কিন্তু আপনি এতো স্পিডে গাড়ি চালান কেনো বলেন?মরার খুব শখ হয়েছে আপনার?”

সায়ান রুশির শেষ কথাগুলো শুনে কেনো যেনো হাসলো তারপর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো

“কেউ একজন আমার সাথে থাকতে চায়না,আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চায় এই দুঃখে আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছে চলে গিয়েছিলো। এই জন্য মরতে গিয়েছিলাম”

সায়ানের কথা শুনে রুশি চুপ মেরে গেলো,সায়ান ওর কথা শুনে রাগ করে এমন করেনি বরং ও ছেড়ে চলে যাবে বলে কষ্টে এমন করেছে!এটা কি আদোও বিশ্বাসযোগ্য?রুশির ভাবুক চেহারা দেখে সায়ান হাসলো, সত্যি বলতে ও আসলে এই কারণেই ফুল স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিলো। রুশির মুখে ডিভোর্সের কথা শুনে ও ঠিক সহ্য করতে পারছিলো না, মনে হচ্ছিলো রুশি চলে গেলে ও কি করবে?কি করে বলতে পারলো রুশি ওকে এমন কথা?ওর বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছিলো,তাই ও এমনটি করেছিলো। কিন্তু ভাগ্য ভালো ও বেঁচে ফিরেছে নাহয় কতোবড় ভুল হয়ে যেতো!

রুশির সাথে এখনো ওর সম্পর্কই শুরু হয়নি সেখানে ও যদি নাই থাকে তাহলে ওর রুশির সাথে দেখা স্বপ্ন গুলো তো স্বপ্নই থেকে যাবে। যখন ওর এক্সিডেন্ট হচ্ছিলো তখন এই কথা গুলো মনে হয়েছিলো, দোয়া করেছিলো যাতে ও বেঁচে যায় কারণ ও বাঁচতে চায় রুশি, ওর সন্তান,ওর পরিবার সবার সাথে বাঁচতে চায়। আর তার জন্য ওর বেঁচে থাকা খুব জরুরি!

সায়ান রুশির দিকে তাকিয়ে বললো

“মাম্মা বা সামু কই?ওরা কি এখানে আছে?”

“মা আর সামু পাশের কেবিনে, মায়ের শরীর ভালো ছিলো না অতোটা তাই তাদের পাঠিয়ে দিয়েছি। আর ইনান ভাই বাসায় গেছেন যাতে কাল সকালে খাবার আর জামাকাপড় নিয়ে আসতে পারেন।আমি বলেছি আমি এখানে থাকবো তাই তারা আর জোর করেনি”

রুশির মুখে ‘ইনান ভাই’ শুনে সায়ানের কেমন যেনো হাসি পেলো, ও হাল্কা কেশে বললো

“ইনান ভাই?ইনানকে ইনান ভাই বলো কবে থেকে?”

“না মানে আসলে সামু ডাকে তাই আমিও ডাকতে ডাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে”

“গুড! এভাবেই ডাকবা সবসময়। সামু ডাকা বন্ধ করে দিলেও তুমি বন্ধ কইরো না”

রুশি কনফিউশন নিয়ে সায়ানের হাত চেপে ধরে বসেছিলো আর সায়ান ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো।এমন সময় খট করে দরজা খুললো, গেটে চন্দ্রিকা দাঁড়িয়ে আছে। রুশি কি ভাবে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো,তারপর উঠে দাঁড়ালো। এই মুহুর্তে চন্দ্রিকার সাথে ঝগড়া করার কোন মানেই হয়না, অযথা হয়রানি। তারউপর এতো এনার্জিও নেই ঝগড়া করার!আর এমনিতেও সায়ানের শরীর ভালোনা, অতিরিক্ত চেঁচামেচি ওর শরীরের জন্য ক্ষতিকর এটা ভেবে দমে গেলো আর সোজা বেরিয়ে গেলো। শুধু এমন একজনের সাথে ঝগড়া করে লি লাভ যে পরিস্থিতি বুঝেনা বরং নিজের স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করে।

রুশি বেরিয়ে যেতেই সায়ান সেদিকে তাকিয়ে রইলো এক ধ্যানে! রুশি ওকে এখানে একা রেখে কি করে চলে গেলো?সায়ান চন্দ্রিকার দিকে তাকালো তারপর শান্ত কন্ঠে বললো

“আমি এখন রেস্ট নিতে চাই, তুমি শুধুশুধু এখানে বসে থেকে কি করবে?তুমি বরং নিজেও কেবিনে গিয়ে রেস্ট নাও।”

কথাটা বলেই সায়ান চোখ বন্ধ করে ফেললো, মনে মনে ভাবছে রুশি কি আর আসবে না এখানে?তাহলে কোথায় ঘুমাবে ও!এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লো ও, ঘুমের তীব্র ডোজ দেয়াতে সেই রেশ এখনো রয়ে গেছে!

#চলবে

গুমোট অনুভুতি পর্ব-২৮ ( প্রথমাংশ ও শেষাংশ)

0

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_২৮(প্রথমাংশ)

ইনান এতোক্ষন অনেক সাহস নিয়ে কথাগুলো বলার চেষ্টা করলেও কোথাও একটা যেনো জড়িয়ে যাচ্ছে, ঠিক বুঝতে পারছেনা কিভাবে শুরু করবে!ইনানের ইতস্ততভাব দেখে সায়ান ওর থেকে চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকালো, সুর্যের আলো প্রায় কমে যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশে হাল্কা রক্তিম আকার ধারণ করছে তা দেখে সায়ান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো। ও কিছু বলবে তার পুর্বেই ইনান হঠাৎ বলে উঠলো

“আমি জানিনা বিষয়টি জিজ্ঞেস করা আদোও ঠিক হচ্ছে কিনা আমার তবে বন্ধু হিসেবে আমি তোর ভালো চাই। তোর লাইফে যা চলছে তা কি ঠিক হচ্ছে?কিছু ভেবেছিস সে ব্যাপারে!”

“কিসের কথা বলছিস তুই?”

“তোর,চন্দ্রিকার আর রুশির কথা বলছি। তোকে আমি আগেও বলেছি আর এখনো বলছি যে দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা যায় না, তোকে যেকোন একটা বেছে নিতে হবে। আর যদি দুইজনকেই চাস তবে কেউই সুখে থাকতে পারবে না, না তুই, না চন্দ্রিকা আর না রুশি।তুই আমাকে এটা বল তুই চন্দ্রিকাকে নিজের কাছে কেনো রাখতে চাস?”

“কারণ আমি ওই লোকটির মতো হতে চাইনা যে ওয়াদা দিয়ে ওয়াদা রক্ষা করেনা। নিজের দায়িত্ব যে পালন করতে পারেনি, আমি আমার দায়িত্ব থেকে পিছ পা হতে চাইনা। তাহলে তার আর আমার পার্থক্য কোথায়?”

“যদি তুই চন্দ্রিকা চাস তবে রুশিকে ছেড়ে দে,ওকে কেনো তোদের জীবনের সাথে জড়াচ্ছিস? ওকে ওর মতো থাকতে দে, ওকে নিজের সাথে বেধে ওর লাইফ নষ্ট করিস না”

কথাটা বলার প্রায় সাথে সাথেই সায়ান ইনানের কলার চেপে ধরলো, চেহারায় রাগ ফুটে উঠেছে। ইনানের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো

“কেনো ওকে ছেড়ে দেয়া না ছেড়ে দেয়া নিয়ে তোর এতো মাথা ব্যাথা কেনো?আমি ওকে ছেড়ে দিলে কি তোর কাছে নিয়ে যাবি?তবে শুনে রাখ রুশি যদি নিজে থেকেও চায় তবুও আমি তাকে তোর হতে দিবো না।ও আমার বিয়ে করা বউ! এই কথা যতো তাড়াতাড়ি মাথায় ঢুকাতে পারবি ততই তোর মঙ্গল। আমি বেঁচে ও কোনদিন তোর হবে না, আমি হতে দিবো না!”

শেষের কথাটা সায়ান জোরেই বলেছে, খালি যেনো ওর কথাগুলো প্রতিধ্বনি হচ্ছে। সায়ান ইনানের কলার ছেড়ে দিলেও ইনান তব্দা মেরে বসে রইলো। ও নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা, কাঁপা গলায় বললো

“তুই সবটা জানতি?তাহলে এমন ভান করে ছিলি কেনো যে কিছুই তোর জানা নেই!”

সায়ান মুখ ঘুরিয়ে নিলো, নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। ও কখনো চায়নি যে ইনান বা রুশির কেউ একজনও জানুক যে ওদের সম্পর্কে সবটা জেনে গেছে। ও জানে ও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবে না, আর হয়তো উল্টো পালটা কিছু করবে যা কারোই কাম্য নয়।

সেদিন সায়ানদের বাগান বাড়িতে শুধু সামুই ইনান আর রুশিকে একসাথে দেখেনি বরং সায়ানও ছিলো সেখানে।সায়ানদের রুমের বারান্দা থেকে বাগান স্পষ্ট দেখা যায়,রুশিকে হঠাৎ করে ইনানের বাগানের কোনায় যাওয়ার দৃশ্য বারান্দা থেকে ওর চোখে ঠিকই পড়েছিলো আর স্বামী হিসেবে বিষয়টি ও স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। খুব দ্রুত নিচে নেমে আসে আর আসতেই এক কোনায় সামুকে চোখে পড়ে। তারপর ওদের সম্পুর্ণ কথাগুলো ও শুনতে পায়,ইনানের উপর সায়ান প্রচণ্ড রাগ হয়েছিলো সেদিন। মাত্র কয়েকদিন পুর্বে যে ওর বোনের সাথে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছে সে আজ অন্য মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে বলছে সে ওই মেয়েটিকে ভালোবাসে! আর সবচেয়ে বড় কথা সেই মেয়েটি ওর নিজের স্ত্রী!

সায়ান রাগে ফেটে পড়েছিলো কিন্তু রুশির কথা শুনে ওর রাগটা কমে যায়। বুঝতে পারে ইনান এক পাক্ষিক ভাবে রুশিকে চাচ্ছে রুশি নয় এমনকি রুশি ওকেও চায়না। না চাইতেই ওর মনটা খারাপ হয়ে যায় তবে ইনানের প্রতি রাগ যেনো আরো বেড়ে গেলো, আর যাইহোক যে ওয়াদা ভাঙ্গে তাকে ওর কখনোই পছন্দ নয়। নিজের বোনের সাথে এমন ব্যাবহার দেখে সায়ান ইনানের দিকে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু সামুর করুণ চাহনিতে দমে যায়। ও ভাবতেই অবাক লাগছিলো যে সামুকে ভালোবাসে না সামু তার জন্য এতোটা করেছিলো কেনো, কেনো চায়না সে জানুক? আর যাইহোক যে ভালোবাসে না তার সাথে কি করর সুখি হবে ও?কেনো থাকতে চায় এমন মানুষের সাথে!ভালোবাসে বলে?ভালোবাসা কি এতোই অসহায়!

সায়ান তখন রুশির দিকে তাকায়, দেখে ওর চোখ জোড়া টলমল করেছিলো। কতটা অসহায় লাগছিলো ওকে!রুশি এদিকেই এগিয়ে আসছিলো, সায়ান নিজেকে সামলে রুশির দিকে এগিয়ে গেলো। ওই মুহুর্তে সবথেকে বেশি গুরত্বপুর্ণ কাজ এটাই মনে হয়েছে যে রুশিকে সামলাতে হবে, ওকে বুঝাতে হবে যে ইনান ওর চোখের পানি ডিজার্ভ করে না। ওকে এমন কিছু বলতে হবে যাতে ওর মাইন্ড ডিস্ট্রেক্ট হয়ে যায়।আর তাই করেছিলো ও, যদিও রুশি কেঁদেছিলো হাল্কা তবে তাতে ওর মাইন্ড ফ্রেশ হয়ে ছিলো।

এরপর থেকে এই জিনিসটা ওকে কুড়ে কুড়ে খেতো যে রুশি অন্যকাউকে ভালোবাসে! রুশির মন জুড়ে অন্যকারো বসাবাস, যেখানে ততদিনে রুশিকে ছাড়া ও অন্যকিছু ভাবতেই পারছিলো না সেখানে অন্য কোন ছেলেকে নিয়ে ভাববে এটা মেনে নিতে পারছিলো না।ও এটা প্রচুর ভেবেছে আর শেষে ভাবলো রুশির সাথে সরাসরি কথা বলা উচিৎ! ও হয়তো সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারবে না যে তুমি ইনানকে ভালোবাসো?আর যদি বাসো তবে কতোখানি বাসো?কিন্তু এটা তো জিজ্ঞাস করাই যায় যে রুশির মনে কেউ আছে কিনা আর সেটা ভেবেই সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলো যে ‘রুশি কাউকে কখনো ভালোবেসেছিলো কিনা?’

যখন বুঝতে পারলো রুশির কাছে ইনান ভালো বন্ধু ব্যতীত অন্যকিছু নয়, ও ইনানকে দেখে এইজন্য মন খারাপ করেছিলো কারণ বন্ধু বলতে তখন শুধু ইনানই ছিলো আর সে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়াতে অনেক কষ্ট পেয়েছিলো। ও ঠিক কতোটা খুশি হয়েছে ওর জানা নেই আর তাই সামুর সাথে ইনানের বিয়ে নিয়ে কোন ঝামেলা করেনি।ও জানে ইনানের ভালোবাসা এক পাক্ষিক আর সেটা ভুলা খুব কষ্ট হবে। এইজন্য ওর পাশে সামুকে প্রয়োজন,ইনান সামুকে একদিন মেনে নিতে বাধ্য হবে এটা ও বিশ্বাস করে। এতে ওর বোন ভালো থাকবে আর ওর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে না, কারণ রুশি ইনানকে ভালোবাসে না এটা যেমন সত্যি তেমনি রুশি ওকেও ভালোবাসে না আর কোন একদিন যদি দুজনের একজনকে বেছে নিতে হয় তখন ইনানকে বেছে নেয়ার এক পার্সেন্ট চান্সও রাখতে চায়না। রুশি তার শুধুমাত্র তার, অন্যকারো না এমনকি রুশি চাইলেও না।

সায়ানের হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়াতে ইনান শান্ত স্বরে বললো

“আমি জানিনা তুই কতোটুকু জানিস,আমি রুশিকে ভালোবাসতাম হয়তো এখনো বাসি কিন্তু ভবিষ্যতে আমি ওকে ভালোবাসতে চাইনা। লাইফে এমন একজনকে পাওয়া খুব কষ্টকর যে তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। আমি হয়তো অনেক সৌভাগ্যবান তাই আমার লাইফে এমন একজন আছে যে পাগলের মতো ভালোবাসে আর আমি তাকে হারাতে দিতে চাইনা। এটা ঠিক যদি রুশি তোর বউ না হয়ে অন্যকারো হতো তবে আমি তাকে কখনোই ওই ব্যাক্তির হতে দিতাম না কিন্তু সে তোর ওয়াইফ আর আমাদের সম্পর্ক আমার ভালোবাসার থেকে অনেক বেশি দামি। আমার জীবনে তোর মতো বন্ধু আমি আর পাবো না হয়তো রুশির মতো কাউকেও না। আর আমি হয়তো ওকে চাইতাম যদি ও আমার কাছে আসতে চাইতো কিন্তু ও নিজেই চায়না। রুশি আমাকে…”

“বন্ধুর থেকে বেশি কিছু ভাবে না, রুশির লাইফে তুই শুধুমাত্র একজন ভালো বন্ধু ছাড়া আর কিছুই নয়।”

ইনান কিছু বললো না কিন্তু বুকের ব্যাথাটা তীব্র হয়ে গেলো। ও যতোই বলুক যে রুশিকে নিয়ে ভাববে না কিন্তু জীবনের প্রথম প্রেম ভোলা যায় না। ও হয়তো ভুলবে না, রুশিকে হয়তো ভালোবেসে যাবে আজীবন কিন্তু সামুকে তার থেকে বেশি ভালোবাসতে চায়! এই কয়দিনে ওর ভালো থাকার ঔষুধ হয়ে গেছে সামু, মন খারাপ হলেই সবার আগে সামুর কথা মাথায় আসে। এই মুহুর্তেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি, সব ভালোলাগা গুলো এখন সামুকে ঘিরে হয়ে গেছে। সামু অনেকটা চঞ্চল প্রকৃতির তাই তাকে ভালো না বেসে থাকাই যায়না, ও হয়তো পারবে না সামুকে না ভালোবেসে থাকতে!

#চলবে

#গুমোট_অনুভুতি
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#পর্ব_২৮(শেষাংশ)

ইনানের চোখেমুখে বিষণ্ণতা ফুটে উঠলেও এটা ভেবে ও খুশি হচ্ছে সায়ান আগের থেকে বদলে গিয়েছে, রুশির প্রতি ওর অনুভুতির পরিবর্তন ঘটেছে। একমাস পুর্বে সায়ানকে তার বউ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার পর সে বলেছিলো যে মেয়েটি শুধুমাত্র তার দায়িত্ব, তার সম্পুর্ণ খরচ ও চালাবে তবে বউয়ের মর্যাদা দিতে পারবে না।অথচ আজ যখন রুশিকে ছেড়ে দেয়ার কথা বলেছে তখন রেগে গেছে আর নিজের বউ বলে পরিচয় দিতে এক সেকেন্ডও সময় নেয়নি যেখানে আগে মেয়ে ছাড়া অন্যকিছু বলতো না!

মানুষ বদলে যায়, খুব দ্রুত বদলে যায়। কিন্তু সবারটা আমরা বুঝতে পারিনা, যারটা চোখে পড়ে তাকে হয়ত বলি তুমি বদলে গিয়েছো নাহয় আমাদের নোটিস করার সময় কই?মানুষের এই বদলানোর স্বভাবটা সবসময় খারাপ হয়না, কিছু কিছু সময়ে তা ভালোর জন্যই হয়। এই যে আজ ইনান রুশি অন্যকারো হওয়া সত্ত্বেও তা মেনে নিচ্ছে, আজ থেকে আরো কয়েকদিন পুর্বেও তা অসম্ভব ছিলো ওর জন্য। ও রুশিকে ছাড়ার কথা ভাবতেও পারতো না কিন্তু এখন ও ছেড়ে দিয়েছে তাও স্বেচ্ছায়। কতটা বদলে গেছে ও আর ওর চিন্তা ধারাও।যেখানে সামুর সাথে মাত্র কয়েকদিন থেকে ও এতোবড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে সেখানে সায়ানের বদলে যাওয়া কি স্বাভাবিক নয়?

ওতো একমাস থেকেছে একটা মেয়ের সাথে যার সাথে ওর বিয়ে হয়েছে, যে ওর সন্তানের মা হতে চলেছে। তার প্রতি মায়া জন্মানো খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়, তাছাড়া কোন নারীর প্রতি এটা সায়ানের প্রথম অনুভুতি তাই সায়ান চাইলেও এর থেকে বেরুতে পারবে তবে সায়ান তা বুঝতে পারছে না।সায়ানকে বুঝানো খুব দরকার অন্তত রুশির জন্য কারণ ও মনে প্রাণে চায় রুশি ভালো থাকুক, ওর ছোট্ট একটা পরিবার হোক যেটার কথা রুশি প্রায় উল্লেখ করতো। ওইযে একটা ছেলে আরেকটা ছেলের মন খুব ভালোভাবে পড়তে পারে আর সে যদি লাভ রাইভাল হয় তবে তো কথাই নেই!সায়ানের জেলাসিতে স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছে ও রুশিকে কতোটা চায়। ইনান সায়ানের দিকে তাকিয়ে বললো

“যদি রুশি তুই না ছাড়িস তবে চন্দ্রিকাকে কেনো রেখেছিস নিজের সাথে?ও কেনো শুধু শুধু আশা দিচ্ছিস?ওতো এটা ভেবেই বসে আছে যে কোন একদিন তুই ওকে বিয়ে করবি তাহলে এই মিথ্যে আশা কেনো দিচ্ছিস ওকে??”

“আমি ওকে ওয়াদা দিয়েছি যে আমি সবসময় ওর পাশে থাকবো আর ওকে ভালোবাসবো। আমি সেই ওয়াদা থেকে কি করে মুখ ফিরিয়ে নিবো?আমি যে তাহলে ওই লোকটার মতো হয়ে যাবো কিন্তু আমিতো তার মতো হতে চাইনা!”

সায়ান দুহাতে নিজের চুল মুঠ করে ধরলো,রাগে কপালের রগ ফুলে উঠেছে। নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে এই দোটানার কারণে,ও রুশিকে কখনোই ছাড়তে পারবে আর না চন্দ্রিকাকে! রুশিকে ও ছাড়তে চায়না আর চন্দ্রিকাকে ছাড়তে পারবে না। দুটো কথার মধ্যে অনেক পার্থক্য, একজনকে ছাড়া ওর বেচে থাকা অসম্ভব মনে হয় কিন্তু আরেকজনকে ও ছাড়তে পারছে না, নিজের বিবেকের কাছে হেরে যাচ্ছে!

ইনান সায়ানের অবস্থা দেখে একটু বিচলিত হলো, কারণ সায়ানের অবস্থা সবটা না বুঝতে পারলেও কিছুটা ও বুঝতে পারছে। দায়িত্ব আর ভালোবাসার মাঝে যেকোন একটা বেছে নেয়া কোন দিনই সহজ নয়,কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দায়িত্ব কে আর ভালোবাসা কে? ইনান সায়ানের কাঁধে হাত রেখে বললো

“তোর কাছে ওয়াদার মুল্য অনেক বেশি! কারণ তুই তোর বাবার মতো হতে চাস না কিন্তু তুই হয়তো জানিসনা যে তুই নিজের অজান্তেই তার মতো হয়ে গেছিস। সে যে ভুলটা করেছে তুই ঠিক একই কাজ করছিস যদিও পরিস্থিতি ভিন্ন!”

ইনানের কথা শুনে সায়ান রেগে যায় আর কড়া গলায় বলে

” আমি ওই লোকটার মতো কখনো ছিলাম না আর কখনোও হবোও না। ও আমার মাকে চিট করেছে, তাকে দেয়া ওয়াদা সে রাখেনি, আমি তার মতো কখনোই না”

“তুই তার ব্যাতিক্রম কি করে?রুশিও তো তোর বউ তাইনা আর তুই তাকে ঠকাচ্ছিস!চন্দ্রিকা তোর বউ নয় তোর প্রেমিকা আর রুশি তোর বউ। তাই যদি তুলনা করিস তবে তোর মায়ের জায়াগায় কিন্তু রুশি আছে, চন্দ্রিকা নয়। আর তোর বাবার মতো তুইও কিন্তু নিজের বউকে ঘরে রেখে বাইরের প্রেমিকাকে বেছে নিতে চাইছিস! তাহলে তুই ই বল তোর বাবা তোর মাঝে পার্থক্য কোথায়? স্যরি টু সে বাট তোর বাবার মতো একই কাজ তুই রিপিট করছিস।”

শেষের কথাটা ইনান ইচ্ছে করেই জোর দিয়ে বলেছে, সায়ানের বোঝা উচিৎ কৃতজ্ঞতার বসে কারো সাথে সারাজীবন থাকা যায়না, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা গেলেও আর যাইহোক তাকে ভালোবাসা যায়না তাই এমন ওয়াদার কোন ভিত্তি নেই, এটা সায়ান এবং চন্দ্রিকা দুইজনকেই বুঝতে হবে তাছাড়া একটা কথা খুব প্রচলিত আছে,
“প্রমিসেস আর মেড টু বি ব্রোকেন” তাই একটা ওয়াদার উপর ভিত্তি করে কখনো কারো জীবন থেমে থাকতে পারে না, এটা নিতান্তই হাস্যকর বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয়।

এদিকে সায়ান মুহুর্তেই চুপ হয়ে গেলো, বিষয়টি এভাবে কখনো ও ভেবে দেখেনি। আসলেই তো রুশি ওর বউ সেতো বাইরের কেউ নয়, তাই চন্দ্রিকাকে করা ওয়াদার মুল্য ওর বউয়ের থেকে বেশি কি করে হতে পারে?চন্দ্রিকা তো ওর বউ নয় তাহলে ও তো সেই বাইরের একজনের জন্যই নিজের বউকে মেনে নিচ্ছে। পরিস্থিতি যাই হোক পার্থক্য তো খুব বেশি নয়! সায়ানকে চুপ থাকতে দেখে ইনান আবার বললো

“তুই বল কোন ছেলে একজনকে বিয়ে করবে বলে কথা দিয়েছিলো কিন্তু কোন এক কারণে সে অন্য একজনকে বিয়ে করেছে। প্রথমে মেনে নিতে না পারলেও পরে সে তার স্ত্রীকে ভালোবেসে ফেলেছে এবং তার সাথে থাকতে চায়। তাহলে এখন বল নিন স্ত্রীকে ভালোবাসা সত্ত্বেও তার কি ওই মেয়ের কাছে ফিরে যাওয়া উচিৎ? শুধু তাকে একসময় বিয়ে করবে বলেছে বলে!এতে কি আদোও তিন জনের একজনও সুখি হতে পারবে?”

সায়ান মাথা নাড়ালো, কেউ কি সুখি হতে পারবে না। এর চেয়ে ভালো ওই মেয়েকে বুঝিয়ে বলা যদিও তার একটু কষ্ট হবে কিন্তু এক সময় সে অন্যকাউকে মেনে নিয়ে সুখে থাকবে।

“সেই ছেলেটির জায়াগায় তুই থাকলে কি করতি?”

“নিজের ভালোবাসাকে মেনে নিতাম এতে তিনজনই একসময় সুখি হতাম”

“তাহলে তোর এখন কাকে মেনে নেয়া উচিৎ?”

“যাকে ভালোবাসি তা…”

সায়ান থমকে গেলো, ওর তাকেই মেনে নেয়া উচিৎ যাকে ও ভালোবাসে।কিন্তু ও কাকে ভালোবাসে?রুশির সাথে ওর পরিচয় বেশিদিনের নয় কিন্তু এখনি মনে হয় ওকে ছাড়া বাঁচা অসম্ভব, রুশির শাসন কথা বলা আর মুহুর্তেই মুখ ফুলানো এগুলো দেখা ছাড়া ওর দিন চলে না। যেখানে খান বাড়ির সাথে ওর কোন সম্পর্ক ছিলো না সেখানে রুশির জন্য ও এ বাড়িতে থেকেছে, রুশি কথা শুনে মায়ের সাথে কথা বলেছে।তার থেকে বড় কথা ইনানের সাথে রুশিকে দেখে ওর কষ্ট হয়েছিলো প্রচণ্ড কষ্ট কিন্তু কই চন্দ্রিকার সাথে থাকতে তো এমন হয়নি! ওর সাথে মাসের পর মাস কথা না বললেও ওর কিছু যায় আসেনি, কখনো নিজ থেকে খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি,কখনো তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করেনি তাহলে?
ওকি রুশিকে ভালোবাসে?হ্যা এই অনুভুতি গুলো যদি ভালোবাসার হয় তবে ও রুশিকে ভালোবাসে।

সায়ান হুট করে উঠে দাঁড়ালো, দ্রুত পকেট থেকে চাবি বের করলো তারপর গাড়ির দিকে ছুটতে শুরু করলো। কিছু একটা ভেবে দৌড়ে ইনানের কাছে ছুটে আসলো তারপর জড়িয়ে ধরলো আর বললো

“থ্যাংকস!ইটস আ বেস্ট থিং টু হ্যাভ আ বেস্টফ্রেন্ড লাইক ইউ”

ইনান সায়ানের কাঁধে হাত রেখে বললো

“আমি তোর জন্য কিছু করিনি, আমি চাই রুশি ভালো থাকুক আর আমি জানি ও তোর সাথে ভালো থাকবে কিন্তু মনে রাখিস যদি ভুলেও ওকে কষ্ট দিস তবে ওর ছায়াটুকুও আর দেখতে পাবিনা।রুশি আমাকে বন্ধু ভাবে আমি জানি, তাই বন্ধু হিসেবে ওর কোন ক্ষতি আমি হতে দিবো না”

সায়ান জবাবে হাসলো তারপর মাথা নাড়িয়ে দ্রুত গাড়ির দিকে গেলো। এই মুহুর্তে রুশির সাথে কথা বলা খুব প্রয়োজন, ওকে বলতে চায় যে ও রুশিকে কতটা চায়! ওর বউ হিসেবে শুধু রুশিই আছে, চন্দ্রিকা ওর দায়িত্ব সেটা পালন করবে তবে জরুরি নয় তাকে বিয়ে করতে হবে। আশাকরি চন্দ্রিকা এই জিনিসটা বুঝতে পারবে আর না পারলেও ওর কিছু করার নেই। ভালোবাসার কাছে সবাই অসহায় হয় আর ও নিজেও তাই!

ঘরে ঢুকতেই রুম অন্ধকার দেখলো, সায়ান কিছুটা অবাক হলো। রুশি কি তাহলে রুমে নেই?এই সন্ধ্যা বেলা কোথায় গিয়েছে? নিচেও তো দেখলো না। সায়ান লাইট জালাতেই রুশিকে বারান্দা থেকে আসতে দেখলো আর দেখেই ও খুশি হয়ে গেলো। কিছুটা হেসে বললো

“এই সন্ধ্যায় লাইট অফ কেনো? আমাকে ভয় দেখাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে নাকি?”

রুশি সায়ানের দিকে তাকালো তারপর ক্লান্ত স্বরে বললো

“আমি ভনিতা করে কথা বলতে পারিনা তাই সরাসরি বলছি আই ওয়ান্ট ডিভোর্স!আমি চাই আপনি আমাকে এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি দিয়ে দেন”

কথাটা বলার সাথে সায়ানের মুখে ঝুলে থাকা হাসি মিইয়ে গেলো, হাতে থাকা চাবির থোকা পড়ে গিয়ে ঝনঝন আওয়াজ হতে লাগলো। ও নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা, ও যা শুনেছে তা আদোও সত্যি নাকি কোন হ্যালুসিনেশন!

#চলবে